৩০ জুন ২০১৫

কামাখ্যার সংক্ষিপ্ত কাহিনী


নরকাসুর এর ঘটনা কামরূপের আধ্যাত্মিক উপাখ্যানের সাথে জড়িয়ে আছে। ভগবান নারায়ন যখন বরাহ অবতার ধারন করেন তখন ধরিত্রী দেবীর সাথে মিলনে নরক অসুরের জন্ম হয়। নরক প্রথমে সৎ উত্তম চরিত্রের একজন ব্যাক্তি ছিল।সে সময় কামরূপ কিরাত দের দ্বারা পরিচালিত ছিল। রাজা ছিলেন কিরাত রাজ ঘটক।ধরিত্রীর আশীর্বাদে নরক কিরাত দের যুদ্ধে পরাস্ত ও ঘটক কে বধ করে নিজেই কামরূপের রাজা হন। ভগবান বিষ্ণু, বিদর্ভ রাজ্যের রাজকন্যা মায়ার সাথে, নরকের বিবাহ দিয়ে কিছু আদেশ করেন পুত্রকে। যথা ----
-
‘মহাদেবীং মহামায়াং জগম্মাতরম্বিকাম ।
কামাখ্যাং ত্বং বিনা পুত্র নান্যদেবং যজিষ্যসি ।।
ইতোহন্যথা ত্বং বিহরণ্ হতপ্রানো ভবিষ্যসি ।
তস্মান্নরক যত্নেন সময়ং প্রতিপালয়।।‘ --- (কালিকাপুরান, অষ্টত্রিংশ অধ্যায়, ৪৪-১৪৫)
-
অর্থাৎ- দ্বার প্রান্তে তোমার পুত্র লাভ হইবে । ইতিমধ্যে দেবতা ও ব্রাহ্মণ বিরোধী হবে না এবং আসুরী প্রবৃত্তি প্রদর্শন করবে না। জগত মাতা মহামায়া কামাখ্যা দেবী ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করবে না, অন্যথায় গতপ্রান হবে ।
পুরান মতে নারায়নের নির্দেশ পালন করে নরক অসুর সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগ শাসন করল। অপরদিকে শোনিতপুরের রাজা বলি পুত্র বানের সাথে নরকের বন্ধুত্ব হল। বান ছিল অসুর, কথায় বলে ‘অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। তাই হল, কূট বানের সাথে মিশে নরক অসৎ হল। কামাখ্যা পূজা ত্যাগ করলো, ব্রাহ্মণ হত্যা করতে লাগলো, স্বর্গ দখল করে নিল। স্বর্গ হারা দেবতা গণ প্রজাপতির কাছে নিজেদের দুঃখের কথা বিবরণ করলে প্রজাপতি জানালেন তোমরা মহামায়ার বন্দনা করো। ভগবতী দেবতাদের প্রার্থনায় সাড়া দিলেন। কালিকাপুরান মতে একদিন মহর্ষি বশিষ্ঠ কামাখ্যা দর্শনে যাচ্ছিলেন। সে সময় নরক অসুর তাকে বাঁধা দান করলেন। এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বশিষ্ঠ অভিশাপ দিলেন – ‘তুই যতদিন জীবিত থাকবি, ততদিন জগতমাতা কামাখ্যা দেবী সপরিবারে অন্তর্ধান করুন।’
বশিষ্ঠের অভিশাপে নরকের কাল সময় নির্ধারিত হল। এরপর দেবী মহামায়া কামাখ্যামোহ বিস্তার করে নরকাসুরকে ভ্রমিত করলেন।ভগবান বিষ্ণু সৃষ্টি রক্ষার্থে নিজ পুত্র নরককে সংহার করলেন। নরকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ভগদত্ত কামরূপের রাজা হ’ন। ভগদত্তের বংশ লোপ হলে কামরূপ রাজ্যের পরাক্রম হ্রাস পায়। পরে বিশ্বকর্মা দ্বারা স্থাপিত মন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই পবিত্র, যোনিমুদ্রা, কুন্ড গাছগাছালীতে ঢেকে যায়। পর্বতে হিংস্র জন্তু দের আস্তানা হয়ে ওঠে। স্থানীয় আদিবাসী গণ ঐ জঙ্গলে ঢাকা কুন্ডে পশু পক্ষী বলি দিয়ে পূজা করতো, গবাদি পশু হারালে ঐ কুন্ডে দুগ্ধ দিয়ে মানত করলে- মানত ফলে যেতো।
এরপর বহু পড়ে কোচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ এই পীঠ উদ্ধার ও মন্দির নির্মাণ করেন। কামরূপ অভিযান কালে কোচ (কোচবিহার রাজ বংশ) নরপতি রাজা বিশ্বসিংহ দেবীর এই পীঠ উদ্ধার ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। আহোম রাজার সাথে যুদ্ধ চলার সময় একদিন তিনি ও তাঁর ভাই শিবসিংহ মূল সৈন্য দল থেকে পৃথক হয়ে পড়েন এবং তাঁরা দুজন ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে এই পর্বতে জঙ্গলে ঢাকা কুন্ডের সামনে এসে উপস্থিত হন। তারা জানতেন না সেটি দেবী পীঠ। উভয়ে দেখলেন সামনে এক বৃদ্ধা পূজা করছেন। দুইজন গিয়ে সেই বৃদ্ধার কাছে জল চাইলেন।
বৃদ্ধা বললেন - ‘সামনের ঝর্না থেকে জল পান করো।’
জল পান করে এসে রাজা বিশ্বসিংহ ও তাঁর ভাই শিবসিংহ জানতে চাইলেন এই মৃত্তিকা স্তূপের সামনে কার পূজা করছেন?
