• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

৩০ জুন ২০১৫

দেবী চণ্ডী

চণ্ডী পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় লৌকিক দেবী। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য একাধিক চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়। এর ফলে লৌকিক চণ্ডী দেবী মূলধারার হিন্দুধর্মে স্থান করে নেন। মঙ্গলকাব্য ধারার চণ্ডী দেবী কালীর সমতুল্য। তিনি শিবের স্ত্রী, গণেশ ও কার্তিকের জননী। দেবীর এই সত্ত্বাদুটি পার্বতী বা দুর্গার সমতুল্য। চণ্ডীর ধারণাটি নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। তাই চণ্ডীর পূজাও বিভিন্ন প্রকার।
চণ্ডী সৌভাগ্যের দেবী। সুখসমৃদ্ধি, সন্তান, বিজয় ইত্যাদি কামনায় তাঁর মঙ্গলচণ্ডী, সঙ্কটমঙ্গলচণ্ডী, রণচণ্ডী ইত্যাদি মূর্তিগুলি পূজা করা হয়। ওলাচণ্ডীর পূজা হয় মহামারী ও গবাদিপশুর রোগ নিবারণের উদ্দেশ্যে।
পশ্চিমবঙ্গের বহু গ্রামের নামের সঙ্গে দেবী চণ্ডীর নাম যুক্ত। মঙ্গলচণ্ডীর পূজা সমগ্র রাজ্যে এমনকি অসমেও প্রচলিত। এই দেবীর উৎস প্রাচীন বঙ্গদেশের শাক্ত সম্প্রদায়ের তন্ত্র সাধনায়।
প্রাচীন সংস্কৃত রচনায় চণ্ডী কথাটির অনুপস্থিতির কারণ হল এই দেবী হিন্দুধর্মের অব্রাহ্মণ্য শাখার দেবতা। ইনি প্রকৃতপক্ষে বঙ্গদেশের অনার্য আদিবাসী সমাজের দেবী। এই দেবী ছিলেন মহাশক্তি। তিনি ত্রিনয়না, তাঁর কপালে অর্ধচন্দ্র শোভিত। দেবীর বহু হাতে বহু প্রকার অস্ত্র, গাত্রে বহুমূল্য অলংকার ও মালা। সকলই দেবগণ দেবীকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর সোনার অঙ্গ সহস্র সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল। এইরূপে সিংহবাহিনী দেবী চণ্ডী হয়ে উঠলেন বিশ্বশক্তির মূর্তিস্বরূপ।
অন্য একটি কাহিনি অনুযায়ী, চণ্ডী রক্তবীজ দৈত্যবধে দেবী কালীকে সহায়তা করেন। রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়লে সহস্র সহস্র রক্তবীজ অসুরের সৃষ্টি হত। কালী রক্তবীজের রক্ত পান করেন। এই সময় ভূপতিত রক্ত থেকে সৃষ্ট অসুরদের ধ্বংস করেন চণ্ডী এবং শেষে তিনিই রক্তবীজকে বধ করেন। স্কন্দ পুরাণেও এই কাহিনিটি রয়েছে। এই পুরাণে আরও বলা হয়েছে যে দেবী চণ্ডিকা চণ্ড ও মুণ্ড অসুরদ্বয়কে বধ করেন।
চণ্ডী বা চণ্ডিকা দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের সর্বোচ্চ দেবী। তিনি দুর্গা সপ্তশতী নামেও পরিচিত। মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী দেবীর সমন্বয়ে চণ্ডীকে উক্ত গ্রন্থে সর্বোচ্চ সত্ত্বা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থের অন্তভাগে মূর্তিরহস্য অংশে তাঁকে অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী নামে অভিহিত করা হয়েছে।
চণ্ডরূপ ধারণ করে দেবশত্রুদের বধ করেন বলে তার নাম হয় চণ্ডী। চণ্ডীই যখন ভক্তের দুর্গতি বিনাশ করেন তখন তাকে বলা হয় দুর্গা। দুর্গারূপে তিনি মহিষাসুরকে বধ করেন। বহু নামে ও রূপে চণ্ডী পূজিত হন, যেমন : দেবীচণ্ডী, মঙ্গলচণ্ডী, জয়চণ্ডী, ওলাইচণ্ডী, কুলুইচণ্ডী, চেলাইচণ্ডী প্রভৃতি। জয়চণ্ডীরূপে তিনি দ্বিভুজা, ত্রিনয়না, গৌরবর্ণা, বরাভয়াহস্তা এবং পদ্মোপরি দণ্ডায়মানা। মার্কণ্ডেয়পুরাণে চণ্ডী নামে একটি অধ্যায় আছে যার শ্লোকসংখ্যা সাতশ। এখানে দেবীচণ্ডীর বিচিত্র রূপ ও মাহাত্দ্য বর্ণিত হয়েছে।
দেবীপূজা, বিশেষত দুর্গাপূজা উপলক্ষে কিংবা গৃহস্থের কল্যাণ কামনায় এক বা একাধিকবার চণ্ডীপাঠের নিয়ম আছে।
মঙ্গলচণ্ডী
======
* সকল বিশ্বের মূল স্বরূপা প্রকৃতি দেবীর মুখ হইতে মঙ্গলচণ্ডী দেবী উৎপন্না হইয়াছেন। তিনি সৃষ্টিকার্য্যে মঙ্গলরূপা এবং সংহারকার্য্যে কোপরূপিণী, এইজন্য পণ্ডিতগণ তাঁহাকে মঙ্গলচণ্ডী বলিয়া অভিহিত করেন। ---- দেবীভা-৯স্ক-১।
* দক্ষ অর্থে চণ্ডী এবং কল্যাণ অর্থে মঙ্গল। মঙ্গলকর বস্তুর মধ্যে দক্ষা বলিয়া তিনি মঙ্গলচণ্ডী নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। প্রতি মঙ্গলবারে তাঁহার পূজা বিধেয়। মনু বংশীয় মঙ্গল রাজা নিরন্তর তাঁহার পূজা করিতেন। ----- দেবীভা-৯স্ক-৪৭।
-
সকলের মঙ্গল কামনা করে পরিশেষে বলি ----
'রক্ষ রক্ষ জগন্মাতর্দেবি মঙ্গলচণ্ডিকে।
হরিকে বিপদাং রাশে হর্ষমঙ্গলকারিকে।।
হর্ষমঙ্গলদক্ষে চ হর্ষমঙ্গলদায়িকে।
শুভে মঙ্গলদক্ষে চ শুভে মঙ্গলচণ্ডিকে।
মঙ্গলে মঙ্গলার্হে চ সর্বমঙ্গলমঙ্গলে।
সদা মঙ্গলদে দেবী সর্বেষাং মঙ্গলালয়ে।।'

লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ

Share:

কামাখ্যার ইতিহাস

মহাভারত এবং রামায়ণে এই অঞ্চলকে প্রাগজ্যোতিষ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। ইরিত্রিয় সাগরের পেরিপ্লাস (প্রথম শতাব্দী) এবং টলেমির জিওগ্রাফিয়াতে (দ্বিতীয় শতাব্দী) এই অঞ্চলকে কিরহাদিয়া নামে আখ্যায়িত করেছে যা কিরাত জনগণের নামে নামাঙ্করণ করা হয়েছে। কামরূপের প্রথম মহাকাব্যিক উল্লেখ পাওয়া যায় ৪র্থ শতাব্দীর সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদের প্রশস্তিতে, যা এক ঐতিহাসিক সময়কালের সুচনাপাতের নির্দেশক। চৈনিক পর্যটক সুয়ানচাং ৭ম শতাব্দীর দিকে ভাস্করবর্মণের শাসনকালে এই রাজ্য ভ্রমণ করেন। কামরূপের রাজাদের বিশেষ করে ভাস্করবর্মণের বিভিন্ন অভিলিখন থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়। কালিকা পুরাণ এবং চৈনিক পর্যচক সুয়ানচাং-এর মতে কামরূপের পশ্চিম সীমানায় ঐতিহাসিক করোতয়া নদী এবং পূর্ব সীমায় তামেশ্বরী দেবীর মন্দির যা ছিল আসাম রাজ্যের সর্বপূর্বে অবস্থিত বর্তমান সাদিয়ার নিকট। দক্ষিণ সীমানা ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলার মধ্যবর্তী এলাকায়। ফলে এটি সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নিয়ে গঠিত ছিল এবং সময়ে সময়ে বর্তমান সময়ের ভুটান এবং বাংলাদেশের কিছু অংশও এর অধীন ছিল। এর প্রমাণ এই অঞ্চলে প্রাপ্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলাদি থেকে পাওয়া যায়। রাজ্যটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে সম্পুর্নরূপে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হয় এবং এগুলোর মধ্য হতেই এই রাজ্যের উত্তরসুরী হিসেবে পশ্চিমে কামাতা রাজ্য এবং পূর্বে অহোম রাজ্যের উথ্থান ঘটে।




১৫৮১ সালে কামাতা রাজ্যের তদানীন্তন শাসক কোচ রাজা নারায়ণ রায় তাঁর রাজ্যকে দুই ভাগ করেন এবং শঙ্কোশ নদীর পশ্চিম অংশ নিজে রেখে পূর্ব অংশ তার ভাইয়ের ছেলে চিলারায়কে উপঢৌকন দেন। বর্তমান আসাম-পশ্চিমবঙ্গ সীমানার মধ্যে এই বিভাজনের গভীর ছাপ লক্ষ করা যায়। নারায়ণের শাসনামলের পর ১৬০২ থেকে পরবর্তীতে পূর্বকোচ রাজ্য বারংবার মুঘলদের আক্রমণের স্বীকার হয় এবং ১৬১৫ সালে এটি মুঘল এবং অহমদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় যা কিনা সপ্তাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলতে থাকে যখন অহোমরা মুঘলদের শেষবারের মতো পিছু হটতে বাধ্য করে। রাজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অহোমদের হাতে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের আগমনের আগে পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে।




পৌরানিক কাহিনী বলে ---
-
সৃষ্টির একবারে আদি মুহূর্তে সৃষ্টি কর্তারা যখন জগত তৈরির কাজে ব্যস্ত হলেন। পাগল শিব তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। ধ্বংসের দেবতা যদি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নেন তাহলে সৃষ্টি হবে কি করে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু পরলেন মহা ফাঁপরে। বিষ্ণুর বুদ্ধিতে ব্রহ্মা নিজের মানসপুত্র দক্ষকে ডেকে পাঠালেন। দক্ষ এলেন ব্রহ্মার কাছে।
-
ব্রহ্মা তাঁকে বললেন-
-তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
-
দক্ষ পিতৃ আজ্ঞা পালনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন-
-বলুন পিতা আমাকে কি করতে হবে।
-
ব্রহ্মা তখন বললেন-
-দেখো দেবাদিদেব মহাদেব মহাযোগে তন্ময় হয়ে আছেন। এইরকম ভাবে চললে সৃষ্টির ব্যাঘাত ঘটবে। ধ্বংস না হলে সৃষ্টি করবো কি করে ? তুমি জগন্মাতার পূজা করো। প্রার্থনা করো তিনি যেন তোমার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে শিবের পত্নী হন।
-
পিতৃ আজ্ঞা পালনে দক্ষ তৎপর হয়ে উঠলেন। এবং নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। দেবী মহামায়া দক্ষের আকুল প্রার্থনায় প্রীত হয়ে আবির্ভূতা হয়ে দক্ষকে এই বর দিলেন যে - "আমি তোমার কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করবো এবং শিবকে স্বামীরূপে গ্রহণ করবো। কিন্তু একটা কথা তোমায় মনে রাখতে হবে, যখনই আমার অনাদার হবে আমি দেহত্যাগ করবো।" দক্ষ দেবী মহমায়ার কথা মেনে নিলেন। যথা সময়ে মহামায়া দক্ষরাজার পত্নী বীরিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন এবং মহাদেবকে বিবাহ করলেন। মহামায়া সতী নাম নিয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে এলেন শ্বশুর বাড়ি কৈলাসে।




কিছুদিন পর স্বর্গরাজ্যে একটা অনুষ্ঠানে দক্ষরাজ নিমন্ত্রিত হয়ে এলেন। দেবসভা মাঝে পাগল শিব শ্বশুর দক্ষকে পাত্তাই দিলেন না। জামাই-এর এরকম অভব্য ব্যবহারে দক্ষ বেশ অপমানিত বোধ করলেন। শিবকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য দক্ষরাজ এক শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করলেন। তাতে দেবর্যি নারদকে ত্রিভুবনের সকলকে আমন্ত্রণের কথা বললেও শিবকে আমন্ত্রণ জানাতে নিষেধ করলেন। যথা সময়ে দক্ষরাজের যজ্ঞ শুরু হলো। নারদের মুখে সতী পিত্রালয়ে যজ্ঞ হচ্ছে শুনে, সেখানে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হলেন। স্বামীর অনুমতি নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে এলে শিব পাত্তাই দিলেন না। শেষে সতী দশমহাবিদ্যা রূপ দর্শন করালেন। তখন শিব সতীকে পিত্রালয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিলেন। এরপর সতীদেবী পারিষদদের নিয়ে যজ্ঞ স্থলে উপস্থিত হলেন। কিন্তু পিতা দক্ষ সতীকে দেখে গালমন্দ শুরু করলেন। কেন সে নিমন্ত্রিত না হয়েও এখানে এসেছে। শিবের প্রতিও অপমানসূচক মন্তব্য করলেন। 

অতো লোকের মাঝে পতিনিন্দা শুনে সতীর মুখ চোখ লাল হয়ে গেল। যজ্ঞস্থলেই সতী দেহত্যাগ করলেন। শিব তার দুই চেলা নন্দী- ভিরিঙ্গির মুখে সতীর দেহত্যাগের কথা শুনে রেগে লাল হয়ে গেলেন। বীরভদ্রাদি অনুচরদের নিয়ে শিব দক্ষের যজ্ঞশালায় উপস্থিত হলেন। সতীর মৃতদেহ দেখে শিব আর স্থির থাকতে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গে অনুচরদের বললেন যজ্ঞ লণ্ড-ভণ্ড করে দাও আর দক্ষকে হত্যা করো। শিবের আজ্ঞা পেয়ে অনুচরেরা সব লণ্ড-ভণ্ড করে দিল ও ধড় থেকে দক্ষের মথা আলাদা করে দিল। দক্ষরাজের স্ত্রী, শিবের শ্বাশুড়ী, জামাই-এর কান্ডে হতবাক। স্বামীর মৃত্যুতে শোকাতুর হয়ে উঠলেন। তিনি শিবের কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা করে স্তব স্তুতি করতে শুরু করে দিলেন। শেষে শিব ছাগলের মুন্ডু কেটে দক্ষের মাথায় বসিয়ে দিয়ে তাকে জীবনদান করলেন। এরপর শিব অনুচরদের কৈলাসে পাঠিয়ে সতীর দেহ নিয়ে ত্রিভুবন দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করলেন। শিবের এই উন্মত্ত আস্ফালনে ত্রিভুবনে প্রলয়কান্ড শুরু হয়েগেল। ব্রহ্মা ভয়ে তটস্থ হয়ে সৃষ্টি রক্ষার তাগিদে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হলো। যেহেতু উনি এই ধরাধামের পালনকর্তা।



সতীর শবদেহ চিন্ময়বস্তু। শিবগাত্র স্পর্শে তার মহিমা হাজার গুণ বেড়ে গেছে। জগৎপালক বিষ্ণু তখন জগতের মঙ্গলকামনার্থে তাঁর সুদর্শন চক্রের সাহায্যে ধীরে ধীরে একান্ন খন্ডে বিভক্ত করলেন। দেবীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধরাধামের যেখানে যেখানে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে তা পাথরে পরিণত হলো। সেই সব স্থান পবিত্র মহাপীঠ রূপে প্রসিদ্ধ লাভ করলো। এই একান্নটা মহাপীঠ ছাড়াও ছাব্বিশটা উপপীঠ রয়েছে। কামরূপে মায়ের মাতৃঅঙ্গ পতিত হয়েছিল। যে স্থানে দেবীর যোনি পতিত হয়েছিল সেই স্থান হচ্ছে তীর্থচূড়ামণি। তীর্থচূড়ামনির অর্থ হলো সব তীর্থের মধ্যে সেরা তীর্থ স্থান। যেখানে সতীর যোনি মন্ডল পতিত হয়েছিল সেই জায়গাটাকে বলে কুব্জিকাপীঠ। কথিত আছে যোনিরূপ যে প্রস্তরখণ্ডে মা কামাক্ষা অবস্থান করছেন, সেই শিলা স্পর্শ করলে মানুষ মুক্তিলাভ করে।



এই প্রসঙ্গে কালিকাপুরাণের একটা গল্প ছিলো। কালিকাপুরাণের ছাব্বিশতম অধ্যায়ে কামাক্ষার বর্ণনা রয়েছে। পূর্বে এই পর্বতের উচ্চতা ছিল শতেক যোজন। কিন্তু মহামায়া সতীর যোনি অঙ্গ পতিত হওয়ার পর এই উচ্চ পর্বত মহামায়র যোনি মন্ডলের ভার সহ্যে করতে না পেরে কেঁপে উঠলো এবং ক্রমশঃ পাতালে প্রবেশ করতে লাগলো। তখন শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রত্যেকে একটা করে শৃঙ্গ ধারন করলেন। তাদের সঙ্গে মহামায়া স্বয়ং সমবেত হলেন। এবং পাতাল প্রবেশ থেকে রক্ষা করলেন এই শৃঙ্গকে। ফলে পর্বতের উচ্চতা একশতো যোজন থেকে এক ক্রোশ উঁচু হয়ে গেল। আর মাতৃ যোনি পতিত হওয়ার ফলে পর্বতের রং নীল বর্ণ আকার ধারণ করলো। তাই পর্বতের নাম হলো নীলাচল পর্বত। এই মহামায়া নিখিল জগতের প্রকৃতি এবং এই জগতের প্রসব-কারিণী তাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর তাকে ধারণ করে রেখেছেন।




এদিকে মহাযোগী মহাদেব, স্ত্রী সতী বিরহে পাগল প্রায় অবস্থা। তাঁর মনে মহাবৈরাগ্যের উদয় হলো। তিনি হিমালয়ের দুর্গম স্থানে গিয়ে তপস্যায় নিমগ্ন হলেন। সেই মহাযোগীর ধ্যান ভঙ্গ করে কার সাধ্য। দক্ষযজ্ঞে সতীদেবী প্রাণত্যাগ করার পর গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে মেনকার গর্ভে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করলেন। শিশু কন্যাকে সকলে গিরিজা, পার্বতী আরও নামে ডাকতে শুরু করলেন। এদিকে পিতামহ ব্রহ্মা তারকসুর নামে অসুররাজের কঠোর তপস্যায় সুপ্রসন্ন হয়ে তাকে বর দিলেন ত্রিভুবন শিবের ঔরাসজাত সন্তান ভিন্ন কেউই তাকে বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মার বরে বলীয়ান তারকাসুর ত্রিলোক জয় করে দেবতাদের প্রজা বানিয়ে দিলেন। ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ ব্রহ্মার শরাণাপন্ন

