• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৮)

গড়ুরে চড়ে শ্রীবিষ্ণু বৈকুণ্ঠে আসলেন। দেবলোকে উৎসব আরম্ভ হল । বৈকুণ্ঠ ধামে উৎসব আরম্ভ হল। বৈকুণ্ঠের অধিবাসীরা সকলে স্বাগত জানালেন। দেখলেন শ্রীরামের কৃপায় সকলে উদ্ধার হয়ে দেব শরীর প্রাপ্ত করে বৈকুণ্ঠে এসেছেন । নারদ মুনি কীর্তন করছেন। গন্ধর্ব, অপ্সরা, চারণ, কিন্নররা নৃত্য সঙ্গীত পরিবেশন করছেন । বিবিধ বাদ্য বাজনা বাজছে। অপূর্ব শোভা সেই বৈকুণ্ঠপুরীর। সরস্বতী দেবী সহ বিরিঞ্চিদেব, পার্বতী সহ শঙ্কর পদার্পণ করেছেন। দেবতারা পুস্প বর্ষণ করে ভগবান বিষ্ণুকে স্বাগত জানাচ্ছেন। সেই কতকাল পর বৈকুণ্ঠে গমন । এরপর দেখলেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী লক্ষ্মী বরণডালা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছেন । ভগবান বিষ্ণুকে বরণ করলেন। অনন্ত নাগে লক্ষ্মী নারায়ণ অবস্থান করলেন। লক্ষ্মী দেবীকে বামে রেখে ভগবান নারায়ণ বসলেন। অপূর্ব যুগল মূর্তি দেখে সকলে সকলে ধন্য ধন্য করলো। পুস্পাদি, সুগন্ধ, চামর, পাখা ব্যাঞ্জন করে সকলে ভগবান নারায়ণের স্তব স্তুতি করলেন। মহেশ্বর বললেন- “হে নারায়ণ! আপনার শ্রীরাম রূপ ধন্য। এই ত্রেতা যুগে দেবী লক্ষ্মী যেমন সীতা রূপে নারীর অধিকার মর্যাদা প্রতিতিষ্ঠ করে এসেছেন, ঠিক আপনি শ্রীরাম রূপে ধর্ম স্থাপন করে জগতের সামনে আদর্শ স্থাপন করেছেন। ন্যায়, নীতি, সত্য, বৈরাগ্য, ত্যাগ, কর্তব্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। যুগে যুগে এই রামলীলা মানুষকে প্রেরণা দেবে।” শ্রী নারায়ণ বললেন- “হে মহাদেব। রাম রূপে আপনার কপি অবতারকে ভক্ত রূপে পেয়ে আমি ধন্য। হনুমানের সকল সেবায় আমি প্রসন্ন। যুগে যুগে যখন আমার রাম অবতারের পূজা হবে, সাথে আপনার অবতার হনুমানের পূজা হবে। হনুমানের পূজা না করে যে আমার পূজা করবে, তাহার পূজা আমি স্বীকার করবো না। আমার বৈষ্ণব ভক্ত গড়ুর, নারদ, ধ্রুব, প্রহ্লাদ, বলির সাথে সাথে হনুমানের পূজা হবে। যে বৈষ্ণব হনুমানের পূজা করবে না, তাহাকে আমি কদাপি কৃপা করবো না। যেখানে আমার ভক্তদের সম্মান, শ্রদ্ধা করা হয়, সেখানেই আমি থাকি। যেখানে আমার ভক্তের অপমান হয় সেখানে আমি কোনদিন বিরাজ করি না।” মাতা কমলা বললেন- “প্রভু! এই রূপে বারংবার আপনার থেকে আমার বিচ্ছেদ হয়েছে। আপনার সেবার সুযোগ পেলাম না। কথা দিচ্ছি আপনার আগামী অবতারে আমি বহু রূপে আবির্ভূতা হয়ে আপনার সেবা করবো।” রাধারানী সহ ও রুক্মিণী দেবী সহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল ৮ পত্নীরা সেই লক্ষ্মী দেবীর অংশা ছিলেন।
ব্রহ্মা বললেন- “প্রভু! আপনাকে ফিরিয়ে আনতে আমি অধর্ম অর্থাৎ ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছি। আমি অপরাধী। আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু।” ভগবান বিষ্ণু বললেন- “হে ব্রহ্মদেব। আমি নিজেই আমার রামাবতারের সময় নির্ধারিত করেছিলাম। এতে আপনার দোষ নেই। আপনি এইরূপ ছলচাতুরীর আশ্রয় না নিলে বিধির বিধান লঙ্ঘিত হতো। আপনি সঠিক কাজ করেছেন।” নারদ মুনি নারায়ন শব্দ উচ্চারণ করে ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন – “পিতা! এই রামলীলা অর্থাৎ ‘রামায়ণ’ এর মাহাত্ম্য কি?” ব্রহ্মা বললেন- “পুত্র নারদ! মহামুনি বাল্মিকীর লিখিত এই রামায়ণ কে আমি নিজে পূজা করি । দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ, ব্রহ্মর্ষি সকলে শ্রদ্ধা সহ রামায়ণ শ্রবণ করেন । ইহা শ্রবণে পরমায়ু সৌভাগ্য লাভ হয় । শ্রাদ্ধকালে পণ্ডিত সর্বদা রামায়ণ পাঠ করিয়া সকলকে শ্রবণ করাবেন । রামায়ণ পাঠে পুত্রহীন পুত্র, ধনহীন ধন লাভ করিবে। রামায়নের এক অধ্যায় যে পড়িবে সে সর্ব পাপ হতে মুক্ত হবে । রামায়ণ পাঠক সন্তুষ্ট হলে দেবতারা তুষ্ট হন। সুতরাং রামায়ণ পাঠককে বস্ত্র, সুবর্ণ, ধেনু দান করা কর্তব্য। এই আয়ু বর্ধক ‘রামায়ণ’ পড়লে ইহকাল ও পরকালে মঙ্গল হয় । যে সকাল, দ্বিপ্রহর ও সন্ধ্যায় রামায়ণ পড়ে সে কদাপি অবসন্ন হয় না। সহস্র অশ্বমেধ, সহস্র বাজপেয় যজ্ঞে যেই ফল লাভ হয়, রামায়নের একটি অধ্যায় শুনিলে সেই ফল লাভ হয় । ” যাই হোক। অযোধ্যা এর পর দীর্ঘদিন জনশূন্য ছিলো। রাজা ঋষভের রাজত্বকালে পুনঃ অযোধ্যা জনপূর্ণ হল। অযোধ্যা ভারতবর্ষে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত। এখনও শ্রদ্ধালু ভক্তেরা সেখানে গিয়ে ভজন সাধন করেন । যেখানে যেখানে রামায়ণ পাঠ হয় সেখানে সেখানে হনুমান অবস্থান করেন। ইহা মিথ্যা নয় । কিন্তু আমাদের সেই নয়ন কোথায় যে হনুমানজিকে দর্শন করবো। তীর্থ স্থানে পবিত্র স্থানে ভ্রমণে যে ফল হয় রামায়ণ শ্রবনে সেই ফল হয়। কুরুক্ষেত্রে সূর্য গ্রহণের সময় যেব্যাক্তি প্রচুর সোনা দান করেন, আর যে রামায়ণ শ্রবণ করেন উভয়ে সমান ফল পায়। যে ব্যাক্তি শ্রদ্ধা সহ এই ‘রামায়ন’ শ্রবণ করবে সে সর্ব পাপ হতে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করবে। মহর্ষি বাল্মিকী রচিত এই রামায়ণ শ্রদ্ধা সহ সত্য জ্ঞানে শ্রবণ করলে স্ত্রীপুত্র সন্ততি পরিবর্ধিত হয় । তাই সত্য জ্ঞানে শ্রবণ করা উচিৎ।
শ্রীরামচন্দ্র, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব এবং হনুমানকে প্রনাম করি । যে যে স্থানে রামকথা পাঠ হয় সে সে স্থানে অশ্রুপূর্ণলোচনে অবস্থিত সেই রাক্ষসবিনাশক পবননন্দন হনুমান কে প্রনাম করি । সর্বশক্তিমান , রামভদ্র , রামচন্দ্র , রঘুনাথ, সীতানাথ, জগন্নাথ রামকে প্রণাম করি । এই পৃথিবীতে রামায়ণলেখক, রামায়ণপাঠক, রামায়ণ শ্রোতা এবং যে রাজ্যে রামায়ণ থাকে, সেই রাজ্যের রাজা- সকলেরই মঙ্গল হয়। ( রামায়ণ মাহাত্ম্য বাল্মিকী রামায়ন হতে লেখা )
জয় জয় রঘুপতি রাজা রাম,
পতিত- পাবন সীতা রাম ।
জয় জয় মঙ্গল পরশন রাজা রাম ,
পতিত- পাবন সীতা রাম ।।
বরাভয়দানরত রাজা রাম,
পতিত- পাবন সীতা রাম ।
দীন দয়াল প্রভু রাজা রাম ,
পতিত- পাবন সীতা রাম ।।
আশ্রিত – বৎসল রাজা রাম,
পতিত- পাবন সীতা রাম ।
দশরথ - নন্দন রাজা রাম ,
পতিত- পাবন সীতা রাম ।।
রাজা রাম জয় সীতা রাম ।
পতিত- পাবন সীতা রাম ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
রামায়ণের আরতি
........................
আরতি শ্রীরামায়ণজী কী ।
কীরতি কলিত ললিত সিয় পী কী ।।
গাবত ব্রহ্মাদিক মুনি সারদ ।
বাল্মীক বিগ্যান বিসারদ ।।
সুক সনকাদি সেষ অরু সারদ ।
বরনি পবনসুত কীরতি নীকী ।।
গাবত বেদ পুরান অষ্টদস ।
ছঅ সাস্ত্র সব গ্রন্থন কো রস ।।
মুনি জন ধন সন্তন কো সবরস ।
সার অংস সম্মত সবহী কী ।।
গাবত সন্তত সম্ভু ভবানী ।
অরু ঘটসম্ভব মুনি বিগ্যানী ।।
ব্যাস আদি কবিবর্জ বখানী ।
কাগভুসূণ্ডি গরুড় কে হী কী ।।
কলিমল হরনি বিষয় রস ফীকী ।
সুভগ সিঙ্গার মুক্তি জুবতী কী ।।
দলন রোগ ভব মূরি অমী কী ।
তাত মাত সব বিধি তুলসী কী ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )
হে দয়াময় শ্রীরাম তোমার লীলামাহাত্ম্য বলে শেষ হয় না। রামায়ণ লেখনীতে যে সকল ত্রুটি, ভুল – ভ্রান্তি, বিচ্যুতি অক্ষর বিচ্যুতি আদি দোষ হয়েছে তাহা তুমি নিজগুনে ক্ষমা করে সকলের ওপর আশীর্বাদ প্রদান করো। জয় সীতারাম । জয় শ্রীরাম । জয় হনুমান ।
এবার দেখি ভারতবর্ষে সব ভাষায় কোন কোন কবি ‘রামায়ণ’ লেখেছেন।
সংস্কৃত- মহর্ষি বাল্মিকী মুনি
বাংলা- কৃত্তিবাস ওঝা
হিন্দী- তুলসীদাস গোস্বামী
তামিল- কুম্ভন
তেলেগু- রঙ্গনাথন
অসমীয়া – মাধবকন্দলী
কানাড়া- তরাবে
মারাঠী- একনাথ
সকল রামায়ণ রচয়িতাদের দিগের চরণে প্রণাম জানাই ।
জয় সীতারাম । জয় মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম । জয় মাতা সীতা । জয় মহাবীর হনুমান । জয় রামায়ণ । জয় হিন্দুধর্ম ।
“রামায়ণ কথা” লিখতে যে সকল গ্রন্থের সহায়তা নিতে হয়েছে-
বাল্মিকী রামায়ণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, তুলসীদাসী রামায়ণ, অমরচিত্রমালা, উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সাইট ও ব্লগ, পদ্মপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত, দেবীভাগবতপুরাণ, বৃহৎ ধর্ম পুরাণ, কালিকাপুরাণ, অদ্ভুত রামায়ন, অধ্যাত্ম রামায়ণ, রামায়ণ কথা, গুরুমুখী রামায়ণ, রামকথা , দশাবতারচরিত, ভারতের আদিযুগ ইত্যাদি।
( উত্তরকাণ্ড সমাপ্ত। রামায়ণ কথা সমাপ্ত )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৭)



বিভীষন আসলেন। সুগ্রীব, জাম্বুবান, নল, নীল, অঙ্গদ, গবাক্ষ, মৈন্দ , দ্বিবিদ আদি সব বানরেরা আসলেন। হনুমান শ্রীরামের লীলাত্যাগ শুনে খুবুই রোদন করতে লাগলেন । প্রভু শ্রীরামের চরণে পড়ে বললেন- “প্রভু! আপনার বিহনে আমি বা কিরূপে থাকবো? এ কেমন সিদ্ধান্ত? অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত ত্যাগ করুন। কিছুতেই আপনাকে দেহ রাখতে অনুমতি দিতে পারি না।” শ্রীরামচন্দ্র বললেন- “বতস্য হনুমান! আমি নিত্য। আমি জন্ম মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। হনুমান ! আমি আমার ভক্তদের ছেড়ে কোথায় থাকি ? যেখানে আমার ভক্তেরা আমাকে আহ্বান করেন, আমি সেইখানেই অবস্থান করি। আমার ভক্তের মধ্যেই আমি বিরাজ করি। তুমি নিজে বক্ষ বিদীর্ণ করে জগতকে এই শিক্ষাই ত দিয়েছো? তুমি এখন রোদন করছ? হনুমান। মানব কদাপি অমর হয় না। যে জন্মে সে একদিন দেহ রাখে। ইহাই সত্য। ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে শিশু ত ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যায়। প্রতি শ্বাস, প্রতি ক্ষণ তাহাকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকেই নিয়ে যায়। সুতরাং এই শরীর আমাকে ত্যাগ করতে হবে।” এই বলে শ্রীরামচন্দ্র , হনুমান সহ বিভীষণ, সুগ্রীব, জাম্বুবান, নল, নীল, অঙ্গদ সকলকে এই অমৃত বার্তা প্রদান করলেন । সুগ্রীব বললেন- “প্রভু! আমি অঙ্গদকে কিস্কিন্ধ্যার রাজা করে এসেছি। আপনার সহিত আমিও গমন করবো। ইহাতে নিষেধ করতে পারবেন না। ইহাই আমার দৃঢ় সঙ্কল্প ।” ভগবান শ্রীরামচন্দ্র সেই ইচ্ছা মেনে নিলেন । এরপর ভগবান শ্রীরাম বিভীষণকে বললেন- “বিভীষণ তুমি ইক্ষাকু কুলের দেবতা সূর্যনারায়ন জগন্নাথের আরাধনা করো। ইহাতে তোমার পরম মঙ্গল হবে।” সকলে রোদন করতে লাগলেন। শ্রীরাম সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “ জাম্বুবান, অঙ্গদ , দ্বিবিদ, মৈন্দ, বিভীষণ তোমরা যতদিন কলিকাল না আসে ততদিন ধরণী তে থাকো। জাম্বুবানের সাথেই তোমরা থাকো।”

এরপর এলো সেই লীলা সংবরণের দিন। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বললেন- “হনুমান। তুমি চার যুগে অমর। এই কথা বিস্মৃত হয়ো না। লব ও কুশ সহ অয্যোধ্যার রাজকুমারদের দেখো। আগামী যুগে তোমার পূজা প্রচলন হবে। তোমার অনেক মন্দির স্থাপনা হবে।” হনুমান রোদন করতে করতে বলল- “না প্রভু! সেবকের কেন পূজা হবে? আমি আমার পূজা চাই না। আপনার চরণ ভিন্ন আমার অন্য কিছু অভিলাষ নেই।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “হনুমান! মানুষের বিশ্বাস এর রূপ হচ্ছে মন্দির । মন্দিরের বিগ্রহ মানুষের বিশ্বাসেই নির্মাণ হয়। ঈশ্বর সর্বব্যাপী। তবুও মানুষ তাহাকে সেই রূপেই পূজা করেন, যেই রূপে শাস্ত্রে ব্যাখা হয়। তুমি ত্রানকর্তা, তুমি সংকটমোচন , তুমি মহাবীর। যারা তোমাকে পূজা করবে, আমি স্বহস্তে তাঁহাদিগের ভববন্ধন মোচন করে বৈকুণ্ঠে নিয়ে যাবো। তোমার ভক্তদের ওপর সর্বদা আমার কৃপা বর্ষণ হবে। তোমাকে ভগবান রূপে প্রকাশ হতেই হবে। তুমিই ধর্মের রক্ষা করবে। অধর্মের থেকে ধর্মকে ত্রান করবে। বিপদে পড়ে যে তোমার স্মরণ করবে তুমি তাহাকে রক্ষা করবে। তুমিই মুক্তি প্রদান করবে।” হনুমান অশ্রু মোচন করতে লাগলেন । রোদন করতে করতে বললেন- “প্রভু! আপনার দর্শন কবে পাবো? কবে আপনার সেবার সুযোগ পাবো?” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “হনুমান! দ্বাপরে আমি আবার অবতার গ্রহণ করে আসবো। তখন তোমার সাথে আমার আবার সাক্ষাৎ হবে। কথা দিলাম। তোমাকে আমি দ্বাপর যুগেও ‘রাম’ রূপে দর্শন দান দেবো। তোমাকে সেবার সুযোগ দেবো। হনুমান, বৈকুণ্ঠের দ্বার তোমার জন্য অবাধ। তোমার যখন ইচ্ছা বৈকুণ্ঠে এসে আমার দর্শন করতে পারবে।” হনুমান বললেন- “প্রভু! আমি জানি, আপনিই স্বয়ং নারায়ন। আপনার এই ‘রাম’ রূপ আমার হৃদয়ে অবস্থিত। কৃপা করে সদা সর্বদা আপনি এই ‘রাম’ রূপেই মাতা সীতা সহিত বিরাজ করবেন। এই প্রার্থনাই জানাই। যেখানে যেখানে আপনার লীলা, আপনার কীর্তন , রামায়ন পাঠ হবে – সেখানে আমি অবস্থান করবো। এই আপনাকে কথা দিলাম। ” শ্রীরাম সম্মতি প্রদান করলেন । নারায়ন, কৃষ্ণ, রাম সকলেই এক। যে তাঁহাকে যেই রূপে হৃদয়ে স্থান দেন, তিঁনি সেই রূপেই আসেন। রামভক্তের নিকট তিঁনি সর্বদা ধনুর্বাণ ধারী শ্রীরামচন্দ্র।

এই বলে শ্রীরামচন্দ্র রাজপুরী ছেড়ে বের হলেন। পেছনে ফেলে রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি । মনে পড়লো কত পুরানো ঘটনা। বাল্যকাল থেকে এক এক করে সব মনে পড়লো। সকলেই ত স্বর্গ চলে গেছেন। ধরিত্রীর এই নিয়ম। যে আসে, তার গমন নির্ধারিত হয়েই যায়। এক এক করে সবাই চলে গেলো। অযোধ্যার অনেক বৃদ্ধ, কাণা , খোঁড়া ছুটে এলো। অনেক পুরুষ নারী এলো। সকলে শ্রীরামের সাথে যেতে চাইলেন। কিন্তু শ্রীরাম প্রথমে রাজী না হলেও, পরে ভক্তের কাছে রাজী হলেন । ভরত, শত্রুঘ্ন চললেন। সুগ্রীব চললেন। সকলের চোখে জল । হনুমান কাঁদছেন। শ্রীরামচন্দ্র বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, অগ্যস্ত ও অনান্য মুনিদিগকে একে একে সকলের কাছে প্রণাম জানালেন। মুনি- ঋষি- ব্রাহ্মণ দের ভূমি, গো, ধন সম্পদ দান করে আশীর্বাদ নিলেন। এরপর হনুমানকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “হনুমান। তুমি আমার ভক্তদের সর্বদা রক্ষা করবে।সকলের কাছে আমার ভক্তি বিতরণ করবে। যখন যখন ধর্মের অবক্ষয় হবে, অধর্মের প্রাদুর্ভাব হবে তখন তখন আমি এই ধরণীতে আসবো।” তারপর সরয়ূর ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ধীরে ধীরে জলে নামলেন শ্রীরাম, ভরত, শত্রুঘ্ন । চলে গেলেন সোজা মাঝ নদীতে । আকাশে দেবতাবৃন্দ উপস্থিত হয়ে বিবিধ বাদ্য বাজনা বাজাতে লাগলেন। মাঝ নদীতে গেলে যোগ সমাধি দ্বারা ভরত ও শত্রুঘ্নের তেজ , শ্রীরামের বৈষ্ণবতেজে মিলিত হইল। দেবতারা পুস্পাদি বর্ষণ করতে লাগলেন । প্রজারা একে একে এসে সরয়ূর জলে প্রবেশ করলেন। দেহ ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠ গমন করলেন। অবশেষে যোগ সাধনা দ্বারা শ্রীরামচন্দ্র দেহ রাখলেন । হনুমান দেখলেন অপূর্ব দিব্য তেজ সরয়ূর গর্ভ থেকে উঠে চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি ধারণ করে মহাকাশে বীলিন হলেন । সুগ্রীবও দেহ রাখলেন । ভগবানের লীলা কদাপি সমাপ্ত হয় না। ভগবানের জন্ম মৃত্যু বলেও কিছু হয় না। তিঁনি আবির্ভূত হন। আমাদের সুশিক্ষা প্রদান করেন। তাই আমাদের মাঝেই আসেন। আবার লীলান্তে লীলা সংবরণ করেন। কিন্তু ভক্তের শ্রদ্ধা বিশ্বাসে তিঁনি নিত্য বিরাজিত। নিত্য লীলা করেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৬)



