• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩৪)

মহীরাবণ আকাশ পথে ধীরে ধীরে শত্রু সেনার দিকে অগ্রসর হল। সত্যই দেখে সে কঠিন প্রহরা। অন্ধকারে বানরেরা মশাল নিয়ে ঘুরছে। সতর্ক প্রহরা দিচ্ছে। মনে হয় যেনো অগ্নিগোলা সকল সমুদ্র তটে এদিক ওদিক ঘুরছে। অন্ধকারে কেবল মশাল দেখতে পেলো। লক্ষ লক্ষ মশাল সে চতুর্দিকে দেখতে পেলো। মহীরাবণ এসব দেখে হাস্য করলো। ভাবল এই বনের পশুগুলি তাহার শক্তির ধারনাই করতে পারবে না । রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে বিভীষণ এসে হনুমানকে বললেন- “কেশরীলাল! খুব সতর্কে প্রহরা দেবে। মহীরাবণ মায়াবিদ্যায় পটু। এমন ভাবে সে নিকট আত্মীয়ের রূপ ধরে আসবে, যে কেউ ধরতে পারবে না। রাত্রিকালে নিশাচরদের শক্তি অধিক হয়। কদাপি নিদ্রা যেয়ো না। আর যে কেউ আসুক, প্রভাতের পূর্বে কুটীরে কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না। এমনকি তোমার পিতা পবন দেব আসলেও ভেতরে যেতে দেবে না।” হনুমান বিভীষণকে আশ্বস্ত করলো। জেগে সতর্কে প্রহরা দিতে লাগলো। মহীরাবণ সূক্ষ্ম হয়ে বানরদলে প্রবেশ করলো। কেউ দেখতে পেলো না। বানর দলের ভেতরে ঢুকে প্রতি তাঁবুতে গিয়ে রাম আর লক্ষ্মণকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পেলো না । এক সময় ঘুরতে ঘুরতে সে সত্যই প্রভু শ্রীরামের তাঁবুর নিকটে আসলো। দেখলো এক বৃহৎ মর্কট সেই তাঁবু পুচ্ছ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বসে আছে। এইহেন অদ্ভুদ দৃশ্য দেখে মহী ভাবল নিশ্চয়ই এখানে দুই নর আছে। এই মর্কটই হনুমান। এই ভেবে সে ভাবল লেজ ডিঙিয়ে ঢুকবে। মহী এসে হনুমানের পুচ্ছের বাঁধনের ভেতর ছিদ্র অন্বেষণ করতে লাগলো। সমস্ত তাঁবুর চারপাশে ঘুরেও একটিও ছিদ্র দেখতে পেলো না- যার মধ্য দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায় । এরপর মহীরাবণ মায়া দ্বারা দশরথের রূপ ধরল।

দশরথ হ’য়ে আসি দিল দরশন ।
দশরথ বলে শুন পবন নন্দন ।।
আমার সন্তান দুটি শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সনে করি দরশন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান জানতো যে প্রভু শ্রীরামের পিতা মহারাজ দশরথ বহু আগে পুত্র শোকে স্বর্গ গমন করেছেন। এ নিশ্চয়ই সেই মায়াবী। হনুমান চতুর । বলল- “আপনি একটু দাঁড়ান। বিভীষণ আসুন- তাহার পর প্রবেশ করতে দেবো।” এই বলে হনুমান ভাবল একবার বিভীষণ আসুক, তার পর এই মায়াবীর মাথায় গদার আঘাতে যমালয়ে পাঠাবো। এই শুনে মহীরাবণ পালালো। পুনঃ আসলো ভরতের রূপ ধরে । বলল-

ভরত হইয়া এল হনুমানের কাছে ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দুই ভাই কোথা আছে ।।
চৌদ্দ বর্ষ বনবাসী মস্তকেতে জটা ।
দশরথ রাজার আমরা চারি বেটা ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান বললেন- “ভ্রাতা ভরত! আপনি একটু প্রতীক্ষা করুন। এক মায়াবী নিশাচরের আগমন ঘটেছে। সেবক হয়ে প্রভুকে প্রহরা দিচ্ছি। বিভীষণ আসুন, আমি আপনাকে তাঁবুতে নিয়ে যাবো।” শুনে মহীরাবণ আবার পালালো। এবার আবার বুদ্ধি করে কৌশল্যা রূপ ধরল । সেই হনুমানের কাছে এসে বলল- “হনুমান! দ্বার উন্মোচন করো। চৌদ্দ বর্ষ পুত্রের মুখ দেখিনি। এই অভাগী মায়ের প্রাণ ফেটে যাচ্ছে। একবার পুত্রকে দেখি। পথ ছাড়ো বাছা!” হনুমান বুঝলো এও সেই মহীরাবণের মায়া। বলল- “মাতা! আপনার পুত্রের প্রাণ সঙ্কটে। কৃপা করে প্রভাত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বিভীষণকে আসতে দিন। হয়তো আপনার সাথে সাথে সেই দুষ্ট ঘাতক প্রবেশ করতে পারে।” দূর থেকে বিভীষণকে আসতে দেখে কৌশল্যারূপী মহীরাবণ দাঁত কটমট করে পালালো। এবার সেই মহীরাবণ জনক রাজার রূপ ধরল। ‘হাঁ সীতা’ বলে রোদন করতে করতে এসে বলল-

জনক বলেন শুন পবন নন্দন ।
রাম সঙ্গে আমার করাহ দরশন ।।
আমার জামাতা হন শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
চতুর্দশ বর্ষ গত নাহি দরশন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

জনক রাজাকে দেখে হনুমান বুঝলো আবার মহীরাবণ এসেছে। হনুমান বিনয় সহ বলল- “বিভীষণ আসুন। আমি তারপর আপনাকে প্রবেশ করতে দেবো। এখন নয়। আপনি এখন বিশ্রাম গ্রহণ করুন।” মহীরাবণ পুনঃ পালালো। সে বুঝলো হনুমানকে এইভাবে ভুলিয়ে রাম লক্ষ্মণকে হরণ করা অসম্ভব । আর এখানে এখন যুদ্ধ করা যাবে না। হনুমান অনেক শক্তি রাখে। এইভেবে মহীরাবণ ভাবল এবার কূট বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। যেই ভাবে অমনি মাথায় বুদ্ধি এলো । মহীরাবণ মায়া দ্বারা একটি সুড়ঙ্গ রচনা করলো। সে ভাবল ভেতর দিয়ে গিয়ে সেই দুই ভ্রাতাকে পাতালে নিয়ে যাবে। হনুমান কিছুই বুঝবে না। সে ত বাইরে প্রহরায়। আর পাতালে সে প্রবেশ করতে পারবে না। এই ভেবে হাসতে হাসতে মহীরাবণ পাতালে প্রবেশ করলো। তারপর সুড়ঙ্গ দিয়ে ভগবান রাম ও লক্ষ্মণের তাঁবুর মাটি খুঁড়ে উঠলো। দেখিলো দুভাই পরম যত্নে শয়ণ করছে। শরীরে নানা ক্ষত্রিয় চিহ্ন দেখতে পেলো। মহীরাবণ তখন ইষ্টদেবী পাতালভৈরবীর স্মরণ করে ধূলিপোড়া নিক্ষেপ করলো। তাহার ফলে রাম ও লক্ষ্মণ গভীর ঘুমে চলে গেলো। মহীরাবণ অতি সতর্কে তাহাদের দুজনকে দুস্কন্ধে ধারণ করলো। বিন্দু মাত্র শব্দ না করে রাম লক্ষ্মণকে নিয়ে সোজা চলে গেলো পাতাল পুরী। ওদিকে হনুমান প্রহরা দিচ্ছে। বিভীষণ এসে মাঝে মাঝে দেখে যাচ্ছে। প্রভাত হল। কিন্তু প্রভু শ্রীরাম আর কুটির থেকে বহির্গমন করেন না। সকলে দেখতো প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ প্রত্যহ অতি প্রভাতে উঠে সমুদ্রে স্নান, সূর্য দেবতাকে জল অর্পণ করতেন। কিন্তু আজ আর কেহই বের হলেন না। সকলে আশ্চর্য হল। হনুমান পুচ্ছ বাঁধন মুক্ত করলো। কুটিরে প্রবেশ করে দেখতে পেলো ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ কেহই নেই। সকলে অবাক হল ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩৩)



মহীরাবণ এরপর মাতা মন্দোদরীকে প্রণাম করে বলল- “মাতা! আমি আপনার গর্ভ হতে জনম নেবার সৌভাগ্য প্রাপ্ত করিনি । কিন্তু মাতঃ! আমি আপনাকেই মাতা বলে জানি। বিপদের সময় কেন আমাকে স্মরণ করলেন না? আমার ভ্রাতা, তাত একে একে সবাই নিহত হয়েছে। শুনেছি কাকা বিভীষণ সেই শত্রু দলের সাথে মিলেছে। কেন মাতঃ! আমাকে একটিবার সংবাদ দিলেন না। আমি থাকলে আমার ভ্রাতারা কেউ নিহত হতেন না। কবে সেই রাম, লক্ষ্মণের শব এনে লঙ্কায় রেখে দিতাম।” মন্দোদরী বলল- “পুত্র মহী! আমি তোমাকে কদাপি আলাদা জ্ঞান করিনি। নিজ পুত্র মেঘনাদের ন্যায় দেখি তোমাকে। তাই বলছি পুত্র, তুমি এই যুদ্ধে অংশ কদাপি নিয়ো না। এই যুদ্ধের ফল কেবল রাক্ষস জাতির ধ্বংস। আর তোমার পিতার দম্ভ একে একে বলশালী রাক্ষসদের যমের দুয়ারে প্রেরণ করেছে। পুত্র তুমিই এখন কেবল বংশজ। তোমার কিছু হোক আমি চাই না। তুমি বরং পাতালে ফিরে যাও। তোমার পিতার কথা শোনার অর্থই যমের পদধ্বনি শ্রবণ করা। তুমি সেই ভুল করো না।” এই বলে মন্দোদরী, মহীকে বোঝালো। মহী বলল- “মাতাঃ! আপনি এই পুত্রের বিক্রম দেখেন নি। আমি যে কি করতে পারি, তা রাম, লক্ষ্মণ ত দূর- কাকা বিভীষণ অবধি বুঝতে পারবেন না। আমি লঙ্কায় খুব কম সময় এসেছি, তাই কাকা বিভীষণ আমার দুর্বলতার কথা জানেন না। আর এটাই আমার কাছে মহাস্ত্র। এমন ভাবে রাম লক্ষ্মণকে বধ করবো যে গোলকধাঁধার মতো বানরেরা কেবল খুঁজে যাবে কিন্তু পাবে না। পাতালে প্রবেশ করা সহজ কর্ম নয়। তাহা দেবতাদেরও অসাধ্য।” মন্দোদরী বলল- “পুত্র! তোমার ন্যয় এমন অনেকেই বলেছিল । তারা কিন্তু কেউ সফল হয় নি। কারণ শ্রীরাম অজেয়। তাঁহাকে পরাজিত কেউ করতে পারে না। তাই বলছি এই মুহূর্তে সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।” রাবণ আবার ধমক দিয়ে স্ত্রীকে শান্ত করলো। তাহার পর শ্রীরামকে গালাগালি দিয়ে নিবৃত্ত করলো। মহীরাবণ দর্প করে নিজের শক্তির কথা বলছিল। মন্দোদরী বলল- “পুত্র মহী! মনে হচ্ছে এবার আমাদের মুখাগ্নি করার জন্য সত্যই কেউ থাকবে না। কারণ শ্রীরামের সাথে শত্রুতা স্থাপন করে তুমি নিজের বিনাশকেই আহ্বান করলে।” এই বলে মন্দোদরী প্রস্থান করলো।

রাবণ বলল- “মহী! তোমার পরিকল্পনা কি?” মহী বলল- “পিতা! আপনি জানেন যে আমি পাতালভৈরবীর উপাসক। আমি একজন তন্ত্রসিদ্ধ। দেবীর কৃপায় নানা রকম সিদ্ধ মন্ত্র আমার করায়ত্ত । আসছে অমাবস্যায় আমি রাম লক্ষ্মণকে পাতালে নিয়ে বলি দেবো পাতাল ভৈরবীর চরণে। শুনেছি রাম ও লক্ষ্মণ অযোধ্যার সম্রাট দশরথের পুত্র। তাহারা জাতিতে ক্ষত্রিয়। আর ক্ষত্রিয় ব্যক্তি বলির জন্য প্রশস্ত। দেবীকে রাজরক্তে অভিষেক করিয়ে আমি মহাশক্তি প্রাপ্ত করবো।” রাবণ বলল- “পুত্র! তুমি তাহাদের বলি দাও আর হত্যা করো- যেমন মন চায় তাই করো। কিন্তু এই আপদদিগকে লঙ্কা থেকে বিতারিত করো। কিন্তু খুব সাবধান- ঘরের শত্রু বিভীষণ গিয়ে এখন তাদের দলে মিশে সব কিছু বলে দিচ্ছে। এই অবস্থায় রাম লক্ষ্মণ কে পাতালে নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়া সহজ কাজ নয়।” মহী বলল- “পিতা! তারা কেবল মায়ার খেলা দেখেছে, কিন্তু তন্ত্রের ক্ষমতা দেখে নি। এ মায়া নয়। বিশাল এক মায়াজাল। এর থেকে উত্তীর্ণ হওয়া সহজ নয়। এমন ভাবে হরণ করবো, যে তাঁরা নিজেরাও আশ্চর্য হবে।” এই শুনে রাবণ আর মহী উভয়ে হাস্যাদি করতে লাগলো। অপরদিকে বানর শিবিরে তখন বিভীষণ, হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, শ্রীরাম, লক্ষ্মণ ও বানর সেনারা আলোচনা করছিলেন । ভগবান রাম বললেন- “বিভীষণ! লঙ্কায় আর বড় কোন বীর বেঁচে নেই- তাইতো?” বিভীষণ বলল- “প্রভু একজনই বেঁচে, আর তিনি হলেন আমার অগ্রজ দশানন। কিন্তু আরোও একজন আছে, যে বীরের বীর। ছলাকলায় পটু । সে হলেন অগ্রজ রাবণের মানস পুত্র মহীরাবণ। সে পাতালে থাকে। পাতালভৈরবীর উপাসক সে। আর একজন তন্ত্র সিদ্ধ। সে লঙ্কায় খুবুই কম আসে। তাই তার সম্বন্ধে বিষদ ভাবে আমিও জানি না। শুধু এইটুকু জানি সে তন্ত্র দ্বারা এমন সব অসাধ্য সাধন করতে পারে, যা কেহই উপলব্ধি করতে পারে না।”

শুনে বানরেরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। সকলে অবাক হলেন। বিভীষণ বললেন- “প্রভু! এই বীর মহীরাবণ কদাপি সম্মুখ সমরে আসবে না। কারণ সে জানে এতে সে জয়ী হবে না। সে এমন কিছু তান্ত্রিক ক্ষমতার বিস্তার করবে, যা কেহই বুঝতে পারবে না, কিন্তু তাঁর কার্যসিদ্ধি হবে । এই মহীরাবণ কখন কোথায় কিভাবে আঘাত হানবে কেউই জানে না। আমি আমার চর মারফৎ সংবাদ পেয়েছি মহীরাবণ এসে আমার অগ্রজ দশাননের সাথে দেখা করেছে। এবার নিশ্চয়ই মহীরাবণ কিছু করবে। পাতালে মহীরাবনের পুত্র অহীরাবণ থাকে । সেও পিতার ন্যয় পরাক্রম রাখে। উভয়ে নরবলি দিয়ে পাতালভৈরবীর উপাসনা করে।” এরপর বিভীষণ হনুমানকে বললেন- “পবনপুত্র! তুমি প্রভুর একনিষ্ঠ সেবক। এবার তোমাকে প্রভুর সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ করে প্রভু ও লক্ষ্মণ ঠাকুর যখন শয়ন করবেন। কারণ মহীরাবণ কখন কোথায় কার ছদ্দবেশে এসে মায়া বিস্তার করে- তা কেও জানে না। মারীচ অপেক্ষাও সে অধিক রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে ।” বানর শিবিরে সত্যই মহীরাবণের আতঙ্ক বিস্তৃত হল। রাত্রিকালে প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ একটি কুটিরে শয়ন করলেন। চারপাশে কড়া প্রহরা দেওয়া হল। হনুমান করলেন কি , তাঁর লাঙ্গুল বিশাল করলেন। তার পর সেই লাঙুল দিয়ে প্রভুর কুটিরকে আস্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে রেখে দিলেন । যাহাতে একটি পিঁপড়ে অবধি না প্রবেশ করে। হনুমান বলল- “এই আমার পুচ্ছ ডিঙিয়ে কেউ এই কুটিরে প্রবেশ করতে পারবে না। দেখি কিভাবে মহীরাবণ আসে। আসলেই গদার আঘাতে যমালয়ে প্রেরণ করবো।” বানেররা সব গদা নিয়ে চারদিকে প্রহরা দিতে লাগলো। কেউ কেউ মশাল জ্বালিয়ে প্রহরা দিতে লাগলো। হনুমান সেই অবস্থায় বসে থাকলো। অপরদিকে মহীরাবণ সব কিছু দেখে হাস্য করছিলো ।

( ক্রমশঃ )

Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩২)


রাবণ হন্তদন্ত হয়ে অশোক বনে আসছে দেখে রাক্ষসীরা সব উঠে দাঁড়িয়ে রাবণকে প্রনাম জানালো। রাবণের পেছন পেছেন মন্দোদরী রাবণকে বাধা দিতে আসলো। বলতে লাগলেন- “এমন অনর্থ করবেন না। নারী হত্যা অতি নিন্দনীয় কাজ।” সীতাদেবী পুনঃ রাবণের আগমন শুনতে পেয়ে মস্তকে ঘোমটা দিয়ে হস্তে দূর্বা ধারণ করলেন। রাবণ বলল- “সীতা! তোমার কারণেই রাম আমার পুরী থেকে রাক্ষস শূন্য করেছে। তোমাকে উদ্ধার করতেই সেই রাম, বানর সেনা নিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করেছে । একের পর এক আমার পুত্রেরা নিহত হয়েছে। আমার নাতিরা সব নিহত হয়েছে। আমার অনুগত বীর প্রতাপী রাক্ষসেরা নিহত হয়েছে। এই সব হয়েছে তোমার কারণে । আজ তোমাকে হত্যা করে আমি মনের সব ক্ষোভ দূর করবো। মেঘনাদ মায়া সীতা বধ করেছে, আমি আসল সীতাকেই বধ করে সেই দেহ রামকে উপহার দেবো।” সীতা বললেন- “দাম্ভিক রাবণ! এত ক্ষয়ক্ষতি দেখেও তোর চেতনা লাভ হয়নি? পরাজিত ব্যক্তির এত ক্রোধ শোভা পায় না। অবশ্য তোর ন্যয় ভীরু ব্যক্তি এর থেকে কি আর করতে পারে ? যে সাধুর বেশে স্বামীর অনুপস্থিতিতে পরস্ত্রী হরণ করে, যে নকল মূর্তি নির্মাণ করে যুদ্ধে জিতবার প্রয়াস করে, তাহার ন্যয় ভীরু ব্যক্তি কেবল স্ত্রী বধই করতে পারে। কারণ ভীরু ও দুর্বল ও শক্তিহীন ব্যক্তি কদাপি যুদ্ধে বীর যোদ্ধাকে পরাজিত করতে পারে না। আমাকে হত্যা কর। আমি ত এই পাপপুরী থেকে মুক্তি পেতেই চাই। কি জীবন্ত অবস্থায় কি মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মা হয়ে। এই লঙ্কার বাতাস আমার কাছে বিষাক্তসম । এই সুন্দর অশোক বাগিচা আমার কাছে যমালয় তুল্য । রঘুনাথের বিহনে এক একটি ক্ষণ আমার কাছে শত বৎসর তুল্য। তুই বরং আমাকে হত্যা কর।” সীতা এই সকল কথা বলে ক্রোধ মূর্তি ধারণ করলেন। রাবণ সীতার মধ্যে সেই বেদবতীকে দেখলেন। বহু পূর্বে বেদবতীকে হরণ করতে গেলে বেদবতী যজ্ঞে ঝাঁপ দেন। রাবণ বলল- “তাই হোক! তোকে এত দিন বাঁচিয়ে রাখাই আমার ভুল। এই কাজ আগে করলে এত বীরের পতন হতো না।” এই বলে রাবণ খড়গ তুলল।

মন্দোদরী কহিতেছে করি যোড়হাত ।
পরম পণ্ডিত তুমি রাক্ষসের নাথ ।।
শ্রীবিশ্রবা পিতা তব সংসারে পূজিত ।
তোমার এ নারীবধ না হয় উচিৎ ।।
একে দেখ মজেছে কনক লঙ্কাপুরী ।
পাপেতে ম’জ না তাহে বধ করে নারী ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

মন্দোদরী বললেন- “প্রভু! আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত! আপনি ব্রহ্মার বংশজ শ্রী বিশ্বশ্রবা মুনির তনয় । আপনি তো জানেন নারী হত্যা নিকৃষ্ট কর্ম। সীতাকে হরণ করে পূর্বেই আপনি অনেক অপযশ প্রাপ্ত করেছেন। এর ওপর সীতাকে বধ করলে জগতে আপনার অনেক কলঙ্ক হবে। এই হেন পাপ কর্ম করবেন না। আপনার চরণে অনুরোধ জানাই।” রাবণ বলল- “তুমি বাঁধা দিও না মন্দোদরী। এই সকল কথা বলে আজ আমাকে আটকাতে পারবে না। এই জগতে যে বা যারা তার মুখদিয়ে আমার নামে কলঙ্ক ব্যখান করবে, তাহাদিগের মস্তকটাই আমি ছিন্ন করে দেবো। দেখবো কার কত সাহস। আমার মনে পুত্র হারানোর শোক থেকে ক্রোধের জন্ম হয়েছে। এই সীতাকে হত্যা করলেই এই ক্রোধ প্রশমিত হবে।” এই বলে রাবণ খড়্গ উত্তোলন করে সীতাকে কাটতে গেলো। মন্দোদরী তখন রাবণের চরণে পতিত হল। বলল- “প্রভু! যদি সীতার অঙ্গে একটিও আঘাত লাগে, তাহলে আপনার চরণের শপথ রেখে প্রতিজ্ঞা করছি আমি নিজেও জীবন রাখবো না। সমুদ্রে ঝাঁপ দেবো। তখন না থাকবেন সীতা, না থাকবো আমি। তখন আপনি তখন যা ইচ্ছে করে বেড়াবেন।”