বৃদ্ধা জানালো- ‘ইনি দেবী, এখানে যে যা প্রার্থনা ব্যক্ত করে- দেবী তাঁর সেই ইচ্ছাই পূর্ণ করেন, এর অন্যথা হয় না।’
শুনে রাজা বিশ্বসিংহ মনে মনে প্রার্থনা করলেন -- তিনি যেনো তাঁর হারানো সেনাদলকে ফিরে পান। তাঁর রাজ্য যেন নিষ্কণ্টক হয়। মহারাজ সেখানে প্রতিশ্রুতি দিলেন প্রার্থনা পূর্ণ হলে তিনি এখানে সোনার মন্দির ও নিত্য পূজোর ব্যবস্থা করবেন। বৃদ্ধা জানালেন, দেবীকে ছাগাদি বলি, সিঁদুর, গন্ধ, পুস্প, রক্তবস্ত্র, অলংকার দ্বারা পূজা করতে হয়। যাই হোক, মহাদেবী ভবানী কামাখ্যা রাজার ইচ্ছা পূর্ণ করলেন, রাজার বাসনা পূর্ণ হল।
অপর একটি জনশ্রুতি অনুসারে – একদিন রাজা বিশ্বসিংহ ঐ স্থানে এসে ঐ কুন্ডের মাহাত্ম্য শুনলেন। তিনি ভাবলেন পরীক্ষা করে দেখা যাক সত্যই এই কুন্ডে ইচ্ছা পূরনের কোন শক্তি আছে কিনা। এই ভেবে তিনি তার আঙুলের একটি হীরক আংটি ঐ কুন্ডে ফেলে মনে মনে বললেন- ‘যদি কাশীতে গঙ্গা তে আমি এই আংটি ফেরত পাই, তবেই দেবীর মহিমা মানবো।’ এই ঘটনার পর একদা তিনি কাশীধামে গিয়ে তর্পণ কালে ঐ আংটি পুনরায় ফেরত পেলেন। তিনি ঐ কুন্ডের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে আরও জানার জন্য পণ্ডিত দের একটি বিচারসভা বসালেন। পণ্ডিত গণ শাস্ত্র ঘেটে জানালেন যে, ঐ স্থানে দেবী সতীর যোনিদেশ পতিত হয়েছে এবং দেবী সেখানে কামাখ্যা রূপে বিরাজিতা। এই শুনে মহারাজ সেখানে মন্দির নির্মাণে অগ্রসর হলেন।
রাজার আদেশে লোকজন লেগে কাজে নেমে পড়লো। জঙ্গল পরিষ্কার করে কুন্ড উদ্ধারের সময়, বিশ্বকর্মা স্থাপিত মন্দিরের ভিত উদ্ধার হল। যোনীমুদ্রা সহ মূল পীঠ আবিস্কৃত হল। রাজা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সোনায় মুড়ে মন্দির বানাবেন। কিন্তু অত সোনা পাওয়া মুস্কিল।তাই কেবল ইট দ্বারা মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা হল। কিন্তু প্রতি দিন মন্দিরের ইট খসে খসে পড়তে লাগলো। একদা রাজা বিশ্বসিংহ কে স্বপ্নে মা দেখা দিয়ে বললেন – ‘হে রাজন।কি প্রতিজ্ঞা করেছিলে মনে কর, সোনার মন্দির করবে বলেছিলে- তা কি বিস্মৃত হয়েছ?’ রাজা গদগদ হয়ে বলল --- ‘মা সন্তানের অপরাধ ক্ষমা কর। এত স্বর্ণ কোথায় পাবো?’ মা জানালেন- ‘চিন্তার কিছু নাই। প্রতি ইষ্টকে এ এক রতি করে সোনা দিবে।’ রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই মতো মন্দির নির্মাণ করলেন। অসমের শুয়ালকুচি গ্রামের ব্রাহ্মণদের পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করা হল। মন্দির স্থাপনার পর প্রতিষ্ঠা ও নিত্য পূজার ব্যবস্থা করা হল। বর্তমানে সে বংশানুক্রমিক ভাবে সেই পুরোহিতগণই মায়ের নিত্য পূজা করেন। এই স্থানে তন্ত্র, পুরান আলোচনা হতে লাগলো। সাধুরা এখানেই তন্ত্র সাধনা করতে লাগলেন।সেই সব শাস্ত্রের জীর্ণ লিপি এখনও আসামের কিছু স্থানে পাওয়া যায়, কিছু গৃহে দেখা যায়।
