২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩০)


রাক্ষস বিরূপাক্ষ রোদন করতে করতে রাবণের কাছে গেলো। বিরূপাক্ষের কথা শুনে রাবণ ডুকরে কেঁদে উঠলো। প্রবল শোক পেলো দশানন। কুড়ি চোখে দিয়ে তাঁর অশ্রুপাত হল। “হা পুত্র!” বলে সে পুত্রের ছিন্নস্কন্ধ ইন্দ্রজিতের মৃতদেহের কাছে গেলো। মেঘনাদের শব দেখে রোদন করতে লাগলো। রাক্ষসেরা জানালো মেঘনাদের ছিন্নস্কন্ধ বানরেরা নিয়ে গেছে। রাবণ শোকে প্রস্তর সম হল। মেঘনাদের বাল্য অবস্থার রূপ মনে করতে তার অন্তর ভেঙ্গে প্রবল কান্না আসলো। রাবণ বিলাপ করে বলতে লাগলেন- “হা পুত্র ইন্দ্রজিৎ! তুমিও শেষে আমাকে ছেড়ে প্রস্থান করলে? পুত্রহীন হয়ে আমার আর বেঁচে থাকার অর্থ কি? এই লঙ্কার সুন্দর কানন , স্বর্ণ লঙ্কা আজ পুত্রের বিহনে জনশূন্য বলে বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই রাবণ আজ গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। পুত্র মেঘনাদ তুমি এই পিতামাতা, স্ত্রীকে ত্যাগ করে কোথায় গমন করলে? হা বীর! পুত্রই তার পিতার প্রেতকার্য সুসম্পন্ন করে। আমি এতই দুর্ভাগা যে নিজ পুত্রের প্রেতকার্য সম্পন্ন করতে হবে !” এই বলে রাবণ পুত্রের নিথর দেহের সামনে বসে অবিরত ক্রন্দন করতে লাগলেন। রাবণের পুরী আজ সত্যই শূন্য হয়েছে। মন্দোদরী দাসীদের কাছে সংবাদ পেয়ে আসলেন। তিঁনি এসে পুত্রের নিথর দেহ দেখে শোকে পাগলিনী হলেন। মাতা হয়ে পুত্রের নিথর শব দেখা অত্যন্ত অভাগী মাতার অদৃষ্টেই লেখা থাকে। মন্দোদরী কপাল চাপড়ে বিলাপ করে বলতে লাগলেন- “হা পুত্র! তুমি কেন যুদ্ধে নিয়োজিত হলে ? হা পুত্র! আমি শিব আরাধনা করে তোমাকে প্রাপ্তি করেছিলাম। আজ তুমি কেন চলে গেলে ? হা ঈশ্বর! আমি অত্যন্ত অভাগিনী নারী। হে পুত্র! যদি তুমি আমার কথা শুনতে তবে আজ এই দশা হতো না।” এই বলে মন্দোদরী রোদন করে ক্ষিপ্তা হয়ে দশাননকে ক্রুড় ভাষা বলতে লাগলেন ।

বললেন- “আপনি রোদন করছেন কেন? আপনার তো হাস্য করা উচিৎ! আপনার পুত্র আপনার জন্যই হত হয়েছে। আপনার ত গর্ব করা উচিৎ! কেন আপনি রোদন করছেন ? আপনার কি শরীরে মায়াদয়া আছে নাকি? লক্ষ্মণ আজ ইন্দ্রজিতকে বধ করেনি। তাকে হত্যা করেছে আপনার দম্ভ, আপনার কুবুদ্ধি! আপনি পুত্রঘাতী পিতা। আপনি নৃশংস । আপনিই আপনার কুল নিজ হাতে নাশ করে দিয়েছেন। আপনি প্রসন্ন চিত্তে আনন্দ করুন। কারণ আপনার মন- বুদ্ধি কিছুই নেই। আপনাকে পুত্রশোক শোভা দেয় না।” এত বলে মন্দোদরী রোদন করতে লাগলেন । প্রমীলাকে তখন দাসীরা অন্দরমহল থেকে নিয়ে আসলো। শোকে সে চলন গমনের শক্তি হারিয়েছে । প্রমীলার চোখে কোন অশ্রু নেই। তার পলক পড়ছে না। এলোকেশে কোন সজ্জা নেই, গাত্রের অলঙ্কার সকল নানাদিকে পতিত হয়ে আকাশ থেকে পতিত নক্ষত্রের ন্যয় দীপ্তি বিকিরণ করছিলো । শোকে যেনো প্রমীলার আত্মা দেহ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। কেবল যেনো তার দেহকেই ধরে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিলো । মন্দোদরী সদ্য বিধবা প্রমীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল- “মা! তোমার শ্বশুর এই উপহার তোমাকে দিয়েছেন। নিষ্ঠুর ও দাম্ভিক ব্যক্তি এর থেকে বড় উপহার আর কি দিতে পারেন ? তুমি তোমার শ্বশুরকে ক্ষমা করো না। পত্নী হয়ে পতিকে আমি অভিশাপ দিতে পারি না মা। কিন্তু তুমি ঈশ্বরের কাছে এর বিচার প্রার্থনা করো মা।” প্রমীলা এবার শোকে ভেঙ্গে পড়ে মেঘনাদের নিথর শবের উপর আছরে পড়ে অনেক রোদন করতে লাগলেন । প্রলাপ করে বলতে লাগলেন- “স্বামী! আপনি আমাকে বলেছিলেন আমাকে আপনাকে কেউ আলাদা করতে পারে না, কিন্তু আপনি নিজেই ত আমাকে আপনার থেকে দূরে সড়িয়ে দিয়েছেন। কেন আমি বেঁচে রইলাম ? কেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে না? কেন এই বসুমতীতে আমি প্রবেশ করছি না?” এই বলে প্রমীলা শোকাতুরা হয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন । রাবণ আদেশ দিলো পুত্রের দেহ সৎকার করতে। কিন্তু শির না পেলে ত সৎকার সম্ভব না ।

