০১ এপ্রিল ২০১৬

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড – ৩০ )

বিদ্যা শিক্ষা সমাপন করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এলেন । রানীরা সাদর সমারোহে চার রাজকুমারকে বরণ করে নিলেন । শ্রীরামচন্দ্রের ধনুর্বিদ্যা দেখে সকলের তাক লেগে গেল । চোখের নিমিষে রামচন্দ্রের ধনুক থেকে বাণ ছুটে নিশানায় বিদ্ধ করে । রাজা দশরথ নিশ্চিন্ত হলেন । ভাবলেন অযোধ্যার যোগ্য উত্তরসূরি এসে গেছে । এবার আর চিন্তার কারণ নেই । ওদিকে তপোবনের কথা । তপবনে বিশ্বামিত্রর আশ্রমে রাক্ষসেরা রোজ হামলা চালাতো । তাড়কার ভয়ে অরন্য একেবারে জীবশূন্য হয়েছিলো। গাছগুলিও যেনো জড়বৎ হয়ে গিয়েছিলো। গাছে ফুল, ফল আসতো না। অরন্যের শোভা নষ্ট হয়ে জায়গায় জায়গায় কেবল অস্থি, খুলি ইত্যাদি দেখা যেতো। ভুলবশত এই বনে কেউ প্রবেশ করলে সে আর জীবিত ফিরতো না। সোজা রাক্ষসদের আহারের তালিকায় স্থান পেতো। সেই হাড় হিম অরণ্য ছিলো প্রাকৃতিক শোভা বর্জিত । কেবল রাক্ষসদের অট্টহাস্য শোনা যেতো । শিষ্যেরা বললেন- “হে গুরুদেব ! এই রাক্ষসের অত্যাচার কোনোকালেই কি স্তব্ধ হবে না ? আমরা কি চিরকাল যাগ যজ্ঞ করে দেবতাবৃন্দকে আহুতি প্রদানে ব্যর্থ হব? দেবর্ষি নারদ বলেছিলেন এই রাক্ষসদের বিনাশ করতে ভগবান হরি আসবেন!” বিশ্বামিত্র বললেন- “বোধ হয় এই রাক্ষসদের অন্তিম কাল উপস্থিত । ভগবান , দশরথ রাজার গৃহে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁহার শিক্ষা সমাপ্তি হয়েছে। আমি তাহাদিগকে আনিতে অযোধ্যায় যাবো।”

মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি অযোধ্যায় আসলেন । রাজা দশরথ এই সংবাদে ভীত হয়েছিলেন । তিনি জানতেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র পূর্বে তাঁর পূর্বপুরুষ হরিশ্চন্দ্র রাজার কাছে দানে সমগ্র রাজ্য নিয়েছিলেন। আবার কি তিনি এমন করবেন ? রাজা মুনিকে স্বাগত জানালেন । করজোড়ে রানী সহিত মুনিকে আপ্যায়ন করলেন । আসনে বসিয়ে মুনির পদযুগল সুগন্ধি বারি দ্বারা ধৌত করতো, স্বর্ণ উত্তরীয় দ্বারা মুনির পদযুগল মুছিয়ে দিলেন। অতঃ চামর, পাখা ব্যাঞ্জনাদি করে চন্দন অগুরু কর্পূর পুস্প দ্বারা, বিবিধ নৈবদ্য দ্বারা মুনির পূজা করে বলিলেন- “হে মহর্ষি আদেশ করুন, আমি আপনার কিরূপে সেবা করিতে পারি?” বিশ্বামিত্র রাক্ষসদের অত্যাচার কাহানী বলে বললেন- “হে রাজা দশরথ ! রাক্ষস বাহিনীর বধ প্রয়োজন । অন্যথায় তারা তপোবন ধ্বংস করে দেবে। আপনি রাম লক্ষণ কে প্রদান করুন। তাহারা রাক্ষস বধ করবেন।” শুনে দশরথ রাজা , রাণীদের প্রান শুকিয়ে গেল। দশরথ রাজার বুকে মহাভয় উপস্থিত হল। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন । মহর্ষির চরণ ধরে বললেন- “ মহর্ষি ! আপনি অন্য কিছু প্রার্থনা করুন। কিন্তু রাম লক্ষণকে কিভাবে দেবো ? তাহারা সদ্য কৈশোরে এসেছে । তাহারা কিভাবে সেই ভয়ানক মায়াবী রাক্ষসদের বধ করবে? আপনি চাইলে সমগ্র অযোধ্যা নগরী আপনার চরণে সমর্পণ করব, সমগ্র অযোধ্যার সেনা আপনার সহিত প্রেরন করবো, তাহারা গিয়ে সেই রাক্ষসের বধ করবে। আমি নিজে তাহাদিগকে বধ করবো- আপনি আদেশ করুন। কিন্তু প্রভু, রাম লক্ষণ এখনো বালক, তারা ঐ রাক্ষসদের বধ করা তো দূর, তাহাদের দেখেই হয়তো প্রাণত্যাগ করবে।” বিশ্বামিত্র বললেন- “রাজন। সেই রাক্ষস গণ আপনি বা অন্য কেউ কিংবা আমার হাতে বধ্য নয়। এমন হলে আমি নিজেই তাদের বধ করতাম। পূর্বে আমি ক্ষত্রিয় গাঁধিপুত্র ছিলাম। বহু অস্ত্রের জ্ঞাতা আমি। আপনার বা মিথিলা নরেশ জনকের সাহায্য চাইতে পারতাম। কিন্তু ওরা কেবল রাম- লক্ষণের হাতে বধ্য হবে।” 

রাজা তো নারাজ । কিন্তু শেষে রাম লক্ষণ এগিয়ে এলেন । পিতাকে সান্তনা দিলেন । বললেন- “পিতা। আপনার আশীর্বাদে আমরা সেই রাক্ষস বধ করতে পারবো। গুরুদেব বশিষ্ঠ মুনি আমাদের যে যুদ্ধবিদ্যা , অস্ত্রদান করেছেন- এখন সেইগুলির প্রয়োগের সময় এসেছে। তবেই তো জানবো যে আমাদের বিদ্যা শিক্ষা সফল হয়েছে । আপনি অমত করবেন না। সেই রাক্ষস কূল বিনষ্ট করে আমি আপনার নাম উজ্জ্বল করবো। প্রজা পালন ও দুষ্টের বিনাশ করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। আপনি অনুমতি প্রদান করুন।” রাজা ভয়ে দিশেহারা । মনে মনে অন্ধ মুনির প্রদত্ত শাপ মনে পড়লো। হয়তো রাম লক্ষণ আর বেঁচে ফিরবে না। রাক্ষসেরা তাদের বধ করে খাবে। আর সেই শোকে তাঁর মৃত্যু ঘটবে । অনেক মানা আপত্তি করতে লাগলেন রাজা দশরথ । মুনি বিশ্বামিত্র ক্রোধে বললেন- “দশরথ । তুমি আমার শক্তি সম্বন্ধে অবগত আছো । পূর্বে তোমার পূর্বপুরুষ রাজা হরিশ্চন্দ্রকে যেরূপ সর্বস্বান্ত করেছিলাম, সেইরূপ শাপ দিয়ে তোমার নগরী ভস্ম করবো। অবশ্য রাক্ষসেরা বধ না হলে তারা এরপর তোমার রাজ্যে হানা দিয়ে তোমার রাজ্য ছারখার করবে। যদি তুমি এমন না চাও তাহলে রাম লক্ষণ কে প্রদান কর ।” রাজা দশরথ আর কি করেন ? দিয়ে দিলেন শ্রীরাম ও লক্ষণ কে। রাজা শোকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লেন । বিশ্বামিত্র মুনি তখন রাম লক্ষণ কে নিয়ে চললেন । 

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।