ওঁ তৎ সৎ
শ্রীমদ্ভগবদগীতা
অর্জুন উবাচ
যে শাস্ত্রবিধিম্-উৎসৃজ্য যজন্তে শ্রদ্ধয়া-অন্বিতাঃ।
তেষাম্ নিষ্ঠা তু কা কৃষ্ণ সত্ত্বম্-আহো রজঃ-তমঃ।। ১।।
অনুবাদঃ অর্জুন জিঙ্গাসা করলেন- হে কৃষ্ণ ! যারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করে শ্রদ্ধা সহকারে দেব-দেবীর পূজা করে, তাদের সেই নিষ্ঠা কি সাত্ত্বিক, রাজসিক না তামসিক।
তাৎপর্যঃ চতুর্থ অধ্যায়ের ঊনচত্বারিংশম শ্লোকে বলা হয়েছে যে,কোনও বিশেষ ধরনের আরাধনার প্রতি শ্রদ্ধাবান হলে কালক্রমে জ্ঞান লাভ হয় এবং পরা শান্তি ও সমৃদ্ধির পরম সিদ্ধি লাভ করা যায়। ষোড়শ অধ্যায়ের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, যারা শাস্ত্র - নির্দেশিত বিধির অনুশীলন করে না,তাদের বলা হয় অসুর এবং যাঁরা শ্রদ্ধা সহকারে শাস্ত্রের অনুশাসনাদি মেনে চলেন, তাঁদের বলা হয় সুর বা দেব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যদি শ্রদ্ধা সহকারে কোন নীতির অনুশীলন করে যার উল্লেখ শাস্ত্রে নেই, তার কি অবস্থা। অর্জুনেরর মনের এই সংশয় শ্রীকৃষ্ণকে দুর করতে হবে। যারা একটি মানুষকে বেছে নিয়ে তার উপর বিশ্বাস অর্পণ করে এক ধরনের ভগবান তৈরি করে নেয়,তারা কি সত্ত্বগুণ, রজোগুণ কিংবা তমোগুণের বশবর্তী হয়ে আরাধনা করতে থাকে? ঐ ধরনের লোকেরা কি জীবনে সিদ্ধি লাভের পর্যায়ে উপনীত হয়? তাদের পক্ষে কি যথার্থ জ্ঞান লাভ করে পরম সিদ্ধির স্তরে উন্নীত হওয়া সম্ভব? যারা শাস্ত্রবিধির অনুশীলন করে না,কিন্তু শ্রদ্ধা সহকারে বিভিন্ন দেব- দেবীর ও মানুষের পূজা করে, তারা কি তাদের প্রচেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে? অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে এই সমস্ত প্রশ্ন জিঙ্গাসা করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্রিবিধা ভবতি শ্রদ্ধা দেহিনাম্ সা স্বভাবজা।
সাত্ত্বিকী রাজসী চ-ত্রব তামসী চ-ইতি তাম্ শৃণু।।২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- দেহীদের স্বভাব জনিত শ্রদ্ধা তিন প্রকার -- সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী। এখন এই সম্বন্ধে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ যারা শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধি সম্বন্ধে অবগত হওয়া সত্ত্বেও আলস্য বা বৈমুখ্যবশত এই সমস্ত বিধির অনুশীলন করে না, তারা জড়া প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের পূর্বকৃত সত্ত্বগুণ, রজোগুণ অথবা তমোগুণাশ্রিত কর্ম অনুসারে তারা বিশেষ ধরনের প্রকৃতি অর্জন করে। প্রকৃতির বিভিন্ন গুণাবলীর সঙ্গে জীবের আসঙ্গ চিরকাল ধরেই চলে আসছে, যেহেতু জীবসত্তা জড়া প্রকৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে, সেই জন্য জড় গুণের সঙ্গে তার আসঙ্গ অনুসারে সে বিভিন্ন ধরনের মানসিকতা অর্জন করে থাকে। কিন্তু যদি সে কোন সদ্ গুরুর সঙ্গ লাভ করে এবং তার নির্দেশিত অনুশাসনাদি ও শাস্ত্রাদি মেনে চলে, তা হলে তার প্রকৃতি বদলাতে পারা যায়। ক্রমশ, সেভাবেই মানুষ তম থেকে রজ, কিংবা রজ থেকে সত্ত্বে তার অবস্থার উন্নতি সাধন করতে পারে। এই থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রকৃতির কোনও এক বিশেষ গুণের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের ফলে মানুষ পূর্ণ সার্থকতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না। সব কিছুই সতর্কতার সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে, সদ্ গুরুর
সান্নিধ্যে বিবেচনা করতে হয়। এভাবেই মানুষ প্রকৃতির উচ্চতর গুণগত পর্যায়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সত্ত্বানুরূপা সর্বস্য শ্রদ্ধা ভবতি ভারত।
শ্রদ্ধা-ময়ঃ-অয়ম্ পুরুষঃ যঃ যৎ-শ্রদ্ধঃ সঃ এব সঃ।।৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভারত ! সকলের শ্রদ্ধা নিজ-নিজ অন্তঃকরণের অনুরূপ হয়। যে সেই রকম গুণের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেই রকম শ্রদ্ধাবান।
তাৎপর্যঃ প্রতিটি মানুষেরই, সে যেই হোক না কেন, কোন বিশেষ ধরনের শ্রদ্ধা থাকে। কিন্তু তার স্বভাব অনুসারে সেই শ্রদ্ধা সাত্ত্বিক, রাজসিক অথবা তামসিক হয়। এভাবেই তার বিশেষ শ্রদ্ধা অনুসারে সে এক-এক ধরনের মানুষের সঙ্গ করে। এখন প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে যে, পঞ্চাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, প্রতিটি জীবই মূলত পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ বিভিন্ন অংশ-বিশেষ। তাই, মূলত প্রতিটি জীবই জড়া প্রকৃতির এই সমস্ত গুণের অতীত। কিন্তু কেউ যখন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে তার সর্ম্পকের কথা ভুলে যায় এবং বদ্ধ জীবনে জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসে, তখন সে বৈচিত্র্যময় জড়া প্রকৃতির সঙ্গ অনুসারে নিজের অবস্থান গড়ে তোলে। তার ফলে তার যে কৃত্রিম বিশ্বাস ও উপাধি তা জড়- জাগতিক। কেউ যদিও কতকগুলি সংস্কার বা ধারণার বশবর্তী হয়ে পরিচালিত হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে হচ্ছে নির্গুণ বা গুণাতীত। তাই, পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে তার সর্ম্পক পূনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য তাকে তার জন্ম-জন্মান্তরে সঞ্চিত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হতে হবে। সেটিই হচ্ছে নির্ভয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার একমাত্র পন্থা -- কৃষ্ণভাবনামৃত। কৃষ্ণভাবনামৃত যিনি লাভ করেছেন, তিনি নিশ্চিতভাবে সিদ্ধ স্তরে অধিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু কেউ যদি আত্মজ্ঞান লাভের পন্থা অবলম্বন না করেন,তা হলে তিনি অবশ্যই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিচালিত হবেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অশাস্ত্রবিহিতম্ ঘোরম্ তপ্যন্তে যে তপঃ জনাঃ।
দম্ভ-অহঙ্কার-সংযুক্তাঃ কাম্-রাগ-বল-অন্বিতাঃ।।৫।।
কর্ষয়ন্তঃ শরীরস্থম্ ভূতগ্রামম্-অচেতসঃ।
