• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

                                               কৈলাশনাথ মন্দির   

১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।





প্রধান মন্দির- নন্দী মন্ডপ-এ লিঙাম অবস্থিত। নন্দী মন্ডপ ১৬ টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে যার উচ্চতা ২৯.৩ মিঃ। নন্দী মডপে একটি বিশাল আকৃতির পাথরের তৈরী হাতি বিদ্যমান। একটি জীবন্ত পাথরের সেতু দ্বারা নন্দী মন্ডপ ও শিব মন্দিরের যোগাযোগ সাধিত হয়েছে। এই স্থাপনাটি তৎকালীন শিল্পীদের প্রতিভার সাক্ষর বহন করে। এই মন্দির তৈরীতে হয় ২,০০,০০০ টন পাথর কেটে, যার জন্য সময় লেগেছিল ১০০ বছর।

ইতিহাসঃ

কৈলাশ নাথ  মন্দিরটির নির্মাতার নাম  শিলালিপিতে না থাকলেও এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে এটি একটি রাষ্ট্রকূটের  রাজা  দ্বারা নির্মান লাভ করেন ।সাধারণত রাষ্ট্রকূটের রাজা কৃষ্ণকে এর নির্মাতা মনে করা হয়  দুটি লিপির  উপর ভিত্তি করে,   যেটায় মন্দিরের সাথে  "কৃষ্ণরাজা" এর (IAST Kṛṣṇarāja) (৭৫৬-৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ)সংযোগ দেখা যায় ।

কর্করাজা-২ ( গুজরাটের একটি  শাখা রাষ্ট্রকূটের শাসক) এর বরোদা তাম্রলিপিতে (৮১২-৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ) বর্তমান গুজরাটের একটি গ্রামে অনুদান দেবার কথা উল্লেখ আছে।  এটায় কৈলাশ নাথের  পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কৃষ্ণরাজার নাম এবং ইলোপুরা (ইলোরা) নামে একটি শিব মন্দিরেরও উল্লেখ আছে ।এটায় বলা ছিল যে, রাজা একটি বিষ্ময়কর মন্দির নির্মান করান যা দেখে দেবতা ও নির্মান শিল্পীরাও আশ্চর্য হয়ে গেলেন ।  অধিকাংশ পন্ডিত মনে করেন যে, এটি একটি তথ্যসূত্র কৈলাসনাথ শিব মন্দিরের ইলোরায় ।

কৈলাস মন্দিরের বৈশিষ্ট্যগুলোয় একাধিক স্বতন্ত্র স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শৈলীর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । মন্দিরের এই অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আকার ও সম্বিলিত গঠনের কারনে , কিছু পণ্ডিতগন  মনে করেন একাধিক রাজাদের রাজত্বকালে এটি নির্মান হয়েছে। কিছু মন্দিরের নির্মান শৈলী একই রকম দশাবতর গুহায় পরিলক্ষ্যিত হয় যা মন্দিরের পাশে অবস্থিত।দশাবতার গুহায় একটি শিলালিপি রয়েছে যেখানে কৃষ্ণরাজার পূর্বসূরীগন ও ভাতিজা দন্তিদূর্গার (৭৩৫-৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ)কথা উল্লেখ রয়েছে ।H. Goetz (১৯৫২) অনুমান করেন, রাজা দন্তিদূর্গার সময় এটি নির্মান কাজ শুরু হয় এবং রাজা কৃষ্ণ তা প্রথম শেষ করেন যেটি বর্তমান মন্দির থেকে অনেক ছোট ।



                                                      ইলোরা গুহাসমূহ



ইলোরা ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ৩০ কিমি (১৮.৬ মাইল) দূরে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রাষ্ট্রকুট রাজবংশ এই নিদর্শনের স্থাপনাগুলো নির্মাণ করেছিল। এখানে রয়েছে প্রচুর স্মৃতি সংবলিত গুহার সারি। এটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে।
ভারতের শিলা কেটে কোন কিছু তৈরি করার প্রাচীন প্রতিরূপ স্থাপত্যটি এখানে অণুসৃত হয়েছে। এখানে মোট ৩৪টি গুহা রয়েছে যেগুলো চরনন্দ্রী পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। গুহাগুলোতে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মন্দিরের স্বাক্ষর রয়েছে। ৫ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে এই ধর্মীয় স্থাপনাগুলো নির্মিত হয়েছিল। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের ১২টি হিন্দু ধর্মের ১৭টি এবং জৈন ধর্মের ৫টি মন্দির রয়েছে। সব ধর্মের উপাসনালয়ের এই সহাবস্থান সে যুগের ভারতবর্ষে ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন বহন করে। ইলোরা –কে ভেলুরা অথবা এলুরা বলা হয়। এটি প্রাচীন এলাপুরা নামের বিকৃত শব্দ। 

ইতিহাসঃ

ইলোরা গুহা মন্দির কালাচুরি, চালুক্য ও রাষ্ট্রকুট শাসনামলে তৈরী হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। নবম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকুটের শাসনামলে তৈরী হয় জগন্নাথ সভা (পাচটি জৈন মন্দিরের সমষ্টি)


০১। বৌদ্ধ গুহাসমূহঃ
                                             এই গুহাসমূহ খ্রিস্টাব্দ ৫ম-৭ম শতাব্দীতে স্থাপিত হয়। ধারণা করা হয় যে, বৌদ্ধ গুহাসমূহ প্রাথমিক স্থাপনারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। প্রথম পর্যায়ে ১-৫ নাম্বার গুহা (৪০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরবর্তী পর্যায়ে ৬-১২ নাম্বার গুহা (মধ্য ৭ম-মধ্য ৮ম খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু বর্তমানে এইটা আধুনিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এইটা নিশ্চিত যে, হিন্দু গুয়া ( ২৭, ২৯, ২১, ২৮, ১৯, ২৬, ২০, ১৭ এবং ১৪ নাঃ গুহা) এর আগে তৈরী। সর্বপ্রথম স্থাপিত বৌদ্ধ গুহা ৬ নাম্বার গুহা ডান পাশের ৫, ২, ৩, ৫ এবং ৪, ৭, ৮, ১০ ও ৯ নাঃ ব্লক। আর সর্বশেষ স্থাপিত গুহা হল ১১ ও ১২ নাঃ গুহা। সকল বৌদ্ধ গুহা স্থাপিত হয় ৬৩০-৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

এই বিশাল স্থাপনাটি বেশিরভাগ বিহার ও মঠের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে বড়, পাহাড়ের হায়ে খোদাইকৃত বহুতল ভবন (বাসস্থান, শোবার ঘর, রান্নাঘর এবং অন্যান্য কক্ষ) বিদ্যমান। এই স্থাপনার কিছু গুহাতে পাহাড়ের গায়ে খোদাইকৃত গৌতম বুদ্ধ, বৌদিসত্তব ও পন্ডিতদের প্রতিমা সংবলিত মন্দির বিদ্যমান।

সবচেয়ে বিখ্যাত বৌদ্ধ গুহা হল ১০ নাম্বার গুহা, একটি চৈত্য হল (চন্দরশালা) অথবা ভিশভাক্রাম গুহা, যা “কারপেন্টার’স কেভ” ('Carpenter's Cave') নামে সর্বাধিক পরিচিত। এই গুহাটিতে অনেকটা গির্জার মত একটি বিশাল হল বিদ্যমান যার নাম চৈত্য, যার ছাদ এমন ভাবে খোদাইকৃত যে দেখতে অনেকটা কাঠের বিমের মত। এই গুহার ঠি মধ্যখানে একটি ১৫ ফুট লম্বা আসনকৃত বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। অন্যান্য বৌদ্ধ গুহার মধ্যে ১-৯ নাঃ গুহা হল মঠ এবং দো-তাল (১১ নাম্বার গুহা) ও তিন-তাল (১২ নাম্বার গুহা) তিনতলা ।


০২। গুহা-১০ঃ
                        গুহা-১০ একটি বিহার যার আট ক্ষুদ্র কক্ষ বিশিষ্ট। যার চারটি ক্ষুদ্র কক্ষ সামনের দেয়ালের সাথে লাগানো বাকি চারটি ক্ষুদ্র কক্ষ পেছনের দেয়ালের সাথে লাগানো। এই গুহার সামনে একটি ক্ষুদ্র কক্ষসহ খোদাইকৃত স্তম্ভ আছে। সম্ভবত এই গুহাটি অন্যান্য বিহারের সরবরাহকৃত খাদ্য ভান্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হত।

০৩। বিশ্বকর্মাঃ
                               বৌদ্ধ গুহাসমূহের মধ্যে বিশ্বকর্মা একমাত্র চৈত্য গৃহ। এই গুহা স্থানীয়ভাবে বিশ্বকর্মা বা সুতার কা ঝপদা (Sutar ka jhopda/ carpenter's hut) নামে ডাকা হয়। এই গুহার নকশা দেখতে অনেকটা অজন্তা গুহাসমূহের মন্দিরের ১৯ ও ২৬ নাম্বার গুহার মত। ৭০০ খ্রিস্টাব্দতে এই গুহা স্থাপিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। চৈত্য গুহায় একসময় একটি বড় দেয়াল ছিল, যা বর্তমানে নেই। এই গুহার প্রধান হল একটি চক্রাকারে তৈরী এবং এর চারপাশে অষ্টভূজাকৃতির ২৮ স্তম্ভ বিদ্যমান।

০৪। হিন্দু গুহাঃ

হিন্দু গুহাসমূহ স্থাপিত হয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতাব্দীর শেষ সময়ের মধ্যে। প্রাথমিক গুহাসমূহ (১৭-২৯ নাম্বার গুহা) তৈরী হয় কালাচুরির শাসনামলে। সর্বপ্রথম নির্মান করা হয় ২৮, ২৭ ও ১৯ নাম্বার গুহা। এই গুহাগুলো নির্মাণ করা হয় প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মিত ২৯ ও ২১ নাম্বার গুহার নির্মানের কৌশল অবলম্বন করে। ১৪, ১৫ ও ১৬ নাম্বার গুহা তৈরী হয় রাষ্ট্রকূটের শাসনামলে। সকল স্থাপনা বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও সুচারু দক্ষতার পরিচায়ক। কিছু কিছু স্থাপনা এতটাই জটিল যে এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত করতে কয়েক বংশপরাম্পরা পরিকল্পনা ও পরিচালনার প্রয়োজন হয়েছিল।



                                                    
                                                                                                 নৃত্যরত অবস্থায় শিব (১৬ নাম্বার গুহা)

০৫। দশাবতারঃ
দশাবতার (১৫ নাঃ গুহা) প্রাথমিকভাবে ছিল বৌদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরটির গঠনগত দিক থেকে ১১ ও ১২ নাম্বার গুহার সাথে সাদৃশ্য আছে। দেয়ালের খিলান থেকে মেঝের উপরের অংশের একটি বিশাল স্থাপত্য কলা বিদ্যমান যা বিভিন্ন দৃশ্য দিয়ে সাজানো। এই দৃশ্যের মধ্যে বিষ্ণুর দশাবতার চেহারা অন্তর্ভুক্ত আছে।




                                           
                   একটি দেয়াল খোদাই শিল্প, শিবের সাথে কল্যাণাসুন্দ্রার বিবাহ এবং পার্বতী


০৬। অন্যান্য হিন্দু মন্দিরঃ  অন্যান্য উল্লেখযোগ্য হিন্দু মন্দিরগুলো হল রামেশ্বর (২১ নাম্বার গুহা), যার প্রবেশদ্বারের সম্মুখে গঙ্গা ও যমুনা মূর্তি খচিত। ধুমুর লিনা (২৯ নাম্বার গুহা) যা দকেহতে অনেকটা মুম্বাইয়ের নিকটে অবস্থিত এলিফ্যান্ট দ্বীপের গুহার মত। অপর দুইটি মন্দির হল, রাভন কি খাই (১৪ নাম্বার গুহা) এবং নীলকণ্ঠ (২২ নাম্বার গুহা) যেখানে অনেক স্থাপত্যের নিদর্শন বিদ্যমান। অন্যান্য হিন্দু গুহাগুলো হল, কুম্ভারব্দা (২৫ নাম্বার গুহা) এবং গোপেলিনা (২৭ নাম্বার     গুহা), এতে তেমন উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন নেই।                                                                                               ২১ নাম্বার গুহা




০৭। জৈন গুহাঃ 
                            ইলোরা মোট পাচটি জৈন গুহা আছে যা খ্রিষ্টীয় নবম থকে দশম শতাব্দীর মধ্যে স্থাপিত। এর সবগুলো গুহা ডিঘাম্বরা’র সাথে সম্পর্কযুক্ত। জৈন গুহাগুলো জৈন দার্শনিক ও ঐতিহ্যের ধারক। এই গুহাগুলো কঠোর তপস্যার অনুভূতির প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু এসব এখন অন্যান্য গুহার তুলনায় তেমন বৃহৎ নয়। কিন্তু এসব গুহা বিভিন্ন শিল্পকলার পরিচয় বহন করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জৈন মন্দিরগুলো হল ছোট কৈলাশ (৩০ নাম্বার গুহা), ইন্দ্র সভা (৩২ নাম্বার গুহা) এবং জগন্নাথসভা (৩৩ নাম্বার গুহা)। ৩১ নাম্বার গুহাও জৈন গুহা কিন্তু এটি একটি অসমাপ্ত চার স্তম্ভবিশিষ্ট্য হল এবং একটি মন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত। ৩৪ নাম্বার গুহাটি আয়তনে ছোট যা ৩৩ নাম্বার গুহার বামদিকে অবস্থিত। অন্যান্য ভক্তিমূলক খোদাইচিহ্ন, একটি স্থান যার নাম সামভতস্বর্ণ যা ইলোরায় বিদ্যমান। সামভতস্বর্ণ জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি বিশেষ স্থান।

