১৫ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ১৬ )

লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে রাবণ নিজ রাজ্য দেখিয়ে সীতাকে অনেক প্রকারে প্রলোভন দেখাতে লাগলো। বলল- “হে সুমুখী! হে মধুমুখী! এই দেখো আমার এই স্বর্ণ লঙ্কা। দেখো, এই সকল সম্পদ ঐশ্বর্য তোমার। আমাকে বিবাহ করে এই সকল সুখ ঐশ্বর্য ভোগ করো! তোমার ঐ ভিখারী রাম কি দিয়েছে? বনে এনে বহু যাতনা দিয়েছে। এবার এই সকল ভোগসুখে দিন যাপন করো। আমাকে বিবাহ করো। স্বর্গ থেকে ইন্দ্রকে বিতারিত করে সেই ইন্দ্রাসনে তোমাকে আসীনা করবো।” জানকী দেবী ঘৃনায় বললেন- “দুর্মতি রাবণ! ভগবান রঘুবীর ভিন্ন আমার পতি অপর কেউ হতে পারেন না। জন্মে জন্মে আমি কেবল তাঁরই শ্রীচরণের দাসী। আমি এই তনু ত্যাগ করবো কিন্তু তোকে বিবাহ কদাপি নয়। তুই মস্ত বড়ো পাপ করেছিস। এখনও সময় আছে আমাকে আমার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমার স্বামীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। উনি দয়ালু। তোর মতোন নরকের কীটকেও ক্ষমা করবেন। নাহলে তোর সর্বনাশ তাঁরই হস্তে হবে।” রাবণ অট্টহাস্য করতে লাগলো। সেই সাথে সমস্ত রাক্ষসেরা হাস্য করতে লাগলো। এই মূর্খা নারী বলে কি! সেই অরণ্যবাসী দুই যুবক এই লঙ্কায় এসে রাবণের বিনাশ করবে! নিশ্চয়ই সীতা খুবুই ভাবপ্রবণ। ভাবের বশে এই সব বলে রাবণকে ভয় দেখাচ্ছে। রাবণ বলল- “ওহে জনকদুহিতা ! তোর ঐ অরণ্যবাসী স্বামী আর দেবর কদাপি আমার রাজ্যের খবর পাবে না। আর যদিও বা প্রাপ্তি করে তবুও সমুদ্র পার করে এখানে আসা অতি দুষ্কর । আর যদিও বা আসে, আর বেঁচে ফিরবে না- যমের দক্ষিণ দুয়ারে তাদের পাঠিয়ে দেবো। সুতরাং ঐ সমস্ত কাল্পনিক আশায় স্বপ্ন না দেখে আমাকে বিবাহের জন্য সম্মতি প্রদান করো। উত্তম লগ্ন দেখে আমি তোমাকে বিবাহ করবো।” সীতাদেবী মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলেন। ক্রোধে তাঁর মুখমণ্ডল রক্তিম হল। তিনি বললেন- “দুর্মতি দশানন! তুমি আমাকে লঙ্কায় কেন- ব্রহ্মাণ্ডের যেখানেই রাখো না কেন, আমার স্বামী আসবেন। তিনি তোমার এমন দুরাবস্থা করবেন যে তুমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। আর এই সকল রাক্ষস যারা তোমাকে উৎসাহ বর্ধন করছে, তাহাদিগের স্ত্রীদের ললাটে বৈধব্য যোগ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তুমি তৈরী থাকো- লঙ্কার বিনাশ, নিজ পাত্রমিত্রদের মৃতদেহ দেখবার জন্য। আমি যদি সতী হই- তবে আমার অভিশাপে এই লঙ্কা শ্মশান হবে। এখানে বাতাসে আনন্দ উৎসব নয়- ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠবে। তুমিও নিস্তার পাবে না।”