মাম্ চ-এব-অন্তঃ-শরীরস্থম্ তান্ বিদ্ধি-আসুর-নিশ্চয়ান্।।৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- দম্ভ ও অহঙ্কারযুক্ত এবং কামনা ও আসক্তির প্রভাবে বলান্বিত হয়ে যে সমস্ত অবিবেকী ব্যক্তি তাদের দেহস্থ ভূতসমূহকে এবং অন্তরস্থ পরমাত্মাকে ক্লেশ প্রদান করে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘোর তপস্যার অনুষ্ঠান করে, তাদেরকে নিশ্চিতভাবে আসুরিক বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ কিছু মানুষ আছে যারা নানা রকম তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন ঊদ্ভাবন করে, যা শাস্ত্রবিধানে উল্লেখ নেই। যেমন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনশন করা। এই ধরনের অনশন করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়নি। শাস্ত্রের নির্দেশ হচ্ছে কেবলমাত্র পারমার্থিক উন্নতি সাধনের জন্যই অনশন করা উচিত। কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তা উচিত নয়। এই ধরনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা তপশ্চর্যা করে, ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে যে, তারা অবশ্যই আসুরিক ভাবাপন্ন। তাদের কার্যকলাপ শাস্ত্রবিধির বিরোধী এবং তার ফলে জনসাধারণের কোন মঙ্গল হয় না। প্রকৃতপক্ষে, তারা গর্ব, অহঙ্কার, কাম ও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত হয়ে ঐ সমস্ত কর্ম করে। এই ধরণের কাজকর্মের ফলে যে সমস্ত
জড় উপাদান দিয়ে দেহ তৈরি হয়েছে তা-ই যে কেবল বিক্ষুব্ধ হন তা নয়, পরম পুরুষোত্তম ভগবান যিনি এই শরীরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন, তিনিও ক্ষুব্ধ হন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই ধরনের অবিধিপূর্বক অনশন বা তপস্যা অপরের কাছে উৎপাত-স্বরূপ। এই রকম তপস্যার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা মনে করতে পারে যে, এই উপায় অবলম্বন করে তারা তাদের শত্রুকে অথবা অন্য দলকে তাদের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করতে বাধ্য করতে পারে, কিন্তু এই ধরনের অনশনের ফলে অনেক সময় তাদের মৃত্যু ঘটে। পরম পুরুষোত্তম ভগবান এই ধরনের কাজ অনুমোদন করেননি
এবং তিনি বলেছেন যে, যারা এই ধরনের কাজে প্রবৃত্ত হয়, তারা অসুর। এই ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতিও অসম্মানসূচক, কারণ বৈদিক শাস্ত্রের অনুশাসন আদি অমান্য করে তা করা হয়। অচেতসঃ কথাটি এই সম্পর্কে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সুস্থ স্বাভাবিক মনোভাবাপন্ন মানুষেরা অবশ্যই অনুশাসনগুলি পালন করে চলেন। যারা তেমন মনোভাবাপন্ন নয়, তারা শাস্ত্রের নির্দেশ অবহেলা করে তাদের নিজেদের মনগড়া তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন পন্থা উদ্ভাবন করে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষের যে পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে তা সব সময় মনে রাখা উচিত। ভগবান তাদের আসুরিক যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য করেন। তার ফলে তারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে তাদের নিত্য সম্পর্কের কথা জানতে না পেরে, জন্ম-জন্মান্তরে আসুরিক জীবন- যাপন করতে থাকবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
আহারঃ-তু-অপি সর্বস্য ত্রিবিধো ভবতি প্রিয়ঃ।
যজ্ঞঃ-তপঃ-তথা দানম্ তেষাম্ ভেদম্-ইমম্ শৃণু।।৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সকল মানুষের আহারও তিন প্রকার প্রীতিকর হয়ে থাকে। তেমনই যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ। এখন তাদের এই প্রভেদ শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির গুণের বিভিন্ন অবস্থা অনুসারে আহার, যজ্ঞ অনুষ্ঠান,তপশ্চর্যা ও দান বিভিন্নভাবে সাধিত হয়। এই সমস্ত একই পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হয় না। যাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারেন যে, জড় জগতের কোন্ গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোন্ কর্ম সাধিত হয়েছে, তাঁরাই হচ্ছেন যথার্থ জ্ঞানী। যারা মনে করে, সব রকমের যজ্ঞ, খাদ্য অথবা দান সমপর্যায়ভুক্ত, তাদের পার্থক্য নিরূপণ করবার ক্ষমতা নেই, তারা মূর্খ। কিছু ধর্ম-প্রচারক এখন প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, মানুষ নিজের ইচ্ছামতো যা ইচ্ছা তাই করে যেতে পারে এবং এই ধরনের যথেচ্ছাচার করার ফলেই তাদের পরমার্থ সাধিত হবে। কিন্তু এই ধরনের মূর্খতা প্রচারকেরা বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশের অনুসরণ করছে না। তারা নিজেদের মনগড়া পন্থা তৈরি করে জনসাধারণকে বিপথগামী করছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
আয়ুঃ-সত্ত্ব-বল-আরোগ্য-সুখ-প্রীতি-বিবর্ধনাঃ।
রস্যাঃ স্থিরাঃ হৃদ্যাঃ আহারাঃ সাত্ত্বিক-প্রিয়াঃ।।।৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে সমস্ত আহার আয়ু, সত্ত্ব, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বর্ধনকারী এবং রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, স্থায়ী ও মরোরম, সেগুলি সাত্ত্বিক লোকদের প্রিয়।
কটু-অম্ল-লবন-অত্যুষ্ণ-তীক্ষ্ণ-রুক্ষ-বিদাহিনঃ।
আহারাঃ রাজসস্য-ইষ্টা দুঃখ-শোক-আময়প্রদাঃ।।৯।।
অনুবাদঃ যে সমস্ত আহার অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ণ, অতি শুষ্ক, অতি প্রদাহকর এবং দৃঃখ, শোক ও রোগপ্রদ, সেগুলি রাজসিক ব্যক্তিদের প্রিয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যাতযামম্ গতরসম্ পূতি পর্যুষিতম্ চ যৎ।
উচ্ছিষ্টম্ চ-অমেধ্যম্ ভোজনম্ তামস-প্রিয়ম্।।১০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আহারের এক প্রহরের অধিক পূর্বে রানা করা খাদ্য, যা নীরস, দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী এবং অপরের উচ্ছিষ্ট দ্রব্য ও অমেধ্য দ্রব্য, সেই সমস্ত তামসিক লোকদের প্রিয়।
তাৎপর্যঃ খাদ্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে আয়ু বর্ধন করা, মনকে পবিত্র করা এবং শরীরের শক্তি দান করা। সেটিই হচ্ছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য। পুরাকালে মুনি-ঋষিরা বলদায়ক, আয়ুবর্ধক সমস্ত
