• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

উপসংহার

বাঙ্গালী হিন্দুর সম্মুখে আজ কি ঘোর দুর্দিন উপস্থিত, এই প্ৰবন্ধাবলীতে আমরা যথাসাধ্য সুস্পষ্টভাবে তাহা দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি। বাঙ্গালী হিন্দুর সংখ্যা ক্রমশঃ ক্ষয় হইতেছে,-কি উচ্চস্তরে কি নিম্নস্তরে সর্বত্রই এই ক্ষয়ের লক্ষণ আমরা দেখিতে পাইতেছি। একদিকে মধ্যবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে প্ৰাকৃতিক বিপৰ্য্যয়, অন্য দিকে হিন্দু সমাজের অন্তর্নিহিত দৌৰ্ব্বল্য ও সঙ্ঘশক্তিহীনতা—বাঙ্গালী হিন্দুর জীবনীশক্তিকে ক্রমশঃ হ্রাস করিয়া ফেলিতেছে, তাহার উপর আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থা—বাঙ্গালী হিন্দুর ভবিষ্যৎ আশঙ্কাজনক করিয়া তুলিয়াছে। যদি এখনও বাঙ্গালী হিন্দু সচেতন হইয়া আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা না করে, তবে অদূর ভবিষ্যতে, হয়, তাহারা লুপ্ত হইবে, নতুবা শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতিভ্ৰষ্ট দাসজাতিরূপে কোনরূপে টিকিয়া থাকিবে এবং তাহা মৃত্যুরই তুল্য। এতকাল ধরিয়া বাঙ্গালী হিন্দু যে সংস্কৃতি ও সভ্যতা গড়িয়া তুলিয়াছিল, তাহার চিহ্নমাত্র থাকিবে না।


বাঙ্গালী হিন্দুই গত শতাব্দীতে জাতীয় আন্দোলন প্ৰবৰ্ত্তিত করিয়াছিল, কংগ্রেসের সৃষ্টি করিয়াছিল, সমগ্ৰ ভারতীয় জাতির প্ৰাণে স্বাধীনতার প্রেরণা দিয়াছিল, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান প্রচারে তাহারাই অগ্ৰণী হইয়াছিল, এমন এক সাহিত্য গড়িয়া তুলিয়াছিল, যাহার তুলনা কেবল ভারতে নহে, সমগ্র এশিয়াতেও নাই। জীবনের সৰ্ববিভাগে এমন সব প্ৰতিভাশালী ব্যক্তিদের জন্ম দিয়াছিল, যাহারা সমগ্ৰ ভারতের গৌরব, এমন কি অনেকস্থলে বিশ্বেরও গৌরব। সেই বাঙ্গালী হিন্দুর আজ কি শোচনীয় দুৰ্গতি ! সৰ্ব্বভারতীয় রাজনীতিতে তাহার প্রতিষ্ঠা নাই, জ্ঞানবিজ্ঞানেও তাহার বুদ্ধি যেন ম্লান হইয়া পড়িয়াছে,—সৰ্ব্বভারতীয় কোন ব্যাপারে নেতৃত্ব করিবার জন্য আজ আর তাহার ডাক পড়ে না। ইহাতেও যদি বাঙ্গালী হিন্দুর চৈতন্য না হয়, তবে আর কিসে হইবে ?


বাঙ্গলার হিন্দু যুবকদিগকে, শিক্ষিত বাঙ্গালী হিন্দুসমাজ এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদিগকে আমরা বলি,—সৰ্ব্বভারতীয় সমস্যা ও জাতীয় আন্দোলন আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকিবে। সেই দিকে সমস্ত শক্তি নিয়োজিত না করিয়া একবার নিজেদের ঘরের দিকে দৃষ্টি ফিরান,—কিরূপে ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুসমাজকে রক্ষা করা যায়, তাহার উপায় চিন্তা করুন। সকল বিষয়েই ভারতের অন্য প্রদেশের নেতাদের মুখের দিকে অসহায় ভাবে চাহিয়া থাকিলে চলিবে না, কেননা, বাঙ্গালী হিন্দুর সমস্যা লইয়া মাথা ঘামাইবার সময় তাঁহাদের নাই। নিজেদের সমস্যা সমাধানের ভার নিজেদেরই গ্রহণ করিতে হইবে। বাঙ্গালী হিন্দু যদি নিজেরাই না বঁচিল, তবে সৰ্ব্বভারতীয় সমস্যা বা জাতীয় জীবনের বড় বড় সমস্যার জন্য ব্যাকুল হইয়া ফল কি ? আর যাঁহারা মনে করেন যে, এরূপ করিলে জাতীয়তাকে ত্যাগ করিয়া সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হইবে, তাহাদিগকে বলি, আত্মরক্ষা কি সাম্প্রদায়িকতা ? সাম্প্রদায়িকতার ভয়ে যাহারা নিজেদের জীবনমরণ সমস্যা চিন্তা করিতে ভয় পায়, তাহাদের বুদ্ধি মোহাচ্ছন্ন, তাহারা আত্মঘাতী ।


বাঙ্গালী হিন্দুর এই জীবনমরণ সন্ধিক্ষণে রক্ষণশীল সনাতনপন্থী সমাজপতিদের নিকট আমাদের বিশেষ নিবেদন, তাঁহারা ‘আৰ্য্যামি’ ও সনাতনী গৰ্ব্ব ত্যাগ করিয়া—বাস্তব অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। এই গ্রন্থে যেসব তথ্য সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, তাহা একটু মনোযোগ দিয়া পড়িলেই তাহারা বুঝিতে পরিবেন,—বাঙ্গালী হিন্দু কিরূপ দ্রুতগতিতে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইতেছে। এই ধ্বংস নিবারণ করিতে হইলে বৰ্ত্তমান যুগের উপযোগী আমূল সমাজসংস্কার করিতে হইবে, হিন্দুসমাজের সংহতিশক্তি যাহাতে বাড়ে, তাহার উপায় উদ্ভাবন করিতে হইবে। অতীতে হিন্দুসমাজের সম্মুখে বহুবার এরূপ সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছিল, কিন্তু প্রাচীনেরা যুগোপযোগী সংস্কার করিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন। বৰ্ত্তমান যুগের বাঙ্গালা হিন্দুর বুদ্ধি ও প্রতিভা কি এতই বন্ধ্যা হইয়াছে যে, তাহারা যুগোপযোগী সমাজসংস্কার করিয়া আত্মরক্ষা করিতে পারিবে না ?
সৰ্ব্বাগ্রে হিন্দুসমাজের নিম্নজাতিদের ক্ষয় নিবারণ করিতে হইবে। বহু শতাব্দী ধরিয়া তাহাদের প্রতি যে নিপীড়ননীতি আমরা অবলম্বন করিয়া আসিয়াছি, তাহা ত্যাগ করিয়া উহাদিগকে মনুষ্যত্বের মৰ্য্যাদা দিতে হইবে। অস্পৃশ্যতাবর্জ্জন, জাতিভেদের কঠোরতা ও সঙ্কীর্ণতা নিবারণ এবং অসবর্ণ বিবাহ—হিন্দু সমাজের সংহতিশক্তি গঠনের পক্ষে এই তিনটী পন্থাই অপরিহার্য্য। উচ্চবর্ণের হিন্দুদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে, হিন্দুসমাজে তাহারা সংখ্যাল্প, শতকরা ৩০ জনের বেশী নহে। অবশিষ্ট শতকরা ৭০ জনই তথাকথিত নিম্ন জাতির হিন্দু। সেই নিম্নজাতির হিন্দুদিগকে যদি আমরা উপেক্ষা করি, তাহারা যদি কৰ্ম্মক্ষেত্রে আমাদের পার্শ্বে না দাঁড়ায়, তবে হিন্দুসমাজ ছত্ৰভঙ্গ হইয়া পড়িবে।

ব্রিটিশ শাসকেরা হিন্দুসমাজের আভ্যন্তরীণ ভেদের সুযোগ লইয়া একটা কৃত্ৰিম ‘তপসীলী জাতির’ সৃষ্টি করিয়াছেন। যদি উচ্চজাতিরা এখনও সনাতনী গর্ব ও ঔদ্ধত্য ত্যাগ না করেন, তবে হিন্দুসমাজ অদূর ভবিষ্যতে বহু খণ্ডে বিভক্ত হইয়া পড়িবে। এই বিংশ শতাব্দীতে যে সব শিক্ষিত হিন্দু সনাতনী আৰ্য্য সাজিয়া প্রাচীন সরস্বতী নদীর তীর বা নৈমিষ্যারণ্যের দুঃস্বপ্ন দেখিতেছেন, তাহাদিগকে সূক্ষ্ম ভণ্ডামি ও ভাববিলাস ত্যাগ করিয়া আমরা আত্মস্থ হইতে অনুরোধ করি। বৈদিক যুগ বা বৌদ্ধ যুগের জয়গান করিয়া আমরা বিশ শতাব্দীর এই কঠোর জীবনসংগ্রামে আত্মরক্ষা করিতে পারিব না।


সৰ্ব্বোপরি মনে রাখিতে হইবে, হিন্দুনারীদিগকে যদি আমরা সমাজে যোগ্য স্থান না দেই, তাহাদের মনুষ্যত্বের মৰ্য্যাদা ও অধিকার স্বীকার না করি, তবে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত। আমরা সুস্পষ্টরূপে দেখাইয়াছি, হিন্দুসমাজের ক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ বিধবাবিবাহ নিযেধ। নারীদের প্রতি আমরা যে ঘোর অবিচার করিয়া আসিতেছি, তাহার প্রতিকার করিবার একটা প্ৰাথমিক উপায় বিধবাবিবাহের সুপ্ৰচলন। অন্য নানাদিক দিয়া হিন্দুসমাজে বিবাহ সমস্যার যে অনাবশ্যক ও অর্থহীন জটিলতা গত কয়েক শতাব্দী ধরিয়া আমরা সৃষ্টি করিয়াছি, জাতিক্ষয় নিবারণ করিতে হইলে তাহা ও দূর করা একান্ত প্রয়োজন ।

বাঙ্গলার ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুজাতিকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব আজ আমাদের মাথার উপর পড়িয়াছে। যদি এই দায়িত্ব আমরা পালন করিতে না পারি, তবে ইতিহাস চিরদিনের জন্য আমাদের নাম কলঙ্কিত হইয়া থাকিবে।

সমাপ্ত

গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

মানব সভ্যতায় ‘অহিংসার স্থান’

মহাত্মা গান্ধী কিছুদিন পূর্বে “প্রত্যেক ব্রিটেনের প্রতি” এই শিরোনামা দিয়া যে পত্ৰখানি প্ৰকাশ করিয়াছেন,1 তাহা মানবসভ্যতার ইতিহাসে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। পত্ৰখানি তিনি ভারতের বড়লাট ও রাজপ্ৰতিনিধির মারফৎ ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্টের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন। ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট তাহার একটা উত্তরও বড়লাটের মারফৎ গান্ধীজীকে দিয়াছেন। তাঁহারা সৌজন্যসহকারে জানাইয়াছেন যে, বৰ্ত্তমান অবস্থায় মহাত্মাজীর পরামর্শ গ্ৰহণ করিতে তাঁহারা অক্ষম।


সমগ্ৰ ইউরোপ যখন নাজীবাহিনীর পদভরে টলমল, সমুদ্র পরিখাবেষ্টিত ব্রিটেন হিটলারের বিমানবাহিনীর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার পন্থী উদ্ভাবনে ব্যাপৃত, তখন ব্রিটিশ জাতির নিকট অস্ত্ৰ ত্যাগের জন্য প্ৰস্তাব করা বর্তমান জগতে একমাত্ৰ মহাত্মা গান্ধীর পক্ষেই সম্ভব। অন্য কেহ এরূপ প্ৰস্তাবের কথা কল্পনাই করিতে পারিত না। কল্পনা করিতে পারিলেও, তাহা প্ৰকাশ্যে ব্যক্ত করিতে সাহস পাইত না, অন্ততপক্ষে দ্বিধাবোধ করিত। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সাধারণ মানব নহেন, অসাধারণ মানব। অসাধারণ মানবেরাই অসাধারণ প্ৰস্তাব করিতে পারেন। অনুরূপ অবস্থায় বুদ্ধ, খ্রীস্ট বা চৈতন্যও খুব সম্ভব ঐ রূপ প্ৰস্তাবই করিতেন। পক্ষান্তরে, ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট যে জবাব দিয়াছেন, কোন সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্র বা গবৰ্ণমেণ্টেও উহা ব্যতীত অন্য কোনরূপ উত্তর দিতে পারিতেন না।


মহাত্মা গান্ধী কেবল ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্টের নিকটই এইরূপ প্ৰস্তাব করেন নাই, ভারতের গণশক্তির প্রতিনিধি, জাতীয় প্ৰতিষ্ঠান কংগ্রেসের নিকট ও অনুরূপ প্ৰস্তাব করিয়াছেন। কিন্তু যে কারণে ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট মহাত্মা জীর প্ৰস্তাব গ্রহণ করিতে পারেন নাই, সেইরূপ কারণেই কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটিও তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারেন নাই। ইতিপূৰ্ব্বে মহাত্মাজী চীন, আবিসিনিয়া, চেকোশ্লাভাকিয়া, প্ৰভৃতিকেও ঐরূপ পরামর্শ দিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, তাহারাও উহা গ্রহণযোগ্য মনে করে নাই।


মহাত্মাজীর এই প্ৰস্তাবটি বড়লোকের খেয়াল বা পাগলামী বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। বস্তুত, মহাত্মাজী তাহার প্রস্তাবের মধ্য দিয়া যে প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছেন, তাহা মানবসভ্যতার একটা জটিল প্ৰশ্ন, উহার উপর মানবসভ্যতা তথা মনুষ্য জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। বুদ্ধ, খ্রীস্ট ও চৈতন্যও এই প্রশ্নই তুলিয়া মানবসভ্যতাকে ঢালিয়া সাজিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহারা সফলকাম হন নাই, মহাত্মাজীও সফলকাম হইবেন না। তথাপি প্রশ্নটি রহিয়া যাইবে এবং অনাগত ভাবিষ্যতে অন্য কোন মহাপুরুষ আসিয়া উহার সমাধানের জন্য পুনরায় চেষ্টা করিবেন। প্রশ্নটি এই—মানুষ কি “হিংসা” ত্যাগ করিয়া, সম্পূর্ণভাবে ‘অহিংসার’ আদর্শের দ্বারাই জীবন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করিবে ? লোক রক্ষা, সমাজস্থিতি, বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে দেশরক্ষা-সমস্তই কি অহিংসা ও মৈত্রীর দ্বারা সাধন করা সম্ভবপর ? মহাত্মা গান্ধী বলিতেছেন, তাহা সম্ভবপর। সমাজস্থিতি রক্ষা, আভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে দেশরক্ষা,—সমস্তই অহিংস উপায়ে করা যাইতে পারে এবং সভ্য মানুষকে তাহাই করিতে হইবে। পরাধীন দেশের পক্ষ হইতে স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রামও তিনি এই অহিংস উপায়ে চালাইবার নির্দেশ দিয়াছেন।


 মহাত্মা গান্ধী বলেন, হিংসা ও বলপ্রয়োগ মানুষের পশুত্ব ও বর্ব্বরতার নিদর্শন। আদিম বর্ব্বর মানুষের পক্ষে এই পন্থা অবলম্বন স্বাভাবিক হইতে পারে। কিন্তু মানুষ যতই সভ্যতার উচ্চস্তরে উঠিয়াছে, ততই সে অধিক পরিমাণে অহিংসা ও মৈত্রীর আদর্শ অনুসরণ করিয়াছে। পৃথিবীতে যে সব প্ৰধান প্রধান ধৰ্ম্ম প্রচারিত হয়েছে, সেগুলিও অহিংসা ও মৈত্রীর আদর্শেই অনুপ্ৰাণিত। আদিম বন্য বর্ব্বর অবস্থায় মানুষ পরস্পরের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ গায়ের জোর, ছাড়া অন্য কোন উপায়ে মিটাইতে জানিত না। কিন্তু মানুষের মধ্যে ধৰ্ম্ম ও নীতি যতই উন্নত হইয়াছে, ততই সে গায়ের জোরের পরিবর্তে বুদ্ধি ও চরিত্রবলের আশ্রয় লইয়াছে; প্রেম ও অহিংসাকেই উচ্চতম নীতি বলিয়া শ্রদ্ধা করিতে শিখিয়াছে। নরমাংস ভক্ষণ, নিহত শত্রুর মাথার খুলি লইয়া গলায় মুণ্ডমালা ধারণ, শত্রুর রক্তপান প্রভৃতি আদিম যুগের প্রথা—সভ্য মনুষ্যসমাজে লোপ পাইয়াছে। মানুষ পরিবার ও সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। অথচ আদিম বর্ব্বর যুগের নিদর্শন যুদ্ধটাই শুধু টিকিয়া থাকিবে কেন ? সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উহাও বিলুপ্ত হওয়া উচিত। নতুবা আদিম বন্য মানুষ ও সভ্য মানুষে প্রভেদ রহিল কি ?


যুক্তির দিক দিয়া কথাগুলি আপাতত নির্ভুল বলিয়াই মনে হয় বটে। কিন্তু এই যুক্তির মধ্যে একটা ফাঁক রহিয়া গিয়াছে, objective reality বা বাস্তব সত্যের সঙ্গে ইহার সামঞ্জস্য সাধন করা যায় না। মানবসভ্যতার একটা বড় ট্রাজেডি এই যে, মানুষ বুদ্ধি ও মেধার দিক দিয়া যেরূপ উন্নত হইয়াছে, ধৰ্ম্ম ও নীতির দিক দিয়া তদনুপাতে উন্নত হয় নাই, বরং অনেক পশ্চাতে পড়িয়া আছে। মানবসভ্যতার ইতিহাস লেখক জনৈক মনীষী এজন্য দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন যে, দুই হাজার বৎসর পূৰ্ব্বেকার মানুষের তুলনায় বৰ্ত্তমান যুগের মানবের বুদ্ধি ও মেধা তীক্ষ্ণতর হইয়াছে, জ্ঞানবিজ্ঞানে সে উন্নত হইয়াছে, প্ৰকৃতির রহস্য ভেদ করিয়া নানা অত্যাশ্চৰ্য্য যন্ত্রের সে আবিষ্কার করিয়াছে; কিন্তু ধৰ্ম্ম ও নীতির দিক দিয়া, প্রেম ও অহিংসার মাপকাঠিতে দুই হাজার বৎসর পূর্ব্বেকার মনুষ্য সমাজের তুলনায় বৰ্ত্তমান যুগের মানুষের কিছুমাত্র উন্নতি হয় নাই। মানুষ ঠিক সেইরূপ নিষ্ঠুর, হিংস্র, ঈৰ্ষাপরায়ণ, পরধনলোভী, দুৰ্ব্বলপীড়কই আছে। তারপর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্বন্ধের মধ্যে মানুষ যেটুকু-বা সত্য, অহিংসা, প্ৰেম, মৈত্রী প্ৰভৃতির নীতি রক্ষণ করিয়া চলিবার চেষ্টা করে, রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে সেটুকুও করে না। এখানে মানুষ একেবারে আদিম যুগের বন্য, বর্ব্বর, হিংস্র।

 বরং আদিম যুগের মানুষের তুলনায় বুদ্ধি ও মেধায় উন্নত হওয়াতে তাহার ক্রূরতা ও হিংস্ৰতা আরও বেশী ভয়ঙ্কর হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিকে সে প্রতিবেশীর সংহার কাৰ্য্যে নিয়োগ করিয়াছে, প্ৰকৃতির গোপন অন্তঃপুর হইতে যে সব অত্যাশ্চৰ্য্য রহস্যের সে সন্ধান পাইয়াছে, তাহার দ্বারা শক্তিশালী মারণাস্ত্ৰসমূহ নিৰ্ম্মাণ করিতেছে। অর্থাৎ তথাকথিত সভ্য, উন্নত মানুষের বুদ্ধি সর্বনাশী মূৰ্ত্তিতে দেখা দিয়াছে। ছিন্নমস্তার ন্যায় সে নিজের রুধির নিজেই পান করিয়া পৈশাচিক আনন্দে নৃত্য করিতেছে। বুদ্ধির দ্বারা শাণিত এই প্রতিযোগিতামূলক হিংসার খেলায়, অথবা বৈজ্ঞানিক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে যদি মহাত্মা গান্ধীর মত দুই একজন আদর্শবাদী মহাপুরুষ অহিংসা ও প্রেমের জয়গান করেন, তবে কে তাঁহাদের কথা শুনিবে ? অহিংসা ও প্রেমের আদর্শের প্রতি যদি কোন মানুষের, সমাজের বা রাষ্ট্রের শ্রদ্ধা থাকিয়াই থাকে, তাহা হইলেও উহার দ্বারা কিরূপে সে আত্মরক্ষা করিবে ?

