০৩ মে ২০১৬

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ২ )

রামচন্দ্র, লক্ষণ ও দেবী বৈদেহী সেই রাক্ষসের জঙ্গল প্রবেশ করলেন । হাড় হিম সেই জঙ্গলে কোনো প্রকার প্রাকৃতিক শোভা ছিলো না। গভীর অরণ্যে দিনের বেলাতেই ঘোর অন্ধকার রাত্রি মনে হচ্ছিল্ল। সেই স্থান এত নিস্তব্ধ ছিলো, যে চরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল্ল। সেখানে বৃক্ষ গুলিতে কোন প্রকার পুস্প বা ফল ছিলো না। কোন পাখীর কলরব শোনা যাছিল্ল না। একটা বিভীষিকাময় পরিবেশ গ্রাস করেছিল এই জঙ্গলকে । এখানে বৃক্ষ গুলিকে দেখলে মনে হয় বৃক্ষ গুলিও অজানা ভয়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে । তারা যেনো এই বৃক্ষ জন্ম থেকে মুক্তি পেতে চায় । বনের মধ্যে দিয়ে নদীনালা গুলো বয়ে চলছিল- সেই ধারাতে কোনো আনন্দের বয়ে চলার ছন্দ ছিলো না। মনে হল অজ্ঞাতে সকল জল এই স্থান দিয়ে নিঃশব্দে বয়ে চলে যেতে চায় । চারপাশে কেবল গৃধ, বাঁদুর ইত্যাদি প্রানী উড়ে বেড়াছিল্ল । আর দেখা গেলো চারদিকে নর মানব ও পশু পক্ষীর অস্থি । কতকাল থেকে পড়ে আছে, অস্থি গুলিতে মৃত্তিকার আস্তরণ পড়ে ছত্রাক গজিয়েছে । অস্থির স্তূপ দেখে সীতাদেবী ভীত হয়েছিলেন, কিন্তু পর মুহূর্তে ভাবলেন রাক্ষস বিনাশক শ্রীরামচন্দ্র যখন সঙ্গে আছেন তখন ভয় পেলে শ্রীরামচন্দ্রকেই অপমান করা হয় । কিছু সদ্য অস্থি মাংসে মক্ষী কূল ভনভন করে উড়ছে । রামচন্দ্র বললেন- “হে জানকী! দেখো অরণ্যের কি ভয়ানক পরিবেশ। পূর্বে তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম অযোধ্যা ফিরে যেতে। এই সকল বনে অনেক রাক্ষস ও হিংস্র জন্তু ভ্রমণ করে।” সীতাদেবী বললেন- “হে নাথ! আপনি স্বয়ং তাড়কা, সুবাহু বধ করেছেন। আপনি যেস্থানে সেখানে আমি নয়ন মুদ্রিত করেও নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারিব।” হঠাত জঙ্গল থেকে ভয়ানক গর্জন শোনা গেলো। সেই গর্জনে মনে হল একটা ঝড় বয়ে গেলো। বৃক্ষ গুলি আন্দোলিত হল।

মানুষের গন্ধ পেয়ে সেই বিরাধ রাক্ষস এগিয়ে আসতে লাগলো। সে যখন চরণ ফেলে আসছিলো- গোটা অরণ্য কম্পিত হচ্ছিল্ল । বিশাল বৃক্ষ গুলিকে এমন ভাবে দুলিয়ে আসছিলো যেনো এক শিশু অনায়েসে ঘাসবন দুলিয়ে আসে। স্তম্ভাকৃতি অতি উচ্চ বট, অশ্বত্থ বৃক্ষ গুলিকে দুলিয়ে সেই রাক্ষস অগ্রসর হয়ে রামচন্দ্রের, লক্ষণের ও মাতা সীতার সম্মুখে আসলেন । সেই রাক্ষসের নয়ন অগ্নির ন্যায় প্রজ্বলিত ছিলো, অতি উচ্চ শরীর মনে হয় মস্তক যেনো গগনে ঠেকেছে। বিকট চেহারার মুখে তীক্ষ্ণ ফলার ন্যায় দন্ত যুগল প্রকাশিত হয়েছিল। হস্তের নখ গুলি এক একটি বৃহৎ তরবারির ন্যায় সর্পিল আকারে ছিলো । পায়ের তলায় বৃক্ষ গুলি পিষ্ট হয়ে চূর্ণ চূর্ণ হয়েছিলো। অতি বিশালাকৃতি সেই দানবকে দেখে সীতা দেবী ভয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল । রাক্ষসের মুখ থেকে মাংস লোভে লালা ঝড়ছিলো, মনে হচ্ছিল্ল বিশাল জলকুণ্ড পতিত হচ্ছে । সেই রাক্ষস রাম আর লক্ষণ কে দুহাতে তুলে ভক্ষণ করতে উদ্যত হলে সীতাদেবী বললেন – “ওরে রাক্ষস! তুমি আমার স্বামী ও দেবরকে ছেড়ে আমাকে ভক্ষণ কর। এঁনাদের ভক্ষণ করলে আমাকে বনে সুরক্ষা দেবে কে?” বিরাধ তখন রাম লক্ষণ কে মাটিটে নামিয়ে সীতা দেবীকে ধরতে গেলে রাম, লক্ষণ যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। বাণে বাণে ছেয়ে গেলো চারপাশ । রাক্ষসের দিকে তীক্ষ্ণ বানাদি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। রাক্ষসের শরীরে বাণ লাগতেই সব বাণ তৃনের ন্যায় চূর্ণ চূর্ণ হল। রাক্ষস পালটা বিশাল বট, অশ্বত্থ , কদম বৃক্ষ তুলে রামচন্দ্রের পাণে নিক্ষেপ করতে লাগলেন । শ্রীরামচন্দ্র বাণ দ্বারা সেই সকল বৃক্ষ চূর্ণ করলেন । চতুর্দিকে বৃক্ষ গুলি চূর্ণ হয়ে পতিত হয়ে স্তূপাকৃতি নিলো। রাক্ষসের নিঃশ্বাসে সেই স্তূপ গুলি চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হচ্ছিল্ল, যেনো প্রলয় ঝড়ে বালুকা দ্বারা চতুর্দিকে আচ্ছাদিত হয়েছিলো ।

