• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪

মহালয়া আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ- এ যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি মুক্তা


১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে All India Radio Medium Wave প্রচার তরঙ্গে এই অনুষ্ঠানের সূচনা। শুরু হয়েছিল নিছক একটি experiment হিসেবেই, হয়ে গেল কিংবদন্তী। কোন বেতার তরঙ্গে নিয়ম করে এতদিন ধরে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়া, সারা বিশ্বে এমন নজির কোথাও নেই। আপামর বাঙ্গালিদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরকালের জন্য অমর হয়ে রইল বাণীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরারোপিত এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র দ্বারা উচ্চারিত শ্রীশ্রীচণ্ডীর শ্লোকসমূহ।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৩৪ সালে দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্রচারিত হয় দেবী মাহাত্ম্য বিষয়ক এক সঙ্গীত আলেখ্য। এটি প্রচারিত হবার পর অবিভক্ত বাংলায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। তারপরই জন্ম নেয় আজকের "মহিষাসুরমর্দিনী।" প্রথমদিকে রেকর্ডিঙের ব্যবস্থা না থাকায় মহালয়ার ভোরে সব শিল্পীদের নিয়ে আকাশবাণীর গারস্টিন প্লেসের পুরাতন স্টুডিও থেকে এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হত। রাশভারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে তখনকার দিনের তাবড় তাবড় শিল্পী ও কলাকুশলীরা সকলেই ভয় ও সমীহ করে চলতেন। তাঁর নির্দেশে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, শিপ্রা বসু, মানবেন্দ্র ইত্যাদি সঙ্গিত মহলের বিশিষ্ট নক্ষত্ররা রাত ৩টের মধ্যেই স্টুডিওতে এসে হাজির হয়ে যেতেন। ঠিক ৪টে থেকে শুরু হত অনুষ্ঠানটি।

সত্তরের দশকে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের এই "মহিষাসুরমর্দিনী" বাতিল করে মহানায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে ভাষ্যপাঠ করিয়ে নবরূপে এই অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠান শেষে ভয়ংকর জনরোষ দেখা দেয়। কর্তৃপক্ষের কাছে অজস্র চিঠি আসতে থাকে। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা মহানায়ককেও বিপুল তিরস্কার হজম করতে হয়েছিল এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। শোনা যায়, উত্তমকুমার নিজে গিয়ে এর জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কাছে ক্ষমা চেয়ে এসেছিলেন। আকাশবাণী দ্বিতীয়বার আর উত্তমকুমারের সেই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করার সাহস করেনি। পরের বছর হতে পুনরায় "মহিষাসুরমর্দিনী" ফিরে আসে, আজও যা নতুন, আজও যা হ্রদয়গ্রাহী। পূজা এলেই যেন হৃদয়তন্ত্রীতে আপনেই বেজে ওঠে সেই চিরপরিচিত সুর-

"রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিশো জহি............ "

---Tamojit

Collected from: Fans of Durga Puja
Share:

০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪

স্বামী বিবেকানন্দের দুর্গাপুজো পর্ব-০২



এরপর দীর্ঘদিন কেটে গেছে। পুজোর সময়ও এসে গেল। কিন্তু পুজোর এক সপ্তাহ আগেও এ নিয়ে কোনও কথাবার্তা বা উদ্যোগ দেখা গেল না। হয়ত এ বারও বিবেকানন্দের ইচ্ছাটির পূরণ হল না। কিন্তু হঠাৎই একদিন, তখন পুজোর আর মাত্র চার-পাঁচ দিন বাকি, স্বামীজি কলকাতা থেকে নৌকা করে বেলুড়মঠে ফিরেই ‘রাজা কোথায়? রাজা কোথায়?’ বলে স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজের খোঁজ করতে লাগলেন। (স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামী বিবেকানন্দ রাজা বলে সম্বোধন করতেন)। স্বামী ব্রহ্মানন্দকে দেখতে পেয়েই বিবেকানন্দ বলে উঠলেন, ‘এবার মঠে প্রতিমা এনে দুর্গাপূজা করতে হবে, তুমি সব আয়োজন করে ফেল।’ সবে আর মাত্র চার-পাঁচটা দিন বাকি রয়েছে। এত কম সময়ের মধ্যে সব আয়োজন কীভাবে করবেন, প্রতিমাই বা পাওয়া যাবে কি না, এই সব ভেবে ব্রহ্মানন্দজি বিবেকানন্দের কাছে দুটো দিন সময় চাইলেন। বিবেকানন্দ বললেন, ‘আমি ভাব-চক্ষে দেখেছি এবার মঠে দুর্গোৎসব হচ্ছে এবং প্রতিমায় মার পূজা হচ্ছে।’ স্বামী ব্রহ্মানন্দজিও তাঁর এক অদ্ভুত কথা স্বামী বিবেকানন্দকে জানালেন। দিন চারেক আগের ঘটনা। ব্রহ্মানন্দজি বেলুড়মঠের গঙ্গাতীরে বসেছিলেন। হঠাৎই দেখলেন দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে মা দুর্গা গঙ্গা পার হয়ে মঠের বেলগাছতলায় এসে উঠলেন।

স্বামীজি আর ব্রহ্মানন্দ মহারাজের মধ্যেকার এই সব কথাবার্তা বেলুড়মঠের অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তেই বেশ হই হই পড়ে গেল। ব্রহ্মানন্দ মহারাজ ব্রহ্মাচারী কৃষ্ণলালকে কলকাতার কুমারটুলিতে পাঠালেন কোনও প্রতিমা পাওয়া যাবে কি না দেখে আসতে। আর কী আশ্চর্য! ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল কুমারটুলিতে গিয়ে দেখলেন যে মাত্র একটিই সুন্দর প্রতিমা সেখানে অবশিষ্ট রয়েছে। যিনি বা যাঁরা সেই প্রতিমাটি তৈরি করতে দিয়েছিলেন, সে দিনও পর্যন্ত তাঁরা সেটি নিতে আসেননি। ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল শিল্পীকে ওই প্রতিমাটি পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞাসা করতে শিল্পী একটি দিন দেখে নেওয়ার সময় চাইলেন। বেলুড়মঠে ফিরে এসে এই খবর স্বামী বিবেকানন্দকে জানাতেই তিনি ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলালকে বললেন, ‘যেমন করেই হোক তুমি প্রতিমাখানি নিয়ে আসবে।’
....................................... মণীশ সিংহরায়


ক্রমশ..........................................।
সংগ্রহেঃ-কৃষ্ণকমল
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ আশ্বিন ১৪০৯ রবিবার ১৩ অক্টোবর ২০০২
Share:

স্বামী বিবেকানন্দের দুর্গাপুজো পর্ব-০১


১৯০১ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপুজো করলেন। আর সেই থেকেই বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোর প্রচলন হল। সেই পুজোর মাত্র আট মাস পরেই ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই স্বামীজি মহাসমাধিস্থ হলেন। তাঁর শততম প্রয়াণ বর্ষে ফিরে দেখা যাক বিবেকানন্দের সেই দিনগুলিকে।

অনেক দিন ধরেই স্বামী বিবেকানন্দের মনে এই ইচ্ছেটা ছিল যে তিনি বেলুড়মঠে দুর্গাপুজো করবেন। কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠার পর স্বামীজি প্রায়ই তাঁর প্রিয় বেলগাছতলায় বসে সম্মুখে প্রবাহিতা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আপন মনে গাইতেন ‘‘...বিল্ববৃক্ষমুলে পাতিয়া বোধন/গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন।/ঘরে আনব চণ্ডী, কর্ণে শুনব চণ্ডী,/আসবে কত দণ্ডী, জটাজুটধারী।...’’ এরপর একদিন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন মাস নাগাদ স্বামীজির অন্যতম গৃহী শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী বেলুড়মঠে এলে বিবেকানন্দ তাঁকে ডেকে রঘুনন্দনের ‘অষ্টবিংশতি তত্ত্ব’ বইটি কিনে আনার জন্য বললেন। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি রঘুনন্দনের বইটি নিয়ে কি করবেন?’ স্বামীজি বললেন, ‘এবার মঠে দুর্গোৎসব করবার ইচ্ছে হচ্ছে। যদি খরচ সঙ্কুলান হয় ত মহামায়ার পুজো করব। তাই দুর্গোৎসববিধি পড়বার ইচ্ছা হয়েছে। তুই আগামী রবিবার যখন আসবি তখন ঐ পুস্তকখানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসবি।’ যথাসময়েই শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী বইখানি বিবেকানন্দকে এনে দিয়েছিলেন। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বইটি পড়া শেষ করে বিবেকানন্দ তাঁর স্নেহভাজন শিষ্যের সঙ্গে আবার দেখা হতেই জানিয়েছিলেন, ‘রঘুনন্দনের স্মৃতি বইখানি সব পড়ে ফেলেছি, যদি পারি তো এবার মার পূজা করব।’


মণীশ সিংহরায়

ক্রমশ..........................................।
সংগ্রহেঃ-কৃষ্ণকমল

সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ আশ্বিন ১৪০৯ রবিবার ১৩ অক্টোবর ২০০২
Share:

উপবাস




উপবাস হিন্দুদের আচার বিশেষ। সামাজিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য খাদ্য গ্রহণ না করাকেই বলে উপবাস। বিবাহ, পূজার্চনা এবং বিভিন্ন ব্রত উপলক্ষে উপবাস পালন করা হয়। সাধনক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় সংযম অত্যাবশ্যক কর্ম, আর এ জন্য উপবাস একটি প্রধান উপায়। উপবাস শব্দটির মধ্যে দুটি বিষয়ের দ্যোতনা আছে; একটি হলো খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং অপরটি কায়মনোবাক্যে ইষ্টদেবতার সান্নিধ্য অনুভব করা।

দেহ-মনকে সুস্থ ও নীরোগ রাখার জন্যও অনেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক উপবাস পালন করেন। তাঁদের ক্ষেত্রে দৈহিক ব্যাপারটিই প্রধান, মানসিক সংযম সেখানে গৌণ। অপরদিকে যাঁরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উপবাস পালন করেন তাঁরা দেহ-মন উভয় দিক থেকেই সংযত হয়ে থাকেন। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ এগুলি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও উপবাস বিশেষ ভূমিকা রাখে। উপবাস দ্বারা সংযমী সাধক মন, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে আরাধ্য দেব-দেবীর সান্নিধ্য অনুভব করেন এবং এর মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করেন। তাই আত্মিক ভাবনায় ঋদ্ধ ব্যক্তিগণ দেহ ও মন উভয় সুস্থ রাখার জন্য সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে, একাদশী তিথিতে অথবা অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপবাস পালন করেন। এ ছাড়া বিশেষ পূজা-অর্চনাদির সময়ও ভক্তগণ উপবাস পালন করেন। যেমন সরস্বতী পূজা উপলক্ষে হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা উপবাস পালন করে।

ব্যক্তিবিশেষের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী উপবাসের প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যদি কেউ পূর্ণ একটা তিথি (প্রায় চবিবশ ঘণ্টা) উপবাস থাকতে না পারেন তাহলে তিনি স্বাভাবিক আহারের পরিবর্তে কিঞ্চিৎ লঘুখাদ্য গ্রহণ করতে পারেন। আবার কেউ কেউ উপবাসের সময় পানীয় পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। বহু সাধক-মহাপুরুষের জীবনে ক্রমাগত দুই, তিন, চার, পাঁচদিন ব্যাপী উপবাসের কাহিনীও জানা যায়। স্বাভাবিক উপবাস দেহ ও মনকে সুস্থ ও পবিত্র রাখে। [পরেশচন্দ্র মন্ডল]
Share:

শ্যামা বা আদ্যাশক্তি

 প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে, তিনি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশ জন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী। শাক্তরা কালীকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিকারণ মনে করে। বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।
পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা; গলায় মানুষের মুণ্ড দিয়ে গাঁথা মালা; বিরাট জিভ, কালো গায়ের রং, এলোকেশ দেখা যায় এবং তাঁকে তাঁর স্বামী শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ব্রহ্মযামল মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীর বিভিন্ন রূপভেদ আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে "ব্রহ্মময়ী", "ভবতারিণী", "আনন্দময়ী", "করুণাময়ী" ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়।আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। এছাড়া মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে।
কালী দেবীর উপাসকরা হিন্দু বাঙালি সমাজে বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। কালীকে বিষয়বস্তু করে রচিত "শ্যামাসংগীত" বাংলা সাহিত্য ও সংগীত ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্গ। রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কালী সাধকেরা এবং কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ বিশিষ্ট কবিরা অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত লিখেছেন। "মৃত্যুরূপা কালী" হল দেবী কালীকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি বিখ্যাত দীর্ঘকবিতা। ভগিনী নিবেদিতা মাতৃরূপা কালী নামে একটি কালী-বিষয়ক বইও রচনা করেছিলেন।
Share:

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কোন মাসের কত তারিখে আরম্ভ হয়? ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রী মুখ থেকে গীতা প্রকটের দিনই বা কবে?

আমরা মহাভারত থেকে জানতে পারি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশম দিনে পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় পতিত হন। কিন্তু তিনি সে দিন মৃত্যুবরণ করেননি। সে সময় দক্ষিণায়ন চলছিল তাই তিনি বললেন ‘ভূতলে পতিত থেকেই আমি উত্তরায়ণের জন্যে প্রাণ ধারন করব। সূর্য দক্ষিণায়নে থাকতে আমি মরব না উত্তরায়ণের দেহত্যাগ করব। পিতা শান্তনুর বরে মৃত্যু আমার ইচ্ছাধীন।(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব) এরপর মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ২১ পরিচ্ছদে আমরা দেখি পিতামহ ভীষ্ম তাঁর মৃত্যুর সময়ে বলছেন তিনি ৫৮ দিন শরশয্যায় শুয়ে আছেন। আমরা জানি পৌষ সংক্রান্তিতে দক্ষিণায়নের অবসান হয়। তাহলে ১লা মাঘ উত্তরায়ণের প্রথম দিন তথা উত্তরায়ণের শুরু। আর তাই ১লা মাঘ পিতামহ ভীষ্ম মৃত্যুবরণ করছিলেন এ কথা প্রমাণিত।

তাহলে ১লা মাঘ থেকে শরশয্যার ৫৮ দিন এবং যুদ্ধের প্রথম ১০ দিন (৫৮+১০)=৬৮ দিন পিছিয়ে গেলে যে তারিখ পাওয়া যাবে সেটাই হবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুরুর দিন এবং গীতার আবির্ভাবের দিন। ৫৮ দিন পিছিয়ে গেলে পৌষ মাসের ২৯ দিন + অগ্রহায়ণ মাসের ৩০ দিন=৫৯ দিন, তাহলে পহেলা মাঘ থেকে পিছালে আমরা পাই ৩০ কার্তিক। এখন পুরো ৬৮ দিন পিছিয়ে যেতে আরও ৯ দিন পিছাতে হবে। ৩০ কার্তিক থেকে ৯ দিন পিছালে আমরা পাব ২১ কার্তিক। সুতরাং ‘২১ কার্তিকই’ হল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ নিঃসৃত বাণী শ্রীমদ্ভগবদগীতা প্রকটের দিন।

পুনশ্চঃ ১. তবে বাংলা মাস বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের হয়, যেমন কোন বার কোন মাস ২৯ দিনে হয় আবার কোন বার ৩০ দিনে। দুই একদিন হেরফের করে ধরে নিলেও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু ও গীতার প্রকটের দিন কার্তিকের ২০/২১/২২ তারিখের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে এটাও বলে রাখা ভাল মহাভারতের যুগে এই ভাবে মাস গণনা করা হত না। সে সময় উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন, নক্ষত্র ইত্যাদি অনুসারে হিসাব হত। তাই এই তথ্য একেবারে অভ্রান্ত দাবী করা ঠিক হবে না।

তবে মহাভারত থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই হিসাবটি মোটামুটি সর্বজন গ্রাহ্য একটি হিসাব। ২. উত্তরায়ণ = মাঘ থেকে আষাঢ় এই ছয় মাস। ৩. দক্ষিণায়ন = শ্রাবণ থেকে পৌষ এই ছয় মাস। তথ্যসূত্রঃ ১. গীতা তত্ত্ববোধিনী, প্রফেসর নিখিল ভট্রাচার্য, প্রকাশকঃ নির্ঝর, নিসর্গ – হাসপাতাল সড়ক, হবিগঞ্জ প্রকাশ কালঃ ১ম জন্মাষ্টমী ১৪১২ এবং ২য় মহালয়া ১৪১৩ ২. মহাভারত, রাজশেখর বসু, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, বঙ্কিম চ্যাটাজি স্ট্রীট, কলিকাতা। ৩. সংক্ষিপ্ত মহাভারত, গীতাপ্রেস।

লেখক: অগ্নি সম্পদ
Share:

দেবীর আশা-যাওয়ার নেপথ্যে

প্রতি বছর গজ, ঘোটক, নৌকা, দোলা এইসব যানবাহন করে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আসা ও যাওয়ার সময় শুভ, অশুভ, ক্ষয়ক্ষতি ও নানাভাবে মানুষের মৃত্যুসংবাদও শোনা যায়। পুরাকালের মুনি, ঋষি ও পণ্ডিতেরাও একসময় ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছিলেন, মায়ের আগমন ও গমন এবং পুজোর সময়ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মৃত্যু, ধ্বংস-এই সমস্ত অশুভ ঘটনার কারণ কী? তাঁরা আরও ভেবেছিলেন যে, শুভ ঘটনার চেয়ে অশুভ ঘটনার প্রাধান্যই বা কেন থাকে, তাছাড়াও দেব-দেবীরা এই ব্যাপারে নিরব কেন? ভাবনা চিন্তার পর তাঁরা ঠিক করলেন, পুজোর আগে, পুজোর সময় ও দুর্গার গমনের সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। যথাসময়ে তাঁদের দিব্যদৃষ্টিতে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে সবকিছু। ঘটনার গতি-প্রকৃতির অর্থাৎ দেবীর আগমন, গমন ও পুজোর সময় যে সব ঘটনা ঘটছে তা উপলব্ধি করে পারস্পরিক আলোচনায় দিন, তিথি ও নক্ষত্রের দিকে সন্দেহের আঙুল তুলে তাদের দোষী সাব্যস্ত করলেন। কিন্তু তাঁদের একথাও মনে হলো যে, এই তিথি, নক্ষত্র ও দিন এত শক্তি কোথা থেকে পেলো। আবার চলল অনুসন্ধান। এবার তাঁরা জানতে পারলেন যে, দেব-দেবীরাই নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্যেই এই সব তিথি-নক্ষত্রকে বিশেষভাবে শক্তিশালী করে তাঁদের পাহারাদারে নিযুক্ত করেছিলেন।

দেব-দেবীর দাপট বা শক্তি যতই থাকুক না কেন, দিন, তিথি ও নক্ষত্রের কর্তৃত্বকে এঁরা কেউই অস্বীকার করতে পারেননি কারণ এই তিন শক্তিকে তো দেবতারাই সৃষ্টি করেছেন।

