• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

১৬ মে ২০১৬

বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

 

জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরে বাঁকে বিহারীর পবিত্র বিগ্রহ রয়েছে। নিধি অর্থে সম্পদ এবং চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা বলে বন। সেখান থেকেই এই মন্দিরের নাম নিধিবন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই জঙ্গলের সব গাছের শাখাই নিম্নমুখী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গাছের শাখা-প্রশাখা নিচের দিকে মুখ করে রয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও এই মন্দির ও তার আশেপাশের এলাকা অত্যন্ত রুক্ষ, এই সব গাছগুলো সারা বছরে সবুজে ভরে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দা ও মন্দিরের কর্মচারিদের বিশ্বাস এই সব গাছ আসলে বাঁকে বিহারীর লীলাখেলার সঙ্গী গোপীনির দল।

রাত নামলেই নাকি বদলে যায় মন্দির এলাকা? তাই বিকেলের পরই বন্ধ করে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজা। স্বয়ং বাঁকে বিহারী নাকি আজও এখানে রাইকিশোরী ও অন্য গোপীনিদের সঙ্গে লীলাখেলা করেন। মন্দিরের চারপাশ ঘিরে রাখা এই গাছগুলোই গোপীনিতে পরিবর্তিত হয়ে রাসলীলায় অংশ নেন। মন্দির চত্বরে ঘুরতে ঘুরতেই একটি ছোট কুয়ো নজরে পড়বে আপনার। মনে করা হয়, রাসলীলার সময় একদিন রাধা তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে, তাঁর তৃষ্ণা মেটাতে খোদ শ্রীকৃষ্ণ এই কুয়োটি তাঁর বাঁশি দিয়ে খনন করেন।



 


সন্ধ্যারতির পরই এই মন্দিরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাইরে বের করে দেওয়া হয় সমস্ত পর্যটক ও পূণ্যার্থীদের। সকাল পর্যন্ত এখানে যে কোনও কারোর প্রবেশ নিষেধ। এই মহারাসলীলা কাউকে চাক্ষুস করতে দেওয়া হয় না। কয়েকজন অতি-উত্‍সাহী কখনও সখনও লুকিয়ে সন্ধের পর মন্দিরে থেকে গিয়েছিলেন। সকালবেলা তাঁদের হয় মৃত, নয়তো পাগল অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি সন্ধের পর বন্ধ মন্দির থেকে ভেসে আসা ঘুঙুরের শব্দ অনেকেই শুনেছেন। রাধা-কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করতে সন্ধ্যারতির পর পুরোহিতরা এখানে শাড়ি, মিষ্টি, চুড়ি, পান এই সব রেখে যান। সকালে সেই সবকিছু ছড়ানো-ছিটোনো অবস্থায় পাওয়া যায়। মিষ্টি, পান কেউ খেয়েছে বলেও বোঝা যায়।

এই মন্দিরে সত্যিই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাল করেন বলেই বিশ্বাস করেন স্থানীয়রা। বৃন্দাবনের মানুষের ভক্তি ও প্রেম কৃষ্ণভগবানকে এই মন্দিরে ফিরিয়ে আনে বলে মনে করেন তাঁরা। অনেক ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক এই মন্দিরের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। তবে কিছু একটা অস্বাভাবিক এখানে রয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন তাঁরাও ।

Source:  www.eisamay.com
Share:

০৩ মে ২০১৬

এবং নারদ ও এক শিকারী


ভগবানের নাম জপ করতে করতে নারদ মুনি একদিন গঙ্গায় স্নান করার জন্য বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন এই সময় তিনি এক বীভৎস দৃশ্য দেখতে পেলেন।
নারদ মুনি - কে ভগবানের সৃষ্টির এই অবস্থা করলো? নিশ্চয়ই কোন দুর্বুদ্ধি বোকা এই ভয়ানক পাপ কর্ম করেছে! কিছু আত্মা প্রাণীদের উপর এমন অত্যাচারের মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারময় তৈরী করছে! ---- নারদ মুনি কৃষ্ণ কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর দিব্য বীণাতে টঙ্কার দিলেন আর তাতে সমস্ত পশুরা সেই স্থান পরিত্যাগ করলো।
শিকারী - এটি কিসের শব্দ? এটি কি ঘটছে? আমার সমস্ত পশুরাই এই স্থান থেকে চলে গেল।
নারদ মুনি - শিকারী, আমি তোমার কাছেই এসেছিলাম।
শিকারী - তুমি কে? আমি তো তোমার মত কাউকে চিনি না, তুমি আমার কাছে কি চাও?
নারদ মুনি - আমি নারদ, আমি তোমার কাছে এসেছিলাম যদি তুমি আমাকে আমার পথ চিনতে সাহায্য কর।
শিকারী - আমি একজন শিকারী আর তুমি কিনা আমার সমস্ত বন্দী পশুকে তাড়িয়ে দিলে, তুমি কেন এমন করলে?
নারদ মুনি - আমি যখন এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম যে এই সমস্ত পশু যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এই হীন, পাপ কার্য কে করেছে?
শিকারী - পাপ কাজ! তুমি এসব কি বলছ?. আমিই তো এসব করেছি, এ সব কিছুই সঠিক আছে।
নারদ মুনি - তুমি এই দুর্বল খরগোশটিকে অর্ধমৃত কর রেখেছ আর বলছ এসবই সঠিক?
শিকারী - প্রভু, এতে পার্থক্য কোথায়, আমার পিতাই এই শিক্ষা প্রদান করেছেন, আর যখন আমি কোন খরগোশকে মৃত্যু যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে দেখি, তা আমাকে আরো বেশি আনন্দ দান করে।
নারদ মুনি - শিকারী আমি তোমার কাছে শুধু একটি জিনিসই চাই, বল তুমি আমাকে তা দান করবে।
শিকারী - আপনি কি কোন কিছু পুষতে চান? আপনি আমার বাড়িতে চলুন আমি আপনাকে হরিণ, বাঘ, যা চান না কেন তাই দিয়ে দিব।
নারদ মুনি - আমার এইসব কিছুই চাই না। আমি শুধু চাই যে, তুমি পশুদেরকে এভাবে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখ না। তোমায় কষ্ট ভোগ করতে
শিকারী - কিন্তু, আমি এই কষ্ট ভোগ করতে পারবনা।
নারদ মুনি - কিন্তু এটাই ঘটবে। তোমাকে প্রত্যেক পাপ কর্মের জন্য তার ফল ভোগ করতেই হবে।
শিকারী - হে প্রভু, আমি তাহলে কিভাবে এই পাপময় কর্ম থেকে মুক্তি পেতে পারি? আমি আপনার কাছে এই মিনতি নিবেদন করছি, দয়া করে আমাকে এই অবস্থায় বিপদ থেকে রক্ষা করুন। আমাকে পথ প্রদর্শণ করান।
নারদ মুনি - আমি তোমাকে প্রকৃত পথ দেখাতে পারি, কিন্তু তোমাকে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
শিকারী - অবশ্যই প্রভু, আমি তা থেকে বিরত হবো না।
নারদ মুনি- তাহলে প্রথমেই তুমি তোমার ধনুক ভেঙ্গে ফেল।
----- শিকারী তার ধনুক ভেঙ্গে ফেলে সেই শিকারীটি এবার নারদ মুনির নির্দেশনা শুনতে লাগল। সে তার সমস্ত বল, সম্পদ-সমৃদ্ধি ফেলে মাত্র একটি বসন পরে নারদের কাছে আসল।
শিকারী - আমার অতীত ছিল রাতের ভয়ংকর স্বপ্নের মত এবং এখন আমি জাগ্রত হতে চাই। কিন্তু কিভাবে এই বদ স্বভাবগুলো থেকে মক্তি পেতে পারি।
নারদ মুনি - হে শিকারী তুমি কি জান না কৃষ্ণ কত দয়াময়। তিনিই তোমাকে সকল রকম ব্যবস্থা করে দিবেন। তুমি শুধু তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ কর। শিকারী ও তার স্ত্রী নদীর তীরে একটি ছোট্ট কুটির তৈরী করল।
শিকারীর স্ত্রী - তুমি আমাকে অনেক আনন্দ দান করেছ। এখন কৃপা করে নারদ মুনি যা তোমাকে বলেছে তা আমাকে বল। তুমি এখন যা করছ তাই প্রকৃত মুক্তির পথ এবং আমরা এখনই কেবল মাত্র বনের অন্য পশুর থেকে আলাদা হতে পারি।
শিকারী- তুমি আমাকে আমার আধ্যাত্মিক গুরুর নির্দেশনা পালনে সাহায্য কর। তুমি আমার সাথে যোগদান কর আর আমার গুরুদেব যে পারমার্থিক সেবা প্রদান করেছেন তাতে অংশগ্রহণ কর।
শিকারী এবার ‘হরেকৃষ্ণ’ মহামন্ত্র নাম জপ করতে শুরু করল এবং তারা অন্যের দয়া নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করত। তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই গ্রহণ করত না।
তিনি তার বাড়িতে পরম পবিত্র তুলসী মহারাণীকে প্রতিদিন জলদান করতেন। এসব দেখে পাশের বাড়ির লোকেরা বলাবলি করতে লাগল -- আমাদের বাড়ির জানালা থেকে আমরা প্রায়ই দেখি যে তোমার স্বামী ভগবৎ ভজনা করছে, আর দেখ এমন তাঁর মুখমন্ডল কেমন জ্যোতির্ময় এবং উৎফুল্ল দেখাচ্ছে।
শিকারীর স্ত্রী - এটি সার্বিকভাবে নারদ মুনির কৃপা, ঐ তুলসী গাছটি দেখ। আমার স্বামী নারদ মুনির কাছ থেকে শুনেছে যে, শুধুমাত্র তুলসী গাছে জল সেচনের দ্বারা নিজেদের পবিত্র করে তুলতে পারা যায়। কারণ তুলসী মহারাণী ভগবানের পরমা প্রিয়া, দেখ দেখ, শিকারী এখন ভক্তে পরিণত হয়ে গেছে। গ্রামবাসী প্রত্যহ তার জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসত।
ভক্তবৃন্দ - সে সকল কিছুই বুঝতে পারছে, আমি বলছিলাম না আমরা খুবই ভাগ্যবান কারন আমরা এখন এমন একজনের সাক্ষাৎ পেয়েছি যিনি নারদ মুনির শিষ্য।
----- আর এরপর থেকে দশ থেকে বিশ জন প্রত্যেক দিন সেই শিকারীর সাথে প্রসাদ গ্রহণ করত।
ভক্তবৃন্দ - সবই তোমার কৃপা, আমরা তোমাকে আর কখনো পশুদের শত্রু বলব না। আমরা তোমাকে একজন সাধু বলে ডাকতে পারি। আর তোমার জন্য কিছু ফল নিয়ে এসেছিলাম।
শিকারী - দয়া করে আমাকে নারদ মুনির শিষ্য বলে ডাকলেই চলবে। আমি এর বেশি কিছুই নই।
---- একদিন নারদ মুনি এবং তার বন্ধু পর্বত মুনি সেই বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
নারদ মুনি - পর্বত মুনি আমার এক শিষ্য এরই পাশে কোথাও বাস করে তো দেখি এখন সে কি করছে?
পর্বত মুনি- আমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তদের খবুই ভালবাসি এবং তাদের দর্শনে আনন্দ উপভোগ করি, নারদ দয়া করে আমাকে সেখানে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও। ঐ যে সেই শিকারী, দেখ দেখ।
শিকারী নারদ মুনিকে দেখে বললেন, “ঐ যে দেখ, আমার শ্রদ্ধেয় পরমারাধ্য শ্রী গুরুদেব আসছেন।” যখন শিকারী মাঠ পার হতে যাচ্ছিল সে দেখলো তার পায়ের ঠিক নিচে কিছু পিঁপড়া। সে বলল হে আমার প্রিয় বন্ধুরা তোমরা ভয় পেয় না, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করব না। এই দৃশ্য দেখে নারদ মুনি বললেন তুমি সত্যই বলিহারি শিকারী, তুমিই প্রকৃত ভক্ত। এটিই কাম্য যে, কোন কৃষ্ণ ভক্ত কোন ভাবেই জীবকে কষ্ট দিতে চায় না, এমনকি একটি পিঁপড়াকেও না। শিকারী নারদ মুনির চরণে দন্ডবৎ হয়ে বললেন, “গুরুদেব আমার পিঁপড়া ব্যাথা পেত তাই কৃপা পূর্বক সেই পিঁপড়াগুলোকে সরে যেতে দিন।”
নারদ মুনি - সকল কিছু কি ঠিক মত চলছে?
শিষ্য - হ্যাঁ গুরুদেব। দেখুন তুলসী মহারাণী কিভবে বর্ধিত হচ্ছে।
মহামুনি নারদ আপনি দয়া করে আমাদের সাথে প্রসাদ গ্রহণ করুন।
পর্বত মুনি - আমি দেখছি যে তুমি এখানে ভাল আছো এবং তোমার ভক্তি জীবন খুব ভালোভাবে চলছে এবং তোমার এমন হৃদ্যতায় আমি খুব খুশি হয়েছি।
শিষ্য - মহতী আপনি জানেন যে আমরা মহানাম থেকে সকল সময়ই কৃপা পেয়ে থাকি আর এই মহামন্ত্র নারদ মুনিই আমাকে দান করেছেন। আপনি জানেন যে এই মহামন্ত্র খুবই সুমধুর আর তাই আমরা সকল সময়ই এই মহামন্ত্র জপ করতে থাকি।
---- পূর্বের শিকারী এবং তার স্ত্রী হরিনামের উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে পড়ল। তারা তাদের এই অনুভূতিকে কৃষ্ণনামের মাধ্যমে উপভোগ করতে লাগল।
নারদ মুনি - সকল প্রশংসাই সমস্ত গৌরভক্তবৃন্দের। সকল প্রশংসাই ভগবান রাধাকৃষ্ণের।
পর্বত মুনি - নারদ মুনি সত্যিই তুমি একটি পরশ পাথর। তোমার স্পর্শেই আজ এই ঘৃণ্য শিকারী মানব জীবনের পরম প্রাপ্তি কৃষ্ণ প্রেম লাভ করেছে।
নারদ মুনি - তুমি কি ঠিক মত প্রসাদ পাচ্ছ প্রিয় শিষ্য?
শিষ্য - হ্যাঁ, গুরুদেব, আমি প্রত্যহ বিশজন ভক্তকে নিয়ে একত্রে প্রসাদ পাচ্ছি।
পর্বত মুনি - ঠিক আছে, এখন তুমি এবং তোমার স্ত্রী ভালভাবে কৃষ্ণ ভক্তি যাজন করো, কৃষ্ণ তোমাদের মঙ্গল এবং সুখী করুন।
শিকারী - মহৎ সাধুরা সকল সময় কৃষ্ণের কথাই বলেন। যিনি পরম ঈশ্বর ভগবান এবং দেবদেবীরাও তাঁকে জানেন, যিনি সমস্ত কিছুর পরম নিয়ন্তা। কিন্তু আমি এতই অধম যে, আমি কৃষ্ণকে জানতেও পারলাম না, ,আমি শুধুমাত্র আমার আধ্যাত্মিক গুরুর সেবা পূজা করতে পারি, যিনি আমাকে তাঁর পরম কৃপায় এই অজ্ঞতার অন্ধকারকে দূর করে, আমাকে দিব্য চক্ষুদান করেছেন।
কীর্তন - ভগবানের পবিত্র নামের গুণে শিকারীর বাড়ির আঙ্গিনা মধুর পরিবেশের সৃষ্টি, ঠিক যেন শুষ্ক মরুভূমিতে বসন্তের এক পশলা বৃষ্টি। সবাই 'হরিবোল হরিবোল' বলে চিৎকার করে উঠল।
.
.
নারদ পারেন এক দুর্বৃত্তকে সাধু বানাতে ................
.
পশ্চিম বাংলাকে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে পারবেন কি?

 লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে হিন্দুশাস্ত্র কী বলে? এ বিষয়ে হিন্দু বিজ্ঞানীদের কোন অবদান আছে কি?

আধুনিক বিশ্বে সকলের ধারণা মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ শক্তি নিউটন প্রথম আবিষ্কার করেছেন। অনেকেই জানেন না যে, এ বিষয়ে হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদে স্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
-
'সবিতা যন্ত্রৈঃ পৃথিবী মরভণাদস্কম্ভনে সবিতা দ্যামদৃংহৎ।
অশ্বমিবাধুক্ষদ্ধু নিমন্তরিক্ষমতূর্তে বদ্ধং সবিতা সমুদ্রম ॥' ------ ঋগ্বেদ, ১০/১৪৯/১
অনুবাদ ----- সূর্য রজ্জুবৎ আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। নিরাধার আকাশে দ্যুলোকের অন্যান্য গ্রহকেও ইহা সুদৃঢ় রাখিয়াছে। অচ্ছেদ্য আকর্ষণ রর্জ্জুতে আবদ্ধ, গর্জনশীল গ্রহসমূহ নিরাধার আকাশে অশ্বের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতেছে।


দেখুন, আকাশ যে ‘নিরাধার’ এবং ‘রজ্জুবৎ আকর্ষণ’ অর্থাৎ মহাকর্ষ শক্তির দ্বারাই যে সেই নিরাধার আকাশে সূর্য ও গ্রহসমূহ নিজ অক্ষরেখায় সুদৃঢ় রয়েছে -এখানে সেকথা বলা হয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক ধর্মগ্রন্থে আকাশকে স্পষ্টভাবে ‘পৃথিবীর ছাদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ এই সব ধর্মমতের জন্মেরও হাজার বছর পূর্বে বেদে আর্য ঋষিগণ আকাশকে ‘নিরাধার’ অর্থাৎ পৃথিবীকে ও গ্রহসমূহকে শূন্যে ভাসমান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আরও লক্ষণীয়, মহাকর্ষ শক্তিতে আবদ্ধ গ্রহসমূহ যে নিরাধারে অর্থাৎ মহাশূন্যে স্থির নয়, বরং পরিভ্রমণ করছে নিজ কক্ষপথে -এই তত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেন বৈদিক ঋষিগণ। এমনকি সূর্য নিজেও যে তার নিজস্ব কক্ষপথে চলছে সেই অত্যাশ্চর্য গূঢ় বিজ্ঞানও আলোচিত হয়েছে নিম্নের মন্ত্রে :
-
'আকৃষ্ণেন রজসা বর্তমানো নিবেশয়ন্নমৃতং মর্তঞ্চ।
হিরণ্ময়েন সবিতা রথেনা দেবো যাতি ভুবনানি পশ্যন্ ॥' ------- ঋগ্বেদ, ১/৩৫/২
অনুবাদ ---- সূর্য আকর্ষণযুক্ত পৃথিব্যাদি লোক-লোকান্তরকে সঙ্গে রাখিয়া নশ্বর-অবিনশ্বর উভয় পদার্থকে নিজ নিজ কার্যে নিযুক্ত রাখিয়া এবং মাধ্যাকর্ষণ রূপে রথে চড়িয়া যেন সারা লোকান্তর দেখিতে দেখিতে গমন করিতেছে।
-
খুব অবাক হতে হয়, পৃথিবী যেমন চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে, তদ্রুপ সূর্যও যে তার গ্রহ-উপগ্রহসমূহকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কক্ষপথে গমন করছে -এই গভীর জ্ঞানও পবিত্র বেদ-এ আলোচিত হয়েছে।
-
মহাবিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (১১৫০ খ্রি:) তাঁর ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ নামক জ্যোতিঃশাস্ত্রের গোলাধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন-
-
“আকৃষ্টি শক্তিশ্চ মহী তয়া যৎ স্বস্থং স্বাভিমুখী করোতি।
আকৃষ্যতে তৎ পততীব ভাতি সমে সমন্তাৎ কুবিয়ং প্রতীতিঃ॥”
অর্থাৎ, “সর্ব পদার্থের মধ্যে এক আকর্ষণ শক্তি বিদ্যমান রহিয়াছে, যে শক্তি দ্বারা পৃথিবী আকাশস্থ পদার্থকে নিজের দিকে লইয়া আসে। যাহাকে ইহা আকর্ষণ করে তাহা পতিত হইল বলিয়া মনে হয়।”
-
অর্থাৎ, প্রাচীন ঋগ্বেদ শাস্ত্রের পাশাপাশি ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করলেও হিন্দু বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫) বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) জন্মেরও কমপক্ষে পাঁচশত বছর পূর্বে মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করে তাঁর গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’তে আলোচনা করে গিয়েছেন।
-
কিন্তু আজ নতুন প্রযুক্তির বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে ইংরাজী উচ্চারণে সংষ্কৃত ভাষা ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে Back Dated বলতে দ্বিধা করি না....... সত্য সেলুকাস ................ !



লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

শিবের সোমবারের ব্রত পালন বিধি


শিবের সোমবারের ব্রতপালনের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেই নিয়মগুলি কী, সেটা জানার আগে সাধারণ শিবলিঙ্গ এবং বাণলিঙ্গর তফাত জেনে রাখা উচিত। কেন না, সাধারণ শিবলিঙ্গ আর বাণলিঙ্গর পূজার মন্ত্র আলাদা।
নর্মদা নদীর জলে যে শিবলিঙ্গ পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় বাণলিঙ্গ। এই বাণলিঙ্গ শিবের স্বয়ম্ভু রূপ; নারায়ণ শিলার মতো। তাই যাঁদের বাড়িতে বাণলিঙ্গ আছে, তাঁরা আলাদা মন্ত্র অনুসরণ করবেন।
সোমবার সূর্যোদয়ের তিন ঘণ্টার মধ্যেই শিবপূজা সেরে নেওয়া নিয়ম। খুব দেরি হলে অপেক্ষা করা যেতে পারে বেলা বারোটা পর্যন্ত। তার পরে, সোমবারের শিবপূজা করা যায় না।
সোমবার শিবপূজার জন্য হাতের কাছে গুছিয়ে নিন পূজার উপচার। ধূপ ও প্রদীপ জ্বেলে নিন।

এবার হাত জোড় করে বলুন ---

ওঁ সর্বমঙ্গলমাঙ্গল্যং বরেণ্যং বরদং শুভম্।
নারায়ণং নমস্কৃত্য সর্বকর্মাণি কারয়েৎ।।

আচমন --- ডান হাতের তালু গোকর্ণাকৃতি করে মাষকলাই ডুবতে পারে এই পরিমাণ জল নিয়ে ‘ওঁ বিষ্ণু' মন্ত্রটি পাঠ করে পান করুন। এইভাবে মোট তিন বার জলপান করে আচমন করার পর হাত জোড় করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন ---
ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্।
ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।।

জলশুদ্ধি --- তাম্রপাত্রে বা কোশায় গঙ্গাজল বা পরিষ্কার জল নিয়ে মধ্যমা দ্বারা সেই জল স্পর্শ করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন ---
ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি।
নর্মদে সিন্ধু-কাবেরি জলেঽস্মিন সন্নিধিং কুরু।।
সূর্যমণ্ডল থেকে সকল তীর্থ সেই পার্শ্বস্থ জলে এসে উপস্থিত হয়েছেন এই চিন্তা করতে করতে সেই জলে একটি ফুল দিয়ে তীর্থপূজা করুন।
তীর্থপূজার মন্ত্রটি হল ----
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে তীর্থেভ্যো নমঃ।
এরপর এই জল সামান্য কুশীতে নিয়ে পূজাদ্রব্যের উপর ও নিজের মাথায় ছিটিয়ে দিন।

আসনশুদ্ধি --- যে আসনে বসেছেন, সেই আসনটিতে একটি ফুল দিয়ে হাত জোড় করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন ----
ওঁ পৃথ্বি ত্বয়া ধৃতা লোকা দেবি ত্বং বিষ্ণুনা ধৃতা।
ত্বঞ্চ ধারায় মাং নিত্যং পবিত্রং কুরু চাসনম্।।

পুষ্পশুদ্ধি --
পুষ্প স্পর্শ করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন—
ওঁ পুষ্পে পুষ্পে মহাপুষ্পে সুপুষ্পে পুষ্পসম্ভবে। পুষ্পাচয়াবকীর্ণে চ হুঁ ফট্ স্বাহা।

ভূতশুদ্ধি ----
হাত জোড় করে মনে মনে এই চারটি মন্ত্র পাঠ করুন ---
ওঁ ভূতশৃঙ্গাটাচ্ছিরঃ সুষুম্নাপথেন জীবশিবং পরমশিবপদে যোজয়ামি স্বাহা ।।
ওঁ যং লিঙ্গশরীরং শোষয় শোষয় স্বাহা ।।
ওঁ রং সংকোচশরীরং দহ দহ স্বাহা ।।
ওঁ পরমশিব সুষুম্নাপথেন মূলশৃঙ্গাটমুল্লসোল্লস জ্বল জ্বল প্রজ্জ্বল প্রজ্জ্বল সোঽহং হংসঃ স্বাহা ।।

প্রাণায়াম ---
‘ওঁ' বা গুরুপ্রদত্ত বীজমন্ত্রে (বাণেশ্বর শিবের ক্ষেত্রে ‘ঐঁ' মন্ত্রে) চার বার ৪/১৬/৮ ক্রমে পূরক, কুম্ভক ও রেচক করে প্রাণায়ম করুন।

শ্রীগুর্বাদিপূজা ---
এরপর একটি একটি করে গন্ধপুষ্পদ্বারা শ্রীগুরু ও অন্যান্য দেবতাদের পূজা করুন। মন্ত্রগুলি হল -----
ঐঁ এতে গন্ধপুষ্পে শ্রীগুরবে নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে গণেশাদিপঞ্চদেবতাভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে আদিত্যাদিনবগ্রহেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ইন্দ্রাদিদশদিকপালেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে কাল্যাদিদশমহাবিদ্যাভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে মৎস্যাদিদশাবতারেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে মৎস্যাদিদশাবতারেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে সর্বেভ্যো দেবেভ্যো নমঃ।
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে সর্বাভ্যো দেবীভ্যো নমঃ।

ধ্যান ----
এরপর একটি ফুল নিয়ে (সম্ভব হলে কূর্মমুদ্রায় ফুলটি নেবেন) শিবের ধ্যান করবেন। শিবের সাধারণ ধ্যানমন্ত্র ও বাণেশ্বর ধ্যানমন্ত্র দুটি নিচে দেওয়া হল ----
সাধারণ ধ্যানমন্ত্র ----
ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং
রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।
পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং
বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।

বাণেশ্বর শিবের ধ্যান ---
ঐঁ প্রমত্তং শক্তিসংযুক্তং বাণাখ্যঞ্চ মহাপ্রভাং।
কামবাণান্বিতং দেবং সংসারদহনক্ষমম্।।
শৃঙ্গারাদি-রসোল্লাসং বাণাখ্যং পরমেশ্বরম্।
এবং ধ্যাত্বা বাণলিঙ্গং যজেত্তং পরমং শিবম্।।

স্নান ----
এরপর শিবকে স্নান করাবেন। গঙ্গাজলে শুদ্ধজলে চন্দন মিশ্রিত করে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে শিবকে স্নান করাবেন এই মন্ত্রে শিবকে স্নান করাবেন -----
ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।
ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।
সাধারণ শিবলিঙ্গ ও বাণেশ্বর -- উভয়ক্ষেত্রেই স্নান মন্ত্র এক।

প্রধান পূজা --
স্নানের পর আরেকবার আগের ধ্যানমন্ত্রটি পাঠ করে শিবের ধ্যান করবেন। তারপর মনে মনে উপচারগুলি শিবকে উৎসর্গ করে মানসপূজা করবেন। মানসপূজার পর একে একে উপচারগুলি বাহ্যিকভাবে শিবকে সমর্পণ করবেন।
ওঁ নমঃ শিবায় এতৎ পাদ্যং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় এষঃ অর্ঘ্যঃ শিবায় নমঃ। (আতপচাল ও দূর্বা একটি সচন্দন বেলপাতায় করে ফুল সহ দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদমাচমনীয়ং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং স্নানীয়ং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় এষ গন্ধঃ শিবায় নমঃ। (চন্দনের ফোঁটা দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং সচন্দনপুষ্পং শিবায় নমঃ। (একটি চন্দনমাখানো ফুল দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং সচন্দনবিল্বপত্রং শিবায় নমঃ। (একটি চন্দনমাখানো বেলপাতা দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় এষ ধূপঃ শিবায় নমঃ। (ধূপটি শিবের সামনে তিনবার ঘুরিয়ে দেবতার বাঁ দিকে, অর্থাৎ নিজের ডানদিকে রাখুন)
ওঁ নমঃ শিবায় এষ দীপঃ শিবায় নমঃ। (প্রদীপটি শিবের সামনে তিনবার ঘুরিয়ে দেবতার ডানদিকে, অর্থাৎ নিজের বাঁ দিকে রাখুন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং সোপকরণনৈবেদ্যং শিবায় নিবেদয়ামি। (নৈবেদ্যের উপর অল্প সামান্যার্ঘ্য জল ছিটিয়ে দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং পানার্থোদকং শিবায় নমঃ। (পানীয় জলের উপর অল্প সামান্যার্ঘ্য জল ছিটিয়ে দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং পুনরাচমনীয়ং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং তাম্বুলং শিবায় নমঃ। (একটি পান দিন, অভাবে সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন।)
ওঁ নমঃ শিবায় ইদং মাল্যং শিবায় নমঃ। (মালা থাকলে মালাটি পরিয়ে দিন)
বাণেশ্বর শিবলিঙ্গে দশোপচার পূজার মন্ত্র ---
ঐঁ এতৎ পাদ্যং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ এষঃ অর্ঘ্যঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদমাচমনীয়ং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদং স্নানীয়ং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ এষ গন্ধঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদং সচন্দনপুষ্পং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদং সচন্দনবিল্বপত্রং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ এষ ধূপঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ এষ দীপঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদং সোপকরণনৈবেদ্যং বাণেশ্বরশিবায় নিবেদয়ামি।
ঐঁ ইদং পানার্থোদকং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদং পুনরাচমনীয়ং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদং তাম্বুলং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।
ঐঁ ইদং মাল্যং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

পুষ্পাঞ্জলি ---
সচন্দন পুষ্প ও বেলপাতা নিয়ে এই মন্ত্রে এক, তিন অথবা পাঁচ বার অঞ্জলি দেবেন ---

সাধারণ পুষ্পাঞ্জলি ----
ওঁ নমো শিবায় এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি নমো শিবায় নমঃ।

বাণেশ্বর শিবের পুষ্পাঞ্জলি ---
ঐঁ এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

গৌরীপূজা ---
এইভাবে শিবপূজা শেষ করে শিবলিঙ্গের গৌরীপীঠে একটি ফুল দিয়ে এই মন্ত্রে গৌরীর পূজা করুন ---
ওঁ হ্রীঁ এতে গন্ধপুষ্পে গৌর্যৈ নমঃ।

অষ্টমূর্তি পূজা --
বাণেশ্বর শিবে অষ্টমূর্তির পূজা করতে হয় না। কিন্তু অন্যান্য শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে করতে হয়। একটি ফুল দিয়ে এই মন্ত্রে অষ্টমূর্তির পূজা করুন --
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে অষ্টমূর্তিভ্যো নমঃ।

জপ ও জপসমর্পণ ---
এরপর ‘ওঁ নমঃ শিবায়' বা দীক্ষামন্ত্র ১০৮ বার জপ করে এই মন্ত্রে এক গণ্ডুষ জল শিবের নিচের দিকের ডান হাতের উদ্দেশ্যে প্রদান করুন --
ওঁ গুহ্যাতিগুহ্যগোপ্তা ত্বং গৃহাণাস্মৎকৃতং জপম্।
সিদ্ধির্ভবতু মে দেব ত্বৎপ্রসাদান্মহেশ্বর।।

প্রণাম --
এইবার এই মন্ত্রটি পড়ে সাষ্টাঙ্গে শিবকে প্রণাম করে পূজা সমাপ্ত করুন --
সাধারণ শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে --
ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে।
নিবেদয়ামি চাত্মানং গতিস্তং পরমেশ্বরম্।।
বাণেশ্বর শিবের ক্ষেত্রে --
ওঁ বাণেশ্বরং নরকার্ণবতারণায় জ্ঞানপ্রদায় করুণাময়সাগরায়।
কর্পূরকুন্দধবলেন্দুজটাধরায় দারিদ্র্যদুঃখদহনায় নমঃ শিবায়।।

 লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

আদ্যাপীঠ


দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অদূরেই আদ্যাপীঠে হিন্দু-তীর্থ আদ্যমায়ের মন্দির। শ্রী অন্নদা ঠাকুর মানুষকে প্রেম ও আদর্শে দীক্ষিত করতে স্বপ্নে দেখা এই মন্দিরটি গড়েন ১৯২১ সালে। তিন চূড়োওয়ালা তিন ধাপে গড়া মন্দির। প্রথম ধাপে উপবিষ্ট শ্রী রামকৃষ্ণ, দ্বিতীয় ধাপে ইডেন গার্ডেনের ঝিলে পাওয়া আদ্যামায়ের আদলে পদ্মাসনে শায়িত শিবের বুকে অষ্টধাতুর দেবীমূর্তি। আর তৃতীয় ধাপে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। সারা দিনে সকাল ও সন্ধায় মাত্র কিছু সময়ের জন্যই মূল মন্দিরটি খোলা থাকে। মন্দিরে প্রতিদিন দুপুরে ভক্তদের জন্য মেলে অন্নপ্রসাদ।
'পাতানো মা নয়, জন্বজন্বান্তরের মা এ বুঝেছি।' যে মার কোলে স্থান পেয়েছে অনাথ ছেলেরা, অনাথ মেয়েরা, স্বামী পুত্রহীনা বিধবা মায়েরা, বানপ্রস্থ আশ্রমের বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা, সাধক ও সাধিকাদের জন্যও গড়ে উঠেছে পৃথক পৃথক আবাসস্থান, আবার দেশবাসীর জন্য দাতব্য চিকিৎসালায়, ভ্রাম্যমান চিকিৎসালয়, এক্সরে ক্লিনিক, ই.সি.জি ক্লিনিক, দন্ড ও চক্ষু বিভাগসহ, দৈনিক বিনামূল্যে তিন চারশো নরনারায়ণ সেবা, ভাবতে অবাক লাগে কী নেই এই আদ্যাপীঠে। সকলের অবারিত দ্বার। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোক এ মাকে ডেকে কত দুরারোগ্যব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ করছে। এইসব কার সাধনা। কোন মহামানবের প্রাণে এসব আর্ত মানুষের ক্রন্দর ধ্বনিত হয়েছিল? এ মানবদরদী মহামানব হলেন আমাদের চট্টগ্রামের বীর সন্তান দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ অন্নদার ঠাকুর। তাঁকে একদিন রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন চলো আমার সঙ্গে তা হলে তোমার সকল দুঃখের অবসান হবে। কিন্তু এই সময় হাজার হাজার নরনারীর কাতন আবেদন ছিল ঠাকুর তুমি একা রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে যেও না, আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও। আমরা সংসারতাপে তাপিত। পৃথিবীর মানুষের কাতর আবেদন ঠাকুরকে আর নিজের মুক্তির কথা চিন্তা করতে দিলনা। আর্ত মানুষেল জন্য এই মানবদরদী মহাপুরুষ গড়ে তুললেন এই আদ্যাপীঠ কেন্দ্র। কী মাতৃসাধক! যাঁর সাধনায় তৃপ্ত হযে জগৎজননী তাঁর সন্তানদের পূজার বিধান দিয়েছিলেন খাওয়ার সময় শুধু বলবে মা তুমি খাও আর কাপড় চোপড় পরার সময় বলবে মা তুমি পর। কী সহজ সরল পূজার বিধি। মা জানতেন সংসারে আত্বীয় পরিজন সকলের সেবা করার পর তাঁর সন্তানদের সময় কোথায়। তাই করুণাময়ার এই রকম সহজ সরল পূজার বিধান। মা শুধু বলেছিলেন যদি কেউ আমার সামনে আদ্যাস্তব পাঠ করে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হই। এ মাতৃকৃপা যে মহামানবের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি উনি ছিলেন সমন্বয়ের প্রতীক। মন্দির দেখলেই বোঝা যায় একই মন্দিরে গুরু কালী ও হরি। এমনি সংঘগুরু অন্নদাঠাকুর নিজের হাতে বসিয়েছিলেন। হিন্দুদের ত্রিশূল, মুসলমানদের চাঁদ, খ্রীষ্টানদের ক্রশ ও বৌদ্ধদের হাতপাখা। সারা বিশ্ব আজ আদ্যাপীঠ ও অন্নদাদাকুরকে নিয়ে মুখর। শুধু কি তাই তিনি বিশ্বের সকলকে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্য ও কর্মীদের নামের শেষে ভাই কথাটা ব্যবহার করতেন। তাই আসুন সমস্ত দ্বন্দ্ব ভেদাভেদ ভুলে অন্নদা ঠাকুরের সমন্বয়ের পতাকা তলে একত্রিত হই। একত্রিত হয়ে সাম্যের জয়গান করি।

 লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

বিবাহ কত প্রকার ও কি কি


হিন্দু ধর্ম্ম গ্রন্থ হমে বাৎস্যায়ন আট প্রকার বিয়ে কথা উল্লেখ করেছেন-
১। ব্রাহ্ম বিয়ে।
২। প্রজাপত্য বিয়ে।
৩। আর্য্য বিয়ে।
৪। দৈব বিয়ে।
৫। অসুর বিয়ে বা আসুরিক বিয়ে।
৬। গন্ধর্ব বিয়ে।
৭। পিশাচ বা পৈশাচিক বিয়ে।
৮। রাক্ষক বিয়ে।
-
যে আট রকম বিয়ের কথা বলা হলো তার মধ্যে প্রথম চার রকম-ব্রাহ্ম, প্রজাপত্য, আর্য্য ও দৈব বিয়ে থাকে বিভিন্ন মন্ত্র ক্রমে।
বর্তমানে প্রজাপত্য বিয়ের চলনই বেশি। এই সব প্রথায় বিয়ে করতে বর ও কনের কোনও প্রকার চেষ্টা করতে হয় না। পিতামাতা বা আত্নীয় স্বজনই এই ধরনের বিয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। কেবল বিভিন্ন মন্ত্র অনুযায়ী বা পদ্ধতি অনুযায়ী বিভিন্ন নামকরণ।
এ ছাড়া যে সব বিয়ে আছে, সেগুলির জন্য বর এবং কন্যার নিজের ব্যবস্থা করা দরকার। এ গুলিতে পিতামাতা বা আত্নীয় স্বজনের কোন দায়িত্ব নেই। যেমন ধারা গান্ধর্ব বিয়ে। এ বিয়ে বর এবং কনে পরস্পরকে ভালবেসে নিজে থেকে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেনি এবং নিজেও কোনও পুরুষকে আকর্ষণ করতে পারেনি, তা হলে তাদের বিয়ে হবে আসুরিক মতে। যদি পিতামাতাকে টাকা বা বেশ উপহার দিয়েও ঐ নারীকে বিয়ে করতে স্বীকৃত না করা যায়, তাহলে তা হয় পৈশাচিক বা রাক্ষস বিবাহ।