খাদ্যদ্রব্য নির্বাচন করে গেছেন, যেমন দুর্গন্ধজাত খাদ্য, শর্করা, অন্ন, গম, ফল ও শাক-সবজি। যারা সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন, তাদের কাছে এই ধরনের খাদ্য অত্যন্ত প্রিয়। অন্যকিছু খাদ্যদ্রব্য,যেমন ভুট্রার খই ও গুড় খুব একটা সুস্বাদু নয়, কিন্তু দুধ বা অন্য কোন খাদ্যের সঙ্গে মিশ্রিত হওয়ার ফলে সেগুলি খুব সুস্বাদু হয়ে ওঠে। তখন সেগুলি সাত্ত্বিক আহারে পরিনতি হয়। এই সমস্ত খাদ্যগুলি স্বাভাবিকভাবেই পবিত্র। এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য মদ্য, মাংস আদি অস্পৃশ্য বস্তু থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র। অষ্টম শ্লোকে যে স্নিগ্ধ বা স্নেহজাতীয় খাদ্যের বর্ণনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে হত্যা করা পশুর চর্বির কোন সর্ম্পক নেই। সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে খাদ্য দুধ, তাতে যথেষ্ট পরিমাণে স্নেহ পর্দাথ আছে। দুধ, মাখন, ছানা এবং এই জাতীয় পর্দাথের যে পরিমাণ স্নেহ পর্দাথ পাওয়া যায়, তাতে আর নিরীহ পশু হত্যা করার কোন প্রয়োজন থাকে না। শুদু মাত্র পাশবিক মনোবৃত্তির ফলে এই সমস্ত পশু হত্যা হয়ে চলছে। সভ্য উপায়ে স্নেহ পর্দাথ পাওয়ার পন্থা হচ্ছে দুধ। নরপশুরাই কেবল পশু হত্যা করে থাকে। ছোলা, মটর, গম আদিতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন বা অন্নসার পাওয়া যায়।
রাজসিক খাদ্য হচ্ছে সেই সমস্ত খাদ্য, যা তিক্ত, অত্যন্ত লবণাক্ত বা অতি উষ্ণ অথবা অতিরিক্ত শুকনো লঙ্কা মিশ্রিত, যার ফলে উদরে কফ উৎপন্ন হয়ে শ্লেষ্মা প্রদান করে এবং অবশেষে রোগ দেখা দেয়। আর তামসিক আহার হচ্ছে সেগুলি, যা টাটকা নয়। যে খাদ্য আহার করার কম করে তিন ঘন্টা আগে রান্না করা হয়েছে ( ভগবৎ প্রসাদ ব্যতীত) তা তামসিক আহার বলে গণ্য করা হয়। যেহেতু তা পচতে শুরু করেছে, তাই এই সমস্ত খাদ্য দুর্গন্ধযুক্ত। সেগুলি তমোগুণ সম্পন্ন মানুষকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন মানুষেরা তা সহ্য করতে পারে না।
উচ্ছিষ্ট খাদ্য তখনই গ্রহন করা উচিত তা যদি ভগবান নিবেদিত হয় বা মহাত্মার, বিশেষ করে গুরুজনের উচ্ছিষ্ট হয়। তা না হলে উচ্ছিষ্ট খাদ্য তামসিক বলে গন্য হয়।
শ্রেষ্ঠ খাদ্য হচ্ছে সেই সমস্ত খাদ্য, যা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নিবেদন করা হয়। ভগবদ্ গীতায় ভগবান বলেছেন যে , শাক-সবজি, ময়দা, দুগ্ধ আদি প্রস্তুত আহার্য যখন ভগবানকে ভক্তি সহকারে নিবেদন করা হয় তিনি তা গ্রহন করেন। পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ম্।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অফলাকাঙ্ক্ষিভিঃ-যজ্ঞঃ বিদিদিষ্টঃ য
ইজ্যতে।
যষ্টব্যম্-ত্রব-ইতি মনঃ সমাধায় সঃ সাত্ত্বিক।। ১১।।
অনুবাদঃ ফলের আকাঙ্ক্ষা রহিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক শাস্ত্রের বিধি অনুসারে অনুষ্ঠান করা কর্তব্য এভাবেই মনকে একাগ্র করে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তা সাত্ত্বিক যজ্ঞ।
তাৎপর্যঃ সাধারণত মানুষ কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে যে, কোনও রকম ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা উচিত। কর্তব্যবোধে আমাদের যজ্ঞ করা উচিত। মন্দির ও গির্জাগুলিতে যেভাবে সমস্ত আচার অনুষ্ঠান করা হয়, তা সাধারণত অনুষ্ঠিত হয় জড়- জাগতিক লাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তা সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন নয়। কর্তব্যবোধে মানুষের মন্দিরে বা গির্জায় যাওয়া উচিত এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা, পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করা ও নৈবেদ্য নিবেদন করা উচিত। সকলেই মনে করে যে, কেবল ভগবানের আরতি করার জন্য মন্দিরে গিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু অর্থ লাভের জন্য ভগবানের উপাসনার কথা শাস্ত্রে অনুমোদিত হয়নি। ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করার জন্যই সেখানে যাওয়া উচিত। তার ফলে মানুষ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সভ্য মানুষের কর্তব্য হচ্ছে শাস্ত্রের নির্দেশ পালন করা এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অভিসন্ধায় তু ফলম্ দম্ভ-অর্থম্-অপি চ-এব যৎ।
ইজ্যতে ভরতশ্রেষ্ঠ তম্ যজ্ঞম্ বিদ্ধি রাজসম্।। ১২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভারতশ্রেষ্ঠ ! কিন্তু ফল কামনা করে দম্ভ প্রকাশের জন্য যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাকে রাজসিক যজ্ঞ বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ কখনও কখনও স্বর্গলোক প্রাপ্তির জন্য অথবা কোন জাগতিক লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে যজ্ঞ ও বৈদিক আচার অনুষ্ঠান করা হয়। এই ধরনের যজ্ঞ বা আচার অনুষ্ঠান রাজসিক বলে গণ্য করা হয়।
বিধিহীনম্-অসৃষ্টান্নম্ মন্ত্রহীনম্-অদক্ষিণম্।
শ্রদ্ধাবিরহিতম্ যজ্ঞম্ তামসম্ পরিচক্ষতে।।১৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শাস্ত্রবিধি বর্জিত, প্রসাদান্ন বিতরণহীন, মন্ত্রহীন, দক্ষিণাবিহীন ও শ্রদ্ধারহিত যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলা হয়।
তাৎপর্যঃ তমোগুণে শ্রদ্ধা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে অশ্রদ্ধা। কখনও কখনও মানুষ টাকা-পয়সা লাভের আশায় কোন কোন দেব-দেবীর পূজা করে থাকে এবং তারপর শাস্ত্র-নির্দেশের সম্পূর্ণ অবহেলা করে নানা রকম আমোদ-প্রমোদে সমস্ত অর্থ ব্যয় করে। এই ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ লোকদেখানো ধর্ম অনুষ্ঠানকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করা হয়। এই সমস্তই হচ্ছে তামসিক। তার ফলে আসুরিক মনোভাবের উদয় হয় এবং মানব-সমাজের তাতে কোন মঙ্গল সাধিত হয় না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দেব-দ্বিজ-গুরু-প্রাজ্ঞ-পূজনম্ শৌচম্-আর্জবম্।