আসলে শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থার মতো দেব-দেবীরাও হিসেবের খাতায় সমতা রাখার জন্যে সৃষ্টি ও লয় এই দুটো অঙ্ককে মাথায় রেখেছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, সৃষ্টিপ্রাপ্তদের সংখ্যাকে ক্রমশই বাড়তে দিলে, মহাপ্রলয়ের সূচনা হবে, তাই ধ্বংসের প্রয়োজন আছে। লয়কে সৃষ্টি করার জন্যে বন্যা, ভূমিকম্প, মহামারি ইত্যাদির দ্বারা তাকে শক্তিশালীও করা হয়েছিল। অবশ্য দেবর্ষি নারদের কাছ থেকে এই সংবাদ পেয়ে, মুনি-ঋষি ও পণ্ডিতেরা বুঝেছিলেন দুর্গতিনাশিনী দেবী প্রয়োজনবোধে কেন ধ্বংসকারিণী রূপে আবির্ভূতা হন। এই সমস্ত প্রকৃত তথ্য উন্মোচন হবার পর, মুনি-ঋষি ও পণ্ডিতেরা বিষয়টাকে বিধিবাক্য ও শাস্ত্রমতে চিহ্নিত করেছিলেন। অর্থাৎ দুর্গার আগমন ও গমনে যে বিপর্যয় ঘটে, সেই নিয়ে তাঁদের মনে আর সংশয় রইল না বলে আদি অনন্তকাল ধরে সেই নিয়মই চলে আসছে। জ্যেতিষীরা এই ব্যাপারটিকে ‘সিম্বলিক, বা প্রতীকি রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। ভাগ্যগণনার সময় মানুষের ভাগ্যচক্রে তিথি, নক্ষত্র, দিন ও জন্মসময় ইত্যাদির বিষয়ে লক্ষ্য রেখে তাঁরা মানুষের জীবনে শুভ, অশুভ, শোক, দুঃখ ও আনন্দের ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছেন। তাই জন্মসময়, দিন ও গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির ওপর তাকিয়েই জ্যোতিষীরা কোষ্ঠী বিচার ও হাতে প্রতীকি ও অন্যান্য চিহ্ন দেখেই সার্বিক ভাগ্যচক্রের উত্থান, পতন, আয়ু, স্বাস্থ্য ইত্যাদির কথা বিচার করে থাকেন।

পৌরাণিক যুগে গজ, ঘোটক, নৌকো এবং দোলার ব্যবহার আমরা জেনেছি এবং পুরাকালেও মানুষ এই যানবাহনই প্রয়োজনবোধে কাজে লাগাতেন। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, চার যানবাহনের মধ্যে গজকেই বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে শুভ যাত্রার প্রতীক বলে চিহ্নিত করা হলো কেন।

আসলে পৌরাণিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত দেখা গেছে যে, গজ গোড়া থেকেই বিশেষ সম্মানীয় জায়গায় নিজের স্থান করে নিয়েছে। দেব-দেবী ছাড়াও রাজা, মহারাজা, জমিদারদের কাছেও “গজ” রাজকীয় মর্যাদা পেয়েছে। হয়তো তাই দেবী দুর্গার গজে আগমন ও গমনকে কেন্দ্র করে বলা হয়েছে-“গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা।” অর্থাৎ এই আগমন ও গমনে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণ হয়ে মানুষকে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলবে। অন্যদিকে ঘোটক দেব-দেবী ও মানুষের কাজে ব্যবহৃত হলেও গজের মতো মর্যাদা না দিয়ে ঘোটকে মায়ের আগমন ও গমন নিয়ে বলা হয়েছে-“ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে”। অর্থাৎ ঘোটকে আগমন ও গমনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রেও অস্থিরতা প্রকাশ পাবে। যেমন, রাজনৈতিক উত্থান, পতন, সামাজিক স্তরে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, গৃহযুদ্ধ, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যু ইত্যাদির প্রভাব বাড়বে। আবার নৌকায় আগমন ও গমনে বলা হয়েছে শস্যবৃদ্ধিস্তুথাজলম। এ ক্ষেত্রে প্রবল বন্যা, ঝড়, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির জন্যে একদিকে প্লাবন ও ক্ষয়ক্ষতি এবং অন্যদিকে দ্বিগুণ শস্যবৃদ্ধি। এর মধ্যে ‘দোলায়’ আগমন ও গমন সবচেয়ে অশুভ। তাই দোলা সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, দোলায়াং মরকং ভবেৎ। মহামারি, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরা ইত্যাদির প্রভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তো ঘটাবেই, আবার সেই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিও হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, একমাত্র গজ ছাড়া দেবী দুর্গার অন্য তিন যানবাহনের মাধ্যমে ধ্বংস বা লয়কে ব্যবহার করা হয়েছে। শুধুমাত্র গজই প্রয়োজনমতো বৃষ্টিধারায় বসুন্ধরাকে ধন-ধান্যে সমৃদ্ধ করে তুলবে।

এই প্রসঙ্গে কোন দিনে আগমন ও গমনে কি যানবাবন ব্যবহার করা হবে সেই ব্যাপারে বলা হয়েছে-“রবৌ চন্দ্রে গজারূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়োঃ, গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং নৌকায়াং বুধবাসরে।” সপ্তমীর দিনে যদি রবিবার এবং সোমবার হয়, তাহলে দুর্গার আগমন ও গমন হবে গজে। ফল-“গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা”। ঠিক এই রকমই শনিবার ও মঙ্গলবারে দুর্গার আগমন ও গমন হলে, ঘোটকের প্রভাব থাকবে। অর্থাৎ ফল-“ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে”। যদি বুধবারে দেবী দুর্গার আগমন ও গমন হয়, তাহলে তিনি আসবেন এবং যাবেন নৌকায়। ফল-“শস্যবৃদ্ধিস্তুথাজলম”। আবার দুর্গার আগমন ও গমন যদি বৃহস্পতি ও শুক্রবারে হয় তাহলে তিনি দোলায় আসবেন এবং যাবেন। ফল-“দোলায়াং মরকং ভবেৎ”।

সৌজন্যেঃ- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্কুল
Share:

০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪

হিন্দু আইনের পরিবরর্তন ও পরিবর্ধন


নিম্নোক্ত এ্যক্টগুলো বাংলাদেশে প্রযোজ্য হিন্দু আইনকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছে-


  • ১৮৫০ সালের কাসট্ ডিসএ্যবিলিটিস রিমুভাল এ্যক্ট। n নাতন হিন্দু আইন ও প্রথা অনুযায়ী যদি কোন হিন্দু তার ধর্ম পরিত্যাগ করত, অথবা ধর্মসভা হতে বহিস্কৃত হতো অথবা জাতিচ্যুত হতো তাহরে এই পরিহার, বহিস্কার অথবা বঞ্চনার ফলে তার অধিকার ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যেত এবং তাকে তার উত্তরাধিকার লাভের অধিকার হতে বঞ্চিত করা হতো। উপরোক্ত এ্যক্টের ফলে ব্রিটিশ ভারতের আদালতসমূহ ধর্মত্যাগের জন্য সৃষ্ট এই পরিণতিগুলো রহিত করে। এই এ্যক্ট ফ্রিডম অব রিলিজিয়ান এ্যক্ট নামেও পরিচিত।
  • ১৮৫৬ সালের হিন্দু উইডোজ রিম্যারেজ এ্যক্ট। কতিপয় ক্ষেত্রে এই এ্যক্ট হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ অনুমোদন করেছে।
  • ১৯২৫ সালের সাকসেশন এ্যক্টের ধারা ৫৭, ২১৪ এবং তৃতীয় তফসীল। এই ধারা দুইটি এবং তফশীলে হিন্দু উইল সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে।
  • ১৮৬৬ সালের নেটিভ কনভার্টস ম্যারেজ ডিসসলিউশন এ্যক্ট। এই এ্যক্টের অধিনে কতিপয় অবস্থায় খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত একজন হিন্দু তার বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে।
  • ১৮৭২ সালের স্পেশাল ম্যারেজ এ্যক্ট। এই এ্যক্ট ১৯২৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে এবং কতিপয় বিবাহের ক্ষেত্রে এই এ্যক্ট প্রযোজ্য।
  • ১৮৮২ সালের ট্রান্সফার অব প্রপার্টি (১৯২৯ সালে যেভাবে সংশোধিত হয়েছে)। এই এ্যক্টের ১২৯ ধারায় উল্লেখিত কতিপয় বিষয় ব্যতীত এই এ্যক্ট সম্পত্তি হস্তান্তর বিষয়ে সমুদয় হিন্দু আইন বাতিল করে দিয়েছে।
  • ১৮৭৫ সালের মেজরিটি এ্যক্ট। এই এ্যক্ট নাবালত্বের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং তা বিবাহ, বিবাহ-চিচ্ছেদ ও দত্তক গ্রহণের বিষয় ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
  • ১৮৯০ সালের হিন্দু গার্ডিয়ানস এ্যন্ড ওয়ার্ডস এ্যক্ট। যে সকল ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক অভিভাবক নিযুক্ত হয়ে সেই সকল ক্ষেত্রে এই এ্যক্ট প্রযোজ্য।
  • ১৯২৮ সালের হিন্দু ইনহেরিট্যান্স (রিমুভাল অব ডিসএ্যবিলিটিস)এ্যক্ট। যে সকল অযোগ্যতা কোন হিন্দুকে উত্তরাধিকার ও পার্টিশনের মাধ্যমে অংশ লাভে বঞ্চিত করত এ এ্যক্ট যে সকল অযোগ্যতাকে সীমিত করেছে।
  • ১৯২৯ সালের হিন্দু ল’ অব ইনহেরিট্যান্স (এ্যামেন্ডমেন্ট) এ্যক্ট। এ এ্যক্ট পিতামহ বা পিতার-পিতার পরে এবং পিতার ভ্রাতার পূর্বে পুত্রের কন্যা, দৌহিত্রী, ভগিনি এবং ভগিনির পুত্রকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকার করেছে।
  • ১৯২৯ সালের ট্রান্সফার অব প্রপার্টি(এ্যামেন্ডমেন্ট) সাপ্লিমেন্টারী এ্যক্ট। এই এ্যক্ট অজাত ব্যক্তির অনুকূলে হস্তান্তর ও রিকোয়েষ্ট সম্পর্কিত ১৯১৪ ও ১৯২১ সালের মাদ্রাজ এ্যক্ট এবং ১৯১৬ সালের হিন্দু ডিসপজিশন অব প্রপার্টি এ্যক্টকে সংশোধন করেছে।
  • ১৯৩০ সালের হিন্দু গেনস অব লানিংস এ্যক্ট। এই এ্যক্ট শিক্ষার সাহায্য অর্জিত সকল সম্পত্তিই অর্জনকারীর পৃথক সম্পত্তিতে রূপান্তর করেছে।
  • ১৯৩৭ সালের হিন্দু উইমেনস রাইটস্ টু প্রপার্টি এ্যক্ট। এই এ্যক্ট ১৯৩৭ সালের ১৪ এপ্রিল হতে কার্যকরী হয় এবং ইহা হিন্দু বিধবাদের উত্তরাধিকারের নতুন অধিকার দান করে মিতাক্ষরাসহ উত্তরাধিকারীত্বের মূলে কুঠারাঘাত করেছে।
  • ১৮৭২ সালের কন্ট্রাক্ট এ্যক্ট। এই এ্যক্ট হিন্দু চুক্তি আইনকে বাতিল করেছে। তবে ‘দামদুপাত’ নীতি চুক্তি আইনের দ্বারা বাতিল হয়নি।
  • ১৮৭২ সালের এভিডেন্স এ্যক্ট। এই আইন হিন্দু সাক্ষ্য আইনকে বাতিল করে দিয়েছে।
  • ১৮৬০ সালের পেনাল কোড। এই আইন সমুদয় হিন্দু দন্ড আইনকে বাতিল করেছে।
উপরোক্ত পরিবর্তন ছাড়াও ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে নিম্নোক্ত এ্যক্টসমূহের দ্বারা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের হিন্দু আইনে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, স্মর্তব্য যে, এই আইনগুলো বাংলাদেশী হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

  • ১৯৫৫ সালের হিন্দু ম্যারেজ এ্যক্ট। এই আইন স্বাধীনতাপূর্ব হিন্দু ম্যারেজ সংক্রান্ত আইনে যা, বাংলাদেশে প্রযোজ্য রয়েছে, আমুল পরিবর্তন সাধন করেছে। ভারতে এই আইনের পরিপন্থী পূর্বস্থিত সকল আইনই বাতিল বলিয়া বিবেচিত হবে।
  • ১৯৫৬ সালের হিন্দু সাকসেশন এ্যক্ট। এই আইন ভারতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনকে আমুল পরিবর্তন করেছে। এই আইন হিন্দু আইনের উত্তরাধিকার আইনকে এমন একটি অভিন্ন ও ব্যাপক ব্যবস্থায় পরিণত করেছে যা সকল হিন্দুদের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। ২০০৫ সালের দ্য হিন্দু সাকসেসন এ্যক্ট হিন্দু মহিলাদের হিন্দু কোপার্সনারীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দান করেছে।
  • ১৯৫৬ সালের হিন্দু মাইনরিটি এ্যন্ড গার্ডিানশিপ এ্যক্ট। এই আইন যে সকল মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করেছে তাদের মধ্যে স্বাভাবিক অভিভাবকের তালিকা সীমিত করণ, স্বাভাবিক ও উইলমূলে নিযুক্ত অভিভাবকের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন, ডি ফ্যাক্টো অভিভাবকের ক্ষমতা রহিতকরণ, মাতার অভিভাবক নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান এবং ৫ বছর বয়সের নিম্নের নাবালক শিশুর তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব মাতাকে প্রদান ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
  • ১৯৫৬ সালের হিন্দু এ্যডপশনন্স এন্ড মেনটেনেন্স এ্যক্ট। এই আইনের অধীনে পুরুষ ও নারী সকল হিন্দু পুত্র কিংবা কন্যা দত্তক গ্রহণ করতে পারে অথচ প্রাক-স্বাধীনতা আইনে কেবলমাত্র স্বামী ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিধবা দত্তকপুত্র গ্রহণ করিতে পারিত। এই আইনের অধীনে দত্তকগ্রহণে স্ত্রীর অনুমতির কোন প্রয়োজন নাই। এই আইনে অবিবাহিতা মহিলা পুত্র দত্তক লইতে পারে এবং দত্তক গ্রহণে যে কোন গোত্রের পুত্রকে দত্তক লইকে পারবেন।
Share:

হিন্দুদের বর্ণভেদ বা বর্ণাশ্রম



হিন্দুরা চারবর্ণে বিভক্ত, বর্ণগুলো যথাক্রমে- ক) ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত বর্ণ, খ) ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা বর্ণ, বৈশ্য বা ব্যবসায়িক শ্রেণীক বর্ণ এবং ঘ)শুদ্র বা কৃষি বর্ণ।
এই বর্ণগুলো প্রত্যেকটি আবার কয়েকটি উ-বর্ণে বিভক্ত। প্রথম তিনটি বর্ণের সদস্যদের দ্বিজ বা পুণর্জন্মা বলা হয়। বেদ বা ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ এবং উপনয়নের ন্যয় ধর্মীয় সংস্কার সম্পাদনের মাধ্যমে তারা দ্বিতীয় জন্ম লাভ করে। হিন্দুদের মধ্যে যে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার রয়েছে তাদের মধ্যে কেবলমাত্র বিবাহ সংক্রান্ত সংস্কার ছাড়া শুদ্ররা অন্যকোন সংস্কার পালন করে না।
হিন্দুদের এই বর্ণ বা শ্রেণী বিভাগ আইনের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে দত্তক পুত্রকে অবশ্যই দত্তকগ্রহণকারী পিতার বর্ণের হতে হয়। বিবাহের ক্ষেত্রেও এক মতবাদ অনুযায়ী বিবাহ পক্ষগণকে এই বর্ণভূক্ত হতে হয়। হিন্দু আইনের কতকগুলো নীতি, বিশেষ করে দত্তক গ্রহণ অনুষ্ঠানে দত্তহোম পালনের ন্যয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত নীতিসমূহ শুদ্রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। শুদ্রবর্ণ নির্ধারণে রাজকুমার লাল ব. বিশ্বেশ্বর [(১৮৮৪) ১০ ক্যাল ৬৮৮] মামলায় কোলকাতা হাইকোর্ট কায়স্থদের সাধারণভাবে শুদ্র বলে অভিহিত করেছেন; অপরদিকে তুলসীরাম ব. বিহারীলাল [(১৮৯০) ১২ এলা ৩২৮] মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট ও ঈশ্বরী প্রসাদ ব. রায়হরি প্রসাদ [(১৯২৭) ৬ পার্ট ৫০৬] মামলায় পাটনা হাইকোর্ট কায়স্থদের শুদ্র নয় বরে তিনটি দ্বিজ বর্ণের যে কোন একটির, সম্ভবত ক্ষত্রিয় বর্ণের অন্তর্ভূক্ত বলে মন্তব্য করেছেন। সুবরাত্ত ব. রাধা [(১৯২৮) ৫২ বোম ৪৯৭] মামলায় বোম্বে হাইকোর্ট মারাঠাদের কিছু ক্ষত্রিয় এবং কিছু শুদ্র বর্ণভূক্ত বলে রায় দিয়েছেন। বেঙ্গলের বৈদ্যরা রাজনন্দিন ব. অশ্বিনী কুমার [(১৯৪১)১ ক্যাল ৪৫৭] মামলার এবং সদ গোপরা দূর্গাদান পান ব. সন্তোষকুমার পান [(১৯৪৫)১ ক্যাল ৬৭] মামলার রায় অনুযায়ী কার্য্যকর হয়।
Share:

শেষ জীবন



বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ মন্দির, বিবেকানন্দকে দাহ করার স্থানে বিবেকানন্দ কিছু দিন মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রমে এবং পরে বেলুড় মঠে অতিবাহিত করেন। অতঃপর শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বেলুড় মঠে অবস্থান করে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের কাজ এবং ইংল্যান্ড ও আমেরিকার কাজ দেখাশোনা করে অতিবাহিত করেন। গোয়ালিয়রের মহারাজাসহ এ বছরগুলিতে হাজার হাজার দর্শক তাঁকে দেখতে আসেন। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে দেখতে আসেন লোকমান্য তিলকসহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয়রা। জাপানের ধর্ম মহাসভায় যোগ দেয়ার জন্য তিনি ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, কিন্ত্তু তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য সেটি অসম্ভব করে তোলে। তাঁর শেষ দিনগুলিতে তিনি বোধগয়া ও বারাণসী তীর্থ করেন।[১১০]