মন্দোদরীর এই রকম মূর্তি দেখে রাবণ নিবৃত্ত হল। খড়্গ নামিয়ে চলে এলো। ব্রহ্মার বরে রাবণ এক মানস পুত্র লাভ করেছিলো। তার নাম মহীরাবণ। সে পাতালে থাকতো । পাতালভৈরবীর উপাসনা করতো। পাতালভৈরবী , দেবী জগদম্বার একটি প্রকাশ। এঁনার পূজো খুব একটা দেখা যায় না। কেবল বীরাচারী তন্ত্র সাধকেরা তন্ত্র মতে এই দেবীর পূজো করেন। দেবী সতী দক্ষযজ্ঞে যেতে বাঁধা পেয়ে মহাদেবের সামনে দশমহাবিদ্যা রূপে প্রকটিত হন। সেই দশ দেবীর একজন হলেন ভৈরবী । ভৈরবী দেবীর একটি রূপ হলেন পাতালভৈরবী। পাতালভৈরবীর দু রকম মূর্তি দেখা যায়- একটি যক্ষিণী মূর্তি, অপরটি কালিকা দেবীর ন্যায়। যক্ষিণী মূর্তি অতি বিকট। ভৈরবীর উপাসনা খুবুই কঠিন । তন্ত্র সাধকেরা খুবুই তান্ত্রিক আচার বিধান মেনে এই দেবীর উপাসনা করেন। যাই হোক মহীরাবণ পাতালে এই দেবীর পূজা করতেন। পাতালেও রাক্ষসদের সাম্রাজ্য পৌছে গিয়েছিলো মহীরাবণ আর তার পুত্র অহীরাবণের শক্তিতে । রাবণ লঙ্কায় বসেছিলেন। সেনারা এসে জানালো মহীরাবণ আগমন করেছে লঙ্কায় । রাবণ তাকে ডেকে নিয়ে আসলো। মহীরাবণ এসে পিতাকে প্রণাম জানিয়ে বলল- “পিতা! আমি আপনার মানস পুত্র বলেই কি আমাকে এত দূরে রেখেছেন। লঙ্কার এত সর্বনাশ হল। একবারও আমাকে সংবাদ দিলেন না? আমার ভ্রাতারা সব বীরগতি প্রাপ্ত করেছে। এই শুনে কষ্টে আমার প্রাণ যায়। কেন আমাকে সংবাদ দিলেন না? আমি কি এতই পর হয়ে গেলাম পিতা? আমার সব ভ্রাতারাও কি একটিবার আমাকে স্মরণ করলেন না? কারণ আমি আপনার মানস পুত্র দেখে? কেন আমাকে সংবাদ পূর্বে দিলেন না? ” এই বলে মহীরাবণ রোদন করতে লাগলো । রাবণ সব বলতে লাগলেন। শূর্পনাখার নাসিকাচ্ছেদ, সীতা হরণ, বালি কে নিহত করে রামচন্দ্র ও সুগ্রীবের মিত্রতা, হনুমানের লঙ্কায় আগমন ও লঙ্কা দহন , রামের বানর সেনা নিয়ে সেতু বন্ধন করে লঙ্কায় আগমন, যুদ্ধে রাবণের সব পুত্র, নাতিদের নিহত হওয়ার সংবাদ- সব কিছুই বললেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩১)

এরপর ভগবান শ্রীরাম বললেন- “প্রমীলা ! তুমি মহাসতী নারী। তোমার স্বামীর প্রাণ হরণ করতে যমদেবতা সাহস করেন না। পাছে তোমার শাপে তিনিই না ভস্ম হন। তুমি বীরপ্রতাপী মেঘনাদের অন্তিম সংস্কারের আয়োজন করো।” প্রমীলা স্বামীর শির আঁচলের তলায় আচ্ছাদন করে লঙ্কায় প্রবেশ করলেন। অশোক বনে গেলেন। যেখানে বন্দিনী সীতাদেবী ছিলেন। তিঁনিও ত্রিজটার কাছে মেঘনাদের নিধন সংবাদ পেয়েছিলেন । কিন্তু তিনি জানতেন প্রমীলা সতী নারী। যখন প্রমীলা তাঁর নিকটে গেলেন, তখন সীতাদেবীর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ছিলো। জানকী দেবী বললেন- “প্রমীলা! তোমাকে সান্ত্বনা প্রদান করবার ভাষা আমার কাছে নেই। সেই ধৃষ্টতা নেই। কারণ আমার দেবর তোমার স্বামীর প্রাণ হরণ করেছে। তুমি চাইলে আমার সাথে শত্রুসম আচরণ করতে পারো।” প্রমীলা তখন রোদন করে প্রথমে এসে সীতাদেবীর চরণে প্রণাম করলেন। বললেন- “মহা সতীর চরণে প্রণাম জানিয়ে সেই পরম সৌভাগ্য আমি লাভ করলাম। আমার কি সাধ্য সতী নারীর ক্ষতি করবার। সতী নারীর তেজে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর অবধি শিশু হন। মাতঃ আপনি সতী শিরোমণি। একজন লোভীর নিকট ধনসম্পত্তি যতটা প্রিয়- একজন সতী নারীর কাছে তাঁর স্বামী ততটাই প্রিয়। তাই আমি আমার স্বামীর চিতায় প্রবেশ করতে চাই। ভগবান শ্রীরাম আদেশ দিয়েছেন, আপনিই অনুমতি দিলে এই সৌভাগ্য সম্ভব। কৃপা পূর্বক এই অভাগিনী নারীকে দয়া করুন।” মাতা সীতাদেবী বললেন- “আমার স্বামী জানেন নারী ধর্মের আদর্শ আমার দ্বারাই জগতে বিস্তৃত হবে। কিন্তু আমি তোমাকে সতী হতে সমর্থন করতে পারি না। যদি মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামের স্ত্রী সতী প্রথার সমর্থন করেন, তবে এই প্রথা সর্বস্তরে প্রচলণ হবে। এতে নারীদের জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে।”

প্রমীলা অনেক বুঝিয়ে বললেন- “দেবী! আমার স্বামী বচন বদ্ধ হয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরেও আমি আর উনি কদাপি সঙ্গছাড়া হবো না। অতএব আপনি এই আদেশ প্রদান করুন। আমি চাই না, আমাকে অনুসরণ করে সকল পতিব্রতা নারী সতী হোক। কিন্তু এই নিয়ম কেবল আমারই জন্য। পতি হীনা হয়ে আমি কিরূপে থাকবো? না আমার পতির আত্মা শান্তি পাবেন, না আমি পাবো।” প্রমীলার অনেক কাকুতি মিনতি সীতাদেবী কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারলেন না । শেষে বললেন- “মন না চাইলেও কেবল তোমাকে সতী হতে আদেশ করলাম। সতী প্রথা অধর্ম, আর অধর্মই থাকবে।” এই বলে সীতাদেবী প্রমীলার সিঁথি সিদুরে রাঙিয়ে বললেন- “তুমি সতী নারী রূপে আজ থেকে জগতে খ্যাত হবে। মাতা অনুসূয়া, সাবিত্রী, মাতা নর্মদার সাথে তোমার নাম শ্রদ্ধা পূর্বক স্মরণ করা হবে।” প্রমীলা স্বামীর শির নিয়ে ফিরে গেলো। মন্দোদরী অনেক বুঝালেন কিন্তু প্রমীলা নারাজ। সে সতী হবেই। মেঘনাদের দেহ নানা প্রকার সুগন্ধি পুস্প ও সুগন্ধি দিয়ে সাজানো হল। নিথর দেহ শত চামর, পাখা ব্যঞ্জন করতে করতে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হল। পেছন পেছন প্রস্তরবৎ হয়ে প্রমীলা চলল। তাঁহাকে নববধূর ন্যায় সজ্জা, কপালে সিঁদুর দেওয়া হয়েছিলো। মেঘনাদের চিতায় উঠে স্বামীর মুণ্ড ক্রোড়ে নিলো। চন্দন কাষ্ঠের চিতায় ঘৃত ঢেলে অগ্নি সংযোগ করা হল। দাউ দাউ করে চিতা জ্বলে উঠলো। পর্বত প্রমান আগুনের শিখা উঠলো। দেখা গেলো তার মধ্যেই সতী প্রমীলা স্বামীর শির নিয়ে নির্বিকার ভাবে বসে আছেন । এই সতী নারীর ওপর দেবতাবৃন্দ পুস্পাদি বর্ষণ করলেন। সকলে দেখলো গগন থেকে পুস্প সেই চিতায় ঝরে পড়ছে। আগুনের শিখা একসময় প্রমীলাকেও ঢেকে দিলো। তাহার পর ধূম ভিন্ন আর কিছুই দেখা গেলো না। শরত এর নির্মল আকাশে সেই ধূম বহু দূর দূর অবধি ছড়িয়ে গেলো । চিতা নির্বাপিত হলে মেঘনাদ ও প্রমীলা উভয়ের অস্থি শাস্ত্র মতে সমুদ্রে বিসর্জন করা হল ।

ভগবান শ্রীরাম সকল কিছুই দেখছিলেন। তাঁর কমলসম নয়ন হতে অশ্রু বিন্দু নির্গত হল। সীতাদেবীও এই সতীর আত্মত্যাগে অশ্রু মোচন করছিলেন। সীতাদেবী দেখলেন তাঁহাদের বিদেহী আত্মাকে। তাঁহারা সীতাদেবীকে নমস্কার ও স্তুতি করলেন । এছাড়া ভগবান শ্রীরাম দেখলেন মেঘনাদ আর তাঁর স্ত্রী প্রমীলার আত্মা তাঁহার সম্মুখে। তাঁহারা করজোড়ে ভগবান শ্রীরামকে নানা স্তবস্তুতি করছেন । ভগবান শ্রীরামই কেবল দেখতে পেলেন এই দৃশ্য। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম তখন আশীর্বাদ করে বললেন- “তোমাদের আর কেউ সঙ্গছাড়া করতে পারবে না। আমার শাশ্বত ধাম বৈকুণ্ঠে তোমরা চির অবস্থিতি লাভ করে সুখ আনন্দ প্রাপ্তি করবে।” মেঘনাদ ও প্রমীলা উভয়ে ভগবানের ধাম প্রাপ্ত করেছিলেন । রাবণ বিমর্ষ হয়ে বসেছিলো রাজসভাতে। শূন্য আসন গুলি দেখে অন্ধকারে বসেছিলেন । এক সময় এই রাজসভা কত রাক্ষস বীরেরা অলঙ্কৃত করে থাকতো। আজ একটিও নেই। হঠাত তার সামনে আবির্ভূত হল রম্ভা। সেই অপ্সরা অট্টহাস্য করে বলল- “রাবণ!তুই না বীর! তো তোর এই অবস্থা কেন? কোথায় গেলো তোর সেই প্রতাপ? সেই বল? তোর এই অবস্থা দেখে দেবতাগণ খুবুই প্রীত হয়েছেন। তোর বংশ নাশ হতে দেখে আমিও আনন্দিত হয়েছি । রাবণ মনে পড়ে আমার ওপর কিভাবে অত্যাচার করেছিলি ? নারীর চোখের জল বজ্র তুল্য। তা কেবল বিনাশ আনে। তুইও এবার মরবি ।” এই বলে রম্ভা অদৃশ্য হল। রাবণের মনে হল শত শত সাধু তার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে আনন্দে হাস্য করছেন। মনে পড়লো বেদবতীর কথা। নন্দীর কথা মনে পড়লো। মনে হয় এই সেই নর আর বানর। মন্দোদরী এসে বললেন- “এখন আপনি চিন্তা করছেন? এত কিছু হওয়ার পর? যদি আমার পরামর্শ শুনে আপনি সীতা হরণ না করতেন বা সীতাকে অনেক আগেই ফিরিয়ে দিতেন- তবে আজ এমন শোক আমরা পেতাম না। শ্রীরামের শক্তি দেখেছেন? কোথায় গেলো আপনার সেই রাক্ষস কূল? কোথায় সেই বলশালী রাক্ষসেরা? কোথায় আমার বীর পুত্র। সব আপনার দম্ভের কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তাই বলছি এখনও সময় আছে, সীতাকে ফিরিয়ে দিন।” রাবণ বলল- “এই সীতার জন্যই এত কিছু। তার জন্যই রাম লঙ্কা আক্রমণ করেছে। আজ এই সীতাকেই আমি পৃথিবী থেকে দূর করবো।” এই বলে রাবণ ধারালো খড়্গ নিয়ে অশোক বনে সীতাকে হত্যা করতে গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩০)


রাক্ষস বিরূপাক্ষ রোদন করতে করতে রাবণের কাছে গেলো। বিরূপাক্ষের কথা শুনে রাবণ ডুকরে কেঁদে উঠলো। প্রবল শোক পেলো দশানন। কুড়ি চোখে দিয়ে তাঁর অশ্রুপাত হল। “হা পুত্র!” বলে সে পুত্রের ছিন্নস্কন্ধ ইন্দ্রজিতের মৃতদেহের কাছে গেলো। মেঘনাদের শব দেখে রোদন করতে লাগলো। রাক্ষসেরা জানালো মেঘনাদের ছিন্নস্কন্ধ বানরেরা নিয়ে গেছে। রাবণ শোকে প্রস্তর সম হল। মেঘনাদের বাল্য অবস্থার রূপ মনে করতে তার অন্তর ভেঙ্গে প্রবল কান্না আসলো। রাবণ বিলাপ করে বলতে লাগলেন- “হা পুত্র ইন্দ্রজিৎ! তুমিও শেষে আমাকে ছেড়ে প্রস্থান করলে? পুত্রহীন হয়ে আমার আর বেঁচে থাকার অর্থ কি? এই লঙ্কার সুন্দর কানন , স্বর্ণ লঙ্কা আজ পুত্রের বিহনে জনশূন্য বলে বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই রাবণ আজ গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। পুত্র মেঘনাদ তুমি এই পিতামাতা, স্ত্রীকে ত্যাগ করে কোথায় গমন করলে? হা বীর! পুত্রই তার পিতার প্রেতকার্য সুসম্পন্ন করে। আমি এতই দুর্ভাগা যে নিজ পুত্রের প্রেতকার্য সম্পন্ন করতে হবে !” এই বলে রাবণ পুত্রের নিথর দেহের সামনে বসে অবিরত ক্রন্দন করতে লাগলেন। রাবণের পুরী আজ সত্যই শূন্য হয়েছে। মন্দোদরী দাসীদের কাছে সংবাদ পেয়ে আসলেন। তিঁনি এসে পুত্রের নিথর দেহ দেখে শোকে পাগলিনী হলেন। মাতা হয়ে পুত্রের নিথর শব দেখা অত্যন্ত অভাগী মাতার অদৃষ্টেই লেখা থাকে। মন্দোদরী কপাল চাপড়ে বিলাপ করে বলতে লাগলেন- “হা পুত্র! তুমি কেন যুদ্ধে নিয়োজিত হলে ? হা পুত্র! আমি শিব আরাধনা করে তোমাকে প্রাপ্তি করেছিলাম। আজ তুমি কেন চলে গেলে ? হা ঈশ্বর! আমি অত্যন্ত অভাগিনী নারী। হে পুত্র! যদি তুমি আমার কথা শুনতে তবে আজ এই দশা হতো না।” এই বলে মন্দোদরী রোদন করে ক্ষিপ্তা হয়ে দশাননকে ক্রুড় ভাষা বলতে লাগলেন ।

বললেন- “আপনি রোদন করছেন কেন? আপনার তো হাস্য করা উচিৎ! আপনার পুত্র আপনার জন্যই হত হয়েছে। আপনার ত গর্ব করা উচিৎ! কেন আপনি রোদন করছেন ? আপনার কি শরীরে মায়াদয়া আছে নাকি? লক্ষ্মণ আজ ইন্দ্রজিতকে বধ করেনি। তাকে হত্যা করেছে আপনার দম্ভ, আপনার কুবুদ্ধি! আপনি পুত্রঘাতী পিতা। আপনি নৃশংস । আপনিই আপনার কুল নিজ হাতে নাশ করে দিয়েছেন। আপনি প্রসন্ন চিত্তে আনন্দ করুন। কারণ আপনার মন- বুদ্ধি কিছুই নেই। আপনাকে পুত্রশোক শোভা দেয় না।” এত বলে মন্দোদরী রোদন করতে লাগলেন । প্রমীলাকে তখন দাসীরা অন্দরমহল থেকে নিয়ে আসলো। শোকে সে চলন গমনের শক্তি হারিয়েছে । প্রমীলার চোখে কোন অশ্রু নেই। তার পলক পড়ছে না। এলোকেশে কোন সজ্জা নেই, গাত্রের অলঙ্কার সকল নানাদিকে পতিত হয়ে আকাশ থেকে পতিত নক্ষত্রের ন্যয় দীপ্তি বিকিরণ করছিলো । শোকে যেনো প্রমীলার আত্মা দেহ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। কেবল যেনো তার দেহকেই ধরে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিলো । মন্দোদরী সদ্য বিধবা প্রমীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল- “মা! তোমার শ্বশুর এই উপহার তোমাকে দিয়েছেন। নিষ্ঠুর ও দাম্ভিক ব্যক্তি এর থেকে বড় উপহার আর কি দিতে পারেন ? তুমি তোমার শ্বশুরকে ক্ষমা করো না। পত্নী হয়ে পতিকে আমি অভিশাপ দিতে পারি না মা। কিন্তু তুমি ঈশ্বরের কাছে এর বিচার প্রার্থনা করো মা।” প্রমীলা এবার শোকে ভেঙ্গে পড়ে মেঘনাদের নিথর শবের উপর আছরে পড়ে অনেক রোদন করতে লাগলেন । প্রলাপ করে বলতে লাগলেন- “স্বামী! আপনি আমাকে বলেছিলেন আমাকে আপনাকে কেউ আলাদা করতে পারে না, কিন্তু আপনি নিজেই ত আমাকে আপনার থেকে দূরে সড়িয়ে দিয়েছেন। কেন আমি বেঁচে রইলাম ? কেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে না? কেন এই বসুমতীতে আমি প্রবেশ করছি না?” এই বলে প্রমীলা শোকাতুরা হয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন । রাবণ আদেশ দিলো পুত্রের দেহ সৎকার করতে। কিন্তু শির না পেলে ত সৎকার সম্ভব না ।

দাসীরা প্রমীলার রক্তিম সূর্যের ন্যয় কপালের সিঁদুর ও হাতের শাঁখা পলা খুলে নিতে গেলে, তাহার জন্য শ্বেত বস্ত্র আনয়ন করলে প্রমীলা রোদন করে বললেন – “আমি সতী নারী। আমার আর ওঁনার বন্ধন কেউ ছিন্ন করতে পারে না।” এই বলে প্রমীলা উঠে রাবণকে বললেন- “পিতা! আপনাকে রাক্ষসেরা ভগবান বলে মানে। আপনি দেবতাদের জয় করেছেন। কিন্তু আমাকে আমার স্বামীর সহিত সঙ্গবদ্ধ করার ক্ষমতা আপনার নেই। আমি তাঁর কাছেই যাবো যিনি এই আশীর্বাদ আমাকে দিতে পারেন।” এই বলে প্রমীলা একছুটে লঙ্কার বাইরে বের হল। চলে গেলো প্রভু শ্রীরামের কাছে। এলোকেশী, গহনা বিবর্জিতা প্রমীলাকে উন্মত্ত পাগলিনীর ন্যায় মনে হচ্ছিল্ল। সে গিয়ে ভগবান শ্রীরামের চরণে পড়ে বলল- “প্রভু! নারায়ণ! আপনি ত ভগবান! ভক্তের সর্বস্ব । পিতার গৃহে অবস্থান কালে আমি তো আপনারই পূজা করতাম । হে রঘুপতি! আমি কোন অভিযোগ জানাতে আসিনি। আমি আমার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষাও চাইবো না। দয়া করে আমাকে আশীর্বাদ করুন, যেনো আমি আমার স্বামীর সহিত মরণের পর একত্র হতে পারি। বৈধব্য জীবন নিয়ে আমি বাঁচতে চাই না। কৃপা করে আপনি আমার স্বামীর শির ফিরিয়ে দিন। আমি তাহা নিয়ে স্বামীর চিতায় উঠতে যাই।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “প্রমীলা ! তুমি মহাসতী। তোমার সতীত্ব তেজেই মেঘনাদ এত শক্তিমান ও অজেয় ছিলো। আমি সেই বীরের শির ফিরিয়ে দিলেও তোমাকে সতীদাহের অনুমতি দিতে পারি না। কারণ এর থেকে সতী প্রথার উদ্ভব আরম্ভ হবে। আর সীতাও এই ঘটনা শ্রবণে দুখী হবেন। কারণ সীতা নারী ধর্মের আদর্শ প্রচার করতেই জগতে এসেছেন। আমি বিধবা নারীর পুনঃবিবাহ প্রচলন করেছিলাম নিহত বালির স্ত্রী তারার সাথে সুগ্রীবের বিবাহ সুসম্পন্ন করে। কিন্তু তোমাকে সতী হওয়ার সমর্থন দিলে সীতা কোনদিন প্রসন্ন হবে না। যদি সীতা মত প্রদান করেন তবেই এ সম্ভব।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম, মেঘনাদের শির প্রদান করলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৯)


