১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১২ )

রাবণের লঙ্কা পুড়ে ছাই । চতুর্দিকে স্তূপীকৃত ভস্ম থেকে কেবল ধোয়া উঠছে। সে সবের মাঝে রাবণ কপালে হাত দিয়ে বসেছিলো । ক্রোধে তার শরীর কাঁপছিলো। পুত্র হারানোর শোক আর প্রিয় লঙ্কাকে হারানোর শোক উভয়ে তাকে গ্রাস করেছিলো । রাবণ মেনে নিতে পারছিলোই না যে এক সামান্য মর্কট এসে লঙ্কায় এত তাণ্ডব করে চোখ রাঙিয়ে হুমকি দিয়ে গেলো । আর গর্বিতা সীতা সে সকল দেখে আনন্দ প্রকাশ করলো । রাবণকে এসে বৃদ্ধ মন্ত্রী মাল্যবান জানালো যে- “লঙ্কেশ! এবার লঙ্কার পুনঃ নির্মাণের প্রয়োজন। যে কোন ব্যক্তি এই কাজ পারে না। এই লঙ্কা দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা তৈরী করেছে। পুনরায় তাহাকেই এনে নির্মাণ করা হোক।” রাবণ বলল- “দেবতারা আমার দাস। ঐ মর্কট লঙ্কা দহন করে নবগ্রহকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে। দেবতারা আমার দুর্দশা দেখে অবশ্যই হাস্য করছে। যেখান থেকে হোক, বিশ্বকর্মাকে ধরে আনো। যদি আসতে না চায় তাহলে বেঁধে আনো।” মন্দোদরী সেখানে ছিলো। মহারানী সে ভয়ে ভীত ছিলো । সে বলল- “মহারাজ আমি চাই আপনি সুখে রাজ্য করুন । আপনি সীতাকে ফিরিয়ে দিন। এই রাক্ষসদের সর্বনাশ আপনি ডেকে আনছেন কেন?” এই বলে মন্দোদরী বললেন-

রহসি জোরি কর পতি পগ লাগি ।
বোলী বচন তীতি রস পাগী ।।
কম্ভ করষ হরি সন পরিহরহূ ।
মোর কহা অতি হিত হিয়ঁ ধরহূ ।।
সমুঝত জাসু দূত কই করনী।
স্রবহিঁ গর্ভ রজনীচর ঘরনী ।।
তাসু নারি নিজ সচিব বোলাঈ ।
পঠবহু কন্ত জো চহহু ভলাঈ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

মন্দোদরী বললেন- “ হে প্রিয়তম ! আমি করজোড়ে মিনতি করছি । আপনি শ্রীহরির সাথে শত্রুতা করবেন না । আমি সমগ্র রাক্ষস জাতির জন্য হিতের চিন্তা করেই বলছি । তাঁর দূতের কথা ভেবেই রাক্ষসীদের গর্ভপাত হচ্ছে । হে প্রিয় পতি দেব! যদি সত্যই লঙ্কার মঙ্গল চান তাহলে সীতাকে ফিরিয়ে দিন । সীতার কারণে আপনি নষ্ট হবেন । আপনি সীতাকে না ফেরালে ব্রহ্মা ও হর এসেও আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।”

