২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ৬ )


গড়ুর এসে রাম লক্ষ্মণ কে মুক্তি দিয়েছে শুনে রাবণ ভীষণ ক্রুদ্ধ হল । মেঘনাদ হতাশ হল এই ভেবে যে, মৃত্যুপথযাত্রী রাম লক্ষ্মণ মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছে । অশোক বনে এসে নাগপাশে বন্ধন হবার কথা দেবী সীতা শুনেছিলেন । গরুড়ের আগমন ও নাগপাশ ব্যর্থ হওয়ার কথা শুনে আনন্দে চোখের জল মুছলেন । তিঁনি বুঝলেন দেবতারা এই যুদ্ধে ধর্মের সঙ্গ দিয়েছে । রাবণ এখন কি করে । পর দিন ধূম্রাক্ষ নামক অতি বীর যোদ্ধাকে যুদ্ধে পাঠানোর আয়োজন করলো । বীর সেই যোদ্ধা পরাজিত হয় না । দেবতারাও এই নাম শুনে ভয় পায় । রাবণ ধূম্রাক্ষকে ডেকে তাকে তিলকে চর্চিত করলো । তারপর তাকে যুদ্ধে প্রেরণ করলো । প্রভাতে সূর্য উঠতেই হনুমান সহ বাকী কপিরা সব দাঁড়ালো। লঙ্কার বিশাল দ্বার খুলতেই রাক্ষসেরা হৈ হৈ করে বের হল। রাবণের অনুগত বৃহৎ গজে চেপে রাক্ষস সেনারা বর্শা, শর, আগুনের গোলক নিক্ষেপ করতে লাগলো বানর সেনাদের প্রতি। বানরেরা প্রকাণ্ড বৃক্ষ, প্রস্তর বর্ষণ করতে লাগলো রাক্ষসদের প্রতি । দুদলের সেনা মিশে গেলো। শুরু হল অস্ত্রের আওয়াজ, মার- মার, কাট- কাট আওয়াজ । যুদ্ধে কেবল ধূলা উড়তে দেখা গেলো । আর শোনা গেলো উন্মত্ত গজের গর্জন, কিংবা প্রস্তরে চাপা পড়া অশ্বের আওয়াজ, আর রাম ও রাবণের কপি ও রাক্ষসদের জয়ধ্বনি । হনুমান প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ আরম্ভ হল। লাঙ্গুলে পেঁচিয়ে শত রাক্ষসকে মাটিতে আছরে মারলো, কাউকে তুলে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করলো। হাঙর, মকরেরা সেই সব রাক্ষসদের মাংস ভক্ষণ করতে লাগলো । আবার কাউকে গদা দিয়ে পিটিয়ে ধ্বংস করলো । একে অপরের দিকে অস্ত্রাদি বর্ষণ শুরু করলো । ভল্লুকেরা আঁচর কামড় দিয়ে রাক্ষস সেনাদের দফারফা সাঙ্গ করলো। রাবণের বীর সেনারা একে একে কপিদের প্রস্তরে চাপা পড়ে পিষে মরল । রক্তে রক্তে ভেসে সমুদ্রের সাদা বালুকা রাশি লাল বর্ণ ধারণ করলো । প্রকাণ্ড প্রস্তর নিক্ষেপ করে, বড় বড় বৃক্ষ নিক্ষেপ করে সোনার রথ গুলি চূর্ণ করলো। সেগুলি দেখলে মনে হয় সোনার তাল জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে আছে ।

এইভাবে প্রচণ্ড যুদ্ধ আরম্ভ হল । যতদূর দেখা যায় কেবল এই যুদ্ধের দৃশ্য । ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ যুদ্ধে যেতে চাইলে কপিরা বাধা দিয়ে বলল- “প্রভু ! আমরা থাকতে আপনি কেন কষ্ট করবেন ? যবে রাবণ যুদ্ধে আসবে তবে আপনি যুদ্ধ করবেন।” রাবণের সেনারা নিহত হচ্ছে দেখে ধূম্রাক্ষ প্রবল বেগে যুদ্ধ আরম্ভ করলো । শরে শরে আছন্ন করলো চারদিক । বানরদের দেখে প্রবল বেগে তীক্ষ্ণ বহু শর সন্ধান করলো । বৃষ্টির ন্যায় জলন্ত শর এসে কপি, ভল্লুক, মর্কট দের শরীর ছিন্নভিন্ন করে দিলো । কপিরা যে সকল প্রস্তর, বৃক্ষ ছুড়লো – ধূম্রাক্ষ তা শর দ্বারা চূর্ণ করলো । যেনো গগনে প্রস্তর বিস্ফোরণ হয়ে চতুর্দিকে প্রস্তর পতিত হচ্ছিল্ল । তখন রাক্ষসেরা উজ্জীবিত হল। বিকট রূপে এসে দাঁত, নখ দিয়ে কপিদিগের ছিন্নবিছিন্ন করে রক্ত মাংস ভক্ষণ করতে লাগলো । হনুমান এগিয়ে এলো ।ধূমরাক্ষের সামনে দাঁড়লো । ধূম্রাক্ষ অতি উচ্চ রবে হাস্য করে বলল- “হনুমান ! আমি তোকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। লঙ্কায় আগ্নিকাণ্ডের শাস্তি আজ তোকে দেবো। সেদিন তোর পুচ্ছ পোড়াতে পারিনি ঠিক- কিন্তু আজ এই দিনটিকে তোর অন্তিম দিন অবশ্যই বানাবো।” এই বলে ধূম্রাক্ষ একসাথে দশ বাণ নিক্ষেপ করলো । হনুমান গদা দিয়ে বান গুলিকে এদিক সেদিক ফেলে দিয়ে বলল- “ধূম্রাক্ষ! যত পারিস হাস্য কর। কারণ এইবার তোর মৃত্যু হবে। এরপর তো হাসবার আর অবকাশ পাবি না।” এই বলে হনুমান গদা নিয়ে ধূম্রাক্ষর রথে আঘাত করলো । রথ তো উলটে পড়লো। এরপর হনুমান কয়েকটি গদার আঘাতে ধূম্রাক্ষের মস্তক চূর্ণ করলো। ধূম্রাক্ষ নিহত হয়েছে দেখে রাক্ষসেরা ভয়ে পলায়ন করলো । যুদ্ধ সমাপ্ত হল । কপিরা আনন্দে হনুমানের জয়ধ্বনি করলো । হনুমান গিয়ে ভগবান শ্রীরামের চরণে প্রনাম জানালো । রাবণ দেখলো বড় বড় বীরেরা আজ মারা গেছে । তার কোন পরিবর্তন হল না। কৃত্তিবাসী রামায়ণ মতে এরপর অকম্পন যুদ্ধে এসেছিলো, বাল্মিকী রামায়ণ মতে এরপর বজ্রদংষ্ট্র নামক এক রাক্ষস যোদ্ধা যুদ্ধে এসেছিলো । আমরা বাল্মিকী রামায়ণ কেই মান্যতা দিয়ে লেখলাম ।

