• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২২ অক্টোবর ২০১৩

সংস্কার কি?




সংস্কার মানে হচ্ছে নিজেকে পবিত্র, দোশত্রুটি মুক্ত এবং নির্মল করতে যে কাজ করা হয় তাকে বোঝায়। প্রতিটা মানুষ চায় তার সন্তান একজন ভাল চরিত্রের মানুষ হিসাবে গড়ে উঠুক। যে অনুষ্ঠান জীবনকে ধর্মীয় পরিবেশে সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে তাই সংস্কার। সনাতান ধর্মে ১৬ টি সংস্কার আছে।

সংস্কার এমন কিছু কাজ যা ভবিষ্যত জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলে এবং একজন ব্যাক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে। চারপাশের পরিবেশ শিশুর চরিত্র গঠনে ভুমিকা রাখে। যে কোন ভাল প্রভাব সুন্দর চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। এই ষোলটি সংস্কার মানুষের জীবন কে উন্নত করে, খারাপ সঙ্গ থেকে রক্ষা করে এবং তাকে একজন সু-নাগরীক হিসাবে গড়ে তোলে।

যখন কেও একটি আরাম দায়ক চেয়ার তৈরি করতে চায় নিশ্চয় সে আজেবাজে কাঠ দিয়ে তা তৈরি করতে চাইবে না। খারাপ কাঠ কে মসৃন করে, সুন্দর ভাবে পরিষ্কার করে, তারপর ঘরের জন্য আসবাব তৈরি করে। জন্মের পর থেকে এইসব সংস্কার মানুষকে একজন পূর্ণ মানুষে পরিনত করে।

আমরা ঘরে ধূলা ময়ল ঝাড়ু দেই। নিজেদের কাপড় পরিষ্কার করি।ঘরবাড়ী, কাপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকলে আমাদের খারাপ লাগে। আমরা প্রতিদিন স্নান করি শরীর পরিষ্কার করার জন্য। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করি কারন এর অভাবে আমাদের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এই বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা জীবনের একটি অংশ কিন্তু মন, চিন্তা এবং আত্মার পরিচ্ছন্নতা বেশি প্রয়োজন ।

মন কে অবশ্যই সত্যের অনুসন্ধানে ব্যকুল থাকতে হবে; দয়ালু এবং উদার হতে হবে; বোধবুদ্ধি সততায় পূর্ণ থাকতে হবে; আত্মাকে অবশ্যই পাপ শূণ্য হতে হবে।মহৎ জীবন গঠনে এগুলো প্রয়োজন। মন, বোধবুদ্ধি এবং আত্মার সর্বচ্চ পবিত্রতা অর্জনের জন্য ঋষিরা ষোলটি সংস্কারের কথা বলেছেন।প্রাথমিক সংস্কার জীবনের শুরু নির্দেশ করে সর্বশেষ সংস্কার মৃত্যুর সময় পালন করা হয়ে থাকে।আমরা এই সংস্কার গুলো পালন করি যাতে ভগবানের আশীর্বাদ পেয়ে সত্য ও ভালোর প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি। সংস্কার একজন প্রকৃত মহান মানুষের মর্যাদা কে আরও বৃদ্ধি করে।

১৬ টি সংস্কার হচ্ছে:
১) গর্ভদানঃ বিবাহের পর স্বামী স্ত্রী সন্তান জন্মদানের জন্য সকলের আশীর্বাদ পান। এই সংস্কার দ্বারা তারা স্ব্যাস্থবান, মহৎ এবং উদার হৃদয়ের সন্তান প্রার্থনা করেন।

২) পুংসবনঃ গর্ভদানের ৩ মাস পর এই সংস্কার পালন করতে হয়। গর্ভাবস্থায় সন্তানের সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়।

৩) সীমান্তনয়নঃ এটা গর্ভধারনের ষষ্ঠ বা অস্টম মাসের শেষে করা হয় বাচ্চার অঙ্গ প্রত্তঙ্গ পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য।

৪) জাতকর্ম: জন্মগ্রহনের দিন বাচ্চা কে জাতকর্মের মাধ্যমে পৃথিবিতে স্বাগতম জানান হয়।

৫) নামকরনঃ জন্মের এগার মাসে এই সংস্কার পালন করা হয় এবং বাচ্চাকে একটি নাম দেয়া হয়।

৬) নিশক্রমনঃ জন্মের চতুর্থ মাসে এই সংস্কার পালন করা হয়।শিশু সন্তান কে বাইরের পরিবেশে উন্মুক্ত করা হয়। যাতে সূর্যের আলো তাকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে। দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করা হয়। এই সময় থেকে সন্তান প্রকৃতির কোলে প্রাকৃতিক ভাবে বড় হতে থাকে।

৭) আন্নপ্রাসনঃ সন্তানের যখন দাঁত উঠতে থাকে সাধারনত ছয় থেকে আট মাস বয়সে এই সংস্কার পালন করা হয়। এখন থেকেই তাকে শক্ত খাবার দেয়া হয়।

৮) চুড়াকরনঃ প্রথম থেকে তৃতীয় বছর বয়সের মধ্যে এই সংস্কার পালন করা হয়। প্রথম বারের মত মাথার সব চুল ফেলে দেয়া হয়। সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ্য্ মানসিক বিকাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়।

৯) কর্ণভেদঃ তিন বছর বয়সে কান ফোরানো হয় এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করা হয়।

১০) উপনয়নঃ ৫ থেকে ৮ বছর বয়সের যে কোন সময় এই কাজ করা হয়। উপনয়ন মানে কার সন্নিকটে আসা। এই সংস্কারের মাধ্যমে একটি শিশু গুরু/ শিক্ষকের সন্নিধ্যে আসে। তাকে একটি পবিত্র সূতা দেয়া হয়, যাতে তিনটি আঁশ থাকে। এটি ছাত্রজ়ীবনের তিনটি নিয়মানুবর্তিতা নির্দেশ করেঃ জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি।শাস্ত্রে জীবন যাপনের যে পদ্ধতি উল্লেখ আছে তার প্রতি ওই শিশুটির অঙ্গিকার নির্দেশ করে। ব্রহ্মচর্য/ কৌমার্য (অবিবাহিত অবস্থা) ছাত্র জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ত পুর্ণ বিষয়।নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা এবং সব রকম খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অভ্যাস ছাত্র জীবনেই করতে হয়। নিয়মিত পড়ালেখা এই সংস্কারের পরেই শুরু হয়।

১১) বেদারম্ভঃ উপনয়ন এর পরেই এই সংস্কার পালন করা হয়। এই সময় বেদ এবং বিভিন্ন শাস্ত্র অনুসারে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন শুরু হয়।জ্ঞানের সকল শাখায় তাকে বিচরণ করতে হয় এবং এর মাধ্যমে সে জাগতিক বিষয়ের সাথে আধাত্মিক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে।

১২) সমাবর্তনঃ ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে যখন শিক্ষা গ্রহন শেষ হয় তখন এটি পালন করা হয়। গুরু ছাত্র কে যোগ্যতা অনুযায়ী ডিগ্রি প্রদান করেন। এরপর একজন ছাত্র আত্ম নির্ভর এবং স্বাধীন জীবন যাপন করে।

১৩) বিবাহঃ ছাত্রজীবনের ব্রহ্মচর্য শেষে একজন বিয়ে করে পরবর্তী জ়ীবনে পদার্পন করে, গৃহস্থ জ়ীবনে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা যারা এতদিন স্বাধীন জীবন যাপন করেছে এখন একসাথে জীবনভর চলার সপথ গ্রহন করে। বিয়ের পর সন্তান হয় এবং পরিবারের ধারা চলতে থাকে।

১৪) বানপ্রস্থঃ ৫০ বছর বয়সে গৃহস্থ আশ্রম শেষে বানপ্রস্থ আশ্রম শুরু হয়। নিজের সুবিধার জন্য তিনি যে সব কাজ করতেন তার সব কিছু পরিত্যাগ করেন। পরিবারের সব দায়িত্ব সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে পূজর্চনা, ধ্যান এবং মানব সেবায় নিয়োজিত হন।

১৫) সন্ন্যাস: যদিও ৭৫ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহন করার কথা বলা আছে তারপরেও আত্মনিয়ন্ত্রন এবং আধ্যাত্মিকতা দ্বারা যিনি জাগতিক সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন তিনিই সন্ন্যাস গ্রহন করবেন। এ সময় তিনি ধনসম্পদ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন এবং সকল ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করবেন । গাঢ় হলুদ রঙের ঢিলেঢালা পোশাক এই কঠোর জীবনের প্রতীক।তার কোন নির্দিষ্ট পরিবার সমাজ অথবা গৃহ নেই।

১৬) অন্তেষ্টীঃ মৃত্যুর পর শবদাহ করা হয় ।কিন্তু আত্মা অমর। যখন দেহ অগ্নিতে দাহ করা হয় তখন শরীর যে পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি, যেমন- মাটি, জল, আগুন, বাতাস এবং আকাশ প্রকৃতিতে মিশে যায়। মৃতের আত্মার শান্তিতে প্রার্থনা করা হয়। শবদাহ হচ্ছে মৃত দেহ সৎকারের সব চেয়ে ভাল উপায়।
সংস্কার কি? সংস্কার মানে হচ্ছে নিজেকে পবিত্র, দোশত্রুটি মুক্ত এবং নির্মল করতে যে কাজ করা হয় তাকে বোঝায়। প্রতিটা মানুষ চায় তার সন্তান একজন ভাল চরিত্রের মানুষ হিসাবে গড়ে উঠুক। যে অনুষ্ঠান জীবনকে ধর্মীয় পরিবেশে সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে তাই সংস্কার। সনাতান ধর্মে ১৬ টি সংস্কার আছে। সংস্কার এমন কিছু কাজ যা ভবিষ্যত জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলে এবং একজন ব্যাক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে। চারপাশের পরিবেশ শিশুর চরিত্র গঠনে ভুমিকা রাখে। যে কোন ভাল প্রভাব সুন্দর চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। এই ষোলটি সংস্কার মানুষের জীবন কে উন্নত করে, খারাপ সঙ্গ থেকে রক্ষা করে এবং তাকে একজন সু-নাগরীক হিসাবে গড়ে তোলে। যখন কেও একটি আরাম দায়ক চেয়ার তৈরি করতে চায় নিশ্চয় সে আজেবাজে কাঠ দিয়ে তা তৈরি করতে চাইবে না। খারাপ কাঠ কে মসৃন করে, সুন্দর ভাবে পরিষ্কার করে, তারপর ঘরের জন্য আসবাব তৈরি করে। জন্মের পর থেকে এইসব সংস্কার মানুষকে একজন পূর্ণ মানুষে পরিনত করে। আমরা ঘরে ধূলা ময়ল ঝাড়ু দেই। নিজেদের কাপড় পরিষ্কার করি।ঘরবাড়ী, কাপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকলে আমাদের খারাপ লাগে। আমরা প্রতিদিন স্নান করি শরীর পরিষ্কার করার জন্য। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করি কারন এর অভাবে আমাদের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এই বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা জীবনের একটি অংশ কিন্তু মন, চিন্তা এবং আত্মার পরিচ্ছন্নতা বেশি প্রয়োজন । মন কে অবশ্যই সত্যের অনুসন্ধানে ব্যকুল থাকতে হবে; দয়ালু এবং উদার হতে হবে; বোধবুদ্ধি সততায় পূর্ণ থাকতে হবে; আত্মাকে অবশ্যই পাপ শূণ্য হতে হবে।মহৎ জীবন গঠনে এগুলো প্রয়োজন। মন, বোধবুদ্ধি এবং আত্মার সর্বচ্চ পবিত্রতা অর্জনের জন্য ঋষিরা ষোলটি সংস্কারের কথা বলেছেন।প্রাথমিক সংস্কার জীবনের শুরু নির্দেশ করে সর্বশেষ সংস্কার মৃত্যুর সময় পালন করা হয়ে থাকে।আমরা এই সংস্কার গুলো পালন করি যাতে ভগবানের আশীর্বাদ পেয়ে সত্য ও ভালোর প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি। সংস্কার একজন প্রকৃত মহান মানুষের মর্যাদা কে আরও বৃদ্ধি করে। ১৬ টি সংস্কার হচ্ছে: ১) গর্ভদানঃ বিবাহের পর স্বামী স্ত্রী সন্তান জন্মদানের জন্য সকলের আশীর্বাদ পান। এই সংস্কার দ্বারা তারা স্ব্যাস্থবান, মহৎ এবং উদার হৃদয়ের সন্তান প্রার্থনা করেন। ২) পুংসবনঃ গর্ভদানের ৩ মাস পর এই সংস্কার পালন করতে হয়। গর্ভাবস্থায় সন্তানের সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। ৩) সীমান্তনয়নঃ এটা গর্ভধারনের ষষ্ঠ বা অস্টম মাসের শেষে করা হয় বাচ্চার অঙ্গ প্রত্তঙ্গ পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য। ৪) জাতকর্ম: জন্মগ্রহনের দিন বাচ্চা কে জাতকর্মের মাধ্যমে পৃথিবিতে স্বাগতম জানান হয়। ৫) নামকরনঃ জন্মের এগার মাসে এই সংস্কার পালন করা হয় এবং বাচ্চাকে একটি নাম দেয়া হয়। ৬) নিশক্রমনঃ জন্মের চতুর্থ মাসে এই সংস্কার পালন করা হয়।শিশু সন্তান কে বাইরের পরিবেশে উন্মুক্ত করা হয়। যাতে সূর্যের আলো তাকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে। দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করা হয়। এই সময় থেকে সন্তান প্রকৃতির কোলে প্রাকৃতিক ভাবে বড় হতে থাকে। ৭) আন্নপ্রাসনঃ সন্তানের যখন দাঁত উঠতে থাকে সাধারনত ছয় থেকে আট মাস বয়সে এই সংস্কার পালন করা হয়। এখন থেকেই তাকে শক্ত খাবার দেয়া হয়। ৮) চুড়াকরনঃ প্রথম থেকে তৃতীয় বছর বয়সের মধ্যে এই সংস্কার পালন করা হয়। প্রথম বারের মত মাথার সব চুল ফেলে দেয়া হয়। সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ্য্ মানসিক বিকাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়। ৯) কর্ণভেদঃ তিন বছর বয়সে কান ফোরানো হয় এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করা হয়। ১০) উপনয়নঃ ৫ থেকে ৮ বছর বয়সের যে কোন সময় এই কাজ করা হয়। উপনয়ন মানে কার সন্নিকটে আসা। এই সংস্কারের মাধ্যমে একটি শিশু গুরু/ শিক্ষকের সন্নিধ্যে আসে। তাকে একটি পবিত্র সূতা দেয়া হয়, যাতে তিনটি আঁশ থাকে। এটি ছাত্রজ়ীবনের তিনটি নিয়মানুবর্তিতা নির্দেশ করেঃ জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি।শাস্ত্রে জীবন যাপনের যে পদ্ধতি উল্লেখ আছে তার প্রতি ওই শিশুটির অঙ্গিকার নির্দেশ করে। ব্রহ্মচর্য/ কৌমার্য (অবিবাহিত অবস্থা) ছাত্র জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ত পুর্ণ বিষয়।নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা এবং সব রকম খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অভ্যাস ছাত্র জীবনেই করতে হয়। নিয়মিত পড়ালেখা এই সংস্কারের পরেই শুরু হয়। ১১) বেদারম্ভঃ উপনয়ন এর পরেই এই সংস্কার পালন করা হয়। এই সময় বেদ এবং বিভিন্ন শাস্ত্র অনুসারে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন শুরু হয়।জ্ঞানের সকল শাখায় তাকে বিচরণ করতে হয় এবং এর মাধ্যমে সে জাগতিক বিষয়ের সাথে আধাত্মিক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। ১২) সমাবর্তনঃ ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে যখন শিক্ষা গ্রহন শেষ হয় তখন এটি পালন করা হয়। গুরু ছাত্র কে যোগ্যতা অনুযায়ী ডিগ্রি প্রদান করেন। এরপর একজন ছাত্র আত্ম নির্ভর এবং স্বাধীন জীবন যাপন করে। ১৩) বিবাহঃ ছাত্রজীবনের ব্রহ্মচর্য শেষে একজন বিয়ে করে পরবর্তী জ়ীবনে পদার্পন করে, গৃহস্থ জ়ীবনে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা যারা এতদিন স্বাধীন জীবন যাপন করেছে এখন একসাথে জীবনভর চলার সপথ গ্রহন করে। বিয়ের পর সন্তান হয় এবং পরিবারের ধারা চলতে থাকে। ১৪) বানপ্রস্থঃ ৫০ বছর বয়সে গৃহস্থ আশ্রম শেষে বানপ্রস্থ আশ্রম শুরু হয়। নিজের সুবিধার জন্য তিনি যে সব কাজ করতেন তার সব কিছু পরিত্যাগ করেন। পরিবারের সব দায়িত্ব সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে পূজর্চনা, ধ্যান এবং মানব সেবায় নিয়োজিত হন। ১৫) সন্ন্যাস: যদিও ৭৫ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহন করার কথা বলা আছে তারপরেও আত্মনিয়ন্ত্রন এবং আধ্যাত্মিকতা দ্বারা যিনি জাগতিক সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন তিনিই সন্ন্যাস গ্রহন করবেন। এ সময় তিনি ধনসম্পদ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন এবং সকল ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করবেন । গাঢ় হলুদ রঙের ঢিলেঢালা পোশাক এই কঠোর জীবনের প্রতীক।তার কোন নির্দিষ্ট পরিবার সমাজ অথবা গৃহ নেই। ১৬) অন্তেষ্টীঃ মৃত্যুর পর শবদাহ করা হয় ।কিন্তু আত্মা অমর। যখন দেহ অগ্নিতে দাহ করা হয় তখন শরীর যে পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি, যেমন- মাটি, জল, আগুন, বাতাস এবং আকাশ প্রকৃতিতে মিশে যায়। মৃতের আত্মার শান্তিতে প্রার্থনা করা হয়। শবদাহ হচ্ছে মৃত দেহ সৎকারের সব চেয়ে ভাল উপায়।

courtesy by : Dipan Kumar Sarker
Share:

১৪ অক্টোবর ২০১৩

মহাভারত (ভূমিকা )

     
 মহাভারত অতি বৃহৎ গ্রন্থ। সংস্কৃত ভাষায় এতাদৃশবিস্তীর্ণ গ্রন্থ আর দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহা ইতিহাস বলিয়াই প্রসিদ্ধ; কিন্তু কোন কোন স্থলে ইহা পুরাণ এবং পঞ্চম বেদ শব্দেও উক্ত হইয়াছে। বস্তুতঃ মহাভারতে পুরাণের সমস্ত লক্ষণ বিদ্যমান আছে, এবং স্থানে স্থানে বেদের আখ্যানও বর্ণিত হইয়াছে। ইহাতে দেবচরিত, ঋষিচরিত ও রাজচরিত কীর্ত্তিত হইয়াছে এবং নানাপ্রকার উপাখ্যানাদিও লিখিত আছে। অতি বিস্তৃত মহাভারত গ্রন্থে অনেক প্রকার রাজনীতি ও ধর্ম্মনীতি উক্ত হইয়াছে, এবং নানাবিধ লৌকিকাচার ও বিষয়-ব্যবহারও বর্ণিত আছে। যাহাতে ভারতবর্ষের পূর্ব্ববৃত্তান্ত সমস্ত জ্ঞাত হইয়া সম্পূর্ণরূপে চরিতার্থ হইতে পারা যায়, সংস্কৃত ভাষায় এতাদৃশ কোন প্রকৃত পুরাগ্রন্থ দৃষ্ট হয় না। কিন্তু মহাভারত পাঠ করিলে সে ক্ষোভ অনেক অংশে দূর হইতে পারে। যেরূপ পদ্ধতি অনুসারে অন্যান্য দেশের পুরাবৃত্ত লিখিত হইয়া থাকে, মহাভারত তদ্রূপ প্রথানুক্রমে রচিত নহে, কিন্তু কোন বিচক্ষণ লোকে মনোযোগপুর্ব্বক ইহার আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া দেখিলে যে ভারতবর্ষের পূর্ব্বকালীন আচার, ব্যবহার, ধর্ম্ম ও বিষয়-ব্যবহারের অনেক পরিচয় প্রাপ্ত হইতে পারেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
    কোন কোন বিষয় বিবেচনা করিলে মহাভারত যেমন পুরাবৃত্তমধ্যে পরিগণিত হইতে পারে, সেইরূপ কোন কোন অংশে ইহাকে নীতি-শাস্ত্র বলিলেও বলা যায়। ইহার অনেক স্থানে সুষ্পষ্টরূপে অনেক উপাখ্যানাদি বর্ণিত হইয়াছে। মহাভারতের রচনাকর্ত্তা এবং ভারতবর্ষীয় অপরাপর পূর্ব্বতন ঋষিগণ উল্লিখিত অসামান্য গ্রন্থের অধ্যয়ন ও শ্রবণের যে সমস্ত অসাধারণ অলৌকিক ফলশ্রুতি বর্ণন করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে আস্থাশূন্য হইলেও ইহার শ্রবণ ও অধ্যয়ন দ্বারা নীতি, জ্ঞান ও বিষয়-ব্যবহার জ্ঞানাদি অনেক প্রকার উপকার লাভ করিয়া সুখী হওয়া যাইতে পারে, সন্দেহ নাই।
    এই গ্রন্থ হইতে উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট নীতি সকল সঙ্কলন করিয়া এতদ্দেশীয় অনেক পণ্ডিত প্রশংসনীয় নীতিশাস্ত্র রচনা দ্বারা জনসমাজে প্রতিষ্ঠিা লাভ করিবাছেন, এবং ভারতবর্ষের অনেক কবিও ইহার অনেক মনোহর আখ্যান অবলম্বনপূর্বক অনুপম আশ্চর্য্য কাব্য-নাটকাদি রচনা করিয়া কাব্য-রসরসিক জনগণের চিত্তবিনোদ সাধন করিয়াছেন। শাস্ত্রব্যবসায়ী পণ্ডিতগণও উল্লিখিত গ্রন্থ হইতে সর্ব্বদা শ্লোক সকল উদ্ধৃত করিয়া লোকদিগকে নীতিশিক্ষা প্রদান করেন। ফলতঃ ভারতান্তর্গত অনেক উপদেশ শ্রবণ করিয়া যে ভারতবর্ষীয় লোকে অনেক প্রকার নীতিজ্ঞান লাভ করিয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। অতি বিস্তীর্ণ ভারত-গ্রন্থে প্রায় মনুষ্যের সকল প্রকার অবস্থাই বর্ণিত আছে, সুতরাং ইহা হইতে সকল অবস্থার অনুরূপ উপদেশ প্রাপ্ত হইয়া লোকে সাবধানে সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারে। এই গ্রন্থ এদেশের সবিশেষ গৌরবস্বরূপ। কোন ভিন্নদেশীয় পণ্ডিত নিরপেক্ষ হইয়া ইহার আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া দেখিলে অবশ্যই গ্রন্থকর্তার আশ্চর্য্য অধ্যাবসায়, অসামান্য রচনানৈপূণ্য, প্রগাঢ় ভাবমাধুরী ও উদার উদ্দেশ্যের যশঃকির্ত্তন করেন, সন্দেহ নাই।
    অসামান্য যত্ন-সম্পন্ন ভারতগ্রন্থ যে, কোন্ সময় ও ভারতবর্ষের কি প্রকার অবস্থায় রচিত হইয়াছে, তাহা সংশয়শূন্য হইয়া অবধারিত করা নিতান্ত কঠিন। কিন্তু বেদরচনার অনেক পরে যে ইহার রচনা হইয়াছে, তাহা ইহার রচনাতাৎপর্য্য ও উপাখ্যানাদি দ্বারাই সহজে প্রতিপন্ন হইতেছে। বেদের ভাষার সহিত ইহার ভাষার তুলনা করিয়া দেখিলেই ইহাকে বেদাপেক্ষা আধুনিক বোধ হয় এবং ইহার মধ্যে বেদের আখ্যানাদিও দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার মধ্যে রাজনীতি, ধর্ম্মনীতি, লোকযাত্রাবিধান, বাণিজ্য-কৃষিকার্য্য ও শিল্পশাস্ত্রাদি সংক্রান্ত যে সকল কথা বর্ণিত আছে, কোন আদিম-কালবর্ত্তী অসভ্যাবস্থা লোকের চিন্তাপথে তৎসমুদয় উদিত হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব হইতে পারে না। অতএব যে সময় ভারতবর্ষে বিলক্ষণ রূপে সভ্যতার প্রচার ও জ্ঞানের বিস্তার হইয়াছিল, মহাভারত যে তৎকালে রচিত গ্রন্থ, সে বিষয়ে কোন সংশয় জন্মিতে পারে না।