রাবণ দর্পে মত্ত হয়ে বলল- “স্বভাবে নারীজাতি ভীতা হয়। সে সব কিছুতেই কেবল অমঙ্গল দেখে । শূর্পনাখাও তো নারী। সে তো তোমার মতোন ভীত নয়। তুমি ময় দানবের কণ্যা হয়ে এত ভীত কেন ? আমি চাই ঐ ভিখারী, বনের পশু নিয়ে এখানে আসুক । আমি তাদের জন্য মৃত্যুজাল রচনা করে রেখেছি । পিঁপড়ের মতো পিষে মারবো তাদের । আমার আশ্রিত নরমাংস ভোজী রাক্ষসেরা আনন্দে পশুর মাংস ভক্ষণ করবে। একবার যুদ্ধ হতে দাও- দেখবে কপির দলকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারবো।” মাল্যবান অনেক বোঝালো রাবণকে । কিন্তু রাবণ মানেই না । রাবণ মাল্যবানকে অনেক বকাঝকা করলো। এরপর রাবণ শুক আর শারণ নামক দুই গুপ্তচর কে নিয়োগ করলো। বলল- “তোমরা মায়া বিদ্যায় পারঙ্গদ। সর্বদা রাম লক্ষ্মণ আর কপিদের ওপর দৃষ্টি রেখে আমাকে খবর দেবে।” শুক আর শারণ সেই কাজেই লেগে পড়লো । রাক্ষসেরা বীর দর্পে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। একদিনের কথা কুম্ভকর্ণ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে । স্বয়ং নারদ মুনি এসেছেন । নারদ মুনিকে প্রনাম করে কুম্ভকর্ণ অনেক স্তবস্তুতাদি করলো । নারদ বলল- “কুম্ভকর্ণ! এবার তোমার আর তোমার ভ্রাতা রাবণের মুক্তির সময় এসেছে।” কুম্ভকর্ণ বলল – “কিসের মুক্তি প্রভু?” নারদ মুনি বললেন- “কুম্ভকর্ণ স্মরণ করো তোমাদের পূর্ব জন্মের কথা। তুমি আর তোমার ভ্রাতা সত্যযুগে জয়, বিজয় নামে ছিলে। তোমরা ছিলে ভগবান বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠধামের দ্বারপাল । একদা যখন প্রভু বিষ্ণু তোমাদের দ্বার প্রহরাতে রেখেছিলেন সে সময় সনক , সনাতন, সনন্দন , সনৎকুমার নামক চার বাল্য ঋষি বৈকুণ্ঠে এসেছিলেন । তোমরা তাঁদের বিষ্ণু দর্শনে বাধা দিয়েছিলে। তারা ক্রোধে তোমাদের অভিশাপ প্রদান করেন যে তোমরা তিনযুগে ধরিত্রীতে বিষ্ণু বিদ্বেষী হয়ে জন্মে বিষ্ণুর হস্তে নিধন হবে। তারপরে পুনঃ বৈকুণ্ঠে ফিরে আসবে। মনে করো বতস্য।” কুম্ভকর্ণের ধীরে ধীরে সব কিছু মনে পড়লো । সে আর রাবণ আগে দ্বারপাল ছিলো । কুম্ভকর্ণ বলল- “হ্যা দেবর্ষি ! আমার সব মনে পড়েছে।”

নারদ মুনি বললেন- “তুমি আর রাবণ এর পূর্বে হিরণ্যক্ষ আর হিরণ্যকশিপু নামে কশ্যপ মুনির পুত্র ছিলে। কিন্তু তোমরা ছিলে দানব । ভগবান শ্রীবিষ্ণু বরাহ ও নৃসিংহ অবতার গ্রহণ করে তোমাদের বধ করেন । সেই প্রভুই এবার অযোধ্যার স্বর্গীয় রাজা দশরথের পুত্র রাম রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন । যিনি বরাহদেব , যিনি নৃসিংহ দেব তিঁনিই বর্তমানে রঘুপতি শ্রীরামচন্দ্র। তাঁর স্ত্রী রূপে লক্ষ্মী দেবী, সীতা রূপে আবির্ভূতা হয়েছেন । তোমার ভ্রাতা, ভগবান শ্রীরামের স্ত্রীকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে এসেছেন। এবার রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করবেন। এই যুদ্ধে লঙ্কার পতন অবধারিত । তুমিও প্রভুর হস্তে নিহত হবে, পরে তোমার ভ্রাতাও নিহত হবে। তোমাদের শাপ খণ্ডন হবে। তুমি মুক্তির জন্য প্রস্তুত হও।” কুম্ভকর্ণ এভাবে স্বপ্ন দেখলো । অপরদিকে রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ অযূথ সেনা নিয়ে লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যথা-

দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি উত্তরফাল্গুনী ।
শুভক্ষণ শুভলগ্ন শুভফল গণি ।।
দক্ষিণে সবৎসা ধেনু হরিণ ব্রাহ্মণ ।
দেখিলেন রাম বামে শব শিবাগণ ।।
সূর্য্যবংশী নৃপতির নক্ষত্র রোহিণী ।
রাক্ষসগণের মূলা সর্বলোকে জানি ।।
মূলা ঋক্ষ দেখিলেন রোহিণী বড় রোষে ।
সবংশে মরিবে তেঁই রাবণ- রাক্ষসে ।।
চলিল বানর ঠাট নাহি দিশপাশ ।
কটক যুড়িয়া যায় মেদিনী আকাশ ।।
কিলি কিলি শব্দ করি কপিগণ চলে ।
উত্তরিল গিয়া সবে সাগরের কূলে ।।
রহিবারে পাতা লতা দিয়া করে ঘর ।
অবস্থিতি করিলেন সকল বানর ।।
সেই স্থানে রহিলেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
চরমুখে নিত্য বার্তা পায় সে রাবণ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।