১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ১৮ )




রাম, লক্ষণ সীতাদেবীকে খুঁজতে খুঁজতে অনেক এগিয়ে গেলেন। ভগবান রামের বিষণ্ণ অবস্থায় সান্ত্বনা দিচ্ছেন লক্ষণ । রামচন্দ্র ভ্রমর, মৃগ, নদীর মৎস্য, কাঠবিড়ালী, শশক আদি বনজ প্রানী, বিবিধ বৃক্ষকে শোকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন- “তোমরা কি আমার সীতাকে দেখেছো?” কেউ উত্তর দিতে পারলো না। রামচন্দ্র আরোও অগ্রসর হলেন। একস্থানে দেখলেন ভাঙা রথের চক্র, রথের টুকরো, ছত্র, ধনুক ভূমিতে পড়ে আছে। আর দেখলেন সেই স্থানে রক্তে রাঙিয়ে আছে লতাপাতা । তাই দেখে ভয়নাক ভয় পেলেন শ্রীরাম। দুচোখে অন্ধকার দেখলেন। তবে কি সীতা আর বেঁচে নেই? ক্রন্দন করে বললেন- “ভ্রাতা এই স্থানে বোধ হয় যুদ্ধ হয়েছে। রাক্ষসেরা খড়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হয়তো সীতাকে নিয়ে গিয়ে নরমাংস আহার করেছে। হয়তো এই স্থানেই সেই মাংসের অধিকার নিয়ে দুই দল রাক্ষসের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। এই দেখো স্থানে স্থানে কীরিট, অলঙ্কারাদি চূর্ণবিচূর্ণ ভাবে পতিত হয়ে আছে। হে সীতা! আমি তোমাকে রক্ষা করতে অসমর্থ হলাম। আমি এই জীবন আর রাখবো না। এই মুখ কিভাবে দেখাবো?” লক্ষণ সান্ত্বনা দিতে লাগলো। নিকটে দেখলো জটায়ু পক্ষী দারুনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুযন্ত্রনায় পড়ে আছে । লক্ষণ বলল- “দাদা! বোধ হয় ঐ জটায়ু বৌঠাণকে ভক্ষণ করেছে। হায় তিনি আমাদের পিতার সখা হয়েও অযোধ্যার কুলবধুকে ভক্ষণ করলেন। এই জটায়ুকে আর জীবিত রাখবো না।” এই বলে লক্ষণ জটায়ুকে শর বিদ্ধ করতে উদ্যত হলে ভগবান রাম বললেন- “শান্ত হও ভ্রাতা! জটায়ু , সীতাকে পুত্রী জ্ঞান করে। সে কদাপি এরূপ করতে পারে না, আর এ যদি সত্যই সীতাকে ভক্ষণ করে থাকে- তবে একে এমন আহত করলো কে? কে এর পঙ্খ দ্বয় ছেদন করিল?” রাম, লক্ষণ এই বলে সামনে গেলো। রামচন্দ্র জটায়ুর মস্তক নিজ ক্রোড়ে স্থাপন করে বলল- “তাত! তোমার এই অবস্থা কে করিল ? তাহার নাম বল- আমি তাহাকে আজই যমালয়ে প্রেরণ করবো।” জটায়ু বলল- “পুত্র রাম! আমাকে ক্ষমা করো। আমি পুত্রী সীতাকে রক্ষা করতে পারলাম না। লঙ্কারাজ দশানন রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল্ল, আমি বাধা দিয়েও সীতাকে মুক্ত করতে পারলাম না। সেই পাপী আমার এই অবস্থা করে সীতাকে নিয়ে চলে গেছে।”

রামচন্দ্র জটায়ুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল- “রাবণ কোথায় নিয়ে গেছে আমার প্রানের অধিক প্রিয়া সীতাকে?” জটায়ু বলল- “রাবণের রাজ্য কোথায় সে আমি জানি না । কোথায় সে সীতাকে নিয়ে গেছে তাহাও আমি জানি না। শুধু তাঁহাকে আকাশ মার্গে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যেতে দেখেছি । ” রামচন্দ্র বিলাপরত জটায়ুকে সান্ত্বনা দিলেন । জটায়ু বললেন- “হে রাম! আমার অন্তিম সময় উপস্থিত। আমি জানি আপনিই সেই বৈকুণ্ঠের জনার্দন। আপনি অনন্ত নাগশয্যায় শয়ন করে যোগনিদ্রায় থাকেন। হে ভগবান আমাকে মুক্তিদান করুন।” এই বলে জটায়ু বলল-

কোন চিন্তা না করিহ, সম্বর ক্রন্দন ।
জানকীরে উদ্ধারিবে মারিয়া রাবণ ।।
তবো পাদোদক রাম দেহ মোর মুখে ।
সকল কলুষ নাশি যাই পরলোকে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

জটায়ু জানে অন্তিম সময় উপস্থিত। অন্তিমকালে ভগবান রামের পাদোদক পান করলে সকল কর্মের বন্ধন মোচন হয়, আরে গঙ্গার কি প্রয়োজন যিনি নিত্য রামের পাদোদক পান করেন। গঙ্গা তো সেই রামের চরণেই নিবাস করেন । পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তখন তাঁর পাদোদক জটায়ুর মুখে দিলেন । জটায়ু পান করে ভগবান রামচন্দ্রের স্তব করতে লাগলেন-

