• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৮ জানুয়ারী ২০১৬

বাংলার ঘরে ঘরে বৃহস্পতিবার হল সাপ্তাহিক লক্ষ্মী আরাধনার দিন

বাংলায় বৃহস্পতিবারকে বলা হয় লক্ষ্মীবার। এই দিন লক্ষ্মীপূজা করলে হৃদয়ে ও গৃহে চঞ্চলা লক্ষ্মী হন অচলা।
-
সহজে লক্ষ্মীপূজা করার পদ্ধতি -
-
বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজার উপকরণ অতীব সামান্য। যেগুলি লাগে সেগুলি হল—সিঁদুর, ঘট ১টি, ধান সামান্য, মাটি সামান্য, আমপল্লব ১টি, ফুল ১টি, দুর্বা সামান্য, তুলসীপাতা ২টি, ফুল, কাঁঠালি কলা বা হরীতকী ১টি, চন্দন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, সামান্য আতপচাল ও জল। কোনো দ্রব্য সংগ্রহ করতে না পারলে, পূজার শেষে সেই দ্রব্যটির কথা মা লক্ষ্মীর কাছে উল্লেখ করে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে।
-
লক্ষ্মী-পরিচয়
------------------
লক্ষ্মী হিন্দুদের ধনসম্পদ, উন্নতি (আধ্যাত্মিক ও পার্থিক), আলো, জ্ঞান, সৌভাগ্য, উর্বরতা, দানশীলতা, সাহস ও সৌন্দর্যের দেবী। বাঙালি বিশ্বাসে লক্ষ্মীদেবী দ্বিভূজা ও পেচকবাহিনী। দেবী তুষ্ট হলেই দেবেন সুখ-সমৃদ্ধির বরদান। লক্ষ্মীপূজায় রাত জেগে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করাই শাস্ত্রমতে রীতি। প্রচলিত ধারণা, রাতের বেলা ঘরে ঘরে আসেন দেবী এবং যার পুজো-অর্চনায় তিনি তুষ্ট হন, সুখ ও সমৃদ্ধির বরদান দিয়ে যান তাঁকেই।
যে দেবতার পূজা করেন, সেই দেবতার পরিচয় আগে জেনে নিতে হয়। লক্ষ্মীকে আমরা টাকাপয়সার দেবী ভাবি, আসলে লক্ষ্মীর পরিচয় শুধু ওইটুকুতেই নয়। লক্ষ্মী শুধু ধনই দেন না, তিনি জ্ঞান ও সচ্চরিত্রও দান করেন। এককথায় লক্ষ্মীপূজা করলে, মানুষ সার্বিকভাবে সুন্দর ও চরিত্রবান হয়। স্বামী প্রমেয়ানন্দ বলেছেন, ‘কেবল টাকাকড়িই ধন নয়। চরিত্রধন মানুষের মহাধন। যার টাকাকড়ি নেই সে যেমন লক্ষ্মীহীন, যার চরিত্রধন নেই সে তেমনি লক্ষ্মীছাড়া। যাঁরা সাধক তাঁরা লক্ষ্মীর আরাধনা করেন মুক্তিধন লাভের জন্য।’ লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা কেন? কেউ কেউ বলেন, এটি বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের পরিবর্তিত রূপ। মা লক্ষ্মী আসলে তাঁর স্বামীর বাহনটিই ব্যবহার করেন। কিন্তু এই রূপ পেঁচার কেন? লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যারা অপব্যবহার করে, তাদের কপালে লেখা আছে যমের দণ্ড—এই কথা ঘোষণা করে লক্ষ্মীর বাহন। তাই কথায় বলে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। তাছাড়া ধনসম্পত্তি, সে টাকাকড়ি হোক বা সাধনধনই হোক, সদাজাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয়। রাতে সবাই যখন ঘুমায়, তখন পেঁচা জেগে থাকে। পেঁচাই সেই ধনসম্পদ পাহারা দেয়।
লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা বাজাতে নেই। লক্ষ্মীকে তুলসীপাতা দিতে নেই। কিন্তু লক্ষ্মীপূজার পর একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা দিয়ে নারায়ণকে পূজা করতে হয়। লক্ষ্মীপূজা সাধারণত সন্ধ্যাবেলা করে, তবে অনেকে সকালেও করে থাকেন। সকালে করলে সকাল ন-টার মধ্যে করে নেওয়াই ভাল। পূজার পর ব্রতকথা পাঠ করতে হয়। লক্ষ্মীপূজায় লোহা বা স্টিলের বাসন-কোসন ব্যবহার করবেন না। লোহা দিয়ে অলক্ষ্মী পূজা হয়। তাই লোহা দেখলে লক্ষ্মী ত্যাগ করে যান।
লক্ষ্মীপূজা প্রতিমা, সরা বা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে হয়ে থাকে। পূর্ববঙ্গীয়রা সাধারণত সরা বা প্রতিমায় লক্ষ্মীপূজা করেন, পশ্চিম বঙ্গীরা লক্ষ্মীর ধানপাত্রে বা ঘটে পূজা করেন। কারো কারো বিশেষ পারিবারিক লক্ষ্মী প্রতীক রয়েছে। যাঁর যা আছে, বা যাঁদের যা নিয়ম তাঁরা তাতেই লক্ষ্মীপূজা করবেন। পূজার পূর্বে পূজাস্থান পরিষ্কার করে নিয়ে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে দেবেন। পূজাস্থানে লক্ষ্মীর পা-সহ আলপনা আঁকবেন। ঘটের পাশে একটি লক্ষ্মীর পা অবশ্যই আঁকবেন। পূজার সময় অন্যমনস্ক হবেন না বা অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না। মনকে লক্ষ্মীতে স্থির রাখবেন। পূজার সময় অন্য কথা বললে বা অন্যমনস্ক হলে মন্ত্রপাঠাদি করে লক্ষ্মীপূজা করাই শ্রেয়। কিন্তু একমনে আন্তরিকভাবে লক্ষ্মীপূজা করলে বিনা মন্ত্রেই পূজা সিদ্ধ হয়। অবশ্য দীক্ষিত হলে গুরুমন্ত্রেও পূজা চলে। বিশেষভাবে মনে রাখবেন, মন্ত্রপাঠ ও পূজাক্রিয়াদিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিনা মন্ত্রে পূজা করবেন না। বিনা মন্ত্রে পূজা শুধু সেই সবে অনভিজ্ঞদের জন্য।
-
পূজাপ্রণালী
------------
প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল নিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করে নিন। পূজার আগে মাথায় জল নিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল দিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উৎস সূর্যকে জল দেওয়ার নিয়ম, তাই জল দেওয়ার জন্য ঠাকুরের সিংহাসনে একটি ছোটো তামার পাত্র সর্বদা রাখবেন। সূর্যের নাম করে সেই কুশীতে জল নিয়ে সেই তামার পাত্রে দেবেন। তারপর সংসারের সকলের মঙ্গলকামনা করবেন। এরপর একটু গঙ্গাজল আপনার পূজার আসন, পূজার ফুল-নৈবেদ্য ইত্যাদি উপকরণের উপর ছিটিয়ে দেবেন। এইভাবে পূজাদ্রব্যগুলিকে শুদ্ধ করে নিতে হয়।
এরপর লক্ষ্মীর সামনে সামান্য ধান ও এক চিমটি মাটি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর জলভরা ঘট স্থাপন করবেন। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে নিতে ভুলবেন না। ঘটে একটি আমপল্লব (যাতে বিজোড় সংখ্যায় আমপল্লব থাকে) ও তার উপর একটি কলা বা হরীতকী দিয়ে উপরে একটি ফুল দেবেন। ইচ্ছা করলে ঘটে ও লক্ষ্মীকে একটি করে মালাও পরাতে পারেন। এবার লক্ষ্মীকে ধ্যান করবেন।
লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্র হল —
-
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
-
মন্ত্রটি পাঠ করতে ভাল। নয়তো লক্ষ্মীর রূপটি চোখ বুজে মনে মনে খানিকক্ষণ চিন্তা করবেন। এরপর মা লক্ষ্মীকে আপনার ঘরে আবাহন করবেন। আবাহন মন্ত্রটি হল —
-
ওঁ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ
ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ
ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য
অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।
-
সংস্কৃতে মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বাংলায় বলবেন, এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, যতক্ষণ তোমার পূজা করি, ততক্ষণ তুমি স্থির হয়ে থাকো মা।
তারপর ভাববেন, মা লক্ষ্মী আপনার হৃদয়ে এসে বসে আপনার দেওয়া ফুল-নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। একে বলে মানসপূজা। এরপর আপনার পূজাদ্রব্যগুলি একে একে লক্ষ্মীকে দেবেন। লক্ষ্মী আপনার গৃহে পূজা নিতে এলেন, তাই প্রথমেই একটুখানি জল ঘটের পাশে লক্ষ্মীপদচিহ্নে দেবেন। এটি মা লক্ষ্মীর পা ধোয়ার জল। এরপর দুর্বা ও একটু আতপ চাল ঘটে দেবেন, এটি হল অর্ঘ্য। এর সঙ্গে একটি ফুলও দিতে পারেন। এরপর লক্ষ্মীকে একটি চন্দনের ফোঁটা দেবেন। লক্ষ্মীর প্রতিমা না থাকলে ফুলে চন্দন মাখিয়ে ঘটে দেবেন। এরপর লক্ষ্মীকে ফুল দেবেন। তারপর প্রথমে ধূপ ও তারপর প্রদীপ দেখাবেন। শেষে নৈবেদ্যগুলি নিবেদন করে দেবেন।
তারপর ফুল দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন। মন্ত্র—এষ সচন্দনপুষ্পাঞ্জলি ওঁ শ্রীঁ লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ। (শ্রীঁ উচ্চারণ হবে শ্রীং, নমঃ উচ্চারণ হবে নমহ।) পুষ্পাঞ্জলি এক, তিন বা পাঁচ বার দিতে পারেন।
পুষ্পাঞ্জলির পর নারায়ণের উদ্দেশ্যে একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা ঘটে দেবেন।
তারপর ইন্দ্র ও কুবেরের নামে দুটি ফুলও ঘটে দেবেন।
মা লক্ষ্মীর পেচককেও একটি ফুল দেবেন।
আপনি যদি দীক্ষিত হন, তবে এরপর আপনার গুরুমন্ত্র যথাশক্তি জপ করে মা লক্ষ্মীর বাঁ হাতের উদ্দেশ্যে জপসমর্পণ করবেন। শেষে নিম্নোক্ত মন্ত্রে প্রণাম করবেন —
-
ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমঽস্তু তে।।
-
মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বিনা মন্ত্রেই ভক্তিভরে মা-কে প্রণাম করবেন। এরপর ব্রতকথা পাঠ করবেন বা শুনবেন।
-
বিঃ দ্রঃ কেউ কেউ লক্ষ্মীকে পান-সুপারিও দেন। আপনাদের বাড়িতে তেমন প্রথা থাকলে দেবেন।
-
বাড়িতে যে লক্ষ্মীর পাঁচালি আছে সেটিই পড়বেন। লক্ষ্মীর ব্রতকথা বা পাঁচালি বাজারে সুলভ। বাড়িতে পাঁচালি না থাকলে, যেকোনো একটি কিনে নিয়ে পাঠ করলেই চলে।