একজন বুদ্ধ, খ্রীস্ট, চৈতন্য বা মহাত্মা গান্ধী প্রেম ও অহিংসার আদর্শের জন্য পশুবলের নিকট আত্মবলি দিতে পারেন, কিন্তু একটা জাতি বা রাষ্ট্র কিরূপে তাহা করিতে পারে ? মহাত্মা গান্ধীর প্রস্তাবমত যদি কোন জাতি বা রাষ্ট্র হিংসার ভাব সম্পূর্ণ বর্জ্জন করিয়া, অস্ত্ৰত্যাগ করিয়া আততায়ীর নিকট আত্মসমৰ্পণ করে, তাহা হইলে হয় সেই জাতি বা রাষ্ট্র আততায়ী কর্তৃক সম্পূর্ণ ধ্বংস হইবে, অথবা দাসজাতি বা দাসরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। অহিংসার জন্য এই আত্মবিসর্জনের দৃষ্টান্ত দেখিয়া অনাসক্ত মহাত্মা গান্ধী পুলকিত হইতে পারেন, কিন্তু কোন জাতি বা রাষ্ট্রই ঐভাবে আত্মবিসর্জন দিয়া প্রেম ও অহিংসার আদর্শ প্ৰতিষ্ঠায় সম্মত হইতে পারে না। সেই কারণেই ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট মহাত্মা গান্ধীর প্ৰস্তাবে রাজী হইতে পারেন নাই, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিও তাহার প্ৰস্তাবে সায় দেন নাই। কেবল আততায়ী জাতি বা রাষ্ট্রের সম্পর্কেই নয়, কোন দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষেও ঠিক এই কথা প্ৰযোজ্য। অহিংসা ও প্রেমের আদর্শ রক্ষার জন্য কোন রাষ্ট্রই চোর, ডাকাত, দাঙ্গাবাজ, বিদ্রোহী বা ষড়যন্ত্রকারীদের নিকট আত্মসমৰ্পণ করিতে পারে না।
মোট কথা, যতদিন পৃথিবীর সমস্ত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র অহিংস না হইয়া উঠিতেছে, ততদিন মানুষকে আত্মরক্ষার জন্য হিংসা ও বলপ্রয়োগের পন্থা অবলম্বন করিতেই হইবে। হিংসার দ্বারা হিংসার প্রতিরোধ, বলের দ্বারা বলের প্রতিরোধ করা যায়, ইহা বাস্তব জগতের পরীক্ষিত সত্য। প্ৰেম ও অহিংসার দ্বারা হিংসা ও পশুবলের প্রতিরোধ করা সম্ভবপর, এই সত্য সর্ব্বক্ষেত্রে নিশ্চিতরূপে প্ৰমাণিত হয় নাই। ব্যক্তিগত জীবনে এরূপ দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যাইতে পারে বটে, মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় ২|৪ জন মহাপুরুষের জীবনেও এই সত্য পরীক্ষিত হইয়া থাকিতে পারে বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে, মনুষ্যসমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষে এখনও উহা সত্য হইয়া উঠে নাই,—কোনকালে হইবে, এরূপ সম্ভাবনাও আমরা দেখি না।


অন্যায়কারী, অত্যাচারী বা আততায়ীকে কি উপায়ে প্রেম ও অহিংসার দ্বারা জয় করা সম্ভবপর, মহাত্মা গান্ধী বহুবার তাহা ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন। তাঁহার মতে প্ৰত্যেক মানুষের মনেই দেবভাব নিহিত আছে। ত্যাগ ও দুঃখবরণের দ্বারা যদি অত্যাচারী বা আততায়ীর হৃদয়ের অন্তর্নিহিত সেই দেবভাবের উদ্বোধন করা যায়, তাহা হইলেই অহিংসপন্থীর উদ্দেশ্য সফল হইবে, অত্যাচারী বা আততায়ী প্রেমের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া নত হইবে বা অস্ত্ৰত্যাগ করিবে। কিন্তু মানবপ্ৰকৃতির অন্তর্নিহিত দেবভাবের উপর মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় এইরূপ একান্ত বিশ্বাস সাধারণ মানুষের নাই। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এরূপ অহিংসার পরীক্ষা হয়ত সফল হইতে পারে, কিন্তু কোন সমাজ, রাষ্ট্র বা জাতিই এইরূপ একটা ‘থিওরি’ বা মতবাদের উপর নির্ভর করিয়া অগ্রসর হইতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, প্ৰেম, ত্যাগ ও দুঃখবরণের দ্বারা আবিসিনিয়েরা আততায়ী ইতালীর2 হৃদয় জয় করিতে পারিত না, কিম্বা চেকোশ্লোভাকিয়া বা পোল্যাণ্ড সহস্ৰ বৎসর চেষ্টা করিলেও হিটলার ও তাঁহার নাজীবাহিনীর অন্তরের “দেবভাব” জাগাইয়া তুলিতে পারিত না । চীন জাপানের 3 অন্তরের ‘দেবভাব’ জাগাইবার চেষ্টা করিলে মাত্র পণ্ডশ্রমই করিত ।


আমরা এতক্ষণ প্ৰধানত মহাত্মা গান্ধীর যুক্তি অনুসরণ করিয়া মানবসভ্যতায় অহিংসার স্থান ও উহার কাৰ্য্যকারিতার সীমা নির্ণয়ের চেষ্টা করিলাম। এইবার আর একটু অগ্রসর হইয়া আমরা বলিব—বুদ্ধ, খ্রীস্ট, চৈতন্য বা মহাত্মা গান্ধীর এই ‘অহিংসা দর্শন’ মানবজীবনের পূর্ণ সত্য ব্যক্ত করে না, মানবসভ্যতা এই “নিভাঁজ” অহিংসনীতির উপরে গড়িয়া উঠিতে পারে না, কোন যুগে গড়িয়া উঠেও নাই এবং যেখানেই এই চেষ্টা হইয়াছে, সেইখানেই উহা ব্যর্থ হইয়াছে। ইহার কারণ এই যে, মানবপ্ৰকৃতির মধ্যে ‘হিংসার’ একটা স্থান আছে এবং উহাকে বাদ দিয়া মানুষের জীবনযাত্ৰা চলিতে পারে না । সৃষ্টির প্রথম হইতে অন্যান্য জীবের ন্যায় মানুষের পক্ষেও “হিংস” আত্মরক্ষার প্রধান উপায়, ইহাকে বর্জ্জন করিলে বহুযুগ পূর্ব্বেই মনুষ্যজাতি পৃথিবী হইতে লুপ্ত হইত। প্ৰেম, দয়া, ধৈৰ্য্য প্রভৃতি যেমন মানবপ্রকৃতির অংশ,—কাম, হিংসা, ক্ৰোধ প্ৰভৃতিও তেমনি উহার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের বংশবিস্তার ও আত্মরক্ষার জন্য ঐ প্ৰবৃত্তিগুলি অপরিহার্য্য। প্ৰেম, দয়া, ধৈৰ্য্য প্রভৃতির তুলনায় কাম, হিংসা, ক্ৰোধ প্রভৃতিকে নিম্নতর বৃত্তি বলা যাইতে পারে। কিন্তু কোনমতেই ঐগুলিকে অনাবশ্যক বলিয়া বর্জ্জন করা বা ধ্বংস করা যায় না। তবে এই সব নিম্নতর বৃত্তির মোড় ঘুরাইয়া উৰ্দ্ধাভিমুখী করা যাইতে পারে,—অর্থাৎ ঐগুলিকে মহত্তর উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করা যাইতে পারে,—যথা দেশরক্ষা, জাতিরক্ষা, মানবকল্যাণ সাধন ইত্যাদি। আধুনিক মনোবৈজ্ঞানিকদের ভাষায় ইহারই নাম sublimation ! এইরূপ “উন্নয়নের” ফলেই ক্ৰোধ, হিংসা, কাম প্রভৃতি শৌৰ্য্য, বীৰ্য্য, প্রেম প্রভৃতিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ ঐগুলি নষ্ট হয় না, ‘সংশোধিত’ বা উন্নত হইয়া মানবকল্যাণে সহায়তা করে।



প্ৰকৃতপক্ষে মানুষের এইসব বিভিন্ন বৃত্তির উৎকর্ষসাধন ও তাহাদের মধ্যে সুসঙ্গত সামঞ্জস্য স্থাপনই মানবসভ্যতার পূর্ণ আদর্শ। যে সমাজ বা জাতি কতকগুলি বৃত্তির উপর অতিরিক্ত ঝোঁক দেয় এবং অন্যগুলিকে দমন বা অবহেলা করে, তাহাদের অধঃপতন সুনিশ্চিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বৌদ্ধধৰ্ম্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া এক সময়ে ভারতবর্ষ অতিরিক্ত পরিমাণে অহিংসা, প্রেম ও মৈত্রীর সাধনা করিয়াছিল, কিন্তু সেই অনুপাতে শক্তিসামর্থ্য, শৌর্য্যবীর্য্যের চর্চ্চা করে নাই। ফলে বিদেশী আততায়ী কত্তৃক সে পর্য্যুদস্ত হইয়াছিল, আত্মরক্ষা করিবার শক্তি তাহার ছিল না। অহিংসার আদর্শ ভারতবর্ষে কিরূপ চরম সীমায় উপনীত হইয়াছিল এবং তাহার কিরূপ শোচনীয় পরিণাম হইয়াছিল, তাহার দুইটি দৃষ্টান্ত দিব। পাঠানেরা যখন প্রথম উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়া ভারত আক্রমণ করে তখন ঐ অঞ্চলে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। ঐ সব রাজ্যে বৌদ্ধধৰ্ম্মই প্ৰবল ছিল, বৌদ্ধ শ্রমণেরা রাষ্ট ব্যাপারেও কত্তৃত্ব করিতেন। পাঠানেরা নগর আক্রমণ করিলে এইসব বৌদ্ধ শ্রমণেরা বলিলেন, প্ৰভু বুদ্ধের রাজ্যে হিংসা চলিবে না,—অতএব দুর্গদ্বার খুলিয়া দাও, অস্ত্র ত্যাগ কর, আততায়ীদের আসিতে দাও। ফল কি হইয়াছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়। ঐ সব রাজ্যের চিহ্ন পৰ্যন্ত লুপ্ত হইল। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, মহাত্মা গান্ধীও আজি সেই বৌদ্ধ শ্রমণদের মতই আততায়ীর সম্মুখে অস্ত্ৰত্যাগ করিবার পরামর্শ দিতেছেন। দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত,—ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ভারতের জৈনদের মধ্যে অহিংসা এরূপ বিকৃতরূপ ধারণ করিয়াছিল যে, তাহারা দস্যুদল কর্ত্তৃক আক্রমণ, লুণ্ঠন, নরহত্যা প্ৰভৃতিতেও বাধা দিত না। ফলে সর্বত্র অশান্তি ও অরাজকতার সৃষ্টি হইয়াছিল।


পক্ষান্তরে কোন সমাজ বা জাতি যদি প্ৰেম, অহিংসা, দয়া, ক্ষমা প্রভৃতি অবহেলা করিয়া কেবলমাত্ৰ হিংসা ও শক্তিচর্চার উপর অতিরিক্ত ঝোঁক দেয়, তবে সেই সমাজ বা জাতি প্ৰকৃতপক্ষে আদিম বন্য বর্ব্বর সমাজ হইয়া দাঁড়ায়,—যুদ্ধ, নরহত্যা, পররাজ্য জয়, দস্যুতা, লুণ্ঠন—এই সবই তাহাদের নিত্যকাৰ্য্য হইয়া উঠে। এইরূপ জাতি বা সমাজের দ্বারা পৃথিবীর ঘোর অকল্যাণ হয়, তাহাদের আদর্শ মানব সভ্যতার উচ্চাদর্শ বলিয়াও গণ্য হইতে পারে না।


বস্তুত হিংসা ও অহিংসার সুসঙ্গত সামঞ্জস্য সাধনেই মানব সভ্যতার পূর্ণ আদর্শ। এই আদর্শে অহিংসা ও মৈত্রীর যেমন স্থান আছে, আত্মরক্ষার্থ অন্যায়ের প্রতিরোধ করিবার জন্য হিংসারও তেমনি স্থান আছে। ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় এই পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার আদৰ্শই স্থাপন করিয়াছেন। সর্ব্বকালের মানবজাতির জন্য তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, মাত্র প্রেম ও অহিংসাই শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম নহে, যুদ্ধমাত্রই পাপ নহে;—ধৰ্ম্মরক্ষার জন্য, দেশরক্ষার জন্য, লোককল্যাণের জন্য যুদ্ধও অবশ্য কৰ্ত্তব্য। সেক্ষেত্রে অনাসক্তভাবে কৰ্ম্মযোগীর মত হিংসার আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে হইবে। অহিংসা ও প্রেমের নামে যিনি মনুষ্যসমাজ বা মনুষ্যজাতিকে অন্যায়ের নিকট আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিবেন, তিনি মানুষকে বিপথগামীই করিবেন। বৌদ্ধ অহিংসার ফলে ভারতবর্ষ যখন নিৰ্জীব ও অকৰ্ম্মণ্য হইয়া পড়িয়াছিল, তখন গীতোক্ত এই মহৎ মানব ধৰ্ম্ম ও পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার আদর্শ প্রচারের প্রয়োজন হইয়াছিল। উহার ফলে ভারতে আবার হিন্দুজাতির নবজাগরণের সুচনা হইয়াছিল।


বীৰ্য্যহীন যে অহিংসা, তাহা তামসিক অহিংসা। উহারই আর এক নাম ‘ক্লৈব্য’। তার চেয়ে সাত্ত্বিক হিংসা শ্রেষ্ঠ। আমাদের আশঙ্কা হয়, মহাত্মা গান্ধী আজ সেই তামসিক অহিংসার বাণীই প্রচার করিতেছেন। তিনি বলিতেছেন বটে যে, তিনি শক্তিমানের অহিংসার আদর্শ প্রচার করিতেছেন, কিন্তু আসলে তাঁহার প্রচারিত অহিংসা দুর্বল ও নিবীৰ্য্যের তামসিক অহিংসা। কিন্তু গীতায় ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ বীৰ্য্যবানের অহিংসা অথবা সাত্ত্বিক হিংসার আদৰ্শই কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। এই সাত্ত্বিক হিংসা সমাজরক্ষা দেশরক্ষা লোক কল্যাণার্থ যুদ্ধ করিতে ভয় পায় না। মহাত্মা গান্ধী গীতার যে ভাষ্য করিয়াছেন, আমাদের মতে তাহাতে তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। গীতার মূলতত্ত্বকে বৌদ্ধ বা জৈন অহিংসার ছাঁচে কখনও ঢালা যায় না। মহাত্মা গান্ধী সেই অসাধ্যসাধন করিতে গিয়া ব্যর্থপ্রয়াস করিয়াছেন মাত্র। মহাত্মা গান্ধী নানাদিক দিয়াই বৰ্ত্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মানব। কিন্তু তিনি যে নিষ্ক্রিয় তামসিক “অহিংসার” আদর্শ প্রচার করিতেছেন, তাহা কখনই মানবজাতির কল্যাণ করিতে পারিবে না। যদি মানুষ তাঁহার ঈপ্সিত পথে কখন ও সম্পূর্ণরূপে “অহিংস” হইয়া উঠে, তবে তাহারা আর মানুষ থাকিবে না, দেবতা হইয়া যাইবে, অথবা ধরাপৃষ্ঠ হইতে সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হইবে। প্রথম কল্পনা অবাস্তব, দ্বিতীয় কল্পনা যে আমরা নির্ব্বিকার চিত্তে পোষণ করিতে পারি না তাহা বলাই বাহুল্য।

• ২রা জুলাই, ১৯৪০ প্রকাশিত হয় ।↩

• ইতালীー১৯৩৫-৩৬ খ্রীস্টাব্দে আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া জয় করেছিল ।↩

• চীন-জাপানের যুদ্ধ ১৮৯৪-৯৫, ১৯৩৭-৪৫ ; ১৯৩১↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
Share:

ডা. মুঞ্জে ও বর্ত্তমান হিন্দুসমাজের দুৰ্গতি

১৯২৩ সালে অসহযোগ আন্দোলনের শেষ পর্বে মালাবারে যে নৃশংস কাণ্ড ঘটে, তাহা সাধারণত “মোপলা বিদ্রোহ” নামে পরিচিত। মালাবারের মুসলমানদিগকে ‘মোপলা’ বলে। মালাবারের এই মোপলারা ১৯২১ সালে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়াছিল—মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসার’ বাণীও তাহাদের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছিল। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের অবসানে সহসা মোপলাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্ৰতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে মালাবারে হিন্দুদের সঙ্গে মোপলাদের প্রবল সঙ্ঘর্ষ হয়। মোপলারা জোর করিয়া ৩৪ হাজার হিন্দুকে ‘মুসলমান’ করিয়া ফেলে, বহু হিন্দু নারী মোপলাদের দ্বারা ধৰ্ষিত হয়, বহু হিন্দুমন্দির কলুষিত হয়। মালাবারে হিন্দুরাই সংখ্যাধিক, তৎসত্ত্বেও তাহারা এইরূপে মোপলাদের হাতে সর্বপ্রকারে বিপৰ্য্যস্ত হয়।


‘মোপলা বিদ্রোহের’1 এই শোচনীয় কাহিনী ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে এবং হিন্দুদের মধ্যে স্বভাবতঃই প্রবল চাঞ্চল্য ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই সময়ে শৃঙ্গেরী মঠের জগৎগুরু শঙ্করাচাৰ্য্য মধ্যপ্রদেশের প্রসিদ্ধ হিন্দু নেতা ডা. বি এস মুঞ্জেকে প্রকৃত অবস্থা স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিবার জন্য মালাবারে যাইতে অনুরোধ করেন । ডা. মুঞ্জে মালাবারে গিয়া সমস্ত অবস্থা অনুসন্ধান করিয়া জগৎগুরু শঙ্করাচাৰ্য্যের নিকট একটি রিপোর্ট দেন। ডা. মুঞ্জের এই রিপোর্ট বৰ্ত্তমানে দুষ্পাপ্য। আমরা বহু চেষ্টা করিয়া পুণার “মারাঠা” পত্রের সম্পাদক শ্ৰীযুত কেটকারের সৌজন্যে উহার একখণ্ড সংগ্ৰহ করিয়াছি। ঐ রিপোর্টে ডা. মুঞ্জে মালাবারের হিন্দুদের অবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে সাধারণভাবে সমগ্ৰ ভারতের হিন্দুসমাজের দুৰ্গতির যে সব কারণ বিশ্লেষণ করিয়াছেন এবং প্রতিকারের পন্থা নিৰ্দেশ করিয়াছেন, এই ১৭ বৎসর পরেও তাহার সত্যতা আমরা মৰ্ম্মে মৰ্ম্মে উপলব্ধি করিতেছি। ভারতের সমস্ত প্রদেশের হিন্দুদেরই ডা. মুঞ্জের এই মূল্যবান রিপোর্টের মৰ্ম্ম অবগত হওয়া এবং উহা লইয়া আলোচনা করা উচিত। কেননা উহার ফলে হিন্দুসমাজের ব্যাধির মূল কোথায়, তাহা উপলব্ধি করা সহজ হইবে এবং প্ৰতিকারের পন্থা অবলম্বন করাও সম্ভবপর হইবে।
মালাবারের হিন্দুদের শোচনীয় এবং অসহায় অবস্থার জন্য ডা. মুঞ্জে ব্ৰাহ্মণদিগকেই দায়ী করিয়াছেন, কেননা প্ৰাচীনকাল হইতেই ব্ৰাহ্মণেরাই হিন্দু সমাজ শাসন করিতেছেন এবং এ যুগেও তাহাদের প্রভাব অসীম। তাঁহাদেরই প্ৰবৰ্ত্তিত নানা সামাজিক অনুশাসন, বিধিনিষেধ, আচারব্যবহারের কুফল ভারতের অন্যত্র যেমন, মালাবারেও তেমনি হিন্দুরা ভোগ করিতেছে। এস্থলে উল্লেখযোগ্য যে, ডা. মুঞ্জে নিজে উচ্চশ্রেণীর মারাঠা ব্ৰাহ্মণ। ডা. মুঞ্জে তাঁহার রিপোর্টে বলিয়াছেন:-

“মালাবারের ব্ৰাহ্মণদের নিজেদের পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠতাসম্বন্ধে এমনই অদ্ভুত ধারণা যে, কোন অ-বৰ্ণ বা নিম্নজাতীয় হিন্দু তাঁহাদের নিকটে অন্ততপক্ষে ৫০|৬০ ফিটের মধ্যে আসিতে পারে না। এই কুপ্রথার মধ্যে শোচনীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ঐ সব অ-বর্ণ হিন্দুরা যতক্ষণ হিন্দু থাকে, ততক্ষণই তাহাদের ঐ নিয়ম পালন করিতে হয়,—কিন্তু যেই তাহারা মুসলমান হইয়া ‘খাঁ’, ‘সৈয়দ’ প্ৰভৃতি পদবী গ্ৰহণ করে, অমনি তাহারা স্পশ্য ও আচরণীয় হইয়া উঠে, ব্ৰাহ্মণেরা আর তাহদের সান্নিধ্য অপবিত্র মনে করেন না। আর ঐ সব নবদীক্ষিত মোপলা—যাহারা কয়েক ঘণ্টা পূর্ব্বেই হিন্দুরূপে অস্পৃশ্য ও ঘৃণ্য ছিল—তাহারাই উচ্চ জাতীয় হিন্দুদের উপর প্রভুত্ব করিতে কুণ্ঠিত হয় না। হিন্দুসমাজের এই অস্পৃশ্যতা ও অনাচরণীয়তা সম্বন্ধীয় বিধিবিধান ‘থিয়া’, ‘পঞ্চমা’ প্ৰভৃতি অ-বর্ণ হিন্দুদের চিন্তা ও চরিত্রের উপর ঘোর অনিষ্টকর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। মালাবারের হিন্দুসমাজে ইহারাই সংখ্যাধিক এবং ইহারা পরিশ্রমী, কষ্টসহ, দৈহিক শক্তিশালী। বিপদের সময়ে মোপলাদের আক্রমণ হইতে অন্যান্য হিন্দুদিগকে ইহারাই রক্ষা করিবার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু পূর্বোক্ত সামাজিক পাপের ফলে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা ইহাদের সহানুভূতি হারাইয়াছে। যদি ইহাদিগকে হিন্দুসমাজের মধ্যে সম্মানের স্থান দিয়া সঙ্ঘবদ্ধ করা যায়, তবেই কেবল হিন্দু সমাজ আত্মরক্ষা করিতে পরিবে।”


ডা. মুঞ্জে মালাবারের হিন্দুসমাজের সম্বন্ধে যে মন্তব্য করিয়াছেন, বাঙলার হিন্দু সমাজের সম্বন্ধেও ঠিক সেই মন্তব্য করা যাইতে পারে। এখানেও ‘অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়’ হিন্দুদিগকে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে ঐ সব ‘অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়’ হিন্দু হিন্দুধৰ্ম্ম ত্যাগ করিয়া মুসলমান বা খ্রীস্টান হয়, সেই মুহূৰ্ত্ত হইতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা তাহাদিগকে ভয় ও সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখিতে থাকে। “অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়” অর্থাৎ নিম্নজাতীয় হিন্দুদের প্রতি উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের এই ব্যবহারের ফলে হিন্দু সমাজ বহুধাখণ্ডিত হইয়া পড়িয়াছে,—নিম্নজাতীয় হিন্দুরা নিজেদের আর ‘হিন্দু’ বলিয়া গৰ্ব্ববোধ করিতে পারে না।


মালাবারের অধিকাংশ মোপলাই হিন্দুদের বংশধর। কিরূপে মালাবারের মোপলাদের সংখ্যা এরূপ বাড়িয়া গেল, তাহাদের এতটা প্রাধান্যই বা কিরূপে সম্ভব হইল, তাহার কারণ বর্ণনা করিতে গিয়া ডা. মুঞ্জে বলিতেছেন:-
“প্রচলিত কাহিনী এই যে, ৮ শত বৎসর পূর্ব্বে মালাবারের হিন্দু রাজা ব্ৰাহ্মণদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় নিজের রাজ্যমধ্যে বসতি স্থাপন করিবার জন্য আরব মুসলমানদিগকে সর্ব্বপ্রকার সুবিধা প্রদান করেন। রাজা এই সব আরবকে মুসলমান ধৰ্ম্মপ্রচার করিবার জন্য অনুমতি তো দিলেন-ই, তাহাদিগকে উৎসাহ ও সাহায্যদানকল্পে এমন আদেশ ও জারী করিলেন যে, প্ৰত্যেক হিন্দু ধীবর পরিবারের অন্তত একজন পুরুষকে মুসলমান হইতে হইবে। এইরূপে একদিকে রাজার প্রশ্রয় ও সাহায্য, অন্যদিকে মুসলমানদের উৎসাহ, জবরদস্তি এবং প্রলোভনের ফলে দলে দলে হিন্দুরা মুসলমান হইতে লাগিল, হিন্দুরা জীবনসংগ্রামে পিছাইয়া পড়িতে লাগিল। আর জামোরিন রাজাদের তথা হিন্দুসমাজের গুরু ও পরামর্শদাতা ব্ৰাহ্মণেরা প্রসন্ন ঔদাসিন্যের সঠিত সেই দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন। তাঁহারা ভাবিলেন, ‘অস্পৃশ্য’ হিন্দু তথা মুসলমান সম্প্রদায় উভয়ের আক্রমণ হইতেই তাঁহাদের পবিত্ৰ সনাতন ধৰ্ম্ম নিরাপদ রহিল। ব্ৰাহ্মণেরা সমুদ্রযাত্রার যে নিষেধবিধি প্ৰবৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, এ সমস্ত তাহারই প্ৰত্যক্ষ পরিণাম। মালাবার সমুদ্রকুলবর্ত্তী রাজ্য—উহা রক্ষা করিবার জন্য নৌবহর ও নৌসৈন্য চাই। কিন্তু সমুদ্রযাত্ৰা নিষিদ্ধ বলিয়া হিন্দুরা ঐ সব কাজ করিতে পারে না। কাজেই রাজাকে উহার জন্য আরব মুসলমান ও উহাদের দ্বারা মুসলমান ধৰ্ম্মে দীক্ষিত হিন্দু বংশধরদের উপরই নির্ভর করিতে হইল।”


অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের মস্তিষ্ক হইতে উদ্ভূত একটা অস্বাভাবিক সামাজিক নিষেধবিধির জন্য মালাবারের হিন্দু রাজার নির্দেশে হিন্দুসমাজ আত্মহত্যা করিতে প্ৰবৃত্ত হইল। পৃথিবীর কোন সভ্য সমাজে এরূপ নির্ব্বুদ্ধিতাপ্রসূত আত্মহত্যার দৃষ্টান্ত বিরল। বাঙলার হিন্দুসমাজেও সমুদ্রযাত্রা নিষেধবিধি কয়েক শতাব্দী ধরিয়া কি ঘোর অনিষ্ট করিয়াছে, তাহা আমরা সকলেই জানি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের কারণই ইহাই। এরূপ আত্মহত্যাকর সামাজিক বিধান হিন্দুসমাজে আরও বহু আছে।