মেঘের আড়াল হত মেঘনাদের যুদ্ধ বিদ্যার কথা সকলেই জানতো । নানা প্রকার ঘাতক অস্ত্র প্রয়োগ করলো। বানরদের মুণ্ড গুলো যেনো শরের আঘাতে উড়ে গেলো। মনে হল একটা চোখের পলকে ঝড় এসে সমস্ত মুণ্ড গুলো উড়িয়ে নিয়ে গেলো। কবন্ধ হয়ে হয়ে বানরেরা ভূপতিত হল। আবার শিলা বান নিক্ষেপ করা মাত্র আকাশ হতে বৃষ্টির ন্যায় শিলা বর্ষণ আরম্ভ হল। বানরেরা সেই শিলা থেকে বাঁচবার জন্য এদিক সেদিক দৌড়ঝাঁপ আরম্ভ করলো। কিন্তু সেই শিলাগুলির তলায় পিষ্ট হল। এরপর পর্বত বাণ মন্ত্র পড়ে নিক্ষেপ করলেন মেঘনাদ। বৃহৎ পর্বত যুদ্ধভূমিতে পতিত হয়ে সব বানর মরল। মেঘনাদ এইভাবেই যুদ্ধ চালালেন যেনো চোখের পলকে কটকে কটক কপিদল নষ্ট হল । অট্টহাস্য করে মেঘনাদ যুদ্ধ আরম্ভ করলো। ধীরে ধীরে মেঘনাদ আকাশ মার্গে উঠে যুদ্ধভূমিতে আসলে তার পেছন পেছন রাক্ষস সেনারাও আসলো। তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। মেঘনাদের অস্ত্রে যেনো চারপাশ ঢেকে দিলো। বানরেরা নষ্ট হতে আরম্ভ করলো। এই দেখে মেঘনাদ বলল- “নিকুম্ভিলা যজ্ঞ পূর্ণ না করেও আমি অতি শক্তি রাখি। আজ এই যুদ্ধে আমি রাম, লক্ষ্মণ কে বধ করে যুদ্ধ সমাপন করবো।” ক্ষিপ্ত হয়ে লক্ষ্মণ তখন মন্ত্র পড়ে কালান্তক বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণের তেজে রাক্ষসেরা দমবন্ধ হয়ে মরল । তারপর লক্ষ্মণ ঠাকুর যমাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। লক্ষ লক্ষ রাক্ষসেরা ভূপতিত হল সেই অস্ত্রের প্রভাবে। লক্ষ্মণের বাণে এইরূপে রাক্ষস নিধন হতে দেখে মেঘনাদ গর্জন করে দাঁত কটমট করলেন। লক্ষ্মণ হাস্য করে বলল- “ওরে পাপীষ্ঠি! এই ভাবে গর্জন না করে যুদ্ধবিদ্যা দ্বারা শত্রু নিধন করে নিজ শক্তির পরিচয় দে। এইরূপ বালক স্বভাব তোমার সাজে না।” এই শুনে মেঘনাদ আরোও উত্তেজিত হল। লক্ষ্মণের দিকে পাঁচটি তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করলো। বাণের আঘাতে লক্ষ্মণের তনু থেকে রুধির নির্গত হল। লক্ষ্মণ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে মেঘনাদের দিকে পাঁচটি বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণগুলি থেকে উজ্জ্বল জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল্ল। তা যখন মেঘনাদের বুকে বিঁধলো তখন মনে হল মেঘনাদ পাঁচটি উজ্জ্বল মণি ধারণ করেছেন। মেঘনাদের কিছুই হল না। রথ শুদ্ধো অদৃশ্য হল ।

হনুমান এগিয়ে গেলো। কহিল –

হনুমান বলে বেটা তোর রণ চুরি ।
দেখাদেখি আজই তোরে দিব যমপুরী ।।
না জানি ধরিতে অস্ত্র বানর জাতি ।
এ কারণে এতদিন তোর অব্যহতি ।।
মল্লযুদ্ধ কর বেটা , ফেল ধনুর্বাণ ।
একটা চাপরে বেটা তোর বধিব পরাণ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান আর অঙ্গদ যখন যুদ্ধ আরম্ভ করলো তখন মেঘনাদ একটি ত্রিশূল হস্তে নিলো ।

লৈ ত্রিসূল ধাবা কপি ভাগে ।
আএ জহুঁ রামানুজ আগে ।।
আবা পরম ক্রোধ কর মারা ।
গর্জ ঘোর রব বারহিঁ বারা ।।
কোপি মরুতসুত অঙ্গদ ধাএ ।
হতি ত্রিসূল উর ধরনি গিরাএ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

অর্থাৎ- সেই ত্রিশূল তখন মেঘনাদ অঙ্গদ আর হনুমানের দিকে ছুড়লো। ত্রিশূলের আঘাতে হনুমান আর অঙ্গদ ধরাশায়ী হল। পুনঃ সেই ত্রিশূল মেঘনাদের কাছে ফিরে গেলো।

মেঘনাদ হাস্য করে সেই ত্রিশূল লক্ষ্মণের দিকে নিক্ষেপ করলো। মেঘনাদ তখন পাশুপাত অস্ত্র নিক্ষেপ করলো। পাশুপাতের আঘাতে সেই ত্রিশূল চূর্ণ হল। মেঘনাদ অদৃশ্য হল। লক্ষ্মণ কেবল তাহার অট্টহাসি শুনতে পেয়ে সেইদিকেই শর নিক্ষেপ করলো। মেঘনাদ একবার দৃশ্য হয় আবার অদৃশ্য হয়ে বাণ নিক্ষেপ করে। অট্টহাস্য করে মেঘনাদ পুনঃ প্রকট হয়ে উল্কা বাণে বানর দল বিনষ্ট করে বললেন- “লক্ষ্মণ। স্মরণে আছে নাগপাশে তোদের দুইভ্রাতাকে কিভাবে আবদ্ধ করেছিলাম! তাহা কি বিস্মৃত হয়েছিস?” এই বলে মেঘনাদ দশটি শর নিক্ষেপ করলেন । লক্ষ্মণের বুকে দশটি শর বিঁধলে লক্ষ্মণ সেগুলিকে তুলে ফেলে দিলেন। তাঁহার বুক থেকে রক্তপাত হচ্ছিল্ল। লক্ষ্মণ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে “নারাচ অস্ত্র” প্রকট করলেন। সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। সেই অস্ত্র গিয়ে বিঁধলো মেঘনাদের বুকে। মেঘনাদের কবচ ছিন্নভিন্ন হল।

মেঘনাদ সমানে প্রকট হন। আবার অদৃশ্য হন। বাণে বাণে চারপাশ ছেয়ে গেলো। গগনে দেবতারা উপস্থিত হয়ে দেববিজয়ী ইন্দ্রজিতের সাথে লক্ষ্মণের যুদ্ধ দেখতে লাগলো। ভয়ানক যুদ্ধ চলল। কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারে না। রাক্ষস ও বানর উভয়ে মরল। তখন লক্ষ্মণ “দেবজয়” নামক অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। সেই অস্ত্রের আঘাতে মেঘনাদের রথ চূর্ণ হল। রথ ভূপতিত হলে সারথি, অশ্ব সকল হত হল। মেঘনাদ সহসা গগনে উঠে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে বাণাদি বর্ষণ আরম্ভ করলো। আবার কখনো দৃশ্যমান হল। দৃশ্যমান হয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলো। লক্ষ্মণের দেহে শর ফুটলো। লক্ষ্মণ সেদিকে না দেখে যুদ্ধ করতে লাগলো। এরপর এলো সেই মহেন্দ্র ক্ষণ । লক্ষ্মণ ধনুকে ঐন্দ্রাস্ত্র প্রকট করলেন। বললেন- “যদি আমার অগ্রজ দাদা বিষ্ণুর অবতার হন। যদি আমি কায়মনবাক্যে আমার অগ্রজ শ্রীরামের সেবা করে থাকি, তবে এই অস্ত্রে মেঘনাদ হত হোক।” এই বলে লক্ষ্মণ মেঘনাদকে লক্ষ্য করে ঐন্দ্রাস্ত্র ছুড়লেন । সেই অস্ত্রের থেকে জ্বালামুখীর ন্যায় অগ্নিশিখা ও স্ফুলিঙ্গ নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল্ল। মেঘনাদ সমানে শেল, শূল, জাঠা , গদা, বর্শা ও বহু শর , দিব্যাস্ত্র নিক্ষিপ্ত করেও সেই ঐন্দ্রাস্ত্রকে ব্যর্থ করতে পারলেন না। সেই অস্ত্র গিয়ে মেঘনাদের শিরোচ্ছেদ করলো। আকাশ থেকে মেঘনাদ ধরিত্রীর বুকে পড়লো। দেবতারা লক্ষ্মণের ওপর পুস্পবৃষ্টি করলেন। শঙ্খ, কাঁস্রম ন্যাকড়া, দুন্দুভি, মঙ্গল বাদ্য স্বর্গে বাজতে লাগলো। ইন্দ্রদেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কারণ মেঘনাদ যতদিন জীবিত ছিলো, ইন্দ্রদেবতা নিজের পরাজয়ের গ্লানিতে ভুগছিলেন । লক্ষ্মণের আদেশে মেঘনাদের কাটা মুণ্ড বানরেরা নিয়ে গেলো শ্রীরামের কাছে। শ্রীরাম সেই বীর মেঘনাদের মুণ্ড পুস্পে শোভিত স্থানে রাখলেন। অপরদিকে রাক্ষসেরা মেঘনাদের ছিন্নমুণ্ডহীন দেহ লঙ্কায় নিয়ে গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৮)



মেঘনাদ যজ্ঞে বসলো । বিভীষণ ও হনুমান, জাম্বুবান, নল- নীল আদি বানর দলেরা বিভীষণের পিছু পিছু চলল। বিভীষণ সকলকে আগে আগে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেলো। নিকুম্ভিলা মন্দির থেকে ধূম উঠতে দেখা গেলো। বিভীষণ বলল- “সর্বনাশ। বোধ হয় মেঘনাদ যজ্ঞ আরম্ভ করে দিয়েছে। একবার যজ্ঞ সমাপন হলে আর তাহাকে কেহ পরাজিত করতে পারবে না।” মেঘনাদের যজ্ঞ গৃহের দ্বারে প্রহরায় ছিলো রাবণের অনুগত শ্যাম বর্ণের মায়াবী রাক্ষসেরা। বিভীষণ বললেন- “ওহে বানরগণ! তোমরা সত্বর ঐ রাক্ষসদের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করো। তাহা হইলেই এদের সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থাকা যজ্ঞরত মেঘনাদকে দেখা যাবে।” এরপর বিভীষণ লক্ষ্মণকে বললেন- “আপনি দিব্যাস্ত্র সমূহ চালনা করে এই রাক্ষস কটক বিনষ্ট করুন । তাহার পর সেই ক্রূরকর্মা , পাপাত্মা মেঘনাদকে বধ করবেন।” এই শুনে লক্ষ্মণ তখন বাণ রাক্ষসদের দিকে ছুড়তে থাকলেন । রাক্ষসেরা সেই বানর সেনা দেখা মাত্রই তোমর, সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলো। বানরেরা বৃক্ষ, প্রস্তর, গদা নিয়ে রাক্ষসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুই দলে রণ আরম্ভ হল। লক্ষ্মণ দেখলো মেঘনাদ যজ্ঞে বসেছে।

জাই কপিনহ সো দেখা বৈসা ।
আহুতি দেত রুধির অরু ভৈসা ।।
কীনহ কপিনহ সব জগ্য বিধংসা ।
জব ন উঠই তব করহিঁ প্রসংসা ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

এর অর্থ- “ মর্কটগণ গিয়ে দেখল যে মেঘনাদ বসে বসে রক্ত ও মহিষ আহুতি দিচ্ছে। তারা সব যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে দিল । তবুও যখন মেঘনাদ যজ্ঞ থেকে নিবৃত্ত হল না তখন তারা মেঘনাদের প্রশংসা করলো।” কিন্তু মেঘনাদ যজ্ঞ থেকে ওঠে না। লক্ষ্মণের নিক্ষেপিত শরে তাঁর অঙ্গ থেকে রুধির ধারা বের হল। কিন্তু সে যজ্ঞ করতেই থাকলো। তখন হনুমান গেলো বানর দল সহিত।

হনুমান বীর যেন সিংহের প্রতাপ ।
যজ্ঞকুণ্ড ভরি তায় করিল প্রস্রাব ।।
যজ্ঞকুণ্ড উপরেতে হনুমান মূতে ।
ফলমূল যজ্ঞের ভাসিয়া যায় স্রোতে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এই ভাবে আর তাহার সহিত যজ্ঞে প্রস্তর ফেলে যজ্ঞের অগ্নি নির্বাপিত করা হল । হনুমান তখন বলল- “রে দুর্মতি রাবনতনয় ! তুই যদি বীর হোস , তবে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করতে পারবি । কিন্তু আমার হস্তে পড়লে প্রাণ ফিরিয়া পাইবি না। আয় আমার সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধ কর। দেখি তবে বুঝিবো তুই সত্যই বীর ।” মেঘনাদ বললেন- “তবে তাই হোক। লঙ্কায় এসেছিস জীবিত দেহে, ফিরবি শবদেহ হয়ে।” এই বলে মেঘনাদ ধনুর্বাণ নিয়ে রথে উঠলো। তারপর হনুমানকে অনবরত শর নিক্ষেপ করে আহত করলো। বিভীষণ এই দেখে লক্ষ্মণকে বললেন- “হে সৌমিত্র! ঐ দেখুন সুরবিজয়ী মেঘনাদ কিভাবে হনুমানকে বধ করবার চেষ্টা করছে । আপনি ভীষণ শর নিক্ষেপ করে ইন্দ্রজিতের প্রাণ হরণ করুন।” এই শুনে লক্ষ্মণ বললেন- “হে মেঘনাদ! আমি তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি। এসো! আমার সহিত যুদ্ধ করো।” মেঘনাদ বলল- “তাত বিভীষণ! তুমি সম্পর্কে আমার পিতার ভ্রাতা। আমার পূজ্য। কিন্তু তুমি নিজের ভ্রাতার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করেছো । তুমি মন্দবুদ্ধি । তাই মিত্রপক্ষকে ত্যাগ করে শত্রুর দলে যোগদান করেছো। তুমি আত্মীয় স্বজন ছেড়ে শত্রুর সঙ্গে নিবাস করছ। তুমি নিজ পুত্রের শত্রু। কারণ তরণীসেনকে তুমি রক্ষা করো নি। ধন্য আমার ভ্রাতা তরণীসেন । সে শত্রু পক্ষে যোগ দেয়নি। বরং স্বদেশের মান রক্ষার্থে বীরগতি প্রাপ্ত করেছে । যদি স্বজন নির্গুণ ও শত্রু স্বগুণ হয় তথাপি স্বজনের সাথেই নিবাস করা উচিৎ। তোমার ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নাই। তুমি নির্দয়ী । তুমি আজ শত্রুকে আমার যজ্ঞস্থানের পথ দেখিয়ে দিয়েছো। তুমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছো । তুমি পিতৃব্য হলেও আজ তোমার সহিত আমি শত্রু ভাব পোষণ করবো।”

বিভীষণ বলল- “মেঘনাদ! আমি তোমার স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞাত । তুমি আমার পুত্রতুল্য। কিন্তু আমার অগ্রজ তথা তোমার পিতা দশানন ধর্মের মার্গ ত্যাগ করে অধর্মকে আশ্রয় করেছে । যদি আমি পাপাচারী হতাম তবে অগ্রজ রাবণকে আশ্রয় করে থাকতাম । আমি রাক্ষস কূলে জন্মিয়াছি- কিন্তু ধর্ম ছাড়িনি । আমি যদি পাপচারে লিপ্ত হতাম তবে আমার অগ্রজ ভ্রাতা আমাকে চোখের মণি করে রাখতেন। কিন্তু আমি সর্বদা ওনার অন্যায় কর্মের বিরোধিতা করেছি, তাই আমি তাঁহার চোখের শূল। মেঘনাদ! আমি তোমার পিতা তথা আমার অগ্রজকে বহুবার সংযত হতে বলেছি। কিন্তু সে কোন কথাই মানে নি। একের পর এক দুষ্কর্ম করে গেছে। কত মুনি- ঋষি- ধর্মাত্মাকে বধ করেছে, দেবকণ্যাদের অপহরণ করে এনে লঙ্কার দাসী বানিয়েছে। না জানি কত নারীর সতীত্ব নাশ করেছে , দেবী লক্ষ্মীর অবতার মাতা বেদবতীকে যজ্ঞকুণ্ডে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করেছে। অগ্রজ ভ্রাতা কুবেরের পুত্রবধূ রম্ভাকে ধর্ষণ করেছে। এমনকি মাতা সীতার মতো সতী নারীর দিকে কুদৃষ্টি দিয়েছে। এই পাপে আজ তাঁহার এই অবস্থা হয়েছে। আমি ধর্মের পথে এসে কোন পাপ করিনি । জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হল ধর্মপথে থেকে জীবন ধারণ করা। পুত্র মেঘনাদ! তুমি নির্দোষ। তুমি বলশালী। অতএব তুমিও ভগবান শ্রীরামের শরণে এসে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো।” মেঘনাদ গর্জে জানালো সে এইহেন প্রস্তাবে রাজী নয়। লম্ফ দিয়ে রথে উঠলো। মেঘনাদ বলল- “এবার আমার বীক্রম দেখো।” এই বলে রথ থেকে নানা ঘাতক অস্ত্র দ্বারা বানর সেনাদের বধ করতে লাগলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৭)



মায়া সীতার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে । রাক্ষস বিদ্যুৎজিহ্ব হত হয়েছে। রাবণের অনান্য সকল পুত্র ও নাতিপুতি, জ্ঞাতিগুষ্টি সকলেই নিহত হয়েছে । এ কেমন শত্রু, ভাবতে লাগলো রাবণ। লঙ্কায় প্রবেশ করে আক্রমণ হানছে । এসব ভেবে রাবণ চিন্তিত হল। মন্দোদরী আবার সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবার কথা বলতে রাবণ ধমকে স্ত্রীকে নিবৃত্ত করলেন । মেঘনাদ এলো। বলল- “পিতা! এবার আমি আবার যুদ্ধে গমন করবো। পিতা আমি যতবার যুদ্ধে গিয়েছি ঐ রাম লক্ষ্মণকে আহত করে দিয়েছি। কিন্তু ওদের ভাগ্য ভালো যে বেঁচে যায়। এবার আর বাঁচবে না। দেবী নিকুম্ভিলার আরাধনা করে আমি আবার যুদ্ধে যাবো। দেবীর সামনে বিজয়ের জন্য যজ্ঞ করবো। দেবীর কৃপায় সেই যজ্ঞ থেকে দিব্য রথ, কবচ, অস্ত্রাদি উঠে আসবে।” মন্দোদরী বললেন- “পুত্র! কেন জানি না আমার হৃদয় বড় শঙ্কিত হচ্ছে। এর পূর্বে এমন হয় নি। শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ বড়ই শক্তিমান। অতএব তাঁহাদিগের সাথে যুদ্ধ কদাপি করো না। তুমি বরং প্রমীলাকে নিয়ে লঙ্কা থেকে কোথাও চলে যাও । তুমি দূরে থাকলেও বেঁচে থাকবে। আমি শান্তি পাবো। কিন্তু এখানে থাকলে তোমার পিতার দর্পের হাওয়ায় তোমারো জীবনদীপ নির্বাপিত হবে। মাতা হয়ে পুত্রের মৃত্যুর সংবাদ শ্রবণ করবার শক্তি বিধাতা আমাকে প্রদান করেন নি। তোমার ভ্রাতাদিগের অবস্থা কি হয়েছে দেখেছোই ত?” এত বলে মন্দোদরী রোদন করে মেঘনাদকে বোঝাতে লাগলেন। রাবণ বলল- “মন্দোদরী! তোমার কি নিজ পুত্রের শক্তির ওপর বিশ্বাস নেই ? মেঘনাদ সেই ইন্দ্রকে পরাজিত করে আবদ্ধ করেছে- এই মানুষ ত অতি তুচ্ছ। বৃথা কেন শঙ্কা করছ ? বরং মেঘনাদকে আশীর্বাদ করে যুদ্ধে প্রেরণ করো।” মন্দোদরী বলল- “ মাতা হয়ে পুত্রকে মৃত্যুমুখে যাওয়ার আশীর্বাদ দেবো ? আপনার কি সম্পূর্ণ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? শ্রীরাম অনেক শক্তি রাখেন। তাঁহাকে পরাজিত করা যায় না। এই যুদ্ধে এত রাক্ষসের মৃত্যু দেখেও কি আপনি এই সরল সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন না?”