হয়ে তাঁকে সব জানালেন। ব্রহ্মা সব শুনেটুনে বেশ চিন্তিত হয়ে পরলেন। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তিনজনে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের কর্তা একজন এইভাবে উদাসীন হয়ে পরলে সৃষ্টিরক্ষা করা মহা মুস্কিল। তার ওপর তারকাসুরের ঝামেলা। ব্রহ্মা তখন দেবতাদের ডেকে বললেন,সতী দেহত্যাগের পর গিরিরাজের ঔরসে মেনকার গর্ভে স্থান পেয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। একমাত্র শিব বীর্য হতে উৎপন্ন সন্তান তারকাসুরকে বধ করতে পারবে। সবশুনে-টুনে দেবতারা যেন একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পেল। প্রথমে শিবের ধ্যান ভঙ্গ করতে হবে, দ্বিতীয় শিবের বিয়ে দিতে হবে। চলো নারদের কাছে। নারদ দেবতাদের কথা শুনে আনন্দে নেচে উঠলেন। চলে গেলেন হিমালয় রাজের কাছে। গিরিরাজ এবং তার স্ত্রী মেনকা সব শুনে মহা খুশী। তার কন্যার সঙ্গে শিবের বিয়ে হবে। এর থেকে সুখবর আর কি আছে।অনেক খোঁজা খুঁজির পর মহাদেবের দুর্গম যোগসাধনের স্থান খুঁজে বার করা হলো। গিরিরাজ হিমালয় এবং তাঁর স্ত্রী মেনকা দেখে এলেন শিবের সেই সাধনের স্থান। তাঁর রাজপ্রসাদ থেকে সেটা খুব একটা দূরে নয়।



দেবর্ষি নারদের কথা মতো তিনি পার্বতীকে পাঠালেন মহাদেবের পূজা আর সেবা করার জন্য। পার্বতীও মহা আনন্দে সখীদের নিয়ে প্রত্যহ শিবের পূজা শুরু করলেন। সতীর মুখের ছায়া পার্বতীর মুখ মন্ডলে। একবার শিবের ধ্যানভঙ্গ হলে তিনি যদি পার্বতীকে দেখেন তাহলে পার্বতীকে পাওয়ার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠবেন। মহাদেব নিজেই গিরিরাজের কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাবেন। কিন্তু মহাযোগী শিব একদিনও পার্বতীর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন না। ব্রহ্মা বিষ্ণু পরলেন মহা সংকটে। দেবতাদের সঙ্গে ব্রহ্মা বিষ্ণু পরামর্শ করে স্থির করলেন, একমাত্র শিবের মধ্যে কামের উদ্রেক জাগাতে পারলেই তার ধ্যানভঙ্গ হওয়া সম্ভব।ডাক পরলো কাম দেবের। বুঝিয়ে দেওয়া হলো তার কাজ। যথা সময়ে কামদেব স্ত্রী রতিকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন হিমালয়ের শিখরে। ফুল শর নিক্ষেপ করে কামদেব মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করলেন। ধ্যানভঙ্গ হওয়ার পরই মহাদেবের রোষানলে পরলেন মদন কামদেব। শিবের তৃতীয় নয়নের অগ্নিবর্ষণে কামদেব ভষ্মে পরিণত হলো। রতি মূর্ছা গেল। দেবতারা পরলেন মহা বিপদে। এক বিপদ যায়, আর এক বিপদ এসে উপস্থিত হয়। দেবতারা কোনপ্রকারে রতিকে সুস্থ করে বললেন, তুমি ভয় পরিত্যাগ করে এই ভস্মগ্রহণ করো,শিব সুপ্রসন্নহলে আমরা তোমার প্রাণবল্লভকে পুণঃ জীবনদান করবো। কামদেব ভষ্মীভূত হওয়ার পর শিবের উগ্রচন্ডীভাব কিছুটা স্তিমিত হলো। পার্বতীর দিকে চোখ পরতেই তিনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন। খুব চেনা চেনা মুখ। তারপরেই আবার গম্ভীর হয়ে নিজের যোগাসন থেকে উঠে সেই স্থান পরিত্যাগ করলেন।





পার্বতীও ছাড়বার পাত্র নয়। শিবকে পাওয়ার জন্য তিনি তপস্যায় ব্রতী হলেন। শিব পার্বতীর তপস্যায় গলে জল
হয়েগেলেন। সময় সুযোগ করে মহাধুমধাম সহকারে তিনি পার্বতীকে বিবাহ করলেন। দেব-দেবাদিদেব সকলেই মহাদেবের বিবাহে উপস্থিত রইলেন। রতিও সেই বিবাহে উপস্থিত হলেন। নিজের স্বামীকে ফিরে পাবার জন্য তিনি শিবের কাছে কাকুতি মিনতি করতে শুরু করলেন। দেব-দেবীগণ সকলেই শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন রতির স্বামী কামদেবকে পুনঃ জীবিত করা হোক। শিব রতির হাতে ধরা সেই ভস্মাধারে তাঁর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সেই ভস্মাধার থেকে কামদেবের পুনঃ জন্ম হলো। রতি স্বামী পেলেন। কিন্তু এই কামদেবের রূপের বিপর্যয় ঘটেছে। কামদেবের সেই কাম রূপ স্বরূপ-কান্তি আর নেই। দুজনেই আবার শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন, ফিরিয়ে দেওয়া হোক তার আগের রূপ। তখন মহাদেব বললেন- ভারতবর্ষের ঈশানকোনে নীলাচল পর্বত রয়েছে। সেখানে সতীদেহের একান্নটা খন্ডের এখনো একটা খন্ড অনাবিষ্কৃত রয়েছে। সেটি মহামায়ার মহামুদ্রা। সেখানে গিয়ে দেবীর মহিমা প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা করলে তুমি তোমার আগের রূপ আবার ফিরে পাবে। কামদেব নীলাচলে এসে মহামায়ার সেই মহামুদ্রা প্রস্তরখন্ড রূপে খুঁজে পেলেন এবং ভক্তি সহকারে পূজা পাঠ করলেন। মহামায়া কামদেব এবং রতির প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে তার আগের রূপ প্রদান করলেন। এই যে কামদেব এখানে এসে তাঁর আগের রূপ ফিরে পেলেন তাই জায়গার নাম হলো কামরূপ। কামদেব তাঁর স্বীয় রূপ ফিরে পাবার পর। দেবীর পূজা যাতে সঠিক ভাবে হয় তাই তিনি বিশ্বকর্মাকে ডেকে পাঠালেন। মহামায়ার জন্য মন্দির তৈরি করতে হবে। বিশ্বকর্মা জায়গা দেখে ভীষণ আনন্দ পেলেন। সব শোনার পর তিনি মন্দির নির্মান করলেন। মন্দিরের গায়ে চৌষট্টি যোগিনী, আর আঠারোটা ভৈরব-মূর্তি খোদাই করলেন। কামদেব এই মন্দিরকে আনন্দাখ্যা মন্দির নাম জগতে প্রচার করলেন। আর মহামায়া মায়ের মহামুদ্রার নাম হয় মনোবভগুহা। অতীতে কামরূপে বহু হিন্দু রাজা রাজত্ব করেছেন। কিন্তু তাদের ধারাবাহিক ইতিহাস বিলুপ্ত। অনেক ধর্মবিপ্লব এবং যুগবিপ্লবের সাক্ষী কামদেব প্রতিষ্ঠিত মন্দির কামরূপ কামাখ্যা।



কালের অতলে একদিন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল এই মন্দির। নীলাচল পর্বতের ওই স্থান ঘন জঙ্গলে ভরে গেল। শক্তিময়ী মা কামাখ্যার কথা ভুলেই গেল সকলে। বৌদ্ধযুগের পর গুপ্তবংশের রাজারা কামরূপে বেশ কিছুদিন রাজত্ব করেন। বিশেষ করে বিক্রমাদিত্যের সময় থেকে হিন্দুধর্ম আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১১৫০ সালে পালবংশের ধর্মপাল বর্তমান গৌহাটিরপশ্চিমখণ্ডে রাজত্ব করতেন। তিনি খুব ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিছিলেন। তিনি আবার কামাখ্যা দেবীকে নীলাচল পর্বতে খুঁজে বার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মপালই মায়ের যথাবিধি পূজার্চনার জন্য কনৌজ থেকে অনেক সদব্রাহ্মণকে কামরূপে নিয়ে আসেন।এরা বাসত্তরীয় ব্রাহ্মণ নামে খ্যাত। এঁরাই কামাখ্যা দেবীর মন্দিরের আদি পূজারী। পালবংশের শাসনের পর মন্দিরের আবার অবলুপ্তি ঘটে। মা কামাখ্যা হারিয়ে যান নীলাচলের গহীণ অরণ্যে। বারভুঞ্যাদের সময় মন্দিরের ইতিহাস অতোটা পরিষ্কার জানা যায় না। পরে কামরূপের শাসন ভার করায়ত্ত করেন মেছ বা কোচবংশীয় শাসনকর্তা। এরা হাজো বংশীয় নামে পরিচিত ছিলেন। ১৪৮৫ সালে এই বংশের বিশু নামে এক শক্তিমান পুরুষ রাজা হন। ১৪৯০ সালে তিনি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে বিশ্বসিংহ নাম পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর ভাই শিশু শিবসিংহ নামে পরিচিতি লাভ করেন। পরে এই বিশ্বসিংহ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন এবং তৎকালীন কামতাপুর বর্তমান কোচবিহারে এসে বসবাস শুরু করেন।


যেখানে সতীর যোনিমন্ডল পতিত হয়েছিল সেই জায়গাটাকে বলে কুব্জিকাপীঠ। কথিত আছে যোনিরূপ যে প্রস্তরখণ্ডে মা কামাক্ষা অবস্থান করছেন, সেই শিলা স্পর্শ করলে মানুষ মুক্তিলাভ করে। এই প্রাচীন মন্দিরটিই কামাক্ষা দেবীর মন্দির নামে পরিচিত।

পুরোহিতদের কথামতো মন্দিরে পুজো পর্ব সম্পাদন করা । প্রধান মন্দিরের বাইরের সৌভাগ্যকুণ্ড থেকে মাথায় জলের ছিটে দিয়ে শুরু করা হয় পুজো পর্ব। সেখানে অসমিয়া ভাষায় লেখা রয়েছে, ‘যখনই মুখ খুলিবেন, মা কামাক্ষার নাম বলিবেন।’ দেশের অন্যান্য বড় মন্দিরের মতোই নগদমূল্যে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন। অনেকেই বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে পূজা সারেন। এই মন্দিরে দেবীর কাছে প্রার্থনা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসেন। মনস্কামনা পূর্ণ হলে তারা ঘন্টা বেধে যান। কামাখ্যা মন্দিরের চুড়া সপ্তরথ আকৃতির। তার গড়নে পাওয়া যায় মৌচাকের আদল। সাতটি ডিম্বাকৃতি গম্বুজের প্রতিটির ওপর তিনখানা স্বর্ণকলস বসানো আছে। মন্দিরের বহিরাংশে গণেশ ও অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিকৃতি ও পুরাণ কাহিনীর নানা খণ্ডচিত্র খোদাই করা প্যানেলের সারি। মন্দিরের ভেতরে তিনটি প্রকোষ্ঠ। সবচেয়ে বড় পশ্চিম প্রকোষ্ঠটি আয়তাকার। এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার। এখানে দেবী কামাখ্যার চলন্তা মূর্তি আছে। দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা শিলালিপি, মহারাজ নরনারায়ণ এবং অন্য হিন্দু দেবতার মূর্তি দেখা যায়। এই প্রকোষ্ঠর পরেই গুহা সংবলিত গর্ভগৃহ শুরু হয়েছে। গুহার দেওয়ালে কোনও ছবি বা খোদাইয়ের কাজ নেই। সরু সিঁড়ির ধাপের শেষে যোনি আকৃতির পাথরের ফাটল থেকে ঝরে পড়ছে প্রাকৃতিক ঝরণাধারা। জলের ধারা সৃষ্ট করেছে একরত্তি জলাশয় যার ধারে অবিরাম পূজার্চনা চলে। ধারার উৎসমুখ ঢাকা এক টুকরো লাল কাপড়ে। আষাঢ় মাসে অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা মন্দির তিন দিন বন্ধ থাকে। এই সময় গর্ভগৃহের চারপাশের জল রক্তিম হয়ে যায়। দেবী রজঃস্বলা হন। তাই মন্দিরে প্রবেশ করা সকলের জন্য নিষিদ্ধ। শোনা যায় এক তরুণ পূজারী সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় দেবীর কোপে তিনি দৃষ্টিহীন হয়ে যান। জনশ্র“তি যে, কোচবিহারের যে রাজবংশ দেবীর প্রধান ভক্ত ছিল, দেবীর আদেশে তাদেরই মন্দিরে পুজো দেওয়া বারণ ছিল। এখনও রাজবংশের কেউ নীলাচল পর্বতের পাশ দিয়ে গেলে মন্দিরের দিকে তাকান না।



তন্ত্র'- ছোট্ট একটি শব্দ, কিন্তু গভীর তার অন্তর্নিহিত অর্থ। তন্ত্র হল এক বৃহৎ ও অতিপ্রাচীন গুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় বিষয়। মুক্ত বিশ্বকোষে বলা আছে, তন্ত্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত ঈশ্বর উপাসনার একটি পথবিশেষ। শিব ও মহাশক্তির উপাসনা সংক্রান্ত শাস্ত্রগুলিকেও তন্ত্র সাধনা নামে অভিহিত করা হয়। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব হল শিব ও মহাশক্তির দিব্যলীলা। তন্ত্রে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।ভারতের আদি ও অকৃত্রিম তন্ত্র সাধনার জায়গা হল নীলাচল পর্বত। যা 'কামাখ্যাধাম' নামে পরিচিত। তন্ত্র এমনই একটি শাস্ত্র যার মাধ্যমে নিজেকে অনুসন্ধান করা যায়। নিজের অন্তরের ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায়।তন্ত্র প্রাক্ বৈদিক আচার হ'লেও খ্রিস্ট্রীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে সাধারণের মধ্যে তন্ত্র সাধনা বিকাশ লাভ করে। গুপ্তযুগের শেষভাগে এই প্রথার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। মূলত বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে এই তন্ত্রশাস্ত্রটি। তন্ত্র ভারতের অতিপ্রাচীন এবং গুরু পরম্পরার একটি গুপ্ত বিদ্যা। প্রাচীন ভারত থেকে বহু মূল্যবান পুঁথি চীনা পরিব্রাজকরা তাঁদের দেশে নিয়ে চলে গেছেন। এটি গুরু পরম্পরা বিদ্যা বলে প্রকৃত গুরুর খোঁজ করতে হয়। দীক্ষা ছাড়া এ শাস্ত্র সম্পর্কে সহজে কেউ কাউকে কিছু ব্যক্ত করেন না।


লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

শাঁখা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কেন মহামূল্যবান

শাঁখা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মহামূল্যবান। শাঁখা ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে অসম্ভব। শাঁখা হচ্ছে শঙ্খ দিয়ে তৈরি এক ধরনের সাদা অলঙ্কার।
ব্রহ্মবৈবরতপুরাণে আছে, শঙ্খাসুরের স্ত্রী তুলসী দেবী ছিলেন ভগবান নারায়ণে বিশ্বাসী এক সতীসাধ্বী নারী। আর শঙ্খাসুর ছিল ভগবানবিমুখ অত্যাচারী। তার (শঙ্খাসুর) পাপের শাস্তিস্বরূপ তাকে বধ করার পর ভারত মহাসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীব্রতী তুলসী দেবী তা সইতে না পেরে স্বামী এবং নিজের অমরত্বের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। ভগবান প্রার্থনা মঞ্জুর করে তার দেহ থেকে তুলসী গাছ এবং সমুদ্রে হত্যা করা স্বামীর রক্ত বা অস্থি থেকে শঙ্খ বা শাঁখার উৎপত্তি করেন। তুলসী দেবীর ধর্মপরায়ণতায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান দু'জনকেই ধর্মীয় কাজে নির্ধারণ করে দেন। সেই থেকে পতিব্রতা তুলসীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তুলসী ও শাঁখা ব্যবহারের প্রচলন হয়।


এ কাহিনী সূত্রে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে (মহাভারতের যুগে) শাঁখার ব্যবহার শুরু হয়৷ দাক্ষিণাত্যে প্রায় দু’হাজার বছর আগে থেকেই এ শিল্পের প্রচলন ছিল। তামিলনাড়ুর প্রাচীন রাজধানী কোরকাই এবং কায়েলের ভগ্নস্তুপ থেকে শঙ্খশিল্পের প্রাচীন নির্দশন আবিষ্কৃত হয়েছে। মাদ্রাজ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত শঙ্খশিল্পের নিদর্শনের কথা লিখেছেন ভ্রমনকারী জেমস হরনেল। তিনি উল্লেখ করেছেন খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতকেই মহীশূর, হায়দ্রাবাদ, গুজরাট, কাথিয়াবার প্রভৃতি অঞ্চলে শঙ্খশিল্পের বিকাশ লাভ করেছিল। এর পরেই শঙ্খশিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। পরে ঢাকাই হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। শাঁখারীরা আসলে নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে বাঙ্গালী না। তাদের আদি নিবাস দক্ষিন ভারতে। আনুমানিক ১২ শতকের দিকে বল্লাল সেনের আমলে ঢাকায় শঙ্খশিল্পের প্রচলন শুরু হয় বলে ধারনা করেছেন ইতিহাসবেত্তারা। শাঁখারি সম্প্রদায় প্রথমে বিক্রমপুরে বসতি স্থাপন করে। সতেরো শতকে মুঘলরা ঢাকায় এলে শাঁখারিদের এখানে আনা হয়। তারা ব্যবসায়ের উপযুক্ত একটি এলাকা নির্ধারণ করে বসতি স্থাপন করেন, যার বর্তমান নাম ‘শাঁখারিবাজার'।

সনাতন হিন্দুদের পূজা-অর্চনা, সামাজিক, মাঙ্গলিকসহ যে কোনো শুভ অনুষ্ঠান শঙ্খের ধ্বনি ছাড়া হয় না বললেই চলে।শঙ্খধ্বনি ছাড়া যে কোনো পূজাই অসমাপ্ত। শঙ্খধ্বনি আমাদের কাছে পবিত্র। শঙ্খ দর্শনে পাপ ক্ষয় হয়। সে জন্য পূজায় সন্ধ্যার সময় বিয়েতে অথবা যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভ পরিণতির জন্য শঙ্খ বাজানো হয়ে থাকে। শঙ্খ অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক। কখনও পূজা-পার্বণের ধ্বনিতে কখনও শ্রীকৃষ্ণের রণবাদ্য আবার কখনও নারায়ণের হাতের পরশে কখনও বা সাবিত্রীর সতীত্ব বলয়ে।

শঙ্খ হিন্দু রমণীর সতীত্বের প্রতীক। বিবাহিত হিন্দু রমণীর সঙ্গে জড়িত রয়েছে একজোড়া শাঁখা। কারণ কুমারী অবস্থায় শাঁখা পরা যায় না। তাই সে গুনতে থাকে প্রহর কখন তার হাতে উঠবে বিয়ের প্রতীক হিসেবে একজোড়া শঙ্খবালা। তাদের ধারণা, এ শঙ্খবালা যতদিন হাতে থাকবে ততদিন তার স্বামী সুস্থ দেহে বেঁচে থাকবে। তাদের বিশ্বাস, হাত শাঁখাহীন থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়।