সাধারণভাবে বৰ্ত্তমান হিন্দুসমাজের দুৰ্গতির মূল নির্ণয় করিতে গিয়া ডা. মুঞ্জে বলিয়াছেন যে, হিন্দু সমাজের গঠন ব্যবস্থাই তাহার দৌৰ্ব্বল্যের প্ৰধান কারণ। হিন্দু সমাজ নানা জাতি ও নানাস্তরে বিভক্ত। ইহারা প্ৰত্যেকে স্বতন্ত্র, প্ৰত্যেকের সংস্কৃতি, শিক্ষা, আচারব্যবহার স্বতন্ত্র, এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের প্রাণের যোগ নাই । পরস্পরের প্রতি সমবেদনা নাই। সুতরাং এই সমাজে সংহতিশক্তি আসিবে কোথা হইতে ? ইহার এক অংশ আক্রান্ত হইলে, অন্য অংশ যে সাহায্যাৰ্থ অগ্রসর হইবে না, তাহা আর আশ্চৰ্য্য কি ? যতদিন হিন্দুরা স্বাধীন ছিল, ততদিন এই জাতিভেদের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ বিশেষ কোন বাধা পায় নাই। উচ্চজাতিরা নিম্নজাতিদের অবজ্ঞা করিত, তাহাদের পায়ের তলায় রাখিত, আর নিম্নজাতিরাও সেই দাসত্বকে অদৃষ্ট ও কৰ্ম্মফলের দোহাই দিয়া নিরুপায়ভাবে মানিয়া লইত। কিন্তু যখন ভিন্ন ধৰ্ম্মাবলম্বী বিদেশীরা বিজয়ীবেশে এদেশে আসিল এবং প্ৰভু হইয়া বসিল, তখন হইতে অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটিল। প্ৰথমে মুসলমান ধৰ্ম্মাবলম্বী পাঠান ও মোগলেরা, তারপর খ্রীস্টান ইউরোপীয়েরা। ইহাদের কাহারও মধ্যে জাতিভেদ নাই,—ইহাদের সামাজিক ব্যবস্থায় সকলেই সমান, স্পশ্য অস্পৃশ্যের বিচার তো নাই-ই।


 নিম্নজাতিরা সহজেই এই তথ্য আবিষ্কার করিল এবং বিদেশী প্ৰভুদের আশ্রয় ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করিতে বিলম্ব করিল না। বিদেশী প্রভুরাও তাহাদিগকে মানুষের মৰ্যাদা দিতে লাগিল। যাহারা এতকাল স্বীয় সমাজের উচ্চশ্রেণীর নিকট অবজ্ঞা ও অপমান পাইয়া আসিয়াছে, তাহারা বিদেশী প্ৰভুদের নিকট ভিন্নরূপ ব্যবহার পাইয়া, স্বভাবতঃই তাহাদের অনুগত হইয়া পড়িল। ইহার ফলে হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণীয় ও নিম্নবর্ণীয়দের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়িয়া গেল,—উচ্চবর্ণীয়দের প্রতি নিম্নবর্ণীয়দের ঘেটুকু সহানুভূতি ও মমত্বের ভাব ছিল, তাহাও হ্রাস পাইতে লাগিল। তারপর নিম্নবণীয়রা যখন দেখিল যে, ঐসব বিদেশী প্ৰভুদের নিকট উচ্চবর্ণীয়েরাও মাথা নত করিতে লাগিল, তাহাদের চাকুরী গ্ৰহণ করল, তখন স্বভাবতঃই উচ্চবর্ণীয়দের প্ৰতি নিম্নবর্ণীয়দের শ্রদ্ধাও ক্রমে ক্ষীণ হইতে লাগিল৷ আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তীক্ষ্ণধী ব্ৰাহ্মণেরা এই পরিবৰ্ত্তন দেখিয়া ও দেখিলেন না, ইহার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া আত্মরক্ষার তথা সমাজরক্ষার কোন ব্যবস্থা করিলেন না। ফলে আজ নিম্ন জাতীয়েরা হিন্দুসমাজ হইতে পৃথক হইয়া পড়িবে, এরূপ আশঙ্কার কারণ দেখা দিয়াছে। বিদেশী শাসকেরা একটা কৃত্ৰিম ‘তপসীলী’ সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়া সেই বিচ্ছেদ ও স্বাতন্ত্র্যকে পাকা করিবার ব্যবস্থা করিয়াছে।


ডা. মুঞ্জে মালাবারে লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে, হিন্দুরা স্বভাবতই শান্ত, নিরীহ এবং “বশম্বদ’ প্ৰকৃতির; তাহারা দুৰ্দ্দান্ত এবং বেপরোয়া প্ৰকৃতির মুসলমান প্ৰতিবাসীদের সঙ্গে আঁটিয়া উঠিতে পারে না, সহজেই নীতি স্বীকার করে। হিন্দুদের এই প্রকৃতিগত দৌৰ্ব্বল্যের কারণ কি, ডা. মুঞ্জে তাহার বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এস্থলে বলা যাইতে পারে, ডা. মুঞ্জে মালাবারের হিন্দুদের চরিত্রে যে সব ক্ৰটী লক্ষ্য করিয়াছেন, তাহা ভারতের সকল প্রদেশের হিন্দুদের চরিত্রেই লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং ডা. মুঞ্জের এই বিশ্লেষণ সকল প্রদেশের হিন্দুদের সম্বন্ধেই প্ৰযোজ্য। ডা. মুঞ্জেও সেই দিক হইতেই ইহার বিচার করিয়াছেন। ডা. মুঞ্জের মতে হিন্দু সমাজের এই প্ৰকৃতিগত দৌৰ্ব্বল্যের কারণ—(১) হিন্দুরা সাধারণত নিরামিষাশী, নিরামিষ খাদ্য মানুষকে শান্ত, শিষ্ট, নিরীহ করিয়া তোলে। (২) বৈদিক আদর্শ ছিল জীবনকে বীৰ্য্যবানের মত ভোগ করা। কিন্তু পরবর্ত্তী কালের বৌদ্ধধৰ্ম্ম, বৈষ্ণব ধৰ্ম্ম প্ৰভৃতির আদর্শ হইয়া দাঁড়াইল বৈরাগ্য ও ত্যাগ। এই আদর্শ হিন্দুদের ঘোর অনিষ্ট করিয়াছে। (৩) ‘অহিংসা পরম ধৰ্ম্ম’—এই অ-বৈদিক আদর্শ হিন্দু সমাজের সবল মনোবৃত্তিকে নষ্ট করিয়া দিয়াছে। (৪) বাল্যবিবাহও হিন্দুদের শারীরিক ও মানসিক দৌৰ্ব্বলের অন্যতম প্ৰধান কারণ। এমন কি, ডা. মুঞ্জের মতে বাল্যবিবাহ ও নিরামিষ আহার-এই দুইয়ে মিলিয়া হিন্দুসমাজের সর্ব্বনাশ করিয়াছে।
হিন্দুসমাজের সংহতিশক্তির অভাবের জন্য জাতিভেদই যে প্রধানত দায়ী, একথা ডা. মুঞ্জে পুনঃ পুনঃ দৃঢ়তার সঙ্গে বলিয়াছেন। কিন্তু তিনি সরাসরি জাতিভেদ প্রথা তুলিয়া দিবার প্রস্তাব করেন নাই। জাতিভেদের কুফলকে কিরূপে প্ৰতিহত করিয়া হিন্দুসমাজকে সঙ্ঘবদ্ধ ও সংহতিসম্পন্ন করা যায়, তাহারই উপায় চিন্তা করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে ডা. মুঞ্জের সিদ্ধান্ত এই:-


(১) হিন্দুদের এমন একটা স্থান থাকা চাই যেখানে সমস্ত জাতি ও বর্ণের হিন্দু একত্ৰ মিলিত হইতে পারে। মুসলমানদের মসজিদ এইরূপ স্থান। এখানে উচ্চনীচ ধনী দরিদ্র ভেদ নাই, সকলে মিলিত হইয়া সামাজিক কল্যাণ ও সুখদুঃখের কথা আলোচনা করে। জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা-কণ্টকিত হিন্দুদের মধ্যে ঐ রূপ সাধারণ মিলনভূমি গড়িয়া উঠিতে পারে নাই। এখন হিন্দুসমাজের কল্যাণের জন্য দেবমন্দিরকে ঐরূপ মিলনক্ষেত্রে পরিণত করিতে হইবে। এখানে উচ্চনীচভেদ থাকিবে না, অস্পৃশ্যতা বর্জন করিতে হইবে। ডা. মুঞ্জে বলেন, ইহা একটা অসম্ভব প্ৰস্তাব নয়, পুরীর জগন্নাথ মন্দির এখনও সর্বজাতীয় হিন্দুর মিলনক্ষেত্র। জগন্নাথ মন্দিরের দৃষ্টান্ত সমস্ত গ্রামে নগরে অনুসরণ করিতে হইবে। ইহার ফলে হিন্দুসমাজের সংহতি শক্তি বাড়িবে।

 (২) অসবর্ণ বিবাহ প্রথার বহুল প্ৰচলন করিতে হইবে। এই প্ৰথা বৰ্ত্তমানে অপ্রচলিত হইলেও মোটেই অ-শাস্ত্রীয় নহে। অনুলোম ও প্ৰতিলোম বিবাহের ব্যবস্থা মনু ও অন্যান্য স্মৃতিকার সমর্থন করিয়াছেন। পূর্ব্বে হিন্দু সমাজে যে ইহা প্রচলিত ছিল, তাহার দৃষ্টান্তেরও অভাব নাই। ডা. মুঞ্জে মনে করেন যে, অসবৰ্ণ বিবাহ বহুল পরিমাণে প্রচলিত হইলে, জাতিভেদের তীব্ৰতা হ্রাস হইবে, হিন্দুসমাজের সংহতি শক্তিও বাড়িবে। অসবর্ণ বিবাহের সুফলের উপর ডা. মুঞ্জের এমন দৃঢ় বিশ্বাস যে, তাঁহার মতে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করিলে হিন্দুসমাজের সমস্ত ব্যাধি দূর হইবে। তিনি অকুণ্ঠিত চিত্তে বলিয়াছেন—
I believe that it is the reversion to this “IDharinasastric’ sociology which will prove a panacea for all the social evils that beset the prescnt Hindu Society.


(৩) অস্পৃশ্যতা ও অনাচারণীয়তা বর্জ্জন। ডা. মুঞ্জে বলেন,—“হিন্দুসমাজের পক্ষে ইহাই বৰ্ত্তমান সময়ে সৰ্ব্বাপেক্ষা বেশী প্রয়োজন, কেননা ইহা ব্যতীত হিন্দুরা তাহাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষে নিজেদের প্রাধান্য রক্ষা করিতে পরিবে না এবং জীবনসংগ্রামে বিদেশী ও বিধর্ম্মীদের দ্বারা পদে পদে প্ৰতিহত হইবে।” সৰ্ব্বাগ্রে তথাকথিত অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়দের মন্দির প্রবেশের অধিকার এবং অন্য সকলের সঙ্গে মিশিয়া দেবতার পূজা করিবার অধিকার স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। তারপর তাহাদিগকে অন্য সমস্ত সামাজিক অধিকার দিতে হইবে। অস্পৃশ্য, অনাচরণীয় ও অবনতরূপে যাহাদিগকে আমরা পৃথক করিয়া রাখিয়াছি, তাহাদিগকে যদি আপনার করিয়া লইতে না পারি, তবে হিন্দুসমাজের ও হিন্দুজাতির ধবংস অনিবাৰ্য্য। উপসংহারে ডা. মুঞ্জে বর্তমান হিন্দু সমাজের সমস্যাকে দুইটি প্ৰধান ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন—(১) জাতিভেদ প্ৰপীড়িত হিন্দুসমাজকে কিরূপে সঙ্ঘবদ্ধ ও সংহতিশক্তিম্পন্ন করিতে হইবে; (২) “নিরীহ ও শান্ত” হিন্দুকে কিরূপে সবল মনোবৃত্তিসম্পন্ন ও আত্মরক্ষায় সক্ষম করিয়া তুলিতে হইবে। ১৭ বৎসর পূর্বে ডা. মুঞ্জে হিন্দুসমাজের সম্মুখে যে সমস্যা তুলিয়া ধরিয়াছিলেন, এখনও আমরা তাহার সমাধান করিতে পারি নাই। অদূর ভবিষ্যতে যদি না করিতে পারি, তবে হিন্দুসমাজের পক্ষে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব।

• মালাবারের কট্টর সাম্প্রদায়িক মুসলমান । আরব থেকে এসে ভারতীয় নারী বিবাহ করে বংশবৃদ্ধি করেছে । প্রায়ই স্থানীয় হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাত । সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ ঘটেছিল ১৮৫২ খ্রীস্টাব্দে ।↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

সমাজসংস্কারে নারীর স্থান

হিন্দুসমাজে নারীর স্থান খুব উচ্চে, এই কথা প্রমাণ করিবার জন্য আজকাল আমরা খুবই ব্যগ্ৰ, সংস্কৃত শ্লোক আওড়াইয়া আমরা পরম গর্বভরে বলি—
‘যত্ৰ নাৰ্য্যস্তূ পূজ্যন্তে
রমন্তে তত্র দেবতাঃ’। 1
আর প্রাচীন ভারতে স্ত্রী স্বাধীনতা ও স্ত্রী শিক্ষার যে খুব চমৎকার ব্যবস্থা ছিল, ইহাও প্রমাণ করিতে বসিয়া যাই,—গার্গী, মৈত্ৰেয়ী, খনা, লীলাবতী প্রভৃতির নাম করি; ‘কন্যাপেব পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ’2—মনুর এই শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া অবিশ্বাসীদের তাক লাগাইয়া দিই।

প্ৰাচীন ভারতের প্রতি আমাদের খুবই শ্রদ্ধা আছে। হিন্দুসভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরব আমরাও অনুভব করি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও অতীব দুঃখের সঙ্গে আমাদিগকে বলিতে হইতেছে যে, হিন্দুসমাজে নারীর অবস্থার যে রঙ্গীন চিত্র আমরা আঁকিয়া থাকি, তাহা অনেকাংশেই বাস্তব সত্য নহে। প্ৰাচীন বৈদিক ও বৌদ্ধযুগের “স্বপ্নরাজ্যের” কথা ছাড়িয়া দিলে, ঐতিহাসিক মধ্যযুগে তথা আধুনিক যুগে দেখিতেছি, হিন্দু সমাজে নারীকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পত্তির চেয়ে বেশী মূল্য দেওয়া হয় নাই। তাহাকে সর্বপ্রকারে অসহায় ও পরবশ করিয়া রাখা হইয়াছে। তাহার জ্ঞাননেত্ৰ উন্মীলন করার কোন ব্যবস্থা করা হয় নাই। বরং বহির্জগতের সঙ্গে যাহাতে তাহার সম্বন্ধ না ঘটতে পারে, সেইজন্য অবরোধ প্রথার আমদানী করা হইয়াছে। ‘সতীদাহের’ কথা উঠিলে এখনও আমাদের শরীরে রোমাঞ্চ হয়। মাত্ৰ এক শতাব্দী পূর্বেও ‘সতীদাহ’ পরম পবিত্র হিন্দুশাস্ত্ৰ সম্মত বলিয়া গণ্য হইত এবং আইনের ভীতি না থাকিলে এখনও ঐ উপায়ে পুণ্যসঞ্চয় করিতে আমরা দ্বিধাবোধ করিতাম না। প্ৰাচীন শাস্ত্ৰে বিধবার জন্য তিনটী পথ নির্দিষ্ট হইয়াছিল,—ব্রহ্মচৰ্য্য, বিধবাবিবাহ এবং সতীদাহ। কিন্তু অর্ব্বাচীন যুগের হিন্দুসমাজ তন্মধ্যে ‘সতীদাহকেই’ প্ৰাধান্য দিয়াছিল। এই প্ৰথা যে আদিম বর্ব্বর যুগের এবং ইহার সঙ্গে নারীকে সম্পত্তিরূপে গণ্য করিবার মনোভাব জড়িত, এই অপ্রিয় সত্য কথাটা কয়জন ভাবিয়া দেখিয়াছেন ? বিধবা বিবাহ নিষেধও অল্পবিস্তর এই ভাবের সঙ্গে জড়িত। স্বামীর মৃত্যু হইলেও স্ত্রী পুনর্বিবাহ করিতে পরিবে না, কেন-না স্বামীর সঙ্গে তাহার জন্মজন্মান্তরের সম্বন্ধ,—ইহার সরল অর্থ, স্ত্রী স্বামীর অন্যান্য স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির পর্য্যায়ভুক্ত। নতুবা স্বামী স্ত্রীর মৃত্যুর পর, এমন কি স্ত্রী বাঁচিয়া থাকিতেও যতবার ইচ্ছা বিবাহ করিতে পারিবে, সেখানে ইহলোক ও পরলোকের কোন প্রশ্নই উঠিবে না, অথচ নারীর জন্যই যত কিছু বিধি নিষেধ, ইহার অর্থ কি ?


অপহৃত ও বলপূর্বক ধৰ্ষিতা নারীদের প্রতি হিন্দুসমাজ যে হৃদয়হীন ব্যবহার করে, তাহার মূলেও নারীর প্রতি হীনতাসূচক এই নিকৃষ্ট মনোভাব। অপহৃত নারীকে রক্ষা করিবার মত ক্ষাত্ৰবীৰ্য্য বাঙ্গলার হিন্দুসমাজ হইতে যে পরিমাণে লোপ পাইয়াছে, ঠিক সেই পরিমাণেই যেন অপহৃত ও নিগৃহীত নারীদিগকে সমাজ হইতে বিতাড়িত ও বহিস্কৃত করিবার প্রবৃত্তিও বৃদ্ধি পাইয়াছে। অপহৃত ও বলপূর্বক নিগৃহীত নারীদের প্রতি জগতের কোন মনুষ্যসমাজ এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করে না। আমরা কথায় কথায় শাস্ত্রের দোহাই দিই, কিন্তু শাস্ত্রের দোহাই দিয়াও এই অপকাৰ্য্য সমর্থন করা যায় না। কেন না স্মৃতিকারেরা বলপূৰ্ব্বক অপহৃতা ও নিগৃহীতা নারীকে সমাজে গ্রহণ করার জন্য উদার ব্যবস্থাই দিয়াছেন। হিন্দুসমাজের হৃদয়হীনতার ফলে কত নিরপরাধিনী নারী যে এইভাবে সমাজ হইতে বহিস্কৃত হইয়া বিধর্ম্মীর অঙ্কশায়িনী হইতে বাধ্য হইয়াছে, কত নারী যে পতিতা বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে, তাহা ভাবিতেও মন গভীর বিষাদ ভারাক্রান্ত হইয়া উঠে এবং হিন্দুসমাজের ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কা হয় । যে সমাজ নিজেদের নিরপরাধিনী নারীর সঙ্গন্ধে এই আত্মহত্যাকর নীতি অবলম্বন করিতে পারে তাহার কল্যাণ কোথায় ?


হিন্দু নারীকে যে আমরা সমাজে মনুষ্যত্বের মর্য্যাদা দিই না, তাহার অন্যতম প্ৰমাণ, নারীদের পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার নাই । জীবিত কালের জন্য গ্ৰাসাচ্ছাদন পাইবার অধিকার মাত্ৰ তাহার আছে । ফলে বাল্যে, যৌবনে ও বাৰ্দ্ধক্যে সর্ব্ব অবস্থাতেই নারীকে পরাধীন হইয়া থাকিতে হয় । মনুও অবশ্য সেই ব্যবস্থা দিয়াছেন—“ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি’।3 এ বিষয়ে হিন্দু নারীর চেয়ে মুসলমান নারীদের মৰ্যাদা ও অধিকার যে অনেক বেশী, একথা স্বীকার করিতে হইবে ।


তার পর বাল্যবিবাহ প্ৰথা। এই প্ৰথা হিন্দুসমাজের অৰ্দ্ধাংশ নারীকে যে দেহ ও মনে পঙ্গু করিয়া ফেলিতেছে, একথা অস্বীকার করিয়া লাভ নাই। একদিকে অবরোধপ্রথা, অন্য দিকে বাল্যবিবাহ এই দুইয়ে মিলিয়া হিন্দু নারীদের মধ্যে অকালমৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি করিতেছে। হিন্দুর সূতিকাগারের সঙ্গে নানারূপ লোকাচার ও দেশাচার মূলক কুসংস্কার ও কুপ্রথা জড়িত। বাল্যমাতৃত্বের সঙ্গে এই কুসংস্কার মিলিয়া প্ৰসূতিমৃত্যুর সংখ্যা যেরূপ ভয়াবহ করিয়া তুলিয়াছে, বোধ হয় কোন সমাজে তাহার তুলনা নাই। হিন্দু নারীদের মধ্যে প্রসূতি মৃত্যুর কোন পৃথক হিসাব পাওয়া যায় না, কিন্তু নিম্নে প্ৰসূতিমৃত্যুর যে হিসাব দেওয়া হইল, (ভারত গবৰ্ণমেণ্টের মেডিক্যাল সাভিসের ভূতপূৰ্ব ডিরেক্টার জেনারেল স্যার জন মীগের হিসাব মতে) তাহার মধ্যে হিন্দু নারীদের একটা বড় অংশ যে আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
প্ৰসূতি মৃত্যুর হার (হাজার করা)—(১৯৩৩) | | | | :—-: | :—-: | | আসাম | ২৬.৪০ | | যুক্তপ্রদেশ | ১৮ | | মধ্যপ্ৰদেশ | ৮.১৮ | | মান্দ্রাজ | ১৩.২৪ | | বাঙ্গলা | ৪০.১৬ | | বিহার উড়িষ্যা | ২৬.৮৭ | | পাঞ্জাব | ১৮.৭৩ | | বোম্বাই | ২০ | | সমগ্র ভারতে (গড়ে) | ২৪.০৫ |
বিলাতে প্ৰসূতি মৃত্যুর হার হাজার করা ৪ জন মাত্র এবং উহাও কমাইবার জন্য প্ৰবল চেষ্টা চাইতেছে।
হিন্দুনারীদের মধ্যে যক্ষ্মা রোগের প্রাবল্যও লক্ষ্য করবার বিষয় ! বাল্যমাতৃত্ব এবং অবরোধ প্ৰথা যে ইহার অন্যতম প্ৰধান কারণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।


বাঙ্গলা দেশে হিন্দুসমাজে নারীর সংখ্যা যে ক্রমশঃ হ্রাস হইতেছে এবং উহার ফলে হিন্দুসমাজ ক্রমশঃ ক্ষয় হইতেছে, ইহা আমরা পূর্বে দেখাইয়াছি। হিন্দু নারীর এই সংখ্যা হ্রাসের কারণ কি ? হিন্দুজাতির জীবনীশক্তিহ্রাস যে ইহার একটা প্ৰধান কারণ, এরূপ সন্দেহ করিবার হেতু আছে। আমাদের মনে হয়, হিন্দুসমাজে কন্যাসন্তানের প্রতি অনাদর ও উপেক্ষাও ইহার আর একটা প্ৰধান কারণ। যে সমাজ কন্যাসন্তান চায় না, তাহার প্রতি অনাদর ও উপেক্ষা করে, জীবতত্ত্বের নিগূঢ় নিয়মে সে সমাজে কন্যার সংখ্যা কম হইবেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজপুতানা ও সিন্ধুর হিন্দুসমাজ কন্যাসন্তানের প্রতি ঘোর অনাদর করিত, এমন কি শিশুকালে কন্যাকে বিষ খাওয়াইয়া বা গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলিত। ইংরাজ আমলে ঐ নৃশংস প্ৰথা আইন বলে বন্ধ করা হইয়াছে, কিন্তু গোপনে এখনও উহা চলিয়া থাকে। ফলে ঐ সব প্রদেশে হিন্দুদের মধ্যে নারীর সংখ্যা অত্যন্ত কম, অনেক পুরুষ বিবাহই করিতে পারে না, ভিন্ন প্রদেশ হইতে নানা উপায়ে কন্যা সংগ্ৰহ করিতে হয়। কাশ্মীরে নারীর সংখ্যা এত কমিয়া গিয়াছে যে, কাশ্মীর দরবার সম্প্রতি আইন করিয়াছেন যে, প্রত্যেক হিন্দু গৃহস্থ কন্যাসন্তানকে সযত্নে পালন ও রক্ষা করিবার জন্য দায়ী থাকিবে। ইহার কোন ব্যতিক্রম হইলে আইনতঃ দণ্ড হইবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হইলে গবৰ্ণমেণ্ট কন্যাসন্তানের পালন ও রক্ষা করার জন্য অভিভাবকদিগকে অর্থ সাহায্য করিবেন ।