রাবণ রেগে সীতাকে অশোকবনে বন্দী করলো। সাথে বিশাল চেহাড়ার রাক্ষসীদের প্রহরায় রাখলো। মন্দাদোরী , বিভীষণ সকলে এসে অনেক প্রকারে বোঝালো। সীতার অভিশাপ যে ফলতে চলেছে সে জানতো তাঁহারা । তাই তারা শঙ্কিত হল। লঙ্কায় নানা অশুভ চিহ্ন দেখা দিলো। যেমন শৃগাল, শ্বাপদের ক্রন্দন, গর্দভের ক্রন্দন, আকাশে গৃধাদি মাংসাশী পক্ষীর বিচরণ , রক্তবৃষ্টি ইত্যাদি নানা অশুভ চিহ্ন লঙ্কায় দেখা দিলো । অপরদিকে রাম কুটিরে ফিরে দেখলেন সীতা নেই । লক্ষণের রচিত গণ্ডীর বাহিরে ফলমূল সহিত ঝুড়ি পড়ে আছে । রামচন্দ্র সীতাকে খুঁজতে লাগলেন । রামচন্দ্র “সীতা” বলে উচ্চস্বরে সীতাকে আহ্বান করতে লাগলেন। লক্ষণ “বৌঠান” বলে সীতাদেবীকে ডাকতে লাগলেন । কিন্তু কোন প্রত্যুত্তর আসলো না। রামচন্দ্রের মন কু গাইতে লাগলো। রঘুবীর অশান্ত হয়ে ছুটে গিয়ে গোদাবোরী তট, পঞ্চবটির বিভিন্ন পুস্প কানন , ফলের বৃক্ষের বণ, পদ্মপুকুর প্রভৃতি স্থান খুঁজে বেড়াতে লাগলেন । যেখানে যেখানে সীতা যায় সেই সকল স্থানে খুঁজতে লাগলেন । কিন্তু কোথাও সীতা নেই। বহুক্ষণ ধরে তারা সকল জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সীতাকে খুঁজে পেলেন না। রামচন্দ্র বিষণ্ণ হলেন । বললেন- “হে লক্ষণ! কোথায় আমার জানকী? আমি সকল স্থান তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাঁহাকে খুঁজে পেলাম না। সে কোথায় গেলো ? আমাকে বলেছিল সেই স্বর্ণমৃগ ধরে আনতে, বিফল হয়েছি বলে কি সীতা অভিমানে কোথাও চলে গেলো। বলো ভ্রাতা বলো ! কোথায় আমার বৈদেহী?” লক্ষণ কি আর বলবে। সে নিজেও উত্তর জানে না। রাম বললেন- “হে লক্ষণ! দেখো তো আমার সীতা কোন বৃক্ষের আড়ালে আত্মগোপন করে আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন নাকি! নাকি কোন মুনিপত্নীর সহিত সীতা আমাকে না বলে কোথাও বেড়াতে গেলেন- কিন্তু সীতা তো এরূপ করে না। গোদাবরী তীরে যে পদ্মবন আছে সেখানে পদ্মালয়া লক্ষ্মী দেবী কি সীতাকে পদ্মে লুকিয়ে রাখলেন ? সীতা ঐ শশীর ন্যায় তাঁহার অধিক সুন্দরী ছিলো- তাই কি রাহু তাঁকে চন্দ্র ভেবে গ্রাস করেছে? হে লক্ষণ বলো।”

রঘুপতি রামচন্দ্র এই বলে ভূমিতে পতিত হয়ে রোদন করতে লাগলেন। পদ্মের ন্যায় তাঁর নীলমণি নয়ন থেকে নির্গত অশ্রুধারায় সিক্ত হল মেদিনী । ভূমিতে পড়ার দরুন তিনি ধূলাময় হলেন। তিনি বললেন- “রাজ্য হারিয়ে এই বনে এসেছিলাম তবুও রাজলক্ষ্মী হয়ে সীতা আমার সহিত ছিলো। বোধ হয় মাতা কৈকয়ী মনে মনে শাপ দিয়েছেন, তাই সীতা হারিয়ে গেলো। কে সীতাকে উৎপাটন করলো ? সীতা বিনে এই রাম অন্ধকার, সূর্য- চন্দ্র- নক্ষত্রের আলোকেও এই আঁধার দূর হবে না । সীতা বিনা দশদিক আমার কাছে শূন্য। সীতা বীনা আমি মণি হারানো সর্পের ন্যায় অসহ্য জ্বালা বোধ করছি। হে লক্ষণ! আমার জানকীকে এনে দাও।” ক্রন্দনরত রামকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে লক্ষণ নিজেও রোদন করতে লাগলো। বলতে লাগলো- “দাদা! আমাকে দণ্ড প্রদান করো। আমি দোষী! কেন আমি বৌঠানকে একলা রেখে আপনাকে অন্বেষণ করতে গেলাম? কেন বৌঠানের বাক্য অগ্রাহ্য করে এখানে উপস্থিত থাকলাম না ।”রামচন্দ্র তখন গিয়ে বনের পশু, পক্ষী, ফুলকে , বৃক্ষকে প্রশ্ন করতে লাগলো- “তোমরা কি আমার জানকীকে দেখেছো? হে পদ্ম, তুমি কি আমার সীতাকে নিজ মৃণালে লুকিয়ে রেখেছো? হে পক্ষী, তুমি উড়বার সময় কি আমার সীতাকে দেখেছো? হে পুস্প! তোমার দ্বারা সীতা রোজ শৃঙ্গার করতো, আজ কি সে এখানে এসেছিলো? তুমি কি দেখেছো? হে বৃক্ষ তোমরা কি সীতাকে নিজেদের বক্ষে লুকিয়ে রেখেছো রাক্ষসদের থেকে তাকে রক্ষা করবার জন্য? হে মেদিনীদেবী বসুমতী! সীতা তোমার কন্যা। তাঁর দুঃখে তুমি কি তাঁকে নিজ মধ্যে টেনে নিয়েছো? তোমরা নিরুত্তর কেন? চৌদ্দ বৎসর অন্তে আমি কিমুখে অযোধ্যায় ফিরে যাবো ? কি উত্তর দেবো মিথিলাবাসীদের? ” কেউ কোন উত্তর দিলো না। রামচন্দ্র ক্রোধে বললেন- “যদি আমার সীতাকে না পাই তবে ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা এই বসুমতীই ধ্বংস করে দেবো।” এত বলি রাম ব্রহ্মাস্ত্রের আহ্বান করতে গেলে লক্ষণ বাধা দিয়ে বলল- “অগ্রজ! চলুন আমরা বৌঠানের অন্বেষণ করি। ঠিক ওনাকে খুঁজে পাবোই।” এই বলে রামচন্দ্রকে নিয়ে লক্ষণ বেড়িয়ে পড়লো আরোও সামনে ।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।