০৮। ইন্দ্রসভাঃ
                       ইন্দ্র সভা (৩২ নাম্বার গুহা) দ্বীতলবিশিষ্ট গুহা যাতে একটিমাত্র পাথর কেটে তৈরী মন্দির বিদ্যমান। এর ছাদের দেয়ালে অপূর্ব সুন্দর করে কাটা পদ্মফুল বিদ্যমান।

০৯। অন্যান্য জৈন গুহাঃ

অন্যান্য জৈন গুহাগুলোও জটিল শিল্পকলায় পরিপূর্ণ। অনেক স্থাপনার ছাদ খুবই উচ্চমানের ছবি সংবলিত, যার অনেকগুলো অংশ এখনো বিদ্যমান।

ইলোরার ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ

ইলোরা ওয়েস্টার্ন ঘাটের সমতল ভূমি দখল করে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন প্রাচীন আগ্নেয়গিরি কর্মকান্ডের ফলে এই এলাকায় বিভিন্ন স্তরে গঠিত, যা ডেকান ফাদ (Deccan Traps )নামে পরিচিত। ক্রেটাচিয়াসের সময়, একটি আগ্নেয়গিরি ইলোরা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গঠিত হয়েছিল।

ইলোরা বিভিন্ন খোদাইচিহ্ন

ইলোরায় খ্রিস্টাব্দ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর অনেক খোদাইচিহ্ন বিদ্যমান। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল রাষ্ট্রকুট দান্তিদুর্গা (৭৫৩-৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ) যা ১৫ নাম্বার গুহার মন্ডপের পেছনের দেয়ালে খোদাইকৃত। এটি খোদাই করা হয় রাষ্ট্রেকুটের বিজয়ানন্দে। কৈলাশ মন্দিরের খোদাইচিহ্নগুলো খ্রিস্টাব্দ ৯-১৫ শতাব্দীর মধ্যে অঙ্কিত। জৈন গুহার জগন্নাথসভায় তিনটি খোদাইচিহ্ন আছে। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত পার্সভান্ত মন্দিরে একাদশ শতাব্দীর একটি খোদাইচিহ্ন আছে। মহা কৈলাশ (১৬ নাম্বার গুহা) কৃষ্ণা (খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৭-৮৭ খ্রিস্টাব্দ) দিগ্বিবিজয়ী এবং দান্তিদুর্গার কাকা তার সম্মানার্থে তৈরী হয়। কার্কা II (খ্রিস্টপূর্ব ৮১২-১৩খ্রিস্টাব্দ)  এর অনুদানে ইলোরার একটি পাহাড়ে মহান স্মৃতিচিহ্ন খোদাইকৃত একটি তামার থালা স্থাপিত হয়। অজন্তা গুহার ন্যায়, ইলোরা গুহাসমূহ কখনো ধ্বংসের সম্মুখীন হয় নি। বিভিন্ন লেখা ও ভ্রমণকাহিনী থেকে পাওয়া যায় যে, ইলোরায় নিয়মিত পরিদর্শন করা হত। তার মধ্যে প্রথমে লেখা পাওয়া যায় আরব ভূতত্ত্ববিদ আল-মাসা’উদি, যা লেখা হয় খ্রিস্টাব্দ দশম শতাব্দীতে। ১৩৫২ সালে সুলতান হাসাব বাহ্মী, যিনি এই স্থানে কিছুকাল অবস্থান করেন ও পরিদর্শন করেন। অন্যান্যের মধ্যে ফিরিশ্তা, থেভেনট (১৬৩৩-১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দ), নিকালো মানাউচি (১৬৫৩-১৭০৮ খ্রিস্টাব্দ), চার্লস ওয়্যার ম্যতালেট (১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ), এবং সেলী (১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ)।

অন্যান্য ছবিঃ

১। কৈলাশ মন্দিরে পাথর খচিত স্তম্ভঃ

০২। একটি পাথরের সেতু নন্দী মন্ডপ ও ও প্রধান মন্দিরের যোগাযোগ রক্ষা করেছেঃ


০৩। কৈলাস স্তম্ভে খোদাইচিহ্নঃ


০৪। ইলোরা গুহার খোদাইশিল্প

০৫। সিতার পুকুর (Sita ki Nahani)

০৬। অম্বিকা মূর্তি, ৩৪ নাম্বার গুহা


Share:

২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

যোগযুক্ত অবস্থায় মানুষ কি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সম্পর্কে বলতে পারে?

প্রশ্নঃ যোগযুক্ত অবস্থায় মানুষ কি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সম্পর্কে বলতে পারে?
বেদ, উপনিষদ ও গীতা কি বলে?
উত্তরঃ হ্যা। দেখুন...........
যেনেদং ভূতং ভুবনং ভবিষ্যৎ পরিগৃহীতমমৃতেন সর্বম্।
যেন যজ্ঞস্তায়তে সপ্তহোতা তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমতু।।
যজুর্বেদ ৩৪/৪
অনুবাদঃ
হে জগদীশ্বর! যদ দ্বারা যোগীগণ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কার্য জানিতে পারে, যাহা অবিনাশী জীবাত্মাকে পরমাত্মার সহিত মিলিত করিয়া সর্বপ্রকারের ত্রিকালজ্ঞ করে, যাহাতে জ্ঞান ও ক্রিয়া আছে। যাহা পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রীয়, বুদ্ধি ও আত্মার সহিত সংযুক্ত এবং যাদ্বারা যোগীগণ যোগরূপে যজ্ঞের বৃদ্ধি সাধন করেন আমার মন সেই যোগ বিজ্ঞান সম্পন্ন হইয়া অবিদ্যা ক্লেশ হতে দূরে থাকুক।
অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো জ্যোতিরিবাধূমকঃ।
ঈশানো ভূতভব্যস্য স এবাদ্য স উ শ্বঃ। এতদ্বৈ তৎ।।
কঠ উপনিষদ ২/১/১৩
অনুবাদঃ
পূর্বোক্ত অঙ্গুষ্ঠ-পরিমান পুরুষ নির্ধূম জ্যোতির ন্যায় যোগিদের হৃদয়ে প্রকাশমান হন। ইনি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই তিন কালের নিয়ন্তা। ইনি আজও আছেন, কালও অর্থাৎ সর্বকালে থাকিবেন। ইনিই সেই আত্মা।
পৃথ্ব্যপতেজোহনিলখে সমুত্থিতে পঞ্চাত্মকে যোগগুণে প্রবৃত্তে।
ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যুঃ প্রাপ্তস্য যোগাগ্নিময়ং শরীরম্।।
শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ ২/১২
অনুবাদঃ
পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশ - এই পঞ্চভূত সমত্থিত হইলে অর্থাৎ ধ্যানবলে নিজ নিজ কারণে বিলীন হইলে এবং উহাদের গুণসমূহ গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ যখন যোগীর নিকট প্রকাশিত হয়, তখন সেই যোগী যোগাগ্নি-পূত বিমল দেহ লাভ করিয়া রোগ, জরা ও মৃত্যু জয় করেন অর্থাৎ তিনি ইচ্ছামৃত্যু হন।
বাহ্যস্পর্শেষ্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্।
স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মশ্নতে।।
গীতা ৫/২১
অনুবাদঃ
সেই প্রকার ব্রহ্মবিৎ পুরুষ কোন রকম জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আকৃষ্ট হন না, তিনি চিদ্গত সুখ লাভ করেন। ব্রহ্মে যোগযুক্ত হয়ে তিনি অক্ষয় সুখ ভোগ করেন।
যোহন্তঃসুখোহন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ।
স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোহধিগচ্ছতি।।
গীতা ৫/২৪
অনুবাদঃ
যিনি আত্মাতেই সুখ অনুভব করেন, যিনি আত্মাতেই ক্রীড়াযুক্ত এবং আত্মাই যার লক্ষ্য, তিনিই যোগী। তিনি বুহ্মে অবস্থিত হয়ে ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।
ও গীতার ৬/১৮,২৯, ৩১,৪৩, ৪৫, ৪৬ দেখুন
এই বেদ, উপনিষদ ও গীতা অনুযায়ি রাম, কৃষ্ণ কেউ ঈশ্বর না তারা এক একজন যোগী পুরুষ।
(SunVeer সূর্যবীর)
Share:

১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

গৌতম বুদ্ধ এবং তার জীবনী

সংস্কৃত ‘বুদ্ধ’ শব্দের অর্থ যিনি পরম শাশ্বত বোধ বা জ্ঞান লাভ করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মানুসারে তিনিই ‘বুদ্ধ’ যিনি জগতের সার সত্য সম্বন্ধে অবগত হয়েছেন এবং নিজে নির্বাণলাভের পূর্বে ধরিত্রীর সকল জীবকে নির্বাণলাভের উপায় উপদেশ করে গেছেন। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি ২৮ জন বুদ্ধ গত হয়েছেন। আমরা এখন ২৮তম বুদ্ধ -- গৌতম বুদ্ধ এর ধর্মকাল অবস্থান করছি, গৌতম বুদ্ধের ধর্মের ব্যপ্তিকাল মোট ৫০০০ বছর, বর্তমানে আমরা এই ধর্মকালের ২৫৫৪ বছরে আছি। আরো ২৪৪৬ বছর পর আরো একজন বুদ্ধ আবির্ভাব হবেন। তিনি হচ্ছেন মৈত্রীয় বুদ্ধ। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি যেসব বুদ্ধ গত হয়েছেন, তাঁরা হলেন ----
Image may contain: 1 person
১। তৃষঙ্কর বুদ্ধ
২। মেধঙ্কর বুদ্ধ
৩। শরণংকর বুদ্ধ
৪। দীপংকর বুদ্ধ
৫। কোন্ডণ্য বুদ্ধ
৬। সুমঙ্গল বুদ্ধ
৭। সুমন বুদ্ধ
৮। রেবত বুদ্ধ
৯। সোভিত বুদ্ধ
১০। অনোমদর্শী বুদ্ধ
১১। পদুম বুদ্ধ
১২। নারদ বুদ্ধ
১৩। পদুমুত্তর বুদ্ধ
১৪। সুমেধ বুদ্ধ
১৫। সুজাত বুদ্ধ
১৬। প্রিয়দর্শী বুদ্ধ
১৭। অর্থদর্শী বুদ্ধ
১৮। ধর্মদর্শী বুদ্ধ
১৯। সিদ্ধার্থ বুদ্ধ
২০। তিষ্য বুদ্ধ
২১। ফুসস্ বুদ্ধ
২২। বিপশী বুদ্ধ
২৩। সিখী বুদ্ধ
২৪। বেসস্ভূবুদ্ধ
২৫। কুকুসন্ধ বুদ্ধ
২৬। কোণাগমন বুদ্ধ
২৭। কশ্যপ বুদ্ধ
২৮। গৌতম বুদ্ধ

গৌতম বুদ্ধ (পালি -- গোতম) বা শাক্যমুনি বুদ্ধ হলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা। জন্মের পর তাঁর নাম ছিল সিদ্ধার্থ গৌতম। আধ্যাত্মিক সাধনা ও জীবন নিয়ে নিজস্ব জ্ঞান-উপলব্ধির পর তিনি বুদ্ধ নামটি গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ৬২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং পরিনির্বাণ সাল ৫৪৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ।
সিদ্ধার্থের পিতা ছিলেন শাক্য বংশীয় রাজা শুদ্ধোদন। মাতা মায়াদেবী।

মায়াদেবী কপিলবাস্তু থেকে পিতার রাজ্যে যাবার পথে লুম্বিনি গ্রামে (অধুনা নেপালের অন্তর্গত) সিদ্ধার্থের জন্ম দেন। তাঁর জন্মের সপ্তম দিনে মায়াদেবীর জীবনাবসান হয়। পরে তিনি বিমাতা গৌতমী কতৃক লালিত হন। ধারণা করা হয় তাঁর নামের “গৌতম” অংশটি বিমাতার নাম থেকেই এসেছে। আবার কারও কারও মতে এটি তাঁর পারিবারিক নাম। জন্মের পঞ্চম দিনে রাজা ৮ জন জ্ঞানী ব্যক্তিকে সদ্যোজাত শিশুর নামকরণ ও ভবিষ্যৎ বলার জন্য ডাকেন। তাঁর নাম দেওয়া হয় সিদ্ধার্থ -- “যে সিদ্ধিলাভ করেছে, বা যার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে”। তাঁদের মধ্যে একজন বলেন, রাজকুমার একদিন সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে যাবেন এবং বোধিপ্রাপ্ত হবেন। একজন রাজপুত্র হিসেবে সিদ্ধার্থ বিভিন্ন শাখায় শিক্ষা লাভ করেন।

সিদ্ধার্থ গৌতমের বিবাহ সম্বন্ধে দুধরনের মত আছে। প্রথম মত অনুসারে ১৬ বছর বয়সে তিনি একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর স্ত্রীকে লাভ করেন। অতঃপর পুত্র রাহুল জন্মগ্রহণ করে। আর একটি মত অনুসারে ২৮ বছর বয়সে তাঁকে সংসারের প্রতি মনোযোগী করার জন্য তাঁর পিতামাতা তাঁকে রাজকন্যা যশোধরার সাথে বিবাহ দেন। পরবর্তী বছরে জন্ম নেয় পুত্র রাহুল।