শ্রীরামচন্দ্র হা হুতাশ করে বলতে লাগলেন- “ভ্রাতা! কেন তুমি মন্ত্রণা চলাকালীন এই কক্ষে প্রবেশ করলে? আমি কিরূপে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবো। কেনই বা আমি এই প্রতিজ্ঞা করলাম। আমি কিভাবে আমার প্রাণাধিক প্রিয় ভ্রাতাকে এইহেন শাস্তি দেবো। ভ্রাতৃহন্তা হয়ে আমি নরকেও ঠাঁই পাবো না। হে বিধাতা! কেনই বা আপনি আমার থেকে এই সকল কঠোর পরীক্ষা গ্রহণ করেন ? আপন স্ত্রীকে গর্ভস্থ অবস্থায় ত্যাগ করতে হল। স্ত্রীকে বসুমতী গর্ভে প্রবেশ করাও আমাকে সহ্য করতে হল। এখন নিজের ভ্রাতাকে মৃত্যু দিতে হবে? এ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। এই জীবন আমি আর রাখবো না।” লক্ষ্মণ বলল- “অগ্রজ! আমি কি করবো? মহর্ষি দুর্বাসা পদার্পণ করেছেন। তিঁনি আদেশ করেছেন এই মুহূর্তে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে। তিলেক বিলম্ব হলেই উনি অভিশাপ দিয়ে এই রাজপুরী, এই অযোধ্যা ভস্ম করবেন বলে জানিয়েছেন। অগ্রজ! অযোধ্যা আমাদের মাতৃভূমি। মাতৃভূমির জন্য এই একজনের বলিদান উপযুক্ত। কিন্তু একজনের জীবন রক্ষার নিমিত্ত গোটা অযোধ্যাকে আমি কিভাবে ভস্ম হতে দিতে পারি? আমি ত তোমার ভ্রাতা। বড় ভ্রাতা গুরুতুল্য। আপনি ত নিজেই ত্যাগী। আপনাকে দেখেই এই ত্যাগ আমি মাথা পেতে স্বীকার করলাম । এবার সত্ত্বর গিয়ে মহর্ষি দুর্বাসার সহিত সাক্ষাৎ করুন। পাছে বিলম্ব হলে মহর্ষি আবার ক্রোধে কাণ্ডজ্ঞান বিস্মৃত না হন।” ভগবান শ্রীরাম যথাউপযুক্ত ভাবে মহর্ষি দুর্বাসাকে প্রণাম জানিয়ে বললেন- “মহর্ষি আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না। আপনার আগমন বার্তা পেয়েই আমি ছুটে এসেছি। এ আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনার চরণ যুগল দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছে । দয়া করে আপনি শাপ প্রদান করবেন না। কৃপা করে আপনার সেবা করার সুযোগ প্রদান করুন।” এই বলে মহারাজ শ্রীরাম সুগন্ধি বারি দ্বারা দুর্বাসা মুনির পদ ধৌত করে চরণ পূজা করে বসতে আসন দিলেন । মহর্ষি দুর্বাসা শান্ত হলেন ।

বিনয়ে বলেন রাম কোন্ প্রয়োজন ।
দুর্বাসা বলেন চাহি উচিৎ ভোজন ।।
এক বর্ষ করিয়াছি আমি অনাহার ।
দেহ অন্ন ব্যঞ্জন যে অমৃত সুসার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

দুর্বাসা মুনি বললেন- “হে শ্রীরাম! এক বৎসর অনাহারে তপস্যা করে আমি এখন বড়ই ক্ষুধার্ত । আমাকে অন্ন ভোজন প্রদান করো।” শ্রীরামচন্দ্র বুঝতে পারলেন এও বিধাতার খেলা। যাহাতে লক্ষ্মণ আগে গমন করতে পারে । কারণ দুর্বাসা মুনি উগ্রতপা মুনি। সহস্র বৎসর অনাহারে তপস্যা করার ক্ষমতা রাখেন তিঁনি । কিন্তু এখন আর কি করবেন । সুগন্ধি উত্তম অন্ন বিবিধ ব্যঞ্জনাদি দ্বারা মহর্ষি কে সেবা করালেন। উৎকৃষ্ট তাম্বুল বিবিধ মশলা সহকারে মহর্ষিকে প্রদান করলেন। মহর্ষি দুর্বাসা গোপোনে বললেন- “হে শ্রীরাম! আপনি সাক্ষাৎ নারায়ণ। প্রভু মর্ত্যলোকে আপনার লীলা সমাপন হয়েছে। এবার বৈকুণ্ঠে গমনের সময় এসেছে। আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন। প্রজাপতি ব্রহ্মার আদেশে আমি এমন করেছি। যাহাতে আপনি বৈকুণ্ঠ গমন করতে পারেন । ” মহর্ষি বিদায় নিলেন । লক্ষ্মণ গিয়ে বললেন- “অগ্রজ! কাল্য আমি প্রভাতে দেহ রাখবো।” শুনে শ্রীরামচন্দ্র ক্রন্দন করলেন। বললেন- “ভ্রাতা! এ কি রূপে হয় ? আমি কিভাবে মৃত্যু পথে যেতে তোমাকে আদেশ দেবো?” লক্ষ্মণ বলল- “অগ্রজ! আপনি শপথ করেছিলেন যে মন্ত্রণা গৃহে যে আসবে তাকে মৃত্যু দেবেন । রঘুকুলের নিয়ম এটাই যে প্রাণ দিয়ে হলেও শপথ রক্ষা করতে হবে। এই কারণেই ত আপনি বনে গমন করেছিলেন। এই কারণেই ত প্রজার দাবী মেনে বৌঠাণ কে ত্যাগ করেছিলেন। আজ কেন এত দুর্বল আপনি? আমি আপনার ভ্রাতা। আমি কিভাবে আপনার শপথ ভঙ্গ হতে দিতে পারি?” লক্ষ্মণ এরপর শ্রীরামের চরণে পড়ে বললেন- “ভ্রাতা! আমি আমার যথাসাধ্য আপনার সেবা করার চেষ্টা করেছি। জানি অনেক ভুল ভ্রান্তি হয়েছে। আপনি তাহা স্নেহবশে ক্ষমা করেছেন। আশীর্বাদ করুন- পরজন্মে যেনো আপনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হয়ে জন্মাতে পারি। কারণ এই রূপে আপনাকে বনে চতুর্দশ বৎসর কণ্টক, প্রস্তরের ওপর হাটতে দেখে বুক ফেটে গেলেও, আপনাকে আদেশ করার ধৃষ্টতা করতে পারিনি। যদি আমি আপনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হতাম তবে আপনাকে কদাপি বনবাসে যেতে দিতাম না, বৌঠানকেও ত্যাগ করতে দিতে দিতাম না। যুগে যুগে যেনো আমি আপনার ভ্রাতা হতে পারি।”

শ্রীরাম ক্রন্দন করতে করতে বললেন- “ভ্রাতা! মন না চাইলেও অনুমতি দিতে হবে। সাধুগণের কাছে ত্যাগ করা আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উভয় সমান। আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম ভ্রাতা। তোমার ন্যায় ভ্রাতা শত কোটি জন্মের পুণ্যের ফলেই প্রাপ্তি করা যায়। পরজন্মে তুমি আমার জ্যেষ্ঠ হয়ে আবির্ভূত হবে।” এই বলে শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষ্মণকে আলিঙ্গন করে অনেক অশ্রু বিসর্জন করলেন । পর দিন প্রাতঃকালে লক্ষ্মণ সবার অলক্ষ্যে উঠে পড়ছেন। পাছে মায়া বশত পুনঃ শ্রীরামচন্দ্র তাহাকে যেতে না দেন। পুত্র চন্দ্রকেতু আর অঙ্গদ কে দেখে অযোধ্যাকে প্রণাম করে চললেন সরয়ূ নদীর দিকে। সেখানে প্রণাম, পূজাদি করে যোগসাধনায় বসলেন। মনে পড়লো কত পুরাণো স্মৃতি ঘটনা। এই অযোধ্যাকে ঘীরে, সমগ্র বনবাস স্মৃতি, লঙ্কার যুদ্ধ আদি সকল ঘটনা। ব্রাহ্ম মুহূর্তে চতুর্দিকে পাখীর কলরবে পরিপূর্ণ। মুনি, ঋষি, ব্রাহ্মণেরা উঠে স্নানে আসছেন। চতুর্দিক হতে মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি ও পবিত্র মন্ত্র সকল ভেসে আসছে। আর একধারে সরয়ূর জল বয়ে যাওয়ার আওয়াজ। চোখ মুদ্রিত করে লক্ষ্মণ ধ্যানে বসলেন। আত্মা লক্ষ্মণের দেহ থেকে বের হয়ে গেলো। স্বর্গের অপ্সরা, দেবতা সকলে লক্ষ্মণের সেই পবিত্র দেহে পুস্প বর্ষণ করলেন । যোগসাধনা দ্বারা মৃত্যু বরন আর আত্মহত্যা কিন্তু এক জিনিষ না। যোগ দ্বারা দেহ রাখতে পারেন যোগী। কঠোর যোগসাধনায় সিদ্ধ যোগীরা এমন ভাবে দেখ রাখেন। হরিদ্বার, কাশী, প্রয়োগে এখনও এমন যোগসিদ্ধ যোগী দেখা যায়। আর আত্মহত্যা করে কাপুরুষেরা, যাদের বুদ্ধি বিবেক নষ্ট হয়, তাহারাই। যোগ সাধনা দ্বারা দেহ রাখলে আত্মা সেই পরমাত্মায় লীন হয়। আর আত্মহত্যা করলে ভূত, প্রেত হয়ে ঘুরে ঘুরে অশেষ দুঃখ যাতনা পেতে হয় । লক্ষ্মণের দেহ রাখার সংবাদে শ্রীরাম খুবুই দুঃখ পেলেন । হা হুতাশ করলেন। ভরত ও শত্রুঘ্ন কে ডেকে বললেন, তিঁনিও প্রান ত্যাগ করবেন। ভরত ও শত্রুঘ্ন অনুগমন করতে চাইলে শ্রীরাম বাধা দিলেন। কিন্তু তাঁহারা বলল যে- “অগ্রজ! আমরা সকলে আপনার অংশ। আপনিই বিষ্ণু। আপনার অংশ হতে আমরা আবির্ভূত। আপনি চলে গেলে অংশ রূপ কিভাবে থাকবে? আপনাকে চতুর্দশ বৎসর বনে নিবাসে আপত্তি জানালেও, আপনি রাখেন নি। বৌঠানকে ফিরিয়ে আনতে বললেও , আপনি শোনেন নি। জানি আপনার আদেশ না মান্য করার কারণে আমাদের অপরাধ হবে। কিন্তু এই মহাপাপ করতে রাজী, তবুও আপনাকে ভিন্ন একবিন্দু মর্ত্যে থাকতে ইচ্ছা করিনা ।” তখন শ্রীরামচন্দ্র রাজী হলেন। লঙ্কা, কিস্কিন্ধ্যায় দূত প্রেরণ করে জানানো হল যে শ্রীরাম দেখ রাখবেন সরয়ূর জলে ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৫)



এরপর শ্রীরামচন্দ্র রাজ্য ভাগ করলেন । লবকে অয্যোধ্যার রাজা বানালেন। কুশকে নন্দিগ্রামের রাজা করলেন । ভরতের পুত্র তক্ষকে তক্ষশীলা আর ভরতের অপর পুত্র পুষ্কর কে পুষ্করাবতীর রাজা বানালেন । লক্ষ্মণের পুত্র চন্দ্রকেতুকে অশ্বদেশ আর লক্ষ্মণের আর এক পুত্র অঙ্গদকে মল্লদেশের রাজা করলেন । শত্রুঘ্নের দুই পুত্র শত্রুঘাতী ও সুবাহুকে মথুরা রাজ্য দুভাগ করে দুভাগের রাজা বানালেন । এভাবে সকলকে রাজা বানালেন ভগবান শ্রীরাম । ধীরে ধীরে সময় বয়ে গেলো। ত্রেতা যুগ সমাপনের পথে । দ্বাপর যুগ প্রতীক্ষারত । একদিন ব্রহ্মলোকে দেবতারা সকলে একত্র হয়েছেন। দেবতারা বললেন- “প্রজাপতি! প্রভু শ্রীবিষ্ণু কবে রাম রূপ ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠে আসবেন? ত্রেতা যুগ ত সমাপনের পথে।” ব্রহ্মা বললেন- হে দেবতাগণ তোমরা ঠিক বলেছ। আমার বিধানে রাম অবতারের সময় সীমা সমাপ্ত । কিন্তু যদি প্রভু শ্রীরাম আরোও মর্ত্যলীলা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তবে থাকবেন। তবুও বিধান রক্ষার জন্য আমি সেখানে কালদেবকে প্রেরণ করবো।” এই বলে ব্রহ্মা, কালদেবকে আহ্বান করলেন। ব্রহ্মা বললেন- “হে কালদেব! রাম অবতারের সময় সমাপ্ত। তুমি এখন সেই লীলা তরান্বিত করো।” এই বলে প্রজাপতি ব্রহ্মা বুদ্ধি দিলেন কালদেবকে। অপরদিকে প্রজাপতি ব্রহ্মা দুর্বাসা কে দেখা দিয়ে বললেন- “মহর্ষি দুর্বাসা। তোমার ক্রোধের কথা জগত বিদিত। মর্তলোকে শ্রীরাম অবতারের সময়সীমা সমাপন হয়েছে। শ্রীহরি যাহাতে বৈকুণ্ঠে ফিরে আসতে পারেন, তাহার জন্য তোমাকে অগ্রনী ভূমিকা নিতে হবে ।” এই বলে প্রজাপতি ব্রহ্মা, মহর্ষি দুর্বাসাকে বুদ্ধি দিলেন। ব্রহ্মার ইচ্ছায় কালদেব একজন সাধু রূপ ধরে অযোধ্যায় আসলেন। সাধু এসেছেন শুনে লক্ষ্মণ গিয়ে ভগবান শ্রীরামকে সংবাদ দিলেন । ভগবান শ্রীরাম সাদরে আপ্যায়ন করে মুনির স্বাগত জানালেন। মুনির চরণ পূজা করে বসতে আসন দিলেন। বলিলেন- “হে মহর্ষি! আমি আপনার কিরূপে সেবা করতে পারি?” এই বলে ভগবান শ্রীরাম মুনিকে স্বাগত জানিয়ে গৃহে নিয়ে গেলেন। কালদেব বললেন- “হে শ্রীরাম! আমার আপনার সহিত অতি গোপনীয় কথা আছে। সেই কথা সবার সামনে প্রকাশ নিষেধ। সে কথা অন্যজনের শোনা নিষেধ। একটি শর্তেই আমি সেই কথা বলিব।” অবাক হলেন শ্রীরাম ।

সে কালপুরুষ কহে শুনহ বচন ।
যে কথা কহিব পাছে শুনে অন্য জন ।।
এ সময়ে যে করিবে হেথা আগমন ।
ব্রহ্মার বচনে তারে করিবে বর্জন ।।
( কৃত্তিবাস রামায়ণ )

কালদেব বললেন- “হে শ্রীরাম! আপনার সাথে বার্তা চলাকালীন যদি কেহ আমাদের বার্তাকক্ষে প্রবেশ করে কিংবা বার্তা শ্রবণ করে, তবে আপনি তাহাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। ইহাই শর্ত।” ইহা শুনে আশ্চর্য হলেন। এমন কি কথা থাকতে পারে। পাছে মুনিবাক্য না মানলে মুনি শাপ দেন। তাই ভগবান শ্রীরাম বললেন- “অবশ্যই মহর্ষি। আমি দাশরথি রাম এই প্রতিজ্ঞা করছি যে আমাদের কথা চলাকালীন যদি কেহ কক্ষে আসে, বা সেই কথা শ্রবণ করে- তবে তাহাকে বধ করবো।” কালদেব তখন লক্ষ্মণকে বললেন- “হে লক্ষ্মণ। তুমি সর্বদা তোমার বড় ভ্রাতার আজ্ঞা মেনে চলেছো। এমনকি বনে গিয়ে সেবা করেছো। যুদ্ধে রাক্ষস বধ করেছো। এমনকি তাঁর আজ্ঞাতেই সীতাদেবীকে বনে রেখে এসেছো। তুমি কক্ষের দ্বার প্রহরা দেবে। ভুলেও সেই কক্ষে যেনো কেউ প্রবেশ না করে। কেউ যেনো আমাদের কথা শ্রবণ না করে।” লক্ষ্মণ দ্বার প্রহরায় থাকলো। সেই সময় কক্ষে কেবল শ্রীরাম ও কালদেব। কালদেব নিমিষে ছদ্দবেশ ত্যাগ করে আসল রূপে এসে বললেন- “ভগবান! আপনি কি আপনার স্বরূপ ভুলে গেছেন ? আপনিই ত ক্ষীরোদ সাগড়ে নাগশয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণু। আপনি মধু কৈটভ বধ করে মেদিনী সৃষ্টি করেছেন। আপনার নাভি থেকেই পদ্মযোনি ব্রহ্মা আবির্ভূত হয়েছেন। হে নারায়ণ । সেই চতুর্মুখ ব্রহ্মা আমাকে এখানে প্রেরণ করেছেন । আপনার রাম অবতারের সময় সীমা সমাপ্ত হয়েছে। আপনি রাম অবতার ধারণ করার পূর্বে যেটুকু সময় নির্ধারিত করেছিলেন, তাহা সমাপ্ত। যদি আপনি আরোও মর্তে থাকতে চান তাহলে আপনি থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে তবে প্রজাপতির বিধান পরিবর্তন হবে। দেবতাদের প্রার্থনা আপনি এখন বৈকুণ্ঠে আগমন করুন।” ভগবান শ্রীরাম ভাবতে লাগলেন। সত্যি ত। রাম অবতারের সময় সীমা সমাপন হয়েছে। এই অবতারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তিঁনি কালদেবের সাথে এই নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন ।

এই সময় মহর্ষি দুর্বাসা আসলেন। ব্রহ্মার বুদ্ধিমতো কর্ম করছেন। মহর্ষি দুর্বাসাকে শ্রদ্ধা সহকারে ভেতরে আনা হল। লক্ষ্মণ কে ডেকে বললেন- “লক্ষ্মণ! এই মুহূর্তেই আমি শ্রীরামের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। তাহাকে জানাও যে আমি এসেছি।” কিন্তু শ্রীরামকে কিভাবে ডাকা সম্ভব! সেই ঘরে প্রবেশে মানা আছে। লক্ষ্মণ বিনম্র ভাবে বলল- “মহর্ষি! আপনি কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করে আমাদের সেবার সুযোগ প্রদান করুন। মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র খানিক ক্ষণ পরেই আসবেন।” শুনে দুর্বাসা মুনি ক্ষেপে গেলেন। বললেন- “তোমার সাহস ত মন্দ নয়। মহর্ষি দুর্বাসাকে প্রতীক্ষা করতে বল কোন সাহসে? অযোধ্যায় কি এইভাবে মুনি ঋষিদের বসিয়ে রেখে স্বাগত জানানো হয়?” লক্ষ্মণ অনেক বুঝালো। দুর্বাসা মুনি নারাজ। সেই মুহূর্তেই সাক্ষাৎ চাই। দুর্বাসা মুনি ক্ষেপে গেলেন। রেগে বলতে লাগলেন- “দেখো আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গো না। তুমি কি জানো না আমার শাপে দেবতারা শ্রীভ্রষ্ট হয়েছিলেন। আমার ক্রোধে প্রলয় হতে পারে। এইভাবে আমার অপমান করলে আমি মেনে নেবো না। অবিলম্বে শ্রীরামকে ডেকে আনো। নচেৎ আমি শাপ দিয়ে এই অযোধ্যা, অয্যোধ্যার সকল অধিবাসী, তোমাদের চার ভ্রাতা, তোমাদের এই রাজপুরী ভস্ম করবো।” লক্ষ্মণ দেখলেন দুর্বাসা মুনির চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝড়ছে। রাঙা ক্রোধী চোখ। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র সেই কক্ষ প্রবেশে মানা করেছেন। যে যাবে , তাকেই মৃত্যু দন্ড দেবেন। সেই ঋষি এমনই শর্ত দিয়েছেন। আজকেই বা দুই দুই জন ঋষি আসলেন কেন ? দুর্বাসা মুনি বললেন- “তুমি কি এখুনি রামচন্দ্রকে ডেকে আনবে, নাকি আমি শাপ দিয়ে ভস্ম করবো?” লক্ষ্মণ দেখলেন এই মুহূর্তে দুর্বাসা মুনির দাবী না মানলে গোটা অযোধ্যা ভস্ম হবে। অপরদিকে শ্রীরামচন্দ্রের কক্ষে যে যাবে সে মৃত্যুর শাস্তি পাবে। লক্ষ্মণ ভাবল তার মৃত্যুতে ত অযোধ্যা বাঁচবে। দশের বদলে একের মরণই শ্রেয়। এই ভেবে লক্ষ্মণ সেই মন্ত্রণা কক্ষে ঢুকে পড়লেন। লক্ষ্মণকে দেখেই কালদেব অদৃশ্য হল। কক্ষে ঋষির বদলে দেবতাকে দেখে লক্ষ্মণ অবাক হলেন। শ্রীরামচন্দ্র বললেন- “হাঁ লক্ষ্মণ! তুমি এ কি করলে?”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৪)