ব্রক্ষচর্যম্-অহিংসা চ শারীরম্ তপঃ উচ্যতে।।১৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ব্রাহ্মণ, গুরু ও প্রাজ্ঞগণের পূজা এবং শৌচ, সরলতা, ব্রক্ষচর্য ও অহিংসা --এগুলিকে কায়িক তপস্যা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান এখানে বিভিন্ন ধরনের তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যাখ্যা করছেন। প্রথমে তিনি কায়িক তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনেরর কথা বলেছেন। পরমেশ্বর ভগবানকে, দেব-দেবীকে, সিদ্ধ পুরুষকে, সদ্ ব্রাহ্মণকে, সদ্ গুরুকে এবং পিতা-মাতা আদি গুরুজনদেরকে অথবা যাঁরা বৈদিক জ্ঞান সম্বন্ধে অবগত, তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধা করা উচিত অথবা তাদের শ্রদ্ধা করার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এদের সকলকে যথাযথ সম্মানী দেওয়া উচিত। বাইরে ও অন্তরে নিজেকে পরিস্কার রাখার অনুশীলন করা উচিত এবং আচার ব্যবহারে সহজ সরল হতে শেখা উচিত। শাস্ত্রে যা অনুমোদন করা হয়নি, কখনই করা উচিত নয়। কখনই অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীসঙ্গ করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর কোন মতেই নয়। একে বলা হয় ব্রক্ষচর্য। এগুলি হচ্ছে দেহের তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অনুদ্বেগকরম্ বাক্যম্ সত্যম্ প্রিয়-হিতম্ চ যৎ।
স্বাধ্যায়-অভ্যসনম্ চ-ত্রব বাঙ্ময়ম্ তপ উচ্যতে।।১৫ ।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অনুদ্বেগকর, সত্য, প্রিয় অথচ হিতকর বাক্য এবং বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করাকে বাচিক তপশ্চর্যা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ এমনভাবে কোন কথা বলা উচিত নয়, যার ফলে মন উত্তেজিত হতে পারে। তবে শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের
শিক্ষা করবার জন্য সত্য' কথা বলতে পারেন, কিন্তু তা যদি অন্যদের, যারা তার শিষ্য নয়, তাদের উত্তেজিত করে তোলে, তা হলে সেখানে তাঁর কথা বলা উচিত নয়। এটিই হচ্ছে বাচোবেগ দমন করার তপশ্চর্যা। এ ছাড়া অর্থহীন প্রজল্প করা উচিত নয়। ভক্তমণ্ডলীতে যখন কথা বলা হয়, তখন তা যেন শাস্ত্র-প্রমাণের উল্লেখ করা উচিত। সেই সঙ্গে, ঐ ধরনের আলোচনা অন্যের কাছে শ্রুতিমধুর হওয়া উচিত। তবেই এই ধরনের আলোচনার মাধ্যমে পরম মঙ্গল লাভ হতে পারে এবং মানব-সমাজের উন্নতি সাধিত হতে পারে। বৈদিক সাহিত্যের অনন্ত ভাণ্ডার রয়েছে এবং সেগুলি পাঠ করা উচিত। একেই বলা হয় বাচোবেগের তপশ্চর্যা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মনঃপ্রসাদঃ সৌম্যত্বম্ মৌনম্-আত্মবিনিগ্রহঃ।
ভাবসংশুদ্ধিঃ-ইতিত্রতৎ তপঃ মানসম্ -উচ্যতে।।১৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- চিত্তের প্রসন্নতা, সরলতা, মৌন, আত্মনিগ্রহ ও ব্যবহারে নিষ্কপটতা-- এগুলিকে মানসিক তপস্যা বলে।
তাৎপর্যঃ মানসিক তপশ্চর্যা হচ্ছে সব রকমের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের ইচ্ছা থেকে মনকে মুক্ত করা। মনকে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে সে সর্বক্ষণ মানুষের কি করে মঙ্গল হবে, সেই চিন্তায় মগ্ন থাকা। মনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হচ্ছে চিন্তায় গাম্ভীর্য। কৃষ্ণভক্তি থেকে কখনই বিচ্যুত হওয়া উচিত নয় এবং সর্বদাই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ পরিত্যাগ করা উচিত। স্বভাকে নির্মল করে গড়ে তোলার উপায় হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া। মনের সন্তোষ তখনই লাভ করা যায়, যখন মনকে সমস্ত ইন্দ্রিয় উপভোগের চিন্তা থেকে দুরে সরিয়ে রাখা যায়। আমরা যতই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের চিন্তা করি, মন ততই অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। বর্তমান যুগে আমরা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য নানা রকম পন্থায় মনকে অনর্থক নিযুক্ত করছি এবং তাই মানসিক শান্তির কোন সম্ভাবনা নেই।
মানসিক শান্তি লাভের শ্রেষ্ঠা উপায় হচ্ছে মহাভারত ও পূরাণ আদি বৈদিক শাস্ত্রে মনকে নিবদ্ধ করা, যা নানা রকম মনোমুগ্ধকর আনন্দদায়ক কাহিনীতে পরিপূর্ণ। এই জ্ঞানের সহয়তা লাভ করে মানুষ পবিত্র হতে পারে। মন যেন সব রকমের কপটতা থেকে মুক্ত থাকে এবং আমাদের উচিত সকলের মঙ্গল কামনা করা। মৌনতা মানে হচ্ছে সর্বক্ষমতা আত্মজ্ঞান লাভের চিন্তাম্ মগ্ন থাকা। এই অর্থে কৃষ্ণভাবনামৃত ভক্ত হচ্ছেন যথার্থ মৌন।
আত্মনিগ্রহের অর্থ হচ্ছে মনকে সব রকমের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা থেকে মুক্ত রাখা। আমাদের অকপট ব্যবহার করা উচিত, তার ফলে আমাদের অস্তিত্ব শুদ্ধ হয়। এই সমস্ত গুণাবলী হচ্ছে মানসিক তপশ্চর্যা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শ্রদ্ধয়া পরয়া তপ্তম্ তপ-তৎ ত্রিবিধম্ নরৈঃ।
আফলাকাঙ্ক্ষিভিঃ-যুক্তৈঃ সাত্ত্বিকম্ পরিচক্ষতে।। ১৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ফলাকাঙ্ক্ষা রহিত মানুষের দ্বারা পরম
শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত ত্রিবিধ তপস্যাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে।
সৎকার-পূজার্থম্ তপঃ দম্ভেন চ-ত্রব যৎ।
ক্রিয়তে তৎ-ইহ প্রোক্তম্ রাজসম্ চলম্-অধ্রুবম্।। ১৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শ্রদ্ধা, সম্মান ও পূজা লাভের আশায় দম্ভ সহকারে যে তপস্যা করা হয়, তাকেই এই জগতে অনিত্য ও অনিশ্চিত রাজসিক তপস্যা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ অনেক সময় তপশ্চর্যার আচরণ করা হয় মানুষকে আকৃষ্ট করবার জন্য এবং অন্যের কাছ থেকে
সম্মান, শ্রদ্ধা ও পূজা লাভের জন্য। রাজসিক মানুষেরা তাদের অধস্তনদের কাছ থেকে পূজা আদায়ের বন্দোবস্ত করে, তাদের দিয়ে পা ধোয়ায় এবং সম্পদ দান করতে বাধ্য করায়। তপশ্চর্যার আচরণের দ্বারা এই ধরনের কৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলির ব্যবস্থা রাজসিক এবং তার ফল ক্ষণস্থায়ী। তা কিছু দিনের জন্য কেবল থাকে , কিন্তু স্থায়ী হয় না।
।
শ্রীভগবান্ 'উবাচ
মূঢ়-গ্রাহেণ-আত্মনঃ যৎ পীড়য়া ক্রিয়তে তপঃ।