ইহাই প্ৰকৃতির প্রতিশোধ। বাঙলা দেশের হিন্দুসমাজে নারীর সংখ্যা যে ক্রমশঃ হ্রাস হইতেছে, তাহাও প্ৰকৃতির প্রতিশোধ বলিয়া মনে হয়। হিন্দুর গৃহে কন্যার প্রতি যে ভাবে অনাদর ও উপেক্ষা করা হয়, কন্যার বিবাহ দিবার জন্য পিতামাতাকে যেরূপ দুর্ভোগ সহ্য করিতে হয়, এমন কি অনেক সময় সর্ব্বস্বান্ত হইতে হয়, তাহাতে হিন্দুসমাজে কন্যার সংখ্যা যে ক্রমশঃ হ্রাস হইবে, তাহা আর বিচিত্র কি?
নারীদের শিক্ষার প্রতি বাঙ্গলার হিন্দুসমাজ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া যে ভাবে উপেক্ষা ও ঔদাসীন্য প্ৰদৰ্শন করিয়া আসিয়াছে, তাহা সমাজের পক্ষে মোটেই গৌরবের বিষয় নহে। মেয়েরা লেখা পড়া শিখিলে বিধবা হয়, এ ধারণা উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও হিন্দুসমাজে প্ৰচলিত ছিল। প্ৰধানতঃ খ্রীস্টান মিশনারীদের প্রচেষ্টায় বাঙলা দেশে স্ত্রী শিক্ষার আন্দোলন আরম্ভ হয়। তার পর অবশ্য হিন্দুসমাজের নেতা ও সংস্কারকেরা স্ত্রী শিক্ষার আন্দোলনে সোৎসাহে যোগ দিয়াছেন। প্ৰাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্ৰ সেন, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রভৃতির নাম এক্ষেত্রে বিশেষ-ভাবে উল্লেখযোগ্য। স্ত্রী স্বাধীনতার আন্দোলনও উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য-ভাগে হিন্দুসমাজের সংস্কারপন্থী নেতারা আরম্ভ করেন।


কিন্তু নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতার আন্দোলন এই বিংশ শতাব্দীর প্ৰথম পাদেই সমধিক প্ৰবল হইয়াছে এবং কিয়দংশে সফলও হইয়াছে। প্ৰথমে স্বদেশী আন্দোলন, তারপর মহাত্মা গান্ধীর প্রবৰ্ত্তিত অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনই ইহার জন্য গৌরব করিতে পারে। গত বিশ বৎসরে বাঙলা দেশে হিন্দুসমাজে নারীশিক্ষা দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইয়াছে, অবরোধ-প্ৰথা কিয়দংশে দূর হইয়াছে, নারীরা সাধারণের কাজে যোগ দিতে শিখিয়াছেন।
কিন্তু বাঙলার বিরাট হিন্দুসমাজের তুলনায় এই নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতার আন্দোলন কতটুকু অগ্রসর হইয়াছে ? বলিতে গেলে সমাজের উপরের স্তরে—ভদ্রলোকদের মধ্যেই এই আন্দোলন কিয়ৎ পরিমাণে অগ্রসর হইয়াছে। হিন্দু সমাজের শতকরা ৯৫ জন নারী এখনও অজ্ঞ, অশিক্ষিত, কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমগ্ন। সুতরাং সর্বপ্রকার সংস্কার আন্দোলন যে হিন্দুনারীদের এই অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের পাষাণ প্রাচীরে আসিয়া ঠেকিয়া যাইবে, তাহা আর বিচিত্র কি? হিন্দুসমাজের পুরুষেরা শিক্ষায় সংস্কৃতিতে যতই অগ্রসর হোক, যতই হিন্দু বড় বড় সমাজসংস্কারের কথা তাহারা বলুক, যতদিন সমাজের অৰ্দ্ধাংশ নারীরা তাহাতে সহযোগিতা না করিতেছে, ততদিন কোন সংস্কারই সফল হইতে পরিবে না। দিদিমা, পিসীমা, মাসীমা, জেঠাইমার দল চিরদিন আমাদের পথরোধ করিয়া দাড়াইয়া থাকিবেন।

 অতএব হিন্দুসমাজকে রক্ষা করিতে হইলে, সমাজকে নবযুগের উপযোগী করিয়া নূতন ভাবে গড়িতে হইলে, সৰ্ব্বাগ্রে নারীদিগকে সেজন্য প্ৰস্তুত করিয়া তুলিতে হইবে। এ কাজের ভার শিক্ষিতা নারীরা যদি স্বহস্তে গ্রহণ করেন, তাহা হইলেই সব চেয়ে ভাল হয়। কিঞ্চিৎ আশার কথা, শিক্ষিতা নারীরা আজকাল বহু সভাসমিতি ও সন্মিলন গড়িয়া তুলিয়াছেন এবং নারীদের মধ্যে নানাদিকে সংস্কার আন্দোলন চালাইতে চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু তাহাদের কার্য্যক্ষেত্ৰ এখনও সহরের মুষ্টিমেয় ভদ্র পরিবারের নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই কাৰ্য্যক্ষেত্র বিস্তৃত করিতে হইবে, হিন্দু সমাজের নিম্নস্তরে শহরের বাহিরে গ্রামে যে বিশাল নারী-সমাজ আছে, তাহাদের মধ্যে চেতনা সঞ্চার করিতে হইবে। তবেই নারী আন্দোলন প্ৰকৃতপক্ষে সফল হইতে পারিবে।


প্রাচীন যুগে যাহাই হোক, বৰ্ত্তমান যুগে হিন্দুসমাজ নারীকে উপযুক্ত মৰ্যাদা দেয় নাই, তাহার মনুষ্যত্বের দাবীকে পূরাপূরি স্বীকার করে নাই। ফলে নারী আজ হিন্দুসমাজের অগ্রগতির পথে প্ৰধান বাধাস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যদি পূর্ব্বকৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিয়া হিন্দু নারীকে আজ আমরা তাহার প্রাপ্য স্থান দেই, তবেই হিন্দুসমাজের পক্ষে জীবনসংগ্রামে আত্মরক্ষা করা সম্ভবপর হইবে।

• মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়, ৫৬ শ্লোক↩

• মহানির্বাণতন্ত্রম অষ্টম উল্লাস ৪৭ শ্লোক↩

• মনুসংহিতা ৯ম অধ্যায় ৩ শ্লোক↩


Share:

সমাজ ও সাহিত্য—২

এইবার অতি-আধুনিক বাঙ্গলা সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা দুই একটা কথা বলিব। তরুণেরা এই সাহিত্যের নানা বিচিত্ৰ মনোহর নাম দিয়া থাকেন। যথা—অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্য, রবীন্দ্রোত্তর বাঙলা সাহিত্য, যুদ্ধোত্তর বাঙলা সাহিত্য, সাম্প্রতিক সাহিত্য হত্যাদি। কিন্তু নামগুলি যতই গালভরা বা শ্রুতিমধুর হউক না কেন, জিনিষটা আসলে কি ? এই সাহিত্য কি জাতিকে কোন মৌলিক বলিষ্ঠ চিন্তার সন্ধান দিতে পারিয়াছে, অথবা সমাজকে কোন উন্নততর আদর্শ দেখাইতে পারিয়াছে ? প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মনের সঙ্ঘর্ষে উনবিংশ শতাব্দীতে যে নূতন বাঙলা সাহিত্যের জন্ম হইয়াছিল, তাহার মধ্যে শক্তি ছিল, তেজ ছিল, চিন্তার মৌলিকতা ও সজীবতা ছিল, একটা বলিষ্ঠ পৌরুষের ভাব তাহার মধ্যে আমরা দেখিতে পাই। কিন্তু অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্য কেবল চিন্তার মৌলিকতা বা সজীবতার দিক হইতেই নিকৃষ্ট নহে,—একটা অবসাদগ্ৰস্ত, অতৃপ্ত ভোগবিলাসকামী, পৌরুষহীন, নিস্তেজ মনের শোচনীয় বিকাশ ইহার মধ্যে দেখিয়া জাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমরা হতাশ হইয়া উঠি।


এই অতি-আধুনিক সাহিত্যিকেরা নিজেদের বাস্তববাদী বলিয়া গৰ্ব্ব করিয়া থাকেন এবং রবীন্দ্রনাথকে পৰ্য্যন্ত অত্যধিক আদর্শবাদী ভাববিলাসী বলিয়া অভিহিত করিতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু দেশ ও জাতির রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, এমন কি পারিবারিক জীবনের সঙ্গে এই নূতন সাহিত্যের কোন সম্বন্ধ আছে বলিয়া মনে হয় না। আলোকলতার যেমন মূল নাই, শূন্যে ঝুলিয়া থাকে, এই অতি-আধুনিক সাহিত্যও তেমনি সমসাময়িক জীবন হইতে যেন কোন রসধারা সংগ্ৰহ করিতে পারে না। পরাধীনতার জ্বালা, স্বাধীনতার তীব্ৰ আকাঙ্ক্ষা, অগণিত নরনারীর দারিদ্র্যপূর্ণ দুর্ব্বহ জীবনভার, প্রাণহীন সমাজের অশেষ গ্লানি ও নৈরাশ্য—অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে এই সমস্তের কোন প্ৰতিধ্বনি আমরা শুনিতে পাই কি ? এই সাহিত্যে যে সমস্ত নরনারীর চিত্র অঙ্কিত হয় তাহারা এ দেশের বা সমাজের নয়,—তাহাদের চিন্তা, ভাবনা, চরিত্রের সঙ্গে আমাদের চারদিককার পরিচিত নরনারীর কোন মিল নাই। ইহাদের পরিকল্পিত “বালিগঞ্জ সমাজ” বৈষ্ণবদের “মানস বৃন্দাবনের” মত কল্পনা ও ভাববিলাসের রাজ্যেই বৰ্ত্তমান। একথা কেহ অস্বীকার করে না যে, উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী হিন্দু সমাজ যেখানে ছিল, এখন আর সেখানে নাই, কালচক্রের আবৰ্ত্তনে আমরা বহু দূর চলিয়া আসিয়াছি। আমাদের সম্মুখে আজ জীবনসংগ্রাম কঠোরতর মূৰ্ত্তিতে দেখা দিয়াছে, নূতন নূতন সমস্যা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইতেছে, পৃথিবীর চারিদিক হইতে নানা বিচিত্ৰ চিন্তা ও ভাবের তরঙ্গ আসিয়া আমাদিগকে আঘাত করিতেছে। যদি অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে এই সমস্ত সমস্যার ছায়াপাত দেখিতাম, ঐ গুলির সম্মুখীন হইবার একটা প্ৰচেষ্টা এইসব নবীন লেখকদের রচনার মধ্যে ফুটিয়া উঠিত, তাহা হইলে আমরা আনন্দিত হইতাম। কিন্তু তাহার কোন লক্ষণ আমরা এই সাহিত্যে দেখিতে পাই না।


প্রশ্ন হইতে পারে, তাহা হইলে এইসব অতি-আধুনিক লেখকদের উদ্ভট ও অস্বাভাবিক কল্পনার মূল উৎস কোথায়, এই সব কৃত্রিম ও অবাস্তব নরনারীর চিত্ৰ কোথায় ইহারা পাইল ? ইহার সন্ধান করিতে হইলে গত মহাযুদ্ধের পরবর্ত্তী ইউরোপীয় সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে হইবে। মহাযুদ্ধের পর ইউরোপের অধিকাংশ দেশে সমাজ ও সভ্যতার একটা বিপৰ্য্যয় ঘটিয়াছিল, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকৃত হইয়া পড়িয়াছিল। পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যে সত্য ও নীতিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, কঠোর নিৰ্ম্মম আঘাতে তাহার ভিত্তি ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। ইহার ফলে মানুষের জীবপ্রকৃতির আবরণ খুলিয়া গিয়া উহা একেবারে নগ্ন হইয়া পড়িল।

 নরনারীর সম্বন্ধের মধ্যে যে আদিম যৌনপ্রবৃত্তি এতকাল কতকটা সুপ্ত ও সংঘাত ছিল, নীতির বন্ধন হইত বিচ্ছিন্ন হইয়া উহা উচ্ছৃঙ্খল বীভৎস মূৰ্ত্তিতে দেখা দিল। ইউরোপীয় যুদ্ধোত্তর সাহিত্য এই উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল, বিপৰ্য্যস্ত সমাজেরই চিত্র অঙ্কনের কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিল। ঐ রূপ সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে যে সমস্ত সমস্যা প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল, এই নূতন সাহিত্যে তাহারই ছায়াপাত হইয়াছিল। যে সব নরনারী এই নূতন সামাজিক পরিবেশের মধ্যে আবির্ভূত হইয়াছিল, যুদ্ধোত্তর সাহিত্যে তাহারাই প্রধান অভিনেতা। আমাদের দেশের অতি-আধুনিক সাহিত্যিকেরা ইউরোপের এই যুদ্ধোত্তর সাহিত্যেরই নকল করিয়া বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে যুগান্তর সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আসলে ও নকলে যে প্ৰভেদ হয়, এ ক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছে। যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সাহিত্য যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সমাজের বাস্তব চিত্ৰই আঁকিয়াছিল,—ঐ সাহিত্যের উদাম উচ্ছৃঙ্খল নরনারীরা নিছক কল্পনা রাজ্যের প্রাণী নহে, সত্যকার জীবন ও চরিত্রেরই প্ৰতিচ্ছবি। কিন্তু এ দেশের সাহিত্যে যখন ঐ সব নরনারীর চিন্তা, চরিত্র ও জীবন সমস্যার আমদানী করা হইল, তখন উচ্চা উদ্ভট অম্বাভাবিক কাল্পনিক চিত্ৰ মাত্ৰ হইয়া দাঁড়াইল।

ঐ সব নরনারীও আমাদের সমাজে নাই, তাহাদের সমস্যাও আমাদের নহে। তাই যে উচ্ছৃঙ্খল উদ্দাম নগ্ন পশু প্ৰবৃত্তির চিত্র আমরা অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে দেখি, তাহাতে ঘৃণায় শিহরিয়া উঠি, নিজের অন্তরেই লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া পড়ি। যদি মিথ্যা ও অবাস্তব বলিয়া একেবারে ফুৎকারে হাওয়ায় উড়াইয়া দিতে পারিতাম, তাহা হইলে আর এই সাহিত্য লইয়া এমন উদ্বেগের কারণ ঘটিত না। কিন্তু মিথ্যা ও অবাস্তবেরও একটা মোহিনী শক্তি আছে, মানুষের আদিম পশু প্ৰকৃতিকে উহা প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ফলে সমাজ ও পরিবারের উপর উহার অনিষ্টকর প্রভাব ক্রমে বিস্তৃত হইয়া পড়ে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচির বিকৃতি ঘটে। অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্য তাই আমাদের নিকট আশঙ্কার স্থল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এ সাহিত্য সমাজকে উন্নততর আদর্শ প্রদর্শন করা দূরে থাকুক, উহাকে নীচের দিকে টানিয়া লইবারই চেষ্টা করিতেছে। বাঙলার হিন্দুসমাজের পক্ষে ইহা নিশ্চয়ই আশার কথা নহে।

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
Share:

সমাজ ও সাহিত্য

সমাজসংগঠন ও সমাজসংস্কার করিবার অন্যতম প্ৰধান অস্ত্ৰ সাহিত্য ও শিল্পকলা। সাহিত্য ও শিল্পকলার মধ্য দিয়া যে শক্তি প্ৰয়োগ করা যায়, রাষ্ট্রের আইন বা সংস্কারপন্থীদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রচারকাৰ্য্যের চেয়ে তাহা কোন অংশেই কম নহে, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশী। সাহিত্য ও শিল্পকলার মধ্য দিয়া প্ৰচারিত ভাব ও আদর্শ জাতির মনোরাজ্যে বিপ্লব আনয়ন করে, মানুষের জীবনধারার আমূল পরিবর্ত্তন সাধন করিতে পারে। রাজনৈতিক আন্দোলন বা জাতীয় আন্দোলনে সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রভাব ইতিহাস পাঠকেরা কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। ফরাসীবিপ্লবের, এমনকি আধুনিক রাশিয়ার রাষ্ট্রবিপ্লবের মূলে সাহিত্য যে কত বড় শক্তি যোগাইয়াছিল, তাহা আমরা সকলেই জানি। অথচ সমাজ সংস্কার বা সমাজের পুনর্গঠন ব্যাপারেও সাহিত্যকে সেইরূপ মৰ্য্যাদা দিতে আমরা অনেক সময় ভুলিয়া যাই। কিন্তু একথা কে অস্বীকার করিতে পারে যে, সাহিত্যের মধ্য দিয়া প্ৰচারিত যে ভাব ও আদর্শ রাষ্ট্রকে ভাঙ্গিতে গড়িতে পারে, জাতীয় আন্দোলনের ধারাকে প্রভাবিত করিতে পারে, সমাজসংস্কার ও সংগঠনের ব্যাপারেও সেই শক্তি অশেষ কাৰ্য্য করিতে পারে।


জাতীয় আন্দোলন এবং সমাজসংস্কার আন্দোলনের উপর সাহিত্যের প্রভাব যে কত বেশী বাঙলাদেশেই তাহার বড় দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের উপর রহিয়াছে। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলা সাহিত্য বাঙালীর জাতীয় আন্দোলনের উপর যেমন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, হিন্দুধৰ্ম্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের উপরও তেমনি গভীর রেখাপাত করিয়াছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে যে সমাজসংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়, তাহা প্ৰধানত বাঙলা সাহিত্যকে অবলম্বন করিয়াই অগ্রসর হইয়াছিল। ব্ৰাহ্মসমাজের নেতাগণ—রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্ৰনাথ ঠাকুর, ব্ৰহ্মানন্দ কেশবচন্দ্ৰ সেন, আচাৰ্য্য শিবনাথ শাস্ত্রী, রাজনারায়ণ বসু প্ৰভৃতি প্ৰধানত সাহিত্যের মধ্য দিয়াই সংস্কার আন্দোলন চালাইয়াছিলেন। ব্ৰাহ্মসমাজের নেতারা যে সমাজসংস্কার আন্দোলনে অগ্ৰণী হইয়াছিলেন, একথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করিতে হইবে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষভাগে সামাজিক জড়তা ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁহারা অক্লান্তভাবে সংগ্ৰাম করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয় নাই। হিন্দুসমাজ উহাতে বহুল পরিমাণে প্ৰভাবিত হইয়াছে। তৎসত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের শক্তি ও তেজ যে ক্রমে মন্দীভূত হইয়া পড়িয়াছে, উহা আশানুরূপ প্রসারলাভ করিতে পারে নাই, তাহার কারণ কি ? আমাদের মনে হয়, ব্ৰাহ্মসমাজ একটা বিষয়ে মারাত্মক ভুল করিয়াছিল। তাহারা হিন্দুসমাজ হইতে স্বতন্ত্র হইয়া বাহির হইতে সংস্কার আন্দোলন চালাইতে চেষ্টা করিয়াছিল। ইহার ফলেই হিন্দুসমাজের সহানুভূতিলাভে তাহারা বহুল পরিমাণে বঞ্চিত হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ এই সত্য বহুদিন পূর্ব্বেই ধরিতে পারিয়াছিলেন। “ব্ৰাহ্ম ধৰ্ম্মের প্রচার” নামক তাঁহার বিখ্যাত বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করিয়াই বলিয়াছিলেন, ব্ৰাহ্মসমাজের কাজ শেষ হইয়াছে, উহার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের আর প্রয়োজন নাই। বৃহত্তর হিন্দুসমাজের অন্তর্ভূক্ত হওয়াই উহার পক্ষে বাঁচিবার একমাত্র পথ। জানি না, ব্ৰাহ্মসমাজের নেতাগণ এ সত্য এখনও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছেন কিনা। পাঞ্জাবের আর্য্যসমাজ এই ভুল করে নাই, তাই তাহাদের শক্তি ক্রমেই বাড়িতেছে।



বাঙলাদেশে হিন্দুসমাজের ভিতর হইতেই যাঁহারা সমাজসংস্কার আন্দোলন চালাইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে প্ৰাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের নাম সৰ্ব্বাগ্রগণ্য। বলিতে গেলে হিন্দুসমাজের নবযুগের স্মৃতিকাররূপে তিনি আবির্ভূত হইয়াছিলেন। প্রাচীন স্মৃতিকারদের চেয়ে তাঁহার গৌরব কোন অংশেই কম নহে। তাঁহার দুই প্ৰধান সংস্কার প্রচেষ্টা-বিধবাবিবাহ প্ৰচলন এবং বহুবিবাহ নিবারণ বহুল পরিমাণে সাফল্যলাভ করিয়াছে। আর বিদ্যাসাগর মহাশয় প্ৰধানত সাহিত্যের মধ্য দিয়াই এই সংস্কার প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক যে সব সাহিত্যিক কাৰ্য্যক্ষেত্রে নামিয়াছিলেন, সমাজ সংস্কারের দিক দিয়া তাহাদের প্রভাব ও সামান্য নহে। পণ্ডিত রামনারায়ণের “কুলীনকুলসর্বস্ব” নাটক এবং দীনবন্ধু মিত্রের সামাজিক নাটক ও প্ৰহসন এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’1 ও কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সাও’2 বাঙলার সামাজিক আন্দোলনে স্থান পাইবার যোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্ৰ ও তাঁহার সমসাময়িক সাহিত্যিকবৃন্দ সমাজসংস্কার আন্দোলনের উপর অশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন অসাধারণ শক্তিধর পুরুষ।


সাহিত্যের মধ্য দিয়া তিনি বাঙ্গালীর জাতীয় জীবন—তথা সমাজজীবনকে যে ভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছিলেন, তাহার তুলনা নাই। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্ঘর্ষে আমরা কতকটা বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলাম, পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের তীব্র আলোকে আমাদের চোখ ঝলসিয়া গিয়াছিল। ফলে যাহা কিছু পাশ্চাত্য তাঁহাই আমরা নকল করিয়া নিজেদের সত্ত্বা হারাইয়া ফেলিবার উপক্ৰম করিয়াছিলাম। এই বিমূঢ় অবস্থা হইতে জাতিকে যাহারা সচেতন করিয়া তোলেন—বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাদের মধ্যে সৰ্বাগ্রগণ্য। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে তিনি যেমন পাণ্ডিত্যলাভ করিয়াছিলেন, অগাধ হিন্দুশাস্ত্ৰ, দৰ্শন ও সাহিত্যেও তেমনি ছিল তাঁহার জ্ঞানের গভীরতা। তাই প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় বিদ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া তিনি স্বজাতি ও সমাজকে আত্মস্থ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। জাতির শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যে দৃষ্টি বহির্ম্মুখী হইয়াছিল, তাহাকে তিনি অন্তর্ম্মুখী করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। আর তাঁহার অসামান্য প্রতিভা সাহিত্যের মধ্য দিয়াই এই দুঃসাধ্য ব্ৰত পালন করিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ তাঁহার শিষ্য ও সহকৰ্ম্মীরাও এই মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন।