রামায়ণে আমরা দেখতে পাই, শ্রীরামচন্দ্র যুদ্ধে আপন বিক্রম দেখানোর অধিকার সবাইকে দিয়েছেন। লক্ষ্মণ নিজে লঙ্কার যুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন। শত্রুঘ্ন লবণ অসুর বধ করেছিলেন। এবার ভরতের গন্ধর্ব দিগদের বধের পালা। শুভ দিনে তিন অক্ষৌহিণী সেনা তৈরী হল। গজ, অশ্বারোহী, পদাতিক সেনা সকল তৈরী হলে। কোটি রথে অসংখ্য বীর যোদ্ধা সকল নানান ঘাতক অস্ত্র নিয়ে উঠলো। মাণ্ডবী কুলদেবতা সূর্যনারায়ণের পূজা করে ভরতের হস্তে তরবারি দিলেন। কপালে তিলক দিয়ে বিজয় কামনা করলেন । পুস্প দ্বারা পূজিত করলেন। ধূপ দ্বারা আরতি করলেন । এরপর ভরত গেলেন শ্রীরামের কাছে। শ্রীরাম আশীর্বাদ করলেন। ভরতের দুই পুত্র তক্ষ ও পুষ্কর মহারাজকে প্রণাম করলে মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “তোমাদের পিতা বীর। তোমরা বীরের বংশে জন্ম হয়েছো। কুলের মান গড়িমা বজায় রেখো। যুদ্ধে তোমাদের পিতাকে সহায়তা করো।” এরপর মহারাজ শ্রীরাম ভরতকে ‘সংবর্ত’ নাম এক অস্ত্র দিলেন। বললেন- “ভ্রাতা! গন্ধর্বেরা মায়াবিদ্যাতে পটু। বহু মায়া রচনা করবে। এই অস্ত্র প্রচুর বিধ্বংসী ক্ষমতা রাখে। সময় বুঝে এই অস্ত্রে গন্ধর্ব দিগকে নাশ করবে।”ভরত রথে উঠলেন। ঢাক- ঢোল- কাঁসর- ন্যাকড়া- দুন্দুভি- দামামা- শিঙা বেজে উঠলো। অসংখ্য শঙ্খে ধ্বনি উঠলো। ভরত গিয়ে রথে উঠলেন । দুপাশে দুই পুত্র রথে উঠলো। হস্তী গুলি ভূমি কাঁপিয়ে শুণ্ড তুলে গর্জন করে বের হল। অশ্ব গুলি বের হল। রথের চাকায় ধূলাঝড় উঠলো। এভাবে সমগ্র সেনা সকল বের হল। হৈহৈ করতে করতে সব সেনারা চলল। ভরত তার পুত্র সহ বের হলেন। সোজা সিন্ধু নদের দিকে চলল। আশেপাশে অনেক রাজা তাহাদের স্বাগত জানালেন। কারণ অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় সকল রাজাই আনুগত্য স্বীকার করেছেন। কত গ্রাম, কত নদী, কত জনপদ, কত নগর, কত পর্বত পার হল। মাঝে মাঝে রাত নামলে সেইস্থানে শিবিড় রচনা করে দিন কাটালেন। এইভাবে সেই রাজ্যের উদ্দেশ্যে চললেন।

গন্ধর্বেরা খবর পেলো। গন্ধর্ব দেবতাদের অনুগত এক ধরনের জীব। যেমন- যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর, বেতাল, কুস্মাণ্ড ইত্যাদি। গন্ধর্বেরা দেবতাদের খুব মান্য করেন। স্বর্গে সোমরস জোগান এরাই। আবার স্বর্গের নৃত্যে বিবিধ বাজনা বাজিয়ে তাল প্রদান করেন । গন্ধর্বেরা মায়াবী। বিভিন্ন ধরনের মায়া জানে তাহারা। এরা কিছু বদ হয় আবার কিছু উত্তম । এদের শরীর থেকে দিব্য সুগন্ধ বিচ্ছুরিত হয় । ভরতের সেনার পেছন পেছন রক্ত মাংসের আশায় ব্যাঘ্র, সিংহ, শৃগাল ও বিভিন্ন মাংসভোজী পক্ষী কুল চলছিলো। গৃধের দল আকাশে বিচরণ করতে করতে এই সেনা দলের পেছনে চলছিলো। শুধু কি তাই ! রক্তমাংস প্রিয় বেতাল, পিশাচেরা এই সেনা দলের পেছন পেছন চলছিলো। অবশেষে ভরত সেনা নিয়ে গন্ধর্ব প্রদেশে আবির্ভূত হল । সেই সিন্ধু নদের পাশে মনোরম পরিবেশ। সেই মনোরম পরিবেশ অতীব সুন্দর। সিন্ধ নদে বয়ে চলা জলের ধারার শব্দ শোনা যায়। মিষ্টি শীতল জল প্রবাহিত। দুপাশে অপূর্ব সুন্দর বন। বিভিন্ন গাছে বিভিন্ন সুগন্ধি পুস্প ভরে আছে। যাহার সুবাস বাতাস বহুদূর অবধি বহন করে নিয়ে যায়। আর মিষ্ট কতশত ফলে বৃক্ষ গুলি সজ্জিত হয়ে আছে। এই সুন্দর কানন প্রহরা দেয় তিন কোটি অত্যাচারী গন্ধর্ব। গন্ধর্বেরা খবর পেলো। শোনা মাত্রই হৈহৈ করে ছুটে এলো । এত সংখ্যক অয্যোধ্যার সেনাকে দেখে হাস্য করতে লাগলো। কারণ সংখ্যায় অল্প হলেও গন্ধর্বেরা ভাবল মায়াবিদ্যার সহায়তায় অল্প সময়ে এই সমস্ত কিছু নাশ করে দেবে । ভরতের নির্দেশ পেতেই সেনারা যুদ্ধে এগিয়ে গেলো। বর্শা, শর ইত্যাদি গন্ধর্ব দের দিগকে ছুড়তে লাগলো। গন্ধর্বেরা মায়া বিদ্যার সহায়তায় সেই সকল অস্ত্র চূর্ণ করতে আরম্ভ করলো। গন্ধর্বেরা খড়্গ, দিব্যদণ্ড, তরবারি নিয়ে যুদ্ধে অগ্রসর হল। যুদ্ধের সময় তারা বিভিন্ন মায়ার আশ্রয় নিতে লাগলো। অদৃশ্য হয়ে অয্যোধ্যার সেনাদের ওপর আঘাত হানতে লাগলো। মায়া দ্বারা বৃহৎ প্রস্তর রূপ ধারণ করে অয্যোধ্যার সেনাদের ওপর পড়তে লাগলো।

মায়া আক্রমণে অয্যোধ্যার সেনারা কোণঠাসা হচ্ছিল্ল। রক্তনদীর ধারা গিয়ে সিন্ধু নদে মিশল। চারিদিকে কেবল অসংখ্য মৃত শব দেখা গেলো। কিছু গন্ধর্ব আবার মায়া দ্বারা নানা অস্ত্র ভরতের দিকে নিক্ষেপ করতে লাগলো। তক্ষ ও পুষ্কর তখন বিবিধ দিব্যাস্ত্রের সন্ধান করে গন্ধর্ব দের অস্ত্র গুলি চূর্ণ করতে লাগলো। দুই বালকের বীক্রম দেখে গর্বে ভরতের বুক ফুলে উঠলো। এই ত হলেন বীর সূর্যবংশী। লবকুশের ভ্রাতা এমনই শক্তিমান হওয়ার প্রয়োজন । চোখের পলকে নানা অস্ত্র নিক্ষেপ করে গন্ধর্ব দের অস্ত্র নষ্ট করতে লাগলো। ভরত নিজেও যুদ্ধে অগ্রসর করলেন। কিন্তু নানা দিব্যাস্ত্রে গন্ধর্বেরা ধ্বংস হল না। উলটে নানা মায়া বিদ্যা প্রয়োগ করে ভরতকে অতীষ্ঠ করে তুলল। তখন ভরত ধনুকে সেই গন্ধর্বনাশক ‘সংবর্ত’ অস্ত্রের আহ্বান করলেন। প্রবল বিক্রমশালী সংবর্ত অস্ত্র ভরতের ধনুকে আপন মহিমায় আবির্ভূত হলেন । ভরত মন্ত্র পড়ে সেই বাণ ছুঁড়লেন। অতি উজ্জ্বল আলো উৎপন্ন হয়ে সেই অস্ত্র গন্ধর্ব দের দিকে ধেয়ে গেলো। সেই দেখে গন্ধর্বদের ভয়ে যেনো মুখ- হাত- পা শুকিয়ে গেলো। অনেক মায়াবিদ্যা, অনেক অস্ত্র ছুড়লেও ভরতের নিক্ষেপিত অস্ত্র বিফল হল না । নিমিষে সেই অস্ত্র তিন কোটি শক্তিশালী গন্ধর্বকে ছিন্নবিছিন্ন করে দিলো। গন্ধর্বদের রক্ত মাংসে মেদিনী ঢাকা পড়লো। মাংসাশী প্রানীরা তাহা ভক্ষণ করতে লাগলো। যুদ্ধে ভরত জয়লাভ করলেন । এরপর মহারাজ শ্রীরামের আদেশে সেই বিজিত রাজ্য দুভাগ করে দুই পুত্রকে দিলেন । ‘তক্ষশীলা’ নামক রাজ্যের রাজা হলেন ভরতের এক পুত্র তক্ষ। অপর পুত্র পুষ্কর ‘পুষ্করাবতী’ রাজ্যের রাজা হলেন । ভরত সেই বিজিত রাজ্য ‘তক্ষশীলা’ , ‘পুষ্করাবতী’ নামক রাজ্যে ভাগ করেছিলেন । শ্রীরামচন্দ্র ইহা শুনে অতীব প্রসন্ন হলেন। এইভাবে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র এগাড়ো হাজার বর্ষ রাজত্ব করেছিলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৩)



এই শুনে শ্রীরাম শান্ত হয়ে বিষন্ন হয়ে বসলেন। মনে হল সীতাদেবী তাহার কর্ণে এসে বলছেন- “প্রভু! এ আপনি কি করছেন ? আমার জন্য আপনি এই ধরিত্রী নাশ করতে চলেছিলেন ? আমি আপনাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছি ? আপনার চরণেই ত আমি আছি। আপনার অন্তরেই ত আমি আছি। আপনি আর আমি কি আলাদা? এখন কঠোর হয়ে মনকে শান্ত করে সকলকে সান্ত্বনা দিন। আপনার পুত্রদের দেখুন।” ভূমিতে পড়ে রোদন করতে করতে শ্রীরামচন্দ্রের কিরীট, কন্ঠের স্বর্ণ মালা , অঙ্গের উত্তরীয় সকল কিছুই ধূলাময় হয়েছিলো। শ্রীরামচন্দ্রের মনে হতে লাগলো এই রাজধর্ম কত কঠিন। সকল লোকে রাজা হতে চায় কেবল ভোগ সুখে জীবন যাপনের জন্য। কিন্তু রাজধর্ম যে কত কঠিন, কত জলন্ত অঙ্গার বিছানো- তাহা কেবল একজন আদর্শ রাজাই বুঝতে পারে। সেই সিংহাসনের তলায় শেষে সীতার বলিদান হয়ে গেলো। শ্রীরামচন্দ্র উঠে মাতৃহারা লব ও কুশকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন । ক্রোড়ে তুলে পুত্রদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। মাণ্ডবী, ঊর্মিলা, শ্রুতকীর্তি আদি সকলে লব ও কুশকে ক্রোড়ে নিয়ে আদর করতে লাগলেন। মহর্ষি বাল্মিকী বললেন- “হে শ্রীরাম! আমি আমার সাধ্যানুযায়ী সকল প্রকার শাস্ত্র, অস্ত্র- শস্ত্র, বেদাদি জ্ঞান, সঙ্গীত শিক্ষা লব ও কুশকে প্রদান করেছি। এখন আপনি ইহাদিগকে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে প্রেরণ করে বাকী সকল শিক্ষা প্রদান করিবেন। রামায়ণে দেবী সীতার অন্তিম যাত্রা এভাবেই উপস্থাপিত হতো- ইহা আমি জানিতাম। কিন্তু বিধিলিপি পরিবর্তনের শক্তি কাহারোও নেই।” এই বলে মহর্ষি বাল্মিকী বিদায় নিলেন। শ্রীরামচন্দ্র লব ও কুশকে রাজবেশ, রেশমি বস্ত্র, স্বর্ণ আভূষণ দ্বারা সাজিয়ে দিলেন । দুই রাজপুত্রকে দেখে সকলে আনন্দিত হল। অপরদিকে বৈকুণ্ঠে মাতা লক্ষ্মী দেবী পদার্পণ করলেন । তিঁনি ঐশ্বর্যের দেবী। দারিদ্র, অভাব দূর করেন তিঁনি । অপূর্ব শোভাময়ী তিঁনি। চঞ্চলা হয়ে থাকেন কিন্তু ভক্তের গৃহে স্থির হয়ে থেকে ধন সম্পদ বৃদ্ধি করেন ।

পদ্মালয়া, পদ্মহস্তা, পদ্মসুন্দরী দেবী সহস্র পদ্মে চরণ রেখে বৈকুণ্ঠে প্রবেশ করলেন। নানা আভূষণ ও দিব্য অলঙ্কারে তিঁনি ভূষিতা। কোটি তারকামালা যেনো অলঙ্কার হয়ে তাঁহার সর্বাঙ্গে শোভা পাচ্ছে। সহস্র কোটি শচী দেবীর সৌন্দর্য সেই লক্ষ্মী দেবীর রূপের কাছে পরাজিত হয় । অনুপমা দেবী পদ্ম ধারণ করে আছেন । বৈকুণ্ঠের অনুচরেরা নানা বিবিধ বাদ্য বাজিয়ে দেবী লক্ষ্মীকে স্বাগত জানালো। বৈকুণ্ঠপুরীর নিদারুন সৌন্দর্য লক্ষ্মী দেবীর আগমন ঠিক তেমন মনে হল, যেমন নক্ষত্রমালায় বিধু অবস্থান করে সেই সৌন্দর্য আরোও সুন্দর করে তোলেন। দেবীর সখীরা নানা সুগন্ধি দ্বারা দেবী লক্ষ্মীর অভিষেক করালেন। হিমালয়চূড়া সদৃশ চারিটি শ্বেত গজ স্বর্ণ কলসে দেবীর অভিষেক করলেন। সখীরা চামড়, পাখা, পুস্প প্রদান করতে লাগলেন। সেখানে দেবী লক্ষ্মী পদ্মাসনে বিরাজিতা হলেন। দেব দেবীরা স্তবাদি করতে লাগলেন । দেবী সরস্বতী, দেবী গৌরী সহ ভগবান শিব, প্রজাপতি ব্রহ্মা, শচী সহ মহেন্দ্র ও অনান্য দেবতারা সহধর্মিণী সহিত বিরাজিত ছিলেন । দেবী সরস্বতী বললেন- “দেবী হরিপ্রিয়া! আপনার এই সীতা রূপ ধন্য। বীরত্ব, ত্যাগ, মমতা, মাতৃত্বের একত্র সমন্বয় এই রূপে। জগত ধন্য হয়েছে আপনার আগমনে। আপনার সীতা অবতার জগতে সকল নারীদের কাছে আদর্শ উদাহরণ প্রস্তুত করেছে। ” দেবী গৌরী বললেন- “দেবী কমলা! আপনিই নারীর শ্রেষ্ঠত্ব জগতে স্থাপিত করেছেন আপনার নিজ জীবন দিয়ে। জগতের সকল নারী আপনাকেই অনুসরণ করে সতী রূপে দেবতাদের নমস্য হবেন। কারণ সতী নারীকে দেবতারাও শ্রদ্ধা করেন। আপনি প্রমান করেছেন নারীর আত্মত্যাগে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব। আপনিই শ্রীরামের সহায়িকা শক্তি হয়ে জগতে সকল পুরুষদের জীবনে স্ত্রীর ভূমিকা স্থাপন করেছেন। নারীজাতি সর্বদা আপনার এই সীতা রূপের কথা স্মরণে রাখবে। এই জগত যতদিন থাকবে ততদিন আপনার মাহাত্ম্য ঘোষিত হবে।” বৈকুণ্ঠের দ্বারপাল জয় বিজয় এসে বললেন- “মাতঃ! সনকাদি মুনির শাপে আমরা রাক্ষস হয়ে আপনার প্রতি কুনজর প্রদান করেছিলাম। আপনার অশেষ কৃপা আপনি আমাদের উদ্ধারের জন্য ভগবানের শক্তিরূপে অবতীর্ণা হয়েছিলেন।”

মাতা লক্ষ্মী দেবী বললেন- “নারী সৃষ্টির আধার। নারীই হলেন পুরুষের শক্তি। নারীই হলেন কল্যাণময়ী। জগতে এই সত্য যুগে যুগে নারীদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হবে । নারী ত্যাগেই পুরুষের বিজয়, শ্রেষ্ঠত্ব- ইহাই চরম সত্য। এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই আমার মর্তে গমন। যুগে যুগে এভাবে নারীধর্ম প্রতিষ্ঠা, নারীর ভূমিকা প্রতিষ্ঠার জন্য আমি প্রভুর সহায়িকা শক্তি রূপে আগমন করবো।” এইভাবে বৈকুণ্ঠে মাতা লক্ষ্মীকে স্বাগত জানালো হল। ব্রহ্মা বললেন- “ত্রেতা যুগের বিদায়বেলা প্রায় উপস্থিত। এখন প্রভু শ্রীরামের মর্তলীলা সমাপনের পথে। খুব সত্বর তিঁনিও বৈকুণ্ঠে বিষ্ণু রূপে ফিরে আসবেন ।” শ্রীরামচন্দ্র খুব মন দিয়ে রাজ্য শাসন করলেন। রাম রাজত্বে ন্যায় বিচার হতো। কালের গর্ভে এক এক করে কৌশল্যা, কৈকয়ী, সুমিত্রা দেবী স্বর্গারোহণ করলেন । বৃদ্ধ মন্ত্রী সকলে পরলোক গমন করলেন । অয্যোধ্যার আট রাজকুমার এখন প্রায় কিশোর থেকে যুবক হওয়ার পথে । একদিনের কথা। কেকয় রাজা যুধাজিত মহর্ষি গার্গ্যমুনির সাথে দশ হাজার অশ্ব, কম্বল, চিত্র বস্ত্র , রত্ন ও নানাপ্রকার উপঢৌকণ নিয়ে অযোধ্যায় আসলেন। মহারাজ শ্রীরাম গার্গ্যমুনির চরণ পূজা করে বসতে আসন দিলেন । রাজা যুধাজিতকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করলেন । রাজা যুধাজিত বললেন- “হে শ্রীরাম। সিন্ধু নদের দুপাশে যে রমণীয় উদ্যান সহিত দেশ আছে। তাহা গন্ধর্বেরা দখল করে রেখেছে। সেখানে গন্ধর্ব রাজ লোমশের অনুগত তিন কোটি শক্তিশালী গন্ধর্ব সেই দেশ প্রহরা দেয়। আপনি সেই দুই রাজ্যকে আপনার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করুন। গন্ধর্বেরা সেই সুন্দর অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালাচ্ছে।” মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “সেই গন্ধর্ব দের অত্যাচার থেকে অবশ্যই আমি মুক্ত করবো সেই নিরীহ প্রজাদের।”এরপর ভগবান শ্রীরাম ভরতকে বললেন- “ভ্রাতা ভরত। এবার তোমার যুদ্ধবিক্রম দেখানোর পালা। অবিলম্বে তুমি যুদ্ধযাত্রা করে লোমশের অনুগত তিন কোটি গন্ধর্ব কে বধ করবে। তোমার সাথে যুদ্ধে তোমার দুই পুত্র তক্ষ ও পুষ্কর যাবে। তুমি সেই রাজ্য জয় করে সেই রাজ্যকে দুভাগ করে তোমার দুই পুত্রকে দেবে। তাহারাই সেই দেশের রাজা হবে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪২)



