১৩ মার্চ ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ১৪)

একদিনের কথা । জটায়ুর ভাই সম্প্রতি আকাশে উড়তে উড়তে একেবারে সৌরলোকে উপস্থিত হয়েছেন । পক্ষী হয়ে সূর্যের নিকটে যেতেই সূর্য দেবতা এমন তাপ বিকিরণ করলেন যে সম্প্রতি পক্ষীর ডানা পুড়ে গেলো । ডানা হারিয়ে সেই পক্ষী সূর্য দেবতার কাছে অনুনয় বিনয় করতে সূর্য দেবতা বললেন- “ তোমার এই উদ্ধত আচরণের জন্যই এই শিক্ষা প্রদান করলাম। তুমি দক্ষিণে সমুদ্র তটে অবস্থান করো। যথাসময়ে তুমি তোমার পাখা ফিরে পাবে। তোমাকে দিয়ে একটি মহৎ কাজ হবে। সেই অবধি প্রতীক্ষা করে রাম নাম জপ করো।” হনুমান শিশু অবস্থায় পালক পিতা পবন দেবতার কাছে আকাশ মার্গে বিচরণের শক্তি পেয়েছিলো । একদিনের কথা । প্রভাতে পূর্ব গগনে উজ্জ্বল লাল দিনমণিকে দেখে হনুমান মহারাজ ভাবলেন সেটি নিশ্চয় মিষ্ট ফল। আকাশে ঝুলে আছে । অতএব ঐ ফল খেয়েই দেখতে হবে । ভাবা মাত্রই লম্ফ দিয়ে ছুটে গেলেন । একেবারে ভূলোক ছাড়িয়ে সোজা ঐ সূর্য লোকে । সেসময় খণ্ডিত রাহুর মস্তক সূর্য কে গ্রাস করবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল্ল । সূর্য দেবতা জানতেন সৃষ্টির নিয়ম অনুসারে গ্রহণ হবে। হনুমানকে দেখে রাহু ও সূর্য উভয়ে চমকে গেলো। হনুমান মহারাজ ঐ বাল্যকালেই রাহুর খণ্ডিত মস্তক তুলে বহুদূরে নিক্ষেপ করে সূর্যকে গিলতে অগ্রসর হল ।

রাহু গিয়ে স্বর্গে ইন্দ্রের কাছে বলল- “হে দেবেন্দ্র! সৃষ্টির নিয়মে আমি চন্দ্র সূর্যকে গ্রাস করি। তবে আজ কোথা থেকে সেই উদ্ধত বালক এসে আমার কর্মে হস্তক্ষেপ করছে?”এইদিকে হনুমান সূর্য কে গ্রাস করলো। সমগ্র জগত প্রথমে ভাবল গ্রহণ উপস্থিত । কিন্তু বহু সময় পরেও সূর্য গগনে দেখা দিলো না দেখে সকলে ভয়ভীত হোল । রুদ্রাবতার হনুমান সূর্য গ্রাস করেছেন । ইন্দ্র দেবতা বজ্র ধারন করে ঐরাবত স্কন্ধে আসলেন । বললেন- “কপি বালক। সূর্য দেবকে উন্মুক্ত করে ফিরে যাও। অন্যত্থায় তোমাকে দণ্ড প্রদান করবো ।” হনুমান তো কিছুতেই সূর্য দেবতাকে ছাড়বেন না । ইন্দ্রদেবতা তখন বজ্র অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। বজ্র গিয়ে হনুমানের বুকে আঘাত হানলো । হনুমানের মুখ থেকে সূর্য বেরিয়ে এলো। রক্তাক্ত অবস্থায় হনুমান আছড়ে পড়লো আরবল্লী পর্বতের উপর । পবন দেবতা এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইন্দ্রদেবতার কাছে গিয়ে বললেন- “হে মহেন্দ্র। আপনি কেন একজন বালকের ওপর বজ্র অস্ত্র প্রয়োগ করলেন ?” ইন্দ্রদেবতা অনেক বোঝালেন যে সূর্য দেবতাকে উন্মুক্ত করতেই এটা করতে হয়েছিলো। পবন দেবতা বললেন- “দেবরাজ । হনুমান আমার পালক পুত্র। এর প্রতিশোধ আমি নেবোই। আজ বিশ্ব সংসার দেখবে পবন দেবতার শক্তি কত। একজন পুত্রহারা পিতার শোকে এই জগত ধ্বংস হবে আজ।” পবন দেবতা সমগ্র জগত থেকে উৎক্ষেপন বায়ু, অবক্ষেপন বায়ু, আকুঞ্চন বায়ু, গমন বায়ু, প্রসারণ বায়ু, প্রান বায়ু, অপান বায়ু, ব্যান বায়ু, সমান বায়ু, উদান বায়ু , নাগ বায়ু, কূর্ম বায়ু, কৃকর বায়ু, দেবদত্ত বায়ু, ধনঞ্জয় বায়ু হরণ করলেন । সমস্ত বায়ু বিশ্ব থেকে নিজের মধ্যে সংহরিত করলেন পবন দেবতা ।