কথিত আছে, একদিন রাজকুমার সিদ্ধার্থ বেড়াতে বের হলে ৪ জন ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। প্রথমে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, অতঃপর একজন অসুস্থ মানুষ এবং শেষে একজন মৃত মানুষকে দেখতে পান। তিনি তাঁর সহিস চন্নকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, চন্ন তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যে এটিই সকল মানুষের নিয়তি। আবার একদিন (কারও কারও মতে সেদিনই) তিনি চন্নকে নিয়ে বের হলেন। এবারে তিনি দেখা পেলেন একজন সাধুর, যিনি মুণ্ডিতমস্তক এবং পীতবর্ণের জীর্ণ বাস পরিহিত। চন্নকে এঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন উনি একজন সন্ন্যাসী, যিনি নিজ জীবন ত্যাগ করেছেন মানুষের দুঃখের জন্য। রাজকুমার সিদ্ধার্থ সেই রাত্রেই ঘুমন্ত স্ত্রী, পুত্র, পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে তিনি প্রাসাদ ত্যাগ করেন। সাথে নিলেন চন্নকে। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়ে তিনি থামলেন। তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেললেন তার লম্বা চুল। অতঃপর চন্নকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা শুরু করলেন জ্ঞানান্বেষণে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে। সিদ্ধার্থের এই যাত্রাকেই বলা হয় মহানিষ্ক্রমণ।

দুঃখ ও দুঃখের কারণ সম্বন্ধে জানতে সিদ্ধার্থ যাত্রা অব্যাহত রাখেন। প্রথমে তিনি আলারা নামক একজন সন্ন্যাসীর কাছে যান। তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তিনি যান উদ্দক নামক আর একজনের কাছে। কিন্তু এখানেও কোনও ফল পেলেন না। এভাবে কিছু দিন যাবার পর তিনি মগধের উরুবিল্ব নামক স্থানে গমন করেন। সেখানে প্রথমে একটি উত্তর-পূর্বমুখি শিলাখণ্ডের উপর বোধিসত্ত্ব জানু পেতে বসে আপন মনেই বলেছিলেন যে, “যদি আমাকে বুদ্ধত্বলাভ করতে হয় তা হলে বুদ্ধের একটি প্রতিচ্ছায়া আমার সম্মুখে দৃশ্যমান হোক।” এই কথা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শিলাখণ্ডের গায়ে তিন ফিট উঁচু একটি বুদ্ধের প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হল।

বোধিসত্ত্ব তপস্যায় বসার পূর্বে দৈববাণী হয় যে, “বুদ্ধত্ব লাভ করতে গেলে এখানে বসলে চলবে না; এখান থেকে অর্ধযোজন দূরে পত্রবৃক্ষতলে তপস্যায় বসতে হবে।” এরপর দেবগণ বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে করে এগিয়ে নিয়ে যান। মধ্যপথে একজন দেবতা ভূমি থেকে একগাছা কুশ ছিঁড়ে নিয়ে বোধিসত্ত্বকে দিয়ে বলেন যে, এই কুশই সফলতার নিদর্শন স্বরূপ। বোধিসত্ত্ব কুশগ্রহণের পর প্রায় পাঁচ শত হাত অগ্রসর হন এবং পত্রবৃক্ষতলে ভূমিতে কুশগাছটি রেখে পূর্বমুখি হয়ে তপস্যায় বসেন। কঠোর সাধনার ফলে তাঁর শরীর ক্ষয়ে যায়। কিন্তু এ তপস্যায় তিনি ভয়, লোভ ও লালসাকে অতিক্রম করে নিজের মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে সক্ষম হলেন।

সহসা তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে বোধিলাভ হবে না। তিনি তাই আবার খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সুজাতা নাম্নী এক নারীর কাছ থেকে তিনি এক পাত্র পরমান্ন আহার করলেন। অতঃপর তিনি নদীতে স্নান করে পুনরায় ধ্যানরত হন। অবশেষে কঠোর তপস্যার পর তিনি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হলেন। শাক্যমুনি বোধিলাভের পর সাতদিন ধরে বোধিবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থেকে বিমুক্তিলাভের আনন্দ উপভোগ করেন। তিনি দুঃখ, দুঃখের কারণ, প্রতিকার প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করলেন। এ ঘটনাটিই বোধিলাভ নামে পরিচিত। সমস্ত জীবন ধরে তাঁর দর্শন এবং বাণী প্রচার করে অবশেষে আনুমানিক ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৮০ বছর বয়সে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশীনগরে ভগবান তথাগত মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

গুহ্যকালী

কালী বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে, তিনি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশ জন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী। শাক্তরা কালীকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিকারণ মনে করে। বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। 
Image may contain: 1 person, indoor
পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা; গলায় মানুষের মুণ্ড দিয়ে গাঁথা মালা; বিরাট জিভ, কালো গায়ের রং, এলোকেশ দেখা যায় এবং তাঁকে তাঁর স্বামী শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ব্রহ্মযামল মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীর বিভিন্ন রূপভেদ আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে "ব্রহ্মময়ী", "ভবতারিণী", "আনন্দময়ী", "করুণাময়ী" ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। এছাড়া মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে। কালী দেবীর উপাসকরা হিন্দু বাঙালি সমাজে বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন।
-
গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর। দেবীর ধ্যানে বলা হয়েছে যে -- 'গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা।'
-
মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দিরের কথা জানা যায়। মহাকাল সংহিতা মতে, নবধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা। 
বাতাসে অল্প হিমেল গন্ধ আর সাথে শিউলির শেষ রেশটুকু নিয়ে শহর ছেড়ে রাঙামাটির পথে পাড়ি দিয়ে ঘুরে আসা যেতেই পারে যে কোনও ছুটির দিনে আকালীপুর, ভদ্রপুর। নলহাটি-বহরমপুর সড়কপথে বাসে করে গেলে পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ের ওপর নগোরার মোড় আর সেখান থেকে আকালীপুর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। আজিমগঞ্জ-নলহাটী শাখায় রেল স্টেশন লোহাপুর থেকে আকালীপুর মাত্র ছ'কিলোমিটার দূরে। কোলকাতার কাছেই এই মন্দিরের খোঁজ অনেকেরই হয়ত বা অজানা।কথায় বলে "কীর্তযস্য স জীবতি"! মহারাজা নন্দকুমারের কীর্তিসমূহ হেস্টিংস বিলোপ করতে চেয়েও পারেন নি। মহারাজা নন্দকুমারের অজস্র কীর্তির মধ্যে অন্যতম হল বীরভূমের আকালীপুরে 'উত্তরবাহিনী ব্রহ্মাণী নদী' তীরে গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা। 

নন্দকুমার যখন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তখন ঐ গ্রামে জনাকয়েক মানুষের বাস ছিল তার মধ্যে কিছু ভট্টাচার্য বামুন ছিল, নদীতীর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। কথিত আছে এই 'গুহ্যকালী' মহাভারতে বর্ণিত মগধরাজ জরাসন্ধের আরাধ্যা দেবী। কালস্রোতে ইনি কাশীরাজ চৈতসিংহের গৃহে পূজিতা হন। রাজা চৈতসিং তাঁর রাহ্যে এক ইঁদারা খননের সময় এই কালীর হদিশ পান। অস্থায়ী মন্দির নির্মিত হয়ে পুজো শুরু হয়। হেষ্টিংস সে সময় এই অপূর্ব গুহ্যকালীর শিল্পশৈলীর কথা জানতে পেয়ে ইংল্যান্ডের 'এন্টিক' বস্তুর সংগ্রহশালায় ঐ দামী কষ্টিপাথরের মূর্তি নিয়ে যাবার ফন্দী আঁটেন। চৈত সিং এইকথা জানতে পেরে গোপনে দেবীকে ব্রাহ্মণী নদীর জলে নিমজ্জিত করে রাখেন। মহারাজ নন্দকুমার স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাতারাতি এই দেবীমূর্তিকে জল থেকে উদ্ধার করে তাঁর জমিদারীর অন্তর্গত আকালীপুর ভদ্রপুরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীকে স্থাপন করেন।

 কেউ কেউ বলেন হেষ্টিংস নাকি নৌকাপথে ঐ মূর্তিকে পাচার করে দিছিলেন। নন্দকুমার গঙ্গাবক্ষেই দেবীকে উদ্ধার করেন এবং ওনার কোলকাতার বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে প্রথমে রাখেন এবং পরে মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। সে যাই হোক্, ব্রাহ্মাণী নদী ভাগিরথীর সাথে কাটোয়ায় মিলিত হয়েছে। নন্দকুমার চেয়েছিলেন এই নৌকাকে ভদ্রপুরে থামাতে কিন্তু নৌকাকে থামানো যায়নি। তাই আকালীপুরে যখন নৌকা এসে ভিড়েছিল তখন ঐ মূর্তিকে নামানো সম্ভব হয়েছিল। উত্তরবাহিনী ব্রাহ্মণী নদী কালের স্রোতে পূর্বমুখী হয়েছে। কে জানে দেবী স্বয়ং দুরাচার, অর্থপিশাচ হেষ্টিংসের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই হয়ত জঙ্গল পরিবেষ্টিত আকালীপুরকেই নিরাপদ স্থান বলে ভেবেছিলেন। অদূরে ব্রাহ্মণী নদীর কোলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশম কুটীরের ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের উপদান হয়ে থেকে গেছে। 

মন্দিরটি ছিল আটকোণা দুর্গের অণুকরণে নির্মিত। চুন-সুরকির গাঁথনির মধ্যে ছোট ছোট বাংলা-ইঁঁট দিয়ে তৈরী। পাঁচিল পলাস্তরা বিহীন। দেওয়ালের খোপে দেবীর দশমহাবিদ্যার মূর্তির অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা। জনশ্রুতি আছে ভদ্রপুরের মহারাণী রাজপ্রাসাদ থেকে মন্দিরের চূড়ো দর্শন করতে চেয়েছিলেন। রাণীর ঐ দম্ভ দেবীর সহ্য হয় নি। তাই দৈব দুর্যোগে একরাতের মধ্যে নির্মিত ঐ মন্দিরের চূড়ো নষ্ট হয়ে যায় ও মন্দিরের পিছনের দেওয়ালে ফাটল ধরে। আবার কারো মতে এই দেবীমূর্তি শ্মশানকালী বলে মন্দির প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকতে নারাজ। তাই নির্মাণকালেই এই মন্দিরটি বিদীর্ণ হয় এবং এখনো অসমাপ্ত। ১৭৭৫ সালের গোড়ায় তিনি মুর্শিদাবাদ-বীরভূমের সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে দেবী গুহ্যকালীর মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু ওই বছর জুন মাসে তিনি ইংরেজের হাতে বন্দী হলে, মন্দির নির্মাণে ছেদ পড়ে। ফাঁসির পূর্বে তিনি পুত্র গুরুদাসকে তান্ত্রিক মতে দেবী গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে যান। লোকশ্রুতি, ওই বছর ১৫ জুলাই মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছিল।

মন্দিরের গর্ভগৃহটিকে বেষ্টন করে পরিখার মত আবরণী, তিনটি দরজা। প্রধান দরজা দক্ষিণদিকে, ত্রিনয়না দেবী দক্ষিণমুখী। ভারতবর্ষের অন্য কোথাও এমন কালীমূর্তির নিদর্শন নেই। অনেকটা নেপাল বা চীনের কালীমূর্তির মত গড়ন। কালো কষ্টিপাথরের একখন্ড টুকরো কেটে কোনোও এক অনামা শিল্পী বানিয়ে ছিলেন। আয়তাকার কালো পাথরের বেদীতে দুটি কুন্ডলীকৃত সাপের ওপর অর্ধ পদ্মাসনে উপবিষ্টা দেবী। দেবীর ডান পা সাপের মাথা স্পর্শ করে আছে। দেবীর মস্তকে পাঁচটি ধাপে সহস্রাধার। অর্থাত হটযোগে যে মস্তকে যে সহস্রাধারের কথা বলা হয় এই সাপের মুকুট তারই প্রতীক। দেবীর গলায় পঞ্চাশটি নরমুন্ড দিয়ে তৈরী মালা। কর্ণ কুহর থেকে বুক অবধি নেমে এসেছে দুটি শিশুর মৃত শবদেহ। দেবীর সর্প উপবীত। নাভীকুন্ডের ওপর দিয়ে সাপের কোমর বেষ্টনী। দুহাতে সাপের বলয়। উন্মুক্ত লোলজিহ্বা, বিস্ফারিত ত্রিনয়ন আর মুখ গহ্বরে নাকি আসল নরদন্তের সারি। চক্ষু ও নাকি নর-করোটির অংশে নির্মিত। দুই হাতে বর এবং অভয়।

 একাধারে সৃষ্টি এবং লয়ের প্রতিকী এই দেবীর ভয়ানক রূপের মধ্যে আবার তাঁর প্রসন্ন রূপটিও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। ব্রহ্মাণী নদীতীর সংলগ্ন শ্মশানঘাটটির পরিবেশও বেশ ছমছমে। মন্দিরের দক্ষিণে "পঞ্চমুণ্ডী" নামে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন রয়েছে। আকালীপুরের দেবী গুহ্যকালীকে ভক্তেরা অতিশয় "জাগ্রত" দেবী মনে করেন। দূর-দূরান্তর থেকে পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে "মানসিক" করে পূজা দেন। দেবীর ভৈরব গৌরীশঙ্করের মূর্তিও আছে পাশেই। গুহ্যকালীর নিত্যপুজো হয় এখানে। দশপোয়া অতপচালের ভোগ দেওয়া হয় দুর্গাপূজার পর চতুর্দশীতে ভেড়া, ছাগল ও মোষ বলির ও প্রচলন আছে। মায়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে মাঘ মাসে রটন্তী কালীপুজোতে মেলাও বসে এখানে। তান্ত্রিকরা এই কালীকে 'বেদের বেটী' বলে থাকেন। ২০০৪ সাল থেকে এই মন্দিরের উন্নয়নে জোর কদমে কাজকর্ম চলছে। ব্রহ্মাণীনদীর সবুজ অরণ্যময়তায় আর বাঁশবনের মর্মরতায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিপুষ্ট এই আকালীপুর ভদ্রপুরের গুহ্যকালী বীরভূমের অন্যান্য সতীপিঠ অপেক্ষা কোনো অংশে কম নয়। আর মহারাজা নন্দকুমারের অপরিমিত সাহস ও দূরদৃষ্টির কথা বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই মন্দির। শক্তিসাধনার ক্ষেত্র হিসেবে এই তীর্থভূমি পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটি তীর্থ সাধনার স্থানের মতই।
-
গত বৎসর এই মন্দিরে মায়ের দর্শনে গিয়েছিলাম। মাতৃভক্ত সুজয় চন্দ্রের গাড়ীতে বহরমপুর থেকে মাতৃদর্শনে গিয়ে মন্দিরে বসে পূজায় অংশগ্রহণ করলাম। পূজারী একজন সজ্জন ও অমায়িক মানুষ -আলাপ করলে অবশ্যই আপনার ভালো লাগবে। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের ডান দিকে তার স্রীর পূজা সামগ্রীর দোকান। পুজা শেষে একটা পাঠা বলি হ'ল। প্রসাদ গ্রহণ করলাম, কয়েকটা ফটো তুলে মা'কে প্রণাম জানিয়ে নলহাটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

আপনার সন্তানের পড়াশুনা নিয়ে চিন্তিত?