মেঘনাদ বলল- “মাতা! আমিও কিছু কম শক্তি রাখি না। কিন্তু বীর কখনো নিজমুখে নিজের শক্তির কথা বলে না। আমি যুদ্ধ করে প্রমান করবো যা আমি কত শক্তি রাখি। কৃপা করে আমাকে যুদ্ধ গমনের আদেশ করুন। পিতার বাক্য পালণ করা পুত্রের ধর্ম । সেই শ্রীরাম পিতার বচন পালন করতেই রাজ্য ছেড়ে বনে এসেছেন। এখন আমি আমার পিতার কথা মেনে যুদ্ধে গিয়ে প্রমান করবো- পিতার কথা মান্যতা করাই পুত্রের কর্তব্য।” এত বলে মেঘনাদ তখন স্ত্রীর কাছে বিদায় নিতে গেলেন । প্রমীলা অনেক কান্নাকাটি করে স্বামীকে যুদ্ধে যেতে বাধা দিলো। বলিল- “প্রভু! কোনদিন আপনাকে বাধা প্রদান করিনি। আমি জানি সীতাদেবীকে অপহরণ করে আনয়ন করা অন্যায়। তবুও সেই ঘটনা নিয়ে আমি কোনপ্রকার অভিযোগ করিনি। আমি আপনার জন্য নাগদেবীর উপাসনা করে নাগপাশ অস্ত্র প্রদান করেছিলাম আপনাকে। কিন্তু নাগদেবী আর সহায়তা করবেন না বলে জানিয়েছেন। কৃপা করে আপনি আপনার মাতার কথা মেনে নিন। চলুন আমি আপনি অনেক দূরে কোথাও চলে যাই।” মেঘনাদ বলল- “ছিঃ! প্রমীলা তোমার বুদ্ধিকে ধিক । এই সঙ্কটের সময় আমি পিতাকে ছেড়ে , নিজের স্বদেশ ছেড়ে পলায়ন করবো ? দেবী সীতাকে অপহরণ করা আমি সমর্থন করি না । কিন্তু তার জন্য আমি নিজে ধর্ম পালন থেকে বিচ্যুত হতে পারি না। পিতার সঙ্কটে পিতার সাথে থাকাই পুত্রের ধর্ম । এই অবস্থায় আমি যুদ্ধে না গমন করলে কিংবা লঙ্কা ছেড়ে পলায়ন করলে আমার অধর্ম হবে।” মেঘনাদ এরপর স্ত্রী প্রমীলাকে আলিঙ্গন করে বললেন- “প্রমীলা! এই যুদ্ধের পর আমি জীবিত থাকি আর হত হই- তুমি আর আমি কদাপি সঙ্গছাড়া হবো না। যতদিন বেঁচেছি একসাথে বেঁচেছি- যমের সাধ্যি নেই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটানোর। ” এই বলে মেঘনাদ প্রস্থান করলো। প্রমীলা নানা অশুভ চিহ্ন দেখতে পেলো। সে ভূমিতে পড়ে ক্রন্দন করতে লাগলো ।

মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আয়োজন করছেন। সেখানে কড়া সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করেছেন রাবণ। একটা মাছি গলে যাবার উপায় নেই। এতই সেনা প্রহরায় সেখানে । মেঘনাদ রাত্রিকালে নিকুম্ভিলা পূজার আয়োজন করলেন। নিকুম্ভিলা দেবী সম্বন্ধে বলা যাক। ‘রামায়ণ’ ভিন্ন এই দেবীর নাম অন্য কোথাও নেই। এই দেবীকে আসুরিক দেবী বলেন অনেকে- যেটা সম্পূর্ণ ভুল। বস্তুত লঙ্কায় একটি শক্তিপীঠ আছে । পীঠনির্ণয়তন্ত্র গ্রন্থে লিখিত আছে –“লঙ্কায়াং নূপুরশ্চৈব ভৈরবো রাক্ষসেশ্বরঃ । / ইন্দ্রাক্ষী দেবতা তত্র ইন্দ্রোণোপাসিতা পুরা ।।” ভগবান হরির চক্রে খণ্ডিত হয়ে সতী দেবীর চরণের নূপুর এখানে পতিত হয়। দেবীর নাম ইন্দ্রাক্ষী ভৈরবের নাম রাক্ষসেশ্বর । পণ্ডিতেরা এই নিকুম্ভিলা দেবীকে সেই শক্তিপীঠের দেবী মানেন । কিন্তু শাস্ত্রে লঙ্কার শক্তিপীঠের দেবীকে নিকুম্ভিলা নয়- ‘ইন্দ্রাক্ষী’ বলে সম্বোধন করা আছে। বহু পূর্বে বৃত্রাসুরের হাতে রাজ্য হারিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাদিগের সহিত এখানে এসে দেবী ভগবতীর তপস্যা করেছিলেন । তাই এই নাম দেবীর। লঙ্কায় এই দেবীর মন্দির এখনও আছে। তবে এটি শক্তিপীঠ রূপে স্বীকৃতি পায় নি । মেঘনাদের এই যজ্ঞের কথা বিভীষণ শুনেছিলো।

বিভীষণ বলে শুন রাজীব- লোচন ।
সামান্যেতে ইন্দ্রজিৎ না হবে পতন ।।
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করে দুষ্ট নিশাচর ।
করিয়াছে যজ্ঞকুণ্ড লঙ্কার ভিতর ।।
যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দিয়া যদি যায় রণে ।
স্বর্গ মর্ত্য পাতালেতে কার সাধ্য জিনে ।।
ব্রহ্মা দিয়াছেন শাপ শুন নারায়ণ ।
ইন্দ্রজিৎ- যজ্ঞ ভঙ্গ করিবে যে জন ।।
ইন্দ্রজিৎ সংগ্রামে মরিবে তার হাতে ।
লক্ষ্মণ পাঠায়ে দেহ আমার সঙ্গেতে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

বিভীষণ বললেন- “হে শ্রীরাম! নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সমাপন হলে এই যুদ্ধে লঙ্কার জয় নিশ্চিত। ব্রহ্মা বলেছেন ইন্দ্রিজিতের যজ্ঞ ভঙ্গ করে তাহাকে নিধন সম্ভব। নাহলে সম্ভব না। অতএব সেনা সমেত লক্ষ্মণ ঠাকুরকে আমার সহিত প্রেরণ করুন।” লক্ষ্মণ বললেন- “নিরস্ত্র অবস্থায়, যজ্ঞে রত মেঘনাদকে যজ্ঞে বাধা দিয়ে যুদ্ধ করা ত ছল চাতুরী, অধর্ম।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “হে লক্ষ্মণ। প্রিয় ভ্রাতা! আমি জানি তুমি ন্যায় নীতি পালন করো। কিন্তু এই রাক্ষসেরা কপট দ্বারা যুদ্ধ করে। পূর্বেই দেখেছো এরা কখনো সীতার নকল মূর্তি দেখিয়ে আমাদের দুর্বল করতে চেষ্টা করছে, কখনো বৃষবাহিনী হয়ে যুদ্ধে এসেছে, যাতে গো হত্যার ভয়ে আমরা অস্ত্র নিক্ষেপ না করি। এই রাক্ষসেরা ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়েছে। মেঘনাদ যতদিন বেঁচে থাকবে সে দুর্মতি রাবণের শক্তিবৃদ্ধি করে অধর্ম বিস্তার করবে। আমি শপথ নিয়েছি এই রাক্ষসদের বিনাশ করবার। ধর্ম, ন্যায়, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যদি ছল অবলম্বন করা যায়- তবে তাহা পাপ বলে গণ্য হয় না। বালীকে বধ করবার সময় আমি নিজেও এইরূপ পথ অবলম্বন করেছি। চতুরতা দ্বারা যদি মহৎ কাজ সম্পন্ন হয়- তবে তাহা পাপ নয়।” এইভাবে লক্ষ্মণকে বুঝালেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৬)

রাবণের শত রানীর পুত্রদের অধিকাংশ যুদ্ধে মারা গেছে। কুম্ভকর্ণ কি বিভীষণ তাদের সন্তানরাও নিহত। রাবণ রাজসভায় বসলেন। রাজসভা শূন্য প্রায় । রাক্ষস সেনার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসছে। লঙ্কায় যতদূর দেখা যায় তত দূর কেবল অন্ধকার। কোন বাটিটে আলো জ্বলছে না । সর্বত্র শোক। রাক্ষসদের কান্না ভিন্ন আর কিছুই শোনা যায় না। রাবণ ভাবছিলো কি করা যায়। সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব। কারন এতে ত্রিলোকবিজয়ী রাবণের বীরত্ব নিয়ে সংশয় হবে। নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হবে। ইন্দ্রজিৎ এসে রাবণ কে সান্ত্বনা দিলো। বলল- “পিতা! এই যুদ্ধ শক্তি বলে জয় করা অসম্ভব। আমি শুনেছি- শ্রীরাম বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র মুনি থেকে অতি ভয়ানক দিব্যাস্ত্র সকল প্রাপ্ত করেছেন। এছারা দেবতারা ওনাকে শার্ঙ্গ ধনুক ও নানা দিব্যাস্ত্র সকল প্রদান করেছেন । অতএব আমাদের চতুরতার অবলম্বন করা উচিৎ। পূর্বে একবার সেই রামকে মায়া দ্বারা নির্মিত সীতার মুণ্ড দেখিয়েছিলাম। শোকে সে দুর্বল হয়েছিলো। এবার সেই উপায় পুনঃ অবলম্বন করা উচিৎ। আমি বিদ্যুৎজিহ্ব কে সংবাদ দিয়েছি। সে এসে পুনঃ এক নকল মূর্তি মায়া দ্বারা গঠন করবে। এবার আর কাটা মুণ্ড নয়। জীবন্ত এক সীতার মূর্তি। আমি তাহাকে রামের সামনে বধ করলে সে নিশ্চয়ই শোক পেয়ে উম্মাদ হয়ে যুদ্ধ থেকে পলায়ন করবে।” বিদ্যুৎজিহ্ব রাক্ষস আসলো। রাবণ তাহাকে অনেক ধনরত্ন প্রদান করলো। মায়াবী বিদ্যুৎজিহ্ব একরাতের মধ্যে একটি নকল সীতার মূর্তি নির্মাণ করলো। সেই সীতা ছিলো একদম রামের প্রেয়সী সীতার ন্যায়। এমনকি তাঁর চালচলন, কথাবার্তা সব কিছুই জানকীর ন্যায়। সে সীতার মতোই পোশাক পরিহিত ছিলো । রাবণ সব দেখে অট্টহাস্য করে বলল- “পুত্র মেঘনাদ! কালই তুমি এই মায়াবী সীতাকে বধ করবে। এমন নিষ্ঠুর ভাবে বধ করবে যেনো রামচন্দ্র শোকে উম্মাদ হয়ে ‘হা সীতা’ বলে রোদন করে বেড়াতে থাকে। একবার রামকে ধ্বংস করতে পারলেই ঐ বনের পশু গুলিকে পিষে বধ করা যাবে।”

পরের দিন সকালে মেঘনাদ তার রথে মায়াবী সীতাকে বসালো। মায়াবী সীতাকে সকল কিছুই বোঝানো হয়েছিলো। ঝলমলে আকাশ আজ। আকাশে কেবল মেঘের রাশি। শরতের শোভা চতুর্দিকে খেলে গেছে । বানরেরা বৃক্ষ, প্রস্তর ধারন করে অপেক্ষা করছিলো কখন লঙ্কার দ্বার খুলে রাক্ষসেরা বের হবে। না জানি আজ কোন বীর আসবে। বিভীষণ বলেছিল লঙ্কার আর তেমন বড় কোন বীর আর বেঁচে নেই। যে আসবে, তাহাকেই সমুচিত জবাব দিতে হবে। হঠাত আকাশে শোনা গেলো এক নারীকণ্ঠ। সে আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে বলছিল – “কোথায় আছেন আমার স্বামী রঘুনাথ। এই পাপীর হস্ত থেকে আমাকে রক্ষা করুন। এ আমাকে বধ করবে। হে দেবর লক্ষ্মণ! আমাকে রক্ষা করো।” হনুমান নিজেও ধোঁকার ফাঁদে পড়লো। সে সীতাদেবীকে দেখেছিলো। সে বলল- “মেঘনাদ! এমন করিস না। বীর পুরুষের নারীহত্যা নিন্দনীয়। এসে আমাদের সাথে যুদ্ধ কর। নারী হত্যা নিকৃষ্ট কর্ম।” মেঘনাদ অট্টহাস্য করে বলল- “কোথায় তোর রাম? ডাক তাহাকে। সে এসে দেখুক লঙ্কারাজ রাবণের সাথে যুদ্ধের পরিণাম কি? অনেক দিন আমরা রোদন করেছি। আজ সে রোদন করবে , আমরা তাহা দেখে আনন্দ উপভোগ করবো।” মায়াবী সীতা বলল- “পুত্র হনুমান! আমাকে রক্ষা করো বাবা! এই রাক্ষসের হস্ত থেকে আমাকে উদ্ধার করো।” শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ দৌড়ে যুদ্ধভূমিতে এসে বললেন- “মেঘনাদ! তুমি এমন পাপ করো না। তুমি বীর! ইন্দ্রকে পরাজিত করেছো। কেন এমন নারী বধের ন্যায় কাপুরুষতার কর্ম করবে? এখুনি সীতাকে এনে আমাকে প্রদান করো। আমি কথা দিচ্ছি এই মুহূর্তে আমি যুদ্ধ বন্ধ করে চলে যাবো।” মেঘনাদ বলল- “দেখ রাম ! তোর সামনেই আমি তোর স্ত্রীকে হত্যা করবো। স্বজন হারানোর বেদনা এবার তুই পাবি।” এই বলে মেঘনাদ তরবারির এক আঘাতে মায়া সীতার মস্তক কেটে ফেলল। মায়া সীতার রক্ত আকাশ থেকে বৃষ্টির ন্যায় ভূমিতে পড়লো। শ্রীরাম সেখানে বসে শোকে স্তব্ধ হলেন। মুখের কথা আর বের হল না। চলন গমন দেখা গেলো না। লক্ষ্মণ বলল- “মেঘনাদ! তোর আমি এমন অবস্থা করবো যে রাক্ষসেরা আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যদি এই যুদ্ধে তোকে আমি বধ না করতে পারি, আমি নিজে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবো।”

এরপর লক্ষ্মণ গিয়ে তাঁর ভ্রাতাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। শ্রীরাম বললেন- “হে লক্ষ্মণ! আর কি লাভ যুদ্ধে ? সীতাই যখন নেই, তখন এই রাম আর কিভাবে ধনুক ধরবে । সীতাই ছিলো আমার শক্তি, আমার অনুপ্রেরণা। সীতাই, হনুমান মারফৎ আমাকে সংবাদ দিয়ে আমাকে কঠোর হতে বলেছিলেন। আমি তাই হয়েছি। কিন্তু আজ যখন সীতাই নেই, আর কি হবে কঠোর হয়ে যুদ্ধ করতে ? যার জন্য যুদ্ধ, সেতো আর বেঁচে নেই। সীতা বিহীন শ্রীরামও আর থাকবে না। আমি এই নরদেহ এখন ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠ গমন করবো।” বিভীষণ দূত মারফৎ সব সংবাদ পেয়েছিলো। সে জানতো আসল সীতা অশোক বনে জীবিত। বিভীষণ বলল- “প্রভু! আর শোক করবেন না। এ এক মায়া ছিলো। আপনার কি স্মরণ আছে যে যুদ্ধ শুরুর আগে এমন নকল সীতাদেবীর মুণ্ড আপনাকে দেখানো হয়েছিলো? আসলে আমার অগ্রজ দশানন চান যে সীতা নিহত ভেবে আপনি দুর্বল হয়ে যুদ্ধ ত্যাগ করে চলে যান। মায়াবী রাক্ষস বিদ্যুৎজিহ্ব এই সবের মূলে। সে পুনঃ মায়া সীতার মূর্তি রচে মায়ার খেলা দেখিয়েছে। প্রভু আপনি স্বয়ং মায়াধীশ। মায়ার কবলে আপনি পড়বেন না।” বিভীষণের কথা শূনে ভগবান রাম সুস্থ হলেন। বিভীষণের দূতেরা জানালো সে সত্যই সীতাদেবী অশোক বনে সুরক্ষিত আছেন। শ্রীরাম বললেন- “এবার মায়াবী বিদ্যুৎজিহ্ব রাক্ষসের বধ প্রয়োজন। জানি সে শিল্পী। সে যুদ্ধে আসে না। কিন্তু বারংবার মায়া রচনা করে রাবণকে সহায়তা করে অধর্মের সঙ্গ দিচ্ছে। যে অধর্ম করে আর যে অধর্মের সঙ্গ দেয়- উভয়ে সমান পাপী। অতএব বিদ্যুৎজিহ্ব কে নাশ করা প্রয়োজন।” ভগবানের আদেশে রাত্রিকালে হনুমানের পৃষ্ঠে আরোহণ করে লক্ষ্মণ আর বিভীষণ লঙ্কায় প্রবেশ করলেন । বিভীষণ হনুমানকে চিনিয়ে দিলো বিদ্যুৎজিহ্বের বাটি । লক্ষ্মণ সেখানে প্রবেশ করতেই বিদ্যুৎজিহ্ব আর লক্ষ্মণের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হল। সংবাদ পেয়ে রাক্ষসেরা ছুটে আসতে লাগলো। লক্ষ্মণ বলল- “রে দুরাচারী! তুই যুদ্ধ করিস নি ঠিকই । কিন্তু বারংবার মায়াজাল রচনা করে রাবণকে সহায়তা করছিস। এই পাপে তোর বধ করতে বাধ্য হলাম।” এই বলে লক্ষ্মণ ধনুকে “খড়্গ বাণ” প্রকট করে সেই বাণ ছুড়লেন। দেখতে দেখতে লক্ষ্মণের নিক্ষিপ্ত অস্ত্রে মায়াবী রাক্ষস বিদ্যুৎজিহ্বের দেহ তিন টুকরো হল। এরপর বিভীষণ ও লক্ষ্মণ উভয়ে হনুমানের পৃষ্ঠে বসলেন। হনুমান লম্ফ দিয়ে শূন্যে উঠে পুনঃ ফিরে আসলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৫)




লঙ্কার বীরেরা একে একে নিহত হচ্ছে দেখে রাবণ খুবুই ভেঙ্গে পড়লো । রাজসভাতে আসন একে একে শূন্য হচ্ছে। যে বীর যুদ্ধে যায় সে যেনো মৃত্যুর মুখে যায় । আর ফিরে আসে না। রাবণ তখন পুত্র বীরবাহুর কথা মনে পড়লো । বীরবাহু ছিলো রাবণের গন্ধর্ব জাতির স্ত্রীর পুত্র । সে সময় বীরবাহু গন্ধর্বলোকে ছিলো। রাবণ সংবাদ প্রেরণ করলো। বহুকাল ধরে বীরবাহু লঙ্কায় ছিলো না দেখে সে লঙ্কার ব্যাপারে কিছুই জানতো না। লঙ্কায় ফিরে আসলে রাবণ তাকে সকল কথা বলল। পুত্রকে দেখে রাবণ স্নেহ প্রদান করে যুদ্ধে যেতে আদেশ দিলো । বীরবাহু বলল-

বীরবাহু বলে, শঙ্কা না কর রাজন ।


ইঙ্গিতে মারিয়া দিব শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।।
এত বলি বীরবাহু ভাবে মনে মন ।
বিষ্ণুহস্তে মৈলে যাব বৈকুণ্ঠ ভুবন ।।
বীরবাহু বলে পিতা তুমি জান ভালে ।
ইন্দ্র আদি দেব কাঁপে আমারে দেখিলে ।।
বিদায় করহ যাব রণের ভিতর ।
এত বলি বীরবাহু চলিল সত্বর ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

বীরবাহু অল্পকালে ব্রহ্মার আরাধনা করে অদ্ভুদ এক বর পেয়েছিলো। ব্রহ্মা , তাহাকে একটি দিব্য হস্তী দিয়েছিলো। বলেছিলেন যে যতক্ষণ যুদ্ধে সেই দিব্য হস্তী জীবিত থাকবে ততক্ষণ বীরবাহুর নিধন অসম্ভব। কিন্তু সেই হস্তী নিধন হলে বীরবাহু মরবে । বীরবাহু সেই হস্তীর পৃষ্ঠে গদা, মুষল, বর্শা, ধনুক, শর পূর্ণ তূণ, তরবারি নিয়ে উঠলো । রাবণের আদেশে ধূম্রাক্ষ , ভস্মাক্ষ নামক অতি বীর রাক্ষস চলল । হস্তী, ঘোড়া, রথ , বীভৎস দর্শন রাক্ষসেরা নানা ঘাতক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে চলল। রাক্ষসদের অট্টহাস্যে গগন মণ্ডল ধবনিত হল। লঙ্কার দ্বার খুলতেই রাক্ষসেরা বের হল। রাক্ষস আর বানরদের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হল। দুই দলমিলেমিশে গেলো। যতদূর দেখা যায় কেবল রক্তের বহির্গমন , অঙ্গপ্রত্যঙ্গচ্ছেদ আর মৃত্যুচিতকার ছাড়া অপর কিছুই শোনা যায় না। রাবণের প্রেরিত গজহস্তীরা তাণ্ডব করে কপি কটক নষ্ট করতে লাগলো।

কপি সেনারা উচ্চমাত্রার প্রস্তর নিক্ষেপ করে হস্তীগুলিকে নিধন করলো । গদা, বর্শা দ্বারা রথ গুলিকে নষ্ট করলো। জাম্বুবানের ভল্লুক সেনারা যখন হৈহৈ করে এগিয়ে গেলো তখন বীরবাহু তীক্ষ্ণ শরে জাম্বুবানের কটক ছিন্নভিন্ন করে দিলো। ধরাশায়ী হয়ে জাম্বুবান পালালো । নল, নীল দুই ভ্রাতা বীরবাহুর দিকে বৃহৎ প্রস্তর নিক্ষেপ করলে বীরবাহু অনায়েসে প্রস্তর খণ্ডখণ্ড করে দিলো। নল নীলের দিকে মণিবাণ নিক্ষেপ করলো। নল, নীল উভয়ে পলায়ন করলো। গবাক্ষ, কুমুদ, দিবিদ, কেশরী, গয়, সুবের নামক বানরেরা যুদ্ধ করতে আসার আগেই বীরবাহুর নিক্ষিপ্ত শরে কিছুই আর করতে পারলো না। সকলে পলায়ন করলো। অঙ্গদ, সুগ্রীব আসলে উভয়ে বীরবাহুর শরে আহত হল। হনুমানের সমস্ত শরীর থেকে রক্তধারা বের হল। এরপর বড় বড় বীরেরা পলায়ন করলে বীরবাহু অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন। কোটি কোটি বানরেরা ভস্ম হল। পর্বত বাণ নিক্ষেপ করা মাত্র বিশাল পর্বত কপিদলের মাঝে পড়ে কপিদের পিষ্ট করলো। ব্জ্রবাণ নিক্ষেপ করলে, বাজ পড়ে কপিরা নষ্ট হল। বানরেরা গিয়ে ভগবান শ্রীরামের কাছে বললেন- “প্রভু ! এই রাক্ষস আজ সব ধ্বংস করে দেবে। আপনি কিছু করুন।” বিভীষণ তখন বীরবাহুর পরিচয় দিয়ে ব্রহ্মার বর প্রদানের ঘটনা বললেন। ভগবান শ্রীরাম তখন যুদ্ধে আসলেন। তাঁর পেছনে বানরেরা যুদ্ধে আসলো। ভগবান শ্রীরাম চোখের নিমিষে নানা দিব্যাস্ত্রে কোটি কোটি রাক্ষস বধ করলেন। রাক্ষসেরা ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে পড়লো । ধূম্রাক্ষ কে এত বাণ মারলেন যে ধূম্রাক্ষ রাক্ষসের সকল অস্ত্র, ধনুক, বর্ম ধ্বংস হল। অন্তিমে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম ধনুকে অর্ধচন্দ্র বাণ জুড়লেন। সেই মহাস্ত্র থেকে এত জ্যোতি বের হল যে চতুর্দিকে কেউ আর চোখে মেলে তাকাতে পারলো না। ভগবান শ্রীরাম সেই অর্ধচন্দ্র বাণ ধূম্রাক্ষের দিকে ছুড়লেন । ধূম্রাক্ষ প্রাণ ভয়ে পালাতে লাগলো। কিন্তু রেহাই পেলো না। অর্ধচন্দ্র বাণ সোজা গিয়ে ধূম্রাক্ষের মুণ্ড কেটে ফেললো ।

