• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৮ নভেম্বর ২০১৭

হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে?

প্রায়ই আপনার মুসলমান বন্ধুদের কাছে আপনাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। সেটা হচ্ছে - হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে? কবরও তো দিতে পারতো বা অন্যকিছু করতে পারতো।মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা কি অমানবিক নয়?

আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হই!! প্রথমে যে ইনফরমেশনটি আপনার জানা প্রয়োজন তা হলো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ হিন্দু-বৌদ্ধ রীতি অনুসরণ করে অর্থাত মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার করে। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপান থেকে শুরু করে চীন, করিয়া, ভারত ও অনান্য জাতি এই রীতি অনুসরণ করে। তাহলে আপনি প্রথমত: পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন : ১. পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপানিরা কি তাহলে অমানবিক ? পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ কি অমানবিক ? যদি এই অর্ধেক মানুষ অমানবিক হয় তবে এদের মধ্যে কেন আমরা সবচেয়ে কম হানাহানি দেখতে পাই ?

আসুন এবার প্রকৃত উত্তরের দিকে যাই।

১. হিন্দুধর্মে কবর দেয়া বা সমাধি দেয়া নিষিদ্ধ নয়। স্মৃতিশাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই এটা অনুমোদিত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে এখনও এটা প্রচলিত আছে। যেমন- নাথ বা যোগী সম্প্রদায় এবং সন্ন্যাসীদেরকে সমাধি দেয়া হয়। অনেক জায়গায় দেখা যায় কারও অপমৃত্যু হলে তার শব সমাধি দেয়া হয়, পোড়ানো হয় না।

২. আমরা কথ্য ভাষায় 'লাশ পোড়ানো' বলি, কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় এটা 'অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া'। এটা আবার কী? অন্ত+ইষ্টি=অন্ত্যেষ্টি। ইষ্টি মানে যজ্ঞ। অন্ত্যেষ্টি হলো জীবনের শেষ যজ্ঞ।
আমরা জানি, আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ ছিল যজ্ঞপ্রধান। জীবনের শুরু 'গর্ভাধান' থেকে জীবনের শেষ 'দেহত্যাগ' সবই হতো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। জীবৎকালে প্রতিদিনই পঞ্চমহাযজ্ঞ করতে হতো (এখনও করার বিধান)। এছাড়া অগ্নিহোত্র যজ্ঞের মতো বিবিধ যজ্ঞে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে 'হবি' (বর্তমানে পূজায় অর্ঘ্য নিবেদনের মতো) উৎসর্গ করা হতো। এ হলো ঈশ্বরের দেয়া জীবন ও দেহ দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির উপাদানসমূহ ভোগ করার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতাপূর্বক তাঁর উপাসনা করা। তাই অন্ত্যেষ্টি তথা জীবনের শেষ যজ্ঞে ঈশ্বরপ্রদত্ত এই দেহখানি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই 'হবি' বা অর্ঘ্যরূপে উৎসর্গ করা হয়। এটা সত্যিই চমৎকার একটা ব্যাপার!

৩. প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী বিশ্বচরাচর তথা আমাদের দেহও পাঁচটি ভূত বা উপাদান দ্বারা তৈরি। একে 'পঞ্চভূত' বলে। এগুলো হলো- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস), ব্যোম (আকাশ বা শূন্যস্থান)। যারা বলেন 'মাটির দেহ' বা দেহ শুধু মাটি দিয়ে তৈরি, তাই একে মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া উচিৎ, তারা অবশ্যই ভুল বলেন। বাস্তবে দেহ এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। শবদাহ করার মাধ্যমে দেহকে এই ৫টি উপাদানেই মিশিয়ে দেয়া হয় প্রত্যক্ষভাবে। দাহ শেষে অবশিষ্টাংশ জলে বিসর্জন দেয়া হয়। এজন্য শ্মশান সর্বদাই জলাশয়ের পাশে হয়ে থাকে।
অপরদিকে সমাধি বা কবর দিলে দেহ পঞ্চভূতে লীন হয় বটে, তবে পরোক্ষ ও ধাপে ধাপে। কারণ দেহ মাটির সাথে মেশে পঁচন প্রক্রিয়ায়। কোটি কোটি অনুজীব, পোকা-মাকড়ের খাবারে পরিণত হয় দেহ। এভাবে পঁচে গলে মাটিতে মেশানোই বরং দাহ করার চেয়ে বেশি অমানবিক মনে হয়।

একটা মজার তথ্য দিই। অনেক সময় আমরা বলি, লোকটা তো মরে ভূত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সে প্রকৃতিতে (পঞ্চভূতে) লীন হয়েছে -এটাই বুঝতে হবে।

৪. মৃত্যু হয় দেহের; আত্মার নয়। অবিনাশী আত্মা অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। এটা জগদীশ্বর পরমাত্মার অংশ। ('বিদ্রোহী' কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে কি?) জড় প্রকৃতির পঞ্চভূতে গড়া দেহ ফিরে যায় পঞ্চভূতে, আর জীবাত্মা ফিরে যায় পরমাত্মাতে। (মৃত্যুর পরে অবশ্যই আর কখনোই আপনি পুরনো দেহে ফিরে আসবেন না, বা কোন প্রকার শাস্তি/আজাব ভোগ করবেন না। শবদাহ করার পরে/মাটিতে মিশে যাওয়ার পরে নিশ্চয়ই লীন হওয়া দেহকে শাস্তি/আজাব যৌক্তিকভাবে সম্ভব নয়।)

৫. মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শোকের কোন ব্যাপার নয়। তীর্থস্থান বেনারস বা কাশীতে মৃত্যুও একটা উৎসবের ব্যাপার।
"জাতস্য হি ধ্রুবর্মৃত্যো ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ"-
গীতাঃ-(২/২৭)
যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরেছে তার জন্মও নিশ্চিত।

অতএব, অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়।।
বরং জরাজীর্ণ রোগশোকে আক্রান্ত দেহ ছেড়ে জীবাত্মার নতুন সুস্থ-সুন্দর দেহে জীবন আরম্ভের প্রাক্কালে মৃতকে হাসিমুখে বিদায় জানানোই উচিত.....।।

Collected from: Subro Nill Suvo
Share:

বৈদিক সনাতন ধর্মে(হিন্দু) বিবাহ- পর্ব ০২

বৈদিক বিবাহের সাত পাকের দ্বিতীয় পাক বাড়ানোর সময়েও বর বলেন “বিষ্ণুরূপ আমি প্রিয়ে! আমি তোমার ভার গ্রহণে সমর্থ। প্রথম উক্তির উত্তরে বধূ নিজের আনন্দ প্ৰকাশ করেন, দ্বিতীয় উক্তিতে তিনি বলেন “চিরদিন শক্তিরূপে বিরাজিব আমি তব বাম পার্শ্বভাগে। দুঃখে ধৈৰ্য ধরব, হৃষ্টচিত্ত হয়ে সুখে তোমার কুটুম্বদের নিত্য হাসিমুখে নিয়ত সেবা করব।” এই রকম ৪র্থবারে বরের উক্তি, “ধীরে সতী ধীরে। চতুর্থ চরণ ফেল, মোর গৃহ পানে চল সুখে অবহেলে তবলোকে লুকাবে আঁধারের রাত্ৰি, সকল সুখের মোর তুমি অধিষ্ঠাত্রী।” যষ্ঠ পাক বাড়ানোর সময় বধূর উক্তি “সৰ্ব্বকাৰ্য্যে তব বামে করি অধিষ্ঠান, সম্পাদিব মনের হরষে! যা করাবে তুমি, তব অনুগামী আমি-সেই ভাবে করব পালন। আমি তব অর্দ্ধাঙ্গিনী আমি তব পরিচালিকা।” সপ্তম পদ গমনেব সময় বরের উক্তি,-"প্রিয়তমে লো সঙ্গিনী। এ মহামুহুৰ্ত্তে তুমি এস সপ্তপদ। ভূ-আদি সপ্তলোকে যা কিছু সম্পদ তোমার অধীন হোক্‌। আমি বিষুরূপ! হে অনুগামিনী, তুমি বুঝে স্বরূপ, এস মোর গৃহপানে এস গৃহলক্ষ্মী।" এখানেও বধূর উক্তিও মহান। সপ্তপদ গমনের পর বর বলেন “আমরা সপ্তপদ গমন করেছি, আমরা পরস্পর পরস্পরের সখা, আমরা যেন অবিযুক্তই থাকি, যেন আমরা উভয়ে পরামর্শ ক’রে সংসার পথে বিচরণ করি’ ইত্যাদি।

বিবাহের কয়েকটি মন্ত্রে উল্লেখ আছে-শুধু অনুবাদ অংশ তুলে ধরছি-

- আমাদের মন দেহ এক হোক, আমাদের অবিভক্ত যুগল হৃদয়ের দ্বারা আমাদের জীবন-ব্রত সিদ্ধিলাভ করুক, তুমি ঋক, আমি সাম, তুমি ভূলোক, আমি দ্যূলোক, আমি মন, তুমি ভাষা। তুমি আমার অনুব্রতা হও। হে সত্যপ্রিয়ে! তুমি শ্রীরূপে, ঐশ্বর্য্যে ও পুত্র জননীরূপে প্রতিষ্ঠিতা হও। যুগল-আত্মা আমাদের অভেদ, যুগল-হৃদয় আমাদের অভেদ, নাভি, শরীরও অভেদ, তুমি আমার অনুব্রতা হও। আমার ত্বকের দ্বারা তোমার ত্বক, মাংস দ্বারা তোমার মাংস, অস্থির দ্বারা তোমার অস্থি-আমার প্রাণের দ্বারা তোমার প্রাণ ধারণ করছি। আমার ব্রতে তোমার হৃদয় সন্নিবিষ্ট কর, আমার চিত্ত তোমার চিত্ত অনুয়ায়ী হোক। একই ধ্রুব-ভূমিতে দ্যুলোক, ভূলোক ও সমস্ত জগত প্রতিষ্ঠিত সেরুপ অচর ধ্রুবরূপ পরম কল্যাণের দ্বারা এই স্ত্রী প্রতিকূলে সুপ্রতিষ্ঠিতা হয়ে বিবাহ করুক। অন্নময় দেহের দ্বারা, মণিময় প্রাণসূত্রের দ্বারা, সত্যগ্রন্থির দ্বারা আমি তোমার হৃদয় মন বেঁধে ফেলেছি, তোমার হৃদয় আমার হােক, এই আমার হৃদয় তোমার হােক।” কন্যাগৃহে বর বধূর দিকে চেয়ে, বধূর অবয়ব নিরীক্ষণ ক’রে বলেন, (‘অঘোর পতিঘ্নোষি-চতুষ্পদ’) “বধু! তুমি স্নিগ্ধদৃষ্টিসম্পন্ন হও, পতিকুলের কল্যাণদায়িনী হও, তোমার হৃদয় অমৃতে পূর্ণ হােক, তােমার দৃষ্টি জ্যোতিঃ হ্মরণ করুক, তুমি দেবভক্ত হও, তোমার কীৰ্ত্তি বিশ্বব্যাপিনী হােক, তুমি আমার প্রিয় পরিজনের এবং গবাদি পশুর আনন্দদায়িনী হও।”

বৈদিক বিবাহের রীতিনীতি অনুয়ায়ী বিবাহের পর ব্রহ্মচর্য্য অবশ্য পালনীয় ছিল, সাধারনতঃ তিনরাত্র পালনীয়, আশ্বলয়ন গৃহসূত্ৰ মতে, তিন রাত্র বা বার রাত্র, কিন্তু ঋষি কল্প সূত্ৰ প্ৰার্থী হলে বিবােহান্তে একবৎসর ব্রহ্মচৰ্য্য অবশ্য-পালনীয়। কাত্যায়ন বলেন যে একবৎসর ব্রহ্মচর্য্যই বিধি, আর ত্রিরাত্র, ছয়রাত্র বা দ্বাদশরাত্র বিকল্পে। ব্ৰহ্মপুরাণে বরকন্যার বয়স হিসাবে পৃথক পৃথক বিধান আছে। ‘হৃদয়-সম্মার্জন’ মন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বদেবগণ’ আমাদের হৃদয় সংযুক্ত করুন, বায়ু ও ব্রহ্মা আমাদের যুগ্মহৃদয়ের ঐক্য সম্পাদন করুন, আমাদের হৃদয়মনের পূর্ণ ঐক্য সম্পাদনকারী বাক্যাবলী এই সময়ে দেবী সরস্বতী আমাদের প্রদান করুন।’ ‘সমাবেশন মন্ত্রে’র মধ্যে সন্তান উৎপাদনের একটি উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, ‘আমি এই বিশ্বভূবনের অন্তর্গত হয়ে পিতৃলোকের তৃপ্তির জন্য জায়াতে সন্তান উৎপাদন করি…...চল আমরা দেবতার পরিচর্য্যা করি।’

বিবাহে, সামাজিক রীতি-নীতি সৰ্বস্থানে এক নয়, যা এক সমাজে দূষণীয়, অন্য সমাজে তা দূষণীয নয়। আদর্শ কোন স্থানে বহির্মুখী, কোন স্থানে অন্তর্মুখী। পিতৃ পুরুষের তৃপ্তিব জন্য—পিতৃ ঋণ হ’তে মুক্ত হওয়ার জন্য আৰ্য্য বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হন, এমন কি ‘সপ্তপদী’ গমনের সঙ্গে শক্তির (কুণ্ডলিনীর) সপ্তচক্ৰ ভেদের সম্বন্ধ বৰ্ত্তমান। এ ভাব আৰ্য্য ছাড়া অন্যত্র নেই। পিতৃঋণ কখনও শোধ হয় না, কিছু পরিশোধ হয় সন্তান হ’লে। কারণ, সন্তান হ’লে তখন পিতামাতার বাৎসল্য কেমন বুঝতে পারা যায়। বিশ্বমাতার ভালবাসার কণাই মাতৃহৃদয়ে বৰ্ত্তমান। বাৎসল্যের অনুভূতি বিশ্বমাতার দিকে এগিয়ে দেয়। তাই আৰ্য্য পুত্রার্থী। মানুষ কতগুলি ঋণ নিয়ে জগতে আসে। তার মধ্যে পিতৃঋণ একটি, এই সমস্ত ঋণই পরিশোধ হয় একমাত্ৰ সন্ন্যাসে, কারণ, বিশ্বমাতার সমদৰ্শীত্ব তখন সন্ন্যাসী লাভ করেন। আৰ্য্য জাতি ছাড়া এভাবও কোন স্থানে নেই।

বিভিন্ন সভ্যতায় বিবাহেব আদর্শ মার্জ্জিত আকার ধারণ করেছে, কিন্তু এখনও সেখানে বিবাহের উদ্দেশ্য তিনটি (1) 'Procreation of Children' বা বংশবৃদ্ধি (2) 'a remedy against sin বা পাপের প্রতিষেধক (3) “to avoid fornication' বা ব্যভিচার হতে আত্মরক্ষা।
ব্রত অনুষ্ঠান সমূহ জাতির মধ্যে অধ্যাত্মশক্তির বীজ, জাতীয়ত্বের বীজ জনশক্তি ধরে বেখেছে আজও। শিক্ষিত অভিমানীদের মধ্যে ঐগুলির আদব ক’মে এলেও সৎ সন্তানের জন্য ভগবানের কাছে কামনা করেন মা।

(এই ধারাবাহিক লেখার উদ্দেশ্য, স্বজাতিয়দের নিজ ধর্ম সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। যদি আমরা আমাদের এই সংস্কৃতিকে ঠিক ঠিক লালন করি তবে এই ধর্মান্তর, সাংসারিক কলহরূপ অনেক সমস্যার অবসান ঘটবে।)

স্মৃতিকার। ভগবান মনু “আৰ্য্য’ সম্বন্ধে এই সংজ্ঞা দিয়েছেন "সৎসস্তান কামনার ফলে যার জন্ম হয়েছে, সেই আৰ্য্য”। ভগবানেব নিকট সন্তানদের কামনা না করে যাঁদের জন্ম হয় স্মৃতিকারের মতে তারা অনার্য্য। সন্তানের জন্য ভগবানের নিকট কামনা করতে হবে। অভিশাপ অসন্তোষের মধ্যে যাদের জন্ম, সংযমের অসামর্থ্য হেতু, উত্তেজনার অতর্কিত সুযোগে যারা জগতে আবির্ভূত হয়, সেই সব সন্তানের কাছে আবার কি আশা করা যায় ?”