গান্ধর্ব বিবাহ -- গান্ধর্ব ইত্যাদি বিয়ের প্রথম দরকার নারীকে আকর্ষণ করা। তা করতে হলে একটি সুনিপুণা ঘটকী আবশ্যক।
যদি কোনও প্রেমিক তার মনের মত নির্বাচিত নারীকে পেতে অসমর্থ হয়-তা হলে তার দরকার-ঐ নারীর ধাত্রী কন্যার সঙ্গে বন্দোবস্ত করা। ধাত্রী কন্যাকে পাঠানো যেতে পারে ঐ নারীর কাছে। নারীর কাছে গিয়ে ধাত্রী কন্যা পাণি প্রার্থী যুবকের গুণ, বিদ্যা, সম্পত্তি, বিষয় ইত্যাদি নিয়ে নানান প্রশংসা করা। এইসব কাজের জন্যে নিপুণা ও কৌশলময়ী একজন বিশ্বস্ত ধাত্রী কন্যা দরকার। তরুণীর বাড়ীর কোন বিশ্বাসী ও ধাত্রী কন্যা ভাল হয় ও আবশ্যক। অবশ্য ধাত্রী কন্যা তরুণীর সমবয়সী হওয়া প্রয়োজন। তার বেশ প্রভাব থাকা উচিত। সে তরুণীকে বেশ নিভৃতে নিয়ে গিয়ে পূর্বে যেসব সম্বন্ধ তার জন্য এসেছে-বা যে বরের সঙ্গে পিতামাতার মত আছে বিয়ে দিতে, সেগুলির একে একে নিন্দা করবে। যেমন, অমুকর ছেলে? আর রাম-লোকটা মদ খায়, আমি নিজে চোখে দেখেছি, বা নিজে কানে শুনেছি। আর তার বাপ এককালে ধনী ছিল এখন তার সর্বস্ব বিক্রি হয়ে গেছে এবারের তাকে ত পথে বসতে হবে। অন্য মেয়ের সঙ্গে তার ভালবাসা আছে। এই সব বলে তরুণীর মনে বীতরাগ জন্মে দেবে। তারপরে বলবে-আমি যে ছোকরার কথা বলছি, তার বাপের অনেক ভূসম্পত্তি আছে। অনেক বিদ্যা, অনেক গুণ, বহু টাকা রোজাগার করে। ভবিষ্যতে ঠিক রাজরাণী হয়ে থাকবে। এই সব কথা বলে তরুণটির নানা গুণ ব্যাখ্যা করবে। তারপর দু’জনে নিভৃতে দেখা হবে, প্রেমলিপি বা প্রেমের কথা হবে। দু’জনের সঙ্গ গভীর প্রেম ও মিলন হবে ভালো। শেষে গোপনে কোন ব্রাহ্মণ ডেকে এনে হোম করবে-বিয়ে হবে অগ্নিদেবকে সাক্ষী করে পরে অবশ্য আত্নীয়দের বলা চলে। এই হলো গান্ধর্ব বিয়ে।

পৈশাচিক বিয়ে --- যদি কোন তরুণ-তরুণীর মধ্যে গান্ধর্ব বিয়ে করার উপায় না থাকে, তাহলে আর এক উপায় চলতে পারে। এ প্রথা বাৎস্যায়নের যুগে ছিল। দু’জনে আগে প্রেম করবে, তারপর সুযোগ বুঝে গোপনে নারীকে কোন মাদকদ্রব্য খাইয়ে অধজ্ঞানহীন ও উত্তেজিত করে যৌন মিলন করবে। তারপর পুরোহিত ডেকে সেই নারীকে বিয়ে করবে। নারী রাজী হলে- কারণ সে জানবে তার অন্য গতি নাই।

রাক্ষস বিয়ে --- যদি কোনও রুপসী নারীকে লাভ করা দুস্কর হয়ে পড়ে, তখন তাকে কোনও বাগান বা পথ থেকে লোকজনের সাহায্যে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে পরে ব্রাহ্মণ ডেকে হোম করে বিয়ে করার নাম রাক্ষস বিয়ে। পুরাকালে ক্ষত্রিয় রাজারা এইভাবে বাহুবলে বহু নারীকে ধরে এনে বিয়ে করত। বর্তমানে এর চলন প্রায় নাই।

আসুরিক বিয়ে ---- যদি কোন লোক রুপসী তরুণীর কোন আত্মীয় বা আত্মীয়কে অর্থের সাহায্যে ভুলিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে হাত করে তাকে এনে বিয়ে করে -- উক্ত লোকটির সাহায্যে --- একে বলা হয় আসুরিক বিয়ে। আসুরিক বিয়ে আজকাল মাঝে মাঝে হয়, তবে লোকে তা বুঝতে বা জানতে পারে না। তাবে কন্যার বা আত্মীয়ের অমতে এ সব করা উচিত নয়।

 লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ১ )



ভয়হর মঙ্গল দশরথ রাম ।
জয় জয় মঙ্গল সীতা রাম ।।
মঙ্গলকর জয় মঙ্গল রাম ।
সঙ্গতশুভবিভবোদয় রাম ।।
আনন্দামৃতবর্ষক রাম ।
আশ্রিতবৎসল জয় জয় রাম ।।
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম ।
পতিতপাবন সীতা রাম ।।

চিত্রকূট পর্বতে রাম, লক্ষণ, সীতা দেবী আনন্দে দিন যাপন করছিলেন । চারপাশে বনের প্রাকৃতিক শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভগবান রামচন্দ্র ও সীতাদেবী। কিছুকাল পড়ে দেখলেন সেখান থেকে মুনি, ঋষি আর বনবাসী সকল পলায়ন করছে। সকলের মুখমণ্ডল আতঙ্কগ্রস্ত । কোন একটা ভয় তাদের তাড়া করছে। আশ্রম গুলি অধিকাংশই পরিত্যক্ত । বাকী আশ্রম গুলি ছেড়ে তপস্যা ছেড়ে মুনি, সন্ত গণ পলায়ন করছিলেন । আশ্রম গুলি জরাজীর্ণ হল। যজ্ঞবেদী নানা বুনো ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেলো। তুলসী মঞ্চে আর তুলসী দেবী শোভা পেলেন না। বুনো লতাপাতায় আচ্ছাদিত হল তুলসী মঞ্চ । একদিন ভগবান রাম, লক্ষণ সেই পলায়ন রত মুনি ঋষি বনবাসীদের জিজ্ঞাসা করলেন- “আপনারা এই সুন্দর রম্য অরণ্য কেন পরিত্যাগ করছেন ? কেনই বা আপনারা ভয়গ্রস্ত হয়েছেন? কি উদ্দেশ্যে আপনারা এই জঙ্গল ছেড়ে প্রস্থান করছেন?” ভগবান রাম অত্যন্ত বিনয় সহকারে মুনি ঋষি দিগকে প্রনাম জানিয়ে বললেন- “হে মহাত্মাজন ! আপনারা বেদান্তিক শাস্ত্রজ্ঞ। আপনাদের ধর্ম সমগ্র জাতিকে আধ্যাত্মিক দিব্য জ্ঞান প্রদান করা। বিধাতা এই কারনেই আপনা দিগকে শাস্ত্রীয় জ্ঞান প্রদান করেছেন। তথাপি আপনারা সকলে আশ্রম ছেড়ে কেনই বা পলায়ন করছেন? কে আপনাদের ভয় প্রদর্শন করলো ?” মুনি গণ বললেন- “আমরা শঙ্কিত । রাক্ষস দিগের মাত্রছাড়া তাণ্ডবে আমাদের ধর্মাচরণ লুপ্ত হতে বসেছে। দুরাচারী রাক্ষসেরা ধর্ম, পুণ্য স্বীকার করে না। যথেচ্ছ ভাবে তাণ্ডব করে বেড়ায়। আমাদের, কে রক্ষা করবে? তাই আমরা এই স্থান হতে প্রস্থান করতে বাধ্য হচ্ছি। এই রাক্ষসেরা আমাদের বিতারন করছে। রাবণের ভ্রাতা খড়, দূষণ এর রাজত্ব চলে এই স্থানে। উহাদের আদেশে রাক্ষসেরা সকল অন্যায় করে বেড়ায়।”

লক্ষণ বলল- “হে মুনিগণ ! আমার অগ্রজ দাশরথি শ্রীরামচন্দ্র পূর্বে রাক্ষস দলন করে তাড়কা, সুবাহু বধ করেছেন। মারীচকে বিতারিত করেছেন । আমরা তিন কোটি রাক্ষস নিধন করে ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের তপোবন রাক্ষসশূণ্য করেছি। আপনারা এভাবে পলায়ন করবেন না। কোথায় সেই খড় আর দূষণ ? আমরা তাহাদিগকে সংহার করে আপনাদের বিপদমুক্ত করবো।” মুনিগণ বললেন- “হে রামচন্দ্র! গোদাবোরী তীরে পঞ্চবটিতে বিরাধ নামক এক রাক্ষস বাস করে। অতীব শক্তিশালী সেই রাক্ষস পঞ্চবটিতে সকল ধর্মাচরণ স্তব্ধ করেছে। নরমাংসভোজী সেই রাক্ষস পূর্বে বহু মুনি, ঋষি ও বনবাসীদের হত্যা করে ভোজন করেছে। আপনি তাহাকে বধ করুন।” মুনি ঋষি বনবাসীরা চলে গেলে রামচন্দ্র লক্ষণ আর সীতাকে বললেন- “আমাদের এখান থেকে প্রস্থান করতে হবে। প্রথম উদ্দেশ্য সেই বিরাধ রাক্ষসের সংহার প্রয়োজন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ভরত এই স্থান জ্ঞাত হয়েছে। হয়তো তার মন পরিবর্তন হলে সে কোনদিন এসে আমাদের অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছা ব্যক্ত করবে। সুতরাং গোদাবোরী পঞ্চবটিতে আমাদিগের যাত্রা করা প্রয়োজন ।” ভগবান রাম অগ্রে, মধ্যে জানকী দেবী অন্তে লক্ষণ চললেন । তত্ত্ব কথাতে শ্রীরাম স্বয়ং পরমব্রহ্ম, সীতাদেবী আদ্যাশক্তির অংশা মহামায়া- মায়া, লক্ষণ জীবাত্মা। মায়া এখানে ব্রহ্মকে আড়াল করে রেখেছেন। তাই মহামায়ার অংশা সীতাদেবী ব্রহ্ম ও জীবাত্মার মধ্যে অধিষ্ঠিত । যাই হোক- ভগবান রাম, লক্ষণ ও সীতাদেবী বনের গভীরে প্রবেশ করলেন। বিবিধ পুস্প বিকশিত হয়েছে। চতুর্দিকে পাখীর কলরব আর মিষ্ট মধুর গন্ধ। ঝর্ণাধারা থেকে অবিরত শীতল জল সশব্দে নদীতে ঝড়ে পড়ছে। শ্রীরামচন্দ্র তথায় বিশ্রাম নিলেন । লক্ষণ ফলমূল সংগ্রহ করতে গেলেন। সীতাদেবী ঝর্ণার জলে নিজ কেশ রাশি সিক্ত করে তা দিয়ে ভগবান রামের চরণ ধৌত করে দিলেন । বিবিধ পুস্প সংগ্রহ করে রামচন্দ্রের চরণে অঞ্জলি দিলেন ।

অতঃ লক্ষণ ফলমূল নিয়ে আসলে তিন জনে সেবা নিলেন। নদীর শীতল জল পান করে পদ্মের মৃনালের সুধা পান করলেন। হরিতকী আমলকী ফল মুখশুদ্ধি রূপে গ্রহণ করে পুনঃ আগে অগ্রসর হলেন । অত্রি মুনির আশ্রম নিকটে। অত্রি মুনির পত্নী অনুসূয়া দেবী ছিলেন মহাসতী । তিনি নিজে সতীত্ব বলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর কে শিশু বানিয়ে পুত্রভাবে লালন পালন করেছিলেন । পড়ে ত্রিদেব একত্রে অনুসুয়া দেবীর পুত্র রূপে ভগবান দত্তাত্রেয় রূপে ( ত্রিনাথ ) আবির্ভূত হয়েছিলেন । মুনির আশ্রমে গিয়ে রাম লক্ষণ ও সীতাদেবী উপস্থিত হলে মুনি পত্নীসহিত তিনজনকে স্বাগত জানালেন। রাম, লক্ষণ অত্রি মুনির সাথে ধর্ম কথা আলোচনা করছিলেন, অপরদিকে মাতা সীতাদেবী, মুনি পত্নী অনুসূয়া দেবীর সাথে আলোচনা করছিলেন । সীতাদেবীর অলৌকিক জন্মের কথা শুনে অনুসূয়া দেবী অবাক আর আশ্চর্য হলেন । সীতা দেবী প্রশ্ন করলেন- “হে দেবী! আদর্শ নারীর কর্তব্য কি?” অনুসূয়া দেবী বললেন- “হে জানকী! শ্রবন করো। পতির সেবা পত্নীর পরম ধর্ম । পতির চরণেই স্ত্রীর তীর্থ। যে নারী কদাপি পতির সেবা না করে সেই নারী নরকে গমন করে। পতি উপার্জনহীন , রোগগ্রস্ত, রুগ্ন হলেও পত্নীর কর্তব্য স্বামীকে পরমেশ্বর জ্ঞানে সেবা করা। যে নারী স্বামীকে ভুলে পরপুরুষের চিন্তা করে সেই মহাপাতকী নারী শত বৎসর রৌরব কুণ্ডে জ্বালা যন্ত্রনা ভোগ করে। অতএব সদা সর্বদা পতি ভিন্ন অপর পুরুষের চিন্তা বিসর্জন দেওয়াই আদর্শ সহধর্মিণীর কর্তব্য। সর্বদা পতির মঙ্গল কামনা করবে, পতি কে ভোজোন করিয়ে অন্তে নিজে ভোজন করবে। পতির সকল দায়িত্ব সমান ভাগে পতি পত্নীর উভয়ে পালন করা কর্তব্য। এই রূপে যে নারী পতির সেবা করেন- তিনি জগতে মহাসতী নামে খ্যাতা হন। তাঁর সতীত্ব তেজে ত্রিলোক থর থর কম্প হয়। তাকে দেবতারা নমস্কার করেন।” এই রূপে অনুসূয়া দেবী সীতাকে আধ্যাত্মিক বার্তা জ্ঞান প্রদান করলেন। অন্তিমে সীতাদেবীকে নানা সোনার অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিতা করলেন। সীতাদেবীর বারণ শুনলেন না। অনুসুয়া দেবী বললেন- “এয়োস্ত্রী নারী সর্বদা সাধ্যানুসারে অলঙ্কারাদি ধারন করে থাকবেন। নচেৎ সংসারের অমঙ্গল হয়।”

( ক্রমশঃ )
Share:

হিন্দুধর্মে অবতার

 হিন্দুধর্মে অবতার, আক্ষরিক অর্থে অবতরণকারী বলতে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে স্বেচ্ছায় মর্ত্যে অবতীর্ণ পরম সত্ত্বাকে বোঝায়। কেবলমাত্র পরম সত্ত্বা বা পরমেশ্বরের অবতারগুলিই ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এই সকল অবতার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও অতিলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন। অন্যান্য অবতারগুলি ঈশ্বরের গৌণ সত্ত্বার রূপ অথবা কোনো গৌণ দেবদেবীর অবতার। এই শব্দটি হিন্দুধর্মে মূলত বিষ্ণুর অবতারদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। হিন্দুধর্মের অন্যতম বৃহৎ শাখা বৈষ্ণবধর্মে এই সকল অবতারের পূজার বিধান রয়েছে। বৈষ্ণবরা বিষ্ণুর দশাবতারকে পরমেশ্বরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যরূপে কল্পনা করেন। পুরাণে শিব ও গণেশের অবতারের কথাও পাওয়া যায়। গণেশ পুরাণ ও মুদগল পুরাণ-এ গণেশের অবতারসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। তবে এই সকল অবতারের তুলনায় হিন্দুধর্মে বিষ্ণুর অবতারগণের গুরুত্ব অধিক।
বিষ্ণুর দশ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ অবতার দশাবতার নামে পরিচিত। দশাবতারের তালিকাটি পাওয়া যায় গরুড় পুরাণ গ্রন্থে। এই দশ অবতারই মানব সমাজে তাঁদের প্রভাবের ভিত্তিতে সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হন।
দশাবতারের প্রথম চার জন অবতীর্ণ হয়েছিলেন সত্যযুগে। পরবর্তী তিন অবতারের আবির্ভাব ত্রেতাযুগে। অষ্টম অবতার দ্বাপরযুগে এবং নবম অবতার কলিযুগে অবতীর্ণ হন। পুরাণ অনুসারে, দশম অবতার এখনো অবতীর্ণ হননি। তিনি ৪২৭,০০০ বছর পর কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন।