ভস্মাক্ষ রাক্ষস তখন ক্রোধে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভগবানের রামের দিকে কালপাশ, মহাশিরা, উল্কা বাণ নিক্ষেপ করলেন। ভীষণ দিব্যাস্ত্র সকল আসতে দেখে ভগবান শ্রীরাম জ্বালা বাণ, বরুণ বাণ, ইন্দ্রাস্ত্র সকল নিক্ষেপ করলেন। রাক্ষসের অস্ত্রগুলি ধ্বংস হল। কিন্তু ভস্মাক্ষ হার মানলো না। নানা প্রকার ঘাতক অস্ত্র সকল নিক্ষেপ করতেই থাকলো। গদা, বর্শা নিক্ষেপ করলো। ভগবান শ্রীরাম তাহা ধ্বংস করে দিলেন । এর পর ভগবান শ্রীরাম ইন্দ্রচক্র নামক শর ধনুকে যোজনা করলেন । সেই বাণ থেকে এত ঘোর শব্দ আসছিলো যে সমুদ্রে উথালপাতাল অবস্থা হল। ভগবান শ্রীরাম সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন । সেই বাণ ভয়ানক শব্দে ছুটে আসলো। দেখতে দেখতে সেই বাণের আঘাতে ভস্মাক্ষের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে পড়লো। বীরবাহু তখন সমানে কপিদের নিধন করেই যাচ্ছেন। ভগবান শ্রীরামকে দেখে অন্তরে অন্তরে প্রণাম জানালেন। ভগবান শ্রীরাম বললেন- “বীরবাহু ! তোমার মধ্যে দেবত্ব ভাব আছে। কারণ মাতার বংশ অনুযায়ী তুমি গন্ধর্ব। আমি চাইনা কোন দেবাংশকে হত্যা করতে। অতএব যুদ্ধ হতে পলায়ন করো।” যাহাত প্রভুর হস্তে মৃত্যু প্রাপ্তি হয় তার জন্য বীরবাহু , প্রভু শ্রীরামকে নানান কুবাক্য বলতে লাগলেন। বললেন- “আমি দশানন পুত্র। আমি আজ তোমাদের হত্যা করবো।” এই বলে বীরবাহু নানা অস্ত্রে প্রভু শ্রীরামের সেনাদের হত্যা আরম্ভ করলেন ভগবান শ্রীরাম জবাব দিতে লাগলেন। বীরবাহুর অস্ত্র সকল ধ্বংস করলেন। বীরবাহুকে অনেক আঘাত করলেন। কিন্তু কিছুতেই বীরবাহু মরে না। তখন বিভীষণের কথা মনে হল। ধনুকে ব্রহ্মশিরা অস্ত্র জুড়লেন । সেই অস্ত্র ছুড়লেন। সেই অস্ত্রের আঘাতে বীরবাহুর সেই দিব্য হস্তীর শিরোচ্ছেদ হল। বীরবাহু ভূপতিত হলে ভগবান শ্রীরাম বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। দেখতে দেখতে ভগবান শ্রীরামের বাণে বীরবাহুর শিরোচ্ছেদ হল । এইভাবে সেদিনের যুদ্ধ সমাপন হল।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৪)


যুদ্ধের সংবাদ শুনে রাবণ বিমর্ষ হয়ে পড়লো। একের পর এক বীর মারা যাচ্ছে। চতুরতার দ্বারাও রক্ষা করা যাচ্ছে না। এখন উপায় কি? কুলঘাতী বিভীষণের নাম স্মরণ মাত্রেই বিভীষণের পুত্র তরণীসেনের কথা মনে পড়লো। ভাবল এবার তাকেই যুদ্ধে পাঠানো হবে। দেখি বিভীষণ কার পক্ষ নেয়। রামের না নিজ পুত্রের। ইষ্ট বড়- না পুত্র। ভক্তি আর বাৎসল্যের মধ্যে দেখা যাক কার জয় হয়। সঙ্গে সঙ্গে তরণীসেনকে সংবাদ দেওয়া হল। তরণী এলে রাবণ বলল- “পুত্র! তোমার আর মেঘনাদের মধ্যে আমি কোন ভেদ দেখি না। তুমিও আমার পুত্রসম । আমার ভ্রাতা আমার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আমার বিশ্বাস তুমি এরূপ করবে না। অক্ষয়কুমার , নরান্তক, দেবান্তক, ত্রিশিরা, মকরাক্ষ এরা তো তোমারই সহোদর ছিলো । জাতিতে তুমিও রাক্ষস। আমি তোমার পিতাকে বিদায় করলেও তোমাদের ত আদর যত্ন করি না- এমন ত নয়। এই দুর্দিনে তুমি লঙ্কার সম্মান রক্ষা করো। যদি আমি সীতাকে এখন রামের হাতে তুলে দেই তাহলে লঙ্কার রাজার অপমান হবে, লঙ্কার অপমান হবে। ত্রিলোক বলবে লঙ্কা ঐ দুই ভিখারীর চরণে নতমস্তক হয়েছে। তুমি কি চাও তোমার জন্মভূমির এই বদনাম হোক?” তরণী বুঝতে পারলো যে খুঁড়ামহাশয় এইসব বলে তাহাকে অধর্মের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতে বলছে। তবুও সে বলল- “খুঁড়ামহাশয়। আমি এই যুদ্ধে যাবো। শ্রীরামের সাথে যুদ্ধের পরিণাম কি, তা আমি জানি। যুদ্ধে আমি নিহত হই কি বেঁচে থাকি। কিন্তু লঙ্কার সম্মান বজায় রাখবো।” তরণীসেন নিজ মাতা সরমার কাছে বিদায় নিতে গেলো । সরমা বলল- “পুত্র তুমি কি যেচে মৃত্যুকে বরণ করতে যাচ্ছো? শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করার ফল কি জানো না? এই রকম প্রস্তাবে কেন সায় দিলে? চলো আমি আর তুমি গোপোনে তোমার পিতার নিকট যাই। শ্রীরামকে কেহই পরাজিত করতে পারেন না। তোমার পিতা বলতেন যে রাক্ষস জাতির নাশ করেই উনি লঙ্কা থেকে প্রস্থান করবেন। অতএব যুদ্ধের বিচার ত্যাগ করো।” তরণীসেন বলল- “মাতা! এই যুদ্ধের পরিণতি আমি জানি। লঙ্কার পরাজয় হবে। কিন্তু দেশে আক্রমণ হলে দেশবাসীর কর্তব্য শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা। আমি সেই নিয়ম পালন করতে করতে বীরগতি ও মুক্তি পেতে চাই। মাতঃ সকলে আমাকে বিশ্বাসঘাতকের পুত্র বলে লঙ্কায় উপহাস করে। তোমাকে বিশ্বাসঘাতকের পত্নী বলে ব্যঙ্গ করে। আমি এমন কিছু করে যেতে চাই, যাতে লঙ্কার লোকেরা আমাদের উপহাস না করে। তুমি আমাকে ত্যাগ করে সেই মিথ্যা দোষকে খণ্ডন করো।”

তরণীসেন আরোও বলল- “মাতঃ! আমি জানি শ্রীরাম পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণ। তিনি রাক্ষসদিগের বধ করে তাহাদের মুক্তি প্রদান করছেন। এই সুযোগ কিভাবে হাতছাড়া করি? আমার ইষ্ট আমাদের সামনে। একবার তাঁহার দর্শন লাভ অবশ্যই করবো। তুমি আমাকে বিদায় দাও।” এই বলে তরণীসেন মাতাকে বুঝালে চোখের জলে সরমা বিদায় দিলেন। কারণ সরমা জানেন এই তার শেষ সাক্ষাৎ পুত্রের সাথে। লঙ্কার অনান্য মাতাদের ন্যায় এবার তার গর্ভ খালি হবে। প্রভাতে চতুর অক্ষৌহিণী সেনা দিলেন রাবণ। ত্রিজটার ভ্রাতা মায়াবী ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত বক্রজটাকে সেনাপতি করে দিলেন । তরণীকে আলিঙ্গন করে রথে বসালেন । মেঘনাদ , ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন । সাড়ি সাড়ি রথে যার মস্তকে নানা পতাকা উড়ছিলো, রাক্ষসেরা ধনুর্বাণ , মুষল, খাণ্ডা, শেল, শূল, গদা, তরোয়াল নিয়ে উঠলো । সরমা কপাট রোধ করে ভূমিতে আছরে কাঁদতে লাগলো। কারণ জানে তার সন্তান আর ফিরবে না। তরণীসেনের নেতৃত্বে রাক্ষসেরা সব বের হল। হৈহৈ করে বের হল। বানরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বানেরার বৃক্ষ, প্রস্তর নিক্ষেপ করে রাক্ষস ধ্বংস আরম্ভ করলো । ভগবান শ্রীরাম বললেন- “মিত্র বিভীষণ! ঐ রথে আসীন তেজস্বী প্রতাপী বালক কে? সে যুদ্ধ বিদ্যায় এত পারঙ্গদ। সে বোধ হয় আমার ভক্ত। কারণ তাঁর অঙ্গে তিলক, মাল্য শোভা দেখা যাচ্ছে। কে সেই বীর?” বিভীষণ আর কি বলে? পুত্রকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো । আজ তার কোল খালি হবে। অশ্রু চেপে হৃদয়ে পাথর চাপা দিয়ে বলল- “প্রভু ! এ এক লঙ্কার অতি বীর। একে রোধ না করলে আজ এ সমস্ত বানর সেনার নাশ করেই ছাড়বে।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “ভক্তের দেহে সূচাগ্র বিদ্ধ হলে আমার দেহে শেল বিদ্ধ হয়। আমি আমার ভক্তের ওপর কিভাবে অস্ত্র নিক্ষেপ করবো? এই যুদ্ধ না জানি আর কি কি দেখাবে?” তরণী সত্যই বীর ছিলো। বিভীষণ বলল না যে এ তার ছেলে, পাছে প্রভু আর যুদ্ধ না করেন । তরণীর প্রবল বিক্রম আরম্ভ করে চোখের পলকে লক্ষ লক্ষ বানর, ভল্লুক, লাঙ্গুর, মর্কট বধ করলো। অঙ্গদ, গবাক্ষ, নল, নীল, সুগ্রীব, মৈন্দ, দিবিদ, কেশরী আদি বানরেরা পলায়ন করলো পরাজয় মেনে। হনুমানের দেহ রক্তাক্ত হল। অপরদিকে বক্রজটার সাথে লক্ষ্মণের ঘোরতর যুদ্ধ হল ।

লক্ষ্মণ যত বাণ মারে বক্রজটার কিছুই হয় না। তখন বিভীষণ বলল- “লক্ষ্মণ ঠাকুর! বক্রজটা ব্রহ্মার বর পেয়েছে যে সে ব্রহ্মার প্রদত্ত কোন অস্ত্রেই মরবে না। আপনি এমন কোন বাণ নিক্ষেপ করুন যাহা ব্রহ্মার অস্ত্রভাণ্ডারে নেই।” তখন লক্ষ্মণ ব্রহ্মার সকল অস্ত্রের চেয়েও বহুগুণ ক্ষমতা শালী ‘ব্রহ্মজিৎ’ অস্ত্র নিক্ষেপ করলো। সেই অস্ত্রে বক্রজটার মুণ্ড কেটে মাটিটে পড়লো। বক্রজটা নিহত হতেই লক্ষ্মণ তরণীর সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলো। তরণীর হস্তে পরাজিত হল । তখন শ্রীরাম সামনে এসে বললেন- “রোস বালক! তোর ধৃষ্টতা এতক্ষণ আমি বালকজ্ঞান করে ক্ষমা করেছি। যা ফিরে যা। নচেৎ তোর বধ করবো।” তরণী নিজেও বলল না যে সে বিভীষণের সন্তান, পাছে প্রভু তাঁকে বধ না করেন । তরণী ধনুক রেখে করজোড়ে স্তবস্তুতি করে বলল- “হে মর্যাদা পুরুষোত্তম। আপনিই সেই নারায়ণ! আপনি ত্রিলোক স্বামী । আপনি জগতের রক্ষক । হে ভগবন আপনি মৎস্য, কূর্ম , বরাহ, নৃসিংহ , বামন , পরশুরাম অবতার গ্রহণ করেছেন। আপনিই এখন রাম রূপে আমার সামনে । হে রঘুনাথ। আমি আপনার স্তব কিভাবে করবো ? বেদবেদান্তে আপনাকে পরব্রহ্ম বলে স্তবস্তুতি করেও মুনি ঋষিরা আপনার সম্পূর্ণ মহিমা কীর্তন করতে অসমর্থ হয়েছেন। হে ভগবান। আপনাকে প্রণাম জানাই।” এইভাবে স্তবস্তুতি জানালে ভগবান শ্রীরাম প্রসন্ন হয়ে বললেন- “তবে বালক! ফিরে যাও! ভক্তের ওপর আমি অস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারি না।” তরণী বলল- “তবে আপনি আমার সাথে যুদ্ধ না করলে আমি সম্পূর্ণ বানর সেনা নষ্ট করবো।” এই বলে তরণী বানর কটক নষ্ট করতে থাকলে ভগবান শ্রীরাম যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। ভক্ত আর ভগবানের যুদ্ধ দেখছিলেন হর গৌরী, ব্রহ্মা- সরস্বতী , ইন্দ্রাদি দেবতারা। এই দৃশ্য বড়ই দুর্লভ । তরণী যত অস্ত্র নিক্ষেপ করে সব অস্ত্রই নিবারণ করেন প্রভু শ্রীরাম । অন্তে প্রভু শ্রীরাম “ব্রহ্মশক্তি” বাণ নিক্ষেপ করলেন । সেই বাণে তরণীর বুক বিদীর্ণ হল। মাটিটে পড়ে ‘রাম’ নাম জপতে লাগলো। রাক্ষসেরা পলায়ন করলো। বিভীষণ ‘হা!পুত্র’ বলে তরণীর নিকট গেলেন। শ্রীরাম সব দেখে অবাক ! বললেন- “মিত্র! তুমি আগে কেন বল নি এ তোমার পুত্র! হায় ঈশ্বর! এই যুদ্ধ আর কি কি পরিস্থিতি সামনে আনবে! আমি কিনা আমার মিত্রের সন্তানের হত্যা করলাম।” তরণী সেই অবস্থায় ভগবান শ্রীরামের চরণ ছুয়ে বলতে লাগলেন- “প্রভু এ হত্যা নয়। মুক্তি। আপনার শ্রী চরণ স্পর্শ করে দেহ ত্যাগের ভাগ্য কজন লাভ করে?” এই শুনে প্রভু শ্রীরাম রোদন করতে লাগলেন। তরণীর মস্তক ক্রোড় নিয়ে মস্তকে হস্ত বুলাতে লাগলেন। বানরেরা এই দেখে রোদন করতে লাগলো। ধীরে ধীরে তরণীর শেষ নিঃশ্বাস বের হয়ে গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৩)


ভগ্নদূত গিয়ে দশাননকে সংবাদ দিলো যে কুম্ভ ও নিকুম্ভ বীরগতি প্রাপ্ত করেছে। রাবণ মাথায় হাত দিয়ে বসলো । লঙ্কার বীরদের নিথর দেহ ঘীরে তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা রোদন করতে লাগলো । ক্রন্দনে লঙ্কার আকাশ বাতাস ভরে গেলো । সাদা শাড়ি পড়ে বিধবারা শাঁখা পলা বিসর্জন দিয়ে, সিঁথির সিঁদুর মুছে মাটিটে পড়ে রোদন করতে লাগলেন । লঙ্কার সাগর পারে লক্ষ কোটি চিতা জ্বলে উঠলো । লঙ্কার বাতাসে কান পাতলেই কেবল রাক্ষসদের পরিবারের হাহাকার আর রোদন ছাড়া কিছুই শোনা গেলো না। মন্দোদরী সেই বিধবাদের পাশে নিজেকেও সাদা থান পড়ে দেখতে পেলো ভোরে স্বপ্নে। অত্যন্ত আশাঙ্কিত হল। আরোও দেখলো পুত্রবধূ প্রমীলা, মেঘনাদের ছিন্নমুণ্ড ক্রোড়ে নিয়ে চিতায় উঠে সতী হয়েছেন । এসব দেখে মন্দোদরী অনেক ভয় পেলো। কিন্তু দশানন তার স্ত্রীর কথা এক কর্ণ দিয়ে শুনে অপর কর্ণ দিয়ে বহিষ্কার করলো । কুম্ভকর্ণের ঘৃহে শূন্য হল। প্রভাত হল । হঠাত রাবণের মনে পড়লো, তার ভ্রাতা খড় শ্রীরামের বাণে হত হয়েছে পঞ্চবটিটে। খড়ের পুত্র মকরাক্ষ ত আছে। সে পিতার ন্যায় বুদ্ধিমান । অত্যন্ত ধুরন্ধর সে। অনেক বুদ্ধি রাখে। তাহাকেই যুদ্ধে প্রেরণ করা হোক। তখুনি সেনারা গিয়ে মকরাক্ষকে ডেকে আনলো । মকরাক্ষ বীর দর্পে খুড়া দশাননের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো। রাবণ বলল- “পুত্র ! তুমি এই বিপদে ভরসা । লঙ্কার প্রচুর বীর হত হয়েছে। আমার রাজসভায় যে বীরেরা অলঙ্কৃত করতো, যাহাদের দেখে ত্রিভুবন ভয় পেতো তারা সকলে বানরদের হস্তে হত হয়েছে। তুমি বিহিত করো। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সব নাশ করে দাও। রাম, লক্ষ্মণের কাটা মুণ্ড এনে আমাকে দেখাও।” মকরাক্ষ বলল- “আমি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম খুঁড়ামহাশয়! সেদিন পঞ্চবটিটে যদি আমি থাকতাম , তবে সেইদিনই রাম, লক্ষ্মণের বধ করে সীতাকে এনে আপনার হস্তে দিতাম। কিন্তু রামের ভাগ্য ভালো যে সেদিন আমি ছিলাম না। কিন্তু সেদিন যা করিনি , আজ তা করবো।”

মন্দোদরী বলল- “না পুত্র! তুমি সেই যুদ্ধে যেয়ো না। তুমি বরং লঙ্কা ছেড়ে পলায়ন করো। যে এই লঙ্কাতে থাকবে সেই হত হবে। ওনার দম্ভ আর দর্প সকলকে মৃত্যুর মুখে প্রেরণ করবে।” রাবণ বকাঝকা করে বলল- “মন্দোদরী! তুমি ময় দানবের কন্যা। জাতিতে দানবী হয়েও কেন মনুষ্য, বনের পশুকে ভয় করো? কেন যুদ্ধে গমনরত বীরকে মৃত্যুভয় প্রদর্শন করছ ? তোমার কর্তব্য মকরাক্ষকে আশীর্বাদ করে যুদ্ধে প্রেরণ করা। কিসের তোমার এত ভয়?” মকরাক্ষ তখন বলল- “আপনি চিন্তা করবেন না খুঁড়িমা। আমি যুদ্ধে গেলে দেখবেন ঐ দুই নর আর বনের পশুরা পলায়ন করবার পথ পাবে না। পিষে পিষে তাদের মৃত্যু প্রদান করবো। আমার শক্তি তারা দেখেনি।” রাবণ তিন অক্ষৌহিণী সেনা দিয়ে মকরাক্ষকে যুদ্ধে পাঠাবে স্থির করলো। মকরাক্ষ বলল- “খুঁড়ামহাশয়! আমি এক বুদ্ধি রচেছি। যাহাতে অল্প সময়ে সমস্ত বানর আর দুই নরকে বধ করা যাবে। তাহারা দুজন আর্য । তাহারা গো হত্যা করে না। আজ যুদ্ধে কোন হস্তীবাহিনী বা অশ্বারোহী যুদ্ধে যাবে না। আপনি গোশালা থেকে বৃষদের প্রদান করুন। আজ সমস্ত রথে অশ্বের বদলে বৃষভ থাকবে। অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনীর পরিবর্তে রাক্ষসেরা আজ বৃষভবাহিনী হয়ে যুদ্ধ করবে। পাছে বৃষের অঙ্গে আঘাত লেগে গোহত্যা হয় এই ভয়ে তারা আজ যুদ্ধ করবে না। আমরা অনায়েসে অস্ত্র দিয়ে তাহাদিগের প্রাণহরণ করবো।”