কর সরোজ সির পরসেউ কৃপাসিন্ধু রঘুবীর ।
নিরখি রাম ছবি ধাম মুখ বিগত ভঈ সব পীর ।।
তব কহ গীধ বচন ধরি ধীরা ।
সুনহু রাম ভঞ্জন ভব ভীরা ।।
...
জাকর নাম মরত মুখ আবা ।
অধমউ মুকুত হোই শ্রুতি গাবা ।।
সো মম লোচন গোচর আগেঁ ।
রাখৌঁ দেহ নাথ কেহই খাঁগেঁ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

জটায়ুর, কৃপাসিন্ধু শ্রীরামের করকমল মস্তকে লাভ করলে , শ্রীরামের অপূর্ব দিব্যদেহ দেখে সকল যন্ত্রনা উপশম হল । জটায়ু স্মিত হাস্য করে বলল- “বেদ বলে মৃত্যুকালে তাঁর নাম মুখে এলে এই অধমও ( মহাপাপীও) মুক্তি লাভ করে ; সেই আপনিই ( শ্রীরামই ) তো আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আর কি জন্য বেঁচে থাকবো?” এই বলে জটায়ু চোখ মুদ্রিত করলো। সারাজীবন পক্ষী – স্বভাববশতঃ অপর প্রানী ভক্ষণ করেছে যেমন ঈগল, বাজ করে। কিন্তু অন্তিম সময়ে ভগবানের পাদোদক পান করে, ভগবানের দিব্য স্বরূপ দর্শন করে সে নিজেই দেবত্ব প্রাপ্ত করলো । জটায়ু দেহ রেখে সেই শ্রীহরির রূপ পেলো। চতুর্ভুজ, শ্যামাঙ্গ, দিব্য পীতাম্বর, দিব্য অলঙ্কারাদি দ্বারা ভূষিত ছিলো । ভগবানের হস্তে যাঁরা নিহত হয়- তাঁরাও মুক্তি লাভ পেয়ে ভগবানের শাশ্বত ধাম বৈকুণ্ঠ প্রাপ্তি করে, কিন্তু যাঁহারা ভগবানের ভক্ত তারা সাক্ষাৎ ভগবানকেই লাভ করে। জটায়ুর দিব্য স্বরূপ লক্ষণ দেখতে না পেলেও ভগবান রাম দেখলেন । করজোড়ে জটায়ু স্তবাদি করছেন-

“হে শ্রীরামচন্দ্র! আপনার জয় হোক! অনুপম সুন্দর আপনি। সগুন শ্রীপ্রভুই আপনিই নিশ্চিতভাবে গুনের ( মায়ার ) প্রেরক । আপনি দশানন রাবণের প্রচণ্ড বাহু সকলকে খণ্ডখণ্ড করবার জন্যই প্রচণ্ড শর ধারন করে থাকেন । জগ সুশোভন , নবজলদশ্যাম তনু , কমলানন , রাজীব আয়তলোচন , আজানুলম্বিত বাহু এবং ভবভয় মোচন কৃপালু শ্রীরামচন্দ্রকে সতত আমি নমস্কার করি । আপনি অপ্রমেয় বল, অনাদি, অজ, অব্যক্ত, অদ্বিতীয় ও এক, অগোচর , গোবিন্দ, ইন্দ্রিয়াতীত , দ্বন্দ্বহারী, বিজ্ঞানঘণবিগ্রহ ও ধরণীর আধারস্বরূপ । আপনি রামনাম মন্ত্র জপকারী সাধুদিগের মনোরঞ্জনকারী । সেই নিস্কামপ্রিয় ও কামাদি দুষ্ট দলনকারী শ্রীরামচন্দ্রকে সতত নমস্কার করি। যাঁকে শ্রুতিসকল মায়াতীত , ব্রহ্ম, ব্যাপক, বিকাররহিত ও অজ রূপে স্তুতি করে থাকে ও মুনি সকল ধ্যান- জ্ঞান- জপ- বৈরাগ্য- যোগাদি সাধনায় যাঁহাকে লাভ করে থাকেন, সেই করুণাঘণ , শোভাপুঞ্জ শ্রীভগবান স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে জড় চৈতন্যময় জগতকে মোহিত করেছেন । আমার হৃদয়কমলের ভ্রমরসম তাঁর অঙ্গসকল সহিত কন্দর্প সৌন্দর্য যুক্ত হয়ে আছেন । যিনি অগম্য ও সুগম দুইই, নির্মল স্বভাব , বিষম ও সম এবং সর্বদা শান্ত ও শীতল, যোগীগণ মন ও ইন্দ্রিয় সকল বশীভূত করে বহু সাধনার পর যাঁর দর্শন পেয়ে থাকেন, সেই ত্রিলোকেশ্বর শ্রীনিবাস শ্রীরামচন্দ্র সতত নিজ ভক্তাধীন হয়ে থাকেন। যিনি পবিত্র কীর্তি ও গতায়াত নিবারণকারী সেই শ্রীপ্রভু সতত আমার হৃদয়ে বিরাজমান থাকুন।” ( তুলসীদাসী রামায়ণ )

পক্ষীর আত্মা দিব্যদেহ লাভ করে দিব্যবিমানে বৈকুণ্ঠের দূতদের দ্বারা সেবিত হয়ে ভগবানের সেই পরমধামে গমন করলো। ভগবান রাম আর লক্ষণ মিলে জটায়ুর অন্তিম সংস্কার করে গোদাবরীতে তর্পণ করলেন ।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।