    অশেষ জ্ঞানাধার ও নীতিগর্ভ মহাভারত গ্রন্থ এদেশীয় সর্ব্বসধারণ লোকের বোধসুলভ করিবার উদ্দেশে, কাশীরাম দাস তাঁহার অষ্টাদশ-পর্ব্ব বাঙ্গালা ভাষায় পদ্যে অনুবাদ করিয়া গিয়েছেন এবং এপর্য্যন্ত পৌরাণিক পণ্ডিতেরাও  স্থানে স্থানে দেশীয় ভাষায় উক্ত গ্রন্থের ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন। কিন্তু কাশীরাম দাসের গ্রন্থপাঠ, অথবা বেদীস্থিত পৌরাণিকদিগের ব্যাখ্যা শ্রবণ করিয়া মহাভারত যে কি পদার্থ ইহা যথার্থ রূপে জানিবার সম্ভাবনা নাই। কাশীরাম দাস স্বরচিত গ্রন্থের সৌন্দর্য্য-সম্পাদনমানসে এবং সর্ব্বসাধারণ লোকের চিত্তরঞ্জন উদ্দেশে ব্যাসপ্রোক্ত মূল গ্রন্থের বহির্ভূত অনেক কথা রচনা করিয়া আপনার কবিত্বশক্তি প্রকাশ করিয়াছেন, এবং মূলের লিখিত অনেক স্থল পরিত্যাগ করিয়া আপনার শ্রম লাঘব করিতে চেষ্টা পাইয়াছেন। ইদানীন্তন পুরাণ-বক্তা পণ্ডিত মহাশয়েরাও শ্রোতাদিগের শ্রবণ-সুখসম্পাদনাভিলাষে এবং আপনাদিগের হাস্যকরুণাদি-রসসাধনীশক্তি প্রকাশ করিবার মানসে কাশীরাম দাসের অনুকরণ করিয়া মূল গ্রন্থ পরিত্যাগপূর্ব্বকও অনেক প্রকার নূতন কথার ব্যাখ্যা করেন এবং শ্রোতাদিগের শ্রবণের অনুপযুক্ত আশঙ্কা করিয়া মূল গ্রন্থের অনেক স্থল পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। এই দেশীয় সর্ব্বসাধারণ লোকের মহাভারতের প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হইবার উল্লিখিত উভয় পথে যখন উক্ত প্রকার বিষম প্রতিবন্ধক বিদ্যমান রহিয়াছে, তখন গুরুতর পরিশ্রম স্বীকারপূর্বক সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ পারদর্শী হইয়া স্বয়ং মহাভারত পাঠ বা কোন যোগ্য পণ্ডিতের মুখে প্রত্যেক শ্লোকের ব্যাখ্যা শ্রবণ না করিলে আর মহাভারত যে কি  ইহা জানিবার উপায় নাই। কিন্তু এক্ষণে এদেশে দিন দিন সংস্কৃত ভাষায় যে প্রকার অননুশীলন এবং অনাদর হইয়া আসিতেছে তাহাতে বরং সংস্কৃত গ্রন্থসকল ক্রমে এদেশীয় লোকের নিকট হইতে তিরোহিত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা বোধ হয়। অতএব যাহাতে এদেশিয় লোকে অতীব আদরণীয় ভারত-গ্রন্থের সমস্ত মর্ম্ম প্রকৃত রূপে অবগত  হইয়া সুখী হইতে পারেন এবং  যাহাতে ভারতবর্ষের গৌরবস্বরূপ মহাভারতের অবশ্যম্ভব মর্য্যাদা চিরদিন বর্ত্তমান থাকে, তাহার উপযুক্ত উপায় নির্দ্ধারণ করিবার উদ্দেশে আমি এই দুঃসাধ্য ও চিরসঙ্কল্পিত ব্রতে ব্রতী হইয়াছি।
    এক্ষণে আমাদিগকে দেশের মধ্যে নানাস্থানে নানা বিদ্যোৎসাহী ও স্বদেশহিতানুরাগী মহানুভবগণ ইংরেজী ভাষার বিবিধ জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ বাঙ্গালা ভাষায় অনুবাদ করিয়া দেশের হিতসাধনে তৎপর হইয়াছেন। কেহ বিজ্ঞানশাস্ত্রের অনুবাদ করিতেছেন, কেহ সাহিত্যের অনুবাদ করিয়া প্রচার করিতেছেন, কেহ পুরাবৃত্তাদি গ্রন্থের অনুবাদপ্রসঙ্গেও আমোদিত হ‌ইয়াছেন। ইহা দেখিয়াও আমার মনে হইল যে, যেমন অনুবাদ দ্বারা ভিন্ন দেশের গ্রন্থান্তর্গত অমূল্য জ্ঞানরত্ন সকল সঞ্চয় করিয়া স্বদেশের গৌরববৃদ্ধি করা উচিত, সেইরূপ স্বদেশীয় মহানুভব পুরুষদিগের মানসোদিত আশ্চর্য্য তত্ত্ব সকল স্থায়ী হইবার উপায় বিধান করাও একান্ত কর্ত্তব্য। স্বদেশের জ্ঞানোন্নতি সংসাধন ও জ্ঞানগৌরব রক্ষা করাই তাহার প্রকৃত হিত সাধন করা। সুদূরপ্রস্থিত প্রশস্ত পন্থাও কালেতে বিলুপ্ত হয়, সুদীর্ঘ দীর্ঘিকাও সময়ে শুষ্ক হইয়া যায়, অত্যূচ্চ প্রাসাদও কালে ভগ্ন ও চূর্ণ হইয়া গিয়া থাকে এবং পরিখাপরিবেষ্টিত দুর্গম দুর্গেরও ক্রমেই নাশ হইয়া থাকে, কিন্তু প্রগাঢ় জ্ঞানচিহ্ন দেশ হইতে শীঘ্র অপনীত হ‌ইবার নহে। এই বিবেচনায় আমি স্বীয় যৎ-সামান্য পরিমিত শক্তি দ্বারা বাঙ্গালা ভাষায় প্রবিস্তীর্ণ মহাভারতের অনুবাদ করিত স্বদেশের হিত সাধন করিতে সাহসী হইয়াছি।
    মহাভারত যেরূপ দুরূহ গ্রন্থ, যাদৃশ অল্পবুদ্ধি জনকর্ত্তৃক ইহা সম্যক্‌রূপে অনুবাদিত হওয়া নিতান্ত দুষ্কর। এই নিমিত্ত ইহার অনুবাদসময়ে অনেক কৃতবিদ্য মহোদয়গণের ভূয়িষ্ঠ সাহায্য গ্রহণ করিতে হইয়াছে, এমনকি তাঁহাদের পরামর্শ ও সাহায্যের উপর নির্ভর করিয়া আমি এই গুরুতর ব্যাপারের অনুবষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তন্নিমিত্ত ঐ সকল মহানুভবদিগের নিকট চিরজীবন কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ রহিলাম।
    আমি যে দুঃসাধ্য ও চিরজীবনসেব্য কঠিন ব্রতে কৃতসংকল্প হইয়াছি তাহা যে নিবিগ্নে শেষ করিতে পারিব, আমার এপ্রকার ভরসা নাই। যদি জগদীশ্বর-প্রসাদে পৃথিবীমধ্যে কুত্রাপি বাঙ্গালা প্রচলিত থাকে, আর কোন কালে এক অনুবাদিত পুস্তক কোন ব্যক্তির হস্তে পতিত হওয়ায় সে ইহার মর্ম্মানুধাবন করত হিন্দুকুলের কীর্ত্তিস্তম্ভস্বরূপ ভারতের মহিমা অবগত হইতে সক্ষম হয়, তাহা হইলেই আমার সমস্ত পরিশ্রম সফল হইবে।
    অষ্টাদশপর্ব্ব সমগ্র মহাভারত অনুবাদ করত একত্রে মুদ্রিত করিয়া প্রকাশ করিতে হইলে, দীর্ঘ কালের মধ্যেও সম্পন্ন হওয়া কঠিন। অতএব ইহা ক্রমশ খণ্ড খণ্ড করিয়া মুদ্রিত করাই উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া, ইহার দোষ গুণ অবগত হইবার জন্য আপাততঃ আদিপর্ব্বের প্রথমাবধি পৌষ্য, পৌলোম ও আস্তীক পর্ব্বাধ্যায়ের শকুন্তলোপাখ্যান পর্যন্ত প্রথম খণ্ড সাধারণ সমীপে অর্পণ করিতেছি, করুণাশীল সুধীগণ ইহার অবশ্যম্ভাবী অপেক্ষিত দোষরাশি মার্জ্জনা করিয়া উৎসাহ প্রদান করিলে অচিরে অপর খণ্ড প্রকাশ করিতে উৎসাহান্বিত হইব।

কলিকাতা, ১৭৮১ শকাব্দ                                                            শ্রীকালীপ্রসন্ন সিংহ

ভূমিকা
    মহাভারতীয় সভাপর্ব অনুবাদিত  ও মুদ্রিত হইল। এ খণ্ডে লোকপালদিগের সভাবর্ণন, রাজসূয় যজ্ঞ, দ্যূতক্রীড়া, সভামধ্যে দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ ও বস্ত্রহরণ প্রভৃতি নিগ্রহ, পাণ্ডবগণের নির্ব্বাসন ও কুন্তীর বিলাপাদি সমুদায় বিষয় অবিকল অনুবাদিত হ‌ইয়াছে। যে কারণে অতি বিশাল কৌরবকুলে ভ্রাতৃবিরোধের সূত্রপাত হয়, যে কারণে ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির সাম্রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া ভার্য্যা ও ভ্রাতৃগণের সহিত প্রাকৃত জনের ন্যায় ত্রয়োদশ বৎসর বনবাসে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহিত করেন, যে কারণে অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী সেনা সমরানলে পতঙ্গবৃত্তি অবলম্বন করে,  যে কারণে দুর্জ্জয় ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ সমূলে নির্ম্মূলিত হয় এবং যে সকল বৃ্ত্তান্ত লইয়া বেদব্যাস কবিত্বশক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন সেই সমুদয়ের মূলস্বরূপ করুণরসপূর্ণ দ্যূতক্রীড়া এই পর্ব্বের অন্তর্গত। এই পর্ব্বে মহর্ষি ব্যাসদেব রৌদ্র করুণ প্রভূতি নানাবিধ রসমাধুর্য্যের সহিত অপূর্ব্ব কবিত্বশক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন।
    সভাপর্ব্ব অন্যান্য পর্ব্ব অপেক্ষা অনেক ক্ষুদ্র বটে, কিন্তু ইহার অনুবাদে অত্যন্ত পরিশ্রম স্বীকার করিতে হইয়াছে, কারণ কূটার্থপূর্ণ শ্লোক অধিক পরিমাণে এই পর্ব্বে সন্নিবেষ্টিত আছে। যাঁহারা বিশেষ মনোযোগ সহকারে সভাপর্ব্বের আদ্যোপান্ত পাঠ করিবেন, তাঁহারা নীতিশাস্ত্র ও ধর্ম্মশাস্ত্র অধ্যায়নের ফলপ্রাপ্ত হইবেন এবং মনুষ্যের অবস্থা যে কখনই অপরিবর্ত্তনীয় নহে, যুধিষ্ঠিরের অতুল সাম্রাজ্য ও দ্যুতোপলক্ষে নির্ব্বাসনব্যাপার অবলোকন করিলে তাহা সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিবেন।

কলিকাতা, ১৭৮২ শকাব্দ                                                            শ্রীকালীপ্রসন্ন সিংহ

Share:

মহাভারত (আদিপর্ব ষষ্ঠ-সপ্তম অধ্যায়)

ষষ্ঠ অধ্যায়
রাক্ষস কর্ত্তৃক পুলোমা-হরণ
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, দুরাত্মা রাক্ষস অগ্নির সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া বরাহরূপ ধারণপূর্ব্বক ভৃগুজায়াকে অপহরণ করিয়া বায়ুবেগে পলায়ন করিতে লাগিল। তখন পুলোমার গর্ভস্থ বালক রাক্ষসের এইরূপ গর্হিত অনুষ্ঠান অবলোকনে ক্রোধান্বিত হইয়া মাতৃগর্ভ হইতে নির্গত হইলেন। তাহাতেই তাঁহার নাম চ্যবন হইল। রাক্ষসসূর্য্যের ন্যায় তেজস্বী সদ্যোজাত সেই শিশুকে অবলোকন করিবামাত্র পুলোমাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক ভস্মীভূত হইয়া ভূতলে পতিত হইল। অনন্তর দুঃখাভিভূতা পুলোমা ভৃগুর ঔরসপুৎত্র চ্যবনকে ক্রোড়ে লইয়া রোদন করিতে করিতে আশ্রমাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা সেই অনিন্দিতা ভৃগুপত্নীকে বাষ্পাকুলিত-লোচনা দেখিয়া সমীপে গিয়া অশেষ প্রকার প্রবোধবাক্যে তাঁহাকে সান্ত্বনা করিলেন। ভৃগুপত্নীর নয়ন-নিপতিত জলধারায় এক মহানদী প্রবাহিত হইল। পিতামহ ব্রহ্মা সেই নদীকে পুৎত্রবধূ পুলোমার অনুসরণ করিতে দেখিয়া তাহার নাম "বধূসরা" রাখিলেন।
    পরে পুলোমা চ্যবনকে ক্রোড়ে লইয়া আসিতেছিলেন, ইত্যবসরে মহর্ষি ভৃগু স্নান-পূজাদি সমাপনান্তর প্রত্যাগমনপূর্ব্বক স্বীয় ধর্ম্মপত্নী ও পুৎত্রকে তদবস্থ দেখিয়া ক্রোধান্ধ হইলেন এবং সহধর্ম্মিণী পুলোমাকে সম্বোধনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, "হে মধুরহাসিনি! হরণেচ্ছৃ দুরাত্মা রাক্ষস তোমাকে আমার ভার্য্যা বলিয়া জানিত না, তুমি সত্য করিয়া বল, কে তাহার নিকট তোমার পরিচয় প্রদান করিল? আমি এক্ষণেই সেই পরিচয়দাতাকে শাপ প্রদান করিব। কোন্ ব্যক্তির এই দুষ্টকর্ম্মের অনুষ্ঠানে সাহস হইল? আমার শাপে ভীত না হয়, এমত লোক কে?" ভৃগু কর্ত্তৃক এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া পুলোমা কহিলেন, "ভগবন্! অগ্নি সেই রাক্ষসের সমীপে আমার পরিচয় দেন, পরে সেই পাপাত্মা রাক্ষস আমাকে রোরুদ্যমানা কুররীর [উৎক্রোশ পক্ষী
কুরল পাখী] ন্যায় অপহরণ করিল। তদনন্তর এই পুৎত্রের তেজঃপ্রভাবে সে ভস্মীভূত হইয়া ভূমিসাৎ হইয়াছে, তাহাতে আমি রক্ষা পাইলাম।" ভৃগু পুলোমার এই বাক্যশ্রবণে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হইয়া "অদ্যাবধি তুমি সর্ব্বভক্ষ হইবে" বলিয়া অগ্নিকে শাপ প্রদান করিলেন।

                                                          সপ্তম অধ্যায়
                                                     পুলোমা রাক্ষস নিধন

    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ভৃগু এইরূপ শাপ প্রদান করিলে অগ্নি সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, "হে ব্রহ্মন্! আপনি কেন অকারণে আমাকে এই নিদারুণ অভিসম্পাত করিলেন? আমি তৎকর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া ধর্ম্মপ্রতিপালনার্থ সত্যকথা কহিয়াছি, ইহাতে আমার দোষ কি? যে ব্যক্তি জিজ্ঞাসিত হইয়া জানিয়া-শুনিয়া মিথ্যা বলে, সে আপনার ঊর্দ্ধতন সপ্তপুরুষ ও অধস্তন সপ্তপুরুষকে নরকে পাতিত করে। আর যে ব্যক্তি যথার্থ জানিয়াও না কহে, সেও সেই পাপে লিপ্ত হয়, ইহাতে সন্দেহ নাই। যাহা হউক, আমিও আপনাকে শাপ প্রদান করিতে পারি, কিন্তু আমি ব্রাহ্মণদিগকে মান্য করি, এই নিমিত্ত বিরত হইলাম। আপনি সর্ব্বজ্ঞ, তথাপি আপনাকে কিছু কহিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি যোগবলে আত্মাকে বহুধা বিভক্ত করিয়া শরীরভেদে অগ্নিহোত্র, গর্ভাধান ও জ্যোতিষ্টোমাদি ক্রিয়াকলাপে অধিষ্ঠিত আছি। বেদোক্তবিধিপূর্ব্বক আমাতে হুত যে হবিঃ, তদ্দ্বারা দেবগণ ও পিতৃগণ পরিতৃপ্ত হয়েন। হূয়মান সোমরসাদি সামগ্রী সকল দেবগণ ও পিতৃগণের শরীররূপে পরিণত হয়। দেবগণ ও পিতৃগণকে উদ্দেশ করিয়া একত্র দর্শ ও পৌর্ণমাস যজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়, অতএব দেবগণ ও পিতৃগণ অভিন্নস্বরূপ এবং প্রতি পর্ব্বে কখন একত্র, কখন বা পৃথক্ কৃথক্ পূজিত হইয়া থাকেন। আমাতে যে আহুতি-সকল প্রদত্ত হয়, সেই সকল আহুতি দেবগণ ও পিতৃগণ ভক্ষণ করেন। তন্নিমিত্ত আমি দেবগণ ও পিতৃগণের মুখস্বরূপ। অমাবস্যাতে পিতৃগণকে ও পূর্ণিমাতে দেবগণকে উদ্দেশ করিয়া আমাতে আহুতি প্রদত্ত হয়, তাঁহারাও আমারই মুখ দ্বারা তাহা ভক্ষণ করেন, অতএব আমি কি প্রকারে সর্ব্বভক্ষ হইব?"
    পরে অগ্নি ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বিপ্রগণের অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞক্রিয়া হইতে আপনাকে তিরোহিত করিলেন। তাঁহার অন্তর্দ্ধানান্তর প্রজাগণ ওঙ্কার, বষট্‌কার ও স্বধা-স্বাহা-বিবর্জ্জিত হইয়া দুঃখার্ণবে নিমগ্ন হইল। ঋষিগণ তদ্দর্শনে উদ্বিগ্নমনে দেবগণ সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া নিবেদন করিলেন, "হে দেবগণ! অগ্নির অন্তর্দ্ধানপ্রযুক্ত ক্রিয়ালোপ হওয়াতে ত্রিলোকী ইতিকর্ত্তব্যতাবিমূঢ় হইয়াছে, অতএব এ বিষয়ে যাহা কর্ত্তব্য হয়, শীঘ্র বিধান করুন, আর কালাতিপাত করিবেন না।"
    অনন্তর ঋষিগণ ও দেবগণ ব্রহ্মার নিকট গমন করিয়া অগ্নির শাপ ও তন্নিবন্ধন ক্রিয়ালাপের বৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া কহিলেন, "হে ব্রহ্মন্! মহর্ষি ভৃগু কোন কারণবশতঃ অগ্নিকে 'সর্ব্বভক্ষ হও] বলিয়া শাপ দিয়াছেন, কিন্তু অগ্নি দেবগণের মুখ ও যজ্ঞের অগ্রভাগভোক্তা হইয়া কিরূপে সর্ব্বভক্ষ হইবেন?" বিধাতা তাঁহাদিগের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া অগ্নিকে আহ্বান করিলেন এবং মধুরবাক্যে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, "বৎস! তুমি সর্ব্বলোকের কর্ত্তা ও সংহর্ত্তা এবং অগ্নিহোত্রাদি ক্রিয়াকলাপের প্রবর্ত্তয়িতা, তুমিই এই ত্রিলোকী ধারণ করিতেছ; অতএব হে ত্রিলোকেশ হুতবহ! এক্ষণে যাহাতে ক্রিয়াকলাপের উচ্ছেদ না হয়, তাহা কর। তুমি সর্ব্বলোকের ঈশ্বর হইয়া এরূপ বিমূঢ়প্রায় হইতেছ কেন? তুমি সর্ব্বলোকে সর্ব্বদা পবিত্র এবং সর্ব্বজীবের গতিস্বরূপ। অতত্রব আমি বলিতেছি তুমি সর্ব্বশরীরে সর্ব্বভক্ষ হইবে না। অপানদেশে তোমার যে-সকল শিখা আছে, তাহারাই সকল বস্তু ভক্ষণ করিবে এবং তোমার মাংসভক্ষিকা যে তনু আছে, সেই সর্ব্বভক্ষ হইবে। যেমন রবিকিরণ-সংস্পর্শে সকল বস্তু শুচি হয়, সেইরূপ তোমার শিখা দ্বারা দগ্ধ হইয়া সকল বস্তু শুচি হইবে। হে হুতাশন! তুমি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ তেজঃপদার্থ, তুমি আপনার প্রভাবে আপনি বিনির্গত হইয়াছ, এক্ষণেও স্বকীয় তেজঃপ্রভাবে ঋষির শাপ সত্য কর এবং তোমার মুখে হুত দেবভাগ ও আত্মভাগ গ্রহণ কর।"
    অগ্নি সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া "যে আজ্ঞা" বলিয়া তদীয় আজ্ঞা-পালনার্থে গমন করিলেন। দেবগণ ও ঋষিগণ আহ্লাদিত হইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। মহর্ষিগণ পূর্ব্বের ন্যায় যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াসকল সম্পন্ন করিতে লাগিলেন। স্বর্গে দেবগণ ও ধরাতলে নরগণ অত্যন্ত হৃষ্টচিত্ত হইলেন। অগ্নিও শাপ-বিনির্ম্মুক্ত হইয়া সাতিশয় প্রীতিলাভ করিলেন। পূর্ব্বকালে ভগবান অগ্নি মহর্ষি ভৃগু হইতে এইরূপে শাপগ্রস্ত হইয়াছিলেন। অগ্নির শাপ, পুলোমা রাক্ষসের নিধন ও চ্যবনের জন্মবৃত্তান্ত-ঘটিত প্রাচীন ইতিহাস এই।

Share:

মহাভারত ( আদিপর্ব : চতুর্থ-পঞ্চম)







