২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ১৬ )



মেঘনাদ রথে আসীন হল। রাক্ষসেরা সব একত্র হল। সকলে বিক্রাল রূপ ধরেছে । হস্তে ধারণ করেছে সদ্য শাণ দেওয়া নানা মারণাস্ত্র । রাক্ষসেরা যে পালটা একটা বড় আঘাত হানবে তা বুঝতে পেরেছিলেন কপিরা। তারাও বহু সংখ্যায় একত্রিত হয়ে অতি উচ্চ ওজনের শিলা, বৃহৎ বৃক্ষ, গদা, বর্শা, শর আনয়ন করলেন । মেঘনাদ বলল- “রাক্ষস বৃন্দ! তোমরা বীরবিক্রমে আজ যুদ্ধ করবে। বিজয় আমাদেরই হবে। প্রয়োজন অনুসারে মায়াবিদ্যার প্রয়োগ করতেও কুন্ঠিত হবে না।”

রাজ আভরণ দেবের পরে বাঞ্ছিত ।
সংগ্রামেতে সাজিল কুমার ইন্দ্রজিৎ ।।
ঘন ঘন সারথিরে করিছে মেলানি ।
শীঘ্র কর রথসজ্জা ডাকিছে আপনি ।।
সারথি আনিল রথ সংগ্রাম কারণ ।
মনোহর বেশে রথ করিল সাজন ।।
করিলেক রথসজ্জা রথের সারথি ।
মাণিক্য প্রবাল কত বসাইল তথি ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

ইন্দ্রজিতের যজ্ঞ হতে প্রাপ্ত তিন অক্ষৌহিণী রাক্ষস কাড়া, পড়া, ঢাক, ন্যাকড়া, দুন্দুভি, দামামা বাজাতে লাগলো। নানা বাদ্যে লঙ্কার আকাশ বাতাস মুখরিত হল। যুদ্ধসাজে মেঘনাদকে ভয়ানক বোধ হইতেছিলও । বাল্মিকী রামায়ণে লেখা সেই রাক্ষসেরা কেহ কেহ হস্তী, অশ্বে, ব্যঘ্র, বৃশ্চিক, মার্জার , অশ্বতর , উষ্ট্র, বরাহ, সর্প, সিংহ, জম্বুক, কাক, হাঁস, ময়ুরাদি আদি পশুপক্ষীর স্কন্ধে চেপে প্রাস, মুদ্গর, নিস্ত্রিংশ, পরশু, গদা, ভুশণ্ডী, যষ্টি, শতঘ্নী , পরিঘ অস্ত্রাদি ধারন করে ছিলেন । রাবণ আদেশ দিতেই মেঘনাদ বিশাল সেনা নিয়ে চলল। লঙ্কার পথ রাক্ষসে ছেয়ে গেলো। লঙ্কার দ্বার খুলতেই বিকট শব্দে রাক্ষসেরা ধেয়ে আসলো। বানরেরা বৃহৎ ওজন প্রস্তর, বৃহৎ বৃক্ষ নিক্ষেপ করা আরম্ভ করলো। পালে পালে রাক্ষস নিহত হল। কেউ আবার পশুস্কন্ধে বসেই মৃত্যুমুখে চলে গেলো । রথ গুলি ধ্বংস হল। রাক্ষসেরা ঘাতক অস্ত্র প্রহারে পালে পালে মর্কট, কপিদের ছিন্নবিছিন্ন করে টুকরো টুকরো করলো। শত শত শরে শত শত কপিদের মুণ্ডচ্ছেদ হল। হনুমান, অঙ্গদ, সুগ্রীব, নল, নীল একত্র হয়ে গদা দিয়ে পিটিয়ে রাক্ষসদের নিধন আরম্ভ করলো । শত শত রাক্ষস নিহত হল। হস্তী, অশ্ব, রথ ও অনান্য আগত প্রানী ধ্বংস হল। এই সময় মেঘনাদ কেল্লার চূরায় অবস্থিত রাক্ষসদের আদেশ দিলেন। রাক্ষসেরা প্রস্তর ক্ষেপণ যন্ত্র থেকে বিশাল প্রস্তর নিক্ষেপ আরম্ভ করলো। সেগুলো আগুনের গোলার ন্যায় বানরদের মধ্যে পড়ে বানর নিধন আরম্ভ করছিলো ।