কিন্তু এক সুমন্ত্রণা আছয়ে ইহার ।
শুনিয়াছি রঘুনাথ বিষ্ণু অবতার ।।
বড়ই ধার্মিক রাম, ধর্মেতে তৎপর ।
অস্ত্রাঘাত না করেন গরুর উপর ।।
এতেক ভাবিয়া মকরাক্ষ নিশাচর ।
যুক্তি ক’রে ধেনু বৎস আনায় বিস্তর ।।
নব নব বৎস সব রথে লয়ে তোলে ।
রথের চৌদিকে ধেনু বান্ধে পালে পালে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এতেক ভাবে মকরাক্ষ লঙ্কার দ্বার খুলে যুদ্ধে বের হল। বানরেরা প্রস্তর বৃক্ষ নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে আশ্চর্য হল। একটাও অশ্ব বা হস্তী নেই। সব ধেনু, বৃষভ, বাছুর । এখন কিভাবে অস্ত্র নিক্ষেপ করা যাবে। হনুমান বলল- “কেহ অস্ত্র নিক্ষেপ করবে না। গোহত্যা হলে প্রভু শ্রীরাম কিন্তু আর হয়তো যুদ্ধ করবেন না।” এই সুযোগে রাক্ষসেরা লক্ষ লক্ষ কপি নিধন করতে থাকলো। কপিরা কোন অস্ত্রের আঘাত করতে পেলো না।

মকরাক্ষ রাক্ষসদের আদেশ দিলো- “তোমরা আমার সম্মুখে থেকে বানরদের হত্যা করবে । আজ মহারাজ রাবণের আদেশে আমি রাম, লক্ষ্মণ আর সুগ্রীবকে বধ করবো।” কামরূপী, পিঙ্গলনেত্র , অতি ক্রুড় রাক্ষসেরা গোরথ ও গোপৃষ্ঠে চেপে অনবরত শর আর বর্শা নিক্ষেপ করে বানরদের বধ আরম্ভ করলো। যুদ্ধে বানরদের দেহের পর্বত তৈরী হল। মকরাক্ষ হাস্য করতে করতে নানা দিব্যাস্ত্রে বানরদের রক্তে যেনো নদী তৈরী করলো। বানরেরা দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করতে লাগলো। হনুমান কিছু রাক্ষসকে গোপৃষ্ঠ থেকে সাবধানে তুলে ভূমিতে আছার মেরে বধ করলো। কিন্তু এভাবে তিন অক্ষৌহিণী সেনাকে রোধ করা সম্ভব হল না । নল, নীল, গবাক্ষ, কুমুদ বানরেরা মকরাক্ষের শরে আহত হয়ে পলায়ন করে প্রভু শ্রীরামের কাছে গেলো। শ্রীরাম তখন বললেন- “এই রাক্ষসেরা অতি কাপুরুষ। যেমন তাহাদিগের রাজা। যে কিনা সাধুবেশে পরস্ত্রী হরণ করে। আমাকেই যুদ্ধে যেতে হবে ।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম যুদ্ধে এসে দেখলেন যে সত্যই রাক্ষসেরা গোপৃষ্ঠে আরোহন করে বানর নিধন করছে। ভগবান শ্রীরাম তখন শার্ঙ্গ ধনুক থেকে পবন বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণের প্রভাবে সমস্ত বৃষভ, ধেনু, বাছুর উড়ে গিয়ে লঙ্কার গোশালায় ঢুকে গেলো। বিন্দুমাত্র আহত হল না তারা। যুদ্ধে আর কোন পশু দেখা গেলো না। গোবিহীন রথ গুলি ভূপতিত হল। তখন বানরেরা পালটা আঘাত করলো। প্রস্তর, বৃক্ষ দিয়ে রাক্ষসদের বধ করে করে সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে দিলো। মকরাক্ষ, শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করতে করতে পরাজিত হল। তখন ভগবান শ্রীরাম , মকরাক্ষের দিকে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন। অগ্নিবাণ গিয়ে মকরাক্ষের হৃদয় বিদীর্ণ করলো। সেই বাণের প্রভাবে মকরাক্ষের গোটা শরীর টাই ঝলসে গেলো। তার চেহারা অবধি চেনা যাচ্ছিল্ল না। দেহের অস্থিমাংস গলে গলে বেরিয়ে এসেছিলো। মকরাক্ষ নিহত হতেই সেদিনের যুদ্ধ থামল ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২২)


কুম্ভ বীর তখন উল্কার ন্যায় বাণ বর্ষণ করে কপিদের নষ্ট করতে লাগলো। কপিদের দেহের স্তূপ জমল। তাহার পর্বত প্রমাণ মুষল আর গদা যখন কপিসেনাদের মাঝে পড়লো মনে হল যেনো পিপীলিকার ওপর বৃহৎ প্রস্তর পতিত হয়েছে। তার নীচে শত শত বানর পিষ্ট হল। মহেন্দ্র আর দেবেন্দ্র নামক বানর তখন সামনে গেলো। কুম্ভ তাহাদের দেখা মাত্রই তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করতে লাগলো । শরে শরে ছেয়ে গেলো। মহেন্দ্র আর দেবেন্দ্রর শরীর থেকে রুধির ধারা নিস্ক্রিমণ হল। পালটা দুই বানর অতি উচ্চ শৃঙ্গের ন্যায় প্রস্তর তুলে কুম্ভের দিকে নিক্ষেপ করলো। কুম্ভ শর দ্বারা সেই প্রস্তর চূর্ণ করলো। তখন দুই বানর বৃহৎ বৃক্ষ উৎপাটন করে এনে কুম্ভের দিকে নিক্ষেপ করতেই কুম্ভ শর দিয়ে চূর্ণ করলো। এর পর কুম্ভ চোখের নিমিষে শত বাণ নিক্ষেপ করলে দুই বানর পলায়ন করলো। এরপর অঙ্গদ গদা নিয়ে ধেয়ে আসলো । কুম্ভ তাহাকে দেখা মাত্রই শত শত তির ছুঁড়তে লাগলো । শরের প্রভাবে অঙ্গদ কিছুই দেখতে পেলো না। গদা দিয়ে যত শর সড়িয়ে দেয় তত কুম্ভ শর সন্ধান করে। অঙ্গদ কিছুতেই কুম্ভের দিকে যেতে পারলো না। একটি শর অঙ্গদের ভ্রুর মধ্যে বিদ্ধ করলে সেখান থেকে রক্তপাত হতে লাগলো । অঙ্গদ এরপর অতি বৃহৎ পর্বত শৃঙ্গ নিক্ষেপ করলে কুম্ভ সাতটি শরে সেই শৃঙ্গ চূর্ণ করলেন । এরপর অপর একটি বাণে অঙ্গদের চেতনা হরণ করলেন । চেতন পেতেই অঙ্গদ পলায়ন করলো। সকলে মিলে তখন শ্রীরামের কাছে গিয়ে কুম্ভের দৌরাত্ম্য বর্ণনা করলো। ভগবান শ্রীরাম তখন ঋষভ , কুমুদ, সুষেণ নামক তিন বানরকে প্রেরণ করলো । হৈ হৈ করে তিন বীর তাহাদের কটক নিয়ে ধেয়ে আসলো । ঋষভ , কুমুদ এসে প্রথমে রাক্ষসদের বধ করতে করতে একবারে কুম্ভের নিকটে পৌছালেন। দেখলেন কুম্ভ একাই লক্ষ লক্ষ কপি সেনাদের নিধন করছে । কপিরা যে দিকে পারছে পলায়ন করছে। তার রথ যেনো রক্তে মাখা কর্দমের ওপর দিয়ে চলছে ।

কুম্ভ তার বীক্রমে সাদা বালুকারাশি রক্তিম বর্ণে রঞ্জিত করেছে । ঋষভ , কুমুদ এসে প্রথমেই প্রস্তর নিক্ষেপ আরম্ভ করলো। কুম্ভ দেখলো সেই প্রস্তরে রাক্ষসেরা নিহত হচ্ছে। এই দেখে সে শরে শরে প্রস্তর গুলিকে চূর্ণ করলো। গগনে প্রস্তর চূর্ণ হয়ে প্রস্তর বৃষ্টির ন্যায় সেগুলি ভূতলে পতিত হল । এরপর কুম্ভ এমন ভাবে শর সন্ধান আরম্ভ করলো যেনো বর্ষা ঋতুতে মহেন্দ্রর অনুচর মেঘেরা বর্ষণ করে । ঝাঁকে ঝাঁকে শর এসে কপিদের ছিন্নভিন্ন করে দিলো ।ঋষভ , কুমুদ আহত হয়ে পলায়ন করলো। তখন সুষেণ ও জাম্বুবান যুদ্ধে আসলো। জাম্বুবানের ভল্লুক সেনারা রাক্ষসদের দিকে দৌড়ে যেতেই কুম্ভ দিব্যাস্ত্র চালনা করে সেই ভল্লুক দের বধ করলেন । অত সুষেণ ও জাম্বুবানের দিকে শর সন্ধান আরম্ভ করলেন । এইভাবে তারা আহত হল। তখন সুগ্রীব এগিয়ে এলো । যেনো মদমত্ত হস্তীর সিকে সিংহ ধাবিত হচ্ছে- এমন মনে হল। কুম্ভ সুগ্রীবের পানে শর সন্ধান আরম্ভ করলে , সুগ্রীব রামনাম নিয়ে সেই শর উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে লাগলো । সুগ্রীবের দেহে যেনো শত ছিদ্র হয়ে রক্ত বের হচ্ছিল্ল । এরপর সুগ্রীব এক লম্ফ দিয়ে কুম্ভের রথে উঠে তাঁর ইন্দ্রধনু সম ধনুক কেড়ে নিলো । কুম্ভের সাথে সুগ্রীবের বাহুযুদ্ধ হল । কুম্ভ একটি হস্তীত পৃষ্ঠে আরোহিত হলে সুগ্রীব সেই হস্তীকে ধরাশায়ী করলো। তারপর হস্তীর দুটি দন্ত উৎপাটিত করে ভূতলে পতিত কুম্ভের ওপর আঘাত হানলো। আঘাত খেয়ে কুম্ভ পড়ে গিয়ে আবার যুদ্ধ আরম্ভ করলো। দুজনে যুদ্ধ চলতে লাগলো। কুম্ভ পরাজিত হয়ে ভূতলে পতিত হল । তাহার পর কুম্ভের বক্ষস্থলে অনবরত কয়েকটি মুষ্ট্যাঘাত করলো সুগ্রীব। সুগ্রীবের মুষ্ট্যাঘাতে কুম্ভ রক্তবমন করতে করতে চিরদিনের ন্যয় চোখ বন্ধ করলো ।

ভ্রাতাকে নিহত হতে দেখে নিকুম্ভ নিদারুন শোক পেলো। ক্রোধে সে দিগ্বিদিকজ্ঞান শূন্য হয়ে মুগুর তুলে সুগ্রীবের দিকে তখুনি নিক্ষেপ করলো। মুগুর যখন সুগ্রীবের বুকে আঘাত হানলো, তখন প্রচণ্ড শব্দ হল । সুগ্রীব পড়ে গিয়ে চেতনা লুপ্ত হলে বানরেরা তাহাকে শিবিরে নিয়ে গেলো। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে অগ্নি যেমন ভাবে প্রজ্বলিত হয়- ঠিক সেইভাবেই নিকুম্ভ জ্বলে উঠলো । শিলাবাণ, জ্বালাবাণ নিক্ষেপ করলো। সেই দিব্যাস্ত্রের প্রভাবে গগন থেকে অনবরত শিলা ও আগুনের গোলা কপিসেনাদের মাঝে পতিত হতে থাকলো। শত শত বানর নিহত হল। নিকুম্ভের অনুগত রথ গুলি থেকে অনবরত বাণ নিক্ষেপ করা হল। অশ্ব থেকে বর্শা ছুড়ে কপিদের নিহত করা হল । হস্তীগুলি ধেয়ে গিয়ে বানরদের পিষে দিলো। কাউকে আবার শুণ্ড দিয়ে শূন্যে তুলে দিলো। কাউকে শুণ্ডে পেঁচিয়ে ভূমিতে আছার দিলো। রাক্ষসেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো। হনুমান এগিয়ে এসে গদা প্রহারে হস্তীগুলিকে বধ করলেন। রথগুলিকে আছার দিয়ে, গদা দিয়ে , শূন্যে ছুড়ে ধ্বংস করলেন । বানরেরা প্রস্তর, বৃক্ষ বর্ষণ করে হস্তীগুলি, অশ্বারোহী, রথ গুলি চূর্ণ করলো। রথের টুকরো অংশে মেদিনী এইভাবে ঢাকা পড়লো যেনো মনে হল সোনার পাত বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর দিয়ে রক্তনদীর স্রোত বয়ে গেলো । হনুমান তখন নিকুম্ভের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন । নিকুম্ভের রথ চূর্ণ করে দিলেন। নিকুম্ভ লম্ফ দিয়ে যুদ্ধভূমিতে নামলো । হনুমান তাহাকে ভূতলে পতিত করে কণ্ঠে চরণ দিয়ে চেপে ধরলেন। নিকুম্ভের চোখ, জিহ্বা বাহিরে এলো। এরপর হনুমান নিকুম্ভের কেশ মুষ্টিবদ্ধ করে এমন জোরে টানলেন যে নিকুম্ভের মুণ্ড ধড় থেকে আলাদা হয়ে হনুমানের হস্তে এলো । হনুমান সেই মুণ্ড নিয়ে ভগবান শ্রীরামকে দেখালে, শ্রীরাম খুশী হয়ে হনুমানকে আশীর্বাদ করলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২১)

কুম্ভ নিকুম্ভ প্রবল আড়ম্বর সহকারে লঙ্কার রাজপ্রসাদে প্রবেশ করলেন । রাজা দশানন তাহাদিগের আদর যত্ন করে যুদ্ধে যেতে আদেশ দিলেন । কপালে তিলক, পুস্পাদি, মুখে তাম্বুল দিয়ে যুদ্ধে পাঠালেন । আট অক্ষৌহিণী সেনা সাথে দিলেন। লক্ষ লক্ষ গজ, অশ্ব, রথ, ধনুর্ধারী রাক্ষস, পদাতিক সেনা গেলো। লঙ্কার মেদিনী কাঁপিয়ে কুম্ভ ও নিকুম্ভ যুদ্ধে বের হলেন । সকলে জয় জয় শব্দে আকাশবাতাস প্রতিধ্বনিত করলো । লঙ্কার রাক্ষসেরা দেখতে লাগলো । কুম্ভ নিকুম্ভ হস্তী পৃষ্ঠে বসেছিলেন । উভয়ে কুম্ভকর্ণের বীরপুত্র। পিতার ন্যায় অতি বলশালী । বানর সেনারা প্রস্তুত হয়ে ছিলো। অপেক্ষা করছিলো কখন লঙ্কার দ্বার উন্মোচিত হবে। লঙ্কার দ্বার খুলতেই লক্ষ লক্ষ রাক্ষসেরা ঝাঁপিয়ে পড়লো । বানরেরা বর্শা, বৃহৎ প্রস্তর, গদা, বৃক্ষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো । রক্তে রক্তময় হল। রাক্ষসেরা তীক্ষ্ণ শর বর্ষণ আরম্ভ করলো । শরে বানরদের মুণ্ড হস্ত পদ কেটে কেটে আলাদা হয়ে গেলো । অপরদিকে বৃহৎ গদার আঘাতে রাক্ষসেরা সব মুখ থুবরে থুবরে ভূমিতে পড়ে ইহলোক ত্যাগ করলো । যুদ্ধ যেনো আজ সব নাশ করে দেবে এমন মনে হল । হনুমান একাই লাঙ্গুলে পেঁচিয়ে শত শত রাক্ষসকে ভূমিতে আছার দিয়ে খুলি চূর্ণ করলো । গদার আঘাতে লক্ষ লক্ষ হস্তীগুলোকে বধ করলো। ভল্লুকেরা লম্ফ দিয়ে রাক্ষসদের ওপর পড়ে রাক্ষসদের মুণ্ড ছিড়ে উদর ছিড়ে ভক্ষণ করতে লাগলো ।নল , নীল, গবাক্ষ, অঙ্গদ এই সব বীরেরা গদা দিয়ে আঘাত করে শত শত রাক্ষস বধ করলো । যুদ্ধে শরে আচ্ছন্ন হল। বজ্রকন্ঠ নামক রাক্ষস শর দিয়ে ভল্লুক বাহিনীকে আঘাত হানলো । সেই রাক্ষসের শরে ভল্লুকেরা ছিন্নভিন্ন হতে লাগলো অত্যন্ত অট্টহাস্য করে বজ্রকন্ঠ সমগ্র যুদ্ধে রথে দাঁপিয়ে বেড়াতে লাগলো । হস্তীগুলি পায়ে পিষে বানরদের বধ করতে লাগলো । বজ্রকন্ঠের সামনে যতগুলি সুগ্রীবের সেনা পড়লো সকলে ধ্বংস হল। বজ্রকন্ঠ এইভাবে যুদ্ধ করার পর গদা নিয়ে ভূমিতে লাফ দিয়ে নামলো। রাক্ষসের পায়ের তলাতেই কতক বানর পিষ্ট হয়ে ছটফট করে মরল । তাহার পর গদা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে বানরদের খেদিয়ে দিতে লাগলো । রাক্ষসের গদার প্রহারে বানরেরা রক্তবমি করতে করতে প্রান ত্যাগ করলো ।

অট্টহাস্য করে এই ভাবে বজ্রকন্ঠ বহু বীর কপিকে হত্যা করলো । দেহের স্তূপ জমল । এমন সময় তার সামনে আসলো অঙ্গদ । বালির নন্দন অঙ্গদকে দেখেই বজ্রকন্ঠ বলল- “ওরে বালক! এই যুদ্ধে কেন জড়িয়েছিস? আমার খুঁড়া দশাননের সাথে মিত্রতা স্থাপিত করে সুখ ভোগ কর। কেন অকালে প্রান হারাবি?” অঙ্গদ বলল- “ওরে দুর্মতি! একবার আমার সহিত যুদ্ধ কর। দেখবি কে বালক আর কেই বা নাবালক । তুই বরং প্রভু শ্রীরামের শরণাগত হ। এতে প্রাণে বেঁচে যাবি।” বজ্রকন্ঠ মুখে বিকট শব্দ করে গদা উচিয়ে অঙ্গদের মস্তকে আঘাত করবার জন্য দৌড়ে গেলো। অঙ্গদ স্বীয় গদা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো । দুই বীরের মধ্যে রণ চলল। তাহাদিগের রণ চলাকালীন তাদের পায়ের তলায় বহু রাক্ষস বানর পিষ্ঠ হল । দুজনের গদার সংঘর্ষে প্রচণ্ড শব্দ হতে লাগলো । কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারে না এমন ছিলো। উভয়ে উভয়ের ওপর অনেক গদার আঘাত করলো। গদার আঘাতে দুজনেই দুর্বল হল । তখন বজ্রকন্ঠ অতি বেগে গদার আঘাত করলো অঙ্গদের ওপর। বুকে আঘাত পেয়ে অঙ্গদ রক্তবমি করতে করতে ভূমিতে হাটু মুড়ে বসে পড়লো । প্রচণ্ড সূর্যের তাপে তাহার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। নাক ও মুখ দিয়ে নির্গত শোনিত ধারা তার বস্ত্র, বুক সকল লাল করে দিলো। এই অবস্থা দেখে সুগ্রীব, জাম্বুবান এগিয়ে আসতে গেলে হনুমান বাধা দিয়ে বলল- “অঙ্গদ একাই এই রাক্ষসের বধ করতে সমর্থ।” হনুমান অঙ্গদকে বলল- “অঙ্গদ। তুমি বীর। এই রাক্ষস তোমার কাছে তৃনসম । তুমি একে বধ করতে পারবে। মনে প্রভু শ্রীরামের ধ্যান করে উঠে দাঁড়াও বতস্য।” অঙ্গদের মনে হল সে মূর্ছা যাচ্ছে। এই অবস্থায় হনুমানের বাক্য ভারীভারী হয়ে কর্ণে প্রবেশ করলো। মুখের বোল আটকে যাচ্ছে। হৃদয়ে প্রভু শ্রীরামের ধ্যান করলো । ভগবান রাম, করকমল তার মস্তকে বুলিয়ে দিচ্ছেন এমন মনে হল । অপরদিকে বজ্রকন্ঠ প্রবল এক আঘাত হানবার জন্য গদা তুলে নিলো। অঙ্গদ তখন ‘জয় শ্রী রাম’ বলে লম্ফ দিয়ে গদা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বজ্রকন্ঠের মস্তকে আঘাত হানলো। বজ্রকন্ঠের মস্তক থেঁতলে গেলো।

বজ্রকন্ঠ মারা যাবার পর সকম্পন নামক আরোও এক বীর রাক্ষস শরে শরে আচ্ছন্ন করলো অঙ্গদকে । অঙ্গের সমস্ত শরীর দিয়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত বইছিল । সকম্পন সমানে হাস্য করতে করতে অঙ্গদের দিকে তীক্ষ্ণ বাণ সন্ধান করতে লাগলেন । অঙ্গদ সেইদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সকম্পনের রথের চক্র গদার আঘাতে চূর্ণ করলেন । দুটি চক্র চূর্ণ হতেই রথ পড়ে গেলো । এরপর অঙ্গদ সেই রথ তুলে রাক্ষসদের পালে নিক্ষেপ করলেন। বেশ কিছু রাক্ষস রথের তলে মরল । এরপর সকম্পন ঢাল আর খড়্গ নিয়ে যুদ্ধ করতে আসলে অঙ্গদ খড়্গ আর ঢাল কেড়ে নিলো। এরপর খড়্গের আঘাতে সকম্পনের শিরোচ্ছেদ করে ফেলল। কুম্ভ এবার যুদ্ধে আসলো। কুম্ভ যেই মদমত্ত হস্তীর পৃষ্ঠে বসে ছিলো তার তলায় বহু বানর, ভল্লুক পিষ্ট হল । যূপাখ, শোনিতাক্ষ , শ্রীমৈন্দ, দ্বিবিদ নামক বানর বীরেরা কুম্ভের কাছে পরাজিত হয়ে পালালো । কুম্ভের পেছনে হস্তীগুলো থেকে রাক্ষসেরা সমানে বানরদের শর বিদ্ধ করে বধ করতে লাগলো। সুগ্রীব তার কটক নিয়ে এগিয়ে গেলো। সুগ্রীবের সেনারা বৃহৎ প্রস্তর নিক্ষেপ করে হস্তীগুলিকে ধরাশায়ী করলো। যে সব রাক্ষসেরা হস্তীর পীঠে ছিলো তারাও মরল । সে সময় বিদ্যুমালী নামক এক রাক্ষসের সাথে নলের যুদ্ধ আরম্ভ হল । নল ও বিদ্যুমালী বাহুযুদ্ধ আরম্ভ করলো । একে অপরকে কামড়, আঁচর বসালো। উভয়ের শরীর থেকেই রক্তপাত হতে লাগলো কেউ যেনো কাউকে পরাজিত করতে পারে না। এমনই ছিলো উভয়ের বীক্রম । বিদ্যুমালী ও নল একে অপরের বুকে, মস্তকে কিল, চর দিতে লাগলো। উভয়ের ঠোঁট কেটে শোনিত ধারা বের হল। উভয়ে রক্তাক্ত। এই সময় বিদ্যুমালী একটি রথে উঠে নলের ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে নল একটি বিশালাকার প্রস্তর রথে নিক্ষেপ করলো। সেই প্রস্তরে রথ গুড়িয়ে গেলো। সারথি, অশ্ব সহ বিদ্যুমালী নিহত হল। কুম্ভ এরপর মহাবিক্রমে যুদ্ধ আরম্ভ করলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ২০ )