গত কয়েকদিন আগে এক দম্পতি তার দুই ছেলের পড়াশুনা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আমার কাছে ছেলে দুইজন কে নিয়ে আসেন। আমি তাদের যথাসাধ্য মূল্যবান পরামর্শ দিই। তারপরই একদিন পূর্বনির্ধারিত কথামত তাদের বাড়ী যাই। ভদ্রলোকের বড় ছেলের পড়ার ঘরে বসে তার সাথে গল্প করতে করতে তাকে পড়াশুনা ভালোভাবে করবার পরামর্শ দিয়ে চলে এলাম।
ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে ছাত্রদের বিভিন্ন শিক্ষা সংক্রান্ত যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, মূল্যবান সেই তথ্য গুলো এখানে লিপিবদ্ধ করে দিলাম।
=> প্রাথমিক শিক্ষামূলক (উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত) পড়াশুনার ক্ষেত্রে পড়াশুনার ঘরের মধ্যে সর্বদা উত্তর দিক কিংবা উত্তর-পূর্ব কোণের (ঈশান কোণ) দিকে মুখ করে বসা উচিৎ, তবে উত্তর-পূর্ব কোণটাই গুরুত্বপূর্ণ। 
=> পড়াশুনার ঘর সর্বদা সবুজ রঙ করা প্রয়োজন কারন সবুজ রঙ বুধ গ্রহের রঙ আর এই রঙ থেকে আমাদের সবচেয়ে বেশী মনঃসংযোগ বাড়ে।
=> পড়াশুনা করতে হলে সবসময় চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করে তাতে বসে পড়াশুনা করা উচিৎ এবং তার সাথে যদি পাসে একটা টেবিল ল্যাম্প থাকে তাহলে সেটা শুভফলদায়ক।
=> উচ্চতর শিক্ষামূলক পড়াশুনা (উচ্চমাধ্যমিকের পরবর্তী শিক্ষা কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা কোনো টেকনোলজি কিংবা গবেষণা সংক্রান্ত শিক্ষা) উচ্চতর শিক্ষামূলক পড়াশুনার ক্ষেত্রে সর্বদা দক্ষিন-পূর্ব কোণ (অগ্নি কোণ) বরাবর মুখ করে প্রতিদিন পড়াশুনা করতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে আপনার জন্ম কুন্ডলী (Horoscope) অনুযায়ী যে দিক শুভ, বাড়ীর সেই দিকের ঘরে পড়াশুনা করা উচিৎ। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রেও পড়াশুনার ঘরের রঙ সবুজ করতে হবে। গবেষনা মূলক কিংবা টেকনোলজি শিক্ষার ক্ষেত্রে নীল, গোলাপী ইত্যাদি রঙও করা যেতে পারে।
=> পড়াশুনার ঘরে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যে একটি করে চন্দনের ধুপ জ্বালানো উচিৎ কারন একমাত্র চন্দনের ধূপের মধ্যে মনঃসংযোগ করার অধিক ক্ষমতা আছে।
=> আপনাদের বাড়ীর মধ্যে যদি একটা গ্লোব রাখতে পারেন তাহলে এটা সেই বাড়ীর শিক্ষার্থীদের উপর শুভ প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
আপনাদের শোবার ঘরে যেদিকে আপনি মাথা রেখে ঘুমান সেই দিকে আমাদের দেশের একটা বড় আকৃতির কাগজের ম্যাপ (Map) বা মানচিত্র দেওয়ালে পেরেক দিয়ে কিংবা আঠা লাগিয়ে শুধু টাঙিয়ে রাখবেন, এতে আশাকরি আপনাদের বাচ্চার মনঃসংযোগ অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে।
=> যেসব ছাত্ররা উচ্চতর শিক্ষামূলক পড়াশুনা করছেন তারা তাদের পড়ার টেবিলে একটি পরিস্কার কাঁচের গ্লাসে চারটি সবুজ রঙের (মাথা ছোলা) পেন্সিল নিয়ে সেগুলিকে একটি সবুজ সুতো দিয়ে ৩ প্যাঁচে বেঁধে পেন্সিল গুলোর ছোলা দিকটা উপরের দিকে করে কাঁচের গ্লাসে রেখে দিন এবং সেই পেন্সিল সমেত গ্লাসটি রেখে দিন, এতে আশাকরি আপনাদের পড়াশুনার প্রতি মনঃসংযোগ বৃদ্ধি পাবে।
=> এই কাজটি করতে হবে শুক্ল পক্ষ্যের মধ্যে শুক্রবার। আপনাদের বাচ্চার পড়ার বই গুলোর মধ্যে শুক্লপক্ষের শনিবার একটি করে লবঙ্গ প্রতিটি বইয়ের মধ্যে রেখে দিন এতে ছাত্রের পড়ায় মনঃসংযোগ বাড়বে।
=> পরীক্ষার সময় যদি আপনারা আপনাদের বাচ্চার হাতের অনামিকা আঙ্গুল (Ring Finger) দিয়ে টক দইয়ের ফোটা কিংবা হনুমানজীর মন্দিরে গিয়ে তাঁর ডান কাঁধের থেকে কিছুটা মেটে সিন্দুর অনামিকা আঙ্গুল (Ring Finger) দিয়ে কপালে এবং গলায় তিলক দিয়ে তারপর পরীক্ষা দিতে যায় তাহলে পরীক্ষাকেন্দ্রে আপনার বাচ্চা মনঃসংযোগ সঠিকভাবে প্রয়োগ
করতে পারবে।
=> আপনাদের বাড়ীর শৌচালয় ঘরের (Toilet Room) পাশে অথবা শৌচালয় ঘরের দেওয়ালের সাথে সংযুক্ত কোনো ঘরে পড়াশুনা করা উচিৎ নয়।
=> আপনাদের বাড়ীর শোবার বিছানার উপর বসে পড়াশুনা করা কখনোও উচিৎ নয়, এটা ভারতীয় বাস্তুমতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, তবে এই বাস্তুদোষের জন্য হয়তো প্রথম প্রথম আপনারা আপনাদের পড়াশুনার ক্ষেত্রে বাস্তুর কুপ্রভাব বুঝতে নাও পারেন কিন্তু পরবর্তীকালে উচ্চ শিক্ষার সময় ৯৯% নিশ্চিতভাবে অবশ্যই আপনারা কুপ্রভাব আপনাদের বাচ্চার পড়াশুনার ক্ষেত্রে পাবেন।
=> আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, 'হনুমান চালিশা' নিত্য পাঠ করা ছাত্রেরা পরীক্ষায় ভালো ফল তো অবশ্যই করে উপরন্তু শিক্ষক ও গুরুজনদের যথাযোগ্য সম্মান দেয় এবং সামাজিক অশুভ প্রভাব থেকে দুরে থাকে।
=> খাদ্যের প্রভাবও ছাত্রদের উপর মারাত্মক। যত বেশী নিরামিষ ও আঁশযুক্ত সুষম খাদ্য বাচ্চারা খায় ততই ভালো। প্রতিদিন ভোরে সূর্য্যপ্রণাম ও প্রাণায়াম বাচ্চাদের মনঃসংযোগ বাড়ানোর আরও একটা উপায়। ফাস্ট-ফুড্ মনঃসংযোগ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক।
পড়াশুনা করার প্রতি মনঃসংযোগ বাড়ানোর উপায় নিয়ে এতক্ষন আলোচনা করলাম কিন্তু এই পড়াশুনাকে কে কতটা ভালোবেসে করবে সেটা পুরোটাই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, একজন ছাত্র সে নিজে থেকে কতটা পড়াশুনাকে ভালোবাসবে সেটা ব্যক্তিগত জন্ম-কুন্ডলী দেখে বিচার করতে হয়। কোনো ছাত্র যদি নিজে বা পরিবার থেকে তার মধ্যে পড়াশুনার প্রতি ভালোবাসা না থাকে তাহলে কিন্তু সেইক্ষেত্রে আমার এই তথ্য কিংবা আমি তার কাছে দায়ী থাকব না। অম্ততঃ একজন বাচ্চাও যদি আমার এই তথ্যে উপকৃত হয় আমি ধন্য হব।

 জয় মা কামাখ্যা।

Courtesy by: Prithwish Ghosh


Share:

জন্মদাত্রী মা ও দেশমাতা

সন্তানকে নাড়ি-ছেঁড়া ধন বলা হয়। মাতৃজঠরে ১০ মাস ধরে তিলে তিলে একটি ভ্রূণ বেড়ে ওঠে। গর্ভে থাকাকালীন তার সব চাহিদা মা-ই মেটায় তার রক্ত দিয়ে, রক্তের মাধ্যমে যাবতীয় পুষ্টি-পদার্থ অনায়াসে চলে যায় ভ্রূণে, আর যা কিছু বর্জনীয়, তাও ঐ মা-ই তার নিজ শরীরের মাধ্যমে বাইরে বের করে দেয়। একটা পেশল শক্তিশালী নাড়ির বাঁধনে গর্ভস্থ শিশুটি মাতৃজঠরে আটকে থাকে। আর চারদিকে থাকে কয়েক স্তরের রক্ষা-আবরণ। তারপর যখন সময় হয় ভূমিষ্ঠ হওয়ার অর্থাত্ পৃথিবীর আলো দেখার, তখন ঐ মা-ই তীব্র প্রসব-যন্ত্রণা সহ্য করে শিশুটিকে পৃথিবীতে আনে, কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ নাড়ির বাঁধন কেটে শিশুকে বাইরে আনা হয়, শিশুটি সজোরে কেঁদে উঠে তার আগমন-বার্তা জানান দেয়। নাড়ি থেকে ছুটে যায় ঠিকই, কিন্তু পরম মমতা ঝরে পড়ে মার স্তন-যুগল হতে। দুধপানরত শিশুর হাস্যোজ্জ্বল মুখ যে দেখেছে, সে জানে স্বর্গীয় সুখ কাকে বলে।
Image may contain: 1 person
ধীরে ধীরে শিশুটি বাবা-মা সবাইকে চিনতে শিখে, সবার আগে চিনে নেয় তার মাকে, এমনকি মায়ের আঁঁচলটিও তার চেনা হয়ে যায়। তারপর বোল ফোটে কচি মুখে, হামাগুড়ি দেয়, উঠে দাঁড়ায়, হাঁটি হাঁটি পা পা করে সামনে এগোয়। বাবা-মাও শিশুর ভবিষ্যত্ ভাবনায় নিমগ্ন হয়। সব বাবা-মা'ই চায় তাদের সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। তারা চায় যেন মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠে তাদের আদরের মানিক। এ লক্ষ্যেই তারা নিজেদের কথা ভুলে গিয়ে ,অশেষ কষ্ট স্বীকার করে, তাদের রক্তজল করা অর্থ-সম্পদে সন্তানকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। যেদিন তাদের সন্তান প্রথম স্কুলে যায়, সেকি আনন্দ, কি উচ্চাশা তাদের মনের মুকুরে উঁকি দিয়ে যায়। যদি তারা অশিক্ষিত হয়, তবু সাধ্যমত চেষ্টা করে সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে। আর শিক্ষিত ও সচেতন বাবা-মা শত কাজের মধ্যেও সময় করে সন্তানকে সুশিক্ষার আলোকে আলোকিত করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। মেধার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে যখন সন্তান কাছে এসে দাঁড়ায়, অনাবিল আনন্দে ভরে যায় তাদের বুক। এভাবে শিক্ষাজগতের ধাপে ধাপে সফলতার ছাপ রেখে যখন তাদের সন্তান দৃপ্ত কদমে এগিয়ে চলে, বাবা-মা'র মনও আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। সুখ-স্বপ্নেরা ভিড় করে আসে, বাবা-মা সেগুলো চয়ন করে সুখের নীড় রচনা করে। 