মাতা সীতার মুখ হতে এই রকম বাক্য শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। শাস্ত্রজ্ঞ মুনি ঋষিদের মুখেও কোন উত্তর ছিলো না । মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র মাথা নীচু করে রইলেন । কারোর মুখে উত্তর নেই। সীতা দেবী চোখের জল মুছে বললেন- “আমি অনেক কটু কথা বলবার জন্য ক্ষমা চাইছি। আমি অযোধ্যা নরেশ মর্যাদা পুরুষোত্তমের স্ত্রী। কিন্তু তাহার পূর্বে আমি একজন নারী। একজন নারী রূপে এই সত্য জানানো উচিৎ ছিলো। নচেৎ আমার নারীধর্ম আমাকে ধিক্কার জানাতো। বারবার নারীর সতীত্বের পরীক্ষা গ্রহণ করা নারীধর্মের চূড়ান্ত অপমান। কিন্তু একজন যোগ্য স্ত্রী রূপে আমি এই পরীক্ষা দেবো। কারণ স্ত্রীর সতীত্বে স্বামীর যশ , খ্যাতি বৃদ্ধি পায়, আজ অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে আমি তাহা প্রমান করবো।” এই বলে দেবী সীতা করজোড়ে সকলের সামনে বললেন- “যদি আমি সতী নারী হয়ে থাকি, তবে এখুনি দেবী বসুন্ধরা তাহার গর্ভে আমাকে স্থান দিন। আমি শ্রীরাম ভিন্ন অপর কাহাকেও কখন মনে স্থান দেই নাই, এই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তাঁহার গর্ভে স্থান দান করুন। আমি কায়মনোবাক্যে সতত কেবল শ্রীরামের অর্চনা করিয়াছি , সেই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তাঁহার গর্ভে স্থান দান করুন । আমি শপথ করে বলছি , শ্রীরামচন্দ্র ভিন্ন আমি অন্য কাহাকেও জানি না, এই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা তাঁহার গর্ভে আমাকে স্থান দান দিন।” এইভাবে বারংবার সীতাদেবী শ্রীরামচন্দ্রের নামে শপথ দিতে লাগলেন। সহসা ভূমিকম্প আরম্ভ হল। দেখতে দেখতে চতুর্দিক দুলে উঠলো। সশব্দে সেই স্থানে ভূমি দুই ভাগ হয়ে গেলো। তাহার মধ্য থেকে একটি দিব্য সিংহাসন উপস্থিত হল। মণি , রত্ন দ্বারা খচিত ছিলো সেই দিব্য সিংহাসন । উৎকৃষ্ট রত্ন আভূষণে সজ্জিত নাগেরা দিব্য দেহে ঐ সিংহাসন ধারণ করিয়া উঠলেন। তাহার মধ্যে অধিষ্ঠিতা ছিলেন ধরিত্রী দেবী মাতা বসুধা । সীতাদেবীকে ক্রোড়ে তুলে নিলেন দেবী ধরিত্রী । সাদরে স্বাগত জানিয়ে সীতাদেবীকে অভিনন্দন জানালেন । করজোড়ে সীতা দেবী বসুন্ধরা মাতার ক্রোড়ে বসলেন ।

সীতাদেবী কে বসুধার ক্রোড়ে যেতে দেখে সকলে হায় হায় করে উঠলো। লব ও কুশ মাতার পেছন পেছন ধাইলো। কিন্তু সীতাদেবী বাধা দিলেন । উপস্থিত মুনি ঋষিরা অবধি মাতা সীতার সতীত্বের প্রশংসা করে ‘সাধু’, ‘সাধু’ করলেন । মহর্ষি বাল্মিকী পূর্বেই জানতেন এমন হবে । শ্রীরাম ছুটে এলেন । সন্দেহবাদী সেই সকল প্রজারা তখন ভূমিতে প্রণাম করে বললেন- “মা। আমরা ঘোরতর পাপী। আপনার ন্যায় সতী নারীর নামে কলঙ্ক দিয়েছি। আমাদের বিনাশ কেহ রোধ করতে পারবে না।” সীতামাতা বললেন- “না পুত্র! এমন হবে না। নারী ক্ষমা ও ধৈর্যের জীবন্ত মূর্তি। সে নাশ করে না বরং সৃষ্টি করে। যদি এমন না হতো তবে বহু আগেই কোন এক হতভাগ্যা নারীর শাপে এই সমাজ ভস্ম হত। নারীর ক্ষমা, ধৈর্য, নিঃস্বার্থ সেবা, স্বামীভক্তিই তাহার সতীত্বের লক্ষণ। সেই নারীকে দেবতারা শ্রদ্ধা করেন। ইহার পরে তাঁহার অগ্নিপরীক্ষা চাওয়া চূড়ান্ত অপরাধ। তোমাদের সকলের মঙ্গল হোক। আমি বিদায় গ্রহণ করছি।” এই বলে সীতাদেবী সকলকে প্রণাম করে লব ও কুশকে বললেন- “পিতার সেবা করাই পুত্রের ধর্ম। পিতার আজ্ঞা পালন পুত্রের অগ্র কর্তব্য। তোমার পিতাও তাই করেছেন। এখন তোমরা তোমাদের পিতার নিকট থাকো।” এই বলে সীতাদেবী ভগবান শ্রীরামকে প্রণাম করে বললেন- “প্রভু! যুগে যুগে যেনো তোমারই চরণদাসী হয়ে জন্মাতে পারি। ইহা ভিন্ন আমার কিছু কামনা নাই। লব ও কুশ আপনারই পুত্র। তাহাদের রাজধর্ম ও ক্ষত্রিয়ধর্মের শিক্ষা দিয়ে যোগ্য করে তুলুন।” সকলে শুনে রোদন করতে লাগলো। হনুমান রোদন করতে লাগলো। লব কুশ, তিন ভ্রাতা, সীতার তিন ভগিনী, সীতার পিতামাতা, তিন শাশুড়ী, অয্যোধ্যার প্রজারা, মুনি ঋষি , বিভীষণ সহ রাক্ষসেরা, সুগ্রীব, অঙ্গদ, জাম্বুবান, নল, নীল আদি সকল বানরেরা রোদন করতে লাগলেন। সকলেই সীতাদেবীকে যেতে মানা করলেন। ভগবান শ্রীরাম বললেন- “হে জানকী। তুমি ভিন্ন আমার অস্তিত্ব কি? দয়া করে তুমি আমাকে একলা রেখে যেয়ো না।” সীতামাতা বললেন- “প্রভু! আপনি আবার দুর্বল হচ্ছেন। মন কঠোর করে আমাকে বিদায় দিন। আমার ইহজন্মে এতটুকুই অধ্যায় ছিলো- যাহা পূর্ণ হয়েছে । এবার আমার ফিরে যাবার সময় এসেছে। আপনি রাজা। রাজাকে সর্বদা দুর্বলতা, আবেগ পরিত্যাগ করে চলতে হয়। তাতেই রাজ্য সুরক্ষিত থাকে। আপনি আপনার পুত্রদের দেখবেন।”

এই বলে মাতা সীতাদেবী বললেন- “সকলের মঙ্গল হোক।” এই বলা মাত্র ধরিত্রী দেবী সীতা সহিত পাতালে চলে গেলেন। দুভাগ হয়েছিলো যে ভূমি, তাহা আবার একত্র হল। শ্রীরাম সেই স্থানে এসে রোদন করতে করতে বলতে লাগলেন- “আমার স্মমুখেই আমার সীতা আমার থেকে চলে গেলেন।এই বিহন অসহনীয়। পূর্বে যখন সীতাকে রাবণ হরণ করেছিলো, তখনও এত শোক হয় নি। হা সীতা! তোমা বিনা আমার অস্তিত্ব কি? হে বসুমতী। আমি করজোড়ে অনুরোধ করছি আমার সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” লব ও কুশ মাটিতে পড়ে রোদন করে বলতে লাগলো- “মা জন্ম হতে পিতাকে দেখি নাই। তুমি আমাদের মাতা আবার তুমি পিতা। কত কষ্টে আমাদের লালিত পালিত করেছো মা । আজ আমাদের ছেড়ে কেন চলে গেলে? তোমা বিনা আমরা কিরূপে বাঁচি?” জনক রাজা , সুনয়না দেবী রোদন করতে লাগলেন। মনে পড়লো সীতাদেবীকে ভূমি কর্ষণ উৎসবে প্রাপ্তি করেছিলেন। মাতা বসুমতী আবার তাঁর সন্তান কে ফিরিয়ে নিলেন । শ্রীরাম পুত্রদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “হে বসুন্ধরা। সকল জীবকে তুমি আশ্রয় দাও, ঠিক যেমন মাতা তাঁর সন্তানকে আশ্রয় প্রদান করেন। তুমি সর্বংসহা। এত পাপী তোমার বুকে অবস্থান করা সর্তেও তুমি খণ্ড খণ্ড হও নি। হে বসুমতী! তুমি করুণার মূর্তি। কৃপা করে আমাদের দুঃখ দেখে সীতাকে ফিরিয়ে দাও। সীতা বিনা সকল কিছু অন্ধকার।” বসুমতী সাড়া দিলো না দেখে শ্রীরাম কঠোর হয়ে বললেন- “যদি তুমি আমাকে সীতা ফিরিয়ে না দাও, তাহলে ব্রহ্মাস্ত্রে মেদিনী ধ্বংস করে দেবো।” এই বলে কঠোর হয়ে শ্রীরাম, লক্ষ্মণকে আদেশ দিলেন- “ভ্রাতা সত্বর আমার ধনুর্বাণ নিয়ে আসো। আমি আজ ধরণী ধ্বংস করে সীতাকে ফিরিয়ে আনবো।” তখন প্রজাপতি ব্রহ্মা দৈববাণী করে বললেন- “হে শ্রীরাম! আপনি কি আপনার অবতারের প্রসঙ্গ ভুলে গেছেন? বরাহ অবতারে আপনি ধরিত্রী উদ্ধার করেছিলেন, আবার সেই ধরিত্রীকে ধ্বংস করতে চান ? সীতাদেবী সাক্ষাৎ দেবী লক্ষ্মী। তিনি পাতালে গিয়ে সীতারূপ ত্যাগ করে দেবী লক্ষ্মীরূপে নাগলোকের পথ ধরে বৈকুণ্ঠে গমন করেছেন। সেখানে তিঁনি আপনার জন্য প্রতীক্ষা করছেন।”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪১)



মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে শাস্ত্র অনুমোদিত সকল শুভ কর্ম করলেন। অতঃ অশ্বকে উৎসর্গ করে যজ্ঞে আহুতি প্রদান পূর্বক যজ্ঞ সমাপন করলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপন হয়েছে। তিঁনি আর্যভূমিতে শক্তিশালী রাজা রূপে কীর্তিত হলেন । অযোধ্যায় সকলে শ্রীরামের পুত্র লব আর কুশের বীরত্বের কথা শুনে গর্বিত হল। কৌশল্যা, কৈকয়ী, সুমিত্রা দেবী- সীতাদেবীর তিন ভগিনী লব , কুশ ও সীতাকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হলেন। বাল্মিকী মুনি জানতেন কি হতে চলেছে। তবুও ব্রহ্মার ইচ্ছায় তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। আশ্রমে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে সীতাদেবী কাবেরীমাতার কাছে গেলেন। প্রণাম করে বিদায় দিলেন। আশ্রমের সকলের চোখে জল। লব ও কুশ ছিলো আশ্রমের প্রাণ, সীতা যেনো সেই আশ্রমের কন্যা ছিলেন। এই তিনের বিহনে আশ্রম শূন্য। পশু, পক্ষী এমনকি মৃগ, ব্যাঘ্র, সিংহ, হস্তী, বরাহ আদি এসে লব কুশের বিদায় যাত্রার সময় অশ্রু মোচন করতে লাগলো। লব ও কুশ বন্য পশুদের সহিত ক্রীড়া করতো। সখা দের বিদায় জানালেন। সকলে বিদায় জানালো। মহর্ষি বাল্মিকী সীতাদেবী, লব ও কুশ কে নিয়ে অয্যোধ্যার দিকে চললেন। অযোধ্যায় উপস্থিত আত্মীয় কুটুম্ব ও প্রজা সকলে অপেক্ষা করতে লাগলেন । এমনকি যে সকল প্রজা মাতা সীতা সম্বন্ধে অপবাদ দিয়েছিলো, তাহারাও অপেক্ষা করতে লাগলেন । সকলের নজর কেবল নগরে প্রবেশের তোড়ন দ্বারের দিকে। কৌশল্যা, কৈকয়ী, সুমিত্রা দেবী অপেক্ষা করে রইলেন। ভরত মাণ্ডবী, লক্ষ্মণ- ঊর্মিলা, শত্রুঘ্ন – শ্রুতকীর্তি সকলে আপন পুত্রদের নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাত মহর্ষি বাল্মিকী সীতাদেবী ও লব কুশকে নিয়ে পদার্পণ করলেন। ভীর যেনো উপচে পড়লো। সকলেই লব ও কুশকে ক্রোড়ে লইতে চায়। এমনই সবার ছিলো। হুজুগ। সীতাদেবী করজোড়ে সকল কে অভিবাদন জানালেন। মনে পড়লো কত পুরাণো স্মৃতি। কতকাল আগে বন দর্শনের জন্য প্রস্থান- বনবাস স্বীকার- আর এত কাল পড় অযোধ্যায় ফেরা। রাজা জনক, মাতা সুনয়না দেবী পুত্রীকে দেখবার জন্য সেই দিকেই গেলেন ।

এত মানুষের ভীর যে সেনারাও সামাল দিতে পারছে না । লোকে যেনো বাঁধভাঙ্গা প্লাবনের ন্যায় ছুটে আসছে। কি অন্ধ , কি প্রতিবন্ধী সকলেই আসছে। সকলের চোখেই অশ্রু আর মুখে হাসি। রাশি রাশি পুস্প বর্ষণ করছে। অযোধ্যার পথ পুস্পে ঢেকে গেলো। সেই পুস্প পথে মহর্ষি বাল্মিকী, দেবী সীতা ও লব কুশ আসতে লাগলেন । প্রথমে রাজা জনক, মাতা সুনয়না আপন পুত্রীকে দেখে অনেক স্নেহ করলেন। লব , কুশকে অনেক ভালোবাসা দিলেন। তিন ভগিনী এসে বড় ভগিনীকে আলিঙ্গন করে অনেক রোদন করলেন । অবশেষে তিন ভ্রাতা এসে বৌঠানকে নমস্কার করে স্বাগত জানালেন। তিন মাতা এসে বরণ করলেন। লব, কুশকে ক্রোড়ে নিয়ে তিন রাজমাতা অনেক আদর স্নেহ প্রদান করলেন । অবশেষে এলেন শ্রীরাম । কি আর বলবেন । উভয়ের চোখে কেবল অশ্রু । রাজসভাতে উপস্থিত হলেন মাতা সীতা ।সন্দেহবাদীরা বলাবলি করতে লাগলো আর একবার অগ্নিপরীক্ষা দেবার জন্য। একথা মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের কানেও গেলো। তিঁনি কি বলবেন- একদিকে রাজধর্ম, প্রজাদের দাবী মান্য করার শপথ- অপরদিকে পতিধর্ম, পিতাধর্ম – শ্রীরামের মনে যেনো টানা হ্যাঁচড়া চলল। ভাবলেন বারবার সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার কথা বলা নারী জাতির চূড়ান্ত অপমান। অপরদিকে যদি অগ্নিপরীক্ষা না হয়, তবে প্রজারা সীতার বর্জন দাবী তুললে আবার সীতাকে বনে যেতে হবে। মাতা সীতাদেবী বললেন- “আমি অগ্নিপরীক্ষা দেবো। সকলের সামনেই দেবো। এমন পরীক্ষা দেবো, যাহাতে কোনো যুগে আর কোন নারীকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয়।” আবার অগ্নিপরীক্ষা! শুনে সকলে বিস্মিত হল। মুনি ঋষিরা বললেন- “সীতা দেবী সাক্ষাৎ সতী রমণী। অগ্নি ও গঙ্গার ন্যায় শুদ্ধা তিঁনি। তাহার সতী ধর্মের পরীক্ষা চাওয়া মানে নারীর সতীত্ব ধর্মকে অপমান করা।” সন্দেহবাদী প্রজারা তবুও চাক্ষুষ অগ্নিপরীক্ষার দাবী তুলেছিলেন থেকে থেকে। মাতা সীতাদেবী কেবল শুনছিলেন সে সকল কথা । তারপর সকলকে থামিয়ে বললেন- “আমি অগ্নিপরীক্ষা দেবো। যে যাহাই বলুক। সতী ধর্মের জয় সকল যুগেই হয়ে থাকে। আজও হবে। তবে তাহার আগে আমি মহারাজকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই।”

সীতাদেবী এরপর মহারাজ শ্রীরামকে বললেন- “প্রভু! সীতা কদাপি শ্রীরাম ভিন্ন অপরের ভজনা করেনি, অপরের চিন্তাও করেনি। আপনার চরণ আমার তীর্থ। আপনার চরণধূলি আমার কাছে তীর্থের ধূলি। আপনার পাদোদক আমার কাছে চরণামৃত। এই ধরিত্রী তে সকল পতিব্রতা নারীর এই ধর্ম। নারীর কাছে তার স্বামীই পরমেশ্বর। নারীর ত্যাগ, নারীর সেবা, নারীর পতিব্রতা ধর্মই নারীর কাছে অগ্নিপরীক্ষা। প্রতি মুহূর্তে সকল সতী নারীই এই পরীক্ষা দিয়ে চলছেন। তবুও এই সতী নারীদের কাছে পৃথক অগ্নিপরীক্ষা চাওয়া কি অধর্ম নয়?” ইহা শুনে সকলে চুপ থাকলেন। এমনকি শাস্ত্রজ্ঞ মুনি ঋষিরাও চুপ হয়ে থাকলেন। সীতাদেবী বললেন- “রাবণের রাজ্যে ঈশ্বর জানেন কি নিদারুন অত্যাচার সয়ে আমি সতীত্ব ধর্ম পালন করেছি। তবুও এই সমাজে আমাকে সেই কারণে অসতী অপবাদ শুনতে হয়েছে। যাহার ফল আমার সন্তানেরা প্রাপ্তি করেছে। অয্যোধ্যার রাজকুমার হয়েও তাহারা সেই ভাবে লালিত হয় নি। কোন নারী স্বেচ্ছায় নিপীড়িত হতে চায় এই জগতে ? আর সেই নিপীড়িতা নারীর কাছে কেন অগ্নিপরীক্ষা চাওয়া হয়? ইহা কি অধর্ম নয় ?” ইহা শুনে সকলের মুখের বোল হারিয়ে গেলো। কাহার মুখে শব্দ নেই। সীতাদেবী বললেন- “স্ত্রী যদি এক দিবস স্বামী গৃহে না থাকে তবে সেই স্ত্রীকে অসতী জ্ঞান করে ত্যাগ করা কোন ধর্মের বিচার? যদি কোন পুরুষ তাহার স্ত্রী থেকে, গৃহ থেকে দূরে থাকে, তবে সেই পুরুষের কেন অগ্নিপরীক্ষা চাওয়া হয় না। ইহা কি অধর্ম নয়?” ইহা শুনেও সকলে চুপ হয়ে গেলেন। মাতা সীতাদেবী বললেন- “হে মহারাজ! আপনি রাজা। রাজা রূপে আপনার কাছেই বিচার চাইলাম । কিন্তু আপনি আমার স্বামী। স্ত্রীরূপে নারী রূপে বলছি- আমি কি একবর্ণও অযৌক্তিক প্রস্তাব করেছি।” এরপর মাতা সীতাদেবী সকলকে বললেন- ‘আপনারা কেন বোঝেন না- এক নারীর ধৈর্য, ত্যাগ, পতিসেবাই তাহার সবচেয়ে বড় অগ্নিপরীক্ষা। তাহার কাছে অন্য অগ্নিপরীক্ষা চাওয়া অধর্ম। দুঃখ লাগে যখন আপনারা একজন সতী নারীর কাছে এইরূপ পরীক্ষা চান। আর তার চেয়েও বড় দুঃখ হয় যখন রাজা এই অগ্নিপরীক্ষাকে সমর্থন করেন। কারণ রাজা যা করেন, প্রজা তাই শেখে। আর তার ফলে এই অগ্নিপরীক্ষার নামে যুগে যুগে নারীদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে।” এই বলে মাতা সীতাদেবী আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রোদন করতে লাগলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪০)