Written by:  Prithwish Ghosh

Share:

প্রভু বিজয়কৃষ্ণ

বাংলা ১২৪৮ সালের ১৩ শ্রাবণ। সোমবার। সেদিন ছিল ঝুলন পূর্ণিমার রাত। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় প্লাবিত হয়ে গেছে নদীয়া জেলার দহকুল গ্রাম। এই গ্রামেই বিজয়কৃষ্ণের মামাবাড়ি। আর এই মামাবাড়িতেই সেই পূর্ণিমার আলোয় এক কচুবনের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক দেবশিশু। হ্যাঁ, কচুবনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ।
সেদিন সেই পবিত্র ঝুলন পূর্ণিমার রাত্রে ঠিক জন্মসময়ে হঠাৎ কোনও কারণে ইংরেজের পুলিশ এসে হানা দিয়েছিল বিজয়কৃষ্ণের মামাবাড়িতে। এতে শঙ্কিত হয়ে বিজয়কৃষ্ণের মাতৃদেবী ঘর ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাড়ির কাছেই এক কচুবনে। বিধাতার এক রহস্যময় বিধানে সেখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন মহান ভক্তিসাধক। পিতৃদেব প্রভুপাদ আনন্দকিশোর গোস্বামী চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ভাগবত পাঠ করতেন, নিজের গলায় সর্বক্ষণ পরম অলঙ্কার হিসেবে ঝুলিয়ে রাখতেন ‘দামোদর’ নামে শালগ্রাম শিলা।
একদিন বিজয়কৃষ্ণ এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন বিজয়কৃষ্ণ শান্তিপুরের বিখ্যাত গোঁসাই পরিবারের সন্তান। তাই কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমি শান্তিপুরের এক গোঁসাই-এর কথা শুনেছিলাম, তাঁর ভাগবত পাঠের সময় প্রতি লোমকূপ হতে রক্তোদগম হত, আর তিনি মাঝে মাঝে এমন হুঙ্কার দিতেন, যা বহুদূর থেকে শোনা যেত।’
সে কথা শুনে প্রভু বিজয়কৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘তিনি আমারই পিতা ছিলেন।’
সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, ‘অমন বাপ না হলে কি এমন ছেলে হয় ?’
আনন্দকিশোর পর পর দু’বার বিবাহ করেন। কিন্তু কোনও পুত্র সন্তানের মুখ দেখতে পাননি।
এই দুই স্ত্রী লোকান্তরিত হওয়ার দীর্ঘকাল পরে ৫০ বছর বয়সে বড় ভাই গোপীমাধব গোস্বামীর অন্তিম অনুরোধে তৃতীয়বার বিয়ে করেন স্বর্ণময়ীদেবীকে। স্বর্ণময়ীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন দুই পুত্র—ব্রজগোপাল এবং বিজয়কৃষ্ণ।
শিশুকাল থেকেই বিজয়কৃষ্ণের মধ্যে দেখা দেয় নানা ধরণের বিস্ময়। সকাল সন্ধ্যা তুলসীতলায় গড়াগড়ি দেয় ছোট্ট শিশু, কথা বলেন গৃহদেবতা শ্যামসুন্দরের সঙ্গে এবং শ্যামসুন্দরের সঙ্গে খেলা করেন। মা স্বর্ণময়ীদেবী এ সবই দেখেন।
স্বর্ণময়ীও এক দিব্য স্বভাবের নারী। এক ফকিরের আশীর্বাদে তাঁর পিতা গৌরীদাস জোদ্দার এই কন্যাকে লাভ করেছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে পাগল বলে ভাবতেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে সাক্ষাৎ দেবী বলে মনে করতেন।
একবার হঠাৎই স্বর্ণময়ীদেবী নিখোঁজ হয়ে গেলেন। মা-কে খুঁজে বার করার জন্য বিজয়কৃষ্ণ পাগলের মতো চারিদিকে ছোটাছুটি করলেন। কিন্তু সবাই নিষ্ফল।
আগেই তিনি হারিয়েছেন (১২৫১ সনের অক্ষয় তৃতীয়ায়) পিতাকে।
একদিন রাণাঘাট স্টেশনে বসে আছেন তিনি। এমন সময় কয়েকজন কাঠুরের কথাবার্তা তাঁর কানে এল।
তাঁরা বলছিলেন, ‘জঙ্গলে একটা অদ্ভুত ঘনটা দেখলাম। একটা উলঙ্গ মহিলা একটা বাঘের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। মহিলার কী দুঃসাহস। মজার কথা, বাঘটাও চুপচুপ শুয়ে আছে, ঠিক যেন পোষা বেড়াল।’
এই আলোচনা শুনেই তাঁর মনে হল, এই কি তবে আমার মা ? সঙ্গে সঙ্গে তিনি কয়েকজন লোককে নিয়ে রাণাঘাটের কাছেই সেই জঙ্গলে গিয়ে হাজির হলেন। জঙ্গলে ঢুকে একটু খোঁজাখুঁজি করার পরই দেখতে পেলেন সেই বিস্ময়কর দৃশ্য।
দূর থেকে দেখলেন, তাঁর মা সেই ভয়ঙ্কর বাঘের দেহে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আর অভিমানের সুরে বলছেন, তুই তো আমার নয়, তুই দশভুজার। আমি কালী। তুই আমার হলে আমাকে তো পিঠে করতিস। যাকগে, তুই শুয়ে থাক, আমি তোর খাবার নিয়ে আসি।
এই কথা বলে তিনি যে-ই জঙ্গলের বাইরে এলেন, অমনি বিজয়কৃষ্ণ ছুটে গিয়ে মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।
পুত্রকে দেখে মায়ের মনেও প্রবাহিত হল স্নেহের ফল্গুধারা। তিনি পুত্রের সঙ্গেই ফিরে এলেন ঘরে। এই অলৌকিক খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
শান্তিপুরের ভগবান গুরুর পাঠশালায় বিজয়কৃষ্ণের প্রথম পাঠ শুরু হয়। তারপর এলেন হেজল নামের এক পাদ্রী সাহেবের পাঠশালায়। এখানে তিনি খুব মন দিয়ে বাইবেল পাঠ করেন। গোবিন্দ ভট্টাচার্যের টোল, পণ্ডিত কৃষ্ণগোপালের চতুষ্পাঠী হয়ে ইংরেজি ১৮৫৯ সালে তিনি এসে ভর্তি হলেন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে।
সেই সময়ে কলকাতায় উদ্ধত নব্য বঙ্গের যুব শ্রেণীর প্রভাব খুব বেশি, খ্রিস্ট ভাবাশ্রিত কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবও ক্রমবর্ধমান, খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের একটা ঝোঁক যুবকদের মধ্যে—এমন একটা প্রতিকূল পরিবেশে বিজয়কৃষ্ণ বেশিদিন তুলসীমালা বা তিলকের ওপর আস্থা রাখতে পারলেন না। তিনি হয়ে উঠলেন সংশয়বাদী, হয়ে উঠলেন বৈদান্তিক।
তাঁর নিজের কথায়, ‘হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া ঘোর বৈদান্তিক হইয়া পড়িলাম।....উপসনার আবশ্যকতা স্বীকার করিতাম না।’
সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়েই তিনি রামচন্দ্র ভাদুড়ীর কন্যা যোগমায়াদেবীকে বিয়ে করেন।
সংস্কৃত কলেজ থেকে ‘পণ্ডিত’ হয়ে তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন শল্যবিদ হওয়ার জন্য। তিনি স্থির করলেন, সেবা ব্রতকেই জীবনব্রত হিসেবে গ্রহণ করবেন।
সেই সময়েই ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ এবং চিকিৎসা বিদ্যার শেষ পরীক্ষায় না বসেই তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক হয়ে পূর্ববঙ্গ সফরে বেরিয়ে পড়লেন। প্রচারকরূপে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতও পরিভ্রমণ করেন। সেই সময়েই তিনি কাশীতে তৈলঙ্গস্বামীকে দর্শন করেন।
উত্তর ভারতে যখন তিনি ঘুরছিলেন ; তখন হঠাৎই এক কঠিন রোগে তিনি মরণাপন্ন হয়ে পড়েন।
শোনা যায়, এই দুঃসংবাদ পেয়ে ঢাকার অধিবাসী তাঁরই এক প্রিয় শিষ্য ছুটে গেলেন বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে। করুণ আবেদন জানালেন, গুরুর জীবন রক্ষা করুন, তাতে আমার আয়ু নিতে হয়, নিন।
গুরুগত প্রাণ এই শিষ্যকে দেখে লোকনাথ ব্রহ্মচারী প্রীত হলেন, বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। শুভ সংবাদ পাবে।’ যথাসময়ে শুভ সংবাদ এল।
পরবর্তীকালে বিজয়কৃষ্ণের একজন শিষ্য বলেন, সে এক অলৌকিক ব্যাপার। মরণাপন্ন বিজয়কৃষ্ণের শিয়রে দেখা যেত লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে। অথচ তিনি তখন ঢাকার বারদীতেই ছিলেন।
সুস্থ হয়ে আবার শুরু হল উত্তরভারতের তীর্থপরিক্রমা। এলেন গয়াধামে। সেখানে সাক্ষাৎ হল রামাইৎ সাধু রঘুবীর দাসের সঙ্গে। তারপর ফল্গুনদীর অপর পাড়ে রামগয়ায় সাক্ষাৎলাভ হয় যোগীবর গম্ভীরনাথের সঙ্গে। এলেন আকাশগঙ্গা পাহাড়ের শীর্ষভূমিতে।
সেখানে অলৌকিকভাবে দেখা পেলেন এক যোগসিদ্ধ মহাপুরুষের। তিনি দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিজয়কৃষ্ণ অনুভব করলেন সর্বদেহে এক অপূর্ব শিহরণ। অধীর হয়ে উঠলেন তিনি সেই মহাপুরুষকে আবার দর্শন করার জন্য।
একদিন রামশিলা পাহাড়ের অরণ্যে আবার দর্শন পেলেন তাঁর। সেই দর্শন দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তরুণ সাধক বিজয়কৃষ্ণ হয়ে উঠলেন অস্থির। অবশেষে এক শুভদিনে আকাশগঙ্গা পাহাড়ে এই মহাপুরুষ ব্রহ্মানন্দ স্বামী দীক্ষা দিলেন বিজয়কৃষ্ণকে।
তারপর গুরুর নির্দেশেই কাশীধামে এসে হরিহরানন্দ সরস্বতীর পদপ্রান্তে বসে গ্রহণ করলেন সন্ন্যাস। বিজয়কৃষ্ণের হল নতুন জন্ম, নতুন পরিচয়। সন্ন্যাস নাম হল অচ্যুতানন্দ সরস্বতী।
কাশীধাম থেকে এলেন আবার গয়াধামের আকাশগঙ্গা পাহাড়ে। গুরু ব্রহ্মানন্দের নির্দেশে শুরু হল কঠোর যোগ সাধনা, আসন পাতলেন এক নির্জন গুহায়। লাভ করলেন যোগসিদ্ধি।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেনের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রথম জীবনে ব্রাহ্মধর্মের একজন মহান প্রচারক রূপেই সর্বজনের কাছে ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয়। তিনি স্বীয় জীবন মাধুর্যে হয়ে উঠেছিলেন প্রেম ভক্তির প্রতীক।
শিবনাথ শাস্ত্রী বলতেন, ‘গোঁসাইকে সকলের সামনে দেখিয়ে বেড়ালে, তাঁর এই ভক্তিসমৃদ্ধ মূর্তি দেখালেই ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার হবে আর কোনও প্রচেষ্টার দরকার হবে না।’
একসময় বিজয়কৃষ্ণ স্বীয় মহিমায় ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য পদ লাভ করেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই নিরাকারবাদী ব্রাহ্ম-আচার্যের জীবনে ঘটল আমূল রূপান্তর।
অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণ এবং কাশীর সচল শিব শ্রী তৈলঙ্গস্বামীর প্রভাবে তিনি একসময় নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তা থেকে চলে এলেন সাকার আরাধনায়। অনন্তকে উপলব্ধি করার জন্যও যে একটা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিমা বা মূর্তির পূজা প্রয়োজন, অনুভব করলেন আধ্যাত্মিক ভারতের সেই সনাতন সত্য ধারণাকে।