তারপর আসিল শ্ৰীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের যুগ। বঙ্কিমচন্দ্ৰ যে আদর্শ স্থাপন করিয়াছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দ তাহাকে করিয়াছিলেন আরও মহীয়ান, গৌরবোজ্জল। বাঙ্গলার তথা সমগ্ৰ ভারতের হিন্দুসমাজকে তিনিই নূতন করিয়া দিয়াছিলেন—কৰ্ম্মযোগ ও সেবাধৰ্ম্মের শিক্ষা। স্বামী বিবেকানন্দ প্ৰচলিত ভাষায় ‘সাহিত্যিক’ ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার বিরাট মনীষার স্পর্শে এক বিশাল নূতন সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে। স্বামীজীর বক্তৃতা ও প্ৰবন্ধাবলী বাঙ্গলা ভাষার মধ্য দিয়া হিন্দুসমাজদেহে বিদ্যুৎসঞ্চার করিয়াছে।


এই যুগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া বিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে যাঁহারা সমাজসংস্কার আন্দোলন করিয়াছেন, তাঁহারা প্ৰধানত সাহিত্যকেই অবলম্বন করিয়াছেন। গিরিশচন্দ্ৰ ঘোষের সামাজিক নাটক এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসাবলীর নাম এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। “অপরাজেয় কথাশিল্পী” শরৎচন্দ্ৰ প্ৰকাশ্যে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য লইয়াই উপন্যাস লিখেন নাই বটে, কিন্তু যে সব ভাব ও আদর্শ তিনি তাঁহার সৃষ্ট কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়া প্রচার করিয়াছেন, তাহা বাঙালী হিন্দুর সমাজজীবনের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। বাঙ্গলার রঙ্গমঞ্চও হিন্দুর সমাজজীবনের উপর কম প্রভাব বিস্তার করে নাই। বাঙ্গলার নাট্যশালার ইতিহাস খুব বেশী দিনের নহে, এখনও একশত বৎসর হয় নাই ।3 কিন্তু নানা বিচিত্র অবস্থাবিপৰ্য্যয়ের মধ্য দিয়া বাঙ্গলার রঙ্গমঞ্চ আমাদের সামাজিক পরিবর্ত্তনে বিপুল শক্তিসঞ্চার করিয়াছে। এক্ষেত্রে বাঙ্গলার সংবাদ পত্রের দানও সামান্য নয়। উনবিংশ শতাব্দীর যত কিছু সমাজসংস্কার আন্দোলন, তাহার অধিকাংশেরই বাহন ছিল বাঙ্গলার সংবাদপত্র। বাঙ্গলার রাজনৈতিক আন্দোলন, তাহার জাতীয়জীবন যেমন সংবাদ পত্রের নিকট ঋণী, হিন্দুর সমাজসংস্কার আন্দোলনও তেমনি সংবাদ পত্রের নিকট কম ঋণী নহে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদেও মহাত্মা গান্ধীর অস্পৃশ্যতা বর্জ্জন আন্দোলন প্ৰধানতঃ সংবাদ পত্রের মধ্য দিয়াই পরিচালিত হইয়াছে। সংবাদ পত্ৰ “সাহিত্যের” অন্তর্ভুক্ত কিনা সেই ‘চুলচেরা’ তর্ক আমরা তুলিব না, তবে বাঙ্গলা সংবাদপত্র যে বাঙ্গলা সাহিত্যের অন্যতম প্ৰধান সহযোগী একথা বিস্মৃত হইলে চলিবে না । বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উৎকৃষ্ট রচনা সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের মধ্য দিয়াই প্রথমে প্রকাশিত হইয়াছে ।

• ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দে ’মাসিক পত্রিকা’য় ধারাবাহিক এবং ১৮৮৫-তে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় ।↩

• ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে প্রথম খণ্ড এবং ১৮৬৪-তে দুই খণ্ড একত্রে প্রকাশিত ।↩

• ১৭৯৫ সনে লেবেডেফ বাংলা নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন । প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চের যুগ শুরু হয় ১৮৭২ সনের ডিসেম্বর মাস থেকে ।↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।


Share:

প্রতিকার কোন পথে—২

কাশীর বিখ্যাত মনীষী ডা. ভগবানদাসের পত্ৰ উপলক্ষ করিয়াই আমরা এই আলোচনা আরম্ভ করিয়াছিলাম। সুতরাং হিন্দুসমাজের বৰ্ত্তমান দুৰ্গতির প্রতিকারকল্পে ডা. ভগবানদাস যে-উপায় নির্দেশ করিয়াছেন, তাহাও আমাদের বিচার করিয়া দেখা প্রয়োজন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ডা. ভগবানদাস মহাত্মা গান্ধীর ন্যায়বৰ্ণাশ্রম ধৰ্ম্মের প্রতি আস্থাবান। প্রাচীন আৰ্য্য হিন্দুগণ যে বৰ্ণাশ্রম ব্যবস্থার উপর সমাজ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, তাহাকেই তিনি Ideal বা আদর্শ মনে করেন। তাঁহার বিশ্বাস, এর চেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা আর কোন সমাজ উদ্ভাবন করিতে পারে নাই। বৰ্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম হিন্দুসমাজে যতদিন অবিকৃত ছিল, ততদিন হিন্দুসমাজে কোন জটিল আর্থিক, সমস্যার উদ্ভব হয় নাই, বেকারের দলও দেখা দেয় নাই। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে একটা সুসঙ্গত সামঞ্জস্যও ছিল। কিন্তু বৰ্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম যখন হইতে বিকৃত হইয়া জাতিভেদে পরিণত হইতে লাগিল, তখন হইতেই হিন্দুসমাজের দুর্দ্দশা আরম্ভ হইল।

ডা. ভগবানদাসের অভিমত এই যে, যদি হিন্দুসমাজে পুনরায় বৰ্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম প্ৰবৰ্ত্তিত করা যায়, তাহা হইলে বৰ্ত্তমানের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হইবে। যে কৰ্ম্মবিভাগের নীতির উপর বর্ণাশ্ৰম ধৰ্ম্ম প্রতিষ্ঠিত, বৰ্ত্তমানকালে কি প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য কোন সমাজই তাহা অনুসরণ করে নাই, ফলে ধনী-দরিদ্র উচ্চ-নীচের আত্যন্তিক বৈষম্য ঘটিয়াছে। এত দুঃখদৈন্য বেকারসংখ্যা বৃদ্ধির মূলে উহাই। সমাজতন্ত্রবাদ বা ধনসাম্যবাদ এই বৈষম্য দূর করিবার জন্য যে সব উপায় চিন্তা করিতেছে, ডা. ভগবানদাসের মতে সেই সব উপায়ে সমস্যার সম্যক সমাধান হইবে না। পক্ষান্তরে আর্য্যহিন্দুদের উদ্ভাবিত বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্মে সমাজতন্ত্রবাদের মূল নীতি নিহিত আছে। ইহাকে এক হিসাবে Practical Socialism বলা যাইতে পারে। হিন্দু সমাজ যদি সেই প্ৰাচীন আদর্শ গ্রহণ করে, তবে আবার সে পূর্বের গৌরব ফিরিয়া পাইতে পারে।
ডা. ভগবানদাস প্ৰাচীন বৰ্ণাশ্রম ব্যবস্থা সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে, ঐ ব্যবস্থায় সমাজে শিক্ষক, রক্ষক, পালক ও ধারক এই চতুর্ধা বিভক্ত বর্ণচতুষ্টয়ের অঙ্গাঙ্গিভাবযুক্ত সহযোগ ও সহকারিতার ফলে সামাজিক স্বস্তি ও সম্পদ সিদ্ধ হইতে পারিয়াছিল।
It was framed by the ancient thinkers of India, who had discovered the greater, nobler, and for the humanity, the far more useful complimentary half-truth and fact of human evolution in accordance with the great “Law of alliance for existence.” (Dire need for a scientist manifesto).
কিন্তু “বৰ্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম যতই ‘আদর্শ’ ব্যবস্থা হোক, বর্তমান যুগে হিন্দু সমাজে তাহা ঠিক ঠিক প্রচলিত করা অসম্ভব। যমুনার জল যেমন উজান বহানো যায় না, প্রাচীন যুগের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাও তেমনই এ যুগে ফিরাইয়া আনা যায় না।
ডা. ভগবানদাস নিজেই স্বীকার করিয়াছেন—It has obviously degenerated utterly and become curse instead of blessing. অর্থাৎ ইহা সম্পূর্ণভাবে বিকৃত ও অধঃপতিত হইয়াছে এবং হিন্দুসমাজের পক্ষে আশীৰ্ব্বাদের পরিবৰ্ত্তে অভিশাপস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

কিন্তু আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা যে সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়াছে, তাহাও মানব জাতির পক্ষে কল্যাণকর হয় নাই, এমন কি অভিশাপস্বরূপ হইয়াই দাঁড়াইয়াছে। এই ব্যবস্থার মারাত্মক দোষ এই যে, ইহাতে সমাজে ধনী দরিদ্রের মধ্যে আত্যন্তিক বৈষম্যের সৃষ্টি হইয়াছে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ ধনসম্পদ বাড়াইবার যে নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়াছে, তাহাতে কতকগুলি কোটিপতি, লক্ষপতির সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাদের ভোগবিলাসের আড়ম্বর বাড়িয়াছে সন্দেহ নাই—কিন্তু অপরদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ অৰ্দ্ধাশনে অনশনে রোগে ব্যাধিতে পশুর ন্যায় দিন যাপন করিতে বাধ্য হইতেছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঐশ্বৰ্য্য ক্রমেই বাড়িতেছে, কিন্তু ঐ ঐশ্বৰ্য্য সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টিত হইতেছে না। ফলে বিরাট অন্নসমস্যা বিভীষিকার মূৰ্ত্তি ধরিয়া সমাজের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে, কৃষক ও শ্রমিকেরা বিদ্রোহ করিয়াছে। ডা. ভগবানদাসের ভাষায়—Humanity is in imminent danger of dying from in mutual hatred—born of lack of equitable disttribution of sufficient bread.
এই বিদ্রোহের মধ্য হইতেই Socialism and Communism—সমাজতন্ত্রবাদ ও ধনসাম্যবাদের জন্ম এবং সোভিয়েট রাশিয়া এই সমাজতন্ত্রবাদ ও ধনসাম্যবাদের আদর্শ অনুসরণ করিয়াই বৰ্ত্তমানে জটিল সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করিতেছে। ডা. ভগবানদাস মনে করেন যে, ভারতের প্রাচীন আৰ্য্যদের বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্মের পরই সোভিয়েটের এই সাম্যবাদমূলক ব্যবস্থা vast experiment বা সুমহৎ পরীক্ষা হিসাবে স্থান পাইবার যোগ্য। কিন্তু এই পরীক্ষার পথে সোভিয়েট রাশিয়া যেমন কতকগুলি বিষয়ে আশ্চৰ্য্য সাফল্য লাভ করিয়াছে, তেমনি আবার কতকগুলি বিষয়ে মারাত্মক এবং নিষ্ঠুর ভ্রমও করিয়াছে—
The vast Russian experiment now in progress, is the second effort of mankind in the same direction ; but, while it las achieved marvels, it has also committed many serious and cruel mistakes, is still undergoing great internal tribulations and is correcting its errors.
সেইজন্য ডা. ভগবানদাস মনে করেন যে, একদিকে সমাজতন্ত্রবাদ ও ধনসাম্যবাদ, অন্যদিকে প্রাচীন হিন্দুদের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা—ইহার মাঝামাঝি একটা পথ অবলম্বন করিলে কেবল হিন্দুসমাজ নয়, বৰ্ত্তমান বিশ্বমানব সমাজের সমস্যারও মীমাংসা করা যাইতে পারে। সেই মধ্য পন্থার নাম দিয়াছেন তিনি ‘নূতনতর ও উন্নততর বর্ণাশ্ৰম ধৰ্ম্ম’ এবং পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদিগকে সেই নূতন পরিকল্পনা গড়িয়া তুলিবার জন্য আহবান করিয়াছেন।


The right middle Course between impossibly equilatarian communism and criminally iniquitons capitalism–a new and complete scheme of social structure ( a newer and better ‘Barnasram-dharma’).
ডা. ভগবানদাস যে সুসংস্কৃত বৈজ্ঞানিক ‘বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্মের’ কথা বলিয়াছেন, আদর্শ হিসাবে তাহা খুবই উচ্চ সন্দেহ নাই, উহার মূল উদ্দেশ্য আমরাও সমর্থন করি। কিন্তু ঐ আদর্শ কাৰ্য্যে পরিণত করা আদৌ সম্ভবপর কিনা বা হইলে কবে সম্ভবপর হইবে, তাহা বলা কঠিন। সুতরাং সেই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্ৰতীক্ষা করিয়া বসিয়া না থাকিয়া হিন্দু সমাজের দুৰ্গতি রোধ করিবার জন্য অবিলম্বেই আমাদের কৰ্ম্মে প্ৰবৃত্ত হওয়া প্ৰয়োজন। আমাদের মতে এখন প্ৰথম এবং প্ৰধান কৰ্ত্তব্য—হিন্দু সমাজের মধ্যে সামাজিক সাম্যবাদ ও কৰ্ম্মযোগের আদর্শ প্রচার করা এবং সাহসের সঙ্গে তদনুযায়ী সংস্কার প্রচেষ্টা করা। সাম্যবাদের কথা উঠিলেই, কতকগুলি পণ্ডিতন্মন্য ব্যক্তি মুরুব্বীয়ানার চালে বলিয়া থাকেন যে, আৰ্য্যঋষিরা যে সাম্যবাদের আদর্শ স্থাপন করিয়াছেন, তাহার চেয়ে বড় আদর্শ আর কোথায় আছে ? “জীবমাত্রেই ব্ৰহ্ম”-এই আদর্শ ত হিন্দুদেরই। কিন্তু কেবল প্ৰাচীন আৰ্য্যঋষিরা কেন, বুদ্ধদেব, চৈতন্য প্রমুখ মহাপুরুষেরাও তা ঐ মহান সাম্যবাদের আদর্শ প্রচার করিয়া গিয়াছেন।


তবু হিন্দু সমাজের এই দুর্দ্দশা কেন, জাতিভেদ এখনও লুপ্ত হয় নাই কেন, তথাকথিত “শূদ্রেরা” এখনও মানুষের অধিকার পায় নাই কেন ? তাহার কারণ, কেবল কথায় চিড়া ভিজে না। মুখে বড় বড় আদর্শের কথা বলিব এবং কাৰ্য্যকালে ভেদ ও বৈষম্যের দুর্গ আরও পাকা করিতে থাকিব, ইহা ভণ্ডামি, আত্মপ্রতারণা, জঘন্য স্বাৰ্থরপতা। সুতরাং হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণীয়দের আজ ভণ্ডামি ছাড়িয়া বাস্তবক্ষেত্ৰে নামিতে হইবে। নিজেদের বহু শতাব্দীর সঞ্চিত স্বার্থ, দম্ভ ও অভিমান ত্যাগ করিয়া সমাজের কল্যাণ, তথা নিজেদের কল্যাণের জন্যও তথাকথিত “শূদ্ৰদের” মানুষের অধিকার দিতে হইবে। শূদ্ৰশক্তি যতদিন অবজ্ঞাত, দলিত, পিষ্ট হইয়া থাকিবে, ততদিন হিন্দুসমাজের কল্যাণ নাই, তাহারা উহাকে ক্ৰমাগত ধ্বংসের পথেই টানিয়া লইয়া যাইবে।

“শূদ্রদের” মধ্যে যদি আমরা মনুষ্যত্বের বোধ জাগাইতে পারি, তাহাদিগকে আপনার করিয়া লাইতে পারি, তবে তাহাদের মধ্য হইতে যে প্ৰচণ্ড শক্তি জাগ্রত হইবে, তাহা হিন্দুসমাজে যুগান্তর সৃষ্টি করিবে। বৰ্ত্তমানে সমাজের শূদ্ৰশক্তির মধ্যে যে হতাশা ও নৈরাশ্যের ভাব দেখা দিয়াছে, তাহা মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ। কিন্তু তাহারা একা মরিবে না, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই মরিব। বৰ্তমানে হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণীয়দের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি হইয়াছে যে, তাহারা হিন্দুসমাজের কেহ নহে, হিন্দুসমাজের ভাল মন্দে তাহাদের কিছু আসিয়া যায় না। কতকটা নৈরাশ্যে, কতকটা প্ৰতিশোধ স্পৃহায় তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণ করিতেছে। যাহারা করিতেছে না, তাহারা মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়া উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে। সুযোগ বুঝিয়া ইংরেজ গবৰ্ণমেণ্ট কৃত্ৰিম “তপশীলী জাতির” সৃষ্টি করিয়া হিন্দুসমাজকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিতেছেন। অতএব এখনও যদি আমরা সাবধান না হই, তবে ধ্বংস নিশ্চিত।
দ্বিতীয়ত কৰ্ম্মযোগ ও রজোগুণের আদর্শ প্রচার করিতে হইবে।


পূর্ব্বেই বলিয়াছি, কৰ্ম্মবিমুখতা এবং একটা তামসিক অহিংসার ভাব হিন্দুসমাজের মধ্যে—বিশেষত তাহার নিম্নস্তরে প্রবেশ করিয়াছে। ফলে স্ব স্ব বৃত্তিকে তাহারা হীন মনে করিতে শিখিয়াছে। কৃষিজীবী হিন্দুরা যে কৃষিকাৰ্য্য ত্যাগ করিতেছে, তাহার মূলে কেবল তাহাদের অক্ষমতা নয়, কৃষিকাৰ্য্যের প্রতি একটা অবজ্ঞার ভাবও আছে। ফলে হিন্দু কৃষকের সংখ্যা ক্ৰমশ হ্রাস হইতেছে, সমস্ত জমি মুসলমান কৃষকদের হাতে চলিয়া যাইতেছে। ইহা হিন্দুসমাজের পক্ষে ঘোর দুর্লক্ষণ। অবস্থা যেরূপ দাঁড়াইতেছে তাহাতে আর অৰ্দ্ধশতাব্দীর মধ্যেই হিন্দুরা ভূমিশূন্য বেকার শ্রমিকের দলে পরিণত হইবে। অতএব হিন্দুসমাজের নিম্নস্তরে কৰ্ম্মের মহিমা প্রচার করিতে হইবে। হিন্দু কৃষকেরা আবার যাহাতে জমিতে ফিরিয়া যায়, পরিত্যক্ত শ্রমশিল্পগুলি গ্রহণ করে, তাহার জন্য তাহাদের উদ্বুদ্ধ করিতে হইবে। গ্ৰাম্য কুটীরশিল্পগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করিতে হইবে এবং হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণীয়েরা যাহাতে গ্রামে থাকিয়াই ঐ সব শিল্প অবলম্বন করিয়া জীবিকা নিৰ্বাহ করিতে পারে, তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। কেহ কেহ বলিতে পারেন, এটা ত অর্থনৈতিক সমস্যা—ইহার সঙ্গে হিন্দুর সামাজিক সমস্যার সম্বন্ধ কি? কিন্তু আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদেরা জানেন যে, অর্থনৈতিক পরিবেশের প্রভাব সমাজের উপর কতখানি কাজ করে। কৰ্ম্মহীন হতাশ বেকারের দল লইয়া কোন সমাজই রক্ষা করা যায় না, হিন্দুসমাজকেও রক্ষা করা যাইবে না ।


তারপর রজোগুণের কথা। অহিংসার নামে যে ঘোর তামসিকতা হিন্দুসমাজকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে, তাহার অনিষ্টকর প্রভাব হইতে হিন্দুসমাজকে মুক্ত করিতে না পারিলে মৃত্যু অনিবাৰ্য্য। স্বামী বিবেকানন্দ বহু পূর্ব্বেই বলিয়া গিয়াছেন, হিন্দুসমাজকে বাঁচাইবার জন্য চাই রজোগুণ—বীৰ্য্যবান কৰ্ম্মের সজীবতা। কিন্তু তাঁহার কথা আমরা ভাল করিয়া শুনি নাই। আর এই অহিংস তামসিকতার সঙ্গে আসিয়া জুটিয়াছে—অদৃষ্টবাদ, পরলোক-বিলাসিতা, ইহলোকের প্রতি ঔদাসীন্য। সমস্ত মিলিয়া হিন্দুজাতিকে এমন শান্ত, নিরীহ, বশংবদ non-aggressive ও submissive করিয়া তুলিয়াছে যে বৰ্ত্তমান যুগের জীবনসংগ্রামে তাহার পক্ষে আত্মরক্ষা করা কঠিন। বহু শতাব্দীর পরাধীনতাও হিন্দুদের প্রকৃতিতে এই ভাব দৃঢ়মূল করিয়া দিয়াছে। জীববিজ্ঞানের দিক হইতে এই Non-aggressivéness বা সবল মনোভাবের অভাব একটা জাতির পক্ষে সৰ্ব্বাপেক্ষা বড় ব্যাধি—ক্ষয়রোগেরই তুল্য। বহু প্ৰাচীন জাতি, প্রাচীন সভ্যতা ইহার ফলে ধ্বংস হইয়াছে। হিন্দুরা যদি সময় থাকিতে এই “পরাজিতের মনোভাব” ত্যাগ করিয়া সবল, সতেজ মনোভাবের অনুশীলন করিতে না পারে, তবে জীববিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে তাহাদেরও অদূর ভবিষ্যতে মৃত্যু হইবে। পৃথিবীতে দুৰ্ব্বলের স্থান নাই, “বীরভোগ্যা বসুন্ধরা”—এই মহাসত্য আজ আমাদিগকে জাতি হিসাবে উপলব্ধি করিতে হইবে।

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

প্রতিকার কোন পথে

জীববিজ্ঞানের ন্যায় সমাজবিজ্ঞানের গোড়ার কথাই এই যে, যেসমাজ পরিবর্ত্তনশীল পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে পারে না, শীঘ্ৰ হউক বা বিলম্বে হউক, তাহার মৃত্যু নিশ্চিত। অনেক প্রাচীন জীবের ন্যায় অনেক প্রাচীন জাতিও এই কারণেই ধরা পৃষ্ঠ হইতে লুপ্ত হইয়াছে, ভবিষ্যতেও আরও অনেক জাতি যে জীবন সংগ্রামে আত্মরক্ষা করিবার এই অক্ষমতার জন্য লুপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রাচীন হিন্দুজাতিও সেই পথের পথিক হইবে কিনা নানা কারণে এই প্রশ্ন আজি উঠিয়াছে। আমরা বহু শতাব্দী ধরিয়া টিকিয়া আছি, অতএব ভবিষ্যতেও টিকিয়া থাকিব, এরূপ যুক্তি বালকোচিত। তারপর কোনমতে টিকিয়া থাকাই পরম পুরুষাৰ্থ নহে। একটা জাতি জীবন্মৃত অবস্থায় বহুকাল টিকিয়া থাকিতে পারে, ক্ষয়রোগীও অনেক সময় দীর্ঘজীবী হয়। কিন্তু কোন বুদ্ধিমান এবং আত্মমৰ্য্যাদাসম্পন্ন জাতিই তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিতে পারে না। আর যাঁহারা বলেন, আমরা আধ্যাত্মিক জাতি, ‘কৌপীনবন্তং খলু ভাগ্যবন্তং’ অবস্থায় জগতের অন্যান্য জড়বাদী জাতিদিগকে ব্ৰহ্মজ্ঞান দান করিবার জন্যই আমরা বাঁচিয়া আছি—সেই সব মোহগ্ৰস্ত আত্মপ্ৰতারকদের সঙ্গে কোনরূপ আলোচনা করাই নিরর্থক।

স্বামী বিবেকানন্দ বড় দুঃখেই বলিয়াছিলেন, আমরা যে আধ্যাত্মিকতার বড়াই করি, তাহা প্ৰকৃতপক্ষে তামসিকতার লক্ষণ। এই কারণেই হিন্দুজাতিকে স্বামীজী কিঞ্চিৎ রজোগুণের চর্চা করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন। কিন্তু সে উপদেশ আমরা গ্ৰহণ করিতে পারিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।