দশরথ পুত্ৰেষ্টি যজ্ঞ করেছিলেন, পুত্ৰ পাবার জন্য। অনেক ব্রত ও অনুষ্ঠান এখন বিলুপ্ত হলেও আজও সন্তানবতী নারী ষষ্ঠী পূজাদি করেন ভবিষ্যৎ সন্তানের মঙ্গলের জন্য, তুলসী তলায় বা বিল্বমূলে বসে তিনি সন্তান না হওয়া পর্য্যন্ত নিত্য জপ ধ্যানে ব্রতী থাকেন, এছাড়া গ্রাম্য দেবতার কাছে, তীর্থ-দেবতার কাছে সন্তানের জন্য ‘মানত’ করা ত আছেই। বিবাহের মন্ত্রে আমরা দেখেছি দম্পতির সম্বন্ধ। গর্ভাধানেব মন্ত্রে, সত্ত্বগুণবিশিষ্ট আত্মানন্দময় সন্তানেব কামনা করা হয়। ঋতুমতী কন্যা ভিন্ন গর্ভাধান হয় না।

বিবাহ অনুষ্ঠানে দশবিধ সংস্কারের একটি সংস্কার গর্ভাধান, এর মন্ত্র অর্থ অনুধাবন করে দেখুন কি গভীর দর্শন এতে নিহিত-
'বিষ্ণু, তোমাব গর্ভস্থানকে শক্তি দান করুন, ত্বষ্টা তোমার গর্ভে রূপ নিৰ্ম্মাণ করুন, ভগবতী সিনী বলি। এই বধূত গর্ভাধান কর, পদ্মমালাধারী অশ্বিনীকুমারদ্বয় তোমার গর্ভাধান করুন-যে অশ্বিনীকুমারদ্ধয়ের অধিষ্ঠানে সমূৎপন্ন সন্তান দেবকুলের প্রিয়, স্বভাব-নম্র, বিনয়ী, সত্ত্বগুণযুক্ত, সম্পদশালী ও আত্মানন্দময় হয়।’
ক্রমশঃ
লেখকঃ কৃষ্ণকমল মিন্টু
Share:

বৈদিক সনাতন ধর্মে(হিন্দু) বিবাহ-পর্ব ০১

বিবাহ ইংরেজি: Marriage, matrimony বা wedlock হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দু'জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরব জাতির ধর্মের চিন্তায় বিবাহ একটি চুক্তি মাত্র (contract), বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সনাতন ধর্মে(হিন্দু)-বিবাহের আদর্শ বৈদিক যুগ হ’তে আজ পৰ্যন্ত ঠিক চলে আসছে স্মৃতির সংস্কারে, যার মূলনীতি আজও বদলায় নি।

বর্ণাশ্ৰমধৰ্ম আলোচনায় আমরা দেখতে পাই যে ব্ৰহ্মচৰ্য্য আশ্ৰমের পর গৃহস্থ আশ্রম, এই গৃহী-জীবন ছিল কয়েক বৎসর মাত্ৰ স্থায়ী, কারণ, বৈদিক জীবন প্রণালীতে “পঞ্চাশোৰ্দ্ধং বনং ব্ৰজেৎ”, এই নিয়ম অনুসারে গৃহী বাণপ্ৰস্থ অবলম্বন করতেন। মোক্ষ প্রাপ্তিই সনাতন ধর্মে(হিন্দু)-জীবনের আদর্শ, সেই জন্য ভোগবিলাস তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারত না। তিনি জানতেন যে কিছু দিন সংসার আশ্রম করার পর তাঁকে নিত্যবস্তুর সন্ধানে তপস্যায়-ব্রত হ’তে হবে, মনকে একাগ্র অভিমুখী করতে হবে। প্রথম জীবনের শিক্ষা তাঁর সহায় হয় সর্বত্র। তিনি জানেন যে, বিবাহিত-জীবনে মোহ আনায়, দুর্বলতা আনায়, এবং সে দুর্বলতা তাকে পরিহার করতে হবে বৃহৎ উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য স্থির থাকায় বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর চিত্তে অবসাদ আসত না-সহজে।

জগতে ভোগের যে কোন প্রয়োজনীযতা নেই তা-নয়, ভোগের স্বরূপ-বোধ থাকা চাই, ভোগ করতে জানা চাই। নতুবা, ভোগ অভিমুখী-শক্তি বহু বিভক্ত হ’য়ে পড়লে, সহজে কেন্দ্ৰ অভিমুখী হ’তে চায় না। মোক্ষ মানে বন্ধন হ’তে মুক্তি, তাতে চাই চিত্তের স্বাধীনতা, চিত্তবৃত্তিকে একাভিমুখী করা। নারী পুরুষের বর্তমান সমস্যা সমাধানে, উভয়কে ঐ আদর্শ্যের দিক দিয়ে বুঝতে হবে।- নারীর নারীত্ব বুঝতে হবে। নারীর অন্তর্মুখী বৃত্তি সমুদায়েব পূর্ণ বিবাশ যাতে হয় তা করতে গেলে নারীকেই এ-ভাব নিতে হবে।

কেন নারী বৈদিকে শাস্ত্রে গুরুত্ববহ-

জৈব বিবর্তনে সৰ্ব্বব্যাপী চৈতন্যের প্ৰকাশ ও ব্যক্ত অবস্থা। ঐ বিবর্তনের তিনটি রূপ- সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংস। ধংস মানে নতুন সৃষ্টি। প্রথম বিকাশ সৃষ্টির দ্যোতনা , স্থিতির লক্ষণ-শৃঙ্খলা-স্থাপন, ক্রমপ্রসার ও ক্রমোন্নতি, শৃঙ্খলার বিচ্যুতি, এলোমেলো গতি, মৃত্যুর চিহ্ন। জৈব বিবর্তন হয় বৈচিত্র্যে, নানাত্ব বোধ আসে এই বিশিষ্টতায় । এই ব্যক্ত প্রকৃতি। এই লক্ষণ আক্রান্ত বলেই নারী প্রকৃতিরূপা-শক্তিরূপা। একাভিমুখী গতিকে কেন্দ্রস্থ করতে পারলে, চিত্তবৃত্তি নিরোধের ফলে যে শক্তি উদ্বুদ্ধ হয়, তাতে অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়, শ্রদ্ধা জেগে উঠে, অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশ হয়। শক্তিরূপিনী নারী-সমাজে যাতে আত্মবিস্মৃতি না আসে, আত্মশ্রদ্ধা সুপ্ত হয়ে না পড়ে, তার জন্য বেদপন্থী সমাজে নারীর ‘পতি-যোগ’ সাধনাই সর্ব্বোত্তম উপায় বলে শাস্ত্রে স্বীকৃত হয়েছে।

এই ‘যোগ’ মানে, সমষ্টি বোধ আনবার জন্য একাভিমুখী গতি, স্বামী স্ত্রী- একেরই যুগ্ম প্রকাশ, আপাত প্রতীয়মান ভেদ মাত্র! সমাজ যাতে আত্মবিস্মৃত না হয়, ধ্বংসের দিকে না যায়, কালের মত যাতে সমাজের অনাদি প্রবাহ বর্ত্তমান থাকে তার জন্য সমাজকে এগিয়ে যেতে হবে আদর্শ সামনে রেখে, সর্ব্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে এই সেই প্রকৃতিরূপারই ছায়া-বহুধা বিভিন্ন শাখা প্রকাশার মূলে বিরাজিতা সেই মহামায়া।

সমাজে আদর্শ রক্ষায়, যুবক-যুবতীদের সুশৃঙ্খল রাখতে, আদর্শ চরিত্র গঠনে, উচ্ছৃঙ্খলতা রক্ষায়, সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে সকলেই যেন সংযত জীবন যাপনের মাধ্যমে শান্তি লাভ করে এবং জীবন কে ধন্য করতে পারে এই ছিল লক্ষ্য।

নারী কেন আবহমান কাল থেকে পুরুষের অধীন, এর বিবাদ নিষ্প্রয়োজন। পুরুষ ও নারী, উভয় নিয়েই সমাজ। সমাজ স্থাপনের মূলে নারী, কারণ নারী থেকেই সন্তান পালন ও সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ-চেষ্টা স্ত্রীপুরুষ উভয়েরই হৃদয়ে স্থিতিশীলতার আবশ্যকতা উপলব্ধ হয়, যার ফলে মানবমনে সূক্ষ্ম বৃত্তির অভিব্যক্তি হয়-স্নেহ গ্ৰীতি করুণা প্রভৃতি দিয়ে; তাতে উন্মেষ ঘটে স্বাৰ্থ-বিসর্জন-বুদ্ধি ও ত্যাগের। সুন্দর সমাজ গঠনে নারীর প্ৰয়োজনীয়তাই বেশী; ঐ সূক্ষ্ম মনোবৃত্তিকে কাৰ্য্যকর করার জন্য, শৃঙ্খলা আনার জন্য, নারীর বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্য সমাজে অবশ্যম্ভাবী। অথচ গোড়া থেকেই সমাজ-বদ্ধ নারী, পুরুষের অধীন থাকতে বাধ্য হয়েছে! গৰ্ভধাবণ, প্রসবভোগ ও সন্তান পালন প্রভৃতি ব্যাপারে নারী, পুরুষের ও আত্মীয় স্বজনের সাহায্য নিতে বাধ্য হন-বাৎসল্যের জন্যই মহাশক্তি নম্রা!

বৈদিক যুগে, বিবাহের মন্ত্ৰ হ’তে গৃহী জীবনে নারীর স্থান কোথায় তার আভাষ আমরা পাই, বিবাহের সময় সপ্তপদী গমনের বৈদিক মন্ত্রগুলি থেকে। এক এক চরণক্ষেপে এক একটি মন্ত্র বধূকে বলতে হয়। প্রথমে বর বধূকে সামনে পা বাড়িয়ে নিজ গৃহপানে আসতে আহ্বান করেন। বর বলেন “বিষ্ণুরূপ আমি প্রিয়ে! গৃহের সমস্ত আহার্য্য সামগ্রী তােমার সেবার জন্যই নিয়োজিত থাকবে”, “আজ হ’তে তুমি গৃহ অধিষ্ঠাত্রী হবে-প্ৰথম চরণ চালন মম গৃহপানে কর দেবী।
ক্রমশঃ
লেখকঃ কৃষ্ণকমল মিন্টু

⚠ নতুন নতুন পোষ্ট পেতে সনাতন সন্দেশ - Sanatan Swandesh
পেজটিতে লাইক দিয়ে একটিভ থাকুন।
 (y) যে এখনো লাইক দেন নাই তাকে অতি শীঘ্রই পেইজটিতে একটি লাইক দেওয়ার জন্য বিনম্র ভাবে অনুরোধ করছি । এবং আপনার বন্ধুদের কে ইনভাইট করার জন্য অনুরোধ করছি।
Share:

২৩ নভেম্বর ২০১৭

সহজ কথায় ধর্ম


ধর্ম শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধৃ(ধরে রাখা, বহন করা, রক্ষণ করা) ধাতু থেকে। অর্থাৎ, যা কোন কিছুকে ধরে রাখে বা রক্ষা করে অথবা যা ছাড়া কোন কিছুরই অস্তিত্ব অসম্ভব তাইই হল ধর্ম। বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থের ধর্মালোচনা থেকে ধর্মের যে ধারণা পাওয়া যায়, তা হল; ন্যায়, বিশেষ পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত, নৈতিক মূল্যবোধ, কর্তব্যনিষ্ঠতা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়, নীতির প্রতি অবিচল আস্থা ও ন্যায্যকর্ম সম্পাদন, অন্যের(মানুষ বা যেকোনো প্রাণীর) প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, জনকল্যাণে সংবেদনশীল ও সহযোগী হওয়া, প্রাকৃতিক গুনাগুণ বা চরিত্র, দায়িত্ব, কর্তব্য, সংবিধান ইত্যাদি। সোজা কথায়, ধর্ম হল এমন একটি পদ্ধতি যা, মহাজাগতিক শৃঙ্খলাকে ধরে রাখে, মানুষের জীবনের সাথে প্রকৃতির ঐকতান সৃষ্টি করে ও এই ঐক্যকে ধারণ করে। অর্থাৎ, আমরা যখন ধর্ম পালন করি, তখন আমরা আসলে বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব প্রাকৃতিক নিয়মের সাথেই সহাবস্থান করি।
অবস্থাভেদে বা পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী ধর্মের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের পরিবর্তন ঘটে। আর এই বিশেষ কারণে, মাত্র এক লাইনে ধর্মের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। এই কারনেই এর (ধর্মের) অর্থের প্রায়োগিক ব্যাপকতা অনেক বিস্তৃত ও গভীর।

আসুন, আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা করা যাক। প্রথমেই আসি ধর্মের মূল আভিধানিক অর্থ; অর্থাৎ যা দ্বারা কোন কিছুকে ধারণ করা বোঝায়। যেমন, জলের ধর্ম তারল্য, বায়ুর ধর্ম বায়বীয়, কঠিন যেকোনো পদার্থের ধর্ম তার কাঠিন্য। এখন জল যদি তার তারল্য হারায়, তখন তা আর জল থাকবে না, অন্য কোন পদার্থ; বরফ বা বাস্পে পরিণত হতে পারে। একইভাবে, কঠিন পদার্থ তার কাঠিন্য, বায়ু তার বায়বীয়তা হারালে তা তাদের স্বাভাবিক সত্ত্বা হারিয়ে অন্য কোন পদার্থে রূপান্তরিত হবে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্ম হল পদার্থের বা অন্য যেকোনো কিছুর এমন এক নিজস্ব গুণ, যা হারালে পদার্থ তার স্বাভাবিক অবস্থা হারায়, তার নিজস্বতা হারিয়ে হয় ধ্বংস প্রাপ্ত হয় নয়ত অন্য কোন কিছুতে পরিণত হয়, যা তার স্বাভাবিক, গুনগত অবস্থা নয়।

এরপর আসি ধর্মের অন্য অর্থ যেমন; নীতি (বেদাদি ধর্মগ্রন্থ সমুহে এটি ধর্মের আরেক রুপ)। মানুষ পশু প্রজাতি হলেও, তার উন্নত মনন, দূরদৃষ্টি, চিন্তাভাবনার গতিশীলতা ও সাবলীলতার কারণে সে অন্যান্য প্রানীদের মত স্বভাবজাত নয়, বরং সে তার স্বতপ্রবৃত্তির বাইরে ও চিন্তা করতে পারে এবং নিজ আদিম প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই দারুন ক্ষমতার জন্যই সে আর সব প্রানী থেকে আলাদা। একই কারণে যে বন্য প্রাণীর মত স্বভাবজাত মানসিকতা নিয়ে চলতে পারেনা, বরং তার সমস্ত নিজস্ব কার্যকারণের আদ্যোপান্ত সে জানতে চায় ও তার সমর্থন চায়। আর এই কার্যকারণের পক্ষে সমর্থন যোগাতে সে নীতি আশ্রয়ী হয়, জীবনে চলার পথে নীতি-অনীতি, সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায়, ঔচিত্য-অনোচিত্য প্রভৃতি যাচাই করে এবং এই যাচাইের সুবিধার্থে নৈতিক কর্মপন্থার খোঁজ করে।

একজন ব্যাক্তি তাঁর জীবনের জন্য এমন কিছু নীতির খোঁজ করেন বা এমন নীতি নিয়ে চলেন, যা তাঁকে বৃহত্তর সামাজিক সম্পর্কের পর্যায়ে স্বচ্ছন্দ করে তোলে, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে একটি অর্থপূর্ণ, স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ জীবনযাপনে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঘাত প্রতিঘাত এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে, শুধু তাই নয়, বিশেষ প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তাঁর কর্তব্যকর্ম স্থির করতে ও সাহায্য করে। এরকম নীতি যেকোনো ব্যাক্তি বা সমষ্টি বা সামাজিক চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। এই উপাদান না থাকলে বা নষ্ট হলে, ব্যাক্তি বা সমাজের কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই থাকেনা। অনেকটা চরিত্রহীন, হীনমন্য, বিবেকহীন, বোধহীন পরজীবী ক্লীবে পরিণত হয়। এই ধরনের ব্যাক্তি বা সমাজের ধ্বংসই একমাত্র নিয়তি। এক্ষেত্রে, নীতিই ব্যক্তি বা সমাজের ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত। যা থাকলে স্বীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া যায় আর না থাকলে নিজ গুনাগুণ রহিত হয়ে অপরের মুখাপেক্ষী হতে হয় এবং স্বীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।
অর্থাৎ, আবারো ধর্মহীনতাই বিলুপ্তির কারণ।