তবে শঙ্খ শুধু বিবাহিত ও হিন্দু রমণীর হাতের শোভা হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, আরও অনেক কাজে ব্যবহৃত হয় ধর্ম ও বিশ্বাসের আধার হিসেবে। দেবতার পূজায় শঙ্খে কপিলা গাভীর দুধ ভরে নারায়ণকে স্নান করানো হয়। বলা হয়, শঙ্খধ্বনি যতদূর পর্যন্ত যায় ততদূর পর্যন্ত লক্ষ্মী দেবী অবস্থান করেন।

শঙ্খ কূটরস পুষ্টিবর্ধক, বলকারক। শূলকফ-শ্বাস-বিষ দোষনাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। মুখের যে কোনো দাগ মোচন করে শঙ্খ চুন। সাধারণত শঙ্খ পাওয়া যায় ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে। আরব সাগরেও কিছু প্রাপ্তি ঘটে। প্রাপ্তির ওপর ভিত্তি করে শঙ্খের বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। বিভিন্ন জাতের শঙ্খ রয়েছে। এদের মধ্যে উন্নতমানের হচ্ছে কন্যা কুমারী, রামেশ্বরী, কেপি, জাজি, পাটি, মতি সালামত, ওমেনি, দোয়ালি, সারভি কি, তিতকুটি, ধলা ইত্যাদি। 'মতি সালামত' সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ এর মধ্যে মুক্তা পাওয়া যায়। শঙ্খের মুখ, লেজ ও পিঠ আছে। সাধারণত বাম দিকে শঙ্খের মুখ থাকে। যদি শঙ্খের মুখ ডান দিকে থাকে তবে তার মূল্য অনেক। এটাকে নারায়ণের হাতের শঙ্খের অনুরূপ মনে করা হয়। এ 'দক্ষিণমুখী শঙ্খ' - কে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ শঙ্খ দিয়ে পূজা করলে ঘরে সৌভাগ্য আসে, বিপদ-আপদ দূর হয়। শঙ্খ একটি প্রাচীন শিল্প। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আবিষ্কারের সময় শঙ্খশিল্পের বিভিন্ন কারুকাজের নিদর্শন পাওয়া যায়।দুর্গাপূজার অন্যতম অনুষঙ্গ শঙ্খ। পুরোহিতের মন্ত্র, ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খধ্বনি -- এই শব্দগুলো সনাতন পূজা মণ্ডপের পরিচিত অনুষঙ্গ, এগুলো ছাড়া পূজাই হয় না ।

শঙ্খ এক প্রকার জলজ জীব। এ শঙ্খ পাওয়া যায় শ্রীলঙ্কা ও মাদ্রাজের সমুদ্রতীরে। একসময় মাদ্রাজ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে শ্রীলঙ্কা থেকে আমদানি করে এ দেশে শঙ্খের চাহিদা মেটানো হয়। শাঁখা ও শঙ্খজাত অলঙ্কার তৈরির জন্য ব্যবহৃত শঙ্খের মধ্যে তিতপুটি, রামেশ্বরি, মতি-ছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, রায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, ঝাঁজি, দোয়ানি, জাডকি, কেলাকর, তিতকৌড়ি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপাটি, আলাবিলা উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের এবং আলাবিলকে নিম্ন মানের শঙ্খ। হাতের শাঁখার মধ্যেও বিভিন্ন নামের শাঁখা রয়েছে। এর মধ্যে সাতকানা, পাঁচদানা, তিনদানা, বাচ্চাদার, সাদাবালা, আউলাকেশী উল্লেখযোগ্য। সৌখিনদের জন্য রয়েছে সোনা বাঁধাই শাঁখা। এসবের মধ্যে টালি, চিত্তরঞ্জন, সতীলক্ষী, জালফাঁস, লতাবালা, মোটলতা, তাঁরপেচ ইত্যাদি। আমাদের দেশে যেসব শঙ্খ আমদানি করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম জাতি, পাটি, ধলা, কাঞ্চন, কড়ি। আরো নানা রকম শঙ্খ থাকলেও এসব শঙ্খই বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে শাঁখা শিল্পে। আমাদের দেশে শঙ্খ দুইভাবে ব্যবহার করা হয়। তা হলো আস্ত শঙ্খ আর কাটা শঙ্খ বা শাঁখা। আস্ত শঙ্খ আবার ব্যবহার করা হয় দুইভাবে। তার একটি বাদ্যশঙ্খ অন্যটি জলশঙ্খ। আর কাটা শঙ্খ দিয়ে হয় শাঁখা, আংটি, চুনসহ নানা উপকরণ। শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শঙ্খ পরিষ্কার করে পেছনের অংশ কেটে বাদ্যশঙ্খ তৈরি করা হয়। এ শঙ্খ বিশেষ কায়দায় ধরে কাটা অংশ মুখে লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে মঙ্গলধ্বনি করা হয়।

বড় আকৃতির এক প্রকারের শঙ্খ হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও জলের সংমিশ্রণে উজ্জ্বল করে এর বহিরাবরণে নকশা এঁকে তৈরি করা হয় জলশঙ্খ। জলশঙ্খ অনেকটা বাদ্যশঙ্খের মতোই। তবে এতে জলশঙ্খের মতো পেছনের অংশ কাটা হয় না। আস্ত শঙ্খটিকে চিত করে রেখে তার মধ্যে জল রাখা হয়। জল রাখা হয় বলেই এর নাম জলশঙ্খ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জলশঙ্খে রাখা জল গঙ্গার জলের মতোই পবিত্র মনে করেন। জলশঙ্খ মন্দিরে বা ঘরে একটি ত্রিপদের ওপর রাখা হয়। বাদ্যশঙ্খ ও জলশঙ্খ উভয়ের গায়ে নকশা করা থাকে। নকশা ছাড়া শঙ্খও ব্যবহার কম নয়। সাধারণত প্রতিটি শঙ্খে গায়ে দেখা যায় ফুল, লতাপাতার নকশা। বিশেষ কিছু শঙ্খের ওপর মা কালী, রাধা-কৃষ্ণ, দুর্গা প্রতিমার নকশাও দেখা যায়। দিনের পর দিন কাটাকাটি করে একটি শঙ্খের ওপর নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। এসব নকশা করা প্রতিটি শঙ্খ আমাদের লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান। শঙ্খ শাখের করাত (বর্তমানে মেশিনে কাটা হয়) দিয়ে গোলাকার করে কাটা হলে তাকে শাঁখা বলে। জটিল এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শঙ্খ শাঁখায় পরিণত হয়। গোলাকার করে করে শঙ্খ কাটার পর সেগুলো নকশাকারের কাছে চলে যায়। নকশাকার তিনটি কাঠের তৈরি তেপায়ার ওপর রেখে রেত ও দা দিয়ে নকশা তৈরি করেন। ফুল, মাছ, লতাপাতাসহ নানা নকশা তোলা হয় চিকন শাঁখার ওপর। অবস্থাপন্নরা শাঁখার ওপর সোনার তার পেঁচিয়ে নেয়। শাঁখায় জোড়া ও ছিদ্র থাকলে এখানেই সেটা এমনভাবে মিটিয়ে ফেলা হয় যে, ক্রেতা সেটা দেখতেও পায় না। শাঁখার বায়না ও দামদর : ক্রেতারা নিজের পছন্দের নকশায়ও শাঁখা-পলা করিয়ে নিতে পারেন। ফরমায়েশ দেওয়ার দুই দিনের মধ্যে তৈরি করা হয়। পূজার এ সময়ে সাত দিন আগে ফরমায়েশ দিতে হয়। পূজার সময় কাজের চাপ বেশি থাকে। তবে সোনা বাঁধানোর কাজটি করেন মূলত স্যাকরা বা স্বর্ণকারেরা। বিভিন্ন শাঁখারীবাজারে শাঁখা-পলা তো পাওয়া গেল। কিন্তু তাতে যদি সোনা, রুপা বাঁধাতে চাই তাহলে তো যেতে হবে স্বর্ণকারের কাছে। বিভিন্ন শাঁখারীবাজারের সারি সারি দোকানে বাহারি রকমের নানা কারুকার্যের নকশা করা শাঁখা-পলা পাওয়া যায় -- প্রদীপ শাঁখা, বরফি শাঁখা ও হৃদয়াকৃতির নকশা করা শাঁখার চাহিদা বেশি।

সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় সোনা বাঁধানোর কাজ কমে গেছে। কৃত্রিম সোনা, সোনার প্রলেপ আর রুপার চাহিদা বেশি। এখন নকশায় এসেছে আধুনিকতা। পুরোনো আর নতুনের মিশ্রণও ঘটে। ক্রেতার রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী শাঁখা-পলার ওপর নকশা করা হয়। শাঁখা দিয়ে গড়া গহনা ও বাদ্যশঙ্খের ব্যবহার ছাড়া হিন্দুদের সামাজিকতা ও ধর্মীয় কার্যাদি অচল বলা চলে। বিবাহিত নারীদের তো বরের দেয়া শাঁখার বালা ধারণ করতেই হবে। হিন্দুদের পূজানুষ্ঠানে জলশঙ্খে গঙ্গার পবিত্রজল রাখা হয়। অন্য এক ধরনের শঙ্খ ব্যবহৃত হয় পূজা ও অন্যান্য হিন্দু আচার অনুষ্ঠানে মঙ্গলধ্বনি করার ক্ষেত্রে। প্রসাধনী ক্ষেত্রেও শাঁখার নানা ভূমিকা রয়েছে। অতীতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অধিকাংশই শাঁখার গুঁড়াকে পাউডার বা প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার করত। আজও নানান জাতের প্রসাধনীর ভীড়ে ব্রণের দাগ তুলতে শাঁখার গুড়া ব্যবহার করা হয়। হাতের শাঁখা ছাড়াও শঙ্খের তৈরি ব্রেসলেট, ব্রুশ, ব্যাংগেল, ঘড়ির চেন, চুলের ক্লিপ, খোঁপার কাঁটা, শঙ্খের মালা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে শঙ্খের পেপারওয়েট, সেপটিপিন, আতরদানি, ফুলদানি, এসট্রের ব্যবহারও লক্ষণীয়।

শঙ্খ সমুদ্রের তলার এক অমূল্য সম্পদ। এটি শুধু দেখতে সুন্দর নয়, শঙ্খকে ভারতীয় উপমহাদেশে একটি পবিত্র বস্তু বলেও মনে করা হয়। একদিকে শঙ্খ যেমন বাদ্যযন্ত্র অন্যদিকে প্রাচীন বিভিন্ন গ্রন্থে বলা আছে বাড়িতে শঙ্খ থাকলে, সুখ-সমৃদ্ধি আসে। শঙ্খ শুধু কোনো একটি বিশেষ ধর্মের উপচার নয়। প্রাচীনকাল থেকে শঙ্খ বার্তা পাঠানোর অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। আজও বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে শঙ্খকে বার্তা পাঠানোর বিশ্বস্থ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাস্তু বিজ্ঞানেও শঙ্খকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাস্তু বিজ্ঞান অনুযায়ী, বাড়িতে শঙ্খ থাকলে, তা পজিটিভ এনার্জিকে আকর্ষিত করে। আবার বাস্তু অনুযায়ী, যত দূর শঙ্খ ধ্বনি পৌঁছায়, ততো দূরের বায়ু শুদ্ধ হয়ে যায়। শঙ্খের শব্দের ফলে সুপ্ত ভূমিও জেগে ওঠে। ভূমি শুদ্ধ হওয়ার ফলে রোগ এবং কষ্ট কমে যায়। সেই বাড়ির লোকজনেরও উন্নতি হয়। শঙ্খের শব্দের যে তরঙ্গ আছে সেটিকে জীবাণুনাশক বা জীবাণু প্রতিরোধক হিসেবে প্রাচীন পুঁথি-পত্রে বলা হয়েছে। শঙ্খ অনেক রোগে ওষুধের কাজ করে। ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্র বলছে ----


  •  যদি কারো উচ্চারণে অস্পষ্টতা থাকে বা কারও কথা বলার সময় অসুবিধা হয় বা তোতলামি আছে তাহলে প্রাচীন বাস্তু শাস্ত্র মতে, রোজ কিছুক্ষণ শঙ্খ বাজানো উচিত। এতে আবার বেশ কয়েক ধরনের ফুসফুসের রোগও সেরে যায়। আবার প্লীহা, ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে আক্রান্ত কেউ বাড়িতে থাকলে শঙ্খ ধ্বনিতে উপকার হয় বলে বাস্তু শাস্ত্রে বলা আছে।



  •  শঙ্খের জল পান শরীরের পক্ষে উপকারী। প্রাচীন পণ্ডিতেরা গর্ভ ধারণ এবং গর্ভস্থ শিশুর বিকাশের জন্য শঙ্খের জল পান করার কথা বলেছেন। সম্ভবত সেই প্রাচীন কালেই শঙ্খের মধ্যে থাকা প্রয়োজনীয় সামুদ্রিক খনিজ পদার্থ গুলোর সন্ধান পেয়েছিলেন।



  •  বাস্তু মতে রোজ সকালে দক্ষিণাবর্তী শঙ্খে অল্প জল ঢেলে ঘরে ছিটিয়ে দিলে নেগেটিভ এনার্জি দূর হয়। একটি কাঁচের বাটিতে লঘু মোতী শঙ্খ রেখে, তা নিজের বিছানার কাছে রাখলে দম্পতির মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।

  •  প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা আছে, শঙ্খ ঘসে চোখে লাগালে ফোলা ভাব দূর হয়। শঙ্খ ভস্ম যথাযথ অনুপাতে ব্যবহার করলে পিত্ত, কফ, প্লীহার সমস্যা দূর হয়। ত্বকের সমস্যা থাকলে শঙ্খের ভস্ম নারকেল তেলে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে রোজ লাগানো যেতে পারে বলেও মনে করেন প্রাচীন আয়ুর্বেদ পণ্ডিতরা।


  •  শুদ্ধ জাফরান গরম দুধে মিশিয়ে রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে শঙ্খের সাহায্যে পান করলে স্মৃতি শক্তি এবং শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। উচ্ছের রসে শঙ্খ ভস্মের সঙ্গে মিশিয়ে, তা গরুর দুধে দিয়ে পান করলে ডায়াবেটিস দূর হতে পারে বলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা আছে।


লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

ভুবনেশ্বরী দেবী



দেবীভাগবতে বর্ণিত মনিদ্বীপের দেবী হৃল্লেখা(হ্রীং) মন্ত্রের স্বরুপশক্তি এবং সৃষ্টির ক্রমপর্যায়ে মহালক্ষ্মীস্বরুপা আদিশক্তি ভাগবতী ভুবনেশ্বরী হচ্ছেন দেবাদিদেব মহাদেবের সমস্ত লীলাবিভূতির সহচরী। জগদম্বা ভুবনেশ্বরীর স্ব-রুপ হচ্ছে সৌমা এবং অঙ্গকান্তি অরুণবর্ণা। ভক্তদের অভয় প্রদান ও সর্বসিদ্ধি প্রদান করাই হল এর স্বাভাবিক গুণ। দশ মহাবিদ্যার মধ্যে ইনি পঞ্চম স্থানাধিকারি। দেবীপুরাণ অনুসারে মূলা প্রকৃতির অপর নামই ভুবনেশ্বরী। ঈশ্বরের জাগতিক ব্যবহার সুপ্ত থাকে সেই সময় একমাত্র ব্রহ্ম ই অব্যক্ত প্রকৃতিসহ অবশিষ্ট বা বর্তমান থাকেন,সেই সময় সেই ঈশ্বর রাত্রির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম ভুবনেশ্বরী। অঙ্কুশ এবং পাশ এর মুখ্য অস্ত্র। অঙ্কুশ হল নিয়ন্ত্রনের প্রতীক আর পাশ হল রাগ অর্থাৎ অনুরাগ বা আসক্তির প্রতীক। এইভাবে সর্বরুপে মূল প্রকৃতিই হচ্ছেন ভুবনেশ্বরী, যিনি বিশ্বকে বমন বা উদগীরন করার জন্য বামা,শিবময়ী হওয়ায় জেষ্ঠা এবং কর্মনিয়ন্ত্রন,ফলপ্রদান ও দণ্ডদান করার জন্য হলেন রৌদ্রী। ভগবান শিবের বাম অঙ্গকেই ভুবনেশ্বরী বলা হয়।)
মহানির্বাণতন্ত্র মতে সব কটি মহাবিদ্যাই ভাগবতী ভুবনেশ্বরীর সেবায় সদাই নিরত থাকেন। সাত কোটী মহামন্ত্র সর্বদা এর আরাধনা করে। দশ মহাবিদ্যাই দশটী ধাপ। কালী তত্ত্ব থেকে সুরু করে কমলাতত্ত্ব পর্যন্ত দশটী স্থিতি আছে, যার থেকে অব্যক্ত ভুবনেশ্বরী ব্যক্তরুপে ব্রহ্মাণ্ডের রুপ ধারন করতে পারেন আবার প্রলয় কালে কমলার থেকে অর্থাৎ ব্যক্ত জগৎ থেকে ক্রমশ লয় হয়ে কালীরুপে প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিতা হন। এইজন্য একে কাল এর জননীও বলা হয়।
শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে মঙ্গলাচরণেও বলা হয়েছে যে ---- "আমি ভুবনেশ্বরী দেবীর ধ্যান করি। তার শ্রী অঙ্গের শোভা নবারুন সদৃশ অরুনাভ। তার শিরে ত্রিনয়না দেবীর শ্রীমুখে মৃদু হাসির আভা। তার হাতে পাশ, অঙ্কুশ, বরদ এবং অভয় মুদ্রা শোভা পায়।
বৃহন্নীলতন্ত্রের এই বিবরণ পুরানের বিবরণের দ্বারাও সমর্থিত যে প্রকারন্তরে কালী ভুবনেশ্বরী অভেদাত্মক। অব্যক্ত প্রকৃতি ভুবনেশ্বরীই রক্তবর্ণা কালী, দেবীভাগবত মতে দুর্গম নামক অসুরের অত্যাচারে সন্তপ্ত হয়ে দেবতা ও ব্রাহ্মণের একত্র হয়ে হিমালয়ে অবস্থিতা সর্বকারণস্বরুপা ভাগবতী ভুবনেশ্বীরই আরাধনা করেন। সেই আরাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবী ভুবনেশ্বরী তৎক্ষণাৎ সেখানে আবির্ভূত হন।তার হাতে বান, পদ্মফুল ও শাকমূল ছিল, তিনি নিজের চোখ থেকে সহস্র অশ্রুধারা প্রবাহিত করেন। সেই জলে পৃথিবীর সব প্রানী তৃষ্ণা নিবারণ করে। নদ নদী, সমুদ্র অজস্ত্র জলে পূর্ণ হয় এবং সমস্ত ওষধি জলে সঞ্জীবিত হয়।তার হাতে ধরা শাক ও ফলমূলে প্রাণীদের পালন করার জন্য দেবী ভুবনেশ্বরীই 'শতাহ্মা' তথা 'শাকম্ভরী' নামে খ্যাত হন। ইনিই দুর্গমাসুরকে বধ করে তার দারা অপহৃত বেদগ্রন্থ দেবতাদের হাতে ফিরিয়ে দেন। এর ফলে দেবী ভুবনেশ্বরীর এক নাম হয় দুর্গা।
-
দেবী ভুবনেশ্বরীর উপাসনা পুত্রলাভের জন্য বিশেষ ফলপ্রদ।