চতুর্থ অধ্যায়
পৌলোম-পর্ব্ব


    সৌতি কহিলেন, নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌনকের দ্বাদশবর্ষব্যাপী যজ্ঞে যে-সকল মহর্ষিগণ সমাগত হইয়াছিলেন, সূত বংশ-সম্ভূত লোমহর্ষণাত্মজ উগ্রশ্রবাঃ পুরাণপাঠ দ্বারা তাঁহাদিগের শুশ্রূষা করিতেছিলে। উগ্রশ্রবাঃ কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাদিগকে নিবেদন করিলেন, "হে মহর্ষিগণ! উতঙ্কচরিত আদ্যোপান্ত কহিলাম, এক্ষণে আপনারা আর কি শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করেন, আজ্ঞা করুন।"
    মুনিগণ কহিলেন, হে লোমহর্ষণনন্দন! আমরা প্রসঙ্গক্রমে তোমাকে যখন যে কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি সেই সমুদয় বর্ণনা করিও। কিন্তু কুলপতি শৌনক এক্ষণে অগ্নিশরণে [অগ্নিগৃহ
যে গৃহে সর্ব্বদা যজ্ঞাগ্নি থাকে।] অবস্থিতি করিতেছেন, তিনি সুরাসুর-মনুষ্য-সর্প-গন্ধবর্বাদিঘটিত বিচিত্র অলৌকিক বৃত্তান্ত জানেন; বিদ্বান্, কর্ম্মদক্ষ, ব্রতপরায়ণ, বেদবেদান্তশাস্ত্রে পারদর্শী, সত্যবাদী, শান্তিগুণাবলম্বী তপোনিরত সেই মহর্ষি আমাদিগের সকলেরই মান্য, তাঁহার অপেক্ষা কর। তিনি পরমার্চ্চিত আসনে অধ্যাসীন হইয়া যে যে কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহাই কহিবে।
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, “ভাল, সেই মহর্ষি আসনে উপবিষ্ট হইয়া জিজ্ঞাসিলেই বিবিধ পবিত্র কথা বলিব।" ক্ষণকাল পরে বিপ্রশ্রেষ্ঠ শৌনকঋষি দেবযজ্ঞ ও পিতৃতর্পণ প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপ বিধিপূর্ব্বক সমাপ্ত করিয়া, যেস্থানে উগ্রশ্রবাঃ ও ব্রতপরায়ণ সিদ্ধ ব্রহ্মর্ষিগণ সুখাসীন আছেন, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পরে ঋত্বিক্ ও সদস্যগণ উপবিষ্ট হইলে স্বয়ং আসন পরিগ্রহ করিয়া এই কথা প্রস্তাব করিলেন।

                                                             পঞ্চম অধ্যায়
                                                      ভূগুবংশ-চ্যবনোৎপত্তি

    শৌনক কহিলেন, বৎস সূতনন্দন! তোমার পিতা মহর্ষি বেদব্যাসের নিকট সমস্ত পুরাণ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, তুমিও সেই সমুদয় অধ্যয়ন করিয়াছ। তোমার পিতার মুখে শ্রবণ করিয়াছি, পুরাণে অলৌকিক কথা-সকল ও আদিবংশ-বৃত্তান্ত-সকল বর্ণিত আছে, তন্মধ্যে প্রথমতঃ ভূগুবংশের বৃত্তান্তশ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি, বর্ণনা কর।
      মহর্ষি শৌনকের আজ্ঞালাভানন্তর সূতনন্দন উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, দ্বিজাগ্রণী মহাত্মা বৈশম্পায়ন প্রভৃতি যাহা সম্যক্‌রূপে অধ্যয়ন ও কীর্ত্তন করিয়াছেন, আমার পিতা যাহা অধ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট আমি যাহা অধ্যয়ন করিয়াছি, সেই সমস্ত বর্ণনা করিতেছি, শ্রবণ করুন।
      সুবিখ্যাত ভূগুবংশ ইন্দ্রাদি দেবগণ ও অশেষ ঋষিগণের পূজনীয়। এই বংশ পুরাণে যেরূপ বর্ণিত আছে, তাহা আমি যথাবৎ বর্ণন করিতেছি। স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা বরুণের যজ্ঞ করিতেছিলেন, আমরা শুনিয়াছি, সেই যজ্ঞাগ্নি হইতে মহর্ষি ভৃগু সমুত্থিত হয়েন। ভৃগুর পুৎত্র চ্যবন পিতার প্রিয়পাত্র ছিলেন; চ্যবনের পুৎত্র প্রমতি অতিশয় ধর্ম্মপরায়ণ ছিলেন; ঘৃতাচীর গর্ভে প্রমতির রুরু-নামক এক পুৎত্র উৎপন্ন হয়; রুরুর ঔরসে প্রমদ্বরার গর্ভে আপনার প্রপিতামহ শুনক জন্মগ্রহণ করেন। মহর্ষি শুনক বেদাধ্যয়ন-সম্পন্ন, তপোনিরত, যশস্বী, অশেষ-শাস্ত্রজ্ঞ, ব্রহ্মজ্ঞানী, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয় ছিলেন।
      শৌনক কহিলেন, হে সূতনন্দন! যেরূপে সেই মহাত্মা ভৃগুনন্দন চ্যবন নামে বিখ্যাত হইলেন, তাহা আমার নিকট সবিশেষ বর্ণন কর।
      উদ্রশ্রবাঃ কহিলেন, মহাত্মা ভৃগুর পুলোমানম্নী প্রিয়তমা ধর্ম্মপত্নী ছিলেন, তিনি ঐ মহর্ষির সহযোগে গর্ভিণী হয়েন। একদা ধার্ম্মিকাগ্রগণ্য মহর্ষি ভৃগু স্নানার্থ গমন করিলে পুলোমা নামে এক রাক্ষস তাঁহার আশ্রমে উপস্থিত হইল। ঐ পাপাত্মা আশ্রমে প্রবেশপূর্ব্বক ভৃগু-গৃহিণীর মনোহারিণী মূর্ত্তি দর্শনে কন্দর্পশরে জর্জ্জরিত ও মূর্চ্ছিতপ্রায় হইল। সুচারুদর্শনা পুলোমা অনায়াসলভ্য বন্যফলমূলাদি দ্বারা সেই অভ্যাগত রাক্ষসের অতিথিসৎকার করিলেন। দুর্ব্বৃত্ত রাক্ষস কুসুমশরের বিষম শরে নিতান্ত উদ্‌ভ্রান্তচিত্ত হইয়া "এই বরবর্ণিনীকে হরণ করিব" এইরূপ সঙ্কল্প করিবামাত্র সাতিশয় হৃষ্টমনা হইল। পুলোমা রাক্ষস পূর্ব্বে ঐ সুচারুহাসিনী কন্যাকে’ ভার্ষ্যারূপে বরণ করিয়াছিল, কিন্তু কন্যার পিতা তাহাকে না দিয়া মহাত্মা ভৃগুকে বিধিপূর্ব্বক কন্যা সম্প্রদান করেন। সে অন্যায় কার্য্যের অনুষ্ঠান তাহার মনে সর্ব্বদা জাগরূক ছিল, এক্ষণে সে অবসর পাইয়া হরণ করিতে অভিলাষ করিল।
      রাক্ষস পুলোমাহরণে কৃতনিশ্চয় হইয়া অগ্নিশরণস্থ প্রজ্বলিত হুতাশন-সমীপে গমনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিল, "হে হুতাশন! তুমি সর্ব্বদেবগণের মুখ্য। তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, সত্য করিয়া বল, এই সুন্দরী কাহার ভার্গ্যা‍! আমি পূর্ব্বে এই কামিনীকে স্বীয় সহচারিণী করিব বলিয়া বরণ করিয়াছিলাম, কিন্তু ইহার পিতা আমাকে কন্যা দান না করিয়া ভৃগুকে সম্প্রদান করেন। অতএব যদি এই নির্জ্জন-নিবাসিনী বরবর্ণিনী ভৃগুর ভার্য্যা হয়, তবে বল, আমি আশ্রম হইতে ইহাকে অপহরণ করিব। ভৃগু যে আমার পূর্ব্বপ্রার্থিত সুরূপা রমণীর প্রাণীগ্রহণ করিয়াছে, সেই ক্রোধাগ্নিতে আমার হৃদয় অদ্যাপি দগ্ধ হইতেছে।" দুরাত্মা রাক্ষস ভৃগু-পত্নী-বিষয়ে এই রূপ সন্দিগ্ধচিত্ত হইয়া প্রজ্বলিত অগ্নিকে আমন্ত্রণ করিয়া পুনঃপুনঃ জিজ্ঞাসিতে লাগিল। পরে সম্বোধন করিয়া কহিল, "হে হুতবহ! তুমি সর্ব্বদা সর্ব্বজীবের অন্তরে পাপ-পুণ্যের সাক্ষিস্বরূপ অবস্থিতি কর, অতএব তোমাকে জিজ্ঞাসিতেছি, সত্য করিয়া বল, পাপিষ্ঠ ভৃগু আমার পূর্ব্বপ্রার্থিত ভার্য্যাকে গ্রহণ করিয়াছে, সেই কামিনী আমার হইতে পারে কি না? তোমার নিকট ইহার যথার্থ শ্রবণ করিয়া তোমার সাক্ষাতেই এই ভৃগুপত্নীকে হরণ করিব।" অগ্নি রাক্ষসের জিজ্ঞাসানন্তর একপক্ষে মিথ্যাকথন ও পক্ষান্তরে ভৃগুশাপ এই উভয় সঙ্কটে পতিত হইয়া অতিশয় ভীত হইলেন এবং মৃদুস্বরে কহিতে লাগিলেন,
হে দানব-তনয়! পূর্ব্বে তুমি ইঁহাকে বরণ করিয়াছিলে যথার্থ বটে; কিন্তু তোমার যথাবিধি বিবাহ করা হয় নাই। এই নিমিত্ত যশস্বিনী পুলোমার পিতা সৎপাত্রলাভে  ইঁহাকে ভৃগুর হস্তে সমর্পণ করেন। মহাতপা ভৃগু বেদবিধিপূর্ব্বক আমার সমক্ষে ইঁহার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন। তথাপি তুমি ইঁহাকে পূর্ব্বে বরণ করিয়াছিলে বলিয়া ইনি বিচারমতে তোমারই পত্নী হইতে পারেন। আমি মিথ্যা কহিতে পারি না, যেহেতু মিথ্যাবাদী সর্ব্বত্র অনাদরণীয় হয়।


Share:

মহাভারত (আদিপর্ব তৃতীয় অধ্যায়)

তৃতীয় অধ্যায়
পৌষ্যপর্ব্ব-জনমেজয় শাপ
    উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, কুরুক্ষেত্রে পরীক্ষিতপুৎত্র রাজা জনমেজয় ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে এক দীর্ঘ-সত্র [দীর্ঘকালব্যাপী যজ্ঞ] অনুষ্ঠান করিতেছেন। তাঁহার তিন সহোদর  শ্রুতসেন, উগ্রসেন ও ভীমসেন। তাঁহাদিগের যজ্ঞানুষ্ঠানকালে একটা কুক্কুর তথায় উপস্থিত হইল। জনমেজয়ের ভ্রাতৃগণ ক্রোধান্ধ হইয়া তাহাকে প্রহার করিলে সে রোদন করিতে করিতে মাতৃসন্নিধানে গমন করিল। সরমা তাহাকে অকস্মাৎ রোদন করিতে দেখিয়া কহিল, "তুমি কেন কাঁদিতেছ? কে তোমাকে প্রহার করিয়াছে, বল।" জননী কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সে কহিল, "জনমেজয়ের ভ্রাতৃগণ আমাকে প্রহার করিয়াছেন।" তাহা শুনিয়া দেবশুনী কহিল, "বোধ হয়, তুমি তাঁহাদিগের কোন অপকার করিয়া থাকিবে।" সে পুনর্ব্বার কহিল, "আমি তাঁহাদিগের কিছুমাত্র অপকার করি নাই, যজ্ঞের হবিঃও নিরীক্ষণ করি নাই, তাঁহারা অকারণে আমাকে প্রহার করিয়াছেন।" তৎশ্রবণে সরমা অতি দুঃখিতা হইয়া যথায় জনমেজয় ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে বহুবার্ষিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেছেন, তথায় সমুপস্থিত হইয়া রোষভরে কহিতে লাগিল, "আমার পুৎত্র তোমাদিগের কিছুমাত্র অপকার করে নাই, যজ্ঞের হবিঃ অবেক্ষণ [দর্শন] ও অবলেহন করে নাই, তোমরা কি নিমিত্ত ইহাকে প্রহার করিয়াছ, বল?" তাঁহারা কিছুই প্রত্যুত্তর দিলেন না। তখন সরমা কহিল, "তোমরা নিরপরাধকে প্রহার করিয়াছ, অতত্রব অনুপলক্ষিত [অজ্ঞাত] ভয় তোমাদিগকে আক্রমণ করিবে।" জনমেজয় দেবশুনী সরমার এইরূপ অভিশাপ শ্রবণ করিয়া অতিশয় বিষণ্ণ ও সন্ত্রস্ত হইলেন।


                                                         সোমশ্রবা ঋষির উপাখ্যান

 অনন্তর সেই যজ্ঞ সমাপ্ত হইলে জনমেজয় হস্তিনাপুরে আগমন ও সরমাশাপ-নিবারণের নিমিত্ত সাতিশয় প্রযত্নসহকারে এক অনুরূপ পুরোহিত অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। একদা মৃগয়ায় নির্গত হইয়া জনমেজয় স্বীয় জনপদের অন্তর্গত এক আশ্রম দর্শন করিলেন। তথায় শ্রুতশ্রবাঃ নামক এক ঋষি বাস করিতেন। তাঁহার সোমশ্রবাঃ নামে এক পুৎত্র ছিল। জনমেজয় ঋষিপুৎত্রের সন্নিহিত হইয়া তাঁহাকে পৌরোহিত্যে বরণ করিলেন এবং ঋষিকে নমস্কার করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, "ভগবন্! আপনার এই পুৎত্র আমার পুরোহিত হউন।" রাজার এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়া শ্রুতশ্রবাঃ কহিলেন, "হে জনমেজয়! একদা এক সর্পী আমার শুক্র পান করিয়াছিল। ঐ শুক্রে তাহার গর্ভসঞ্চার হয়; আমার এই পুৎত্র ঐ গর্ভে জন্মেন। ইনি মহাতপস্বী, অধ্যয়ননিরত ও মদীয় তপোবীর্য্যে সম্ভূত। মহাদেবের অভিশাপ ব্যতিরেকে তোমার সমুদয় শাপশান্তি করিতে সমর্থ হইবেন। কিন্তু ইঁহার একটি নিগূঢ় ব্রত আছে যে, যদি কোন ব্রাহ্মণ ইঁহার সন্নিধানে কোন বিষয় প্রার্থনা করেন, ইনি তৎক্ষণাৎ তাহা প্রদান করিয়া থাকেন, যদি ইহাতে সাহস হয়, তবে ইঁহাকে লইয়া যাও।" শ্রুতশ্রবার এইরূপ কথা শুনিয়া জনমেজয় প্রত্যুত্তর করিলেন, "মহাশয়! আপনি যাহা অনুমতি করিতেছেন, আমি তাহাতে সম্মত আছি।" এই কথা কহিয়া পুরোহিত-সহ স্বনগরে প্রত্যাগমনকরতঃ ভ্রাতৃগণকে কহিলেন, "আমি এই মহাত্মাকে পৌরোহিত্যে বরণ করিয়াছি, ইনি যখন যাহা অনুজ্ঞা করিবেন, তোমরা তদ্বিষয়ে কোন বিচার না করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদন করিবে; কিছুতেই যেন তাহার ব্যতিক্রম না হয়। "সহোদরদিগকে এইরূপ আদেশ করিয়া তিনি তক্ষশিলায় প্রস্থান করিলেন ও অনতিবিলম্বেই সেই প্রদেশ আপন অধিকারে আনিলেন।


                                                        আয়োধধৌম্য ও আরুণিবৃত্তান্ত

    ইত্যবসরে প্রসঙ্গক্রমে একটি উপাখ্যানের উল্লেখ হইতেছে। আয়োধধৌম্য নামে এক ঋষি ছিলেন। উপমন্যু, আরুণি ও বেদ নামে তাঁহার তিনটি শিষ্য ছিল। তিনি একদিন পাঞ্চালদেশীয় আরুণি নামক শিষ্যকে আহ্বান করিয়া ক্ষেত্রের আলি বাঁধিতে অনুমতি করিলেন। আরুণি উপাধ্যায়ের উপদেশক্রমে ক্ষেত্রে গমন করিয়া অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়াও পরিশেষে আলি বাঁধিতে অশক্ত হইলেন। অগত্যা তথায় শয়ন করিয়া জলনির্গম নিবারণ করিলেন। কোন সময়ে উপাধ্যায় আয়োধধৌম্য শিষ্যগণকে জিজ্ঞাসিলেন, "পাঞ্চালদেশীয় আরুণি কোথায় গিয়াছে?" তাহারা কহিল, "ভগবন্! আপনি তাহাকে ক্ষেত্রের আলি বাঁধিতে প্রেরণ করিয়াছেন।" তাহা শ্রবণ করিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, "যথায় আরুণি গমন করিয়াছে, চল, আমরাও তথায় যাই।" অনন্তর সেই স্থানে গমন করিয়া উচ্চৈঃস্বরে এইরূপে তাঁহাকে আহ্বান করিতে লাগিলেন, "ভো বৎস আরুণি! কোথায় গিয়াছ, আইস।" তৎশ্রবণে আরুণি সহসা তথা হইতে উত্থিত ও উপাধ্যায়ের সন্নিহিত হইয়া অতি বিনীতবচনে নিবেদন করিলেন, "ক্ষেত্রের যে জল নিঃসৃত হইতেছিল, তাহা অবারণীয়; সুতরাং তৎপ্রতিরোধের নিমিত্ত আমি তথায় শয়ন করিয়াছিলাম। এক্ষণে আপনার কথা শ্রবণ করিয়া সহসা কেদার [ক্ষেতের আলি] খণ্ড বিদারণপূর্ব্বক আপনার সম্মুখীন হইলাম; অভিবাদন করি, আর কি অনুষ্ঠান করিব, অনুমতি করুন।" আরুণি এইরূপ কহিলে উপাধ্যায় উত্তর করিলেন, "বৎস! যেহেতু তুমি কেদারখণ্ড বিদারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছ, অতত্রব অদ্যাবধি তোমার নাম উদ্দালক বলিয়া প্রসিদ্ধ হইবে এবং আমার আজ্ঞাপালন করিয়াছ, এই নিমিত্ত তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে। সকল বেদ ও সকল ধর্ম্মশাস্ত্র সর্ব্বকালে সমভাবে তোমার অন্তরে প্রতিভাত হইবে।" পরে আরুণি উপাধ্যায়ের আদেশ লাভ করিয়া অভিলষিত দেশে গমন করিলেন।
                                             