এরপর, ধর্মের আরেকটি অর্থের কথা বলতে হয়, যা হল ন্যায়। যারা মহাভারত পড়েছেন, তাঁরা জানেন, কুরু পাণ্ডবের মধ্যেকার যুদ্ধটি সংগঠিত হবার মূল কারণ ছিল ন্যায়। পাশাখেলায় পরাজিত হবার শাস্তি হিসেবে পাণ্ডবদের ১২ বছর বনবাস ও ১ বছর অজ্ঞাত বাস করতে হয়। শর্ত ছিল, শাস্তিভোগের পর পাণ্ডবরা তাঁদের রাজ্য ও সম্পদ ফিরে পাবে। কিন্তু, কৌরবরা শর্তভঙ্গ করে ও পাণ্ডবদের রাজ্য ফেরত দিতে অস্বীকার করে, উল্টো যুদ্ধের হুমকি দেয়। প্রাপ্য ফেরত পাওয়ার সমস্ত তৎপরতা এবং কুটনৈতিকতা (সাম, দান, ভেদ) ব্যর্থ হলে পাণ্ডবরা “কুরুক্ষেত্রে” যুদ্ধে(দণ্ডনীতি)অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধ ছিল ন্যায্য প্রাপ্তির যুদ্ধ অর্থাৎ ন্যায়ের যুদ্ধ। আর এই ন্যায়ের যুদ্ধকেই মহাভারতে বলা হয়েছে ধর্মযুদ্ধ। এখানে, ন্যায় ও ধর্ম সমার্থক। দেখুন, যে কাউকেই সমাজে বসবাস করতে হলে, তাঁকে আর দশজনের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে হয়। মানুষের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক যেমন তৈরি হয় তেমনি আবার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংঘাত ও তৈরি হয়।

 ঠিক এই জায়গাটাতেই ন্যায়ের প্রশ্ন আসে। আমি যদি অপর ব্যাক্তির সাথে অন্যায় আচরণ করি, তবে তারও আমার প্রতি অন্যায় আচরনের অধিকার আছে, কারণ, আমি আগে অন্যায় আচরণ করে তাঁকে সে অধিকার দিয়েছি। এটা আইন শৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়। এটা নৈতিকতার প্রশ্ন ও অধিকারের প্রশ্ন। দুই বা ততোধিক ব্যাক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যদি ন্যায় অনুপস্থিত হয়, তবে সম্পর্কের মধ্যে অন্যায় আসবে, একপাক্ষিকতা আসবে, বঞ্চনা আসবে, বৈষম্য আসবে। এই ধরনের সম্পর্কের মধ্যে কোন শ্রদ্ধাবোধ বা ভালবাসা তৈরি হয়না বরং শঠতা ও প্রতারনা তৈরি হয়। পরিণামে তা একটি সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্কের অন্তরায় হয়, সুস্থ, স্বাভাবিক সমাজ ও জাতি গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে। অরাজকতা তৈরি হয়, মাৎস্যন্যায় তৈরি হয়, দুর্বলের উপর সবলের উৎপাত বৃদ্ধি পায়, পরিবার ও সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়ে এবং এর ফল অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস। কুরুক্ষেত্রে কৌরবদের ধ্বংস হয়েছিল। আর বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
অতএব আবার দেখতে পাচ্ছি, ন্যায়স্বরূপ ধর্মের অনুপস্থিতি এবং নিশ্চিত ধ্বংস।

 ধর্মের সংজ্ঞাঃ
Dharma is an expression of “Ethical Principals” which uphold a cosmic order that harmonize the relationship “among men and also between men and broader nature” through combining both “materialistic development and spiritual enlightenment”, which, when practiced consciously ultimately leads to “Moksha” that is releasing oneself from the cycle of “birth and death”.
ধর্ম হল কর্তব্যকর্মের এমন এক নীতিমালা, যা এক মহাজাগতিক শৃঙ্খলার নির্দেশক, যা বৈষয়িক উন্নয়ন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞ্যানকে একীভূত করে, মানুষে মানুষে এবং মানুষ ও বৃহত্তর প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কের ঐকতান সৃষ্টি করে, যার সচেতন চর্চায় মোক্ষলাভের (জন্ম ও মৃত্যুর চক্র হতে মুক্তি) পথ সুগম হয়।

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্ম বলতে কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের নীতিকেই বোঝায়, যে নীতির আলোকে মানুষ তাঁর আর্থ ও কাম চরিতার্থ করবে, যে নীতিতে মানুষ তাঁর পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বৃহত্তর মানবজাতি ও বৃহত্তর প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে, তাঁদের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে, যে নীতির সচেতন চর্চায় তাঁর সুপ্ত মানবিক গুনগুলোকে সুষমামণ্ডিত করে তুলবে এবং ধাপে ধাপে তাঁর আধ্যাত্মিক সত্তাকে উপলব্ধি করবে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার পার্থক্য দুরীভুত হবে।
কর্তব্যকর্ম ছেঁড়ে যারাই মোক্ষের প্রত্যাশায় লালায়িত হবে, সংসার ছেঁড়ে, সংসারের প্রতি দায়িত্ব ছেঁড়ে যারাই আধ্যাত্মিকতার চর্চা করতে যায়, তাঁরা অধার্মিক। ধর্ম ও ধার্মিক সমাজের চোখে তাঁরা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অথর্ব। তাঁরা মানবজাতির কাছে ভারসম। আবার যারা কর্তব্যকর্ম ছেঁড়ে কেবলমাত্র আত্মসর্বস্ব জীবনযাপন করেন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র চুলোয় যাক, আপনি বাচলে বাপের নাম, কর্তব্য এড়াতে যারা কখনও দর্শনের নামে, কখনও বিশ্ব মানবতার নামে, কখনও অহিংসার নামে কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন, তারাও সমান অধার্মিক, শঠ, প্রতারক এবং তারাও ধর্মের চোখে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অথর্ব। এরাও মানবজাতির কাছে অপ্রয়োজনীয় ও ভারসম।

কেবল যারা যোগী (কর্মযোগী), যারা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা, ন্যায় অন্যায়, রাজনীতি, আর্থসামাজিক চাপানউতর এর মধ্যে শান্ত, সংযত, কর্তব্যপরায়ণ ও ধীসম্পন্ন থাকেন, ধর্মে অবিচল থাকেন, ধর্ম প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকেন, ধর্ম প্রচার, প্রসার ও রক্ষায় বাঘের ন্যায় ক্ষিপ্র, সাহসী, ধৈর্যশীল ও বলবান থাকেন, যেকোনো বাঁধার সামনেই অভিযোগশুন্য, অকুতোভয়, সাত্ত্বিক ও বলীদানে প্রস্তুত থাকেন তাঁরাই প্রকৃত ধার্মিক। এঁদের হাতেই ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়, ধর্মের সুরক্ষা হয়, অপরাপর মানুষের, সমাজের, সংস্কৃতির ও সভ্যতার সুরক্ষা হয়। এঁরাই (পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ই) নেতৃত্ব দানের যোগ্য, এঁরাই সহজাত নেতা হন। এঁদের সংখ্যা কম হতে পারে, কিন্তু এঁদের প্রভাবই সমাজকে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এরা যেকোনো কেউ বা যে কোন পেশার হতে পারেন।

এঁরা সকলে যেক্ষেত্রে এক কাতারে দাঁড়ান, তা হল ধর্মের প্রতি অনন্যসাধারণ চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, অসাধারণ শক্ত মানসিকতা, প্রজ্ঞ্যা, ধী এবং সর্বোপরি যা তাঁদের বাকী সবার চাইতে অনন্য ও আলাদা করে, বাকী সবার চোখে তাঁরা নায়ক/ নায়িকার আসনে অধিষ্ঠিত হন, তা হল যেকোনো বৃহত্তর স্বার্থে নিঃশঙ্ক চিত্তে “আত্মত্যাগের” ক্ষমতা।

www.sanatandharmatattva.wordpress.com
Share:

প্রসঙ্গ- ‘মায়াবাদ’