Written by : Pritwsih Gosh

Share:

কামাখ্যার সংক্ষিপ্ত কাহিনী


নরকাসুর এর ঘটনা কামরূপের আধ্যাত্মিক উপাখ্যানের সাথে জড়িয়ে আছে। ভগবান নারায়ন যখন বরাহ অবতার ধারন করেন তখন ধরিত্রী দেবীর সাথে মিলনে নরক অসুরের জন্ম হয়। নরক প্রথমে সৎ উত্তম চরিত্রের একজন ব্যাক্তি ছিল।সে সময় কামরূপ কিরাত দের দ্বারা পরিচালিত ছিল। রাজা ছিলেন কিরাত রাজ ঘটক।ধরিত্রীর আশীর্বাদে নরক কিরাত দের যুদ্ধে পরাস্ত ও ঘটক কে বধ করে নিজেই কামরূপের রাজা হন। ভগবান বিষ্ণু, বিদর্ভ রাজ্যের রাজকন্যা মায়ার সাথে, নরকের বিবাহ দিয়ে কিছু আদেশ করেন পুত্রকে। যথা ----
-
‘মহাদেবীং মহামায়াং জগম্মাতরম্বিকাম ।
কামাখ্যাং ত্বং বিনা পুত্র নান্যদেবং যজিষ্যসি ।।
ইতোহন্যথা ত্বং বিহরণ্ হতপ্রানো ভবিষ্যসি ।
তস্মান্নরক যত্নেন সময়ং প্রতিপালয়।।‘ --- (কালিকাপুরান, অষ্টত্রিংশ অধ্যায়, ৪৪-১৪৫)
-
অর্থাৎ- দ্বার প্রান্তে তোমার পুত্র লাভ হইবে । ইতিমধ্যে দেবতা ও ব্রাহ্মণ বিরোধী হবে না এবং আসুরী প্রবৃত্তি প্রদর্শন করবে না। জগত মাতা মহামায়া কামাখ্যা দেবী ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করবে না, অন্যথায় গতপ্রান হবে ।
পুরান মতে নারায়নের নির্দেশ পালন করে নরক অসুর সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগ শাসন করল। অপরদিকে শোনিতপুরের রাজা বলি পুত্র বানের সাথে নরকের বন্ধুত্ব হল। বান ছিল অসুর, কথায় বলে ‘অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। তাই হল, কূট বানের সাথে মিশে নরক অসৎ হল। কামাখ্যা পূজা ত্যাগ করলো, ব্রাহ্মণ হত্যা করতে লাগলো, স্বর্গ দখল করে নিল। স্বর্গ হারা দেবতা গণ প্রজাপতির কাছে নিজেদের দুঃখের কথা বিবরণ করলে প্রজাপতি জানালেন তোমরা মহামায়ার বন্দনা করো। ভগবতী দেবতাদের প্রার্থনায় সাড়া দিলেন। কালিকাপুরান মতে একদিন মহর্ষি বশিষ্ঠ কামাখ্যা দর্শনে যাচ্ছিলেন। সে সময় নরক অসুর তাকে বাঁধা দান করলেন। এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বশিষ্ঠ অভিশাপ দিলেন – ‘তুই যতদিন জীবিত থাকবি, ততদিন জগতমাতা কামাখ্যা দেবী সপরিবারে অন্তর্ধান করুন।’
বশিষ্ঠের অভিশাপে নরকের কাল সময় নির্ধারিত হল। এরপর দেবী মহামায়া কামাখ্যামোহ বিস্তার করে নরকাসুরকে ভ্রমিত করলেন।ভগবান বিষ্ণু সৃষ্টি রক্ষার্থে নিজ পুত্র নরককে সংহার করলেন। নরকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ভগদত্ত কামরূপের রাজা হ’ন। ভগদত্তের বংশ লোপ হলে কামরূপ রাজ্যের পরাক্রম হ্রাস পায়। পরে বিশ্বকর্মা দ্বারা স্থাপিত মন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই পবিত্র, যোনিমুদ্রা, কুন্ড গাছগাছালীতে ঢেকে যায়। পর্বতে হিংস্র জন্তু দের আস্তানা হয়ে ওঠে। স্থানীয় আদিবাসী গণ ঐ জঙ্গলে ঢাকা কুন্ডে পশু পক্ষী বলি দিয়ে পূজা করতো, গবাদি পশু হারালে ঐ কুন্ডে দুগ্ধ দিয়ে মানত করলে- মানত ফলে যেতো।
এরপর বহু পড়ে কোচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ এই পীঠ উদ্ধার ও মন্দির নির্মাণ করেন। কামরূপ অভিযান কালে কোচ (কোচবিহার রাজ বংশ) নরপতি রাজা বিশ্বসিংহ দেবীর এই পীঠ উদ্ধার ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। আহোম রাজার সাথে যুদ্ধ চলার সময় একদিন তিনি ও তাঁর ভাই শিবসিংহ মূল সৈন্য দল থেকে পৃথক হয়ে পড়েন এবং তাঁরা দুজন ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে এই পর্বতে জঙ্গলে ঢাকা কুন্ডের সামনে এসে উপস্থিত হন। তারা জানতেন না সেটি দেবী পীঠ। উভয়ে দেখলেন সামনে এক বৃদ্ধা পূজা করছেন। দুইজন গিয়ে সেই বৃদ্ধার কাছে জল চাইলেন।
বৃদ্ধা বললেন - ‘সামনের ঝর্না থেকে জল পান করো।’
জল পান করে এসে রাজা বিশ্বসিংহ ও তাঁর ভাই শিবসিংহ জানতে চাইলেন এই মৃত্তিকা স্তূপের সামনে কার পূজা করছেন?
বৃদ্ধা জানালো- ‘ইনি দেবী, এখানে যে যা প্রার্থনা ব্যক্ত করে- দেবী তাঁর সেই ইচ্ছাই পূর্ণ করেন, এর অন্যথা হয় না।’
শুনে রাজা বিশ্বসিংহ মনে মনে প্রার্থনা করলেন -- তিনি যেনো তাঁর হারানো সেনাদলকে ফিরে পান। তাঁর রাজ্য যেন নিষ্কণ্টক হয়। মহারাজ সেখানে প্রতিশ্রুতি দিলেন প্রার্থনা পূর্ণ হলে তিনি এখানে সোনার মন্দির ও নিত্য পূজোর ব্যবস্থা করবেন। বৃদ্ধা জানালেন, দেবীকে ছাগাদি বলি, সিঁদুর, গন্ধ, পুস্প, রক্তবস্ত্র, অলংকার দ্বারা পূজা করতে হয়। যাই হোক, মহাদেবী ভবানী কামাখ্যা রাজার ইচ্ছা পূর্ণ করলেন, রাজার বাসনা পূর্ণ হল।
অপর একটি জনশ্রুতি অনুসারে – একদিন রাজা বিশ্বসিংহ ঐ স্থানে এসে ঐ কুন্ডের মাহাত্ম্য শুনলেন। তিনি ভাবলেন পরীক্ষা করে দেখা যাক সত্যই এই কুন্ডে ইচ্ছা পূরনের কোন শক্তি আছে কিনা। এই ভেবে তিনি তার আঙুলের একটি হীরক আংটি ঐ কুন্ডে ফেলে মনে মনে বললেন- ‘যদি কাশীতে গঙ্গা তে আমি এই আংটি ফেরত পাই, তবেই দেবীর মহিমা মানবো।’ এই ঘটনার পর একদা তিনি কাশীধামে গিয়ে তর্পণ কালে ঐ আংটি পুনরায় ফেরত পেলেন। তিনি ঐ কুন্ডের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে আরও জানার জন্য পণ্ডিত দের একটি বিচারসভা বসালেন। পণ্ডিত গণ শাস্ত্র ঘেটে জানালেন যে, ঐ স্থানে দেবী সতীর যোনিদেশ পতিত হয়েছে এবং দেবী সেখানে কামাখ্যা রূপে বিরাজিতা। এই শুনে মহারাজ সেখানে মন্দির নির্মাণে অগ্রসর হলেন।
রাজার আদেশে লোকজন লেগে কাজে নেমে পড়লো। জঙ্গল পরিষ্কার করে কুন্ড উদ্ধারের সময়, বিশ্বকর্মা স্থাপিত মন্দিরের ভিত উদ্ধার হল। যোনীমুদ্রা সহ মূল পীঠ আবিস্কৃত হল। রাজা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সোনায় মুড়ে মন্দির বানাবেন। কিন্তু অত সোনা পাওয়া মুস্কিল।তাই কেবল ইট দ্বারা মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা হল। কিন্তু প্রতি দিন মন্দিরের ইট খসে খসে পড়তে লাগলো। একদা রাজা বিশ্বসিংহ কে স্বপ্নে মা দেখা দিয়ে বললেন – ‘হে রাজন।কি প্রতিজ্ঞা করেছিলে মনে কর, সোনার মন্দির করবে বলেছিলে- তা কি বিস্মৃত হয়েছ?’ রাজা গদগদ হয়ে বলল --- ‘মা সন্তানের অপরাধ ক্ষমা কর। এত স্বর্ণ কোথায় পাবো?’ মা জানালেন- ‘চিন্তার কিছু নাই। প্রতি ইষ্টকে এ এক রতি করে সোনা দিবে।’ রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই মতো মন্দির নির্মাণ করলেন। অসমের শুয়ালকুচি গ্রামের ব্রাহ্মণদের পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করা হল। মন্দির স্থাপনার পর প্রতিষ্ঠা ও নিত্য পূজার ব্যবস্থা করা হল। বর্তমানে সে বংশানুক্রমিক ভাবে সেই পুরোহিতগণই মায়ের নিত্য পূজা করেন। এই স্থানে তন্ত্র, পুরান আলোচনা হতে লাগলো। সাধুরা এখানেই তন্ত্র সাধনা করতে লাগলেন।সেই সব শাস্ত্রের জীর্ণ লিপি এখনও আসামের কিছু স্থানে পাওয়া যায়, কিছু গৃহে দেখা যায়।
১৫৩৪ খ্রীঃ রাজা বিশ্বসিংহের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর পুত্র মল্লদেব ‘নরনারায়ণ’ নাম নিয়ে কোচবিহারের রাজ সিংহাসনে বসেন। রাজা নরনারায়ণ নিজ ভ্রাতা শুক্লধ্বজ কে ‘চিলারায়’ নাম দিয়ে কোচ রাজ্যের সেনাপতি পদে নিযুক্ত করেন। এরপর দুভাই মিলে রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করতে উদ্যোগী হন। ১৫৪৬ খ্রীঃ তারা আহোম রাজ খোরাকে পরাজিত করেন। অপর দিকে তখন গৌড় বঙ্গে ছিল মুসলিম শাসন। নসরৎ শাহের পুত্র ফিরোজ শাহ তখন বাংলার শাসনকর্তা। ১৫৩৮ খ্রীঃ শের খাঁ জোর করে গৌড় দখল করে নেন। আহোম রাজ্যের সাথে যখন কোচ রাজা নরনারায়ণ যুদ্ধে মগ্ন তখন ১৫৫৩ খ্রীঃ কালাপাহাড় কামরূপ আক্রমণ করেন। দেশে রাজা নেই, ফলে কালাপাহাড় বাধাহীন ভাবে একের পর এক মন্দির, মূর্তি, দেবালয় ধ্বংস করে এগিয়ে গেলো। এরপর তার কোপ পড়লো কামাখ্যা মন্দিরে।কালাপাহার কামাখ্যা মন্দিরে উপরিভাগের অনেক প্রাচীন মূর্তি ও স্থাপত্য ধ্বংস করলেন। অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় কোচ রাজা নরনারায়ণ এই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন নি। এখনও কামরূপে গেলে কালাপাহারের হাতে ভাঙ্গচুর হওয়া মূর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মহারাজ নরনারায়ণ ও চিলারায় অনেক স্থান বিজয় করে রাজ্যে এসে কালাপাহারের কীর্তি কলাপ দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে মুসলিম রাজ্য গৌড় আক্রমণ করেন। যুদ্ধ জয়ের আগে চিলারায় কামাখ্যা মন্দিরে এসে ভগ্ন অবস্থা দেখে মন্দির সংস্কারের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। কামাখ্যা দেবীর কাছে যুদ্ধে জয়ের আশীর্বাদ চাইলেন। এই সময় তিনি মন্দিরের পুরোহিত কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে কোন কারনে অপমান করে চলে যান।কেন্দুকেলাই ঠাকুর খুব বড় মাপের ভক্ত পূজারী ছিলেন। তিনি যখন আরতি করতেন মা নিজে এসে দেখা দিতেন, নৃত্য করতেন।অপরদিকে চিলারায় বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে গৌড়ের বাদশা সোলেমানের নিকট পরাজিত ও বন্দী হলেন। একদা কারাবন্দী চিলারায়কে মা কামাখ্যা স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন- “কাল নবাবের মাকে সর্পে দংশন করবে, এতে নবাব এর মাতার জীবন সংশয় উপস্থিত হবে, আমার কৃপায় তুমি তাকে বাঁচিয়ে তুলবে।” ঠিক তাই হল। পরদিন নবাবের মাকে সাপে কাটলো। কত ওঝা, বৈদ্য, হাকিম, কবিরাজ ডাকা হল।সকলের চেষ্টাই বিফল হল।নবাবের মা জীবনের শেষ সীমানায়। তখন চিলারায় জানালো, একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।চিলারায় কে নবাবের মাতার সামনে নিয়ে আসা হল। চিলা রায় কামাখ্যা মায়ের কাছে প্রার্থনা জানালেন। মা কামাখ্যা নবাবের মাকে সুস্থ করে জীবন ফিরিয়ে দিলেন।
এর পর নবাব, চিলারায়ের কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকট করলেন। নবাবের মা চিলারায়কে নিজ পুত্রের মতো স্নেহ করলেন।নবাব সোলেমান, চিলারায়ের সাথে ভাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে সসম্মানে মুক্তি দিলেন। রাজ্যে ফিরে এসে কোচ নৃপতি নরনারায়ণ আর চিলারায় মিলে মন্দির সংস্কারে ব্রত হলেন। ১৫৫৫-১৫৬৫ খ্রীঃ মধ্যে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। শুভ দিনে পূজার জন্য রাজা নরনারায়ণ তাঁর পত্নী রানী ভানুমতী, আর চিলারায় তাঁর পত্নী চন্দ্রপ্রভাকে নিয়ে নীল পর্বতে গমন করলেন। শাস্ত্র মতে পূজা সুসম্পন্ন হল। প্রচুর দান করা হল। রাজা অনেক জমি দেবীর সেবার জন্য দান করলেন।সেবাইত দান করে তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করলেন।এছাড়া নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু সেনা রেখে গেলেন।
কেন্দুকেলাই ঠাকুরের অনেক ভক্তি। মা নিজে এসে ঠাকুরকে দেখা দিতেন, ভোগ খেতেন, আরতির সময় নাচতেন, দরজা বন্ধ করে কেন্দুকেলাই ঠাকুর মায়ের আরতি করতেন, বাইরে ঢাক, দামামা, ঢোল, শঙ্খ, কাঁসর , ভেরী , তুরী বাজতো, ভেতরে ঠাকুর আরতি করতেন, কেউ বাঁধা দিতো না। বাইরের লোক মাঝে মাঝে কেবল ভেতর থেকে ভেসে আসা নূপুরের ধ্বনি শুনতেন। কেউ উঁকিঝুঁকি মারার দুঃসাহস দেখাতো না। যারা সরল মনের ছিলেন তাঁরা কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে খুব ভালোবাসতেন। বিপদে আপদে ঠাকুরের কাছে যেতেন।ঠাকুরের কথা মা শুনতেন। অনেক মৃতপ্রায় লোক মায়ের কৃপায় সুস্থ ও আরোগ্য জীবন লাভ করতো।আর কুটিল মানুষ বিশেষত কিছু পুরোহিত আর রাজ কর্মচারী কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে মোটেও সহ্য করতে পারতো না, নানা অপবাদ দিতো, ভণ্ড বলে গালাগালি করতো। একবার ঠাকুরকে ‘চোর’ বদনাম দেওয়াও হয়েছিল। মায়ের কৃপায় ঠাকুর সেই অপবাদ থেকে মুক্তি পান। তিনি যে নির্দোষ – প্রমানিত হয়। কালে কালে কোচ রাজাও ঠাকুরের কিছুটা বিরোধী হয়ে ওঠেন। কারন কুচক্রী পুরোহিত আর রাজ কর্মচারীরা সমানে ঠাকুরের নামে নানান কথা বানিয়ে বানিয়ে রাজার কান ভরতে লাগলেন। রাজা নরনারায়ণ কোনরূপ সত্যতা যাচাই না করে সেই কুটিল মানসিকতা সম্পন্ন লোকেদের কথা বিশ্বাস করতে লাগলেন।
একদা নরনারায়ণ কামাখ্যা ধামে গিয়ে ঠাকুর কেন্দুকেলাই কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন- “শুনলাম আপনি যখন আরতি করেন, তখন নাকি মা নিজে এসে আপনাকে দর্শন দান করেন, ইহা কি সত্য ?”
কেন্দুকেলাই ঠাকুর জানালেন- “আজ্ঞে যথার্থ শুনেছেন মহারাজ। কৃপাময়ী জননী কৃপা করে আমাকে দর্শন দান দিয়াছেন।”
এই শুনে রাজা নরনারায়ণ খুবুই খুশী হয়ে বললেন- “আমিও দেখতে চাই মাকে। আপনি যখন আরতি করবেন, তখন আমি মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে মায়ের দিব্য রূপ দর্শন করবো।”
কেন্দুকেলাই ঠাকুর খুবুই ভীত হয়ে বললেন- “সাবধান মহারাজ। এভাবে ছলাকলার আশ্রয় করে মায়ের দর্শন আপনি পাবেন না।উল্টে আপনার ক্ষতি হবে। আপনি মায়ের তপস্যা করুন। ব্রহ্মময়ী জননী সন্তুষ্ট হলে তিনি আপনাকে নিশ্চয়ই দর্শন দান দিবেন।”
এভাবে ঠাকুর রাজাকে বুঝিয়ে চলে গেলো। একদা সন্ধ্যা আরতিতে মগ্ন ছিলেন কেন্দুকেলাই ঠাকুর, মন্দিরের দ্বার বন্ধ, ভিতরে ঠাকুর আরতি করছেন, বাইরে নানান বাদ্য বাজছিল, রাজা নরনারায়ণ ও অন্য এক কুটিল পূজারী সেখানে চুপিচুপি এসে উত্তর দিকের গবাক্ষ দিয়ে উকি দিয়ে দেখতে লাগলেন। মহামায়া কামাখ্যা দেবী সব জানতে পারলেন। দেবী ভীষনা ক্রুদ্ধ হয়ে বিকট আওয়াজে দিকবিদিক প্রকম্পিত করে সেই কুটিল পূজারীর মাথায় চপেটাঘাত করে শাপ দিয়ে পাথরের মূর্তিতে পরিণত করলেন। মা কামাখ্যা নরনারায়ণ কে অভিশাপ দিয়ে বলেন- “এই মুহূর্তে তোমাকে নীলাচল পর্বত পরিত্যাগ করতে হবে। তুমি কিংবা তোমার বংশধরেরা যদি কখনো আমার মন্দির বা নীলাচল পর্বতে আসে, তবে সে নির্বংশ হবে।”
এই অভিশাপ পেয়ে রাজা নরনারায়ণ রাজ্যে ফিরে গেলেন, তার পর থেকে এখন অবধি কোচ রাজার বংশধরেরা কোনদিন আর নীলাচল পর্বতে যান না, দেবীর মন্দির বা নীলাচল পর্বত দর্শন করেন না। এরপর মন্দির সেবার ভার পড়ে আহোম রাজগনের ওপর।
-
একটা জিনিষ ভাবার বিষয় রাজা নরনারায়ণের পূর্ব পুরুষ রাজা বিশ্বসিংহ এই কামাখ্যা মন্দির নির্মাণ করেন, রাজা নরনারায়ণ এই মন্দির সংস্কার করেন, কিন্তু মা তাঁদের এমন শাপ কেন দিলেন? বস্তুত মা পাপীদের কোনদিন ক্ষমা করেন না, সে মায়ের যত বড় ভক্তই হোক না কেন। কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে বারংবার অপমান, সত্যতার যাচাই না করা- মায়ের ভক্ত হলেও সে রেহাই পাই নি। বস্তুত ভক্ত পাপাচারে লিপ্ত হলে ভগবান তাকে বাঁচান না। শুধরানোর সুযোগ দেন। যেমন মা কামাখ্যা, কেন্দুকেলাই ঠাকুরের মুখ দিয়ে রাজাকে সাবধান করেছিলেন, রাজা শোনেনি। কেন্দুকেলাই ঠাকুরের কথা শুনে রাজা ছলাকলা ত্যাগ করে ভক্তি মার্গ অবলম্বন করলে মায়ের দিব্য দর্শন অবশ্যই পেতেন। রাবন কে ভগবান শিব বাচান নি। ঠিক জরাসন্ধ কে শিব বাঁচান নি। নরক অসুর তার পিতা নারায়নের হাতেই নিহত হয়েছিলেন। সুতরাং ভক্ত যদি পাপাচার করে তার সাত খুন মাফ- এমন ভাবার কোন কারন নেই। ভগবানের চোখে সবাই সমান।এই হল কামাখ্যার সংক্ষিপ্ত কাহিনী ।

Written by: Prithwish Ghosh
Share:

মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য কি ? মহাবিশ্ব আসছে কোথা থেকে এবং যাচ্ছে বা কোথায় ? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল ? যদি থাকে তবে তার আগে কি ঘটেছিল ? কালের চরিত্র কি ? কাল কি কখনও শেষ হবে ? আমি কে ? কোথা থেকে এসেছি ? কোথায় যাব ?

মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য কি ?
মহাবিশ্ব আসছে কোথা থেকে এবং যাচ্ছে বা কোথায় ?
মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল ?
যদি থাকে তবে তার আগে কি ঘটেছিল ?
কালের চরিত্র কি ?
কাল কি কখনও শেষ হবে ?
আমি কে ?
কোথা থেকে এসেছি ?
কোথায় যাব ?

এ সকল মানুষের শাশ্বত প্রশ্ন এর সঠিক উত্তর জানবার জন্য বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবৎ গবেষণা করছেন। তারা ইতিমধ্যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে অনেক তত্ত্ব, মতবাদ, হাইপোথিসিস, সূত্র আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কার আছে পরস্পর বিরোধী একটির সাথে অন্যটির মিল নেই। কিন্তু 'চিন্ময়' জগত বা আত্মা সম্পর্কে তারা নীরব। আসুন দেখি Spirutual Science কি বলে -------
================)(=====================
চিন্ময় জগতে কালের প্রভাব নাই -------
'প্রবর্ততে যত্র রজস্তমস্তয়োঃ সত্ত্বং চ মিশ্রং ন চ কালবিক্রমঃ।
ন য্ত্র মায়া কিমুতাপরে হরে- রনুব্রতা যত্র সুরাসুরার্চিতাঃ।।' ----(ভাগবত ২/৯/১০)
-
অনুবাদ -- ভগবানের সেই ধামে রজো তমোগুণ নাই, এমনকি সেখানে সত্ত্বগুনেরও প্রভাব নাই। সেখানে বহিরঙ্গা মায়াশক্তির প্রভাব তো দূরের কথা, কালেরও প্রভাব নাই। মায়া সেখানে প্রবেশ করিতে পারে না। সুর এবং অসুর উভয়ে কোনরম ভেদবুদ্ধি না করিয়াই ভগবানের পূজা করেন।
-
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, চিন্ময় জগতে কালের কোন প্রভাব নেই। কাল এক প্রকার শক্তি, এই শক্তির দ্বারা ভগবান জড় জগতসহ সবকিছু সৃষ্টি, ধ্বংস এবং নিয়ন্ত্রন করেন, কালের প্রভাবে সব কিছু পরিবর্তিত হয়, আজকের যুবক ৫০ বছর পর বৃদ্ধে পরিণত হয় কালের প্রভাবে। যেহেতু চিন্ময় জগতে কালের কোন প্রভাব নাই, তাই সেখানে সবকিছু অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে। চিন্ময় জগতে সব কিছু জীবন্ত যেখানে জড় বা প্রাণহীন কোন বস্তু নেই। আমরা জড় জগতে প্রানীর দেহে যে আত্মার প্রভাব অনুভব করি, সেই আত্মা জড় জগত থেকে সৃষ্টি হয়নি। আত্মা চিন্ময় বস্তু, এর কোন সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। সেজন্য আত্মা চিন্ময় জগতের বস্তু অর্থাৎ আত্মা চিন্ময় জগত থেকে এই জড় জগতে এসেছে। আত্মাকে সাধারণ ভাষায় জীবন বা প্রাণ বলে। কিছু বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেছেন গভীর সমুদ্রে সূর্যলোকের প্রভাবে কতগুলি জড় বস্তুর সম্মিলনে প্রাণ বা জীবন বা আত্মা সৃষ্টি হয়েছে। আবার কেউ বলছেন পানি থেকে জীবন সৃষ্টি হয়ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জড় বা প্রাণহীন বস্তু থেকে জীবন সৃষ্টি হতে পারে না। জীবন বা আত্মা হল উৎকৃষ্ট উচ্চ স্তরের বস্তু সেটা কখনও নিম্নস্তরের জড় বস্তু থেকে সৃষ্টি হতে পারে না। বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবৎ গবেষণা করছে এই মহাবিশ্বে জীবন বা আত্মা কোথা থেকে এসেছে। সেই প্রশ্নের উত্তরে ভাগবত বলছে আত্মা চিন্ময় জগত থেকে এসেছে। চিন্ময় জগতের 'চিন্ময়' ব অপ্রাকৃত বস্তু, এর সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই চিন্ময় জগত থেকে আত্মার আগমন হয়েছে এবং চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়া ইহার মূল লক্ষ্য-এই জন্য মানব জীবনের মূল লক্ষ্য হল শ্বাশত জীবন অর্থাৎ চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়া। আত্মা চিন্ময় জগত থেকে আসে ---
'অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।' ----- (গীতা ৭/৫)
-
অনুবাদ ---- হে মহাবহো, এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হইয়া এই জড় জগতকে ধারণ করে আছে।
-
এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ভগবানের অন্য একটি উৎকৃষ্টা চৈতন্য স্বরূপা অর্থাৎ চিন্ময় জগত আছে যা জীবভূত অর্থাৎ সেখান থেকে জীবন বা আত্মা এসেছে। চিন্ময় জগতকে আলোকিত করার জন্য জড় জগতের মত সূর্যালোকের প্রয়োজন নেই। সূর্যালোকের যে উৎস ব্রহ্মজ্যোতি, তার দ্বারা চিন্ময় জগত আলোকিত হয়। চিন্ময় জগতে সূর্যোলোক বা চন্দ্রালোকের প্রয়োজন নেই
'ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো না শশাঙ্কো ন পাবকঃ।
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।। ---- (গীতা ১৫/৬)
-
অনুবাদ ------ আমার সেই রম ধাম সূর্য, চন্দ্র অথবা বিদুৎ আলোকিত করিতে পারে না। সেখানে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরিয়া আসিতে হয় না।
-
এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে পরমধাম বা চিন্ময় জগত সূর্য, চন্দ্র বা বিদুৎ আলোকিত করতে পারে না । চিন্ময় জগতের জলও জীবন্ত বস্তুর মত ক্রিয়া করে ।

Written by:  Prithwish Ghosh 
Share:

জগন্নাথের কথা ( পঞ্চম পর্ব )

ওড়িশা ভারতের এক প্রাচীন রাজ্য। এখানকার সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনেক পুরানো । জগন্নাথ যেমন বৈষ্ণব দের নিকট বিষ্ণু তেমনি শাক্ত ও শৈবদের নিকট ভৈরব শিব । যে যেমন ভাবে দেখতে চায়- জগন্নাথ তাঁর কাছে সেরূপেই প্রকাশিত হন। হরিহর অভেদ তত্ত্ব এই শ্রীক্ষেত্রে দেখা যায় । ওড়িশার নানা অঞ্চল জুড়ে বহু প্রাচীন মন্দির আছে । এগুলোর সবকটি সম্বন্ধে লেখা অসম্ভব । কি শিব মন্দির, কি শক্তিপীঠ, কি গোপাল মন্দির এমনকি বৌদ্ধ ও জৈণ ধর্মের নিদর্শন ওড়িশা রাজ্য জুড়ে দেখা যায় । আসুন জেনে নেই পুরীধামে কি কি দেখবার প্রধান জায়গা আছে । জগন্নাথ মন্দির দর্শন সেড়ে “মার্কণ্ডেয় পুষ্করিণী” পুরান গুলি বিশেষত স্কন্দপুরাণে লেখা আছে ভগবান হরির নির্দেশে মার্কণ্ড মুনি এই পুষ্করিণী খনন করেছিলেন , এখানে অনেক ঘাট, শিব মন্দির অষ্ট মাতৃকা মন্দির আছে । এবার দর্শনীয় স্থান ইন্দ্রদুম্ন্য সরোবর । মহারাজ ইন্দ্রদুম্ন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করার সময় ব্রাহ্মণ দের যে গাভী দান করেছিলেন সেই গাভীগুলির ক্ষুরের আঘাতে এই পুষ্করিণী সৃষ্টি হয় ও গোমূত্র, জলে পুষ্করিণী ভরাট হয় । এই জলের দ্বারা মহাপ্রভু তাঁর পার্ষদ সহিত গুণ্ডিচা মন্দির মার্জন করতেন । এরপর “মহাদধি সমুদ্র” । পুরাণ মতে মা লক্ষ্মীর আবির্ভাব সমুদ্র মন্থন থেকে হয়েছিলো। বলা হয় এইস্থানে মা লক্ষ্মী প্রকট হয়েছিলেন । জগন্নাথের স্ত্রী লক্ষ্মী দেবীর আবির্ভাব এইস্থানে হওয়ায় ওড়িশা বাসী হাস্যচ্ছলে এইস্থান কে জগন্নাথের শ্বশুর গৃহ বলেন । এই স্থানেই মহাপ্রভু পরম ভক্ত হরিদাস ঠাকুরকে সমাধিস্থ করেন বালি দিয়ে ।
এরপর “নরেন্দ্র পুষ্করিণী” । এটিকে জগন্নাথ দেবের পিসির বাড়ী বলা হয় । পিসি হলেন কুন্তী । মহাভারতে কিছু স্থানে দেখা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুন্তীদেবীকে ‘পিসি’ সম্বোধন করতেন । এখানে জগন্নাথ দেব এসে মালপোয়া সেবা নেন। এখানেই প্রভুর চন্দনযাত্রা হয় । তারপর আছে “শ্বেতগঙ্গা” বলা হয় এখানে মা গঙ্গা অবস্থান করেন। এখানে স্নানে গঙ্গা স্নানের ফল পাওয়া যায় । এখানে ভগবান মৎস্য ও মা গঙ্গার মন্দির আছে । এরপর স্বর্গদ্বার সমুদ্র তট । অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত সমুদ্র তট । সমুদ্র চরে বসে আপনার মন কোনো এক মধুমাখা কল্পনা লোকে চলে যাবে, হোটেলের বেলকোণি থেকে এই সমুদ্র তরঙ্গ দেখতে দেখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় যেনো কেটে যায়, বিরক্ত আসে না ।
এছাড়া সার্বভৌম আচার্যের বাড়ী, গম্ভীরা গুলি দর্শনীয় স্থান । এছাড়া আরোও অনেক বহু প্রাচীন মন্দির বিরাজিত । জগন্নাথ ক্ষেত্র বা ওড়িশা বা ঔড্র দেশ বা নীলাচল ধাম অপূর্ব সুন্দর ক্ষেত্র । জয় জগন্নাথ ।
( সমাপ্ত )
লেখাটি ডঃ সুমন গুপ্তের লেখা “জগন্নাথ দেবের অমৃত কথা” বইটি থেকে নেওয়া ।

লিখেছনঃ কমল
Share:

জগন্নাথের কথা ( চতুর্থ পর্ব )

সরলাদাসের ওড়িয়া মহাভারত, বলরাম দাসের ওড়িয়া রামায়ন, জগন্নাথ দাসের দারুব্রহ্মগীতা, অচ্যুতানন্দ দাসের হরিবংশ, দিবাকর দাসের জগন্নাথ চরিতামৃত, মহাদেব দাসের নীলাদ্রী মহোদয় ইত্যাদি গ্রন্থে জগন্নাথ দেব সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। সংস্কৃতে রচিত নীলাদ্রী মহোদয়, বামদেব সংহিতা, যাত্রা ভাগবত ইত্যাদি শাস্ত্রে জগন্নাথের কথা দেখা যায় । পদ্মপুরাণে লিখিত আছে ভগবান রামচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্ন এই স্থানে এসেছিলেন । ব্রহ্ম পুরাণ ও বৃহৎ নারদীয় পুরানে এই স্থানের নাম পাওয়া যায় ।

জগন্নাথ মন্দিরের মূর্তি প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় ব্রহ্মা ব্রহ্মলোক থেকে মর্তে এসেছিলেন। তিনিই হয়েছিলেন পুরোহিত । জগন্নাথ দেব রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কে স্বপ্নে নিত্য পূজোর নিয়মকানুনাদি বলেছিলেন । ইন্দ্রদুম্ন্য সেই মতো সব ব্যবস্থা করেন । স্কন্দপুরান মতে শবর জাতির লোকেরা পূর্বে নীলমাধব রূপে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করতো । ব্রহ্ম পুরাণ ও বৃহৎ নারদীয় পুরান মতে শবর গণ নীলমাধব রূপী নারায়নের পূজা করতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর পূর্বে স্বর্গের দেবতা গণ গুপ্ত রূপে নীলমাধবের পূজা করতেন । পরে শবর গণ সেই খোঁজ পান । জগন্নাথ দেবের সৃষ্টি সম্বন্ধে ওড়িয়া মহাভারতে এক অদ্ভুত আখ্যান আছে । লীলা সংবরণের আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৈকুণ্ঠে গমনের চিন্তা করতে লাগলেন। যদু বংশ গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে । বলরাম ভ্রাতা যোগবলে দেহ রেখেছেন । তিনি এই ভেবে বনে গিয়ে একটি বৃক্ষে আরোহণ করে মহাভারতের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। সেসময় তাঁর চরণ কে পক্ষী ভেবে জরা নামক এক ব্যাধ শর বিদ্ধ করলেন ।

বলা হয় এই ব্যাধ পূর্ব জন্মে বালী পুত্র অঙ্গদ ছিলেন । ভগবান রাম বালীকে বধ করে অঙ্গদ কে বর দিয়েছিলেন , পরবর্তী কৃষ্ণ রূপে তিনি অঙ্গদের শরে দেহ রাখবেন । পরে শ্রীকৃষ্ণ দেহ রাখলে তাঁর দেহকে দ্বারকায় সমুদ্র তটে চন্দন কাষ্ঠে, খাঁটি গো ঘৃতে দাহ করার চেষ্টা করা হয় । কিন্তু ৬ দিন হলেও ভগবানের শরীর একটুকুও পুড়লো না । তখন দৈববাণী হোলো- “ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই নশ্বর দেহ আগুনে দাহ করা যাবে না। এই পবিত্র দেহ সমুদ্রে বিসর্জন দাও।” ঠিক সেই মতো সমুদ্রে বিসর্জিত করা হলে সেই দেহ কাষ্ঠে রূপান্তরিত হয়ে ভাসতে ভাসতে এলো । সেই কাষ্ঠ রোহিনীকুণ্ডে পাওয়া যায়। সেই কাষ্ঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ তৈরী হোলো ।

( চলবে )

লিখেছনঃ কমল
Share:

জগন্নাথের কথা ( তৃতীয় পর্ব )

দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখেছি যে ভগবান বিষ্ণু তাঁর পরম ভক্ত রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কে স্বপ্নে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এই বলে যে তিনি সেই হস্তপদ রহিত বিকট মূর্তিতেই পূজা নেবেন । সেই স্বপ্ন পর্ব তখনো চলছে । ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে যে ভাগবতিক ও ভক্তির সম্বন্ধ তা একে একে উঠে আসছে । নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্নে রাজা তখনও সেই ছদ্দবেশী অনন্ত মহারানার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে বলছেন- “হে প্রভু জনার্দন । যে বৃদ্ধ কারিগরকে দিয়ে তুমি তোমার এই মূর্তি নির্মিত করিয়াছ – আমার অভিলাষ এই যে সেই কারিগরের বংশধরেরাই যেনো তোমার সেবায় রথ যুগ যুগ ধরে প্রস্তুত করিতে পারে।” ভগবান নারায়ন তাঁর ভক্তদের খুবুই স্নেহ করেন। তাই ভগবান একে একে রাজার ইচ্ছা পূর্ণ করতে লাগলেন। এরপর ভগবান বিষ্ণু বললেন- “হে রাজন। আমার আর এক পরম ভক্ত শবর রাজ বিশ্বাবসু আমাকে নীলমাধব রূপে পূজা করতো- তাঁরই বংশধরেরা আমার সেবক রূপে যুগ যুগ ধরে সেবা করবে । বিদ্যাপতির প্রথম স্ত্রীর সন্তান গন আমার পূজারী হবে। আর বিদ্যাপতির দ্বিতীয়া স্ত্রী তথা বিশ্বাবসুর পুত্রী ললিতার সন্তান এর বংশধরেরা আমার ভোগ রান্নার দায়িত্ব নেবে। আমি তাদিগের হাতেই সেবা নেবো।”
বিদ্যাপতি প্রথম রাজার আদেশে নীলমাধব সন্ধান করতে গেছিলেন শবর দের দেশে , শবর বা সাঁওতাল যাদের আমরা ছোটোজাত বলে দূর দূর করি- শ্রীভগবান বিষ্ণু প্রথম তাঁদের দ্বারাই পূজা নিলেন । অপরদিকে তিনি তাঁদের হাতে সেবার আদেশ দিলেন। ব্রাহ্মণ ও শূদ্র জাতির একত্র মেলবন্ধন ঘটালেন স্বয়ং ভগবান । সেজন্যই বলে পুরীতে জাতিবিচার নেই । জগতের নাথ জগন্নাথ সবার । বিদ্যাপতি শবর দেশে নীলমাধবের সন্ধান করতে গিয়ে বিশ্বাবসুর দুহিতা ললিতার সাথে ভালোবাসা ও বিবাহ করেছিলেন । আর বিদ্যাপতিকে শবর দেশে পৌছানোর জন্য এক রাখাল বালক বারবার পথ প্রদর্শন করেছিলেন । সেই রাখাল বালক আর কেউ নয় স্বয়ং বৃন্দাবনের রাখালরাজা নন্দদুলাল । ইন্দ্রদুম্ন্য স্বপ্নে ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রতিশ্রুতি দিলেন- “হে মধূসুদন । প্রতিদিন মাত্র এক প্রহর অর্থাৎ তিন ঘণ্টার জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকবে । বাকী সময় মন্দিরের দ্বার অবারিত থাকবে , যাতে তোমার সন্তান ভক্তেরা তোমার দর্শন লাভ করে । সারাদিন আপনার ভোজোন চলবে । আপনার হাত কদাপি শুস্ক থাকবে না।”
ভগবান বিষ্ণু রাজাকে তাই বর দিলেন। এবার ভগবান ভক্তের পরীক্ষা নিলেন- তিনি বললেন- “এবার নিজের জন্য কিছু প্রার্থনা করো। তুমি আমার ভক্ত।” প্রকৃত ভক্তেরা নিস্কাম, তাই কোনো প্রকার সুখ ঐশ্বর্য তারা চান না। রাজা একটি ভয়ানক বর চেয়ে বললেন- “প্রভু আমাকে এই বর দিন আমি যেনো নির্বংশ হই । যাতে আমার বংশধরেরা কেউ যেনো আপনার দেবালয় কে নিজ সম্পত্তি দাবী না করতে পারে।” ভগবান হরি তাই বর দিলেন। জগন্নাথ মন্দিরে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা।
( চলবে )

