০১ এপ্রিল ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ২৩ )


চৈত্রমাস আসলো। মধুমাসে প্রকৃতি সুন্দর হয়ে উঠলো। অযোধ্যার বৃক্ষ গুলি সুগন্ধে ভরা পুস্পে ভরে উঠলো। নানা রঙ বেরঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগলো সেই সব পুস্পে, মধুলোভী অলিকূল মধুলোভে পুস্পের ডালে গমন করতে লাগলো। কোকিলাদি নানা পক্ষী মিষ্ট সুরে ভরিয়ে তুলে দিলো অযোধ্যার পরিবেশকে । ভগবানের আবির্ভাব কাল উপস্থিত । কৃত্তিবাস ওঝা লেখেছেন-

কৌশল্যারে দেখা দেন প্রভু নারায়ণ ।।
স্বপ্নে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শার্ঙ্গধারী ।
চতুর্ভুজ রূপে দেখা দিলেন শ্রীহরি ।।
পুত্রভাবে হরিকে করিল রাণী কোলে ।
কহিলেন কৌশল্যারে ডাকিয়া মা ব’লে ।।

কৌশল্যা দেবী স্বপ্নে চতুর্ভুজ ভগবানের নীলনবঘন শ্রীমূর্তি দর্শন পেলেন। দেখলেন সেই অনাদির আদি গোবিন্দ পুত্র রূপে তাঁর ক্রোড়ে । কিন্তু ভগবান তাঁহার অবিছিন্না যোগমায়া শক্তি অবলম্বনে বৈষ্ণবী মায়া দ্বারা কৌশল্যার সেই স্বপ্ন স্মৃতি মুছে দিলেন । কারন তাহলে ভগবান রাম বাৎসল্য সেবা পাবেন না । আমরা যেরূপ শ্রীকৃষ্ণের শিশু রূপ গোপাল পূজা করি তেমনি উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান ঐদিকে শিশু রামের পূজো হয়। যাঁহাকে বলে “রামলালা”। সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী মহারাজ লিখেছেন-

বিপ্র ধেনু সুর সন্ত হিত লীনহ মনুজ অবতার ।
নিজ ইচ্ছা নির্মিত তনু মায়া গুন গো পার ।।

এর অর্থ- “শ্রীভগবানের নরদেহ ধারন বিপ্র, ধেনু, দেবগণ ও সাধু সন্ত কল্যাণে নিহিত ছিল । অজ্ঞান রূপে মায়ার মলিনতা , ত্রিগুণ ও ইন্দ্রিয় তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর দিব্য তনু নিজ ইচ্ছায় নির্মিত , তা কোন কর্ম বন্ধনের বশীভূত হয়ে ত্রিগুণাত্মক পঞ্চভূত দেহ নয় ।”

এখানে “সাধু” শব্দের অর্থ যিনি জটা লম্বা শ্রশ্রু রেখে বনে থাকেন খালি তারাই নয়, সাধু বলতে যিনি অন্তর থেকে পবিত্র সর্বদা অন্যের মঙ্গল কামনা করে সেই মতো কর্ম করেন । “সন্ন্যাসী” শব্দের অর্থ- “সৎ ন্যাস” অর্থাৎ যিনি সৎ অর্থাৎ মঙ্গল কর্ম করেন তিনিই সন্ন্যাসী । আর শ্রীভগবান এঁনাদের কল্যাণ করেন । যাই হোক চৈত্র মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে কর্কট লগ্নে পুনর্বসু নক্ষত্র ( মতান্তরে অশ্লেষা ) দ্বিপ্রহরে কৌশল্যা দেবীর গর্ভ থেকে আবির্ভূত হলেন শ্রীভগবান রামচন্দ্র । এই দিনটি “রামনবমী” নামে পালিত হয় । যথা কৃত্তিবাস ওঝা লেখেছেন-

মধুচৈত্রমাস, শুক্লা শ্রীরাম নবমী ।
শুভক্ষণে ভূমিষ্ঠ হ’লেন জগৎস্বামী ।।

শ্রীরামের আবির্ভাব হতে দাসীরা গিয়ে রাজা দশরথকে সংবাদ দিলেন। রাজা দাসীদিগকে মণি মুক্তা অলংকার বিতরণ করলেন । পুত্রের মুখ দেখে অতিশয় খুশী হলেন । এই দেখে মন্থরা গিয়ে গর্ভ যন্ত্রনায় কাতর কৈকয়ীকে বললেন- “তোমার কপাল পুড়লো, এবার কৌশল্যা আগে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে সেই রাজা হবে, আর তুমি ভিখারী।” কৈকয়ী জন্ম দিলেন এক পুত্রের। দশরথ রাজা শুনে আনন্দে দান ধ্যান করে কৈকয়ী পুত্রকে দর্শন করলেন । একদিন পর সুমিত্রা দুটি যমজ পুত্রের জন্ম দিলেন। রাজা দশরথের আনন্দের সীমা নেই । সুমিত্রা সহ যমজ পুত্র দেখে খুশীতে ভরে উঠলেন । শ্রীরামের জন্মেতে ধরিত্রী দেবী খুশী হলেন । মুনি ঋষি রা আনন্দিত হলেন – যথা কৃত্তিবাস পণ্ডিত গেয়েছেন-