যোগমায়া
যোগমায়া = অনাদি অনির্বাচ্য অজ্ঞান । – [আনন্দগিরি]গুণত্রয়ের সংযোগই, সংঘটনই যোগ । যোগই মায়া । – [শঙ্করাচার্য]অঘটনঘটনপটীয়সী মায়া – [শ্রীধরস্বামী]আত্মার সঙ্কল্পানুবিধায়িনী মায়া – [মধুসূদন সরস্বতী]
অধ্যাত্মবিজ্ঞানের এই শ্রেষ্ঠ মতটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনধৰ্ম কর্তৃক জগতে প্রচারিত। সেদিনকার খ্ৰীষ্ট ও মুসলমানধৰ্ম এ মতটা হৃদয়ঙ্গম করতে অক্ষম। গ্ৰীসদেশে মহাত্মা প্লেটো ও নিজপুস্তকে এই শ্রেষ্ঠ মত প্রচার করেন। আধুনিক জড়বাদী, স্থুলদর্শী বিজ্ঞান এই মত আদৌ গ্রহন করে না; কারণ ইহার মতে তোমার অস্তিত্বের ন্যায় এই প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান জগতের অস্তিত্ব সকলের নিকট সত্য, মহাসত্য এবং কদাচ মিথ্যাজ্ঞানসম্ভুত হইতে পারে না।
বেদান্তের মায়াবাদের প্রকৃত তাৎপৰ্য্য অতীব দুরূহ। অনেক পণ্ডিত মায়াবাদ ব্যাখ্যা করার সময় দৃষ্টান্ত দেন, যেমন অন্ধকারে রজুদর্শনে সর্পভ্রম হয়, তারপরে রজ্জুজ্ঞান হইলে অলীক সর্পজ্ঞান মন হতে দূরীভূত হয়, সেইরূপ সংসারে পরমার্থ জ্ঞান হইলে সংসারের যাবতীয় মায়াজ্ঞান মন হতে দূরীভূত হয়; তখন সংসারের কোন ভেদাভেদজ্ঞান থাকে না এবং সকলই ব্ৰহ্মময় বলে বোধ হয়। তাঁহাদের মতে, ইহাই মায়াবাদের প্রকৃত তাৎপর্য্য। কিন্তু জৈন ও বৌদ্ধপণ্ডিতগণ এর ব্যাখ্যা করেন নিজের ধর্ম মত অনুসারে। যাহা হউক, এস্থলে মায়াবাদের প্রকৃত তত্ত্ব উদঘাটন করা কর্তব্য।
শাস্ত্রে মায়াশব্দ দুই প্রকার অর্থে ব্যবহৃত। ইহার প্রথম অর্থে অতিরিক্ত মোহ বুঝায়; যেমন দেহ, পুত্র, কলাত্রাদি সংসারের ক্ষণভঙ্গুর বিষয়ে মানব-মন স্বভাবতঃ মায়ায় মুগ্ধ। এ মায়াবন্ধন ছেদন করা ইহার পক্ষে অনেক সময় দুঃসাধ্য বটে, কিন্তু সংসারে বৈরাগ্য উপস্থিত হলে, ইহা অপেক্ষাকৃত সহজ সেইরূপ সংসারের যাবতীয় অনিত্য মিথ্যাজ্ঞান লাভ করতঃ পরব্রহ্মকে ভুলে গিয়ে সকল বিষয়ে আমার আমার যে মিথ্যাজ্ঞান মনে উদয় হয়, তাহাও এর মায়াজ্ঞান। শাস্ত্রোক্ত পরমহংসমার্গ অবলম্বন করিলে এ মায়াজ্ঞান দূরীভূত হইতে পারে।
3662526_orig
মায়াশব্দের দ্বিতীয় অর্থে মহামোহ বুঝায়, যা ছেদন করা মনের পক্ষে একেবারে সম্পূর্ণরূপ অসাধ্য। পরমহংস হউন, যোগী হউন, গৃহস্থ হউন, এ মহামায়ার মহা বন্ধন মানব কোনকালে এ জগতে ছেদন করতে পারে না। যতদিন তিনি স্থুলদেহ ধারণ করিয়া ইহলোকে বা জীবনের এই সমতল ক্ষেত্রে (this plane of existence ) বাহ্যজগতের সহিত বিবিধ সম্বন্ধে সম্বদ্ধ হয়ে বিচরণ করেন, ততদিন যে মহামায়ার মহাবরণে তিনি মুগ্ধ, সে মহাবরণ তিনি কদাচ ভেদ করিতে পারেন না। এ মহামায় তাহার অস্তিত্বের মূলে সংলগ্ন। এ স্থুলদেহ সৰ্ব্বজ্ঞ মায়াতীত আত্মার মায়াদেহ মাত্র। এ মায়াদেহে নিবদ্ধ(বদ্ধ, আটকানো) হইলেই আত্মা মায়ামুগ্ধ হয় এবং বাস্তব পদার্থ বুঝতে পারে না। এ মায়াদেহ ত্যাগ করলে, ইহসংসারের যাবতীয় মায়াজ্ঞান হতে আত্মা ও নর্মুক্ত হয়। এজন্য বিশ্বব্যাপারের ঘাহা কিছু আমাদের নয়নগোচর হয়, তার সমস্তই মিথ্যাজ্ঞানসম্ভুত, তাহ সংবৃতি(লুকায়িত বা আচ্ছাদিত)মূলক (relative); কিন্তু বস্তুত: উহারা কি, উহাদের বাস্তবরূপ কি, তা আমরা অবগত নই: এবং কোনকালে অবগত হইব না।
এই যে অন্ধকারে পথে যেতে যেতে তুমি একখণ্ড রজ্জ্ব অবলোকন করতে করতে সর্পভ্রমে ভয়বিহবল হয়ে পিছনে ফিরে আস, পরে উহাকে ভালরূপ নিরীক্ষণ করাতে তোমার সর্পভ্রম দূর হয় এবং সেইসঙ্গে তোমার মনও সুস্থির হয়; এই যে রেলগাড়িতে যাইতে যাইতে তুমি চতুর্দিকস্থ বৃক্ষসমূহকে চলায়মান দেখ,পরে সামান্য পর্যালোচনা করে বুঝতে পার, যে গাড়ির গতিবশতঃ বৃক্ষ গুলি বিপরীতদিকে চলায়মান; আবার যখন তুমি ভাবতে থাক, ধরিত্রী স্বয়ং উহার পৃষ্ঠস্থ যাবতীয় পদার্থ ও চতুদিকস্থ বায়ুরাশি লয়ে আকাশপথে অসীমবেগে ভ্ৰাম্যমান, তারজন্য প্রতিদিন সূৰ্য্যকে প্রাতঃকালে, পূৰ্ব্বদিকে উদয় হতে ও পশ্চিম দিকে অস্ত যাইতে দেখ এবং রাত্রিকালে আকাশস্থ যাবতীয় নক্ষত্রমণ্ডল ধ্রুবতারার চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করতে দেখ; এই যে একজন পথিক মরুভূমিতে যাইতে যাইতে পিপাসায় আতুর হয়ে পুরোভাগে জলাশয় দেখে এবং জলপানার্থ যেমন উহার দিকে ধাবমান হয়, অমনি জলাশয়টি আরও দূরে পলায়ন করে; এখন জিজ্ঞাসা এ সকল দৃশ্যপটল তোমার মনে কিরূপ বোধ হয় ? এরা কি তোমার মায়ামুগ্ধ মনের মায়াজ্ঞান, না এরা তোমার চোখের ভ্রান্তিদর্শন ? এরা তোমার ভ্রান্তিদর্শন মাত্র এবং কখনোই মায়াজ্ঞাম নয়। এরূপ ভ্রান্তিদর্শন উৎপাদনে যে মহামায়ার কথা উপরে লিখিত, উহার কিছুমাত্র অনুশাসন নাই। এ সকল কেবল আমাদের দর্শনশক্তির ভ্রান্তিমাত্র। অল্পমাত্র জ্ঞান লাভেই এরূপ ভ্রাস্তির দূরকরণ হয়।
কিন্তু এই যে অশ্বখ বৃক্ষটি যা বিশাল ও বহুবিস্তৃত শাখা প্রশাখা লইয়া তোমার সামনে দাড়িয়ে আছে, যার প্রতিকৃতি তোমার নয়ন অভ্যন্তরে বিপরীতভাবে প্রতিবিম্বিত এবং যার রূপ তুমি যাবজ্জীবন একরূপ দেখে থাক, ইহা তোমার মায়ামুগ্ধ মনের মায়াজ্ঞান। প্রকৃতি ঐ বৃক্ষের সাথে তোমার চক্ষু ও মনের যেরূপ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত করিয়া দেয়, তাহাতে তুমি উহাকে চিরদিন একরূপ দেখ। আলোক যোগে বৃক্ষটির যেরূপ প্রতিবিম্ব তোমার নয়নদ্বয়ে পতিত হয়, অধ্যাসবশতঃ তুমি উহার চিরপরিচিত রূপটা নয়নগোচর কর এবং বাহ্যজগতে উহার অবস্থিতি অনুভব কর। তুমি কখনো বলতে পার না, যে উহার বাস্তবরূপ ঠিক ঐ প্রকার। আবার তুমি ঐ বৃক্ষটি যেমন দেখ, একটা পিপীলিকাও যে উহাকে ঐরূপ দেখে, তা ও তুমি বলতে পার না। এতেই কি বোধ হয় না, যে অশ্বথবৃক্ষটির জ্ঞান তোমার মায়াজ্ঞান মাত্র ? সেইরূপ এ জগতের যাবতীয় পদার্থের জ্ঞান আমাদের মায়াজ্ঞান মাত্র। এখন যে মায়ার আবরণে আবৃত হয়ে আমাদের জীবাত্মা এ সংসারে মায়াজ্ঞানলাভ করে, তাহাই মহামায়া।p1030044
মায়া দ্বারা চালিত হয়ে আমরা বিশ্ব প্রপঞ্চের যে জ্ঞানলাভ করি, তা আমাদের মায়াজনিত মিথ্যাজ্ঞান, অথচ ইহাই আবার আমাদের মায়াজনিত সত্যজ্ঞান। যতদিন আমরা মায়ায় মুগ্ধ হয়ে এই মায়াময় জগতে অবস্থান করি, ততদিন ঐ মায়াজনিত মিথ্যাজ্ঞানই আমাদের নিকট মহাসত্য জ্ঞানে পূজিত হয়। এতদ্ব্যতীত আমাদের অন্য গতি নেই। এ স্থানে জগৎ মায়াময় এবং আমরাও সকলে সমভাবে মায়ামুগ্ধ; তারজন্য আমরা কখনো ময়াজনিত জ্ঞানকে মিথ্যাজ্ঞান বলে জানতে পারি না। কিন্তু যাহারা মহামায়া হতে মুক্ত, তাঁদের নিকট আমাদের মায়াজনিতজ্ঞান মিথ্যাজ্ঞান বলিয়া বিবেচিত হয়। এখন এ সংসারে এমন লোক অতীব বিরল। পরমহংস হউন, যোগী হউন, মহামায়ার মহামোহ ভেদ করা সকলের পক্ষে সমান অসাধ্য। একমাত্র পরব্রহ্মই মায়াতীত। সেজন্য তাঁহারই নিকট আমাদের যাবতীয় জ্ঞান মিথ্যাজ্ঞান; অথবা যে সকল দেবতা অল্পাধিক মায়ামুক্ত, তাহাদের নিকটও আমাদের এ মায়াজ্ঞান মিথ্যাজ্ঞান মাত্র। দেখ, এই বিশ্বকে তুমি ও আমি যেরূপ দেখি, সকলেই ঠিক সেইরূপ দেখেন; কিন্তু ইহার বাস্তবরূপ কি, তাহা তুমিও জান না, আমিও জানি না এবং বোধ হয় দেবতারাও জানেন না।
এখন দেখা যাউক, আমরা কি প্রকারে সংসারের মায়াজ্ঞানলাভ করি। এ মন্বন্তরে (পুরাণমতে এক এক মনুর অধিকার কাল) পঞ্চেন্দ্রিয়ই মনের দ্বারস্বরূপ এবং পঞ্চেন্দ্রিয়যোগেই মন জগতের যাবতীয় জ্ঞানলাভ করে। পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে চক্ষু আবার সর্বশ্রেষ্ঠ। পদার্থের জ্ঞানলাভে চক্ষুই সৰ্ব্বাপেক্ষ আমাদের অধিক সাহায্য করে। পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে যদি কোন ইন্দ্রিয়ের অভাব হয়, অপরগুলি উহার অভাব পুরণ করতে চেষ্ট পায় ; যেমন অন্ধ ব্যক্তির লাঠি স্পর্শযোগে অনেকস্থানে চোখের কাজ করতে দেথা যায়।
এ সংসারে মানবমন ও চক্ষুর যেরূপ সম্বন্ধ এবং উহাদের যেরূপ প্রকৃতি, তাহাতে তুমি দর্শনশক্তি দ্বারা যাবতীয় পদার্থের একপ্রকার জ্ঞানলাভ কর। যদি কোন কারণে তোমার চক্ষুদ্বয় বিকৃত হয়, পদার্থবিশেষের জ্ঞানও তখন অন্যরূপ হয়। দেখ, গোলাপ ফুলটা তোমার চক্ষে কেমন সুন্দর ও রমণীয়! যদি তোমার চক্ষু বিকৃত হয়ে যায়, তুমি তাকে অন্যরূপ দেখ, অথবা যদি তোমার মন বিকৃত হয়ে যায়, উত্তম চক্ষু সত্ত্বেও তুমি উহাকে অন্যরূপ দেখে থাক। যখন তোমার চক্ষুদ্বয় এই সুবিস্তৃত, পরিদৃশ্যমান জগৎসমক্ষে উল্মীলিত হয় এবং তোমার মনও ঐদিকে ধাবিত হয়, তখন তুমি এর বিচিত্ররূপদৰ্শনে বিমুগ্ধ হও। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করে দেখ, সেই অপরূপ দৃশ্যটা তৎক্ষণাৎ তোমার মানসপট হইতে অন্তহৃত হয়ে যায় এবং জগৎও ঘোরান্ধকারে আবৃত হয়। তখনই তুমি স্পষ্টই বুঝতে পার, এ বিশ্বপ্রপঞ্চ কেবল মায়াময়।hqdefault
একজন জন্মান্ধকে জিজ্ঞাসা কর, তোমার সন্মুখস্থ বৃক্ষবিশেষের বা জন্তু-বিশেষের স্বরূপ কি প্রকার ? দর্শন ব্যতীত অন্য ইন্দ্রিয়যোগে তাহার মনে ঐ পদার্থ বা জন্তুর যেরূপ জ্ঞান ও স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম হয়, তাহাই সেই হতভাগ্য ব্যক্তি উল্লেখ করে। তুমি দণ্ডায়মান হয়ে তাহাকে জিজ্ঞাসা কর, তুমি দণ্ডায়মান আছ, কি উপবিষ্ট আছ ? তোমার বাক্য উচ্চদেশ হতে নিঃসৃত হইতেছে শ্রবণ করিয়া সে ব্যক্তি বলিয়া থাকে, তুমি দণ্ডায়মান আছ। তোমার মায়াজ্ঞান তোমার নিকট যেরূপ সত্য, তাহার মায়াজ্ঞান তাহার নিকটও সেইরূপ সত্য।
জীবজগৎ পৰ্য্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায়, অনেক নিকৃষ্টজীবে ইন্দ্রিয়গণ অতি অস্ফুটভাবে বর্তমান; এমন কি, অনেক জীবে এক বা ততোধিক ইন্দ্রিয়ের অভাব দেখা যায়; অথচ সকলেই দেহযাত্রা নিৰ্ব্বাহ উপযোগী যাবতীয় কৰ্ম সুচারুরূপে সম্পাদন করে। প্রকৃতি যাবতীয় জীবজন্তুকে স্ব স্ব অবস্থার উপযোগী করিয়া দেয়। এতে বোধ হয়, সকল জীবের মায়াজ্ঞান বিভিন্ন। যে জীব যে অবস্থায় পতিত, উহার মায়াজ্ঞান সেই অবস্থার উপযোগী। পিপীলিকা একখণ্ড মিষ্টান্ন দেখে অপর পিপীলিকাগণকে কিরূপে আহবান করে, তা আমরা অবগত নই; কেবল পিপীলিকারাই তা বুঝিতে পারে।
তত্ত্ববিদ্যা উপদেশ দেয়, এক এক মন্বস্তরে মানবের এক একটা ইন্দ্রিয় স্ফুরিত; সেজন্য প্রত্যেক মন্বন্তরে তাহার মায়াজ্ঞানও বিভিন্ন। এখন আমরা এই কাৰ্য্যকারণাত্মক বিশ্বের যেরূপ জ্ঞানলাভ করি, পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব মম্বন্তরে মনুপুত্ৰগণ বোধ হয় অন্তপ্রকার জ্ঞানলাভ করিয়া যান। স্বায়ম্ভব মন্বন্তরে যে মায়াজ্ঞান প্রচলিত, চাক্ষুস মন্বন্তরে তা বিভিন্ন এবং বৈবস্বত মন্বন্তরে তা আরও বিভিন্ন। এস্থলে জড়বিজ্ঞান সাহঙ্কারে যে উপদেশ দেয়, চিরদিন ভৌতিক শক্তি একরূপ, তা আমরা কখনো গ্রহন করিতে পারি না।
বাসুদেব জ্ঞানীর আত্মা, তাই তিনি জ্ঞানীর প্রিয়
আমার মায়া দ্বারা সাংখোক্ত স্বতন্ত্র প্রকৃতি নিষিদ্ধ হইয়াছে । – [শ্বেতাশ্বতর উপঃ, ৪|১০]অনুভবসিদ্ধা মায়া; অকস্মাৎ ইহাকে অস্বীকার করা যায় না । আবার জ্ঞানোদয়ে দেখা যায় না । – [আনন্দগিরি]
অদ্বৈতবাদী বৈদাস্তিক পণ্ডিতদিগের মতে যা সৎ, তা মায়াতীত এবং যা অসৎ, তা মায়াবিশিষ্ট। একমাত্র পরব্রহ্মই সৎ বা সত্যস্বরূপ, এজন্য তিনি বেদে ওঁ তৎসৎ ও সচ্চিদানন্দ বলিয়া কথিত। এই বিশ্ব প্রপঞ্চ মায়াময়, এজন্য ইহা অসৎ, ক্ষণে ক্ষণে ইহা পরিবৰ্ত্তিত এবং ইহাতে ত্রিগুণের অনন্তলীলা প্রকাশিত।
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীদিগের মতে এই কাৰ্য্যকারণত্মক বিশ্বপ্রপঞ্চ, যা আমাদের চৰ্ম্মচক্ষের সমক্ষে প্রত্যক্ষীভূত, তাহাই সৎ বা সত্যস্বরূপ; আর যে সকল বিষয় প্রত্যক্ষ হয় না, তাহাই অসৎ বা মিথ্যা। সৎ ও অসৎ এই দুইটা শব্দের তাৎপর্য্যে এত পার্থক্য থাকায়, সমগ্র হিন্দু শাস্ত্রে যে কত গোলযোগ উপস্থিত, তা এস্থলে বর্ণন করবার “আবশ্যকতা নাই। পরব্রহ্মের মহামায়া দুরত্যয়া। ইহার অনুশাসন পরিহার করা জীবের অসাধ্য।
ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্ব্বমিদং জগৎ ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্ ॥১৩॥
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া ।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥১৪॥ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সপ্তম অধ্যায়)
“মায়ার ত্রিগুণে সমস্ত জগৎ বিমুগ্ধ, তজ্জন্ত গুণাতীত, মায়াতীত অবিনশ্বর পরমাত্মা যে আমি, অমাকে কেহ জানিতে পারে না। আমার এই গুণময়ী দৈবী মায়া লোকে অতিকষ্টে পরিহার করে। কেবল যাঁহারা আমাকে প্রাপ্ত হন, তাহারাই আমার এই মায়া হইতে উত্তীর্ণ হন।”
যে মহাত্মা অসাধারণ যোগবলে সমাধিস্থ হইয়া মায়ামুগ্ধ দেহের চব্বিশ তত্ত্বের ক্রমশঃ লয় সাধন করতঃ পরব্রহ্মের সহিত নিজ আত্মার মিলন করতে পারেন, তিনিই সমাধির অবস্থার মায়া হতে বিচ্যুত হন। সমাধি ভঙ্গ হলেই তিনি ও পূৰ্ব্বের ন্যায় মায়াবিশিষ্ট অবস্থা প্রাপ্ত হন। কলিযুগের কয়জন লোক সেরূপ যোগাভ্যাস করতে পারেন, বল ? অৰ্দ্ধঘণ্টার জন্য নিমীলিতাক্ষ হইয়া এক প্রাণে, একধ্যানে ঈশ্বরে চিত্ত সমাহিত করতে পারলে, যে তুমি সমাধিস্থ হয়ে মায়ামুক্ত হও, তা কখনো মনে করিও না। চব্বিশতত্ত্বের লয়সাধন করে প্রকৃত সমাধিস্থ হওয়া কত সাধনাসাপেক্ষ, তা মহাত্মাগণই জানেন।
জীবাত্মা মহামায়া দ্বারা অনস্ত কাল চালিত। কেবল যে ইহসংসারে জীবাত্মা ইহাদ্বারা চালিত, এমন নহে; অন্যান্য লোকে ও জীবাত্মা ইহাদ্বারা সম্যক পরিচালিত। যখন নিজ কৰ্ম্মফল কর্তৃক চালিত হয়ে জীব জীবনের বিবিধাবস্থাপন্ন ভিন্ন ভিন্ন সমতলক্ষেত্রে বা ভিন্ন ভিন্ন লোকে পরিভ্রমণ করে, তখনও ইহা এই মহামায়া দ্বারা চালিত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞানলাভ করতে থাকে ও ভিন্ন ভিন্ন সুখ ও দুঃখ ভোগ করতে থাকে। যুগযুগান্তরে, কল্পকল্লান্তরে কোটি কোটি বৎসরের পর শিক্ষা ও সংযম দ্বারা ক্রমোন্নত হয়ে যখন জীবাত্মা পরব্রহ্মে মিলিত হয়ে নিৰ্ব্বাণপদ প্রাপ্ত হয়, তখনই ইহা মহামায়া হইতে একেবারে বিমুক্ত হয়। তদ্ভিন্ন সকল লোকে ও সকল অবস্থায় জীবাত্মা মায়া হইতে অব্যাহতি প্রাপ্ত হয় না এবং সুখদুঃখরূপ মহাবৰ্ত্তে পতিত হইয়া ঘুর্ণায়মান হয়।
পাঠক! তুমি আজ কলিযুগে মানবাকারে এই সংসারে বিচরণ করে সংসারের যাবতীয় পদার্থের একপ্রকার জ্ঞানলাভ করতেছ এবং তুমি আজ একপ্রকার প্রাকৃতিক নিয়মাবলি দ্বারা চালিত। হয়ত লক্ষ লক্ষ বৎসর পরে তোমারই জীবাত্মা এই জন্ম বিস্মৃত হয়ে পুনরায় এ জগতে বিচরণ করবে। তখন তোমার জীবাত্মা বিভিন্নপ্রকার ভৌতিক নিয়মাবলি দ্বারা চালিত হবে এবং বিভিন্ন প্রকার জ্ঞানলাভ করবে। কখন বা দেবলোকে, কথন ব৷ তপলোকে, কখন বা জনলোকে, কথন বা সত্যলোকে তোমার জীবাত্মা বিচরণ করবে এবং সকল অবস্থায় একমাত্র মায়া দ্বারা ইহা চালিত হবে। সেজন্য সনাতন হিন্দুধৰ্ম আমাদিগকে এই মহাশক্তি মায়াদেবীর নিকট মস্তক অবনত করিতে উপদেশ দেয়। জগদম্বা মহেশ্বরীই মায়াদেবী। এস, আমরা তাহার শ্ৰীচরণকমলে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান পূৰ্ব্বক সাষ্টাঙ্গে প্রণত হই।
এখন মায়াবাদের উপর আধুনিক উন্নত জড়বিজ্ঞান কিরূপ মতামত প্রকাশ করে, তা ও সকলের জানা উচিত। বিজ্ঞান মায়াবাদের উপর উপহাস ও বিদ্রুপ করে। ইহার মতে মায়াবাদরূপ কতকগুলি কাল্পনিক জ্ঞানে মানবমনকে বিভোর করলে, সংসারের অণুমাত্র উপকার নাই বরং উহাদ্বারা ইহার প্রভূত অনিষ্ট সাধন হয়; কারণ লোকে মায়াবাদ পাঠ করিয়া সংসার উপেক্ষা করিতে শিক্ষা করে মাত্র। অতএব এ সকল মতামত সমাজে যত অপ্রচলিত হয়, সমাজের ততই মঙ্গল। বিজ্ঞানের মতে যে জ্ঞান তুমি মায়াজ্ঞান বা মিথ্যাজ্ঞান বলিয়া উপেক্ষা করিতে শিক্ষা কর, তাহাই তোমার যথার্থ ও সত্যজ্ঞান এবং উহার উন্নতিতে তোমার উন্নতি এবং তোমার সমাজের উন্নতি। অতএব সেই যথার্থ জ্ঞান শিক্ষা করাই জীবনের মুখ্যব্রত হওয়া উচিত। সে জ্ঞানকে কি কখনো মিথ্যাজ্ঞান বলে উপেক্ষা করা যায় ? অধ্যাত্মবিজ্ঞান বলুক, বেদান্ত বলুক, আর যে শাস্ত্র বলুক না কেন, উহাদের বিকৃত উপদেশে কে কৰ্ণপাত করে ? যতদিন তুমি এ জগতে থাক, ততদিন কেবল ঐ মিথ্যা, তথাকথিত মায়াজ্ঞান লইয়াই তোমায় থাকিতে হয়। ঐ মিথ্যাজ্ঞান ত্যাগ করিলে, কোথায় তুমি অন্য সত্যজ্ঞান পাবে ? তবে কেন তুমি মায়াবাদের কুহকজালে পতিত হও? আরও দেখ, বেদান্তের মায়াবাদ দ্বারা লোকে সংসারাশ্রম ত্যাগ করতঃ বন জঙ্গলে গিয়া বাস করিতে শিক্ষা করে এবং সেইসঙ্গে পৃথিবীকে জঙ্গলাকীর্ণ করে। কিন্তু লোকে বিজ্ঞানানুশীলন করিয়া বন জঙ্গল পরিষ্কার করতঃ পৃথিবীকে নন্দনকানন ও প্রমোদোদ্যান করে। তবে কেন এই অত্যুজ্জল বিংশ শতাব্দীতে মায়াবাদের কথা উত্থাপন করিয়া জিহবা অপবিত্র কর ? ঐ সকল অশ্লীল, অশ্রোতব্য কথা যতই পুস্তক হইতে দূরীভূত হয়, সমাজের ততই মঙ্গল।
এখন সমাজে জড়বিজ্ঞানের অধিক প্রতিপত্তি ও সমাদর। অতএব উহারই উপদেশ শিরোধাৰ্য্য করা সকলের কৰ্ত্তব্য।illusion-2
শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : সপ্তম অধ্যায় – জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ ভগবান সকল জীবের কল্যাণ চিন্তা করে ঘোষনা করছেন-
[ভগবৎতত্ত্ব কি, কিরূপে তদ্‌গত-চিত্ত হওয়া যায় – শ্রীভগবান্‌ স্বয়ং এই অধ্যায়ে তাহা বলিতেছেন ।]
শ্রীভগবান্‌ বলিলেন – হে পার্থ, ভক্ত সর্বতোভাবে আমার শরণাগত হইয়া (অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ, দান বা তপস্যাদি কর্মের ফলাশ্রয় না করিয়া) আমাতে মনোনিবেশ-পূর্বক যোগাভ্যাস করিলে বিভূতি, বল, শক্তি ও ঐশ্বর্যাদিসম্পন্ন পুর্ণস্বরূপে (সগুণ ও নির্গুণরূপে) আমাকে নিঃসংশয়ে যেরূপে জানিতে পারিবে, তাহা শ্রবণ কর । ১
অপরোক্ষ অনুভূতির সহিত মদ্‌বিশয়ক এই জ্ঞান নিঃশেষে তোমাকে উপদেশ দিব । স্বানুভূতির সহিত তাহা লাভ করিলে সংসারে আর অন্য কিছু জ্ঞাতব্য অবশিষ্ট থাকে না । ২
বিদ্রঃ- মায়াবাদ সম্পর্কে শ্ৰীশ্ৰীনাথ ঘোষ বৈজ্ঞানিক হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ থেকে আলোকপাত। মনে রাখবেন, চৈতন্য মহাপ্রভু যে ‘মায়াবাদী’ কথার উল্লেখ করেছেন তা বৌদ্ধ মায়াবাদ কে উদ্দেশ্য করে।
তথ্যসুত্র- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, বৈজ্ঞানিক হিন্দু ধর্ম, দর্শন সমগ্র।
নিবেদনে- শ্রী কৃষ্ণকমল
Share:

ধর্মীয় রীতি কুসংস্কার না বিজ্ঞান?

মন্দিরে ঘণ্টা বাজানো থেকে শুরু করে নদীতে কয়েন ফেলা, এমনকি নমস্কার করা, এ সবই আমরা হিন্দুধর্মের রীতি মেনে করে থাকি। অনেকে হিন্দু ধর্মের রীতিনীতিকে কুসংস্কার বলে মনে করেন। কিন্তু আপনারা কী জানেন হিন্দু ধর্মের এই সমস্ত প্রথা বা রীতিনীতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে? আর তাই যুগ-যুগ ধরে এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। কী এই ঐতিহ্য বা প্রথাগুলি, যার পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে? আজ প্রথম পর্ব।


নদীতে কয়েন ফেলা: আমাদের ধারণা, নদীতে কয়েন ফেললে, তা আমাদের জন্য গুড লাক নিয়ে আসবে। কিন্তু এর একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কারণও রয়েছে। প্রাচীন কালে তামার মুদ্রা প্রচলিত ছিল, আজকের যুগের মতো স্টেইনলেস স্টিলের মুদ্রা নয়। মানবশরীরের জন্য তামা খুব উপকারি ধাতু। জলের মাধ্যমে আমাদের শরীরে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে তামা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্যই আমাদের পূর্বপুরুষরা এই প্রথা চালু করেন। কারণ, নদীই পানীয় জলের একমাত্র উত্‍‌স।

হাতজোড় করে নমস্কার করা: কাউকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আমরা সাধারণত হাতজোড় করে নমস্কার করে থাকি। এই প্রথার প্রচলিত ব্যাখ্যা হল, কাউকে নমস্কার করার অর্থ তাঁকে সম্মান প্রদর্শন। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, হাতজোড় করার ফলে আমাদের দুই হাতের পাঁচটি আঙুলের ডগা পরস্পরের সঙ্গে মিলে যায়। যার ফলে আমাদের চোখ, কান এবং মস্তিষ্কের প্রেশার পয়েন্টে চাপ পড়ে। এই চাপই ওই ব্যক্তিকে দীর্ঘ দিনের জন্য মনে রাখতে আমাদের সাহায্য করে।
পায়ের আঙুলে আংটি পড়া: বিবাহিত মহিলারা হিন্দু প্রথা মেনে পায়ের আঙুলে আংটি পড়লেও, এর পিছনে বিজ্ঞান রয়েছে। সাধারণত পায়ের দ্বিতীয় আঙুলে এই আংটি পড়া হয়। ওই দ্বিতীয় আঙুলের একটি স্নায়ু জরায়ু হয়ে হৃদযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। এই আঙুলে আংটি পড়লে, তা জরায়ুকে সুস্থ, সবল রাখে। এর ফলে রক্তপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং নিয়মিত মাসিক হয়। রুপো ভালো কনডাক্টর হওয়ায় তা পৃথিবী থেকে পোলার এনার্জি আত্মসাত্‍‌ করে শরীরে ছড়িয়ে দেয়।

তিলক করা: কপালে, দু’টি ভুরুর মাঝখানে তিলক করি। দুই ভুরুর মাঝখানের অংশে মানবশরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ু বর্তমান। মনে করা হয়, তিলক শক্তি অপচয় রোধ করে। লাল রঙের কুমকুম মানবশরীরে শক্তি বজায় রাখে এবং মনোযোগের বিভিন্ন স্তর নিয়ন্ত্রণ করে। কপালে কুমকুম লাগানোর সময়ে ভুরুর মাধখানের অংশ এবং আদ্য-চক্রে চাপ পড়ে। এর ফলে মুখের পেশিতে রক্ত চলাচল সুচারু ভাবে সম্পন্ন হয়।

মন্দিরে ঘণ্টা বাজাই কেন? মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকার আগে আমরা ঘণ্টা বাজাই। আগামা শাস্ত্রে বলা গয়েছে, ঘণ্টাধ্বনি সেখান থেকে অশুভ শক্তিকে দূরে রাখে এবং সেই ধ্বনি ঈশ্বরের প্রিয়। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, ঘণ্টাধ্বনি আমাদের মস্তিষ্ক পরিষ্কার করে। ঘণ্টা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের ডান এবং বাম অংশ এক হয়ে যায়। ইকো মোডে ৭ সেকেন্ড পর্যন্ত ঘণ্টাধ্বনি বজায় থাকে। এই সাত সেকেন্ডে আমাদের শরীরের সাতটি আরোগ্য কেন্দ্র সক্রিয় হয়। যার ফলে আমাদের মস্তিষ্কে বর্তমান সমস্ত নেগেটিভ চিন্তাধারা মুছে যায় এবং ঈশ্বর আরাধনায় আমাদের সম্পূর্ণভাবে মনোযোগী করে তোলে।

বছরে দু’বার নবরাত্রি কেন হয়? এই ২ মাসে ঋতু পরিবর্তন হয়। আবার এই দুই মাসের খাদ্যাভ্যাসও একে অপরের থেকে আলাদা। পরিবর্তিত ঋতুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময়ের প্রয়োজন। নবরাত্রি মানবশরীরকে সেই সময় দেয়, যাতে মানুষ পরিবর্তিত ঋতুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। এই ৯ দিনের উপবাসে মানুষ অত্যধিক পরিমাণে নুন বা চিনি খায় না। যা মানুষের শরীর পরিষ্কার করে দেয়। এর ফলে মানুষের পজিটিভ এনার্জি, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ব্যক্তি পরিবর্তিত ঋতুর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

তুলসি পুজো কেন করি? হিন্দু ধর্মে তুলসিকে মা মনে করা হয়। বৈদিক যুগের সাধুরা তুলসির উপযোগিতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাই তাঁরা সকলের মনে ধারণা গড়ে তোলেন যে তুলসি ঈশ্বরসম এবং সমগ্র সমাজের কাছে তুলসি সংরক্ষণের বার্তা পৌঁছে দেন। তুলসি মানবজাতির জন্য সঞ্জিবনী। তুলসির একাধিক ঔষধি গুণ রয়েছে। এটি অসাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক। চা বা অন্য কোনও ভাবে তুলসি খেলে তা মানবশরীরের অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করে এবং মানুষকে রোগমুক্ত করে। এমনকি আয়ুও বাড়িয়ে তোলে। বাড়িতে তুলসি গাছ রাখলে, তা কীটপতঙ্গ বা মশা ঘরে ঢুকতে দেয় না। কথিত আছে, সাপ তুলসি গাছের ধারে-কাছে যেতে সাহস করে না। হয়তো তাই, প্রাচীন কালে বাড়ির সামনে তুলসি গাছ লাগানো থাকত।

অশ্বত্থ গাছের পুজো কেন করি? সাধারণ মানুষের কাছে অশ্বত্থ গাছের কোনও উপকারিতা নেই। ছায়া প্রদান করা ছাড়া এই গাছটি না সুস্বাদু ফল দেয় আর না এর কাঠ এত শক্তপোক্ত, যে তা অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। তা সত্ত্বেও অশ্বত্থ গাছের পুজো কেন করি আমরা? আমাদের পূর্বপুরুষরা জানতেন যে, অশ্বত্থ নির্দিষ্ট কয়েকটি গাছের মধ্যে অন্যতম (বা সম্ভবত একমাত্র গাছ) যা রাত্রিবেলাতেও অক্সিজেন উত্‍‌পন্ন করে। তাই এই গাছকে বাঁচানোর জন্য এর পুজো চালু করা হয়।

ঝাল দিয়ে খাওয়া শুরু, মিষ্টি দিয়ে শেষ: খেতে বসে মশলাদার বা ঝাল খাওয়ার আগে খেতে হয় এবং শেষে মিষ্টি। ছোটবেলা থেকেই আমাদের এই খাদ্যাভ্যাস তৈরি করা হয়েছে। এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস তৈরির কারণ হল, মশলাদার বা ঝাল খাদ্য হজম পদ্ধতিকে সহজ করে দেয়। কিন্তু মিষ্টি বা কার্বোহাইড্রেট হজম পদ্ধতিকে ধীরগতিতে চালিত করে। তাই সব সময় খাবারের শেষে মিষ্টি খাওয়া উচিত।

মাথায় টিকি রাখা: শুশ্রুত ঋষি মাথায় মুখ্য স্পর্শকাতর অংশটিকে অধিপতি মর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যা সমস্ত স্নায়ুর যোগসূত্র। শিখা বা টিকি ওই অংশটিকে নিরাপত্তা প্রদান করে। শরীরের নিম্নাংশ থেকে মস্তিষ্কের নীচে, ব্রহ্মরন্ধ্রে সুশুম্না স্নায়ু পৌঁছয়। যোগ অনুসারে ব্রহ্মরন্ধ্র ১০০০ পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্ম এবং এটি শীর্ষ সপ্তমচক্র। এটি জ্ঞানের কেন্দ্র। গিঁঠ বাধা শিখা বা টিকি কেন্দ্রটিকে উত্‍‌সাহিত করে এবং ওজস নামে পরিচিত এর সূক্ষ্ম শক্তিকে সংরক্ষিত করে।

মেহেন্দি কেন লাগানো হয়: মেহেন্দি খুবই শক্তিশালী ঔষধি। বিয়ের সময় চাপ এবং চিন্তা বেড়ে যায়, যার ফলে মাথাব্যথা, এমনকি জ্বর পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মেহেন্দি শরীর ঠান্ডা করে। ফলে চাপ কমে এবং স্নায়ুকে চিন্তাগ্রস্ত হতে দেয় না। তাই হাতে এবং পায়ে মেহেন্দি লাগানোর প্রথা প্রচলিত।

দীপাবলির আগে ঘর পরিষ্কার: সাধারণত অক্টোবর বা নভেম্বরে দীপাবলি উত্‍‌সব পালিত হয়। দীপাবলির আগে বর্ষাকাল শেষ হয় এবং শীতকাল শুরু হয়। ভারী বৃষ্টির ফলে অনেকের ঘর-বাড়িই সারাই এবং পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়। তাই দিওয়ালির আগে ঘরদোর পরিষ্কার এবং সৌন্দর্যায়নের কাজ করা হয়ে থাকে।

মাটিতে বসে খাদ্যগ্রহণ: মাটিতে বসে খাদ্যগ্রহণের সময়ে আমরা সাধারণত সুখাসনে বসি। সুখাসনে বসে খাবার খেলে তা আমাদের হজমশক্তি বাড়িয়ে দেয়। সংবহনতন্ত্র হজমের ওপর দৃষ্টি দেয়। যা চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে খেলে হয়
sanatandharmatattva.wordpress.com

Share:

হিন্দু ধর্মের সাপেক্ষে নিষিদ্ধ খাবারের সূচী

হিন্দুদের কাছে খাবার বাছাই করা একটি ব্যাক্তিগত, পরম্পরাগত ও নির্দিষ্ট মতবাদের বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। কাজেই এমন অনেক হিন্দু আছেন যারা তাদের বংশানুক্রমিক পরম্পরা ও বিশ্বাসের জন্য কিছু জিনিস খাওয়া ত্যাগ করেছে। যেমন – ভারতের অনেক বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভুক্ত হিন্দু (উত্তর ভারত) আছেন যাদের বাড়িতে মাছ তোলা নিষিদ্ধ। আবার অনেকের হিন্দু বাড়িতে (উত্তর-পশ্চিম ভারত) মাছ মাংশ দুটোই তোলা নিষিদ্ধ। কাজেই হিন্দুদের মধ্যে পরম্পরাগত, ব্যাক্তিগত ও বিশ্বাসী মতবাদগত ফ্যাকটর গুলির উপর অনেক অংশে নির্ভর করে নিষিদ্ধ খাবার গুলি বাছাই এর ক্ষেত্রে।


তাই কারো ব্যাক্তিগত বা পরম্পরাগত পছন্দ তে হস্তক্ষেপ করার জন্য এই নিবন্ধ টি লিখা হয়নি! বরং উক্ত নিবন্ধটি সেইসব বাঙালী হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য লিখা হয়েছে যারা হিন্দু সংস্কার (সম্প্রদায় ভিত্তিক নয়) কে অবলম্বন করে চলেন এবং জানতে ইচ্ছা রাখেন কোন কোন খাবার গুলো হিন্দু শাস্ত্রের সাপেক্ষে সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ। এখানে হিন্দু শাস্ত্র বলতে বেদ, পুরাণ ও তন্ত্রের মূল গ্রন্থ গুলি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই বৈধ-অবৈধ খাবারের সূচীটি বানানো হয়েছে।

প্রাণীজ

✫ ✫ ✫ ✫ ✫ দুধ ✫ ✫ ✫ ✫ 

  উট ও ভেড়ার দুধ পান করা নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২২-২৩, বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.১১-১২, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৭০

  এক খুর বিশিষ্ট প্রাণীর (যেমন – ঘোড়া) দুধ পান করা নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৩, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৭০

  গরু, মোষ, ছাগলের বাচ্চা জন্মানোর পর থেকে ১০দিন যাবৎ তাদের দুধ পান নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৪, বসিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৩৫, বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.৯, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৭০

  নিচুস্তরের পশু (যেমন – কুকুর, বেড়াল) ও মাংসাশী পশুর (যেমন – বাঘ, সিংহ, শৃগাল) দুধ পান নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – লৌগাক্ষিগৃহ্ম সূত্রাণি ২.১৮৪

✫ ✫ ✫ ✫ ✫ ডিম ✫ ✫ ✫ ✫ 

  হাঁস, মুরগি, ময়ুরের ডিম খাওয়া সিদ্ধ।
 তথ্যসূত্র – মানব গৃহসূত্র ১.৪.২-৪, ভেল সংহিতা – চিকিতসাস্থানম – ২৬৭, চরক সংহিতা             ২৭.৬৩-৬৪