                                                     উপমনযু-উপাখ্যান


    আয়োধধৌম্যের উপমন্যু নামে একটি শিষ্য ছিলেন। একদা উপাধ্যায় তাঁহাকে কহিলেন, "বৎস উপমন্যু! সতত সাবধানে আমার গোধন রক্ষা কর।" এই বলিয়া তাঁহাকে গোচারণে প্রেরণ করিলেন। উপমন্যু তাঁহার অনুমতিক্রমে দিবাভাগে গোচারণ করিয়া সায়াহ্নে গুরুগৃহে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান থাকিতেন। একদিন উপাধ্যায় তাঁহাকে স্থূলকায় দেখিয়া কহিলেন, "বৎস উপমন্যু! তোমাকে ক্রমশঃ অতিশয় হৃষ্ট-পুষ্ট দেখিতেছি, এক্ষণে কিরূপ আহার করিয়া থাক, বল।" তিনি উত্তর করিলেন, "ভগবন্! আমি এক্ষণে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছি।" তাহা শ্রবণ করিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, "দেখ, আমাকে না জানাইয়া ভিক্ষালব্ধ দ্রব্যজাত উপযোগ [ভক্ষণ] করা তোমার বিধেয় নহে। "উপমন্যু তাহাই স্বীকার করিয়া ভিক্ষান্ন আহরণপূর্ব্বক গুরুকে প্রত্যর্পণ করিলেন; উপাধ্যায় সমস্ত ভিক্ষান্ন গ্রহণ করিলেন; ভক্ষণার্থ তাঁহাকে কিছুই দিলেন না। অনন্তর উপমন্যু দিবাভাগে গো-রক্ষা করিয়া সায়াহ্নে গুরুগৃহে আগমন ও তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া নমস্কার করিলেন। উপাধ্যায় তাঁহাকে অত্যন্ত পুষ্ট দেখিয়া কহিলেন, "বৎস উপমন্যু! তোমার ভিক্ষান্ন সমুদয়ই গ্রহণ করিয়া থাকি, তথাপি তোমাকে অতিশয় স্থূলকায় দেখিতেছি, এক্ষণে কি আহার করিয়া থাক, বল।" তিনি এইরূপ অভিহিত হইয়া প্রত্যুত্তর করিলেন, "ভগবন্! একবার ভিক্ষা করিয়া আপনাকে প্রদান করি, দ্বিতীয়বার কয়েক মুষ্টি তণ্ডুল আহরণ করিয়া আপনার উদর পূরণ করিয়া থাকি।" উপাধ্যায় কহিলেন, "দেখ, ইহা ভদ্রলোকের ধর্ম্ম ও সমুচিত কর্ম্ম নহে। ইহাতে অন্যের বৃত্তিরোধ হইতেছে, আরও এইরূপ অনুষ্ঠান করিলে তুমিও ক্রমশঃ লোভপরায়ণ হইবে। "উপাধ্যায় কর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া উপমন্যু পূর্ব্ববৎ গোচারণ ও সায়ংকালে গুরুগৃহে আগমন করিলে উপাধ্যায় তাঁহাকে কহিলেন, "বৎস উপমন্যু! তুমি ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিয়া যে ভিক্ষান্ন আহরণ কর, তাহা আমি সম্পূর্ণই লইয়া থাকি এবং প্রতিষেধ করিয়াছি বলিয়া তুমিও দ্বিতীয়বার ভিক্ষা কর না; তথাপি তোমাকে পূর্ব্বাপেক্ষা সমধিক স্থূলকায় দেখিতেছি, এক্ষণে কি আহার করিয়া থাক, বল।" এইরূপ অভিহিত হইয়া উপমন্যু কহিলেন, "ভগবন্! এক্ষণে ধেনুগণের দুগ্ধ পান করিয়া প্রাণধারণ করিতেছি।" উপাধ্যায় কহিলেন, "দেখ, আমি তোমাকে অনুমতি করি নাই, সুতরাং ধেনুর দুগ্ধ পান করা তোমার অত্যন্ত অন্যায় হইতেছে।" গুরুবাক্য অঙ্গীকার করিয়া উপমন্যু পূর্ব্ববৎ গোচারণ ও গুরুগৃহে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া নমস্কার করিলেন। গুরু তাঁহাকে বিলক্ষণ স্থূল দেখিয়া কহিলেন, "বৎস উপমন্যু! তুমি ভিক্ষান্ন ভক্ষণ ও দ্বিতীয়বার ভিক্ষার্থ পর্য্যটন কর না এবং ধেনুর দুগ্ধ পান করিতেও তোমাকে নিবারণ করিয়াছি, তথাপি তোমাকে অতিশয় স্থূলকলেবর দেখিতেছি, এক্ষণে কি আহার করিয়া থাক, বল।" উপমন্যু কহিলেন, :বৎসগণ মাতৃস্তন পান করিয়া যে ফেন উদগার করে, আমি তাহা পান করি।" উপাধ্যায় কহিলেন, "অতি শান্তস্বভাব বৎসগণ তোমার প্রতি অনুকম্পা করিয়া অধিক পরিমাণে ফেন উদগার করিয়া থাকে, সুতরাং তুমি তাহাদিগের আহারের ব্যাঘাত করিতেছ। অতঃপর তোমার ফেন পান করাও বিধেয় নহে।" এইরূপ আদিষ্ট হইয়া উপমন্যু পূর্ব্ববৎ গোরক্ষা করিতে লাগিলেন।
    এইরূপে উপাধ্যায় কর্ত্তৃক প্রতিষিদ্ধ হইয়া তিনি আর ভিক্ষান্ন ভক্ষণ করিতেন না, দ্বিতীয়বার ভিক্ষার্থ পর্য্যটন করিতেন না, ধেনুর দুগ্ধপান ও দুগ্ধের ফেনোপযোগেও বিরত হইলেন। একদা তিনি অরণ্যে গোচারণে ক্ষুধার্ত্ত হইয়া অর্কপত্র ভক্ষণ করিলেন। সেই সকল ক্ষার, তিক্ত, কটু, রুক্ষ ও তীক্ষ্মবিপাক অর্কপত্র উপযোগ করাতে চক্ষুদোষ জন্মিয়া অন্ধ হইলেন; অন্ধ হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে করিতে এক কূপে নিপাতিত হইলেন।
    অনন্তর ভগবান্ দিনমণি অস্তাচল-চূড়াবলম্বী হইলে, উপাধ্যায় আয়োধধৌম্য শিষ্যদিগকে কহিলেন, "দেখ উপমন্যু এখনও আসিতেছে না।" শিষ্যেরা কহিলেন, "ভগবন্! উপমন্যুকে আপনি গোচারণের নিমিত্ত অরণ্যে প্রেরণ করিয়াছেন।" উপাধ্যায় কহিলেন, "দেখ, আমি উপমন্যুকে সর্ব্বপ্রকার আহার করিতে নিষেধ করিয়াছি, বোধ হয়, সে কুপিত হইয়াছে; এই নিমিত্ত প্রত্যাগত হইতেছে না। চল, আমরা গিয়া তাহার অনুসন্ধান করি।" এই বলিয়া শিষ্যগণ-সমভিব্যাহারে বন-গমনপূর্ব্বক "বৎস উপমন্যু! কোথায় গিয়াছ?" এই বলিয়া মুক্তকণ্ঠে তাহাকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। উপমন্যু উপাধ্যায়ের স্বরসংযোগ শ্রবণ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, "আমি কূপে পতিত হইয়াছি।" তাহা শ্রবণ করিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, "তুমি কিরূপে কূপে নিপতিত হইয়াছ?" তিনি প্রত্যুত্তর করিলেন, "আমি অর্কপত্র-ভক্ষণে অন্ধ হইয়া কূপে পতিত হইলাম।" উপাধ্যায় কহিলেন, "তুমি দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারের স্তব কর। তাহা হইলে তোমার চক্ষুলাভ হইবে।" উপমন্যু উপাধ্যায়ের উপদেশানুসারে বেদবাক্য দ্বারা অশ্বিনীকুমার দেবতাদ্বয়ের স্তব আরম্ভ করিলেন। "হে অশ্বিনীকুমার! তোমরা সৃষ্টির প্রারম্ভে বিদ্যমান ছিলে; তোমরাই সর্ব্বভূতপ্রধান হিরণ্যগর্ভরূপে উৎপন্ন হইয়াছ, পরে তোমরাই সংসারে প্রপঞ্চ [সংসার জীব] স্বরূপে প্রকাশমান হইয়াছ; দেশ, কাল ও অবস্থা দ্বারা তোমাদিগের ইয়ত্তা করা যায় না; তোমরাই মায়া ও মায়ারূঢ় চৈতন্যরূপে দ্যোতমান আছ; তোমরা শরীরবৃক্ষে পক্ষিরূপে অবস্থান করিতেছ; তোমরা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় পরমাণুসমষ্টি ও প্রকৃতির সহযোগিতার আবশ্যকতা রাখ না; তোমরা বাক্য ও মনের অগোচর; তোমরাই স্বীয় প্রকৃতির বিক্ষেপশক্তি দ্বারা নিখিল বিশ্বকে সুপ্রকাশ করিয়াছ। এক্ষণে আমি নির্ব্ব্যাধি হইবার জন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন [প্রগাঢ় চিন্তা] দ্বারা তোমাদিগের আরাধনা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। তোমরা পরম রমণীয় ও নির্লিপ্ত, বিলীন জগতের অধিষ্ঠানভূত, মায়াবিকার-রহিত এবং জন্মমৃত্যু বিবর্জ্জিত; তোমরা সর্ব্বকাল সমভাবে বিরাজমান আছ; তোমরা ভাস্কর সৃষ্টি করিয়া দিনযামিনীরূপ শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ সূত্র দ্বারা সংবৎসররূপ বস্ত্র বয়ন করিতেছ; তোমরা জীবদিগকে সুবিহিত পথ সতত প্রদর্শন কর; তোমরা পরমাত্মশক্তিরূপ কালপাশ হইতে বিমুক্ত করিয়া জীবাত্ম-স্বরূপ পক্ষিণীকে মোক্ষরূপ সৌভাগ্যশালিনী করিয়াছ। জীবেরা যাবৎ অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন থাকিয়া নিরবচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয়-পরতন্ত্র থাকে, তাবৎ তাহারা সর্ব্বদোষ-স্পর্শশূন্য চৈতন্যস্বরূপ তোমাদিগকে শরীরী বলিয়া ভাবনা করে। ত্রিশতষষ্টি দিবস-স্বরূপ গোসকল সংবৎসররূপ যে বৎস উৎপাদন করে, তত্ত্বজিজ্ঞাসুরা ঐ বৎসকে আশ্রয় করিয়া পৃথক ফলক্রিয়াসমূহরূপ গো হইতে তত্ত্বজ্ঞানস্বরূপ দুগ্ধ দোহন করেন; উৎপাদক ও সংহারক সেই বৎসকে তোমরাই প্রসব করিয়াছ। অহোরাত্রস্বরূপ সপ্তশতবিংশতি অর [চক্রমধ্যস্থ কাষ্ঠ] সংবৎসররূপ নাভিতে [চাকার হাঁড়ী] সংস্থিত এবং দ্বাদশমাসরূপ প্রধি [রথচক্রের প্রান্ত] দ্বারা পরিবেষ্টিত যুষ্মৎ-প্রকাশিত নেমিশূন্য মায়াত্মক অক্ষয় কালচক্র নিরন্তর পরিবর্ত্তিত হইতেছে। দ্বাদশ রাশিরূপ অর, ছয় ঋতুস্বরূপ নাভি ও সংবৎসররূপ অক্ষ [চক্রের মধ্যমণ্ডল]-সংযুক্ত এবং ধর্ম্মফলের আধারভূত একখানি চক্র আছে, যাহাতে কালাভিমানিনী দেবতা সতত অবস্থিত আছেন। হে অশ্বিনীকুমার যুগল! তোমরা ঐ চক্র হইতে আমাকে মুক্ত কর, আমি জন্ম মরণ ক্লেশে অতিশয় ক্লিষ্ট আছি। তোমরা সনাতন ব্রহ্ম হইয়াও জড়স্বভাব বিশ্বস্বরূপ; তোমরাই কর্ম্ম ও কর্ম্মফল স্বরূপ। আকাশাদি সমস্ত জড়পদার্থ তোমাদের স্বরূপে লয়প্রাপ্ত হয়, তোমরাই অবিদ্যাপ্রভাবে তত্ত্বজ্ঞান উপার্জ্জন করিতে বিমুখ হইয়াও বিষম-বিষয়-রসাস্বাদ-সুখভোগ দ্বারা ইন্দ্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ করিয়া সংসার-মায়াজালে জড়িত হও। তোমরা সৃষ্টির পূর্ব্বে দশদিক্ আকাশ ও সূর্য্যমণ্ডলের উদ্ভাবন করিয়াছ; মহর্ষিগণ সূর্য্য-বিহিত সময়ানুসারে বেদ-প্রতিপাদ্য কার্য্যকলাপ নির্ব্বাহ করেন এবং নিখিল দেবগণ ও মনুষ্যেরা বিবিধ ঐশ্বর্য্য ভোগ করেন। তোমরা আকাশাদি সূক্ষ্ম পঞ্চভূত সৃষ্টি করিয়া তাহাদের পঞ্চীকরণ করিয়াছ, সেই পঞ্চভূত হইতে অখিল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হইয়াছে, প্রাণিগণ ইন্দ্রিয়পরবশ হইয়া বিষয়ানুরক্ত হইতেছে এবং নিখিল দেবগণ ও সমগ্র মনুষ্য অধিষ্ঠানভূতা এই পৃথিবীতে অধিষ্ঠত আছে। তোমাদিগকে ও তোমাদের কণ্ঠদেশাবলম্বিত কমলমালিকাকে প্রণাম করি। নিত্যযুক্ত কর্ম্মফলদাতা অশ্বিনীকুমারযুগলের সাহায্য বিনা অন্যান্য দেবগণ স্বকীয় কার্য্যসাধনে সক্ষম নহেন। হে অশ্বিনীকুমার! তোমরা অগ্রে মুখ দ্বারা অন্নরূপ গর্ভ গ্রহণ কর, পরে অচেতন দেহ ইন্দ্রিয় দ্বারা সেই গর্ভ প্রসব করে। ঐ গর্ভ প্রসূতমাত্র মাতৃস্তন্যপানে নিযুক্ত হয়। এক্ষণে তোমরা আমার চক্ষুর্দ্বয়ের অন্ধত্ব মোচন করিয়া প্রাণরক্ষা কর।" অশ্বিনীকুমারযুগল উপমন্যুর এইরূপ স্তবে সন্তুষ্ট হইয়া তথায় আবির্ভূত হইলেন এবং কহিলেন, "আমরা তোমার প্রতি অতিশয় প্রসন্ন হইয়াছি, অতএব তোমাকে এক পিষ্টক দিতেছি, ভক্ষণ কর।" এইরূপ আদিষ্ট হইয়া তিনি কহিলেন, "আপনাদিগের কথা অবহেলন করিবার যোগ্য নয়; কিন্তু আমি গুরুকে নিবেদন না করিয়া অপূপ [পিষ্টক] ভক্ষণ করিতে পারি না।" তখন অশ্বিনীতনয়দ্বয় কহিলেন "পূর্ব্বে তোমার উপাধ্যায় আমাদিগকে স্তব করিয়াছিলেন। আমরা তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া এক পিষ্টক দিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি গুরুর আদেশ না লইয়া তাহা উপযোগ করেন; অতএব তোমার উপাধ্যায় যেরূপ করিয়াছিলেন, তুমিও সেইরূপ কর।" এইরূপ অভিহিত হইয়া উপমন্যু কহিলেন, "আপনাদিগকে অনুনয় করিতেছি, আমি গুরুকে নিবেদন না করিয়া অপূপভক্ষণ করিতে পারিব না।" অশ্বিনীকুমার কহিলেন, "তোমার এই প্রকার অসাধারণ গুরুভক্তি দর্শনে আমরা অতিশয় প্রসন্ন হইলাম, তোমার উপাধ্যায়ের সন্ত-সকল লৌহময়, তোমারও হিরণ্‌ময় হইবে এবং তুমি চক্ষু ও শ্রেয়োলাভ করিবে।" উপমন্যু অশ্বিনীকুমারের বরদান-প্রভাবে পূর্ব্ববৎ চক্ষুরত্ন লাভ করিয়া গুরু-সন্নিধানে গমন ও অভিবাদনপূর্ব্বক আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত প্রীত হইলেন এবং কহিলেন, "অশ্বিনীতনয়েরা যেরূপ কহিয়াছেন, তুমিও সেইরূপ মঙ্গললাভ করিবে, সকল বেদ ও সকল ধর্ম্মশাস্ত্র সর্ব্বকাল তোমার স্মৃতিপথে থাকিবে।" উপমন্যুর এই পরীক্ষা হইল।
                         