মহর্ষি বাল্মিকী বললেন- “লব ও কুশ, তোমরা ইহা কি করছ ? তোমরা জানো না উনি কে হন। সত্বর ওঁনার অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব সসম্মানে ওঁনাকে ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করো। অজ্ঞান বশত তোমরা নিজের জনকের সাথেই যুদ্ধ করছ। মহাপাপ হয়েছে তোমাদের।” ‘জনক’ শব্দ শুনে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র চমকে উঠলেন। হস্ত থেকে ধনুক খসে পড়লো । মহর্ষির বাক্য যেনো সংশয় হয়ে কর্ণে প্রবেশ করেছে । পুনঃ তিঁনি জিজ্ঞাসা করলেন- “হে মহর্ষি! আমি ইহাদের জনক। তবে কি এরা আমার পুত্র?” মহর্ষি বাল্মিকী বললেন- “হে পুরুষত্তম রঘুনাথ! সময় এসেছে সেই রহস্য উন্মোচনের। বিধাতার বিধানে সেই সময় আগত, যখন পিতা পুত্রদের মধ্যে পরিচয় হবে। ইহারা আপনারই যমজ সন্তান । ইহাদের মাতা সীতাদেবী আমার আশ্রমেই আপনার দুই পুত্রকে জন্ম দিয়েছিলেন ।” লব ও কুশ সব শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন । এ কি কথা বলছেন গুরুদেব? যেই মাতাকে তারা চির দুখিনী বলে জানতেন তিনিই তাহলে রামায়নের সুধা, শক্তিরূপিনী সীতাদেবী? আর সীতাদেবীর দর্শনের জন্যই তারা এত উদগ্রীব হয়েছিলেন । মহর্ষি বাল্মিকী বললেন- “লব ও কুশ তোমরা মহারাজ শ্রীরামের সন্তান। উনিই তোমাদের পিতা। আর সীতাদেবী তোমাদের মাতা। যাহাকে তোমরা সাধারণ রমণী ভেবেছিলে, তিঁনি সীতাদেবী। এবার গিয়ে পিতার আশীর্বাদ গ্রহণ করো।” তারপর মহর্ষি বাল্মিকী শ্রীরামচন্দ্রকে বললেন- “হে শ্রীরাম! এই যুদ্ধে আপনার বহু হানি হয়েছে। প্রজাপতি ব্রহ্মার কৃপায় আমি অমৃত বারি সেচন করে সকল আহত দিগকে সুস্থ করবো। সকল মৃতদের জীবিত করবো।” এই বলে মহর্ষি বাল্মিকী মন্ত্র পুতঃ বারিধারা সেচন করে সকল আহত দের সুস্থ করে মৃত অশ্ব, হস্তী, ভল্লুক, রাক্ষস, বানর, মর্কট, অযোধ্যার সেনারা যাহারা হতাহত হয়েছিলেন, সকলকে বাঁচিয়ে সুস্থ করলেন। শত্রুঘ্ন, ভরত, লক্ষ্মণ কে সুস্থ করলে তাহারা সেইস্থানে আসলেন । লব ও কুশ মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রকে অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দিলেন । চরণে পতিত হয়ে ক্ষমা চাইলে শ্রীরামচন্দ্র দুই পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে অনেক আদর, স্নেহ প্রদান করলেন । অতঃ ভরত, শত্রুঘ্ন, লক্ষ্মণ দুই বালক কে ক্রোড়ে নিয়ে অনেক স্নেহ প্রদান করলেন। যোগ্য সূর্যবংশের উত্তরাধিকারী হয়েছে তাহারা। বংশের নাম উজ্জ্বল করবে ।

মহর্ষি বাল্মিকী বললেন- “হে শ্রীরাম। এই দুই বালক এর নামকরণ সংস্কার আপনার কুলের দ্বারাই হয়েছে। যখন মথুরা নরেশ শ্রীশত্রুঘ্ন লবণ অসুর বধের জন্য যাত্রা করে এই তপোবনে এসেছিলেন, তখন তাহার দ্বারাই আপনার পুত্রদ্বয়ের নামকরণ অনুষ্ঠান হয়।” শ্রীরাম বললেন- “কিন্তু ইহাদের মাতা, তথা আমার পত্নী কোথায়?” সেই সময় হনুমান ,মাতা সীতাদেবীকে নিয়ে আসছিলেন । হনুমান এসে বললেন- “প্রভু! এই মাতাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। দয়া করে আর মাতার ওপর কোন অবিচার করবেন না। তিঁনি মুখ বুজে পালন করেন ঠিকই- কিন্তু অন্তরে অন্তরে অনেক দুঃখ পান। দয়া করে এবার মাতাকে ও আপনার দুই পুত্রকে অযোধ্যায় নিয়ে চলুন।” শ্রীরামচন্দ্র রথ থেকে নেমে সীতার কাছে গেলেন। ঘোমটার আড়ালে থাকা সীতার মুখমণ্ডল দর্শন হল না। শ্রীরামচন্দ্র খানিক ক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর বললেন- “সীতা! আমার সহিত কথা বলবে না? তুমি কি জানো না তোমাকে ত্যাগ করে আমি বা কেমন আছি। চন্দ্র যদি তার জ্যোতি হারিয়ে ফেলে, তখন চন্দ্রের মূল্য থাকে কি? সীতা বিনা রামচন্দ্রেরই কি বা গুরুত্ব?” ইহা শুনে সীতাদেবীর নয়ন জলে ভেসে গেলো। কতদিন পর স্বামীর সঙ্গে কথা হচ্ছে। কত বছর, কত রাত্রি, কত অমাবস্যা, কত পূর্ণিমা, কত দিন কেটে গেছে এই কণ্ঠস্বর কর্ণে প্রবেশ করেনি । সীতাদেবী বললেন- “কিভাবে আবরণ উন্মোচন করি? পাছে প্রজারা অভিযোগ না করেন- যে আপনি অসতী রানীর মুখ দেখেছেন। আপনার চরণ কিভাবে স্পর্শ করি- পাছে অভিযোগ করেন যে এক চরিত্রহীনা রমণী আপনার চরণ স্পর্শ করেছে। আপনাকে দূর হতে প্রণাম করি। এক স্ত্রীর কাছে স্বামী মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সব। যদি আপনাকে কেহ অপবাদ দেয়- তবে সর্বপ্রথম আঘাত আমার ওপরে আসে।” ভগবান শ্রীরামের চোখে জল এলো। শ্রীরামচন্দ্র বললেন- “আমার বড় ভুল তোমাকে সাগর পারে অগ্নিপরীক্ষা গ্রহণ করা। এক সতী স্ত্রীর কাছে সতীধর্মের প্রমান চাওয়া সবচেয়ে বড় অধর্ম। যদি এই অধর্ম আমি অযোধ্যায় সমস্ত প্রজাদের কাছে করতাম, তবে তার থেকেও বড় অধর্ম যা তোমাকে গর্ভস্থ অবস্থায় সহ্য করতে হয়েছে, সেটা করতে হতো না।”

ভগবান শ্রীরাম আরো বললেন- “ সীতা! এই অন্যায় কাজ আমার দ্বারাই কেন বা হল ? রাজধর্ম পালন করতে করতে আমি নিজ পতিধর্ম , পিতাধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়ে দিলাম । এবার আমি তোমাকে গ্রহণ করে অযোধ্যায় নিয়ে যেতে চাই। আর তার জন্য অয্যোধ্যার সেই ভ্রান্ত মানবের মন থেকে সংশয় দূর করা দরকার।” ইহা বলে ভগবান শ্রীরাম চুপ হয়ে রইলেন। মাতা সীতাদেবী বললেন- “বুঝেছি প্রভু! এবার আমি এমন অগ্নিপরীক্ষা দেবো, যে কোন মানব আর সতী স্ত্রীর ওপরে কলঙ্ক লেপন করতে পারবে না। আমি সেই পরীক্ষাই দেবো, যাহাতে লোকে নারীজাতিকে সম্মান করতে শেখে। আমি সেই পরীক্ষাই দেবো যাহাতে যুগে যুগে নারীধর্ম আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে। আপনি চিন্তিত হবেন না।” এই বলে সীতাদেবী পুত্রদের নিয়ে বিদায় হলেন । ভগবান শ্রীরাম মহর্ষি বাল্মিকীকে শিষ্য সহিত, দেবী সীতা ও দুই পুত্রকে নিয়ে যজ্ঞ সমাপনের দিন অযোধ্যায় থাকতে অনুরোধ জানালেন । ইহা বলে ভগবান শ্রীরাম অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে অযোধ্যায় গেলেন। অযোধ্যায় সকলে লব ও কুশের সংবাদ পেয়ে আনন্দিত হল। অপরদিকে আশ্রমের লোকেরা এসে সীতাদেবীর কাছে ক্ষমা চাইলো, কারন যাঁহাকে সাধারণ নারী জ্ঞানে তুচ্ছ করেছিলেন, তিঁনিই স্বয়ং সীতাদেবী। সাক্ষাৎ ভগবতী লক্ষ্মী। সীতাদেবী বললেন- “আপনারা সকলে আমার নমস্য । আপনাদিগের কারণে আজ লব ও কুশ এত শক্তির অধিকারী হয়েছে। আপনাদের স্নেহ ভালোবাসাতেই তারা লালিত পালিত হয়েছে। আপনারা সকলেই আমার আপনজন ।” লব ও কুশকে মাতা সীতাদেবী বললেন- “পুত্র! অযোধ্যা নরেশ শ্রীরামচন্দ্র তোমাদের পিতা। তোমরা এখন থেকে সেখানেই থাকবে ওঁনার কাছে।” লব ও কুশ রোদন করে উঠলো। তাহার বাল্যকাল হতে কেবল মাতাকেই দেখেছেন। পিতাকে ত এই প্রথম দেখলেন। মাতাই সব । সীতাদেবী বললেন- “উনি তোমাদের অধিক স্নেহ করবেন। তোমরা এখন বালক। শিশু নও । তোমরা ক্ষত্রিয় পুত্র। রাজধর্ম পালন করতে চেষ্টা করো। যেমন তোমাদের পিতা পালন করেন। ওঁনার কাছে থেকে এই সকল বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করবে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৩৯)



সেই বালকদের বিক্রম দেখে রাজা রামচন্দ্র বিস্মিত হলেন। ইহারা একাই যেনো গোটা ধরণীকে পরাস্ত করবার ক্ষমতা রাখে। একের পর এক তাহাদের ধনুক থেকে দিব্যাস্ত্র সকল নিক্ষেপিত হয়ে সহস্র সহস্র সেনার নাশ করছে। বজ্রবাণ, ইন্দ্রাস্ত্র, সূর্যবাণ, কালাগ্নি আদি দিব্যাস্ত্র সকল চালনা করছিলেন । দেখতে দেখতে সেনা সকলের দেহ ছিন্নবিছিন্ন হয়ে গেলো লব ও কুশের শরে। তখন ভগবান শ্রীরাম আদেশ দিলেন হস্তীবাহিনী আর অশ্বারোহী দের। তাহারা দুই বালক কে চারপাশে ঘীরে ধরে বন্দী করবে। কোটি কোটি হস্তী, অশ্বারোহী সেই দিকে চলল। হস্তীকুলের পদচালনায় মেদিনী কাঁপতে লাগলো। অশ্বের খুঁড়ের আঘাতে যেনো ধূলা ঝড় বয়ে চলল। হৈ হৈ আর হস্তী, অশ্বের গর্জনে চতুর্দিকে আচ্ছাদিত হল । লব ও কুশ দুজনে মিলে যুক্তি করলেন । ঠিক করলেন আজ শ্রীরামের সমস্ত সৈন্য ধ্বংস করে দেবো।

দুই ভাই কুপিয়া ধনুকে বাণ যোড়ে ।
হস্তী ঘোড়া কাটিয়া গগনে বাণ উড়ে ।।
লব এড়িলেন বাণ নামেতে আহুতি ।
এক বাণে কাটিয়া পড়িল কোটি হাতী ।।
কুশ বাণ এড়িল নামেতে অশ্বকলা ।
কাটিল তিরাশী কোটি তুরঙ্গের গলা ।।
চারিভিতে সৈন্য যুঝে লব কুশ মাঝে ।
নানা অস্ত্র লইয়া সে দুই ভাই যুঝে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

শ্রীরাম দেখলেন লব ও কুশের বাণে চতুর্দিকে কেবল অশ্ব ও হস্তীর কাটা মস্তক শোভা পাচ্ছে। ধ্বজ, ছত্র, রথের টুকরো তে মেদিনী শোভা পাচ্ছে । স্রোতস্বিনী নদী যেমন প্রস্তরে ক্রমাগ্রত ধাক্কা খেয়ে প্রবল স্রোত নিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি এইস্থানে রক্তনদীর ধারা ভাঙা রথে ধাক্কা খেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে । লব ও কুশ একের পর এক বলশালী সেনা, সেনাপতি দিগকে যমালয় প্রেরণ করছে । তাহারা শিলাবাণ নিক্ষেপ করলো। গগন থেকে শিলা পড়ে শ্রীরামের সেনা দলে হাহাকার উঠলো। দুই বালক উল্কাবাণ নিক্ষেপ করলো। চোখের পলকে লক্ষ জলন্ত বাণ এসে অয্যোধ্যার সেনার ওপরে আছড়ে পড়লো । এমনকি সেনারা ঢাল নিয়ে বাঁচলো না । ক্ষিপ্রগামী সেই সকল শর ঢাল বিদ্ধ করে সেনাদিগের বুকে বিঁধলো । আবার পবন বাণ নিক্ষেপ করলো। কত হস্তী, অশ্ব, রথী উড়ে গিয়ে ভূমিতে সশব্দে পতিত হয়ে মৃত হল। অয্যোধ্যার সেনারা চারপাশ থেকে বর্শা, ছোড়া, শর, পট্টিশ বর্ষণ করলো। লব ও কুশ অগ্নিবাণে সেই সকল ভস্ম করলো। দুই বালকের বিক্রম দেখে শ্রীরামের সেনারা রণে ভঙ্গ দিলো। কেহ কেহ আবার অঙ্গহীন হয়ে যুদ্ধে পড়ে থাকলো। লব ও কুশ হাস্য করে বরুণ বাণ নিক্ষেপ করে তাহাদিগকে নিমজ্জিত করে বধ করলেন । এই ভাবে যুদ্ধ চলল।

অপরদিকে তখন বিভীষণ ও তার রাক্ষস বাহিনী এগিয়ে গেলো। রাক্ষসেরা বিকট রূপ ধরে ভয় দেখাতে লাগলো। কিন্তু লব ও কুশ ভয় না পেয়ে কেবল হাস্য করতে লাগলো। বিকট চেহারার রাক্ষসেরা মুগুর নিয়ে চারপাশ কম্পিত করে এগিয়ে গেলো। সকলে ভাবল এবার বুঝি লব আর কুশের নিস্তার নেই । লব ও কুশ রুদ্রবাণ নিক্ষেপ করলেন। প্রচণ্ড সেই বাণ সশব্দে এগিয়ে গিয়ে সেই সকল রাক্ষসদের মুণ্ড গুলো কেটে ফেলল। মনে হল যেনো বিশাল তাল বৃক্ষ ভূমিতে পড়লো। কাটা ধড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো । রক্তে যেনো অকালে বন্যা হল। ইহার পর লব কুশ জ্বালাবান নিক্ষেপ করলেন। আকাশ থেকে অনেক প্রকাণ্ড আগুনের গোলা রাক্ষসদের ওপর ঝড়ে পড়লো। রাক্ষস দলে হাহাকার উৎপন্ন হল। প্রকাণ্ড আগুনের গোলায় রাক্ষসেরা ঝলসে গেলো। হস্তী, অশ্ব ঝলসে গেলো। রথ গুলি গলে যেনো সোনার নদীর ন্যায় প্রবাহিত হল । প্রকাণ্ড আগুনের গোলাতে ভীত হয়ে রাক্ষসেরা পলায়ন করতে লাগলো। ইহা দেখে বিভীষণ কুপিত হয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলো। বিভীষণ যত অস্ত্র নিক্ষেপ করলো লব ও কুশ সব ধ্বংস করলো। লব ও কুশ মিলে তখন চোখ চোখ শর নিক্ষেপ করলো। বিভীষণের রথ টুকরো টুকরো হল। বাণ ফুটে জর্জরিত হল বিভীষণ। সকলে তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো। জাম্বুবান হুঙ্কার দিয়ে ভল্লুক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলেন । লব কুশ ভল্লুক বাহিনীর দিকে অর্ধচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করলেন। তাহার পর মহাপাশ অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। অর্ধচন্দ্র বাণে ভল্লুকেরা ছিন্নভিন্ন হল। মহাপাশ বাণে দফারফা সাড়লো । জাম্বুবাণ হুঙ্কার দিলেন। ভল্লুকেরা বৃহৎ প্রস্তর নিক্ষেপ করতে লাগলো। লব ও কুশ তত বাণ দ্বারা সেই সকল প্রস্তর চূর্ণ করলেন। বজ্রশক্তি বাণ নিক্ষেপ করলেন । এই বাণে ইন্দ্রদেবতার বজ্রের সমান শক্তি আছে। সেই বাণের থেকে সশব্ধে বজ্রপাত হয়ে ভল্লুকেরা সব ঝলসে গেলো। জাম্বুবান কে লক্ষ করে লব ও কুশ শর সন্ধান করলে জাম্বুবান পলায়ন করলেন । এরপর অঙ্গদ, সুগ্রীব, নল, নীল, গবাক্ষ, কেশরী, কুমুদ আদি বানরেরা সব এগিয়ে এলো। বানরেরা হৈ হৈ করে সব গদা, প্রস্তর নিয়ে ধাবমান হল।

মন্ত্র পড়ে কুশ তখন সূচীমুখ বাণ নিক্ষেপ করলো। লক্ষ বাণ উৎপন্ন হয়ে বানর , মর্কট দের উদর ছিন্ন করে দিলো। সাড়ি সাড়ি সেনা সকল মুখ থুবরে পড়লো। চারপাশে যেনো দেহের স্তূপ জমেছে । ঝড় হলে যেমন কদলী বৃক্ষ পড়ে, ঠিক সেই রকম ভাবে বানরেরা পড়লো। সকলে হায় হায় করে উঠলো। নল , নীল বাণ ফুটে ভূমিতে পড়লো । গবাক্ষ কেশরী আদি বানরেরা রক্তাক্ত হয়ে ভূমিতে পড়লো। রক্তে রক্তময় হল চারপাশে । গাছপালা গুলি অবধি সবুজ বর্ণ হারিয়ে রক্তিম আভা প্রাপ্তি করেছিলো। অঙ্গদ যুদ্ধ করতে যেতেই লব মণিবাণে ধরাশায়ী করলেন। রক্তবমি করতে করতে অঙ্গদ ভূমিতে পড়লো। সুগ্রীব গর্জন করে যুদ্ধে এসে বিশাল পর্বতের চূড়ার ন্যায় এক প্রস্তর তুলে নিলো। সেই প্রস্তর তুলে নিক্ষেপ করা মাত্রই লব ও কুশ তাহা কেটে ফেললেন। দেখতে দেখতে দুভ্রাতা সূর্যবাণ নিক্ষেপ করলেন। সুগ্রীব ভূপতিত হল। এবার শ্রীরামচন্দ্রের সাথে লব ও কুশের যুদ্ধ আরম্ভ হল। শ্রীরামের সেনা সকল অর্ধেকের বেশী নিহত হয়েছেন। বাকীরা সকলে আহত হচ্ছেন সমানে। ভগবান শ্রীরাম অগ্নিবাণ ছুড়লে কুশ বরুণ বাণে ধ্বংস করলেন। শ্রীরাম পর্বত বাণ নিক্ষেপ করলে কুশ বায়ুবানে ধ্বংস করলেন। শ্রীরাম নাগাস্ত্র ছুড়লে কুশ গরুর বাণে ধ্বংস করলেন। শ্রীরাম মহাপাশ, মহাশিরা অস্ত্র ছুঁড়লেন । দুই বাণ গর্জন করে ছুটে গেলো। লব ও কুশ অমোঘবাণ, শলাকাবাণ দ্বারা শ্রীরামের বাণ ধ্বংস করলেন । শ্রীরামের যক্ষবাণ, খড়্গবাণ, কৌমুদিনী শক্তি, চক্রবাণ, বায়ব্যবান, আধারবাণ, মায়াবান, কালপাশ আদি সকল অস্ত্রই লব ও কুশ মিলে ধ্বংস করলেন । এরপর বহু দিব্যাস্ত্রের সংঘর্ষ হল। মেদিনী কেঁপে উটলো, পর্বতে ধস নেমে গেলো, সমুদ্র উত্থাল পাতাল হল এই সকল অস্ত্রের প্রয়োগে। এমন সময় মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “বালক ব্রহ্মাস্ত্র থেকে কেহ মুক্তি পায় না। আজ সেই বাণ প্রয়োগ করবো।” এই বলে শ্রীরাম ব্রহ্মাস্ত্র আহ্বান করতে উদ্যত হলেন। দুই বালক পাশুপাত অস্ত্র আহ্বান করতে লাগলেন। তখন মহর্ষি বাল্মিকী এসে বললেন- “লব ও কুশ তোমরা যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হও। একি অনর্থ করছ?”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৩৮)


