১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব –৭)


অক্ষয় কুমার মারা গেছে। লঙ্কার প্রাসাদে এই খবর পৌছাতেই কান্নার রোল উঠলো। রাবণ তাঁর পুত্রের নিথর দেহ দেখে শোকে আছন্ন হল। পড়ে ক্রোধে বলে উঠলো- “যেভাবেই হোক ঐ বানরকে বন্দী করে আমার কাছে নিয়ে আসো। ওকে আমি মৃত্যুদণ্ড দেবো।” অক্ষয় কুমারের মৃত্যু দিয়ে লঙ্কার পতন আরম্ভ হয়েছিলো । মেঘনাদ অস্ত্রাদি নিলেন । দিব্যাস্ত্র সকল তূনে রাখলেন। এরপর বিশাল রাক্ষস সেনা নিয়ে স্বর্ণ রথে উঠে বসলেন । তারপর চললেন অশোক বাটিকার দিকে । দূর থেকে রাক্ষসদের হৈহৈ করে আসতে দেখে হনুমান বিন্দুমাত্র চিন্তিত না হয়ে মনের সুখে ফল খেতে লাগলেন। ঝিলের জল পান করলেন । মেঘনাদ অশোক বাগিচায় ঢুকে দেখলেন ছিন্নভিন্ন অবস্থা। ফুল- ফল ছড়িয়ে ছিটিয়ে নরককুণ্ড করে রেখেছে সেই বানর । সুন্দর সুন্দর পুস্পশোভিত বৃক্ষ গুলো উপরে ফেলেছে। সারা বাগানের সমস্ত সৌন্দর্যকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। রাক্ষস দের মৃতদেহের স্তূপ জমেছে। বলশালী সব রাক্ষস বীরদের অনায়েসে বধ করেছে সেই বানর । কিছু কিছু রাক্ষসের মুণ্ড এমনি ভাবে পিষে গেছে যে চেনাই যাচ্ছে না । মেঘনাদ ক্রোধে গর্জন করে বললেন- “ওরে দুর্মতি ! তোর এই সকল কর্মের ফল ভোগ করবি।” এই বলে মেঘনাদ নানা ঘাতক অস্ত্র প্রয়োগ করলো। নানা ধরণের ঘাতক অস্ত্র বিশাল শব্দ ও বিশাল আলো উৎপন্ন করে মেঘনাদের ধনুক থেকে ছুটে গেলো। কিন্তু দেবতাদের আশীর্বাদে সে সকল বাণ হনুমানের শরীরে পুষ্পসম ঠেকল। অস্ত্রগুলি চূর্ণ হয়ে মাটিতে পড়লো । মেঘনাদ অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলো। ভয়ানক অগ্নিশিখা উৎপন্ন হয়ে হনুমানের কাছে যেতেই নিভে গেলো। মেঘনাদ পবন বাণ নিক্ষেপ করলো। অশোক বাগিচায় যেনো ঝড় উঠলো। কিন্তু পবনপুত্র হনুমানের কাছে যেতেই সেই বাণ মিলিয়ে গেলো। সূচীমুখ, শিলামুখ, গন্ধর্ববান , যক্ষবান , ইন্দ্রাগ্নি, ময়ূরাক্ষী , পর্বত বাণ নিক্ষেপ করলো। কিন্তু কোন অস্ত্রেই কিছু হল না । এরপর মেঘনাদ ভাবলেন কি করা যায়। এই কপি নিশ্চয়ই বড় মায়াবী কেউ হবে। নচেৎ ছদ্দবেশী কোন দেবতা। কোন অস্ত্রেই এর কিছু হচ্ছে না। হনুমান তখন মেঘনাদের সাথে আগত রাক্ষস সেনাদের সংহার করা আরম্ভ করলো। বড় বড় বৃক্ষ উৎপাটন করে রাক্ষসদের পালে নিক্ষেপ করলো। বড় বড় প্রস্তর, ডাব, তাল ইত্যাদি রাক্ষসদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো । রাক্ষসেরা সব অন্ত হতে লাগলো। তখন হনুমান একটি বৃহৎ তাল বৃক্ষ তুলে মেঘনাদের স্বর্ণ রথে নিক্ষেপ করলো। প্রকাণ্ড তালবৃক্ষ কে ছুটে আসতে দেখে মেঘনাদ রথ থেকে লম্ফ দিয়ে নামলো। সেই তালবৃক্ষের তলে মেঘনাদের স্বর্ণ রথ পিষে গেলো।