✫ ✫ ✫ ✫ ✫ মাছ-মাংস ✫ ✫ ✫ ✫ 

  সাপ, কুমীর, ঘড়িয়াল, শুশুক, সর্প আকৃতির মাছ, ব্যাঙ, অনিয়তকার মস্তক বিশিষ্ট মাছ (যেমন – ইল, কুঁচে মাছ, হাঙর, তিমি ইত্যাদি) ও জলজ শামুক, ঝিনুক, গুগলি ইত্যাদি খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪১, গৌতম ধর্মসূত্র ১৭.৩৬, আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.৩৮-৩৯

  বন্য মোরগ/মুরগি খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৭.৬.৪
★ অর্থ্যাৎ গৃহপালিত মোরগ/মুরগি খাওয়া সিদ্ধ।

  যে সমস্ত পাখী শুধু তাদের পা দিয়ে মাটিতে আঁচড়ে আঁচড়ে খাবারের সন্ধান করে এবং যেসব পাখীরা লিপ্তপদী (যেমন – হাঁস) তাদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪৮, গৌতম ধর্মসূত্র ১৭.৩৪-৩৫, বিষ্ণু স্মৃতি LI.২৮-৩১, বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.৭

  রাজহাঁস, সারস, পানকৌড়ি, বক, কাক, পায়রা, টিয়া, ঘুঘু, তিতির, বাজ, চিল, শকূন, বাদুড়, ময়ূর, স্টার্লিং, দোয়েল, চড়ুই, কাঠঠোঁকরা, মাছরাঙা এবং নিশাচর পাখীর মাংশ খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪৮, গৌতম ধর্মসূত্র ১৭.৩৪-৩৫, বিষ্ণু স্মৃতি LI.২৮-৩১, বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.৭, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৭২-১৭৪

  মাংসাশী পাখির মাংশ আহার নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.৩৪, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৭২

  যেকোনো বিস্বাদ ও খাদ্য অনুপযোগী মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – মনু স্মৃতি ৫.১১-১৭, বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪৪

  যে সমস্ত পশুর দুধের দাঁত ভাঙেনি তাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪৫, গৌতম ধর্মসূত্র ১৭.৩০-৩১
★ অর্থ্যাৎ অপ্রাপ্তবয়স্ক পশুর মাংস আহার নিষিদ্ধ।

  যে সমস্ত পশুর একটি মাত্র চোয়ালে দাঁত আছে (যেমন-ঘোড়া) তাদের মাংস আহার নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪০, মনু স্মৃতি ৫.১৪, বিষ্ণু স্মৃতি LI.৩০

  যে সমস্ত প্রাণীর পা বহু অংশে বাঁকা। যেমন শজারু, কাঁটাচয়া, শশক, খরগোশ, কচ্ছপ, গোধা, গোধিকা ইত্যাদির মাংশ খাওয়া সিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৩৯, গৌতম ধর্মসূত্র ১৭.২৭, বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.৫, মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৭.৬.৪

  গণ্ডার ও বন্য শূকরের মাংশ খাওয়া সিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪৭, বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.৫

  নরমাংস বা নরাকার যন্তুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – মহানির্ব্বাণ তন্ত্র ৮.১০৮

  গৃহপালিত পশু, ছাগল, ভেড়ে, শূকরের মাংশ খাওয়া বৈধ।
তথ্যসূত্র – বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.১-৪
★ অর্থ্যাৎ গৃহপালিত শূকরের মাংস বৈধ।

  গ্রাম্য শূকরের মাংস নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৭.৬.৪, আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৯

★ গ্রাম্য শূকর বলতে ফালতু শূকরের সেইসব প্রজাতি গুলোকে বোঝানো হয়, যারা আকারে ছোটো এবং পঙ্কিল নোংরা স্থানেই শুধু বাস করে। নোংরা স্থানে থাকার জন্য এদের মাংসে কৃমিজাতীয় পরজীবীর সিস্ট থাকে যা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করলে মানুষ সংক্রমিত হয়। উক্ত কারণের জন্য গ্রাম্য শূকরের মাংস নিষিদ্ধ কিন্তু গৃহপালিত শূকর নয়।

  যেকোনো মৃত প্রাণীর মাংস আহার করা নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৬.১৬

  বহু উপকারী গোজাতির মাংস আহার নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – মহানির্ব্বাণ তন্ত্র ৮.১০৮, বিষ্ণু পুরাণ ৩.৩.১৫, ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ ১.৯.৯, বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪৩-৪৫

  গৌর, ঘায়ল, সরাভ, ষাঁড় প্রভৃতি গো সম্প্রদায় ভুক্ত জীবের মাংস নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৪৩, আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৯

  মাংসাশী প্রাণীর মাংস নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – মহানির্ব্বাণ তন্ত্র ৮.১০৮, গৌতম ধর্মসূত্র ১৭.৩৪

★ মূলত মাংসাশী প্রাণী বলতে উচ্চতর প্রাণীদের বোঝানো হয়েছে যেমন – বাঘ, সিংহ, শৃগাল, বন্য কুকুর ইত্যাদি। এদের শিকার করা কঠিন এবং মাংস নিরস, দুর্গন্ধ এবং কুরুচিকর স্বাদ যুক্ত হওয়ার জন্য পরিত্যাজ্য।

  একখুর বিশিষ্ট প্রাণীর (যেমন – উটের) মাংস নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৯

  কৃষ্ণসার, নীলগাই, সাধারণ হরিণ, বন্য শূকরের মাংস খাওয়া বৈধ।
তথ্যসূত্র – বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.৬

  স্বাদু ও লবণাক্ত জলের মাছ (যেমন- বিভিন্ন মেজর ও মাইনর কার্প, খাঁড়ির মাছ ইত্যাদি) আহার হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ।
তথ্যসূত্র – বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.৮

অন্যান্য

  মাদক দ্রব্য মিশ্রিত পানীয় নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২১

  সুরা ও সুরা প্রস্তুতের জন্য ব্যাবহৃত দ্রব্য সমূহ নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৫

  ব্যাঙের ছাতা, শালগম নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৮, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৭১, বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৩৩

  যেকোনো আহারে উপযোগী বীজ, ফল, মূল, সব্জি খাওয়া বৈধ।
তথ্যসূত্র – নারদ পুরাণ ১১.১২-২২

  সুস্বাদু আহারে উপযোগী রস (যেমন – খেঁজুরের রস, তালের রস, আখের রস, ডাবের জল, ফলের রস ইত্যাদি), দুগ্ধজাত পদার্থ (যেমন – দুধ, ঘি, মাখন, দই) মধু ইত্যাদি বৈধ।
তথ্যসূত্র – নারদ পুরাণ ১৮.১২-১৩

  রসুন, পেঁয়াজ, পলাণ্ডু খাওয়ার উপর বিতর্কিত বিধান আছে, কাজেই ইহা খাওয়া যেতে পারে।

★আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২৬, মনু স্মৃতি ৫.৫, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ১.১৭৬, বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৩৩ অনুসারে পেঁয়াজ রসুন খেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অপরদিকে বৈদিক আয়ুর্ব্বেদ শাস্ত্র গুলিতে ভিন্ন চিকিৎসার কাজে পেঁয়াজ রসুনের ব্যাবহার উল্লেখ রয়েছে। কাজেই পেঁয়াজ রসুন খাওয়া কে নিষিদ্ধ বলা অযৌক্তিক।

  টকে যাওয়া (ব্যাতিক্রম – দই) বা পচে যাওয়া বা কোনো খাবারে উভয়ে মিশ্রিত খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৭.২০, বৌধায়ন ধর্মসূত্র ১.৫.১২.১৫, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৬৭

  কুকুর, বিড়াল, বানর, মহিষ প্রভৃতি বন্য প্রাণীর মাংস আহার নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – লৌগাক্ষিগৃহ্ম সূত্রাণি ২.১৯৩, বশিষ্ট ধর্মসূত্র ১৪.৩৩, মানব গৃহসূত্র ১.৪.২-৪

  যে খাবারে কোনো পশু মুখ দিয়েছে তা খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – গৌতম ধর্মসূত্র ১৭.১০, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৬৭

  যে সব খাবারে পোকা জন্মছে তা খাওয়া নিষিদ্ধ।
তথ্যসূত্র – আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৫.১৬.২৬, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ৭.১৬৭

উক্ত নিষিদ্ধতার বাইরের খাদ্য বস্তু বা আহার সামগ্রী সমূহ বৈধ, কারণ সেইসব আহার সামগ্রীর উপরে নিষিদ্ধতা আরোপ হয়নি হিন্দুশাস্ত্র সমূহে।

Writer and Editor Samir Kumar Mondal
Collect from: sanatandharmatattva.wordpress.com
Share:

মানবজীবনের সার্থকতা কোথায় ?

"লব্ধ্বা সুদুর্লভমিদং বহুসম্ভবান্তে
মানুষ্যমর্থদমনিত্যমপীহ ধীরঃ ।
তূর্ণং যতেত ন পতেদনুমৃত্যযাব-
ন্নিঃশ্রেয়সায় বিষয়ঃ খলু সর্ব্বতঃ স্যাৎ ॥"

-শ্রীমদ্ভাগবতম্

      উপরোক্ত শ্নোকটি হইতে ষ্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে এই মানবজীবন জীবের কত সুদুর্লভ ও মূল্যবান সস্পদ । দেবদুর্লভ এই অমূল্য সম্পদ লাভ করিয়া জীব যদি ইহার সার্থকতা উপলব্ধি করিতে না পারে, যদি মায়ার মোহে বিভ্রাস্ত জীব প্রাকৃত জগতের সুখ-দুঃখের অন্বেষণে এই জীবনে প্রাপ্ত অল্প কয়েকটি বৎসর বৃথা অতিবাহিত করিয়া দেয়, তাহা হইলে তাহার আর দুঃখের অবধি থাকে না । অনন্তের (Eternity) তুলনায় মনুষ্যের এই জীবিতকাল কতটুকু ? কয়েকটি নিমেষমাত্র বলিলেও অত্যুক্তি হয় না । কিন্তু তথাপি এই অল্প কয়েকক্ষণ অতি মূল্যবান—ইহার একাংশও বৃথা ব্যয় করিলে পরিণামে অশেষ দুঃখ ভোগ করিতে হয় । জন্ম যখন হইয়াছে, তখন মৃত্যু একদিন ঘটিবেই । আর এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে যখন একদিন না একদিন বরণ করিতেই হইবে—ইহার অনিবার্য্য গতি রোধ করিবার মত শক্তি যখন মানুষের নাই, তখন এই পার্থিব জগতের সুখ-দুঃখ, সম্পদ-বিপদের মধ্যে নিজকে সম্পূর্ণ ভাবে নিমজ্জিত করিয়া এবং অবশেষে মৃত্যুকালে দারা-পুত্র-পরিজনের জন্য চিন্তা করিতে করিতে সজলনয়নে এই পৃথিবী হইতে বিদায় লওয়া যে অতিমাত্রায় মূর্খতার পরিচয়—ইহা যে কেহ চিন্তা করিলে উপলব্ধি করিতে পারিবেন ।

      তথাকথিত পার্থিব-সভ্যতাগর্ব্বিত, অজ্ঞানতার গভীরতম পঙ্কে নিমজ্জিত, মায়ামুগ্ধ-জীব, এই চরম সত্যকে অস্বীকার করিবার স্পর্দ্ধা দেখায়—সাংসারিক লাভালাভের অঙ্ক নির্দ্ধারণ করিয়া, নানা পাপকর্ম্মে জীবনের দিনগুলি অতিবাহিত করিয়া অবশেষে মৃত্যবরণ করে এবং পরিণামে অশেষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করে । ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে ?

      জীবনের এই ভয়ঙ্কর পরিণামের কথা যুগে যুগে মহাপুরুষগণ জীবকে বারবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন । অশ্রুসজল-নয়নে প্রতিটী জীবের কাছে তাঁহাদের কাতর আবেদন জানাইয়া বলিয়াছেন ;— ওগো অমৃতের সন্তানগণ, এই মূল্যহীন জাগতিক লাভ-লোকসান ব্যাপারে বৃথা কালক্ষেপ না করিয়া একবার শ্রীভগবানের শরণ লও । তাঁহার শ্রীচরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দাও ও তাঁহাতেই নিজের মন-প্রাণ, সমস্ত সত্ত্বা অর্পণ কর—দেখিবে, পরম শান্তি লাভ করিবে, অনন্ত আনন্দের সন্ধান পাইবে । জাগতিক সুখ-দুঃখ, জরা, ব্যাধি সকলের ঊর্দ্ধ্বে তুমি স্থানলাভ করিবে ; মৃত্যুও তোমাকে ভয় দেখাইতে সাহস করিবে না—তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী হইবে । সেই আত্মচেতনা লাভ করিয়া নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিতে পারিবে ; দেখিবে—তুমি কত বড়, কত মহান্ ! ক্ষণিক সুখ-মোহে কর্ত্তব্যপথ বিস্মৃত হইয়া যে পার্থিব বিষয়ে নিজকে এতদিন লিপ্ত রাখিতে চাহিয়াছ, সেই জগৎ কত ক্ষুদ্র ! সে আজ তোমার দিকে মুগ্ধ-বিস্ময়ে চাহিয়া—তোমার পূজায় নিজকে ধন্য জ্ঞান করিতেছে । স্বর্গের অমরগণও তোমার ন্যায় মর-জীবন কামনা করিতেছে ।

      ইহাই মনুষ্যজীবনের চরমতম সার্থকতা । কিন্তু কৃপাময় শ্রীভগবানের কৃপা ব্যতিরেকে ইহা কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে । সেইজন্য—

শ্রবণং কীর্ত্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনং ।
অর্চ্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্ ॥

এইভাবে নিঃশেষে তাঁহার চরণে নিজের সমস্ত কিছু উৎসর্গ করিয়া মনে-প্রাণে তাঁহার সেবায় নিজকে নিয়োগ করিলে তবেই তাঁহার কৃপালাভ করা যায়,—নচেৎ নিছক স্বার্থান্ধভাবে লাভালাভের কথা চিন্তা করিয়া এবং বহু গ্রন্থ পাঠ দ্বারা সারাজীবন তর্ক ও বিচারাদি করিয়াও তাঁহার কণামাত্র কৃপা লাভ করা যায় না । "বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর," তাঁহার উপর অনন্ত-বিশ্বাস রাখিয়া একান্ত নির্ভরশীলভাবে ভজবৎ কথা শ্রবণ-কীর্ত্তন ও ভগবৎ সেবায় সদাসর্ব্বদা প্রতিটী মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করিতে হইবে এবং পরিপূর্ণভাবে তাঁহাতেঈ আত্মসমর্পণ করিতে হইবে । আমি যখন তাঁহার সেবায় মন-প্রাণ অর্পণ করিয়াছি, তখন আমার কথা নিতিই বিন্তা করিবেন, নিজের জন্য আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই ;— এই যে পূর্ণ-বিশ্বাস ও অনন্ত-বির্ভরতা ইহার তুলনা নাই । সকল শাস্ত্রগ্রন্থাদির ঊর্দ্ধ্বে ইহার স্থান । এইরূপভাবে ভজনা করিয়া ভক্ত, ভগবানের কৃপালাভে সমর্থ হন এবং তদনুগ্রহ লাভ করিয়া নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করেন । শ্রীভগবানও ভক্তের এইরূপ সেবায় পরম প্রীতিলাভ করেন ।

শ্রীগৌড়ীয়-দর্শন, ১ বর্ষ, ১ সংখ্যা
১১ হৃষিকেশ, ২৮শে শ্রাবণ, ১৪ আগষ্ট, রবিবার, গৌরাব্দ ৪৬৯, বাং ১৩৬২, ইং ১৯৫৫

Share:

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মূল শিক্ষা

আম্নায়ঃ প্রাহ তত্ত্বং হরিমিহ পরমং সর্ব্বশক্তিং রসব্ধিং
তদ্ভিন্নাংশাংশ্চ জীবান্ প্রকৃতি-কবলিতান্ তদ্বিমুক্তাংশ্চ ভাবাৎ ।
ভেদাভেদ-প্রকাশং সকলমপি হরেঃ সাধনং শুদ্ধভক্তিং
সাধ্যং তৎ প্রীতিমেবেত্যুপদিশতি জনান্ গৌরচন্দ্র স্বয়ং সঃ ॥

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)

