১২ জুন ২০১৩

"আগামী দিনের মা'দের জন্য"


বেশ কিছু দিন আগে আমেরিকাতে রামকৃষ্ণ মিশনের একজন মহারাজকে কিছু ভক্ত প্রশ্ন করেছিল, মহারাজ, এত মহাপুরুষ কিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নিতেন ? আর বর্তমানে কেন আর সেই মহাপুরুষরা জন্মায় না ? অসাধারণ উত্তরে মহারাজ বলেছিলেন, "আকাশে প্লেন ওড়ে, সে তো আর যেখানে সেখানে ইচ্ছামত নামতে পারে না ! তার নামার জন্য উপযুক্ত এয়ারপোর্ট প্রয়োজন হয় ! ঠিক সেই রকম এক সময় ছিল যখন এই ভারতবর্ষে উপযুক্ত 'মা' ছিলএখন সেই এয়ারপোর্ট নেই, তাই বড় বড় প্লেন আর নামতে চাইলেও পারছে না"

আধুনিক মনঃ বিজ্ঞানের মতে, সন্তান কেমন মানুষ হবে সেটা ৮৫% নির্ভর করে মা-এর উপরআর তা নির্ধারণ হয়ে যায় মায়ের গর্ভে সন্তান আসা এবং জন্মের ৫ বছরের মধ্যেমায়ের চিন্তা, কথা, ভালো লাগা- মন্দ লাগা, রুচি, আদর্শ, সন্তানের উপর দারুনভাবে প্রভাব ফেলতে থাকে গর্ভে থাকা অবস্থাতেইমায়ের কষ্ট, তার কষ্টমায়ের আনন্দ, তার আনন্দমায়ের খাবার, তার খাবারতাহলে মায়ের ইচ্ছা, তার ইচ্ছা হবে না কেন ! মায়ের আদর্শ তার আদর্শ, মায়ের জীবনবোধ, সন্তানের জীবন বোধ হবেসেখান থেকেই তার শিক্ষা শুরু- 3 Idiots এর All is Well এর মত


আমরা আজও সে যুগের কৌশল্যাকে মনে রাখি, পুত্র রামের কারণে'মা' মেরিকে জানি, মহাবতার যীশু খ্রিষ্টের মাতা বলে'মা' আমেনাকে ভুলিনি, মহানবী হযরত মুহম্মদ এর কারণেআর এ যুগে ভুবনেশ্বরী দেবীকে চিনি কারণ, তিনি স্বামী বিবেকানন্দের 'মা' ছিলেনপ্রভাবতী দেবীকে চিনি, কারণ তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর 'মা' বলেভগবতী দেবীকে চিনি, কারণ তিনি বিদ্যাসাগরের 'মা' ছিলেনসারদা দেবীকে মনে রেখেছি, কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গর্ভধারিণী ছিলেনযুগে যুগে কত মহাপ্রান এসেছেন আমাদের পথ দেখানোর জন্যেবারে বারে তারা আমাদের বলেছেন, যদি জীবন সার্থক করতে চাও, তাহলে এই পথে এসোআমরা তাদের কথা না শুনে চলি উল্টো পথে

এখন কার সময়ে কয়জন বাবা-মা আছেন, যারা এমন সন্তান চান ? আমাদের কি অহঙ্কার- আমরা আধুনিক, আমরা বিজ্ঞান মনস্ক, আমাদের ভদ্রতা - সভ্যতা গাদা-গাদা বই পড়ায়, অনেক সার্টিফিকেটে, ভাল রোজগারে, ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি, স্যুট-বুট, দামি শাড়ি, গয়না, Internet, i-phone, i-pad, Tablet, Capsule... কিন্তু কত আশা নিয়ে ছোট্ট দেব শিশুটি অন্ধকার জগৎ থেকে এলো, তাকে কি আমরা সত্যিকারের আলোর সন্ধান দিতে পারছি ? সে পথ তো আমাদেরই অচেনা