ভল্লুক ও মর্কটেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো। হস্তে বিশাল আকার পাথর নিয়ে লম্ফ দিয়ে সগুলি রাক্ষসদের মাথায় নিক্ষেপ করলো। রাক্ষসেরা মাথা লুটিয়ে ভূমিতে পড়ে মরতে থাকলো। রথ গুলো ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে প্রস্তর দিয়ে রথীদের চূর্ণ করলো। রথ থেকে মুক্ত হয়ে অশ্বগুলি সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করছিলো । লঙ্কার দিক হতে আগুনের গোলা আর প্রস্তর ক্রমশ বর্ষণ হতেই লাগলো। হনুমানের প্রবল বীক্রমে রাক্ষস নিধন আরম্ভ করলো । মেঘনাদ তখন “কোথায় সেই রাম লক্ষ্মণ” বলে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। তার সামনে যতগুলি কপি, মর্কট, ভল্লুক আসলো সবগুলিই প্রাণ হারালো । যুদ্ধক্ষেত্রে রাক্ষসেরা মায়া বিদ্যা প্রয়োগ করলো। মন্ত্র বলে অদৃশ্য হয়ে বানরদের উপর আঘাত করলো। কেউ কেউ শূন্যে ভেসে বানরদের দিকে নানা অস্ত্র বর্ষণ করে বানরদের নাশ করতে লাগলো । মেঘনাদের এমন বীর বীক্রম দেখে বানরেরা ভয়ে কেউ আর সামনে গেলো না। রাক্ষসেরা আনন্দে রাবণ ও মেঘনাদের নামে জয়ধ্বনি করলো । লক্ষ্মণ বলল- “অগ্রজ! আবার আমাকে যুদ্ধে যেতে আদেশ দিন। দেখি মেঘনাদের শক্তি কত। আমিও শ্রীরামের ভ্রাতা। দেখি সে কিভাবে আমাকে পরাজিত করে!” লক্ষ্মণ যুদ্ধে এলো । মন্ত্র বলে আকাশে অনল বাণ নিক্ষেপ করলো। সেই বাণ যখন বিকট শব্দে ছুটলো তার থেকে অসংখ্য আগুনের গোলা রাক্ষসদের মাথায় ঝড়ে পড়লো । কাতারে কাতারে রাক্ষসেরা ভস্ম হল । যেনো চিতা ভস্মের পর্বত সৃষ্টি হল। এবং সেই চিতাভস্ম রক্তধারায় ভেসে গেলো । লক্ষ্মণ পুনঃ গন্ধর্ব অস্ত্র প্রয়োগ করে রাক্ষসদের মায়া নষ্ট করলো। রাক্ষসেরা অদৃশ্য থেকে দৃশ্য হতেই, লক্ষ্মণ বায়ুবাণে তাদের উড়িয়ে গভীর সমুদ্রে ফেলে দিলো যেখানে তারা জলজ প্রানীদের আহার হল। মেঘনাদ বানরদের দেখা মাত্রই দশটি, সাতটি করে বাণ নিক্ষেপ করছিলেন। বানরদের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। মেঘনাদের নিক্ষেপিত শর , প্রাস, শূলে হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, গন্ধমাদন, জাম্বুবান, ইশাণ, বেগদর্শী, মৈন্দ, দ্বিবিদ, নীল, গবাক্ষ, গবয়, কেশরী, হরিলোম, বিদ্যুদ্দংষ্ট্র, সূর্যানন , জ্যোতিরমুখ, দধিমুখ, পাবকাখ, নল ও কুমুদ নামক বানর বীরেরা রক্তাক্ত হল । অপরদিকে লক্ষ্মণ শিলাবাণ নিক্ষেপ করে রথগুলি ধ্বংস করতে আরম্ভ করলে মেঘনাদ আর লক্ষ্মণের মুখোমুখি দেখা হল ।