এ জন্য ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণকে অতিক্রম করতে হয়েছে এক ভিন্নতর সাধনার পথ।
সেবার তিনি তীর্থ পরিক্রমা করতে করতে শিবপুরী কাশীতে এসেছেন।
তখনও তিনি নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তায় তন্ময়, বিশ্বাস করেন না মূর্তি পূজায়। হৃদয়ে তাঁর মুক্তিলাভের এবং সত্য দর্শনের প্রবল এষণা। অন্তরের গভীরে তাই সদাই অনুভব করেন এক প্রচণ্ড অস্থিরতাকে। কোথায় যাবেন, কার কাছে গিয়ে সঠিক পথের সন্ধান পাবেন—সেই চিন্তায় তিনি তখন উতলা।
কাশীতে আসার পর তিনি দর্শন করলেন তৈলঙ্গস্বামীকে।
সে-ও এক বিচিত্র দর্শন। উলঙ্গ তৈলঙ্গস্বামী সহস্রচক্ষুর সামনে গঙ্গায় ভেসে বেড়াচ্ছেন, গঙ্গার স্রোতে এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে ভেসে চলে যাচ্ছেন। আর তরুণ দর্শনপ্রার্থী বিজয়কৃষ্ণ নদীর তীর ধরে তাঁকে অনুসরণ করে অবিরাম ছুটে চলেছেন।
এই অপূর্ব দৃশ্য কল্পনা করেও গায়ে শিহরণ জাগে। একজনকে দর্শন করার জন্য, ধরার জন্য আরেকজনের কী গভীর ব্যাকুলতা।
তারপর যখন জল থেকে উঠে এসে তৈলঙ্গস্বামী এক জায়গায় স্থির হয়ে বসলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন বিজয়কৃষ্ণ। বিজয়কৃষ্ণকে দেখেই চলমান শিব চঞ্চল হয়ে উঠতেন কিছু খাওয়াবার জন্য। তিনি সেখানে উপস্থিত ভক্তদের ইঙ্গিতে আদেশ করতেন গোঁসাইজির জন্য ভাল ভাল খাবার, মিষ্টি নিয়ে আসতে। ভক্তরা তৎক্ষণাৎ সেই আদেশ পালন করতেন। এবার তিনি পরম স্নেহে নানারকম ইঙ্গিত করে বিজয়কৃষ্ণকে সেগুলি খাওয়াতেন। গোঁসাই খেলে তিনি তৃপ্তি পেতেন, প্রসন্ন হতেন।
তৈলঙ্গস্বামীর গঙ্গা বিহার নিয়ে বিজয়কৃষ্ণের নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেইসব অভিজ্ঞতার কথা তিনি পরবর্তীকালে বলেছেন।
এভাবেই চলছিল দুই মহাপুরুষের স্বর্গীয় লীলা। সম্ভবত ভাবীকালের জন্য চলছিল এক অপূর্ব প্রস্তুতিপর্ব। একদিন সেই পর্বের পরিণতি হয়ে উঠল অনিবার্য।
সেদিন আকস্মিকভাবে তৈলঙ্গস্বামী ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণকে বললেন, ‘এবার আমি তোমাকে মন্ত্রদীক্ষা দেব।’ এমন কথা যে শুনতে হবে তা গোঁসাইজি কল্পনাও করতে পারেননি। তাই তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।
অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে অন্তরঙ্গ মেলামেশার ফলে দুজনের আধ্যাত্মিক সম্পর্কও অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছিল। স্পষ্ট করেই প্রভু বিজয়কৃষ্ণ বললেন, ‘আচ্ছা, আপনার কাছে আমি কেন দীক্ষা নেব ? আমি তো ব্রাহ্ম, আপনি আমাকে কী করে দীক্ষা দেবেন ?’
চলমান শিবের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘শোন, একটা বিশেষ কারণে তোমাকে দীক্ষা দেব। তবে আসল দীক্ষা আমি দেব না। শরীর শুদ্ধ করার জন্য গুরুকরণ করতে হয়, তাই গুরুকরণ করা প্রয়োজন। তাই বলে আমি তোমার প্রকৃত গুরু নই।’
এরপর তিনি প্রভু বিজয়কৃষ্ণকে ত্রিবিধ মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। দীক্ষাদানের পর বললেন, ‘এবার তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। আমাকে ভগবান যে আদেশ দিয়েছিলেন, আমি তা পালন করলাম মাত্র।’
তারপর ? তারপর কাশীর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। প্রভু বিজয়কৃষ্ণের জীবনেও ঘটেছে আধ্যাত্মিক রূপান্তর। তিনি গ্রহণ করেছেন সন্ন্যাস এবং যোগসাধন, হয়েছেন ভক্তিসাধক।
আবার ফিরে এলেন কলকাতায়। আবার সেই ব্রাহ্মসমাজ।
কিন্তু সেই সময় কেশবচন্দ্র সেনের নাবালিকা কন্যাকে কোচবিহার রাজ পরিবারে বিয়ে দেওয়া নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে দেখা দিল চরম মতবিরোধ। কারণ, ব্রাহ্মরা ছিলেন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে।
কেশবচন্দ্রের নবধর্মের বিরোধিতায় বিজয়কৃষ্ণ, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ গড়ে তুললেন ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’। বিজয়কৃষ্ণ ঢাকায় গেলেন সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক হিসেবে। এই সময় কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী বিজয়কৃষ্ণের কৃপালাভ করে সিদ্ধ সাধক কুলদানন্দে রূপান্তরিত হন।
কুলদানন্দের বড় ভাই সারদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিজয়কৃষ্ণের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। ঢাকায় সদাই নাম সংকীর্তনে বিভোর হয়ে থাকতেন বিজয়কৃষ্ণ। তাঁর এই ‘হিন্দুসুলভ’ আচরণকে ব্রাহ্ম নেতারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
অবশেষে তিনিও ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করে ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় কুটির বানিয়ে সাধন ভজনেই হলেন আত্মসমাহিত, হলেন ভক্তি সাধক বিজয়কৃষ্ণ।
বিজয়কৃষ্ণের এই রূপান্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের ঘটনাগুলিও স্মরণ করতে হয়। স্মরণ করতে হয়, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য রূপে তিনি যখন অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতে শুরু করেন, তখন ধীরে ধীরে তাঁর অন্তরলোকে সুগভীর পরিবর্তনের সূচনালগ্ন।
বিজয়কৃষ্ণের উচ্চ অধ্যাত্ম অবস্থা সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন বললেন, ‘বিজয় এখন সমাধিগৃহের দ্বারে করাঘাত করছে।’
বিজয়কৃষ্ণ একদিন ভাবে বিভোর হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের পা দুটি নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভগবানের অবতার।’ সেদিনের সেই অপরূপ দৃশ্য ছিল অনির্বচনীয়।
শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে বিজয়কৃষ্ণের চিন্তাজগতে দেখা দিল পরিবর্তনের স্রোত। তিনি যেন নতুন এক অধ্যাত্ম আলোয় হলেন উদ্ভাসিত, উপলব্ধি করলেন সনাতন ধর্মের সত্যস্বরূপ এবং সাকার ঈশ্বরে হয়ে উঠলেন বিশ্বাসী।
শুধুমাত্র বিজয়কৃষ্ণ নন, সেই সময়কার ব্রাহ্ম আন্দোলনের সকল নায়কই শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এই ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রেই সে যুগের সেরা তরুণরা পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের স্পর্শ।
সেদিনই শুরু হয়েছিল এক নতুন যুগ।
আমরা এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে এক দিনের কথা স্মরণ করতে পারি।
সেদিনা ছিল ১৮৮২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করতে এসেছেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। সঙ্গে আরও তিন-চারজন ব্রহ্মভক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণের পরম ভক্ত বলরাম বসুর সঙ্গে তাঁরা নৌকোয় কলকাতা থেকে এসেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ দুপুরে সবেমাত্র একটু বিশ্রাম করছেন। তিনি তক্তপোষের ওপর বসে আছেন। বিজয়কৃষ্ণ এবং অন্যান্য ভক্তরা তাঁর দিকে মুখ করে মেঝেতে বসেছেন।
বিজয়কৃষ্ণ শূল বেদনায় দারুণ কষ্ট পান, তাই সঙ্গে শিশিতে ওষুধ এনেছেন। ওষুধ খাওয়ার সময় হলে খাবেন। তখন তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য।
কথামৃতকার ‘শ্রীম’ বলেছেন, মহাভক্ত পূর্বপুরুষ শ্রীঅদ্বৈতের শোণিত বিজয়কৃষ্ণের ধমনীতে প্রবাহিত, শরীর মধ্যস্থিত হরিপ্রেমের বীজ এখন প্রকাশোন্মুখ—কেবল কাল প্রতীক্ষা করছে। তাই তিনি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের দেবদুর্লভ হরিপ্রেমে ‘গরগর মাতোয়ারা’ অবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। মন্ত্রমুগ্ধ সাপ যেমন ফণা ধরে সাপুড়ের কাছে বসে থাকে, বিজয়কৃষ্ণ পরমহংসদেবের শ্রীমুখনিঃসৃত ভাগবত শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে বসে থাকেন। আবার যখন শ্রীরামকৃষ্ণ হরিপ্রেমে বালকের মতো নাচতে থাকেন, বিজয়ও তাঁর সঙ্গে নাচতে থাকেন।
বিজয়কৃষ্ণ নানা প্রসঙ্গের পর জানতে চাইলেন, ‘ঈশ্বর দর্শন কেমন করে হয় ?’
শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন, ‘চিত্তশুদ্ধি না হলে হয় না। কামিনী-কাঞ্চনে মন মলিন হয়ে আছে, মনের কাদা ধুয়ে ফেললে তখন চুম্বক টানে। মনের ময়লা তেমনি চোখের জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা যায়। ‘হে ঈশ্বর, আর অমন কাজ করব না’ বলে যদি কেউ অনুতাপে কাঁদে, তাহলে ময়লাটা ধুয়ে যায়। তখন ঈশ্বর রূপ চুম্বক পাথর মনরূপ সুঁচকে টেনে নেন। তখন সমাধি হয়, ঈশ্বর দর্শন হয়।’
এভাবেই দিনে দিনে দক্ষিণেশ্বরের আনন্দ সভায় বিজয়কৃষ্ণ পেলেন পরমানন্দের স্বাদ।
বিজয়কৃষ্ণের রক্তে ছিল হরিনাম। প্রতিনিয়ত হরিনাম করতে করতে তাঁর দিব্যদেহ হয়ে উঠল পবিত্রতার প্রতীক।
ঢাকা থেকে বেরিয়ে তীর্থ পরিক্রমা সেরে ফিরে এলেন কলকাতায়। বাংলা ১৩০৪ সালের ফাল্গুন মাসে কলকাতার লীলা সাঙ্গ করে জলপথে তিনি যাত্রা করলেন শ্রীক্ষেত্রে। ভগবান চৈতন্যদেবের লীলাভূমি তাঁকে তখন প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে।
শ্রীক্ষেত্রে এসে জগন্নাথ মন্দিরের ধ্বজা দর্শন করেই তিনি ভাবাবেশে মত্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর শ্রীক্ষেত্র লীলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যই ছিলেন সর্বক্ষণের ধ্যান জ্ঞান। এই শ্রীক্ষেত্রেই ঘটল তাঁর অন্ত্যলীলা।
বাংলা ১৩০৬ সালের (১৮৯৯) ২২ জ্যৈষ্ঠ, রবিবার ঈর্ষাকাতর নরাধমের দেওয়া বিষ মাখানো লাড্ডু খাওয়ার দুঃসহ পরিণামে তিনি অনন্তধামে যাত্রা করেন।
written by:  Prithwish Ghosh