কখনও তাদের সুখ-নীড় বাস্তবেও অটল থাকে, যেন কত জনমের পুণ্যফল জমে ছিল, তাই এ পরম পাওয়া। আবার কখনওবা স্বপ্ননীড় ভেঙে খান খান হয়ে যায়, সন্তানের অবাধ্যতায়, অপরিণাম দর্শিতায়। যখন তারা ছাত্র-জীবনকে সঠিকভাবে কাজে না লাগিয়ে হেলায় নষ্ট করে, আর উচ্চশিক্ষার শেষ সোপানে পিছলে পড়ে, ফল আশানুরূপ হয় না। বাবা-মা'র বুক তখন বিদীর্ণ হয়ে যায় তীব্র হতাশায়। তারা কিছুতেই সন্তানের এই হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারেন না। কষ্টের তীব্রতা বাড়ে, কারণ তারা তো কর্তব্যে কোন কার্পণ্য করেননি, পদে পদে সতর্ক করে দিয়েছেন, ছাত্রজীবনের মূল লক্ষ্যে অবিচল থাকতে বলেছেন, কিন্তু সন্তান সে কথা শোনেনি, যখন ছোট ছিল, কাছে ছিল, কোন পরীক্ষায় হারতে দেননি তারা, কিন্তু উচ্চশিক্ষার্থে যখন কাছ-ছাড়া হল, তখনই কেমন যেন বদলে যেতে লাগল তাদের আদরের সন্তান, যাদের জন্য কত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন তারা, নিজে না খেয়ে খাইয়েছেন, কোন অপ্রতিকূলতার আঁঁচ লাগতে দেননি গায়ে।

 কিন্তু সব আনন্দ, সব প্রাপ্যতা ধূলায় মিশিয়ে দিয়ে সন্তান যখন বিপথগামী হয়, কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বাবা-মা সে দুঃখ, সে বেদনা সইতে পারেন না, তাদের চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে সে তীব্রতা, অকালে বুড়িয়ে যান তারা, কিন্তু সন্তানেরা তা বুঝতেই পারে না। অথচ বাবা-মা যেমন সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেন, সন্তানেরও দায়িত্ব থাকে বাবা-মার প্রতি। বাবা-মা যেন কখনই দুঃখ না পান, সেদিকে খেয়াল রাখা সন্তানেরই কর্তব্য। অনর্থক অর্থের অপচয় করা তাদের শোভা পায় না। ধনাঢ্য বন্ধুদের দেখাদেখি অনেক মধ্যবিত্তের সন্তান সে মত চলতে চায়, আর তাতেই আভিজাত্য মনে করে। কিন্তু এ ধারনাটাই তাদের ভুল। প্রত্যেকেরই তাদের শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হওয়া উচিত। এ বোঝার মধ্যে, একে মেনে নেয়ার মধ্যে কোন দীনতা নেই, বরং বাবা-মা'র পাঠানো স্বল্প টাকায় যে সন্তান সাধারণভাবে চলার দৃঢ়তা দেখায়, তারাই পরবর্তীতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে সসম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। 

আরও একটা বিষয়ে সন্তানরা ভুল করে থাকে, তাহল প্রতিষ্ঠিত না হয়েই আর একটি জীবনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া। এজন্য তাদের লেখাপড়ায় যেমন বিঘ্ন ঘটে, তেমনি পায়ের নিচের মাটিও শক্ত হয় না, ফলে জীবনীশক্তিরও নিম্নগতি শুরু হয়। সংসার জীবন শুরু করার আগে বাবা-মা'র প্রতিও সন্তানের কিছু কর্তব্য থাকে। ভাই-বোনের প্রতি দায়িত্ব থাকে। সেগুলোর কিছুটা হলেও পালন করতে হয়। বাবা-মা'ই সঠিক সময়ে নতুন সংসার শুরু করার সব বন্দোবস্ত করে দেন। তাই এ বিষয়ে তাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়, তাতে বাবা-মা'র মন যেমন শান্তি পায়, তেমনি তাদের বর্ষিত আশীর্বাদে সন্তানের চলার পথ সুগম হয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় সন্তানরা সে পথে না গিয়ে ভুল সিদ্ধান্তে দিক হারায়। তার ফলশ্রুতিতে তারা যেমন জীবনে সার্থকতা লাভ করতে পারে না, তেমনি বাবা-মাও সন্তানের অধঃপতনে অসুখী হন। 

তীব্র অভিমানে সন্তানদের কাছ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। বড় কঠিন সে সরে যাওয়া, বড় বেদনার সে অন্তরাল। যা কারো জন্যই শুভ ফল দেয় না। দিতে পারে না। দিন বদলাতে পারে, যুগ পাল্টাতে পারে, কিন্তু সন্তানস্নেহ কখনও পাল্টায় না, পাল্টাতে পারে না। সেটি আজও অমলিন, আজও চির জাগরুক প্রত্যেক বাবা-মার অন্তরের অন্তঃস্থলে। তাই প্রত্যেক সন্তানের উচিত বাবা-মা যেন কখনও অসুখী না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখা ও অধিক যত্নবান হওয়া।
-
আমাদের জন্মভূমিও মায়ের সমান। তাই জন্মভূমি ভারতবর্ষের অবমাননাকারী, হিংসাকারী, দেশবিরোধী, কালোবাজারী, সংস্কৃতি-ধ্বংসকাী, সংবিধান-অমান্যকারীদের তীব্র নিন্দা করুন। জয় ভারতমাতা
-
শ্রীরাম........
সীতারাম......
সীতারাম............. 
জয় জয় রাম ..............

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

কাল কপাল মহাকাল

কামাখ্যায় এক মঠের সন্ন্যাসী সাধক ছিলেন --- স্বামী জ্ঞানানন্দ মহারাজ, জন্মস্থান - বর্ধমান। সংসারে তাঁর একমাত্র বন্ধন ছিলেন মা। মায়ের দেহান্তের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বর্ধমান, পুরী, ভুবনেশ্বর, হরিদ্বার, কাশী ও প্রয়াগ প্রভৃতি তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করে নিজের বাসস্থান, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সৎ কাজের জন্য দান করে দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মঠের যে কামরাটিতে আশ্রয় নেন, সেখানে থেকে রাত্রি ৩টে একমাত্র স্নান ছাড়া অন্য কোন কারণেই মঠের বাইরে যেতেন না। এমনকি তিনি তাঁর সুদীর্ঘ ৬২ বৎসরের সন্ন্যাস জীবনে মায়ের মন্দির দর্শন করেন নি। পবিত্র সন্ন্যাস-ধর্ম যে কী কঠিনতম ব্রত, তা অজগর-বৃত্তিধারী এই মহাতপা যোগীর পুণ্যজীবন দেখলে তবেই মর্মে মর্মে অনুভব করা যায়।
No automatic alt text available.
তাঁর জীবন-দর্শনের একটা কাহিনী শুনুন ---
এক ভক্ত একদিন স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ব্যবসায় বিপর্যয়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করে উন্নতির উপায় খুঁজতে এসেছেন। তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের এক বিখ্যাত ব্যবসায়ী। স্বামীজীর আশীর্বাদে ব্যবসায় তিনি বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু আজ সর্বহারা। সেই তিনিই স্বামীজীকে বললেন --- 'আপনার আশীর্বাদে আমি বহু অর্থ উপার্জন করেছিলাম, অহংকারে আমি আপনার অবদান মানিনি, আজ বড়ই দুঃসময়, গতবছর থেকে ব্যবসায়ে মার খাচ্ছি। আপনি আশীর্বাদ করুন, কিছু প্রতিকার দিন, যাতে ব্যবসায় বিপর্যয় কাটিয়ে আমি আমার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসিা।' 

স্বামীজী বললেন --- সে কি! আমি আবার তোমার ভাগ্য ফিরালাম কবে? আমি নিজে ভিখিরি, মায়ের দুয়ারে পড়ে আছি। ভিখিরি আবার টাকার সন্ধান জানবে কি করে? তুমি তোমার কর্ম অনুযায়ী ফল পেয়েছ বা পাচ্ছ। অতবড় পণ্ডিত ছেলে তুমি, পাছে টাকার প্রয়োজনে অন্য কোন বৃত্তি তুমি অবলম্বন করে ফেল, এজন্য বলেছিলাম রসায়ন জান যখন আছে, আয়ুর্বেদের চর্চা করে বিশুদ্ধ কবিরাজী ঔষধের ব্যবসা কর। আশা ছিল - তোমার সংসারের প্রয়োজনও মিটবে আর যে বিরাট প্রতিভা থেকে তোমার জন্ম, হয়ত একদিন তোমার হাত দিয়ে কোন বিস্ময়কর ওষুধও বের হয়ে যেতে পারে। নতুবা আমার মত ভিখিরি, টাকার সুলুক-সালুক কি করে জানবে বাবা! ছিঃ বাবা, সন্ন্যাসীর কাছে টাকা চাইতে নেই, টাকা দিতে নেই, টাকার প্রসঙ্গ তুলতেও নেই।
স্বামীজীর এই কথা শুনে ভক্ত বড় কাতর হয়ে পড়লেন। কিছু পরে স্বামীজী উঠে পড়লেন।
স্বামীজী ভক্তকে বললেন --- 'চল বাবা, উপরে ছাদে যাই।'

দু'জনে উপরে উঠে গেলেন। তিনতলায় ছাদের উপর তখন মঠ সংলগ্ন একটা অশ্বত্থ গাছের ছায়া পড়েছে। সূর্যাস্ত হতেও তখন বেশী দেরী ছিল না। হঠাৎ স্বামীজী ভক্তকে জিঞ্জেস করলেন --- 'বাবা! এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি- তুমি ও আমি, একটু আগেও এখানে রোদ ছিল, কিন্তু এখন ছায়া পড়েছে। এই যে ছায়া এটা কি সূর্যের জন্য?'
ভক্ত বললেন --- 'কালের জন্য। সন্ধ্যা হয়ে আসছে- তাই ছায়া।'
স্বামীজী বললেন --- 'আবার রোদ আসবে?'

ভক্ত বললেন --- 'হ্যাঁ, আবার রাত্রি গত হলে কাল সকালে এইখানে রোদ আসবে। '
স্বামীজী বললেন --- 'তবে দেখ, রোদের পর ছায়া, দিনের আলোর পর সন্ধ্যা - এই তো নিয়ম। কাল শুভ হয়েছিল, তোমার ঐশ্বর্য হয়েছিল, এখন সন্ধ্যা - অপেক্ষা কর, আবার ঘুরে ঘুরে সূর্যের আলো এইখানেই এসে পড়বে- এই নিয়ম। এতে কারও হাত নেই। মনে কর, একটা ফেরিওলা, হাসিমুখে ফেরি করতে করতে চলে গেল পশ্চিম দিকে। তুমি বসে আছ এখানে। এখন তুমি যদি তাকে ঐখানে আটকে রাখতে না পার অথচ তার থেকে কিছু কিনতে যদি ইচ্ছা কর, তাহলে তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে, ঠায় ঐখানটায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ না সে ফেরি করতে করতে আবার ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরে আসে। আবার এটাও ভেবে দেখা দরকার, ঠিক এই পথ দিয়েই সে আসতেও পারে, নাও পারে। এলেও হাসিমুখে তার জিনিস বেঁচবে কি না তারও কোন ঠিক নেই। সবই তাঁর ইচ্ছা। সেই মহাকাল সব নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমি সাধারণ মানুষ, তোমার ভাগ্য ফিরাব কি করে!'

Courtesy by: 
Prithwish Ghosh
Share:

সাধক বামাক্ষ্যাপা (১৮৪৩-১৯১১)

তারাপীঠের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ সাধক হলেন বামাক্ষ্যাপা (১৮৪৩-১৯১১) তিনি মন্দিরে পূজা করতেন এবং শ্মশানে সাধনা করতেন। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের অপর প্রসিদ্ধ কালীভক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসের সমসাময়িক। অল্প বয়সেই তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং কৈলাসপতি বাবার সান্নিধ্যে তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। পরে তিনি সমগ্র তারাপীঠের প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। ভক্তেরা তাঁর কাছে আশীর্বাদ বা আরোগ্য প্রার্থনা করতে আসত। কেউ কেউ আবার শুধুই তাঁকে দর্শন করতে আসত। তিনি মন্দিরের নিয়ম মানতেন না।

Image may contain: 1 person
একবার নৈবেদ্য নিবেদনের পূর্বে খেয়ে ফেলে তিনি পুরোহিতদের রোষ দৃষ্টিতে পড়েছিলেন। শোনা যায়, এরপর তারাদেবী নাটোরের মহারানিকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে দেবীর পুত্র বামাক্ষ্যাপাকে প্রথমে ভোজন করাতে আদেশ দেন। এরপর থেকে মন্দিরে দেবীকে নৈবেদ্য নিবেদনের পূর্বে বামাক্ষ্যাপাকে ভোজন করানো হত এবং কেউ তাঁকে বাধা দিতেন না। কথিত আছে, তারাদেবী শ্মশানক্ষেত্রে ভীষণা বেশে বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন দিয়ে তাঁকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন।
শৈশবে তিনি এতাই সরল ছিলেন যে, প্রতিবেশীরা তাঁকে বলতেন ‘হাউড়া’ অর্থাৎ নির্বোধ। লেখাপড়ায় তাঁর কোনদিনই মন ছিল না—অভিনয় করতে ভালবাসতেন। তাঁর দিদি জয়কালী দেবীও অল্পবয়সে বিধবা হয়ে সন্ন্যাসিনী হন।

সেই সময় তারাপীঠ মন্দিরের পরিচালনভার ছিল নাটোর রাজের হাতে। তাঁর কর্মচারী দূর্গাদাস সরকার সব কাজ দেখাশোনা করতেন। এই দূর্গাদাসের মাধ্যমেই তারাপীঠের তন্ত্রসাধক কৈলাসপতির সঙ্গে বামাচরণের পরিচয় হয়। কৈলাসপতি বাবা এবং মন্দিরের প্রধান কৌলাচার্য মোক্ষদানন্দের পদতলে বসেই চিরকুমার বামদেবের তন্ত্রসাধনা শুরু হয়। শেষপর্যন্ত ক্ষেপাবাবাই তারাপীঠের প্রধান কৌলপদে বৃত হন। বাংলা ১৩১৮ সালের শ্রাবণ মাস পর্যন্ত তিনি তাঁর নরলীলায় জগৎকল্যাণ করেছেন।
দেবতা ও মানুষে, মানুষ ও পশুতে, জাত ও বেজাতে এবং ধনী ও দরিদ্রে বামদেবের কোনও ভেদজ্ঞান ছিল না। তিনি ছিলেন বাকসিদ্ধ—তাঁর মুখের কথাই ছিল সত্য। ফলে তিনি কখনও কখনও এমন কথা বলে ফেলতেন, যেটা অন্যের পক্ষে ভয়ের বা আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠত। এখানে সেরকমই একটা ঘটনার কথা বলছি।

