০১ এপ্রিল ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ১৯ )

আজ অযোধ্যা নগরীর বর্ণনা করবো। ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে সরয়ূ নদীর তীরে এই রাজ্য অবস্থিত ছিলো। এই রাজ্যে সর্বত্র শ্রী, ঐশ্বর্য ছিলো। সুউচ্চ মহল, পুস্পশোভিত উদ্যান, নির্মল টলটলে জল ভরা সরোবরে হংস হংসী কেলি, মন্দির, মুনি – ঋষি , পাঠশালা, নাট্টশালা, পুস্পে ফলে শোভিত বৃক্ষ, পক্ষী কলতান সবে মিলে অযোধ্যা নগরী এক সুন্দর পরিবেশ ছিলো । এই রাজ্যের রাজা দশরথ ছিলেন প্রজা পালক, দেব দ্বিজে ভক্তি পরায়ণ , জিতেন্দ্রিয় , ধর্মনিষ্ঠ । এই রাজ্যে ব্রাহ্মণ গণ নিত্যযজ্ঞাদি করতেন । কদর্য, নাস্তিক, গরীব, মূর্খ, কামুক, কৃপণ, নিষ্ঠুর এ রাজ্যে ছিলো না। রাজা এত দানবীর ছিলেন দরিদ্রেরাও ধনী হত । এই নগরীর চারপাশে গভীর জলের পরিখাতে মনুষ্যমাংস আহারী কুমীর রাখা হত, যাতে শত্রু আক্রমণ করতে না পারে । সুপ্রশস্ত রাজপথ ছিল। নগরের চারপাশে সুরক্ষার জন্য ‘শতঘ্নি’ নামক অস্ত্র উচিয়ে রাখা হত । বিপুল সেনা চারপাশে পাহারা দিতো। বোধ হয় রাবনের রাক্ষস বাহিনীর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এমন আয়োজন । রাজর্ষি দশরথের সভায় ৮ জন বিচক্ষন , সু পরামর্শদাতা মন্ত্রী ছিলেন । এছাড়া ৭ জন ঋষি দশরথকে সুবুদ্ধি দিতেন । রাজা দশরথ সাগরের মতো গম্ভীর আর আকাশের ন্যায় নির্মল ছিলেন । তাঁর তিন রানী যথা- কৌশল রাজ্যের রাজকণ্যা কৌশল্যা, কেকয় রাজ্যের রাজকণ্যা কৈকয়ী, ও কলিঙ্গের রাজকণ্যা সুমিত্রা দেবী। দশরথের একটি কন্যা সন্তান ছিলেন তাঁর নাম শান্তা । শান্তার বিবাহ হয়েছিলো ঋষশৃঙ্গ মুনির সাথে। রাজার কোন পুত্র সন্তান ছিলো না ।