Share:

রাজ্য ও ক্ষমতার লালসার কাছে স্নেহ,আত্মীয়-স্বজন বা বৈবাহিক সম্পর্ক- কোন কিছুরই দাম থাকে না।

মহাভারতের কাহিনী পর্যালোচনা করলে একটি জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, “রাজ্য ও ক্ষমতার লালসা এমনই এক বিচিত্র স্বভাব তৈরি করে, যেখানে স্নেহ,আত্মীয়-স্বজন বা বৈবাহিক সম্পর্ক- কোন কিছুরই দাম থাকে না।”
যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বিদর্ভ এর রাজা ভীষ্মক। যার মেয়ে রুক্মিণীকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণবিয়ে করে। মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণীর এই বিয়ের মধ্য একটা রাজনৈতিক অভিসন্ধি কাজ করেছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রুক্মিণীর ভালোবাসা হয়তো এখানে প্রধান প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছে কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বিবাহের বাড়তি ফলটা ভেবেছিলো তাঁর অনুকূলে ফলবে। কিন্তু, সেটা ঘটেনি।

ভীষ্মকের মেয়ে রুক্মিণীকে বিয়ে করে শ্রীকৃষ্ণ ভেবেছিলেন, - মেয়ের জন্যই বৈবাহিক কারণেভীষ্মক শ্রীকৃষ্ণের অনুকূলে আচরণ করবে। অর্থ্যাৎ এই বিবাহের মাধ্যমে যাদব ও বিদর্ভের মধ্য একটি সুসম্পর্ক স্থাপিত হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটা হয় নি।
কারণ, ভীষ্মক চেয়েছিল তাঁর মেয়ে রুক্মিণীকে নিজের অনুগত শিষ্য জরাসন্ধের সেনাপতি ‘শিশুপালে’র সাথে বিয়ে দিতে। অন্যদিকে, ভীষ্মকের ছেলে রুক্মী ছিল শিশুপালের অন্ধ সমর্থক। এই অবস্থায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুকৌশলে রুক্মিণীকে বিয়ের আগের দিন বিদর্ভ থেকে হরণ করে দ্বারকায় নিয়ে যায় এবং সেখানে রুক্মিণীর ইচ্ছায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাদের বিয়ে হয়।