তারাপীঠের নগেন পাণ্ডা সে-সময়ে খুবই খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরই খুব পরিচিত স্থানীয় একজন জমিদার—নাম পূর্ণচন্দ্র সরকার হঠাৎই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সবরকম ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েও রোগীর কিছুমাত্র উন্নতি হল না। এবার নগেন পাণ্ডা এসে ধরলেন বামদেবকে। তাঁর অনুরোধ, ওই জমিদারকে রোগমুক্ত করে দিতেই হবে। একবার যদি ক্ষেপা মুখ ফুটে বলেন সে কথা, তাহলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। কারণ, ক্ষেপা হচ্ছেন বাকসিদ্ধ।

খুব আদর করে পাল্কিতে চাপিয়ে নগেন পাণ্ডা বামদেবকে নিয়ে গেলেন জমিদার বাড়িতে। যাওয়ার পথে নগেন পাণ্ডা ক্ষেপাকে বোঝাতে লাগলেন, ‘বাবা, আপনাকে বিশেষ কিছু করতে হবে না - শুধু রোগীর কাছে গিয়ে জোর গলায় বলবেন, এই উঠে বোস্, তোর রোগ ভাল হয়ে গেছে। আপনি মুখ দিয়ে ওইটুকু বললেই কেল্লা ফতে।’

বামাক্ষেপা সরল শিশুর মতোই বললেন, ‘তুমি যখন বলছ, তখন তা-ই বলব। যদি ভুলে যাই, তুমি আমাকে একটু মনে করিয়ে দিও নগেন কাকা।’ ক্ষেপার কথা শুনে নগেনের আনন্দ আর ধরে না।
তারপর একসময় পাল্কি গিয়ে ঢুকল জমিদার বাড়িতে। সবাই মিলে দারুণ খাতির করে ক্ষেপাকে নিয়ে গেলেন রোগশয্যায় শায়িত জমিদারের কাছে। কিন্তু রোগীর ঘরে ঢুকেই ক্ষেপা যা বললে তাতে সকলের আক্কেল গুড়ুম। রোগীকে দেখে ক্ষেপা বললেন, ‘ও নগেন কাকা, এ শাল তো এখনি ফট।’ ফট মানে শেষ। অর্থাৎ, এ রোগীর আর আশা নেই, এখনই প্রাণান্ত হবে একথা বলেই ক্ষেপা, এসে পাল্কিতে উঠে বসলেন। ওদিকে রোগীও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এতে নগেন পাণ্ডা রাগতস্বরে ক্ষেপাকে বললেন, ‘এ আপনি কি করলেন। এরকম করবেন জানলে, আমি আপনাকে এখানে নিয়েই আসতাম না।’

সরল বালকের মতোই ক্ষেপা উত্তর দিলেন, ‘আমি তো তোমার শেখানো কথাই বলতে গিয়েছিলাম, কিন্তু মা তারা যে বাধা দিলেন, বললেন, ওকথা বলিস না, বলে দে ফট। আমি তো তাই বললাম। এই হলেন সাধক বামক্ষেপা।’

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

পৃথিবীর জীব-কল্যাণ ও বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে আর্য(হিন্দু)-দের অবদানের এক ক্ষুদ্র অংশ

Image may contain: 1 person, sitting
=> দশমিক পদ্ধতির প্রথম প্রচলন ও ব্যবহার করেন-মহর্ষি আর্যভট্ট 
=> প্রথম সাইন(sine) সারণী তৈরী করেন-আর্যভট্ট 
=> Continued Fraction আবিষ্কার করেন-ভাস্কর আচার্য্য (Vaskar II) 
=> শল্যবিদ্যার জনক (The Father of Surgery) বলা হয়- মহর্ষী শুশ্রুতকে
=> ঔষধের জনক (The Father of Medicine) বলা হয়- মহর্ষী চরককে।
=> প্রথম পরিপাক(Digestion), বিপাক(Metabolism) (দেহমধ্যে সজীব উত্পাদনের রাসায়নিক পরিবর্তন) ও রোগ প্রতিরোধ(Immunity) এই তিনের ধারনা প্রদান ও ব্যাখ্যা করেন-মহর্ষী চরক।
=> পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণিকার পরমাণু নাম করণ প্রথম করেন-কণাদ।
=> পৃথিবীর প্রথম বীজ গণিতের উপর বই রচনা করেন-মহর্ষি আর্যভট্ট.
=> পাই এর নির্ভুল মান ও পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রথম প্রায় নির্ভুল মাপেন- মহর্ষি আর্যভট্ট
=> কৃত্রিম জীন আবিস্কারক -হরগোবিন্দ খোরানা
=> প্লাস্টিক সার্জারীর জনক - মহর্ষি শুশ্রুত
=> শূন্যের (০) ব্যবহার প্রথম চালু করেন আর্য্যভট্ট
=> গাছের প্রাণ আছে তা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু
=> পৃথিবীর প্রথম ও সর্ব প্রাচীন ২টি বিশ্ববিদ্যালয় হল প্রাচীন ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে ততকালে চীন, জাপান, গ্রিস, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরপের নানান অংশ থেকেও ছাত্ররা জ্ঞান অর্জন করতে আসত। এর মধ্যে নালন্দা ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেন এবং তক্ষশিলারও একই পরিণতি হয়। বলাবাহুল্য এই বিশ্ববিদ্যালয় দুটো ধ্বংস না হলে এই উপমহাদেশ এখন ও পৃথিবীতে রাজত্ব করতো।
=> ব্রহ্মগুপ্ত, শ্রিনিবাস রামানুজন, মহাবীর, বৌধ্যায়ন, কাত্যায়ন, মানব, পিঙ্গল, মাধব কর, নাগার্জুন ......... ইত্যাদিরা সকলেই হিন্দু ...... কেউই সেকুলার না......
তালিকা বাড়ালে আর শেষ করা যাবে না..........
উল্লেখ্য ........... এখন .... নাসার ৩৬ শতাংশ বিজ্ঞানী ভারতীয় তথা হিন্দু.........
আর ভারতের ISRO-র কথা তো বাদই দিলাম ......


Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

দুষ্টু নিমাই শিষ্ট 'শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য'

Image may contain: 1 person, closeupশ্রী গৌর হরির পিতা জগন্নাথ মিশ্র ও মাতা শচী দেবী। জগন্নাথ মিশ্রের পরপর আট কন্যা হয়। কিন্তু কেহই জীবিত ছিলনা। তার পরে এক পুত্র হয়। নাম তার বিশ্বরূপ। পুত্রের বয়স যখন আট বছর তখন জগন্নাথ মিশ্রের বাবা-মায়ের নিকট হতে একটা পত্র আসল। তাতে লেখাছিল যে, সত্বর যেন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সিলেট তাঁদের কাছে আসেন। পিতার মাতার এই আজ্ঞা পেয়ে শচী দেবী ও জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং কিছুদিন পর নিজ গৃহে মাতা-পিতার নিকট পৌছান।

১৪০৬ শকাব্দের মাঘ মাসে শচী দেবী আবার গর্ভস্ত হলেন। শোভা দেবী (শাশুড়ীমাতা) রাত্রিতে স্বপ্ন দেখেন যে, কোন মহাপুরুষ তাঁকে বলছেন যে, পুত্রবধুর গর্ভে স্বয়ং ভগবান প্রবেশ করেছেন এবং শচীদেবীকে নবদ্বীপ পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। এইজন্য জগন্নাথকে শচীদেবীসহ নবদ্বীপে যাওয়ার জন্য শোভা দেবী আদেশ করলেন। জগন্নাথ মিশ্র মহাশয় শচীদেবীকে নিয়ে নবদ্বীপের বাড়ীতে আসলেন। শচীর দেবীর গর্ভ দশমাস উত্তীর্ণ হল তবু পুত্র কন্যা কিছুই হল না। ক্রমে একাদশমাস, দ্বাদশ মাস উত্তীর্ণ হল তবুও সন্তানের জন্ম হল না। ১৪০৭ শকাব্দের ফাল্গুন মাস আসল জগন্নাথ মিশ্র ব্যস্ত হয়ে শ্বশুর নীলাম্বর চক্রবর্তীকে ডাকালেন। নীলাম্বর পন্ডিত গননা করে বললেন অতি সত্বর শচীর সন্তান হবে। তার গর্ভে কোন এক মহাপুরুষ জন্ম নেবেন। একথা শুনিয়া সকলে স্বস্তি পেলেন।
চৌদ্দশত সাত শকে মাস যে ফাল্গুন।

পৌর্নমাসী সন্ধ্যাকালে হৈল শুভক্ষণ,
সিংহ রাশী, সিংহ লগ্ন উচ্চ প্রহসন।
ষড়বর্গ অষ্টবর্গ সবর্ব শুভক্ষণ।
অর্থাৎ ১৪০৭ শকাব্দে জাহ্নবী তীরস্থ পরীশোভিত নবদ্বীপ নগরে। মনোহর ফাল্গুন মাসে, নির্মল পূর্ণিমা সন্ধ্যায় শ্রী গৌরাঙ্গদেব অবতীর্ণ হলেন। যখন পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পূর্বদিকে একখানা উজ্জ্বল থালার মত চন্দ্র উদিত হল। অমনি গৌরাঙ্গ সিংহ রাশিতে পূবর্বফাল্গুনী লক্ষত্রে মাতৃগর্ভ হতে অবির্ভত হলেন। নবদ্বীপবাসী প্রফুল্ল মনে হরিধ্বনি করতে লাগলেন। এভাবে হরিধ্বনির সহিত গৌরাঙ্গ দেব অবিভূত হয়ে ছিলেন। নীম বৃক্ষের তলে জন্ম হয়েছিল বলে শচীমাতা ছেলের নাম নিমাই রাখলেন।

সেসময় নবদ্বীপ বুদ্ধিমান ও নৈয়ায়িক পন্ডিত দ্বারা পূর্ণছিল। ভক্তির লেশ ছিল না। এমনই সময় শ্রী গৌরহরি ভক্তিরস বিতরণের জন্য নদীয়ায় অবর্তীর্ণ হলেন।
কলোহ প্রথম সন্ধ্যায়ং গৌরাঙ্গ অহর মহীতটে।
ভাগীরথী তটে ভূবী ভবিষ্যামী সনাতন। ----ব্রহ্ম পূরাণ
অর্থাৎ কলির প্রথম সন্ধ্যায় গৌরাঙ্গরূপে এই ধরাতলে ভগীরথী তীরে আবির্ভূত হব।
চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার রাত্রে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম। তাঁর পিতামাতা ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপের অধিবাসী জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবী। চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশার জাজপুরের আদি বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন।

চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত। তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি ছিল অবিসংবাদিত। জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছেলেবেলা থেকেই বজায় ছিল, তা জানা যায় তাঁর জীবনের নানা কাহিনি থেকে। কিন্তু তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ ও জ্ঞানার্জন। পিতার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ডদান করতে গিয়ে নিমাই তাঁর গুরু ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বর পুরীর নিকট তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর পণ্ডিত থেকে ভক্ত রূপে তাঁর অপ্রত্যাশিত মন পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্য হয়ে যান। অনতিবিলম্বে নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।

কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর নিমাই 'শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য' নাম গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। এই সময় তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে। ওড়িশার সূর্যবংশীয় সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্যমহাপ্রভুকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।

তিনি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ছিলেন ভাগবত পুরাণ ও ভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করেন এবং হরে কৃষ্ণমহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন। সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাষ্টক নামক প্রসিদ্ধ স্তোত্রটিও তাঁরই রচনা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুসারে, ভাগবত পুরাণের শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে রাধারানির ভাবকান্তি সংবলিত শ্রীকৃষ্ণের চৈতন্য রূপে অবতার গ্রহণের কথা বর্ণিত হয়েছে।

চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বাশ্রমের নাম গৌরাঙ্গ বা নিমাই। তাঁর গাত্রবর্ণ স্বর্ণালি আভাযুক্ত ছিল বলে তাঁকে গৌরাঙ্গ বা গৌর নামে অভিহিত করা হত। অন্যদিকে নিম বৃক্ষের নিচে জন্ম বলে তাঁর নামকরণ হয়েছিল নিমাই। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী সাহিত্য বাংলা সন্তজীবনী ধারায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল। সেযুগে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীরচৈতন্য চরিতামৃত,বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের চৈতন্য ভাগবত, এবং লোচন দাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল।

ছেলেবেলায় দুষ্টুমি করাটা সকলেরই মজ্জাগত। দুষ্টুমী না করলে ছেলেবেলা সার্থক হয় না। এবার এমন একজন বিখ্যাত মানুষের নাম শোনাব, যাঁর দুষ্টুমিতে সারা নবদ্বীপ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
ঠাকুরদা, মধুকর মিশ্র ওড়িশার যাজপুর থেকে রাজা ভ্রমরের অত্যাচারের ভয়ে ,অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টে এসে বসবাস শুরু করেন। এই শ্রীহট্টই হলো এখনকার সিলেট। পরে, মধুকর মিশ্রের ছেলে জগন্নাথ মিশ্র সংস্কৃত শেখার জন্য নদীয়া জেলার নবদ্বীপে এসে সেখানেই থেকে যান।