পরস্য-উৎসাদনার্থম্ বা তৎ-তামসম্-উদাহৃতম্।। ১৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- মূঢ়োচিত আগ্রহের দ্বারা নিজেকে পীড়া দিয়ে অথবা অপরের বিনাশের জন্য যে তপস্যা করা হয়, তাকে তামসিক তপস্যা বলে।
তাৎপর্যঃ নির্বোধ তপশ্চর্যার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন হিরণ্যকশিপু, যে অমরত্ব লাভ করে দেবতাদের হত্যা করাবার জন্য তপস্যা করছিল। সে ব্রক্ষার কাছে এই সব প্রার্থনা করে, কিন্তু পরিণামে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের হাতে সে নিহত হয়। অসম্ভব কোন কিছু লাভের আশায় যে
তপস্যা করা হয়, তা অবশ্যই তামসিক।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দাতব্যম্-ইতি যৎ-দানম্ দীয়তে-অনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তৎ-দানম্ সাত্ত্বিকম্ স্মৃতম্। ২০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- দান করা কর্তব্য বলে মনে করে প্রত্যুপকারের আশা না করে উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে এবং উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলে।
তাৎপর্যঃ পারমার্থিক কর্মে নিযুক্ত যে মানুষ, তাকেই দান করার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। নির্বিচারে দান করার কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। পারমার্থিক উন্নতিই জীবনের পরম উদ্দেশ্য। তাই তীর্থস্থানে, চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময়, মাসের শেষ অথবা সদ্ ব্রক্ষাণ বা বৈষ্ণবকে অথবা মন্দিরে দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে দান করা উচিত। কখনও কখনও অনুকম্পার বশবর্তী হয়ে গরিবদের দান করা হয়, কিন্তু সেই গরিব লোকটি যদি দানের যোগ্য না হয়, তা হলে সেই দানের ফলে কোন পারমার্থিক উন্নতি সাধিত হয় না। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, নির্বিচারে দান করার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তু প্রত্যুপকারার্থম্ ফলম্-উদ্দিশ্য বা পূনঃ।
দীয়তে চ পরিক্লিষ্টম্ তৎ-দানম্ রাজসম্ স্মৃতম্।। ২১।।
অদেশকালে যৎ-দানম্-অপাত্রেভ্যঃ-চ দীয়তে।
অসৎকৃতম্-অবজ্ঞাতম্ তৎ-তামসম্-উতাহৃতম্।।২২।।
অনুবাদঃশ্রীভগবান্ বললেন- যে দান প্রত্যুপকারের আশা করে অথবা ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং অনুতাপ সহকারে করা হয়, সেই দানকে রাজসিক দান বলে।
অশুচি স্থানে, অশুভ সময়ে, অযোগ্য পাত্রে, অনাদরে এবং অবজ্ঞা সহকারে যে দান করা হয়, তাকে তামসিক দান বলা হয়।
তাৎপর্যঃ কখনও কখনও স্বর্গলোকে উন্নীত হওয়ার জন্য দান করা হয়, কখনও আবার গভীর বিরক্তির সঙ্গে দান করা হয় এবং কখনও দান করার পরে অনুশোচনা হয় যে," কেন আমি এভাবে এতগুলি টাকা নষ্ট করলাম"। কখনও আবার গুরুজনের অনুরোধে
বাধ্য হয়ে দান করতে হয়। এই ধরনের দানগুলিকে রাজসিক বলে গণ্য করা হয়।
অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে যারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগে লিপ্ত প্রতিষ্ঠানের উপহার সামগ্রী দান করে থাকে। এই ধরনের দান কে বৈদিক শাস্ত্রে অনুমোদন করা হয়নি। কেবল মাত্র সাত্ত্বিকভাবে দানের নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
নেশা করা বা জুয়াখেলার জন্য দান করতে এখানে উৎসাহিত করা হয়নি। এই ধরনের সমস্ত দান তামসিক। এই ধরনের দানের ফলে কোন লাভ হয় না।
উপরন্তু পাপকর্মে লিপ্ত সমস্ত মানুষগুলি প্রশয় পায়। তেমনই, কেউ যদি আবার অশ্রদ্ধার সঙ্গে এবং অবহেলা করে যোগ্য পাত্রেও দান করে, তা হলে সে দানকে তামসিক বলে গণ্য করা হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ওঁ তৎ-সৎ-ইতি নির্দেশঃ ব্রক্ষণঃ-ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ।
ব্রাক্ষণঃ-তেন বেদাঃ-চ যজ্ঞাঃ-চ বিহিতাঃ পুরা।।২৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ওঁ তৎ সৎ -- এই তিনপ্রকার ব্রক্ষ-নির্দেশক নাম শাস্ত্রে কথিত আছে। পুরাকালে সেই নাম দ্বারা ব্রাক্ষণগণ, বেদসমূহ ও যজ্ঞসমূহ বিহিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তপস্যা,যজ্ঞ,দান ও আহার তিনভাগে বিভক্ত---সাত্ত্বিক,রাজসিক ও তামসিক। কিন্তু উত্তমই হোক, মধ্যমই হোক বা কনিষ্ঠই হোক,সে সবই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কুলষিত। যখন সেগুলি পারমার্থিক উন্নতি সাধনের উপায়-স্বরূপ হয়ে ওঠে। শাস্ত্রের নিদের্শসমূহ সেই উদ্দেশ্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। ওঁ তৎ সৎ ---এই তিনটি শব্দ নির্দিষ্টভাবে পরমতত্ত্ব পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে সূচিত করে। বৈদিক মন্ত্রে সর্বদাই ওঁ শব্দটির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। যে শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে আচরণ করে না, সে কখনই পরম-তত্ত্বকে প্রাপ্ত হতে পারবে না। তার পক্ষে কোন সাময়িক ফল লাভ হতে পারে, কিন্তু তার জীবনের পরম অর্থ সাধিত হয় না। সুতরাং সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, যজ্ঞ, তপস্যা অবশ্যই সাত্ত্বিকভাবে অনুষ্ঠান করতে হবে। রাজসিক বা তামসিকভাবে সেগুলি অনুষ্ঠিত হলে তা অবশ্যই নিকৃষ্ট। ওঁ তৎ সৎ ---এই তিনটি শব্দ পরমেশ্বর ভগবানের পবিত্র নামের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়, যেমন ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ। যখনই কোন বৈদিক মন্ত্র বা পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য নামের উচ্চারণ করা হয়,তার সঙ্গে ওঁ শব্দটি যুক্ত হয়। সেই কথা বৈদিক শাস্তে বলা হয়েছে। এই তিনটি শব্দ বৈদিক মন্ত্র থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ওঁ ইত্যেতদ্ ব্রক্ষণো নেদিষ্ঠং নাম (ঋক্ বেদ) প্রথম লক্ষকে সূচিত করে। তারপর তত্ত্বমসি ( ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬-৮-৭) দ্বিতীয় লক্ষ্য সূচনা করে এবং সদেব সৌম্য ( ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬-২-১) তৃতীয় লক্ষ্যকে সূচিত করে। একত্রে তারা ওঁ তৎ সৎ। পুরাকালে