বিশ্ব সংসারে মহাপ্রলয় নেমে আসলে জীব প্রানী কূল বিনষ্ট হতে থাকলো । ইন্দ্রদেবতা, প্রজাপতি ব্রহ্মা অনেক বোঝালেন। পবন দেবতা বললেন- “হনুমানের প্রান দান করা হলেই এই প্রলয় স্তব্ধ হবে। অন্যত্থায় বিশ্ব নষ্ট করবো।” ব্রহ্মা ইন্দ্রকে বললেন- “হে দেবেন্দ্র। হনুমানের আবির্ভাব দেবশত্রু রাক্ষস দের বিনাশের জন্য। আর দেবতা হয়ে তুমি দেবতাদের মিত্রকে বধ করে দেব শত্রুদের কল্যাণ করলে। তুমি নিজের ক্ষতি নিজেই আহ্বান করেছো।” ব্রহ্মা প্রান দান করতে রাজী হলে পবন দেবতা শান্ত হয়ে সব বায়ু ফিরিয়ে দিলেন । দেবতারা আরবল্লী পর্বতে গেলেন। দেখলেন হনুমান মরে নি। তবে ভয়ানক আহত হয়ে মূর্ছা গেছেন। বজ্রের আঘাত খেয়েও জীবিত। ব্রহ্মা হনুমানের নব নাম দিলেন ‘বজ্রংবলী’ । ব্রহ্মা বর দিলেন – হনুমান তুমি চারযুগে অমর হবে। কোনো অস্ত্রই তোমাকে রোধ করতে পারবে না । ইন্দ্র বর দিলেন- বজ্রের ন্যায় বল পাবে। পবন দিলেন- বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী হবে তুমি। বহু দূরের বাক্য তুমি জানতে পারবে। অগ্নি বর দিলেন- আগুনে তোমার ক্ষতি হবে না । বরুণ বর দিলেন- ‘জলের তলে তুমি অবাধে বিচরণ ও শ্বাস নিতে পারবে। যম হনুমানকে গদা দিয়ে বললেন- “এই গদা দিয়ে দুষ্ট দমন করো। তোমার বৃদ্ধির সাথে সাথে এই গদাও বৃদ্ধি পাবে।” সূর্য দেবতা হনুমানের লোমকূপে সমগ্র কিরণ দিলেন । ব্রহ্মা বললেন- “যাবতীয় বিদ্যার জ্ঞাতা হবে তুমি।” বিশ্বকর্মা বর দিলেন- “অযুত শক্তিমান হও।” নারদ বললেন- মহান হরি ভক্ত রূপে খ্যাত হবে। বাসুকী নাগ বললেন- “নাগেরা তোমার বশে থাকবে। তোমার নামে নাগ ভয় দূর হবে।” এভাবে বাকী দেবতারা নানান বর দিলেন । হনুমান এরপর সূর্য লোকে শিক্ষা প্রাপ্তির জন্য গেলেন ।

বাল সময় রবি ভক্ষি লিয়ো তব ।
তীনহুঁ লোক ভয়ো অঁধিয়ারো ।
তাহি সোঁ ত্রাস ভয়ো জগ কো
য়হ সঙ্কট কাহু সোঁ জাত না টারো ।।
দেবন আনি করী বিনতী তব
ছাঁড়ি দিয়ো রবি কষ্ট নিবারো ।
কো নহিঁ জানত হৈ জগমেঁ কপি
সংকটমোচন নাম তিহারো ।।
( সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী )

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।