গরুড় পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুর দশ অবতার হলেন ----- -
১. মৎস্য, মাছের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
২. কূর্ম, কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৩. বরাহ, শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৪. নরসিংহ, অর্ধনরসিংহ রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৫. বামন, বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৬. পরশুরাম, পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৭. রাম, রামচন্দ্র, অযোধ্যার রাজপুত্রের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৮. কৃষ্ণ, দ্বাপরযুগে ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে অবতীর্ণ।
৯. বুদ্ধ, কলিযুগে অবতীর্ণ হন।
১০. কল্কি, সর্বশেষ অবতার। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কলিযুগের অন্তে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে।
--
ভাগবত পুরাণ মতে বিষ্ণুর অবতার
-----------------------------------
ভাগবত পুরাণ–এর প্রথম স্কন্দে সংখ্যাক্রম অনুসারে বিষ্ণুর যে বাইশ অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা নিম্নরূপ:
১. চতুর্সন [ভাগবত ১।৩।৬] (ব্রহ্মার চার পুত্র)
২. বরাহ [ভাগবত ১।৩।৭] (বন্য শূকর)
৩. নারদ [ভাগবত ১।৩।৮] (ভ্রাম্যমান ঋষি)
৪. নর-নারায়ণ [ভাগবত ১।৩।৯] (যমজ)
৫. কপিল [ভাগবত ১।৩।১০] (দার্শনিক)
৬. দত্তাত্রেয় [ভাগবত ১।৩।১১] (ত্রিমূর্তির যুগ্ম অবতার)
৭. যজ্ঞ [ভাগবত ১।৩।১২] (সাময়িকভাবে ইন্দ্রের ভূমিকা গ্রহণ করা বিষ্ণু)
৮. ঋষভ [ভাগবত ১।৩।১৩] (রাজা ভরত ও বাহুবলীর পিতা)
৯. পৃথু [ভাগবত ১।৩।১৪] (যে রাজা পৃথিবীকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন)
১০. মৎস্য [ভাগবত ১।৩।১৫] (মাছ)
১১. কূর্ম [ভাগবত ১।৩।১৬] (কচ্ছপ)
১২. ধন্বন্তরী [ভাগবত ১।৩।১৭] (আয়ুর্বেদের জনক)
১৩. মোহিনী [ভাগবত ১।৩।১৭] (সুন্দরী নারী)
১৪. নৃসিংহ [ভাগবত ১।৩।১৮] (নর-সিংহ)
১৫. বামন [ভাগবত ১।৩।১৯] (খর্বকায়)
১৬. পরশুরাম [ভাগবত ১।৩।২০] (পরশু অর্থাৎ কুঠার সহ রাম)
১৭. ব্যাসদেব [ভাগবত ১।৩।২১] (বেদ সংকলক)
১৮. রাম [ভাগবত ১।৩।২২] (অযোধ্যার রাজা)
১৯. বলরাম [ভাগবত ১।৩।২৩] (কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা)
২০. কৃষ্ণ [ভাগবত ১।৩।২৩] (রাখাল বা স্বয়ং ভগবান)
২১. বুদ্ধ [ভাগবত ১।৩।২৪] (জ্ঞানী)
২২. কল্কি [ভাগবত ১।৩।২৫] (ধ্বংসকারী)
---
এই বাইশ অবতার ছাড়াও উক্ত গ্রন্থের পরবর্তী অংশে আরও তিন অবতারের কথা আছে ----
-----------------------------------------------------------------------------
১. প্রশ্নিগর্ভ [ভাগবত ১।৩।৪১] (প্রশ্নির সন্তান)
২. হয়গ্রীব [ভাগবত ২।৭।১১] (অশ্ব)
৩. হংস [ভাগবত ১১।১৩।১৯] (রাজহংস)
----
কল্কি অবতারের বর্ণনা দেওয়ার পর ভাগবত পুরাণ–এ ঘোষিত হয়েছে, বিষ্ণুর অবতার অসংখ্য। যদিও উপরি উল্লিখিত পঁচিশ অবতারের গুরুত্বই সর্বাধিক। ভাগবত পুরাণ–এর একটি শ্লোক, মহাভারত-এর কতকাংশ এবং অন্যান্য পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থের মতে, চৈতন্য মহাপ্রভু হলেন বিষ্ণুর অন্যতম অবতার। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুসারে তাঁকে অবতার রূপে পূজা করার বিধান রয়েছে। এই কারণেই চৈতন্য মহাপ্রভুকে গৌরাঙ্গ অবতার নামে অভিহিত করা হয়।



লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

গীতার সারাংশ (অধ্যায় অনুসারে)

বিষাদ-যোগ --- রণাঙ্গনে প্রতীক্ষমাণ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে, মহাযোদ্ধা অর্জুন উভয় পক্ষের সৈন্যসজ্জার মধ্যে সমবেত তাঁর অতি নিকট অন্তরঙ্গ আত্মীয়-পরিজন, আচার্যবর্গ ও বন্ধু-বান্ধব সকলকে যুদ্ধে প্রস্তুত হতে এবং জীবন বিসর্জনে উন্মুখ হয়ে থাকতে দেখেন। শোকে ও দুঃখে কাতর হয়ে অর্জুন শক্তিহীন হলেন, তাঁর মন মোহাচ্ছন্ন হল এবং তিনি যুদ্ধ করার সংকল্প পরিত্যাগ করেন।
সাংখ্য-যোগ --- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তার শিষ্যরূপে অর্জুন আত্মসমর্পণ করেন এবং অনিত্য জড় দেহ ও শাশ্বত চিন্ময় আত্মার মূলগত পার্থক্য নির্ণয়ের মাধ্যমে অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ প্রদান করতে শুরু করেন। দেহান্তর প্রক্রিয়া, পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ সেবার প্রকৃতি এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ মানুষের বৈশিষ্ট্যাদি সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।

কর্মযোগ --- এই জড় জগতে প্রত্যেককেই কোনও ধরণের কাজে নিযুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু কর্ম সকল মানুষকে এই জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করতেও পারে, আবার তা থেকে মুক্ত করে দিতেও পারে। স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেকে, পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাজের মাধ্যমে, মানুষ তাঁর কাজের প্রতিক্রিয়া জনিত কর্মফলের বিধিনিয়ম থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং আত্মতত্ত্ব ও পরমতত্ত্ব দিব্যজ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়।

জ্ঞানযোগ --- আত্মার চিন্ময় তত্ত্ব, ভগবৎ-তত্ত্ব এবং ভগবান ও আত্মার সম্পরক-এই সব অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান বিশুদ্ধ ও মুক্তিপ্রদায়ী। এই প্রকার জ্ঞান হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভক্তিমূলক কর্মের (কর্মযোগ) ফলস্বরূপ। পরমেশ্বর ভগবান গীতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, জড় জগতে যুগে যুগে তাঁর অবতরণের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ গুরুর সান্নিধ্য মাভের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করেছেন।

কর্মসন্ন্যাস-যোগ --- বহিঃবিচারে সকল কর্তব্যকর্ম সাধন করলেও সেগুলির কর্মফল পরিত্যাগ করার মাধ্যমে, জ্ঞানবান ব্যক্তি পারমার্থিক জ্ঞানতত্ত্বের অগ্নিস্পর্শে পরিশুদ্ধি লাভ করে থাকেন, ফলে শান্তি, নিরাসক্তি, সহনশীলতা, চিন্ময় অন্তর্দৃষ্টি এবং শুদ্ধ আনন্দ লাভ করেন।

ধ্যানযোগ --- নিয়মতান্ত্রিক ধ্যানচর্চার মাধ্যমে অষ্টাঙ্গযোগ অনুশীলন মন ও ইন্দ্রিয় আদি দমন করে এবং অন্তর্যামী পরমাত্মার চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট রাখে।এই অনুশীলনের পরিণামে পরমেশ্বরের পূর্ণ ভাবনারূপ সমাধি অর্জিত হয়।

বিজ্ঞান-যোগ --- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, সর্বকারণের পরম কারণ এবং জড় ও চিন্ময় সর্ববিষয়ের প্রাণশক্তি। উন্নত জীবাত্মাগণ ভক্তি ভরে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকেন, পক্ষান্তরে অধার্মিক জীবাত্মারা অন্যান্য বিষয়ের ভজনায় তাদের মন বিক্ষিপ্ত করে থাকে।

অক্ষরব্রহ্ম-যোগ --- আজীবন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তার মাধ্যমে এবং বিশেষ করে মৃত্যুকালে তাঁকে স্মরণ করে, মানুষ জড় জগতের ঊর্ধ্বে ভগবানের পরম ধাম লাভ করতে পারে।

রাজগুহ্য-যোগ --- শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং পরমারাধ্য বিষয়। অপ্রাকৃত ভগবত-সেবার মাধ্যমে জীবাত্মা মাত্রই তাঁর সাথে নিত্য সম্বন্ধযুক্ত। মানুষের শুদ্ধ ভক্তি পুনরুজ্জীবিত করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব।

বিভূতি-যোগ --- জড় জগতের বা চিন্ময় জগতের শৌর্য, শ্রী, আড়ম্বর, উতকরশ-সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় শ্রীকৃষ্ণের দিব্য শক্তি ও পরম ঐশ্বর্যাবলীর আংশিক প্রকাশ মাত্র অভিব্যক্ত হয়ে আছে। সর্বকারণের পরম কারণ, সর্ববিষয়ের আশ্রয় ও সারাতিসার রূপে শ্রীকৃষ্ণ সর্বজীবেরই পরমারাধ্য বিষয়।

বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ --- পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দান করেন এবং সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষক তাঁর অনন্ত বিশ্বরূপ প্রকাশ করেন। এভাবেই তিনি তাঁর দিব্যতত্ত্ব অবিসংবাদিতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রতিপন্ন করেছেন যে, তাঁর স্বীয় অপরূপ সৌন্দর্যময় মানবরূপী আকৃতিই ভগবানের আদিরূপ। একমাত্র শুদ্ধ ভগবত-সেবার মাধ্যমেই মানুষ এই রূপের উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম।

ভক্তিযোগ --- চিম্নয় জগতের সর্বোত্তম প্রাপ্তি বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভের পক্ষে ভক্তিযোগ বা শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। যারা এই পরম পন্থার বিকাশ সাধনে নিয়োজিত থাকেন, তাঁরা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী হন।

প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগঃ- দেহ, আত্মা এবং উভয়েরও ঊর্ধ্বে পরমাত্মার পার্থক্য যিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই এই জড় জগৎ থেকে মুক্তি লাভে সক্ষম হন।

গুনত্রয়-বিভাগ-যোগ --- সমস্ত দেহধারী জীবাত্মা মাত্রই সত্ত্ব, রজ ও তম--জড়া প্রকৃতির এই ত্রিগুণের নিয়ন্ত্রণাধীন। পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এই ত্রিগুনাবলীর স্বরূপ, আমাদের ওপর সেগুলির ক্রিয়াকলাপ, মানুশ কিভাবে সেগুলিকে অতিক্রম করে এবং যে-মানুষ অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত তার লক্ষণাবলী ব্যাখ্যা করেছেন।

পুরুষোত্তম-যোগ --- বৈদিক জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে জড়-জাগতিক বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি লাভ এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা। যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণের পরম স্বরূপ উপলব্ধি করে, সে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ভক্তিমূলক সেবায় আত্মনিয়োগ করে।

দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ --- যারা আসুরিক গুণগুলি অর্জন করে এবং শাস্ত্রবিধি অনুসরণ না করে যথেচ্ছভাবে জীবন যাপন করে থাকে, তারা হীনজন্ম ও ক্রমশ জাগতিক বন্ধনদশা লাভ করে। কিন্তু যারা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসন আদি মেনে বিধিবদ্ধ জীবন যাপন করেন, তাঁরা ক্রমান্বয়ে পারমার্থিক সিদ্ধিলাভ করেন।

শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ --- জড় প্রকৃতির ত্রিগুণাবলীর থেকে উদ্ভূত এবং সেগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রদ্ধা তিন ধরণের হয়ে থাকে। যাদের শ্রদ্ধা রাজসিক ও তামসিক, তারা নিতান্তই অনিত্য জড়-জাগতিক ফল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে, শাস্ত্রীয় অনুশাসন আদি মতে অনুষ্ঠিত সত্ত্বগুণময় কার্যাবলী হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং পরিণামে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শুদ্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধার পথে মানুষকে পরিচালিত করে ভক্তিভাব জাগ্রত করে তোলে।

মোক্ষযোগ --- শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন ত্যাগের অর্থ এবং মানুষের ভাবনা ও কার্যকলাপের উপর প্রকৃতির গুণাবলীর প্রতিক্রিয়াগুলি কেমন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ব্রহ্ম উপলব্ধি, ভগবদগীতার মাহাত্ম্য ও গীতার চরম উপসংহার---ধর্মের সর্বোচ্চ পন্থা হচ্ছে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, যার ফলে সর্বপাপ হতে মুক্তি লাভ হয়, সম্যক জ্ঞান-উপলব্ধি অর্জিত হয় এবং শাশ্বত চিন্ময় পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা যায়।


 লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

“বরুথিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য’’

বৈশাখ কৃষ্ণপক্ষীয়া বরুথিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ভবিষ্যোত্তর পুরাণে যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ সংবাদে বর্ণনা করা হয়েছে।

যুধিষ্ঠির মহারাজ শ্রীকৃষ্ণকে বললেন- হে বাসুদেব! আপনাকে প্রণাম। বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী কি নামে প্রসিদ্ধ এবং তার মহিমাই বা কি তা
কৃপা করে আমাকে বলুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে রাজন! ইহলোক ও পরলোকে বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী ‘বরুথিনী’ নামে বিখ্যাত। এই ব্রত পালনে সর্বদা সুখ লাভ হয় এবং পাপক্ষয় ও সৌভাগ্য প্রাপ্তি ঘটে। দুর্ভাগা স্ত্রীলোক এই ব্রত পালনে সর্বসৌভাগ্য লাভ করে থাকে। ভক্তি ও মুক্তি প্রদানকারী এই ব্রত সর্বপাপহরণ এবং গর্ভবাস যন্ত্রণা বিনাশ করে। এই ব্রত প্রভাবে মান্ধাতা, ধুন্ধুমার আদি রাজারা দিব্যধাম লাভ করেছেন। এমনকি মহাদেব শিবও এই ব্রত পালন করেছিলেন। দশ হাজার বৎসর তপস্যার ফল কেবলমাত্র এক বরুথিনী ব্রত পালনে লাভ হয়। যে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি এই ব্রত পালন করেন তিনি ইহলোক ও পরলোকে সমস্ত প্রকার বাঞ্চিত ফল লাভ করেন।

হে নৃপশ্রেষ্ঠ! অশ্বদান অপেক্ষা গজদান শ্রেষ্ঠ, গজদান থেকে ভূমিদান, তা থেকে তিলদান, তিলদান থেকে স্বর্ণদান এবং তা অপেক্ষা অন্নদান শ্রেষ্ঠ। অন্নদানের মত শ্রেষ্ঠদান আর নেই। পিতৃলোক, দেবলোক ও মানুষেরা অন্নদানেই পরিতৃপ্ত হন। পন্ডিতেরা কন্যাদানকে অন্নদানের সমান বলে থাকেন। স্বয়ং ভগবান গোদানকে অন্নদানের সমান বলেছেন। আবার এই সমস্ত প্রকার দান থেকেও বিদ্যাদান শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই বরুথিনী ব্রত পালনে সেই বিদ্যাদানের সমান ফল লাভ হয়ে থাকে।


পাপমতি যে সব মানুষ কন্যার উপার্জিত অর্থে জীবনধারণ করে, পুণ্যক্ষয়ে তাদের নরকযাতনা ভোগ করতে হয়। তাই কখনও কন্যার উপার্জিত অর্থ গ্রহণ করা উচিত নয়। যে ব্যক্তি বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার সহ কন্যাদান করেন তাঁর পুণ্যের হিসাব স্বয়ং চিত্রগুপ্তও করতে অসমর্থ হন। কিন্তু ‘বরুথিনী’ ব্রত পালনকারী কন্যাদান থেকেও বেশি ফল লাভ করে। ব্রতকারী ব্যক্তি দশমীর দিনে কাঁসার পাত্রে ভোজন, মাংস, মসুর, ছোলা, শাক, মধু, অন্যের প্রদত্ত অন্নগ্রহণ, দুইবার আহার ও মৈথুন পরিত্যাগ করবে। দ্যূতক্রীড়া, নেশাজাতীয় দ্রব্য, দিবানিদ্রা, পরনিন্দা-পরচর্চা, প্রতারণা, চুরি, হিংসা, মৈথুন, ক্রোধ ও মিথ্যাবাক্য একাদশীর দিনে বর্জনীয়।কাঁসার পাত্রে ভোজন, মাংস, মসুর, মধু, তেল, মিথ্যাভাষণ, ব্যায়াম্, দুইবার আহার ও মৈথুন এসব দ্বাদশীর দিনে পরিত্যাজ্য।


হে রাজন! এই বিধি অনুসারে বরুথিনী ব্রত পালনে সকল প্রকার পাপের বিনাশ এবং অক্ষয় গতি লাভ হয়। যিনি হরিবাসরে রাত্রিজাগরণ করে ভগবান জনার্দনের পূজা করেন, তিনি সর্বপাপ মুক্ত হয়ে পরমগতি লাভ করেন। তাই সূর্যপুত্র যমরাজের যাতনা থেকে পরিত্রাণের জন্য পরম যত্নে এই একাদশী ব্রত পালন করা কর্তব্য। বরুথিনী একাদশীর ব্রতকথা শ্রদ্ধাভরে পাঠ বা শ্রবণ করলে সহস্র গোদানের ফল লাভ হয় এবং সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুলোকে গতি হয়।
.
নতুন নতুন পোস্টের জন্য www.facebook.com/shonatonsondesh/ এই ক্ষুদ্র পেইজ লাইক দিয়ে এক্টিভ থাকুন এবং পোষ্ট গুলো শেয়ার করে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন তথ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দিন।
.
প্রচারেঃ ‪#‎feni_sonatoni_songho‬ পোষ্টে লাইক কমেন্ট এবং শেয়ার করুন না হলে পোষ্ট গুলো আপনার হোম পেইজে আসবে না।
☆☆লিখাতে কোনো প্রকার ভুল থাকলে ক্ষমা করবেন , ইহা অনিচ্ছাকৃত। ☆☆
Share:

বেদ ও গণিতের সংখ্যার ক্রমঘাত

সংখ্যার ক্রমঘাতের আদিতম উৎস বেদ । শ্রী শঙ্করাচার্য তার যর্জুবেদে ১৭ নং অধ্যায়ের দুই নং কণ্ডিকায় উল্লেখ করেছেন।
“চ দশ চ দশ শতং চ শতং চ সহস্রং চ সহস্রং অযুতং অযুতং চ নিযুতং চ
নিযুতং চ প্রযুতং চার্ব্বুদং চ ন্যর্ব্বুদং চ সমুদ্রশ্চ মধ্যং চান্তশ্চ পরার্দ্ধশ্চৈতা মে”
অর্থ্যাৎ
০-১০ = ১০^১
১০-১০০ = ১০^২
১০০-১০০০ = ১০^৩
১০০০-১০০০০ = ১০^৪
১০০০০-১০০০০০ = ১০^৫
১০০০০০-১০০০০০০ = ১০^৬
১০০০০০০-১০০০০০০০ = ১০^৭ .............. ১০^১৫
অর্থ্যাৎ
এক থেকে দশ(১০^১)
দশ থেকে শত(১০^২)
শত থেকে সহস্র(১০^৩)
সহস্র থেকে অযুত(১০^৪)
অযুত থেকে নিযুত 1Lac(১০^৫)
নিযুত থেকে প্রযুত 1mil(১০^৬)
প্রযুত থেকে অর্বুদ(১০^৭)
অর্বুদ থেকে ন্যর্বুদ 1bil (১০^৮)
ন্যর্বুদ থেকে খর্ব (১০^৯)
খর্ব থেকে নিখর্ব(১০^১০)
নিখর্ব থেকে মহাপদ্ম 1trillion(১০^১১)
মহাপদ্ম থেকে শঙ্কু (১০^১২)
শঙ্কু থেকে সমুদ্র (১০^১৩)
সমুদ্র থেকে মধ্যম 1 quadrillion (১০^১৪)
মধ্যম থেকে অন্ত 100 quadrillion (১০^১৫)

এই মন্ত্রটিই গণিতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংখ্যার ক্রমঘাত পদ্ধতিতে গণনার সূচনা করে।



Writer & Editor - Samir Kumar Mondal
Share:

দেবী মঙ্গলচণ্ডী

মঙ্গলচণ্ডী সকল বিশ্বের মূল স্বরূপা প্রকৃতি দেবীর মুখ হইতে মঙ্গলচণ্ডী দেবী উৎপন্না হইয়াছেন। তিনি সৃষ্টিকার্য্যে মঙ্গলরূপা এবং সংহারকার্য্যে কোপরূপিণী, এইজন্য পণ্ডিতগণ তাঁহাকে মঙ্গলচণ্ডী বলিয়া অভিহিত করেন। দেবীভা-৯স্ক-১। দক্ষ অর্থে চণ্ডী এবং কল্যাণ অর্থে মঙ্গল। মঙ্গলকর বস্তুর মধ্যে দক্ষা বলিয়া তিনি মঙ্গলচণ্ডী নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। প্রতি মঙ্গলবারে তাঁহার পূজা বিধেয়। মনু বংশীয় মঙ্গল রাজা নিরন্তর তাঁহার পূজা করিতেন। দেবীভা-৯স্ক-৪৭।
মঙ্গলচণ্ডী ব্রত
প্রতি মঙ্গলবারে মা চণ্ডীর আরাধনা করা হয় বলে এ ব্রতের নাম মঙ্গলচণ্ডী ব্রত। জীবনে শ্রেষ্ঠ মাঙ্গল্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই এ ব্রতের অনুষ্ঠান। মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের নানা রূপ আছে। কুমারীরা যে মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের আচরণ করে, তা অতি সহজ ও সংক্ষিপ্ত। দেবী অপ্রাকৃত মহিমার প্রশস্তিগীতি ব্রতের ছড়ায় এসে ধরা দেয়।


