১২ এপ্রিল ২০১৬

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব –৫ )


রামচন্দ্র একবাক্যে বনবাসে যেতে প্রস্তুত। কোন অভিযোগ নেই। কোন আক্ষেপ নেই। তিনি তৈরী। এখন শুধু মহারাজ দশরথের আদেশ নিয়ে যেতে হবে। একেতে রঘুবংশীয় মহারাজ দশরথের প্রতিজ্ঞা, অপরদিকে মাতা কৈকয়ীর ইচ্ছা । রামচন্দ্রের সহধর্মিণী মাতা জানকী দেবী এই সকল সংবাদ শ্রবন করলেন। তিনিও স্বামীর ন্যায় মনে কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, আক্ষেপ, দুঃখ রাখেন নি । তিনি রামচন্দ্রকে বলিলেন- “হে নাথ! আমিও আপনার সাথে বনে গমন করতে ইচ্ছুক।” রামচন্দ্র বললেন- “ইহা অসম্ভব! বন গমনের কথা কেবল আমার। মাতা কৈকয়ী আমাকে বনে যেতে বলেছেন। আমি একাই যাবো। তুমি সেখানে গিয়ে কি করবে?” সীতাদেবী অনেক বোঝালেন। বললেন- “প্রভু! পতির চরণেই পত্নীর সকল তীর্থ, পতির সেবা পত্নীর পরম ধর্ম, পতির অনুগমন করাই আদর্শ সতী নারীর কর্তব্য। আপনি যেখানে যাবেন আমিও সেইখানেই থাকবো।” ভগবান রাম বহু বোঝালেন সীতাকে। কেবল বোঝানোই নয়, জঙ্গলের বিভীষিকার কথাও তুলে ধরলেন । রামচন্দ্র বললেন- “হে বৈদেহী ! তুমি রাজার কণ্যা। জনক রাজ্যে তুমি অতীব সুখ সমৃদ্ধিতে লালিতা পালিতা হয়েছো। অরণ্যে কি কারনে যাবে? আর সেখানে গিয়ে থাকবে কিভাবে ? অরণ্যের নিদারুন কষ্ট তুমি সইতে পারবে না। অরণ্য বাস কালে কোন প্রকার রাজকীয় সুখ, সেখানে প্রাপ্ত হবে না। তোমার কোমল, পুস্প সম চরণ কি প্রকারে পথের কণ্টকের আঘাত সহ্য করবে? শুধু কি এই ? সেখানে বহু হিংস্র জন্তু বিচরণ করে, উপরন্তু তাড়কা, মারীচ, সুবাহুর তুলনায় বহুগুণে শক্তিশালী রাক্ষসেরা সেখানে থাকে? তোমাকে এমন বিপদ সঙ্কুল স্থানে কিভাবে নিয়ে যাই? তুমি বরং অযোধ্যায় থাকো। চতুর্দশ বৎসর সমাপন হলে আমি ফিরে আসবো।”

সীতাদেবী সেসকল শুনে বলল- “প্রভু! আপনি স্বয়ং রাক্ষস বধ করে ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের তপোবন রক্ষা করেছেন । আপনি যেখানে , সেখানে রাক্ষসেরা কিভাবে জীবিত থাকবে ? আপনি আমার সুরক্ষা। হে নাথ! পতি যেস্থানে থাকুক, পতিব্রতা রমণীর কাছে সেই স্থানই স্বর্গ । পতি বিনা দেবপুরীও নরক তুল্য বোধ হয় । জন্ম থেকে আমাকে পতির অনুগামিনী হতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমি সে সকল কিভাবে বিস্মৃত হব? আপনি আমার স্বর্গ, আপনার চরণেই আমি অমৃত সুখ অনুভব করি। আপনি কুটীরে কিংবা রাজমহলে যেখানেই থাকুন, আপনার সঙ্গই আমার কাছে সর্ব বৃহৎ সুখ। অতএব এক আদর্শ পতিব্রতা রমণীর ন্যায় আমি আপনার অনুগামিনী হয়ে চতুর্দশ বৎসর বনবাসে কাটাবো। আপনার সান্নিধ্য পেয়ে সেই অরণ্যবাস আমার কাছে দেবপুরীবাস হয়ে উঠবে। বিবাহ কালে আমি আপনি অগ্নি সাক্ষী করে এই শপথ রেখেছিলাম। আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী, যেখানে আপনি সেখানেই ছায়ার ন্যায় আমি বিচরণ করবো।” শ্রীরামচন্দ্র আর কি করেন ? অনেক বুঝিয়ে সীতাদেবীকে নিরস্ত্র করতে পারলেন না। তখন ভগবান রাম , সীতাদেবীকে সঙ্গে নেবার মনস্থির করলেন । অপরদিকে লক্ষণ সব শুনে তাঁর অগ্রজের সাথে দেখা করতে আসলেন । তিনি প্রথমে ভরত আর বিমাতা কৈকয়ীকে অনেক বকাঝকা করতে লাগলেন। শ্রীরাম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “ভ্রাতা , মাতা ও ভ্রাতার নামে কুবাক্য প্রয়োগ করো না। এ আমাদের মায়ের আদেশ। আমি একে পালন করবো। আমি ও সীতা দুজনেই বনে যাচ্ছি। সীতাকে আমি অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু সে আমার বাক্য রাখেনি। সে আমার সাথেই অরণ্যে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছে ।” লক্ষণ তখন বলল- “অগ্রজ! যখন আপনি ও বৌঠান দুজনেই বনে যাচ্ছেন, তবে সাথে আমাকেও নিয়ে চলুন। আমিও আপনাদের সাথে অরণ্যে গিয়ে চতুর্দশ বৎসর বনবাসীর ন্যায় থাকবো।”

