২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩৪)

মহীরাবণ আকাশ পথে ধীরে ধীরে শত্রু সেনার দিকে অগ্রসর হল। সত্যই দেখে সে কঠিন প্রহরা। অন্ধকারে বানরেরা মশাল নিয়ে ঘুরছে। সতর্ক প্রহরা দিচ্ছে। মনে হয় যেনো অগ্নিগোলা সকল সমুদ্র তটে এদিক ওদিক ঘুরছে। অন্ধকারে কেবল মশাল দেখতে পেলো। লক্ষ লক্ষ মশাল সে চতুর্দিকে দেখতে পেলো। মহীরাবণ এসব দেখে হাস্য করলো। ভাবল এই বনের পশুগুলি তাহার শক্তির ধারনাই করতে পারবে না । রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে বিভীষণ এসে হনুমানকে বললেন- “কেশরীলাল! খুব সতর্কে প্রহরা দেবে। মহীরাবণ মায়াবিদ্যায় পটু। এমন ভাবে সে নিকট আত্মীয়ের রূপ ধরে আসবে, যে কেউ ধরতে পারবে না। রাত্রিকালে নিশাচরদের শক্তি অধিক হয়। কদাপি নিদ্রা যেয়ো না। আর যে কেউ আসুক, প্রভাতের পূর্বে কুটীরে কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না। এমনকি তোমার পিতা পবন দেব আসলেও ভেতরে যেতে দেবে না।” হনুমান বিভীষণকে আশ্বস্ত করলো। জেগে সতর্কে প্রহরা দিতে লাগলো। মহীরাবণ সূক্ষ্ম হয়ে বানরদলে প্রবেশ করলো। কেউ দেখতে পেলো না। বানর দলের ভেতরে ঢুকে প্রতি তাঁবুতে গিয়ে রাম আর লক্ষ্মণকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পেলো না । এক সময় ঘুরতে ঘুরতে সে সত্যই প্রভু শ্রীরামের তাঁবুর নিকটে আসলো। দেখলো এক বৃহৎ মর্কট সেই তাঁবু পুচ্ছ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বসে আছে। এইহেন অদ্ভুদ দৃশ্য দেখে মহী ভাবল নিশ্চয়ই এখানে দুই নর আছে। এই মর্কটই হনুমান। এই ভেবে সে ভাবল লেজ ডিঙিয়ে ঢুকবে। মহী এসে হনুমানের পুচ্ছের বাঁধনের ভেতর ছিদ্র অন্বেষণ করতে লাগলো। সমস্ত তাঁবুর চারপাশে ঘুরেও একটিও ছিদ্র দেখতে পেলো না- যার মধ্য দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায় । এরপর মহীরাবণ মায়া দ্বারা দশরথের রূপ ধরল।

দশরথ হ’য়ে আসি দিল দরশন ।
দশরথ বলে শুন পবন নন্দন ।।
আমার সন্তান দুটি শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সনে করি দরশন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান জানতো যে প্রভু শ্রীরামের পিতা মহারাজ দশরথ বহু আগে পুত্র শোকে স্বর্গ গমন করেছেন। এ নিশ্চয়ই সেই মায়াবী। হনুমান চতুর । বলল- “আপনি একটু দাঁড়ান। বিভীষণ আসুন- তাহার পর প্রবেশ করতে দেবো।” এই বলে হনুমান ভাবল একবার বিভীষণ আসুক, তার পর এই মায়াবীর মাথায় গদার আঘাতে যমালয়ে পাঠাবো। এই শুনে মহীরাবণ পালালো। পুনঃ আসলো ভরতের রূপ ধরে । বলল-