১৫৩৪ খ্রীঃ রাজা বিশ্বসিংহের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর পুত্র মল্লদেব ‘নরনারায়ণ’ নাম নিয়ে কোচবিহারের রাজ সিংহাসনে বসেন। রাজা নরনারায়ণ নিজ ভ্রাতা শুক্লধ্বজ কে ‘চিলারায়’ নাম দিয়ে কোচ রাজ্যের সেনাপতি পদে নিযুক্ত করেন। এরপর দুভাই মিলে রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করতে উদ্যোগী হন। ১৫৪৬ খ্রীঃ তারা আহোম রাজ খোরাকে পরাজিত করেন। অপর দিকে তখন গৌড় বঙ্গে ছিল মুসলিম শাসন। নসরৎ শাহের পুত্র ফিরোজ শাহ তখন বাংলার শাসনকর্তা। ১৫৩৮ খ্রীঃ শের খাঁ জোর করে গৌড় দখল করে নেন। আহোম রাজ্যের সাথে যখন কোচ রাজা নরনারায়ণ যুদ্ধে মগ্ন তখন ১৫৫৩ খ্রীঃ কালাপাহাড় কামরূপ আক্রমণ করেন। দেশে রাজা নেই, ফলে কালাপাহাড় বাধাহীন ভাবে একের পর এক মন্দির, মূর্তি, দেবালয় ধ্বংস করে এগিয়ে গেলো। এরপর তার কোপ পড়লো কামাখ্যা মন্দিরে।কালাপাহার কামাখ্যা মন্দিরে উপরিভাগের অনেক প্রাচীন মূর্তি ও স্থাপত্য ধ্বংস করলেন। অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় কোচ রাজা নরনারায়ণ এই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন নি। এখনও কামরূপে গেলে কালাপাহারের হাতে ভাঙ্গচুর হওয়া মূর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মহারাজ নরনারায়ণ ও চিলারায় অনেক স্থান বিজয় করে রাজ্যে এসে কালাপাহারের কীর্তি কলাপ দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে মুসলিম রাজ্য গৌড় আক্রমণ করেন। যুদ্ধ জয়ের আগে চিলারায় কামাখ্যা মন্দিরে এসে ভগ্ন অবস্থা দেখে মন্দির সংস্কারের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। কামাখ্যা দেবীর কাছে যুদ্ধে জয়ের আশীর্বাদ চাইলেন। এই সময় তিনি মন্দিরের পুরোহিত কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে কোন কারনে অপমান করে চলে যান।কেন্দুকেলাই ঠাকুর খুব বড় মাপের ভক্ত পূজারী ছিলেন। তিনি যখন আরতি করতেন মা নিজে এসে দেখা দিতেন, নৃত্য করতেন।অপরদিকে চিলারায় বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে গৌড়ের বাদশা সোলেমানের নিকট পরাজিত ও বন্দী হলেন। একদা কারাবন্দী চিলারায়কে মা কামাখ্যা স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন- “কাল নবাবের মাকে সর্পে দংশন করবে, এতে নবাব এর মাতার জীবন সংশয় উপস্থিত হবে, আমার কৃপায় তুমি তাকে বাঁচিয়ে তুলবে।” ঠিক তাই হল। পরদিন নবাবের মাকে সাপে কাটলো। কত ওঝা, বৈদ্য, হাকিম, কবিরাজ ডাকা হল।সকলের চেষ্টাই বিফল হল।নবাবের মা জীবনের শেষ সীমানায়। তখন চিলারায় জানালো, একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।চিলারায় কে নবাবের মাতার সামনে নিয়ে আসা হল। চিলা রায় কামাখ্যা মায়ের কাছে প্রার্থনা জানালেন। মা কামাখ্যা নবাবের মাকে সুস্থ করে জীবন ফিরিয়ে দিলেন।