শ্রীরাম সহ সেনারা যখন আসছিলেন, দেখতে পেলেন চতুর্দিকে কেবল অযোধ্যার সেনাদিগের ছিন্নবিছিন্ন দেহ পড়ে আছে। আর আছে খণ্ড খণ্ড হওয়া রথ, হস্তী, অশ্বের টুকরো। ধ্বজ, ছত্র তে মেদিনী ঢাকা পড়ে আছে। চতুর্দিকে ছিন্নবছিন্ন কেয়ুর, বাজু কীরিট নক্ষত্রের ন্যায় ভূমিতে পড়ে আছে । স্থানে স্থানে রক্তের সরোবর সৃষ্টি হয়েছে। এই সকল যে সামান্য দুই বালক করেছে- ইহা কেহই যেনো বিশ্বাস করবে না। মনে হয় যেনো এই স্থানে দেবরাজ ইন্দ্রের সেনার সহিত অসুরদের যুদ্ধ হয়েছে । শ্রীরামচন্দ্র গিয়ে সেই যুদ্ধ স্থানে দাঁড়ালেন । বালক দিগকে দেখে পুনঃ তিঁনি স্নেহাসক্ত হলেন । মনে হতে লাগলো বালক দিগকে ক্রোড়ে লইয়া অনেক স্নেহ প্রদান করি। বালক দিগকে দেখলে মন হতে সমস্ত ক্রোধ কর্পূরের ন্যায় উবে যায় । সেই মায়া ভরা বালক দের চাউনি দেখলে অন্তরে অন্তরে ইহাদের পুত্ররূপে পাইতে ইচ্ছা করে । এমনই ছিলো তাহারা। ইহাদের দেখিলে অস্ত্র চালনা করতে ইচ্ছা হয় না। এই ভেবে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র আপন পুত্রদের দেখতে লাগলেন । কিন্তু পিতা নাতো পুত্রকে চেনে, পুত্র নাতো পিতাকে চেনে । লব ও কুশ বলল- “হে মহারাজ শ্রীরাম আপনাকে প্রণাম জানাই। আমাদিগের অশেষ ভাগ্য যে আপনি যুদ্ধে এসেছেন । আপনার সাথে যুদ্ধ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু মহারাজ শ্রীরাম আপনি জগতের নিকট মর্যাদা পুরুষোত্তম রূপে কীর্তিত হলেও, যোগ্য পতি কদাপি হতে পারেন নি। আপনি কেন নির্দোষী সীতাদেবীকে ত্যাগ করলেন ? কি ছিলো তাঁহার অপরাধ।! আপনার রাজ্যের প্রজারা ওঁনাকে সন্দেহ করার সাহস কিরূপে পান ? আর আপনিই বা কেমন যে তাহাদের বিচার না করে নিরাপরাধ স্ত্রীকেই ত্যাগ করে দিলেন। আপনি ঘোর অন্যায় কর্ম করেছেন।” মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “হে বালক ! আমি সূর্যবংশী। আমরা ব্যক্তিগত সুখ অপেক্ষা প্রজার দাবীকেই অধিক মান্যতা দেই। ইহাই রাজার কর্তব্য। ইহা ভিন্ন আমার উপায় ছিলো না।”

লব ও কুশ বলল- “মহারাজ! আপনি কর্তব্য কর্ম করতে গিয়ে কেন নীরিহকে শাস্তি দিলেন ? দেবী সীতা গর্ভস্থ অবস্থায় জেনেও আপনি আপনার সন্তানের সহিতও অধর্ম করলেন ? যে ব্যক্তি ভূমিষ্ঠ হয় নি- তাহাকে শাস্তি দিলেন কোন অপরাধে ? এ কেমন বিচার?” মহারাজ শ্রীরাম অনেক কিছু বলে বললেন- “বালক! তোমরা জ্ঞানী। তোমরা যুদ্ধবিদ্যায় পারঙ্গদ । নিশ্চয়ই তোমরা কোন শক্তিমান ও তেজস্বিনী পিতামাতার সন্তান । কিন্তু বালক। এই স্থানে আমি তোমাদিগের প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হয়ে আসিনি। তোমরা যজ্ঞের অশ্ব উন্মুক্ত করে দাও ।” লব ও কুশ বলল- “কদাপি নয় মহারাজ! বরং আপনাকে যুদ্ধে পরাজিত করে সীতামাতার ওপরে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার করবো। যজ্ঞের অশ্ব নিতে হলে আমাদিগকে পরাস্ত করুন।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “বালক! তোমরা বয়সে অনেক কনিষ্ঠ। তোমাদিগের সাথে যুদ্ধ করলে তাহা হাস্যকর হবে। অবুঝ না হয়ে অশ্ব ফিরিয়ে দাও। আমি বল পূর্বক তোমাদিগকে বন্দী করে অশ্ব উদ্ধার করতে পারি। তোমরা অয্যোধ্যার বহু সেনা নাশ করে আমার তিন ভ্রাতাকে আহত করেছো। আমি তবুও তোমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করতে মনকে বোঝাতে পারছি না। কারণ তোমাদের দেখে আমার স্নেহ উৎপন্ন হচ্ছে। তোমরা চাইলে অর্ধ রাজত্ব, বিশাল রাজপুরী, বহু স্বর্ণ রথ, হস্তী নিতে পারো। তাহার পরিবর্তে যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দাও।” লব ও কুশ বললেন- “আমরা সে সকল কিছুই চাই না। আপনি যুদ্ধ করুন। দেখি আপনার বীরত্ব। কোন শক্তিতে আপনি দশানন রাবণকে বধ করেছিলেন তাহা দেখতে চাই।” ভগবান শ্রীরাম অনেক বোঝালেন, লব কুশ শুনলো না । অপরদিকে বাল্মিকী মুনি দিব্যদৃষ্টিতে সব কিছুই দেখেছিলেন। তিঁনি দ্রুত গতিতে আশ্রম অভিমুখ চললেন। অপরদিকে হনুমান দুই বালকের দিকে রে রে করে গদা নিয়ে ছুটে গেলো। লব ও কুশ দিব্যাস্ত্র দ্বারা হনুমান কে বন্দী করতে চাইলেন । কিন্তু হনুমানের কোন অস্ত্রেই ক্ষতি হল না ।

তখন লব ও কুশ আশ্রম বালক দের ইশারা করলেন। আশ্রমের বালকেরা এসে “জয় সীতারাম- জয় জয় রাম” বলে হনুমানের চারপাশে তালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করতে লাগলেন । ‘সীতারাম’ নাম শুনতে শুনতে হনুমান সব কিছুই বিস্মৃত হলেন। এমন কি প্রভু যে স্বয়ং এখানে উপস্থিত – তাহাও বিস্মৃত হলেন । হনুমান করতালি দিয়ে ‘সীতারাম’ কীর্তন করে ঘুরে ঘুরে আশ্রমের বালক দের সাথে নাচতে লাগলেন । রাম নাম শুনে তিঁনি এতটাই মত্ত হয়ে গেছিলেন। আশ্রমের বালকেরা হনুমানকে বন্দী করে আশ্রমে নিয়ে গেলো। একেবারে সীতাদেবীর সামনে। আশ্রম বালকেরা সীতাদেবীকে বললেন- “দেবী আপনার পুত্র দ্বয়ের সাথে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের ঘোরতর যুদ্ধ হতে চলছে। অজ্ঞান বশত লব ও কুশ অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব ধরেছিলেন। লব ও কুশের হাতে শত্রুঘ্ন, লক্ষ্মণ, ভরত পরাজিত হয়ে আহত হয়েছেন।” সীতাদেবী কপালে করাঘাত করে রোদন করতে লাগলেন এই শুনে। হনুমান ও মাতা সীতার সাক্ষাৎ হল। হনুমান প্রণাম করে বলল- “মা আপনি এই আশ্রমে। আপনার পুত্র কি লব আর কুশ ? মাতঃ! কৃপা করে চলুন। প্রভু অজ্ঞান বশত পাছে আপন সন্তান দের বধ না করেন। কিংবা দুই বালক অজ্ঞানে পিতাকেই না হত্যা করে। এ কেমন লীলা! পিতা ও পুত্রের যুদ্ধ।” তখন মহর্ষি বাল্মিকী আসলেন। বললেন- “এই যুদ্ধ থামাতে হবে।” অপরদিকে ভগবান শ্রীরাম ক্রোধে বললেন- “তোমরা বড় অবাধ্য বালক। আজ তোমাদের বন্দী করবো।” লব ও কুশ প্রথমে বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ পুস্প হয়ে ভগবান শ্রীরামের চরণে পড়লো। তাহার পর লব ও কুশ শিলাবাণ নিক্ষেপ করলেন। অসংখ্য শিলা অযোধ্যার সেনার ওপরে পড়লো। শিলাতে পিষে গেলো সেনা সকল। হস্তী, অশ্ব, রথ চূর্ণ হল। তাহার পর লব কুশ কালাগ্নি বাণ মারলেন। আগুনের তেজে শ্রীরামের সেনা ঝলসে গেলো। ভগবান শ্রীরাম তখন মরুত বাণ নিক্ষেপ করলেন । লব ও কুশ বজ্রবাণে সেই অস্ত্র ধ্বংস করলেন । দুই বালকের তেজে সমানে বানর, রাক্ষস, মানব সেনারা নাশ হতে লাগলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৭ )



দেখতে দেখতে লব ও কুশ মিলে অয্যোধ্যার সেনা সংখ্যা কমিয়ে দিলো। তাহারা এত দিব্যাস্ত্র চালনা করলো যে আকাশে মেঘ জমে গেলো। সূর্য ঢাকা পড়লো। এক একটি অস্ত্র নিক্ষেপের সময় ধরণী কম্পমান হল। লক্ষ্মণ ঠাকুর দেখলেন এই বালকেরা বহু বীর । উহাদের সহিত এত সহজে পারবে না । এই ভেবে লক্ষ্মণ মন্ত্রপূত লক্ষশিরা বাণ ছুড়লেন। সকল বাণ সকল উল্কার ন্যায় লব কুশের দিকে ছুটে আসতে লাগলো। লব ও কুশ বজ্রবাণ নিক্ষেপ করলেন। লব ও কুশের বাণে লক্ষ্মণের সেই লক্ষশিরা বাণ ভস্ম হল। ইহা দেখে দুভ্রাতা হাস্য করলেন। লক্ষ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে যত রকম দিব্যাস্ত্র চালনা করলেন- সকল অস্ত্রই লব ও কুশ মিলে ধ্বংস করলো। লব বলল- “এখনও কি মনে হয় আমরা দুর্বল ? আমাদের হস্তে আপনার অনেক সেনার নাশ হয়েছে। আপনি দুর্বল হচ্ছেন। দয়া করে প্রস্থান করুন। আর মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রকে যুদ্ধে আসতে অনুরোধ জানান। আমরা তাহাকে যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।” লক্ষ্মণ বললেন- “ওরে বালক! তোরা লক্ষ্মণের পরাক্রম কি জানিস। তোদের ন্যায় উদ্ধত বালককে আজ অবশ্যই দণ্ডিত করবো। এবার আমি সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করবো- যাহা দ্বারা মেঘনাদকে বধ করেছিলাম। দেখি তোরা কেমনে রক্ষা পাস!” এই বলে লক্ষ্মণ ধনুকে ইন্দ্রাস্ত্রের আহ্বান করলো। ইন্দ্রাস্ত্র প্রকট হতেই চতুর্দিকে যেনো প্রলয় আরম্ভ হল। অস্ত্রের ফলা দিয়ে ভীষণ গর্জন করে বজ্রপাত হতে লাগলো। ভীষণ আলো উৎপন্ন হল ইন্দ্রাস্ত্র দিয়ে । এই দেখে লব ধনুকে ইন্দ্রাগ্নি অস্ত্র জুড়লো। সেই অস্ত্র দিয়ে দিব্য জ্যোতি সকল উৎপন্ন হয়ে ভীষণ দাহক অগ্নিশিখা উৎপন্ন হল । লক্ষ্মণ ইন্দ্রাস্ত্র ছুঁড়লে, লব ইন্দ্রাগ্নি অস্ত্র ছুড়লো। দুই অস্ত্রের মুখোমুখি ধাক্কা তে যেনো ত্রিলোক কেঁপে উঠলো। লক্ষ্মণের অস্ত্র ধ্বংস হল। লব তখন কুশকে বললেন- “ভ্রাতা ! এঁনাকে বধ না করে মূর্ছিত করুন।”

কুশ তখন এমন গতিতে বাণ নিক্ষেপ করলো যে লক্ষ্মণের সাথে আগত বাকী হস্তী, অশ্ব, রথ টুকরো টুকরো করে ফেললো। লক্ষ্মণের সুরক্ষায় থাকা সেনারা ছিন্নবিছিন্ন হয়ে গেলো। রক্তের নদী প্রবাহিত হল। কুশের বাণে বাকী সেনারা রণে ভঙ্গ দিলো। জঙ্গল রক্ত, মাংস, কাটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ভরে গেলো। দেখতে দেখতে কুশের বাণে লক্ষ্মণের রথ ছিন্ন হল। সেই উল্কাবাণ লক্ষ্মণের বুকে আছড়ে পড়লো। যেনো মনে হল জলন্ত শেল এসে লক্ষ্মণের বুকে আছড়ে পড়েছে । লক্ষ্মণ মূর্ছিত হল। তাহাকে শিবিরে নিয়ে যাওয়া হল। দূত গিয়ে অযোধ্যায় সব জানালো। শ্রীরাম মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। এ কেমন বালক। যে মেঘনাদ নাশক কে মূর্ছিত করে দিলো। এরা কারা। এরা সাধারণ মানব বালক নয়। নিশ্চয়ই অপর কেও। তাহাদের সাথে যুদ্ধে বড় বড় সেনাপতি, মন্ত্রী, সেনারা যমালয়ে গেছে। সুগ্রীব, বিভীষণ, অঙ্গদ, নল, নীল, গবাক্ষ, জাম্বুবান , হনুমান সকলে অবাক হল। সকলে আশ্চর্য হল। এক বালকের হস্তে তিন মহাবীরের পরাজয় দেখে। বিশেষ করে লক্ষ্মণের পরাজয় বিশ্বাস হয় না। সকলে বলল- “এবার সেই বালক দ্বয়কে বন্দী করে যজ্ঞের অশ্ব আনা হোক।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “এই যজ্ঞে অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বের সুরক্ষার ভার আমার ওপর। আমি নিজেই যাবো । দেখি তাহারা কেমন বীর। কেনই বা আমার সাথে যুদ্ধের অভিলাষ রাখে। যদি মহর্ষি বাল্মিকী উপস্থিত থাকতেন, তবে বিনা রক্তপাতে সমস্যার সমাধান করা যেতো। বোধ হয় এখন সেই অবকাশ নেই।” হনুমান বলল- “প্রভু! আদেশ দিন। সেই দুই উদ্ধত বালক কে এখুনি লাঙ্গুলে বন্দী করে আনি।” বিভীষণ বলল- “আমাকে আদেশ দিন মিত্র। আমি এখুনি রাক্ষস দের নিয়ে সেথায় যাবো। রাক্ষসদের বিকট চেহারা দেখে ভয় পেয়ে সেই বালক অস্ত্র ফেলে পলায়ন করবে।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “অবশ্যই তোমরা যাবে। তবে একাকী নয়। এবার আমিই সেস্থানে যাবো। তোমরা আমার সাথে যাবে।” এতেক শোনা মাত্রই অযোধ্যায় যুদ্ধসাজ আরম্ভ হল। হাজার রণ দামামা, শিঙা, তুরী- ভেরী, ঢাক- ঢোল, শঙ্খ, ন্যাকড়া , করতাল বাজতে লাগলো। ভগবান শ্রীরাম সেনা সমেত বের হলেন।

শ্রীরামের সেনা ঠাট কটক অপার ।
দেখিলে যমের চিত্তে লাগে চমৎকার ।।
সুগ্রীব অঙ্গদ চলে লয়ে কপিগণ ।
গবাক্ষ, শরভ গয় সে গন্ধমাদন ।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র চলে বানর সম্পাতি ।
চলিল ছত্রিশ কোটি মুখ্য- সেনাপতি ।।
সত্তর কোটি বীরে চলে পবন নন্দন ।
তিন কোটি রাক্ষসে চলিল বিভীষণ ।।
মহাশব্দ করি যায় রাক্ষস কপিগণ ।
আর যত সেনা যায় কে করে গণন ।।
বিজয় সুমন্ত্র নড়ে কশ্যপ পিঙ্গল ।
শত্রাজিত মহাবল চলিল সকল ।।
রুদ্রমুখ চলে আর সুরক্ত – লোচন ।
রক্তবর্ণ মহাকায় ঘোর দরশন ।।
রথের উপরে রাম চড়েন সত্বর ।
মহাশব্দ করি যায় রাক্ষস বানর ।।
কটকের পদভরে কাঁপিছে মেদিনী ।
শ্রীরামের বাদ্য বাজে তিন অক্ষৌহিণী ।।
কৃত্তিবাস কবি কহে অমৃত- কাহিনী ।
দুই বালকের জন্য এতেক সাজনি ।।
(কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

অয্যোধ্যার লোকেরা হা করে দেখতে লাগলো। এত সেনা বের হল যে ধূলাময় হল চারপাশ । সাড়ি সাড়ি কেবল সেনা দেখা যায় যতদূর চোখ যায় । স্বর্ণ রথ গুলি চলল। হস্তীগুলি গর্জন করে শুণ্ড তুলে মেদিনী কাঁপিয়ে বের হল। যে রাক্ষস আর বানরেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছিল , আজ তাহারা বন্ধুর ন্যায় হাতে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করতে বের হল । অস্ত্রাদি নিয়ে সকলে চলল। হনুমান গদা নিয়ে চলল। এত সেনা নিয়ে জঙ্গল কাঁপিয়ে চলল। অপরদিকে লব ও কুশ গল্প করছিলো। মায়ের কাছে গেলো। মা সীতাদেবী বললেন- “বাছা! গুরুদেব তোমাদের ওপরে আশ্রমের সুরক্ষা দিয়ে গেছেন। তোমরা কোন ভাবে কর্তব্যে অবহেলা করবে না। আর এত যুদ্ধের ধ্বনি কেন শুনি?” লব ও কুশ কিছুই বলল না। ভাবল শ্রীরামকে পরাজিত করে সকল কথা বলবে। খালি বলিল- “মা! এক দুষ্ট রাজা আমাদের সহিত যুদ্ধ করতে আসছেন।” সীতাদেবী বললেন- “নির্ভয় হয়ে যুদ্ধ করবে । আমার আশীর্বাদ তোমাদের সুরক্ষিত করবে। তোমাদের কেহ পরাজিত করতে পারবে না।” লব ও কুশ সীতাদেবীকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন, সেই যুদ্ধের স্থানে গেলেন। দেখলেন আবার জঙ্গল কাঁপিয়ে ধূলা উড়িয়ে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র আসলেন । পিতা ও পুত্রের মধ্যে যুদ্ধ দেখবার জন্য গগনে দেবতারা আসলেন। লব ও কুশ অনান্য আশ্রম বালক দের বলল- “তোমরা রাম নাম নিয়ে হনুমানকে মত্ত করে আশ্রমে নিয়ে গিয়ে রজ্জু দ্বারা আবদ্ধ করবে। কারণ রামনাম শ্রবণ করা মাত্রই হনুমান সব কিছু ভুলে যান।”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৬ )

বাল্মিকী মুনির তপোবনে যে শিবির রচনা করা হয়েছিলো, সেখানে পূর্ব হতেই নিদারুন আহত শত্রুঘ্ন শয়ন করে মৃত্যুর সাথে লড়ছিলো। সেই শিবিরে মূর্ছিত ভরতকে এনে রাখা হল । চারিদিকে আহত সেনার আর্তনাদ ভিন্ন অপর কিছুই শোনা গেলো না । দুই বালক অসম্ভব যোদ্ধা। যুদ্ধে সুনিপুণ। চোখের পলকে দিব্যাস্ত্র সকল চালনা করে শত্রু নাশ করে। অপরদিকে আশ্রমের বালক বালিকারা ছিন্ন বিছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে কেয়ুর, বাজু, অঙুষ্ঠ, কীরিট সকল সংগ্রহ করে একত্র জমা করেছিলো। সেই সকল অলঙ্কার হতে সূর্যের ন্যায় জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল্ল। মনে হচ্ছিল্ল বনের মাঝে দিবাকর দেব এসে উপস্থিত হয়েছেন । দূত গেলো অযোধ্যায়। গিয়ে বলল- “মহারাজ! সেই দুই বালক তিন অক্ষৌহিণী সেনার বিনাশ করে শ্রীভরতকে মূর্ছিত করেছেন। আমরা অনেক চেষ্টাতেও সেই অশ্ব উদ্ধার করতে পারিনি।” শুনে সকলে আরোও বিস্মিত হলেন। এই বালক কাহারা। সত্যি কি বালক নাকি ছদ্দবেশী দেবতা বা কোন বড় অসুর। সাধারণ সেই বালক কিভাবে এমন দুর্ধর্ষ সেনাদের বিনাশ করে ভরতের ন্যায় শক্তিশালী যোদ্ধাকে মূর্ছিত করতে পারে । মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র অবাক হলেন। লক্ষ্মণ এসে বললেন- “অগ্রজ! এবার আমি গিয়ে অশ্ব উদ্ধার করে আনবো। দেখি তারা কেমন বীর! আমাকে বহু পূর্বে প্রস্থান করা উচিৎ ছিলো, তবে আমার দুভ্রাতা এমন আহত , মূর্ছিত হয়ে থাকতেন না । সেই দুই বালক তপস্বী হোক আর দেবতা হোক কিংবা মায়াবী কোন অসুর হোক- মেঘনাদজয়ী লক্ষ্মণের শর থেকে মুক্তি পাবে না।” মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “শান্ত হও লক্ষ্মণ। তোমার ক্রোধ জগদবিদিত। সেই অশ্ব অবশ্যই আনবে। তবে ঐ বালকের ওপর সাঙ্ঘাতিক প্রহার করে নয়- বরং বুঝিয়ে সুঝিয়ে। বালক দ্বয় কে বলবে ঐ অশ্বের পরিবর্তে তাহারা যত অশ্ব চায়- তাহাই প্রদান করিবে। সেই বালক দ্বয় লক্ষ স্বর্ণ রথের পরিবর্তে যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দিতে চাইলে তাহাই দেবে। ভূমি চাইলে ভূমি প্রদান করবে। কিন্তু কদাপি দুর্বল বালকের ওপর দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করবে না।”