বিবাহসভায় জরাসন্ধ-শিশুপালের এই অপমান ভীষ্মককে সহ্য করতে হয় এবং এই ঘটনায় ভীষ্মক আরও ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভেবেছিলেন- এই ক্ষোভ সাময়িকভাবে থাকবে এবং মেয়ের প্রতি স্নেহবশতই ভীষ্মকের কৃষ্ণ-বিরোধিতা কমে আসবে ও জরাসন্ধের সাথে ভীষ্মকের দূরত্ব বাড়বে। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি।
একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট যে, “মহাভারতে কুরু-পাণ্ডবের জ্ঞাতি-রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে এতদিন ধরে মগধরাজ জরাসন্ধকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছেন নিজের হাতে।”
আর সেজন্যই, যতক্ষণ না অধার্মিক জরাসন্ধকে শেষ করা যাচ্ছে; ততক্ষন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের ফলপ্রাপ্তি অসম্ভব।
মহাভারতের সময়ে কুরুবংশ, মদ্রবংশ, দ্রুপদ, ভীষ্মক (ভোজ বংশের অধিপতি), শিশুপাল, পৌন্ড্র-বাসুদেব, সিন্ধুরাজ বৃদ্ধক্ষত্র এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম (যাদবকুল ও বৃষ্ণিবংশ) এঁরাই ছিল সবথেকে শক্তিশালী রাজা।
এদের মধ্য জরাসন্ধ ছিল ক্ষত্রিয় বিরোধী। যিনি ৮৬ জন রাজাকে বন্দী করে রেখেছিলো;১০০ জন পূর্ণ হলেই তিনি তাদের বলি দিতেন। মগধরাজ জরাসন্ধের নিজেরই ছিল বিশ অক্ষৌহিনী সৈন্য। তাঁর ভয়ে ভীত হয়ে বহু রাজা উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে পালিয়ে যায়। চেদিরাজ শিশুপাল জরাসন্ধের সেনাপতি।

সেসময় বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশের নাম ছিল পুন্ড্রবর্ধন; যার রাজা ছিল পৌন্ড্র-বাসুদেব (যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতই চক্রক্ষেপণ করতে পারে বলে নিজেই “বাসুদেব” উপাধি ধারণ করেছিলো)। এই পৌন্ড্র-বাসুদেব ছিল শ্রীকৃষ্ণ বিরোধী। এদের সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রতাপশালী বীর ভীষ্মক; যার মেয়ে রুক্মিণীকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিয়ে করেছিলেন।
আমরা সকলেই জানি যে, “শান্তিস্থাপন ও ধর্মরাজ্য সংস্থাপন”- এই দুই কাজ করতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। যুদ্ধমত্ত অধার্মিক শক্তিকে ধ্বংস করে নতুনভাবে যুধিষ্ঠিরের মত শান্তিকামী ও ধার্মিক রাজাকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আর সেজন্যই, রাজসূয় যজ্ঞের মাধ্যমে অধার্মিক জরাসন্ধকে বধ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের হাতে। এটাই ছিল ধর্মরাজ্য প্রবর্তনের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রথম প্রয়াস।
শ্বশুর জরাসন্ধের জোর দেখিয়ে কংসের অত্যাচার যখন চরমে উঠলো; তখন শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করেন। কংস মারা যাবার পরে মথুরাবাসী একটা বড় অত্যাচার থেকে মুক্তি পেল; কিন্তু তাঁরা এবার আরও বড় আক্রমণের মুখে পড়ে গেলেন। কংসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই স্ত্রী বাপের বাড়ি গিয়ে পিতা জরাসন্ধকে উত্তেজিত করলেন পতি হত্যাকারী শ্রীকৃষ্ণকে চরম দণ্ড দেওয়ার জন্য। কিন্তু, জরাসন্ধ বার বার মথুরা আক্রমণ করেও, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে পরাজিত করতে পারে নি।
লেখকঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

২৩ জানুয়ারী ২০১৬

ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি, বর্তমান ভারত-এর উড়িষ্যার কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোদালিয়া নামক গ্রামে। তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন আইনজীবী। কর্মক্ষেত্রে ছিল কটক। তাঁর মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী।  তিনি ছিলেন পিতামাতার চোদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। সুভাষের জন্মের সময় তাঁর পিতামাতা কটক শহরে ছিলেন। 

ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি কটকের  একটি ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টিওয়ার্ট স্কুল (
Stewart School)। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় কটকের র‌্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে (Ravenshaw Collegiate School)। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ (Presidency College)-এ ভর্তি হন। এই কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক ওটেন ভারত-বিদ্বেষী কথাবার্তার জন্য তিনি এর বিরোধীতা করেন। ফলে অধ্যাপক ওটেন-এর সমর্থকদের দ্বারা তিনি প্রহৃত হন। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্রসহ সুভাষ বসুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর তিনি স্যার আশুতোষ চৌধুরী সহায়তায় স্কটিশ চার্চ কলেজে (Scottish Church College) ভর্তি হন। এই কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর-এ যোগ দেন এবং সমরবিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে তিনি থেকে দর্শনে বি.এ (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর অভিভাবকরা তাঁকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলাত পাঠান ।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে
ইংল্যান্ডে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই কলেজের পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং মরাল সায়েন্স কেম্ব্রিজ ট্রাইপস অধিকার করেন। ইতিমধ্যে ভারতে নানা রকমের ঘটনা ঘটে যায়। যেমন ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে রাউটাল বিল বাতিলের জন্য গান্ধীজী দরখাস্ত করেন। এপ্রিল মাসে সর্বভারতীয় সত্যগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় এবং হরতাল পালিত হয়। এরপর পাঞ্জাবে তাঁর প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে, গান্ধীজী পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এই কারণে দিল্লী যাওয়ার পথে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৩ই এপ্রিল তারিখে জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধীজী সবরমতী আশ্রমে ৩ দিনের উপবাস করেন। ১৪ই এপ্রিল তারিখে নদীয়াতে স্বীকার করেন যে, সত্যাগ্রহ করে তিনি হিমালয়তূল্য ভুল করেছেন। গান্ধীজী'র এই আন্দোলন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর, সুভাষ তীব্র বৃটিশ বিরোধী হয়ে উঠেন। ফলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভারতে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে [নিজেকে] প্রত্যাহার করে নেওয়া"।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই জাহাজ থেকে নেমে গান্ধীজী'র সাথে দেখা করেন। গান্ধীজী'র নির্দেশে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে দেখা করেন। উল্লেখ্য এই সময় চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন সবার রাজনৈতিক গুরু। কলকাতায় ফিরে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় স্বরাজ নামক সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তাঁর অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দী করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। উল্লেখ্য ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের রেগুলেশন দ্বারা তিনি বন্দী হয়েছিলেন। এখানে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। এই বৎসরে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সময় বাংলার কংগ্রেস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই দুটি দল সেনগুপ্ত কংগ্রেস এবং সুভাষ কংগ্রেস নামে চিহ্নিত হতো। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা কংগ্রেসকে সামরিক কায়দায় সাজান। এক্ষেত্রে তিনি যে বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন, তার নাম ছিল  'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স'। সে সময়ে  'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয়। 'হিন্দুস্থান সেবক দল' নামে আরেকটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন জহরলাল নেহেরু। এই সময় সুভাষ বসুর নেতৃত্বে গড়ে উঠা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই অধিবেশনকে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলে। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন সুভাষবসু। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল সে সময়ের বিভিন্ন সশস্ত্র বিপ্লবীদল। এই দলগুলোর ভিতর উল্লেখযোগ্য দলগুলো ছিল অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, পূর্ণদাস বাউলের দল, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন। কংগ্রেসের এই অধিবেশনের জন্য বিশাল প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় প্রদেশিক কংগ্রেস অধিবশেন সভাপতিত্ব করেন। এই বৎসরের আগষ্ট মাসে 'নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক দিবস' উপলক্ষে তিনি একটি শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। এই কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৯ লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে তিনি ও বিপ্লবীরা ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করার প্রস্তাব করেন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে জানুয়ারি মাসে দেওয়া রায়ে তাঁর ৯ মাসের জেল হয়। আর ১৮ই এপ্রিল সূর্যসেন মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে, প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই ঘটনা ব্রিটিশ ভারতের শাসকদের প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের বেশিরভাগ শহীদ হন, কিন্তু অবশিষ্টদের খোঁজার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু করে। এরই ভিতর  ২৩ সেপ্টেম্বর সুভাষ জেল থেকে ছাড়া পান। এই বৎসরেই ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে উত্তরবঙ্গে সাংগঠনিক কাজে গেলে, মালদহের ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর জেলায় ঢুকতে বাধা দেয়। এই বাধা অগ্রাহ্য করলে তাঁকে গ্রেফতার করে ৭ দিনের জেল দেওয়া হয়। ২৬ জানুয়ারিতে তিনি কলকাতায় একটি শোভাযাত্রা করলে, পুলিশ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী জনগণকে বাধা দেয়। এই সময় পুলিশের লাঠচার্জে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। অজ্ঞান অবস্থায় পুলিশ তাঁকে বন্দী করে হাসপাতালে পাঠায়। বিচারে তাঁর ছয় মাসের জেল হয়েছিল। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মার্চ গান্ধী-অরুইন চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে তিনিও মুক্তি পান। উল্লেখ্য ৮ই মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ডুর্নোকে হত্যা করেন তৎকালীন বাংলার দুই বিপ্লবীসরোজ গুহ এবং রমেন ভৌমিক। এঁদের পুলিশ ধরতে না পেরে, ঢাকার স্থানীয় লোকদের উপর নির্যাতন শুরু করে। এর প্রতিবাদে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি নোটিশ দ্বারা তাঁকে ঢাকা প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এই সময় তাঁর সঙ্গীদের ঢাকাতে প্রবেশ করতে দেওয়া হলেও তাঁকে স্টিমারের করে চাঁদপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।  চাঁদপুর থেকে তিনি আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ১১ নভেম্বর তাঁকে তেজগাঁও রেল স্টেশনে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ নভেম্বর ৫০০ টাকা জামিনে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ই নভেম্বর পুলিশি নির্যাতনে ঢাকার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর সাথে দেখা করেন। পরে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভোযোগ তুলে নিয়েছিল। 