প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রক্ষা যখন যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন,তখন তিনি এই তিনটি শব্দের দ্বারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নির্দেশ করেছিলেন। অতত্রব গুরু-পরস্পরাতেও এই তত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং, এই মন্ত্রটির বিপুল তাৎপর্য রয়েছে। তাই ভগবদ্ গীতায় অনুমোদিত হয়েছে যে,যে কোন কর্মই করা হোক না কেন , তা যেন ওঁ তৎ সৎ অথবা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের জন্য কর হয়। কেউ যখন এই তিনটি শব্দ সহকারে তপস্যা,দান, যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন,তখন বুঝতে হবে তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করছেন। কৃষ্ণভাবনা হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান সমন্বিত অপ্রাকৃত কর্ম যা অনুশীলন করার ফলে আমরা আমাদের নিত্য আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারি। এই রকম অপ্রাকৃত করে কোন রকম শক্তি ক্ষয় হয় না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তস্মাৎ ওঁ ইতি-উদাহৃত্য যজ্ঞ-দান-তপঃ-ক্রিয়াঃ।
প্রবর্তন্তে বিধানোক্তাঃ সততম্ ব্রক্ষবাদিনাম্।।২৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সেই হেতু ব্রক্ষবাদীদের যজ্ঞ, দান,তপস্যা ও ক্রিয়াসমূহ সর্বদাই ওঁ এই শব্দ উচ্চারণ করে শাস্ত্রের বিধান অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
তাৎপর্যঃ ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ ( ঋক বেদ ১-২২-২০)। শ্রীবিষ্ণুর শ্রীচরণ-কমল হচ্ছে পরা ভক্তির পরম আশ্রয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত কর্ম হচ্ছে সমস্ত কর্মের সার্থকতা।
তৎ ইতি-অনভিসন্ধায় ফলম্ যজ্ঞ-তপঃ-ক্রিয়াঃ।
দান-ক্রিয়া-চ বিবিধাঃ ক্রিয়ন্তে মোক্ষকাঙ্ক্ষিভিঃ।।২৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- মুক্তিকামীরা ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে 'তৎ' এই শব্দ উচ্চারণ- পূর্বক নানা প্রকার যজ্ঞ, তপস্যা, দান আদি কর্মের অনুষ্ঠান করেন।
তাৎপর্যঃ চিন্ময় স্তরে উন্নীত হতে হলে জড়-জাগতিক লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কর্ম করা উচিত নয়। চিন্ময় জগৎ ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়ার পরম উদ্দেশ্য নিয়ে সমস্ত কর্ম করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সদ্ভাবে সাধুভাবে চ সৎ-ইতি-ত্রতৎ প্রযুজ্যতে।
প্রশস্তে কর্মণি তথা সচ্ছব্দঃ পার্থ যুজ্যতে।।২৬ ।।
যজ্ঞে তপসি দানে চ স্থিতিঃ সৎ-ইতি চ-উচ্যতে।
কর্ম চ-এব তৎ-অর্থীয়ম সৎ-ইতি-ত্রব-অভিধীয়তে।।২৭।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! সৎভাবে ও সাধুভাবে ' সৎ 'এই শব্দটি প্রযুক্ত হয়।
তেমনই শুভ কর্মসমূহে ' সৎ' শব্দ ব্যবহৃত হয়। যজ্ঞে তপস্যায় ও দানে ' সৎ ' শব্দ উচ্চারিত হয়। যেহেতু ঐ সকল কর্ম ব্রক্ষোদ্দেশক হলেই ' সৎ ' শব্দে অভিহিত হয়।
তাৎপর্যঃ প্রশস্তে কর্মণি কথাগুলির অর্থ এই যে, বৈদিক শাস্ত্রে নানা রকম পবিত্রকারক কাজকর্ম করার নির্দেশ দেওয়া আছে, যা শৈশবে পিতা-মাতার তত্ত্ববধানে খেকে শুরু করে জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত পালন করা উচিত। জীবনের পরম সিদ্ধি লাভ করার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত পবিত্রকারক কর্তব্যগুলি অনুষ্ঠান করা হয়। এই সমস্ত কাজকর্মে ওঁ তৎ সৎ মন্ত্র উচ্চারণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সদ্ভাবে ও সাধুভাবে শব্দগুলি দিব্য অবস্থাদি নির্দেশ করে। কৃষ্ণভাবনাময় কাজকর্মকে বলা হয় সত্ত্ব এবং যিনি কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম সম্বন্ধে সর্ম্পূণ সচেতন, তাকে বলা হয় ' সাধু'। শ্রীমদ্ভগবতে (৩-২৫-২৫) বলা হয়েছে যে, সাধুসঙ্গ করার ফলে অপ্রাকৃত বিষয়বস্তু সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে অবগত হওয়া যায়। এই সর্ম্পকে শ্রীমদ্ভগবতে যে কথাগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, তা হচ্ছে সতাং প্রসঙ্গাৎ। সাধুসঙ্গ ব্যতীত
দিব্যজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। যখন দীক্ষা বা উপবীত দান করা হয়, তখন ওঁ তৎ সৎ শব্দগুলি উচ্চারণ করা হয়। তেমনই, সব রকম যজ্ঞানুষ্ঠানের বিষয় হচ্ছে পরম-তত্ত্ব অর্থাৎ ওঁ তৎ সৎ। তদর্থীয়ম্ শব্দটি আরও বোঝাচ্ছে পরম-তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে এমন যে কোন কিছুর প্রতি সেবা নিবেদন, যেমন রান্না করা ও মন্দিরে সহয়তা করা অথবা ভগবানের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে অন্য যে কোন রকম কাজকর্ম।
সমস্ত কর্মকে পবিত্র করে তোলার উদ্দেশ্যে ওঁ তৎ সৎ শব্দগুলি বহুভাবে
ব্যবহৃত হয় এবং সব কিছুকে সম্যক্ভাবে পরিপূর্ণ করে তোলে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অশ্রদ্ধয়াঃ হুতম্ দত্তম্ তপঃ-তপ্তম্ কৃতম্ চ যৎ।
অসৎ-ইতি-উচ্যতে পার্থ ন চ তৎ প্রেত্য নো ইহ।।২৮।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! অশ্রদ্ধা সহকারে হোম, দান বা তপস্যা যা কিছু অনুষ্ঠিত হয়, তাকে বলা হয় ' অসৎ '। সেই সমস্ত ক্রিয়া ইহলোকে ও পরলোকে ফলদায়ক হয় না।
তাৎপর্যঃপারমার্থিক উদ্দেশ্য রহিত যা কিছুই করা হয়, তা যজ্ঞ হোক, দান হোক বা তপস্যাই হোক, তা সবই নিরর্থক। তাই এই শ্লোকটিতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, সেই সমস্ত কর্ম জঘন্য। সব কিছুই কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে পরব্রহ্মেরর জন্য করা উচিত। এই বিশ্বাস না থাকলে এবং যথার্থ পথপ্রদর্শক না থাকলে কখনই কোন ফল লাভ হবে না। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রে পরম-তত্ত্বের প্রতি বিশ্বাস-পরায়ণ হওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সমস্ত
বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশাদি অনুসরণের চরম লক্ষ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। এই নীতি অনুসরণ না করলে কেউই সাফল্য লাভ করতে পারে না। তাই সদ্ গুরুর তত্ত্ববধানে থেকে প্রথম থেকেই কৃষ্ণভাবনায় ভক্তিযোগের অনুশীলন করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। সব কিছু সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার এটিই হচ্ছে পন্থা।