লক্ষ্মণ বলল- “তাহাই হইবে ভ্রাতা! প্রথমে আমি তাহাদিগকে প্রলোভন দেখিয়ে অশ্ব প্রাপ্তির চেষ্টা করবো। যদি তাহারা না মানে ত , তাহারা লক্ষ্মণের বিক্রম দেখবে।” চার অক্ষৌহিণী সেনা সমেত লক্ষ্মণ বের হল। প্রকাণ্ড হস্তী গুলি মেদিনী কাঁপিয়ে বের হল। অশ্ব গুলি নিয়ে বের হল। রথ বের হল। নানা অস্ত্র নিয়ে অয্যোধ্যার সেনারা হৈহৈ করতে চলল। বিবিধ দামামা, তুরী, ভেরী বাজলো। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলল। এই দুই বালক সামান্য কেহ নহে। তাই সেনা সকল উত্তম ঘাতক অস্ত্র সকল নিলো। তূণ পূর্ণ করলো তীক্ষ্ণ শরে। গদা, তরবারি, মুষল, শেল, শূল , ঢাল, খড়্গ আদি অস্ত্র সকল নিয়ে যুদ্ধে চলল। লব ও কুশ সেই বনে অশ্বের সাথে খেলা করছিলো। অশ্বটি সেই স্থানে উত্তম রূপে ভোজন করলো। কচি কচি তৃণাদি ভক্ষণ করেছিলো। পুনঃ দেখা গেলো জঙ্গল কাঁপছে। কুশ বলল- “ভাই লব! মনে হচ্ছে অযোধ্যা থেকে নিশ্চয়ই এবার মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র এসেছেন। দেখা যাক এবার ওঁনার শক্তি কত।” জঙ্গল কাঁপিয়ে চার অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে লক্ষ্মণ এসে দাঁড়ালো। দেখলো চারপাশে কেবল সেনাদের দেহের স্তূপ। চারপাশে রক্ত নদীর ধারা বয়ে যাচ্ছে। কাটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে চারিদিকে মেদিনী আচ্ছন্ন হয়ে আছে । ইহা দেখে লক্ষ্মণের অতিশয় ক্রোধ জন্মালো। কিন্তু তবুও মহারাজের আদেশে শান্ত ভাবে বলল- “বালক! তোমরা আমাদের বহু সেনাকে বধ করেছো। আমার দুভ্রাতাকে আহত করেছো। তবুও মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের আদেশে আমি সৌজন্য দেখাচ্ছি। ঐ যজ্ঞের অশ্ব কি প্রয়োজন? তোমরা বরং লক্ষ অশ্ব, লক্ষ হস্তী, লক্ষ স্বর্ণ রথ প্রার্থনা করো। এখুনি আমি প্রদান করবো। কিন্তু ঐ যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দাও।” লব ও কুশ বলল- “তোমরা সূর্যবংশীয়রা এত জ্ঞানী- অথচ ইহা জানো না যে তপস্বী বালকদের অশ্ব, হস্তী, সোনার রথে কি প্রয়োজন ? যজ্ঞের অশ্ব আমরা ধরেছি এই কারণে যাহাতে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র এখানে আসেন। আমরা তাহার সহিত যুদ্ধের অভিলাষ রাখি।”

লক্ষ্মণ বলল- “বালক! তোমাদের সেইদিন মধুর সঙ্গীত শুনে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অন্তরে করুণা, মমতা আছে। দয়া করে অর্বাচীন মন্তব্য করে সেই করুণা মমতা কে ধ্বংস করো না। নচেৎ আমি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো। মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করবার দিবাস্বপ্ন ত্যাগ করো। তোমাদের এখনও সেই যোগ্যতা হয় নি । তাই উত্তম রূপে পুনঃ বলছি যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দাও। বিনিময়ে যাহা ইচ্ছা প্রার্থনা করতে পারো।” লব ও কুশ বলল- “আমরা দুভ্রাতা আপনাদের যুদ্ধে পরাজিত করেছি, তাহার পরেও কি আপনার আমাদের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ হয়। তবে বলবো আপনার যুদ্ধবিদ্যা অসম্পূর্ণ। যুদ্ধবিদ্যায় কদাপি শত্রুকে শক্তিহীন ভাবতে নেই। ইহা এক প্রকার মূর্খতা। যান পুনঃ গুরু আশ্রমে গিয়ে যুদ্ধ বিদ্যা শিখে আসুন।” এই বলে লব ও কুশ হাস্য করতে লাগলো। লব , কুশের হাস্য লক্ষ্মণের বুকে শেলের ন্যায় বাজলো। ক্রোধে লক্ষ্মণ দাঁত কটমট করে বলল- “অবাধ্য বালক। তোমরা আমার বীক্রম জানো না। লঙ্কার যুদ্ধে আমি বহু রাক্ষসকে নাশ করেছি। ইন্দ্রজিৎ, বীরবাহু আদি যোদ্ধাদের বধ করেছি। তোমরা আমার যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করো? এর ফল ভুগবে। যদি বাঁচতে যাও, ত এখুনি অশ্ব ফিরিয়ে দাও।” লব ও কুশ ত নারাজ । হৈ হৈ করে অযোধ্যার সেনারা ছুটলে লব ও কুশ ব্রজবাণ নিক্ষেপ করলো। সেই বাণের প্রভাবে অযোধ্যার সেনাদের ওপর স্বশব্দে বজ্রপাত হতে লাগলো। দেখতে সেনা সকল, হস্তী, রথ, অশ্বগুলি পুড়ে যেতে লাগলো। চোখের নিমিষে দুই বালক কালবাণ নিক্ষেপ করলে প্রচন্ড ধূমে সেনারা আচ্ছন্ন হয়ে দম আটকে ভূলোক ত্যাগ করলো। দুই বালক এত ক্ষিপ্র গতিতে বাণ নিক্ষেপ আরম্ভ করলো যে অয্যোধ্যার রথ সকল চূর্ণচূর্ণ হয়ে গেলো। পালটা আঘাত বা ঢাল তুলবার সময় পেলো না। লক্ষ্মণ এবার ধনুকে নানা অস্ত্র প্রকট করে বালকদের দিকে ছুড়তে থাকলেন। লব ও কুশ তাহা চূর্ণ করতে লাগলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৫ )

ভগ্নদূত বিষন্ন হয়ে অযোধ্যা চলে গেলো। মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র শত্রুঘ্ন আদি সেনা অশ্ব কে দেখতে না পেয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলো। দূত সব কিছু ব্যক্ত করলো। বলিল- “মহারাজ! মহর্ষি বাল্মিকীর সহিত যে দুইজন বালক এসেছিলো তাহারা কেবল সঙ্গীত শিক্ষা নয়, অস্ত্র শিক্ষাও উত্তম রূপে প্রাপ্তি করেছে। তাহারাই অশ্ব আটক করে রেখেছে। শ্রীশত্রুঘ্ন তাহাদের হস্তে পরাজিত হয়ে নিদারুন আহত হয়েছেন। দুই বালক একাই বহু সেনা নাশ করেছে। মহর্ষির আশ্রমে রক্ত নদীর ধারা প্রবাহিত হয়েছে।” ভগবান শ্রীরাম অবাক হলেন। সকল পার্ষদেরা অবাক হল। ঐ দুই কোমল বালকের এত শক্তি যে লবণ অসুর বধকারীকে মূর্ছিত করে বহু বীর সেনা নাশ করেছে! তাহাদের বয়সী বালকেরা সামান্য ধনুর্বাণ তুলতেই পারে না। আর তাহারা দিব্যাস্ত্র সকল চালনা করছে। কে সেই বালক? মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র কিছুক্ষণ ভাবলেন । ভরত এসে বলল- “অগ্রজ! পূর্বে একবার আমদিগের বংশের পূর্বপুরুষ রাজা সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব দেবরাজ পুরন্দর হরণ করে যজ্ঞ পণ্ড করেছিলেন। বোধ হয় দুই বালকের বেশে কোন দেবতা আবির্ভূত হয়েছে। শত্রুঘ্নকে পরাজিত করেছে তাহারা। কিন্তু ভরতের বিক্রম দেখেনি। কৃপা করে আমাকে অনুমতি দিন। আমি অশ্ব ফিরিয়ে আনবো।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “যাও ভ্রাতা! তবে দুই বালক কে বধ করবে না। প্রথমে তাহাদের প্রলোভন দেখিয়ে অশ্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেবে। যদি না মানে তবে তাহাদিগকে বন্দী করে অশ্ব নিয়ে আসবে।” তিন অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে ভরত গমন করলো। সকলে দুই বালকের প্রতাপের কথা শুনে অতি বিস্মিত হল। তপোবনে আশ্রম বালকেরা সেই যজ্ঞ অশ্ব নিয়ে খেলা করছিলো। মাতা সীতা দেবী কিছুই জানেন না। তিঁনি দুর্গা দেবীর ব্রত করছিলেন । দুই বালক ধনুর্বাণ উঁচিয়ে অশ্ব প্রহরা দিতে লাগলো।

হঠাত দেখলো সামনে জঙ্গল কাঁপিয়ে কোটি কোটি সেনা আসছে। হস্তীগুলির পদচালনায় মেদিনী কাঁপছে। অশ্বের খুঁড়ের সাথে সাথে ধূলির ঝড় উঠেছে। অসংখ্য সেনার কোলাহলে বৃক্ষের পাখ পাখালী ভয়ে আকশে উড়ে যাচ্ছে। রথের চাকার আওয়াজ ক্রমাগত শোনা যাচ্ছে । ভরত সেই সময় তিন অক্ষৌহিণী রথ নিয়ে আসলো। ভরত দেখলো চারপাশে সেনাদের দেহ, হস্তী- অশ্ব ও রথের ভগ্ন টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । মনে হয় যেনো এখানে শক্তিশালী দুই রাজার যুদ্ধ হয়েছে । কে বিশ্বাস করবে যে ঐ দুই বালক মিলে এত সেনা নাশ করেছে । ভরত মিষ্ট ভাষায় বলল- “বালক! তোমদের দেখে কোনরূপ ক্রোধ নয় বরং স্নেহ উৎপন্ন হচ্ছে। তোমাদের দেখে আমার হৃদয় বিগলিত হচ্ছে । তোমরা অতি বালক। জানি ক্রীড়াচ্ছল্লে অশ্ব আটক করে তোমরা আমার ভ্রাতা শত্রুঘ্ন কে মূর্ছিত করেছ। তোমরা বীর। কিন্তু এই অশ্ব সাধারণ অশ্ব নয়। ইহা অযোধ্যা সম্রাট মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব। ইহা ফিরিয়ে দাও- নচেৎ যজ্ঞ সফল হবে না । তোমরা চাইলে এখুনি আমি তোমাদের এইরকম সদৃশ শত অশ্ব প্রদান করবো। তোমরা তাহা নিয়ে ইহা ফিরিয়ে দাও।” লব ও কুশ বলল- “অশ্ব আমরা কেবল মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রকে ফিরিয়ে দেবো। আপনাকে নয়। ওঁনাকে যুদ্ধে আসতে বলুন। দেখি উনি কেমন বীর। আমাদের বালক বলে উপহাস করছেন, যুদ্ধের সময় ইহার সমুচিত উত্তর দেবো। সাপ ছোট হোক আর বড়- উভয়ের বিষ প্রাণঘাতী হয়। সুতরাং আমাদের বালক বলে উপহাস না করে যুদ্ধ করুন বা অযোধ্যায় ফিরে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রকে যুদ্ধে প্রেরণ করুন।” লব কুশের এমন উত্তর শুনে ভরত ক্রোধাম্বিত হল। বলল- “তোমরা বড় দাম্ভিক বালক। তোমরা বরং হস্তে সঙ্গীতের জন্য বীনা ধারণ করো। তোমাদের এই বয়স যুদ্ধ করবার জন্য নয়। সুতরাং অবাধ্য না হয়ে শান্তি মতো অশ্ব ফিরিয়ে দাও।” লব কুশ বলল- “আপনি বাক্যবাণ প্রয়োগ না করে ধনুক থেকে বাণ নিক্ষেপ করুন- দেখি আপনি কেমন বীর আর দেখি এই যুদ্ধে কে পরাজিত হয়!”

ভরতের ইশারা তে অয্যোধ্যার সেনারা পাশ, রজ্জু নিয়ে লব কুশকে বন্দী করতে অগ্রসর হলে লব ও কুশ বায়ুবাণ নিক্ষেপ করলো। উভয়ের অস্ত্রে বণে যেনো প্রলয় ঝড় উঠলো। বড় বড় বৃক্ষগুলি হেলে গিয়ে যেনো ভূমি স্পর্শ করলো এত সেই প্রলয় বায়ুর তেজ। সেই সকল সেনারা বহু ঊর্ধ্বে উঠে ভূমিতে পড়ে পঞ্চত্ব লাভ করলো। অনান্য সেনারা হৈ হৈ করে ছুটলো। লব ও কুশ পর্বত বান নিক্ষেপ করা মাত্রই বিশাল এক পর্বত গগন থেকে সশব্দে তাহাদের ওপর পতিত হল। ভরত এই যুদ্ধ দেখে অবাক । লব ও কুশ “চক্রবাণ” নিক্ষেপ করে সেনা সকল, হস্তী, অশ্ব গুলি দ্বিখণ্ড করলো। রথ গুলি টুকরো হল। অয্যোধ্যার সেনারা বর্শা, শর, গদা নিক্ষেপ করলো। আকাশ অন্ধকার হয়ে সেগুলো আসতে থাকলে লব ও কুশ অগ্নিবাণে সেসকল ভস্ম করে দিলো। সেই সকল অস্ত্র ভস্ম হয়ে বাতাসে মিলে গেলো। ভরত ধনুক থেকে লক্ষ লক্ষ বাণ নিক্ষেপ করে চারপাশে ঢেকে দিলো, পালটা লব ও কুশ লক্ষ বাণ নিক্ষেপ করে সে সকল অস্ত্র চ্ছেদন করলো। ভরতের দিব্যাস্ত্র সকল চূর্ণ করলো। ভরত ভাবল এবার অতি ক্ষমতাসম্পন্ন দিব্যাস্ত্র সকল নিক্ষেপ করতে। ভরত অর্ধচন্দ্র ও চক্রবাণ নিক্ষেপ করলো। লব ও কুশ সূর্যবাণ ও তেজবাণ নিক্ষেপ করে ভরতের অস্ত্র ধ্বংস করলো। ভরত একে একে যমবাণ, অগ্নিবাণ, সূচীমুখ, শিলামুখ অস্ত্র সকল ছুঁড়তে লাগলো। লব ও কুশ কালবাণ, বরুণবাণ, মহামুখ, সুমুখ অস্ত্র নিক্ষেপ করে ভরতের অস্ত্র সকল চূর্ণ করলেন। ভরতের মায়াবাণ, যক্ষবাণ ধ্বংস করে দিয়ে লব কুশ এমন ভাবে বাণ চালনা আরম্ভ হল, যে ভরতের আশেপাশে সকল সেনার হাত , পা, মুণ্ড কেটে বহু দূরে চলে গেলো। ভরতের ধনুক, রথ চূর্ণ হল। লব ও কুশ ধূম্রবাণ নিক্ষেপ করলো। ভরত মূর্ছা গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৪ )

বাল্মিকী মুনির আশ্রমের তপোবনের সম্মুখে কচি কচি তৃণ ভক্ষণ করতে করতে অশ্ব একেবারে লব কুশের সামনে চলে গেলো। এত সুন্দর অশ্ব দেখে আশ্রমের বালকেরা অবাক হল। সেই স্থানে কেবল ছোটো ছোটো বালকেরা খেলা করছিলো। লব ও কুশ এসে অশ্ব চিনতে পারলো। ইহা সেই মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব । দুই ভ্রাতা একত্রে ফন্দী আঁটলো। যুক্তি করে অশ্ব ধরল। বলল- “ইহা সেই কর্তব্য পরায়ণ নির্দয় মহারাজের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব। যিঁনি কর্তব্য পালনের জন্য সতী নারী স্ত্রীকে ত্যাগ করেছেন। এবার ওঁনাকে এই অশ্বের মারফৎ এনে পরাস্ত করতে হবে।” আশ্রমের অনান্য বালকেরা অশ্ব দেখে তাহার পৃষ্ঠে, মস্তকে হস্ত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এত সুন্দর অশ্ব তাহারা কেহই দেখেনি । লব ও কুশ লতা পাতা দ্বারা অশ্বকে লাগাম পড়িয়ে বৃক্ষের সাথে বেঁধে রাখলো। অশ্বের কপালে জয়পত্র লেখা দেখে দুভ্রাতা বলল- “এবার দেখবো কে আমাদের পরাজিত করে অশ্ব নিয়ে যায়।” অপরদিকে অয্যোধ্যার সেনারা ফিরতে প্রস্তুত হলে দেখা গেলো অশ্ব নেই। খোঁজবিন পড়লো। অশ্ব গেলো কোথায়। কেহ ভাবল অশ্ব না জানি গভীর বনে চলে গেছে, কেহ বলল ব্যাঘ্রে নিয়ে যেতে পারে। শত্রুঘ্ন সমস্ত কিছু শুনে সেনাদের ধমক দিয়ে অশ্ব খুঁজতে বলল। বলিল- “শীঘ্র অশ্ব খুঁজে আনো। সেই অশ্ব বিনা অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে না। অসমাপ্ত যজ্ঞে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের নামে কলঙ্ক লেপন হবে। দেবতারা রুষ্ট হবেন । এই স্থানে কোন রাজা নেই যে অশ্ব ধরবার দুঃসাহস করবে। নিশ্চয়ই অশ্ব গভীর বনে গেছে।” সেনারা খুঁজতে খুঁজতে সেই মুনির তপোবনে আসলো। লব , কুশ কে দেখে বলল অশ্ব ফিরিয়ে দিতে। লব ও কুশ ত নারাজ । বলিল- “মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র আসুন। তাঁর সহিত আমরা যুদ্ধ করবো। যদি তিঁনি বীর হন, তবে আমাদের পরাজিত করে অশ্ব নিয়ে যেতে পারেন।” সেনারা অনেক বুঝিয়ে বিফল হয়ে ফিরে এলো।

অপরদিকে মাতা সীতাদেবী, তিঁনিও কিছু জানতেন না। তিঁনি এসে পুত্রদের বললেন- “বাছা। আমি দুর্গা দেবীর ব্রত আরম্ভ করেছি। তোমরা শীঘ্র নীল কমল সংগ্রহ করে আনো।” লব কে প্রহরায় রেখে কুশ পদ্ম আনতে চলল। অপরদিকে শত্রুঘ্ন শুনে হাস্য করলো যে দুই তপস্বী বালক অশ্ব ধরেছে। শত্রুঘ্ন সেনা সমেত চলল। গিয়ে দেখলো এ সেই বালক, যারা অযোধ্যায় রামায়ন গান শোনাতে এসেছিলো। শত্রুঘ্ন বলল- “বালক। তুমি সেই, যাঁর কণ্ঠে দেবী বীণাপাণি বিরাজ করেন। নিশ্চয়ই তুমি ও তোমার ভ্রাতাই এই অশ্ব ধরেছে। তোমার ভ্রাতা কোথায় ? শোনো। শীঘ্র অশ্ব ফিরিয়ে দাও। আমি তোমাদিগকে অনেক ধন রত্ন অলঙ্কার প্রদান করবো। এই যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে আমাকে এখন অযোধ্যা ফিরে যেতে হবে।” লব বলল- “আমি বনবাসী। ধন রত্নে কিবা প্রয়োজন! যতক্ষণ মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র নিজে না আসবেন, এই অশ্ব আমি ফিরিয়ে দেবো না। আপনি গিয়ে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রকে বলুন এখানে এসে অশ্ব নিয়ে যান। আপনি এখন প্রস্থান করুন।” শত্রুঘ্ন অনেক বোঝালো। লোভ প্রদর্শন করল। কিন্তু লব নারাজ । শত্রুঘ্ন ক্রুদ্ধ হয়ে বলল- “বালক! তুমি এতটা যোগ্য না যে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করবে। তুমি বোধ হয় অশ্বমেধ যজ্ঞের নিয়ম জানো না। যে অশ্ব ধরার দুঃসাহস করে, সে মিত্রতা গ্রহণ না করলে তাকে যুদ্ধে পরাজিত করাই এই যজ্ঞের নিয়ম। তুমি বালক। তোমার ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ করলে নিজ বীরত্বের অপমান হবে। অন্তিম বার বলছি অশ্ব ফিরিয়ে দাও।” লব বলল- “তবে যুদ্ধই হোক!” অয্যোধ্যার সেনা বাহিনী সকল ছুটলে লব শিলা বাণ নিক্ষেপ করলো। প্রচণ্ড গর্জন করে শিলাবাণ ঊর্ধ্বে উঠে শত শত বৃহৎ শিলায় রূপান্তরিত হয়ে শত শত শিলা অয্যোধ্যার সেনাবাহিনীর মধ্যে পড়তে লাগলো। দেখতে দেখতে বৃহৎ হস্তী সকল ভূপতিত হল। রথ গুলি চূর্ণ হল। অশ্ব গুলি প্রস্তর চাপা পড়ে পিষ্ট হল। এত ক্ষতি দেখে শত্রুঘ্ন অবাক হল। অবাক হয়ে বালকের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ হল।