দাসীরা প্রমীলার রক্তিম সূর্যের ন্যয় কপালের সিঁদুর ও হাতের শাঁখা পলা খুলে নিতে গেলে, তাহার জন্য শ্বেত বস্ত্র আনয়ন করলে প্রমীলা রোদন করে বললেন – “আমি সতী নারী। আমার আর ওঁনার বন্ধন কেউ ছিন্ন করতে পারে না।” এই বলে প্রমীলা উঠে রাবণকে বললেন- “পিতা! আপনাকে রাক্ষসেরা ভগবান বলে মানে। আপনি দেবতাদের জয় করেছেন। কিন্তু আমাকে আমার স্বামীর সহিত সঙ্গবদ্ধ করার ক্ষমতা আপনার নেই। আমি তাঁর কাছেই যাবো যিনি এই আশীর্বাদ আমাকে দিতে পারেন।” এই বলে প্রমীলা একছুটে লঙ্কার বাইরে বের হল। চলে গেলো প্রভু শ্রীরামের কাছে। এলোকেশী, গহনা বিবর্জিতা প্রমীলাকে উন্মত্ত পাগলিনীর ন্যায় মনে হচ্ছিল্ল। সে গিয়ে ভগবান শ্রীরামের চরণে পড়ে বলল- “প্রভু! নারায়ণ! আপনি ত ভগবান! ভক্তের সর্বস্ব । পিতার গৃহে অবস্থান কালে আমি তো আপনারই পূজা করতাম । হে রঘুপতি! আমি কোন অভিযোগ জানাতে আসিনি। আমি আমার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষাও চাইবো না। দয়া করে আমাকে আশীর্বাদ করুন, যেনো আমি আমার স্বামীর সহিত মরণের পর একত্র হতে পারি। বৈধব্য জীবন নিয়ে আমি বাঁচতে চাই না। কৃপা করে আপনি আমার স্বামীর শির ফিরিয়ে দিন। আমি তাহা নিয়ে স্বামীর চিতায় উঠতে যাই।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “প্রমীলা ! তুমি মহাসতী। তোমার সতীত্ব তেজেই মেঘনাদ এত শক্তিমান ও অজেয় ছিলো। আমি সেই বীরের শির ফিরিয়ে দিলেও তোমাকে সতীদাহের অনুমতি দিতে পারি না। কারণ এর থেকে সতী প্রথার উদ্ভব আরম্ভ হবে। আর সীতাও এই ঘটনা শ্রবণে দুখী হবেন। কারণ সীতা নারী ধর্মের আদর্শ প্রচার করতেই জগতে এসেছেন। আমি বিধবা নারীর পুনঃবিবাহ প্রচলন করেছিলাম নিহত বালির স্ত্রী তারার সাথে সুগ্রীবের বিবাহ সুসম্পন্ন করে। কিন্তু তোমাকে সতী হওয়ার সমর্থন দিলে সীতা কোনদিন প্রসন্ন হবে না। যদি সীতা মত প্রদান করেন তবেই এ সম্ভব।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম, মেঘনাদের শির প্রদান করলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।