স্বয়ং ভগবান্ শ্রীমদ্ গৌরচন্দ্র এই দশটি তত্ত্ব জীবগণকে উপদেশ করিতেছেন ।
(১) আম্নায়-বাক্যই প্রধান প্রমাণ । তদ্দ্বারা নিম্নলিখিত নয়টি সিদ্ধান্ত উপদিষ্ট হইয়াছে ।
(২) কৃষ্ণস্বরূপ হরি জগন্মধ্যে পরমতত্ত্ব ।
(৩) তিনি সর্ব্বশক্তিমান্ ।
(৪) তিনি অখিল-রসামৃত-সমুদ্র ।
(৫) জীবসকল হরির বিভিন্নাংশ তত্ত্ব ।
(৬) তটস্থ গঠনবশতঃ জীবসকল বদ্ধদশায় প্রকৃতিকর্ত্তৃক কবলিত ।
(৭) তটস্থ ধর্ম্মবশতঃ জীবসকল মুক্তদশায় প্রকৃতি হইতে মুক্ত ।
(৮) জীব-জড়াত্মক সমস্ত বিশ্বই শ্রীহরি হইতে যুগপৎ ভেদ ও অভেদ ।
(৯) শুদ্ধভক্তিই জীবের সাধন ।
(১০) শুদ্ধ-কৃষ্ণপ্রীতিই জীবের সাধ্য ।



শুদ্ধভক্তির ক্রমপন্থা

(শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভুর শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু হইতে উদ্ধৃত)

(১) শ্রদ্ধা—সাধুসঙ্গে শাস্ত্র-শ্রবণদ্বারা শাস্ত্রের অর্থে বিশ্বাস ।
(২) সাধুসঙ্গ—দ্বিতীয় সাধুসঙ্গ, ভজনরীতি-শিক্ষার জন্য ইহাই গুরুপদাশ্রয় ।
(৩) ভজনক্রিয়া—গুরু ও সাধুগণের উপদেশ-ক্রমে শ্রবণ-কীর্ত্তনাদিরূপ ভজন ।
(৪) অনর্থনিবৃত্তি—পরমপুরুষার্থ বিরোধী পাপ, অবিদ্যাদি ক্লেশ ক্ষয় ।
(৫) নিষ্ঠা—চিত্তবিক্ষেপশূন্য নিরন্তর ভজন ।
(৬) রুচি—বুদ্ধিপূর্ব্বক ভজনে বা ভজনীয় বিষয়ে অভিলাষ ।
(৭) আসক্তি—ভজনে বা ভজনীয় বিষয়ে স্বাভাবিকী রুচি ।
(৮) ভাব—প্রেমসূর্য্যের কিরণস্থলীয় বিশুদ্ধসত্ত্বরূপ রুচিদ্বারা চিত্তকে যে তত্ত্ব মসৃণ করে, তাহাকেই ‘ভাব’ বলে ।
(৯) প্রেম—যখন সেই ভাব চিত্তকে সম্যক্ মসৃণ করিয়া অত্যন্ত মমতা দ্বারা পরিচিত হয় এবং স্বয়ং গাঢ়-স্বরূপ হয়, তখন তাহাকে পণ্ডিতসকল ‘প্রেম” বলিয়া উক্তি করেন ।



চতুঃষষ্টি ভক্ত্যঙ্গ

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের অমৃতপ্রবাহভাষ্য হইতে উদ্ধৃত)

(১) গুরুপাদাশ্রয়, (২) মন্ত্রদীক্ষা, (৩) গুরুসেবা, (৪) সদ্ধর্ম্ম শিক্ষা ও জিজ্ঞাসা, (৫) সাধুদিগের পথানুগমন, (৬) কৃষ্ণপ্রীতির জন্য নিজের ভোগত্যাগ, (৭) কৃষ্ণতীর্থে বাস, (৮) যাহামাত্র পাইলে জীবন নির্ব্বাহ হয়, সেইরূপ পরিমাণে প্রতিগ্রহ, (৯) একদশীর উপবাস, (১০) ধাত্রি-অশ্বত্থ-গো-বিপ্র-বৈষ্ণবের সম্মান, (১১) সেবাপরাধ ও নামাপরাধকে দূরে বর্জ্জন, (১২) অবৈষ্ণব-সঙ্গত্যাগ, (১৩) বহুশিষ্য না করা, (১৪) বহুগ্রন্থের কলা অর্থাৎ আংশিক অভ্যাস এবং ব্যাখ্যাবাদত্যাগ, (১৫) হানিতে এবং লাভে সমবুদ্ধি, (১৬) শোকাদির বশ না হওয়া, (১৭) অন্য দেবতা বা শাস্ত্রের অবজ্ঞা না করা, (১৮) বিষ্ণু ও বৈষ্ণবের নিন্দা না শুনা, (১৯) গ্রাম্যবার্ত্তা অর্থাৎ স্ত্রী-পুরুষের ইন্দ্রিয়তর্পণমূলক গৃহবার্ত্তা না শুনা, (২০) প্রাণিমাত্রের মনের উদ্বেগ না জন্মান, ব্যবহারে অকার্পণ্য, মহারম্ভের অনুদ্যম, (২১) শ্রবণ, (২২) কীর্ত্তন, (২৩) স্মরণ, (২৪) পূজন, (২৫) বন্দন, (২৬) পরিচর্য্যা, (২৭) দাস্য, (২৮) সখ্য, (২৯) আত্মনিবেদন, (৩০) শ্রীবিগ্রহের অগ্রে নৃত্য, (৩১) গীত, (৩২) বিজ্ঞপ্তি, (৩৩) দণ্ডবৎ প্রণাম, (৩৪) অভ্যুত্থান অর্থাৎ ভগবান্ বা ভক্ত আসিতেছেন দেখিয়া দাঁড়ান, (৩৫) অনুব্রজ্যা অর্থাৎ ভক্ত বা ভগবান্ যাত্রা করিলে পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাওয়া, (৩৬) তীর্থে এবং ভগবদ্​গৃহে গমন, (৩৭) পরিক্রমা, (৩৮) স্তবপাঠ, (৩৯) জপ, (৪০) সংকীর্ত্তন, (৪১) ভগবৎ-প্রসাদী ধূপ ও মাল্যের গন্ধগ্রহণ, (৪২) মহাপ্রসাদ সেবন, (৪৩) আরত্রিক-মহোৎসব-দর্শন, (৪৪) শ্রীমূর্ত্তি-দর্শন, (৪৫) নিজ প্রিয়বস্তু ভগবান্​েক অর্পণ, (৪৬) ধ্যান, (৪৭) তুলসী-সেবন, (৪৮) বৈষ্ণব-সেবন, (৪৯) মথুরায় বাস, (৫০) ভাগবতের আস্বাদ, (৫১) কৃষ্ণের জন্য অখিল চেষ্টা, (৫২) তাঁহার কৃপা-প্রতীক্ষা, (৫৩) ভক্তগণের সহিত জন্মদিনাদির মহোৎসব, (৫৪) সর্ব্বপ্রকারে শরণাপত্তি, (৫৫) কার্ত্তিকাদি ব্রত, দেহে (৫৬) বৈষ্ণবচিহ্ণধারণ, দেহে (৫৭) হরিনামাক্ষরধারণ, দেহে (৫৮) নির্ম্মাল্যধারণ, (৫৯) চরণামৃত পান, (৬০) সাধুসঙ্গ, (৬১) নামকীর্ত্তন, (৬২) ভাগবৎ-শ্রবণ, (৬৩) মথুরাবাস, (৬৪) শ্রদ্ধাপূর্ব্বক শ্রীমূর্ত্তি-সেবা ।



চতুর্থ প্রকার অনর্

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের শ্রীভজনরহস্য হইতে উদ্ধৃত)

(১) তত্ত্ব বিভ্রম—(ক) স্বতত্ত্বে ভ্রম, (খ) পরত্ত্বে ভ্রম, (গ) সাধ্য-সাধন-তত্ত্বে ভ্রম, (ঘ) বিরোধী বিষয়ে ভ্রম ।
(২) অসত্তৃষ্ণা—(ক) ঐহিক বিষয়ে এষণা অর্থাৎ ইচ্ছা বা অন্বেষণ, (খ) পারত্রিক বিষয়ে অশুভা এষণা, (গ) যোগ-বিভূতিবাঞ্ছা ও মোক্ষ কামনা ।
(৩) অপরাধ—(ক) নামাপরাধ, (খ) সেবাপরাধ, (গ) বৈষ্ণবাপরাধ, (ঘ) ধামাপরাধ, (ঙ) জীবাপরাধ ।
(৪) হৃদয়দৌর্ব্বল্য—(ক) তুচ্ছ অর্থাৎ কৃষ্ণেতর বিষয়ে আসক্তি, (খ) কুটীনাটী অর্থাৎ কপটতা, (গ) মাৎসর্য্য অর্থাৎ পরশ্রী কাতরতা, ও (ঘ) প্রতিষ্ঠাশা ।



পঞ্চরোগ

(১) অবিদ্যা—অজ্ঞান অর্থাৎ জীব নিজের চিৎস্বরূপ ভুলিয়াছে ।
(২) অস্মিতা—স্থুল জড়দেহে আত্মবুদ্ধি ও স্ত্রী-পুত্রাদির নশ্বরদেহে মমতাবুদ্ধি ।
(৩) রাগ—দেহের অনুকূল জড়বিষয়ে তীব্র আসক্তি ।
(৪) দ্বেষ—বিষয় ভোগের প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষবুদ্ধি ।
(৫) অভিনিবেশ—অনুকূল বিষয়ের প্রতি মমতা বা আবিষ্টতা এবং তাহার ত্যাগে অসহিষ্ণুতা ।



বদ্ধজীবের চারপ্রকার দোষ

(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত হইতে উদ্ধৃত)

(১) ভ্রম—যে বস্তু যাহা নহে, তৎসম্বন্ধে মিথ্যজ্ঞান; যথা—রজ্জুতে সর্পভ্রম, শুক্তিতে রজত-ভ্রম ।
(২) প্রমাদ—অনবধানতা, এককথা অন্যপ্রকারে উপলব্ধি করা বা শ্রবণ করা বা বলা । (৩) বিপ্রলিপ্সা—বঞ্চনেচ্ছু  ।
(৪) করণাপাটব—ইন্দ্রিয়ের অপটুতা; যথা—চক্ষুর দূরদর্শনরাহিত্য, ক্ষুদ্রবস্তুদর্শনরাহিত্য, কাম্​লাদিরোগে বর্ণ (রূপ) জ্ঞানের বিপর্য্যয়, সুদূর-স্থিত শব্দশ্রবণে অক্ষমতা ।



দশবিধ নামাপরাধ

(১) সাধুনিন্দা,
(২) কৃষ্ণেতর দেবতায় স্বতন্ত্র ভগবদ্ জ্ঞান,
(৩) গুর্ববজ্ঞা,
(৪) শ্রুতিশাস্ত্র-নিন্দন,
(৫) শ্রীহরিনামে অর্থবাদ,
(৬) শ্রীনামে কল্পনা জ্ঞান,
(৭) শ্রীনামবলে পাপবুদ্ধি,
(৮) শ্রীহরিনাম গ্রহণকে প্রমাদবশতঃ অন্য শুভকর্মের সহিত সমান জ্ঞান,
(৯) জড়-আসক্তি-ক্রমে শ্রদ্ধাহীনে নাম-দান,
(১০) শ্রীনাম-মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়াও জড় অহং-মমাদি ভাবপ্রযুক্ত নামের প্রতি অপ্রীতি ।



চতুর্থ প্রকার সাধুনিন্দা

যিনি বৈষ্ণবের (১) জাতি দোষ, (২) কাদাচিৎক অর্থাৎ প্রমাদাগত দোষ, (৩) নষ্টপ্রায় দোষ, (৪) শরণাগতির পূর্ব্বাচরিত দোষ ধরিয়া বৈষ্ণবকে নিন্দা করেন, তিনি বৈষ্ণব নিন্দুক ।



৩২ প্রকার সেবাপরাধ

(১) যানাদি-যোগে অথবা পাদুকা পরিধান করিয়া ভগবদ্-গৃহে গমন, (২) ভগবজ্জন্মাদি যাত্রার উৎসব না করা, (৩) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে প্রণাম না করা, (৪) উচ্ছিষ্টগাত্রে অথবা অশুচি অবস্থায় শ্রীবিগ্রহের বন্দনা, (৫) একহস্তে প্রণাম, (৬) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে পায়চারি করা, (৭) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে পাদ-প্রসারণ, (৮) পর্যঙ্ক-বন্ধন অর্থাৎ শ্রীবিগ্রহের অগ্রে হস্তদ্বয়দ্বারা জানুদ্বয় বন্ধনপূর্ব্বক উপবেশন, (৯–১৭) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে শয়ন, ভোজন, মিথ্যাভাষণ, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা , পরস্পর ইত কথার আলোচনা, রোদন, কলহ, কাহারও প্রতি নিগ্রহ, কাহারও প্রতি অনুগ্রহ, (১৮) সাধারণের প্রতি নিষ্ঠুর-বাক্য-ব্যবহার, (১৯) লোমকম্বলে আবৃত হইয়া সেবাকার্যাদি করা, (২০-২৩) শ্রীমূর্তির সম্মুখে পরনিন্দা, পরস্তুতি, অশ্লীল-বাক্য ব্যবহার, অপানবায়ু পরিত্যাগ, (২৪) বিত্তশাঠ্য অর্থাৎ সামর্থ্য থাকিতে অল্প উপচারে অথবা অল্প ব্যয়ে পূজা ও উৎসবাদি করা, (২৫) অনিবেদিত বস্তু গ্রহণ, (২৬) যে সময়ে যে ফল ও শস্যাদি উৎপন্ন হয়, সেই সময়ে তাহা অর্পণ না করা, (২৭) সংগৃহীত দ্রব্যের অগ্রভাগ অন্যকে প্রদান করিয়া অবশিষ্টাংশ ব্যঞ্জনে প্রদান, (২৮) শ্রীমূর্তিকে পশ্চাতে রাখিয়া উপবেশন, (২৯) শ্রীমূর্তির সম্মুখে অন্যকে অভিবাদন, (৩০) শ্রীগুরুদেবের অগ্রে স্তবাদি না করিয়া মৌনভাবে অবস্থান, (৩১) শ্রীগুরুদেবের সম্মুখে আত্ম-প্রশংসা, (৩২) দেবতা-নিন্দা ।



দশবিধ ধামাপরাধ

(১) শ্রীধাম-প্রদর্শক শ্রীগুরু ও সাধুকে অবজ্ঞা, (২) শ্রীধামকে অনিত্য-বোধ, (৩) শ্রীধামবাসী ও ভ্রমণকারীর প্রতি হিংসা ও জাতিবুদ্ধি, (৪) শ্রীধামে বসিয়া বিষয়কার্যাদির অনুষ্ঠান, (৫) শ্রীধাম-সেবাচ্ছলে শ্রীধাম-বিগ্রহের ব্যবসায় ও অর্থোপার্জন, (৬) জড়-বুদ্ধিতে ধামের সহিত জড়দেশের অথবা অন্য দেবতীর্থের সমজ্ঞান ও পরিমাণচেষ্টা, (৭) শ্রীধামবাস-বলে পাপাচরণ, (৮) শ্রীনবদ্বীপ ও শ্রীবৃন্দাবনে ভেদজ্ঞান, (৯) ধামমাহাত্ম্যমূলক শাস্ত্র-নিন্দা এবং (১০) শ্রীধাম-মাহাত্ম্যে অবিশ্বাসমূলে অর্থবাদ ও কল্পনা-জ্ঞান ।



কলির পাঁচ স্থান

(শ্রীমদ্ভাগবতম্ হইতে উদ্ধৃত)

(১) দ্যূত; যথা—তাস, দাবা, পাশা, ঘোড়দৌড়, জলের খেলা, জুয়া, লটারি, সতরঞ্চ, দশপঁচিশ, বাঘবন্দী, প্রভৃতি । তার মধ্যে মিথ্যা থাকে । এই করিলে সত্যের নাশ হয় ।
(২) পান; যথা—তাম্বূল, গুবাক, নস্য, তামাক, গাঁজা, অহিফেন, সুরা, ভাং, কালকূট, ধুস্তর, তাড়ি, প্রভৃতি । মাধ্বিক, ঐক্ষব, দ্রাক্ষ্য, তাল, খর্জ্জুর, পনসজাত, মৈরেয়, মাক্ষিক, টাঙ্ক, মাধুক, নারিকেলজাত ও অন্নজাত 
এই দ্বাদশপ্রকার মদ্যও পান মধ্যে গণ্য । তার মধ্যে গর্ব্ব থাকে । এই করিলে দয়ার নাশ হয় ।
(৩) স্ত্রী; যথা—অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ ও নিজ বৈধ স্ত্রীতে আসক্তি (এবং স্ত্রীসঙ্গীর সঙ্গ) । তার মধ্যে কাম থাকে । এই করিলে শৌচের নাশ হয় ।
(৪) সূনা অর্থাৎ নিজ দেহ পোষণের জন্য অপরকে হত্যা করা । প্রাণিবধের মধ্যে হিংসা থাকে । এই করিলে সত্য, দয়া, শৌচ এবং তপের নাশ হয় । পশুহননে অনুমোদনকারী, হতপশুর মাংসবিভাগকারী, স্বয়ং হন্তা, মাংসক্রয়বিক্রয়কারী, পাচক, পরিবেশক, এবং ভক্ষক এই কয়জনই ঘাতকশ্রেণীভুক্ত ।
(৫) জাত অর্থাৎ সুবর্ণ, রৌপ্যাদি দ্রব্য এবং টাকা পসায়া । স্বর্ণের মধ্যে মিথ্যা, গর্ব্ব, স্ত্রীজনিত কাম, হিংসা, ও শত্রুতা নামক একটী পঞ্চম অনর্থ বিরাজিত ।