প্ৰথমেই বিবেচ্য, পাঁচ হাজার বৎসর ধরিয়া যে জাতিভেদের কাঠামোর মধ্যে হিন্দুসমাজ দাঁড়াইয়া আছে, সেই কাঠামো বদলাইবার প্রয়োজন আছে কিনা। আমরা ইতিপূর্ব্বে যেসব কথা বলিয়াছি, তাহাতে অপরিহার্য্যরূপেই এই সিদ্ধান্ত আসিয়া পড়ে যে, জাতিভেদের কাঠামো ত্যাগ না করিলে হিন্দুসমাজ আত্মরক্ষা করিতে পরিবে না। জাতিভেদের ফলে হিন্দুসমাজে সংহতিশক্তির অভাব ঘটিয়াছে, সমস্ত সমাজ দানা বাধিয়া একই সঙ্ঘবদ্ধ প্ৰতিষ্ঠানে পরিণত হইতে পারে নাই। ভারতবর্ষে হিন্দুরা যে কোন শক্তিশালী ‘নেশন’ বা মহাজাতি গঠন করিতে পারে নাই, তাহারও কারণ এই জাতিভেদ। ইহা হিন্দুসমাজকে প্রথমত উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণে বিভক্ত করিয়াছে। উহাদের মধ্যেও আবার বহু উপবিভাগ, শাখা প্ৰশাখা প্ৰভৃতির সৃষ্টি হইয়াছে। কতকগুলি জাতিকে আবার আমরা অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয় বলিয়া ছাপ দিয়া অপাঙ্ক্তেয় করিয়া রাখিয়াছি। ফলে হিন্দুসমাজ একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজ নয়, বহু বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজের সমষ্টি মাত্ৰ, উহাদের মধ্যে কোন নিবিড় যোগসূত্ৰ নাই। এরূপ দুর্বল, সংহতিশক্তিহীন সমাজ বাহিরের সঙ্ঘবদ্ধ প্ৰবল শক্তির বিরুদ্ধে বেশীদিন আত্মরক্ষা করিতে পারে না। অধ্যাপক যদুনাথ সরকার তাঁহার ‘শিবাজী’1 গ্রন্থে মারাঠা জাতির অবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন :
“Infinitely minute subdivisions of society made, the formation of one nation or a compact body of men moved by the community of life, thought and interest, impossible and even inconcivable.”
ইহা কেবল মহারাষ্ট্র দেশের হিন্দুদের পক্ষেই প্রযোজ্য নয়, সমগ্র ভারতের হিন্দু সমাজের পক্ষেই প্রযোজ্য । ঐতিহাসিক ভিন্সেন্ট স্মিথ, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখ মনীষীরাও বহু জাতি-উপজাতিভেদকে হিন্দুসমাজের প্রধান দৌর্বল্য এবং ভারতে ‘নেশন’ বা মহাজাতি গঠনের প্রবল বাধা স্বরূপ বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন ।

জাতিভেদের আর একটা বিষময় ফল, মানুষকে সে মানুষের মৰ্য্যাদা দেয় নাই, তাহাকে নানারূপ কৃত্ৰিম গণ্ডীবদ্ধ করিয়া, বিচিত্র রকমের উচ্চনীচ স্তরভেদ করিয়া তাহার মধ্যে আত্মদৈন্যের ( inferiority complex) সৃষ্টি করিয়াছে। এই আত্মদৈন্য হিন্দুসমাজকে ক্রমশ ক্ষয় করিয়া ফেলিতেছে।


অতএব প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন জাতিভেদের বিলোপ। সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডী ভাঙ্গিয়া হিন্দুসমাজদেহে নূতন প্ৰাণশক্তির সঞ্চার করিতে হইবে, তাহার মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধতার বিকাশ করিতে হইবে। ভারতের ইতিহাসে কয়েকবার এই চেষ্টা হইয়াছে, কিন্তু নানা প্ৰতিকূল শক্তির জন্য উহা সফল হইতে পারে নাই। বৌদ্ধধৰ্ম্ম তাহার সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শের ভিতর দিয়া এই চেষ্টা করিয়াছিল, শ্ৰীচৈতন্যের প্রচারিত বৈষ্ণবধৰ্ম্মও এই চেষ্টা করিয়াছিল। কিরূপে উহা ব্যর্থ হইয়াছে, পূর্বে তাহার আভাস আমরা দিয়াছি। বৰ্ত্তমান কালে আৰ্য্যসমাজ ও ব্ৰাহ্মসমাজও এই চেষ্টা কিয়ৎপরিমাণে করিয়াছে। আৰ্যসমাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত পাঞ্জাবের ‘জাতপাত তোড়কমণ্ডল’ এখনও এই চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু হিন্দু সমাজের ভিতর হইতেই যদি ব্যাপকভাবে এইরূপ প্ৰচেষ্টা না হয়, তবে সাফল্যের আশা কম। স্মরণ রাখিতে হইবে, জাতিভেদ প্ৰাচীন হিন্দুসমাজের সুদৃঢ় দুৰ্গস্বরূপ। ইহাকে ধ্বংস করা মোটেই সহজসাধ্য নহে। অতএব কেবল সম্মুখের দিক হইতে আক্রমণ না চালাইয়া দুই পার্শ্ব হইতে কৌশলে আক্রমণ করাও প্ৰয়োজন।


আমাদের মতে অস্পৃশ্যতা বর্জ্জন এবং অসবর্ণ বিবাহ—এই দুই আন্দোলন পার্শ্বদেশ হইতে আক্রমণ চালাইবার প্রধান উপায়। অস্পৃশ্যতা বর্জ্জন আমরা ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করিতেছি। হিন্দুসমাজে অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয় বলিয়া কেহ থাকিবে না, সকলেই দেবমন্দিরে প্রবেশ করিতে পরিবে, কূপতড়াগাদি হইতে জল তুলিতে পরিবে, বিদ্যালয়ে সৰ্ব্বজাতির হিন্দু একত্ৰ পড়িতে পরিবে—এ সবই অস্পৃশ্যতা বর্জনের অঙ্গ। আদমসুমারিতে বিভিন্ন জাতি অনুসারে হিন্দুর নাম থাকিবে না, সকলেই মাত্ৰ ‘হিন্দু’ বলিয়া উল্লিখিত হইবে, ইহাও একটা উপায় ।2 সরকারী বিধানে ‘তপসিলভুক্ত জাতি’ বলিয়া যে কৃত্রিম রাজনৈতিক উপবিভাগের সৃষ্টি হইয়াছে, যেরূপেই হোক তাহা তুলিয়া দিতে হইবে। যদি কোন হিন্দুই ‘তপসিল’ ভুক্ত হইতে স্বীকৃত না হয়, তবে সহজেই সমস্যার সমাধান হইতে পারে। কিন্তু আমরা যদি তথাকথিত ‘তপসিল’ ভুক্তিদের মনে প্রীতি ও আস্থার ভাব সঞ্চার করিতে না পারি, তবে তাহারা ঐ প্রস্তাবে সম্মত হইবে কেন ?
এইখানেই উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের মধ্যে সঙ্ঘর্ষের কথা আসিয়া পড়ে।


জাতিভেদ তথা স্তরভেদ ও শ্রেণীবিভাগের ফলে বহু শতাব্দী ধরিয়া উচ্চ ও নিম্ন জাতিদের মধ্যে ব্যবধানের সৃষ্টি হইয়াছে এবং ঐ ব্যবধান বাড়িয়াই চলিয়াছে। এই ব্যবধান দূর করিতে হইলে তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দের অভিমান ও ভ্ৰান্ত মৰ্য্যাদাবোধ ত্যাগ করিয়া তথাকথিত নিম্নবর্ণীয়দের সঙ্গে মিলন মিশ্রণ করিতে হইবে। অনুকম্পা বা পতিতোদ্বারের ভাব লইয়া নয়, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শে উদ্বূদ্ধ হইয়া মনুষ্যত্বের মৰ্য্যাদার উপর এই মিলনবেদীর প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। হিন্দুতে হিন্দুতে কোন ভেদ নাই, উচ্চনীচ স্তরবৈষম্য নাই, সকলেই এক হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত—এই মহান্‌ আদর্শ সৰ্ব্বদা আমাদের সম্মুখে রাখিতে হইবে।


এই মহান আদর্শ যাহাতে কাৰ্য্যক্ষেত্রে অনুসৃত হইয়া হিন্দুসমাজের মধ্যে সংহতিশক্তি বা সঙ্ঘবদ্ধতার ভাব সঞ্চার করিতে পারে, তাহার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে। প্রথমত, সমাজসেবাব্রতী হিন্দু সেবক দল গঠন। জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকল হিন্দুযুবকই এই সেবকদলভুক্ত হইতে পরিবে। ইহাদের মধ্যে উচ্চ-নীচ স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বা আচরণীয়-অনাচরণীয়ের ভেদ থাকিবে না। তাহারা পরস্পরে একত্রে আহারব্যবহার করিবে। তারপর, এমন সব সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করিতে হইবে, যাহাতে জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকল হিন্দুই যোগ দিতে পারে। দেবমন্দিরে যদি সকল হিন্দুর প্রবেশ ও পূজার অধিকার স্বীকার করা হয়, তবে এইরূপ সর্বজনীন উৎসব অনুষ্ঠান সহজ হইবে। বৰ্ত্তমান সময়ে যেসব “সর্বজনীন পূজা উৎসব” হয়, তাহা এই দিক হইতে খুবই মূল্যবান। এই শ্রেণীর উৎসবের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করিতে হইবে।


অসবর্ণ বিবাহ জাতিভেদের দুর্গ শিথিল করিবার আর একটি প্ৰধান উপায়। অসবর্ণ বিবাহ হিন্দুসমাজে এককালে প্ৰচলিত ছিল, কিন্তু জাতিভেদের কঠোরতা বৃদ্ধি পাওয়াতে পরবর্ত্তী কালে উহা অপ্রচলিত হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু বৰ্ত্তমান কালে হিন্দুসমাজকে রক্ষা করিবার জন্য উহার বহুল প্ৰচলন আবশ্যক 3 । অসবর্ণ বিবাহ প্ৰচলিত হইলে কেবল যে বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিলন মিশ্রণের ক্ষেত্র প্রসারিত হইবে তাহা নহে, বিবাহক্ষেত্রের সঙ্কীর্ণতা দূর হইবে, বিভিন্ন শ্রেণীর রক্তমিশ্রণে হিন্দু সমাজের উৎকর্ষ সাধিত হইবে । অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে যে আইনের বাধা ছিল, তাহা দূর হইয়াছে, সুতরাং সমাজহিতকামী ব্যক্তিগণ অসবর্ণ বিবাহ প্ৰচলনের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করিতে পারেন ।
কিন্তু গোঁড়াদের “ধৰ্ম্ম গেল” চীৎকার ছাড়াও অসবর্ণ বিবাহ প্রচলনের পথে একটা যে প্রবল বাধা আছে, তাহা আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। অসবর্ণ বিবাহের ফলে যে সব সন্তানসন্ততি হইবে, তাহাদের বর্ণ বা জাতি কি হইবে ? সহজ বুদ্ধিতে বলে উহারা পিতার বর্ণ বা জাতিই পাইবে। কিন্তু এই হতভাগ্য সমাজে অসবর্ণ বিবাহের ফলেও নূতন নূতন জাতি সৃষ্টির দৃষ্টান্ত দেখা গিয়াছে। সেরূপ যাহাতে না ঘটে, সমাজপতিগণকে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে।


জাতিভেদ লোপ, অস্পৃশ্যতা বর্জ্জন এবং অসবর্ণ বিবাহের বিরুদ্ধে আর এক শ্রেণীর আপত্তি উঠিয়া থাকে। এই শ্রেণীর আপত্তিকারিগণ বিজ্ঞানের ভাষায় কথা বলেন। তাঁহারা বলেন, জাতিভেদ উঠাইয়া দিলে হিন্দুসমাজের বিভিন্ন স্তরে যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বৈষম্য আছে, তাহা লুপ্ত হইবে, ফলে সমগ্রভাবে হিন্দুসমাজের সংস্কৃতির অপকর্ষ ঘটবে। ব্ৰাহ্মণ প্ৰভৃতি উচ্চজাতি বহু শতাব্দীর অনুশীলনের ফলে উচ্চ শ্রেণীর সংস্কৃতি ও সদাচার লাভ করিয়াছে,—নিম্নবর্ণীয়েরা ঐ বিষয়ে অনেক নীচে পড়িয়া আছে। জাতিভেদ লোপ করিয়া অসবর্ণ বিবাহ প্ৰচলিত করিলে, উচ্চস্তরের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নষ্ট হইবে এবং তাহাতে ঘোর অনিষ্টই হইবে। অস্পৃশ্যতা বর্জ্জন ও খাদ্যবিচার ত্যাগের ফলেও ঐ অবস্থা ঘটিবে। আপত্তিকারীরা আরও বলেন যে, জাতিভেদ কোন না কোন আকারে পাশ্চাত্য সমাজেও আছে, সেখানেও ধনী দরিদ্র, অভিজাত ও সাধারণ লোকের মধ্যে বিবাহ ও আহারব্যবহার প্রচলিত নাই। কিন্তু এই শ্রেণীর আপত্তিকারীরা ইচ্ছা করিয়াই ভুলিয়া যান যে, বংশগত জাতিভেদের বৈষম্য এবং ধনী-দরিদ্র, অভিজাত-সাধারণের বৈষম্য এক জিনিষ নয়। পাশ্চাত্য সমাজে আজ যে দরিদ্র ও সাধারণ-লোক, দশ বৎসর পরে স্বীয় বুদ্ধিমত্তা ও চরিত্রবলে সে-ই ধনী ও অভিজাত হইতে পারে। সুতরাং সমাজের সকল দ্বারই যে কোন লোকের জন্য অবারিত। বংশগত জাতিভেদের বৈষম্যে ঐ রূপ হইতে পারে না। উহাতে কতকগুলি জাতি অন্য দিক দিয়া সহস্ৰ যোগ্যতা লাভ করিলেও নিম্নস্তরেই থাকিয়া যায়, আর কতকগুলি জাতি অযোগ্য হইলেও সমাজের শীর্ষস্থানে উচ্চস্তরে বিরাজ করিতে থাকে। ইহার ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সদাচার, আভিজাত্য ইত্যাদি সমাজের সর্বস্তরে প্রসারিত হইতে পারে না এবং সমগ্রভাবে সমাজের ক্ষতিই হয়। তারপর জাতিভেদ লোপ এবং অসবর্ণ বিবাহ প্ৰচলিত হইলেও, যাহারা শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সমান সাধারণতঃ এমন সব শ্রেণীর মধ্যেই বিবাহ ও আহারব্যবহার চলিবে, যেসব সমাজে জাতিভেদ নাই সেখানেও ঐরূপই হইয়া থাকে। সুতরাং বৈজ্ঞানিক আপত্তিকারীদের হিন্দুসমাজের সংস্কৃতি লোপের আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক।

• Sarkar, Jadunath. Sivaji. 5th ed. 1952. p. 378.↩

• ১৯৪১ সালের আদমসুমারীতে এই প্রচেষ্টা কিয়ৎ পরিমাণে সফল হইয়াছে । বহু হিন্দু কেবলমাত্র ‘হিন্দু’ বলিয়া নাম লিখাইয়াছে, কোন জাতির উল্লেখ করে নাই । দেওয়ানী আদালতে সাক্ষ্য দিবার কালে অনেকে নিজেকে ‘হিন্দু’ বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন ।ーলেখক↩

• ডা. মুঞ্জে বলেন, হিন্দু সমাজের সকল ব্যাধির পক্ষে ‘অসবর্ণ বিবাহ’ মহৌষধের কাজ করিবে । ‘ডা. মুঞ্জে ও বর্তমান হিন্দুসমাজ’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য ।ーলেখক↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

হিন্দু ভদ্রলোক

বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় এখনও হিন্দুসমাজের মস্তিষ্কস্বরূপ, একথা বোধ হয় কেহই অস্বীকার করিবেন না। সুতরাং ইহাদের মঙ্গলামঙ্গলের উপর বাঙলার হিন্দুসমাজের শুভাশুভ অনেকখানি নির্ভর করে। বৃটিশ শাসনের আরম্ভে এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ই সৰ্ব্বপ্রথমে ইংরাজী শিক্ষালাভ করে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। সমুদ্রমন্থনে যেমন অমৃত ও হলাহল দুই-ই উঠিয়াছিল, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্ঘর্ষে আসিয়া হিন্দুসমাজের পক্ষেও সেই অবস্থা ঘটিয়াছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্পর্শে যে নবজাগরণের ভাব হিন্দুসমাজ এবং তাহার মধ্য দিয়া সমগ্র দেশে আসিয়াছে, তাহাত আমরা চোখের উপরেই দেখিতেছি। গত এক শতাব্দী ধরিয়া জ্ঞানে বিজ্ঞানে, সামাজিক সংস্কারে, রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশে একটা সাড়া পড়িয়া গিয়াছে এবং প্ৰধানত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রসম্প্রদায়ই এ বিষয়ে নেতৃত্ব করিয়াছে। কবি, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাসংস্কারক; সমাজসংস্কারক, জাতীয় আন্দোলনের প্রবৰ্ত্তক, রাজনৈতিক নেতা ইহাদের মধ্য হইতেই হইয়াছে। নবযুগের বাঙালী জাতি যাহা কিছু শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির গর্ব্ব করে তাহা এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়েরই দান, একথা অস্বীকার করিলে অকৃতজ্ঞতা হইবে। আজ যে বিশাল বাঙলা সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে এবং বিশ্বসাহিত্যের দরবারে সম্মানের আসন লাভ করিয়াছে, তাহাও প্ৰধানত এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়েরই সৃষ্টি। সুতরাং এই দিক দিয়া হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় কেবল স্ব-সমাজের নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির, এমন কি সমগ্ৰ ভারতীয় মহাজাতির কল্যাণ সাধন করিয়াছে ।


কিন্তু সমুদ্রমন্থনে যে হলাহল উঠিয়াছে, তাহাও আজ প্ৰধানত এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়কেই পান করিতে হইতেছে। পাশ্চাত্যশিক্ষা লাভ করিয়া হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় দেশ ও জাতির একদিক দিয়া মহৎ কল্যাণ সাধন করিয়াছে বটে, কিন্তু নিজেরা আজ বিষম অর্থনৈতিক সঙ্কট তথা ধ্বংসের মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ব্রিটিশ শাসকেরা এদেশে যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্ৰবৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, তাহার মূলে বিশেষ কোন মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল, এ দেশের শাসনকাৰ্য্যে সহায়তা করিতে পারে এমন একদল লোককে তৈরী করা। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাপ্রণালী প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছিল, তাহার মূলে ছিল ঐ সহকারীর দল তৈরী করার অভিপ্ৰায়। তাই গত এক শতাব্দী ধরিয়া সরকারী এবং তাহারই আদর্শে পরিচালিত বে-সরকারী শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠানসমূহ হইতে প্ৰধানত ডেপুটি, মুন্সেফ, ইস্কুল মাস্টার, উকীল, মোক্তার, কেরাণী, গোমস্তার দল বাহির হইয়াছে। যে ২|৪ জন অন্য ধরণের মানুষ তৈরী হইয়াছে, তাহা এই শিক্ষা প্ৰণালীকে অতিক্রম করিয়াই হইয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হয় না।


সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীর লোভে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় গত এক শতাব্দী ধরিয়া প্ৰাণপণে ইংরাজীশিক্ষা লাভ করিয়াছে। প্ৰথম প্রথম ইংরাজী শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা অল্প ছিল, সুতরাং সরকারী চাকুরী পাওয়াও সহজ ছিল। উকীল, মোক্তার প্রভৃতি হইয়াও বেশ দুপয়সা উপাৰ্জন করা যাইত। সুতরাং হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় অন্য সমস্ত ত্যাগ করিয়া, এমন কি গ্রামভিটা জমিজমা ছাড়িয়া ইংরাজী শিক্ষণ এবং সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীর পিছনে ছুটিয়াছে। আজ এক শতাব্দী পরে দেখিতেছি, মরীচিকার পশ্চাতে ছুটিয়া আমরা মরুভূমিতে প্ৰাণ হারাইতে বসিয়াছি। পাশ্চাত্য শিক্ষার কারখানা হইতে দলে দলে যে সব যুবক বাহির হইয়া আসিতেছে, তাহারা কোন সরকারী বা আধাসরকারী চাকুরী পাইতেছে না,—ওকালতী, মোক্তারী প্ৰভৃতি করিয়াও জীবিকানিৰ্বাহ করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে; পক্ষান্তরে যে শিক্ষা তাহারা লাভ করিতেছে, তাহাতে জীবনসংগ্রামে অন্য কোন ক্ষেত্রেও তাহারা আত্মরক্ষার যোগ্যতা অর্জন করিতেছে না। ইতিমধ্যে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের ঔদাসীন্য ও আত্মবিস্মৃতির সুযোগ লইয়া বিদেশী ও ভিন্ন প্ৰদেশবাসীরা আসিয়া বাঙলার ব্যবসাবাণিজ্য হস্তগত করিয়া ফেলিয়াছে। সুতরাং অবস্থা সব দিক দিয়াই ঘোরাল হইয়া উঠিয়াছে, হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষম অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়াছে। এই সঙ্কটের সমাধানের উপায় যদি এখন হইতেই করা না যায়, তবে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় ভবিষ্যতে লুপ্ত হইয়া যাইবে, এমন আশঙ্কার কারণও আছে।


এই সঙ্কট সমাধানের উপায় কি ? প্ৰবীণ ও বিশেষজ্ঞেরা বলিতেছেন যে, বৰ্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালীরই আমূল পরিবর্ত্তন করিতে হইবে। এখন যে ‘কেতাবী শিক্ষা’ দেওয়া হইতেছে, তাহাতে বৰ্ত্তমানের কঠোর জীবন সংগ্রামে শিক্ষিত যুবকদের অন্নসমস্যার সমাধান হইতে পারে না। এমন শিক্ষা প্ৰণালীর প্ৰবৰ্ত্তন করিতে হইবে, যাহাতে ব্যবহারিক বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক কৃষি ও শিল্পশিক্ষাই হইবে প্ৰধান অঙ্গ। বৰ্ত্তমান যুগে অন্যান্য সভ্যদেশেও এইরূপ শিক্ষা প্ৰণালী প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছে। যদি আমাদের দেশে এইরূপ শিক্ষাপ্রণালী প্ৰবৰ্ত্তিত করা যায়, তবে যুবকেরা সরকারী চাকুরী, কেরাণীগিরি প্রভৃতির মোহ ত্যাগ করিয়া শিল্পবাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করিবার সুযোগ পাইবে। আমাদের মতেও বাঙলার হিন্দু ভদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষে পুরাতন কেতাবী শিক্ষা ও সরকারী চাকুরীর পথ পরিত্যাগ করিয়া কৃষি, শিল্পবাণিজ্য, ব্যবসা প্ৰভৃতি অবলম্বন করা অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে। অন্যান্য দেশের ন্যায় এ দেশেও সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীতে সামান্য সংখ্যক লোকেরই প্রয়োজন হয়। একটা সম্প্রদায় বা শ্রেণী কেবল উহারই উপর নির্ভর করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। তাহার উপর এ দেশে সম্প্রতি রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে হিন্দু ভদ্রলোকদের পক্ষে সরকারী চাকুরী পাওয়া খুবই কঠিন হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ভবিষ্যতে আরও হইবে। সুতরাং হিন্দু ভদ্রলোকেরা যদি সময় থাকিতে জীবনের গতি পরিবর্ত্তন না করে, তবে তাহাদের ভবিষ্যৎ নিতান্তই অন্ধকারময় হইবে সন্দেহ নাই।