বজ্রদংষ্ট্র নামক রাক্ষস কে পাঠালো রাবণ । দ্বি সহস্র সপ্তক সেনা নিয়ে বজ্রদংষ্ট্র যুদ্ধে আসলো । আবার যুদ্ধ শুরু হল। অস্ত্রের গর্জন আরম্ভ হল। একে অপরের দিকে বাণ, বল্লম নিক্ষেপ করতে থাকলো । ছিন্ন ভিন্ন হতে লাগলো একে অপরের নিক্ষেপিত অস্ত্রে । কপিরা বৃক্ষ তুলে ছুড়ে ছুড়ে রাক্ষসদের রথ, হস্তীগুলিকে বধ করতে লাগলেন । যে সমস্ত অশ্বারোহী রাক্ষসেরা তরবারি দিয়ে বানরদের মুণ্ডচ্ছেদ করছিল তারা বানরদের নিক্ষেপিত প্রস্তরে পিষ্ট হল। বাকীরা পালালো। বজ্রদংষ্ট্র যুদ্ধ আরম্ভ করলো । তীক্ষ্ণ শর বর্ষণ করতে লাগলো । নল যুদ্ধ করতে আসলো- কিন্তু বজ্রদংষ্ট্র রাক্ষস এত সব বাণ বর্ষণ করলো যে নল পলায়ন করলো। নলের সাথে আগমন করেছিলো যে কপিরা পলায়ন করলো। নীল বানর তার অনুগামীদের নিয়ে আসলে বজ্রদংষ্ট্র বাণ দ্বারা ছত্রভঙ্গ করলো । শরভঙ্গ নামক বানড় বহু কপি সমেত বজ্রদংষ্ট্র এর রথ ঘেরাও করে রাখলে সেই রাক্ষস প্রবল বেগে রথ চালনা করে সব ঘেরাও তুলে দিলো। রথের তলায় কপিরা পিষ্ট হল। এরপর বজ্রদংষ্ট্র অকাতরে বাণ বর্ষণ করে শরভঙ্গ কে ঘায়েল করলো। সুগ্রীব এর পর বজ্রদংষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করতে আসলে বজ্রদংষ্ট্র আবার বাণ নিক্ষেপ করে সুগ্রীবকে তাড়ালো । কৃত্তিবাসী রামায়ণ মতে সুগ্রীব এই রাক্ষসকে বধ করেছিলো । কিন্তু বাল্মিকী রামায়ণে অন্য রকম লেখা । এর মধ্যে নল আর নীল দুজনে মিলে বজ্রদংষ্ট্রের সাথে আগত অতি বীর রাক্ষস দের হত্যা করলো । হনুমান গিয়ে বজ্রদংষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলে সেই রাক্ষস একটি কণ্টক গদা হনুমানের দিকে নিক্ষেপ করলো। কণ্টক গদার আঘাতে হনুমান ভূমিতে পতিত হলেও পুনঃ উঠে দাঁড়ালো । তখন অঙ্গদ যুদ্ধে আসলে বজ্রদংষ্ট্র বলল- “বালকদের সাথে আমি যুদ্ধ করি না। যা তোর প্রভু ভিক্ষুক রামকে ডেকে আন!” অঙ্গদ বলল- “নিজেকে বীর বলিস তাহলে সেদিন আমার চরণ সড়াতে অক্ষম হয়েছিলি কেন?” এই বলে অঙ্গদ একটি শালগাছ তুলে বজ্রদংষ্ট্রের রথে নিক্ষেপ করলো। রথ চূর্ণ হলে অঙ্গদ আরোও একটি বৃক্ষ তুলে বজ্রদংষ্ট্রের মস্তকে আঘাত হানলো। বজ্রদংষ্ট্র নিহত হল। দেবরাজ ইন্দ্র যেমন দেবতাদের মাঝে পূজা পান- ঠিক সেইরকম অঙ্গদ সেই রাক্ষসকে বধ করে কপিদের মাঝে পূজা পেয়েছিলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।