বদ্ধ অবস্থায় মানুষ দেব-দেবী, ভূত-প্রেত অথবা কুবের যক্ষদের পূজা করার প্রতি আসক্ত থাকে। রজ ও তমোগুণ থেকে সত্ত্বগুণ শ্রেয়। কিন্তু যিনি প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করেছেন, তিনি এই জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের অতীত। যদি ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধন করার পন্থা রয়েছে, তবুও যদি কেউ শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ লাভ করার ফলে সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করতে পারেন,সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা এবং এই অধ্যায়ের সেটিই অনুমোদিত হয়েছে। এভাবেই জীবন স্বার্থক করতে হলে, সর্ব প্রথমে সদ্ গুরুর পাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং তাঁর পরিচালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। তখন পরম-তত্ত্বের প্রতি বিশ্বাসের উদয় হবে। কালক্রমে সেই বিশ্বাস যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, তখন তাকে বলা হয়
ভগবৎ-প্রেম। এই প্রেমই হচ্ছে জীবসমূহের পরম লক্ষ্য। তাই সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করা উচিত। সেটিই হচ্ছে সপ্তদশ অধ্যায়ের বক্তব্য।
ইতি---' শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ ' নামক শ্রীমদ্ভগবদগীতার সপ্তাদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা
অর্জুন উবাচ
যে শাস্ত্রবিধিম্-উৎসৃজ্য যজন্তে শ্রদ্ধয়া-অন্বিতাঃ।
তেষাম্ নিষ্ঠা তু কা কৃষ্ণ সত্ত্বম্-আহো রজঃ-তমঃ।। ১।।
অনুবাদঃ অর্জুন জিঙ্গাসা করলেন- হে কৃষ্ণ ! যারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করে শ্রদ্ধা সহকারে দেব-দেবীর পূজা করে, তাদের সেই নিষ্ঠা কি সাত্ত্বিক, রাজসিক না তামসিক।
তাৎপর্যঃ চতুর্থ অধ্যায়ের ঊনচত্বারিংশম শ্লোকে বলা হয়েছে যে,কোনও বিশেষ ধরনের আরাধনার প্রতি শ্রদ্ধাবান হলে কালক্রমে জ্ঞান লাভ হয় এবং পরা শান্তি ও সমৃদ্ধির পরম সিদ্ধি লাভ করা যায়। ষোড়শ অধ্যায়ের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, যারা শাস্ত্র - নির্দেশিত বিধির অনুশীলন করে না,তাদের বলা হয় অসুর এবং যাঁরা শ্রদ্ধা সহকারে শাস্ত্রের অনুশাসনাদি মেনে চলেন, তাঁদের বলা হয় সুর বা দেব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যদি শ্রদ্ধা সহকারে কোন নীতির অনুশীলন করে যার উল্লেখ শাস্ত্রে নেই, তার কি অবস্থা। অর্জুনেরর মনের এই সংশয় শ্রীকৃষ্ণকে দুর করতে হবে। যারা একটি মানুষকে বেছে নিয়ে তার উপর বিশ্বাস অর্পণ করে এক ধরনের ভগবান তৈরি করে নেয়,তারা কি সত্ত্বগুণ, রজোগুণ কিংবা তমোগুণের বশবর্তী হয়ে আরাধনা করতে থাকে? ঐ ধরনের লোকেরা কি জীবনে সিদ্ধি লাভের পর্যায়ে উপনীত হয়? তাদের পক্ষে কি যথার্থ জ্ঞান লাভ করে পরম সিদ্ধির স্তরে উন্নীত হওয়া সম্ভব? যারা শাস্ত্রবিধির অনুশীলন করে না,কিন্তু শ্রদ্ধা সহকারে বিভিন্ন দেব- দেবীর ও মানুষের পূজা করে, তারা কি তাদের প্রচেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে? অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে এই সমস্ত প্রশ্ন জিঙ্গাসা করেছেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ত্রিবিধা ভবতি শ্রদ্ধা দেহিনাম্ সা স্বভাবজা।
সাত্ত্বিকী রাজসী চ-ত্রব তামসী চ-ইতি তাম্ শৃণু।।২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- দেহীদের স্বভাব জনিত শ্রদ্ধা তিন প্রকার -- সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী। এখন এই সম্বন্ধে শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ যারা শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধি সম্বন্ধে অবগত হওয়া সত্ত্বেও আলস্য বা বৈমুখ্যবশত এই সমস্ত বিধির অনুশীলন করে না, তারা জড়া প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের পূর্বকৃত সত্ত্বগুণ, রজোগুণ অথবা তমোগুণাশ্রিত কর্ম অনুসারে তারা বিশেষ ধরনের প্রকৃতি অর্জন করে। প্রকৃতির বিভিন্ন গুণাবলীর সঙ্গে জীবের আসঙ্গ চিরকাল ধরেই চলে আসছে, যেহেতু জীবসত্তা জড়া প্রকৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে, সেই জন্য জড় গুণের সঙ্গে তার আসঙ্গ অনুসারে সে বিভিন্ন ধরনের মানসিকতা অর্জন করে থাকে। কিন্তু যদি সে কোন সদ্ গুরুর সঙ্গ লাভ করে এবং তার নির্দেশিত অনুশাসনাদি ও শাস্ত্রাদি মেনে চলে, তা হলে তার প্রকৃতি বদলাতে পারা যায়। ক্রমশ, সেভাবেই মানুষ তম থেকে রজ, কিংবা রজ থেকে সত্ত্বে তার অবস্থার উন্নতি সাধন করতে পারে। এই থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রকৃতির কোনও এক বিশেষ গুণের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের ফলে মানুষ পূর্ণ সার্থকতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না। সব কিছুই সতর্কতার সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে, সদ্ গুরুর
সান্নিধ্যে বিবেচনা করতে হয়। এভাবেই মানুষ প্রকৃতির উচ্চতর গুণগত পর্যায়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সত্ত্বানুরূপা সর্বস্য শ্রদ্ধা ভবতি ভারত।
শ্রদ্ধা-ময়ঃ-অয়ম্ পুরুষঃ যঃ যৎ-শ্রদ্ধঃ সঃ এব সঃ।।৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভারত ! সকলের শ্রদ্ধা নিজ-নিজ অন্তঃকরণের অনুরূপ হয়। যে সেই রকম গুণের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেই রকম শ্রদ্ধাবান।