যথা ---
সোনার মা ঘট বামনী।
রূপোর মা মঙ্গলচণ্ডী।।
এতক্ষণ গিয়েছিলেন না
কাহার বাড়ি?
হাসতে খেলতে তেল সিন্দুর মাখতে
পাটের শাড়ি পরতে সোনার দোলায় দুলতে
হয়েছে এত দেরী।
নির্ধনের ধন দিতে
কানায় নয়ন দিতে
নিপুত্রের পুত্র দিতে
খোঁড়ায় চলতে দিতে
হয়েছে এত দেরী।
অভীষ্ট সিদ্ধিমানসে হিন্দু মহিলাগণ মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডী দেবীর অর্চনা ও ব্রত উপসাবাদি করিয়া থাকেন।
[ধনপতি সওদাগরের পত্নী খুল্লনা প্রথম মঙ্গলচণ্ডীদেবীর পূজার প্রবর্তন করেন।]

দেবীর করুণাশক্তি অমোঘ। তাঁর শরণাগত হলে নির্ধন ধনী হয়, অন্ধ নয়ন পায়, বন্ধ্যা পুত্র লাভ করে, খঞ্জ চরণযুক্ত হয়। সংসারজীবনে এই মঙ্গলময়ীর আরাধনা তাই একান্তই প্রয়োজন। কুমারী জীবন থেকেই তারা আরাধনা শুরু করে এবং সমগ্র জীবনব্যাপী তা চলতে থাকে।

Written by :  Prithwish Ghosh.
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ৯ )

রাম ও লক্ষণ উভয়ের কাছে বিবাহের প্রস্তাব অস্বীকৃত হয়েছিলো । একে অপরের কাছে বারংবার প্রেরন করছিলো, এতে শূর্পনাখা রাক্ষসী অতীব ক্রোধী হল। হুঙ্কার দিয়ে বলল- “তোমরা উভয়ে আমার সাথে এইরূপ কৌতুক করছ, তোমরা জানো না আমি কে? এখন আমি আমার স্বরূপ ধরে ঐ সুন্দরী নারীকে ভক্ষণ করবো।” রাক্ষসী , সীতাকেই নির্দেশ করেছিলো অঙ্গুলিহেলনে ।এরপর শূর্পনাখা আসল রূপে আসলো। বিশাল, স্থূল ভয়ানক সেই রূপ। দন্ত গুলি গজদন্তের ন্যায়, মস্তকে পর্বত আকৃতির জটা থেকে বিষাক্ত সর্পের ন্যায় কেশ চতুর্দিকে দোলা খাচ্ছে, হস্তের আঙ্গুলের নখ তীক্ষ্ণ ফলা, চোখ দুটি কোটরগত । ভয়ানক হাসিতে পাখপাখালি যেযেদিকে পারছে উরে চলে যাচ্ছে। সেই রাক্ষসী বলল- “দশানন রাবনের ভগিনী আমি। আজ তোমাদের দুজনের সামনে ঐ সুমুখী নারীকে ভক্ষণ করবো। দেখি তোমরা কি করো?” শূর্পনাখার বিকট কুৎসিত রূপ দেখে ভয়ে সীতাদেবী মূর্ছা গিয়ে ভূমিতে পড়ে যাচ্ছিল্লেন, সেসময় রামচন্দ্র গিয়ে ভূমিতে পড়া থেকে বাঁচালেন। এইহেন বিকট রূপ দেখে যে জীবিত থাকে, সেই বোধ হয় যথার্থ বীর । এই রূপ দর্শন তো দূর- বর্ণনা শুনলেই ভয়ে প্রাণত্যাগ হবে । রামচন্দ্র বললেন- “ভ্রাতা সৌমিত্র! শীঘ্র এই কামাতুরা ব্যাভিচারিনী রাক্ষসীকে বিকৃত করো। যাহাতে এর মধ্যে আর কোনরূপ কাম না আসতে পারে।” লক্ষণ সেই রাক্ষসীকে বলল- “শোন দুরাচারিণী! নারীর ওপর অস্ত্র প্রয়োগ আমি করি না। যদি রক্ষা পেতে চাস, ত এই মুহূর্তে এই স্থান হতে পলায়ন কর। অন্যত্থায় তোর মতো কামাতুরা রাক্ষসীর ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবো না, আর এতে আমার কোনরূপ পাপ হবে না।” লক্ষণের বারণ শুনলো না রাক্ষসী শূর্পনাখা । সে বলল- “ওহে সুপুরুষ! তোমাদের ন্যায় মানব আমাদের আহার্য। মানবের ভয়ে ভীত হলে দশানন রাবনের নামে কলঙ্ক রটবে। এখুনি আমি ঐ নারীকে ভক্ষণ করবো।”

এই বলে শূর্পনাখা অগ্রসর হতেই লক্ষণ তখন হাতের কুঠার দিয়ে রাক্ষসীর নাক কেটে ফেলল। নাক সশব্দে ভূমিতে পতিত হল। অবিরত ধারায় রক্ত বহির্গমন হল। তবুও রাক্ষসী মানে না। তখন লক্ষণ কুঠারে রাক্ষসীর দুকান ছেদন করে দিলো। ছিন্ন কর্ণ কুণ্ডল সহিত পতিত হল ভূমিতে। এই অবস্থায় রাক্ষসীর রক্তমাখা মুখ আরোও ভয়ানক লাগছিলো।মস্তকের দুপাশ, কাটা নাসিকা নিয়ে সমানে রক্ত বের হচ্ছে। শূর্পনাখা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বলল- “এর শাস্তি তোমরা ভালোভাবেই পাবে। তোমাদের বিনাশ করবো।” এই বলে শূর্পনাখা কাঁদতে কাঁদতে খড় আর দূষণের কাছে গেলো। আঘাত দেখিয়ে বলল- “ভ্রাতা এই দেখো পঞ্চবটিতে অবস্থিত অযোধ্যার রাজকুমার রাম আর লক্ষণ আমার কি দশা করেছে। আমার বিচার চাই। সেই দুজনের কাটা মুণ্ডু এনে আমাকে না দেখালে আমার শোক যাবে না।” খড়, দূষণ ক্রোধে জ্বলতে লাগল। বলল- “ভগিনী! এই দুই ভ্রাতাই পূর্বে তাড়কা, সুবাহু ও তাদের আশ্রিত তিন কোটি রাক্ষস বধ করেছে। এরাই বিরাধ বধ করেছে। শক্তিশালী মায়াবী রাক্ষস মারীচকে বিতারিত করেছে। আজ তোমাকে প্রহার করলো। এখন আমি তাদের নিদারুন যমযন্ত্রনা প্রদান করবো। দশানন রাবণের রাজত্বে রাক্ষসদের আঘাত করলে কি পরিণাম হয় তা বুঝবে এবার সেই দুই বনবাসী। প্রথমে তাদের বধ করবো , তারপর তাদের সেই সুন্দরী স্ত্রীকে বন্দী বানিয়ে ভ্রাতা দশাননকে উপহার দিবো, তারপর যত মুনি ঋষি এই জঙ্গলে আছে, সব কটাকে বেছে বেছে বধ করবো।” খড় আর দূষণ এই বলে বোন শূর্পনাখাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো । বলল- “তুমি এই স্থানেই অবস্থান করো। আমার আশ্রিত চতুর্দশ শক্তিশালী রাক্ষসকে দেবতারাও ভয় পায়। তাঁরাই গিয়ে ঐ দুই বনবাসীর শিরোচ্ছেদ করে তাদের মুণ্ড তোমাকে উপহার দেবে।” এই বলে খড় আর দূষণ চতুর্দশ রাক্ষসকে আদেশ দিলো । চতুর্দশ রাক্ষস নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসতে লাগলো । তাদের পদচালনায় দূর থেকে বারংবার ভূকম্পের মতো মেদিনী কাঁপতে লাগলো । বট, অশ্বত্থ, পনস, আম্র, তাল, শাল, সেগুন, কদম্ব বৃক্ষ গুলি তাদের পদচালনায় চূর্ণ চূর্ণ হতে লাগলো । বিকট চেহারা রাক্ষস দের নিঃশ্বাসে পশু, পক্ষী গুলো ছিটকে ছিটকে বহু দূরে দূরে নিক্ষেপিত হল । রাম বললেন- “লক্ষণ তুমি আর সীতা কুটির মাঝেই অবস্থান করো। আমি গিয়ে সেই রাক্ষস দের বধ করবো।” লক্ষণ অনেক কাকুতি মিনতি করলো যে সে একাই সব রাক্ষস বিনাশ করতে পারবে কিন্তু রামচন্দ্র আদেশ দিলো না।

বাইরে এসে অতি উচ্চ, স্থূল, বিকট দর্শন রাক্ষসদের দেখতে পেলো ভগবান রামচন্দ্র । রাক্ষসেরা দেখা মাত্রই গদা, শূল, পট্টিশ , মুগুর, তরবারি , ছোড়া, বাণ ইত্যাদি ঘাতক অস্ত্র সকল রামচন্দ্রের দিকে নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ভগবান রাম নানা অস্ত্র প্রয়োগ করে রাক্ষসদের নিক্ষেপিত অস্ত্র সকল চূর্ণ করতে লাগলেন । নানান দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগে রাক্ষসদের মায়া নষ্ট হতে লাগলো। রাক্ষসেরা বৃহৎ আকৃতি শিলা, বৃক্ষ তুলে রামচন্দ্রের দিকে ছুঁড়তে লাগলেন। ভগবান তখন সূচীমুখ, শিলামুখ, অর্ধচন্দ্র, ঐন্দ্রাস্ত্রের মাধ্যমে সেগুলি চূর্ণ করতে লাগলেন । চারিদিকে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে পড়ে পর্বতের আকার স্তূপাকৃতি হল। রাক্ষসদের নিঃশ্বাসে সেগুলি উড়ে অকালে কৃত্রিম ধোঁয়া কুয়াশা সৃষ্টি হল। সমগ্র জঙ্গলে বোধ হয় প্রবল আলোরন সৃষ্টি হয়েছে এইভাবে যুদ্ধ চলতে লাগলো। রাক্ষসদের সকল অস্ত্রাদি চূর্ণ করে রাক্ষসদের সমুচিত জবাব দিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র । চৌদ্দ রাক্ষসের একত্র ছায়া এইভাবে পতিত হয়েছিলো, যেন মনে হচ্ছিল্ল বিশাল পর্বতমালা সূর্যের আলো আচ্ছাদিত করে রেখেছে। তখন রাক্ষসদের বিনাশ কাল উপস্থিত । ভগবান রাম ধনুকে দিব্যাস্ত্র প্রকট করলেন । সেই বাণ চোখের নিমিষে চালনা করলেন। এক বাণ থেকে চৌদ্দ দিব্য শর প্রকট হয়ে গিয়ে চৌদ্দ রাক্ষসের শিরোচ্ছেদ করলো। বিশাল উল্কাপিণ্ডের ন্যায় চারিধারে রাক্ষসের চৌদ্দ মুণ্ড পতিত হল। ছিন্ন স্কন্ধ দিয়ে হড়পা বাণের ন্যায় তীব্র বেগে রক্তধারা নির্গত হল। চৌদ্দ রাক্ষসের নিথর দেহ এইভাবে পড়লো যে বসুমতীও কেঁপে উঠলো। দেখে মনে হল বিশাল পর্বতমালা থেকে ঝর্ণার ন্যায় রক্ত নদীর ঝর্না প্রবাহিত হয়েছে । দেবতারা, মুনি ঋষিরা ভগবান রামের জয়ধ্বনি করে স্তবস্তুতি করতে লাগলেন । শূর্পনাখাকে কেন নাক, কাণ কেটে ছাড়লেন ? কেন বধ করলেন না? এর মধ্যে কিছু তত্ত্ব কথা আছে । শূর্পনাখা কামের সাক্ষাৎ মূর্তি । সাধারন মানব কামকে সম্পূর্ণ বিনাশ করতে পারে না। ভগবান শিব মদন ভস্ম করেছিলেন, সাধারন মানব পারে না। নানাভাবে কামনা বাসনা মানবের জীবনে আসে। মহামানবদের কথা আলাদা। সাধারন মানব কেবল কামকে আয়ত্তে বা বশে রাখতে পারে, সম্পূর্ণ বধ করলে সেই মানব হন মহামানব ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ৮ )


একদিন লঙ্কা নগরীতে একাকী শূর্পনাখা মনমরা হয়েছিলেন। নিশাচরী কেকসীকণ্যা শূর্পনাখা ভাবল একবার গোদাবরী তট থেকে ঘুরে আসতে । নিশাচরী মায়া দ্বারা আকাশ মার্গে বিচরণ করতে গেলে সে সময় মন্দাদোরী বলল- “ননদিনী । এই সময় শুভ নয়। এই সময় তুমি যাত্রা করলে তোমার পিছু পিছু ভীষণ অমঙ্গল আসতে পারে।”শূর্পনাখা অট্টহাস্য করে বলল- “জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দশাননের নাম শ্রবনে অমঙ্গল নিজেও অমঙ্গলের ভয়ে পলায়ন করে। তুমি সেই বীর পুরুষের স্ত্রী হয়ে এত শঙ্কা করো?” এই বলে শূর্পনাখা পাখসাট মেরে চোখের পলকে সুদুর শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতে গোদাবোরী তীরে পঞ্চবটিটে উপস্থিত হল । রাক্ষসীর বিকট চেহারা দেখে বনের পশু পক্ষী এমনকি বাঘ, সিংহ যে যেদিকে পারলো পলায়ন করলো। নবজাত পুস্পের কলি ঝড়ে পড়ে গোটা অরণ্য থমকে গেলো । সেই রাক্ষসী ঘুরতে ঘুরতে এদিক সেদিক বিচরণ করতে লাগলো । বিশাল চরণের চিহ্ন যেখানে পতিত হল- গর্ত হয়ে গেলো। গাছপালা যথেচ্ছ ভাবে ভেঙ্গেচুড়ে, বৃক্ষ গুলি উৎপাটন করে মনের সুখে আনন্দে নৃত্য গীত করতে লাগলো । তার চরণ প্রহারে ছোট ছোট অসংখ্য জীব নিহত হল । সে গোদাবরী তিরে রামচন্দ্র, লক্ষণ কে দেখতে পেলো। সুন্দর রম্য অরণ্যে দুই সুপুরুষ সেই কুটিরে অবস্থান করছিলো। তাঁরই নিকটে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী অবস্থিত দেখলো । দুই পুরুষের সুঠাম, সুগঠিত, মেদহীন চেহারা। বনবাসী হয়েও গাত্রে রাজকূলের নানান চিহ্ন ও লক্ষণ প্রকাশিত । মস্তকে জটা, গলে রুদ্রাক্ষ, বাহুতে রুদ্রাক্ষ তবুও তাঁরা ক্ষত্রিয় দিগের ন্যায় অস্ত্রাদি সঙ্গে রেখেছেন । দুজনের রূপে সমগ্র অরণ্য আলোকিত হয়ে আছে। কি দীপ্ত শত সূর্যের ন্যায় তাহারা উজ্জ্বল ও তেজস্বী । বিধবা শূর্পনাখার মনে কাম বাসনা প্রবল ভাবে জাগ্রত হল। কামে মত্ত হয়ে মত্ত হস্তীর ন্যায় এক সুন্দরী কামিনী মূর্তি ধরে গজগামিনী নারীর ন্যায় ধীরে ধীরে সেই দিকেই যেতে লাগলো, কারণ রাক্ষসী স্বরূপ দেখলে হয়তো এই দুই পুরুষ ভয়ে আর বাঁচবেই না ।

শূর্পনাখা যখন অপূর্ব সুন্দরী নারীর রূপে সেই কুটিরের দিকে গেলো, তখন রাম লক্ষণ তার দিকে ফিরেও চাইলো না। অপরদিকে শূর্পনাখা তাদের দর্শন করে মনে মনে নানা স্বপ্নজাল রচনা করে আনন্দিতা হচ্ছিল্ল। দুই পুরুষের সাথে রতিশৃঙ্গারের কথা ভেবে অতি উৎফুল্ল হচ্ছিল্ল। এই জগত রূপের দাস। এত রূপসী বেশকে কোন পুরুষই অবহেলা করবে না । অনেকক্ষণ এভাবে থাকলে লক্ষণ জিজ্ঞেস করলো- “হে দেবী! আপনি কে? আপনি কি কারনে হেথায় দণ্ডায়মানা হয়ে আছেন?” শূর্পনাখা লক্ষণের রূপে আকৃষ্ট হয়েছিলেন । বললেন- “ হে সুপুরুষ! হে বীর ! আমি হেথায় অবস্থান করে আপনাকেই প্রত্যক্ষ করছিলাম । আপনি উত্তম। আপনি সুন্দর যুবক। আপনাকে দেখে শক্তিমান বোধ হয়। সুন্দরী নারী সর্বদা শক্তিমান পুরুষকেই পতি রূপে বরন করে, যাতে তাকে পরপুরুষে সদা সমীহ করে। হে কুমার! আপনি আমাকে বিবাহ করুন। আমি আপনার স্ত্রী হয়ে সদা সর্বদা থাকতে চাই।” লক্ষণ শুনে অবাক। তিনি বললেন- “হে দেবী! আমরা অযোধ্যার স্বর্গীয় সম্রাট দশরথের পুত্র শ্রীরামচন্দ্র ও লক্ষণ। আমি লক্ষণ। পিতার বচন পালনের জন্য আমার অগ্রজ রামচন্দ বনবাসে এসেছেন। আমি কেবল আমার অগ্রজ ও বৌঠানের সেবার জন্যই এই বনে এসেছি। আমি এখানে বিবাহ করতে পারি না। আপনি বরং আমার অগ্রজ শ্রীরামচন্দ্রের কাছে যান, তিনি চাইলে তাঁর চরণে আপনি ঠাঁই লাভ করতে পারেন।” শূর্পনাখা তখন রামচন্দ্রের কাছে গেলেন। দেখলেন এই পুরুষ পূর্বের পুরুষের থেকেও অতি অতি সুন্দর। এই সৌন্দর্য ইন্দ্রাদি দেবতা এমনকি চন্দ্রদেব, মদন দেবেরও নেই। মদন দেব এঁনার কাছে লজ্জিত হয়ে পলায়ন করবেন । বললেন- “হে বীর! হে আর্য ! আপনার ন্যায় বীর পুরুষকে সকল নারী গ্রহণ করতে চাইবে। কারণ পতির বীরত্বে পত্নীর গর্ব হয়। হে মানবশ্রেষ্ঠ আপনি আমাকে দয়া করে বিবাহ করুন।” শুনে রামচন্দ্র বিস্মিত হলেন। বললেন- “হে দেবী! আপনি কে? আপনার সাথে পরিচয় নেই। কিভাবে আমি এই প্রস্তাব গ্রহণ করি? উপরন্তু আমি বিবাহিত। এক পত্নীতেই আমি সন্তুষ্ট। আমার আর বিবাহের ইচ্ছা নেই। অতএব আপনাকে বিবাহ করার কোন যুক্তি দেখি না। আপনি বরং আমার ভ্রাতা লক্ষণের নিকট যান। সে হয়তো আপনাকে বিবাহ করতে পারে। ”