                                                   বেদ ঋষি-উতঙ্ক-বৃত্তান্ত





    আয়োধধৌম্যের বেদ নামে অপর একটি শিষ্য ছিলেন। একদা উপাধ্যায় তাঁহাকে আদেশ করিলেন, "বৎস বেদ, তুমি আমার গৃহে থাকিয়া কিছুকাল শুশ্রূষা কর, তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে।" বেদ তদীয় বাক্য শিরোধারণপূর্ব্বক গুরুশুশ্রূষায় রত হইয়া বহুকাল গুরুগৃহে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। গুরু যখন যাহা নিয়োগ করিতেন, তিনি শীত, উত্তাপ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি অশেষ ক্লেশ গণনা না করিয়া ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে তৎক্ষণাৎ তাহা অনুষ্ঠান করিতেন; কখন কোন বিষয়ে অবহেলা করিতেন না। এইরূপে বহুকাল অতীত হইলে উপাধ্যায় তাঁহার প্রতি অতি প্রীত ও প্রসন্ন হইলেন। তখন বেদ গুরুর প্রসাদে শ্রেয়ঃ ও সর্ব্বজ্ঞতা লাভ করিলেন। বেদের এই পরীক্ষা হইল।
    অনন্তর বেদ উপাধ্যায়ের অনুমতিক্রমে গুরুকুল হইলে প্রত্যাগত হইয়া গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করিলেন। ঐ আশ্রমে অবস্থানকালে তাঁহারও তিনটি শিষ্য হইল। বেদ শিষ্যদিগকে কোন কর্ম্মে নিয়োগ বা আত্মশুশ্রূষা করিতে আদেশ করিতেন না। কারণ, গুরুকুলবাসের দুঃখ তাঁহার মনোমধ্যে সতত জাগরূক ছিল। এই নিমিত্ত তিনি শিষ্যগণকে ক্লেশ দিতে পরাঙ্মুখ হইলেন।
    কিয়ৎকাল পরে রাজা জনমেজয় ও পৌষ্য-নামক অপর এক ভূপাল বেদের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে উপাধ্যায় রূপে বরণ করিলেন। একদা তিনি যাজনকার্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে প্রস্থান করিবার কালে উতঙ্ক-নামক শিষ্যকে আদেশ করিলেন, "বৎস! আমার অবস্থানকালে মদীয় গৃহে যে-কোন বিষয়ের অসদ্ভাব হইবে, তাহা তুমি তৎক্ষণাৎ সম্পন্ন করিবে।" উতঙ্ককে এইরূপ আদেশ দিয়া বেদ প্রবাসে গমন করিলেন। উতঙ্ক গুরুকুলে বাস করিয়া গুরুর অনুজ্ঞা পালন করিতে লাগিলেন।
    একদিন উপাধ্যায়পত্নীরা উতঙ্ককে আহ্বান করিয়া কহিলেন, "তোমার উপাধ্যায়ানী ঋতুমতী হইয়াছেন। এ সময় তোমার গুরু গৃহে নাই। যাহাতে তাঁহার ঋতু ফলহীন না হয়, তুমি তাহা কর, কাল অতিক্রান্ত হইয়াছে।" উতঙ্ক এতাদৃশ অসঙ্গত কথা শুনিয়া কহিলেন, "আমি স্ত্রীলোকের কথায় এরূপ কুকর্ম্মে কদাচ প্রবৃত্ত হইতে পারি না এবং গুরু আমাকে অন্যায় আচরণ করিতে কহিয়া যান নাই।" কিয়ৎকাল পরে উপাধ্যায় প্রবাস হইতে গৃহে আগমন করিয়া উতঙ্কের সুচরিত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত প্রসন্ন হইলেন এবং তাহাকে কহিলেন, "বৎস উতঙ্ক! তোমার কি প্রিয়কার্য্য অনুষ্ঠান করিব, বল? তুমি ধর্ম্মতঃ আমার শুশ্রূষা করিয়াছ, তাহাতে আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি অতএব এক্ষণে তোমাকে অনুজ্ঞা করিতেছি, তোমার সকল মনোরথ সফল হউক; গমন কর।" গুরু কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া উতঙ্ক কহিলেন, "ভগবন্! আমি দক্ষিণা দিতে প্রার্থনা করি। কারণ, এইরূপ শ্রুতি আছে যে, যিনি দক্ষিণা গ্রহণ না করিয়া শিক্ষাদান করেন ও যে ব্যক্তি দক্ষিণা না দিয়া অধ্যয়ন করে, তাহাদের মধ্যে একজন মৃত্যু বা বিদ্বেষ প্রাপ্ত হয়। অনুমতি করিলে আপনার ইচ্ছানুরূপ দক্ষিণা আহরণ করি।" উপাধ্যায় কহিলেন, "বৎস উতঙ্ক! অবসর ক্রমে আদেশ করিব।" উতঙ্ক আর একদিন গুরুকে নিবেদন করিলেন, "মহাশয়, আজ্ঞা করুন, কিরূপ দক্ষিণা আপনার অভিমত, তাহা আহরণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে।" তাহা শুনিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, "বৎস উতঙ্ক! গুরুদক্ষিণা আহরণ করিবে বলিয়া আমাকে বারংবার জিজ্ঞাসা করিয়া থাক, অতত্রব তোমার উপাধ্যায়ানীকে বল, তাঁহার যাহা অভিরুচি, সেইরূপ গুরুদক্ষিণা আহরণ কর।" উতঙ্ক উপাধ্যায়ের উপদেশক্রমে গুরু-পত্নী সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, "মাতঃ! গৃহে যাইতে উপাধ্যায় আমাকে অনুমতি করিয়াছেন, এক্ষণে আপনার অভিলষিত গুরুদক্ষিণা দিয়া ঋণমুক্ত হইতে বাসনা করি। বলুন, কি দক্ষিণা আপনার অভিপ্রেত?" উপাধ্যায়ানী কহিলেন, "বৎস! পৌষ্যরাজের ধর্ম্মপত্নী যে কুণ্ডলদ্বয় ধারণ করিয়া আছেন, তাহা আনয়ন করিয়া আমাকে প্রদান কর। আগামী চতুর্থ দিবসে এক ব্রত উপলক্ষে মহা সমারোহ হইবে, সেইদিন ঐ দুই কুণ্ডল ধারণ করিয়া নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদিগের পরিবেশন করিব; অতএব তুমি সত্বর গমন কর, ইহা করিতে পারিলে তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে, অন্যথা মঙ্গল হওয়া সুকঠিন।"
    উতঙ্ক এইরূপ অভিহিত হইয়া প্রস্থান করিলেন। গমন করিতে করিতে পথিমধ্যে অতি বৃহৎ এক বৃষ দেখিলেন। ঐ বৃষে বৃহৎকায় এক পুরুষ আরোহণ করিয়াছিলেন। তিনি উতঙ্ককে আহ্বান করিয়া কহিলেন, "ওহে উতঙ্ক! তুমি এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ কর।" উতঙ্ক তাহাতে অসম্মত হইলেন। তখন ঐ পুরুষ পুনর্ব্বার তাঁহাকে কহিলেন, "উতঙ্ক! তুমি মনোমধ্যে কোনপ্রকার বিচার না করিয়া এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ কর, পূর্ব্বে তোমার উপধ্যায় ইহার পুরীষ ভক্ষণ করিয়াছিলেন।" তখন উতঙ্ক ঐ কথায় স্বীকার করিয়া সেই বৃষের মূত্র ও পুরীষ ভক্ষণ করিলেন। অনন্তর সত্বর আচমন করিতে করিতে সসম্ভ্রমে প্রস্থান করিলেন এবং আসনাসীন পৌষ্যের সন্নিধানে গমন করিয়া আশীর্ব্বাদ-প্রয়োগ-পুরঃসর কহিলেন, "মহারাজ! আমি অর্থিভাবে আপনার নিকট অভ্যাগত হইয়াছি।" রাজা তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া কহিলেন, "ভগবন্! এই কিঙ্কর আপনার কি উপকার করিবে, বলুন। "উতঙ্ক কহিলেন, "মহারাজ! আপনার মহিষী যে কুণ্ডলদ্বয় ধারণ করেন, গুরুদক্ষিণা-প্রদান-বাসনায় আপনার নিকট আমি তাহা প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি।" পৌষ্য কহিলেন, "মহাশয়! অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া আমার সহধর্ম্মিণীর নিকট উহা যাচ্ঞা করুন।" উতঙ্ক তাঁহার আদেশানুসারে অন্তঃপুরে গমন করিয়া রাজ-মহিষীকে দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি পুনর্ব্বার পৌষ্যের নিকট আসিয়া কহিলেন, "মহারাজ। আমার প্রতি এরূপ মিথ্যা আচরণ করা আপনার উচিত হয় নাই। অনেক অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু অন্তঃপুরে আপনার মহিষীকে দেখিতে পাইলাম না।" পৌষ্য ক্ষণকাল বিবেচনা করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, "মহাশয়! বোধ হয়, আপনি অশুচি আছেন, মনে করিয়া দেখুন। আমার গৃহিণী অতি পতিব্রতা, অপবিত্র থাকিলে কেহই তাঁহার সন্দর্শন পায় না।" এইরূপ অভিহিত হইলে উতঙ্ক সমুদয় স্মরণ করিয়া কহিলেন, "আমি বৃষ-পুরীষ ভক্ষণান্তর সত্বরে উত্থিত হইয়া গমনকালে আচমন করিয়াছিলাম।" পৌষ্য প্রত্যুত্তর করিলেন, "মহাশয়! আপনার ইহাই ব্যাতিক্রম হইয়াছে। উত্থানাবস্থায় ও গমনকালে আচমন করা আর না করা উভয়ই তুল্য।" তখন উতঙ্ক প্রাঙ্মুখে উপবেশন এবং করচরণ ও বদন প্রক্ষালন পূর্ব্বক নিঃশব্দ, অফেন, অনুষ্ণ ও হৃদয়দেশ পর্য্যন্ত গমন করিতে পারে, এইরূপ পরিমাণে জল তিনবার আচমনপূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন এবং রাজমহিষীকে দেখিতে পাইলেন। রাজমহিষী তাঁহার দর্শনমাত্রে সত্বরে উত্থিত হইয়া অভিবাদন করিলেন এবং স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন, "ভগবন্! এ কিঙ্করী আপনার কি করিবে, আজ্ঞা করুন?" উতঙ্ক কহিলেন, "গুরুদক্ষিণা প্রদান করিবার নিমিত্ত তোমার নিকট কুণ্ডলদ্বয় ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি, আমাকে তাহা দান কর।" রাজমহিষী তাঁহার তাদৃশ প্রার্থনায় প্রীতা ও প্রসন্না হইয়া সৎপাত্র বোধে তৎক্ষণাৎ কর্ণ হইতে উন্মোচনপূর্ব্বক কুণ্ডলদ্বয় তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং কহিলেন, "নাগরাজ তক্ষক আগ্রহাতিশয়সহকারে ইহা প্রার্থনা করেন। অতত্রব সাবধান হইয়া লইয়া যাউন।" উতঙ্ক কহিলেন, "তুমি কোনরূপ আশঙ্কা করিও না। নিশ্চয় কহিতেছি, তক্ষক আমার কিছুই করিতে পারিবে না।"
    উতঙ্ক ইহা কহিয়া সমুচিত সংবর্দ্ধনাপূর্ব্বক তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া পৌষ্য-সকাশে গমন করিলেন এবং কহিলেন, "মহারাজ! অভিলষিত-ফললাভে আমি অতিশয় প্রীত হইয়াছি। "অনন্তর পৌষ্য কহিলেন, "ভগবন্! সকল সময় সুপাত্র-সমাগম হয় না। আপনি গুণবান্ অতিথি উপস্থিত হইয়াছেন। ইচ্ছা হয়, আতিথ্য করি, অতএব কাল-নির্দ্দেশ করুন।" উতঙ্ক প্রত্যুত্তর করিলেন, "আমি এক্ষণেই প্রস্তুত আছি, আপনি অন্ন আনয়ন করুন।" রাজা তদীয় আদেশানুসারে অন্ন উপস্থিত করিয়া তাঁহাকে উপযোগ করিতে দিলেন। তিনি তাহা শীতল ও কেশসংস্পর্শে অশুচি দেখিয়া কহিলেন, "তুমি আমাকে দূষিত অন্ন ভোজন করিতে দিয়াছ, অতএব অন্ধ হইবে।" পৌষ্য এইরূপ অভিশাপ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, "তুমি অদূষিত অন্নে দোষারোপ করিলে, অতএব তোমারও বংশলোপ হইবে।" তখন উতঙ্ক কহিলেন, "দেখ তুমি অশুচি অন্ন ভোজন করিতে দিয়া পুনর্ব্বার প্রতিশাপ প্রদান করিতেছ, ইহা তোমার সমুচিত কর্ম্ম হইল না, বরং তুমি অন্নের দোষ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ কর।" পৌষ্য অন্নের অশুচিত্ব স্পষ্টই দেখিতে পাইলেন। পরে উতঙ্ককে বিনয়বাক্যে কহিলেন, "ভগবন্! আমি সবিশেষ না জানিতে পারিয়া এই অশুচি অন্ন আহরণ করিয়াছিলাম, এক্ষণে আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। আপনি প্রসন্ন হইয়া যাহাতে আমি অন্ধ না হই, এইরূপ অনুগ্রহ করুন।"
    তখন উতঙ্ক প্রত্যুত্তর করিলেন, "দেখ, আমার বাক্য মিথ্যা হইবার নহে, সুতরাং একবার অন্ধ ও অনতিবিলম্বে চক্ষুষ্মান্ হইবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু তুমি যে শাপ দিয়াছ, তাহা হইতে আমাকে মুক্ত কর।" পৌষ্য কহিলেন, "এখনও আমার ক্রোধের উপশম হয় নাই; অতএব শাপ প্রতিসংহার করিতে পারি না। আর আপনি কি জানেন না যে, ব্রাহ্মণের হৃদয় নবনীতের ন্যায় সুকোমল ও বাক্য খরধার ক্ষুরের ন্যায় নিতান্ত তীক্ষ্ম; ক্ষৎত্রিয়দিগের উভয়ই বিপরীত অর্থাৎ তাহাদিগের বাক্য নবনীতবৎ কোমল ও হৃদয় ক্ষুরধার-তুল্য সুতীক্ষ্ম; সুতরাং আমি স্বভাবসুলভ তীক্ষ্মভাব-প্রযুক্ত এক্ষণে প্রদত্ত শাপের অন্যথা করিতে পারি না।" উতঙ্ক কহিলেন, "আমি অদূষিত অন্নে দোষারোপ করিয়া তোমাকে অভিসম্পাত করিয়াছি, এই ভাবিয়া তুমি আমাকে প্রতিশাপ প্রদান করিয়াছিলে। এক্ষণে অন্নের দোষ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া অনুনয়-বিনয় পূর্ব্বক আমাকে প্রসন্ন করিলে এবং শাপ বিমোচন করিয়া লইলে; কিন্তু তুমি যে শাপ দিয়াছ, তাহা মোচন করিতে চাহিতেছ না। এই প্রবঞ্চনা-প্রযুক্ত সে শাপ আমাকে লাগিবে না; আমি চলিলাম।" এই বলিয়া কুণ্ডলদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
    পথিমধ্যে দেখিলেন, এক নগ্ন ক্ষপণক [বৌদ্ধ ভিক্ষুক-ন্যাঙটা ভিখারী] আসিতেছে; কিন্তু সে মধ্যে মধ্যে অদৃশ্য হইতেছে। উতঙ্ক সেই সময়ে পৌষ্য-মহিষীদত্ত কুণ্ডলদ্বয় ভূতলে রাখিয়া স্নানতর্পণাদির নিমিত্ত সরোবরে গমন করিলেন। ইত্যবসরে-ক্ষপণক নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সত্বর তথায় আগমন ও কুণ্ডলদ্বয় অপহরণ করিয়া পলায়ন করিল। উতঙ্ক স্নানাহ্নিক-সমাপনানন্তর অতি পূতমনে দেবতা ও গুরুকে প্রণাম করিয়া প্রবলবেগে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তিনি সেই ক্ষপণকের সন্নিকৃষ্ট হইবামাত্র সে ক্ষপণকরূপ পরিহারপূর্ব্বক তক্ষকরূপ পরিগ্রহ করিল এবং অকস্মাৎ ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ হইয়া তাহার সম্মুখে এক মহাগর্ত্ত সমুৎপন্ন হইল। তক্ষক সেই মহাগর্ত্ত দিয়া নাগলোকস্থ স্বীয়ভবনে গমন করিলেন। তখন উতঙ্ক পৌষ্য-মহিষীর কথা স্মরণ করিয়া প্রাণপণে তক্ষকের অনুসরণে যত্নবান হইলেন এবং প্রবেশদ্বার বিস্তার করিবার নিমিত্ত দণ্ডকাষ্ঠ দ্বারা খনন করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহাকে কষ্টভোগ করিতে দেখিয়া স্বীয় বজ্রাস্ত্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, "বজ্র! তুমি যাইয়া এই ব্রাহ্মণের সাহায্য কর।" বজ্র প্রভুর আদেশক্রমে তদ্দণ্ডে দণ্ডকাষ্ঠে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া গর্ত্তদ্বার বিস্তীর্ণ করিল। উতঙ্ক তদ্দ্বারা রসাতলে প্রবেশ করিলেন। তিনি এইরূপে নাগলোকে প্রবেশ করিয়া বহুবিধ প্রাসাদ, হর্ম্ম্য, বলভী ও নানাবিধ ক্রীড়াকৌতুকের রমণীয় স্থান অবলোকন করিলেন এবং বক্ষ্যমাণ প্রকারে নাগগণের স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন।
    "ঐরাবত যে-সকল সর্পের অধিরাজ এবং যাঁহারা যুদ্ধে অতিশয় শোভমান, সৌদামিনী সহকৃত পবনচালিত মেঘমালার ন্যায় বেগবান্ সেই সকল সর্পদিগকে স্তব করি। ঐরাবত সম্ভূত অন্যান্য সুরূপ ও বহুরূপ বিচিত্র কুণ্ডলধারী সর্প, যাঁহারা প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় অমরলোকে নিরবচ্ছিন্ন বিরাজমান আছেন এবং ভাগীরথীর উত্তর তীরে যে-সকল নাগের বাসস্থান আছে, সেই সকল সুমহৎ পন্নগদিগকেও স্তব করি। ঐরাবত ব্যতিরেকে আর কে সূর্য্যকিরণে বিচরণ করিতে পারে? যখন ধৃতরাষ্ট্র সর্প গমন করেন, তৎকালে বিংশতিসহস্র অষ্টশত অশীতি সর্প তাঁহার অনুসরণ করেন। যাঁহারা ধৃতরাষ্ট্রের সমভিব্যাহারে গমন করেন ও যাঁহারা অতিদূরে বাস করেন, সেই সমস্ত ঐরাবতের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদিগকে নমস্কার করি। পূর্ব্বে খাণ্ডবপ্রস্থে ও কুরুক্ষেত্রে যাঁহার বাসস্থান ছিল, কুণ্ডলের নিমিত্ত সেই নাগরাজ তক্ষককে স্তব করি। তক্ষক ও অশ্বসেন এই উভয়ে নিত্যকাল সহচর হইয়া স্রোতস্বতী ইক্ষুমতীতীরে সতত বাস করিতেন। মহাত্মা তক্ষকের কনিষ্ঠ পুৎত্র শ্রুতসেন, যিনি সর্ব্বনাগের আধিপত্য লাভ করিবার প্রত্যাশায় কুরুক্ষেত্রে বাস করিয়াছিলেন, তাঁহাকেও নমস্কার করি।"
    উতঙ্ক এইরূপে সর্পদিগকে স্তব করিয়াও যখন কুণ্ডলদ্বয় লাভ করিতে পারিলেন না, তখন অত্যন্ত চিন্তিত হইলেন এবং ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, দুইটি স্ত্রীলোক সুচারু বাপদণ্ডযুক্ত তন্ত্রে [তাঁতে] বস্ত্র বয়ন করিতেছে। সেই তন্ত্রের সুত্রসকল শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ এবং দেখিলেন, দ্বাদশ অর-যুক্ত একখানি চক্র ছয়টি শিশু কর্ত্তৃক পরিবর্ত্তিত হইতেছে। আর একজন পুরুষ ও অতি মনোহর একটি অশ্ব নিরীক্ষণ করিলেন। এইরূপ অবলোকন করিয়া তিনি তাঁহাদিগকেও স্তব করিতে লাগিলেন।
    "সতত ভ্রাম্যমাণ চতুর্ব্বিংশতি পর্ব্বযুক্ত এই চক্রে তিনশত ষষ্টি তন্তু সমর্পিত আছে। ইহাকে ছয় জন কুমার পরিবর্ত্তিত করিতেছে। বিশ্বরূপ দুই যুবতী শুক্ল ও কৃষ্ণ সূত্র দ্বারা এই তন্ত্রে বস্ত্র বয়ন করিতেছেন। এই দুই যুবতী সমস্ত প্রাণী ও চতুর্দ্দশ ভুবন উৎপাদন করেন। নিখিল ভুবনের রক্ষাকর্ত্তা, বৃত্রাসুর ও নমুচির হন্তা, বজ্রধর ইন্দ্র, যিনি সেই কৃষ্ণবর্ণ বসনযুগল পরিধান করিয়া ত্রিলোকে সত্য-মিথ্যা উভয়ই বিচার করেন, সেই ত্রিলোকীনাথ পুরন্দরকে নমস্কার করি।"
    অনন্তর সেই পুরুষ উতঙ্ককে কহিলেন, "তোমার এইরূপ স্তবে আমি অতিশয় র্প্রীত হইলাম, এক্ষণে কি উপকার করিব, বল?" উতঙ্ক কহিলেন, "ভগবন্! এই করুন, যেন সমস্ত নাগগণ আমার বশবর্ত্তী হয়।" তখন সেই পুরুষ কহিলেন, "ভাল, তুমি এই অশ্বের অপান [গুহ্যদেশ]-দেশে ফুৎকার প্রদান কর।" তদীয় বাক্যানুসারে উতঙ্ক অশ্বের অপানদেশে ফুৎকার প্রদান করিলে তাহার শরীর প্রধূমিত হইয়া উঠিল এবং ইন্দ্রিয়রন্ধ্র হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সকল নির্গত হইতে লাগিল। তদ্দ্বারা নাগলোক সাতিশয় সন্তপ্ত হইলে পর তক্ষক অগ্ন্যুৎপাতভয়ে ভীত ও ব্যাকুলিত হইয়া কুণ্ডলদ্বয়ের সহিত স্বীয় বাসভবন হইতে সহসা নিষ্ক্রান্ত হইলেন এবং উতঙ্ক-সমীপে আসিয়া কহিলেন, "আপনার এই কুণ্ডলদ্বয় গ্রহণ করুন।" উতঙ্ক কুণ্ডল লইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, "অদ্য ব্রতোপলক্ষে মহাসমারোহ হইবে, কিন্তু আমি অতিদূরে রহিলাম, অতএব এক্ষণে কিরূপে উপাধ্যায়ানীর মনোরথ সম্পূর্ণ হইবে?" পরে সেই পুরুষ উতঙ্ককে চিন্তাকুল দেখিয়া কহিলেন, "উতঙ্ক! তুমি আমার এই অশ্বে আরোহণ কর, অনতিবিলম্বেই গুরুকুলে উপস্থিত হইতে পারিবে। উতঙ্ক তাঁহার আদেশানুসারে অশ্বে অধিরূঢ় হইয়া ক্ষণকালমধ্যে গুরুগৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। তৎকালে তাঁহার উপাধ্যায়ানী স্নানপূজাদি সমাপনানন্তর কেশবিন্যাস করিতেছিলেন, তিনি উতঙ্কের বিলম্ব দেখিয়া অভিসম্পাত করিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে উতঙ্ক গুরুগৃহে প্রবেশপূর্ব্বক উপাধ্যায়ানীকে অভিবাদন করিয়া কুণ্ডল দিলেন। তিনি তাহা গ্রহণ করিয়া কহিলেন, "বৎস উতঙ্ক! ভাল আছ ত'? বৎস! তুমি ভাল সময়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ। আমি এখনই অকারণে তোমাকে শাপ দিলাম, ভাগ্যে দিই নাই। এক্ষণে আশীর্ব্বাদ করি, তুমি চিরকাল কুশলে থাক।"
    অনন্তর উতঙ্ক গুরুপত্নী সন্নিধানে বিদায় গ্রহণ করিয়া উপাধ্যায়ের নিকট উপস্থিত হইয়া প্রণাম করিলেন। উপাধ্যায় তাঁহাকে প্রত্যাগত দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "বৎস! ভাল আছ ত'? এত বিলম্ব হইল কেন?" উতঙ্ক প্রত্যুত্তর কহিলেন, "ভগবন্! নাগরাজ তক্ষক কুণ্ডলাহরণবিষয়ে অতিশয় বিঘ্ন করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত আমি নাগলোকে গমন করিয়াছিলাম। তথায় দেখিলাম, দুইটি স্ত্রীলোক কৃষ্ণ ও শুক্লবর্ণ সূত্র তন্ত্রে আরোপণ করিয়া বস্ত্র বয়ন করিতেছেন, তাহা কি? ছয়টি কুমার দ্বাদশ অরসংযুক্ত একখানি চক্র নিয়ত পরিবর্ত্তিত করিতেছে, তাহাই বা কি? এবং তথায় এক পুরুষ ও এক বৃহৎকায় অশ্ব দেখিলাম, তাহাই বা কি? আর পথিমধ্যে গমন করিতে করিতে এক বৃষ দেখিলাম, ঐ বৃষে এক পুরুষ আরোহণ করিয়া আছেন, তিনি আমাকে বৃষের পুরীষ ভক্ষণ করিতে অনুরোধ করিলেন এবং কহিলেন, 'পূর্ব্বে তোমার উপাধ্যায় এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ করিয়াছিলেন।' পরে তাঁহার নির্দ্দেশক্রমে আমি সেই বৃষের পুরীষ উপযোগ করিলাম, ঐ বৃষ ও বৃষাধিরূঢ় পুরুষই বা কে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া এই সমস্ত বর্ণনা করুন, আমি শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।"
    উতঙ্কের প্রার্থনায় উপাধ্যায় কহিলেন, "বৎস! তুমি যে দুইটি স্ত্রীলোক দেখিয়াছ, তাঁহারা পরমাত্মা ও জীবাত্মা। দ্বাদশ অর-সংযুক্ত যে চক্র দেখিয়াছ, উহা সংবৎসর। শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ যে-সকল তন্তু দেখিয়াছিলে, উহা দিবা রাত্রি। ছয়টি কুমার ছয় ঋতু। যে পুরুষ দেখিয়াছ, তিনি পর্জ্জন্য। আর অশ্বটি অগ্নি। পথিমধ্যে যে বৃষভ দেখিয়াছিলে, তিনি নাগরাজ ঐরাবত। আর ঐ অশ্বে যে পুরুষ আরোহণ করিয়াছিলেন, তিনি দেবরাজ ইন্দ্র। যে পুরীষ ভক্ষণ করিয়াছ, তাহা অমৃত। বৎস! সেই অমৃত ভক্ষণ করিয়াছিলে বলিয়াই নাগলোকে পরিত্রাণ পাইয়াছ। ভগবন্ ইন্দ্র আমার সখা, তিনি কৃপারসপরবশ হইয়া তোমাকে রক্ষা করিয়াছেন, নতুবা নাগলোক হইতে কুণ্ডল লইয়া আগমন করা দুষ্কর হইত। বৎস! এক্ষণে আমি তোমাকে অনুমতি করিতেছি, গৃহে গমন কর এবং তোমার শ্রেয়োলাভ হউক।"

                                                   জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ প্ররোচনা
    
উতঙ্ক উপাধ্যায়ের অনুজ্ঞালাভানন্তর তক্ষকের প্রতি জাতক্রোধ হইয়া তাহার প্রতীকার-সঙ্কল্পে হস্তিনাপুরে প্রস্থান করিলেন এবং অনতিকালবিলম্বে তথায় উপস্থিত হইয়া রাজা জনমেজয়ের সহিত সমাগত হইলেন। তৎকালে মহারাজ জনমেজয় অমাত্যগণে পরিবৃত হইয়া বসিয়া ছিলেন। উতঙ্ক অবসর বুঝিয়া রাজা জনমেজয়কে যথাবিধি আশীর্ব্বাদবিধানপূর্ব্বক কহিলেন, "মহারাজ! প্রকৃত কার্য্যে অনাস্থা করিয়া বালকের ন্যায় সামান্য কার্য্যে ব্যাপৃত রহিয়াছেন।"
    জনমেজয় তাঁহাকে যথোচিত সৎকার করিয়া কহিলেন, "হে দ্বিজোত্তম! আমি সুতনির্ব্বিশেষে প্রজাপালন করিয়া ক্ষৎত্রিয়ধর্ম্ম প্রতিপালন করিতেছি, এক্ষণে আপনি কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, আজ্ঞা করুন।" উতঙ্ক কহিলেন, "মহারাজ! আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত আগমন করিয়াছি, উহা আপনারই কর্ত্তব্য কর্ম্ম। দুরাত্মা তক্ষক আপনার পিতার প্রাণ হিংসা করিয়াছিল, এক্ষণে তাহার প্রতিবিধান করুন। ঐ অবশ্যকর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানকাল উপস্থিত হইয়াছে; অতএব হে মহারাজ! আপনার পিতৃবৈরী তক্ষককে সমুচিত প্রতিফল প্রদান করুন। সেই দুরাত্মা বিনা দোষে আপনার পিতাকে দংশন করিয়াছিল, তাহাতেই তিনি বজ্রহত বৃক্ষের ন্যায় ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েন। বলদৃপ্ত পন্নগাধম তক্ষক বিনা অপরাধে আপনার পিতার প্রাণসংহার করিয়া কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে, একবার স্থিরচিত্তে ভাবিয়া দেখুন। কাশ্যপ বিষ চিকিৎসা দ্বারা রাজর্ষিবংশরক্ষক দেবতানুভব মহারাজ পরীক্ষিতের প্রাণরক্ষা করিতে আসিতেছিলেন, পথিমধ্যে পাপাধম তক্ষক পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে নিবৃত্ত করে। অতএব মহারাজ! অবিলম্বে সর্পসত্রের অনুষ্ঠান করিয়া ঐ পাপাত্মাকে প্রদীপ্ত হুতাশনে আহুতি প্রদান করুন, তাহা হইলে আপনার পিতার বৈরনির্যাতন এবং আমারও অভীষ্টসাধন হইবে সন্দেহ নাই। মহারাজ! আমি গুরুদক্ষিণা আহরণ করিতে গিয়াছিলাম, ঐ পাপিষ্ঠ পথিমধ্যে আমার যথেষ্ট বিঘ্ন অনুষ্ঠান করিয়াছিল।"
    রাজা জনমেজয় তাহা শ্রবণ করিয়া তক্ষকের প্রতি অত্যন্ত কোপাবিষ্ট হইলেন। যেমন ঘৃত-সংযোগে অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, উতঙ্কের বাক্যে রাজার রোষানলও সেইরূপ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। তখন রাজা জনমেজয় অতিশয় দুঃখিত হইয়া উতঙ্ক-সমক্ষে পিতার স্বর্গপ্রাপ্তির নিমিত্ত স্বীয় অমাত্যবর্গকে বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন এবং উতঙ্কমুখে পিতৃবধবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অবধি শোকে ও দুঃখে নিতান্ত আক্রান্ত ও একান্ত অভিভূত হইলেন।
                                                        পৌষ্যপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।


Share:

মহাভারত (আদিপর্ব দ্বিতীয় অধ্যায় )

সমন্তপঞ্চকোপাখ্যান

    ঋষিগণ কহিলেন, "হে সূতনন্দন! আমরা ভারতের অনুক্রমণিকা শুনিলাম, এক্ষণে সমন্তপঞ্চক নামক যে তীর্থের উল্লেখ করিয়াছ, তাহার যাহা কিছু বর্ণনীয় আছে সমুদয় শ্রবণ করাইয়া আমাদিগকে চরিতার্থ কর।" ঋষিদিগের এইরূপ প্রার্থনাবাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া অতি শিষ্টপ্রকৃতি সৌতি কহিতে লাগিলেন, হে ব্রাহ্মণগণ! আমি আপনাদিগের সম্মুখে সমন্তপঞ্চক তীর্থের বৃত্তান্ত ও অন্যান্য কথা প্রসঙ্গক্রমে সমুদয় কীর্ত্তন করিতেছি, অবধান করুন।
    অদ্বিতীয় বীর 
পরশুরাম ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিতে পিতৃবধ-বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া ক্রোধপরায়ণ হইয়া এই পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষৎত্রিয়া করেন। তিনি স্ববিক্রম-প্রভাবে নিঃশেষে ক্ষৎত্রিয়কুল উৎসন্ন করিয়া সেই সমস্তপঞ্চকে শোণিতময় পঞ্চহ্রদ প্রস্তুত করেন। শুনিয়াছি, তিনি রোষপরবশ হইয়া সেই হ্রদের রুধির দ্বারা পিতৃলোকের তর্পণ করিয়াছিলেন। অনন্তর ঋচীক প্রভৃতি পিতৃগণ তথায় আগমন করিয়া পরশুরাম কে কহিলেন, "হে মহাভাগ রাম! তোমার এরূপ অবিচলিত পিতৃভক্তি ও অসাধারণ বিক্রম দর্শনে আমরা অত্যন্ত প্রীত হইয়াছি, এক্ষণে তুমি আপনার অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।" রাম কহিলেন, "হে পিতৃগণ! যদি প্রসন্ন হইয়া ইচ্ছানুরূপ বর প্রদানে অনুগ্রহ করেন, তাহা হইলে ক্রোধে অধীর হইয়া ক্ষৎত্রিয়বংশ ধ্বংস করিয়া যে পাপরাশি সঞ্চয় করিয়াছি, সেই সকল  পাপ  হইতে যাহাতে মুক্ত হই এবং এই শোণিতময় পঞ্চহ্রদ অদ্যাবধি পৃথিবীতে তীর্থস্থান বলিয়া যাহাতে প্রখ্যাত হয়, এরূপ বর প্রদান করুন।"পিতৃগণ 'তথাস্তু' বলিয়া পরশুরামের অভিমত বর প্রদানপূর্ব্বক সেইরূপ অধ্যাবসায় হইতে তাঁহাকে ক্ষান্ত হইতে আদেশ করিলেন। তিনিও তদবধি ক্ষৎত্রিয়দিগের উপর আর কোনরূপ অত্যাচার করিলেন না।

    সেই শোণিতময় পঞ্চহ্রদের সন্নিধানে যে সকল প্রদেশ আছে, তাহাকেই পরম পবিত্র সমন্তপঞ্চক তীর্থ বলিয়া নির্দ্দেশ করা হয়। কারণ, পণ্ডিতেরা কহেন, যে দেশ যে কোন বিশেষ চিহ্নে চিহ্নিত, তাহা তন্নামেই প্রখ্যাত হইয়া থাকে। ঐ সমন্তপঞ্চক তীর্থে কলি ও দ্বাপরের অন্তরে কুরু ও পাণ্ডবসৈন্যের ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা যুদ্ধার্থে ভূদোষবর্জ্জিত সেই পুণ্যক্ষেত্রে সমবেত ও নিহত হয়। হে ব্রাহ্মণগণ! ইহাই তাহার যথার্থ ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থ। সেই তীর্থ অতি পবিত্র ও রমণীয়। হে ধর্ম্মপরায়ণ মহর্ষিগণ! ত্রিলোকে ঐ দেশ যেরূপ বিখ্যাত, তাহা আপনাদের সমক্ষে কহিলাম।