সকলে অবাক হল হনুমান এত বৃহৎ পর্বত কেনো বা তুলে এনেছে ? পর্বতে দিব্য জড়িবুটি থেকে উৎপন্ন দিব্য আলো দেখে সকলেই বুঝলেন সে এই সেই গন্ধমাদন পর্বত । কিন্তু হনুমানকে আদেশ দেওয়া হয়েছিলো কেবল পর্বত থেকে সেই মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী , সন্ধানকরণী ঔষধি আনতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু হনুমান গোটা পর্বত তুলেই এনেছে। হনুমান নিজে বলল- “প্রভু আপনার কৃপায় সেই পর্বত আনতে পেরেছি। সেখানে কালনেমি রাক্ষস বধ, গন্ধকালি নামক অপ্সরার মুক্তি প্রদান করি। পথে আসবার সময় আপনার ভ্রাতা ভরতের সাথে সাক্ষাৎ হয়।” ঔষধি নিয়ে এসেছেন দেখে ভগবান শ্রীরাম হনুমানকে ধন্যবাদ দিয়ে বলতে লাগলেন- “বেঁচে থাকো বতস্য। তোমার ঋণ আমি ইহজন্মে শোধ করতে পারবো না।” সুষেণ বৈদ্য পর্বতে উঠে মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী , সন্ধানকরণী ঔষধি নিয়ে আসলেন । তারপর তাহা পিষে লক্ষ্মণের মুখে দিলেন । দেখতে দেখতে লক্ষ্মণের ক্ষতস্থান সেরে গেলো। বিষের প্রভাব সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গেলো । লক্ষ্মণ “কোথায় সেই মেঘনাদ” বলে উঠে দাড়ালো । উঠে দাঁড়িয়ে সে সকলকে দেখে অবাক হল। আশেপাশে সকলকে দেখলো চোখের জলে ভাসছেন। খুশীতে তারা চোখের জল মুছে ফেলছেন। আরোও দেখলেন তার বড় ভ্রাতা শ্রীরাম তার সামনেই মাটিটে বসে আছেন । ভগবান শ্রীরাম তখন ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করে বললেন- “ভ্রাতা! তুমি মেঘনাদের অস্ত্রে নিদারুন আহত হয়ে পড়েছিলে। তোমাকে বাঁচিয়েছেন আমার মিত্র বিভীষণ, লঙ্কার বৈদ্য সুষেণ আর হনুমান। ইহাদের প্রণাম করো।” লক্ষ্মণ উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে প্রণাম করলো। ভগবান রাম বললেন- “পবনপুত্র! তুমি আমার এক ভ্রাতা। যেমন ভরত , শত্রুঘ্ন , লক্ষ্মণ আমার এক ভ্রাতা। সত্যই তুমি কনিষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় বিপদের সময় অগ্রজের পাশে থেকেছো। বিপদ থেকে পরিত্রাণ করেছো। সত্যই তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ ।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম তাঁর প্রিয় ভক্ত হনুমানকে আলিঙ্গন করলেন ।

তাহার পর ভগবান বললেন- “হনুমান! তোমার প্রতি রোমকূপে এত দিব্য জ্যোতি কিসের?” হনুমান বলল- “প্রভু! যখন আমি ঔষধি চিনতে না পেরে গোটা গন্ধমাদন নিয়ে আগমন করছিলাম তখন আপনার ভ্রাতা শ্রী ভরত আমাকে কোন রাক্ষস ভেবে শর সন্ধান করে ভূপতিত করেন। তারপর আপনার পরিচয় দিতে তিনি পবন বাণে আমার গতিবৃদ্ধি করেন। পথে আসবার সময় গুরুদেব সূর্যকে উদয় হতে দেখে তাঁহাকে ভক্ষণ করে সূর্য উদয় রোধ করি। না হলে আজ চরম সর্বনাশ হতো। প্রভু! আমি আপনার কুলদেবতাকে অপমান করেছি। সৃষ্টির নিয়ম পরিবর্তন করেছি। কিন্তু ইহা ভিন্ন আর উপায় ছিলো না। কৃপা করে আমাকে ক্ষমা করুন।” এই বলে হনুমান এক লম্ফ দিয়ে সৌরমণ্ডলে প্রবেশ করে সূর্য দেবকে পুনঃ উদ্গীরন করে বাহিরে এনে ক্ষমা চাইলেন । অতঃ সমুদ্র তটে আসলেন । তখন সুষেণ বৈদ্য বললেন- “পবনপুত্র আপনি আর একটি কাজ করুন। এই দিব্য ঔষধি পর্বত যথাস্থানে রেখে আসুন। কারন এই পর্বতে দেবতারা বিরাজ করেন। এখানে এই সকল ঔষধি থাকা উপযুক্ত নয়।” হনুমান তখন সুষেণ বৈদ্যকে পুনঃ লঙ্কায় রেখে এসে গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে পুনঃ হিমালয়ে রেখে আসলেন । বানরেরা এবার নানা বাদ্য বাজনা বাজিয়ে উচ্ছাস প্রকট করলেন । সেই উচ্ছাসে রাক্ষসদের সমস্ত আনন্দে জল ঢেলে দিলো। ভগবান রামের জয়ধ্বনি একেবারে অশোক বনে পৌছালো । রাবণ সব শুনে বিমর্ষ হয়ে বসলেন। কালনেমি নিহত হয়েছে। হনুমান সূর্যকে ভক্ষণ করে সূর্য উদয় রোধ করেছে, গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে এসে লক্ষ্মণের জীবন বাঁচিয়েছে । সীতাদেবী তখন ত্রিজটার কাছে সব শুনে আনন্দ প্রকাশ করে দেবতাদের স্তবস্তুতি করলেন । প্রভাত হতেই আজ আর লঙ্কার দ্বার খুলল না। কোন রাক্ষস যুদ্ধে আসলো না। বানরেরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল । কিন্তু কেউ বাইরে আসলো না । ভগবান শ্রীরাম বললেন- “আজ অবধি আমি ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছি। আজ এই রাক্ষসদের ওপর কোন দয়া করবো না।” এই বলে ভগবান রাম তখন হনুমান সহ অন্য রাক্ষসদের লঙ্কার দ্বার ভেঙ্গে ভেতরে অগ্নি সংযোগ ঘটাতে বললেন। বড় বৃক্ষের কাণ্ড নিয়ে বানরেরা লঙ্কার সিংহদ্বারে আঘাত করতে লাগলো। কিছুক্ষণ আঘাতে লঙ্কার সেই তোড়ন ভেঙ্গে সশব্দে পতিত হল। লক্ষ লক্ষ বানর, মর্কট, ভল্লুক মশাল নিয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগলো। সামনে যত রাক্ষস ছিলো বানরদের পদতলে পিষ্ট হয়ে মাটিটে মিশে গেলো ।

বানরেরা উন্নত গৃহ গুলিতে আগুনের মশাল নিক্ষেপ করলো। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো । শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ চোখের নিমিষে অসংখ্য বাণ নিক্ষেপ করে অগণিত রাক্ষসদের বধ করলেন । রাক্ষসেরা , ভগবান শ্রীরামের বাণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। ভগবান রাম উল্কাবাণে লঙ্কার গৃহ গুলি ভস্ম করলেন । চতুর্দিকে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠলো। যত রাক্ষস ছিলো সব পলায়ন করলো। সারা রাত মদ্যপান করে যেসব রাক্ষসেরা কামিণী সহ শয়ন করছিলেন তারা পট্টিশ , বর্শা, তরোয়াল, গদা, ধনুক নিয়ে যুদ্ধে আসলেন। কিন্তু ভগবান শ্রীরামের বাণের সামণে দাঁড়াতেই তাদের হাত পা মস্তক কেটে বহু দূরে দূরে পতিত হল । ভগবান শ্রীরামের সেই ক্রোধী রূপ রাক্ষসদের তৃণবৎ ভস্ম করতে লাগলেন। যেসব রাক্ষসেরা ঘুমন্ত ছিলো তারাও অন্যত্র পলায়ন করলো । বানরেরা মশাল দ্বারা গৃহগুলি ভস্ম করতে লাগলেন ।

একেক বানর লয় দুই দুই মশাল ।
অগ্নি দিয়া পোড়ায় লঙ্কার চালে চাল ।।
অগ্নিতে পুড়িয়া পড়ে বড় বড় ঘর ।
পরিত্রাহি ডাক ছাড়ে লঙ্কার ভিতর ।।
উলঙ্গ হইয়া কেহ পলাইল ডরে ।
লাফ দিয়া পড়ে কেহ জলের ভিতরে ।।
অনেক পুড়িল ঘর আগুনের জ্বালে ।
কেহ বা পলায় যায় বাপ বাপ বলে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইভাবে লঙ্কার রাক্ষসেরা ত্রাহি ত্রাহি করতে লাগলো। রাবণ ক্রোধে সব দেখে বলতে লাগলো- “এই অপমান সহ্য করবো না। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণের পুত্র কুম্ভ নিকুম্ভকে সংবাদ প্রেরণ করো।” মন্দোদরী বললেন- “আপনি অত্যন্ত দাম্ভিক ইহা জানতাম। কিন্তু এমন নিষ্ঠুর তাহা জানতাম না। নিজ পুত্রেরা আপনার দর্পের কারণে হত হয়েছে এখন আপনি কি ভ্রাতার বংশকেও রেহাই দেবেন না ? যদি কাউকে প্রেরণ করতে হয় তবে সীতাকে রামের কাছে প্রেরণ করুন। এতে আপনার বংশ রক্ষা পাবে।” রাবণ এই কথা শুনে মন্দোদরীকে বকাঝকা করে নিরস্ত্র করলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ১৯ )


বিশালাকার হয়ে হনুমান যখন পর্বত উপরে আনলো, তখন দেবতা সকল অবাক আর আশ্চর্য হল। পর্বত থেকে ব্যঘ্র, মৃগ, হরিণ, ভল্লুক আদি বন্য জাতীয় পশু যেযদিকে পারলো পালালো। ত্রিকোনাকার পর্বতের পাদদেশে মন্দির সুশোভিত ছিলো। পর্বতের নীচে দেখা গেলো বিভিন্ন বৃক্ষের শিকর ঝুলছে। যেনো প্রস্তর খণ্ড আঁকরে সর্পেরা ঝুলছিলো এমন মনে হচ্ছিল্ল । দেবতারা এই দেখে আশ্চর্য হলেন। রুদ্রাবতার হনুমানের ওপর পুস্পাদি বর্ষণ করতে লাগলেন । ঔষধি চিনতে না পেরে গোটা পর্বতটাই বাম হস্তে ধারণ করেছে। গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে হনুমান যখন লম্ফ দিয়ে আকাশে উঠলো তখন মেদিনী কেঁপে উঠলো । তারপর ঝড়ের বেগে উড়ে চলতে লাগলো সমুদ্রের দিকে। মেঘের রাজ্য, নক্ষত্র ভরা আকাশের মাঝে উড়ে যেতে যেতে হনুমান , নিশাচর পক্ষী দিগকে দেখতে পেলো। চন্দ্রের আলোকে হিমালয়ের চূড়া সকল অতি মনোরম দেখাছিল্ল। শ্বেত শুভ্র ধবল হিমালয়ের চূড়াতে চন্দ্রালোকে দেবতারা আগমন করে। হিমালয়ের বিভিন্ন হ্রদের তীরে অপ্সরা, কিন্নর – কিন্নরী , বিদ্যাধর – বিদ্যাধরী , গন্ধর্ব সকলে আগমন করে নৃত্যগীতে রাত্রি যাপন করে। এই সব স্থানে সাধারণ মানব আসতে পারে না । এই সকল মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে হনুমান দ্রুত গতিতে উড়তে থাকলো । যত সম্ভব গতি বাড়ালো। সুদুর হিমালয় থেকে শ্রীলঙ্কা অনেকটাই দূর । অপরদিকে সমুদ্র তীরে বসে ভগবান শ্রীরাম বিলাপ করছিলেন, আর বলছিলেন- “ভ্রাতা আমার! আমি এই যুদ্ধের সূচনা করেছি। আজ আমার নিমিত্তই তোমার প্রাণ সঙ্কটে। আমি কিছুই করতে পারছি না। নিজেকে অসহায় বোধ হচ্ছে। প্রিয় ভ্রাতা! তোমার নিদারুন কষ্ট কেবল আমার কারণে।” লক্ষ্মণের বুকের ক্ষতস্থান ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে সমগ্র দেহে ছড়াতে লাগলো । লক্ষ্মণ ধীরে ধীরে ক্রমশ নিস্তেজ হতে লাগলো। নিঃশ্বাস ক্রমশ স্থির হতে লাগলো । প্রভু শ্রীরাম বিলাপ করতে লাগলেন। জাম্বুবান তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলল- “প্রভু! পবন নন্দন শীঘ্রই আসবেন। আপনার ভ্রাতা সুস্থ হয়ে উঠবেন। এভাবে আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না।”

উচু টিলা, সুবেল পর্বতের উচ্চ চূড়ায় উঠে বানরেরা দেখতে লাগলো হনুমান আসে নাকি । কিন্তু যতদূর দেখা যায় হনুমানকে দেখা যায় না। বানরেরা যত সম্ভব উচ্চ চূড়ায় উঠলো। রাতের আঁধারে তেমন স্পষ্ট দেখা যায় না। যতটুকু দেখা যায় কোথাও হনুমানকে দেখা গেলো না। সকলে কেবল প্রার্থনা করতে লাগলো হনুমান যেন তারাতারি ফিরে আসে ঔষধি নিয়ে । কারণ লক্ষ্মণের ক্ষতস্থান ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অপরদিকে লঙ্কায় আনন্দ হুল্লোর বয়ে যাচ্ছে। কতশত আতসবাজি পুড়িয়ে রাক্ষসেরা আনন্দ করছে। এমন করছে তারা যেনো যুদ্ধ জিতেই গেছে । সুষেণ বৈদ্য জানালো যে সূর্য উদয় হলে তখন ঔষধি দিয়েও আর কাজ হবে না। অতএব শীঘ্র হনুমানকে এসে পড়ুক । কিন্তু হনুমান আর আসে না। লঙ্কায় রাবণ গুপ্তচর মারফৎ সংবাদ পেয়ে আনন্দে বলল- “বোধ হয় কালনেমি , হনুমানের প্রাণ হরণ করেছে। বহুদিন পর অনেক সুখ আনন্দ প্রাপ্তি করলাম। হনুমান ওখানে মরবে। লক্ষ্মণ এখানে মরবে। তারপর দেখি ঐ ভিখারী রাম একা কি বা করতে পারে?” এই বলে রাবণ হাস্য করতে লাগলো। রাক্ষসেরা হাস্য করতে লাগলো । বানর শিবিরে কেবল রোদন । হনুমান অপরদিকে আকাশে প্রবল বেগে উরে উরে প্রবল বেগে আসতে লাগলেন । কত পাহার, পর্বত, নদ – নদী, জনপদ, জঙ্গল পার করলেন। একসময় অযোধ্যার উপর দিয়ে আসতে লাগলেন । অযোধ্যায় প্রভু শ্রীরামের নগরী দেখলেন । সেখানে হয়তো সীতা হরণের সংবাদ জানেই না। রাম- রাবণ যুদ্ধের কথাও জানে না। বিশাল পর্বত হস্তে নিয়ে সে অযোধ্যার আকাশ দিয়ে গমন করছিলো । সেই সময় নন্দীগ্রামে ভরত জেগে ছিলো। সেনারা এসে জানালো এক বৃহৎ মর্কট বিশাল পর্বত নিয়ে অযোধ্যার আকাশে ভ্রমণ করছে। বোধ হয় সে অযোধ্যা ধ্বংস করবে। অযোধ্যার ওপর সেই পর্বত নিক্ষেপ করবে। ভরত আতঙ্কিত হয়ে ধনুর্বাণ নিয়ে বাইরে আসলো। দেখলো সত্যই এক মর্কট , বৃহৎ প্রস্তর হস্তে অযোধ্যার আকাশে । ভরত আর দেরী না করে দিব্যাস্ত্র চালনা করলো। দিব্যাস্ত্র ফুটে হনুমান পর্বত সহ ভূমিতে নামলো । আক্ষেপ করে বলল- “হে প্রভু রামচন্দ্র ! আমি বোধ হয় আর তোমার সেবা করতে পারলাম না।” মর্কটের মুখে রামনাম শুনে ভরত ভাবল এ যখন শ্রীরামচন্দ্রের ভক্ত তখন অযোধ্যা ধ্বংস করবে না। এই বলে ভরত গিয়ে হনুমানকে নিজ পরিচয় দিলো। হনুমানের পরিচয় জানতে চাইলো ।

হনুমান যেখানে পতিত হয়েছিলো – সেই স্থান ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে প্রয়োগধামে অবস্থিত । এখানে এখন হনুমানের বিশাল মন্দির ও বিগ্রহ আছে। মাটি থেকে অনেকটাই নীচে এই বিগ্রহ। এর পাশে ত্রিবেনীসঙ্গম । বর্ষার সময় মাতা গঙ্গা এসে প্রতি বছর এই বিগ্রহকে ঢেকে দেন পবিত্র বারি দ্বারা। বছরের অন্য সময় দর্শন করা যায় । হনুমান নিজ পরিচয় দিয়ে সব বললেন- শূর্পনাখার নাসিকা চ্ছেদন, মারীচ বধ, রাবণের সীতা হরণ, বালি বধ করে সুগ্রীবকে রাজ্য প্রদান, শত যোজন সেঁতু বেঁধে লঙ্কায় এসে রাবণের সাথে যুদ্ধ, রাবণের পুত্র মেঘনাদের অস্ত্রে লক্ষ্মণের অচৈতন্য হওয়া, সেই জন্যই ঔষধি আনতে হিমালয় যাওয়া, ঔষধি চিনতে না পেরে গোটা পর্বত তুলে আনা। ভরত আক্ষেপ করে বলল- “এত কিছু হয়ে গেলো, অগ্রজ একবারও আমাকে সংবাদ দিলেন না? আমাকে কি উনিই এখনও ক্ষমা করেন নি? ভ্রাতা লক্ষ্মণের এমন শোচনীয় অবস্থা! আমরা কিছুই জানি না। আমার মাতা কৈকয়ীর কুবুদ্ধির জন্য আমার অগ্রজ, আমার বৌঠাণ আর আমার ভ্রাতার জীবন কষ্টে ভরে গেলো। জীবনে আমি ঐ কুমাতাকে ক্ষমা করবো না।” এই বলে ভরত রোদন করতে লাগলেন । তারপর বললেন- “আমি কদাপি আর অগ্রজকে কষ্ট করতে দেবো না। আমি অযোধ্যার সমস্ত সেনা নিয়ে যাচ্ছি। আমি রাবণ বধ করে বৌঠানকে মুক্ত করে আনবো।” হনুমান বলল- “তার প্রয়োজন নেই। আমরা বানর সেনারাই সেই রাক্ষসকে বধ করতে সমর্থ। আর রাবণকে বধ করবেন স্বয়ং প্রভু শ্রীরাম । আপনি এখন আমাকে শরমুক্ত করুন। যাতে সূর্য উদয়ের আগে আমি লঙ্কায় পৌছাতে পারি।” ভরত বলল- “বেশ! আমি পবণ বাণ নিক্ষেপ করছি। এই বাণের প্রভাবে তুমি তিনগুণ অধিক বেগে লঙ্কায় পৌছাতে পারবে।” এই বলে ভরত বাণ মুক্ত করে পবন বাণ নিক্ষেপ করলো। যার ফলে হনুমান তিনগুণ গতিতে উড়ে চলল। আকাশে দেখতে পেলো সূর্য উদয় হতে। হনুমান প্রার্থনা করলো গুরুদেব সূর্যের প্রতি। সূর্য বলল- “এ হয় না। নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে উদয় হতেই হয়। এ স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মার বিধান।” হনুমান ক্রোধে বলল- “বাল্যকালে আপনাকে ভক্ষণ করেছিলাম অজ্ঞান বশত! আজ প্রভু শ্রীরামের সেবার জন্য আপনাকে আবার ভক্ষণ করবো যতক্ষণ না লক্ষ্মণ ঠাকুর সুস্থ হন।” এই বলে হনুমান সূর্য দেবতাকে ভক্ষণ করলেন। তারপর লঙ্কায় উপস্থিত হলেন। বিশাল পর্বত সহ হনুমানকে লঙ্কার চরে উপস্থিত হতে দেখে সকলে আনন্দে গর্জন করলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ১৮ )