মেঘনাদ তখন বলল- “ওরে লক্ষ্মণ! লঙ্কাপতির সাথে যুদ্ধ করার পরিণাম মৃত্যু! ইহা কি জানো না? আজ প্রমান পাইবে। তুমি জেনে রাখো, দেশে আর জীবিত ফিরতে পারবে না। এটা তোমার ভ্রাতা রামকেও জানিয়ে রাখো। সীতাকে সে কোনদিনই ফিরে পাবে না। বরং সে প্রাণ হারাবে।” লক্ষ্মণ বলল- “মেঘনাদ! যুদ্ধে জয় আমাদেরই হবে। কারণ আমরা ধর্ম পথে চলেছি। আর বিনাশ তোমাদেরই হবে। অতএব যুদ্ধক্ষেত্রে মুখ থেকে বাক্যবাণ নিক্ষেপ না করে ধনুক থেকে বাণ নিক্ষেপ করো।” মেঘনাদ পাশাস্ত্র নিক্ষেপ করলে লক্ষ্মণ অর্ধচন্দ্র বাণে নিবারণ করলো। এরপর দুই বীর উভয়ে উভয়ের দিকে নানা দিব্যাস্ত্র সকল চালনা করতে লাগলো। উভয়ের শরীর রক্তাক্ত হল। দিব্যাস্ত্র সকল প্রয়োগে চতুর্দিকে আলোর ঝলকানি ও প্রচণ্ড আওয়াজ হতে লাগলো । মেঘনাদ তখন প্রবল বেগে বজ্রবাণ নিক্ষেপ করলে লক্ষ্মণ ইন্দ্রশক্তি বাণে নিবারণ করলো। তখন মেঘনাদ হাস্য করে আকাশে উঠলো । সেখান থেকে মেঘের আড়াল হতে বাণ দ্বারা বানরদের বধ করতে লাগলো। একবার সে অদৃশ্য হয়- আবার দৃশ্য হয়। একবার অদৃশ্য হয়ে যেদিক থেকে বাণ নিক্ষেপ করে পুনঃ দৃশ্য হয়ে অন্যদিক থেকে বাণ নিক্ষেপ করতে থাকে। এইজন্য লক্ষ্মণ ঠাওর করতে পারছিলেন না। শুধু মেঘনাদের আওয়াজ শুনে সেদিকেই বাণ চালনা করতে লাগলেন । মেঘনাদ যক্ষবাণ, ধূম্রবাণ নিক্ষেপ করলেন। প্রবল বেগে সেই অস্ত্র আসতে দেখে লক্ষ্মণ তখন কালবাণ, পবন বাণ ছুড়লেন। লক্ষ্মণের অস্ত্র গিয়ে মেঘনাদের অস্ত্র সকল ধ্বংস করে দিলো। মেঘনাদ কিছুতেই পারছে না দেখে ক্রোধে মেঘনাদ শক্তিশেল ( মতান্তরে ব্রহ্মাস্ত্র ) নিক্ষেপ করলো। অব্যর্থ এই শেলাস্ত্র এসে লক্ষ্মণের বুকে বিঁধলো । লক্ষ্মণ দারুন আহত হয়ে ভূমিতে মূর্ছা গেলো। মেঘনাদ নেমে এসে লক্ষ্মণ কে ক্রোড়ে তুলে লঙ্কায় নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু লক্ষ্মণের দেহ এত ভারী ছিলো যে অনেক রাক্ষসেরা একত্র হয়ে তুলতে পারছিলো না। মনে হচ্ছিল্ল লক্ষ্মণের ক্ষুদ্র দেহ পর্বত তুল্য। হনুমান এসে তখন গদা দিয়ে পিটিয়ে মেঘনাদ সহ অন্য রাক্ষসদের সরিয়ে বলল- “মূর্খ! তোরা কাকে তুলতে যাচ্ছিস? যিনি স্বয়ং মস্তকে পৃথিবী ধারণ করেন- তাঁকে তুলতে যাচ্ছিস?” এই বলে হনুমান, লক্ষ্মণকে তুলে প্রভু শ্রীরামের সামনে নিয়ে গেলো। রাক্ষসেরা বিজিত হয়ে আনন্দে লঙ্কায় প্রবেশ করলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।