পড়াশুনো শেষ হলে, জগন্নাথ মিশ্র, নীলাম্বর চক্রবর্তীর মেয়ে শচীদেবীকে বিয়ে করেন। এঁদের পরপর সাত মেয়ে হলেও সব কটা অকালে মারা যায়। পরে,দুই ছেলে- বিশ্বরূপ আর বিশ্বম্ভর কিন্তু অকালে মারা যান নি। সেকালে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেত সবার। ষোলো বছরে বিশ্বরূপের বিয়ের কথা হলে, তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়ে চলে যান।

জগন্নাথ মিশ্র ভাবলেন- অল্প বয়সে বেশী পড়াশোনার করার ফলেই বড় ছেলের এই হাল! একে তো সাত মেয়ে মারা গেছে, তার ওপর বড় ছেলে বিবাগী হয়ে চলে গেল, ফলে বিশ্বম্ভর কে আর পড়াশোনা করতেই পাঠালেন না!!!!!! বিশ্বম্ভরের ডাক নাম ছিল নিমাই! 
কিন্তু, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক!!!!!! দুষ্টু নিমাই পরে কি হয়েছিল, সেটা বলছি!!!! তার আগে ওর ছেলেবেলার কথা বলে নিই! খুব মজা পাবে।

ওহো! নিমাইয়ের জন্ম তারিখটা তো বলতেই ভুলে গেছি। ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার সন্ধে ৬ টা থেকে ৭টার মধ্যে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে নিমাইয়ের জন্ম।
পাঁচ বছর থেকেই মহা দুষ্টুমি শুরু করেছিল এই নিমাই। তখনকার সব লোক গঙ্গাতে স্নান করতে যেতেন। একটা বিশ্বাস তখনও ছিল, এখনও আছে! গঙ্গাতে স্নান করলে নাকি সব পাপ দূর হয়। তাছাড়া, তখন তো আর ঘরে ঘরে স্নানঘরে শাওয়ার, বাথটাব ছিল না! ফলে লোকে গঙ্গাতেই স্নান করত। আর সেখানেই শুরু হত নিমাইয়ের দুষ্টুমি! ব্রাহ্মণরা স্নান করে উঠলেই গায়ে গোবোর মেশান কাদা ছুঁড়ে দিতেন। কারও শিবঠাকুর নিয়ে পালিয়ে যেতেন। বাচ্চা মেয়েদের চুলে ওকরা নামের একটা কাঁটা ওয়ালা ফলের বীচি ছুঁড়ে দিতেন। চুল জট পাকিয়ে যেত। সে এক কেলেঙ্কারী!!!!!! 

জগন্নাথ মিশ্র সাধে কি, দুঃখ করে লিখেছিলেন!!!!!!!:-
“এহি যদি সর্বশাস্ত্রে হবে গুণবান্।
ছাড়িয়া সংসার সুখ করিবে পয়ান।।
অতএব ইহার পড়িয়া কার্য্য নাই।
মূর্খ হৈয়া ঘরে মোর থাকুক নিমাঞি।।”
তোমরা ভাবছ, আমি বানান ভুল করেছি? আরে না! এটা ১৪৭৩ সালে লেখা!!!!! তখনকার বানান গুলো এরকমই ছিল। আমি ওটা অবিকল তুলে দিয়েছি।
ওই বাচ্চা মেয়েরা নিজেদের বাবা মার কাছে গিয়ে বলত: ---
“বলে মোরে চাহে বিভা* করিবারে”
*বিভা= বিবাহ বা বিয়ে।
পরে আর এক মেয়ে বলছে:-
“পূর্বে শুনিলাম যেন নন্দের কুমার।
সেইমত কি তোমার পুত্রের ব্যাবহার।।”
আর একজন ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্রকে বলছেন ---
“সন্ধ্যা করি জলেতে নামিয়া।
ডুব দিয়া লৈয়া যায় চরণ ধরিয়া।।”
বোঝো কাণ্ড নিমাইয়ের!! ওই পাঁচ বছর বয়সেই ডুব সাঁতার শিখে গেছিল। ব্রাহ্মণ, স্নান সেরে জপ করছেন জলে নেমে আর নিমাই ডুব সাঁতার দিয়ে ব্রাহ্মণের পা টেনে আবার জলে ফেলে নাকানী চোবানী খাওয়াচ্ছেন! 
“কেহ বলে মোর শিবলিঙ্গ করে চুরি।
কেহ বলে মোর লয়ে পলায়ে উত্তরী*।।”
*উত্তরী= উত্তরীয় বা গায়ে দেওয়ার চাদর!
এবার দিনে দিনে বেড়েই চলল, নিমাইয়ের দুষ্টুমী! একদিন এঁটো রান্নার হাঁড়ির ওপর বসে খালি দুলতে লাগল! আর সঙ্গে ঠন্ ঠনা ঠন্ আওয়াজ !!
মা, শচী দেবী বকলেন! বললেন:- ভদ্রতা জানিস না? নিমাই নাকি এর উত্তরে বলেছিল -- (এটা পরে অন্য লোকে লিখেছেন)
“প্রভু বলে মোরে, না দিস পড়িতে।
ভদ্রাভদ্র মূর্খ বিপ্র জানিবে কি মতে।।
মূর্খ আমি না জানি যে ভাল মন্দ স্থান।
সর্বত্র আমার এক অদ্বিতীয় স্থান।।”
এখন আর জগন্নাথ বাবুর কোনো উপায় থাকল না! গ্রামের সকলের পরামর্শে, নিমাইকে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পাঠিয়ে দিলেন পড়তে! 
শচী দেবীর হলো বিপদ! ছেলে আর বই ছেড়ে ওঠে না! শচী দেবী ভাবলেন- ছেলে পাগল হয়ে গেছে!!!!
এ ব্যাপারে লেখা আছে --
“কিবা স্নানে কি ভোজনে কিবা পর্যটনে।
নাহিক প্রভুর আর চেষ্টা শাস্ত্র বিনে।।
আপনি করেন প্রভু সুত্রের টিপ্পনী।
ভুলিয়া পুস্তক রসে সর্বে দেবমণি।।
না ছাড়েন শ্রীহস্তে পুস্তক একক্ষণে।.....
পুঁথি ছাড়িয়া নিমাঞি না জানে কোনো কর্ম।
বিদ্যারস ইহার হয়েছে সর্বধর্ম।।
একবার যে সুত্র পড়িয়া প্রভু যায়।
আরবার উল্টিয়া প্রভু সবারে ঠেকায়।।”
এই দুষ্টু নিমাই কালে কালে হয়ে উঠলো মস্ত পণ্ডিত! নাম হলো চৈতন্যদেব!

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

দেবী কিরীটেশ্বরী

Image may contain: one or more peopleমুর্শিদাবাদ জেলার প্রাচীন জনপদ-- নবগ্রামের কিরীটেশ্বরীমন্দির, ডাহাপাড়া থেকে প্রায় চার কিমি পশ্চিমে, মুর্শিদাবাদের প্রাচীনতম দেবস্থান। এখানে দেবীর কিরীট পড়েছিল বলে এটি একটি পীঠস্থান বা মতান্তরে উপপীঠ।
পৌষ মাসের শেষ মঙ্গলবারের পূজা ও এই কালীমন্দিরকে ঘিরে সুদূর অতীত থেকে ওই এলাকায় প্রতি বছর পৌষ মাস জুড়ে মেলা হয়ে আসছে। পৌষ মাস জুড়ে মেলা হলেও মানুষের ঢল নামে মূলত মঙ্গলবার ও শনিবার। তার মধ্যে আবার মঙ্গলবারের ‘মাহাত্ম্য’ই বেশি বলে বিশ্বাসী লোকজনের ঢল নামে ওই দিন। প্রাচীন কালীমন্দির ঘিরে নানান কিংবদন্তী প্রচারিত থাকায় মুর্শিদাবাদ ও লাগোয়া ৪টি জেলা বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া ও মালদা থেকে দলে দলে পূণার্থীরা এখানে ভিড় করেন। দেবীর পায়ে অঞ্জলি দেওয়ার পাশাপাশি বন্ধু অথবা পরিবারের লোকজনদের নিয়ে তাঁরা মন্দির চত্বর জুড়ে পৌষ মাসের বনভোজনেও মেতে ওঠেন।

 ফলে দিনভর ভিড়ে ঠাসা ওই এলাকার অন্তত পৌষ মাসে যথেষ্ট আর্থিক উন্নতি ঘটে। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনি’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১১৫ বছর আগে ১৩০৪ বঙ্গাব্দে। ওই গ্রন্থের‘ ‘কিরীটেশ্বরী’ র্শীষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “প্রবাদ আছে যে, দক্ষযজ্ঞে বিশ্বজননী পতিপ্রাণা সতী প্রাণত্যাগ করিলে, ভগবান বিষ্ণু তাঁহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, সেই সময় দেবীর কিরীটের একটি কণা এই স্থলে পতিত হয়; তজ্জন্য ইহা উপপীঠ মধ্যে গণ্য এবং ইহার অধিষ্ঠাত্রী কিরীটেশ্বরী বলিয়া কীর্তিতা।” ‘রিয়াজুস্-সালাতীন’ গ্রন্থে, মেজর রেনেলের কাশিমবাজার দ্বীপের মানচিত্রে ও তন্ত্রচূড়ামণির ‘পাঠনির্ণয়’-এ কিরীটেশ্বরী উল্লেখ রয়েছে বলেও নিখিলনাথ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন। নবাব মুর্শিদকুলির আমলে বাংলার কানুনগো ছিলেন দর্পনারায়ন রায়। নিখিলনাথের মতে, “দর্পনারায়ন রায় কিরীটেশ্বরী মেলার সৃষ্টি করেন।”

তন্ত্রচূড়ামণি, মহানীলতন্ত্র প্রমুখ গ্রন্থে বিখ্যাত শক্তিপীঠ হিসেবে কিরীটকণার উল্লেখ রয়েছে। এই মন্দিরও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন। পাঠান-মুঘলরাও পুজো দিতেন এই দেবীকে। জনশ্রুতি, মীরজাফর অন্তিম শয্যায় দেবীর চরণামৃত পান করে দেহজ্বালা প্রশমিত করেন। তার সঙ্গেই শাক্তক্ষেত্রে শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব লীলার প্রকাশভূমিও বটে। শোনা যায়, মঙ্গল নামের এক বৈষ্ণবের পূর্বপুরুষ ছিলেন এই মন্দিরের সেবক। মঙ্গলকে শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণবমতে দীক্ষিত করলে মন্দিরে দৈন্য দশা নেমে আসে। পরে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বঙ্গাধিপতি দর্পনারায়ণ মন্দির সংস্কার করেন এবং কয়েকটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। খনন করান কালীসাগর নামে এক দীঘি। মন্দিরটি পশ্চিমদ্বারী এবং মূর্তিহীন। গর্ভগৃহে একটি উঁচু বেদীর উপরে একটি ছোট বেদী দেবীর কিরীট রূপে পূজা পায়। মন্দিরের কাছেই গুপ্তমঠের নতুন মন্দিরে লাল কাপড়ে কিরীট-টি ঢাকা থাকে, রক্ষা করা হয় সযতনে। কোনও সময়েই তা দেখা বারণ। কিরীটেশ্বরী মন্দির কমিটির পূজারী রক্ষাকর বলেন, “আগে দেবীর অনেক সম্পত্তি ছিল। ছিল ১০০টি মন্দির। বর্তমানে অধিকাংশ জমিই বেহাত হয়ে গিয়েছে। পোড়ামাটির বাংলা ইটের তৈরি মন্দির গুলিরও অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১২ বিঘা জমির উপর রয়েছে মূল মন্দির ছাড়াও আরও ২৫-৩০টি মন্দির।”


Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

ডঃ খনা


Image may contain: 1 person, closeup
'খনার বচন' শোনেনি এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া মুস্কিল, কিন্তু খনার বৃত্তান্ত জানেন এমন লোক খুবই কম। কে ছিলেন এই খনা? কিভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী একজন মহিলার মুখ থেকে উচ্চারিত বাণী শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষের একটা বিরাট অংশে ছড়িয়ে পড়লো আর যুগ যুগ ধরে তা মানুষের স্মৃতিতে জেগে রইলো? খনার বচনের প্রাদুর্ভাব আসাম থেকে কেরালা পর্যন্ত বিস্তৃত। হোরাশাস্ত্র সম্পর্কিত খনার বচনগুলোতে এর প্রমাণ মেলে। আবহাওয়া সম্পর্কিত খনার বচনগুলো বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যাতে প্রায় একই রকম। বিহারে কিছু বচন আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হলেও মূলতঃ এগুলো খনার বচনেরই অনুবাদ মাত্র। এইগুলো নিয়ে বিহারে একাধিক সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।