পাহার পর্বতে ঘেরা এই জনহীন প্রান্তরে ‘রাম’ নাম শুনে হনুমান আশ্চর্য হলেন । একবার ভাবলেন তিনি কি সত্যই শুনছেন । পরে দেখলেন না ঠিকই , কেহ রামনাম উচ্চারন করছে । এইস্থানে প্রভুর ভক্ত দেখে হনুমান খুবুই খুশী হলেন । বিশেষত রামনাম শুনলে তিনি তন্ময় হয়ে যান । সেই দিব্য নাম শুনে হনুমান মুগ্ধ হয়ে করতালি দিয়ে প্রথমে প্রভুর নামে মগ্ন হলেন । এমনকি প্রভুর নির্দেশ বিস্মৃত হলেন । পরে কালনেমি রামনাম সমাপ্ত করলে হনুমানের সকল কিছু মনে পড়লো । হনুমান সেই ছদ্দবেশী কালনেমিকে ধরতে পারেনি । মারুতি তখন সেই সাধুকে নিজ পরিচয় দিয়ে প্রনাম জানিয়ে বলল- “গোঁসাই! এই নির্জন প্রান্তরে আপনার ন্যয় সাধক দেখে আশ্চর্য হয়েছি। এইস্থানে কেহই নাই। চতুর্দিকে কেবল তুষার। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল শ্বেতধবল পর্বত। সাধারণের পক্ষে এখানে বসবাস করা অত্যন্ত কঠিন। আপনি নিশ্চয়ই কোন মহাত্মা যিনি ইন্দ্রিয়বিজয় করে শীতলতাকে জয় করেছেন। অথবা এ নিশ্চয়ই প্রভুর কৃপা হবে। তাহার ফলে আপনি শীতকে জয় করেছেন। হে মহাত্মা আমিও আপনার ন্যয় প্রভুর সামান্য ভক্ত । এখন লঙ্কারাজ রাবণের সাথে প্রভুর যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে রাবণপুত্র মেঘনাদের অস্ত্রে প্রভুর ভ্রাতা লক্ষ্মণ ঠাকুর প্রাণ হারাতে বসেছেন। আমাকে সূর্য উদয়ের আগে গন্ধমাদন পর্বত থেকে ভেষজ ঔষধি নিয়ে যেতে হবে। কৃপা করে বলবেন কোথায় সেই পর্বত?” কালনেমি মনে মনে হাস্য করলো । ভাবল এই কপিকে মূর্খ বানানো হয়েছে। এই কপিরা সাধারণত মূর্খ হয়। সামান্য কদলীর জন্য বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে লোকের মনোরঞ্জন করে। মাদারী ডুগডুগি বাজিয়ে নাচায়। এই কপিরা বরাবরই অকাট মূর্খ। কালনেমি বলল- “আমি প্রভু শ্রীরামের সামান্য ভক্ত। অবশ্যই আপনাকে গন্ধমাদন পর্বত দেখিয়ে দেবো। কিন্তু আপনি এত দূর হতে ঝড়ের বেগে এসেছেন। কিঞ্চিৎ জলপান করে বিশ্রাম গ্রহণ করুন।” কালনেমি মুখে রামের জয়ধ্বনি করলেও অন্তরে কেবল রাবণের জয়ধ্বনি করছিলো। আর ভাবছিলো কিভাবে হনুমানকে জালে আটকানো যায়। হনুমান বলল- “আরে গোঁসাই! আমি এখন প্রভুর সেবায় নিয়োজিত। এই অবস্থায় বিশ্রাম নেওয়া আমার কাছে পাপ। আপনি কেবল জল প্রদান করুন।” কালনেমি এই সুযোগটাই খুঁজছিলো । তাড়াতাড়ি গরল মেশানো বৃহৎ এক কলসি দিয়ে জলপান করতে বলল। হনুমান হেসে বলল- “গোঁসাই! এই সামান্য জলে আমার উদরের এক কোনাও তৃপ্ত হবে না।” কালনেমি দেখলো চালাকী ব্যর্থ ।

সেই রাক্ষস বলল -“তাহলে আপনি এই আশ্রমের পাশে বৃহৎ দিঘিতে জলপান করুন। সেখানে প্রচুর জল আছে। আর সেই গভীর দিঘির জল অত্যন্ত মিষ্ট ও শীতল। যা পান করা মাত্রই আপনার সকল ক্লান্তি দূর হবে। তারপর আপনাকে গন্ধমাদন পর্বতের খোঁজ দেবো।” হনুমান সেই পুকুরের দিকে গেলো । কালনেমি মনে মনে আনন্দ পেতে লাগলো। কারণ হনুমানকে এবার সেই বৃহৎ কুমীর ছিঁড়ে খাবে । হনুমান সেই টলটলে দিঘির জল দেখে নামলো । হাতে মুখে জল দিয়ে অঞ্জলি ভরে ভরে জল পান করতে থাকলো । শাপিত হয়ে অপ্সরা গন্ধকালি সেখানে বৃহৎ কুমীর হয়ে ছিলো । সে দেখলো এক কপি জলপান করছে। কপির মাংস আহারের লোভে তাকে টেনে আনলো। আসতে আসতে গভীর জল দিয়ে এসে হনুমানের সামনে উপস্থিত হল। তারপর লম্ফ দিয়ে হনুমানকে আঘাত করলো। এত বৃহৎ কুমীর দেখে হনুমান অবাক হল। কুমীর নখ, দন্ত দিয়ে হনুমানকে আঘাত করতে লাগলো । হনুমানের দেহ সকলে আঘাত লাগলো। হনুমান পালটা তখন কুমীরের ওপর মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলো । সমানে মুষ্ট্যাঘাতে কুমীরের দম আটকে যেতে লাগলো । দুজনের যুদ্ধে দিঘির জলে যেনো ঝড় উপস্থিত হল। ঝাপ্টাঝাপ্টিতে দিঘির জল উথলে পার ভেঙ্গে যেতে লাগলো । দুপাশে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো । দিঘির পদ্ম সকল হনুমানের উপর এসে পড়েছিলো। মনে হচ্ছিল্ল জলদেবতা , রুদ্রাবতার হনুমানকে পদ্ম ও জলজ নানা ফুলে শৃঙ্গার করেছেন । একসময় হনুমান , কুমীরের মুখ দুটি দুদিকে টেনে টেনে ছিন্নভিন্ন করলেন। চোখ ঠিকরে বের হয়ে কুমীর মারা গেলো। সেখান থেকে শাপমুক্ত হয়ে সুন্দরী অপ্সরা গন্ধকালি বের হয়ে হনুমানের স্তবস্তুতি করে বলল- “হে পবনপুত্র! আমি স্বর্গের অপ্সরা গন্ধকালি। শাপিত হয়ে কুমীর রূপে এখানে ছিলাম। আপনার হস্তে নিধন হয়ে মুক্তিলাভ করেছি । হে রুদ্রাবতার। আপনি যাকে রামভক্ত ভেবেছেন , সে আসলে ছদ্দবেশী রাক্ষস কালনেমি। রাবণের আদেশে সে এখানে আপনাকে হত্যা করতে এসেছে । প্রথমে সে বিষ মেশানো কলসির জল আপনাকে পান করতে দিয়েছিলো। তারপর আপনাকে এখানে প্রেরণ করেছে। এখানে যে পর্বত আছে, যাহার থেকে দিব্য জ্যোতি উৎপন্ন হচ্ছে সেটিই গন্ধমাদন পর্বত।” এই বলে অপ্সরা গন্ধকালি নানা স্তবস্তুতি করে স্বর্গে প্রস্থান করলো। হনুমান এসে কালনেমিকে আক্রমণ করলো।

কালনেমি দেখলো হনুমান বেঁচে ফিরেছে । সে অতি আশ্চর্য হল। তারপর হনুমানের আঘাত খেয়ে সাধু রূপ ছেড়ে মূল বিকট রূপ রাক্ষস রূপে আসলো । দুজনে প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হল। একে অপরকে কিল- চড়- মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলো । হনুমানের আঘাত খেয়ে কালনেমি একেবারে দুর্বল হয়ে পড়লো। হনুমান সেই রাক্ষসকে ভূমিতে ফেলে তাকে চরণ দিয়ে চেপে ধরলেন । কালনেমির জিহ্বা, চোখ যেনো বের হয়ে আসলো। মুহূর্তে কালনেমি মারা গেলো। মৃত্যুর আগে সে একবার ‘রাম’ শব্দ উচ্চারন করেছিলো । হনুমান তখন বলল- “মৃত্যুর আগে প্রভুর নাম নিয়েছিলি। যা ব্যাটা তোর সদ্গতি হল।” এরপর হনুমান গন্ধমাদন পর্বতের কাছে গেলো । সেখানে দেখলো নারদাদি মুনি সেবিত দিব্য পর্বতকে । সেই স্থান হতেই ত্রিপুর বিনাশকালে ভগবান শিব অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিলেন । সেখানে ধর্মরাজকে অনুচর সহিত দেখতে পেলেন। পবিত্র মন্দির দেখলেন । সেখানে অগ্নি , কুবের ও চৌদ্দ ব্রম্মাণ্ডের সূর্য, পিণাক ধনুক, মহাদেবের বাহন বৃষ দেখলেন । আর সেখানে অনেক ঔষধি দেখলেন । হনুমান বুঝতেই পারছিলেন না যে কোনটা আসলে সেই ঔষধি। কারণ এখানে বহু ভেষজ ঔষধি ছিলো। আর তা থেকে উজ্জ্বল আলো বিকিরণ ও দিব্য জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল্ল। হনুমান ভাবল গোটা পর্বত টাই তুলে নিয়ে যাবে। তাহলে বৈদ্য সুষেণ নিজেই চিনে নিয়ে ঔষধি প্রয়োগ করবে। ভুল বশত অন্য ঔষধি নেওয়ার থেকে এটাই ভালো। হনুমান সেই গন্ধমাদন কে স্তবস্তুতি করলেন চলার জন্য। গন্ধমাদন পর্বত মানলো না। সে পালটা হামলা করলো হনুমানের ওপর। হনুমানের গদার আঘাতে গন্ধমাদনের জায়গা জায়গাতে পাথর সকল পতিত হল। ধস নামলো। কিছু জায়গায় ফাটল ধরল । ভারতবর্ষে উত্তরাখণ্ডে এই পর্বত এখনও আছে। এখানকার লোকেরা হনুমানের পূজা করে না। কারন তাদের ধারনা হনুমান জোর করে এই পর্বত নিয়ে গিয়েছিলো। এখানে হনুমানের কোন মন্দিরও নেই। কেউ পূজাও করে না। যাই হোক। হনুমান তখন বিশাল বড় হলেন। তারপর হস্তে তুললেন গন্ধমাদন পর্বত ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ১৭ )


বানরেরা ছুটে গিয়ে অশ্রসজল চোখে ভগবান শ্রীরামের সম্মুখে দাঁড়ালো । সকলে কেবল মস্তক নীচু করে রোদন করছিলো। অপরদিকে লঙ্কায় বিজয় , উল্লাস, আতসবাজি পোড়ানো হচ্ছিল্ল। এই সময় লক্ষ্মণ অনুপস্থিত । শ্রীরামের শঙ্কা হচ্ছিল্ল। লঙ্কায় কেন আজ বিজয়
উৎসব ? এত বাদ্য কেন লঙ্কায় বাজানো হচ্ছে? শ্রীরাম বললেন- “আমার প্রাণের অধিক প্রিয় আমার ভ্রাতা কোথায়?” বানরেরা সব বলল। শ্রীরাম যেন চোখে নিশীথ অপেক্ষাও অধিক তমসা দেখলেন । বুক ভার হয়ে আসলো। হস্তপদ অসার ও শুন্য মনে করলেন । এক ছুটে সমুদ্র তটে এসে দেখলেন লক্ষ্মণ মাটিটে চোখ বন্ধ করে শায়িত। সকলে তাহাকে ঘীরে রোদন করছে। ভগবান রাম ভূমিতে বসে লক্ষ্মণের মস্তক ক্রোড়ে নিয়ে বিলাপ করে প্রলাপ বকতে আরম্ভ করলেন শোকে। পরে বললেন- “হে লক্ষ্মণ! তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলে ? এই যুদ্ধ কত আর বলি নেবে? আমি কি মুখ দেখাবো রাজ্যে ফিরে ? মাতা কৌশল্যা , মাতা কৈকয়ীকে , মাতা সুমিত্রাকে কি উত্তর দেবো? ঊর্মিলাকে কি উত্তর দেবো ? হে ভ্রাতা! তুমি ভিন্ন এই যুদ্ধে জয়ী বা পরাজিত হই- তার আর অর্থ থাকে না। ভ্রাতা ! অরণ্যে তুমি আমাকে এক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যয় সর্বদা দেখাশোনা করে এসেছো। নিজের সুখ না দেখে কেবল আমার আর সীতার সেবা করেছো । আমি কিছুই করতে পারি নি। হায় ঈশ্বর! কেন আজ আমি ভ্রাতাকে যুদ্ধে প্রেরণ করলাম।”পদ্মলোচন শ্রীরামের নয়ন থেকে অশ্রু পতিত হতে লাগলো । জাম্বুবান দেখে বলল – “প্রভু লক্ষ্মণ কেবল মূর্ছা গেছেন। প্রাণ আছে। এই অস্ত্র ধীরে ধীরে প্রভাব বৃদ্ধি করছে। সুচিকিৎসা দ্বারা এই অস্ত্রের প্রভাব বিনষ্ট করে লক্ষ্মণকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব।” বিভীষণ বলল- “প্রভু! এর চিকিৎসা লঙ্কার শ্রেষ্ঠ বৈদ্য সুষেণ করতে পারেন। তাহাকে আনা হোক।” হনুমান যেতে রাজী হল। এক লম্ফ দিয়ে লঙ্কায় ঢুকে সুষেণ বৈদ্যের ঘর সমেত উড়িয়ে নিয়ে আসলো । সুষেণ সমস্ত দেখে বলল- “আমি লঙ্কার চিকিৎসক । শত্রু পক্ষের চিকিৎসা করলে আমার প্রাণ যাবে। মরে গেলেও এ আমি করতে পারবো না।” হনুমান অনেক ভয় দেখালেও সুষেণ চিকিৎসা করলো না।

তখন ভগবান রাম করজোড়ে বললেন- “হে বৈদ্যশ্রেষ্ঠ! ভগবান ধন্বন্তরি কি শত্রু মিত্র জ্ঞান করে চিকিৎসা শাস্ত্র প্রদান করেছেন ? হে বৈদ্যরাজ! বৈদ্যের কর্তব্য শত্রু মিত্র ভেদ না দেখে চিকিৎসা করা। কোন ব্যক্তিই বৈদ্যের শত্রু হয় না। বৈদ্যের শত্রু কেবল রোগজীবানু হয়- রোগী নন। আমি আমার ভ্রাতার জীবন ভিক্ষা চাইছি। আপনি নিজের মনকে প্রশ্ন করুন। যদি আপনি চিকিৎসা না করেন, তবুও আপনাকে অক্ষত লঙ্কায় পৌছে দেওয়া হবে। কিন্তু তাহার পর আপনি বিবেকের কাছে কি উত্তর দেবেন?” সুষেণ এইভাবে ভগবান রামের কথায় অনুপ্রাণিত হল। ভাবল ইনি তো যথার্থ বলেছেন । আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উৎপত্তি রোগীকে আরোগ্য প্রদানের জন্য। স্বার্থ , লোভ এর স্থান আয়ুর্বেদে নেই। যদি চিকিৎসা না করা হয় এতে ভগবান ধন্বন্তরি কোনদিনই ক্ষমা করবেন না। ভাবলেন কপালে যা আছে হোক। ধন্বন্তরিকে প্রণাম করে সুষেণ লক্ষ্মণের নাড়ি টিপে দেখে বলল- “এ বেঁচে আছে। তবে ক্ষত ধীরে ধীরে একে মৃত্যুমুখে নিয়ে যাচ্ছে । এর ঔষধ হল বিশল্যকরণী । কাল সূর্য উদয়ের আগে একে সেই ঔষধি সেবন করালে সম্পূর্ণ সুস্থ হবে। নচেৎ মৃত্যু অবধারিত । জগতের কোন বৈদ্য বাঁচাতে পারবে না।” সকলে জিজ্ঞেস করলো এই ঔষধি কোথায় পাওয়া যায় ? সুষেণ বলল- “সেই স্থান বহুদূরে । উত্তরে হিমালয়ের ঋষভ ও কৈলাস শিখরের মাঝে গন্ধমাদন পর্বত অবস্থিত। সেই পর্বতে এই দিব্য ঔষধি পাওয়া যায় । সেখানে মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী , সন্ধানকরণী নামক চার দিব্য ঔষধি দেখা যায়। সেই ঔষধি থেকে দিব্য জ্যোতি নির্গত হয়। এই ঔষধি আনয়ন করা সামান্য ব্যাপার নয়। সমুদ্র মন্থনের সময় এই ঔষধি সকল প্রকটিত হয়েছিলো। দেবতারা এই ঔষধি প্রহরা দেন। সেই ঔষধি সূর্য উদয়ের আগে বেটে খাওয়ালে শ্রীমান লক্ষ্মণ সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবেন।” কিন্তু একরাতের মধ্যে কে হিমালয়ে যাবে? আর নিয়ে আসবেই বা কে? জাম্বুবান বলল- “আমার মনে হয় হনুমান ব্যতীত এই কাজ কেউ সম্পাদন করতে পারে না। যেমন সেই প্রথম মাতা সীতার অন্বেষণ করে এনেছিলো । সে বায়ুরপুত্র। প্রবল গতিতে আকাশ ভ্রমণের বিদ্যা তার করায়ত্ত । হে পবন পুত্র! তুমি সত্বর গিয়ে সেই ঔষধি আনো।” ভগবান শ্রীরাম তখন হনুমানের কাছে অনেক অনুনয়- বিনয় করলেন। হনুমান রাজী হলেন । রাম নাম নিয়ে লম্ফ দিয়ে আকাশে উঠে উড়ে চললেন হিমালয়ের দিকে। রাবণ গুপ্তচর মারফৎ সব খবর পেয়ে প্রথমে বিভীষণ, তারপর সুষেণ কে অনেক গালমন্দ করলেন। এরপর রাক্ষস বীর কালনেমিকে আদেশ দিলেন হিমালয়ে ঐ হনুমানকে হত্যা করবার । কালনেমি হিমালয়ে চলল।

সীতা সব শুনেছিলেন । তিনি রোদন করে বিলাপ করতে লাগলেন। সীতার কাতর অবস্থা দেখে শূর্পনাখা, রাবণ আদি এরা হাস্য করতে লাগলো। লঙ্কায় যেনো বিজয় উৎসব আরম্ভ হয়েছে । কারণ তারা আনন্দে ছিলো যে লক্ষ্মণ এবার মরবে । সূর্য উদয়ের আগে এতদূর থেকে হনুমান সেই পর্বত আনতে পারবে না। সে ভেষজ উদ্ভিদ চিনবে না। পৌছালেই কালনেমির হস্তে মরবে । সীতাদেবী করজোড়ে দেবতাদের কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন। ভগবান ধন্বন্তরি , যম দেবতা, সূর্য দেবতা এঁনাদের কাছে লক্ষ্মণের আয়ু ভিক্ষা প্রার্থনা করতে লাগলেন। রোদন করে করে বারংবার এই সকল দেবতাদের কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন । অপরদিকে ভগবান রাম সমুদ্র তীরে লক্ষ্মণের মস্তক ক্রোড়ে রেখে কেবল রোদন করতে লাগলেন । হনুমান উড়ে চললেন। আকাশের নক্ষত্র গুলি আগুনের ফুলকির ন্যায় তীব্র বেগে পেছনে সড়ে যাচ্ছিল্ল। প্রবল গতিবেগে হনুমান উড়ে যাচ্ছেন । চন্দ্রালোকে ঘুমন্ত নগরী, গ্রাম, পর্বত কন্দর , জনপদ দেখতে পেলেন। কত পাহার, অরণ্য পার করে গেলেন । প্রবল গতিবেগে উড়ে যাচ্ছেন । একসময় পৌছে গেলেন হিমালয় পর্বতে । বরফে ঢাকা হিমালয়। এখানে পূর্বে শিবলিঙ্গ নিতে এসেছিলেন , মনে পড়লো । দেখলেন সেই যোগীরা ঠাণ্ডায় এখনও ভগবানের তপে মগ্ন । হনুমান সব দেখে গন্ধমাদন পর্বতের খোঁজ করতে লাগলেন । সেখানে কালনেমি পৌছে ভেক ধরেছিল । মায়াবলে যোগী রূপ ধরে, মায়া দ্বারা একটি আশ্রম কুটির নির্মাণ করেছিলো । সেই দুরাচারী রাক্ষস এক কলসি জলে ভয়ানক বিষ মিশিয়ে রেখেছিলো। পরিকল্পনা করেছিলো যে হনুমান আসলেই তাকে এই বিষাক্ত জল পান করতে দেবে। সেই খানে একটি পুকুরে গন্ধকালি নামে এক অপ্সরা শাপিত হয়ে কুমীর হয়ে নিবাস করেছিলো। সেই প্রকাণ্ড কুমীর অতীব শক্তিমান ছিলো। কেউ এই পুকুরে আসতো না। সেই গন্ধকালি সকল কিছুই দেখছিলো। বিশাল কুমীর যে এই পুকুরে থাকে সেই কথাও জানতো কালনেমি। ভাবল সেই হনুমান যদি বিষাক্ত জলে না মরে তবে এই পুকুরে প্রেরণ করবে। আর হনুমান তখন কুমীরের ভোজন হবে। এই ভেবে কালনেমি অতি আনন্দিত হচ্ছিল্ল। ভেক ধরে কপালে তিলক কেটে, তুলসীমাল্য হাতে, বাহু, কণ্ঠে ধারণ করে ‘রাম’ নাম কীর্তন করছিলো । আর খেয়াল রাখছিলো কখন হনুমান আসে। হনুমান সেই দিক হতে রাম নাম শুনতে পেয়ে সেই আশ্রমে উপস্থিত হল।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।