লিখেছনঃ কমল 
Share:

গুরু তত্ত্ব ও গুরু মহিমা

বিভিন্ন শাস্ত্র গ্রন্থে গুরু তত্ত্ব ও গুরু মহিমা সম্বন্ধে যা যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা সম্বন্ধে সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত হলো ।
> রুদ্রযামলে –
অনন্তর গুরু ও শিষ্যের কর্ত্তাব্যাকর্ত্তব্য কথিত হইতেছে। – রুদ্রযামলে কথিত আছে, যে, – কদাচ গুরুর আজ্ঞা লঙ্ঘন করিবে না এবং সহসা কোন বাক্যের প্রত্যুত্তর প্রদান করাও উচিত নহে। দিবানিশি দাসের ন্যায় গুরুর আজ্ঞা প্রতিপালন করিবে।।
> সারসংগ্রহে –
লিখিত আছে, যে, – সদ্ গুরু আশ্রিত শিষ্যকে একবৎসর পর্য্যন্ত পরীক্ষা করিয়া তৎপরে মন্ত্র প্রদান করিবে। কিন্তু স্বপ্নলব্ধ মন্ত্রে কালাকাল বিবেচনার আবশ্যক নাই। যেরূপ অমাত্যকৃত পাপ রাজায় এবং পত্নীকৃত পাপ পতিতে সংক্রান্ত হয়, তদ্রূপ গুরুও শিষ্যকৃত পাপে অভিভূত হইয়া থাকেন। এক বৎসরে ব্রাহ্মণ, দুই বৎসরে ক্ষত্রিয়, তিন বৎসরে বৈশ্য এবং চারি বৎসরে শূদ্রশিষ্য-যোগ্যতা প্রাপ্ত হয়।।
> তারাপ্রদীপে –
লিখিত আছে, যে, – মন্ত্রের অক্ষর সকলকে দেবতাস্বরূপ এবং সেই দেবতাকে গুরুস্বরূপ বিবেচনা করিবে, কদাচ তাহাদিগের ভেদজ্ঞান করিবে না ।।
> রুদ্রযামলে –
লিখিত আছে, যে, – যদি গুরুর দ্রব্য গ্রহণে অভিলাষ করে অথবা গুরুপত্নী গমন করে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি মহাপাতকে লিপ্ত হয়, কোনরূপ প্রায়শ্চিত্তে তাহার পাপের শান্তি হয় না। যে ব্যক্তি গুরুর নিন্দা শ্রবণ করে, তাহার সেই দিনকৃত পূজা দেবী গ্রহন করেন না।
> কুলার্ণবে –
কথিত আছে, যে, – যদি কোন স্থানে গুরুর নিন্দা শ্রুতিগোচর হয়, তাহা হইলে কর্ণদ্বয় আবৃত করিয়া তৎক্ষণাৎ তথা হইতে দূরে গমন করিবে, যেন আর সেই সকল দুর্বাক্য কর্ণগোচর হইতে না পারে।
> নিত্যানন্দে –
লিখিত আছে, যে, – মনুষ্যবৎ জ্ঞান করিবে না, যদি গুরুকে মনুষ্য বলিয়া জ্ঞান করা যায়, তাহা হইলে কি মন্ত্রজপ, কি পূজা কিছুতেই সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা নাই। যদি গুরু একগ্রামে অবস্থিতি করেন, তাহা হইলে শিষ্য প্রতিদিন ত্রিসন্ধ্যা তাঁহাকে প্রণাম করিবে, গুরু এক ক্রোশ দূরে অবস্থিত হইলে প্রতিদিন একবার তাঁহার নিকট গিয়া প্রণাম করিবে। গুরু অর্দ্ধযোজন দূরে থাকিলে শিষ্য পঞ্চ পর্ব্বে গিয়ে বন্দনা করিবে, যদি এক যোজন হইতে দ্বাদশ যোজন মধ্যে অবস্থিতি করেন, তাহা হইলে যোজনসংখ্যক মাসে গিয়া প্রণাম করিবে। যদি গুরুদেব অতি দূরদেশে থাকেন, তাহা হইলে প্রতি বর্ষে বর্ষে এক এক বার গিয়া শিষ্য তাঁহার চরণ বন্দনা করিবে।।
> যামলে –
জামলে লিখিত আছে, যে, – যে ব্যক্তি গুরুর নিন্দা করে, সে গতশ্রী ও গতায়ু হইয়া শতকোটি কল্প নরকে নিমগ্ন থাকে।।
> পুরশ্চরণরসোল্লাসে –
লিখিত আছে, যে, – গুরুকে সর্বদা শিবময় ভাবনা করিবে। গুরু পুত্রকে গণেশসদৃশ, বধূকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী ন্যায় এবং গুরুর কুল ভৈরবগণ সদৃশ বিবেচনা করিতে হয়।
> বৃহন্নীলতন্ত্রে –
লিখিত আছে, যে, – গুরুর অভাবে গুরুপত্নীর অর্চ্চনা করিবে। তাঁহার অভাবে গুরুপুত্র, গুরুপুত্রের অভাবে গুরুকন্যা, গুরুকন্যার অভাবে গুরুস্নুষা এবং এই সকলের অভাবে গুরুবংশীয় অপরের পূজা করিবে। যদি তদ্ধংশীয়গণেরও অভাব হয়, তাহা হইলে গুরুর মাতামহ, মাতূল ও মাতুলানীর পূজা করিতে হয়।।
> গুরুগীতা –
লিখিত আছে, যে, – যে ব্যক্তি প্রতিদিন ভক্তিসহকারে গুরুর পাদোদক পান করেন, তিনি সার্দ্ধত্রিকোটি তীর্থের ফল প্রাপ্ত হন ।।
> গুপ্তসাধনতন্ত্রে –
কথিত আছে, যে, – যে ব্যক্তি ত্রিসন্ধ্যা গুরুর পাদোদক পান করেন, সংসাররূপ মোহপথে তাঁহাকে আর পুনরাগমন করিতে হয় না এবং যে ব্যক্তি ভক্তিসহকারে গুরুপাদোদক শিরোপরি ধারণ করেন, তিনি সর্ব্বতীর্থের ফল প্রাপ্ত হন ।।
> যোগিনীতন্ত্রে –
কথিত আছে, যে, – গুরুর উচ্ছিষ্ট ও গুরুপুত্রের উচ্ছিষ্ট ভক্তিসহকারে ভোজন করিবে, যদি তাহাতে ঘৃণা বোধ করে, তাহা হইলে অধোগতি প্রাপ্ত হয় ।।
> কুলার্ণবে –
লিখিত আছে, যে, – গুরুর পাদুকা, ছত্র, শয্যা ও ভূষণাদি দর্শন মাত্র নমস্কার করিবে, সেই সমস্ত দ্রব্য কদাচ নিজে ভোগ করিবে না ।।
> গুরুগীতা –
কথিত আছে, যে, – গুরু যেরূপ উপদেশ প্রদান করিবেন, তাহাতেই মনঃশুদ্ধি করিবে। গুরু সৎই বলুন আর অসৎই বলুন তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা উচিত নহে। গুরুর নিকট কদাচ মিথ্যা বাক্য প্রয়োগ করিবে না ।।
> পিচ্ছিলাতন্ত্রে –
লিখিত আছে, যে, – যে ব্যক্তি ধর্ম্মবিমোহিত হইয়া পৈতৃক কুরুকুল পরিত্যাগ করে, সেই ব্যক্তি যে পর্য্যন্ত চন্দ্রসূর্য ধরাতলে অবস্থিত থাকে, তাবৎ কাল ঘোর নরকে পতিত হয় ।।
16. জামলে –
লিখিত আছে, যে, – গুরু, গুরুপুত্র, গুরুপত্নী ও গুরুর বন্ধুগণের দোষ কদাচ প্রকাশ করিবে না; ইঁহাদিগের কোন দ্রব্য ভক্ষণ করা উচিত নহে। কিন্তু তাঁহারে আপন ইচ্ছানুসারে প্রদান করিলে তাহা ভক্ষণ করিতে পারে।।
> কুলাগমে –
লিখিত আছে, যে, – যদি পূজাকালে গুরু, গুরুপত্নী বাঁ গুরুপুত্র সমাগত হন, তাহা হইলে পূজা পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাঁহাদিগেরই অর্চ্চনা করিবে; ইহাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। সেই দিন শিষ্যের পক্ষে কোটি সূর্য্যগ্রহণের তুল্য। হে দেবি ! চন্দ্রগ্রহণ দিবসের ন্যায় সেই দিন শিষ্যের পক্ষে পরম শুভপ্রদ জানিবে।।
গুরুর দর্শনমাত্র সর্ব্বপাপ দূরীভূত হয়। হে দেবি ! গুরুকে দর্শন করিবা মাত্র তৎক্ষণাৎ দান করিবে। গুরুর প্রীতি সাধন হইলে দেবতার প্রীতি সাধন হয় এবং দেবতা সন্তুষ্ট হইলে মন্ত্র সিদ্ধি হইয়া থাকে।।
> মুন্ডমালাতন্ত্রে –
লিখিত আছে, যে, – গুরুর পূজা না করিয়া যে ব্যক্তি ইষ্টদেবতার অর্চ্চনা করে, ভৈরব স্বয়ং তাহার মন্ত্রের তেজ হরণ করেন।।
> রুদ্রযামলে –
লিখিত আছে, যে, -শিষ্য গুরুর সহিত কোন দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয় বাঁ গুরুকে ঋণদান অথবা গুরুর নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিবে না।

Courtesy by: Prithwish Ghosh

Share:

২৭ জুন ২০১৫

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জুন ২৭, ১৮৩৮- এপ্রিল ৮, ১৮৯৪) উনিশ শতকের বাঙালি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তাঁর অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁকে সাধারণত প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে গীতার ব্যাখ্যাদাতা হিসাবে, সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তিনি বিশেষ খ্যাতিমান। তিনি জীবিকাসূত্রে ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছদ্মনাম হিসেবে কমলাকান্ত নামটি বেছে নিয়েছিলেন।

জন্ম ও বংশপরিচয়
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁটালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৭ জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁটালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের পূর্বে তাঁর আরও দুই পুত্র জন্মান – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

শিক্ষা

জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যাননি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তাঁর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হননি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।”

১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তাঁর স্কুলে ভরতি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন; তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁটালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁটালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভাল আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাঁকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তাঁর পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল।

কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশুনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মত বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।

তার বাবার মতো তিনিও সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্‌টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারী কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরনের দার্শনিক হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত।


বিবাহ

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিয়ে হয় ১৮৪৯ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১১ বছর। নারায়নপুর গ্রামের এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু চাকুরি জীবনের শুরুতে যশোর অবস্থান কালে ১৮৫৯ সালে এ পত্নীর মৃত্যু হয়। অতঃপর ১৮৬০ সালের জুন মাসে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।


কর্মজীবন

তাঁর কর্মজীবনের সংক্ষেপিত তালিকা:

যশোর - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের তারিখ: ১৮৫৮, ৭ আগস্ট
নেগুয়া (মেদিনীপুর) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সালঃ ১৮৬০, ৯ ফেব্রুয়ারি
খুলনা - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সালঃ ১৮৬০, ৯ নভেম্বর
বারুইপুর (২৪ পরগনা) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সালঃ ১৮৬৪, ৫ মার্চ
মুর্শিদাবাদ - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - উচ্চতর কার্যভার গ্রহণের তারিখ: ১৮৬৯, ১৫ ডিসেম্বর।
মুর্শিদাবাদ- কালেক্টর - পদোন্নতির তারিখ: ১৮৭১, ১০ জুন।
কলিকাতা - বেঙ্গল গনর্মেন্টের অ্যাসিটেন্ট সেক্রেটারি - যোগদানের তারিখ: ১৮৮১, ৪ সেপ্টেম্বর।
আলিপুর - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮২, ২৬ জানুয়ারি।
জাজপুর (কটক) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৩, ৮ আগস্ট।
হাবড়া - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি।
ঝিনাইদহ - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৫, ১ জুলাই।
অবসরগ্রহণের তারিখ: ১৮৯১, ১৪ সেপ্টেম্বর।

মৃত্যূ

শেষ জীবনে তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)।



উপন্যাস
  • দুর্গেশনন্দিনী
  • কপালকুণ্ডলা
  • মৃণালিনী
  • বিষবৃক্ষ
  • ইন্দিরা
  • যুগলাঙ্গুরীয়
  • চন্দ্রশেখর
  • রাধারানী
  • রজনী
  • কৃষ্ণকান্তের উইল
  • রাজসিংহ
  • আনন্দমঠ
  • দেবী চৌধুরানী
  • সীতারাম
  • উপকথা
(ইন্দিরা,যুগলাঙ্গুরীয় ও রাধারানী ত্রয়ী সংগ্রহ)
  • Rajmohan's Wife
প্রবন্ধ গ্রন্থ
  • কমলাকান্তের দপ্তর
  • লোকরহস্য
  • কৃষ্ণ চরিত্র
  • বিজ্ঞানরহস্য
  • বিবিধ সমালোচনা
  • প্রবন্ধ-পুস্তক
  • সাম্য
  • কৃষ্ণ চরিত্র
  • বিবিধ প্রবন্ধ
বিবিধ
  • ললিতা (পুরাকালিক গল্প)
  • ধর্ম্মতত্ত্ব
  • সহজ রচনা শিক্ষা
  • শ্রীমদ্ভগবদগীতা
  • কবিতাপুস্তক
(কিছু কবিতা, এবং ললিতা ও মানস)
সম্পাদিত গ্রন্থাবলী
  • দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী
  • বাঙ্গলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান
  • সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
Share:

২৫ জুন ২০১৫

শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য

এই কাব্যের নাম কেউ শুনেছেন কিনা জানি না, তবে বাংলায় এই কাব্য ও এঁর লেখকের নাম গুপ্তই থেকে গেছে । এই কাব্যের রচয়িতা হলেন মালাধর বসু । বর্ধমান জেলায় এঁনার জন্ম, পিতার নাম ভগীরথ বসু ও মাতার নাম ইন্দুমতী দেবী । তিনি পঞ্চদশ শতকের কবি ছিলেন । ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিনি শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য রচনা শুরু ও সমাপন করেন । এই কাব্যকে “শ্রীকৃষ্ণবিক্রম” ও “গোবিন্দবিজয়” কাব্য নামে আখ্যায়িত করা হয় । এই কাব্য তিনটি পর্বে বিভক্ত । প্রথম পর্বে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, দ্বিতীয় পর্বে কংস বধ থেকে দ্বারকা স্থাপন লীলা, তৃতীয় পর্বে শ্রীকৃষ্ণের অসুর বধ, বিবাহ, বানাসুর দমন , মহাভারতের কাহানী সকল স্থান লাভ করেছে । প্রশ্ন হোলো সুলতানী যুগে সারা বঙ্গপ্রদেশ জুড়ে যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐ ১২ বছর অবধি মাধুর্য লীলা নিয়ে এত এত কাতারে কাতারে পদ লেখা হচ্ছিল্ল তখন মালাধর বসু সেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে কেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বীর ও অসুর দলন রূপটিকে ফুটিয়ে তুললেন ? এর উত্তর পাওয়া যায় তৎকালীন ভারতবর্ষ তথা বঙ্গপ্রদেশে ঘটনাচক্রের মধ্য দিয়ে, ভারতবর্ষে তখন সুলতানী শাসন, বঙ্গে গৌড়ে বিধর্মী শাসন । হিন্দু বাঙ্গালী ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু , উপরন্তু বলপূর্বক বাদশার ধর্মান্তরিত করন প্রক্রিয়া হিন্দু বাঙ্গালীর জীবনে কালো বিভীষিকাময় দিন এনেছিলো । মালাধর বসু এই তথ্য উপলব্ধি করে তিনি শ্রীকৃষ্ণের বীর ও অসুর ধ্বংস রূপটিকে পদাবলী কীর্তনে প্রকাশিত করলেন ।

মালাধর বসু সংস্কৃতে পাণ্ডিত্য অর্জন করলেও কীর্তন রচনায় বাংলা ভাষাকেই বেছেছেন । কারন সংস্কৃত ভাষা সেই সময় সর্বসাধারণের আয়ত্তে ছিলো না । গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি মহাভারত, ভাগবত, বিষ্ণু পুরাণ, লিঙ্গ পুরান ও হরিবংশ পুরান, যোগশাস্ত্র থেকে কিছু কিছু ঘটনা নিয়েছেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন যোগেশ্বর । সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অংশবিশেষ নিলেও তিনি বাংলা সত্ত্বাকে বিসর্জন দেননি । বৃন্দাবন, মথুরা, দ্বারকা স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আহার, সংস্কৃতি রচনার সময় তিনি বাংলার প্রকৃতিকেই বেছেছেন । যেমন আম-জাম-কাঠাল- সুপারী- তাল বন কিংবা পদ্ম- কনকচাঁপা – টগর পুস্প আহারের তালিকায় বাঙ্গালীর খাদ্য ভাত- ডাল কে গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন । হ্যা বৃন্দাবন লীলায় তিনিও পূর্ববর্তী পদাকারদের অনুসরণ করে সখী প্রেম উপস্থাপন করেছেন তবে বেশীর ভাগ অধ্যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বীর রূপকে প্রস্ফুটিত করেছেন । বৃন্দাবনে থাকবার সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেবল সখী প্রেমে মত্ত ছিলেন না তিনি অসুর বধও করেছেন । পূতনা , তৃনাবর্ত, কাকাসুর, ধেনুক অসুর, বকাসুর, অঘাসুর, কেশী ইত্যাদি রাক্ষসী ও দানব সংহার করেছেন । মাধুর্য রসের কীর্তনে এগুলি উধাও সেখানে কেবল দোল, ঝুলন, রাস, কুণ্ডলীলা, বাঁশী বাজানো, কদমতলার প্রেম , সখী প্রেম উপরন্তু চন্দ্রাবলী নামক আরোও একটি চরিত্রের সৃষ্টি ।

পদাবলী কীর্তন অতি মধুর এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, বিশেষ করে মাধুর্য ভক্তির বিকাশে । কিন্তু দিবারাত্র কেবল পদাবলী কীর্তন আর কান্নাকাটি করলে বোধ হয় হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে না । তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চক্র শঙ্খ ধারী বীর রূপ হিন্দু বাঙ্গালীর মানসে পূজিত হওয়া দরকার – সেই অনুসরণ করে স্বধর্ম ও দেশরক্ষা দরকার । তাই মালাধর বসু এই কাব্যটি রচনা করেছেন । পদাবলীতে কিছু শ্লোক আছে । সেখানে একস্থানে রাধারানী বলছেন- “বঁধু কেমনে ধরিব হিয়া- আমারি বঁধু পরগৃহে যায় আমার সম্মুখ দিয়া।” চন্দ্রাবলীর গৃহে শ্রীকৃষ্ণ যাচ্ছেন দেখে রাধারানী আক্ষেপ করে বলেছেন । এখন ভাবুন আমরা যদি সর্বক্ষণ এইগুলি কীর্তন করি তাহলে সেই বীর রূপ জাগবে কি ? ধরুন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এইসব কীর্তন সর্বক্ষণ শোনানো হোলো, সেনারা ভক্তিপ্রেমে গদ্গদ হয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলো- এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনা যদি ভারতের সেনাদের ওপর হামলা করে তাহলে সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে কি? পদাবলী কীর্তন ভক্তি মাধুর্যের প্রতীক । তাই বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের বীর রূপ ফুটিয়ে পরাধীন ভারতে বিপ্লবীদের উজ্জীবিত করেছেন । তাঁরা সেই বীর চরিত্রে উদ্ভুত হয়ে দেশমাতার জন্য লড়েছেন- শহীদ হয়েছেন । এঁনারা যদি সেসময় কেবল ঐ সখী প্রেম আর বৃন্দাবন লীলায় মজে থাকতেন তবে আজকে আমি আপনি এসময় ফেসবুক নয়- কোনো ব্রিটিশ সাহবের পদসেবায় রত থাকতাম ।

লিখেছনঃ কমল


Share:

২৪ জুন ২০১৫

আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে কী নেই?