আশাহত হয়ে শূর্পনাখা লক্ষণের কাছে গেলো। লক্ষণ সেখানে কাঠ কাটছিলেন । লক্ষণের সেই দিব্য তনু দেখে পুনঃ রাক্ষসী কামাতুরা হয়ে লক্ষণ কে বলল- “কুমার! আমি আপনার ভ্রাতার সাথে বারতালাপ করেছি। কিন্তু তিনি বিবাহিত। তিনি অপর স্ত্রী গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছেন। তাই আমি আপনার ভার্যা হইতে ইচ্ছা ব্যক্ত করছি। দয়া করে আমাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করুন।” লক্ষণ বলল- “হে সুনয়নী! আমার দাদা বিবাহিত। আমিও বিবাহিত। অযোধ্যায় আমার স্ত্রী আছেন। প্রথমা স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিবাহ শাস্ত্রে অনুমোদিত নয়। এই অবস্থায় অযোধ্যায় গিয়ে আমার স্ত্রীর অনুমতি গ্রহণ আমার পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু আমার জ্যেষ্ঠ অগ্রজের স্ত্রী এইখানেই আছেন, তিনি হয়তো অনুমতি দিতে পারেন। তিনি অনুমতি দিলে হয়তো অগ্রজ এখুনি আপনাকে বিবাহ করতে পারেন। অতএব আপনি অগ্রজের নিকট গমন করুন।” ভগবান রামচন্দ্রের কাছে সেই রাক্ষসী গিয়ে বলল- “হে কুমার! আপনার ভ্রাতা আমার সাথে বিবাহে ইচ্ছুক নয়। আপনি এখানে সস্ত্রীক আছেন। আমি সতীন নিয়ে সংসার করতে রাজী। আপনি আপনার প্রথমা স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে আমাকে বিবাহ করুন। আপনার ন্যায় সুপুরুষকে আমি হারাতে চাই না।” ভগবান রাম বললেন- “হে দেবী! আমি পিতার বচনে ও মাতার আদেশে চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে সন্ন্যাস পালন করছি। এই অবস্থায় আমার পক্ষে বিবাহ সম্ভব নয়। আপনি আমার ভ্রাতার কাছে যান, তাহাকে ভালো মতো বুঝিয়ে রাজী করুন। হয়তো সে আজই আপনাকে বিবাহ করতে পারে। পিতৃসত্য কেবল আমার জন্যই, আমার ভ্রাতা লক্ষণ এইথেকে মুক্ত।” শূর্পনাখা এরপর লক্ষণের কাছে গিয়ে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। লক্ষণ বলল- “দেবী এখানে আমি দাস। এখানে আমি ভৃত্য। এই অবস্থায় আমি কিভাবে বিবাহ করবো ? আমার অগ্রজই সর্বশক্তিমান । আমি কেবল তাঁর আদেশবাহক । সেবকের কাছে সুখ, ভিখারির পক্ষে সম্মান, দুরাচারীর পক্ষে অর্থ সম্পদ, ব্যভিচারীর পক্ষে শুভগতি, লোভীর পক্ষে যশ আর দাম্ভিকের পক্ষে চতুর্বিধ ফল আশা করা আর আকাশ মন্থন করে দুগ্ধ লাভ করার অলীক কল্পনা একই ব্যাপার। আমার পক্ষে সেইরূপ তোমাকে বিবাহ সম্ভব নয়। তুমি অগ্রজের কাছে যাও।” এভাবে শূর্পনাখা রাক্ষসী বারবার রাম, লক্ষণের কাছে গিয়ে বিফল হলে অতীব ক্রোধী হল ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ৭ )


বনের প্রাকৃতিক পরিবেশে রাম, সীতাদেবী ও লক্ষণের দিন কেটে যাছিল্ল । অনেক মুনি ঋষি সন্ত রোজ ভগবান রাম সীতার দর্শন করতে আসতেন । অনেক আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আলোচনা হতো। বনের পশুগুলি যেনো এই সময়ে ভগবান রাম, সীতাদেবীকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন । নির্ভয়ে বিচরণ করতে লাগলেন । সম্পূর্ণ অন্য এক পরিবেশ । সীতাদেবীকে এত প্রসন্ন দেখে ভগবান রাম খুশী হলেন। তিনি ভেবেছিলেন মিথিলার রাজকুমারী- এত সুখ ঐশ্বর্য বৈভবে লালিতা পালিতা- হয়তো বনে এসে তিনি খুবুই রোদন করবেন। কারন এই স্থানে রাজকীয় সুখ, রাজকীয় ঐশ্বর্য , শত দাস দাসী, গমনের জন্য স্বর্ণরথ , প্রচণ্ড দাবাদাহে পথ চলবার জন্য স্বর্ণছত্র , চরণে কোমল পাদুকা কিছুই নেই । সীতাদেবী একা ঘর সংসারের কাজ চালান । সীতাদেবী এত নিখুত ভাবে ঘর সংসারের দায়িত্ব পালন করেন কে বলবে তিনি এক রাজার দুহিতা, অতি যত্নে লালিতা। ছড়া দিয়ে কুটির লেপা, খড়ের মার্জনী দ্বারা গৃহ আঙিনা পরিষ্কার, কলসিতে গোদাবরীর জল বয়ে আনা, বৃক্ষে জল সিঞ্চন, সকলকে আহার বিতরণ করা। নিস্কালন্ত ভাবে সকল কর্ম নিয়মানুযায়ী করে যাচ্ছেন । মুখে কোন না নেই, আলস্য নেই। মনে হতে লাগলো অরণ্যের এই কুটিরে যেনো এক রত্নের ন্যায় প্রভাবশালী উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় সীতাদেবী অবস্থান করছেন । যিনি রাজার গৃহে পলান্ন , মিষ্টান্ন, হালুয়া- পুরি নিত্য সেবা নিতেন, তিনি সামান্য ফলমূলেই সন্তুষ্ট । যেনো বিধাতা সর্ব উত্তম সুস্বাদু রস ফলমূলে স্থাপিত করে দিয়েছেন । যিনি গজমতী হার, মণি মুক্তা বসানো বালা, স্বর্ণ কুণ্ডল ধারন করতেন তিনি বনের সামান্য পুস্পমালার সাজেই এত খুশী হচ্ছেন । রামচন্দ্র মনে সান্ত্বনা পেলেন । চারিদিকে কি সুন্দর পরিবেশ। হেমন্ত এর আগমন ঘটেছে। গুবাক, নারকেল, খর্জূর, আমলকী , পনস, আম্র , শাল, সেগুন, চন্দন বৃক্ষের রাশি চতুর্দিকে ।

রাক্ষস খড় আর দূষণের প্রেরিত মায়াবী রাক্ষসেরা অবগত হয়ে খড় ও দূষণ কে বলল- “রাক্ষসরাজ ! অযোধ্যার রাজকুমার শ্রীরাম সস্ত্রীক ও ভ্রাতা লক্ষণ সহিত অরণ্যে এসেছেন । এরাই সেই বীর যারা মারীচকে শত যোজন দূরে নিক্ষেপ করেছে। এরাই তাড়কার ন্যায় বীরাঙ্গনা রাক্ষসী ও সুবাহু রাক্ষসকে সংহার করেছে। এরাই বিরাধ বধ করেছে। আপনি লঙ্কায় রক্ষরাজ দশাননের নিকট সংবাদ প্রেরন করুন। ” খড় ও দূষণ অট্টহাস্য করে বলল- “ঐ দুই মানবের জন্য ভ্রাতা দশগ্রীবের আসবার প্রয়োজন নেই। আমার আশ্রিত চতুর্দশ রাক্ষস নরমাংসভোজী । তাহারাই ঐ দুই যুবককে হত্যা করে আহার করুক। আর পরম রূপসী রামচন্দ্রের পত্নীকে আমরা বন্দী করে লঙ্কায় প্রেরণ করবো, সে ভ্রাতা দশাননের পত্নী হবার উপযুক্ত। দশাননের মতো বীরকে অবশ্যই সেই সুন্দরী বিবাহ করবে।” এইভাবে রাক্ষসেরা নানা অলীক কল্পনাতে হাস্য করতে লাগলো। অমরাবতীর দেবতাবৃন্দ চাইছিলো খড় ও দূষণ শ্রীরামের নিকটে যুদ্ধ করতে গমন করুক। সেখান হতে একটি রাক্ষসও বেঁচে আসবে না। সবকটা প্রাণ হারাবে । তখনই দেবশক্তির জয় হবে। রাবণের সাঙ্গপাঙ্গ সকলেই নিধন হলে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে। অনার্য সংস্কৃতি লুপ্ত হবে । অপরদিকে বনের কথা শোনা যাক । বিবিধ সুগন্ধি পুস্প দ্বারা সীতাদেবী মাল্য রচনা করেছেন । প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য সেই পুস্পমালায় একত্রিত হয়েছিলো। তার সুবাস স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষের পুস্পকেও হার মানিয়েছিলো । দিব্য চন্দনের প্রলেপ দ্বারা সীতাদেবী সেই মাল্যগুলিকে সৌরভিত করেছিলেন । সন্ধ্যার পর নির্মল আকাশে চন্দোদয় হল। সমগ্র অরণ্য জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হল। বড় বড় মহীরুহ গুলো যেনো জ্যোৎস্না প্লাবনে স্নানাদি করলো। শাখায় শাখায় উজ্জ্বল শুভ্র কিরণ ছড়িয়ে পড়লো। নিঃশব্দ গোদাবরী তট, কেবল চন্দ্রালোকে বালুকারাশি চকচক করছিলো, কেবল জলপ্রবাহের শব্দ। চতুর্দিকে জোনাকী পোকার মিটিমিটি আলোক পুঞ্জ জলে উঠে নিভে যাছিল্ল। শাখায় শাখায় সুগন্ধি পুস্প শোভিত, তাতে জোনাকীর দল স্বীয় আলো দ্বারা শোভা বর্ধন করছিলো। যেনো আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলী ধরিত্রীর বুকে নেমে আসছিলো ।

শ্রীরাম ও সীতা সেই সুন্দর নিশিতে বন মাঝে ছিলেন। উভয়ে উভয়ের হৃদয় যেনো ধারন করেছিলেন। মনের ভাব মুখ হতে নিঃসৃত হবার পূর্বেই বুঝে নিয়েছিলেন । জ্যোৎস্না আলোকে সীতাদেবীর মুখমণ্ডলে এক অকৃত্রিম সৌন্দর্য শোভা পাছিল্ল। তা দেখে যেনো মাঝে মাঝে রোহিনীপতি নিশানাথ মেঘ মণ্ডলের মাঝে নিজেকে লুক্কায়িত করেছিলেন । কোটি চন্দ্রের রূপকেও লজ্জা দেবে জনকদুহিতার রূপ । একে অপরকে পুস্পমাল্য চন্দনের প্রলেপ দ্বারা সুসজ্জিত করলেন । পুস্পসাজে উভয়ের রূপ শতগুণ বর্ধিত হয়েছিলো। সুগন্ধি চন্দন এক দিব্য সুগন্ধ প্রাপ্ত করলো উভয়ের গাত্রে অবস্থান করে । পুস্প, চন্দনের সুবাসে চতুর্দিকে আমোদিত করলো। উভয়ের মধ্যে দিব্য ঐশ্বরিক ভাব ফুটে ফুটলো । রামচন্দ্রএর মধ্যে বিষ্ণু ভাব, দেবী সীতার মধ্যে লক্ষ্মীর ভাব ফুটে উঠলো । ভগবান রাম বললেন- “হে মধুমুখী সীতা! সময় এসেছে আমার তোমার বিচ্ছেদের। পূর্বে নারদ মুনি আমাকে যে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তা এখন কার্যকারী হবে। মনে আছে পূর্বে আমাদের বিবাহ লগ্ন চন্দ্রদেব ভঙ্গ করেছিলো। দেবতাদের ইচ্ছা আমার তোমার বিচ্ছেদ হোক, নাহলে লঙ্কার পতন হবে না। রাবণের মৃত্যু হবে না।” দেবী সীতা বললেন- “হে ভগবান! আমি আপনি এক। লৌকিক দৃষ্টিতে এই বিচ্ছেদ। আপনার মধ্যে আমি, আমার মধ্যে আপনি সদা বিদ্যমান। আমিও বিস্মৃত হই নি, বেদবতী রূপে আমি রাবণকে কি অভিশাপ প্রদান করেছিলাম । হে নাথ! এই বিচ্ছেদ কে সৃষ্টির কল্যাণে আমি মস্তকে গ্রহণ করলাম। কারন রাবণের ধ্বংস না হলে অধর্মের রাজত্ব চলতেই থাকবে।” বলা হয় এরপর রামচন্দ্র আসল সীতাদেবীকে অগ্নি দেবতার কাছে রেখে সুরক্ষার দায়িত্ব প্রদান করেন। একজন নকল সীতাদেবীকে আনয়ন করেন। রাবণ একেই হরণ করেছিলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব-৬ )

অগস্ত্য মুনির আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে রাম লক্ষণ ও সীতাদেবী সেই দণ্ডকারণ্য ঘুরে দেখতে লাগলেন। এখানে গভীর জঙ্গল বহুদূর দুরান্ত অবধি বিস্তৃত হয়েছে । চতুর্দিকে কেবল সবুজে আচ্ছদিত বৃক্ষ । আর পবিত্র গোদাবরী নদী । কুলকুল বেগে স্বচ্ছ মিষ্টি জল প্রবাহিত হচ্ছে । নদী যেনো এখানে কথা বলে এমনই । আর দেখলেন সেখানে বহু মুনি ঋষির আশ্রম । সেই শাস্ত্রীয় বিদ্বান মুনি ঋষি সন্ন্যাসী গন এখানে ভগবান প্রাপ্তির জন্য কঠিন সাধনায় মগ্ন। ভগবান রাম, লক্ষণ ও সীতা সেই মুনিদিগকে প্রণাম পূর্বক নানা আলোচনাতে মগ্ন হলেন । এই ফুল, ফল দিয়ে সজ্জিত অরণ্য দেখলে মনে হয় বিধাতা সকল প্রকার শান্তি, আনন্দ দিয়ে এই অরণ্যের সৌন্দর্যকে গেঁথেছেন । মুনি গন বললেন- “হে রাম! এই স্থান যত সুন্দর তত ভয়ানক। হিংস্র পশুর থেকেও এখানে হিংস্র রাক্ষসেরা বাস করেন। তুমি তাড়কা, সুবাহু বধ করে মারীচকে দূর করেছো, বিরাধ বধ করেছো এই সংবাদ অবশ্যই খড় আর দূষণ পেয়েছে। তুমি এখানে জানলে সে নিশ্চুপ থাকবে না।” ভগবান রাম বললেন- “হে মহাত্মাগণ আমি চাই তারা এই সংবাদ পাক। তাদের নিধন করে এই অরণ্য থেকে চিরতরে রাক্ষসদের বিদায় করবো। আপনাদের তখন আর কোন ভয় থাকবে না।” মুনি ঋষিরা বললেন- “আমরা জানি আপনি সেই রাক্ষসদের বধের জন্যই নরদেহ অবলম্বন করেছো। সেই খড় দূষণের সাথে প্রবল শক্তিশালী মায়াবী চতুর্দশ রাক্ষস থাকে। তাদের যথেচ্ছ আক্রমণে আমরা বড়ই বিপদে। আপনি শীঘ্র সেই রাক্ষসদের অন্ত করবেন- ইহা আমরা জানি।” এইভাবে মুনি ঋষিরা রাম লক্ষণ কে দিব্যজ্ঞান এর সাথে সাথে রাক্ষসদের অত্যাচারের ঘটনা সব বর্ণনা করলো । এরপর রামচন্দ্র লক্ষণ কে আদেশ দিলেন- “ভ্রাতা! এইস্থানেই কুটির নির্মাণ করো। আমরা এই স্থানেই থাকবো। এই পঞ্চবটি গোদাবরী খুবুই রম্য অরণ্য। দেবী জানকীও এই স্থানে এসে অত্যাধিক প্রীতা হয়েছেন।”

লক্ষণ ও বনবাসীরা মিলে কুটির নির্মাণের আয়োজন করতে লাগলো। মাটি দিয়ে বেদী বানালো। চতুর্দিকে বাঁশ ও শালের কাণ্ড দ্বারা খুঁটি নির্মিত করা হল । খঁড়, বাঁশ দিয়ে ছাউনি বানিয়ে দেওয়াল ও উপরের আচ্ছাদন নির্মাণ করা হল। বাঁশ দিয়ে জানলা, দরজার কপাট নির্মিত করা হল। এইভাবে সুন্দর কুটির নির্মাণ হল। কুটিরের প্রবেশের মুখে কদলী বৃক্ষ রোপিত করা হল। তুলসী, আমলকী, বিল্ব, হরিতকী , আম্র, দাড়িম্ব ও অনান্য পুস্পের বৃক্ষ কুটিরের চারিদিকে রোপণ করা হল । ভগবান রাম মুনি ঋষিদের দ্বারা গৃহ প্রবেশের পূজাদি সম্পন্ন করলেন। যজ্ঞ করলেন মৃগনাভি, কস্তূরী দ্বারা । এই প্রকারে কুটির নির্মাণ হল । কুটিরে বাঁশ দ্বারা খাঁট, তাঁর ওপরে শুকনো তৃন বিছিয়ে শয্যা স্থাপিত হল। এইখানেই রাম, লক্ষণ, সীতাদেবী বাস করতে লাগলেন। প্রত্যহ রাম ও লক্ষণ জঙ্গলে ফলমূলাদি অন্বেষণে যেতেন । মাতা সীতাদেবী বনবালিকাদের সাথে গোদাবরীতে নাইতে যাইতেন। মৃত্তিকার কলসে জল ভরে আনতেন । বনবালিকাদের সাথে সীতাদেবী ক্রীড়া করতেন । বনবালিকারা নতুন সই পেয়ে অতীব প্রীত হয়েছিলো। তারা উত্তম সুগন্ধি পুস্প, মিষ্ট ফল এনে সীতাদেবীকে উপহার দিতেন । সকলের সাথে মিলে সীতাদেবী সেসকল গ্রহণ করতেন । গৃহে ফিরে ফল মূলাদি ভগবান রাম ও লক্ষণকে প্রদান করে নিজে সেবা নিতেন । সাধু সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা চাইতে এলে সীতাদেবী ভিক্ষা দিতেন। সাধু সন্ন্যাসীরা প্রসন্ন চিত্তে ভিক্ষা পেয়ে গমন করতেন । প্রকৃতির সাথে সীতাদেবী একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন । যখন বনে যেতেন দেখতেন বিবিধ রংবেরঙের কারুকার্য শোভিত প্রজাপতি ডানা মেলে প্রকৃতির দেওয়া উপহার পুস্প থেকে পুস্পে উড়ে বেড়াতো। সীতাদেবীকে উজ্জ্বল পুস্প ভেবে ভ্রমে প্রজাপতি কখনো কখনো তাঁর উপর বসতো । মৃগশিশুরা সীতাদেবী যখন ক্রীড়া করতে গিয়ে বনে মাঠে বনবালিকাদের সাথে গল্প করতেন, তখন তাঁর ক্রোড়ে এসে অধিষ্ঠান করতো নিশ্চিন্তে ।