এখন মেঘনাদ নিরুপায় হয়ে বলল- “ওহে কপি! তুমি বৃহৎ কোন মায়াবী বা ছদ্দবেশী দেবতা যেই হও না কেন- আমি তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্রে বন্ধন করবো। ব্রহ্মাস্ত্র থেকে মুক্তি কেউ পায় না। দেখি তোমার কত মায়া।” এই বলে মেঘনাদ ধনুকে ব্রহ্মাস্ত্র আনয়ন করলো। মন্ত্র পড়ে হনুমানের দিকে নিক্ষেপ করলো। ব্রহ্মাস্ত্রের মুখ দিয়ে প্রলয় সমান অগ্নি নিক্ষেপ হল। চারপাশে প্রলয় ঝড়, বজ্রপাত হতে লাগলো। সমুদ্রের জলে বিশাল ঢেউ উৎপন্ন হল। ব্রহ্মাস্ত্রের তেজে চতুর্দিকে চোখ ধাঁধানো আলো সৃষ্টি হল। হনুমান দেখলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে ব্রহ্মাস্ত্রে তাঁর কোন ক্ষতিই হবে না। কিন্তু তিনি ব্রহ্মাস্ত্রে বদ্ধ না হলে ব্রহ্মার অপমান হবে। প্রজাপতি ব্রহ্মার সম্মান রাখার জন্য তিনি ব্রহ্মাস্ত্র কে স্বীকার করে নিলেন ও রজ্জুবদ্ধ হলেন । মেঘনাদ বিজয়ীর ন্যায় অট্টহাস্য করে বললেন- “চলো! আবার আমার পিতা দশানন তোমাকে উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করবেন।” হনুমান বদ্ধ হয়েছে এই শুনে রাক্ষস রাক্ষসীরা আনন্দে নৃত্যগীত করতে করতে হনুমানকে দেখতে আসলো । ভয়ার্ত হয়ে সীতাদেবী অবিরত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন যেনো হনুমান মুক্ত হয়ে যায়। লঙ্কার রাক্ষসেরা হনুমানকে দেখে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলেন ।মেঘনাদের নামে জয়জয়কার পড়ে গেলো। রাবণ এলেন লঙ্কার রাজসভাতে তে। সেখানে হনুমানকে বন্দী করে আনা হয়েছে । রাবণের সুন্দর রাজসভা এত অনুপম সুন্দর যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সোনা মাণিক্যের দিব্য ঝলকে আলো হয়ে আছে চতুর্দিক । রাক্ষসেরা সমানে হট্টগোল করে হনুমানের জন্য মৃত্যুদণ্ড চাইছিলো। রাবনের সামনে বন্দী হনুমান দণ্ডায়মান । হনুমান বলল- “লঙ্কারাজ! আমি একজন দূত! আপনার রাজ্যে কি দূতকে এই ভাবে দাঁড় করিয়ে বন্দী করে অভ্যর্থনা জানানো হয়? আপনি যদি আমাকে আসন প্রদান না করেন, তবে আমি নিজের জন্যই নিজে একটি আসন রচনা করছি।” এই বলে হনুমান তাঁর লাঙুল বৃহৎ করে পেঁচিয়ে কুণ্ডলী বদ্ধ করে তাঁর ওপর বসলেন । একেবারে রাবণের মুখোমুখি। হনুমানের বিক্রম দেখে রাক্ষসেরা সব হা করে থাকলো । দশানন ভাবল এই কপি কে? একি ছদ্দবেশী দেবতা? নাকি শিবের কোন সেবক। বহু আগে নন্দী শাপ দিয়েছিলো যে নর বানরের হাতে লঙ্কার ধ্বংস হবে- এই কি সে? রাবণ বলল- “তুই কে? কোথার থেকে কেন লঙ্কায় এসেছিস? তোর এত সাহস হল কিভাবে যে আমার বাগান তছনছ করিস, আমার পুত্র ও আমার সেনাদের হত্যা করেছিস?” হনুমান বলল- “ওরে দুর্মতি! যাঁর ইচ্ছাতে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় হয়, যিঁনি এই ব্রহ্মাণ্ড রচনা করেছেন, যাঁর ইচ্ছায় শেষনাগ মস্তকে এই বসুমতীকে ধারন করেন – আমি তাঁরই দাস । যিঁনি দেবতাদের রক্ষা করবার জন্য অবতার গ্রহণ করেন, তোমার মতোন মূর্খকে শাস্তি দিয়ে থাকেন আর কঠোর হরধনুক ভঙ্গ করে থাকেন, খড়- দূষণ- ত্রিশিরা-মারীচ যিনি বধ করেছেন- আমি তাঁরই দাস।” এই শুনে লঙ্কারাজ রাবণ সহ সকলে হাসতে থাকলেন। কিন্তু পড়ে পুত্রের মৃত্যুর কথা মনে হওয়াতে রাবণ হাস্য থামিয়ে ক্রোধী হয়ে বললেন- “ও তাহলে সেই ভিক্ষুক রাম তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? শুনি সেই বনবাসী ভিখারী আমাকে কি বলেছে?” হনুমান বলল- “মূর্খ ! তিনি রাজারও রাজা। তুমি বালির হস্তে পরাজিত হয়েছিলে, সেই বালি নিহত হয়েছেন তাঁরই হাতে। হে লঙ্কেশ আমি বন্দী অবস্থায় আমার প্রভুর সেবা করে যেতে চাই। আমি সীতামাতার কাছে প্রভুর সংবাদ দিয়েছি। আমি ক্ষুধার্ত হয়ে ফল খাচ্ছিল্লাম। সেই অবস্থায় তোমার পুত্র ও তোমার সেনাদের বধ করি। দেখো আমি ভগবান শ্রীরামের তুচ্ছ সেবক হয়েই তোমার এমন সর্বনাশ করে দিলাম। এবার ভাবো তিঁনি যদি অস্ত্র ধরেন, তাহলে তোমার কি দশা হবে?”

হনুমান আরোও বলল- “হে লঙ্কেশ! আমি করজোড়ে বিনীত ভাবে বলছি, প্রভু শ্রীরামের সাথে শত্রুতা করো না। মাতা সীতাকে ওঁনার কাছে পৌছে দিয়ে ওঁনার কাছে ক্ষমা চাও। তুমি মহান পুলস্ত্য ঋষির বংশজ । এভাবে এই পবিত্র কুলে কালিমা লেপন করো না । মন থেকে সকল পাপ, অহঙ্কারকে বিসর্জন দিয়ে ভবভয়হারী শ্রীরামকে মনে অধিষ্ঠিত করো। এই জগতে ‘রাম’ নামই সত্য। বাকী সব অসার। তুমি সেই জগতের সার ‘রাম’ নাম অবিরত জপ করে প্রভু শ্রীরামের শরণ লও । আমি শপথ করে বলছি, রামবিমুখদের এই জগতে কেহ রক্ষা করতে পারে না। ব্রহ্মা ও শিব এসেও তোমাকে বাঁচাতে পারবেন না। অতএব মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” শুনে সকলে অট্টহাস্য করলো। বলশালী রাক্ষসেরা ভাবল তারা এত শক্তিমান হয়ে ঐ তুচ্ছ নরের নাম জপ করবে। আরে নর তো আহার্য। তাকে আবার পূজা? রাবণ দশমুখ দিয়ে অট্টহাস্য করে বলল- “এবার দেখছি আমার এক পরম জ্ঞানী বানর গুরু জুটেছে, যে আমাকে ধর্ম কথা শেখাচ্ছে। ওরে দুষ্ট ! তুই আমাকে কি জ্ঞান দিচ্ছিস? তোর শিয়রে যে কাল উপস্থিত। কিছুক্ষণ পর তুই পৃথিবী থেকে সোজা যমের দক্ষিণ দুয়ারে যাবি।” হনুমান অনেক বুঝিয়ে রাবণকে রাজী করাতে পারলো না। হনুমান বলল- “ঠিক উল্টোটাই হবে দশানন। রামভক্তদের তুই কালের ভয় দেখাচ্ছিস? যাঁর মুখে রাম নাম জপ হয় তাঁকে যম স্পর্শ অবধি করতে পারে না। আমি নয়, বরং তুই যমের দক্ষিণ দুয়ারে যাবি। আর সেই দিনটি ক্রমশঃ সন্নিকটে আসছে। মৃত্যুর পূর্বে ব্যাক্তির বাড়বাড়ন্ত প্রবল হয় বলে শুনেছিলাম। আজ চাক্ষুষ উদাহরণ দেখলাম । বিনাশের আগে মানুষের বিপরীত বুদ্ধি হয়।” হনুমানের কথা শুনে রাবণ ক্রোধে দাঁত কটমট করতে লাগলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।