ভক্তির প্রতিকূল

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)

(১) বাক্যবেগ—ভূতোদ্বেগকারী বচনপ্রয়োগ ।
(২) মনবেগ—নানাবিধ মনোরথ ।
(৩) ক্রোধবেগ—রূঢ়বাক্যাদি-প্রয়োগ ।
(৪) জিহ্বাবেগ—মধুর-অম্ল-কটু-লবণ-কষায়-তিক্তভেদে ষড়বিধ রস-লালসা ।
(৫) উদরবেগ—অত্যন্ত ভোজন-প্রয়াস ।
(৬) উপস্থবেগ—স্ত্রী-পুরুষ-সংযোগ-লালসা ।



ভক্তির কণ্টক

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)

(১) অত্যাহার—অধিক আহরণ বা সংগ্রহ বা সঞ্চয়চেষ্টা ।
(২) প্রয়াস—ভক্তি-বিরোধিচেষ্টা বা বিষয়োদ্যম ।
(৩) প্রজল্প—কালহরণকারী অনাবশ্যক গ্রাম্যকথা ।
(৪) নিয়মাগ্রহ—উচ্চাধিকার-প্রাপ্ত-সময়ে নিম্নাধিকারগত নিয়মে আগ্রহ এবং ভক্তিপোষক নিয়মের অগ্রহণ ।
(৫) জনসঙ্গ—শুদ্ধভক্ত-জনসঙ্গ ব্যতীত অন্যজনসঙ্গ ।
(৬) লৌল্য—নানামতবাদি-সঙ্গে অস্থির-সিদ্ধান্ত অর্থাৎ চাঞ্চল্য এবং তুচ্ছ বিষয়ে আকৃষ্ট হওয়া ।



ভক্তির অনুকূল

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)

(১) উৎসাহ—ভক্তির অনুষ্ঠানে ঔৎসুক্য, আদরের সহিত অনুশীলন ।
(২) নিশ্চয়—দৃঢ় বিশ্বাস ।
(৩) ধৈর্য্য—অভীষ্টলাভে বিলম্ব দেখিয়া সাধনাঙ্গে শৈথিল্য না করা ।
(৪) ভক্তিপোষক কর্ম্ম— শ্রবণ-কীর্ত্তনাদি এবং শ্রীকৃষ্ণ জন্য স্বীয় ভোগ-সুখ-পারিত্যাগাদি ।
(৫) সঙ্গত্যাগ—অধর্ম্ম, স্ত্রীসঙ্গ, ও স্ত্রৈণ-ভাবরূপ যোষিৎসঙ্গ, যোষিৎসঙ্গি-সঙ্গ এবং অভক্ত অর্থাৎ বিষয়ী, মায়াবাদী, নিরীশ্বর ও ধর্ম্মধ্বজীর সঙ্গত্যাগ ।
(৬) সদ্বৃত্তি—সাধুগণ যে সদাচার অনুষ্ঠান করিয়াছেন এবং যে বৃত্তির দ্বারা জীবন নির্ব্বাহ করিয়াছেন ।





জয় ধ্বনি

জয় সপরিকর শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-গান্ধর্ব্বা-গোবিন্দসুন্দর জীউ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেব-গোস্বামী মহারাজ কী জয় !
জয় ঁও বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী ভগবান্ শ্রীমদ্ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর কী জয় !
জয় ঁও বিষ্ণুপাদ শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর কী জয় ! জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজী মহারাজ কী জয় !
শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভু কী জয় !
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তী ঠাকুর কী জয় !
শ্রীনরোত্তম শ্যামানন্দ শ্রীনিবাস আচার্য্য প্রভু-ত্রয় কী জয় !
শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর কী জয় !
শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী কী জয় !
শ্রীরূপ, সনাতন, ভট্ট রঘুনাথ, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট, দাস রঘুনাথ, ষড়্-গোস্বামী প্রভু কী জয় !
শ্রীরূপানুগ গুরুবর্গ কী জয় !
নামাচার্য্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর কী জয় !
শ্রীল স্বরূপ দামোদর, শ্রীল রায় রামানন্দ শ্রীগৌরশক্তিবর্গ কী জয় !
প্রমসে কহো শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ কী জয় !
সপার্ষদ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কী জয় !
সপার্ষদ শ্রীমন মহাপ্রভু কী জয় !
শ্রীনবদ্বীপধাম কী জয় !
শ্রীপুরুষোত্তমধাম কী জয় !
বলদেব-সুভদ্রা-জগন্নাথ জীউ কী জয় !
শ্রীবৃন্দাবনধাম কী জয় !
শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ গোপ-গোপী শ্যামকুণ্ড রাধাকুণ্ড গিরিগোবর্দ্ধন কী জয় !
গঙ্গা যমুনা কী জয় !
ভক্তিদেবী বৃন্দাদেবী তুলসীদেবী কী জয় !
গ্রন্থরাজ শ্রীমদ্ভাগবতম্ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত কী জয় !
আকর মঠরাজ শ্রীচৈতন্য মঠ কী জয় !
তদীয় শাখা মঠসমূহ কী জয় !
শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠ কী জয় !
বিশ্বব্যাপী তদীয় শাখা মঠ কী জয় !
অনন্তকোটী বৈষ্ণববৃন্দ কী জয় !
সমবেত বৈষ্ণববৃন্দ কী জয় !
হরিনামসঙ্কীর্ত্তন কী জয় !
নিতাই গৌর প্রেমানন্দে !
হরিবোল !



শ্রীহরিবাসর তিথি বিধি

প্রশ্ন: কখন শ্রীহরিবাসর তিথি পালনীয় ?
উত্তর: ভগবান্ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর লিখেছেন যে “একাদশীতে অরুণোদয়-বিদ্ধা ত্যাগ এবং অন্যব্রতে সূর্য্যোদয়-বিদ্ধা ত্যাগ করিয়া অবিদ্ধা ব্রতই পালনীয় । বিদ্ধা-ব্রত-পালন দোষ এবং অবিদ্ধা ব্রতপালনেই ভক্তি হয়” । শ্রীহরিভক্তিবিলাসমতে বছরের সকল শুদ্ধ (অবিদ্ধা) ব্রত তিথি বিশুদ্ধ সারস্বত গৌড়ীয় পঞ্জিকায় জানা যাবে ।
প্রশ্ন: শ্রীএকাদশীব্রতের পালন করতে হবে কেন ?
উত্তর: ষড়গোস্বামী অন্যতম মহাজন শ্রীল সনাতন গোস্বামী প্রভু লিখেছেন একাদশীব্রতের নিত্যতার (অবশ্য-কর্ত্তব্যতা) চারিটি কারণ—

তচ্চ কৃষ্ণপ্রীণনত্বাদ্বিধিপ্রাপ্তত্বতস্তথা ।

ভোজনস্য নিষেধাচ্চাকরণে প্রত্যবায়তঃ ॥

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস: ১২।৪)

“(১) শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিহেতু, (২) শাস্ত্রীর বিধি থাকায়, (৩) ব্রতদিনে (অন্ন) ভোজন নিষেধ থাকায় এবং (৪) ব্রত অকরণে দোষভাগী হইতে হয়” । তিনি তাঁহার নিজ-কৃত ভাষ্য ব্যাখ্যা করেছিলেন যে যদিও অকরণে দোষভাগীতা মুখ্য নিত্যতা, তবুও শুদ্ধভক্তগণের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিহেতুতাই পরম মুখ্য, এই কারণে তিনি তাহাই প্রথম লিখেছিলেন এবং আরো বলেছেন—
তত্র ব্রতস্য নিত্যত্বাদবশ্যং তৎ সমাচরেৎ ।

 সর্ব্বপাপাহং সর্ব্বার্থদং শ্রীকৃষ্ণতোষণম্ ॥

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৩)

“এই শ্রীহরিবাসর-ব্রতের নিত্যতাহেতু সর্ব্বপাপহারী, সর্ব্বফলপ্রদ ও শ্রীকৃষ্ণতোষণ-ব্রত অবশ্য সম্পূর্ণভাবে আচরণ করিবেন” ।

একাদশীব্রতং নাম সর্ব্বকামফলপ্রদম্ ।

কর্ত্তব্যং সর্ব্বদা বিপ্রৈর্বিষ্ণুপ্রীণনকারণম্ ॥

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৮ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)

“সকল কামফলপ্রদ শ্রীএকাদশীব্রত বিষ্ণু-তোষণের জন্যই বিপ্রগণের সর্ব্বদা আচরণ করা কর্ত্তব্য” । আনুষঙ্গিক ফলস্বরূপ চতুর্ব্বর্গ ফল (ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) এসে গেলেও ঐকান্তিক শুদ্ধভক্ত ঐ সকল তুচ্ছ ফল অনুরক্ত না হয়ে পঞ্চমপুরুষার্থ প্রেমফল লাভে আগ্রহী হয়ে থাকেন ।
প্রশ্ন: শ্রীএকাদশীতে অন্ন শস্যাদি গ্রহণ নিষেধ কেন ?
উত্তর: শাস্ত্র এই রূপ বলেছেন—

যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাসমানি চ ।

অন্নমাশ্রিত্য তিষ্ঠন্তি সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে ।

তানি পাপান্যবাপ্নোতি ভুঞ্জানো হরিবাসরে

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।১৯ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)

“ব্রহ্মহত্যা ও তৎসম এবং যতকিছু পাপ শ্রীহরিবাসরদিনে অন্নকে আশ্রয় করে থাকে । সুতরাং একাদশীতে অন্ন ভোজনকারী ব্যক্তি ঐসকল পাপ যুক্ত হয় ।”

সোঽশ্নাতি পার্থিবং পাপং যোঽশ্নোতি মধুভির্দ্দিনে ।

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।২০ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)

“যে ব্যক্তি শ্রীহরিবাসরে অন্ন ভোজন করে, সেই ব্যক্তি পৃথিবীর যতকিছু পাপ ভোগ করে ।”

মাতৃহা পিতৃহা চৈব ভ্রাতৃহা গুরুহা তথা ।

একাদশ্যান্তু যো ভুঙ্ক্তে বিষ্ণুলোকাচ্চ্যুতো ভবেৎ ॥

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।২১ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)

“যে ব্যক্তি একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, সেই ব্যক্তি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা ও গুরুহত্যার পাপ সকল প্রাপ্ত হয় এবং বিষ্ণুলোকে কখনও গমন করতে পরে না, বা বৈষ্ণবধর্ম্মচ্যুত হওয়ায় বৈষ্ণব সঙ্গ পায় না ।”
ইত্যাদি শাস্ত্র প্রমাণ অনুসারে শ্রীএকাদশীতে উপবাস করা কর্ত্তব্য ।
প্রশ্ন: উপবাস কাহাকে বলে ?
উত্তর: নিকটে বাস—গৃহকার্য্য-বিষয়কার্য্যাদি পরিত্যাগ করে ভগবানের নিকটে বাস । যথা—

উপাবৃত্তস্য পাপেভ্যো যস্তু বাসো গুণৈঃ সহ ।

উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ঃ সর্ব্বভোগবিবর্জ্জিতঃ ॥

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১৩।৩৫ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)

“সকল পাপ হতে নিবৃত্ত হয়ে সদ্গুণ সমূহের সহিত যে মনুষ্যের বাস হয়, তাহাকে উপবাস বলে, এই উপবাসে সমস্ত ভোগ বর্জ্জিত জানতে হবে” ।

বৈষ্ণবো যদি ভুঞ্জীত একাদশ্যাং প্রমাদতঃ ।

বিষ্ণ্বর্চ্চনং বৃথা তস্য নরকং ঘোরমাপ্নুয়াৎ ॥

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৩২ সংখ্যায় ব্রহ্মবৈবর্ত্তপূরণ-বাক্য)

“বৈষ্ণব যদি ভ্রম বশতঃ একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, তবে তাহার বিষ্ণুপূজা বিফল হয় এবং তাহার ভয়ঙ্কর নরক প্রাপ্তি হয়” ।
প্রশ্ন: কিভাবে শ্রীহরিবাসর তিথি পালন করতে হবে ?
উত্তর: শ্রীহরিবাসরের মূলকৃত্য শ্রবণ, কীর্ত্তনাদি নববিধা-ভক্তি যজন । যেমন শ্রীমন্মহাপ্রভু বলেন (শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১০,২১)—

শ্রীহরিবাসর-দিনে কৃষ্ণনামরসপানে
 তৃপ্ত হয় বৈষ্ণব সুজন ।

অন্য রস নাহি লয় অন্য কথা নাহি কয়
 সর্ব্বভোগ করয়ে বর্জ্জন ॥
শ্রীনামভজন আর একাদশী ব্রত ।

এক-তত্ত্ব নিত্য জানি’ হও তাহে রত ॥

শ্রীহরি-বাসরে অধিক কীর্ত্তনদ্বয় করণীয়—সকালে শ্রীহরিবাসরে হরিকীর্ত্তন-বিধান ও রাত্রিতে শুদ্ধ ভকত-চরণ-রেনু ভজন-অনুকূল । শ্রীহরিবাসরে উপবাস এবং পারণ করা কর্ত্তব্য, যেমন (প্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১১)—

প্রসাদ ভোজন নিত্য শুদ্ধ বৈষ্ণবের কৃত্য
 অপ্রসাদ না করে ভক্ষণ ।

শুদ্ধা একাদশী যবে নিরাহার থাকে তবে
 পারণেতে প্রসাদ ভোজন ॥১১॥

পঞ্জিকায় উল্লিখিত পারণ সময়ের মধ্যে শ্রীএকাদশী ব্রত ভঙ্গের জন্য মহাপ্রসাদাদি গ্রহণ অবশ্য কর্ত্তব্য । শ্রীহরিবাসরে যেন সারাদিন সেবা-সাধনে থাকা যায় তার জন্য শাস্ত্র অনুমোদিত অনুকল্প গ্রহণীয়, যেমন (প্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১১)—

অনুকল্পস্থানমাত্র নিরন্ন প্রসাদপাত্র
 বৈষ্ণবকে জানিহ নিশ্চিত ।
শ্রীএকাদশীতে অনুকল্প আয়োজন এই রূপ—
অষ্টৈতান্যব্রতঘ্নানি আপো মূলং ফলং পয়ঃ ।

হরির্ব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনমৌষধম্ ॥

(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।১০০ সংখ্যায় মহাভারত-বাক্য)

“জল, ফল, মূল, দুগ্ধ, ঘৃত ও ব্রাহ্মণ প্রার্থনীয়, গুরুবাক্য ও ঔষধ—এই আটটি ব্রতনাশক হয় না” । শ্রীমঠে ভক্তগণ এইভাবে অনুকল্প গ্রহণ করেন—

সকালে—পূর্ণ উপবাস ।
মধ্যাহ্নে—লবণ, গোল মরীচ, জীরা, আদা সহ আলু পেপে তরকারি, আলু ভাজা, বিভিন্ন ফল (কলা, শশা আদি), বাদাম, পেপে মিষ্টি আলু পায়েস বা সাগু ।
রাত্রিতে—আলু পেপে তরকারি, আলু ভাজা, বাদাম, দুধ ।

শুধু ঘি, বাদাম তেল, সূর্য্যমুখী তেল ব্যবহার করা যাবে । শস্যযুক্ত কোন দ্রব্য যেমন গুড়া মশলা, ময়দাযুক্ত সাগু ইত্যাদি গ্রহণ করা যাবে না । সেইজন্য ঘরের তৈরী ঘি, ছানা অথবা নারকেল মিষ্টি দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে । এই সকল পঞ্চ রবিশস্য অবশ্যই বর্জ্জনীয়—(১) ধান্য অথবা ধান্যজাতীয় দ্রব্য—চাল, চিড়া, মুড়ি প্রভৃতি, (২) গোধূম—আটা, ময়দা প্রভৃতি, (৩) যব—যবের ছাতু, বার্লি প্রভৃতি, (৪) ডাল—মুগ, মসূর, ছোলা, মটর, অড়হর, কলাই, খেসারি প্রভৃতি, (৫) সরিষার তৈল ও তিল তৈল ।
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।