০১ এপ্রিল ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড – ২২ )

রাজা দশরথ বশিষ্ঠ মুনির সাথে কথাবার্তা বললেন । বশিষ্ঠ মুনি জানালেন অন্ধমুনির প্রদত্ত শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলবে । কিন্তু ইক্ষাকু বংশকে ধরে রাখবার জন্য পরবর্তী অযোধ্যার সম্রাট রূপে রাজার বংশজ ত চাই । নাহলে শত্রু রাজ্য অযোধ্যা দখল করবে। রাজা হীন রাজ্য আর তালাখোলা সিন্দুক এক সমান । রাজা নিজ জীবনের তোয়াক্কা না করে ‘পুত্রেষ্টি’ যজ্ঞ করতে মন দিলেন । ঋষশৃঙ্গ মুনিকে আনা হল । রাজা দূত পাঠিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের আমন্ত্রণ জানালেন। মুনি ঋষি দের সাদরে আহ্বান করলেন । বোধ হয় তখন ভারতে আর্য, অনার্য মিত্রতা হয় নি। এই মিত্রতার সূত্রপাত করেছিলেন ভগবান রামচন্দ্র। পরবর্তীতে দেখবো ভগবান রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে রক্ষ রাজ বিভীষণ, বানর কূলের সুগ্রীব, অঙ্গদ, হনুমান যোগ দিয়েছিলেন । কিন্তু দশরথ রাজার যজ্ঞে এনারা কেউ আসেন নি । রাবণের সাথে মিত্রতা হবার চান্স তো ছিলোই না, কিস্কিন্ধ্যা থেকেও কেউ আসেন নি । পুলোম, বিশ্বশ্রবা, অগ্যস্ত, বৈশ্যাম্পন, দুর্বাসা, গৌতম, জৈমিনী, পরাশর, ভৃগু, মতঙ্গ, কৌন্ডিন্য, নিশাকর, সনকাদি মুনি, মার্কণ্ড, ভরত, ভরদ্বাজ, পরশুরাম , অষ্টাবক্র, ভৃগু, কূর্ম, দক্ষ , গর্গ , শরভঙ্গ , বিশ্বামিত্র, শতানন্দ, কপিল, বেদবান, চক্রবান, সাবর্ণি , মৎস্যকর্ণি, সৌভরি , বাল্মিকী , বিভাণ্ডক ইত্যাদি ঋষি গণ তাঁহাদিগের বিশাল শিষ্য সহ এলেন । সপ্তর্ষি, জটায়ু আসলেন। অসুর গুরু শুক্রকেউ আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো, তিনি আসেন নি । অপরদিকে অন্য সব রাজা যেমন জনক, কাশী, লোমপাদ , তৈলঙ্গ, পুরন্দর, ঘনশ্যাম, চম্পেশর, মাগধ ইত্যাদি রাজা আসলেন । কৃত্তিবাসী রামায়নে এই সংখ্যা অনেক বেশী । ৮৮ লক্ষ কোটি রাজার কথা বলা হয়েছে ।

অযোধ্যা নগরীতে আনন্দের বাণ বইল । রাজা দশরথ নিজ মৃত্যু ভুলে সেই আনন্দে যোগ দিলেন । ব্রাহ্মণ গণ পরিবার সহিত অযোধ্যায় এলেন । সমগ্র অযোধ্যা মঙ্গল কলস, স্বস্তিক, ওঁকার ধ্বজা, কলা বৃক্ষ দিয়ে সাজানো হল । রাস্তা ঘাট পুস্প দ্বারা সজ্জিত করা হল । কৃত্তিবাসী রামায়নে লেখা ৮১ যোজন দীর্ঘ, ১২ যোজন প্রস্থ সমান ঘরে এই যজ্ঞ আরম্ভ হয় । মুনি গণ পবিত্র মন্ত্র আরম্ভ করলেন । যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলিত হল । ঋষশৃঙ্গ মুনি বৈদিক মন্ত্র পড়ে যজ্ঞে আহুতি দিতে লাগলেন । যজ্ঞ ধূমে পবিত সুগন্ধি সুবাস চতুর্দিকে ছেয়ে গেল । খাঁটি গব্য ঘৃত, উৎকৃষ্ট বনজ মৌমাছির মধু, মৃগ নাভি, কস্তূরী সুবাসিত বিবিধ দ্রব্য যজ্ঞদেবতাকে অর্পিত করা হল। যজ্ঞে আমরা যে আহুতি দেই সেই আহুতি অগ্নিদেবতা গ্রহণ করে বিভিন্ন দেবী দেবতার কাছে পৌছে দেন। যজ্ঞের বিধিবিধান ভুল বা ত্রুটি বা মন্ত্র অশুদ্ধ উচ্চারণে ভয়ানক কুপ্রভাব সৃষ্টি হয়। অগ্নি দেবতা বৈশ্বানর কুপিত হয়ে সর্বস্ব গ্রাস করেন । সেজন্য সর্বদা বেদজ্ঞ সংস্কৃত শাস্ত্র জ্ঞাত, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ দ্বারা যজ্ঞ করানো উচিৎ। ভোগী ব্রাহ্মণ দের দ্বারা নয় । যাই হোক রাজা দশরথের রাজ্যে দান ধ্যান আদি কর্ম করা হল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চার বর্ণের মানুষ দান পেলো । সকলে রাজার নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন । অবশেষে যজ্ঞে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ সুসম্পন্ন করা হল । যজ্ঞের অগ্নি রাশি থেকে অগ্নি দেবতা স্বর্ণ পাত্রে চরু নিয়ে উঠে আসলেন ।

অগ্নিদেবতা বললেন- “রাজন! তোমার আয়োজিত যজ্ঞে দেবতাবৃন্দ অত্যন্ত প্রীত হয়েছেন । তোমার যজ্ঞ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে । এই চরু তোমার রানীদিগকে ভোজোন করাবে। তোমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।” রাজা দশরথ প্রথমে সেই চরু কৌশল্যা ও কৈকয়ীর মধ্যে ভাগ করে দিলেন । কিন্তু রানী সুমিত্রা এসে সেই চরুর ভাগ চাইলো। তখন কৌশল্যা ও কৈকয়ী নিজের অংশের থেকে অল্প ২ জনে ২ অংশ সুমিত্রাকে দিলেন । এভাবে তিন রানী অগ্নি দেবতা প্রদত্ত চরু ভক্ষণ করলেন । কালে কালে তিন রানীর গর্ভের লক্ষণ প্রকাশ পেলো। মহারানী কৌশল্যার শরীরে দিব্যজ্যোতি দেখা দিলো । তাঁর রূপ ফুটে উঠলো । যারা এসময় কৌশল্যাকে দেখতেন তারা অবাক হতেন যেমন মানব শরীরে এমন দেবজ্যোতি ! কৌশল্যা দেবীর গর্ভে অবস্থান করছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি । শুধু তাই নয়, এই সময় কৌশল্যা দেবী অনেক দিব্য দর্শন লাভ করতেন । সুরবৃন্দ করতেন কি কৌশল্যা দেবীকে দর্শন করতে আসতেন । মানব হয়ে সচরাচর দেবতার দর্শন পাওয়া যায় না । এমন কারণে কৌশল্যা দেবী মাঝে মাঝে ভীত হতেন । নানারকম দেবতার স্বপ্ন দেখতেন । ব্রহ্মা, শিব দর্শন পেতেন । ধীরে ধীরে ভগবান, কৌশল্যার গর্ভে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।