বনবালিকাদের মাঝে মাঝে মনে হতো, নিরাকারা প্রকৃতিদেবীই সাক্ষাৎ সাকারা হয়ে সীতা মূর্তি ধরে এই বনে এসে তাহাদিগের সাথে ক্রীড়া করছেন । ইনি কোন মানবী নয়। স্বর্গের কোন দেবী । নাহলে গাত্রে এত জ্যোতি কেন ? চেহড়ায় এত দ্যুতি কেন ? সমস্ত প্রকার সৌন্দর্য, মধুরিমা একত্রিত হয়ে সীতা রূপে আবির্ভূতা হয়েছে । যখন সীতাদেবী গোদাবরী নদীতে অবস্থান করতেন, মৎস্য রা নির্ভয়ে তার অঙ্গ স্পর্শ করতো নিশ্চিন্ত হয়ে। মনে হতো এই অভয়া দেবী কোন প্রকার ক্ষতি করতে পারেনই না । এঁনার থেকে ভয় কি! পক্ষী কূল মিষ্টি সুরে ক্রীড়াতে যখন ক্লান্ত হতেন জানকী দেবী তখন ছন্দে ছন্দে তারা কলরব করতেন । মিষ্টি সুর, শীতল বন, বিবিধ সুগন্ধি ফুলের ঘ্রানে আমোদিত হয়ে থাকতো দণ্ডকারণ্য । সেই স্থানে এইভাবে বাস করতে থাকলেন রাম, লক্ষণ, সীতাদেবী। ভগবান রামচন্দ্র ও সীতাদেবী নানা দিব্য কথায় রাত্রি জাগরণ করতেন। কুটিরের বাইরে অগ্নি প্রজ্বলিত করে লক্ষণ ধনুর্বাণ নিয়ে সতর্ক পাহাড়ায় থাকতেন । এই ভাবে তাহাদের মিষ্টি মধুর দিন কাটতে লাগলো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বৎসর কেটে গেলো। নয়, থেকে দশ বৎসর তারা এখানেই কাটালেন । বনের পরিবেশে আনন্দ, হাসির সাথে। কিশোরী সীতাদেবী এখন যুবতী । তাঁর সৌন্দর্যে কোটি চন্দ্র একত্রিত হয়েও লজ্জা পাবে। এমনই ছিলো মাতা লক্ষ্মীর রূপ ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ৫ )

সুতীক্ষ্ণ মুনির সাথে রাম, সীতামাতা ও লক্ষণ গমন করতে করতে সুতীক্ষ্ণ মুনির কথিত গল্প শ্রবন করতে লাগলেন । সুতীক্ষ্ণ মুনি বললেন- “হে ভগবন! যে পিপ্পলি বনে আমার গুরুদেব অগস্ত্য মুনির আশ্রম , সেখানে পূর্বে দুই রাক্ষস বাস করতেন । আপনারা সেই কথা শ্রবন করুন।” বহু পূর্বে ইল্বল ও বাতাপি নামক দুই রাক্ষস বাস করতো। সেই মায়াদয়াহীন ভয়ানক রাক্ষস যুগল নিষ্ঠুর ভাবে ব্রাহ্মণ বধ করতেন । সেও ছিলো এক অদ্ভুত রকমের মায়া। যেনো মিছরির ছুড়ি। কোন আক্রমণ, অস্ত্রাদি ছাড়াই । মায়াবিদ্যায় পারঙ্গদ বাতাপি মেষের রূপ ধারন করে থাকতো । ইল্বল রাক্ষস, ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করে আনত । মেষের রূপধারী বাতাপিকে কেটে রান্না করে সেই ব্রাহ্মণকে মাংস ভোজন করাতো। ব্রাহ্মণ অমৃত ভেবে সেই মৃত্যুবিষ গ্রহণ করতো। পড়ে ইল্বল মায়াবিদ্যা দ্বারা বাতাপিকে ডাকলে , বাতাপি সেই ব্রাহ্মণের পেট ফুঁড়ে রাক্ষস দেহে বেরিয়ে আসতো । আর উদর ছিন্ন হয়ে সেই ব্রাহ্মণ ভয়ানক যন্ত্রনা পেয়ে মৃত্যুমুখে ধাবিত হত । এভাবে এখানে ইল্বল ও বাতাপি রাক্ষস রাজত্ব চালাতেন । প্রচুর ব্রাহ্মণ কে সেই দুই রাক্ষস এইভাবে যমদুয়ারে প্রেরণ করেছিলো। যে ব্রাহ্মণ ইল্বলের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতো সে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতো। সে বেঁচে ফিরতো না । একদিবসের কথা । অগস্ত্য মুনি এইস্থানে এসেছেন । অগস্ত্য মুনির দিব্য তেজের কথা ত্রিলোক বিদিত। এক গণ্ডূষে সপ্ত সমুদ্রের জল পান করেছিলেন ।

ইল্বল রাক্ষস তখন বাতাপির সাথে পরামর্শ করে বাতাপিকে মেষ সাজালো। অপরদিকে অগস্ত্য মুনিকে সাদরে বন্দনা জানিয়ে বলল- “হে মহামুনে! আপনার আগমনে আমি ধন্য। কৃপা করে মম গৃহে আপনার শ্রীচরণের ধুলো দিলে আমি কৃতার্থ হবো। হে ব্রাহ্মণ! আপনি কৃপা বশত আজ আমার গৃহে অবস্থান করে, আহার গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করবেন।” অগস্ত্য মুনি সবই জানেন । তিনি রাক্ষসের মায়াতে পা দেবার অভিনয় করে ইল্বলের সাথে গেলেন । অগস্ত্য মুনি বললেন- “বতস্য! আজ আমাকে মেষমাংস আহার করাও ! বহুদিন যাবৎ মেষমাংস আহারের ইচ্ছা ।” ইল্বল খুশীতে ডগমগ । অগস্ত্যের মতো ব্রাহ্মণ তেজস্বী মুনিকে হত্যা করতে পারলে রাক্ষসদের মাঝে সম্মান বৃদ্ধি পাবে। ইল্বল মেষরূপী বাতাপি কে কেটে রন্ধন করলেন। অপরদিকে স্নানান্তে অগস্ত্য মুনি কমণ্ডলু তে গঙ্গা দেবীর আহ্বান করে কদলীপত্র নিয়ে আহারে বসলেন । বললেন- “বতস্য! আমাকে সব টুকু মেষ মাংসই প্রদান করো। লোভ বশে নিজের জন্য সামান্য কিছু রাখলে আমি শাপ দেবো।” ইল্বল কদলী পত্রে অন্নাদি ব্যাঞ্জন ও সবটুকু মেষ মাংস প্রদান করলেন । অগস্ত্য মুনি পরম তৃপ্তি সহকারে ভোজন করতে লাগলেন । একেবারে সব টুকু মেষমাংস আহার করলেন । ইল্বল মনে মনে হাসতে লাগলো। মুনিও “অতি উত্তম রন্ধন” বলে সব ভোজন করলেন । আহারান্তে গঙ্গা জল পান করে মুখশুদ্ধি গ্রহণ করলেন। তখন ইল্বল রাক্ষস এসে “বাতাপি” , “বাতাপি” বলে ডাকতে লাগলো। অগস্ত্য মুনি বললেন- “তোমার সকল ছলছাতুরী আমি জানতাম। তোমাদের বিনাশের জন্যই আমি এখানে এসেছি। বাতাপি আর আসবে না। তাকে আমি খেয়ে হজল করেছি। সে প্রাণ হারিয়েছে। সে আর বেঁচে নেই।” শুনে ইল্বল, অগস্ত্য মুনিকে বধ করতে গেলে মুনি শাপ দিয়ে ইল্বলকে ভস্ম করলেন । সুতীক্ষ্ণ মুনির গল্প শুনতে শুনতে অগ্যস্ত মুনির আশ্রম চলে আসলো। সুতীক্ষ্ণ গিয়ে গুরুদেব অগস্ত্যকে প্রণাম জানিয়ে বললেন- “গুরুদেব! আমার সাথে স্বয়ং দাশরথি রামচন্দ্র ও তাঁহার পত্নী সীতাদেবী ও রামচন্দ্রের ভ্রাতা লক্ষণ এসেছেন।”

অগস্ত্য মুনি রাম, লক্ষণ, সীতাকে স্বাগত জানালেন। ভগবান রাম, জানকী দেবী ও লক্ষণ, মুনি অগস্ত্যকে বন্দনা করে প্রনাম জানালেন । মুনির আশ্রমে যেনো মহা উৎসব আরম্ভ হল। শিষ্য গণ ভগবান রামকে দেখে নিজেদের ধন্য মনে করছিলেন । উত্তম পুস্প দ্বারা ভগবান রামচন্দ্রের পূজাদি করলেন । সুগন্ধি চন্দনের প্রলেপ প্রভুর অঙ্গে প্রদান করলেন। বনের মিষ্টি ফল, গোদুগ্ধ, মধু, কন্দ ইত্যাদি প্রদান করলেন। মুনির আশ্রমে আনন্দ আর আনন্দ । মুনি বললেন- “রঘুবর! আমি জানি আপনি রাক্ষস বিনাশের জন্যই এই অরণ্যে এসেছেন। আপনাকে আমি অস্ত্রাদি বিদ্যা ও দেবতাপ্রদত্ত অস্ত্র প্রদান করিব। বহু পূর্বে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই সব অস্ত্র আমাকে দিয়ে আপনাকে প্রদান করতে আদেশ করছেন।” ভগবান রাম বললেন- “মুনিবর! আপনার থেকে আমি বিদ্যা গ্রহণে ইচ্ছুক। আপনি আমার আজ থেকে গুরু হবেন। গুরু হয়ে আমাকে শিষ্য বানিয়ে ধন্য করবেন।” সেই রাত্রি অগস্ত্য মুনির আশ্রমে সকলে কাটালেন । পরদিবস অগস্ত্য মুনি রামকে দীক্ষা দিলেন । তারপর নানান অস্ত্রাদি বিদ্যা প্রদান করলেন । এরপর রামচন্দ্রকে অনুরোধ জানালেন গোদাবোরী তীরে এই পঞ্চবটিতেই অবস্থান করে যেতে। ভগবান রামচন্দ্র স্বীকৃত হলেন। এখানে ভগবান রামের সাথে জটায়ুর সাক্ষাৎ হয়েছিলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ৪ )

ভগবান রাম এরপর গোদাবরী তীরে রম্য অরণ্যে প্রবেশ করলেন। এখানে তিনি অনেক প্রকার সাধু, সন্ন্যাসীর দর্শন পেলেন । জায়গাটিতে অনেক মৃগ, ময়ূর, বিচিত্র রঙ্গবাহারী পক্ষী অবস্থান করে মধুময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো। এমন জায়গাতে রাম, সীতা দেবী, লক্ষণ কোথাও চার পাঁচ মাস, কোথাও আবার দশ মাস কাটালেন । সাধু, সন্ন্যাসীদের কাছে দিব্য আধ্যাত্মিক কথা শুনলেন। ভগবান সবই জানেন, কারণ তাঁকে কেন্দ্র করেই শাস্ত্র, তিনি কেবল মানব দেহে অবতার নেওয়ার সকল কর্তব্য পালন করছিলেন। মুনি, ঋষি গন আধ্যাত্মিক শাস্ত্রীয় জ্ঞান প্রদান করবার সময় ভেবেছিলেন তাঁরা সকল শাস্ত্রে বর্ণিত সেই বিরাটপুরুষ কেই জ্ঞান দিচ্ছেন, পাছে অপরাধ না হয় এই ভয়ে ভীত ছিলেন । এখানে মুনি ঋষি গণ কেউ বছর ব্যাপী উপবাসী, কেউ কেবল কুম্ভক প্রাণায়ামে বায়ু সেবন, কেউ কেবল ফলমূল সেবন, কেউ কেবল পত্র সেবন করে তপস্যা করছিলেন। কাহারো মস্তকে জটা সমগ্র সর্পিল সর্পের ন্যায় মস্তক থেকে ঝুলছে, কাহারো আবার হস্ত পদের নখ বিশালাকৃতি হয়েছে, কেউ আবার এক পায়ে ভর দিয়ে ঊর্ধ্বমুখে ভগবানকে ডাকছেন, কেউ কেবল বাকল ধারণ করে বৃক্ষের কোটরে অবস্থান করছেন। চতুর্দিকে পাখপাখালীর মধুর কলরবে কেবল বৈদিক মন্ত্রের ছন্দ মানানসই ভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল্ল। কেবল সুখ আর শান্তি। সংসারের কুটিলতা, নগরের কোলাহল , হৈচৈ থেকে অনেক দূরে এই রম্য বণ আপন একটা ছন্দ বানিয়ে নিয়েছিলো। এই ছন্দকে বারংবার বিনষ্ট করছিলো রাবণের আশ্রিত রাক্ষসেরা। মুনি, ঋষিরা ভগবান রামচন্দ্রকে দেখে প্রীত ও প্রসন্ন হলেন। ভাবলেন তাঁহাদের তপস্যার ফল সার্থক হয়েছে। যে ভগবানের দর্শনের জন্য এত কৃচ্ছতা পালন করছিলেন- তা আজ সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি করলো। সকল কিছুই ভগবানের চরণে সমর্পণ করলেন। এরপর রাবণের রাক্ষস কূলের অত্যাচারের বিবরণ করলেন ।

শুনে রামচন্দ্র বললেন- “এখুনি আমি এই রাক্ষস দিগের বিনাশ করবো।” সীতাদেবী বললেন- “প্রভু! এস্থানে অনেক অবলা আর নীরিহ জীব বসবাস করে, আপনি যখন রাক্ষস দিগের সাথে যুদ্ধ করবেন তখন মাঝে থেকে তাদের প্রাণ নাশ হবে। অতএব এইস্থানে আপনি রাক্ষস দিগকে যুদ্ধে আহ্বান জানাবেন না।” ভগবান রামচন্দ্র তখন সীতাদেবীর প্রস্তাব মেনে নিলেন। মুনি গণ বললেন- “হে রামচন্দ্র! এই স্থানেই মহর্ষি অগস্ত্যের শিষ্য সুতীক্ষ্ণ মুনি বসবাস করেন। সে আপনার একান্ত ভক্ত। দয়া পূর্বক আপনি তাঁর আশ্রমে অবশ্যই যাবেন।” ভগবান রামচন্দ্র, সীতাদেবী ও লক্ষণ সেই সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রমে গেলেন। সুতীক্ষ্ণ মুনি যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একবার ভাবলেন এই সকল স্বপ্ন কিনা! পড়ে ভাবলেন স্বপ্নেও রঘুপতির দর্শন অত্যন্ত উচ্চ ব্যাপার। স্বয়ং রঘুপতি কৃপা না করলে এই রকম সৌভাগ্য হবে না। রামচন্দ্রের দর্শন কি ভাবে পেলেন? তিনি তো এত ভক্তসঙ্গ, শাস্ত্রপাঠ করেন নি। এসকল কিভাবে সম্ভব হল? সাক্ষাৎ হরির দর্শন কিভাবে তিনি পেলেন? পড়ে ভাবলেন এসকল প্রভুর অহৈতুকী কৃপা। যার ফলেই এই দর্শন সম্ভব। ভগবান রাম, সীতাদেবী ও লক্ষণ এসে মুনি সুতীক্ষ্ণ কে প্রণাম জানালেন। সুতীক্ষ্ণ মুনি করজোড়ে ভগবান রামচন্দ্রকে প্রনাম জানালেন। ভক্তিভাবে তার অশ্রু জল নির্গত হল। সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে পনসের মতো হচ্ছিল্ল। ভাবে গদ গদ হয়ে মুখের বোল স্ফুরন হচ্ছিল্ল না। অনবরত ক্রন্দন করেই যাছিল্ল। তখন ভগবান রাম মৃদু হেসে খালি সেই মুনি সুতীক্ষ্ণ কে চতুর্ভুজ নারায়ণ মূর্তিতে দর্শন দিয়ে পুনঃ রাম রূপে আসলেন । মুনি ক্রন্দন করতে লাগলেন । বাক্য স্ফুরিত হল। বললেন- “হে রঘুনন্দন ! হে পুরুষোত্তম ! আপনার এই পবিত্র স্বরূপ দর্শনে আমি কৃতার্থ। হে মহাপ্রভু ! আমি কিরূপে আপনার স্তব করবো। আমার বাক্য সকল লুপ্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে আপনার এই দিব্য স্বরূপ দর্শন করতে চাই। হে দয়াময়, আপনার চরণেই সকল তীর্থ। আপনার চরণেই সকল শাস্ত্র। আপনি যেখানে চরণ স্থাপন করেন সেইখানেই অমরাবতী সৃষ্টি হয়। হে করুণাময় ভগবান। আপনার এই ভক্ত সদা সর্বদা হৃদয়ে কেবল আপনাকেই দর্শন করতে চায়।”

অতঃ মুনি সুতীক্ষ্ণ রাম নাম কীর্তন করে ভগবানের সম্মুখে প্রেমে মত্ত হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন। পুস্পাদি দ্বারা অঞ্জলি প্রদান করলেন। মুনির প্রেমাশ্রুতে ভগবানের চরণ সিক্ত হল। ভগবানের বন আগমনের আর একটি কারণ ভক্তসঙ্গ। ভক্তের সঙ্গ স্বয়ং ভগবান নিজেও গ্রহণ করেন, তাই এমন শুদ্ধ ভক্তকে তিনি আপন ধাম বৈকুণ্ঠে স্থান দেন । মুনি ক্রন্দন করে ভাবাবেগে বলতে লাগলেন- “হে মহাবিষ্ণু । আপনি রামচন্দ্র । আপনি অনাদির আদি গোবিন্দ। হে মধুসূদন ! আপনিই মৎস্য অবতারে বেদ উদ্ধার করেছেন, আপনি কূর্ম অবতারে মন্দার পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারন করেছিলেন, আপনি মোহিনী অবতারে দেবতাদিগকে অমৃত প্রদান করেছেন। আপনি বরাহ রূপে দৈত্য বধ করে ধরিত্রী দেবীকে উদ্ধার করেছেন। আপনিই স্তম্ভ থেকে নৃসিংহ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। হে মাধব আপনিই বামন রূপে বলিকে আপনার শ্রীচরণ প্রদান করে ধন্য করেছেন। আপনিই জমদাগ্নিপুত্র পরশুরাম রূপে আবির্ভূত হয়ে ক্ষত্রিয় দিগের উৎপীড়ন হতে ব্রাহ্মণ দিগকে রক্ষা করেছেন। আপনি এখন রাম রূপে। হে শেষনাগশয্যাশায়ী ভগবান বাসুদেব! আমি অধম মূর্খ! বড় বড় যোগীগণ আপনার বন্দনা করে শেষ করতে পারেন না। আপনি সেই বেদে বর্ণিত ব্রহ্ম । হে ভগবান রাম, আপনি মাতা সীতা সহিত, ভ্রাতা লক্ষণ সহিত আমার হৃদয়ে অবস্থান করুন। হে ভগবান আমার ত্রুটি সকল মার্জনা করুন।” এইভাবে মুনি স্তবস্তুতি করলেন। ভগবান তাঁর ভক্তকে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন। সেই দিন তাঁরা তিন জন , ভক্তের আলয়ে কাটালেন। পরদিন সুতীক্ষ্ণ মুনি ভগবান রাম, দেবী বৈদেহী ও লক্ষণ কে গুরু অগস্ত্যের আশ্রমে নিয়ে গেলেন। পথে যেতে যেতে শোনাতে লাগলেন ইল্বল ও বাতাপি নামক দুই রাক্ষসের কথা ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ৩ )