এক সময়ের কথা । রাজা দশরথের সুন্দর রাজ্যে একদিন অকাল নেমে আসলো । চারপাশে খরা। মাঠের ফসল মাঠেই রোদে পুড়ে গেলো। বর্ষা ঋতুতে কোন বৃষ্টি নেই। এমন সুন্দর স্বর্গসম রাজ্য বৃষ্টির অভাবে যেনো নরকে পরিণত হতে লাগলো। রাজা অন্নসত্র খুলে প্রজাদের অন্ন বিতরণ করতে লাগলেন । ধীরে ধীরে অন্নের ভাণ্ডার সমাপ্ত হতে লাগলো। রাজা সমস্ত প্রকার কর মুকুব করে দিলেন । কিন্তু ফসল না হলে খাবে কি? রাজা তখন জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হলেন । জ্যোতিষীরা বলল- “হে রাজন। ইন্দ্র দেবতার কোপে এই অনাবৃষ্টি হয় নি। গ্রহরাজ শণিদেব রোহিনী নক্ষত্রের শকট ভেদ করেছেন, তাই এই অবস্থা । এই অবস্থায় শণির দশায় আপনার রাজ্যে বারো বছর অনাবৃষ্টি হবে।” রাজা মহাচিন্তায় পড়লেন । রাজ্যে শণিপূজার আয়োজন করলেন শনি দেবকে সন্তুষ্ট করবার জন্য । কিন্তু শণিদেব তবুও রোহিনী নক্ষত্র ছেড়ে গেলেন না। রাজা বাধ্য হয়ে শণিদেবকে আক্রমণ করলেন । দুজনে মহাযুদ্ধ হল। দশরথ রাজা একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। তিনি এমন সব দিব্যাস্ত্র চালনা করলেন যে দেবতা হয়ে শণিদেব পর্যন্ত অবাক হলেন । কিন্তু দৈবশক্তির বিরুদ্ধে কতক্ষণ আর লড়াই চলে। ঘায়েল হলেন দশরথ । তখন জটায়ু পাখী তাকে সুস্থ করলেন । জটায়ু বললেন- “রাজন। আমি গরুড় পুত্র জটায়ু। আপনাকে আমি সুস্থ করেছি।” রাজা দশরথ বললেন- “হে জটায়ু। আপনি আমার প্রান রক্ষা করে আমাকে নবজীবন দান করেছেন । আজ থেকে আপনি আমার মিত্র।” সুস্থ হয়ে রাজা দশরথ পুনঃ শনিদেবকে আক্রমণ করলেন । একজন মানবের এত স্পর্ধা দেখে শণিদেব আশ্চর্য চকিত হলেন । দুজনের নানা দিব্যাস্ত্রে গগন ছেয়ে গেলো।

নারদ মুনি মধ্যস্থতা করলেন। শণিদেবকে বললেন- “হে সূর্য পুত্র। আপনি রোহিনী নক্ষত্রে এসেছেন বলেই অযোধ্যায় অনাবৃষ্টি হচ্ছে। সেই কারনেই দশরথ রাজা আপনাকে আক্রমণ করেছেন । উপরন্তু ভগবান হরির আগামী অবতারের পিতা হচ্ছেন দশরথ। আপনি প্রভুর পিতার কোনো ক্ষতি করলে তখন হরির কোপ থেকে আপনাকে কেউ বাঁচাতে পারবেন না। অতএব আপনি রোহিনী নক্ষত্র ছেড়ে চলে যান।” শনিদেব বললেন- “তাই হবে। আমি কদাপি আর রোহিনী নক্ষত্রের সীমা অতিক্রম করবো না।” শনিদেব চলে গেলেন। অযোধ্যায় আবার সুদিন ফিরে এলো। অপরদিকে সম্বর নামক অসুরের হাতে দেবাতারা রাজ্যপাট হারিয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন- “সম্বর অসুর কেবল দশরথের হাতে বধ্য । তোমরা তাহাকে যুদ্ধে আনো।” দেবতারা গিয়ে দশরথকে সব কিছু বললেন। দশরথ যুদ্ধে আসলেন । সাথে আসলেন তাঁর স্ত্রী কৈকয়ী । অসুরের সাথে যুদ্ধে দশরথ দারুন ভাবে আহত হলেন । কিন্তু সম্বর অসুরকে বধ করলেন । অসুরের বধ হতে দেবতারা স্বর্গ ফিরে পেলো । কৈকয়ী যুদ্ধে স্বামীকে সাহায্য করেছিলেন । এমনকি দশরথ দারুন ভাবে আহত হয়েছিলেন । সমস্ত শরীরে আঘাত স্থানে পচন ধরেছিল । স্বর্গের বৈদ্য অশ্বিনী কুমার ঔষধ দিলেন। কৈকয়ী প্রানপণে সেবা করে দশরথকে সুস্থ করলেন। খুশী হয়ে দশরথ বললেন- “কৈকয়ী তোমার সেবাতে আমি সুস্থ হয়ে নব জীবন লাভ করেছি। এই ঋণ আমি কদাপি বিস্মৃত হবো না। তোমাকে আমি দুটি বর দিতে চাই। প্রতিজ্ঞা করছি দুই বরে তুমি যা চাইবে তাই আমি দেবো।” কৈকয়ী বললেন- “সময় আসলে আমি অবশ্যই আপনার কাছে দুটি বর চেয়ে নেবো। এখন না।”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।