বালকের দিকে নানা দিব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলো। লব নানান দিব্যাস্ত্রে সেই সকল অস্ত্র চূর্ণ করলো। হঠাত লবের ধনুকের ছিলা ছিঁড়ে গেলো। সেই সময় শত্রুঘ্ন পাশবাণ নিক্ষেপ করে লব কে বন্দী করলো। সেনাদের বলল- “ইঁহাকে বন্দী করে যজ্ঞ অশ্ব নিয়ে অযোধ্যায় চলো। নিয়ম মতোন বন্দী করেই নিতে হয়। এই বালক সত্যি বীর ছিলো।” এই বলে শত্রুঘ্ন লবকে রথে তুলে অশ্ব নিয়ে চলল। অপরদিকে কুশ এসে সীতাদেবীকে পদ্ম সকল দিয়ে সেই স্থানে এসে দেখে অশ্ব ও লব নেই। আশ্রমের বালকেরা জানালো সব ঘটনা । কুশ তখন “আকর্ষণী বাণ” নিক্ষেপ করলো। সেই বাণ ছুটে গিয়ে শত্রুঘ্ন তাহার সেনা, যজ্ঞের অশ্ব সব কিছুকে আকর্ষণ করে সেই স্থানে নিয়ে এলো। সকলে অবাক হল। কেউ যেনো পেছন থেকে প্রবল আকর্ষণে নিয়ে এসেছে । কুশ বলল- “মথুরা নরেশ। এই আপনার বীরত্ব যে অস্ত্রহীন বালক কে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছেন। এবার আমার বীরত্ব দেখুন।”বলে কুশ সবার প্রথমে লবকে পাশ মুক্ত করে উদ্ধার করলো। লব নিজ ধনুকে পুনঃ ছিলা জড়ালো। দুভ্রাতা ধনুক থেকে এত বাণ নিক্ষেপ করলো যেনো সেই সকল বাণ জলন্ত উল্কাপিন্ডের ন্যায় অযোধ্যার সেনার ওপর আছ্ড়ে পড়লো। হূলস্থূল পড়ে নিমিষে অযোধ্যার সেনা সকল নাশ হতে লাগলো। বীর শত্রুঘ্ন যক্ষবাণ, কালপাশ, বজ্রবাণ, মরুতবাণ নিক্ষেপ করলেন। লব ও কুশ গন্ধর্ববাণ, মহাপাশ, ইদ্রাস্ত্র, সূর্যবাণ নিক্ষেপ করলেন। দেখতে দেখতে শত্রুঘ্নের অস্ত্র গুলি চূর্ণ হল। লব ও কুশ বলল- “এই আপনার বীরত্ব ? কিভাবে এই সামান্য বল নিয়ে আপনি লবণ অসুরকে নাশ করেছিলেন ?” এই বলে লব কুশ বাণ দ্বারা শত্রুঘ্নের রথের দুই চক্র, ধ্বজা কেটে দিলেন । অশ্ব ও সারথি দিগকে বধ করলেন । বাণে বাণে এমন বিদ্ধ করলেন যে শত্রুঘ্ন নিদারুন ক্ষতবিক্ষত হয়ে মূর্ছা গেলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৩ )


যজ্ঞের অশ্ব নানাদিক ঘুরে বেড়ালো। নানা রাজ্যে বিচরণ করলো। অনেক রাজাই শ্রীরামের প্রস্তাব মেনে যজ্ঞে গেলো। কিন্তু দেখা গেলো ভগবান শ্রীরাম যেনো একেবারে দয়ালু মাটির মানুষ । এত আদর, আপ্যায়ন আর বিনয় স্বভাব দেখে সে সকল রাজারা অবাক হল। সকলকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করলেন । এমনকি যে সকল রাজা অশ্ব ধরে যুদ্ধে লিপ্ত হল, তাহাদের বন্দী করে অযোধ্যায় প্রেরণ করা হল। ভগবান শ্রীরাম তাহাদের যথাবিহিত আদর, যত্ন, আপ্যায়ন করে যথাযোগ্য সম্মান দিলেন। সে সকল রাজারা শ্রীরামের আনুগত্যে এসে শান্তি লাভ করলো। সেই সময়ে ক্ষত্রিয় রাজারা পরস্পরের মধ্যে এত যুদ্ধ করতো, যে সর্বদা মারমার কাটকাট লেগেই থাকতো। এই সকলকে একত্র করেছিলেন ভগবান শ্রীরাম। যেমন মহাভারতে আমরা দেখি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়েছিলেন রাজা যুঠিষ্ঠিরকে দিয়ে । সমগ্র ভারতবর্ষের রাজাদের এক শাসন ব্যবস্থার ছত্রতলে এনে শক্তিশালী ভারত রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন । যাই হোক এবার দেখি কোন কোন রাজা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন । পূর্বদেশে ঘোড়া অনেক দূর গেলো। নদ নদী পার করে এক পর্বতের উপর উঠলো। সেই পর্বতের নাম বিরূপাক্ষ গিরি । সেখানকার রাজা অশ্ব ধরলেন । অশ্ব নিতে অয্যোধ্যার সেনারা যাহাতে রাজ্যে না ঢুকতে পারে, সেই জন্য রাজ্যের সীমানায় গড় কেটে অগ্নি সংযোগ করে দিলেন । শত্রুঘ্ন তাঁর দুই অক্ষৌহিণী সেনা সমেত সেখানে আসলেন । দেখলেন আগুন জ্বলছে ।

শত্রুঘ্নের কটক যে দুই অক্ষৌহিণী ।
নিভাইল সে সকল গড়ের আগুনি ।।
গড় মধ্যে প্রবেশ করেন শত্রুঘন ।
শত্রুঘ্নের সহিত রাজার বাজে রণ ।।
রাম সম শত্রুঘন বীর- অবতার ।
শত্রুঘ্নের বাণেতে রাজার চিৎকার ।।
মহাবল শত্রুঘ্ন বাণের জানে সন্ধি ।
হাতে গলে সে রাজারে করিলেন বন্দী ।।
বান্ধিয়া পাঠায় তারে বীর শত্রুঘন ।
রাম দরশনে তার বন্ধন মোচন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইভাবে শত্রুঘ্ন জয়ী হলেন । পূর্ব দিক জয় করলেন । উত্তরদিকে অশ্ব ছুটলো। বায়ুবেগে যজ্ঞের অশ্ব ছুটে চলল। পেছন পেছন শত্রুঘ্ন সেনা কটক নিয়ে চলল। অনেক রাজা বশ্যতা স্বীকার করলেন। কেউ ভাবলেন অশ্ব বন্দী করবেন। কিন্তু লবণ অসুর বধ, হনুমানের বিক্রম শুনে আর সাহস পেলো না । এইভাবে অশ্ব হিমালয়ের দিকে গেলো।

ঘোড়া গেল হিমালয়- পর্বতের পার ।
সেই দেশী রাজা যেই বিক্রমে অপার ।।
ঘোড়া দেখি রাজার ধরিতে গেল সাধ ।
শত্রুঘ্ন রাজার সহিত লাগিল বিবাদ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

সেই রাজার সাথে শত্রুঘ্নের যুদ্ধ আরম্ভ হল । দুজনের দিব্যাস্ত্র ঝঙ্কারে মেদিনী কাঁপতে লাগলো। একে একে রাজার সকল অস্ত্র ধ্বংস করে দিলেন বীর শত্রুঘ্ন । তার পর শত্রুঘ্ন বাণে বাণে রাজাকে আচ্ছাদিত করে দিলেন। শত্রুঘ্নের বাণে সেই রাজার রথ, চক্র, অশ্ব, ধ্বজা, সারথি, অশ্ব সকল ধ্বংস হল। বাণ ফুঁটে রাজা জর্জরিত হল।

না পারে কথা কহিতে অত্যন্ত কাতর ।
তারে বান্ধি পাঠাইল অযোধ্যা নগর ।।
দর্শন দিলেন তারে কমল লোচন ।
তাহাতে হইল তার বন্ধন মোচন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

সেই রাজাকে শ্রীরামচন্দ্র সম্মান প্রদর্শন করে অত্যন্ত বিনয় প্রদর্শন করলেন। রাজাও ক্ষমা চাইলেন রাজা শ্রীরামের কাছে । এরপর অশ্ব পশ্চিম দিকে ছুটলো। সেখানে বিকৃতাকার ব্যাধেরা থাকতো। তাহারা এত অদ্ভুদ ছিলো যে দেখলেই ভয়ে ভীত হতে হত ।

বিকৃত আকার তারা হাতে চেরা বাঁশ ।
হস্তী ঘোড়া মারি খায় যত রক্ত মাস ।।
পিশাচ ভোজন আর পিশাচ আচার ।
জীব জন্তু মারি করে তাহারা আহার ।।
সকল ব্যাধেতে ঘোড়া ঘেরে চারিভিতে ।
কুপিল শত্রুঘ্ন বীর ধনুর্বাণ হাতে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

শত্রুঘ্ন এরপর ব্যাধেদের সাথে যুদ্ধে মগ্ন হল। যুদ্ধ প্রচণ্ড হল। ব্যাধদের পরাজিত করে শত্রুঘ্ন অশ্ব মুক্ত করলো। ব্যাধের সর্দার কে বেঁধে অযোধ্যায় প্রেরণ করলো। তিন দিক জয় করে শত্রুঘ্ন অযোধ্যায় চলল। দক্ষিণে অশ্ব গেলো না। কারণ দক্ষিণের কিস্কিন্ধ্যা ও লঙ্কার রাজা মিত্রতা স্থাপন করেছে । অপরদিকে একদিনের কথা । মহর্ষি বাল্মিকী লব ও কুশকে ডেকে বললেন- “বতস্য! আমি কঠিন সাধনার নিমিত্ত চিত্রকূট গমন করবো। তোমরা তপোবন রক্ষা করো। আমার আসতে বিলম্ব হবে। আশ্রমের সকলের সুরক্ষার ভার তোমাদের ওপর।” এই বলে মহর্ষি বাল্মিকী বিদায় নিলেন । যজ্ঞের অশ্ব বাল্মিকী মুনির আশ্রমের খুব নিকটে ছিলো। দুভ্রাতা খেলা করতে লাগলো। অপরদিকে অয্যোধ্যার কাছাকাছি এসে শত্রুঘ্ন , পবন নন্দনকে বলল- “বীর হনুমান! এখন আমরা অয্যোধ্যার সমীপে। আর কেহ অশ্ব ধরার সাহস করবে না। তুমি অযোধ্যায় ফিরে সংবাদ প্রদান করো যে আমরা শীঘ্রই অশ্ব সমেত ফিরে আসবো। এখন আমাদের সেনারা ক্লান্ত। অশ্ব বড়ই ক্লান্ত। এখানে আমাদের সেনারা বিশ্রাম, আহার, স্নানাদি করবে। অশ্ব এখন তৃনাদি ভোজন করিবে।” হনুমান বিদায় নিলো। সেনারা সকলে যুদ্ধে ক্লান্ত। শিবির রচনা করে বিশ্রাম নিলো। অশ্ব এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে মহর্ষি বাল্মিকীর তপোবনে চলে গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩২)


শিবের অনুচর বাহিনীর কাছে অয্যোধ্যার সেনারা পরাস্ত হয়ে নাশ হতে লাগলো। শত্রুঘ্ন নিজেও ভগবান শিবের অনুচর দের সাথে পেরে উঠলো না । তখন হনুমান যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। গদা দিয়ে রে রে করে তেড়ে গিয়ে ভগবান শিবের অনুচরদের মেরে তাড়াতে লাগলেন। হনুমান স্বয়ং রুদ্রাবতার । তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে জেতা অসম্ভব । তাই ভগবান শিবের অনুচরেরা পরাস্ত হয়ে পলায়ন করতে লাগলো। রাজা চন্দ্রকেতু এই সকল দেখে ভগবান শিবকে স্তব করতে লাগলেন । যুদ্ধভূমিতে রুদ্রদেব আর রুদ্রাবতার মুখোমুখি আসলেন। গগনে দেবতারা ইহা দেখে পিতামহ ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন- “হে প্রজাপতি! এই যুদ্ধ এখন ভয়ানক পরিস্থিতিতে এসেছে। স্বয়ং শিব আর শিবাংশের মধ্যে যুদ্ধ হবে। ইহার ফল কি হইবে ? কে জয়ী হবেন ? যদি ভগবান শিব জয়ী হয়ে রাজা চন্দ্রকেতুকে রক্ষা করেন, তবে ভগবান শ্রীরামের যজ্ঞ বিফল হবে। অপরদিকে মহাদেব স্বয়ং অপরাজিত । তাঁহাকে কে পরাস্ত করতে পারে?” পিতামহ ব্রহ্মা বললেন- “এই পরিস্থিতি কেবল চিন্তার নয়, মহাবিনাশের সূচক। যদি শিবাবতার আর ভগবান শিবের মধ্যে যুদ্ধ হয়, তবে উভয়ের অস্ত্র সংঘর্ষে এই বিশ্বে মহাপ্রলয় আসন্ন হবে। অকালে সব বিনাশ হবে।” দেবতারা একে অপরের মুখ ভয়ে চাওয়চাওয়ি করলেন। এর উপায় কি? পিতামহ ব্রহ্মা বললেন- “এই সমস্যার সমাধান নারদ মুনি ও রাজা চন্দ্রকেতু করতে পারবেন । রাজা চন্দ্রকেতু পরম শিবভক্ত। তাহার প্রার্থনাতেই ভগবান শিব এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। যদি নারদ মুনির পরামর্শে রাজা চন্দ্রকেতু ভগবান শ্রীরামের শরণাগত হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে, তবে মহাপ্রলয় স্তব্ধ হবে।” এরপর প্রজাপতি ব্রহ্মা নারদ মুনিকে বললেন- “পুত্র নারদ! শীঘ্র তুমি মর্তে গমন করে রাজা চন্দ্রকেতুকে ভগবান শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দাও। রাজা চন্দ্রকেতু কোন অসুর নয়। তিনি শিভবক্ত দয়ালু, উদারচেতা রাজা। তিঁনি তোমার এই শুভ প্রস্তাব মেনে নেবেন।”

নারদ মুনি চললেন। রাজা চন্দ্রকেতুকে সব বলে বললেন- “হে রাজন! আপনি দয়ালু, উদার। আপনি ন্যায়- নীতি দ্বারা রাজ্য শাসন করেন । আপনার ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং ভগবান শিব আপনার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের সেবক হনুমানজী নিজেও শিবাবতার। এখন স্বয়ং ভগবান শিব ও শিবাবতারের যুদ্ধ হলে সমগ্র বিশ্ব নাশ হবে। হে রাজন! আপনি কি সকলের বিনাশ কামনা করেন, না সকলের মঙ্গল প্রার্থনা করেন ? আমি জানি আপনি সকলের মঙ্গল কামনা করেন। সুতরাং শ্রীরামের শরণ নিয়ে এই যুদ্ধ বন্ধ করুন। শ্রীরামের সাথে মিত্রতা হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তিঁনি আপনার রাজ্য দখল করবার মানসে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন নি । তাহার এই যজ্ঞের উদ্দেশ্য সমগ্র আর্য্যভূমিতে শক্তিশালী একটি শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন। তিঁনি দখলের নীতিতে বিশ্বাসী নন। রাবণ বধ করে তিঁনি লঙ্কা দখল করেন নি- বরং রাবণের ভ্রাতা বিভীষণের হস্তেই লঙ্কার শাসন ভার ন্যস্ত করেছেন। দেবতাদের ইচ্ছা আপনিও এই মহান যজ্ঞে ভগবান শ্রীরামের প্রস্তাবে সায় দিন। ” রাজা চন্দ্রকেতু বললেন- “হে দেবর্ষি! আপনি যথার্থ বলেছেন। এই যুদ্ধ এখনই বন্ধ করা উচিৎ। নচেৎ বিশ্ব ধ্বংস হলে সব কিছুই নাশ হবে। আমি শ্রীরামের শরণ নিলাম। এই অশ্ব মুক্ত করে আমি তাঁহার যজ্ঞে সামিল হতে চাই।” অপরদিকে ভগবান শিব ও হনুমান মুখোমুখি যুদ্ধে। হনুমান বললেন- “প্রভু! জানি আমি আপনারই অংশ। কিন্তু এই রূপে আমি ভগবান শ্রীরামের সেবক। তাঁহার আদেশ পালণ করাই আমার ধর্ম। তাই আপনার বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছি।” ভগবান শিব বললেন- “বতস্য! ভগবান স্বয়ং ভক্তের বশে থাকেন। রাজা চন্দ্রকেতু আমার ভক্ত। আমার ভক্তের সাথে আমি সর্বদাই বিরাজ করি। সুতরাং তুমি তোমার ধর্ম পালন করো। আমি ভক্তের পাশে থেকে আমার ধর্ম পালন করি।” হনুমান গদা তুলে লম্ফ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ভগবান শিব ত্রিশূল নিয়ে বৃষ থেকে নেমে এলেন। সে সময় রাজা চন্দ্রকেতু এসে বললেন- “হে শম্ভু ! হে ভোলেনাথ! আপনি কৃপা করে এই যুদ্ধ করবেন না। আমি আপনার ভজনা করেছি। কিন্তু অজ্ঞান বশত আপনারই অবতারের সাথে যুদ্ধে নিমগ্ন হয়ে পাপ করেছি।”

এই বলে রাজা চন্দ্রকেতু অশ্ব ফিরিয়ে দিলেন। রাজা বললেন- “প্রভু! আপনাদের দুজনের যুদ্ধে সৃষ্টি নাশ হতে চলেছিলো। যার দায়ী হতাম আমি। স্বয়ং ভগবান শ্রীরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষোনা করে আমি অন্যায় করেছি। আমি ওঁনার শরণাপন্ন হয়ে ওঁনার বৃহৎ যজ্ঞে নিজেকে সামিল করতে চাই।” ভগবান শিব বললেন- “রাজা চন্দ্রকেতু! আমি এই কথাই তোমার মুখ হতে শ্রবন করতে চেয়েছিলাম। যে আমার শুদ্ধ ভক্ত- তার ন্যায়, অন্যায়, ধর্ম, অধর্ম বোধ থাকে । তোমার মধ্যে আমি সেই উন্নত চিন্তা লক্ষ্য করছি। শ্রীরাম হলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি। হরি আর হর অভেদ জানবে। শ্রীরাম সাক্ষাৎ ধর্মের জীবন্ত বিগ্রহ। তুমি সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছো। তোমার কল্যাণ হোক। তুমি বর প্রার্থনা করো।” রাজা চন্দ্রকেতু বললেন- “হে শঙ্কর। হে আশুতোষ! আমার কিছু চাওয়ার নেই। কিছু যদি দিতে হয়, তবে এই যুদ্ধে উভয় পক্ষে যত প্রান হানি হয়েছে সকলকে জীবন প্রদান করুন। আপনি সাক্ষাৎ মৃত্যুঞ্জয়। আপনি যার ওপর সদয় থাকেন, যম তাহার শত ক্রোশের ধার দিয়েও যান না। মার্কণ্ড মুনিকে আপনিই ত পরম আয়ু দিয়েছিলেন।” ভগবান শিব বললেন- “তথাস্তু রাজা চন্দ্রকেতু! তোমার ন্যায় নির্লোভী, উদারচেতা, পরোপকারী ভক্তকেই ত ভগবান খুঁজে বেড়ান। তোমার কল্যাণ হোক। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।” এই বলে ভগবান শিব নিহতদের পুনর্জীবিত করলেন । এরপর রাজা চন্দ্রকেতু নানা উপঢৌকন নিয়ে যজ্ঞে সামিল হতে গেলেন। ভগবান শ্রীরাম সকল কিছু ভুলে রাজা চন্দ্রকেতুকে স্বাগত জানালেন। কুশল মঙ্গলাদি জিজ্ঞাসা করে রাজার ন্যায় যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করলেন । এরপর অশ্ব এগিয়ে চলল। পেছন পেছন শত্রুঘ্ন ও হনুমান চলল। আর চলল অয্যোধ্যার বিশাল বাহিনী ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।