২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩২)


রাবণ হন্তদন্ত হয়ে অশোক বনে আসছে দেখে রাক্ষসীরা সব উঠে দাঁড়িয়ে রাবণকে প্রনাম জানালো। রাবণের পেছন পেছেন মন্দোদরী রাবণকে বাধা দিতে আসলো। বলতে লাগলেন- “এমন অনর্থ করবেন না। নারী হত্যা অতি নিন্দনীয় কাজ।” সীতাদেবী পুনঃ রাবণের আগমন শুনতে পেয়ে মস্তকে ঘোমটা দিয়ে হস্তে দূর্বা ধারণ করলেন। রাবণ বলল- “সীতা! তোমার কারণেই রাম আমার পুরী থেকে রাক্ষস শূন্য করেছে। তোমাকে উদ্ধার করতেই সেই রাম, বানর সেনা নিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করেছে । একের পর এক আমার পুত্রেরা নিহত হয়েছে। আমার নাতিরা সব নিহত হয়েছে। আমার অনুগত বীর প্রতাপী রাক্ষসেরা নিহত হয়েছে। এই সব হয়েছে তোমার কারণে । আজ তোমাকে হত্যা করে আমি মনের সব ক্ষোভ দূর করবো। মেঘনাদ মায়া সীতা বধ করেছে, আমি আসল সীতাকেই বধ করে সেই দেহ রামকে উপহার দেবো।” সীতা বললেন- “দাম্ভিক রাবণ! এত ক্ষয়ক্ষতি দেখেও তোর চেতনা লাভ হয়নি? পরাজিত ব্যক্তির এত ক্রোধ শোভা পায় না। অবশ্য তোর ন্যয় ভীরু ব্যক্তি এর থেকে কি আর করতে পারে ? যে সাধুর বেশে স্বামীর অনুপস্থিতিতে পরস্ত্রী হরণ করে, যে নকল মূর্তি নির্মাণ করে যুদ্ধে জিতবার প্রয়াস করে, তাহার ন্যয় ভীরু ব্যক্তি কেবল স্ত্রী বধই করতে পারে। কারণ ভীরু ও দুর্বল ও শক্তিহীন ব্যক্তি কদাপি যুদ্ধে বীর যোদ্ধাকে পরাজিত করতে পারে না। আমাকে হত্যা কর। আমি ত এই পাপপুরী থেকে মুক্তি পেতেই চাই। কি জীবন্ত অবস্থায় কি মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মা হয়ে। এই লঙ্কার বাতাস আমার কাছে বিষাক্তসম । এই সুন্দর অশোক বাগিচা আমার কাছে যমালয় তুল্য । রঘুনাথের বিহনে এক একটি ক্ষণ আমার কাছে শত বৎসর তুল্য। তুই বরং আমাকে হত্যা কর।” সীতা এই সকল কথা বলে ক্রোধ মূর্তি ধারণ করলেন। রাবণ সীতার মধ্যে সেই বেদবতীকে দেখলেন। বহু পূর্বে বেদবতীকে হরণ করতে গেলে বেদবতী যজ্ঞে ঝাঁপ দেন। রাবণ বলল- “তাই হোক! তোকে এত দিন বাঁচিয়ে রাখাই আমার ভুল। এই কাজ আগে করলে এত বীরের পতন হতো না।” এই বলে রাবণ খড়গ তুলল।

মন্দোদরী কহিতেছে করি যোড়হাত ।
পরম পণ্ডিত তুমি রাক্ষসের নাথ ।।
শ্রীবিশ্রবা পিতা তব সংসারে পূজিত ।
তোমার এ নারীবধ না হয় উচিৎ ।।
একে দেখ মজেছে কনক লঙ্কাপুরী ।
পাপেতে ম’জ না তাহে বধ করে নারী ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