রামচন্দ্র বললেন- “এ হয় না ভ্রাতা। বন গমনের শর্ত শুধু আমার। বল পূর্বক সীতা আমার বাক্য অগ্রাহ্য করে তাকে অরণ্যে নিয়ে যেতে আমাকে স্বীকৃত করেছে। এর উপর তোমাকে আমি কিমতে নিয়ে যাবো? তোমার ঘরে স্ত্রী আছেন। তোমাকে কোনরূপ বন গমনের শর্ত দেওয়া হয়নি। মাতা সুমিত্রা এসকল শুনলে কষ্ট পাবেন । তুমি রাজমহলেই থেকে আমাদের প্রতীক্ষা করো। ” লক্ষণ তখন ভগবান রামের চরণে বসে বললেন- “অগ্রজ! জন্ম থেকে মাতা আমাকে জেষ্ঠ্য ভ্রাতার সেবা করতে বলেছিলেন । আমি তাই করি। জেষ্ঠ্য ভ্রাতার সেবা করা কনিষ্ঠ ভ্রাতার কর্তব্য। অগ্রজ ভরত এসকল বিস্মৃত হয়ে তোমাকে অরণ্যের দুঃখে ঠেলে দিয়ে সে মাতুলালয়ে বসে সুখাদি ভোগ করছে । কিন্তু আমি নীতিবাক্য ভুলিনি। যদি যেতে হয়, তবে আমিও আপনার সাথে যাবো। আপনার সেবা করা, অরণ্যে আপনাদের সুরক্ষার দায়িত্ব সব আমার। আমি জানি আপনি মহাবীর । কিন্তু এই লক্ষণ থাকতে আপনাকে কেন কষ্ট করে ধনুর্বাণ তুলতে হবে? সেসকল দায়িত্ব আমার। অতএব আমিও আপনার, বৌঠানের সেবার জন্য চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে গমন করতে চলেছি। আপনি আদেশ দিন।” রামচন্দ্র অনেক বোঝালেন লক্ষণ কে । কিন্তু লক্ষণ কিছুই শুনলো না। তখন রামচন্দ্র অনুমতি দিলেন । মাতা সুমিত্রা পুত্র লক্ষণকে স্নেহ ভরে আদর করে বললেন- “পুত্র! তুমি উচিৎ কর্ম করেছো। তোমার জন্য গর্ব হচ্ছে। দেখো অরণ্যে যেনো আমার জেষ্ঠ্য পুত্র রামের কোনরূপ যেনো অসুবিধা না হয়। তাঁর সেবায় কোন ত্রুটি রেখো না। অযোধ্যার কূল বধূ সীতাকে সর্বদা রক্ষা করো। যেনো কোন দুঃখের ছায়া উহাদের জীবনে না আসে।” সীতার ও লক্ষণ রামচন্দ্রের সাথে বণে যাবে, এই কথায় গোটা অযোধ্যার শোক আরোও বৃদ্ধি পেলো। রামচন্দ্র, সীতাদেবী, লক্ষণ সকলে রাজবেশ ত্যাগ করে বনবাসীদের ন্যায় মস্তকে জটা বাঁধলেন, পরনে সন্ন্যাসীর ন্যায় গেরুয়া বস্ত্র, কর্ণে , বুকে, বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা, মৃগ চর্ম দ্বারা সজ্জিত হলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।