বিরাধ রাক্ষস বধ হতেই সেই ভয়ানক বন আবার সুন্দর হয়ে উঠলো। মুনি, ঋষিদের আশ্রম গুলিতে নিত্য যাগ, যজ্ঞ, তপ আদি ধার্মিক ক্রিয়াকাণ্ড হতে লাগলো। বনবাসীরা আনন্দে বনে বাস করতে লাগলেন। ভগবান রামের বন্দনায় চতুর্দিক ভরে গেলো । রাবণের ভ্রাতা খড় ও দূষণ এই সংবাদ পেয়েছিলো। তারা অবাক হল বিরাধের মতো শক্তিশালী রাক্ষসকে কে বধ করলো।তারা গুপ্তচর প্রেরণ করলো। রাক্ষসেরা মায়া দ্বারা মানব রূপ নিয়ে রামচন্দ্রের অন্বেষণ করতে লাগলো । একদিনের কথা এই তপোবনেই শরভঙ্গ মুনি বাস করেন । মহামুনি একদিন যখন ধার্মিক ক্রিয়ায় মগ্ন তখন দেবরাজ ইন্দ্রদেবতা প্রকট হলেন । মহর্ষি শরভঙ্গ ইন্দ্রদেবতার বন্দনা স্তবস্তুতি করলেন। মহেন্দ্র জানালেন- “হে মুনিবর ! স্বয়ং বিষ্ণুবতার ভগবান রাম সস্ত্রীক ও ভ্রাতা লক্ষণ সহিত আপনার আশ্রমে আসছেন । আপনি বিদিত হয়েছেন ভগবান বিষ্ণু রাক্ষসরাজ দশাননকে বিনাশ করবার জন্যই এই অবতার গ্রহণ করেছেন । প্রজাপতি ব্রহ্মার নির্দেশে আমি আপনাকে ভগবান বিষ্ণুর শার্ঙ্গ ধনুক ও দিব্যাস্ত্র প্রদান করতে এসেছি। আপনি এই সকল ভগবান রামচন্দ্রের হস্তে সমর্পণ করবেন।” এই বলে ইন্দ্রদেবতা শার্ঙ্গ ধনুক ও দিব্যাস্ত্র সকল মুনির হস্তে দিয়ে বিদায় হলেন । বনের প্রাকৃতিক শোভা দর্শন করতে করতে ভগবান রাম, লক্ষণ ও সীতা আসছিলেন । আকাশের মেঘগুলি প্রখড় রোদ্রকিরণ থেকে বাঁচতে তাহাদিগের ওপরে ছত্রের ন্যায় তাঁহাদের সঙ্গেই গমন করছিলো । ভগবানের যাতে কোনরূপ কষ্ট না হয় সেই কারনে প্রকৃতিদেবী বৃক্ষের কোমল পুস্প পথের ওপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন। ফুলের মিষ্ট গন্ধ প্রবাহিত করে পবন দেবতা সেই সুবাস রাম, সীতাদেবী ও লক্ষণের নাসিকায় পৌছে দিচ্ছিল্লেন।

বনের মধ্যে সুরবৃন্দ এইভাবে স্বর্গীয় সুষমা বিস্তার করেছিলেন । এই মধুর পরিবেশ দেখে তিন জনেই প্রীত হলেন। সীতাদেবী ফুলের মাল্য রচনা করে ভগবান রামচন্দ্রের কণ্ঠে পড়িয়ে দিচ্ছিল্লেন। ভগবান রামের সেই পবিত্র তনুর স্পর্শে পুস্পগুলির সৌরভ ও সৌন্দর্য সর্বাত্মক প্রকাশিত হল । পক্ষী কুল নানান রবে সুন্দর মিষ্টি সুর উৎপন্ন করে চারপাশ ভরিয়ে দিয়েছিলেন । কণ্টক বৃক্ষ গুলি তাহাদের সকল কণ্টক সৃষ্টির নিয়ম উলঙ্ঘন করে লুক্কায়িত করেছিলো- যাতে প্রভুর শ্রীঅঙ্গে আঘাত করবার পাপ না গ্রহণ করতে হয়। শরভঙ্গ মুনি পথ চেয়েছিলেন কখন তাঁর আরাধ্যদেবতা এই পথে আসবেন । আশ্রমে আসবার পথ তিনি নিজেই সযত্নে পুস্প মাল্য দ্বারা সজ্জিত করেছিলেন। সেই পুস্পশোভিত কোমোল পথে যখন ভগবানের কমলসম চরণ পতিত হল- যেনো প্রকৃতি আনন্দের লহরী প্রবাহিত করলো। পুস্পগুলি ঝড়ে পড়তে লাগলো ভগবানের যাত্রাপথে। পদ্ম ফুটলে যেমন অলিকুল ধাবমান হয়, ঠিক তেমনি পুস্পগুলি বাতাসে ভগবান রামের দিকে ধাবমান হল। শরভঙ্গ মুনিকে ভগবান রাম, মাতা সীতা ও লক্ষণ প্রণাম জানালেন। মুনির চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রুধারা নির্গত হচ্ছে। আহা! কি রূপ ভগবানের। এঁনারই জন্যই তো এত তপস্যা, এত জপ, এত আরাধনা, এত কৃচ্ছ সাধন, এত যাগ যজ্ঞ। সেই সকল মঙ্গল মঙ্গলের অধিনায়ক ভগবান এসেছেন। মুনির বাক রুদ্ধ হয়ে অবিরত ধারায় অশ্রুজলে সর্বাঙ্গ সিক্ত হল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল- “হে জনার্দন! হে মাধব! আপনি এসেছেন। হে দয়াময় তোমাকে কিভাবে স্তব করবো? তুমি ভক্তের প্রতি এতই প্রীত যে ভক্তের সম্মানের জন্য তুমি প্রণাম জানালে। হে ভগবান! ত্রিলোকে সকলে আপনাকে স্তবস্তুতি করে অবিরত নমস্কার প্রনাম করে। হে রঘুনাথ ! চার বেদ তোমার মহিমা বর্ণনা করেও সমাপন করতে পারে না। পঞ্চমুখে শিব ও চতুর্মুখে পদ্মযোনি ব্রহ্মা, গজারূঢ় দেবেন্দ্র তোমারই মহিমা কীর্তন করেন। আমি কি পুণ্য করেছি জানি না, তবে তোমার অশেষ দয়াতে তোমার দিব্য স্বরূপ দর্শন লাভ করেছি।”

এইভাবে মুনি ভগবান রামের স্তবস্তুতি করে ভগবতী সীতা দেবী ও লক্ষণ ঠাকুরের স্তবস্তুতি করলেন । ভগবান রামের চরণ অভিষেক করলেন । মুনির সেই ভক্তির সেবা, চন্দনের তিলক, বন পুস্প প্রদানে ভগবান রাম অতীব প্রসন্ন হলেন । মুনির বারংবার বাক রুদ্ধ হল। অবিরত অশ্রুধারা নির্গত হল। “রাম” নাম উচ্চারন করে কীর্তন নৃত্য করতে লাগলেন । নিজেকে ধন্য মনে করলেন , কারণ ভগবানের দর্শন অতীব দুর্লভ। সেই ভগবান আজ আশ্রমে। আহা! কত জন্মের তপস্যার ফল। এরপর শরভঙ্গ মুনি ভগবান রামকে দেবেন্দ্র দ্বারা প্রদত্ত শার্ঙ্গ ধনুক ও দিব্যাস্ত্র দিয়ে বললেন- “হে মহাপ্রভু! দেবেন্দ্র আপনাকে এই সকল প্রদান করতে আজ্ঞা দিয়েছেন। আপনি এই সকল গ্রহণ করুন। রাক্ষস বিনাশ সময়ে এইগুলি প্রয়োগ করবেন।” ভগবান রাম প্রসন্ন হয়ে সেই অস্ত্র সকল গ্রহণ করে বললেন- “হে মহামুনি! আপনি আমার ভক্ত। বর প্রার্থনা করুন।” ভগবান রামের মনে এই সময় ভগবৎ সত্তার পূর্ণ বিকাশ হয়েছিলো। মুনি বললেন- “হে ভগবান! আপনার দর্শন লাভ করে যে অপর কিছু প্রার্থনা করে সে নির্বোধ ও মূর্খ। আপনার দর্শনই সর্বাপেক্ষা উত্তম বর। যদি আমাকে দিতে হয় এই আশীর্বাদ করুন যেনো আমার হৃদয়ে আপনি , দেবী সীতা ও লক্ষণ সহিত বিরাজিত থাকেন।” ভগবান রাম তাই বর দিলেন। এরপর মহর্ষি শরভঙ্গ যোগাগ্নি তে আত্মাহুতি দিয়ে ভগবানের শাশ্বত ধাম প্রাপ্তি করলেন। এখানে অনেকে বলবেন যে মুনি এত জ্ঞানী হয়ে আত্মহত্যা কেন করলেন ? প্রথমতঃ যোগবলে যোগীরা যখন প্রাণত্যাগ করেন তখন সেটা আত্মহত্যা বলে না। আত্মহত্যা আর যোগের মাধ্যমে দেহ ত্যাগ এক ব্যাপার না । আত্মহত্যা যে করে সে প্রেতযোনি প্রাপ্ত করে শতবর্ষ ব্যাপী যাতনা ভোগ করে। সেই জন্য আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলা হয়। যে ভগবানের প্রদত্ত জীবন নিজেই নষ্ট করে সে মহাপাপী। আর যোগ একধরনের সাধনা। যোগের দ্বারা কুণ্ডলিনী জাগরিত হয়, তখন যোগীরা এই শক্তির অধিকার হন। যোগীরা কদাপি রেলের তলায়, গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে বা বিষ খেয়ে দেহ রাখেন না। তারা এই যোগশক্তির অবলম্বনে দেহ রাখেন । প্রয়োগ, হরিদ্বার, কাশীতে এখনও এমন যোগীর কথা শোনা যায় যারা এমন যোগের দ্বারা কাল পূর্ণ হলে দেহ রাখেন । আর ভগবান প্রাপ্তির মানব জীবনের চরম উদ্দেশ্য। সুতরাং ইষ্টদেবতার দর্শন পেয়েই মহর্ষি শরভঙ্গ যোগ বলে দেহ রেখেছিলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব – ১২)

রাম, লক্ষণ, সীতাদেবী এসে কুটির বেঁধেছেন চিত্রকূট পর্বতে । অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা চারপাশে বিকশিত । বিবিধ সুগন্ধি পুস্পে ভ্রমর কূল খেলা করছে। সেই বৃক্ষ গুলি সবুজে মোরা। নিত্য তারা বনের মাটিকে সুন্দর ঘ্রানযুক্ত পুস্পে ঢেকে দিতো । সেখানে খেলা করতো বনের হরিণ আদি বিবিধ পশু । এমনই সুন্দর ছিলো চিত্রকূট । লক্ষণ বন থেকে বিবিধ মিষ্টিফল, কন্দ, মধু আহরণ করে আনত । তিন জনে মিলে তাই সেবা নিতো। চতুর্দিকে কেবল শান্তি আর পাখপাখালির কলরব । কোনরূপ হট্টগোল নেই । বনদেবী শ্রীরামচন্দ্রের স্বাগত জানানোর জন্য নানা প্রাকৃতিক শোভার ডালি বিস্তার করেছিলেন । তিন জনে প্রতীক্ষা করছিলেন কবে চতুর্দশ বছর সমাপনের দিন আসবে । এখানে মুনি ঋষি বৃন্দ দেখা করতে আসতেন রামচন্দ্রের সাথে । রাম, লক্ষণ ও জানকী দেবী এই সকল মুনি সন্তদের নিকট আধ্যাত্মিক দিব্যবাণী শ্রবন করতেন । একদিনের কথা ভরত , তিন রানী, শত্রুঘ্ন ও অযোধ্যার অনেক বাসিন্দা, বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ, নিষাদ সহিত গুহক অনেক অযোধ্যার সেনা, হস্তী, রথী , পদাতিক এই স্থানে আসলেন । দূর থেকে ভরত শত্রুঘ্ন ও এত সেনা দেখে লক্ষণ ক্ষিপ্ত হলেন । বললেন- “অগ্রজ! রাজ্য আর সিংহাসন দখল করেও ভরতের তৃপ্তি লাভ ঘটেনি। দেখুন কত সেনা নিয়ে এইস্থানে আসছে। উহার ন্যায় নৃশংস মানব এই ত্রিভুবনে আর নেই। তবে সে এখনও লক্ষণের বিক্রম দেখেনি। আজ তাকে বিনাশ করবো।” ভগবান রাম মৃদু হেসে বললেন- “শান্ত হও সৌমিত্র! ক্রোধ পরিত্যাগ করো ভ্রাতা। ভরত আসছে ঠিকই। কিন্তু সে কি প্রয়োজনে আসছে তা জ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন।”

ভরত এসে উপস্থিত হয়ে সোজা রামচন্দ্রের চরণে পতিত হয়ে অনেক কান্নাকাটি করলো। বলল- “দাদা! ভরতের ওপর অভিমান করে চলে এলে। তোমার স্নেহছায়া থেকে কেন বঞ্চিত করলে? তুমি কিভাবে বিশ্বাস করলে যে রামচন্দ্র থাকতে, ভরত রাজা হবে। ধিক আমাকে। ঐ রকম চিন্তা ভাবনা স্বপ্নেও আমার আসে না। অগ্রজ। বড়ই দুঃখের সংবাদ আমাদের পিতার স্বর্গবাস হয়েছে। তিনি দেহ রেখেছেন।” দশরথ রাজার মৃত্যু সংবাদ শুনে রাম, লক্ষণ, সীতা খুবুই শোক পেলেন। রোদন করতে লাগলেন পিতৃবিয়োগের সংবাদ শুনে । চার ভ্রাতা মিলে নদীতে নেমে পিতার উদ্দেশ্যে জল তর্পণ করলেন । এই মতে সকলে মিলে একে অপরকে সান্ত্বনা দিলেন । ভরত বললেন- “অগ্রজ। তুমি শীঘ্র অযোধ্যা ফিরে চল। পিতা এখন আর নেই। তুমি আমাদিগের অভিভাবক। আমরা তোমার স্নেহছায়াতে জন্ম থেকে বড় হইয়াছি । তোমার ছায়াতলেই থাকতে চাই। তুমি মনে কোন প্রকার ক্ষোভ রেখো না। আমার মা এক কুটিল রমণী। বিষাক্ত ধূমে যেরূপ দমবন্ধ হয়ে জীবেরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তেমনি ডাইনী মন্থরার যুক্তিতে রাণী কৈকয়ী এক নাগিনীর মতো বিষাক্ত ছোবোলে সকল সুখ, আনন্দকে হত্যা করেছে । সেই রাণী কৈকয়ী অযোধ্যাতে থাকলে পিতার আত্মা কদাপি শান্তি পাবে না। আর আমি সিংহাসনে অধিষ্ঠান করলে পূর্বপুরুষ গণ কুপিত হবেন। আমি নিজেও নিজেকে সম্মান করতে পারবো না। অতএব তুমি বৌঠান সহিত ভ্রাতা লক্ষণকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে রাজকার্য চালনা করো। অযোধ্যা এখন অভিভাবকহীন । এই অবস্থায় তোমার ছত্রছায়া অযোধ্যা নগরী কামনা করছে। ” ভরত এই প্রকার বোঝালো । ভগবান রামচন্দ্র বললেন- “ভ্রাতা ভরত। আমি চতুর্দশ বৎসর সমাপন মাত্রই অযোধ্যা গমন করবো। আমি পিতার বচন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। রঘু বংশের কেহ কখনো শপথ ভাঙ্গেনা। এই দাশরথি রাম পিতার বচন ভঙ্গ কিরূপে করবে? মহারানী কৈকয়ী আমার তোমার মাতা। মাতা সম্বন্ধে কুবাক্য প্রয়োগ মহাপাপ। মায়ের আদেশ পালন করা পুত্রের কর্তব্য। আমি আমার মায়ের সেই ইচ্ছাই পূর্ণ করছি। সত্যি এখন অযোধ্যা রাজাহীন। রাজাহীন রাজ্য আর তালাবিহীন সিন্দুক এক সমান । অতএব তুমি রাজ্য পরিচালনা করো।”

ভরত নাছোড়বান্দা । কিছুতেই ফিরে যাবেন না। শেষে ভগবান রাম অনেক বুঝিয়ে রাজী করলেন । ভরত বললেন- “দাদা তোমার যখন এই ইচ্ছা তবে আমিও একটি প্রতিজ্ঞা করছি। চতুর্দশ বৎসর আমিও বনবাসীর বেশে রাজবাটি ছেড়ে বনবাসীর ন্যায় রাজ্য চালাবো। আর তোমার পাদুকা সিংহাসনে স্থাপন করে বনবাসীর ন্যায় ভূমিতে কুশাসনে বসে তোমার নামে রাজ্য পরিচালনা করবো। আমি এই চতুর্দশ বৎসর অযোধ্যার সন্নিকটে নন্দীগ্রামে অবস্থান করবো। তোমারই ন্যায় বনবাসীর মতো এই চতুর্দশ বৎসর কঠোর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে কেবল ফলমূল আহার করে থাকবো। আর চতুর্দশ বৎসর অন্তে তুমি যেখানেই থাকো না কেন, অযোধ্যায় আসতে হবে। এক মুহূর্ত বিলম্ব হলে আমি অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করবো।” ভগবান রাম তাই মেনে নিলেন। এরপর রামচন্দ্র ভ্রাতা শত্রুঘ্নকে বললেন- “তুমি কনিষ্ঠ ভ্রাতা। এই চতুর্দশ বৎসর অযোধ্যার রাজপুরী ও অযোধ্যাকে রক্ষা করবে। জেষ্ঠ ভরতের আদেশ মেনে চলবে। মাতাদের খেয়াল রাখবে।” সেই রাত সকলে রামচন্দ্রের সাথে বনেই কাটালো। নিশি অন্তে সূর্য উদয় হল। ভরত স্নানাদি সেরে আসলো। দু চোখ বেয়ে অবিরত চঞ্চল স্রোতের ন্যায় অশ্রুধারা বহির্গমন হচ্ছিল্ল । বড় ভ্রাতা রামচন্দ্রকে প্রনাম করলো । অতঃ ভগবান রামের পবিত্র পাদুকা দ্বয় মস্তকে ধারন করলো। দেবতারা এই দেখে আশ্চর্য হচ্ছিল্লেন। ভরত জানতো না তাঁর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা স্বয়ং ভগবান । কিন্তু অজান্তে সে ভ্রাতা ভেবে ভগবানের পাদুকা দ্বয় দ্বারা নিজেকে ও নিজের কুলকে পবিত্র করলো। স্বয়ং ভগবানের শ্রীচরণ পাদপদ্ম স্পর্শের জন্য যোগী মুনিরা লক্ষ লক্ষ বছর এক পায়ে দাঁড়িয়ে তপস্যা করেন । দেবতারা এই দেখে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হচ্ছিল । অশ্রুসজল চোখে সকলে ফিরে গেলো। ভরত সেই পাদুকা নন্দীগ্রামে সিংহাসনে স্থাপন করে নিজে কুশাসনে ভূমিতে বসে রোজ পূজা করতো। রামচন্দ্রের নামে নিজেকে রামচন্দ্রের দাস বিবেচনা করে রাজ্য চালনা করতে লাগলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।