এর পর নবাব, চিলারায়ের কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকট করলেন। নবাবের মা চিলারায়কে নিজ পুত্রের মতো স্নেহ করলেন।নবাব সোলেমান, চিলারায়ের সাথে ভাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে সসম্মানে মুক্তি দিলেন। রাজ্যে ফিরে এসে কোচ নৃপতি নরনারায়ণ আর চিলারায় মিলে মন্দির সংস্কারে ব্রত হলেন। ১৫৫৫-১৫৬৫ খ্রীঃ মধ্যে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। শুভ দিনে পূজার জন্য রাজা নরনারায়ণ তাঁর পত্নী রানী ভানুমতী, আর চিলারায় তাঁর পত্নী চন্দ্রপ্রভাকে নিয়ে নীল পর্বতে গমন করলেন। শাস্ত্র মতে পূজা সুসম্পন্ন হল। প্রচুর দান করা হল। রাজা অনেক জমি দেবীর সেবার জন্য দান করলেন।সেবাইত দান করে তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করলেন।এছাড়া নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু সেনা রেখে গেলেন।
কেন্দুকেলাই ঠাকুরের অনেক ভক্তি। মা নিজে এসে ঠাকুরকে দেখা দিতেন, ভোগ খেতেন, আরতির সময় নাচতেন, দরজা বন্ধ করে কেন্দুকেলাই ঠাকুর মায়ের আরতি করতেন, বাইরে ঢাক, দামামা, ঢোল, শঙ্খ, কাঁসর , ভেরী , তুরী বাজতো, ভেতরে ঠাকুর আরতি করতেন, কেউ বাঁধা দিতো না। বাইরের লোক মাঝে মাঝে কেবল ভেতর থেকে ভেসে আসা নূপুরের ধ্বনি শুনতেন। কেউ উঁকিঝুঁকি মারার দুঃসাহস দেখাতো না। যারা সরল মনের ছিলেন তাঁরা কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে খুব ভালোবাসতেন। বিপদে আপদে ঠাকুরের কাছে যেতেন।ঠাকুরের কথা মা শুনতেন। অনেক মৃতপ্রায় লোক মায়ের কৃপায় সুস্থ ও আরোগ্য জীবন লাভ করতো।আর কুটিল মানুষ বিশেষত কিছু পুরোহিত আর রাজ কর্মচারী কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে মোটেও সহ্য করতে পারতো না, নানা অপবাদ দিতো, ভণ্ড বলে গালাগালি করতো। একবার ঠাকুরকে ‘চোর’ বদনাম দেওয়াও হয়েছিল। মায়ের কৃপায় ঠাকুর সেই অপবাদ থেকে মুক্তি পান। তিনি যে নির্দোষ – প্রমানিত হয়। কালে কালে কোচ রাজাও ঠাকুরের কিছুটা বিরোধী হয়ে ওঠেন। কারন কুচক্রী পুরোহিত আর রাজ কর্মচারীরা সমানে ঠাকুরের নামে নানান কথা বানিয়ে বানিয়ে রাজার কান ভরতে লাগলেন। রাজা নরনারায়ণ কোনরূপ সত্যতা যাচাই না করে সেই কুটিল মানসিকতা সম্পন্ন লোকেদের কথা বিশ্বাস করতে লাগলেন।
একদা নরনারায়ণ কামাখ্যা ধামে গিয়ে ঠাকুর কেন্দুকেলাই কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন- “শুনলাম আপনি যখন আরতি করেন, তখন নাকি মা নিজে এসে আপনাকে দর্শন দান করেন, ইহা কি সত্য ?”
