০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাধা রানী অস্বীকারীদের যৌক্তিক উত্তর

আজ রাধারানীর সখী শ্রীললিতা দেবীর আবির্ভাব তিথি। কাল রাধাষ্টমী। বৃন্দাবনেশ্বরী , গোলকপুরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী শ্রীরাধারানীর বৃষভানু কন্যা রূপে আবির্ভাব তিথি। আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেকেই রাধার অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন । এটা সত্য যে “রাধা” দেবীর অস্তিত্ব মহাভারত বা শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন মহাভারত কিন্তু পূর্ণ শ্রীকৃষ্ণজীবনী নয় । এখানে পঞ্চপাণ্ডব ও কুরুপাণ্ডব যুদ্ধ ও শ্রীমদ্ভগবতগীতাই মুখ্য। ঘটনাচক্রে এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আংশিক লীলার পরিচয় পাই । এখানে তিঁনি শান্ত অর্থাৎ পরব্রহ্ম রূপে আত্মপ্রকাশিত। আবার শ্রীমদ্ভাগবতে গুপ্তা দেবী রূপে রাধারানীর উল্লেখ আছে।

রাসলীলার আরম্ভে প্রধানা সখীকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মণ্ডল থেকে- সেটা আছে। গুপ্তা দেবীরূপে রাধারানী সকল ভক্তকে কৃপা করেন। রাধারানী কৃপা না করলে সেই ভক্ত কোটি জন্মেও কৃষ্ণ কৃপা পায় না। রাধারানী কি কাল্পনিক ? মোটেও তা না। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য অনেক লেখক শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র রচণা করেছেন, তাতে রাধারানী প্রসঙ্গ আনেন নি। কারণ বিপ্লববাদে “প্রেম” নয় সুদর্শন ধারী শ্রীকৃষ্ণের রূপ প্রয়োজন।

এখন পরিস্থিতি অনুসারে ভগবানের রূপ ধারণ। অসুর দমন কালে ভগবান কিন্তু অতি ক্রুদ্ধ নৃসিংহ রূপ ধরেছিলেন আবার সেই এক ভগবান রাসমণ্ডলে সখীদের বাসনা পূর্ণ করার জন্য শ্যামসুন্দর বংশীধারী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এমনকি চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি ধারণ করলেও সখীরা সেই রূপে নয় বরং সেই বংশীধারী বনমালা শোভিত কৃষ্ণ স্বরূপকেই কামনা করেছিলেন । আর শ্রীমদ্ভাগবতগীতা বলার সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অদ্বৈতস্বরূপ এ এসে বিরাট ব্রহ্মের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন। সুতরাং গীতায় যে মাধুর্য রসের সাধিকা রাধা ও সখীদের নাম থাকবেই না ইহা বোঝাই যায়।
শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী মহাশয় ব্যক্ত করেছেন-
আত্মেন্দ্রিয়প্রীতি বাঞ্ছা- তারে বলি ‘কাম’।
কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্রীতি- ইচ্ছা ধরে ‘প্রেম’ নাম ।।

“প্রেম” কাহাকে বলে ? একটি ছেলে একটি মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেলো বা পর ধর্মের একজনকে বিয়ে করলো ভালোবাসা করে – সেটি কি ? না তা নয় । ভগবান এর প্রীতির জন্য যে ইচ্ছা তাহাই প্রেম । আর বাকী সব ইচ্ছা “কাম” নামেই পরিচিত। অর্থাৎ ইষ্টদেবের সেবা, আকুতি , মিনতি হল প্রেম । প্রেমের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ রূপে বলে বোঝানো যায় না। কৃষ্ণ ভজনের পথে নিজেই উপলব্ধি করা যায় । এবার আসা যাকা শ্রীরাধারানী প্রসঙ্গে। তত্ত্ব কথানুসারে জীবাত্মা মাত্রই “রাধা” বা প্রকৃতি । পুরুষোত্তম একমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ । জীবাত্মা আর পরমাত্মার যে মিলন হয় তাই “মহারাস”।

 এই মিলন অন্তরে দিব্য স্বরূপে হয়। জড়জাগতিক ভাবে এই মিলনের ব্যাখা বা উপলব্ধি কোনোটাই হবে না । অষ্টসখী ( ললিতা, বিশাখা, সুচিত্রা, চম্পকলতা , সুদেবী, রঙ্গদেবী, তুঙ্গরেখা ও ইন্দুরেখা ) হলেন রাধারানীর ‘পরমশ্রেষ্ঠসখী’। এঁনাদের পথ অবলম্বন করে মঞ্জরী ভাব নিয়ে যুগলের সেবাই সাধনা। গুরু পরম্পরা অনুসারে এই সাধনা গুপ্ত । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবান বিষ্ণু এক । বৈকুণ্ঠধাম হল ভগবান বিষ্ণুর নিবাস। যাঁরা নৃসিংহ, ভগবান শ্রীরাম, বরাহ, বামন, বুদ্ধ আদি অবতারের সাধনা করেন তারা এই বৈকুণ্ঠধাম প্রাপ্ত হন। এমনকি ভগবানের হস্তে নিহত অসুরেরাও এই লোকে আসেন। কিন্তু গোলোকধাম এই বৈকুণ্ঠধামের ওপর। যারা কুঞ্জসেবাদি করেন, তারাই এই ধামে আসেন। মাধুর্য ভাবেই এই ধামে আসা যায় ।