অক্ষৌহিণী-পরিমাণ

    ঋষিগণ কহিলেন, "হে সুতনন্দন! তুমি যে অক্ষৌহিণী শব্দের উল্লেখ করিলে, আমরা তাহার অর্থ শুনিতে ইচ্ছা করি। কারণ, তুমি সকলই জান, অতত্রব কত নর, কত হস্তী, কত অশ্ব ও কত রথে এক অক্ষৌহিণী হয়, তাহা সপ্রমাণ করিয়া বল।" সৌতি কহিলেন,  এক রথ, এক হস্তী, পঞ্চ পদাতি ও তিন অশ্ব, ইহাতে একটি পত্তি হয়। তিন পত্তিতে এক সেনামুখ, তিন সেনামুখে এক গুল্ম, তিন গুল্মে এক গণ, তিন গণে এক বাহিনী, তিন বাহিনীতে এক পৃতনা, তিন পৃতনায় এক চমু, তিন চমূতে এক অনীকিনী, দশ অনীকিনীতে এক অক্ষৌহিণী হয়। এক অক্ষৌহিণীতে একবিংশতি সহস্র অষ্টশত ও সপ্ততি-সংখ্যক রথ ও তৎসংখ্যক গজ, একলক্ষ নয় সহস্র তিন শত পঞ্চাশ জন পদাতি এবং পঞ্চষষ্টি সহস্র ছয় শত দশ অশ্ব থাকে। আমি যে অক্ষৌহিণী শব্দের উল্লেখ করিলাম, সংখ্যাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা তাহার এইরূপ নিরূপণ করিয়াছেন [এক অক্ষৌহিণীমাণ  ১ লক্ষ ৯ হাজার ৫০ পদাতি, ৬৫ হাজার ৬ শত ১০ অশ্ব, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ হস্তী, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ রথ। মোট সৈন্যসংখ্যা ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৭ শত]। সমন্তপঞ্চক তীর্থে কুরু ও পাণ্ডবদিগের এইরূপ অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা একত্র সমাগত হইয়াছিল। সেই সেনা কৌরবদিগকে উপলক্ষ্য করিয়া কালের অদ্ভুত ও অচিন্তনীয় শক্তিসহকারে তথায় মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। তন্মধ্যে পরমাস্ত্রবেত্তা ভীষ্ম দশ দিবস যুদ্ধ করেন, দ্রোণ পাঁচ দিন কৌরবসেনা রক্ষা করিয়াছিলেন। পরবলপীড়ক কর্ণ দুই দিবস ও শল্য অর্দ্ধদিবস মাত্র যুদ্ধ করেন। তৎপরে ভীমসেন ও দুর্য্যোধনের গদাযুদ্ধ আরম্ভ হয়, তাহাও দিবসার্দ্ধ মাত্র। অনন্তর দিবসের অবসানে ও নিশার আগমন হইলে অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্য সকলে একমত অবলম্বন করিয়া অসঙ্কুচিতচিত্তে সুখপ্রসুপ্ত যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণকে সংহার করিলেন।
                                                              পর্ব্বসংগ্রহ


    হে শৌনক! আপনার যজ্ঞে যে ভারতাখ্য ইতিহাস কহিব, বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের সর্পসত্রকালে তাহা কীর্ত্তন করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থের আরম্ভে পৌষ্য, পোলোম ও আস্তীকপর্ব্বে মহানুভব ভূপালদিগের বিচিত্র চরিত্র সম্যক্‌রূপে বর্ণিত আছে। ইহা বহুবিধ উপাখ্যান ও অনেকানেক লৌকিক আচার-ব্যবহারে পরিপূর্ণ। যাদৃশ মোক্ষার্থীরা একমাত্র পারত্রিক শুভসঙ্কল্পে বৈরাগ্য অবলম্বন করেন, তাদৃশ বিজ্ঞেরা মঙ্গললাভ প্রত্যাশায় এই পবিত্র ইতিহাসের আশ্রয় লইয়া থাকেন। যেমন সমস্ত জ্ঞাতব্য বস্তুমধ্যে আত্মা ও সকল প্রিয়বস্তুমধ্যে প্রাণ শ্রেষ্ঠ পদার্থ, সেইরূপ এই গ্রন্থ সর্ব্বশাস্ত্র অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। যেমন অন্নপান ব্যতীত জীবনধারণের আর উপায় নাই, সেইরূপ এই ইতিহাস যে সকল সুললিত কথা প্রতিপন্ন করিতেছে, তদ্ব্যতিরিক্ত ভূমণ্ডলে আর কথা নাই। যেমন সৎকুলোদ্ভব প্রভুকে প্রভুপরায়ণ ভৃত্যগণ অভ্যুদয়বাসনায় উপাসনা করে, সেইরূপ বুধগণ বিবিধ জ্ঞানলাভের অভিলাষে এই ভারতসংহিতার সেবা করিয়া থাকেন। যেমন স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ কি লৌকিক, কি বৈদিক সকল বাক্যকেই অধিকার করিয়া আছে, সেইরূপ এই অদ্ভুত ইতিহাসে বহুবিষয়ে শুভকরী বুদ্ধিবৃত্তি সমর্পিত হইয়াছে।
    হে ঋষিগণ! এক্ষণে বেদপ্রতিপাদ্য, সনাতন ধর্ম্মে অলঙ্কৃত, অনুভূতপূর্ব্ব বিষয়ের মীমাংসাসহকৃত, সুচারুরূপে বিরচিত ভারতের পর্ব্বসংগ্রহ বলিতেছি, আপনারা অবধান করুন। প্রথম অনুক্রমণিকা-পর্ব্ব, দ্বিতীয় সংগ্রহ-পর্ব্ব, পরে পোষ্য ও পৌলোম পর্ব্ব, আস্তীক ও বংশাবতরণ-পর্ব্ব, তৎপরে পরমাশ্চর্য্য সম্ভবপর্ব্ব, তাহা শ্রবণ করিলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তৎপরে জতুগৃহ-দাহ, তৎপরে হিড়িম্ববধ, তৎপরে বকবধ, তৎপরে চৈত্ররথ-পর্ব্ব, তৎপরে দেবী পাঞ্চালীর স্বয়ংবর-বৃত্তান্ত, তৎপরে বিবাহ, তৎপরে বিদুরাগমন ও রাজ্যলাভ-পর্ব্ব, তৎপরে অর্জ্জুনের অরণ্যবাস, তৎপরে সুভদ্রাহরণ, তৎপরে যৌতুকাহরণপর্ব্ব, তৎপরে খাণ্ডবদাহ ও ময়দানবদর্শন, তৎপরে সভাপর্ব্ব, তৎপরে মন্ত্রপর্ব্ব, তৎপরে জরাসন্ধবধ, তৎপরে দিগ্বিজয়-পর্ব্ব, দিগ্বিজয়ের পর যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় মহাযজ্ঞ, তৎপরে অর্ঘ্যাভিহরণ, তৎপরে শিশুপালবধ, তৎপরে দ্যূত ও অনুদ্যূত-পর্ব্ব, তৎপরে অরণ্য, তৎপরে কির্ম্মীর-বধ, তৎপরে অর্জ্জুনের অভিগমন ও তৎপরে মহাদেব ও অর্জ্জুনের যুদ্ধ, ইহাকে কিরাতপর্ব্ব বলিয়া নির্দ্দেশ করা হয়। তৎপরে ইন্দ্রলোকাভিগমন, তৎপরে নলোপাখ্যান, ইহা শ্রবণ করিলে অশ্রুপাত হয়। তৎপরে যুধিষ্ঠিরের তীর্থযাত্রা-পর্ব্ব, তৎপরে যক্ষযুদ্ধ, তৎপরে নিবাতকবচযুদ্ধ-পর্ব্ব, তৎপরে অজগর-পর্ব্ব, তৎপরে মার্কণ্ডেয়-সমস্যা, তৎপরে দ্রৌপদী ও সত্যভামা-সংবাদ, তৎপরে ঘোষযাত্রা, তৎপরে মৃগস্বপ্নোদ্ভব-পর্ব্ব, তৎপরে ব্রীহিদ্রৌণিক-উপাখ্যান-পর্ব্ব, তৎপরে ঐন্দ্রদ্যুম্ন, তৎপরে দ্রৌপদীহরণ, তৎপরে জয়দ্রথ-বিমোক্ষণ, তৎপরে রামচন্দ্রোপখ্যান, তৎপরে পতিব্রতা সাবিত্রীর অদ্ভুত মহাত্ম্যবর্ণন, তৎপরে কুণ্ডলা-হরণ, তৎপরে আরণেয়, তৎপরে বিরাট-পর্ব্ব, তৎপরে পাণ্ডবদিগের প্রবেশ ও সময় প্রতিপালন, তৎপরে কীচকবধ, তৎপরে গোগ্রহণ, তৎপরে অভিমন্যুর সহিত উত্তরার বিবাহ, তৎপরে উদ্‌যোগ, তৎপরে সঞ্জয়াগমন-পর্ব্ব, অনন্তর ধৃতরাষ্ট্রের চিন্তামূলক প্রজাগর-পর্ব্ব, পরে সনৎসুজাত-পর্ব্ব, তৎপরে যানসন্ধি-পর্ব্ব, তৎপরে কৃষ্ণের গমন, তৎপরে মাতলীয় উপাখ্যান ও গালবচরিত, তৎপরে সাবিত্রীর উপাখ্যান, বামদেবোপাখ্যান, বৈণ্যোপাখ্যান ও জামদগ্ন্যোপাখ্যান, তৎপরে ষোড়শরাজিক-পর্ব্ব, তৎপরে কৃষ্ণের সভাপ্রবেশ, তৎপরে বিদুলাপুল্র-শাসন, তৎপরে সৈন্যোদ্‌যোগ ও শ্বেতোপাখ্যান-পর্ব্ব, তৎপরে মন্ত্রনিশ্চয় করিয়া কার্য্যচিন্তন, তৎপরে সেনাপতি-নিয়োগোপাখ্যান, তৎপরে শ্বেত ও বাসুদেব-সংবাদ, তৎপরে মহাত্মা কর্ণের বিবাদ, তৎপরে কুরুপাণ্ডব-সেনানির্যাণ, তৎপরে রথী ও অতিরথ-সংখ্যা-পর্ব্ব, অনন্তর অমর্ষবিবর্দ্ধন উলুকদূতের আগমন, তৎপরে অম্বোপাখ্যান, তৎপরে অদ্ভুত ভীষ্মভিষেক-পর্ব্ব, তৎপরে জম্বুদ্বীপনির্ম্মাণ-পর্ব্ব, তৎপরে ভূমিপর্ব্ব, তৎপরে দ্বীপবিস্তার-কথন-পর্ব্ব, তৎপরে ভগবদ্‌গীতা-পর্ব্ব, অনন্তর ভীষ্মবধ, তৎপরে দ্রোণাভিষেক, তৎপরে সংসপ্তক-সৈন্যবধ, তৎপরে অভিমন্যুবধ-পর্ব্ব, তৎপরে প্রতিজ্ঞা, তৎপরে জয়দ্রথবধ-পর্ব্ব, তৎপরে ঘটোৎকচবধ, তৎপরে পরমাশ্চর্য্য দ্রোণবধ-পর্ব্ব, তৎপরে নারায়ণাস্ত্রপ্রয়োগ-পর্ব্ব।
    অনন্তর কর্ণপর্ব্ব, তৎপরে শল্যপর্ব্ব, তৎপরে হ্রদপ্রবেশ ও গদাযুদ্ধ-পর্ব্ব, অনন্তর সারস্বত ও তীর্থবংশানুকীর্ত্তন-পর্ব্ব, তদনন্তর অতি বীভৎস সৌপ্তিক-পর্ব্ব, অনন্তর দারুণ ঐষীক-পর্ব্ব, তৎপরে জলপ্রদানিক-পর্ব্ব, তৎপরে স্ত্রীবিলাপ-পর্ব্ব, তৎপরে ঔর্দ্ধ্বদেহিক পর্ব্ব, তৎপরে ব্রাহ্মণরূপী চার্বাক রাক্ষসের বধপর্ব্ব, তৎপরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অভিষেক-পর্ব্ব, তৎপরে গৃহপ্রবিভাগ-পর্ব্ব, অনন্তর শান্তিপর্ব্ব, এই পর্ব্বে রাজধর্ম্ম, আপদ্ধর্ম্ম ও মোক্ষধর্ম্ম কথিত আছে। তৎপরে শুকপ্রশ্নাভিগমন, তৎপরে ব্র্হ্মপ্রশ্নানুশাসন, তৎপরে দুর্ব্বাসার প্রাদুর্ভাব ও মায়াসংবাদ-পর্ব্ব, অনন্তর অনুশাসন-পর্ব্ব, অনন্তর ভীষ্মের স্বর্গারোহণপর্ব্ব, তৎপরে সর্বপাপপ্রণাশক আশ্বমেধিক-পর্ব্ব, তৎপরে অধ্যাত্মবিদ্যাবিষয়ক অনুগীতা-পর্ব্ব, তৎপরে আশ্রমবাসিক-পর্ব্ব, তৎপর পুৎত্রদর্শন-পর্ব্ব, তৎপরে নারদাগমন-পর্ব্ব, তৎপরে অতি ভীষণ মৌষল-পর্ব্ব, তৎপরে মহাপ্রস্থানিক-পর্ব্ব, তৎপরে স্বর্গারোহণিক-পর্ব্ব, অনন্তর খিলনামক হরিবংশ-পর্ব্ব; এই পর্ব্বে বিষ্ণু-পর্ব্ব, শিশুচর্য্যা, কংসবধ ও অতি অদ্ভুত ভবিষ্য-পর্ব্ব কথিত আছে। এই শত-পর্ব্ব মহাত্মা ব্যাসদেব কহিয়াছিলেন এবং নৈমিষারণ্যে যথাক্রমে লোমহর্ষণপুৎত্র সৌতি অষ্টাদশপর্ব্ব কীর্ত্তন করেন। সঙ্ক্ষেপে এই মহাভারতের পর্ব্বসংগ্রহ কহিলাম।
আদিপর্ব্বশ্লোকসংখ্যা
    পৌষ্য, পৌলোম, আস্তীক, আদিবংশাবতরণ, সম্ভব, জতুগৃহ, হিড়িম্ব ও বকবধ, চৈত্ররথ, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর, বৈবাহিক, বিদুরাগমন, রাজ্যলাভ, অর্জ্জুনের বনবাস, সুভদ্রাহরণ, যৌতুকানয়ন, খাণ্ডবদাহ, ময়দানবদর্শন এই সকল আদিপর্ব্বের অন্তর্গত। পৌষ্য-পর্ব্বে উতঙ্কের মাহাত্ম্য ও পৌলোমপর্ব্বে ভৃগুবংশবিস্তার কথিত আছে। আস্তীকপর্ব্বে সর্পকুল ও রুড়ের সম্ভব, ক্ষীরসমুদ্রমন্থন, উচ্চৈঃশ্রবার জন্ম, রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞানুষ্ঠান ও মহাত্মা ভরতবংশীয়দিগের চরিত্র কীর্ত্তিত আছে। সম্ভবপর্ব্বে অনেকানেক ভূপতিদিগের উৎপত্তি, অনেকানেক বীরপুরুষ ও মহর্ষি দ্বৈপায়নের জন্মবৃত্তান্ত এবং দেবতাদিগের অংশাবতরণ বর্ণিত আছে। দৈত্য, দানব, যক্ষ, সর্প, গন্ধর্ব্ব, পক্ষী ও অন্যান্য প্রাণীদিগের সমুদ্ভব; যাঁহার নামের অনুরূপে লোকে ভারতকুল বলিয়া প্রখ্যাত হইয়াছে, মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে দুষ্মন্তের ঔরসে শকুন্তলার গর্ভে সেই ভরতের জন্মলাভ। শান্তনুর আবাসে গঙ্গার গর্ভে বসুদিগের পুনর্জ্জন্ম ও তাঁহাদিগের স্বর্গে আরোহণ এবং তেজোংশের সম্পাত, ভীষ্মের সম্ভব এবং তাঁহার রাজ্যপরিত্যাগ ও ব্রহ্মচর্য্যব্রতধারণ, প্রতিজ্ঞাপালন এবং ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদের রক্ষা, চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হইলে কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য্যের রক্ষাবিধান ও তাঁহার রাজ্যাধিকার, অণীমাণ্ডব্যের অভিশাপে ধর্ম্মের নরলোকের অংশে সম্ভব ও বরদানপ্রভাবে কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ঔরসে উৎপত্তি, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও পাণ্ডবদিগের সম্ভব, বারণাবতপ্রস্থানে দুর্য্যোধনের মন্ত্রণা, পাণ্ডবদিগের প্রতি ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের কূটপ্রেরণ, ধীমান্ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হিতসাধন করিবার নিমিত্ত পথিমধ্যে তাঁহাকে ম্লেচ্ছ ভাষায় বিদুরের অশেষ উপদেশ, বিদুরের পরামর্শক্রমে অতি গোপনে সুরঙ্গনির্ম্মাণ, রাত্রিকালে পঞ্চপুৎত্রের সহিত নিদ্রিতা নিষাদীকে জতুগৃহে পুরোচন নামক ম্লেচ্ছের সহিত দাহ, নিবিড় অরণ্যে পাণ্ডবদিগের হিড়িম্বদর্শন, মহাবল ভীমসেন হইতে হিড়িম্বের বধসাধন ও ঘটোৎকচের উৎপত্তি, মহাপ্রভাব মহর্ষি ব্যাসদেবের সন্দর্শন ও তাঁহার অনুমতিক্রমে একচক্রা নগরীতে এক ব্রাহ্মণের আবাসে ছদ্মবেশে বাস, বকবধে পুরবাসীদিগের বিস্ময়, দ্রৌপদী ও ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম, ব্রাহ্মণ-সন্নিধানে দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণপূর্ব্বক স্বয়ংবর-সভাদিদৃক্ষা [দর্শনেচ্ছা]- ক্রান্তচিত্ত হইয়া ব্যাসের আদেশে ও রমণীরত্নলাভের অভিলাষে পাঞ্চালদেশে পঞ্চপাণ্ডবদিগের গমন, গঙ্গাতীরে গন্ধর্ব্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে পরাজয় করিয়া অর্জ্জুনের তাঁহার সহিত পরমসখ্যভাব-সংস্থাপন ও তৎসমীপে তপতী, বশিষ্ঠ ও ঔর্ব্বের রমণীয় উপাখ্যান শ্রবণ ও ভ্রাতৃগণের সহিত অর্জ্জুনের পাঞ্চালদেশে গমন, তথায় সমাগত অসংখ্য ভূপাল সমক্ষে লক্ষ্যভেদপূর্ব্বক ধনঞ্জয়ের দ্রৌপদী লাভ, ভীম ও অর্জ্জুন কর্ত্তৃক যুদ্ধে ক্রুদ্ধ রাজগণের সহিত শল্য ও কর্ণের পরাজয়, মহামতি অতি-শিষ্টপ্রকৃতি কৃষ্ণ ও বলরামের ভীমার্জ্জুনের সেইরূপ অপ্রমেয় ও অমানুষ-সাহস সন্দর্শনে পাণ্ডব বোধে তাঁহাদিগের সহিত সমাগত হইবার বাসনায় পরশুরামের গৃহপ্রবেশ, পঞ্চভ্রাতার এক ভার্য্যা হইবে বলিয়া দ্রুপদের বিমর্ষ, এইস্থলে পরমাশ্চর্য্য পঞ্চেন্দ্রের উপাখ্যানের উল্লেখ, পাঞ্চালীর দৈববিহিত অমানুষ বিবাহ, পাণ্ডবদিগের প্রতি ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক বিদুরপ্রেরণ, বিদুরের গমন ও কৃষ্ণের সন্দর্শন, পাণ্ডবদিগের খাণ্ডবপ্রস্থে বাস ও রাজ্যার্দ্ধের অধিকার, নারদের আদেশে পঞ্চপাণ্ডবের দ্রৌপদীবিষয়ক নিয়মসংস্থাপন, সুন্দোপসুন্দের ইতিহাস, অনন্তর দ্রৌপদীর সহিত একান্তে উপবিষ্ট যুধিষ্ঠিরের সন্নিকৃষ্ট হইয়া অর্জ্জুনের অস্ত্রগ্রহণ ও ব্রাহ্মণের গোধন আহরণপূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন জন্য অরণ্যবাস এবং তৎকালে উলুপীনাম্নী নাগকন্যার সহিত পথিমধ্যে অর্জ্জুনের সমাগম, পুণ্যতীর্থে গমন ও বভ্রুবাহনের জন্ম এবং তথায় তপস্বী ব্রাহ্মণের অভিসম্পাতে গ্রাহ [কুম্ভীর] যোনিপ্রাপ্ত পঞ্চ অপ্সরার শাপমোচন, প্রভাস-তীর্থে কৃষ্ণের সহিত অর্জ্জুনের সাক্ষাৎকারলাভ, কৃষ্ণের অভিমতে দ্বারকায় অর্জ্জুনের সুভদ্রাপ্রাপ্তি, যৌতুক-প্রদানের নিমিত্ত খাণ্ডবপ্রস্থে কৃষ্ণ প্রস্থিত হইলে পর সুভদ্রার গর্ভে অভিমন্যুর জন্ম, দ্রৌপদী-পুৎত্রের উৎপত্তি-কীর্ত্তন, যমুনায় জলবিহারার্থে গমন করিলে কৃষ্ণার্জ্জুনের চক্র ও ধনুলাভ, খাণ্ডবদাহ, প্রদীপ্ত অনলমধ্য হইতে ময়দানব ও ভুজঙ্গের পরিত্রাণ, মন্দপালনামা মহর্ষির ঔরসে শাঙ্গীর গর্ভে সুতোৎপত্তি, আদিপর্ব্বে এই সকল বর্ণিত আছে। বেদব্যাস এই পর্ব্বে দুই শত সপ্তবিংশতিসংখ্যক অধ্যায় কহিয়াছেন, তাহাতে অষ্ট সহস্র অষ্ট শত ও চতুরশীতি শ্লোক রচনা করেন।
সভাপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
অনন্তর বহুবৃত্তান্তযুক্ত দ্বিতীয় সভাপর্ব্ব আরম্ভ হইতেছে। পাণ্ডবদিগের সভা-নির্ম্মাণ, কিঙ্কর-দর্শন, দেবর্ষি নারদ কর্ত্তৃক ইন্দ্র প্রভৃতি লোকপালগণের সভাবর্ণন, রাজসূয়-মহাযজ্ঞের আরম্ভ, জরাসন্ধ-বধ, গিরিব্রজে নিরুদ্ধ রাজগণের কৃষ্ণ কর্ত্তৃক বিমোচন, পাণ্ডবদিগের দিগ্বিজয়, ভূপালদিগের রাজসূয়যজ্ঞে আগমন যজ্ঞে অর্ঘ্যদানপ্রসঙ্গে শিশুপালের সহিত বিবাদ ও তাহার বধ, পাণ্ডবদিগের রাজসূয়যজ্ঞে তাদৃশ সমৃদ্ধি সন্দর্শন করিয়া দুর্য্যোধনের বিষাদ ও ঈর্ষা, ভীমকর্ত্তৃক সভামধ্যে দুর্য্যোধনের প্রতি উপহাস ও তাহার ক্রোধ, তন্নিবন্ধন দ্যুতক্রীড়া, ধূর্ত্ত শকুনি-কর্ত্তৃক দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরের পরাজয়, দ্যূতার্ণবমগ্না দুঃখিতা দ্রৌপদীর ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক উদ্ধার, দ্রৌপদীকে বিপদ্ হইতে উত্তীর্ণা দেখিয়া দুর্য্যোধনের পুনর্ব্বার পাণ্ডবদিগের সহিত দ্যূতারম্ভ, দ্যূতে পরাজয় করিয়া তৎকর্ত্তৃক পাণ্ডবদিগের বনপ্রেরণ, মহর্ষি বেদব্যাস সভাপর্ব্বে এই সকল বর্ণন করিয়াছেন। এই পর্ব্বে অষ্টসপ্ততি অধ্যায় এবং দ্বিসহস্র পঞ্চশত একাদশ শ্লোক আছে।
বনপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অনন্তর অরণ্য নামক তৃতীয় পর্ব্ব। মহাত্মা পাণ্ডবগণ বনপ্রস্থান করিলে পৌরজন কর্ত্তৃক ধীমান্ যুধিষ্ঠিরের অনুগমন, ওষধি ও ব্রাহ্মণগণের ভরণপোষণের নিমিত্ত ধৌম্য মুনির উপদেশ-ক্রমে যুধিষ্ঠিরের সূর্য্যারাধনা, সূর্য্যের অনুগ্রহে অন্নলাভ, ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক হিতবাদী বিদুরের পরিত্যাগ, বিদুরের পাণ্ডবসমীপে গমন ও ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে পুনর্ব্বার তাঁহার নিকটে আগমন, কর্ণের উত্তেজনায় বনবাসী পাণ্ডবদিগকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত দুর্ম্মতি দুর্য্যোধনের মন্ত্রণা, তাহার দুষ্ট অভিসন্ধি জানিতে পারিয়া ব্যাসের আগমন, ব্যাস কর্ত্তৃক দুর্য্যোধনের বনগমন-প্রতিষেধ, সুরভির উপাখ্যান, মৈত্রেয়ের আগমন, ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি মৈত্রেয়ের উপদেশ, মৈত্রেয় কর্ত্তৃক রাজা দুর্য্যোধনের প্রতি শাপপ্রদান, ভীম কর্ত্তৃক যুদ্ধে কির্ম্মীর রাক্ষস-বধ, শকুনি ছল প্রকাশ করিয়া দ্যূতে পাণ্ডবদিগকে পরাজয় করিয়াছে শুনিয়া পাঞ্চাল ও বৃষ্ণিবংশীয়দিগের আগমন, কৃষ্ণ অতিশয় রোষাবেশ প্রকাশ করিলে অর্জ্জুনের সান্ত্বনাবাক্য, কৃষ্ণের নিকট দ্রৌপদীর বিলাপ, দুঃখার্ত্তা দ্রৌপদীকে বাসুদেবের আশ্বাসদান, সৌভপতি শাল্বের বধ, সপুৎত্রা সুভদ্রাকে কৃষ্ণ কর্ত্তৃক দ্বারকায় আনয়ন, ধৃষ্টদ্যুম্নকর্ত্তৃক দ্রৌপদীর সন্তানগণকে পাঞ্চালনগর-প্রাপণ, রমণীয় দ্বৈতবনে পাণ্ডবদিগের প্রবেশ, দ্রৌপদী ও ভীমসেনের সহিত দ্বৈতবনে যুধিষ্ঠিরের কথোপকথন, পাণ্ডবদিগের সমীপে ব্যাসের আগমন, যুধিষ্ঠিরের ব্যাসদেব হইতে প্রতিস্মৃতিনামক বিদ্যালাভ, ব্যাস প্রতিগত হইলে পাণ্ডবদিগের কাম্যকবনে গমন, অমিততেজা অর্জ্জুনের অস্ত্রলাভপ্রত্যাশায় প্রবাসে গমন ও কিরাতরূপী দেবদেব মহাদেবের সহিত যুদ্ধ, ইন্দ্রাদি লোকপালের দর্শন ও অস্ত্রলাভ, অস্ত্রশিক্ষার্থে অর্জ্জুনের ইন্দ্রলোকে গমন, পাণ্ডববৃত্তান্ত শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্রের বলবতী চিন্তা, মহানুভব মহর্ষি বৃহদশ্বের সন্দর্শন, দুঃখার্ত্ত যুধিষ্ঠিরের বিলাপ, ধর্ম্মসঙ্গত ও করুণরসাশ্রিত নলোপাখ্যান, যুধিষ্ঠিরের বৃহদশ্ব হইতে অক্ষহৃদয় নামক বিদ্যালাভ, পাণ্ডবদিগের নিকট স্বর্গ হইতে লোমশ ঋষির আগমন, লোমশ কর্ত্তৃক বনবাসগত মহাত্মা পাণ্ডবদিগের নিকট স্বর্গবাসী অর্জ্জুনের বৃত্তান্ত-কথন, অর্জ্জুনের অনুসন্ধানার্থ পাণ্ডবদিগের তীর্থাভিগমন, তীর্থের ফলপ্রাপ্তি ও পাবনত্ব-কীর্ত্তন, দেবর্ষি নারদের পুলস্ত্যতীর্থযাত্রা, পাণ্ডবদিগের তীর্থযাত্রা, গয়াসুরের যজ্ঞবর্ণন, অগস্ত্যের উপাখ্যান ও বাতাপি ভক্ষণ, অপত্যোৎপাদনের নিমিত্ত মহর্ষির লোপামুদ্রা-পরিগ্রহ, কৌমার ব্রহ্মচারী ঋষ্যশৃঙ্গের চরিত কীর্ত্তন, প্রভূত-পরাক্রম পরশুরামের চরিত্রবর্ণন, কার্ত্তবীর্য্য ও হৈহয়দিগের বধ, প্রভাসতীর্থে পাণ্ডবদিগের সহিত বৃষ্ণিবংশীয়দিগের সমাগম, সুকন্যার উপাখ্যান, শর্য্যাতি রাজার যজ্ঞে চ্যবনমুনি কর্ত্তৃক অশ্বিনীকুমারের সোমপান, অশ্বিনীকুমার কর্ত্তৃক চ্যবনের যৌবন-প্রতিপাদন, মান্ধাতার উপাখ্যান, জন্তু-নামক রাজপুৎত্রের উপাখ্যান, শত পুৎত্রের অভিলাষে সোমক রাজার জন্তু-নামক পুৎত্রের শিরশ্ছোদন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও অভীষ্ট-ফললাভ, শ্যেনকপোতীয় উপাখ্যান, শিবি রাজার প্রতি ইন্দ্র ও অগ্নির ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসা, অষ্টাবক্রোপাখ্যান, জনক-যজ্ঞে মহর্ষি অষ্টাবক্রের সহিত বরুণাত্মজ নৈয়ায়িক বন্দীর বিবাদ, মহাত্মা অষ্টাবক্র কর্ত্তৃক বিবাদে বন্দীর পরাজয় ও সাগরের অভ্যন্তরগত পিতার উদ্ধার, মহাত্মা যবক্রীত ও রৈভ্যের উপাখ্যান, গন্ধমাদনযাত্রা ও নারায়ণাশ্রমে বাস, পুষ্পানয়নার্থ দ্রৌপদী কর্ত্তৃক ভীমসেনের নিয়োগ, পথিমধ্যে গমন করিতে করিতে ভীমসেনের সহিত কদলীবনে হনূমানের সন্দর্শন, কুসুমাবচয়ন করিবার নিমিত্ত সরোবরে অবগাহন, তথায় অতি ভীষণ রাক্ষসগণ ও মণিমান্ প্রভৃতি মহাবীর্য্য যক্ষদিগের সহিত যুদ্ধ, জটাসুর-নামক রাক্ষস-বধ, তথায় রাজর্ষি বৃষপর্ব্বার আগমন, আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে পাণ্ডবদিগের গমন ও অবস্থান, দ্রৌপদী কর্ত্তৃক ভীমসেনের উৎসাহদান, ভীমের কৈলাস-পর্ব্বতে আরোহণ ও মণিমান্ প্রমুখ যক্ষদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ, পাণ্ডবদিগের সহিত বৈশ্রবণের সমাগম, দিব্যাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়া ভ্রাতৃগণের সহিত অর্জ্জুনের সমাগম, হিরণ্যপুরবাসী নিবাতকবচগণ ও পুলোমপুৎত্র কালকেয়দিগের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধবর্ণন, তৎকর্ত্তৃক কালকেয়দিগের রাজার প্রাণসংহার, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সন্নিধানে অর্জ্জুনের অস্ত্র-সন্দর্শনের উদ্যম, দেবর্ষি নারদের তদ্বিষয়ে প্রতিষেধ, গন্ধমাদন হইতে পাণ্ডবদিগের অবরোহণ, গহনবনে ভুজগেন্দ্র কর্ত্তৃক মহাবল ভীম-গ্রহণ, প্রশ্নোত্তর প্রদানপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের ভীমমোক্ষণ, মহাত্মা পাণ্ডবদিগের কাম্যকবনে পুনরাগমন, তথায় পাণ্ডবদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রত্যাশায় পুনর্ব্বার বাসুদেবের আগমন, মার্কণ্ডেয়সমস্যা, পৃথু রাজার উপাখ্যান, সরস্বতী ও মহর্ষি তার্ক্ষ্যের সংবাদ, মৎস্যোপাখ্যান, ইন্দ্রদ্যুম্নোপাখ্যান, ধুন্ধুমারোপাখ্যান, পতিব্রতোপাখ্যান, অঙ্গিরা ঋষির উপাখ্যান, দ্রৌপদী ও সত্যভামাসংবাদ, পাণ্ডবদিগের দ্বৈতবনে পুনরাগমন, ঘোষযাত্রা, গন্ধর্ব্ব কর্ত্তৃক দুর্য্যোধন বন্ধন ও অর্জ্জুন কর্ত্তৃক বিমোচন, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মৃগস্বপ্ন-সন্দর্শন, রমণীয় কাম্যকবনে পুনর্গমন, অতি বিস্তীর্ণ ব্রীহিদ্রৌণি কোপাখ্যান, মহর্ষি দুর্ব্বাসার উপাখ্যান, আশ্রমের অভ্যন্তর হইতে জয়দ্রথ কর্ত্তৃক দ্রৌপদী-হরণ, মহাবল ভীমের বায়ুবেগে গমন ও জয়দ্রথের পঞ্চশিখীকরণ, বহুবিস্তার রামায়ণ উপাখ্যান, রামচন্দ্র কর্ত্তৃক রাবণের বধ, সাবিত্রীর উপাখ্যান, কুণ্ডলদ্বয় দান দ্বারা ইন্দ্রের হস্ত হইতে কর্ণের অব্যাহতি, পরিতুষ্ট ইন্দ্র কর্ত্তৃক একপুরুষঘাতিনী শক্তিপ্রদান, আরণেয়-উপাখ্যান ও ধর্ম্মের সপুৎত্রানুশাসন, বরলাভ করিয়া পাণ্ডবদিগের পশ্চিমদিকে গমন, তৃতীয় আরণ্যক-পর্ব্বে এই সকল কীর্ত্তিত আছে। ইহাতে দুই শত একোনসপ্ততি অধ্যায় ও একাদশ সহস্র ছয় শত ও চতুঃষষ্টি শ্লোক আছে।
বিরাটপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অতঃপর বহু বিস্তৃত বিরাটপর্ব্ব শুনুন। পাণ্ডবগণ বিরাটনগরে প্রবেশ করিয়া শ্মশানে অতি প্রকাণ্ড শমীবৃক্ষ নিরীক্ষণপূর্ব্বক তাঁহাদের সমুদয় অস্ত্র তাহাতে সংস্থাপন করিলেন ও অতি প্রচ্ছন্নভাবে নগরে প্রবেশ করিয়া বিরাট-রাজপ্রাসাদে বাস করিতে লাগিলেন। দুরাত্মা কীচক কামোন্মত্ত হইয়া দ্রৌপদীর নিমিত্ত আপনার অভিমত অভিলাষ প্রকাশ করিলে ভীমসেন তাহার প্রাণসংহার করেন। রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডবদিগের অন্বেষণার্থ চতুর্দ্দিকে অতি সুচতুর চরসমূহ প্রেরণ করিলেন, কিন্তু তাহারা মহাত্মা পাণ্ডবদিগের অনুসন্ধান করিতে পারিল না। প্রথমতঃ ত্রিগর্ত্তেরা বিরাট-রাজার গোপন অপহরণ করে, তদুপলক্ষ্যে তাহাদিগের সহিত বিরাটের যুদ্ধ হয়। শত্রুপক্ষ বিরাট রাজাকে পরাজিত ও বন্ধন করিয়া লইয়া যাইতেছিল। ইত্যবসরে ভীমসেন স্ববিক্রমপ্রভাবে তাঁহাকে মুক্ত করেন, পাণ্ডবেরা বিরাটের অপহৃত গোধন প্রত্যাহরণ করেন। অনন্তর কৌরবগণ তাঁহার গোধন হরণ করিলে অর্জ্জুন বাহুবলে নিখিল কৌরবগণকে যুদ্ধে পরাভূত করিয়া বিরাটের গোধন উদ্ধার করেন। বিরাট সুভদ্রাগর্ভসম্ভূত অভিমন্যুকে উদ্দেশ করিয়া দুহিতা উত্তরাকে সম্প্রদান করিলে অর্জ্জুন তাঁহাকে প্রতিগ্রহ করেন। বেদবেত্তা মহর্ষি বেদব্যাস বিরাট-নামক চতুর্থ পর্ব্বে এই সকল কীর্ত্তন করিয়াছেন এবং ইহাতে সপ্তষষ্টি অধ্যায়, দুই সহস্র ও পঞ্চাশৎ শ্লোক আছে।
উদ্‌যোগপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    তৎপরে উদ্‌যোগ-নামক পর্ব্ব শ্রবণ করুন। পাণ্ডবেরা জিগীষা-পরবশ হইয়া উপপ্লব্য-নামক স্থানে অবস্থান করিলে দুর্য্যোধন ও অর্জ্জুন কৃষ্ণের সন্নিকটে উপস্থিত হইলেন। "তুমি এই যুদ্ধে আমাদিগের সাহায্য কর", তৎসন্নিধানে উভয়ে এইরূপ প্রার্থনা করিলে মহামতি কৃষ্ণ কহিলেন, "আমি এক পক্ষে এক অক্ষৌহিণী সেনা প্রদান করিব ও অন্য পক্ষে আমি একাকী থাকিব; কিন্তু কোনরূপে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না ও অকপটে তাহাদিগের মন্ত্রী হইব। এক্ষণে তোমরা অন্যতরের কে কি ইচ্ছা কর, বল।" অনভিজ্ঞ দুর্য্যোধন সৈন্য প্রার্থনা করিলেন ও অর্জ্জুন তাঁহাকে মন্ত্রিত্ব স্বীকার করিতে অনুরোধ করিলেন। পাণ্ডবদিগের সহায়তা করিবার নিমিত্ত সমাগত মদ্ররাজকে পথিমধ্যে দুর্য্যোধন বহুবিধ উপহার প্রদান করিয়া 'তুমি আমার সাহায্য কর', এইরূপ প্রার্থনা করিলেন। শল্য তাহাতে সম্মত হইয়া পাণ্ডবদিগের নিকট গমন করিলেন। তথায় যুধিষ্ঠিরের নিকট দেবরাজ ইন্দ্রের বৃত্রাসুরবিজয় বৃত্তান্ত বর্ণন করেন। পাণ্ডবেরা কৌরবসমীপে পুরোহিত প্রেরণ করিলেন। প্রবল-প্রতাপ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পুরোহিতের কথা শ্রবণ করিয়া শান্তি-স্থাপন প্রত্যাশায় সঞ্জয়কে দূতস্বরূপে পাণ্ডবদিগের নিকট পাঠাইলেন। কৃষ্ণ ও পাণ্ডবদিগের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অতিবলবতী চিন্তায় ধৃতরাষ্ট্রের নিদ্রাচ্ছেদ হইল। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বিবিধ হিতবাক্য শ্রবণ করান। মহর্ষি সনৎসুজাত রাজাকে শোকসন্তপ্ত দেখিয়া অতি উৎকৃষ্ট বেদশাস্ত্র শুনাইলেন। প্রভাত-সময়ে সভামণ্ডপে উপস্থিত হইয়া সঞ্জয় বাসুদেব ও অর্জ্জুনের অভিন্নত্ব কীর্ত্তন করেন। মহামতি কৃষ্ণ কৃপাপরায়ণ হইয়া সন্ধি বাসনায় হস্তিনাপুরে গমন করিয়াছিলেন। কিন্তু রাজা দুর্য্যোধন, উভয়পক্ষের হিতাকাঙ্ক্ষী তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। অনন্তর দম্ভোদ্ভবের উপাখ্যান, মহাত্মা মাতলির বরান্বেষণ, মহর্ষি গালবের চরিত, বিদুলার স্বপুৎত্রানুশাসন বর্ণিত আছে। কৃষ্ণ কর্ণ ও দুর্য্যোধনের নিতান্ত মন্দ অভিসন্ধি জানিতে পারিয়া সমস্ত রাজাদিগকে স্বীয় যোগেশ্বরত্ব দর্শন করাইলেন। কর্ণকে রথে আরোহণ করাইয়া তাঁহার সহিত কৃষ্ণ পরামর্শ করিয়াছিলেন, কিন্তু কর্ণ অহঙ্কার-পরতন্ত্র হইয়া তাঁহার মন্ত্রণা গ্রহণ করিল না। তিনি হস্তিনাপুর হইতে উপপ্লব্যে আগমন করিয়া পাণ্ডবদিগের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত-বর্ণন করিলেন। তাঁহারা কৃষ্ণের কথা শুনিয়া হিতাহিত বিবেচনাপূর্ব্বক যুদ্ধ-সজ্জা করিতে লাগিলেন। অনন্তর হস্তিনাপুর হইতে সংগ্রামবাসনায় হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতি এই সমুদয় ক্রমশঃ নির্গত হইতে লাগিল। রাজা দুর্য্যোধন যুদ্ধের পূর্ব্বদিবস পাণ্ডবদিগের নিকট উলুক-নামক দূত প্রেরণ করেন। রথী ও অতিরথ-সংখ্যা, অন্বোপাখ্যান, বহুবৃত্তান্ত-সংযুক্ত সন্ধিবিগ্রহ বিশিষ্ট উদ্‌যোগপর্ব্বে এই সকল কথিত হইল। ইহাতে শত ও ষড়শীতি অধ্যায় আছে। মহর্ষি এই পর্ব্বে ষট্‌সহস্র ষট্‌শত ও অষ্টনবতি শ্লোক রচনা করিয়াছেন।
ভীষ্মপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অতঃপর পরমাশ্চর্য্য ভীষ্মপর্ব্ব। ইহাতে সঞ্জয় জম্বুদ্বীপ নির্ম্মাণ বর্ণনা করেন। যুধিষ্ঠিরের সেনাগণ অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়। দশ দিবস অতি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হইয়াছিল। মহামতি বাসুদেব মুক্তিপ্রতিপাদক বহুবিধ যুক্তি প্রদর্শন করিয়া, অর্জ্জুনের মোহজনিত বিষাদ নিরাকরণ করেন। যুধিষ্ঠিরের হিতাভিলাষী মনস্বী কৃষ্ণ সত্বর রথ হইতে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক প্রতোদ [কশা বা চাবুক] হস্তে লইয়া নিঃশঙ্কচিত্তে ভীষ্মকে সংহার করিতে ধাবমান হইয়াছিলেন এবং সকল ধনুর্দ্ধারিশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনকে বাক্যরূপ অসি দ্বারা আঘাত করেন। অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়া শাণিত শরে ভীষ্মকে রথ হইতে ভূতলে পতিত করিয়াছিলেন। ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ান হইলেন। অতি বিস্তৃত ভারতের ষষ্ঠ পর্ব্ব সমাখ্যাত হইল। ইহাতে শত ও সপ্তদশ অধ্যায় নির্দ্দিষ্ট আছে। বেদবেত্তা ব্যাসদেব ভীষ্মপর্ব্বে পঞ্চ সহস্র, অষ্টশত ও চতুরশীতি শ্লোক রচনা করিয়াছেন।
 
