২৩ ডিসেম্বর ২০১৩

সমন্তপঞ্চকোপাখ্যান


ঋষিগণ কহিলেন, "হে সূতনন্দন! আমরা ভারতের অনুক্রমণিকা শুনিলাম, এক্ষণে সমন্তপঞ্চক নামক যে তীর্থের উল্লেখ করিয়াছ, তাহার যাহা কিছু বর্ণনীয় আছে সমুদয় শ্রবণ করাইয়া আমাদিগকে চরিতার্থ কর।" ঋষিদিগের এইরূপ প্রার্থনাবাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া অতি শিষ্টপ্রকৃতি সৌতি কহিতে লাগিলেন, হে ব্রাহ্মণগণ! আমি আপনাদিগের সম্মুখে সমন্তপঞ্চক তীর্থের বৃত্তান্ত ও অন্যান্য কথা প্রসঙ্গক্রমে সমুদয় কীর্ত্তন করিতেছি, অবধান করুন।

অদ্বিতীয় বীর পরশুরাম ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিতে পিতৃবধ-বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া ক্রোধপরায়ণ হইয়া এই পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষৎত্রিয়া করেন। তিনি স্ববিক্রম-প্রভাবে নিঃশেষে ক্ষৎত্রিয়কুল উৎসন্ন করিয়া সেই সমস্তপঞ্চকে শোণিতময় পঞ্চহ্রদ প্রস্তুত করেন। শুনিয়াছি, তিনি রোষপরবশ হইয়া সেই হ্রদের রুধির দ্বারা পিতৃলোকের তর্পণ করিয়াছিলেন। অনন্তর ঋচীক প্রভৃতি পিতৃগণ তথায় আগমন করিয়া পরশুরামকে কহিলেন, "হে মহাভাগ রাম! তোমার এরূপ অবিচলিত পিতৃভক্তি ও অসাধারণ বিক্রম দর্শনে আমরা অত্যন্ত প্রীত হইয়াছি, এক্ষণে তুমি আপনার অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।

" রাম কহিলেন, "হে পিতৃগণ! যদি প্রসন্ন হইয়া ইচ্ছানুরূপ বর প্রদানে অনুগ্রহ করেন, তাহা হইলে ক্রোধে অধীর হইয়া ক্ষৎত্রিয়বংশ ধ্বংস করিয়া যে পাপরাশি সঞ্চয় করিয়াছি, সেই সকল পাপ হইতে যাহাতে মুক্ত হই এবং এই শোণিতময় পঞ্চহ্রদ অদ্যাবধি পৃথিবীতে তীর্থস্থান বলিয়া যাহাতে প্রখ্যাত হয়, এরূপ বর প্রদান করুন।"পিতৃগণ 'তথাস্তু' বলিয়া পরশুরামের অভিমত বর প্রদানপূর্ব্বক সেইরূপ অধ্যাবসায় হইতে তাঁহাকে ক্ষান্ত হইতে আদেশ করিলেন। তিনিও তদবধি ক্ষৎত্রিয়দিগের উপর আর কোনরূপ অত্যাচার করিলেন না।


সেই শোণিতময় পঞ্চহ্রদের সন্নিধানে যে সকল প্রদেশ আছে, তাহাকেই পরম পবিত্র সমন্তপঞ্চক তীর্থ বলিয়া নির্দ্দেশ করা হয়। কারণ, পণ্ডিতেরা কহেন, যে দেশ যে কোন বিশেষ চিহ্নে চিহ্নিত, তাহা তন্নামেই প্রখ্যাত হইয়া থাকে। ঐ সমন্তপঞ্চক তীর্থে কলি ও দ্বাপরের অন্তরে কুরু ও পাণ্ডবসৈন্যের ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা যুদ্ধার্থে ভূদোষবর্জ্জিত সেই পুণ্যক্ষেত্রে সমবেত ও নিহত হয়। হে ব্রাহ্মণগণ! ইহাই তাহার যথার্থ ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থ। সেই তীর্থ অতি পবিত্র ও রমণীয়। হে ধর্ম্মপরায়ণ মহর্ষিগণ! ত্রিলোকে ঐ দেশ যেরূপ বিখ্যাত, তাহা আপনাদের সমক্ষে কহিলাম।

অক্ষৌহিণী-পরিমাণ

ঋষিগণ কহিলেন, "হে সুতনন্দন! তুমি যে অক্ষৌহিণী শব্দের উল্লেখ করিলে, আমরা তাহার অর্থ শুনিতে ইচ্ছা করি। কারণ, তুমি সকলই জান, অতত্রব কত নর, কত হস্তী, কত অশ্ব ও কত রথে এক অক্ষৌহিণী হয়, তাহা সপ্রমাণ করিয়া বল।" সৌতি কহিলেন,– এক রথ, এক হস্তী, পঞ্চ পদাতি ও তিন অশ্ব, ইহাতে একটি পত্তি হয়। তিন পত্তিতে এক সেনামুখ, তিন সেনামুখে এক গুল্ম, তিন গুল্মে এক গণ, তিন গণে এক বাহিনী, তিন বাহিনীতে এক পৃতনা, তিন পৃতনায় এক চমু, তিন চমূতে এক অনীকিনী, দশ অনীকিনীতে এক অক্ষৌহিণী হয়। এক অক্ষৌহিণীতে একবিংশতি সহস্র অষ্টশত ও সপ্ততি-সংখ্যক রথ ও তৎসংখ্যক গজ, একলক্ষ নয় সহস্র তিন শত পঞ্চাশ জন পদাতি এবং পঞ্চষষ্টি সহস্র ছয় শত দশ অশ্ব থাকে।

আমি যে অক্ষৌহিণী শব্দের উল্লেখ করিলাম, সংখ্যাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা তাহার এইরূপ নিরূপণ করিয়াছেন [এক অক্ষৌহিণীমাণ– ১ লক্ষ ৯ হাজার ৫০ পদাতি, ৬৫ হাজার ৬ শত ১০ অশ্ব, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ হস্তী, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ রথ। মোট সৈন্যসংখ্যা ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৭ শত]। সমন্তপঞ্চক তীর্থে কুরু ও পাণ্ডবদিগের এইরূপ অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা একত্র সমাগত হইয়াছিল। সেই সেনা কৌরবদিগকে উপলক্ষ্য করিয়া কালের অদ্ভুত ও অচিন্তনীয় শক্তিসহকারে তথায় মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। তন্মধ্যে পরমাস্ত্রবেত্তা ভীষ্ম দশ দিবস যুদ্ধ করেন, দ্রোণ পাঁচ দিন কৌরবসেনা রক্ষা করিয়াছিলেন। পরবলপীড়ক কর্ণ দুই দিবস ও শল্য অর্দ্ধদিবস মাত্র যুদ্ধ করেন। তৎপরে ভীমসেন ও দুর্য্যোধনের গদাযুদ্ধ আরম্ভ হয়, তাহাও দিবসার্দ্ধ মাত্র। অনন্তর দিবসের অবসানে ও নিশার আগমন হইলে অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্য সকলে একমত অবলম্বন করিয়া অসঙ্কুচিতচিত্তে সুখপ্রসুপ্ত যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণকে সংহার করিলেন।
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।