ওঁ তৎসৎ, কঠোপনিষদে যম বলছেন,
শ্রেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেত স্তো সম্পরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ।
শ্রেয়ো হি ধীরো অভি প্রেয়শো বৃণীতে প্রেয়ো মন্দো য়োগক্ষেমাদ্ বৃণীতে।।
অর্থাৎ শ্রে এবং প্রেয় যেন মানুষকে পরস্পর মিলিত হয়ে আশ্রয় করেন। যিনি ধীর তিনি প্রেয় অপেক্ষা শ্রেয়কে উত্তম বলে মনে করেন। কিন্তু যিনি সত্যি অল্পবুদ্ধি তিনি অস্থায়ী সুখের জন্য প্রেয়কে বেশি গুরুত্ব দেন।
আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে কী নেই? এমন চমৎকার বাণী রয়েছে যা আমাদের সমস্ত ভুল বুঝাবুঝির নিরসন করবেন।
উক্ত বাণীর আলোকে বলি, সত্য ও হিতকর বাক্য অপ্রিয় হলেও গ্রহণ করতে হয় যেমন ঔষধ। ঔষধ কি আমাদের রুচিমত না হলেও গ্রহণ না করে পারি? না। তাহলে কেন আমরা সমাজের এত দোষ প্রত্যক্ষ করেও সবার প্রিয় থাকার লোভে নীরব থাকবো? কেন আমাদের কে মিষ্টি কথার জন্য কান পেতে থাকতে হবে? কেন অনুরোধ করতে হবে যে, অসৎ গুরুকে নিন্দা না করে কেবল বন্দনা করুন বা গুরু নিন্দা আমরা সহ্য করতে পারি না? কেন আমরা সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শকে লাইক না করে শুধু মুখের মিষ্টিকে পছন্দ করবো?
মুখের মিষ্টির চেয়ে অন্তরের মিষ্টি কি বেশি হতে পারে না?
কেন আমাদের সব কথা আপনার মনো মত না হয়ে সত্য হলেও গ্রহণ করতে পারেবন না?
তা যদি না পারেন তাহলে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় উপাধী সত্যি ব্যাধি হয়ে দেখা দিবে না?
কেন আপনার মনমতো না হলে চলে যাবেন?
এমন ত কথা ছিল না!
যদি চলেই যান তাহলে আপনি কি ঠকবেন না ঐ ঠকবাজদের কাছে?
আমরা যে সমাজ সংস্কার ব্রত ধারণ করেছি তা অতীতে মাত্র এক এক জন বীর পুরুষের দ্বারাও সংগঠিত হয়েছিল! আমরা আজ সবাই মিলে করার কারণ সমাজে হিতকারীর চেয়ে ক্ষতিকারী বেড়ে গেছে। আপনি আমাদের সংগ পরিত্যাগ করলে নিশ্চই ওদের সঙ্গে না গিয়ে পারবেন কি? যাদের দ্বারা আপনার কোন উত্থানতো হবে না বরং ভয়ানক অধপতনই অনিবার্য!
স্বয়ং বিচার করুন।
ধন্যবাদ।
কেবল বেদানুগামীদেরই কল্যাণ প্রার্থনা করি।
কারণ এই প্রার্থনা বেদেই ধ্বনিত হয়েছে।


Arya Sebananda
Share:

পৃথিবীতে সূর্যঘড়ির কথা প্রথম কোথায় পাওয়া যায়? বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম সূর্যঘড়ি কাদের অবদান, এটি কোথায় অবস্থিত?


উত্তর: পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সূর্যঘড়ির কথা পাওয়া যায় অথর্ববেদে। পরে ভাস্করাচার্য্য এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে সূর্যঘড়ি তৈরি করেছিলেন।
রাজস্থানের জয়পুরের যন্তর মন্তর কয়েকটি জ্যোতির্বিজ্ঞান যন্ত্র স্থাপত্যের সমষ্টি। ১৭২৭ থেকে ১৭৩৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মহারাজা দ্বিতীয় জয়সিংহ তাঁর নতুন রাজধানী জয়পুরে মুঘল রাজধানী দিল্লিতে তাঁরই নির্মিত যন্তর মন্তরের আদলে এটি নির্মাণ করেন।
এর মাধ্যমে স্থানীয় সময়, সূর্যের বিষুবলম্ব ও উন্নতি কোণ পরিমাণ করা যায় এমনকি এই ঘড়ির মাধ্যমে গ্রহণও নির্ধারণ করা যায়। ১৫ সেকেন্ডে মধ্যে নির্ভুল সময় নির্ণয় করা সম্ভব। এটি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সূর্যঘড়ি। এর অনুরূপ ঘড়ি মানমন্দির দিল্লি, উজ্জ্বয়িনী, মথুরাতে ও কাশীতে রয়েছে। তিনি এই রকম পাঁচটি স্থাপনা পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নির্মাণ করেছিলেন। তার মধ্যে দুটি দিল্লি ও জয়পুরে অবস্থিত। জয়পুর মানমন্দিরটি ছিল বৃহত্তম এবং এখানে তিনি ২০টি স্থায়ী যন্ত্র বসিয়েছিলেন। সূর্যের ছায়া থেকে পৃথিবীর অক্ষাংশ নির্ণয় করে এর মাধ্যমে সময় গণনা করা হয়।
এর সূক্ষ্ম সময় নির্ণয় ব্যবস্থা ও নির্ভুল হিসেবের প্রেক্ষিতে ইউনেস্কো এই সূর্যঘড়িকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় সাংস্কৃতিক সম্পত্তি রূপে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
পৃথিবীর এই বৃহত্তম সূর্যঘড়ি বৈদিক ঋষিদের অবদান।
_____________
বি.দ্র. এটি ‪#‎প্রশ্নোত্তরে‬ হিন্দুধর্ম নামক বই (প্রকাশের অপেক্ষায়) এর একটি প্রশ্ন, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের একটি প্রচেষ্টা। তাই কেউ কপি পেস্ট করে নিজেদের নামে চালাবেন না। প্রচার হোক কিন্তু ঋণ স্বীকার করুন। ধন্যবাদ।

Courtesy by: Sanjoy Sarker
Share:

গীতা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী

দেখা যাক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার নিজের সম্পর্কে গীতায় কি বলেছেন।

১/ যে ব্যক্তি কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়,তার মন সংযত নয়। (২/৬৬)
২/ সকলেই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।(৪/১১)
৩/ আমি সর্বলোকের মহেশ্বর (মহা+ঈশ্বর)।(৫/২৯)
৪/ আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের মূল কারণ। (৭/৬)
৫/ আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। (৭/৭)
৬/ পরমাত্মা রুপে আমি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করি। (৭/২১)
৭/ পরমেশ্বর ভগবান রুপে আমি অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূূর্ণরুপে অবগত। (৭/২৬)
৮/ আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পূর্ণজন্ম হয় না। (৮/১৬)
৯/ সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর ভগবানকে অনন্যা ভক্তির মাধ্যমেই কেবল লাভ করা যায়। (৮/২২)
১০/ অব্যক্ত রুপে আমি সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত আছি। (৯/৪)
১১/ আমি নিজেই সমস্ত সৃষ্টির উৎস। (৯/৫)
১২/ এই জগৎ আমারই প্রকৃতির অধীন। (৯/৮)
১৩/ আমিই এই জগতের পিতা। (৯/১৭)
১৪/ আমিই এই জগতের বিধাতা (সৃষ্টিকর্তা) । (৯/১৭)
১৫/ আমি সকলের গতি। (৯/১৮)
১৬/ আমি তাপ প্রদান করি এবং আমি বৃষ্টি বর্ষণ করি ও আকর্ষণ করি। (৯/১৯)
১৭/ আমিই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু। (৯/২৪)
১৮/ আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। (৯/২৯)
১৯/ সব কিছু আমার থেকে প্রবর্তিত হয়। (১০/৮)
২০/ মনুষ্যদের মধ্যে আমি সম্রাট। (১০/২৭)
২১/ অব্যয় অমৃতের,শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের আমিই আশ্রয়। (১৪/২৭)
২২/ আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ। (১৫/১৫)
২৩/ বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত। (১৫/১৮)
২৪/ সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরনাগত হও। (১৮/৬৬)

Samir Pondit

Share:

মহারানী লক্ষী বাঈ

মহারানী লক্ষী বাঈ হিন্দুর চির পবিত্র তীর্থ বারানসিতে ১৮৩৫ সালের ১৯শে নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন ।তার পিতা মোরাপন্ত রাও পেশওয়ের অধিকর্তা বাজি রাওয়ের দরবারে কাজ করতেন ।ছোট বেলায় তার নাম ছিল মনু বাঈ । ৩/৪বছর বয়সে তার মা মারা যায় ।মনু বাঈ বিঠুর রাজপ্রাসদে ছিলেন সকলের চোখের মনি ।বাজি রাও তাকে আদর করে "ছবেলী" বলে ডাকতেন । ছবেলী মানে ময়না পাখী ।তিনি ছিলেন সুন্দরী বুদ্ধিমতি এবং তার আরেকটি বড় গুন ছিল তিনি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারতেন ।তাই এরকম নাম দেওয়া হয়েছিল ।

বাজি রাও নিঃসন্তান ছিলেন ,তার দত্তক পুত্র নানা সাহেবকে ছবেলী ভাই বলে ডাকতেন এবং প্রতি বছর তাকে ভাইফোঁটা দিতেন । তিনিও ছবেলীকে ছোট বোন বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দুই ভাই বোনের জীবনে একই পরিনতি ঘটে ।ছোট বেলায় লক্ষী বাঈ দাদা নানা সাহেবের সাথে তাতিয়া টোপের কাছে সমরবিদ্যা, আস্ত্রবিদ্যা ,অশ্বচালনা ইত্যাদি শিক্ষা গ্রহন করেন এবং সেই সাথে পড়াশোনাও শিখে ফেলেন ।

ঈশ্বরের প্রতি অসীম ভক্তি ছিল এই মারাঠি বালিকার ,পরিনত বয়সে বিয়ের পর যখন তার স্বামী বিয়োগ ঘটে, তখন তিনি প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠতেন, স্নান সরে শিবপূজা করতেন তারপর অশ্বচালনা।এসব শেষে আবার স্নান সেরে দান করতেন, সেই সাথে প্রতিদিন ১১শত বার রাম নাম চন্দন দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে কগজে লিখতেন।সে সময় ইংরেজরা তাদের অনুষ্ঠানে প্রচুর গোহত্যা করত।এটার বিরুদ্ধে রাণী বৃট্রিশ সরকারের কাছে আবেদন করেন।যাই হোক মাত্র আট বছর বয়সে তত্কালীন ভারতবর্ষের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু পরাক্রমশালী রাজ্য ঝাঁশীর নরেশ মহারাজ গঙ্গাধর রাওয়ের সাথে তার বিয়ে হয় ।মহারাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী অনুযায়ী নতুন বধূ ঘরে আসলে তার নতুন একটি নাম করন করতে হয় ।তাই ঝাঁশীতে এসে তার নাম হল মহারানী লক্ষী বাঈ ।

এই নামেই তিনি জগতবিখ্যাত হলেন ।তার একটি পুত্র সন্তান হয় বিয়ের পর, কিন্তু মাত্র তিন মাস বয়সে সে মারা যায় ।সেই শোকে মহারাজ গঙ্গাধর রাও মারা যান ।তবে মারা যাবার আগে তিনি দত্তক পুত্র গ্রহন করেন ।যার নাম ছিল দামোদর রাও ।রাজার মৃত্যুর পরেই ইংরেজরা ঝাঁশি দখলের ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয় ।এসময় বৃটিশরা নতুন আইন তৈরি করে যে দত্তক পুত্র রাজ্যাধিকার পাবে না।এদিকে তার পুত্র দামোদর রাও যেমন দত্তক পুত্র তেমনি ও দিকে লক্ষী বাঈ এর ভাই নানা সাহেবও দত্তক পুত্র ছিলেন ।রাণী এই নিয়মের তীব্র প্রতিবাদ করলেন ।

এরমধ্যে সদাশিব রাও ঝাঁশি অক্রমন করলেন । রানী তাদের প্রবল পরাক্রমে পরাজিত করলেন এবং সদাশিব রাও কে বন্দি করলেন ।তারপর বিশ হাজার সৈন্য সহ নথে খা ঝাঁশি আক্রমন করলে তিনি তাকেও পরাজিত করলেন।
এর পর স্যার Sir Hugh Rose নেতৃত্বে ইংরেজরা ঝাঁশি আক্রমন করল ।পরাক্রমশালী রাণী পুরুষবেশে ঝাপিয়ে পড়লেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ।কিন্তু কিছু দিন যুদ্ধ চলবার পরই তার সমরঅস্ত্রের রসদ ফুরিয়ে যায় এবং বেঈমান আত্মিয়রা দূর্গের দরজা খুলে দেয় ।তখন তিনি পলিয়ে যান ভাই নানা সাহেবের কাছে ।তারপর তারা গোয়ালিয়র দূর্গ দখল করেন ।
সেই বিজয়ের আনন্দে নানা সাহেব উত্সবের আয়োজন করেন বোন ছবেলীর নিষেদ সত্ত্বেও আর এটই হয় নানা সাহেবের জীবনের চরম ভুল ।সেই সুযোগে ইংরেজরা আক্রমন করে বসে।রানী আবার যূদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন তার দুই সহচরী মুন্দরা ,কাশী এবং তার অনুগত সৈন্যদের নিয়ে ।
এই সময় সবাই যুদ্ধ স্থল ত্যাগ করেন ।কিন্তু রাণী যুদ্ধ চালিয়ে য়ান ।পরে যুদ্ধস্থল ত্যাগের সময় তার প্রিয় ঘোড়া পবন আহত হয় ।তিনি ঘোড়া পাল্টে নেন কিন্তু নতুন ঘোড়া চলতে গিয়ে সামনে জল দেখে উল্টোদিকে ঘুরে কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যের মধ্যে গিয়ে পড়ে। আর কি, শুরু হয় তলোয়ার যূদ্ধ এবং সে যুদ্ধে পিছন থেকে তার মাথায় আঘাত করে বুকে তলোয়ার ঢূকিয়ে দেওয়া হয় ।আর এভাবেই মহাপরাক্রমশালী রানীর জীবন অবসান হয়।

তার মৃত্যুর পর তার দেহ গঙ্গাধর বাবাজীর কুটিরে নিয়ে চিতায় ভষ্মীভূত করা হয় ।এই মহান বীরাঙ্গনা রাণীর পরাক্রমে ,সমর বিদ্যায় ,শিক্ষায় ,চরিত্রে ধর্মানুভূতিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তার "হর হর মহাদেব " ধ্বনীতে এবং ইংরেজ রাজপুরুষদের বিরুদ্ধে সেই দিপ্ত উচ্চারন "মেরি ঝাঁশি দেঙ্গি নেহি " সে সময় ইংরেজর গর্ভমেন্ট স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ।নিজের স্বদেশ জন্মভূমির প্রতি তার অপরিসীম মমত্ত্ব সর্বপরি একজন নারী হয়ে যা তিনি করে দেখিয়েছ তা সত্যিই বিষ্ময় কর । নিজের জীবন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ কে করেছিলেন সুপ্রসস্ত ।ভারতের সিপাহী যুদ্ধের অন্যতম পুরধা নাইকা তার রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের ।

ইংরেজ সেনাপতি Sir Hugh Rose লক্ষী বাঈ সম্পর্কে বলেছিলেন- রাণীর বংশগৌরব,সৈনিকগণ ও অনুচরদিগের প্রতি তাহার অপরিসীম উদারত,তাহার সর্বপ্রকার বিঘ্ন বিপত্তিতে অবিচলিত দৃঢ়তা,তাহাকে আমাদের প্রভূতক্ষমতাপন্ন ও ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দী করিয়া তুলিয়াছিল।

তথ্যঋন-সিপাহীযুদ্ধের ইতিহাস,রজনীকান্ত গুপ্ত
ছবি- অগ্নি সম্পদ
Share:

বৈদিক পুরুষার্থ

প্রতিটি মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যকে বলা হয় পুরুষার্থ। প্রতিটি মানুষই জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি, সাফল্য, স্বচ্ছন্দ, যশ, খ্যাতি, অমরত্ব(কীর্তিদ্বারা) প্রভৃতি চায়। বৈদিক ঋষিরা মানবজীবনের এই সকল চাওয়া পাওয়াকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। কাম ও আর্থ। এই দুটি শব্দ দ্বারা মানব জীবনের সমস্ত কামনাবাসনা প্রকাশ করা যায়। কাম ও আর্থ না থাকলে জীবন পরিপূর্ণ হয়না বা বলা যায় কাম ও আর্থ ছাড়া জীবনই হয়না। কিন্তু, প্রত্যেকটি কাজেরই কিছু নীতি থাকে। নীতিবর্জিত যেকোন কাজই ব্যক্তি ও সমাজের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে থাকে এবং নীতিভ্রষ্ট সমাজের ধ্বংসই নিয়তি। তাই বৈদিক ঋষিদের মতে, যে নীতিদ্বারা কাম ও আর্থ পরিচালিত হবে, তা হবে ধর্ম। ধর্মই পথ দেখাবে মানুষ, সমাজ ও প্রকৃতির পরস্পর নির্ভরশীল সহাবস্থানের, ঠিক করে দেবে পারস্পরিক সম্পর্কের নৈতিকতা, তৈরি করবে ব্যক্তিত্ব, নির্ধারণ করবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক চরিত্র, উন্মেষ ঘটাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের এবং মানুষের সুপ্ত ঐশ্বরিক গুনসমূহের ধাপে ধাপে চর্চার মাধ্যমে তার মনুষ্যগুণের সর্বোচ্চ পরিস্ফুরন ঘটাবে। আর, এই গুণসমূহের সর্বোচ্চ পরিস্ফুটনের দ্বারা মানুষের সাথে ঈশ্বরের পার্থক্য ঘুচে যাবে, মানুষ হয়ে উঠবে সচ্চিদানন্দ, তাঁর ভেতরকার ব্রহ্ম জেগে উঠবে, আর আত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যাবে। এই, অন্তিম অবস্থাকেই বৈদিক ঋষিরা কাম ও আর্থের বাইরে এক অন্তিম লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যার নাম মোক্ষ।
সুতরাং, বেদ মতে পুরুষার্থ চারটি। যথাঃ কাম, আর্থ, ধর্ম ও মোক্ষ।
ব্যাপারটা আর একটু খোলাসা করা যাক।
বেদমতে ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেননি। বরং, সকল সৃষ্টি ঈশ্বরেরই প্রকাশ। অর্থাৎ, এক ঈশ্বরই সর্বজীবে ও সর্বভূতে অধিষ্ঠিত। সৃষ্টির সাথে ঈশ্বরের গুনগত কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল প্রকাশভেদে। সৃষ্টি গুণে অপূর্ণ ও অপ্রকাশিত, কিন্তু ঈশ্বর সম্পূর্ণ ও প্রকাশিত।
ঈশ্বরকে বলা হয়, সচ্চিদানন্দ। এটি তিনটি শব্দের যুক্তাক্ষর; সত, চিত ও আনন্দ।
সত= যা সর্বদা বিরাজমান; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেয় এবং যা সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। যেমনঃ সৃষ্টি, প্রকৃতি, মহাবিশ্ব ইত্যাদি।
চিত= যিনি সচেতন বা চেতনাধারী। যিনি ন্যায়, অন্যায়, ভুল শুদ্ধ বিচার করতে পারেন, এমন বিবেকবান। যেমনঃ জীবজগত (বিশেষ করে মানুষ)
আনন্দ= যিনি সর্বদা আনন্দময়; সুখ, দুঃখ, জরা, ব্যাধি, রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, জীবন মৃত্যুর অতীত, সর্ব গুণান্বিত, সম্পূর্ণ। চিরসচেতন, সর্বত্র ও অনন্ত।
অর্থাৎ, আমরা দেখি প্রকৃতি বা সৃষ্টি হল সত, জীব হল সত ও চিত উভয়ই। আর ঈশ্বর হল সচ্চিদানন্দ। কারণ, তিনি সত ও চত এর পাশাপাশি পূর্ণ প্রকাশিত আনন্দময়। জীবের (এক্ষেত্রে মানুষের) সাথে ঈশ্বরের পার্থক্য কেবল গুণাবলীর প্রকাশে। মানুষের সুপ্ত, ঈশ্বরের সম্পূর্ণ প্রকাশিত।
মানুষের সুপ্ত চেতনা বা গুণের প্রকাশের অনুঘটক হল ধর্ম।

Courtest by: Ayan Chowdhury

Share:

যোগ (Yoga)

ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুধর্ম ও দর্শনের একটি ঐতিহ্যবাহী শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক সাধনপ্রণালী। "যোগ" শব্দটি পরে হিন্দু ছাড়াও বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের ধ্যানপ্রণালীতে একীভূত হয়েছে। বর্তমানে এটি সমগ্রবিশ্বে সকল ধর্মের মানুষ পালন করে থাকে। হিন্দু দর্শনে যোগের প্রধান শাখাগুলি হল রাজযোগ, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও হঠযোগ। যোগের মূল হিন্দুধর্মের কোথায় বা কে এর প্রবর্তক তা সঠিক নির্ণয় খুব কঠিন, কেননা হিন্দুধর্মের প্রাচীনত্বের সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে যোগ। দেবাদিদেব মহাদেবকে সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী বলা হয়। মহর্ষি পতঞ্জলি আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদর্শনের কাঠামোগত রূপ দেন। পতঞ্জলির যোগসূত্রে যে যোগের উল্লেখ আছে, তা হিন্দু দর্শনের ছয়টি প্রধান শাখার অন্যতম (অন্যান্য শাখাগুলি হলো কপিলের সাংখ্য, গৌতমের ন্যায়, কণাদের বৈশেষিক, জৈমিনীর পূর্ব মীমাংসা ও বাদরায়ানের উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত)। অন্যান্য যেসব হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থে যোগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি হলো উপনিষদ্, ভগবদ্গীতা, হঠযোগ প্রদীপিকা, শিব সংহিতা, বিভিন্ন পুরাণ ও বিভিন্ন তন্ত্রগ্রন্থ। যোগ ইতিহাসের প্রাচীনত্ব অন্তত ৫০০০ বছর বা তারও অধিক।

সংস্কৃত "যোগ" শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। এটি সংস্কৃত "যুজ" ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন, যার অর্থ "নিয়ন্ত্রণ করা", "যুক্ত করা" বা "ঐক্যবদ্ধ করা"। "যোগ" শব্দটির আক্ষরিক অর্থ তাই "যুক্ত করা", "ঐক্যবদ্ধ করা", "সংযোগ" বা "পদ্ধতি"। যিনি যোগ অনুশীলন করেন বা দক্ষতার সহিত উচ্চমার্গের যোগ দর্শন অনুসরণ করেন, তাঁকে যোগী বা যোগিনী বলা হয়।
পতঞ্জলি তাঁর সাধনপাদের দ্বিতীয় সূত্রে যোগের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটিকেই তাঁর সমগ্র গ্রন্থের সংজ্ঞামূলক সূত্র মনে করা হয়:
যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ।। যোগসূত্র ১.২
অর্থাৎ "যোগ হল মনের ("চিত্ত") পরিবর্তন ("বৃত্তি") নিবৃত্তি ("নিরোধ")। অর্থাৎ চিত্তকে বিভিন্ন প্রকার বৃত্তি বা পরিণাম গ্রহণ করিতে না দেওয়াই যোগ। স্বামী বিবেকানন্দ এই সূত্রটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, "Yoga is restraining the mind-stuff (Citta) from taking various forms (Vrittis)."

স্বামী বিবেকানন্দ একে আরও উদাহরণের সাথে স্পষ্ট করেছেন তাঁর পাতঞ্জল যোগসূত্রে- মানুষ ঘুমিয়ে চক্ষু খুলে রাখলেও তার দর্শনের অনুভূতি হয় না। অর্থাৎ চক্ষুর সাথে চিত্তেরও সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আবার তিনি বলেছেন- ‘আমরা হ্রদের তলদেশ দেখিতে পাই না, কারণ উহার উপরিভাগ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গে আবৃত। যখন তরঙ্গগুলি শান্ত হয়, জল স্থির হইয়া যায়, তখনই কেবল উহার তলদেশের ক্ষণিক দর্শন পাওয়া সম্ভব। যদি জল ঘোলা থাকে বা উহা ক্রমাগত নাড়িতে থাকে, তাহা হইলে উহার তলদেশ কখনই দেখা যাইবে না। যদি উহা নির্মল থাকে, এবং উহাতে একটিও তরঙ্গ না থাকে, তবেই আমরা উহার তলদেশ দেখিতে পাইব।.. যিনি মনের এই তরঙ্গগুলি নিজের আয়ত্তে আনিতে পারিয়াছেন, তিনিই শান্ত পুরুষ’।

সমাধিপাদের ২৯ সূত্রের ব্যাখ্যায় বিবেকানন্দ বলেছেন- ‘ক্রমাগত জপ ও চিন্তার ফল অনুভব করিবে- অন্তর্দৃষ্টি ক্রমশঃ বিকশিত হইতেছে এবং মানসিক ও শারীরিক যোগবিঘ্নসমূহ দূরীভূত হইতেছে’। এই কথাগুলোই কোয়ান্টাম নিজেদের মতো করে চালাচ্ছে অথচ তা বহু আগের কথা ও আমাদেরই কথা।

বৈদিক সংহিতায় তপস্বীদের উল্লেখ থাকলেও, তপস্যার (তপঃ) স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক ব্রাহ্মণ গ্রন্থে। সিন্ধু সভ্যতার (৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বিভিন্ন প্রত্নস্থলে পাওয়া সিলমোহরে ধ্যানাসনে উপবিষ্ট ব্যক্তির ছবি পাওয়া গেছে। ধ্যানের মাধ্যমে চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার পদ্ধতি হিন্দুধর্মের বৈদিক ধারায় বর্ণিত হয়েছে। নাসাদীয় সূক্ত এবং ঋগ্বৈদিক যুগেও ধ্যানপ্রণালীর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে।

"যোগ" শব্দটি প্রথম উল্লিখিত হয়েছে কঠোপনিষদে। উক্ত গ্রন্থে "যোগ" শব্দটির অর্থ ইন্দ্রিয় সংযোগ ও মানসিক প্রবৃত্তিগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মাধ্যমে চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়া। যোগ ধারণার বিবর্তন যে সকল গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে, সেগুলি হল উপনিষদসমূহ, মহাভারত, (ভগবদ্গীতা) ও পতঞ্জলির যোগসূত্র । যোগের উল্লেখ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও আছে।

হিন্দু দর্শনে যোগ ছয়টি মূল দার্শনিক শাখার একটি। যোগ শাখাটি সাংখ্য শাখাটির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। পতঞ্জলি বর্ণিত যোগদর্শন সাংখ্য দর্শনের মনস্তত্ত্ব, সৃষ্টি ও জ্ঞান-সংক্রান্ত দর্শন তত্ত্বকে গ্রহণ করলেও, সাংখ্য দর্শনের তুলনায় পতঞ্জলির যোগদর্শন অনেক বেশি ঈশ্বরমুখী।

পতঞ্জলি আনুষ্ঠানিক যোগ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের লোক। যোগসূত্রের সংকলক তিনি। পতঞ্জলির যোগ, যা মনকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায়, তাকে রাজযোগ নামে চিহ্নিত করা হয়। মহর্ষি পতঞ্জলির যোগদর্শন চারটি পাদে (অধ্যায়) বিভক্ত। এগুলো হলো-
১. সমাধিপাদ : এই পাদে যোগের লক্ষণ, স্বরূপ ও প্রাপ্তির উপায় বর্ণনা করা হয়েছে।

২. সাধনপাদ : এই পাদে অবিদ্যাসহ বিভিন্ন প্রকার ক্লেশকে সমস্ত দুঃখের কারণ বলা হয়েছে। এই পাদেই যোগের আটটি অঙ্গের কথা তথা অষ্টাঙ্গ যোগের বর্ণনা রয়েছে।

৩. বিভূতিপাদ : অষ্টাঙ্গ যোগের মধ্যে ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি একত্রে এই তিনটিকে সংযম বলা হয়েছে। সাধক যাতে ভুল করেও সিদ্ধিলাভের প্রলোভনে না পড়েন সেই দিকেও সতর্ক করা হয়েছে।

৪. কৈবল্যপাদ : মুক্তি প্রাপ্তিতে সক্ষম চিত্তের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। যোগদর্শনের জন্য যে যে শঙ্কা তৈরি হতে পারে তার কথাও বলা হয়েছে এই অধ্যায়ে। শেষে সমাধিস্থ পুরুষের স্বরূপ বর্ণনা করে গন্থের শেষ হয়েছে।

রেচক ও কুম্ভক, পতঞ্জলি যোগসূত্র (১:৩৪), আসন, (২:৪৬), প্রাণায়াম (২:৪৯)। পতঞ্জলির পর অন্যান্য যোগীদের প্রধান তিনটি প্রাণ প্রবাহ- ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্মা এগুলো বহুলভাবে হিন্দুধর্ম ও দর্শনের আধ্যাত্মিক জীবনের সাথে জড়িত।

পতঞ্জলির রচনা "অষ্টাঙ্গ যোগ" নামে প্রচলিত ব্যবস্থাটির মূল ভিত্তি। এই অষ্টাঙ্গ যোগের ধারণাটি পাওয়া যায় যোগসূত্রের দ্বিতীয় খণ্ডের ২৯তম সূত্রে। অষ্টাঙ্গ যোগই বর্তমানে প্রচলিত রাজযোগের প্রতিটি প্রকারভেদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই আটটি অঙ্গ হল:

১. যম (পাঁচটি "পরিহার")
অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ।

২. নিয়ম (পাঁচটি "ধার্মিক ক্রিয়া")
পবিত্রতা, সন্তুষ্টি, তপস্যা, সাধ্যায় ও ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণ। 'যম' ও 'নিয়ম' এ দুয়েরই উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয় ও চিত্তবৃত্তিগুলিকে দমন করা এবং এগুলিকে অন্তর্মুখী করে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা।

৩. আসন
যোগ অভ্যাস করার জন্য যে ভঙ্গিমায় শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোনোরূপ কষ্টের কারণ ঘটেনা তাকে আসন বলে। সংক্ষেপে স্থির ও সুখজনকভাবে অবস্থান করার নামই আসন।

৪. প্রাণায়ম ("প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রণ")
প্রাণস্বরূপ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ।

৫. প্রত্যাহার
বাইরের বিষয়গুলি থেকে ইন্দ্রিয়কে সরিয়ে আনা। আসন ও প্রাণায়ামের সাহায্যে শরীরকে নিশ্চল করলেও ইন্দ্রিয় ও মনের চঞ্চলতা সম্পূর্ণ দূর নাও হতে পারে। এরূপ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলোকে বাহ্যবিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হল প্রত্যাহার।

৬. ধারণা
কোনো একটি বিষয়ে মনকে স্থিত করা। কোনো বিশেষ বস্তুতে বা আধারে চিত্তকে নিবিষ্ট বা আবদ্ধ করে রাখাকে ধারণা বলে।

৭. ধ্যান
মনকে ধ্যেয় বিষয়ে বিলীন করা। যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সে বিষয়ে যদি চিত্তে একাত্মতা জন্মায় তাহলে তাকে ধ্যান বলে। এই একাত্মতার অর্থ অবিরতভাবে চিন্তা করতে থাকা।

৮. সমাধি
ধ্যেয়ের সঙ্গে চৈতন্যের বিলোপসাধন। ধ্যান যখন গাঢ় হয় তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমনভাবে নিবষ্ট হয়ে পড়ে যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ধ্যান রূপ প্রক্রিয়া ও ধ্যানের বিষয় উভয়ের প্রভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্তের এই প্রকার অবস্থাকেই সমাধি বলে। এই সমাধি প্রকার - সবিকল্প এবং নির্বিকল্প। সাধকের ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকলে, তাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমধি। তখন তাঁর মনে চিন্তার কোনো লেশমাত্র থাকে না। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর, যোগীর পরম প্রাপ্তি।

এই শাখার মতে, চৈতন্যের সর্বোচ্চ অবস্থায় উঠতে পারলে বৈচিত্র্যময় জগতকে আর মায়া বলে মনে হয় না। প্রতিদিনের জগতকে সত্য মনে হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভ করে। তাঁর আমিত্ব রহিত হয়।
যোগ দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:
১। হঠযোগ
২। রাজযোগ
হঠযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীরকে সুস্থ, সবল ও দীর্ঘায়ু করা। হঠযোগীর ধারণা কোনোরূপ শক্তিকে আয়ত্ত করতে হলেই শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। সাধারণ লোক যোগ বলতে হঠযোগের ব্যায়াম বা আসনগুলোকে বুঝিয়ে থাকে।
রাজযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করা। আর এই পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়াই হচ্ছে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ।

তবে হঠযোগের সঙ্গে রাজযোগের ঘনিষ্ট সম্বন্ধও রয়েছে। সাধনার পূর্বশর্ত হচ্ছে শরীরকে সুস্থ রাখা। "শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম"। অর্থাৎ, 'শরীর মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোনো কর্মই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়'।
হিন্দুধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থে যোগের বর্ণনা রয়েছে। সেগুলো হলো-

বক্ষঃ, গ্রীবা ও শিরোদেশ উন্নতভাবে রাখিয়া, শরীরকে সমভাবে ধারণ করিয়া, ইন্দ্রিয়গুলিকে মনে স্থাপন করিয়া জ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্মস্বরূপ ভেলা দ্বারা সকল ভয়াবহ স্রোত পার হইয়া যান। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ২:৮) এছাড়াও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৬, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মন্ত্রসমূহে যোগ-ধ্যান সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সমুদয় বৃত্তির নিরোধে ধ্যানসিদ্ধি হয়। (সাংখ্য-প্রবচন সূত্র ৩:৩১)
কারণ ধ্যানী পুরুষকে নিশ্চল পৃথিবীর সহিত তুলনা করা হয়। [ব্যাস (বেদান্ত) সূত্র, ৪র্থ অধ্যায়, ১, পাদ, ৯]
শেষ করছি গীতার বাণী দিয়ে। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে যোগ-ধ্যান সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন-
‘মেরুদণ্ড, মস্তক, গ্রীবা সমান ও নিশ্চলভাবে স্থির করে নিজ নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টিস্থাপন করে, অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে, ব্রহ্মচর্যে স্থিত ও প্রশান্তচিত্ত যোগী সতর্কতার সাথে মনকে সংযত করবে।’ (গীতা, ৬:১৩-১৪)
গীতায় এমন আরও বহু শ্লোক আছে। মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, গুরু দ্রোণাচার্য, ব্যাসদেব ও অনেকের ধ্যান ও যোগের উল্লেখ রয়েছে।

অতএব যোগ-ধ্যান-ব্যায়াম এগুলো বহু বহু প্রাচীন সময় থেকে হিন্দুদের জীবন ব্যবস্থার সাথে একীভূত হয়ে আছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা এগুলো অবহেলায় দূরে রেখেছি। অথচ আধুনিক সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ; জীবিতদের মধ্যে বাবা রামদেব, রবি শঙ্করসহ অনেক যোগগুরু এই যোগদর্শনকে বিশ্বের সম্পদ করে তুলেছেন। এমনকি অনেক তারকা ও খেলোয়াড়দের মধ্যে এই যোগদর্শনের প্রভাব থাকায় হিন্দুধর্মের এই সম্পদ বিশ্বসম্পদে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে জাতিসংঘ এই দিবসটিকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া ও আমাদের ঐতিহ্য, এমনকি এর ব্যবহারিক দিক খেয়াল রেখে এই মহান দর্শনকে লালন ও পালন করা হোক যোগ দিবসের মূল প্রেরণা।
__________________________
ঋণ স্বীকার:
১। স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা, ১ম খণ্ড
২। মহর্ষি পতঞ্জলিকৃত যোগ-দর্শন, গীতাপ্রেস গোরক্ষপুর
৩। উইকিপিডিয়া

Written by: Sanjoy Sarker
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।