ভরত হইয়া এল হনুমানের কাছে ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দুই ভাই কোথা আছে ।।
চৌদ্দ বর্ষ বনবাসী মস্তকেতে জটা ।
দশরথ রাজার আমরা চারি বেটা ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান বললেন- “ভ্রাতা ভরত! আপনি একটু প্রতীক্ষা করুন। এক মায়াবী নিশাচরের আগমন ঘটেছে। সেবক হয়ে প্রভুকে প্রহরা দিচ্ছি। বিভীষণ আসুন, আমি আপনাকে তাঁবুতে নিয়ে যাবো।” শুনে মহীরাবণ আবার পালালো। এবার আবার বুদ্ধি করে কৌশল্যা রূপ ধরল । সেই হনুমানের কাছে এসে বলল- “হনুমান! দ্বার উন্মোচন করো। চৌদ্দ বর্ষ পুত্রের মুখ দেখিনি। এই অভাগী মায়ের প্রাণ ফেটে যাচ্ছে। একবার পুত্রকে দেখি। পথ ছাড়ো বাছা!” হনুমান বুঝলো এও সেই মহীরাবণের মায়া। বলল- “মাতা! আপনার পুত্রের প্রাণ সঙ্কটে। কৃপা করে প্রভাত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বিভীষণকে আসতে দিন। হয়তো আপনার সাথে সাথে সেই দুষ্ট ঘাতক প্রবেশ করতে পারে।” দূর থেকে বিভীষণকে আসতে দেখে কৌশল্যারূপী মহীরাবণ দাঁত কটমট করে পালালো। এবার সেই মহীরাবণ জনক রাজার রূপ ধরল। ‘হাঁ সীতা’ বলে রোদন করতে করতে এসে বলল-

জনক বলেন শুন পবন নন্দন ।
রাম সঙ্গে আমার করাহ দরশন ।।
আমার জামাতা হন শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
চতুর্দশ বর্ষ গত নাহি দরশন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

জনক রাজাকে দেখে হনুমান বুঝলো আবার মহীরাবণ এসেছে। হনুমান বিনয় সহ বলল- “বিভীষণ আসুন। আমি তারপর আপনাকে প্রবেশ করতে দেবো। এখন নয়। আপনি এখন বিশ্রাম গ্রহণ করুন।” মহীরাবণ পুনঃ পালালো। সে বুঝলো হনুমানকে এইভাবে ভুলিয়ে রাম লক্ষ্মণকে হরণ করা অসম্ভব । আর এখানে এখন যুদ্ধ করা যাবে না। হনুমান অনেক শক্তি রাখে। এইভেবে মহীরাবণ ভাবল এবার কূট বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। যেই ভাবে অমনি মাথায় বুদ্ধি এলো । মহীরাবণ মায়া দ্বারা একটি সুড়ঙ্গ রচনা করলো। সে ভাবল ভেতর দিয়ে গিয়ে সেই দুই ভ্রাতাকে পাতালে নিয়ে যাবে। হনুমান কিছুই বুঝবে না। সে ত বাইরে প্রহরায়। আর পাতালে সে প্রবেশ করতে পারবে না। এই ভেবে হাসতে হাসতে মহীরাবণ পাতালে প্রবেশ করলো। তারপর সুড়ঙ্গ দিয়ে ভগবান রাম ও লক্ষ্মণের তাঁবুর মাটি খুঁড়ে উঠলো। দেখিলো দুভাই পরম যত্নে শয়ণ করছে। শরীরে নানা ক্ষত্রিয় চিহ্ন দেখতে পেলো। মহীরাবণ তখন ইষ্টদেবী পাতালভৈরবীর স্মরণ করে ধূলিপোড়া নিক্ষেপ করলো। তাহার ফলে রাম ও লক্ষ্মণ গভীর ঘুমে চলে গেলো। মহীরাবণ অতি সতর্কে তাহাদের দুজনকে দুস্কন্ধে ধারণ করলো। বিন্দু মাত্র শব্দ না করে রাম লক্ষ্মণকে নিয়ে সোজা চলে গেলো পাতাল পুরী। ওদিকে হনুমান প্রহরা দিচ্ছে। বিভীষণ এসে মাঝে মাঝে দেখে যাচ্ছে। প্রভাত হল। কিন্তু প্রভু শ্রীরাম আর কুটির থেকে বহির্গমন করেন না। সকলে দেখতো প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ প্রত্যহ অতি প্রভাতে উঠে সমুদ্রে স্নান, সূর্য দেবতাকে জল অর্পণ করতেন। কিন্তু আজ আর কেহই বের হলেন না। সকলে আশ্চর্য হল। হনুমান পুচ্ছ বাঁধন মুক্ত করলো। কুটিরে প্রবেশ করে দেখতে পেলো ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ কেহই নেই। সকলে অবাক হল ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।