কিন্তু নূতন পন্থা অবলম্বনের পথে কতকগুলি প্ৰবল বাধা আছে। প্রথমত শিক্ষাপ্রণালীর আমূল পরিবর্ত্তন করিতে হইলে,-ব্যবহারিক বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, কৰ্ম্মশালা প্ৰভৃতি স্থাপন করিতে প্রচুর অর্থ ও উদ্যোগ আয়োজনের প্রয়োজন। কেবলমাত্র দেশের গবর্ণমেণ্টই এই কাৰ্য্য করিতে সক্ষম, যদিও দেশবাসীর সহানুভূতি ও সহযোগিতা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বৰ্ত্তমানে গবৰ্ণমেণ্টের দ্বারা এই কাৰ্য্য হওয়ার সম্ভাবনা অতি কম। দ্বিতীয়ত, কতকগুলি যুবককে কেবলমাত্র ব্যবহারিক বিজ্ঞান, কৃষি-শিল্প ইত্যাদি শিক্ষা দিলেই সমস্যার সমাধান হইবে না। ঐ শ্রেণীর শিক্ষিত যুবকেরা উপযুক্ত কৰ্ম্ম সংগ্ৰহ করিতে পারিবে কিনা, তাহাও চিন্তা করিতে হইবে। দেশের বর্তমান অবস্থায় এই শ্রেণীর শিক্ষিত যুবকদের কৰ্ম্মক্ষেত্ৰ বড় বেশী নাই। সেজন্য দেশে নূতন নূতন শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়িতে হইবে, বৈজ্ঞানিক কৃষি প্ৰভৃতির প্ৰবৰ্ত্তন করিতে হইবে। গ্রামে গ্রামে কুটীর শিল্প যতদূর সম্ভব পুনরুজ্জীবিত করিয়া তোলাও একটা উপায়। কিন্তু এই সমস্ত উপায়ও বহুল পরিমাণে গবৰ্ণমেণ্টের সাহায্য ও সহযোগিতার উপর নির্ভর করে। দেশে যে সব হিন্দু ধনী ও ব্যবসায়ী ব্যক্তি আছেন, তাহারা যদি নূতন নূতন শিল্প-বাণিজ্য গঠনে অধিকতর অর্থ নিয়োগ করেন, তাহা হইলে অবস্থার অনেক পরিবর্ত্তন হইতে পারে বটে।



বলা বাহুল্য, এ সমস্ত ২|৪ দিন বা ২|৪ মাসের কাজ নয়, কতকগুলি লোক খেয়ালমাফিক একটা কিছু করিলেও চলিবে না। একটা অর্থনৈতিক “পরিকল্পনা” করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ প্ৰণালীতে এই কাজ করিতে হইবে। জাতির মনে যদি শুভবুদ্ধি জাগে এবং শক্তিশালী, প্রতিভাবান, দূরদর্শী লোকেরা এইসব কাৰ্য্যের নেতৃত্ব গ্ৰহণ করেন, তবেই ইহা সম্ভবপর হইতে পারে। যতদিন তাহা না হইতেছে ততদিন হিন্দু ভদ্রসম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ আশাপ্ৰদ বলিয়া মনে করিতে পারি না। অদূরে ভবিষ্যতেই বিষম অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে তাহাদের সংগ্ৰাম করিতে হইবে। জয়পরাজয় অনিশ্চিত।
এস্থলে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, বাঙালী হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনের প্রথম হইতেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছড়াইয়া পড়িয়া সরকারী ও আধা-সরকারী চাকুরীর প্রধান অংশ দখল করিয়াছিল। কিন্তু বৰ্ত্তমানে অন্যান্য প্রদেশের লোকেও ইংরাজী শিক্ষা লাভ করিয়া বাঙালীর সঙ্গে প্ৰতিযোগিতা করিতেছে। সুতরাং বাঙালীর পক্ষে অন্যান্য প্রদেশেও কাজ পাওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়াইতেছে। অন্যান্য প্রদেশে যে “বাঙালী বিদ্বেষ” দেখিতে পাই, তাহার মূলে প্ৰধানত এই অর্থনৈতিক কারণ বিদ্যমান।


এই সঙ্গে আরও একটী চিন্তার বিষয় আছে। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে হইতেই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ জমিদার ও ভূস্বামীরূপে গ্রামে বাস করিতেন। ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সেই পুরাতন জমিদারদের মধ্যে অনেককে স্থায়িত্বদান করে এবং নূতন নূতন জমিদার জোতদার, পত্তনীদার, তালুকদার প্রভৃতি নানা মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি করে। গত দুই শত বৎসর ধরিয়া এই সব হিন্দু জমিদার, তালুকদার ও জোতদার প্রভৃতি বাঙ্গলার হিন্দুসমাজের উপর নানাদিক দিয়া প্রভাব বিস্তার করিয়াছে।1



সেকালে বাঙলার গ্রামে হিন্দু জমিদারেরাই ছিলেন অনেক স্থলে সমাজের শীর্ষস্থানীয়। জমিদারদের দোষ ক্ৰটী অনেক ছিল বটে, প্রজাদের উপর তাঁহারা অনেক সময় উৎপীড়ন করিতেন, একথাও সত্য। কিন্তু জমিদারদের গুণও যে কিছু ছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না। লোকের উপকারের জন্য তাঁহারা বহু সৎকাৰ্য্য করিতেন, আপদে বিপদে প্রজাদের সাহায্য করিতেন, প্ৰজারাও তাঁহাদিগকে “মা বাপ” বলিয়াই জানিত। জমিদারদের বাড়ীতে দোল দুর্গোৎসব পূজা অনুষ্ঠানে, বিবাহ শ্রাদ্ধ ইত্যাদিতে গ্রামের দরিদ্র প্রজারা নিঃসঙ্কোচে যোগ দিত। উহার ফলে তাহারা আর্থিক দিক দিয়াও উপকৃত হইত। শিক্ষাবিস্তারেও জমিদারের কম সাহায্য করিতেন না। সেকালের পাঠশালা, টোল প্ৰভৃতি তাঁহাদের সাহায্যেই চলিত। একালেও বহু ইংরাজী, বিদ্যালয় তাঁহাদের অর্থসাহায্যেই প্ৰতিষ্ঠিত হইয়াছে। এক কথায় জমিদারেরা ছিলেন প্রাচীন হিন্দু সমাজের ধুরন্ধর ।2 কিন্তু ব্রিটিশ আমলে কলিকাতা প্রভৃতি বড় বড় শহর যখন গড়িয়া উঠিল, তখন জমিদারেরা গ্রাম ত্যাগ করিয়া শহরে বাস করিতে আরম্ভ করিলেন।


 গ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবও জমিদারদের গ্ৰামত্যাগের অন্যতম প্ৰধান কারণ। শহরে আসিয়া পাশ্চাত্য সভ্যতা ও বিলাসের মোহে তাহারা অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন এবং বিলাসময় ব্যয়বহুল জীবন যাপন করিতে লাগিলেন। ইহার ফলে অনেকেই ঋণগ্ৰস্ত হইয়া পড়িলেন। বহু জমিদারের সম্পত্তি ঋণের দায়ে বিকাইয়া গেল, অনেকের সম্পত্তি ২|৪ বিঘা লাখেরাজ জমিতে মাত্ৰ পর্য্যবসিত হইল। তাঁহাদের প্রাচীন গ্ৰাম্যজীবনের ধারা লুপ্ত হইয়া গেল, গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁহাদের সম্পর্কও ক্রমে ক্রমে ছিন্ন হইল। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাঙলার হিন্দু জমিদারদের এই “সহরাভিযান” আরম্ভ হইয়াছে এবং এখনও উহার জের পুরাদমে চলিতেছে। ইহার ফলে একদিকে জমিদারেরা লোপ পাইতে বসিয়াছে, অন্যদিকে গ্ৰাম্য হিন্দুসমাজও সাধারণভাবে যে ক্ষতিগ্ৰস্ত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই ।3 জমিদারদের যেটুকু প্রভাবপ্রতিপত্তি ছিল, বাঙ্গলার বর্ত্তমান শাসকগণের নূতন নীতির ফলে তাহাও নিঃশেষ হইবে, আশঙ্কা হয়। ইহার উপর যদি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উঠিয়া যায়, তবে হিন্দু জমিদারসম্প্রদায় একেবারে উৎখাত হইয়া যাইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য লোক কৰ্ম্মহীন হইয়া পড়িবে। ইহার ফলে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের যে গুরুতর ক্ষতি হইবে, তাহা বলা বাহুল্য মাত্ৰ।
পক্ষান্তরে জমিদারী প্রথার যে অনেক দোষ আছে, বৰ্ত্তমান যুগে উহা নানা কারণে টিকিতে পারেনা, ইহা আমরা জানি। এই জমিদারী প্রথার জন্য বাঙলার বহু লক্ষ টাকার মূলধন নিষ্ফলভাবে জমিতে আটক হইয়া আছে, ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত হইয়া জাতির সম্পদ বৃদ্ধি করিতে পারিতেছে না। তার পর এই প্রথার ফলে কতকগুলি অলস, বিলাসী, চরিত্রহীন, অকৰ্ম্মণ্য লোকের সৃষ্টি হইয়াছে এবং বর্ত্তমানে অধিকাংশ প্রাচীন বনিয়াদী হিন্দু জমিদার বংশের নৈতিক অধঃপতন ঘটিয়াছে। কিন্তু এই প্রথা উঠিয়া গেলে বাঙ্গলার মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবনে যে একটা ওলটপালট হইবে, তাহাতেও সন্দেহ নাই, কেননা ইহার উপর ভিত্তি করিয়াই গত কয়েক শতাব্দীতে বাঙ্গলার গ্ৰাম্যজীবন গড়িয়া উঠিয়াছে। সুতরাং কি উপায়ে সেই প্ৰতিক্রিয়া রোধ করা যাইতে পারে, অন্য কোন নূতন ভিত্তির উপর সমাজজীবনকে গড়া যাইতে পারে কিনা, এখন হইতেই তাহা চিন্তা করিতে হইবে।4 আমাদের মনে হয়, দেশে নূতন নূতন শিল্পবাণিজ্য প্ৰবৰ্ত্তন ও গঠনের দিকে হিন্দু ভদ্রলোক ও জমিদারদের এখন হইতেই আত্মনিয়োগ করিতে হইবে, জমিদারী ও মধ্যস্বত্ব ভোগের মোহ তাহাদিগকে ত্যাগ করিতে হইবে। সময় থাকিতে প্ৰস্তুত না হইলে তাহাদের পক্ষে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। আরও আশঙ্কার কথা, বর্ত্তমান শাসকগণ যে সাম্প্রদায়িক নীতি অবলম্বন করিয়াছেন এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গী হইতে যেসব আইন কানুন প্রণয়ন করিতেছেন,5 তাহাও হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের বিলোপে সহায়তা করিবে। বর্তমান মন্ত্রীমণ্ডলের কর্ণধারদের এইরূপ কোন গূঢ় অভিপ্ৰায় আছে কিনা জানিনা, কিন্তু যেভাবে তাঁহারা অগ্রসর হইতেছেন, তাহাতে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ আশঙ্কাপূৰ্ণ বলিয়াই মনে হইতেছে।

• Report of the Land Revenue Commission of Bengal 1940.↩

• মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর দানের পরিমাণ ৩ কোটি টাকা । কেবলমাত্র শিক্ষা বিস্তারে বর্ধমানরাজের দান ২৫ লক্ষ, মৈমনসিংহ গৌরীপুরের জমিদারের দান ১২ লক্ষ, দিঘাপাতিয়ারাজের ৫ লক্ষ, চকদিঘী ৫ লক্ষ, লালগোলা ৪ লক্ষ, পুঁটিয়া ২ লক্ষ, উত্তরপাড়া ৬ লক্ষ ৫০ হাজার, মহারাজা মৈমনসিংহ ৯ লক্ষ, সন্তোষ ২ লক্ষ ইত্যাদি (Land Revenue Commission, vol.III দ্রষ্টব্য) ।ーলেখক↩

• আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ’আত্মজীবনী’তে জমিদারের এই শহরাভিযান সম্বন্ধে বহু জ্ঞাতব্য তথ্য ও সুচিন্তিত মন্তব্য আছে ।ーলেখক↩

• Land Revenue Commision তাঁহাদের রিপোর্টে পরামর্শ দিতেছেনー১) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা উঠাইয়া দিতে হইবে । ২)গবর্নমেন্টের পক্ষ হইতে ক্ষতিপূরণ দিয়া জমিদারীগুলি ক্রয় করিয়া প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি বন্দোবস্ত করিতা হইবে । এই Report পরীক্ষা করিয়া বাংলা গবর্নমেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত গার্নার সাহব তাহাদের নিকট যে প্রস্তাব দাখিল করিয়াছেন, তাহাতে জমিদারী প্রথা উঠাইয়া দিবার পক্ষে যে সব প্রবল বাধা আছে, তাহা প্রদর্শন করা হইয়াছে । গবর্নমন্টের পক্ষ হইতে দশ গুণ কি ১৫ গুণ মূল্য ক্ষতিপূরণ দিয়া যধি সমস্ত জমিদারী ক্রয় করিতে হয়, তবে সে অর্থ কোথা হইতে আসিবে, তাহাও গার্নার সাহেবের মতে বিবেচ্য ।ーলেখক↩

• যেমন কাপড় রেশনিংয়ের সময় হিন্দু ও মুসলমানদের সমান সমান দোকান হইতেছে, যদিও দোকানীদের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের অনুপাত ১২ : ১ । ফলে হিন্দু দোকান উঠিয়া যাইতেছে, মুসলমানদের দোকান হইতেছে ।ーলেখক↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

নিম্নজাতির ক্ষয়

বাঙলার হিন্দুসমাজের ক্ষয়ের একটা প্ৰধান কারণ যে, নিম্নজাতিদের সংখ্যা হ্রাস এবং বংশলোপ—তাহা চক্ষুষ্মান্ ব্যক্তিমাত্রেই বুঝিতে পারেন, অন্ততপক্ষে পারা উচিত। বাঙলার হিন্দুসমাজে তথাকথিত উচ্চজাতিরা, অর্থাৎ—ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্ৰভৃতি কয়েকটি জাতি মোট শতকরা কুড়ি ভাগ হইতে পঁচিশ ভাগের বেশী নহে। অবশিষ্ট শতকরা ৭৫ হইতে ৮০ ভাগই তথাকথিত নিম্নজাতীয় হিন্দু। সুতরাং এই নিম্নজাতীয় হিন্দুদের আর্থিক অবস্থা ও জনবলের উপরেই যে হিন্দুসমাজের উন্নতি-অবনতি, শক্তিসমৃদ্ধি প্ৰধানত নির্ভর করে, একথা বলা বাহুল্য মাত্ৰ ।


বাঙলার হিন্দুসমাজের নিম্ন জাতীয় হিন্দুদের বংশলোপ হইতেছে, প্ৰধানত তিনটি কারণে :—বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং বিধবাবিবাহের অপ্রচলন । উচ্চজাতীয় হিন্দুদের অর্থাৎ যাহাদের আমরা সাধারণত “ভদ্রলোক সম্প্রদায়” বলি—তাহদের সঙ্গে এ বিষয়ে নিম্নজাতীয়দের সমস্যার কিছু প্ৰভেদ আছে। এই ভদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বরপণ’ প্ৰচলিত ( বংশজ ব্ৰাহ্মণ প্ৰভৃতি কয়েকটি বিশেষ শ্রেণী ছাড়া ) এবং বাল্যবিবাহ প্ৰথা গত ৩০|৪০ বৎসরের মধ্যে একরূপ উঠিয়া গিয়াছে বলিলেই হয়। তাহাদের মধ্যে যথাসময়ে মেয়ের বিবাহ দেওয়াই একটা কঠিন সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ২০|২৫ বৎসর বয়সের মেয়েদেরও বয়স গোপন করিয়া বিবাহ দিতে হয়, ইহা আমরা সকলেই জানি ।

“বরপণ” প্ৰথা এই সমস্যাকে আরও কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। গত ৩০|৪০ বৎসর ধরিয়া ভদ্রলোক হিন্দুরা ‘বরপণের’ বিরুদ্ধে বহু বক্তৃতা করিয়াছেন, প্ৰবন্ধ লিখিয়াছেন, পণপ্ৰথা নিবারণী সমিতি করিয়া বহু ভাবী বরের এবং তাহাদের পিতাদের “প্ৰতিজ্ঞাপত্রে” স্বাক্ষর লইয়াছেন, নামজাদা নাট্যকারেরা নাটক লিখিয়া রঙ্গমঞ্চ হইতে এই ‘কু-প্রথার’ বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়াছেন ; প্ৰসিদ্ধ ঔপন্যাসিকেরা এই বরপণ সমস্যাকে কেন্দ্ৰ করিয়া হৃদয়বিদারক উপন্যাস লিখিয়াছেন, এমন কি, স্নেহলতা হইতে আরম্ভ করিয়া আরও কয়েকজন হতভাগিনী কুমারী পিতামাতাকে বরপণের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য আত্মহত্যা পৰ্য্যন্ত করিয়াছেন ; কিন্তু তথাপি এই জঘন্য প্রথা দূর হয় নাই, বরং উহা উত্তরোত্তর যেন বাড়িয়াই চলিয়াছে। ইহার কারণ কি ? আমাদের মনে হয়, অর্থনীতিশাস্ত্রে যে Law of Demand and Supply, অৰ্থাৎ ‘চাহিদা ও যোগানের’ নিয়ম আছে, এখানেও সেই নিয়মই কাৰ্য্য করিতেছে।


 মধ্যবিত্ত ভদ্র সম্প্রদায়ের প্রায় সকল পিতামাতাই চাহেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত বি-এ, এম-এ, পাশ করা সরকারী চাকুরিয়া অথবা হবু-চাকুরিয়া জামাই। অন্ততপক্ষে উকীল, ডাক্তার, অধ্যাপক অথবা হবু-উকীল প্রভৃতি হইলেও চলে। কিন্তু এই শ্রেণীর ছেলের সংখ্যা খুব বেশী নহে, তার উপর জাতিভেদ এবং অসবৰ্ণ বিবাহের অপ্রচলন সেই সংখ্যা সমস্যাকে আরও কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। ফলে বিবাহের বাজারে এই শ্রেণীর “শিক্ষিত” বরের দাম ক্ৰমাগত বাড়িয়াই চলিয়াছে। বৰ্তমানে বিয়ের বাজারে “আই-সি-এস” বরের মূল্য তিরিশ হাজার হইতে পঞ্চাশ হাজার টাকা,—ডেপুটী, মুন্সেফ প্রভৃতির দর দশ হাজার হইতে পনের হাজার টাকা পৰ্য্যন্ত উঠিয়াছে। এটর্ণী, উকীল, ডাক্তার, ব্যারিস্টার এবং বিলাতফেরত অন্যান্য শ্রেণীর বরের মূল্যও আট দশ হাজার টাকার কম নহে। সুতরাং মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে মেয়ের বিবাহ দেওয়া যে দুঃসাধ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা আর বিচিত্ৰ কি ! সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থেরা যতদিন ধনীদের অনুকরণে এবং তাহাদের সঙ্গেপাল্লা দিয়া এই বিশেষ শ্রেণীর “বর” খুঁজিবে, ততদিন বরপণ সমস্যার সমাধান হইবে না বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস ।


তবে ভবিষ্যতে কয়েকটি কারণে এই বরপণ সমস্যার জটিলতা হ্রাস হইতে পারে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ, এম-এ পাশ করা ছেলেদের এবং উকীল, ডাক্তার প্রভৃতির অথোপাৰ্জ্জনের অক্ষমতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহাদের দুৰ্দ্দশা চোখের উপর দেখিয়া মেয়ের বাপদের এই শ্রেণীর ছেলেদের উপর ঝোঁক কমিতে পারে । দ্বিতীয়ত, মেয়েদের বেশী বয়সে বিবাহ হইতেছে, তাহারা ছেলেদের মতই লেখাপড়াও শিখিতেছে। সুতরাং “বর মনোনয়ন” ব্যাপারে মেয়েদের মতামত অনেকক্ষেত্ৰে লইতে হইতেছে। আর অর্থ উপার্জনে অক্ষম “শিক্ষিত ছেলেদের” এই সব মেয়েরা ভবিষ্যতে পছন্দ করিবে কি না সন্দেহ। তৃতীয়ত, পূর্বোক্ত দ্বিতীয় কারণেই কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা “পরস্পরকে ভালবাসিয়া” বিবাহ করিতেছে এবং এরূপ বিবাহ প্ৰায়ই ‘অসবর্ণ’ হইতেছে। ভবিষ্যতে এরূপ বিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইবার সম্ভাবনাই দেখা যাইতেছে। বলা বাহুল্য, এ সব ক্ষেত্রে বরপণ সমস্যার প্রশ্ন উঠিবে না।


সে যাহাই হউক, বৰ্ত্তমানে এই “বরপণ সমস্যার” জন্য মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের মধ্যে অনেক বয়স পৰ্য্যন্ত মেয়েদের অনুঢ়া থাকিতে হইতেছে। ছেলেরাও এই আর্থিক সমস্যার দিনে অনেক সময় ৩৫|৪০ বৎসর বয়স পৰ্য্যন্ত অবিবাহিত থাকিতেছে । ইহার ফল মধ্যবিত্ত ভদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষে কোনদিক দিয়াই কল্যাণকর হইতেছে না। নানা কারণে বাল্যবিবাহ বাঞ্ছনীয় নহে স্বীকার করি ; কিন্তু ছেলেমেয়েরা যদি ৩০|৩৫ বৎসর বয়স পৰ্যন্ত অবিবাহিত থাকে, তবে তাহার পরিণামও ভাল হইতে পারে না। উহার ফলে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস হয়, এমন কি, বংশলোপের সম্ভাবনাও দেখা দেয়। উচ্চ জাতীয় হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসের ইহা একটি প্রধান কারণ, সন্দেহ নাই।


পূৰ্বেই বলিয়াছি, নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার। ইহাদের মধ্যে “কন্যাপণ” প্ৰথাই প্রচলিত, অর্থাৎ মূল্য দিয়া কন্যা ক্ৰয় করিয়া বিবাহ করিতে হয় । বাল্যবিবাহও ইহাদের মধ্যে সমধিক প্ৰচলিত । তিন চার বৎসরের মেয়েরও বিবাহ হয় । সারদা আইন ইহার কোন পরিবর্ত্তন ঘটাইতে পারে নাই এবং যে-আকারে ঐ আইন প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছে, তাহাতে কোনদিন নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্য হইতে যে বাল্যবিবাহ দূর হইবে, তাহারও কোন সম্ভাবনা দেখিতেছি না। এই সব নিম্নজাতিদের মধ্যে কোন এক অজ্ঞাত ”জৈবনিক” ( Biological ) কারণে কন্যার সংখ্যা সাধারণত খুব কম হওয়াতে সমস্যা আরও ঘোরালো হইয়াছে। মোটের উপর ফল দাঁড়াইতেছে এই যে, নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই অর্থের অভাবে “কন্যাপণ” দিয়া বেশী বয়স পৰ্য্যন্ত বিবাহ করিতেই পারে না । বহু বৎসর ধরিয়া সেজন্য তাহাদিগকে অর্থসঞ্চয় করিতে হয়। অবশেষে প্রৌঢ় বয়সে কিছু অর্থসঞ্চয় করিয়া তাহারা বিবাহ করে। কিন্তু কন্যার বয়স যত বেশী হয়, তত বেশী পণ দিতে হয়। সুতরাং যাহারা বেশী কিছু অর্থ সঞ্চয় করিতে পারে না, তাহাদের বাধ্য হইয়া অল্পবয়সের মেয়েকেই বিবাহ করিতে হয়। ৪৫|৫০ বৎসরের প্রৌঢ় ব্যক্তি চার-পাঁচ বৎসরের একটি মেয়েকে বিবাহ করিতেছে—এদৃশ্য গ্রাম অঞ্চলের নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। ইহার পরিণাম বড়ই শোচনীয়। সেই বালিকা পত্নী যুবতী হইবার পূর্ব্বেই হয়ত বৃদ্ধ স্বামী ভবলীলা সম্বরণ করে। রাখিয়া যায় একটি নিঃসন্তানা বলবিধবা । একদিকে বৃদ্ধের বংশলোপ হয়, অন্যদিকে অরক্ষিতা যুবতীবিধবা সমাজের পক্ষে একটা জটিল সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়। যদি বিধবা বিবাহের সুপ্রচলন থাকিত, তবে এই সমস্যার একটা সমাধান হইত। কিন্তু তাহা না থাকাতে ইহারা সমাজে দুর্নীতি ও ব্যভিচারের বিস্তারেই সহায়তা করে।