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১ লা জানুয়ারিতে কংগ্রেসর ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ইংরেজের সকল ধরনের রাজনৈতিক অত্যাচারের বন্ধ করার দাবি করা হয় এবং সাতদিনের মধ্যে এই দাবি না মানলে, আইন-অমান্য আন্দোলন-এর হুমকি দেওয়া হয়। এই সূত্রে সরকার গান্ধীজী, জহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল-সহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। বোম্বে থেকে ফেরার পথে , বোম্বে রেলস্টেশনের ৩০ মাইল দূরে কল্যাণপুরে সুভাষ বসুকে গ্রেফতার করে প্রথমে মধ্য প্রদেশের সিডনী সাবজেলে পাঠানো হয়। পরে তাঁকে জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। জেলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, তাঁকে ভাওয়াল স্বাস্থ্য নিবাসে পাঠানো হয়। ক্রমে ক্রমে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। 

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ভিয়েনার উদ্দেশ্যে বোম্বে থেকে জাহাজযোগে রওনা দেন। ৮ই মার্চ তিনি ভিয়েনা পৌঁছান। একটু সুস্থ হয়ে তিনি ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেন।

১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনাতে থাকার সময় তিনি একজন ইংরেজি জানা সেক্রেটারি খুঁজছিলেন। এই সময় তাঁর সাথে অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভুত এমিলি (Emilie Schenkl)-এর সাথে দেখা হয়। এক সাথে কাজ করার সূত্রে, এমিলি'র সাথে তাঁর প্রণয়ের সূত্রপাত হয়। এই বৎসরের ডিসেম্বর মাসে পিতার অসুস্থার সংবাদ শুনে ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু সরকার তাঁকে নির্বাসিত করে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ফলে তিনি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি আবার ইউরোপে ফিরে যান। এই সময় ভারত থেকে প্রথমে তিনি ইতালিতে আসেন। এখানে তাঁর সাথে দেখা হয় মুসেলিনির। ১৬ই জানুয়ারি তাঁর 'ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল' নামক বইটি প্রকাশিত হলে, ইউরোপে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

সুভাষ বসু ও তাঁর স্ত্রী  Emilie Schenkl 
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল তিনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারতে ফিরে আসেন। বোম্বের জাহাজ ঘাট থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১০ মে সুভাষ দিবস পালিত হয়। সুভাষ বসুকে কার্শিয়াং-এর গির্দা পাহাড়ের এক জেলখানায় রাখা হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ৬ এপ্রিল তাঁকে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য পুনোরুদ্ধারের জন্য ডঃ ধর্মবীরের নির্দেশে ১৮ই নভেম্বর তিনি আবার ইউরোপ যান।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রেমিকা এমিলি-কে বিবাহ করেন এবং ইউরোপে তাঁর স্ত্রীর সাথে কাটান।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বিদেশে থাকাবস্থায় হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে সভাপতির পদে তিনি প্রতিযোগিতা করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি আচার্য কৃপালিনী- সুভাষ বসুকে কংগ্রেসের সভাপতি ঘোষণা করেন। মূলত এতকাল কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে
গান্ধীজী'র ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটতো। এই নির্বাচনে গান্ধীজী পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সুভাষ বসু জয়লাভ করেন। এই জয়লাভের পর, ইংল্যাণ্ডের ডরচেস্টারের প্রবাসী ভারতীয় এবং ইংরেজ রাজনীতিবিদরা তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। এরপর ২৪ জানুয়ারিতে তিনি বিমানযোগে করাচিতে পৌঁছান।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে সুভাষ বসুর যোগ দিতে যাওয়ার সময়।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ত্রিপুরা কংগ্রেস নির্বাচনে সভাপতির পদে প্রতিযোগিতায় প্রাথমিকভাব অংশগ্রহণ করেন মৌলানা আজাদ, পট্টভি সিতারামায়া এবং সুভাস বসু। গান্ধীজী পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন করায় মৌলানা আজাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান এবং পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন করেন। এই সময় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশই পট্টভি সিতারামায়া-এর স্বপক্ষে নগ্নভাবে সমর্থন জানান। এতকিছুর পরেই সুভাস বসু জয়লাভ করেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি। এই নির্বাচনে সুভাস বসু পেয়েছিলেন ১৫৭৫ ভোট, আর পট্টভি সিতারামায়া পেয়েছিলেন ১৩৪৬ ভোট। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর, গান্ধীজীর এক বিবৃতিতে জানান, "...পট্টভি সিতারামায়ার পরাজয় আমারই পরাজয়।...হাজার হোক সুভাষবাবু দেশের শত্রু নন!...তাঁর জয়লাভে আমি আনন্দিত।"

যেহেতু নগ্নভাবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অনেক সদস্যই পট্টভি সিতারামায়া-কে সমর্থন করেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির সাথে সুভাষ বসুর দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার জন্য, সুভাষ বসু ১৫ই ফেব্রুয়ারি গান্ধীজীর সাথে দেখা করার জন্য সেবাগ্রাম যান। প্রাথমিকভাবে গান্ধীজী এই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে বলেন সুভাষ ইচ্ছা করলে তাঁর মনোমত নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে পারেন। পরে গান্ধীজী দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও ছিল ছলনাপূর্ণ। তারপরেও তিনি অপর এক বিবৃতিতে বলেন 'আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, গোড়া থেকেই আমি তাঁর (সুভাষের) পুননির্বাচনের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলাম। এর কারণ আজ আমি বলতে চাই নে।' অবশ্য সে কারণ গান্ধীজী কখনোই আর ব্যাখ্যা করেন নি।

সুভাষ বসুর সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর, ২২শে ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই সভায় ব্যক্তিগত কাজের অজুহাতে গান্ধীজী যোগদান করেন নি।  আর স্বাস্থ্যগতকারণে ডঃ নীলরতনের পরামর্শে সুভাষ বসু অনুপস্থিত থাকেন। ফলে সুভাষ বসু ছাড়াই সভার কাজ শুরু হয়। একরম বিনা কারণেই, এই সভায় ১২ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য পদত্যাগ করেন। অবশেষে ৫ মার্চ সুভাষ বসু জ্বর নিয়ে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু প্রচণ্ড জ্বরের জন্য তাঁকে এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সভাপতির চেয়ারে রাখা হয় তাঁর প্রতিকৃতি। তাঁর পক্ষে লিখিত ভাষণ পাঠ করে শোনান তাঁর মেজ দাদা শরৎচন্দ্র বসু। এই সভায় শেষ পর্যন্ত গান্ধীর সমর্থকদের নিয়ে কমিটি তৈরি হয়েছিল।

২১ এপ্রিল সুভাষ বসু সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফেরেন। নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে যোগাদানের জন্য কলকাতায় গান্ধীজী আসেন ২৭ এপ্রিল। ২৮ এপ্রিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনেগান্ধীজীর  এবং সুভাষ বসুর ভিতর দীর্ঘ আলোচনা হয়, কিন্তু গান্ধীজী কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ বসুর বিরুদ্ধেই থেকে যান। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বসু পদত্যাগ পত্র জমা দেন এবং সাথে সাথে গৃহীত হয়। এরপর নতুন সভাপতি নির্বাচিত হন- গান্ধীজীর প্রিয়ভাজন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ।

এরপর থেকে কংগ্রেসের সাথে ক্রমান্বয়ে তাঁর বিরোধ হতে থাকে। ৪ঠা জুন গান্ধীজী একটি নির্দেশনায় সারাদেশে সত্যগ্রহ আন্দোলন বন্ধ করে দেন। ১৯ জুন এর বাড়তি আরও একটি ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণায় বলা হয়, কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা সম্পর্কে কোথাও কিছু বলা যাবে না। ৯ জুলাই সুভাষ বসু 'জাতীয় সংগ্রাম সপ্তাহ' উদ্‌যাপন করেন এবং কংগ্রেসের এই অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের প্রতিবাদ করেন। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে তাঁর বাদানুবাদ চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানালেন যে, 'গুরুতর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসুকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতির পদের অযোগ্য বলিয়া ঘোষণা করা হইল এবং ১৯৩৯ সালের আগষ্ট মাস হইতে তিন বৎসরের জন্য তিনি কোনো নির্বাচিত কংগ্রেস কমিটির সদস্য হইতে পারিবেন না।'

এর ভিতরে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে তারিখে সুভাষ বসু  অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক (All India Forword Block) নামক একটি দল গঠন করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের [বিস্তারিত: জার্মান-পোল্যান্ড যুদ্ধ] মধ্য দিয়ে থেকে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সুভাষ বসু এই সুযোগে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেন। পক্ষান্তরে যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশদের পক্ষে থাকার পথ অবলম্বন করেন গান্ধীজী

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ২০-২২ জুন নাগপুরে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রথম একটি সম্মেলন করে। এই সম্মেলনে একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকারের আহ্বান করা হয়। এই সময় কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের ঘোষণাও করা হয়। এই মনুমেন্ট অপসারণের দিন ধার্য করা হয়েছিল ৩রা জুলাই। ব্রিটিশ সরকার এর আগের দিন ২রা জুলাই সুভাষ বসুকে গ্রেফতার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে প্রেরণ করে। ২৯ নভেম্বর তিনি মুক্তির দাবীতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন। ৭দিন অনশন পালন করার পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে তিনি তখনও পুলিশি নজরে ছিলেন।