দ্রোণপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অনন্তর বাহুবৃত্তান্তানুগত অতি বিচিত্র দ্রোণপর্ব্ব আরম্ভ হইতেছে। প্রবল-প্রতাপ দ্রোণাচার্য্য সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হইয়া দুর্য্যোধনের প্রীতিবর্দ্ধনের নিমিত্ত "ধীমান্ যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধে বন্দী করিব," এইরূপ অঙ্গীকার করিয়াছিলেন। সংসপ্তকগণ অর্জ্জুনকে সমরাঙ্গন হইতে অর্পসৃত করিয়াছিলেন। শত্রুতুল্য পরাক্রমশালী মহারাজ ভগদত্ত সুপ্রতীক নামক হস্তীর সহিত অর্জ্জুন কর্তৃক নিহত হন। জয়দ্রথ প্রভৃতি সপ্তরথী অপ্রাপ্তযৌবন একাকী বালক অভিমন্যুর প্রাণদণ্ড করিয়াছিলেন। অর্জ্জুন অভিমন্যু-বধে ক্রোধে অধীর হইয়া সপ্ত অক্ষৌহিণী সৈন্যের সহিত জয়দ্রথকে বিনষ্ট করিলেন। মহাবাহু ভীম ও মহারথ সাত্যকি রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমে অর্জ্জুনের অন্বেষণের নিমিত্ত অতি দুর্দ্ধর্ষ কৌরব-সেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। হতাবশিষ্ট সংসপ্তকগণ যুদ্ধে নিঃশেষ হয়। অলম্বুষ, শ্রুতায়ুঃ,মহাবীর জরাসন্ধ, সৌমদত্তি, বিরাট, মহারথ দ্রপদ ও ঘটোৎকচাদি অন্যান্য বীরগণের নিধনের বিষয় দ্রোণপর্ব্বে কথিত আছে। সমরে দ্রোণাচার্য্য হত হইলে, অশ্বত্থামা ক্রোধান্ধ হইয়া যে ভীষণ নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তাহাও এই পর্ব্বে বর্ণিত আছে। এই পর্ব্বে অত্যুৎকৃষ্ট রুদ্রমাহাত্ম্য, বেদব্যাসের আগমন এবং কৃষ্ণার্জ্জুনের মাহাত্ম্য অভিহিত হইয়াছে। এই মহাভারতের সপ্তম পর্ব্বের বিষয় কথিত হইল। এই দ্রোণপর্ব্বে যে যে বীরপুরুষদিগের কথা নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তাঁহারা প্রায় সকলই নিধন-প্রাপ্ত হয়েন। তত্ত্বদর্শী মহামুনি পরাশরাত্মজ এই পর্ব্বে এক শত সপ্ততি অধ্যায় ও অষ্ট সহস্র নব শত নব শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন।
কর্ণপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অতঃপর কর্ণপর্ব্বের কথা লিখিত হইতেছে। এই পর্ব্বে ধীমান্ শল্যের সারথ্যকার্য্যে নিয়োগ, ত্রিপুরনিপাতনবৃত্তান্ত, গমনকালে কর্ণ ও শল্যের পরস্পর বিবাদ, কর্ণতিরস্কারার্থ শল্য কর্ত্তৃক হংসকাকীয়োপাখ্যান-কথন, মহাপ্রভাব দ্রোণাত্মজ কর্ত্তৃক পাণ্ড্যের নিধন, দণ্ডসেন ও দণ্ডের বধ, সর্ব্বধনুর্দ্ধরগণসমক্ষে কর্ণের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের প্রাণসংশয়, যুধিষ্ঠির ও অর্জ্জুনের পরস্পর ক্রোধ, কৃষ্ণ কর্ত্তৃক অনুনয়বাক্য দ্বারা অর্জ্জুনের ক্রোধশান্তিকরণ, ভীমসেন কর্ত্তৃক যুদ্ধে দুঃশাসনের বক্ষঃস্থল-বিদারণপূর্ব্বক রক্তপান এবং অর্জ্জুনের সহিত দ্বৈরথ-যুদ্ধে কর্ণের নিপাত; এই সমস্ত বর্ণিত আছে। ভারতের অষ্টম পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। এই কর্ণপর্ব্বে একোনসপ্ততি অধ্যায় ও চারি সহস্র নয় শত চতুঃষষ্টি শ্লোক কীর্ত্তিত আছে।
শল্যপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অতঃপর বিচিত্র শল্যপর্ব্বের বিষয় কথিত হইতেছে। কুরুসৈন্য বীরশূন্য হইলে, মদ্রাধিরাজ শল্য সৈনাপত্যকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। শল্যপর্ব্বে যাবতীয় রথযুদ্ধ ও প্রধান প্রধান কৌরবদিগের বধ বর্ণিত আছে। এই পর্ব্বে মহাত্মা যুধিষ্ঠির কর্ত্তৃক শল্যের বধ ও সহদেব কর্ত্তৃক শকুনির বিনাশ কথিত আছে। দুর্য্যোধন অল্পমাত্রাবিশিষ্ট সৈন্য দেখিয়া দ্বৈপায়নহ্রদে প্রবেশপূর্ব্বক জলস্তম্ভ [নিশ্চল জলমধ্যে লুক্কায়িত ব্যক্তির বাহির হইতে অনুসন্ধান না পাইবার কৌশল] করিয়া তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। ব্যাধেরা হ্রদমধ্যে দুর্য্যোধনের আত্মগোপন-বৃত্তান্ত ভীমকে বলিয়া দিল। মহামানী দুর্য্যোধন ধীমান্ যুধিষ্ঠিরের তিরস্কারবাক্য সহ্য করিতে না পারিয়া হ্রদ হইতে উত্থিত হইলেন ও ভীমের সহিত গদাযুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। সংগ্রামসময়ে বলরাম আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই পর্ব্বে সরস্বতী ও অন্যান্য তীর্থ-সমুদয়ের পবিত্রতা কীর্ত্তন ও তুমুল গদাযুদ্ধবর্ণন আছে। যুদ্ধে বৃকোদর ভয়ানক গদাঘাতে দুর্য্যোধনের ঊরুদ্বয় ভগ্ন করিলেন। ভারতের নবম পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। এই পর্ব্বে নানাবৃত্তান্তযুক্ত একোনষষ্টি অধ্যায় কথিত আছে। এক্ষণে শ্লোকসংখ্যা কথিত হইতেছে। কুরুবংশযশঃকীর্ত্তক মহামুনি বেদব্যাস এই পর্ব্বে তিন সহস্র দুই শত বিংশতি শ্লোকের সংখ্যা করিয়া গিয়াছেন।
সৌপ্তিকপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অনন্তর দারুণ সৌপ্তিকপর্ব্বের কথা লিখিত হইতেছে। পাণ্ডবেরা সংগ্রামক্ষেত্র হইতে শিবিরে গমন করিলে, সায়ংকালে কৃতবর্ম্মা, কৃপাচার্য্য ও অশ্বত্থামা রুধিরাক্তকলেবর ভগ্নোরুযুগল অভিমানী রাজা দুর্য্যোধনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহারাজ রণক্ষেত্রে পতিত আছেন। মহাক্রোধ দ্রোণাত্মজ প্রতিজ্ঞা করিলেন, "ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাঞ্চালদিগকে ও অমাত্যসহিত পাণ্ডবগণকে বিনষ্ট না করিয়া বর্ম্মত্যাগ করিব না।" রাজাকে এইরূপ কহিয়া তিন জনেই সেস্থান হইতে অপক্রান্ত হইয়া প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের তলে উপবিষ্ট হইলেন। ঐস্থানে অশ্বত্থামা রাত্রিকালে পেচককে বহুসংখ্যক কাক নষ্ট করিতে দেখিয়া পিতৃনিধন-বৃত্তান্ত স্মরণপূর্ব্বক ক্রোধান্ধ হইয়া নিদ্রাতুর পাঞ্চালদিগের বধে সপ্রতিজ্ঞ হইলেন। এইরূপ স্থির করিয়া শিবিরদ্বারে গমনপূর্ব্বক দেখিলেন যে, একটা বিকটমূর্ত্তি ভয়ঙ্কর রাক্ষস আকাশ পর্য্যন্ত ব্যাপিয়া রহিয়াছে। অশ্বত্থামা অস্ত্র ত্যাগ করিতে লাগিলেন, কিন্তু রাক্ষসের কিছুতেই কিছু হইল না। তখন তিনি দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়া, কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্যের সহায়তায়, সুষুপ্ত ধৃষ্টদ্যুম্ল প্রভৃতি পাঞ্চালগণকে ও সপরিবার দ্রৌপদীর পুগণকে বিনাশ করিলেন। কেবল কৃঞ্চবলে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা ও ধনুর্দ্ধর সাত্যকি রক্ষা পাইলেন, আর সকলেই বিনষ্ট হইল। ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি যুধিষ্ঠিরাদিকে সমাচার দিল যে "অশ্বত্থামা প্রসুপ্ত পাঞ্চালদিগকে বধ করিয়াছে।" দ্রৌপদী পুৎত্র, পিতা, ও ভ্রাতাগণের নিধনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া নিতান্ত অধীরার ন্যায় অনশন সঙ্কল্প করিয়া স্বামিগণের নিকট উপবিষ্টা হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীম দ্রৌপদীর মনস্তুষ্টি-করণার্থ ক্রোধান্বিত হইয়া গদা গ্রহণপুরঃসর অশ্বত্থামার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। অশ্বত্থামা ভীমভয়াক্রান্ত হইয়া সক্রোধে "অদ্য আমি মেদিনী পাণ্ডববিহীনা করিব" এই বলিয়া অস্ত্র ত্যাগ করিলেন। কৃষ্ণ "এমন করিও না" এই বলিয়া অশ্বত্থামাকে নিবারণ করিলেন। অর্জ্জুন পাপাত্মা অশ্বত্থামাকে অনিষ্টাচরণে অভিনিবিষ্ট দেখিয়া স্বকীয় অস্ত্র দ্বারা অশ্বত্থামার অস্ত্রচ্ছেদন করিলেন এবং অশ্বত্থামা ও ব্যাসাদি পরস্পরের প্রতি শাপ প্রদান করিলেন। পাণ্ডবগণ মহারথ দ্রোণাত্মজের নিকট হইতে মণি গ্রহণ করিয়া সানন্দে দ্রৌপদীকে প্রদান করিলেন। ভারতের দশম সৌপ্তিকপর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। ব্রহ্মবাদী মহাত্মা উত্তমতেজা বেদব্যাস এই পর্ব্বে অষ্টাদশ অধ্যায় ও অষ্ট শত সপ্ততি শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন। ঐষীকপর্ব্ব এই পর্ব্বের অন্তর্গত।
স্ত্রীপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    এক্ষণে করুণরসোদ্ধেধক স্ত্রীপর্ব্বের বিষয় কথিত হইতেছে। এই পর্ব্বে পুৎত্রশোকার্ত্ত প্রজ্ঞাচক্ষু রাজা ধৃতরাষ্ট্র ভীমসেনকে সংহার করিতে সঙ্কল্প করিয়া লৌহময়ী ভীমপ্রতিমূর্ত্তি ভগ্ন করেন। বিদুর মোক্ষোপদেশক হেতুবাদ দ্বারা পুৎত্রশোকাভিসন্তপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সাংসারিকমোহনিবারণ ও তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করেন। শোকার্ত্ত ধৃতরাষ্ট্র অন্তঃপুরমহিলাগণের সহিত রণস্থলদর্শনার্থ গমন করেন। অতঃপর বীরবনিতাগণের করুণস্বরে রোদন এবং গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের ক্রোধ ও মোহ। তৎপর ক্ষৎত্রিয়পত্নীগণ সমরে অপরাঙ্মুখ নিহত পিতা, ভ্রাতা ও পুৎত্রগণকে দেখিলেন। কৃষ্ণ পুৎত্র-পৌৎত্রশোকাকুলা গান্ধারীর ক্রোধোপশমন করেন। সর্ব্ব-ধর্ম্মজ্ঞশ্রেষ্ঠ, মহাপ্রাজ্ঞ, রাজা যুধিষ্ঠির শাস্ত্রানুসারে নৃপতিগণের শরীর দাহ করাইলেন। ভূপতিগণের উদকক্রিয়া [তর্পণাদি] আরব্ধ হইলে কুন্তী কর্ণকে আপনার গূঢ়োৎপন্ন পুৎত্র বলিয়া স্বীকার ও প্রকাশ করেন। মহর্ষি বেদব্যাস এই একাদশ পর্ব্ব রচনা করিয়াছেন। এই পর্ব্ব শ্রবণ কিংবা পাঠ করিলে সহৃদয় জনের হৃদয় শোকাকুল ও নয়ন অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হয়। এই পর্ব্বে বেদব্যাস সপ্তবিংশতি অধ্যায় ও সপ্তশত পঞ্চসপ্ততি শ্লোকের সংখ্যা করিয়া গিয়াছেন।
শান্তিপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অতঃপর ধীশক্তিবর্দ্ধক শান্তিপর্ব্বে কথা লিখিত হইতেছে। এই পর্ব্বে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতৃগণ, ভ্রাতৃগণ, পুৎত্র, সন্বন্ধী ও মাতুলগণকে বধ করাইয়া সাতিশয়, নির্ব্বণ্ণ হইলেন। শরশয্যাশায়ী ভীষ্মদেব রাজা যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম্মোপদেশ প্রদান করেন। ঐ সমস্ত ধর্ম্মের যথার্থ-জ্ঞান দ্বারা লোকে সর্ব্বজ্ঞতা লাভ করে। ইহাতে বিচিত্র মোক্ষধর্ম্মের কথাও সবিস্তারে কথিত আছে। মহাভারতের দ্বাদশ পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। হে তপোধনগণ! এই শান্তিপর্ব্বে মহামুনি বেদব্যাস ত্রিশত ঊনচত্বারিংশৎ অধ্যায় ও চতুর্দ্দশ সহস্র সপ্ত শত সপ্ত শ্লোক রচনা করিয়াছেন।
অনুশাসনপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    ইহার পর অত্যুৎকৃষ্ট অনুশাসনপর্ব্ব। এই পর্ব্বে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভাগীরথীপুৎত্র ভীষ্মদেবের নিকট ধর্ম্মনিশ্চয় শ্রবণ করিয়া বিগতশোক ও স্থিরচিত্ত হইলেন। এই পর্ব্বে ধর্ম্মার্থ-সম্বন্ধ ব্যবহার সমুদয়-কথন, বিবিধ দানের বিবিধ প্রকার ফলনির্দ্দেশ, সৎপাত্র ও অসৎপাত্রের বিশেষ বিবেচনা, দানবিধানকথন, আচার-বিনির্ণয়, সত্যের স্বরূপ-কথন, গোগণের ও ব্রাহ্মণগণের মহত্বকীর্ত্তন, দেশ কালানুযায়ী-ধর্ম্মরহস্য-কথন ও ভীষ্মের অমরলোকসম্প্রাপ্তি কীর্ত্তিত আছে। ধর্ম্মনির্ণায়ক নানা-বৃত্তান্ত-সঙ্কলিত অনুশাসনাভিধান মহাভারতের ত্রয়োদশ পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। এই অনুশাসনপর্ব্বে মুনিসত্তম পরাশরাত্মজ একশত ষট্‌চত্বারিংশৎ অধ্যায় ও অষ্ট সহস্র শ্লোক নির্ণয় করিয়াছেন।
অশ্বমেধপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অতঃপর আশ্বমেধিক-নামক চতুর্দ্দশ পর্ব্বের বিষয় কথিত হইতেছে। এই পর্ব্বে সংবর্ত্তমুনি ও মরুত্ত রাজার আখ্যান, যুধিষ্ঠিরের হিমালয়স্থিত সুবর্ণস্তূপ-সম্প্রাপ্তি ও পরীক্ষিতের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার অস্ত্রানলে দগ্ধ হইয়াছিলেন; কৃষ্ণ তাঁহাকে জীবিত প্রদান করেন। অত্যুৎকৃষ্ট যজ্ঞ-তুরঙ্গরক্ষার্থ তৎপশ্চাদগামী অর্জ্জুনের নানাদেশে ক্রোধনরাজ-পুৎত্রগণের সহিত সংগ্রাম, চিত্রাঙ্গদার গর্ভে সমুদ্ভুত স্বসুত বভ্রুবাহনের সহিত যুদ্ধে ধনঞ্জয়ের জীবন-সংশয়। মহান্ অশ্বমেধযজ্ঞের সমাপ্তির পর নকুলের বৃত্তান্ত। এই পরমাদ্ভুত আশ্বমেধিক পর্ব্বের বিষয় কথিত হইল। এই পর্ব্বে অশেষ-তত্ত্ববিৎ ভগবান্ পরাশরসূনু ত্র্যধিক শত অধ্যায় ও তিন সহস্র তিন শত বিংশতি শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন।
আশ্রমবাসিকপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অনন্তর আশ্রমবাসাখ্য পঞ্চদশ পর্ব্ব। এই পর্ব্বে রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যত্যাগ করিয়া গান্ধারী ও বিদুরের সহিত অরণ্যানী [মহাবন] প্রবেশ করিলেন। গুরুশুশ্রূষায় একান্ত অনুরক্তা, সাধ্বী কুন্তীও ধৃতরাষ্ট্রকে বনে গমন করিতে দেখিয়া পুৎত্ররাজ্য পরিত্যাগকরতঃ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র সমরে নিহত লোকান্তরগত পুৎত্র-পৌৎত্র এবং অন্যান্য ক্ষৎত্রিয় বীরপুরুষগণকে পুনরাগত দেখিলেন। তিনি মহামুনি বেদব্যাসের প্রসাদে এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দর্শন করিয়া অবশেষে শোক পরিত্যাগপূর্ব্বক পরমসিদ্ধি লাভ করিলেন। বিদুর ও জিতেন্দ্রিয় গবলগণ-নন্দন সঞ্জয় অমাত্যের সহিত ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিয়া চরমে সদ্‌গতি প্রাপ্ত হইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তপোধন নারদকে সন্দর্শন করিলেন এবং তৎপ্রমুখাৎ যদুকুলধ্বংসের কথা অবগত হইলেন। এই অত্যদ্ভুত আশ্রমবাসাখ্য পর্ব্বের বিষয় কথিত হইল। মহামুনি বেদব্যাস এই পর্ব্বে দ্বিচত্বারিংশৎ অধ্যায় ও এক সহস্র পঞ্চশত ষট্‌শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন।
মৌষলপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    হে তপোধনগণ! অতঃপর দারুণ মৌষল-পর্ব্ব জানিবেন। এই পর্ব্বে লবণ-সমুদ্র-সমীপে ব্রহ্মশাপগ্রস্ত পুরুষসিংহ যাদবগণ আপানে [মদ্যপান দলবদ্ধ হইয়া যেখানে মদ্যপান করা হয়] –মদ্যপান দ্বারা মত্ত হইয়া দারুণ দৈবদুর্ব্বিপাকবশতঃ এরকা [শরতূণ শরকাঠি] রূপ বজ্র দ্বারা পরস্পর আঘাত করেন। কৃষ্ণ ও বলভদ্র উভয়ে আপনাদিগের কুলক্ষয় করিয়া পরিশেষে আপনারাও সর্ব্বসংহর্ত্তা সমুপস্থিত কালের করাল কবলে নিপতিত হয়েন। নরোত্তম অর্জ্জুন দ্বারবতী নগরীতে আগমনপূর্ব্বক ঐ নগরীকে যাদবশূন্য নিরীক্ষণ করিয়া বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। তিনি নরশ্রেষ্ঠ মাতুল বসুদেবের সংস্কার করিলেন এবং তৎপরে কৃষ্ণ ও বলরামের সংস্কার করিয়া পরিশেষে অন্যান্য প্রধান প্রধান বৃষ্ণিগণেরও সংস্কার করিলেন। অনন্তর তিনি দ্বারকা হইতে বৃদ্ধ ও বালকগণকে লইয়া গমন করিতে করিতে ঘোরতর আপৎকালে গাণ্ডীবের প্রভাবক্ষয় ও দিব্যাস্ত্র সমুদয়ের অপ্রসন্নতা দেখিলেন। তৎপরে তিনি যাদবমহিলাগণের নাশ ও প্রভুত্বের অনিত্যতা দর্শনে সাতিশয় নির্ব্বেদ-প্রাপ্ত হইয়া ব্যাসোপদেশে যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিয়া সন্ন্যাসধর্ম্মগ্রহণের বাসনা করিলেন। ষোড়শ-সংখ্যক মৌষলপর্ব্ব কীর্ত্তিত হইল। তত্ত্ববিৎ পরাশরাত্মজ এই পর্ব্বে আট অধ্যায় ও তিনশত বিংশতি শ্লোক গণনা করিয়াছেন।
মহাপ্রাস্থানিকপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
‌‌    তদনন্তর মহাপ্রাস্থানিক-নামক সপ্তদশ পর্ব্বের বিষয় লিখিত হইতেছে। এই পর্ব্বে পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণ স্বকীয় রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক দ্রৌপদী দেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া মহাপ্রস্থানে প্রস্থিত হইলেন। তাঁহারা লোহিত্যার্ণবের কূলে অগ্নিসন্দর্শন পাইলেন। অর্জ্জুন মহানুভব অগ্নি কর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া তাঁহাকে পূজা করিয়া অত্যুৎকৃষ্ট গাণ্ডীবধনু প্রদান করিলেন। যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীকে নিপতিত ও নিহত দেখিয়া তাঁহাদিগের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপও না করিয়া সমস্ত মায়ামোহ পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন। মহাপ্রাস্থানিকাখ্য সপ্তদশ পর্ব কথিত হইল। এই পর্ব্বে অশেষতত্ত্বজ্ঞ ভগবান্ পরাশরনন্দন তিন অধ্যায় ও তিন শত বিংশতি শ্লোক নির্দ্ধারিত করিয়াছেন।
স্বর্গরোহণপর্ব্ব শ্লোকসংখ্যা
    অনন্তর আশ্চর্য্য অলৌকিক স্বর্গপর্ব্ব জানিবেন। এই পর্ব্বে দয়ার্দ্রাচিত্ত মহাপ্রাজ্ঞ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির দেবলোক হইতে আগত দৈবরথে কুক্কুর ত্যাগ করিয়া আরোহণে সম্মত হইলেন না। ধর্ম্ম স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের ধর্ম্মে অবিচলিত অনুরাগ বুঝিতে পারিয়া কুক্কুররূপ পরিত্যাগপূর্ব্বক দর্শন দিলেন। পরম্‌-ধার্ম্মিক যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের সহিত একরথে উপবিষ্ট হইয়া স্বর্গে গমন করিলেন। দেবদূত ছল করিয়া নরক দর্শন করাইলেন। পরমধার্মিকাগ্রগণ্য যুধিষ্ঠির তৎস্থানস্থিত নির্দেশানুবর্ত্তী ভ্রাতৃগণের করুণ-রসোদ্দীপক ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণ করিলেন। ধর্ম্ম ও দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার মনোদুঃখ নিবারণ করেন। তৎপরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সুরদীর্ঘিকায় [স্বর্গনদীগঙ্গা] স্নান করিয়া মানুষ-কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বর্গে নিজ ধর্ম্মার্জ্জিত স্থান পাইয়া ইন্দ্রাদি দেবগণ কর্ত্তৃক পরম সমাদৃত হইয়া পরমানন্দে কালযাপন করিতে লাগিলেন। হে তপোধনগণ! অশেষধীশক্তিসম্পন্ন নামাতত্ত্বদর্শী মহর্ষি বেদব্যাস এই অষ্টাদশ পর্ব্ব রচনা এবং ইহাতে পাঁচ অধ্যায় ও দুই শত নব শ্লোকের সংখ্যা করিয়া গিয়াছেন।
হরিবংশ শ্লোকসংখ্যা
 
