২৫ জুন ২০১৫

শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য

এই কাব্যের নাম কেউ শুনেছেন কিনা জানি না, তবে বাংলায় এই কাব্য ও এঁর লেখকের নাম গুপ্তই থেকে গেছে । এই কাব্যের রচয়িতা হলেন মালাধর বসু । বর্ধমান জেলায় এঁনার জন্ম, পিতার নাম ভগীরথ বসু ও মাতার নাম ইন্দুমতী দেবী । তিনি পঞ্চদশ শতকের কবি ছিলেন । ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিনি শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য রচনা শুরু ও সমাপন করেন । এই কাব্যকে “শ্রীকৃষ্ণবিক্রম” ও “গোবিন্দবিজয়” কাব্য নামে আখ্যায়িত করা হয় । এই কাব্য তিনটি পর্বে বিভক্ত । প্রথম পর্বে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, দ্বিতীয় পর্বে কংস বধ থেকে দ্বারকা স্থাপন লীলা, তৃতীয় পর্বে শ্রীকৃষ্ণের অসুর বধ, বিবাহ, বানাসুর দমন , মহাভারতের কাহানী সকল স্থান লাভ করেছে । প্রশ্ন হোলো সুলতানী যুগে সারা বঙ্গপ্রদেশ জুড়ে যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐ ১২ বছর অবধি মাধুর্য লীলা নিয়ে এত এত কাতারে কাতারে পদ লেখা হচ্ছিল্ল তখন মালাধর বসু সেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে কেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বীর ও অসুর দলন রূপটিকে ফুটিয়ে তুললেন ? এর উত্তর পাওয়া যায় তৎকালীন ভারতবর্ষ তথা বঙ্গপ্রদেশে ঘটনাচক্রের মধ্য দিয়ে, ভারতবর্ষে তখন সুলতানী শাসন, বঙ্গে গৌড়ে বিধর্মী শাসন । হিন্দু বাঙ্গালী ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু , উপরন্তু বলপূর্বক বাদশার ধর্মান্তরিত করন প্রক্রিয়া হিন্দু বাঙ্গালীর জীবনে কালো বিভীষিকাময় দিন এনেছিলো । মালাধর বসু এই তথ্য উপলব্ধি করে তিনি শ্রীকৃষ্ণের বীর ও অসুর ধ্বংস রূপটিকে পদাবলী কীর্তনে প্রকাশিত করলেন ।

মালাধর বসু সংস্কৃতে পাণ্ডিত্য অর্জন করলেও কীর্তন রচনায় বাংলা ভাষাকেই বেছেছেন । কারন সংস্কৃত ভাষা সেই সময় সর্বসাধারণের আয়ত্তে ছিলো না । গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি মহাভারত, ভাগবত, বিষ্ণু পুরাণ, লিঙ্গ পুরান ও হরিবংশ পুরান, যোগশাস্ত্র থেকে কিছু কিছু ঘটনা নিয়েছেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন যোগেশ্বর । সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অংশবিশেষ নিলেও তিনি বাংলা সত্ত্বাকে বিসর্জন দেননি । বৃন্দাবন, মথুরা, দ্বারকা স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আহার, সংস্কৃতি রচনার সময় তিনি বাংলার প্রকৃতিকেই বেছেছেন । যেমন আম-জাম-কাঠাল- সুপারী- তাল বন কিংবা পদ্ম- কনকচাঁপা – টগর পুস্প আহারের তালিকায় বাঙ্গালীর খাদ্য ভাত- ডাল কে গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন । হ্যা বৃন্দাবন লীলায় তিনিও পূর্ববর্তী পদাকারদের অনুসরণ করে সখী প্রেম উপস্থাপন করেছেন তবে বেশীর ভাগ অধ্যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বীর রূপকে প্রস্ফুটিত করেছেন । বৃন্দাবনে থাকবার সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেবল সখী প্রেমে মত্ত ছিলেন না তিনি অসুর বধও করেছেন । পূতনা , তৃনাবর্ত, কাকাসুর, ধেনুক অসুর, বকাসুর, অঘাসুর, কেশী ইত্যাদি রাক্ষসী ও দানব সংহার করেছেন । মাধুর্য রসের কীর্তনে এগুলি উধাও সেখানে কেবল দোল, ঝুলন, রাস, কুণ্ডলীলা, বাঁশী বাজানো, কদমতলার প্রেম , সখী প্রেম উপরন্তু চন্দ্রাবলী নামক আরোও একটি চরিত্রের সৃষ্টি ।

পদাবলী কীর্তন অতি মধুর এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, বিশেষ করে মাধুর্য ভক্তির বিকাশে । কিন্তু দিবারাত্র কেবল পদাবলী কীর্তন আর কান্নাকাটি করলে বোধ হয় হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে না । তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চক্র শঙ্খ ধারী বীর রূপ হিন্দু বাঙ্গালীর মানসে পূজিত হওয়া দরকার – সেই অনুসরণ করে স্বধর্ম ও দেশরক্ষা দরকার । তাই মালাধর বসু এই কাব্যটি রচনা করেছেন । পদাবলীতে কিছু শ্লোক আছে । সেখানে একস্থানে রাধারানী বলছেন- “বঁধু কেমনে ধরিব হিয়া- আমারি বঁধু পরগৃহে যায় আমার সম্মুখ দিয়া।” চন্দ্রাবলীর গৃহে শ্রীকৃষ্ণ যাচ্ছেন দেখে রাধারানী আক্ষেপ করে বলেছেন । এখন ভাবুন আমরা যদি সর্বক্ষণ এইগুলি কীর্তন করি তাহলে সেই বীর রূপ জাগবে কি ? ধরুন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এইসব কীর্তন সর্বক্ষণ শোনানো হোলো, সেনারা ভক্তিপ্রেমে গদ্গদ হয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলো- এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনা যদি ভারতের সেনাদের ওপর হামলা করে তাহলে সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে কি? পদাবলী কীর্তন ভক্তি মাধুর্যের প্রতীক । তাই বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের বীর রূপ ফুটিয়ে পরাধীন ভারতে বিপ্লবীদের উজ্জীবিত করেছেন । তাঁরা সেই বীর চরিত্রে উদ্ভুত হয়ে দেশমাতার জন্য লড়েছেন- শহীদ হয়েছেন । এঁনারা যদি সেসময় কেবল ঐ সখী প্রেম আর বৃন্দাবন লীলায় মজে থাকতেন তবে আজকে আমি আপনি এসময় ফেসবুক নয়- কোনো ব্রিটিশ সাহবের পদসেবায় রত থাকতাম ।

লিখেছনঃ কমল


Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।