ছোট্ট নরেন (তখনও বিলে) একটা অন্যায় করলমা তাকে কোন কটু কথা না বলে, কোনও শাস্তি না দিয়ে, একটা কাগজে সেটি লিখে ঘরে টানিয়ে দিলেনদুরন্ত বিলের পড়ায় মন নেই, মা পড়ছেন, বিলে শুনছে, সব আয়ত্ত হয়ে যাচ্ছেমা শিক্ষা দিচ্ছেন,"বাবা, জীবনে যেটা সত্য বলে জানবে, কখনও সেই আদর্শ থেকে সরে এস না।" তাই তো পরবর্তীতে আমরা পেলাম "সত্যের জন্যে সব কিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।" "ছোট বেলায় মায়ের কাছেই জীবনে বড় হওয়ার সব শিক্ষা পেয়েছি, তাই বলতে পারি- সত্যই আমার ঈশ্বর, সমগ্র জগৎ আমার দেশ, জগৎ এর সবাই আমার ভাই, আমার রক্ত।" এই হল যথার্থ 'মা' এর শিক্ষা

১৪ / ১৫ বছরের সুভাষ বসু 'মা' কে চিঠি লিখছেন- "তোমরা আমার কাছে কি চাও মা ? তোমরা কি চাও আমি লেখাপড়া শিখে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হইআমার অনেক টাকা, বাড়ি-গাড়ি হোকনাকি এই চাও- আমি পৃথিবীর সবথেকে গরীব হবকিন্তু এমন মানুষ হব, যেন শ্রদ্ধায় পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ মাথা নিচু করে।" 'জন বাবা-মা আছি আমরা, সৎ সাহস নিয়ে আমাদের সন্তানদের এই উৎসাহ দিতে পারি! বলি শুধু পড়, ভালো রেজাল্ট করো, টাকা রোজগার করার একটা মেশিন হয়ে ওঠোআমরা শেখাই, কি করে সে মিথ্যাবাদী হতে পারে, কি করে সে আরও স্বার্থপর হতে পারেছোট শিশুর কোমল অন্তরে এই 'বিষ-বৃক্ষ' আমরাই লাগিয়ে দিইআর সত্যিই এক সময় যখন সে আবেগহীন, ভালবাসা হীন, বিবেকহীন মেশিনের মত আচরণ করে, তখন আমরা বুক চাপড়াইআমরা প্রত্যেকেই দ্রুত গতির এক ব্রেকহীন গাড়িতে উঠেছি, যার গতি শুধু বাড়তে পারে কমে নাআমরা ভেসে চলেছি...... সন্তানদেরও তুলে দিচ্ছি ব্রেক ফেল করা আর এক গাড়িতেএই গাড়ি কখন থামবে!!! যখন সব শেষ !!! নবনী দাদা (Founder, Akhil Bharat Vivekananda Yuva Mahamondal), চরিত্র গঠন বই এর এক জায়গায় লিখেছেন, "বুদ্ধিমান দেখে শেখে আর বোকা ঠেকে শেখেকিন্তু বেশিরভাগ মানুষ, না দেখে শেখে, না ঠেকে শেখে।" আমরা আমাদের চারপাশের এই অসহনীয় পরিস্থিতি দেখে তো শিক্ষা গ্রহন করি না, এমনকি ঠেকেও শিখি না

সুভাষ চন্দ্র বসু যখন তার মা-কে ঐ চিঠি লেখেন, সম্ভবত তার আগেই স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শের সাথে পরিচয় ঘটেছেতিনি পরবর্তীতে বলেছেন-" বিবেকানন্দের আদর্শকে যে সময়ে জীবনে গ্রহন করেছিলাম, তখন আমার বয়স বছর পনের হবে কিনা সন্দেহস্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল।" “......ত্যাগে তিনি বেপরোয়া, কর্মে তিনি বিরতিহীন, ভালবাসায় তিনি সীমাহীন, জ্ঞানে তিনি প্রগাঢ় ও বিচিত্রগামী, আবেগে তিনি প্রাণোচ্ছ্বল, আক্রমণে তিনি করুণাহীন তথাপি শিশুর মত সরল, আমাদের পৃথিবীতে তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্বরামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে একসময় নেতাজীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় স্বামী বিবেকানন্দের একটা জীবনী লেখার জন্যতার উত্তরে তিনি বলেছিলেন- "আপনাদের এই প্রস্তাব পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি, গর্বিত বোধ করছিকিন্তু এত বড় শক্ত কাজ আমি পারব নাকারণ স্বামী বিবেকানন্দ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আজ আপনারা যাকে নেতাজী বলে সম্মান করেন, সে সব কাজ ছেড়ে স্বামী বিবেকানন্দের পায়ের কাছে পড়ে থাকতো।" এমন আদর্শ আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরব না !