কেন্দুকেলাই ঠাকুর জানালেন- “আজ্ঞে যথার্থ শুনেছেন মহারাজ। কৃপাময়ী জননী কৃপা করে আমাকে দর্শন দান দিয়াছেন।”
এই শুনে রাজা নরনারায়ণ খুবুই খুশী হয়ে বললেন- “আমিও দেখতে চাই মাকে। আপনি যখন আরতি করবেন, তখন আমি মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে মায়ের দিব্য রূপ দর্শন করবো।”
কেন্দুকেলাই ঠাকুর খুবুই ভীত হয়ে বললেন- “সাবধান মহারাজ। এভাবে ছলাকলার আশ্রয় করে মায়ের দর্শন আপনি পাবেন না।উল্টে আপনার ক্ষতি হবে। আপনি মায়ের তপস্যা করুন। ব্রহ্মময়ী জননী সন্তুষ্ট হলে তিনি আপনাকে নিশ্চয়ই দর্শন দান দিবেন।”
এভাবে ঠাকুর রাজাকে বুঝিয়ে চলে গেলো। একদা সন্ধ্যা আরতিতে মগ্ন ছিলেন কেন্দুকেলাই ঠাকুর, মন্দিরের দ্বার বন্ধ, ভিতরে ঠাকুর আরতি করছেন, বাইরে নানান বাদ্য বাজছিল, রাজা নরনারায়ণ ও অন্য এক কুটিল পূজারী সেখানে চুপিচুপি এসে উত্তর দিকের গবাক্ষ দিয়ে উকি দিয়ে দেখতে লাগলেন। মহামায়া কামাখ্যা দেবী সব জানতে পারলেন। দেবী ভীষনা ক্রুদ্ধ হয়ে বিকট আওয়াজে দিকবিদিক প্রকম্পিত করে সেই কুটিল পূজারীর মাথায় চপেটাঘাত করে শাপ দিয়ে পাথরের মূর্তিতে পরিণত করলেন। মা কামাখ্যা নরনারায়ণ কে অভিশাপ দিয়ে বলেন- “এই মুহূর্তে তোমাকে নীলাচল পর্বত পরিত্যাগ করতে হবে। তুমি কিংবা তোমার বংশধরেরা যদি কখনো আমার মন্দির বা নীলাচল পর্বতে আসে, তবে সে নির্বংশ হবে।”
এই অভিশাপ পেয়ে রাজা নরনারায়ণ রাজ্যে ফিরে গেলেন, তার পর থেকে এখন অবধি কোচ রাজার বংশধরেরা কোনদিন আর নীলাচল পর্বতে যান না, দেবীর মন্দির বা নীলাচল পর্বত দর্শন করেন না। এরপর মন্দির সেবার ভার পড়ে আহোম রাজগনের ওপর।
-
একটা জিনিষ ভাবার বিষয় রাজা নরনারায়ণের পূর্ব পুরুষ রাজা বিশ্বসিংহ এই কামাখ্যা মন্দির নির্মাণ করেন, রাজা নরনারায়ণ এই মন্দির সংস্কার করেন, কিন্তু মা তাঁদের এমন শাপ কেন দিলেন? বস্তুত মা পাপীদের কোনদিন ক্ষমা করেন না, সে মায়ের যত বড় ভক্তই হোক না কেন। কেন্দুকেলাই ঠাকুরকে বারংবার অপমান, সত্যতার যাচাই না করা- মায়ের ভক্ত হলেও সে রেহাই পাই নি। বস্তুত ভক্ত পাপাচারে লিপ্ত হলে ভগবান তাকে বাঁচান না। শুধরানোর সুযোগ দেন। যেমন মা কামাখ্যা, কেন্দুকেলাই ঠাকুরের মুখ দিয়ে রাজাকে সাবধান করেছিলেন, রাজা শোনেনি। কেন্দুকেলাই ঠাকুরের কথা শুনে রাজা ছলাকলা ত্যাগ করে ভক্তি মার্গ অবলম্বন করলে মায়ের দিব্য দর্শন অবশ্যই পেতেন। রাবন কে ভগবান শিব বাচান নি। ঠিক জরাসন্ধ কে শিব বাঁচান নি। নরক অসুর তার পিতা নারায়নের হাতেই নিহত হয়েছিলেন। সুতরাং ভক্ত যদি পাপাচার করে তার সাত খুন মাফ- এমন ভাবার কোন কারন নেই। ভগবানের চোখে সবাই সমান।এই হল কামাখ্যার সংক্ষিপ্ত কাহিনী ।

Written by: Prithwish Ghosh
Share:

1 Comments:

Unknown বলেছেন...

অনেক জানা অজানা তথ্য জানতে পেরে সমৃদ্ধ হলাম , অনেক ধন্যবাদ।
🙏জয় মা কামাক্ষা 🙏








Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।