তাঁর ভ্রমণসমূহ, উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতাদান, ব্যক্তিগত আলোচনা এবং চিঠিপত্রের আদান-প্রদান তাঁর স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি হাঁপানি, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য শারীরীক অসুখে ভুগছিলেন।[১১১] তাঁর দেহ ত্যাগের কিছুদিন পূর্বে তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ষপঞ্জি/পঞ্জিকা পড়তে দেখা যেত। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার তিনি দিন পূর্বে তাঁকে দাহ করার স্থান দেখিয়ে দেন-যে স্থানে বর্তমানে তাঁর স্মৃতিতে একটি মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কতিপয় লোকের কাছে মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবেন না।[১১১]তাঁর দেহ ত্যাগ করার দিন তিনি বেলুড় মঠে সকালে কিছু ছাত্রকে শুক্লা-যজুর্বেদ শেখান।[১১২] তিনি ভ্রাতা-শিষ্য স্বামী প্রেমানন্দের সাথে হাটেন এবং তাকে রামকৃষ্ণ মঠের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্দেশনা দেন। বিবেকানন্দ ধ্যান করার সময় ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই রাত ৯টা ১০ মিনিটে দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর শিষ্যদের মতে এটা ছিল মহাসমাধি।[১১৩] পরবর্তীতে তাঁর শিষ্যগণ লিপিবদ্ধ করেন যে তারা স্বামীজির নাসারন্ধ্র, তাঁর মুখ এবং চোখে “সামান্য রক্ত” লক্ষ্য করেছেন।[১১৪] ডাক্তাররা মন্তব্য করেন যে এটি হয়েছে তাঁর মস্তিষ্কে একটি রক্তনালী ফেটে যাবার কারণে, কিন্ত্তু তারা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বের করতে পারেননি। তাঁর শিষ্যদের মতানুসারে ব্রহ্মরন্ধ্র-মস্তিষ্কের চূড়ার রন্ধ্র-অবশ্যই ফেটে থাকবে যখন তিনি মহাসমাধি অর্জন করেছিলেন। বিবেকানন্দ তাঁর চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বেচে না থাকার তাঁর নিজের ভবিষ্যৎবাণী পূরণ করেছিলেন।[১১২]
Share:

পরমপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ




স্বামী বিবেকানন্দ (১২ জানুয়ারি, ১৮৬৩ – ৪ জুলাই, ১৯০২) (পূর্বাশ্রমের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত[২]) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ হিন্দু ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য এবং রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা।[৩] স্বামী বিবেকানন্দ ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেদান্ত ও যোগশাস্ত্রের প্রচার ও প্রসারে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।[৩] ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দুধর্মকে বিশ্বজনীন ধর্মের স্তরে উন্নীত করা তথা সর্বধর্মসমন্বয় চেতনার বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।[৪] আধুনিক ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের প্রধান চালিকাশক্তি ছিলেন বিবেকানন্দ।[৫] তাঁর সর্বাধিক খ্যাতি ১৮৯৩ সালে বিশ্বধর্ম মহাসভায়[২] “আমেরিকান ভ্রাতা ও ভগিনী”দের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত[৬][৭] তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতাটির মাধ্যমে পাশ্চাত্য সমাজে হিন্দুধর্মের পরিচিতি প্রদানে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
১৮৬৩ সালে কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম। তাঁর চিন্তা-চেতনার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর যুক্তিবাদী পিতা ও ধর্মপ্রাণা জননী। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মপিপাসা ও গভীর ঈশ্বরানুরাগ লক্ষিত হত। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন এক ব্যক্তির সন্ধানে বেরিয়ে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের সান্নিধ্যে আসেন এবং পরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা দেন। তাঁর কাছ থেকেই বিবেকানন্দ শেখেন যে সব ধর্মই সত্য এবং মানুষের সেবাই সর্বোৎকৃষ্ট ঈশ্বরোপাসনা। গুরুর মৃত্যুর পর সন্ন্যাস অবলম্বন করে তিনি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ পদব্রজে পর্যটন করেন। পরবর্তীকালে শিকাগো যাত্রা করে ১৮৯৩ সালের বিশ্বধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ফোরাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংঘ তাঁর বাগ্মীতায় মুগ্ধ হয়ে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানান। একাধিক সাধারণ ও ব্যক্তিগত সভায় ভাষণ দিয়ে তিনি আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও আরও কয়েকটি দেশে বেদান্ত, যোগশাস্ত্র ও হিন্দুধর্মকে সুপরিচিত করে তোলেন। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে তিনি স্থাপন করেন বেদান্ত সোসাইটি। ভারতে প্রত্যাবর্তন করে ১৮৯৩ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন নামে একটি মানবকল্যাণমূলক আধ্যাত্মিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে অন্যতম জাতি-স্রষ্টারূপে পরিগণিত হন। তাঁর শিক্ষা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ একাধিক জাতীয় নেতা ও দার্শনিককে প্রভাবিত করেছিল।[২][৫][৮
বংশ-পরিচয়
স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবনেশ্বরী দেবী (১৮৪১-১৯১১)
বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী।”[৯]
স্বামী বিবেকানন্দ এক কায়স্থ দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই দত্ত-পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার অন্তর্গত দত্ত-ডেরিয়াটোনা বা দত্ত-ডেরেটোনা গ্রামে। দত্ত-পরিবার মুঘল আমল থেকে ওই গ্রামে বাস করছিলেন। তাঁরাই ওই গ্রামের জমিদার ছিলেন বলে অনুমিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দত্ত-পরিবারের রামনিধি দত্ত তাঁর ছেলে রামজীবন দত্ত ও নাতি রামসুন্দর দত্তকে নিয়ে গড়-গোবিন্দপুর (অধুনা কলকাতা ময়দান-ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চল) গ্রামে চলে আসেন। এখানে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু হলে এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে দত্তরাও চলে আসেন সুতানুটিতে (অধুনা উত্তর কলকাতা)। সেখানে তাঁরা প্রথমে মধু রায়ের গলিতে একটি বাড়ি তৈরি করেন। রামসুন্দরের বড়ো ছেলে রামমোহন দত্ত ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িটি নির্মাণ করেন। এই বাড়িতেই পরে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয়। রামসুন্দরের বড়ো ছেলে দুর্গাপ্রসাদ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ঠাকুরদা। তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে বিশ্বনাথ দত্তের জন্মের পরই সন্ন্যাস অবলম্বন করে গৃহত্যাগ করেছিলেন। বিশ্বনাথ দত্ত দুর্গাপ্রসাদের ছোট ভাই কালীপ্রসাদ কর্তৃক প্রতিপালিত হন। কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নি হিসেবে তিনি সারা ভারতে সুনাম অর্জন করেছিলেন। বিশ্বনাথ দত্ত ইংরেজি, বাংলা, ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন। ইতিহাস পাঠে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি সুলোচনা (১৮৮০) ও শিষ্ঠাচার-পদ্ধতি (বাংলা ও হিন্দি ভাষায়, ১৮৮২) নামে দুটি বইও রচনা করেছিলেন। ধর্মবিষয়ে বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন উদার। বাইবেল ও দেওয়ান-ই-হাফিজ তাঁর প্রিয় বই ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকেও তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দুর্গাপ্রসাদের সংসারত্যাগের পর কালীপ্রসাদের অমিতব্যয়িতায় দত্ত-পরিবারের আর্থিক সাচ্ছল্য নষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অ্যাটর্নিরূপে বিশ্বনাথ দত্তের সুদূর-প্রসারিত খ্যাতি সেই সাচ্ছল্য কিয়দংশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।[১০] তাঁর স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন সিমলার নন্দলাল বসু মেয়ে। তিনি বিশেষ ভক্তিমতী নারী ছিলেন। তাঁর প্রথম কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু ও কন্যাসন্তানের জন্মের পর পুত্রসন্তান কামনায় তিনি তাঁর এক কাশীবাসিনী আত্মীয়াকে দিয়ে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে নিত্য পূজা দেওয়ার ব্যবস্থা করান। এরপরই স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হওয়ায় তাঁর বিশ্বাস হয় যে, তিনি শিবের কৃপায় পুত্রলাভ করেছেন।[১১]
জন্ম ও বাল্যজীবন
৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট, কলকাতা। এই বাড়িতেই নরেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে বাড়িটি রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম কেন্দ্র।
১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি (বাংলা ১২৬৯ সালের ২৯ পৌষ), সোমবার, মকর সংক্রান্তির দিন সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে[১২] কলকাতার সিমলা অঞ্চলের ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে[১৩] স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম।[১১] তাঁর নামকরণ করা হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত।[১৪] পিতার যুক্তিবাদী মন ও জননীর ধর্মীয় চেতনা স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা ও ব্যক্তিত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।[৮] প্রথম জীবনেই পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের সহিত তাঁর পরিচিতি ঘটেছিল। এই কারণে অকাট্য প্রমাণ ও ব্যবহারিক পরীক্ষা ছাড়া কোনো বক্তব্যই তিনি গ্রহণ করতেন না। অন্যদিকে অতি অল্পবয়সেই ধ্যান ও বৈরাগ্যের আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রতি তাঁর মন আকৃষ্ট হয়।[৮] নরেন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষার সূচনা ঘটে স্বগৃহেই। ১৮৭১ সালে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং ১৮৭৯ সালে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।[১৫] দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ ও পাণ্ডিত্য।[১৬] বেদ, উপনিষদ, ভাগবত গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের প্রতিও তাঁর আগ্রহের কথা সুবিদিত। কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত – শাস্ত্রীয় সংগীতের উভয় শাখাতেই তাঁর বিশেষ পারদর্শীতা ছিল। বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলা, শারীরিক ব্যায়াম ও অন্যান্য সংগঠনমূলক কাজকর্মেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন।[১৬] অতি অল্পবয়সেই বিভিন্ন কুসংস্কার এবং ধর্ম ও বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য বিচারের যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।[১৭]
নরেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক বিকাশে তাঁর মায়ের ভূমিকাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী জীবনে তিনি তাঁর মায়ের একটি কথা বারংবার উদ্ধৃত করতেন, সারা জীবন পবিত্র থাকো, নিজের সম্মান রক্ষা কোরো, অন্যের সম্মানে আঘাত কোরো না। কোমল হও, কিন্তু প্রয়োজনবোধে নিজের হৃদয়কে শক্ত রেখো[১৪] কথিত আছে, নরেন্দ্রনাথ ছিলেন ধ্যানসিদ্ধ; ঘুমের মধ্যে তিনি এক জ্যোতি দর্শন করতেন ও ধ্যানের সময় বুদ্ধের দর্শন পেতেন।[১৮
কলেজে ও ব্রাহ্মসমাজে
১৮৮০ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম বর্ষের কলা বিভাগে ভর্তি হন নরেন্দ্রনাথ। পরের বছর তিনি চলে যান স্কটিশ চার্চ কলেজে। এই সময়েই তিনি অধ্যয়ন করেন পাশ্চাত্য যুক্তিবিজ্ঞান, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় জাতিসমূহের ইতিহাস।[১৭] ১৮৮১ সালে এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৮৪ সালে ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন।[১৯][২০] তাঁর অধ্যাপকদের মতে, নরেন্দ্রনাথ ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন ছাত্র। স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষ উইলিয়াম হেস্টি তাঁর সম্পর্কে লেখেন, “নরেন্দ্র ছিল সত্যকারের প্রতিভাবান। আমি বহু দেশ ভ্রমণ করেছি; এই ছেলেটির মধ্যে মেধা ও সম্ভাবনার যে সাক্ষর দেখি তা আমি কারোর মধ্যে পাইনি, এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন বিভাগীয় ছাত্রদের মধ্যেও না।” (“Narendra is really a genius. I have travelled far and wide but I have never come across a lad of his talents and possibilities, even in German universities, among philosophical students.”)[২১] তিনি ছিলেন একজন শ্রুতিধর, অর্থাৎ অসামান্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী ব্যক্তি।[২২][২৩] কথিত আছে, তাঁর সঙ্গে এক আলোচনার পর ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বলেছিলেন, “আমি ভাবতেও পারিনি, এই রকম একটি বাচ্চা ছেলে এত কিছু পড়েছে।”[২৪]
ছেলেবেলা থেকে আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরোপলব্ধি ও সর্বোচ্চ অধ্যাত্ম সত্যের উপলব্ধির জন্য তাঁর ব্যাকুলতা দৃষ্ট হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধর্মীয় ও দার্শনিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেযুগের এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসেন এবং ব্রাহ্মসমাজের একেশ্বরবাদ, অপৌত্তলিকতা ও সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার চেতনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।[২৫] এই সময়ে ব্রাহ্মসমাজের দুই সর্বোচ্চ নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁদের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পান না।[২৬][২৭]
কথিত আছে, নরেন্দ্রনাথ ডেভিড হিউম, ইমানুয়েল কান্ট, জোহান গটলিব ফিচ, বারুখ স্পিনোজা, গেয়র্গ ভিলহেল্ম হেগল, আর্থার সোফেনহয়্যার, ওগুস্ত কোঁত, হারবার্ট স্পেনসার, জন স্টুয়ার্ট মিল ও চার্লস ডারউইন প্রমুখের রচনাবলি অধ্যয়ন করেছিলেন।[২১][২৮] হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি নিজের প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের জন্য স্পেনসারের এডুকেশন (Education) নামক গ্রন্থখানি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। কিছুকাল তাঁর সঙ্গে হারবার্ট স্পেনসারের পত্রালাপও হয়।[২৯][৩০] পাশ্চাত্য দার্শনিকদের রচনা অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতীয় সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ তথা বহু বাংলা গ্রন্থও অধ্যয়ন করেছিলেন।[২৮]
অধ্যক্ষ হেস্টি সাহিত্যের এক ক্লাসে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের দি এক্সকার্সন (The Excursion) কবিতাটির আলোচনাকালে কবির প্রাকৃতিক-ভাবতন্ময়তার (nature-mysticism) বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসের উল্লেখ করলে নরেন্দ্রনাথ প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের কথা জানতে পারেন।[৩১] কবিতায় ব্যবহৃত trance শব্দটির অর্থ বোঝাতে গিয়ে হেস্টি তাঁর ছাত্রদের বলেন যে এই শব্দটির প্রকৃত অর্থ জানতে হলে তাদের দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতে হবে। এতে তাঁর কয়েকজন ছাত্র উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনে যান। তাঁদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অন্যতম।[৩২][৩৩]
শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে রামকৃষ্ণ পরমহংস
“ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভুত স্পর্শে মুহূর্তমধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হইল। স্তম্ভিত হইয়া সত্য সত্যই দেখিতে লাগিলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছুই আর নাই!… যখন প্রকৃতিস্থ হইলাম, তখন ভাবিলাম উহাই অদ্বৈতবিজ্ঞানের আভাস! তবে তো শাস্ত্রে ঐ বিষয়ে যাহা লেখা আছে, তাহা মিথ্যা নহে! তদবধি অদ্বৈততত্ত্বের উপরে আর কখনও সন্দিহান হইতে পারি নাই।”[৩৪][৩৫] ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত নরেন্দ্রনাথের জীবনের ধারাটিকে পরিবর্তিত করে দেয়।[৩৬] এই সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তাঁহাকে [রামকৃষ্ণ] একজন সাধারণ লোকের মতো বোধ হইল, কিছু অসাধারণত্ব দেখিলাম না। অতি সরল ভাষায় তিনি কথা কহিতেছিলেন, আমি ভাবিলাম, এ ব্যক্তি কি একজন বড় ধর্মাচার্য হইতে পারেন? আমি সারা জীবন অপরকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাঁহার নিকটে গিয়া তাঁহাকেও সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন?’ তিনি উত্তর দিলেন- ‘হাঁ।’ ‘মহাশয়, আপনি কি তাঁহার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেন?’ ‘হাঁ’। ‘কি প্রমাণ? ‘ ‘আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাঁহাকেও ঠিক সেইরূপ দেখি, বরং আরও স্পষ্টতর, আরও উজ্জ্বলতররূপে দেখি।’ আমি একেবারে মুগ্ধ হইলাম। [...] আমি দিনের পর দিন এই ব্যক্তির নিকট যাইতে লাগিলাম। [...] ধর্ম যে দেওয়া যাইতে পারে, তাহা আমি বাস্তবিক প্রত্যক্ষ করিলাম। একবার স্পর্শে, একবার দৃষ্টিতে একটা সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইতে পারে। আমি এইরূপ ব্যাপার বারবার হইতে দেখিয়াছি।”[৩৬][৩৭]
যদিও প্রথমে নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে নিজের গুরু রূপে স্বীকার করতে সম্মত ছিলেন না। তিনি তাঁর ধ্যানধারণার বিরুদ্ধের প্রায়শই বিদ্রোহ প্রকাশ করতেন। তবু শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বার বার তাঁর দর্শনে ছুটে যেতেন।[৩৮] প্রথম দিকে শ্রীরামকৃষ্ণের তুরীয় আনন্দের ভাব ও দর্শনকে কেবলমাত্র মনগড়া কল্পনা বলে মনে করতেন।[৮] [৩৯] ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে তিনি মূর্তিপূজা ও বহুদেববাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন কালীর উপাসক।[৪০] অদ্বৈত বেদান্ততত্ত্বকেও নরেন্দ্রনাথ নাস্তিকতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন; এবং মাঝে মাঝেই তা নিয়ে উপহাস করতেন।[৩৯]
শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানধারণা গ্রহণ করতে না পারলেও নরেন্দ্রনাথ তা উড়িয়ে দিতে পারতেন না। কোনো মত গ্রহণ করার আগে তা যাচাই করে নেওয়াই ছিল নরেন্দ্রনাথের স্বভাব। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণও কোনোদিন তাঁকে যুক্তিবর্জনের পরামর্শ দেননি। তিনি ধৈর্য সহকারে নরেন্দ্রনাথের তর্ক ও পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং তাঁকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই সত্য পরীক্ষা করতে বলেন।[৩৮] পাঁচ বছর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থেকে নরেন্দ্রনাথ এক অশান্ত, বিভ্রান্ত, অধৈর্য যুবক থেকে এক পরিণত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন। ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগে স্বীকৃত হন এবং শ্রীরামকৃষ্ণকে নিজের গুরু রূপে স্বীকার করে নিয়ে গুরুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেন।[৩৮]
১৮৮৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এই সময় তাঁকে কলকাতার কাশীপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। জীবনের অন্তিম পর্বে বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভ্রাতাগণ তাঁর সেবাসুশ্রুষা করেছিলেন। এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে তাঁদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা চলে। কথিত আছে, কাশীপুরেই বিবেকানন্দ নির্বিকল্প সমাধির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।[৪১] শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ পর্বে বিবেকানন্দ ও তাঁর কয়েকজন গুরুভ্রাতা গুরুর নিকট থেকে সন্ন্যাসীর গৈরিক বস্ত্র লাভ করেছিলেন। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম রামকৃষ্ণ সংঘ।[৪২] গুরুর নিকট থেকে বিবেকানন্দ এই শিক্ষাই পান যে মানবসেবাই সর্বাপেক্ষা কার্যকরী ঈশ্বরোপাসনা।[৮][৪৩] কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্ব নিয়ে বিবেকানন্দের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলে শ্রীরামকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই রামকৃষ্ণ… “[৪৪] শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অবর্তমানে নিজের শিষ্যদের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন বিবেকানন্দের উপর, এবং তাঁর শিষ্যদেরও বিবেকানন্দকে নেতা বলে স্বীকার করতে বলেন।[৪৫] দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৮৮৬ সালের ১৬ অগস্ট অতিপ্রত্যুষে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহাপ্রয়াণ ঘটে। তাঁর শিষ্যদের মতে, এ ছিল তাঁর মহাসমাধি।[৪৫]
Share:

স্বামীজীর বিশ্বধর্ম মহাসভা এবং আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বক্তৃতাদান



ধর্মসভা মঞ্চে স্বামী বিবেকানন্দ
ধর্মসভা ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হয়। এ দিন বিবেকানন্দ তাঁর প্রথম সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তিনি ভারত এবং হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন।[৭৫] প্রথমদিকে বিচলিত থাকলেও তিনি বিদ্যার দেবী সরস্বতীর নিকট মাথা নোয়ালেন এবং তার বক্তৃতা শুরু করলেন এভাবে, “আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ!”[৭৩][৭৬] তাঁর এ সম্ভাষণে প্রায় সাত হাজারের মত দর্শক-শ্রোতা দুই মিনিট দাঁড়িয়ে তাঁকে সংবর্ধনা জানান। নীরবতা ফিরে আসার পর তিনি তার বক্তৃতা শুরু করলেন। “যে ধর্ম বিশ্বকে সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহণযোগ্যতা শিখিয়েছে সে ধর্মের সর্বাধিক প্রাচীন সন্ন্যাসীদের বৈদিক ক্রমানুসারে” তিনি জাতিসমূহের কনিষ্ঠতমকে অভিবাদন জানালেন।[৭৭] এবং তিনি গীতা থেকে এ সম্পর্কে দুটি উদাহরণমূলক পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেন-“যেহেতু বিভিন্ন স্রোতধারাগুলির উৎসসমূহ বিভিন্ন জায়গায় থাকে, সেগুলির সবই সমুদ্রের জলে গিয়ে মিশে যায়, সুতরাং, হে প্রভু, বিভিন্ন প্রবণতার মধ্য দিয়ে মানুষ বিভিন্ন যে সকল পথে চলে, সেগুলো বিভিন্ন রকম বাঁকা বা সোজা মনে হলেও, সেগুলি প্রভুর দিকে ধাবিত হয়!” এবং “যে আকারের মধ্য দিয়েই হোক না কেন, যেই আমার নিকট আসে, আমি তাঁর নিকট পৌঁছাই; সকল মানুষই বিভিন্ন পথে চেষ্টা করছে যা অবশেষে আমার নিকট পৌঁছায়।”[৭৭] সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা হওয়া সত্ত্বেও এটি সভার আত্মা এবং এর বিশ্বজনীন চেতনা ধ্বনিত করে।[৭৭][৭৮]
সভার সভাপতি, ডঃ ব্যারোজ বলেন, “কমলা-সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মসমূহের মাতা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং তাঁর শ্রোতাদের উপর সবচাইতে বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করেছেন।”[৭৬] প্রেসে তিনি প্রচুর মনোযোগ আকর্ষণ করেন যাতে তিনি “ভারতের সাইক্লোন সন্ন্যাসী” হিসেবে অভিহিত হন। নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক লিখেছিল, “ঐশ্বরিক অধিকারবলে তিনি একজন বক্তা এবং হলুদ ও কমলার চিত্রবৎ আধানে তাঁর শক্তিশালী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার চেয়ে কম আগ্রহোদ্দীপক ছিল না ঐ সকল সমৃদ্ধ ও ছন্দোময়ভাবে উচ্চারিত শব্দসমূহ। নিউইয়র্ক হেরাল্ড লিখেছিল, “বিবেকানন্দ নিঃসন্দেহে ধর্মসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বক্তৃতা শুনে আমরা অনুভব করি এ শিক্ষিত জাতির নিকট মিশনারি পাঠানো কি পরিমাণ বোকামি।”[৭৯] আমেরিকার পত্রিকাসমূহ স্বামী বিবেকানন্দকে “ধর্মসভার সবচেয়ে মহান ব্যক্তিত্ব” এবং “সভার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তি” হিসেবে প্রতিবেদন লেখে।[৮০]
তিনি সভায় আরো অনেকবার হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত বিষয়ে বলেন। সভা ১৮৯৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর সমাপ্ত হয়। সভায় তাঁর সকল বক্তৃতার একটি সাধারন বিষয়বস্ত্তু ছিল – সর্বজনীনতা – অধিক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সহিষ্ণুতা।[৮১]
আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বক্তৃতাদান:
শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটে ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে ধর্মসভা শেষ হবার পর বিবেকানন্দ পুরো দুই বছর পূর্ব ও কেন্দ্রীয় যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে শিকাগো, ডেট্রয়েট, বোস্টন এবং নিউইয়র্কে বক্তৃতা দেন। ১৮৯৫ সালের বসন্তকালের মধ্যে তাঁর অব্যাহত প্রচেষ্টার কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর স্বাস্থ্য হয়ে পড়ে দুর্বল।[৮২] তাঁর বক্তৃতাদান সফর স্থগিত করার পর স্বামীজি বেদান্ত ও যোগের উপর বিনা মূল্যে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। ১৮৯৫ সালের জুন থেকে দুই মাসব্যপী তিনি থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে তাঁর এক ডজন শিষ্যকে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য ভাষণ দেন। বিবেকানন্দ এটিকে আমেরিকায় তাঁর প্রথম ভ্রমণের সবচেয়ে সুখী অংশ বলে বিবেচনা করতেন। তিনি পরে “নিউইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটি” প্রতিষ্ঠা করেন।[৮২]
আমেরিকায় তাঁর প্রথম পরিদর্শনের সময় তিনি ইংল্যান্ডে ভ্রমণ করেন দুইবার – ১৮৯৫ এবং ১৮৯৬ সালে। সেখানে তাঁর বক্তৃতাসমূহ সফল ছিল।[৮৩] এখানে তিনি সাক্ষাৎ পান এক আইরিশ মহিলা মিস মার্গারেট নোবলের যিনি পরে সিস্টার নিবেদিতা নামে পরিচিত হন।[৮২] ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাঁর দ্বিতীয় ভ্রমণের সময় পিমলিকোতে এক গৃহে অবস্থানকালে স্বামীজি দেখা পান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিখ্যাত ভারত বিশেষজ্ঞ ম্যাক্স মুলারের যিনি পাশ্চাত্যে রামকৃষ্ণের প্রথম আত্মজীবনী লেখেন।[৭৮] ইংল্যান্ড থেকে তিনি অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশেও ভ্রমণ করেন। জার্মানীতে তিনি আরেক ভারত বিশেষজ্ঞ পল ডিউসেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন।[৮৪]
তিনি দুটি শিক্ষায়তনিক প্রস্তাবও পান, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য দর্শনের চেয়ার এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরণের প্রস্তাব। তিনি উভয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে পরিভ্রমণকারী সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি এই ধরণের কাজে স্থিত হতে পারবেন না।[৮২]
তিনি কতিপয় অকৃত্রিম শিষ্যকে আকৃষ্ট করেন। তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের মধ্যে ছিল জোসেফিন ম্যাকলিয়ড, মিস মুলার, মিস নোবল, ই.টি.স্টার্ডি, ক্যাপটেন এবং মিসেস সেভিয়ের-যারা অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন জে জে গুডউইন-যিনি তাঁর স্টেনোগ্রাফার হন এবং তাঁর শিক্ষা ও বক্তৃতাসমূহ রেকর্ড করেন।[৮২][৮৪] হেল ফ্যামিলি আমেরিকাতে তাঁর উষ্ণতম আতিথ্যকর্তাদের অন্যতম ছিলেন।[৮৫] তাঁর শিষ্যগণ-ফ্রেঞ্চ মহিলা ম্যাডাম লুই হন স্বামী অভয়ানন্দ এবং মিস্টার লিয়ন ল্যান্ডসবার্গ হন স্বামী কৃপানন্দ। তিনি কতিপয় অন্যান্য শিষ্যকে ব্রহ্মচারীতে দীক্ষা দেন।[৮৬]
স্বামী বিবেকানন্দের ধারণাসমূহ বেশ কয়েকজন পন্ডিত ও বিখ্যাত চিন্তাবিদ কর্তৃক প্রশংসিত হয়-উইলিয়াম জেমস, জোসেফ রয়েস, সি.সি. এভারেট, হার্ভার্ড ধর্মশাস্ত্র বিদ্যালয়ের ডিন, রবার্ট জি ইনগারসোল, নিকোলা টেসলা, লর্ড কেলভিন এবং অধ্যাপক হারম্যান লুডউইক ফারডিন্যান্ড ভন হেলমহোলটজ।[৮] অন্যান্য ব্যক্তিত্ব যারা তাঁর কথাবার্তায় আকৃষ্ট হন তারা হলেন হ্যারিয়েট মনরো এবং এলা হুইলার উইলকক্স-দুজন বিখ্যাত আমেরিকান কবি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস; ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি ডক্টর লুইজ জি জেনস; নরওয়ের পিয়ানোবাদক ওলে বুলের স্ত্রী সারা সি বুল; ফ্রান্সের অভিনেত্রী সারাহ বার্ণহারট এবং ফ্রান্সের অপেরা সঙ্গীতশিল্পী ম্যাডাম এমা ক্যালভি।[৮৭]
পশ্চিম থেকেও তিনি তাঁর ভারতীয় কাজে গতি আনেন। বিবেকানন্দ ভারতে অবস্থানরত তাঁর অনুসারী ও সন্ন্যাসী ভাইদের উপদেশ দিয়ে এবং অর্থ পাঠিয়ে বিরামহীনভাবে চিঠি লেখেন। পাশ্চাত্য থেকে পাঠানো তাঁর চিঠিসমূহ সে দিনগুলিতে সামাজিক কাজের জন্য তাঁর প্রচারাভিযানের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।[৮৮] তিনি ভারতে তাঁর নিকট শিষ্যদের বড় কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যান। তাদের নিকট পাঠানো তাঁর চিঠিসমূহে তাঁর সবচেয়ে কঠিন কিছু শব্দ ছিল।[৮৯] এ রকম একটি চিঠিতে তিনি স্বামী অক্ষরানন্দকে লিখেছিলেন, “খেতরী শহরের দরিদ্র ও নিচু শ্রেণীর ঘরে ঘরে যাও এবং তাদের ধর্মশিক্ষা দাও। ভূগোল এবং অন্যান্য বিষয়েও তাদের মৌখিক শিক্ষা দিও। অলসভাবে বসে থেকে, রাজকীয় খাবার খেয়ে আর “রামকৃষ্ণ, ও প্রভু!” বলে ভাল কিছু হবে না-যদি না তুমি দরিদ্রদের জন্য ভাল কিছু করতে পার।”[৯০][৯১] পরিণামস্বরুপ ১৮৯৫ সালে বেদান্ত শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দের সরবরাহকৃত অর্থে মাদ্রাজে “ব্রহ্মাবদীন” নামে এক সাময়িকপত্র প্রকাশ করা শুরু হয়েছিল।[৯২] পরবর্তীকালে (১৮৮৯) “ব্রহ্মাবদীনে” “দি ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট” এর প্রথম ছয় অধ্যায়ের বিবেকানন্দকৃত অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।[৯৩]
বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য ক্যাপ্টেন এবং মিসেস সেভিয়ের ও জে জে গুডউইনকে নিয়ে ১৮৯৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ইংল্যান্ড ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তারা ফ্রান্স ও ইটালী ভ্রমণ করেন এবং লিওনার্ডো ডা ভিঞ্চির দি লাস্ট সাপার দর্শন করে ১৮৯৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ভারতের উদ্দেশ্যে ন্যাপলস বন্দর ত্যাগ করেন।[৯৪] পরবর্তীতে মিস মুলার এবং সিস্টার নিবেদিতা ভারতে তাঁকে অনুসরণ করেন। সিস্টার নিবেদিতা তার বাকী জীবন ভারতীয় নারীদের শিক্ষায় এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে নিয়োজিত করেন।[৮২][৯৫]
Share:

বিবেকানন্দ মানবমুক্তির এক নব আবির্ভাব /স্বামী বেদানন্দ




একদা সেই দক্ষিণেশ্বরের ছোট্ট ঘরটিতে বসে শ্রীরামকৃষ্ণ যুবক নরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হ্যাঁরে, তুই কি চাস?” যুবক বেশ উদ্ধত ভাবেই উত্তর দিলেন, “আমি সমাধিতে ডুবে থাকতে চাই”। কথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণের মন ভরল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভাবশিষ্যকে মৃদু তিরস্কার করে বললেন, “বলিস কি রে? এই তুই সবচেয়ে বড় মনে করলি? আমি ভেবেছিলাম তুই একটা বড় মহীরুহ হবি আর তার তলায় শ্রান্ত পথিকেরা এসে আশ্রয় পাবে, শান্তি ও বিশ্রাম লাভ করবে, তা না হয়ে তুই-ও নিজের মুক্তির কামনা করছিস?” নরেন্দ্রনাথ চমকে উঠলেন। কিন্তু বেদবাক্যগুলির গভীর তাৎপর্য তখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। পরে গুরুদেবের দেহত্যাগের পর পরিব্রাজক বেশে যখন তিনি তৎকালীন ভারতের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে অবহিত হলেন তখনই বুঝতে শুরু করলেন। তিনি অনুধাবন করলেন, অতীব গৌরবোজ্জ্বল ভারতবর্ষ কতগুলি বদ্ধমূল ধারণা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। দেশের লোকসকল ধর্ম ধর্ম করে পরস্পর হৃদয়বত্তাকে আরও সংকীর্ণতা ও নিগূঢ় অনুশাসনে বেঁধে ফেলেছে। সর্বত্র দারিদ্রের প্রতাপ। শিক্ষার অভাব। চিন্তাধারার মধ্যেও সামাজিক ন্যায় ও গণতন্ত্রের কোনও অস্তিত্ব নেই। এ কী ভারতবর্ষ তিনি দেখছেন? যেখানে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে কেবল বিভেদের প্রাচীর। অস্পৃশ্যতার বাড়বাড়ন্ত। এ সব দেখেশুনে গভীর বেদনায় ব্যথিত হয়ে উঠলেন জ্যোতি-তনয় বিবেকানন্দ। ফলে সন্ন্যাসীর আত্মমগ্নতা থেকে নেমে এলেন তিনি কঠিন বাস্তবতায়। দেশ ও জাতিকে আরও গভীর ভাবে চেনার জন্য আতিথ্য গ্রহণ করলেন রাজার প্রাসাদ থেকে দরিদ্রের কুটিরে। আরও আরও প্রত্যক্ষ করলেন দুঃখ, দারিদ্র, বন্ধন ও অজ্ঞতার গভীর অন্ধকার। শুনলেন নৈরাশ্য নিপীড়িত লক্ষ লক্ষ ভারত সন্তানের করুণ আর্তনাদ। ভারতবর্ষের এই বর্তমান দৈন্যরূপ তাঁর চিত্তকে দলিত মথিত করে তুলল।
আর সেই অস্থিরতার প্রশমনে ভারতের শেষ শিলাখণ্ডে ধ্যানমগ্ন হলেন নবযুগের ঋষি বিবেকানন্দ। তাঁর অন্তরমন ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করেই উপলব্ধি করল অখণ্ড গৌরবোজ্জ্বল ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রূপ। এই সম্যক দর্শনে তিনি বুঝলেন, এই দেশের ঘোর অবনতির জন্য দায়ী প্রাণহীন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জনসাধারণকে উপেক্ষা এবং নারীজাতিকে অবমাননা। তাই ভারতকে উঠতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা যা ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সমন্বয়সাধন করেই গড়ে উঠতে পারে। আর সেই সঙ্গে প্রয়োজন স্বদেশবাসীর দারিদ্র দুঃখ লাঞ্ছনা মোচনের জন্য কিছু করা এবং নারীজাতিকে তাঁর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি এক্ষণে আরও উপলব্ধি করলেন শ্রীরামকৃষ্ণের অবতরণের মুখ্য উদ্দেশ্য হল, মানুষের দুঃখ দূর করা, মূর্খ-দরিদ্র-বঞ্চিত-শোষিত-নিপীড়িত-লাঞ্ছিত মানুষের সর্বাত্মক চেতনার জাগরণ ঘটানো, নরের মধ্যে নারায়ণকে দেখা জীবকে শিবজ্ঞানে সেবা করা।
স্বামীজি গুরুর এই আদর্শকে কার্যত এর পর থেকে প্রচার করতে ও কর্মে রূপ দিতে যত্নবান হলেন। ফলে, তিনি প্রথমেই হিন্দুর হাজার হাজার বছরের যে ধর্ম আকাঙ্ক্ষায় মানুষ ও সমাজকে অস্বীকার করে বিদ্যমান ছিল তার মূলে কুঠারাঘাত করলেন। তিনি বললেন, “নিজের মুক্তি চাস যে জাহান্নমে যাবি। সকলের মুক্তি কামনাই হল যথার্থ সন্ন্যাসের লক্ষণ।” সেই সঙ্গে সন্ন্যাস ধর্মের সামাজিকীকরণের কথা ঘোষণা করে বললেন, “বৃহৎ সংখ্যক মানুষ যদি ক্ষুধা, পীড়া ও অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে, সে ক্ষেত্রে কয়েক জন ব্যক্তি মানুষ যদি ঊর্ধ্বায়িত জীবনের আকাঙ্ক্ষা করে তা শুধু স্বার্থপরতার নয়, চরম পাপও। প্রয়োজন হল ব্যক্তির জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে শত শত লোকের কল্যাণ এবং এ ভাবে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি।” তাঁর দৃঢ় মত হল, যত দিন জগতে একজনও বদ্ধ থাকবে, অজ্ঞানে আচ্ছন্ন থাকবে, আমি নিজের মুক্তি চাই না। আমি বারবার জন্মগ্রহণ করে তাদের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করব। পরবর্তী কালে আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বেলুড়ে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ’ গঠন করে তাঁর মূল আদর্শবাণী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করলেন এই একটিই মহামন্ত্র ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আত্মার মুক্তি ও জগতের কল্যাণ যা হল এই সংঘের মূল মন্ত্র।
বস্তুত স্বামীজি ছিলেন বিশ্ব আচার্য বা লোকশিক্ষক। তাঁকে কোনও বিশ্বের ধর্ম বা গোষ্ঠী নিজের বলে দাবি করতে পারেন না। তিনি মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যই জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আত্মমুক্তিকামী সাধারণ মানুষ থেকে পরিণত হয়েছিলেন মহান দেশপ্রেমিকে, সমাজ সংস্কারক ও জগৎ কল্যাণের ভূমিকায়। তিনি নিজে যেমন ছিলেন সৎ ও অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর, তেমন ভাবেই প্রত্যেক ভারতবাসীকে গঠন করতে চাইতেন। তাঁর মধ্যে অদ্ভুত ধীশক্তি, বজ্রদৃঢ় মনোবল, ঐকান্তিক ঈশ্বরনির্ভরতা, অসাধারণ মানবপ্রেম, অসম্ভব সহৃদয়তার প্রকাশ ঘটেছিল। তাই তিনি ছিলেন শাশ্বত ভারতাত্মার নবীন ও প্রেরণাদায়ী উজ্জ্বল মূর্তি। বলতে কি গুরুর আদর্শ শিরোধার্য করে বিবেকানন্দ সারা জীবনই মানবচেতনার সমৃদ্ধির জন্য নানা কথা বলে গেছেন। বিশেষত তাঁর মধ্যে মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সত্যিই ছিল অসাধারণ। স্বামীজির প্রত্যাশা ছিল মেয়েরা যেমন আত্মবোধে জাগ্রতা হবে, তেমনই কর্মক্ষেত্রেও স্বনির্ভরতার উজ্জ্বল আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে। নারীদের পবিত্রতা ও সংযমের উপর জোর দিলেও স্বামীজি নারীর স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেননি। তিনি সে সময়ে বলেছিলেন, “আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা হেয়, অপবিত্র বলি। তার ফল আমরা পশু, উদ্যমহীন, দরিদ্র। তোমরা যদি মেয়েদের উন্নতি করিতে পার তবে আশা আছে। নচেৎ পশুজন্ম ঘুচবে না।” স্বামীজি মেয়েদের বলতেন এঁরা হলেন মূর্তিমতী শক্তি। যদি এই নারীশক্তিকে ঠিক মতো ব্যবহার করা যায়, তা হলে সহজেই দেশের উন্নতি হবে এবং সমাজও সার্বিক ভাবে সুন্দর হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে তাঁর যথাযোগ্য মন্তব্য হল “মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাধীনতা দাও। তা হলে তারা নিজেরাই নিজেদের গড়ে নেবে।”
এই নারীজাতির উন্নতির পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা করা, ভাষার চর্চা, শিল্প স্থাপন করা এবং দরিদ্র জনগণ তথা কৃষক-শ্রমিকের জীবনের মানোন্নতির জন্যও তাঁর বড় অবদান রয়েছে। বস্তুত মানবসেবার সমস্ত উপকরণগুলির সম্বন্ধেই স্বামীজি সর্বদা সচেতন ছিলেন। স্বামীজি চেয়েছিলেন, সেবা ধর্মের আমূল পরিবর্তন যা সমস্ত মানুষকে এক দিব্যচেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে। তাঁর মতে, ‘মানবসেবাই ঈশ্বরসেবা’ এটি স্বামীজি যে ভাবে প্রচার করে গেছেন তার তুলনা বিরল। বস্তুত স্বামীজির এই অসাধারণ সেবামার্গের অনুপ্রেরণাতে আকৃষ্ট হয়েই ভারতের বুকে নানা সেবাকাজ চলছে। এ আদর্শ অবশ্য যৌবনে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে শিখিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন, “চোখ বুজলে ভগবান আছেন আর চোখ খুললে তিনি কি নেই? প্রতিমায় ঈশ্বরের পুজো হয়, আর জীবন্ত মানুষে হয় না? …যত্র জীব তত্র শিব”। স্বামীজি বুঝেছিলেন ঠাকুরের নবযুগের এই মহামন্ত্র মানুষকে দেবে বাঁচার মন্ত্র, হতাশা থেকে মুক্তি, জীবত্ব থেকে শিবত্বের উত্তরণের এক অভিনব সুসমাচার।
স্বামীজির প্রবর্তিত এই সুমহান সেবাধর্মের বিজয়রথ এগিয়ে চলেছে দেশ হতে দেশান্তরে। তাঁর মহান জীবন এবং ততোধিক প্রাণপদ বাণী ভারতের ইতিহাসে এক নবযুগের যে সূচনা করেছে তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুত শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদে বিবেকানন্দের কণ্ঠে যে স্বর ধ্বনিত হয়েছে তা ভারতেরই কণ্ঠস্বর। যে ভারত মরেনি, যে ভারত মরবে না। যে ভারত পুরোনো হয় কিন্তু কখনও স্থবির হয় না, জরায় নষ্ট হয় না যে ভারত চিরনবীন যে ভারত স্বীয় ব্রতসাধনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শ্রীঅরবিন্দ তাই লিখে গিয়েছেন, “বিবেকানন্দের যাত্রা, যে বিবেকানন্দকে তাঁর গুরু চিহ্নিত করেছিলেন সেই বিরাট শক্তিধর পুরুষ হিসেবে যিনি গোটা জগৎটাকে দু’হাতে ধরে পাল্টে দিতে সমর্থ ছিলেন, পৃথিবীর সম্মুখে এটা প্রমাণ হয়েছে যে ভারতবর্ষ জাগ্রত হয়েছে, শুধু নিজে বাঁচার জন্য নয়, জগৎকে জয় করার জন্যও।”
স্বামীজির সার্ধশতবর্ষের প্রাক্কালে আজ আরও একবার সকলকে স্মরণ করতে হবে এই মহামানবের অপরূপ বাণীটিও যা সতত প্রেরণাদায়ক। যা পথ চলার হাতিয়ার এবং মানবমুক্তির অন্যতম সোপান।
Share:

রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সংক্ষিপ্ত জীবনী


রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৬ – ১৬ই আগস্ট, ১৮৮৬; পূর্বাশ্রমের নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়) ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু। তাঁর প্রচারিত ধর্মীয় চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁরা উভয়েই বঙ্গীয় নবজাগরণের এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর হিন্দু নবজাগরণের অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব। তাঁর শিষ্যসমাজে, এমনকি তাঁর আধুনিক ভক্তসমাজেও তিনি ঈশ্বরের অবতাররূপে পূজিত হন। রামকৃষ্ণ পরমহংস গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে পৌরোহিত্য গ্রহণের পর বঙ্গীয় তথা ভারতীয় শক্তিবাদের প্রভাবে তিনি কালীর আরাধনা শুরু করেন। তাঁর প্রথম গুরু তন্ত্র ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিতত্ত্বজ্ঞা এক সাধিকা। পরবর্তীকালে অদ্বৈত বেদান্ত মতে সাধনা করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত ইসলাম ও খ্রিস্টীয় মতে সাধনা তাঁকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে।পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে অশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ততসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী, যাঁরা ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তাঁর কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই নেতা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দ তাঁর ধর্মীয় চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্যের জনসমক্ষে উপনীত করেন। বিবেকানন্দ যে বিশ্বমানবতাবাদের বার্তা প্রেরণ করে তা সর্বত্র সমাদৃত হয় এবং তিনিও সকল সমাজের সমর্থন অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু দর্শনের সার্বজনীন সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এরপর প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত সোসাইটি এবং ভারতে রামকৃষ্ণের ধর্মীয় সমন্বয়বাদ ও “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”র আদর্শ বাস্তবায়িত করার জন্য স্থাপনা করেন রামকৃষ্ণ মিশন নামে একটি ধর্মীয় সংস্থা।রামকৃষ্ণ আন্দোলন ভারতের অন্যতম নবজাগরণ আন্দোলনরূপে বিবেচিত হয়।২০০৮ সালে ভারত ও বহির্ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের মোট ১৬৬টি শাখাকেন্দ্র বিদ্যমান। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বেলুড় মঠে অবস্থিত।

জন্ম ও শৈশব
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে এক দরিদ্র ধর্মনিষ্ঠ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম হয়। তিনি পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মা চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ ও শেষ সন্তান। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মের পূর্বে তাঁর পিতামাতার সম্মুখে বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। সন্তানসম্ভবা চন্দ্রমণি দেবী দেখেছিলেন শিবলিঙ্গ থেকে নির্গত একটি জ্যোতি তাঁর গর্ভে প্রবেশ করছে। তাঁর জন্মের অব্যবহিত পূর্বে গয়ায় তীর্থভ্রমণে গিয়ে ক্ষুদিরাম গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দর্শন করেন। সেই কারণে তিনি নবজাতকের নাম রাখেন গদাধর।শৈশবে গদাই নামে পরিচিত গদাধর তাঁর গ্রামবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। অঙ্কন ও মাটির প্রতিমা নির্মাণে তাঁর ছিল সহজাত দক্ষতা। যদিও প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর আদৌ মনযোগ ছিল না। সেযুগে ব্রাহ্মণসমাজে প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষাকে তিনি “চালকলা-বাঁধা বিদ্যা” (অর্থাৎ পুরোহিতের জীবিকা-উপার্জনী শিক্ষা) বলে উপহাস করেন এবং তা গ্রহণে অস্বীকার করেন। তবে পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাঁর ঔদাসিন্য থাকলেও নতুন কিছু শিখতে তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিল না।গানবাজনা, কথকতা ও ধর্মীয় উপাখ্যান অবলম্বনে যাত্রাভিনয়ে তিনি অনায়াসে পারদর্শিতা অর্জন করেন।তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী এবং গ্রাম্য পুরাণকথকদের কথকতা শুনে অতি অল্প বয়সেই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে বুতপত্তি অর্জন করেন গদাধর।মাতৃভাষা বাংলায় তাঁর অক্ষরজ্ঞান ছিল;কিন্তু সংস্কৃত অনুধাবনে সক্ষম হলেও সেই ভাষা তিনি বলতে পারতেন না।পুরীর পথে কামারপুকুরে বিশ্রামরত সন্ন্যাসীদের সেবাযত্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ধর্মীয় বিতর্ক মন দিয়ে শুনতেন গদাধর। শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তা দেখা দিত। একবার ধানক্ষেতের পথে চলতে চলতে আকাশে কালো মেঘের পটে সাদা বলাকার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তিনি বাহ্যজ্ঞানরহিত হন। পরবর্তীকালে তাঁর সেই অবস্থাকে তিনি ব্যাখ্যা করেন এক অনির্বচনীয় আনন্দের অভিজ্ঞতারূপে।বাল্যকালে আরও কয়েকবার তাঁর অনুরূপ ভাবতন্ময়তা দেখা দিয়েছিল – একবার দেবী বিশালাক্ষীর পূজার সময়, আরেকবার শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রায় শিবের চরিত্রাভিনয়কালে। দশ-বারো বছর বয়স থেকে এই ভাবতন্ময়তা তাঁর নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।১৮৪৩ সালে পিতৃবিয়োগের পর পরিবারের ভার গ্রহণ করেন তাঁর অগ্রজ রামকুমার। এই ঘটনা গদাধরের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মীয় জীবনযাপনের ইচ্ছা তাঁর মনে দৃঢ় হয়। পিতার অভাব তাঁকে মায়ের খুব কাছে নিয়ে আসে; ঘরের কাজ ও গৃহদেবতার পূজাপাঠে তিনি অধিকতর সময় ব্যয় করতে থাকেন; আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন ধর্মীয় মহাকাব্য পাঠে। গদাধর যখন কিশোর, তখন তাঁর পরিবারের আর্থিক সংকট দেখা দেয়। রামকুমার কলকাতায় একটি সংস্কৃত টোল খোলেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালে দাদাকে পৌরোহিত্যে সহায়তা করার মানসে গদাধর কলকাতায় পদার্পণ করেন।

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে পৌরহিত্য
১৮৫৫ সালে কলকাতার অস্পৃশ্য কৈবর্ত সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সেই মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন।নিম্নবর্ণীয়া এক নারীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির হওয়া সত্ত্বেও সামান্য অনুরোধেই গদাধর সেই মন্দিরে চলে আসেন। তিনি ও তাঁর ভাগনে হৃদয়রাম রামকুমারের সহকারী হিসাবে প্রতিমার সাজসজ্জার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম আঙিনায় তাঁকে একটি ছোটো ঘর দেওয়া হয়। এই ঘরেই তিনি অতিবাহিত করেন তাঁর অবশিষ্ট জীবন।অনুমিত হয়, রাণী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস, যিনি মথুরবাবু নামে পরিচিত ছিলেন, তিনিই গদাধরকে রামকৃষ্ণ নামটি দিয়েছিলেন।অন্য মতে, এই নামটি তাঁর অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া।রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তা বৃদ্ধি পায়। কালীকে তিনি মা ও বিশ্বজননীভাবে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেন। এই সময় দেবীর প্রত্যক্ষ রূপ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস পাষাণপ্রতিমা জীবন্ত হয়ে অন্নগ্রহণ করতে শুরু করে। পূজা করতে করতে দেবীর দর্শন না পেয়ে তিনি চিতকার করে কেঁদে উঠতে থাকেন। রাত্রিকালে নিকটবর্তী জঙ্গলে গিয়ে বস্ত্র ও উপবীত ত্যাগ করে নির্জনে ধ্যান করতেও শুরু করেন।কেউ কেউ বলতে থাকে যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন, আবার কেউ বলেন তিনি ঈশ্বরের প্রেমে আকুল হয়েছেন।একদিন অস্থিরতার বশে তিনি সংকল্প করেন দেবীর দর্শন না পেলে জীবন বিসর্জন দেবেন। দেওয়াল থেকে খড়্গ তুলে নিয়ে তিনি গলায় কোপ বসাবেন, এমন সময় অকস্মাৎ সমগ্র কক্ষ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর প্রথম কালীদর্শনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা নিম্নরূপ;
“সহসা মার অদ্ভুত দর্শন পাইলাম ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম! তাহার পর বাহিরে কি যে হইয়াছে, কোন্ দিক দিয়া সেদিন ও ততপরদিন যে গিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই! অন্তরে কিন্তু একটা অননুভূত জমাট-বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলাম!… ঘর, দ্বার, মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হইল – কোথাও যেন আর কিছুই নাই! আর দেখিতেছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতিঃ-সমুদ্র! – যেদিকে যতদূর দেখি, চারিদিক হইতে তার উজ্জ্বল ঊর্মিমালা তর্জন-গর্জন করিয়া গ্রাস করিবার জন্য মহাবেগে অগ্রসর হইতেছে! দেখিতে দেখিতে উহারা আমার উপর নিপতিত হইল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলাইয়া দিল! হাঁপাইয়া হাবুডুবু খাইয়া সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম।উক্ত ঘটনার পর শ্রীরামকৃষ্ণ কালীর নিকট সম্পূর্ণত নিজেকে সমর্পণ করেন। কি সাধারণ, কি দার্শনিক – সকল ক্ষেত্রেই বালকসুলভ আনুগত্য নিয়ে তিনি দেবীর নিকট প্রার্থনা নিবেদন করতে শুরু করেন। রাণী রাসমণি ও তাঁর জামাতা মথুরবাবু যদিও পরম স্নেহবশত তাঁকে তাঁর ইচ্ছামতো পূজার অনুমতি দিয়েছিলেন, তবুও তাঁরা মনে করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ দীর্ঘ ব্রহ্মচর্যজনিত কোনও দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। মথুরবাবু তাঁর জন্য বারবণিতার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু তাঁকে প্রলুব্ধ করার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। তিনি সেই দেহোপজীবিনীর মধ্যেও দিব্য মাতৃমূর্তি দর্শন করেন।

বিবাহ
কামারপুকুরে গুজব রটে যায়, দক্ষিণেশ্বরে অতিরিক্ত সাধনার শ্রমে শ্রীরামকৃষ্ণ পাগল হয়ে গেছেন। মা ও মধ্যমাগ্রজ রামেশ্বর তাঁর বিবাহদানের চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, বিবাহের পর সাংসারিক দায়-দায়িত্বের ভার কাঁধে চাপলে আধ্যাত্ম সাধনার মোহ তাঁর কেটে যাবে – তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরে আসবেন।শ্রীরামকৃষ্ণ বিবাহে আপত্তি তো করলেনই না, বরং বলে দিলেন কামারপুকুরের তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে জয়রামবাটী গ্রামের রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গৃহে কন্যার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। ১৮৫৯ সালে পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকা সারদার সঙ্গে তাঁর শাস্ত্রমতে বিবাহ সম্পন্ন হয়।শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ। বয়সের এই পার্থক্য উনিশ শতকীয় গ্রামীণ বঙ্গসমাজে কোনও অপ্রচলিত দৃষ্টান্ত ছিল না। যাই হোক, ১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৬৭ সালের মে মাসের আগে তাঁদের আর সাক্ষাৎ হয়নি।

সাধনা
বিবাহের পর শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে পুণরায় মন্দিরের কাজ গ্রহণ করেন। তবে ভাবতন্ময়তা কাটার পরিবর্তে তাঁর অধ্যাত্ম-পিপাসা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ব্রাহ্মণের জাত্যভিমান দূর করার জন্য তিনি নিম্নবর্ণীয়দের হাতে খাদ্যগ্রহণ, অন্ত্যজ পারিয়াদের (চাকর ও ঝাড়ুদার) সেবা করতে থাকেন।স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাকে মাটির ঢেলার সঙ্গে মিশিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন “টাকা মাটি, মাটি টাকা”। এবং অর্থকে লোষ্ট্রজ্ঞানে গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। লোকে মনে করতে থাকেন, সত্যিই তিনি পাগল হয়ে গেছেন।কথিত আছে, এই অবস্থায় তিনি এতটাই সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিলেন, যে ঘুমন্ত অবস্থাতে কেউ মুদ্রা স্পর্শ করালে, তাঁর দেহ সংকুচিত হয়ে আসত।তাঁর শরীরে তীব্র দাহ উপস্থিত হল। তিনি নিদ্রারহিত হলেন। ফলে মন্দিরের কাজকর্ম তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। চিকিতসকগণ আহূত হলেন। কিন্তু তাঁদের একজন বললেন যে রোগীর এই অবস্থার কারণ আধ্যাত্মিক উত্তেজনা। কোনও ঔষধ একে সুস্থ করতে সক্ষম নয়।

ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও তন্ত্রসাধনা
১৮৬১ সালে ভৈরবী ব্রাহ্মণী নামে গৈরিক বস্ত্র পরিহিতা এক যোগিনী দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল যোগেশ্বরী এবং বয়স ছিল চল্লিশের কাছাঁকাছি।দক্ষিণেশ্বরে আগমনের পূর্বে তাঁর জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না।তবে তিনি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞা ও তন্ত্র ও বৈষ্ণব সাধনে সিদ্ধা।শ্রীরামকৃষ্ণ ভৈরবীর কাছে তাঁর ভাবতন্ময়তা ও দৈহিক পীড়ার বর্ণনা দিলেন।ভৈরবী তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে তিনি পাগল হয়ে যাননি; বরং আধ্যাত্মিক ‘মহাভাব’ তাঁকে আশ্রয় করেছে।এই মহাভাবের বশেই তিনি দিব্যপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন।বিভিন্ন ভক্তিশাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখালেন রাধা ও চৈতন্য মহাপ্রভুরও একই ভাব উপস্থিত হয়েছিল।ভৈরবী তাঁর দৈহিক পীড়া অবসানের নিদানও দিলেন।ভৈরবীর পথনির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রমতে সাধনা শুরু করলেন। এই সাধনায় তাঁর সমস্ত শারীরিক ও মানসিক পীড়ার উপশম হল।ভৈরবীর সহায়তায় তিনি তন্ত্রোল্লেখিত ৬৪ প্রকার প্রধান সাধন অভ্যাস করলেন।জপ ও পুরশ্চরণের মতো মন্ত্রসাধনায় চিত্ত শুদ্ধ করে পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ স্থাপন করলেন। তন্ত্রসাধনায় সাধারণত বামাচারের মতো ধর্মবিরোধী পন্থাও অভ্যাস করতে হয়; যার মধ্যে মাংস ও মতস্য ভক্ষণ, মদ্যপান ও যৌনাচারও অন্তর্ভুক্ত।শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর জীবনীকারগণের কথা থেকে জানা যায়, শেষোক্ত দুটি তিনি অভ্যাস করেননি, শুধুমাত্র সেগুলির চিন্তন করেই কাঙ্খিত সাধনফল লাভ করেছিলেন।শ্রীরামকৃষ্ণ বামাচারকে একটি জ্ঞানমার্গ বলে উল্লেখ করলেও, অন্যদের এই পথে সাধন করতে নিষেধ করতেন।পরে তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ যখন তাঁকে বামাচার সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, তিনি বলেন, “(এই পথ) বড় কঠিন, ঠিক রাখা যায় না, পতন হয়।”২১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯, কেশবচন্দ্র সেনের গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবসমাধি।ভাগিনেয় হৃদয় ব্রাহ্ম ভক্তবেষ্টিত শ্রীরামকৃষ্ণকে ধরে আছেন। ভৈরবী শ্রীরামকৃষ্ণকে কুমারী পূজা শিক্ষা দেন।এই পূজায় কোনও কুমারী বালিকাকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়।এছাড়াও ভৈরবীর নির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ কুণ্ডলিনী যোগেও সিদ্ধ হন।১৮৬৩ সাল নাগাদ তাঁর তন্ত্রসাধনা সম্পূর্ণ হয়।শ্রীরামকৃষ্ণ ভৈরবীকে মাতৃভাবে দেখতেন।অন্যদিকে ভৈরবী তাঁকে মনে করতেন ঈশ্বরের অবতার।তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম সর্বসমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণকে অবতার বলে ঘোষণা করেন।কিন্তু নানা লোকের কথা শুনেই শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে তাঁর অবতারত্ব সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন।যাই হোক, ভৈরবীর নিকট তন্ত্রসাধনা তাঁর আধ্যাত্ম-সাধনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব বিবেচিত হয়।

বৈষ্ণবীয় ভক্তিসাধনা
বৈষ্ণব ভক্তিশাস্ত্রে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম নিবেদনে পাঁচটি ভাবের উল্লেখ রয়েছে – শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাতসল্য ও মধুর।শ্রীরামকৃষ্ণ এই ভাবগুলির কয়েকটি অভ্যাস করেন।কালীদর্শন ও বিবাহে মধ্যবর্তী সময়ে কিছুকালের জন্য তিনি দাস্যভাবে সাধনা করেছিলেন।এই সময় তিনি হনুমানভাবে ভাবিত হয়ে রামচন্দ্রের আরাধনা করেন। এইসময় তাঁর হাবভাব সকলই হনুমানের মতো হয়েছিল। তিনি কদলীভক্ষণ করতেন, অধিকাংশ সময় বৃক্ষশাখায় কাটাতেন, এমনকি বানরের মতো অস্থির চোখের দৃষ্টিও লাভ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তাঁর মেরুদণ্ডের নিচে সামান্য অংশও এই সময় লেজের মতো প্রসারিত হয়েছিল।দাস্যভাবে সাধনার সময় তিনি রামের পত্নী সীতাদেবীর দর্শন পান এবং সীতার সেই মূর্তি তাঁর নিজদেহে অন্তর্হিত হতে দেখেন।১৮৬৪ সালে দেবীপ্রতিমায় মাতৃভাব আরোপ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বাতসল্যভাবের সাধনা করেন। এই সময় তিনি ‘রামলালা’ অর্থাৎ বালক রামচন্দ্রের একটি ধাতুমূর্তি পূজা করতেন।পরে তিনি বলেছিলেন, এই সময় তাঁর হৃদয় মাতৃভাবে পূর্ণ হত।তাঁর মধ্যে নারীর ভাব ফুটে উঠত এমনকি তাঁর কথাবার্তা ও হাবভাবও মেয়েলি আকার নিত।শ্রীরামকৃষ্ণ আরও বলেছেন যে এই সময় তিনি ধাতুমূর্তিতেই জীবন্ত বালক রামচন্দ্রকে চাক্ষুষ করতেন।পরবর্তীকালে গোপিনী রাধার ভাব আরোপ করে কৃষ্ণের প্রেমিকরূপে মধুর ভাব সাধনা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ।এই প্রেম উপলব্ধি করার জন্য তিনি দীর্ঘকাল নারীর বেশে নিজেকে বৃন্দাবনের গোপিনী কল্পনা করেছিলেন। এই সাধনার অন্তে তাঁর সবিকল্প সমাধি হয় – তিনি কৃষ্ণের সাথে আধ্যাত্মিক মিলনে মিলিত হন।নদিয়ায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবর্তক চৈতন্য ও নিত্যানন্দের জন্মস্থান ভ্রমণকালে তিনি ভাবচক্ষুতে দুই নৃত্যরত বালককে তাঁর দেহে অন্তলীন হতে দেখেছিলেন।

তোতাপুরী ও বৈদান্তিক সাধনা
১৮৬৪ সালে তোতাপুরী নামক জনৈক পরিব্রাজক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর নিকট শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী তোতাপুরী ছিলেন জটাজুটধারী এক বিশালবপু উলঙ্গ নাগা সন্ন্যাসী।গুরুর নাম গ্রহণ করা শাস্ত্রমতে বারণ; তাই শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে ‘ল্যাংটা’ বা ‘ন্যাংটা’ বলে উল্লেখ করতেন।তোতাপুরী ‘নেতি নেতি’ দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ দর্শন করতেন। তাঁর মতে সকলই ছিল মায়া। দেব-দেবীর মূর্তিপূজাকেও তিনি উপহাস করতেন। বিশ্বাস করতেন এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মে।তোতাপুরী প্রথমে সকল জাগতিক বন্ধন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁকে সন্ন্যাস প্রদান করেন। অতঃপর তোতা তাঁকে অদ্বৈত তত্ত্ব শিক্ষা দেন। নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব, দেশকালাদি দ্বারা সর্বদা অপরিচ্ছিন্ন একমাত্র ব্রহ্মবস্তুই নিত্য সত্য। অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া নিজপ্রভাবে তাঁহাকে নামরূপের দ্বারা খণ্ডিতবৎ প্রতীত করাইলেও তিনি কখনও বাস্তবিক ঐরূপ নহেন। … নামরূপের দৃঢ় পিঞ্জর সিংহবিক্রমে ভেদ করিয়া নির্গত হও। আপনাতে অবস্থিত আত্মতত্ত্বের অন্বেষণে ডুবিয়া যাও।অদ্বৈত বেদান্তের নানা তত্ত্ব শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোতা এগারো মাস দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট রয়ে যান। তিনি বিদায় নিলে আরও ছয় মাস শ্রীরামকৃষ্ণ আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তার জগতে অবস্থান করেন।শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অনুযায়ী, এরপর তিনি দেবী কালীর নিকট থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হন – “তুই ভাবমুখে থাক” (অর্থাৎ, সমাধি ও সাধারণ অবস্থার মুখে অবস্থান করে লোকশিক্ষা দান কর)।

ইসলাম ও খ্রিস্টমতে সাধনা
১৮৬৬ সালে সুফিমতে সাধনাকারী হিন্দু গুরু গোবিন্দ রায়ের কাছে ইসলাম ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ।তিনি বলেছেন, “ঐ সময়ে ‘আল্লা’মন্ত্র জপ করিতাম, মুসলমানদিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম; ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম এবং হিন্দুভাব মন হইতে এককালে লুপ্ত হওয়ায় হিন্দুদেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক, দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না।তিনদিন অনুরূপ সাধনার পর তিনি “এক দীর্ঘশ্মশ্রুবিশিষ্ট, সুগম্ভীর, জ্যোতির্ময় পুরুষপ্রবরের (মহানবী) দিব্যদর্শন লাভ” করেন। সেই পুরুষ তাঁর দেহে লীন হন।১৮৭৩ সালের শেষভাগ নাগাদ শম্ভুচরণ মল্লিক তাঁকে বাইবেল পাঠ করে শোনালে তিনি খ্রিস্টীয় মতে সাধনা শুরু করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এই সময় তাঁর চিত্ত খ্রিস্টীয় ভাবে পূর্ণ হয়েছিল এবং তিনি কালীঘরে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন। একদিন মেরিমাতার কোলে যিশু খ্রিস্টের চিত্রে তিনি জীবন্ত যিশুর দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। তাঁর ঘরে হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে পিতরকে ত্রাণরত যিশুর একটি চিত্র ছিল, সেটিতে তিনি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপারতি করতেন।

সারদা দেবী
সেকালের প্রথা অনুযায়ী সতেরো-আঠারো বছর বয়স হলে সারদা দেবী স্বামীগৃহে যাত্রা করলেন। স্বামী পাগল হয়ে গেছেন – এইরূপ একটি গুজব শুনে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ছিলেন। আবার এও শুনেছিলেন, তাঁর স্বামী একজন বিশিষ্ট সাধকে পরিণত হয়েছেন।শ্রীরামকৃষ্ণ এই সময় ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। এই পূজায় তিনি সারদা দেবীকে দিব্য মাতৃকাজ্ঞানে পূজা নিবেদন করেছিলেন। তাঁকে দেবী কালীর পীঠে বসিয়ে পুষ্প ও ধূপদানে তাঁর পূজা সম্পাদন করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, তিনি যে নারীমাত্রেই জগজ্জননীর রূপ দর্শন করেন, তাঁর নিজের স্ত্রীও তার ব্যতিক্রম নয়।এমনকি তিনি রূপপোজীবিনী বারবণিতাদেরও মাতৃসম্বোধন করতেন।দাম্পত্যজীবনে সারদা দেবীর মধ্যে মাতৃজ্ঞান করায় তাঁদের বিবাহ অসাধারণত্বে উন্নীত হয়।সারদা দেবীর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ কোনও দিন তাঁকে ‘তুই’ সম্বোধন করেননি। কখনও রূঢ়বাক্য প্রয়োগ বা তিরস্কারও করেননি।সারদা দেবীকেই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম অনুগামী মনে করা হয়। তাঁর শিষ্য ও ভক্তসমাজে সারদা দেবী ‘শ্রীমা’ বা ‘মাতাঠাকুরানী’ নামে পরিচিতা হন। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোভাবের পর তিনিই রামকৃষ্ণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্বরূপা হয়েছিলেন।

ব্রাহ্ম ও ভদ্রলোক সমাজে প্রভাব
১৮৭৫ সালে প্রভাবশালী ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়।কেশব খ্রিস্টধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সহিত তাঁর বিচ্ছেদও ঘটেছিল। তিনি প্রথমে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের বহুদেববাদ গ্রহণ করেন এবং তাঁর সর্বধর্মসমন্বয়, ঈশ্বরে মাতৃভাব আরোপ এবং ব্রাহ্ম ও বহুদেববাদের সম্মিলনের আদর্শে “নববিধান” প্রতিষ্ঠা করেন।নববিধানের পত্রপত্রিকায় কেশব বেশ কয়েকবছর শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশাবলি প্রচারও করেছিলেন।এর ফলে বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণী, অর্থাৎ ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও ভারতে বসবাসকারী ইউরোপীয়গণ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন।কেশবচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতো অন্যান্য ব্রাহ্মগণও শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাতায়াত শুরু করেন, ও তাঁর মতের অনুগামী হয়ে পড়েন। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী ও ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল প্রমুখ কলকাতার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ১৮৭১ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নিময়িত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রথম ইংরেজিতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেন। ১৯৭৯ সালে থেইস্টিক কোয়ার্টারলি রিভিউ পত্রিকায় দ্য হিন্দু সেইন্ট নামে প্রকাশিত সেই জীবনী জার্মান ভারতবিদ ম্যাক্স মুলার প্রমুখ পাশ্চাত্য পণ্ডিতের দৃষ্টি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট করে।এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অন্যান্য ব্রাহ্মদের বক্তৃতা ও নিবন্ধ থেকেও বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুসারে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেম ও ভক্তির বাণী বাঙালি সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং বহু বিপথগামী যুবককে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও স্বামী দয়ানন্দের সঙ্গেও ধর্মবিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের বাক্যালাপ হয়েছিল।তবে ব্রাহ্মসমাজে তাঁর মত ও ধর্মবিশ্বাসের বিরোধিতাও অনেকে করেছিলেন। তাঁর সমাধি অবস্থাকে তাঁরা স্নায়ুদৌর্বল্য বলে উপহাস করেন।ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁর অবতারত্ব অস্বীকার করেছিলেন।শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব কলকাতার শিক্ষিত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর জীবদ্দশাতেই পণ্ডিত-বিদ্বজ্জন মহলের গণ্ডী টপকে তাঁর ধর্মীয় চিন্তাধারণা ও উপদেশের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল বাংলার বাউল ও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে, এমনকি বাংলার বাইরেও। অবশ্য মৃত্যুর পূর্বে রামকৃষ্ণ আন্দোলনের কাজ বিশেষ কিছুই সাধিত হয়নি।ব্রাহ্মসমাজ ও নবোত্থিত হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে বাংলার নবজাগরণে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব অবিস্মরণীয়।সেই যুগে শ্রীরামকৃষ্ণের পাশ্চাত্য গুণগ্রাহীদের অন্যতম ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের তদনীন্তুন অধ্যক্ষ ডক্টর ডব্লিউ ডব্লিউ হেস্ট।শ্রেণীকক্ষে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ রচিত দ্য এক্সকারসন কবিতাটিতে ব্যবহৃত ট্র্যান্স শব্দটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, শব্দটির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে হলে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাওয়া আবশ্যক। তাঁর এই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন তরুণ দক্ষিণেশ্বরে যান। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত; যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন।

ভক্ত ও শিষ্য
১৮৭৯ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নিজের প্রধান শিষ্যদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাক্ষাৎ হয়। এঁদের অনেকেই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। কেউ আবার ছিলেন একান্তই নাস্তিক; নিছক কৌতূহলের বশেই তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ এঁদের সকলের মধ্যেই গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং এঁরা সকলেও তাঁর অনুরাগী ভক্তে পরিণত হন। প্রবল যুক্তিবাদী সুরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন, তাঁর ‘কান মলে’ দেওয়ার জন্য; কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হন।তাঁর অননুকরণীয় ধর্মপ্রচারের ভঙ্গি অনেক সংশয়বাদী ব্যক্তির মনেও দৃঢ় প্রত্যয়ের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল।
তাঁর প্রধান শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখনীয়:
• গৃহস্থ শিষ্য – মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অক্ষয়কুমার সেন প্রমুখ;
• ত্যাগী বা সন্ন্যাসী শিষ্য – নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), রাখালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ), তারকনাথ ঘোষাল (স্বামী শিবানন্দ), শশীভূষণ চক্রবর্তী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী (স্বামী সারদানন্দ) প্রমুখ।
• এছাড়া নারী ভক্তদের একটি ছোটো অংশও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। এঁদের মধ্যে গৌরী মা ও যোগীন মা উল্লেখযোগ্য। এঁদের কেউ কেউ মন্ত্রদীক্ষার মাধ্যমে তাঁর থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। তবে তপস্যার বদলে শহরে অবস্থান করে নারীসমাজের সেবাতেই তাঁদের উতসাহিত করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসতে শুরু করেন – “কি মহারাজা কি ভিখারি, কি পত্রিকাকার কি পণ্ডিত, কি শিল্পী কি ভক্ত, কি ব্রাহ্ম কি খ্রিস্টান কি মুসলমান, সকল মতের সকল পেশার আবালবৃদ্ধ বণিতা”।জীবনীকারদের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন খুবই মিশুকে ও তুখোড় আলাপচারী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক নাগাড়ে বলে যেতে পারতেন – নিজের অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতার কথা, নানা গল্প; খুব সাধারণ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে চলতেন বেদান্তের দুর্বোধ্য তত্ত্ব; রসিকতা, গান বা অন্যদের নকল করারও মাধ্যমে আমোদ-প্রমোদেও পিছপা হতেন না। সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধের টেনে রাখতেন তাঁর কাছে। কিছু সন্ন্যাসী শিষ্য থাকলেও, তিনি সকলকে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে বলতেন না।আবার ত্যাগী শিষ্যদের সন্ন্যাসজীবনের জন্য প্রস্তুত করার মানসে তাদের জাতিনির্বিশেষে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষা করার নির্দেশ দিতেন। এঁদের তিনি সন্ন্যাসী জীবনের প্রতীক গৈরিক বস্ত্র ও মন্ত্রদীক্ষাও দান করেছিলেন।

শেষ জীবন
১৮৮৫ সালের প্রারম্ভে তিনি ক্লার্জিম্যান’স থ্রোট রোগে আক্রান্ত হন; ক্রমে এই রোগ গলার ক্যান্সারের আকার ধারণ করে। কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে তাঁকে নিয়ে আসা হয়।বিশিষ্ট চিকিতসক মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁর চিকিতসায় নিযুক্ত হন। অবস্থা সংকটজনক হলে ১১ ডিসেম্বর, ১৮৮৫ তারিখে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় কাশীপুরের এক বিরাট বাগানবাড়িতে।এই সময় তাঁর শিষ্যগণ ও সারদা দেবী তাঁর সেবাযত্ন করতেন। চিকিৎসকগণ তাঁকে কথা না বলার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে তিনি অভ্যাগতদের সঙ্গে ধর্মালাপ চালিয়ে যান।কথিত আছে, মৃত্যুর পূর্বে বিবেকানন্দকে তিনি বলেছিলেন, “আজ তোকে যথাসর্বস্ব দিয়ে ফকির হয়েছি। এই শক্তির সাহায্যে তুই জগতের অশেষ কল্যাণ করতে পারবি। কাজ শেষ হলে আবার স্বস্থানে ফিরে যাবি।” এও কথিত আছে বিবেকানন্দ তাঁর অবতারত্ব সম্পর্কে সন্ধিহান হলে তিনি বলে ওঠেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই রামকৃষ্ণ…”তাঁর শেষের দিনগুলিতে তিনি বিবেকানন্দকে ত্যাগী শিষ্যদের দেখাশোনার ভার অর্পণ করে যান। এরপরেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় এবং তিনি ১৬ অগস্ট, ১৮৮৬ অতি প্রত্যুষে পরলোকগমন করেন। তাঁর শিষ্যদের কথায় এই তাঁর মহাসমাধি।তাঁর প্রয়াণের পর বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী শিষ্যদের নিয়ে বরাহনগরে একটি পোড়ো বাড়িতে ওঠেন এবং গৃহী শিষ্যদের অর্থসাহায্যে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রা।
Share:

“ওম” গ্রন্থের সূচনা অংশ – দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য





সত্যকে জানা বা তাকে জানার চেষ্টা করা প্রত্যেকটি মানুষেরই উচিত। কারন সত্যই শিব। আর শিবই সুন্দর। “সত্যম শিবম সুন্দরম”। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সেই সত্য যা সুন্দর তাকে জানার চেষ্টায় নিজেকে নিযুক্ত করা। তাতে একাধারে যেমন নিজের উন্নতি তেমনই উন্নতি সমাজের। কারন মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের নিজের উন্নতি হলেই সমাজেরও কল্যান ও উন্নতি হতে বাধ্য। এখন তাই আমাদের উচিত সমাজের প্রতিটি মানুষকে সঠিক জ্ঞান দ্বারা উন্নত করে সমাজসংস্কার করা। আমার মতে কোন একটি বিশেষ মানুষ বা দল বা গোষ্ঠির কিছু সুন্দর কাজের মাধ্যমে সমাজের কিছু অংশের উন্নতি সাধন সম্ভব। কিন্তু সম্পুর্ণ উন্নতি নয়। তার জন্যে একমাত্র প্রয়োজন সবাইকে উন্নত করা। শিক্ষিত করা। শিক্ষিত মানে এই নয় যে লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত। কারন আজকাল এমন অনেকই তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ অশিক্ষিতের মতই আচরন করে। তাই পুঁথগত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, সেটাতো লাগবেই, তাছাড়া আত্মোন্নতি ও সত্যকে সঠিক ভাবে জেনে যে শিক্ষিত আমি তার কথাই বলছি। এবার প্রশ্ন হল এই শিক্ষা কিভাবে কোথা থেকে কি বিষয় এবং কি উপায় পাওয়া সম্ভব। আসুন সেই পথটিই প্রথমে খোঁজার চেষ্টা করি। শূন্য থেকে শুরু করি।
সত্যজ্ঞানের অভাবেই এই জগতে সৃষ্টি হয়ে এসেছে একের পর এক কুসংস্কার। মানুষ অন্ধকারে দুবে থাকছে আর সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করে জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার লোক ঠকানো জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বাবা ইত্যাদি। যেখানে জ্যোতিষ শাস্ত্র একটি অতি উন্নত বিজ্ঞান সেখানে এই সমস্ত ভন্ড মানুষদের নিচ মানসিকতা, ও লোভের কারনে সেই অতি উত্তম শাস্ত্রকে ভুল কাজে ব্যাবহার করার ফলে আজ মানুষ সেই শাস্ত্রকেও অবহেলা করছে। জ্যোতিষের কথা শুনলেই তাই আজ শিক্ষিত মানুষরা জ্যোতিষশাস্ত্রের কত শক্তি, কত উন্নত সেই বিজ্ঞান তা না জেনেই, বা তার বিচার বিশ্লেষন না করেই তাকে অবজ্ঞা করতে শিখেছে। আর এর ফলেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে ধর্ম, শাস্ত্র ইত্যাদির প্রতি মানুষের অণীহা। আর এর জন্যে দায়ী সেই সব পাষন্ড, ধর্মের নামে নিজের স্বার্থসিদ্ধি চরিতার্থ করতে তৎপর লোভী মানুষের দল। এখন আবার নতুন একটি সমস্যা। সব জ্যোতিষীই তবে লোভী বা ভুল? না তাও নয়। অনেক ভালো মানুষ আজও এই পৃথিবীতে আছেন। তা না থাকলে আজও একটি লোক রোদে মাথা ঘুরে পরে গেলে বা ট্রেনে উঠতে গিয়ে পরে গেলে দশজন মানুষ তাকে সাহায্য করতে, তাকে ধরতে ছুটে আসত না। আমার এই ভারত প্রেমের দেশ। এখানে ভালোবাসা সবথেকে ওপরে। তাই হে ভারতবাসী, আজ আমাদের একজোট হয়ে জাগতে হবে। এই সমস্ত ভন্ড দের মাধ্যমে তাদের লোভ চরিতার্থের কারনে আমাদের এই মহান ধর্মকে আমরা খারাপ হতে, কলুষিত হতে দেবনা। সমস্ত অন্ধ কুসংস্কারকে ধুয়ে ফেলে শুধু ধর্মের মুল সারটুকু তুলে এনে সমগ্র সমাজকে সেই সারের সুধারসে ভাসিয়ে দিতে চাই। তবেই এই সমাজের কল্যান। মানবকল্যানে বোধকরি এর চেয়ে ভালো কাজ আর কিছু হতে পারেনা।
কিন্তু আমরা জানব কিকরে কে ঠিক আর কে ভুল? প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। ভগবানের সর্বচ্চ সৃষ্টি আমরা। অর্থাৎ মানুষ। ভগবান আমাদের মধ্যে এমন একটি জিনিস দিয়েছেন যার থেকে দামি কিছু বোধহয় কিছু হয়ে না। আর তা হোল মানুষের মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে সঠিক ভাবে কাজে লাগিয়েই আমরা পেতে পারি সত্যের সন্ধান। তবে তার জন্যে চাই সত্যের জ্ঞান, সেই জ্ঞান কিভাবে হতে পারে আসুন সরল ভাবে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
আমি পন্ডিত ব্যাক্তি নই। আমি পন্ডিতদের জন্যেও লিখি না। আমি সাধারন, তাই লিখিও সাধারনদের জন্যেই। তাই আমি অনেক সাধারন উদাহরনের মাধ্যম দিয়ে সব ব্যাপার গুলিকে বোঝানোর চেষ্টা করি মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন হল সেই উদাহরন যা আমি দি তা যখন কেই পড়ে, তারকাছে তা গ্রহনযোগ্য মনে হয়, হয়েতো বা হয়েনা, কেন এই বিভেদ। বা কখন তা সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে? কখন হবেনা। সেটাই বা জানি কিকরে? এবারে আমি এই সূত্র ধরেই সরাসরি আলোচনার বিষয়বস্তুর কেন্দ্রে প্রবেশ করছি।
ধরাযাক ১০০ জন মানুষকে একসাথে দাঁড় করিয়ে প্রচন্ড গরমের মধ্যে কনকনে ঠান্ডা একটি করে আইসক্রিম হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করা হল এটি ঠান্ডা না গরম? তারা কি উত্তর দেবে বলে আপনার মনে হয়? যদি সকলেই সুস্থ মস্তিকের মানুষ হয় বা মিথ্যা না বলে তাহলে সকলেই আশা করা যায় যে বলবে “ঠান্ডা”। তাইতো? কিন্তু আবার তাদেরই যদি একে একে জিজ্ঞেস করতে শুরু করা হয় যে তাদের প্রত্যেকে পছন্দের রঙ কি কি, তারা দেখবেন হয়েত প্রত্যেকে কখনই একটি রঙই সবার পছন্দ তা বলবেন না। এর কারন কি? এর কারন অনুভুতি। অর্থাৎ অনুভুতির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে বলা যেতে পারে “অবিসংবাদী সত্য” (Universal Truth) । তাই মানুষ যে দলেরই হোক না কেন, যে দেশেরই হোক না কেন তাদের কাছে এই অনুভুতির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান সর্বদাই একই হবে। পৃথক হবেনা। তাই সূর্য উঠলে দিন হয় আবার অস্ত গেলে রাত হয় ইত্যাদি সারা দুনিয়ার লোক মানবে। কিন্তু লক্ষ করুন এই ধরনের মানার বা “অবিসংবাদী সত্য” এর সংখ্যা কিন্তু অনেকই কম। আর তার কারন হোল অনুভুতির অভাব। আর এই কারনেই মানুষের নানা ধরনের বিচার বুদ্ধির কারনে মানুষের মধ্যে আজ এত দন্ধ এত মারামারি। কিন্তু প্রকৃতির এই অপুর্ব মায়ায় সৃষ্ট এই বিষয়টিকে কেউই হাত করতে পারবে না যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের একই ধরনের চিন্তা হবে। আর তা উচিতও নয়। কারন তাহলে সৃষ্টিই আর হবেনা। কারন ভাবুন সবাই যদি বলে মিষ্টি ভালোবাসিনা তাহলে মিষ্টির দোকান চলবে কিকরে? সবাই যদি বলে রাস্তার খাবার খাবোনা তবে সেই লোকগুলির পেট চলবে কিকরে যারা রাস্তার ধারে খাবার বিক্রয়ের মাধ্যমে সংসার প্রতিপালন করেন? তবে কি দাঁড়াল? দাঁড়াল এই, যে, আমরা অযথা এইসব বিষয়গুলোতে মানুষের একই অনুভুতি বা একই চিন্তার জাগোরনের কথা বলছিনা। আমি বলছি আধ্যাত্মিক অনুভুতির কথা। সেই চেতনার কথা, যা জাগ্রত হলে সবার কাছেই সেই অনুভূতি একই হবে। সবাই একই কথা বলবে যে ঈশ্বর সুন্দর। এই অনুভুতি অপার তৃপ্তিদায়ক এ বিষয় কারর মনেই কোন সন্দেহ থাকবেনা। তাই আমার উদ্দেশ্য কোনভাবে এই অনুভুতির জাগোরন। আর সেই অনুভুতি একবার জাগলে, একবার মায়ের কৃপা পেলে আর কোন দন্ধ থাকেনা। সকল অন্ধকার কেটে যায়। তখন জ্ঞানালোকে মানুষ শুধু সত্যিটাকেই দেখে। আসুন এবার সেই কাজ কিকোরে সম্ভব একটু ভেবে দেখি।
একজন আমার কাছে বেশকয়েকদিন আগে বেশ কিছু বিষয় তর্ক তুলেছিল। সে নিজেকে আমার কাছে খুব গর্বের সাথে পরিচয় দিয়েছিল “আমি নাস্তিক” বলে। তাতে তার খুব গর্ব একথা বুঝেছিলাম। এখন তার কিছু প্রশ্ন ও আমার কিছু উত্তর দিলাম। আবার স্মরন করাই আমি অতি সাধারন, তাই কোন ভারি ভারি তত্ত কথা তাকে আমি বলতে পারিনি। আমি সহজভাবেই তাকে উত্তর দিয়েছিলাম। একখানি প্রশ্ন ও উত্তর আলোচনার প্রয়োজনে এখানে তুলে ধরছিঃ
প্রথম প্রশ্নঃ আমাদের হিন্দুধর্মে শুরু থেকেই স্ববিরোধিতা। কেউ বলে কালী আসল, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব। একেকটি পুরানে একএকজনকে বড় ও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। তবে আসল কে? বড় কে?
আমার উত্তরঃ মনে কর একটি পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট আছে যেখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। এখন সেই বিদ্যুৎ তোমার বাড়িতে একটি মেন পয়েন্ট থেকে এসে বাড়িতে পাখা চালাও, আলো জ্বালাও। এবার বল পাখার কারেন্টটা বড়? নাকি আলোরটা? কোনটা আসল?
সে বলেঃ একই যায়গা থেকে আসছে সবকটি একই হবে। আলাদা আলাদা জিনিস যাযা চলছে তাদের ক্ষমতা অনুযাই আলাদা। কিন্তু বিদ্যুৎ একি আসছে।
আমি বলিঃ এই আমাদের ধর্মের আসল কথা। গোড়ার কথা। ঈশ্বর এক। একটাই শক্তি। একটাই উৎস। কিন্তু তার বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ। কখন আলো জ্বালাতে চাও তো কখন জল গরম করতে চাও। তেমনি কখনো মা কালী রূপে বা শিব রূপে ধ্বংস করেন, কখনো বা বিষ্ণুরূপে পালন করেন। ব্রম্মারূপে সৃষ্টি করেন। ইত্যাদি। কিন্তু উৎস এক। সেই পরব্রম্ম পরমাত্মা।
সে মেনেছিল এই সহজ উত্তরে তার বোঝার সুবিধা হয়েছে। আগে অনেক যায়গায় সে এর উতর খুঁজেছে, পেয়েওছে, কিন্তু বোধগম্য হয়েনি। ঠিক এই কারনেই আমি এই লেখা শুরু করি। আমার একটি ধারনা আছে। কতটা সঠিক জানিনা। তাও বলি। এই তত্ত কথা দিয়ে যেখানে যে বইতে লেখা থাকে সেই বইগুলি যারা পরেন তারাও জ্ঞানি। কিন্তু যারা কিছুই জানেন না তারা এই বইএর লেখা কি বুঝবেন? মায়ের স্বরূপ বর্ননা করতে গিয়ে যে মহান ভাষার ব্যাবহার দেখি চন্ডী ইত্যাদি গ্রন্থে তা কি এই যুগের সাধারন মানুষের বা সেই মহা জ্ঞানালোকের ছোঁয়া না পাওয়া মানুষের সম্পুর্ন রূপে বোধগম্য হওয়া সম্ভব? আমার ধারনায়, এই যুগে এমন গ্রন্থ রচনা করতে হবে, যা ঘরে ঘরে খেটে খাওয়া তত্তজ্ঞানশূন্য মানুষকেও সরল ভাষায় দেখাতে পারে সেই মহাজ্ঞানের পথের আলো। আমাদের মহান ধর্মের সর্বরস সংগ্রহ করে মূল রসটিকে বের করে এনে, সমস্ত দন্ধকে ছেঁটে ফেলে রচনা করতে হবে এমন এক গ্রন্থ যা পড়লে মানুষের মনে কালী কৃষ্ণের ভেদভাব চলে গিয়ে চারিদিকে দেখবে একটাই আলো আর যে আলোর থেকে একি সাথে একি শরীরে বেড়িয়ে এসে সামনে দাঁড়াবেন কালী ও কৃষ্ণ। তখন এই প্রতিভাত হবে যে এরা পৃথক সত্তা নন। এরা এক। এবং নিজেও এদের থেকে পৃথক নন। নিযেও এঁরই অংশ। এই বৈদান্তিক সত্যকে সরল ভাষায় পৌঁছবার দায়িত্ব আমি পেয়েছি তাঁরই নির্দেশে। তাঁরই আদেশে। সেই মহান পরমেশ্বর এই কাজে আমাকে এগিয়ে নিয়ে যান তাঁর পরম কৃপায় এই কামনা তাঁর শ্রী চরনে। আর কিছু চাই না। এই কার্যের মাধ্যমে সমাজের কল্যান করে এ জীবনকে সার্থক করতে চাই। যাতে তাঁর সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বলতে পারি। “ওগো প্রিয়, আমি তোমার সৃষ্টির মান রেখেছি গো। এস, আমায় তোমার চরণে আশ্রয় দাও”।
Share:

হিন্দু দেবতাদের মাঝে অন্যতম জগন্নাথ দেব; ইনি ভগবান শ্রী কৃষ্ণের একটি বিশেষ রূপ


জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে দুটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। প্রথম কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যন্মুর সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।

দ্বিতীয় কাহিনিটির অবতারণা করা হয়েছিল পূর্বোল্লিখিত উপখ্যানটির ব্যাখ্যা ও সংশয় নিরসনের উদ্দেশ্যে। বৃন্দাবনে গোপীরা একদিন কৃষ্ণের লীলা ও তাঁদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা আলোচনা করছিলেন। কৃষ্ণ গোপনে সেই সকল কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা নিয়োগ করা হয়েছিল গোপীরা যখন কৃষ্ণের কথা আলোচনা করেন তখন কৃষ্ণ যেন তাঁদের নিকটবর্তী না হতে পারে সেদিকে নজর রাখার জন্য। কিন্তু গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতি দেখে পরিতুষ্ট সুভদ্রা তাঁদেরই কথা শুনতে শুনতে বিমোহিত হয়ে গেলেন। দেখতে পেলেন না যে তাঁদের দুই দাদা কৃষ্ণ ও বলরাম এগিয়ে আসছেন। শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ের কেশ খাড়া হয়ে উঠল, হাত গুটিয়ে এল, চোখদুটি বড় বড় হয়ে গেল এবং মুখে আনন্দের উচ্চ হাসির রেখা ফুটে উঠল। এই কারণেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এইপ্রকার রূপ।বৈষ্ণবেরা কৃষ্ণের এই বিমূর্ত রূপটিকে পূজা করেন।
জগন্নাথ মন্দির

পুরীর জগন্নাথ মন্দির ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ মন্দির। জগন্নাথ-আরাধনার ইতিবৃত্ত এতই প্রাচীন যে এর কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড পাওয়া সম্ভব নয়। জগন্নাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরটি শ্রীমন্দির নামে সমধিক পরিচিত। গর্ভগৃহের মাথায় রয়েছে একটি সুউচ্চ শিখর বা চূড়া। প্রদীপ উৎসর্গের জন্য রয়েছে ফসিল হয়ে যাওয়া কাঠের একটি স্তম্ভ। মন্দিরের প্রধান দ্বার সিংহদ্বারের রক্ষক দেবতা জয়া ও বিজয়া। মূল প্রবেশপথের সামনে রয়েছে অরুণস্তম্ভ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। খুরদার রাজা কোনার্কের সূর্যমন্দির থেকে এটি নিয়ে আসেন।

তিন দেবতাকে সাধারণত মন্দিরের অভ্যন্তরেই পূজা করা হয়। তবে প্রতি বছর আষাঢ় মাসে তাঁদের রাজপথে বের করে রথারূহ করে তিন কিলোমিটার দূরে মাসি মা’র মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় ভক্তরা দেবতাকে গণদর্শনের সুযোগ পান। এই বিরাট বিরাট রথগুলি প্রতি বছর কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হয়। এই সুদীর্ঘ রথগুলিই ইংরেজি শব্দ ‘juggernaut’। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের প্রতীকী রূপে পালিত হয়ে থাকে এই রথযাত্রা উৎসব। রথযাত্রার সময় সারা পৃথিবী থেকে এখানে ভক্ত সমাগম হয়। পুরীর রাজা রথের সম্মুখে রাস্তা ঝাঁট দেন।

রথযাত্রাবা রথদ্বিতীয়া- একটি আষাঢ় মাসে আয়োজিত অন্যতম প্রধান হিন্দু ধর্মীয় উৎসব।দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর ভগবান কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে।