ঘরের সব ফটো সরিয়ে ফেলে, এমন মহাপুরুষদের ফটো, তাদের অমৃত বানী আমাদের সন্তানের সামনে তুলে ধরিতারও আগে সেই বানী আমাদের জীবনে অভ্যাস করে নিজের জীবনটা সুন্দর করিজগৎ 'মাতা' সারদার শেষ বানী- "যদি শান্তি চাও মা, কার দোষ দেখো নাদোষ দেখবে নিজেরপৃথিবীর সবাই তোমার আত্মীয়, কেউ পর নয়।" এমন একটা কথা যদি জীবনে প্রতিফলিত করা যায়, তা হবে স্বামী বিবেকানন্দের কথায়- "আমরা পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে, সেখান থেকে দেবত্বে নিজেকে নিয়ে যেতে পারি।" আমরা নিজেকে উন্নত করার এই চেষ্টা থেকে কখনও বিরত হবো নাকারণ এই চেষ্টা যে জীবনে নেই, সেটা আর যাই হোক মানুষের জীবন নয়

এমন জীবন লাভ করলে কি হবে-- আমরা দেবতা হয়ে উঠবোআমরা যেখানে থাকব, সেটা হবে মন্দিরআমাদের কাছের মানুষ গুলোর "দেবী" দর্শন হবেআমাদের সন্তান বলবে- 'দুর্গা, কালি, লক্ষ্মী, সরস্বতী বুঝি না, আমার 'মা' আমার ''দেবী'', আমার পৃথিবী, আমার আদর্শ' আমাদের এই সন্তান কখনও পশুর মত আচরণ করতে পারে নাসমাজের আতঙ্ক সে হতে পারে নাসে শিক্ষক হলে ক্লাসে ফাঁকি না দিয়ে, জীবন্ত দেবতার পুজা করবেডাক্তার হলে, রুগিকে নিয়ে ব্যবসা করবে নাইঞ্জিনিয়ার বা সরকারী কর্মচারী হলে পশুর মত দেশের গরীব- দুঃখী সাধারণ মানুষ গুলোর মুখের খাবার কেড়ে খাবে না

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রত্যেককে একটি গাছ লাগানর কথা বলা হয়আমরা প্রত্যেকে যদি নিজে দেবতা হয়ে উঠি এবং একটি করে "দেব-বৃক্ষ" সমাজের মাটিতে লাগাতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন তো সার্থক হবেই, সেই সাথে ঐ "দেব-বৃক্ষ" থেকেও অমৃত ফল ফলতে থাকবেআমরা তেমন "দেবী- মা" হয়ে উঠি, যেন আমাদের সন্তান বলতে পারে- " মা-গো, আমি যখন 'মা' কথাটি লিখি, তখন আমার লেখার কাগজ, আমার হাতের কলম পবিত্র হয়ে যায়আর আমি যখন তোমায় 'মা' বলে ডাকি, তখন আমার শরীর পবিত্র হয়ে যায়, আমার সমস্ত মন উৎসাহে, আনন্দে ভরে ওঠেআমাকে তুমি আশীর্বাদ করো 'মা'- আমি যেন তোমার পবিত্রতা রক্ষা করতে পারি, আমি যেন তোমার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারি'
 --------------------------------------------------------

Courtesy by: Soumitra Sarkar

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।