তখন ভগবান রামচন্দ্র অর্ধচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণে রাক্ষসের এক হস্ত কাটা পড়লো। রাক্ষসের কাটা হস্ত এভাবে পড়লো যেনো শত বট বৃক্ষ একত্র হয়ে ধরাতলে পতিত হল। চতুর্দিকে কেঁপে উঠলো। সেই কাটা হস্তের তলায় বৃক্ষ গুলি চূর্ণ হল। রক্তধারা উদ্যম লহরীর ন্যায় প্রবাহিত হল । এরপর রামচন্দ্র অনেক দিব্যবাণ প্রয়োগ করলেন। কিন্তু রাক্ষসের অন্ত আর হয় না । এরপর ভগবান রামচন্দ্র ধনুকে ঐষিক বাণ আনয়ন করলেন। বাণ দিয়ে অগ্নির জুয়ালামুখী সৃষ্টি হল। সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন। ঐষিক বাণের আঘাতে বিরাধের মুণ্ড কেটে পতিত হল। যেনো বিশাল উল্কাপিণ্ড ধরাতলে পতিত হল। এরপর বিশাল দেহটা পতিত হল। চতুর্দিক কেঁপে উঠলো। মনে হল কোন গ্রহ এসে বসুমতীর বুকে আছড়ে পড়েছে। রক্তধারার নদী সৃষ্টি হয়ে সবুজ বনভূমিকে রক্তাভ করে দিলো। সেই রাক্ষসের দেহ থেকে এক গন্ধর্ব প্রকট হল। গন্ধর্ব প্রনাম করে বলল- “হে ভগবান! আপনি আমায় মুক্তিদান করলেন। আপনার জয় হোক । পূর্বে আমি তুম্বুরু নামক এক গন্ধর্ব ছিলাম। অপ্সরা রম্ভার রূপে আমি মত্ত ছিলাম। সেই কারণে একদিন আমি কর্মে অবহেলা করলে কুবেরের শাপে এই রাক্ষস দেহ প্রাপ্তি করেছিলাম । ধনপতি কুবের আমাকে বলেছেন, অযোধ্যার সম্রাট দশরথের গৃহে যখন ভগবান নারায়ণ, রাম রূপে অবতীর্ণ হবেন, তাঁরই হস্তে নিধন হয়ে আমার শাপমোচন হবে। হে প্রভু! আপনি আজ আমাকে কৃপা করে মুক্তি দিলেন। আপনার চরণে কোটি কোটি নমস্কার জানাই।” ভগবান রাম বললেন- “হে গন্ধর্ব! তুমি এখন মুক্তিলাভ করেছো। যাও স্বর্গে ফিরে তোমার প্রভুর সেবা করো। আর কদাপি কর্মে অবহেলা করো না।” সেই গন্ধর্ব এরপর স্বর্গে ফিরে গেলেন । বিরাধ রাক্ষসের দেহ লক্ষণ মাটিটে সমাধি দিয়েছিলেন । চারপাশ থেকে মুনি ঋষিরা ভগবান রামের জয় জয়কার করে দর্শন করতে আসলেন। এই অঞ্চলে আর রাক্ষসের উপদ্রব থাকলো না। যারা চলে গিয়েছিলো তারা ফিরে এলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।