মন্দোদরী বললেন- “প্রভু! আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত! আপনি ব্রহ্মার বংশজ শ্রী বিশ্বশ্রবা মুনির তনয় । আপনি তো জানেন নারী হত্যা নিকৃষ্ট কর্ম। সীতাকে হরণ করে পূর্বেই আপনি অনেক অপযশ প্রাপ্ত করেছেন। এর ওপর সীতাকে বধ করলে জগতে আপনার অনেক কলঙ্ক হবে। এই হেন পাপ কর্ম করবেন না। আপনার চরণে অনুরোধ জানাই।” রাবণ বলল- “তুমি বাঁধা দিও না মন্দোদরী। এই সকল কথা বলে আজ আমাকে আটকাতে পারবে না। এই জগতে যে বা যারা তার মুখদিয়ে আমার নামে কলঙ্ক ব্যখান করবে, তাহাদিগের মস্তকটাই আমি ছিন্ন করে দেবো। দেখবো কার কত সাহস। আমার মনে পুত্র হারানোর শোক থেকে ক্রোধের জন্ম হয়েছে। এই সীতাকে হত্যা করলেই এই ক্রোধ প্রশমিত হবে।” এই বলে রাবণ খড়্গ উত্তোলন করে সীতাকে কাটতে গেলো। মন্দোদরী তখন রাবণের চরণে পতিত হল। বলল- “প্রভু! যদি সীতার অঙ্গে একটিও আঘাত লাগে, তাহলে আপনার চরণের শপথ রেখে প্রতিজ্ঞা করছি আমি নিজেও জীবন রাখবো না। সমুদ্রে ঝাঁপ দেবো। তখন না থাকবেন সীতা, না থাকবো আমি। তখন আপনি তখন যা ইচ্ছে করে বেড়াবেন।”

মন্দোদরীর এই রকম মূর্তি দেখে রাবণ নিবৃত্ত হল। খড়্গ নামিয়ে চলে এলো। ব্রহ্মার বরে রাবণ এক মানস পুত্র লাভ করেছিলো। তার নাম মহীরাবণ। সে পাতালে থাকতো । পাতালভৈরবীর উপাসনা করতো। পাতালভৈরবী , দেবী জগদম্বার একটি প্রকাশ। এঁনার পূজো খুব একটা দেখা যায় না। কেবল বীরাচারী তন্ত্র সাধকেরা তন্ত্র মতে এই দেবীর পূজো করেন। দেবী সতী দক্ষযজ্ঞে যেতে বাঁধা পেয়ে মহাদেবের সামনে দশমহাবিদ্যা রূপে প্রকটিত হন। সেই দশ দেবীর একজন হলেন ভৈরবী । ভৈরবী দেবীর একটি রূপ হলেন পাতালভৈরবী। পাতালভৈরবীর দু রকম মূর্তি দেখা যায়- একটি যক্ষিণী মূর্তি, অপরটি কালিকা দেবীর ন্যায়। যক্ষিণী মূর্তি অতি বিকট। ভৈরবীর উপাসনা খুবুই কঠিন । তন্ত্র সাধকেরা খুবুই তান্ত্রিক আচার বিধান মেনে এই দেবীর উপাসনা করেন। যাই হোক মহীরাবণ পাতালে এই দেবীর পূজা করতেন। পাতালেও রাক্ষসদের সাম্রাজ্য পৌছে গিয়েছিলো মহীরাবণ আর তার পুত্র অহীরাবণের শক্তিতে । রাবণ লঙ্কায় বসেছিলেন। সেনারা এসে জানালো মহীরাবণ আগমন করেছে লঙ্কায় । রাবণ তাকে ডেকে নিয়ে আসলো। মহীরাবণ এসে পিতাকে প্রণাম জানিয়ে বলল- “পিতা! আমি আপনার মানস পুত্র বলেই কি আমাকে এত দূরে রেখেছেন। লঙ্কার এত সর্বনাশ হল। একবারও আমাকে সংবাদ দিলেন না? আমার ভ্রাতারা সব বীরগতি প্রাপ্ত করেছে। এই শুনে কষ্টে আমার প্রাণ যায়। কেন আমাকে সংবাদ দিলেন না? আমি কি এতই পর হয়ে গেলাম পিতা? আমার সব ভ্রাতারাও কি একটিবার আমাকে স্মরণ করলেন না? কারণ আমি আপনার মানস পুত্র দেখে? কেন আমাকে সংবাদ পূর্বে দিলেন না? ” এই বলে মহীরাবণ রোদন করতে লাগলো । রাবণ সব বলতে লাগলেন। শূর্পনাখার নাসিকাচ্ছেদ, সীতা হরণ, বালি কে নিহত করে রামচন্দ্র ও সুগ্রীবের মিত্রতা, হনুমানের লঙ্কায় আগমন ও লঙ্কা দহন , রামের বানর সেনা নিয়ে সেতু বন্ধন করে লঙ্কায় আগমন, যুদ্ধে রাবণের সব পুত্র, নাতিদের নিহত হওয়ার সংবাদ- সব কিছুই বললেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।