 বস্তুত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাতীত অপর কারোর মাধুর্য সেবা নাই। আর সখীরা চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি নয়, শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপই কামনা করেছিলেন । এই মাধুর্য সেবাই শ্রেষ্ঠ। যথা শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন রায় রামানন্দের সাথে মহাপ্রভুর আলাপ প্রসঙ্গে-
মহাপ্রভু, ভক্ত রায় রামানন্দ সনে এই গোপিনী প্রেমকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছিলেন-

পূর্ব পূর্ব রসের গুণ পরে পরে হয় ।
দুই তিন গণনে পঞ্চ পর্যন্ত বাঢ়য় ।।
গুণাধিক্যে স্বাদাধিক্যে বাঢ়ে প্রতি রসে ।
শান্তদাস্যসখ্যবাৎসল্যেরগুণমধুরেতে বৈসে ।।
আকাশাদির গুণ যেন পর পর ভূতে ।
দুই তিন ক্রমে বাঢ়ে পঞ্চ পৃথিবীতে ।।
পরিপূর্ণ কৃষ্ণপ্রাপ্তি এই প্রেমা হৈতে ।
এই প্রেমের বশ কৃষ্ণ কহে ভাগবতে ।।
( শ্রীচৈতন্যচরিতামমৃত – মধ্যলীলা )

রাধারাণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। স্বামী স্ত্রী যখন একত্র হন তখনই সন্তানের জন্ম হয়। আদিমকাল থেকে এই ভাবেই চলছে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড , কোটি কোটি নক্ষত্র যিঁনি সৃষ্টি করেছেন সেই ব্রহ্ম কে পুরুষ আবার প্রকৃতিও ধরা হয়। যিনি পুরুষ তিনিই প্রকৃতি। রামকৃষ্ণ দেব একজায়গায় বলেছেন- “বেদে যিনি ব্রহ্ম তন্ত্রে তিনিই শক্তি”। সেই পুরুষ প্রকৃতি( শক্তি) রূপ অর্ধনারীশ্বর । শিব আর কালী। কৃষ্ণ আর শ্রীরাধিকা । এই পুরুষ যখন নিস্ক্রিয় হন, প্রকৃতি বা শক্তি হন সক্রিয় । কালীমূর্তি দেখলে দেখবেন, মায়ের চরণে শান্ত অর্ধ নিদ্রিত ঢুলুঢুলু চোখে মহাদেব উপরে দেবীর চোখে তাকিয়ে আছেন, পুরুষ এখানে নিদ্রিত, তিঁনি দেবীর দিকে তাকিয়ে। আবার মা কালী নয়ন নীচে মেলে মহাদেবের নয়নে দৃষ্টি রেখেছেন, তিঁনি সক্রিয় – সৃষ্টি- স্থিতি- লয় করছেন ।

বস্তুত আদ্যাশক্তির রূপ হলেন রাধারানী। শক্তি যখন পুরুষের বামে অবস্থান করেন, তখন সেই রূপ হয় পরিপূর্ণ। দেখবেন কৃষ্ণ বামে মাথা হেলিয়ে সেই ভাবে আদ্যাশক্তি রাধারানীর দিকে তাকিয়ে আছেন, আর রাধারানী বরামুদ্রায় আছেন, অর্থাৎ আশীর্বাদ দিচ্ছেন। শ্রীকৃষ্ণের কোনো এমন ছবি দেখেছেন যেখানে রাধাকে বামে নিয়ে একহাতে বাঁশী ধরেছেন অপর হাতে আশীর্বাদ দিচ্ছেন? এমন দেখা আয় না। ব্রহ্ম এখন শক্তির দিকে চেয়ে আছেন, আর শক্তিরূপিনী রাধারানী আশীর্বাদ করে “কৃষ্ণপ্রেম” প্রদান করছেন । শ্রীরূপ গোস্বামী “উজ্জ্বলনীলমণি” গ্রন্থে লেখেছেন-
হ্লাদিনী যা মহাশক্তিঃ সর্বশক্তিবরীয়সী ।

হ্লাদিনী যে মহাশক্তি যিনি শক্তিগণ দ্বারা পূজিতা । আর সেই রাধারাণী “কৃষ্ণপ্রেম” প্রদান করেন । আপনি যদি সব সময় শ্রীকৃষ্ণের কাছে “প্রেম” চান উনি দেবেন না। গৌড়ীয়া মতে এই প্রেম প্রদান করেন রাধারানী । আর তার জন্য দরকার যুগলের সেবা, আকুতি মিনতি, সদগুরু দ্বারা মঞ্জরী সেবা গ্রহণ। আর চাই শাস্ত্র শ্রবণ, সাধুসঙ্গ , অসৎ আলাপ বর্জন । বস্তুত রাধারানী কাল্পনিক নয়। শ্রীমদ্ভাগবতের গুপ্তা দেবী তিনি । “রাধা” নামে আঁখি ধারা ঝড়লে সেই প্রেমের পথে গোবিন্দ প্রাপ্তি হয় । রাধারানী কাল্পনিক দেবী নন- তিনি বীজমন্ত্রস্বরূপা গুপ্তা দেবী।

সবার সামনে সেই তত্ত্ব প্রকাশ করা যায় না, করেও বোঝানো যায় না। ভজন হয় গোপোনে – মনে মনে। ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে ভজন হয় না, শাস্ত্রীয় তর্ক করেও ভজন হয় না। যারা ভজনহীন , সাধনহীন তাঁহাদিগের কাছে “রাধারানী” হামেশাই কাল্পনিক থাকবেন। আর একদিন তারাও একসময় কাল্পনিক হয়ে যাবেন। কারণ লক্ষ কোটি পশু জন্ম তারপর মানব জন্ম পেয়ে ঈশ্বর সাধনার সুযোগ মেলে- এটাকে হাতছাড়া করা উচিৎ না ।
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।