    এইরূপে অষ্টাদশ পর্ব্ব সবিস্তারে উক্ত হইল। ইহার পর হরিবংশ ও ভবিষ্যপর্ব্ব কথিত আছে। মহর্ষি হরিবংশে দ্বাদশ সহস্র শ্লোকসংখ্যা করিয়াছেন। মহাভারতের পর্ব্বসংগ্রহ নির্দ্দিষ্ট হইল।
পর্ব্বসংগ্রহ-প্রশংসা
    যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা আসিয়াছিল। সেই ঘোর সংগ্রাম অষ্টাদশ দিবস ব্যাপিয়া হয়।
    যে দ্বিজ অঙ্গ ও উপনিষদের সহিত চারি বেদ উত্তমরূপে অধ্যায়ন করিয়াছেন, কিন্তু মহাভারতাখ্যান জানেন না, তাঁহাকে বিচক্ষণ বলিতে পারা যায় না। অপরিমিত-ধীশক্তিমান্ বেদব্যাস এই ভারতকে অর্থশাস্ত্র, ধর্ম্মশাস্ত্র ও কামশাস্ত্রস্বরূপ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। যেমন পরম সুমধুর পুংস্কোকিলের কলরব শ্রবণ করিয়া কর্কশ কাকধ্বনি শ্রবণ করিতে ইচ্ছা  হয় না, সেইরূপ এই আখ্যান শ্রবণ করিলে অন্যশাস্ত্র-শ্রবণে রুচি থাকে না। যেমন পঞ্চভূত হইতে ত্রিবিধ লোকের উৎপত্তি হয়, সেইরূপ এই সর্ব্বোৎকৃষ্ট ইতিহাস হইতে কবিগণের বুদ্ধি উৎপন্ন হয়। হে বিপ্রোত্তমগণ! যেমন জরায়ুজাদি চতুর্ব্বিধ শরীরী অন্তরীক্ষের [আকাশতলের সমগ্র সৃষ্টির]  অন্তর্গত, সেইরূপ যাবতীয় পুরাণ এই আখ্যানের অন্তর্ভূত। যেমন বিচিত্রা মানসিক ক্রিয়া সমস্ত ইন্দ্রিয়গণের আশ্রয়, সেইরূপ এই ইতিহাস যাবতীয় দানাধ্যয়নাদি ক্রিয়া ও শমদমাদি গুণের আশ্রয়। যেমন আহার বিনা শরীরীর শরীর ধারণের উপায়ান্তর নাই, সেইরূপ এই সুললিত ইতিহাসান্তর্গত কথা ব্যতিরেকে ভূমণ্ডলে অন্য কথা নাই। যেমন সমুন্নতি-প্রেপসু ভূত্যগণ সদ্‌বংশজ প্রভুর আরাধনা করে, সেইরূপ কবিবরাগ্রগণ্যগণ এই বিচিত্র ইতিহাসের উপাসনা করিয়া থাকেন। যেমন অন্যান্য আশ্রমাপেক্ষা গৃহস্থাশ্রম উৎকৃষ্ট, সেইরূপ এই কাব্য অন্যান্য কবিকৃতকাব্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
    হে মহর্ষিগণ! তোমাদিগের ধর্ম্মে মতি হউক। কারণ, লোকান্তরগত জনের ধর্ম্মই অদ্বিতীয় বন্ধু। অর্থ ও স্ত্রী সাতিশয়ানুরাগপূর্ব্বক সেবিত হইলেও কখন স্থির ও আত্মীয় হয় না। যে ব্যক্তি কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ওষ্ঠবিনির্গত অপ্রমেয় পরমপবিত্র পাপনাশক মঙ্গলবিধায়ক পাঠ্যমান ভারত শ্রবণ করে, তাহার পুষ্করজলে স্নান করিবার প্রয়োজন কি? ব্রাহ্মণ দিবাভাগে নিরঙ্কুশ ইন্দ্রিয়গণ-প্রভাবে যে পাপরাশি সঞ্চয় করেন, সন্ধ্যাকালে মহাভারত পাঠ দ্বারা সেই সকল পাপপুঞ্জ হইতে মুক্ত হয়েন; আর নিশাকালে কর্ম্ম, মন ও বাক্য দ্বারা যে সকল পাপ সঞ্চয় করেন, প্রাতঃকালে মহাভারত পাঠ করিয়া সেই সমস্ত পাপ হইতে মুক্ত হয়েন। যে ব্যক্তি বেদজ্ঞ ও বহুশ্রুত ব্রাহ্মণকে কনকমণ্ডিত শত গো-দান করে, আর যে ব্যক্তি পরম পবিত্র ভারত-কথা প্রত্যহ শ্রবণ করে, এই দুইজনের তুল্য ফললাভ হয়। যেমন অর্ণবপোতাদি দ্বারা সুবিস্তীর্ণ অগাধ-জলধি অনায়াসে পার হওয়া যায়, সেইরূপ অগ্রে পর্ব্বসংগ্রহশ্রবণ দ্বারা অত্যুৎকৃষ্ট মহার্থযুক্ত উপাখ্যান সুখবোধ্য হয় জানিবেন।
পর্ব্বসংগ্রহাধ্যায় সমাপ্ত।


Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।