রামের জনম শুনি, নাচেন সকল মুনি ,
দণ্ড কমণ্ডলু করি হাতে ।
স্বর্গে নাচে দেবগণ , মর্তে নাচে মর্তজন
হরিষে নাচিছে দশরথে ।।
অযোধ্যায় শঙ্খ, উলুধ্বনি, মৃদঙ্গ, করতাল আদি মঙ্গলজনক বাদ্য বাজতে থাকলো । স্বর্গের দেবতারা পুস্প বর্ষণ করতে লাগলেন । ছদ্দবেশে অযোধ্যা পুরীতে এলেন । চার পুত্রকে একই দোলনায় রাখা হল । রানীরা একে অপরের পুত্রকে আদর করিতে লাগলেন । কে কার মা বোঝাই গেলো না । সরল হৃদয় কৈকয়ী রামচন্দ্রকে আদর বাৎসল্য প্রদান করতে লাগলেন । ভগবানের বাল্যরূপ দর্শন করা অতি সৌভাগ্যের । বিশেষত ভগবান যখন পূর্ণব্রহ্ম অবতার গ্রহণ করেন । এর পূর্বে বামন, কপিল, পরশুরাম অবতারে এই দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য হয় নি । মুনি ঋষি গণ আশীর্বাদ করে অন্তরে অন্তরে কৌশল্যার পুত্রকে প্রনাম করলেন । শিশু ভগবান রাম রূপে নারায়ণ অবস্থান করছেন । সেই শিশু রামের কি অপূর্ব শোভা – কৃত্তিবাস ওঝা লিখেছেন-

অন্ধকার ঘুচে যে জ্বালিলেক বাতি ।
কোটি সূর্য জিনিয়া তাঁহার দেহ- জ্যোতি ।।
শ্যামল শরীর প্রভু চাঁচর কুন্তল ।
সুধাংশু জিনিয়া মুখ করে ঝলমল ।।
আজানুলম্বিত দীর্ঘ ভুজ সুললিত ।
নীলোৎপল জিনি চক্ষু আকর্ণ পূর্ণিত ।।
কে বর্ণিতে হয় শক্ত রক্ত ওষ্ঠাধর ।
নবনীত জিনিয়া কোমল কলেবর ।।
সিন্দূরে মণ্ডিত রাঙা চরণ সুন্দর ।
কমল জিনিয়া প্রভু- নাভি মনোহর ।।
সংসারের রূপ যত একত্র মিলন ।
কিসে বা তুলনা দিব নাহিক তেমন ।।

অপূর্ব সুন্দর সদ্যোজাত ভগবানকে দখে মোহিত হয়ে গেলেন সকলে। লঙ্কায় নানা অশুভ চিহ্ন দেখা দিলো । রক্তবৃষ্টি, শেয়াল সারমেয় ক্রন্দন, গৃধ দলের আকাশে বিচরণ , বিনা মেঘে বজ্রপাত , গর্দভের ক্রন্দন ইত্যাদি ইত্যাদি । রাক্ষসেরা ভয়ে ভীত হল ।

চৈত্র মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে অবশ্যই রাম নবমী তিথি পালন করুন । জন্মাষ্টমীর মতোন নিয়ম । তবে শ্রীরামের জন্ম দ্বিপ্রহরে । তাই পূজা দ্বিপ্রহরে ১ টার মধ্যে সমাপন করবেন । উপোবাসী থেকে পূজাদি করে প্রসাদ সেবা নিয়ে ভগবানের নাম কীর্তন করে পালন করবেন এই তিথি । পূজাতে আপনার সাধ্য মতো ফলমূল ও একটি লাড্ডু হলেও দিবেন। কেউ কেউ মাটির সড়ায় ছাতু, মধু, দৈ, ঘৃত , শর্করা একত্রে দেন । ভগবানের পূজার আড়ম্বর নেই। যার যেমন সামর্থ্য। ভগবান রাম শবরীর দেওয়া উচ্ছিষ্ট জাম ফল খেয়েই তুষ্ট হয়েছিলেন । গর্বে উন্মত্ত হয়ে রাশি রাশি ভোগ দিলে ভগবানের কাছে তা বিষ, আবার ভক্তিভাবে এক পাত্র জল দিলেই তিনি তা আনন্দে সেবা করেন । সুদামার তিন মুঠ চিড়াতেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন , আবার বিদূরের স্ত্রী , ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে ভক্তিভাবে এতই উন্মত্ত হয়েছিলেন যে কলা খেতে দিয়ে ভাবে মোহিত হয়ে নিজেই কলা ছুলে কলার পরিবর্তে কলার খোসা নিবেদন করেছিলেন । আর ভগবান হাসতে হাসতে সেই কলার খোসা সেবা নিয়েছিলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।