মোটকথা ভারতীয় উপমহাদেশে যে ভাষায়ই খনার বচন প্রচলিত হয়েছে তারাই খনাকে নিজেদের লোক বলে দাবি করেছেন। কিংবদন্তী অনুসারে খনা মিহিরের স্ত্রী। এই দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ খনার বচনেই আছে - খনা তার বচনে নিজেকে মিহিরের স্ত্রী এবং বরাহকে শ্বশুর বলে সম্বোধন করেছেন। খনার স্বামী মিহিরও ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতিষী, শ্বশুর বিক্রমাদিত্যের রাজ দরবারের নবরত্নের অন্যতম সদস্য। খনার ভবিষ্যৎবাণীর কারণে বরাহের খ্যাতি ম্লান হতে থাকে, এর ফলশ্রুতিতে খনাকে হত্যা করা হয় অথবা জিহ্বা কর্তন করা হয়। অবশ্য কোনো কোনো পণ্ডিত এ রকমও বলেছেন যে, খনাকে তার ভবিষ্যৎ বক্তৃতাবলীর জন্য নয় ব্রাহ্মণ বিদ্বেষের জন্য হত্যা করা হয়। কারণ খনা ছিলেন চার্বাকের অনুসারী 'নাস্তিক'। আবার কোনো কোনো গবেষক বলেছেন - খনা ছিলেন তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভিক্ষুণী। খনার জীবন কথা যেমন রহস্যে ভরা তেমনি হেঁয়ালিপূর্ণ তার রচনাবলী। জ্যোতিষ শাস্ত্রের ইতিহাসে তিনি অনুপস্থিত। খনার মৃত্যুর প্রায় চারশ বছর পর বাঙালি জ্যোতিষী প্রজাপতি দাসের পঞ্চস্বর ও ষষ্ঠী দাসের গ্রন্থে খনার বচনের উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু এখানেও তার পরিচয় অস্পষ্ট। প্রজাপতি দাসের গ্রন্থে খনার পরিচয় কখনো খনা কখনো লীলাবতী।

আসলে খনার বসবাস ছিলো বারাসাতের কাছেই বেড়াচাঁপার দেউলী গ্রামে। চব্বিশ পরগণার এই গ্রামটি দেগংগা থানার দেউল নগরে অবস্থিত ছিলো। রাজা ধুমকেতুর প্রপৌত্র রাজা চন্দ্রকেতুর শাসনামলে এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তখন থেকেই স্থানটিকে স্থানীয় লোকজন দেউলী বলে অভিহিত করে আসছেন। এখানে রাজবাড়ির অদূরে একখণ্ড জমিকে বরাহ ‘মিহিরের বাস্তু’ নামে লোকে অভিহিত করে থাকে। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন অবশ্য অনেক আগেই এ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, খনার স্বামী মিহির অধুনা বিলুপ্ত চন্দ্রপুর নামক স্থানে দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন, এটা ছিলো চন্দ্রকেতু রাজ্যে অবস্থিত একটি গড়। এ কারণে এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে, খনার জন্ম বাংলাদেশেই হয়েছিলো। ডঃ সেনের বর্ণনা মতে চন্দ্রকেতুর রাজভবনের পাশে এখনো একটি উঁচু মাটির স্তূপ দেখা যায় দিও জায়গাটি এখন জঙ্গল হয়ে আছে এবং স্থানীয় লোকদের ধারণা এটাই মিহিরের বাসস্থান ছিলো। ওখানকার লোকেরা বংশ পরমপরায় এ কথা বিশ্বাস করে আসছে। খনার বচনের উৎপত্তিস্থল চন্দ্রপুর বা চন্দ্রগড় হোক বা নাই হোক খনাকে নিয়ে এই স্থানটিকে নিয়ে লোকশ্রুতি প্রচলিত হওয়ায় স্থানটি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ‘চন্দ্রকেতু গড়ে যে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার হইয়াছে, তাহা দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, স্থানটি ভারতের অতি পুরাতন স্থানগুলির অন্যতম।’ শুধু এইা স্থানটি খনা এবং মিহিরের বসবাসরে কারণে সুপ্রাচীন স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এটাকে অনেকে তীর্থস্থান হিসেবে অভিহিত করেছেন। ড. কল্যাণ কুমারের ভাসায় চন্দ্রকেুত গড় পূর্ব ভারতের এক সুমহান তীর্থ ক্ষেত্র রূপে জাগ্রত হয়ে আছে।

এই ধরনের কথা আরো বহু পণ্ডিত বলেছেন। খনা মিহিরের বাসভবন বলে কথিত স্থানটিকে যুগে যুগে খনা মিহিরের ঢিপি বা 'পোঁতা' বলে আসছে। কিংবদন্তী অনুসারে রাজা চন্দ্রকেতু পূজার সময় নরবলি দিতেন ও তারই রোধকল্পে গোড়াইচাঁদ পীর চন্দ্রকেতু আক্রমণ করেন এবং রাজা ও তার পরিবারকে হত্যা করেন, অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় গোড়াইচাঁদ পীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চন্দ্রকেতু স্বপরিবারে আত্মহত্যা করেন এ কথার উল্লেখ দেখা যায়। কিংবদন্তীর কথা যদি বিশ্বাস করি তা হলো রাজা চন্দ্রকেতু খনা মিহিরের সমসাময়িক এ কথা ধোপে টিকে না, কারণ গোড়াইচাঁদ পীরের ঘটনাটি মুসলিম আমলের, এ কারণেই খনা মিহিরের বাস্তুভিটা এবং খনার বচনের উৎপত্তিস্থল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।

১৯০৬ সালে প্রকাশিত আর্কেওলজি অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ২৪ পরগণার লোকদের খনার বচন অনুসারে কৃষি পদ্ধতি, গাছ রোপণের ব্যাপকতা এবং বাসস্থান নির্মাণের কৌশল দেখে মনে হয় খনার বাসস্থান ২৪ পরগণাই ছিলো। খনার সমসাময়িক বিক্রমাদিত্য এ কথাও আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে, খনার ঢিপি থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা গেছে এগুলো গুপ্তযুগের। এখানে প্রাপ্ত মুদ্রা এবং দেয়ালের গায়ে রাজা-রাণীর উৎকীর্ণ বিবাহ চিত্র এর প্রমাণ। কিন্তু এতেও যে ভ্রম নিরসন হয় না। 

১৪শ’ এবং ১৫শ’ শতকের রচিত কিছু গ্রন্থে খনার বচনের উল্লেখ দেখা যায়, এতে মনে হয় খনা চতুদর্শ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বের লোক ছিলেন। তিনি তাহলে কি চতুদর্শ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর ও আগে কয়েক শতাব্দী ডিঙিয়ে গিয়েছেন হয়তো এমনটাই হবে, না হলে খনার বচনে বৈষ্ণব মতবাদ, ভক্তিবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে ছিটেফোঁটা ইঙ্গিতও নেই সেন আমলের জ্যোতিষ শাস্ত্র ছিলো ধর্ম নির্ভর কিন্তু খনার বচনে দেবদেবীর উল্লেখ নেই, আধ্যাত্মবাদও তার বচনে অনুপস্থিত, ব্রাহ্মণবাদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ, মায়াবাদ ও সন্ন্যাসবাদের কোনো প্রভাব নেই। এ কারণে অনেক গবেষক মনে করেন খনার কাল ছিলো মাধবাচার্য এবং শংকরাচার্যেরও পূর্বে তা না হলে বৈদিক ধর্ম প্রচারের প্রবল তোড়ে খনার বচনগুলো ভেসে যেতো। গবেষকদের ধারণা খনা সপ্তম শতাব্দীর লোক যখন বৌদ্ধ, জৈন, শাক্ত, শৈব, সাহজিয়া, বাউল, তান্ত্রিক, নাথ এবং চার্বাক-নাস্তিকবাদের ঘোরে সমাজ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো তখন খনার উদ্ভব। খনার বচনে অলৌকিকত্ব নেই। কুসংস্কার ও খনার বচনকে আবিষ্ট করতে পারেনি। বচনগুলো অধিকাংশই বাস্তবধর্মী। উড়িয়া এবং বাঙালিরা উভয়েই খনার বচনকে তাদের নিজস্ব সম্পদ বলে মনে করে। উড়িয়া ভাষায় খনার বচনের সংখ্যা ও প্রচলন বাংলা ভাষার চেয়ে বেশি। মৈথিলী ভাষাও বহু খনার বচনকে আত্মসাৎ করেছে, অন্যান্য ভাষায়ও রূপান্তরিত হয়ে খনার বচন প্রচলিত আছে, নেপালী ভাষায় কিছু প্রবচন দেখা যায়- সেগুলো খনার বচনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

 আসুন দেখে নিই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত 'খনার বচন' কি বলে ----
> আগে পাছে ধনু চলে মীন অবধি তুলা
মকর মুম্ভ বিছা দিয়া কাল কাটায়ে গেলা।
অর্থ - পৌষ মাসের ৩০ দিন কে ১২ ভাগে ভাগ করলে প্রতি ভাগে আড়াই দিন করে পরে। এর প্রথম ও শেষ সোয়া দিন পৌষের জন্য রেখে প্রথম সোয়া দিনের থেকে প্রতি আড়াই দিন ক্রমে মীন অর্থ্যাত চৈত্র মাস থেকে প্রতি মাসের জন্য গণনা করতে হবে। পৌষের এই ভাগ সমুহের ক্রমে যে আড়াই দিনে যেরুপ আবহাওয়া থাকবে সেই মাসেও তদ্রপ আবহাওয়া হবে।
> জর ভিটায় তুলে ঘর,
সে আসে তারই জর।
অর্থ - অপরিচ্ছন স্যাতসেতে জায়গায় ঘর করলে সে ঘরে অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে।
> পীড়ে উঁচু মেঝে খাল,
তার দুঃখ চিরকাল।
অর্থ - ঘরের মেঝে চারদিকের ভিটির চাইতে নিচু হলে সে ঘর স্বাস্থ্য সম্মত নয়।
> আলো হাওয়া বেঁধ না,
রোগ ভোগে মরো না।
অর্থ - বদ্ধ ঘর স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
পুবে হাঁস পশ্চিমে বাঁশ
উত্তরে বেড়ে(কলা) দক্ষিনে ছেড়ে
ঘর করগে পুতা জুড়ে।
অর্থ - হাস মুরগীর খামার বাড়ীর পুব দিকে রাখতে হয় আর বাঁশ ঝাড় পশ্চিমে করতে হয় কলা বাগান উত্তরে এবং দক্ষিণ দিক খোলা রাখতে হয়।
> উনা ভাতে দুনা বল,
অতি ভাতে রসাতল।
অর্থ - অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
> অধিক খেতে করে আশ,
এর নাম বুদ্ধি নাশ।
অর্থ - মাত্রারিক্ত খেলে বুদ্ধিনাশ ঘটে।
> আঁতে তিতা দাঁতে নুন,
উদর ভরো তিন কোন।
অর্থ - পাকস্থলির চার ভাগের এক ভাগ খালি রেখে খেতে হয়।
> বারো মাসে বারো ফল,
না খেলে যায় রসাতল।
অর্থ - সব মৌসুমেই কিছু কিছু মৌসুমি ফল খেতে হয়।
> জল খেয়ে ফল খায়,
যম বলে আয় আয়।
অর্থ - জল খেয়ে ফল খেতে নেই।
> বেল খেয়ে খায় জল,
জির(কৃমি) যায় রসাতল।
অর্থ - বেল খেয়ে জল পান করলে কৃমি নাশ হয়।
> খালি পেটে কুল,
ভরা পেটে মূল।
অর্থ - কুল খালি পেটে আর মূলা ভরা পেটে খাওয়া ভালো।
> খেতে বসলে কিসের দায়,
পাকনা ধান কি জলে যায়।
অর্থ - নিশ্চিন্ত মনে আহার করা উচিত।
> খানা খায় করে শব্দ,
অলক্ষী খুশী লক্ষী জব্দ।
অর্থ - নীরবে খাদ্যগ্রহন করতে হয়।
> তপ্ত অম্ল ঠান্ডা দুধ,
যে খায় সে নির্বুধ।
অর্থ - ঠান্ডা দুধ স্বাস্থ্যে জন্য ক্ষতিকর। (এখানে অম্ল বলতে টক্ খাদ্য বোঝানো হয়েছে)
> খেয়ে উদাইম্যা ভাত,
শইল করে উৎপাত।
অর্থ - শারীরিক পরিশ্রম না করলে খাদ্য হজম হয় না।
> দুগ্ধ শ্রম গাংগা বারি,
এ তিন উপকারী।
অর্থ - দুধ, শারীরিক শ্রম এবং স্রোতস্বিনী নদী স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
> ভোরের হাওয়া
লাখ টাকার দাওয়া।
অর্থ - লাখ টাকার ঔষুধের চাইতে ভোরের হাওয়া উপকারী।
> শাক অম্বল পান্তা,
তিনো অসুখের হন্তা।
অর্থ - অসুখ হলে শাক অম্বল এবং পান্তা খেতে নেই।
> ঘোল কুল কলা,
তিনে নাশ গলা।
অর্থ - গলার অসুখ হলে ঘোল কুল ও কলা খেতে নেই।
> মাংসে মাংস বৃদ্ধি, ঘৃতে বৃদ্ধি বল
দুগ্ধে বীর্য বৃদ্ধি, শাকে বৃদ্ধি মল।
অর্থ - মাংস খেলে মাংস বাড়ে, ঘিয়ে শক্তি বাড়ে, দুধে বীর্য বাড়ে এবং শাক খেলে মল বৃদ্ধি হয়।
> তেল তামাকে পিত্ত নাশ,
যদি হয় তা বারো মাস।
অর্থ - সারা বছর তৈলাক্ত খাবার এবং তামাক সেবন করলে পিত্তের প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়।
>আহারান্তে চোখে জল,
দৃষ্টি শক্তির বাড়ে বল।
অর্থ - খাবার পর চোখে জল ছিটানো চোখের জন্য ভালো।
> সকালে সোনা,
বিকালে লোনা।
অর্থ - সকালের স্নান উত্তম আর বিকেলে স্নান করলে ত্বক মলিন হয়ে যায়।
> প্রভাত কালে উঠে যে খাবে ঠান্ডা জল,
তাহার ঘরে বদ্যি না যাবে কোন কাল।
অর্থ - সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা জল পান করতে হয়।
-
লক্ষ্য করুন প্রত্যেকটি সূত্রই আধুনিক বিজ্ঞানসম্মতই শুধু নয় কালের বাধা অতিক্রম করে আজও এ'গুলি জ্ঞানে বা অজ্ঞানে আমরা মেনে চলি।

Courtesy by: 
Prithwish Ghosh
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।