আমরা যে সব কথা বলিতেছি, তাহা অনেকের নিকট অপ্রিয় বোধ হইবে জানি। কিন্তু যতই অপ্রিয় হৌক, হিন্দুসমাজের কল্যাণের জন্য ইহা প্ৰকাশ্যভাবে স্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। হিন্দুসমাজের নিম্নজাতিরা যে ক্রমে লুপ্ত হইয়া যাইতেছে, তাহার জন্য বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং পুরুষদের বিবাহের অক্ষমতাই প্ৰধানত দায়ী। আমাদের জীবনের মধ্যেই পল্লী অঞ্চলে চোখের উপরে বহু জাতিকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হইতে দেখিয়াছি। বহু গ্রামে ধোপা, ভূইমালী, বেহারা, ধীবর, নাপিত, কুমার, তেলী, সূত্রধর, পাটনী প্রভৃতি জাতির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। যে সব গ্রামে এই সব জাতীয় লোক এখনও আছে—সেখানেও তাহদের বংশে বালকবালিকার সংখ্যা কম । বয়স্ক লোকদের সংখ্যাই বেণী । অর্থাৎ ৪০|৪৫ বৎসর পরে উহাদের সংখ্যা আরও কমিয়া যাইবে এবং শেষ পৰ্য্যন্ত বংশে বাতি দিতে হয়ত কেহই থাকিবে না ।
ডা. রাধাকমল মুখোপাধ্যায় তাহার “বাঙ্গলা ও বাঙ্গালী” গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, হিন্দুসমাজে নিম্নজাতিদের সংখ্যা বাড়িতেছে, আর উচ্চজাতিদের সংখ্যা হ্রাস হইতেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি মাহিষ্য, রাজবংশী ও নমঃশূদ্ৰদের সংখ্যাবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করিয়াছেন। ডা. মুখোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত আমরা গ্ৰহণ করিতে পারিলাম না । মাহিষ্য, রাজবংশী ও নমঃশূদ্র এই তিনটী জাতির সংখ্যা কিছু বাড়িতেছে বটে, বোধ হয় এখনও ইহাদের হাতে কৃষিকাৰ্য্য আছে বলিয়া ; কিন্তু এই তিনটি জাতি ছাড়া হিন্দু সমাজের অন্য সমস্ত নিম্নজাতির সংখ্যা কমিতেছে। এমন কি কোন কোন নিম্নজাতির অস্তিত্ব লুপ্ত হইবার উপক্রম হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বেহারা, ধোপা, নাপিত, কুমার, মালী, ঝল্লমল্ল, ক্ষত্ৰিয়, কোচ, তিয়ার, হদি, হাজ্‌ব, লুপ্ত মাহিষ্য ( পাটনী), হাড়ি, ডোম, ভুঁইমালী, মুচি, রহিদাস ( চৰ্ম্মকার), জালিয়া, কাওরা, লোহার প্রভৃতি জাতিগুলির জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে হ্রাস হইতেছে। ১৯২১ সাল ও ১৯৩১ সালে এই দুইটি আদমসুমারীর লোকসংখ্যার তুলনা করিলে দেখা যাইবে, ইহাদের বংশ লোপ আসন্ন ।



উচ্চজাতীয় ভদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের সমস্যার কথাই চিন্তা করেন। তাঁহাদের যত কিছু সংস্কারবুদ্ধি সবই নিজেদের কেন্দ্ৰ করিয়া । তাহাই অবশ্য স্বাভাবিক ; কিন্তু ইহাও ঠিক যে, এই সব নিম্নজাতীয়দের সমস্যা লইয়া যদি “শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা” চিন্তা না করেন এবং প্ৰতিকারের উপায় নিৰ্দেশ করিতে না পারেন, তবে সমগ্রভাবে হিন্দুসমাজের ক্ষয় নিবারণ করা যাইবে না ।


আমি বাঙলা দেশের যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর ও পাবনা জেলার কতকগুলি গ্রামের কথা জানি। সেখানে অ-বাঙালী হিন্দু বেহারা, ধোবা, নাপিত প্রভৃতি আসিয়া বাঙালী হিন্দুর স্থান পূরণ করিতেছে। কিছুদিন পূর্ব্বে ময়মনসিংহ জেলা হিন্দু সম্মেলনে সভাপতি এবং পাবনা জেলা হিন্দু সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি দেখাইয়াছেন যে, ঐ দুই জেলার গ্রামসমূহে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ক্রমশ লুপ্ত হইতেছে। বাঙলার মফঃস্বলের অনেক খেয়াঘাট হিন্দুস্থানীরা দখল করিয়া ফেলিয়াছে। সেজন্য কেবল ব্যবসাদার হিন্দুস্থানীদের দোষ দিয়া লাভ নাই। বাঙালী পাটনী যদি না পাওয়া যায়, তবে ভিন্ন প্ৰদেশাগত লোকেরাই সেই কাজের ভার গ্রহণ করিবে। বাঙলার উচ্চ জাতীয় ভদ্রসম্প্রদায়ের সঙ্গে যদি নিম্নজাতীয় হিন্দুদের যোগসূত্ৰ থাকিত, তবে তাহারা নিশ্চয়ই হিন্দুসমাজের নিম্নস্তরের অস্তিত্ব লোপের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিত। কিন্তু বৰ্তমানে তাহার কোন লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি না ।

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

ধৰ্ম্মান্তর গ্ৰহণ

বাঙলাদেশে হিন্দুর তুলনায় মুসলমানের সংখ্যাবৃদ্ধির আর একটি প্রধান কারণ, বহু হিন্দুর মুসলমানধৰ্ম্ম গ্ৰহণ। পাঠান যুগ হইতেই এই ব্যাপার চলিয়া আসিতেছে এবং এখনও চলিতেছে। প্ৰধানত দুইটি কারণে হিন্দুর এই ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণ সম্ভবপর হইয়াছে। প্রথমত হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথা, তাহার অনুদারতা ও সঙ্কীর্ণতা। পূৰ্ব্বে কয়েকটি প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। বহু বৌদ্ধ এবং প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধও যে হিন্দুসমাজের অত্যাচারে মুসলমানধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছে, ইহাও আমরা বলিয়াছি। দ্বিতীয়ত, মুসলমান ধৰ্ম্ম প্রচারকদের প্রচারকাৰ্য্য। প্ৰধানত নিম্নজাতীয় হিন্দুরাই এই প্রচারকার্য্যের ফলে মুসলমান হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে। রিজলী সাহেব ১৯০১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে বলিয়াছেন, পূর্ববঙ্গের ১ কোটি ৫০ লক্ষ মুসলমান হিন্দু সমাজের পোদ ও নমঃশূদ্র হইতে হইয়াছে। রিজলী সাহেবের এই মন্তব্যে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। যাহাদিগকে আমরা “অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়” করিয়া রাখিয়াছি, তাহারা যে প্ৰথম সুযোগেই মুসলমান ধৰ্ম্মের সাম্যবাদের আশ্রয় গ্ৰহণ করিবে, ইহা খুবই স্বাভাবিক। এই সম্পর্কে শ্ৰীযুত যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত কৃত ‘বিক্রমপুরের ইতিহাসে’ (২য় সংস্করণ) কতকগুলি মূল্যবান তথ্য প্রদত্ত হইয়াছে।


একদিকে উপনিবেশ স্থাপন, অন্যদিকে ধৰ্ম্মপরায়ণ মুসলমান সাধুগণের উদার মত ও ধৰ্ম্মপ্রচারও মুসলমানাধিক্যের অন্যতম কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। শ্ৰীহট্টের মহাপুরুষ শাহ জালাল ৩৬০ জন আউলিয়া লইয়া আঁসিয়া শ্ৰীহট্টের নানাস্থানে ধৰ্ম্মপ্রচার করিতে আরম্ভ করেন । কেবল শ্ৰীহট্ট জেলার মধ্যেই যে ইঁহাদের প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল, তাহা নহে, সমগ্র পূর্ববঙ্গে ক্রমশ ইঁহাদের দ্বারা ইসলাম ধৰ্ম্ম প্রচারিত হইয়াছিল। বৰ্ত্তমান সময়ে পূর্ববঙ্গে যে সমস্ত সম্রাস্ত মুসলমান পরিবার আছেন, তন্মধ্যে এই আউলিয়াগণের বংশীয়দের কোন না কোনভাবে সম্পর্ক নাই, এমন অতি অল্পই দেখা যায়। বিজয়ী মুসলমানদের ধৰ্ম্মে তখন বহু লোক দীক্ষিত হইতে লাগিল। হিন্দু জাতি অতিশয় ধৰ্ম্মপরায়ণ হইলেও, তৎকালে অর্থাৎ সেই রাষ্ট্র বিপ্লবের যুগে, ধৰ্ম্মবন্ধন যে শিথিল হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কারণ নাই।…..এই অবস্থায় সমাজের মধ্যে যাহাদের অবস্থা হীন ছিল, তাহারাই দলে দলে নবধৰ্ম্মে দীক্ষিত হইয়া বাদশাহী জাতির মধ্যে পরিগণিত হইতে লাগিল।……শ্রীহট্টের শাহ জালালের ন্যায় বিক্রমপুরের বায়া আদম বা বাবা আদম প্রভৃতি মহাপুরুষগণের প্রভাবে সহজেই পূর্ববঙ্গে ইসলাম ধৰ্ম্ম বিস্তৃতিলাভ করে। নিম্নবর্ণের লোকেরা ইসলাম ধৰ্ম্মে নানাপ্রকার সাম্যভাব দেখিয়াও এই ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছিল।”


শ্ৰীযুত সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ কৃত “যশোহর ও খুলনার ইতিহাসে”ও লিখিত হইয়াছে যে, পাঠান আমলে বহু পীর, আউলিয়া প্ৰভৃতি গিয়া যশোহর ও খুলনার নানাস্থানে “আস্তানা” করেন। হঁহাদের দ্বারা যে মুসলমান ধৰ্ম্মপ্রচারে খুবই সহায়তা হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। যশোহর জেলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্যের ইহা অন্যতম কারণ। বাঙ্গলার অন্যান্য অঞ্চলেও সে সময়ে বহু পীর ও আউলিয়াদের আস্তান হইয়াছিল এবং তাহারা ইসলাম ধৰ্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন। হিন্দুরা স্বভাবতই ধৰ্ম্মপ্ৰাণ জাতি। সেই কারণে যাহারা পীর ও আউলিয়াদের নিকট ইসলাম ধৰ্ম্মে দীক্ষা লইত না, তাহারাও ঐ সব মুসলমান সাধুদিগকে শ্রদ্ধা করিত। মুসলমান সাধু ও পীরদের এইরূপে বহু হিন্দু শিষ্যও জুটিয়া যাইত। ঐরূপ দৃষ্টান্ত এ যুগেও বিরল নহে। ধৰ্ম্মবিষয়ে হিন্দুদের এই অত্যধিক উদারতা, আদর্শের দিক দিয়া যতই উচ্চ হোক, কাৰ্য্যক্ষেত্রে হিন্দুদের বহু ক্ষতি করিয়াছে, কিঞ্চিৎ অনুদার শুনাইলেও একথা আমাদিগকে বলিতে হইতেছে। বৰ্ত্তমানকালে সঙ্ঘবদ্ধভাবে মুসলমান ধৰ্ম্ম প্রচারের ব্যবস্থা হইয়াছে এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম প্ৰভৃতি এজন্য বহু অর্থব্যয় করিয়া থাকেন। এই সজঘবদ্ধ প্রচারকার্য্যের ফলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এখনও বহু হিন্দু মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতেছে। বাঙলার গ্রামেও ঐ ব্যাপার চলিতেছে।


উত্তরবঙ্গে ইসলাম ধৰ্ম্মপ্রচারের পশ্চাতে বহু সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ নিহিত আছে। “রংপুরে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য সম্বন্ধে বুকানন সাহেব ( ১৮০৭ ) লিখিয়াছেন যে, এখানকার মুসলমানেরা আরব, আফগান বা মুসলমান আগন্তুকদের বংশধর নহে, অধিকাংশই স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীদের বংশধর, রাজা ও ভূস্বামীদের গোঁড়ামি ও অত্যাচারের ফলে ধৰ্ম্ম পরিবর্ত্তন করিয়াছে। রাজা রামমোহনের সময়েও এই ধৰ্ম্মপরিবর্ত্তন প্রবলভাবে চলিয়াছিল। রংপুর অপেক্ষা বগুড়া জেলায় আফগান জায়গীরদারদের ধৰ্ম্মপ্রচার অধিকতর ফলপ্ৰদ হইয়াছিল । ত্ৰয়োদশ শতকে অনেক আফগান করতোয়ার পশ্চিম তীরে দিনাজপুর হইতে ঘোড়াঘাট এমন কি নাটোরের নিকট পৰ্য্যন্ত নিষ্কর জমি লাভ করিয়াছিল। তাহদের কৰ্ত্তব্য ছিল করতোয়ার পূর্বপারের কুচজাতির অভিযান ও আক্রমণ হইতে শান্তিস্থাপন এবং দেশরক্ষা করা । একদিকে যেমন তাহারা প্ৰজাদিগকে জোর করিয়া ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে বাধ্য করিতে লাগিল, অপরদিকে তাহারা পূর্ব অঞ্চলে সৈন্য অভিযান করিয়া আদিম জাতিদের সম্মুখে একহস্তে তরবার অন্য হস্তে কোরান লইয়া উপস্থিত হইল। এইরূপ ব্যাপার প্রায় দুইশত বৎসর চলিতে থাকে। তুঘ্রিল খাঁর আক্রমণ ( ১২৫৭ ) ও হুসেন সাহের কামতাপুর ধ্বংসবিধান (১৪৯০) ইহার সাক্ষ্য দেয়। অপরদিকে কুচবিহারের রাজা বিষ্ণু সিংহ ( ১৬শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ) যখন হিন্দুধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়া “রাজবংশী” নাম গ্ৰহণ করিলেন, তখন ঐ অঞ্চলের অনেক উচ্চশ্রেণীই তঁহার অনুকরণে হিন্দু হইল । অবশিষ্ট কুচ, মোচ, বোন্দো, ধীমলি প্ৰভৃতি নিম্নজাতির লোকেরা হিন্দুসমাজের বাহিরে উপেক্ষিত ও অবজ্ঞাত থাকিয়া গেল। তখন তাহাদের ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।……বগুড়া যে বাংলার সব জেলা অপেক্ষা মুসলমানবহুল, তাহার প্রধান কারণ বাংলার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইতিহাসের এক করুণ বিস্মৃত অধ্যায়ে নিহিত রহিয়াছে।1


চট্টগ্রাম অঞ্চলে সহস্ৰ সহস্ৰ হিন্দু প্ৰাচীনকাল হইতে সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকের কাজ করিয়া জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করিত। কিন্তু মধ্যযুগে হিন্দুশাস্ত্ৰে সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ হওয়াতে উহারা দলে দলে মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেই জন্যই মুসলমানের সংখ্যা বেশী এবং জাহাজের লস্কর, সারেং প্রভৃতির কাজ যাহারা করে, তাহারা সকলেই মুসলমান। মালাবারেও ঠিক এইরূপ ব্যাপার ঘটে। [^10]


মুসলমান ধৰ্ম্মের ন্যায় খ্রীস্টান ধৰ্ম্মও হিন্দুদের মধ্যে প্রচারকাৰ্য্য চালাইয়াছে, এখনও চালাইতেছে। খ্রীস্টান মিশনারীরা দক্ষিণ ভারতেই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক খ্রীস্টান করিতে সমর্থ হইয়াছেন বটে, কিন্তু বাঙলাদেশেও তাহারা নানাভাবে প্রচারকাৰ্য্য চালাইয়া কতকটা সফলতা লাভ করিয়াছেন। প্রথমত, বিবিধ শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠান স্থাপন করিয়া তাঁহারা খ্রীস্টানধৰ্ম্মের মূলতত্ত্ব ও আদর্শ প্রচারের চেষ্টা করিয়াছেন। এই উপায়ে পূর্ব্বে তাঁহারা বহু হিন্দু যুবককে খ্রীস্টান করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। দ্বিতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরে গ্রাম অঞ্চলে নানা সেবা প্ৰতিষ্ঠান স্থাপন করিয়াও খ্রীস্টানধৰ্ম্ম প্রচারের কার্য মিশনারীরা চালাইয়া থাকেন। যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় খ্রীস্টান মিশনারীদের এইরূপ প্রচারমুখী সেবা প্রতিষ্ঠান আছে। খ্রীস্টান মিশনগুলির অর্থবল ও জনবল উভয়ই প্রচুর পরিমাণে আছে।
একদিকে খ্রীস্টান ধৰ্ম্ম ও অন্যদিকে মুসলমান ধৰ্ম্ম,—এই দুই প্রচারশীল ধৰ্ম্মের সম্মুখীন হইয়া হিন্দুসমাজকে যে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইয়াছে, তাহাতে সন্দেত নাই। পক্ষান্তরে হিন্দুধৰ্ম্ম মোটেই প্রচারশীল ধৰ্ম্ম নহে। অন্য ধৰ্ম্মাবলম্বীকে দীক্ষা দিয়া সে হিন্দু করিয়া লইতে সন্মত নহে। সে কেবল লোককে সামান্য ভুলত্রুটির জন্য বহিস্কৃত করিয়া দিতেই জানে, বাহির হইতে কাহাকেও গ্রহণ করিতে জানে না ।


ইহার ফলে হিন্দুসমাজ আজ কবির ভাষায় সত্যই “অচলায়তন” হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মহাপ্ৰভু শ্ৰীগৌরাঙ্গের প্রচারিত বৈষ্ণব ধৰ্ম্মই প্ৰথমে অ-হিন্দুদিগকেও দীক্ষা দিয়া হিন্দুসমাজে গ্রহণ করিতে আরম্ভ করে। বহু পাহাড়িয়া জাতি৷ এই সময়ে হিন্দুধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছিল। মণিপুরী পৰ্যন্ত এই ধৰ্ম্মের প্রচার হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্ত্তীকালে ব্ৰাহ্মণ গোস্বামীরা আসিয়া এই উদারতার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। নতুবা এতদিনে বাঙলার প্রান্তভাগের বহু পাহাড়িয়া ও অহিন্দু জাতি হিন্দু হইয়া যাইত। বৰ্ত্তমান যুগে আৰ্য্যসমাজীরা2 শুদ্ধি আন্দোলন3 প্ৰবৰ্ত্তন করিয়া ‘অচলায়তন’ হিন্দুধৰ্ম্ম ও সমাজের সম্মুখে একটা নূতন সিংহদ্বার খুলিয়া দিয়াছেন। যদি হিন্দুসমাজ এই শুদ্ধি আন্দোলনকে মনে প্ৰাণে গ্ৰহণ করিতে পারে, তবে উহার দ্বারা হিন্দুসমাজের বহু সমস্যার সমাধান হইবে।কিন্তু এদিকেও সেই সনাতনী জাতিভেদের মনোবৃত্তি প্ৰবল বাধা হইয়া আছে। অ-হিন্দুরা যদি হিন্দু ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করে, তবে হিন্দুসমাজে তাহদের স্থান কোথায় হইবে ? কোন্ জাতির অন্তর্ভুক্ত তাহারা হইবে ? তাহদের জন্য কি নূতন নূতন জাতির সৃষ্টি হইবে ? আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, হিন্দু সমাজের সনাতনী অনুদারতার ফলে অ-হিন্দুরা বৈষ্ণবধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়া সমাজে সম্মানের আসন পায় নাই, বরং তাহদের জন্য একটা পৃথক “জাতবৈষ্ণবের” সৃষ্টি হইয়াছিল। শুদ্ধি আন্দোলনের ফলে যাহারা হিন্দু হইতেছে, তাঙ্গাদের দশাও ঐরূপ হইতেছে, একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই ।


এ স্থলে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আৰ্য্যসমাজের শুদ্ধি আন্দোলনের বহুপূর্ব্বে বাঙলা দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতের মনে এই শুদ্ধিসমস্যার কথা উদিত হইয়াছিল। ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণের ফলে হিন্দুর সংখ্যা যে হ্রাস হইতেছে এবং ভবিষ্যতে আরও হ্রাস হওয়ার আশঙ্কা আছে, ইহা তাহারা উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং সেই বিপত্তি নিবারণের জন্য শুদ্ধির ব্যবস্থা দিয়াছিলেন। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে বাঙ্গলার এক শত জন বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত কলিকাতার “পতিতোদ্ধার সভার অনুমত্যনুসারে” “পতিতোদ্ধার বিষয়ক ভূমিকা ও ব্যবস্থা পত্রিকা” প্রচার করেন। উহাতে সুস্পষ্টরূপে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, শুদ্ধিব্যবস্থা শাস্ত্রসম্মত এবং যাহারা হিন্দুধৰ্ম্ম ত্যাগ করিয়া ধৰ্ম্মান্তর গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহারা পুনরায় হিন্দু হইতে ইচ্ছা করিলে, তাহাদিগকে শুদ্ধির দ্বারা গ্ৰহণ করা যাইতে পারে। উক্ত পুস্তিকার শেষে ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা আবেগপূর্ণ ভাষায় হিন্দুসমাজের নিকট নিবেদন করিয়াছিলেন,—“সুবিজ্ঞবর মহাশয়েরা উদিত বিষয় অতি মনোযোগপূর্বক বিশেষ বিবেচনা করিয়া, বৰ্ত্তমান সময়কে শেষ সাবকাশ জানিয়া, হিন্দুজাতির চিহ্ন থাকিতে এমত বিহিত উপায় ত্বরায় করিতে আদেশ হয়, যদ্বারা পৃথিবী এককালে হিন্দুশূন্যভূতা ও বেদবিহিত সনাতনধৰ্ম্ম নিতান্ত লোপ না হয় ; অর্থাৎ ভ্রান্ত ম্লেচ্ছ ধৰ্ম্মাবলম্বনে পতিত হিন্দুদিগকে তাঁহাদিগের প্রার্থনা মতে আমাদিগের উক্ত ধৰ্ম্মশাস্ত্ৰ ব্যবস্থানুযায়ী সংস্কার দ্বারা উদ্ধার ও স্বজাতির সহিত ব্যবহার করণ সর্বসাধারণ পক্ষে আজ্ঞা করেন। 4
কিন্তু হায় ৮৬ বৎসর পূর্ব্বে বাঙ্গলার উদার দূরদর্শী ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা হিন্দুসমাজকে আত্মরক্ষার জন্য যে আহবান করিয়াছিলেন, বাঙ্গলার হিন্দুসমাজ এখনও তাঁহাতে সাড়া দিতে পারিল না !

• ডা. রাধাকমল মুখোপাধ্যায় । ‘বাঙ্গলা ও বাঙ্গালী’↩

• স্বামী দয়ানন্দের (১৮২৪-৮৩) উদ্যোগে ১৮৭৭ খ্রীস্টাব্দে স্থাপিত হয় । বহু যুগসঞ্চিত কুসংস্কার ও লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে ক্লিষ্ট হিন্দু ধর্মকে বৈদিক যুগের বিশুদ্ধ হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে নেওয়াই ছিল সমাজের প্রধান লক্ষ্য ।↩

• স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (১৮৫৫ー১৯২৬) শুদ্ধি প্রথার প্রবর্তন করেন । ইহার দ্বারা পরধর্মাবলম্বী কিছু আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা ‘শুদ্ধ’ হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে পারেন । বিশেষ করে জোর করে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের এর ফলে স্ব-ধর্মে ফিরে আসার সুবিধা হয় ।↩

• অধ্যাপক বিমানবিহারী মজুমদারের “হিন্দুর সংখ্যা সংরক্ষণের চেষ্টা” আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৪৬। পরিশিষ্টে বিস্তৃত ব্যবস্থাপত্র দ্রষ্টব্য ।↩


Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।