ইতিমধ্যে তিনি ব্রিটিশের শত্রু হিসেবে জার্মান, ইতালি, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই সব দেশের সহায়তায় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন করা। এই সব রাষ্ট্রের সাথে পূর্বে কোনো যোগাযোগ না করেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, তিন ভারত থেকে পালানোর উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল পাঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টি এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্যরা।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১ টা ২৫ মিনিটে পশ্চিমী মুসলমানী পোশাকে তিনি তাঁর এই গোপন যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় তিনি তাঁর শিশির বোসকে সাথে নিয়ে মোটর গাড়ি করে কলকাতা ত্যাগ করেন। ১৮ই জানুয়ারিতে কলকাতা থেকে প্রায় ২১০ মাইল দূরবর্তী গোমোতে পৌঁছান। শেষ রাতে ট্রেনযোগে তিনি উত্তর ভারতের দিকে রওনা দেন। এই সময় তিনি ছদ্ম নাম নেন মৌলবী জিয়াউদ্দিন। পেশোয়ার রেলস্টেশনে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা আকবর শা, সুভাষ বসুর সাথে মিলিত হন এবং এরপর উভয় পরবর্তী পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে নেমে পড়েন। তারপর টাঙ্গা গাড়ি করে নিয়ে স্থানীয় তাজমহল হোটেলে উঠেন। এরপর মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতা আব্দুল মজিদ খাঁ তাঁকে গোপন আস্তানায় নিয়ে যান। এরপর সুভাষ বসুকে কাবুল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া দায়িত্ব নেন ভগৎ সিং। ২১শে জানুয়ারি বিকাল চারটায় সুভাষ বসুর সাথে ভগৎসিং-এর দেখা হয়। পাঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টি বাকি পথটুকু যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল।  আগে যে পথ ধরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, সে পরিকল্পনায় কিছু রদবদল করায় ভগৎসিং কিছুটা বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ পরিবর্তিত পথের সাথে ভগৎসিং ততটা পরিচিত ছিলেন না। ২৫ মার্চ একজন পথ প্রদর্শক পাওয়ায়, সুভাষ বসু আবার যাত্রা শুরু করলেন। সাথে ছিলেন ভগৎ সিং, পথপ্রদর্শক, আবিদ খাঁ ও গাড়ির চালক। এঁরা এই যাত্রাপথে প্রথম থামেন খাজুরি ময়দান-এ। গাড়ির চালক  এবং আবিদ খাঁ এখান থেকে বিদায় নেওয়ার পর বাকি তিনজন পায়ে হেঁটে রওনা দেন। এঁরা রাত ১২টায় আশ্রয় নেন 'পিশকান ময়না' নামক গ্রামে। এখানে তাঁরা স্থানীয় একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। এই সময় বাইরে  তুষারপাত চলছিল। এরপর সুভাষ বসু খচ্চরের পিঠে চড়ে এবং ভগৎ সিং, পথপ্রদর্শক ও খচ্চরওয়ালা পায়ে হেঁটে রওনা দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর পথপ্রদর্শক বিদায় নিয়ে ফিরে যান। এরপর এঁরা গাওড়ি নামক একটি গ্রামে পৌঁছান পরের দিন বেলা ১২টার দিকে। এরপর খচ্চরওয়ালা বিদায় নিলে ভগৎসিং এবং সুভাষ বসু পেশোয়ার-কাবুল মহাসড়কে পৌঁছান। এই সড়ক ধরে এঁরা জালালাবাদের দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দেন।  এঁরা এরপর পৌঁছান হারজানাও গ্রামে। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন বাসোল গ্রামে। এখানে এসে চায়ের প্যাকিং বাক্স ভরা একটি ট্রাকে করে রাত দশটার দিকে এঁরা জালালাবাদ পৌঁছান। এখানে একটি সরাইখানায় রাত কাটিয়ে আড্ডাশরীফ মসজিদ দেখে 'লালমা' গ্রামে আসেন। এখানে ভগৎ সিং-এর পরিচিত একজন লোক ছিলেন। এই লোকটির নাম হাজি মোহম্মদ আমিন। এই লোকের পরামর্শ অনুসারে এঁরা কাবুল নদী পার হয়ে টাঙ্গায় করে সুলতানপুর যান। সেখানে ট্রাক না পেয়ে আরও সারাদিন পায়ে হেঁটে মিমলা গ্রামে আসেন। এখানে এসে তাঁরা একটি সরাইখানায় এসে কিছু আহার করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া একটি ট্রাকে করে 'গনডামক' নামক স্থানে আসেন রাত নটায়। এখানে রাতের খাবার খেয়ে আবার ট্রাকে করে রওনা দেন। ভোরের দিকে এঁরা 'বুদখাক' চেকপোষ্টে পৌঁছান। ভোররাতে চেকপোষ্টের প্রহরীরা ঘুমিয়ে ছিল। তাই বিনা বাধায় চেকপোষ্ট পেরিয়ে এঁরা স্থানীয় একটি হোটেলে আশ্রয় নেন। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে টাঙ্গায় চড়ে এঁরা কাবুলে পৌঁছান। এই দীর্ঘ ও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এঁরা ৩১শে জানুয়ারি কাবুলে পৌঁছান।

কাবুলে পৌঁছে সেদিনের মতো বিশ্রাম নিয়ে, পরদিন তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করেন। কিন্তু রুশ-রাষ্ট্রদূত তাঁকে কোনও সাহায্য করলেন না। কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর সুভাস বসু জার্মান দূতাবাসে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করলেন। জার্মান রাষ্ট্রদূত তাঁকে আশ্বাস দিলেও বার্লিনের অনুমতি লাগবে বলে জানালেন। এই সময় ভগৎ সিং তাঁর পূর্বপরিচিত উমিচাঁদের সাথে দেখা করেন। ইতিমধ্যে সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের সংবাদ সবাই জেনে গেছে। ভগৎসিং সুভাষ বসুকে লুকিয়ে রাখার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। প্রথমে উমিচাঁদ তাঁর এবং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে থাকেন। কিন্তু উভয়ই বহু চেষ্টা করে তেমন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেলেন না। শেষ পর্যন্ত উমিচাঁদের বাসায় আশ্রয় পেলেন তাঁর স্ত্রীর দয়ায়। এই সময় চোরাই পথে রুশ সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য দালাল পাওয়ায়, সেই পথে আফগানিস্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এঁরা। কিন্তু শেষ মুহুর্তে বার্লিন থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পান। এরপর জার্মান এ্যাম্বেসীর নির্দেশক্রমে এঁরা ইতালির রাষ্ট্রদূত এ্যালবার্ট কোরানীর সাথে দেখা করেন। কিন্তু রাশিয়ার সাথে ব্রিটেনের কোনো ভুল বুঝাবুঝি হোক, এটা এড়ানোর জন্য রুশ এ্যাম্বেসী ভিসা দিতে গড়িমসি করছিলেন। ১২ মার্চ রুশ এ্যাম্বেসী সুভাস বোসের ভিসা দিতে সম্মত হয়। ১৭ মার্চ সিনর অরল্যান্ডো ম্যাজোট্টা নামে ইতালির পাসপোর্ট নিয়ে  সুভাষ বোস কাবুল ত্যাগ করেন। তিনি প্রথমে মস্কো আসেন। সেখানে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, পরে তিনি মস্কো থেকে রোমে আসেন এবং ২৮ মার্চ তিনি রোম থেকে বার্লিন পৌঁছান।

তিনি বার্লিনে মুক্ত ভারতীয় কেন্দ্র (Free India Center) গড়ে তোলেন। এই সময় তাঁর স্ত্রী এমিলি তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে এমিলি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এর নাম Anita Bose Pfaff। অনিতা বর্তমানে জার্মানীর অগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা। 

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের কারণে, সমগ্র ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লক-কে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের সকল রাজনৈতিক অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া ফরওয়ার্ড ব্লক-এর নেতাকর্মীদের পুলিশি নজরাদারিতে রাখা হয়।

জার্মানীতে গিয়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে জার্মান কিছু সাহায্য করলেও, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে হিটলারের উদাসিনতা তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়। ফলে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সুভাষ বসু জার্মান ত্যাগ করেন। একটি জার্মান সাবমেরিনে চড়ে তিনি ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই সিঙ্গাপুরে পৌছান।
 
ইতিমধ্যে ভারতীয় অপর একজন নেতা রাসবিহারী বসু, প্রবাসে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলে। এই বাহিনীর নাম ছিল ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (INA=Indian National Army) । ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহা-এশিয়া মিলনায়তনে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সভায় দাঁড়িয়ে, সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তাব করেন। শেষ পর্যন্ত সবাই এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে, সুভাষ বসু প্রবাসী সরকার এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক পদ লাভ করেন। উল্লেখ্য রাসবিহারী বসুর গড়া এই বাহিনীতে একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) ছিল। সব মিলিয়ে এই বাহিনীতে প্রায় ৮৫,০০০ হাজার সৈন্য ছিল। এই বাহি্নীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার" (আরজি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ)। এই সেনাবাহিনী  'আজাদ হিন্দ ফৌজ' নামে সর্বাধিক পরিচিত।

১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' ইম্ফল ও কোহিমার পথে অগ্রসর হয়। ২১ মার্চ 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' ভারতভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যাবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।  যুদ্ধের শেষ দিকে জাপান আত্মসমর্পণ করলে, সুভাষ বসু এই বাহিনী প্রত্যাহার করেন। পরে তিনি এই বাহিনী ভেঙে দেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ফরমোসার তাইহোকু বিমান বন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যবরণ করেন।