কথিত আছে সূর্য গ্রহনের সময় তীর্থস্থান দর্শন করার ধর্মীয় নির্দেশ আছে,সেসময়ে হিন্দুধর্মালম্বীরা সূর্য গ্রহনের সময় কুরুক্ষেত্র দর্শনে যান।বৃন্দাবন থেকে আগত ভক্তবৃন্দ জানতে পারেন তাদের পরম প্রিয় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ ভক্তসাধারণের সাথে দেখা করতে জনসন্মুখে এসেছেন,সেই খবর জানা মাত্র ভক্তবৃন্দ ভগবানের দর্শন পেতে ছুটে যান।সেখানে গিয়ে তারা ভগবানের রাজবসন দেখতে পেয়ে শ্রী কৃষ্ণের কাছে আবদার করে বসেন তারা তাদের পরম প্রিয় ভগবানকে পুর্বের বেশে দেখতে চান এবং শ্রী কৃষ্ণকে রথে চড়িয়ে বৃন্দাবন নিয়ে যেতে চান।কিন্তু শ্রী কৃষ্ণ যাবেন সেখানে কি ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রা ছাড়া যাওয়া যায়? তাই ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে আলাদা রথে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো।এই জন্য তিনটি রথ টানা হয়।
উৎসব

রথযাত্রার দিন পুরীর জগন্নাথ মন্দির সহ ভারতের ও বিশ্বের সকল জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রা ও সুদর্শন চক্র মূর্তি মন্দির বাহিরে সর্বসমক্ষে বাহির করা হয়। তারপর তিনটি সুসজ্জিত রথে (কোনো কোনো স্থলে একটি সুসজ্জিত সুবৃহৎ রথে) বসিয়ে দেবতাদের পূজা সম্পন্নপূর্বক রথ টানা হয়।

পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পূণ্যার্থীর সমাগম হয়। এখানে তিন দেবতাকে গুগিচা মন্দিরে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। পুরীতে বছরে এই একদিনই অহিন্দু ও বিদেশীদের মন্দির চত্বরে এসে দেবদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। পুরীতে যে রথগুলি নির্মিত হয় তাদের উচ্চতা ৪৫ ফুট। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলে এই রথযাত্রা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

ইসকনের ব্যাপক প্রচারনা ও আন্দোলনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই রথযাত্রা পালিত হয়।বাংলাদেশের ধামরাইয়ের রথযাত্রা বেশ পুরনো ও প্রসিদ্ধ।বর্তমানে ইসকনের প্রচারনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় এ রথযাত্রা পালিত হয়।

– দেবাশিষ ভট্টাচার্য্য (সংগ্রাহক)
Share:

স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত সেবাযোগের ভিত্তি – তাপস ঘোষ, কলকাতা।



প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদ দেখা যায় , তা হল – প্রাচ্যবাসীরা অন্তর্জগতের অনুসন্ধানে তাঁদের অধিকাংশ শক্তি ব্যয় করেছেন । প্রাচীন ভারতবর্ষ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রভুত উন্নতি সাধন করা সত্ত্বেও সেগুলোকে ‘ অপরা বিদ্যা ‘ বলে চিহ্নিত করে ‘ পরা বিদ্যা ‘ অর্থাৎ অন্তর্জগতের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছিল ।

অন্তর্জগত-সন্ধানী ঋষিরা ক্রমশঃ এই দৃশ্যমান জগতের অবাস্তবতা অনুধাবন করলেন । এই দৃশ্যমান জগৎ পরিবর্তনশীল , আর যা পরিবর্তনশীল তা নিত্য বা পরম ( absolute ) হতে পারেনা । বিষয়টি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের relativity তত্ত্বের সাথে তুলনীয় । জগতের ঘটনাগুলি নির্দিষ্ট frame of reference এর সাপেক্ষেই সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে । frame of reference বদলে গেলেই তা অন্যভাবে প্রতিভাত হবে । আমাদের ঋষিগণ খুঁজতে চেয়েছেন এই পরিবর্তনশীল অনিত্যতার পিছনে কি সেই নিত্যবস্তু , যাকে পরম সত্য (absolute truth) বলে নির্দেশ করা যাবে ? এই সন্ধানই ভারতে অধ্যাত্মবিদ্যার জন্ম দিয়েছে ।

অপরপক্ষে পাশ্চাত্য দেশের মানুষ জড়জগতের রহস্যভেদ করতে গিয়ে জড়বিজ্ঞানে ক্রমশঃ পারদর্শী হয়ে উঠেছে । পাশ্চাত্য সভ্যতা তাই বহির্মুখী এবং প্রাচ্য তথা ভারতীয় সভ্যতা অন্তর্মুখী । ভারতের বেদান্তবাদী ঋষিরা এই ভ্রমাত্মক দৃশ্যমান জড়জগৎকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দৃশ্যমান জড়জগতের কারণ স্বরূপ যে absolute সত্ত্বার সন্ধান পেয়েছেন, তাকে তাঁরা ‘ সদ্ – চিৎ – আনন্দ ‘ – এই নামে অভিহিত করলেন । ‘ সদ্ ‘ , অর্থাৎ সত্য স্বরূপ বা নিত্য , ‘ চিৎ’, অর্থাৎ চৈতন্য বা জ্ঞানস্বরূপ এবং ‘আনন্দ’, অর্থাৎ প্রেমস্বরূপ । এই ‘ সদ্ – চিৎ – আনন্দ ‘ কে ‘ব্রহ্ম’ নামেও অভিহিত করা হয় । ‘ব্রহ্ম’ই পরম ( absolute ) , ‘ব্রহ্ম’ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আর কোনকিছুরই অস্তিত্ব নেই । ব্রহ্মের যেটুকুতে ‘সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়’ নামক এই পরিবর্তনশীল জগতের ভ্রম সাধিত হচ্ছে , বেদান্ত তাকেই নির্দেশ করল – ‘ঈশ্বর’ বা ‘ভগবান’ নামে । ঈশ্বর হলেন এই পরিবর্তনশীল জগৎ চক্রের কেন্দ্র স্বরূপ , আবার তিনিই পরিবর্তনশীল জগৎ রূপে নিজেকে অভিব্যক্ত করছেন । সুতরাং দেখা গেল – ভ্রমাত্মক দৃষ্টিতে যা বহুত্বময় জগৎ , জ্ঞানদৃষ্টিতে তাই ঈশ্বর ।

জগৎকে এই ভ্রমাত্মক দৃষ্টিতে দেখার ফলে আমরা নিজেদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছি । ” আমার থেকে অমুক আলাদা ” -এটা ভ্রমাত্মক দৃষ্টির উপলব্ধি । জ্ঞানদৃষ্টিতে আমরা সকলেই একই পরমসত্তা – ঈশ্বরের প্রকাশ ।

এখানথেকেই স্বামী বিবেকানন্দের practical বেদান্তের ধারণার উদ্ভব । তত্ত্বগত ভাবে বেদান্ত ঘোষণা করে – ” সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম ” – সবই সেই ব্রহ্মের প্রকাশ, কিন্তু ব্যবহারিক স্তরে তার প্রকাশ এযাবত তেমন ভাবে দেখা যায়নি । স্বামীজী তাই প্রবর্তন করলেন ‘সেবা যোগ ‘ । ” ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু , সর্বভুতে সেই প্রেমময় ; মন – প্রাণ – শরীর অর্পণ কর সখে এ সবার পায় । / বহুরূপে সম্মুখে তোমার , ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ! / জীবে প্রেম করে যেই জন – সেই জন সেবিছে ঈশ্বর । /

আমাদের শরীরগত আমিত্ববুদ্ধি থেকে আমরা যে সব কাজ করি , তাকে বলে ‘ প্রবৃত্তি মূলক কাজ ‘ , যা আমাদের ভ্রমাত্মক উপলব্ধিকে আরও দৃঢ় করে । অপরপক্ষে সর্বভূতস্থিতঈশ্বরের সেবার জন্যে আমরা যে কর্ম করি , তা ‘নিবৃত্তি মূলক কর্ম’ । এই কর্ম আমাদের দেহগত আমিত্বকে ক্ষয় করে । জগতের মূল কারণ স্বরূপ একমেবাদ্বয়ম ব্রহ্মের পুজাই হল এই অভেদবুদ্ধিতে সেবা-রূপ কর্ম । এই কর্ম । এই কর্ম আমাদের স্বার্থপর , ভ্রমাত্মক আমিত্বের নাশ করে । আর এই ভ্রমদৃষ্টি তিরোহিত হলেই আমরা মুক্ত হয়ে যাই জন্ম-মরণ কুহেলিকার বন্ধন থেকে । সত্যদৃষ্টি উন্মোচনের মাধ্যমে অনন্ত স্ব- স্বরূপে ।
Share:

সকল হিন্দুর বেদে সম অধিকার লেখক — সম্পদ দাশ ( অগ্নি সম্পদ ) , বাংলাদেশ





বেদ আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ , আমাদের কারও কারও মধ্যে একটি ধারণা আছে যে বেদে ব্রাহ্মন ছাড়া আর কারও অধিকার নাই ।এটা পুরোটাই ভুল , কারন যর্জুবেদে বলা হয়েছে –

‘ ওঁ যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানি জনেভ্যঃ ।বহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায়।।প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ,ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু ।। ‘ — যজুর্বেদ ২৬/২

অনুবাদ :হে মনুষ্যগনআমি যেরূপে ব্রাক্ষণ ,ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র , স্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সমস্ত জনগনকে এইকল্যানদায়িনী পবিত্র বেদবানী বলিতেছি ,তোমরাও সেই রূপ কর । যেমন বেদবানীর উপদেশকরিয়া আমি বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি ,তোমরাওসেরুপ হও ।আমার ইচ্ছা বেদ বিদ্যা প্রচার হোক ।এর দ্বারা সকলে মোক্ষ এবং সুখ লাভ করুক ।

এখানে দেখা যাচ্ছে বেদের সত্যদ্রষ্টা ঋষি বলছেনব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র স্ত্রীলোকএবং অন্যান্য সকল জনগনের জন্যই এই পবিত্র বেদবানী ।সুতরাং বেদ মন্ত্র উচ্চারণে সকলেরইসমান অধিকার । সব থেকে মজার বিষয় হল বেদের মন্ত্রদ্রষ্ট্রা ঋষিদের মধ্যে মহিলা ঋষিও রয়েছেন যেমন

১/ ১ম মন্ডল১৭৯সূক্তেরদেবতা রতি ,ঋষি অগস্ত্যের পত্নী লোপামুদ্রা ।

২/ ৫মন্ডল ২৮সুক্তেরদেবতা অগ্নী ,ঋষি অত্রিকন্যা বিশ্ববারা ।

৩/ ৮মন্ডল ৯৬ সুক্তেরদেবতা ইন্দ্র ,ঋষি অত্রি কন্যা অপালা ।

৪/ ১০মন্ডল ৩৯ ও ৪০ সুক্তেরদেবতা অশ্বিদয় ,ঋষি কক্ষিবত্ কন্য ঘোষা ।

৫/ ১০মন্ডল ৮৫সুক্ত যা বিবাহ সূক্ত বলে খ্যাততার ঋষি সাবিত্রি সূর্যা ।

৬/ ১০মন্ডল ১২৫সুক্তেরদেবতা আত্মা ,ঋষি অশ্ভৃণ কন্যা বাকৃ

৭/ ১০মন্ডল ১৮৫ সুক্তেরদেবতা সপত্নীবাধন ,ঋষি ইন্দ্রানী ।

আমরা উপরে পেলাম সাত জনমহিলা ঋষি যথাক্রমে :লোপামুদ্রা ,বিশ্ববারা ,অপালা ,ঘোষা ,সূর্যা ,বাকৃএবং ইন্দ্রানী ।আমাদের একটা প্রচলিতকথা আছে যে বেদে মেয়েদেরও অধিকার নেই ।এটা আসলে ঠিক নয় ,কারণ দেখা যাচ্ছে – বেদের মন্ত্রদ্রষ্ট্রা ঋষিদের মধ্যে নারীরাও রয়েছেন ।যাঁদের অধিকারই নাই তারা ঋষি এবং মন্ত্রদ্রষ্ট্রা হন কেমন করে ?আসলে এগুলো অসাধু মহলের কারসাজি । এসব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে ।

তাহলে উপরক্ত প্রমান অনুসারে আমরা অবশ্যইবলতে পারি বেদে সকলেরই সমান অধিকার ।
Share:

আধুনিক বিজ্ঞান ও সনাতন হিন্দু ধর্ম – তাপস ঘোষ, কলকাতা।


সনাতনধর্মের ( প্রকৃত হিন্দু ধর্মের ) প্রাচীন মুনি ঋষি গণ এবং তাঁদের উত্তরসূরি হিন্দু সাধক গণ তাঁদের সাধনার মধ্যে দিয়ে বহুত্বময় এই জগতের কারণ স্বরূপ এক , অখণ্ড , অনন্ত চৈতন্যকে ( consciousness ) উপলব্ধি করেছেন । এই চিৎ সত্তা বা চৈতন্যকেই তাঁরা জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ রূপে চিহ্নিত করেছেন । জগতের ভিত্তি স্বরূপ এই অখণ্ড অনন্ত চৈতন্যকেই ঈশ্বর বলা হয় ।


বেদের উপমা অনুযায়ী বলা যায় , মাকড়সা নিজদেহ থেকে জাল উৎপন্ন করে স্বয়ং সেই জালে অবস্থান করে । এখানে জালের উপাদান হল মাকড়সার দেহ , কাজেই মাকড়সাই জালের উপাদান কারণ । আবার মাকড়সা নিজেই জাল তৈরী করেছে তাই জালের নিমিত্ত-কারণও ( কর্মের কর্তা ) মাকড়সা । ঠিক তেমনই চৈতন্য স্বরূপ ঈশ্বর এই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ দুইই ।
হিন্দু দর্শন ঈশ্বরের বিশেষণ হিসাবে ‘ সচ্চিদানন্দ ‘ শব্দটি প্রয়োগ করে । সচ্চিদানন্দ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে আমরা সৎ ( শাশ্বত বা সনাতন ) , চিৎ ( চেতনা বা জ্ঞানময়তা ) এবং আনন্দ ( প্রেমময়তা ) এই শব্দ গুলি পাই । এই শাশ্বত চৈতন্যময় সত্তাই জগৎ কারণ ঈশ্বর ।জগতের সবকিছুর মুল উপাদান হওয়ায় তিনি আমাদের সকলের আত্মস্বরূপ বা ‘ আত্মা ‘ ( self ) । হিন্দু শাস্ত্রে এই চৈতন্যময় সত্তাকে ‘ আত্মা ‘ নামেও অভিহিত করা হয় । এই আত্মাই জগত রূপে প্রতিভাত হচ্ছেন ।
শ্রী ভগবান গীতায় শিক্ষা দিচ্ছেন , ” সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্ ।/ বিনশ্বৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।। / সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ । / ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ।। / ” ( গীতা – ১৩ /২৮-২৯ )
অর্থাৎ, বিনাশশীল সর্বভূতে অবিনাশী ঈশ্বরকে যিনি সমভাবে দেখেন তিনিই যথার্থ দর্শন করেন ; কারণ সর্বত্র সমভাবে সেই ঈশ্বর অবস্থিত দেখে সেই সমদর্শী আর কাউকে হিংসা করতে পারেননা । সেইজন্য তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন ।
আমাদের উপনিষদে এই জাগতিক সবকিছুর স্বরূপ হিসাবে সেই অনন্ত চৈতন্যময় ঈশ্বরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে । ” ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী । / ত্বং জীর্ণো দন্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি – বিশ্বতোমুখঃ ।। / ( শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৩) অর্থাৎ তুমি স্ত্রী , তুমি পুরুষ , তুমি কুমার , তুমি কুমারী , তুমি বৃদ্ধ – দণ্ডহস্তে ভ্রমণ করছ , তুমি জাত হয়ে নানা রূপ ধারণ করেছ ।
সুতরাং দেখাযাচ্ছে হিন্দুধর্ম তত্ত্ব অনুযায়ী এই বহুত্ব পূর্ণ জগতের পিছনে একত্ব রয়েছে । এবং জগতের ভিত্তি স্বরূপ সেই একত্ব হল অখণ্ড চৈতন্য বা ঈশ্বর ।
আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান quantum potential ভিত্তিক holistic approach দ্বারা জগতের এই একত্বের দিকে , এই স্বরূপতঃ অখণ্ডতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে । বিজ্ঞানী ডেভিড বোহম্ , বিজ্ঞানী বেসিল হিলি প্রমুখ বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীর গবেষণা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । বিজ্ঞানী বোহম্ পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন Bell’s Theorem কে , যা জগতের এক ও অখণ্ড সত্তার কথা বলে । এই তত্ত্ব অনুসারে বিশ্বের সবকিছু যুক্ত আছে unbroken wholeness এর সঙ্গে ।
আমাদের বেদান্ত দর্শনে জগতের কারণ স্বরূপ নিত্যমুক্ত অখণ্ড চৈতন্যের কথা বলা হয় । আধুনিক বিজ্ঞানীগণ নিত্যমুক্ত অখণ্ড চৈতন্য ( consciousness )কে মূল হিসাবে ধরে জীবের individual চৈতন্যের ব্যাখ্যা করতে চাইছেন । বিজ্ঞানের এই নতুন পদক্ষেপকে বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অমিত গোস্বামী চিহ্নিত করেছেন ‘ monistic ontological approach ‘ নামে । এই monistic ontological approach আসলে চৈতন্যের বিজ্ঞান ( science within consciousness ) যা অধ্যাত্ম সাধকের তুরীয় অনুভূতির সমর্থক ।
হাজার হাজার বছর আগে ভারতীয় ঋষি গণ তাঁদের অধ্যাত্ম গবেষণার ফলাফল রেখে গেছেন বেদ নামক পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থে । বেদান্ত বা উপনিষদ হল এই বেদেরই সারভাগ বা নির্যাস । এই যুক্তি ও প্রত্যক্ষ অনুভূতি নির্ভর অধ্যাত্মতত্ত্বের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সনাতন হিন্দু ধর্ম । বর্তমান জড় বিজ্ঞানও ভিন্ন পথে এগিয়ে চলেছে একই সত্যের দিকে । বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি এখনও শেষ হয়নি । হয়তো এমন দিন আসতে চলেছে যেদিন জড় বিজ্ঞানীরা তাঁদের ভাষায় তাঁদের মতো করে ঘোষণা করবেন , ” শৃন্বতু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ । / আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূঃ ।। / বেদাহমেতাং পুরুষং মহান্তম্/ আদিত্য বর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ । / তমেব বিদিত্বাহতিমৃত্যুমেতি / নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহনায় ।। / ” {শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (২/৫ ও ৩/৮ ) }
— ” হে দিব্যধামবাসী অমৃতের সন্তানগণ তোমরা শ্রবণ কর , আমি পথ খুঁজে পেয়েছি । যিনি সকল অন্ধকারের পারে , তাকে জানলেই মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায় । 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।