১৯ অক্টোবর ২০১৫

দেবী দুর্গার মুখ দেখেন না ‘মহিষাসুরের বংশধররা’

শারদ উৎসবে বিশ্বব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পূজিত হন দেবী দুর্গা। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর দেশ ভারতেই এমন কিছু মানুষ আছে, দেবী দুর্গার মুখ দেখা যাদের কাছে পাপ! তাই দুর্গা পূজার কয়েক দিন প্রাণপণে তাঁরা চেষ্টা করেন যাতে দেবীর মূর্তি দেখতে না হয়। কারণ তাঁরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মনে করেন।
ঝাড়খন্ড এবং উত্তরাখন্ডের সীমান্তের আলিপুরদুয়ারা জেলার মাঝেরডাবরি এলাকার একটি গ্রাম অসুরা কিংবা ‘অসুর গ্রাম’। ‘তফশিলী উপজাতি’র অন্তর্গত আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় আট হাজার মানুষের বাস এখানে। পরম্পরা অনুযায়ী নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর দাবি করেন তাঁরা। এই সম্প্রদায়ের পদবীও ‘অসুর’। বহুকাল ধরে বংশপরম্পরায় আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর।

এই বিশ্বাস ব্যাখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ মার্কন্ডেয় পুরাণের আখ্যান অনুসরণ করেন তাঁরা। এই জনগোষ্ঠী মনে করেন, দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধ আসলে দেবতাদের ষড়যন্ত্র। তাই অসুরদের বংশধররা দুর্গাপূজার চারদিন মহিষাসুরের জন্য আলাদা পূজার আয়োজন করে। মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী এই সম্প্রদায় দুর্গাপূজার কয়েকদিন শোক দিবস পালন করেন।

হিন্দু পুরাণের বর্ণনা অনুসারে মহিষাসুর নিজেও একজন রাজার ছেলে। অসুররাজ রম্ভার ছেলে। মহাদেব শিবের বরে রম্ভা এবং মহিষরূপী শাপগ্রস্ত রাজকুমারী শ্যামলার মিলনেই জন্ম হয়েছিল মহিষাসুরের। তাঁর জন্মের পর দেবতা-অসুরের যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে নিহত হন রম্ভা।



এর প্রতিশোধ নিতে ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা শুরু করেন মহিষাসুর। কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন ব্রহ্মা। বরটি ছিল, ত্রিভুবনের কোনো পুরুষই তাঁকে পরাস্ত করতে পারবে না। এই বর পেয়ে আরো পরাক্রমশালী ও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন মহিষাসুর। স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন দেবতাদের। বিতাড়িত দেবতারা শিব ও বিষ্ণুর কাছে তাঁদের দুঃখের বিবরণ দেন। এরপরের ইতিহাস অবশ্য বহুল চর্চিত। দেবালোকেই দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। এরপরের টানা নয়দিনের যুদ্ধে মাতৃরূপী দুর্গার হাতে পরাভব ঘটে অসুররূপী মহিষাসুরের।

অবশ্য এসব পুরাণ কথার বাইরে গিয়ে তফশিলী উপজাতিদের ভাষা ও নৃতাত্তিক বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হরিপ্রসাদ মান্ডা। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে তিনি জানান, এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদি বসবাস ছিল ছোটনাগপুরের এলাকার মালভূমিতে। ব্রিটিশরা এঁদের চা বাগানের কাজে লাগিয়েছিল। সেই থেকে এঁরা থেকে গেছেন উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকায়।

অধ্যাপক হরিপ্রসাদ জানালেন, এই জনগোষ্ঠীর পদবিতে অসুর শব্দ এসেছে বংশপরম্পরায় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। এর নেপথ্যে কোনো লিখিত প্রমাণ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। জনশ্রুতিতে আস্থা রেখেই বংশপরম্পরায় চলে আসছে ধ্যানধারণা।

হরিপ্রসাদ আরো জানান, হিন্দুদের চতুর্বেদের অন্যতম ঋগ্বেদ এবং সামবেদের যুগে ‘অসুর’ বলতে বোঝানো হত শক্তিশালী পুরুষকে। পরে কালক্রমে সেই শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে ‘দানব’ বা ‘বিনাশী’ অর্থ প্রকাশ করে।

তবে দুর্গাপূজার সময় দেবীর মুখ না দেখার এই ঐতিহ্য কতদিন টিকে থাকবে সে নিয়েও সংশয়ে ‘অসুর’ সম্প্রদায়ের প্রবীণরা। কারণ সম্প্রদায়ের নবীন প্রজন্ম মানতে চায় না পুরোনো গল্প। এমনকি অনেকে গা ভাসান চিরাচরিত শারদোৎসবে। আশঙ্কা আর পরম্পরা নিয়ে এভাবেই উজান স্রোতে সাঁতার দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’।
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।