সূত্র :
  • সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড। জানুয়ারি ২০০২।
  • আমি সুভাষ বলছি: শ্রীশৈলেশ দে। রবীন্দ্র লাইব্রেরী, কলকাতা। প্রকাশকাল- রথযাত্রা-১৩৮১ প্রথম খণ্ড, রথযাত্রা -দ্বিতীয় খণ্ড ১৩৮৪, রথযাত্রা -তৃতীয় খণ্ড ১৩৮৯।
  • আধুনিক ভারত: প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়। দ্বিতীয় খণ্ড (১৯২০- ১৯৪৭) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৯
Share:

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সংক্ষিপ্ত জীবনি

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (জন্ম: ২৩ জানুয়ারি, ১৮৯৭ – তথাকথিত মৃত্যু: ১৮ অগস্ট, ১৯৪৫ (যদিও এই মত বিতর্কিত) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তি নেতা। তিনি নেতাজি নামে সমধিক পরিচিত।

সুভাষচন্দ্র পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরিণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন গান্ধীজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ ও সত্বর স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এগারো বার কারারুদ্ধ করেছিল। তাঁর বিখ্যাত উক্তি "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।"

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তাঁর মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতার সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করে ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দান করেন। এই বাহিনী সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দী এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুর সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন; এমনকি কেউ কেউ তাঁকে নাৎসি মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে ভারতে অন্যান্যরা তাঁর ইস্তাহারকে রিয়েলপোলিটিক (নৈতিক বা আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ব্যবহারিক রাজনীতি)-এর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে তাঁর পথপ্রদর্শক সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেছেন।

উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাঁকে সমর্থন করেন। শেষপর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংহের ফাঁসি ও তাঁর জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র গান্ধী-আরউইন চুক্তি বিরোধী একটি আন্দোলন শুরু করেন। তাঁকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়।

মনে করা হয় ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর এই তথাকথিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধ প্রমাণও বিদ্যমান।


প্রথম জীবন:

১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি, বর্তমান ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে (ওড়িয়া বাজার) জন্মগ্রহণ করেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন কটক-প্রবাসী বিশিষ্ট বাঙালি আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর চোদ্দো সন্তানের মধ্যে নবম। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র একটি কটকের ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন; বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টিওয়ার্ট স্কুল। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় কটকের রর্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। সুভাষচন্দ্র ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ১৯১১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতা থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিক সহ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

এরপর সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান। কিন্তু বিপ্লব-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে [নিজেকে] প্রত্যাহার করে নেওয়া"। এই সময় অমৃতসর হত্যাকাণ্ড ও ১৯১৯ সালের দমনমূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল। ভারতে ফিরে সুভাষচন্দ্র স্বরাজ নামক সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন বাংলায় উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯২৪ সালে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তাঁর অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ সালে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দী করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। এখানে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তিনি ধ্যানে অনেক সময় অতিবাহিত করতেন। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি তাঁর দেশপ্রেমিক সত্ত্বার জন্য পরিচিত ছিলেন।

কর্মজীবন ও রাজনীতিতে প্রবেশ:

প্রায় বিশ বছরের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র মোট ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন তাকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩০ সালে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। ১৯৩৪ সালে তিনি তাঁর প্রথম প্রেম এমিলি সেচঙ্কল এর সাথে পরিচিত হন ভিয়েনাতে। ১৯৩৭ সালে তারা ব্যাড গ্যাস্টিনে বিয়ে করেন।

তাঁর পিতার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার তাকে শুধু মাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের উদ্দ্যেশ কিচ্ছুক্ষণের জন্য কলকাতা আসার অনুমতি দেয়। ১৯৩৮ সালে তিনি গান্ধির বিরোধীতার মুখে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা সেসনে কংগ্রেসের প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে গান্ধি পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন দেন; নির্বাচনের ফলাফল শোনার পর গান্ধি বলেন "পট্টভির হার আমার হার"। কিন্তু জয়যুক্ত হলেও তিনি সুষ্ঠু ভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারছেলেন না। গান্ধীর অনুগামীরা তার কাজে বাধা সৃষ্টি করছেলেন। গোবিন্দ বল্লভ পন্থ এইসময় একটি প্রস্তাব পেশ করেন যে, "কার্যনির্বাহক পরিষদকে পুনর্গঠন করা হোক"। এভাবে সুভাষ চন্দ্র বসু এ নির্বাচনে জয় লাভ করলেও গান্ধির বিরোধীতার ফল স্বরুপ তাকে বলা হয় পদত্যাগ পত্র পেশ করতে নইলে কার্যনির্বাহি কমিটির সকল সদস্য পদত্যাগ করবে। এ কারণে তিনি নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেণ এবং অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি জাতীয় পরিকল্পনা পরিষদের প্রস্তাবনা দেন।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে সুভাষ বসুর যোগ দিতে যাওয়ার সময়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ:

সুভাষ চন্দ্র বসু প্রস্তাব করলেন, কবে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের স্বাধীনিতার অনুমোদন দেবে তার জন্য বসে না থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সুবিধা নেওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নির্ভর করে অন্য দেশের রাজনৈতিক, সামরিক ও কুটনৈতিক সমর্থনের উপর। তাই তিনি ভারতের জন্য একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্দ্যেগ গ্রহণ করেণ।

ভারত থেকে পলায়ন:

ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে সুভাষ বসু নাখোশ ছিলেন। তিনি সে সময় গৃহ বন্দি ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ব্রিটিশরা তাঁকে যুদ্ধের আগে ছাড়বে না। তাই তিনি দুইটি মামলার বাকি থাকতেই আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানী পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আফগানিস্তানের পশতু ভাষা না জানা থাকায় তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের উত্তর-পশ্চিম সিমান্ত প্রদেশের নেতা মিয়া আকবর শাহকে তার সাথে নেন। যেহেতু তিনি পশতু ভাষা জানতেন না তাই তাঁর ভয় ছিল, আফগানিস্তানবাসীরা তাকে ব্রিটিশ চর ভাবতে পারে। তাই মিয়া আকবর শাহের পরামর্শে তিনি অধিবাসীদের কাছে নিজেকে একজন কালা ও বোবা বলে পরিচিত করেণ। সেখান থেকে সুভাষ বসু মস্কো গমন করেন একজন ইতালির কাউন্ট অরল্যান্ডো মাজ্জোট্টা" নামক এক নাগরিকের পরিচয়ে। মস্কো থেকে রোম হয়ে তিনি জার্মানী পৌছেন। তিনি বার্লিনে মুক্ত ভারতীয় কেন্দ্র (Free India Center) গড়ে তোলেন। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করেণ। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে হিটলারের উদাসিনতা তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়। ফলে ১৯৪৩ সালে সুভাষ বসু জার্মান ত্যাগ করেণ। একটি জার্মান সাবমেরিন তাকে সমুদ্রের তলদেশে একটি জাপানি সাবমেরিনে পৌছিয়ে দেয়, সেখান থেকে তিনি জাপান পৌছেন।

ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী:

ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (INA=Indian National Army) মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে, ১৯৪৩ সালে রাসবিহারি বসু এই সেনাবাহিনীর দ্বায়িত্ব সুভাষ চন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেণ । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ হাজার সৈন্য ছিল। এই বাহি্নীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার" (আরজি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষ শক্তির ৯ টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। আই.এন.এ.-র সৈন্যরা জাপানিজদের আরাকান ও মেইক্টিলার যুদ্ধে সাহায্য করে।

সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আই.এন.এ.-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যাক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে আই.এন.এ.-তে যোগ দেবে। কিন্তু এই ব্যাপারটি তেমন ব্যাপকভাবে ঘটল না। বিপরীতদিকে, যুদ্ধে পরিস্থিতির অবনতির সাথে সাথে জাপান তার সৈন্যদের আই.এন.এ. থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। একই সময় জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মস্বমর্পন এর সাথে সাথে আই.এন.এ. ও আত্মসমর্পন করে।

রাজনৈতিক চিন্তাধারা:

সুভাষ চন্দ্র বসুর সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হল, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব" (হিন্দিতে, তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙা)। ৪ জুলাই ১৯৪৪ সালে বার্মাতে এক র‌্যালিতে তিনি এই উক্তি করেণ। তার আর একটি বিখ্যাত উক্তি হল "ভারতের জয় ("জয় হিন্দ"), যা কিনা পরবর্তিতে ভারত সরকার গ্রহণ করে নেয়।

অন্তর্ধান ও তথাকথিত মৃত্যু:

একটি মতে নেতাজী সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বন্দী অবস্থায়, সাইবেরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন।

আর একটি মতে, বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজির চিতাভষ্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে -ঐ চিতা ভস্ম নেতাজির নয়। আসলে ভারতবর্ষে নেতাজির তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্স্বানিত হয়ে একদল উঁচুতলার ভারতীয় নেতা এবং ইংরেজ সরকার মিলিত ভাবে ষড়যন্ত্র করে নেতাজীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়।তাই ভারতীয় সরকার কখনো নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের প্রকৃত মৃত্যুর কারণ জনসমক্ষে আনেন নি। অনেকের মতে ফোইজাবাদের ভগবান জি ওরফে গুনমানি বাবা হলেন নেতাজি। কিন্তু এ ব্যাপারটি আজও স্পষ্ট নই। আরেকটি মতে নেতাজী নাকি আজও জীবিত।

সম্মাননা :

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে 'দেশনায়ক' আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।" আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাঁকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তাঁর নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: "নেতাজি ভবন" (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও "নেতাজি" (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।