তাৎপর্যঃ প্রতিটি মানুষেরই, সে যেই হোক না কেন, কোন বিশেষ ধরনের শ্রদ্ধা থাকে। কিন্তু তার স্বভাব অনুসারে সেই শ্রদ্ধা সাত্ত্বিক, রাজসিক অথবা তামসিক হয়। এভাবেই তার বিশেষ শ্রদ্ধা অনুসারে সে এক-এক ধরনের মানুষের সঙ্গ করে। এখন প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে যে, পঞ্চাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, প্রতিটি জীবই মূলত পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ বিভিন্ন অংশ-বিশেষ। তাই, মূলত প্রতিটি জীবই জড়া প্রকৃতির এই সমস্ত গুণের অতীত। কিন্তু কেউ যখন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে তার সর্ম্পকের কথা ভুলে যায় এবং বদ্ধ জীবনে জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসে, তখন সে বৈচিত্র্যময় জড়া প্রকৃতির সঙ্গ অনুসারে নিজের অবস্থান গড়ে তোলে। তার ফলে তার যে কৃত্রিম বিশ্বাস ও উপাধি তা জড়- জাগতিক। কেউ যদিও কতকগুলি সংস্কার বা ধারণার বশবর্তী হয়ে পরিচালিত হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে হচ্ছে নির্গুণ বা গুণাতীত। তাই, পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে তার সর্ম্পক পূনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য তাকে তার জন্ম-জন্মান্তরে সঞ্চিত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হতে হবে। সেটিই হচ্ছে নির্ভয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার একমাত্র পন্থা -- কৃষ্ণভাবনামৃত। কৃষ্ণভাবনামৃত যিনি লাভ করেছেন, তিনি নিশ্চিতভাবে সিদ্ধ স্তরে অধিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু কেউ যদি আত্মজ্ঞান লাভের পন্থা অবলম্বন না করেন,তা হলে তিনি অবশ্যই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিচালিত হবেন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অশাস্ত্রবিহিতম্ ঘোরম্ তপ্যন্তে যে তপঃ জনাঃ।
দম্ভ-অহঙ্কার-সংযুক্তাঃ কাম্-রাগ-বল-অন্বিতাঃ।।৫।।
কর্ষয়ন্তঃ শরীরস্থম্ ভূতগ্রামম্-অচেতসঃ।
মাম্ চ-এব-অন্তঃ-শরীরস্থম্ তান্ বিদ্ধি-আসুর-নিশ্চয়ান্।।৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- দম্ভ ও অহঙ্কারযুক্ত এবং কামনা ও আসক্তির প্রভাবে বলান্বিত হয়ে যে সমস্ত অবিবেকী ব্যক্তি তাদের দেহস্থ ভূতসমূহকে এবং অন্তরস্থ পরমাত্মাকে ক্লেশ প্রদান করে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘোর তপস্যার অনুষ্ঠান করে, তাদেরকে নিশ্চিতভাবে আসুরিক বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ কিছু মানুষ আছে যারা নানা রকম তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন ঊদ্ভাবন করে, যা শাস্ত্রবিধানে উল্লেখ নেই। যেমন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনশন করা। এই ধরনের অনশন করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়নি। শাস্ত্রের নির্দেশ হচ্ছে কেবলমাত্র পারমার্থিক উন্নতি সাধনের জন্যই অনশন করা উচিত। কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তা উচিত নয়। এই ধরনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা তপশ্চর্যা করে, ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে যে, তারা অবশ্যই আসুরিক ভাবাপন্ন। তাদের কার্যকলাপ শাস্ত্রবিধির বিরোধী এবং তার ফলে জনসাধারণের কোন মঙ্গল হয় না। প্রকৃতপক্ষে, তারা গর্ব, অহঙ্কার, কাম ও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত হয়ে ঐ সমস্ত কর্ম করে। এই ধরণের কাজকর্মের ফলে যে সমস্ত
জড় উপাদান দিয়ে দেহ তৈরি হয়েছে তা-ই যে কেবল বিক্ষুব্ধ হন তা নয়, পরম পুরুষোত্তম ভগবান যিনি এই শরীরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন, তিনিও ক্ষুব্ধ হন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই ধরনের অবিধিপূর্বক অনশন বা তপস্যা অপরের কাছে উৎপাত-স্বরূপ। এই রকম তপস্যার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা মনে করতে পারে যে, এই উপায় অবলম্বন করে তারা তাদের শত্রুকে অথবা অন্য দলকে তাদের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করতে বাধ্য করতে পারে, কিন্তু এই ধরনের অনশনের ফলে অনেক সময় তাদের মৃত্যু ঘটে। পরম পুরুষোত্তম ভগবান এই ধরনের কাজ অনুমোদন করেননি
এবং তিনি বলেছেন যে, যারা এই ধরনের কাজে প্রবৃত্ত হয়, তারা অসুর। এই ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতিও অসম্মানসূচক, কারণ বৈদিক শাস্ত্রের অনুশাসন আদি অমান্য করে তা করা হয়। অচেতসঃ কথাটি এই সম্পর্কে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সুস্থ স্বাভাবিক মনোভাবাপন্ন মানুষেরা অবশ্যই অনুশাসনগুলি পালন করে চলেন। যারা তেমন মনোভাবাপন্ন নয়, তারা শাস্ত্রের নির্দেশ অবহেলা করে তাদের নিজেদের মনগড়া তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন পন্থা উদ্ভাবন করে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষের যে পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে তা সব সময় মনে রাখা উচিত। ভগবান তাদের আসুরিক যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য করেন। তার ফলে তারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে তাদের নিত্য সম্পর্কের কথা জানতে না পেরে, জন্ম-জন্মান্তরে আসুরিক জীবন- যাপন করতে থাকবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
আহারঃ-তু-অপি সর্বস্য ত্রিবিধো ভবতি প্রিয়ঃ।
যজ্ঞঃ-তপঃ-তথা দানম্ তেষাম্ ভেদম্-ইমম্ শৃণু।।৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সকল মানুষের আহারও তিন প্রকার প্রীতিকর হয়ে থাকে। তেমনই যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ। এখন তাদের এই প্রভেদ শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির গুণের বিভিন্ন অবস্থা অনুসারে আহার, যজ্ঞ অনুষ্ঠান,তপশ্চর্যা ও দান বিভিন্নভাবে সাধিত হয়। এই সমস্ত একই পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হয় না। যাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারেন যে, জড় জগতের কোন্ গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোন্ কর্ম সাধিত হয়েছে, তাঁরাই হচ্ছেন যথার্থ জ্ঞানী। যারা মনে করে, সব রকমের যজ্ঞ, খাদ্য অথবা দান সমপর্যায়ভুক্ত, তাদের পার্থক্য নিরূপণ করবার ক্ষমতা নেই, তারা মূর্খ। কিছু ধর্ম-প্রচারক এখন প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, মানুষ নিজের ইচ্ছামতো যা ইচ্ছা তাই করে যেতে পারে এবং এই ধরনের যথেচ্ছাচার করার ফলেই তাদের পরমার্থ সাধিত হবে। কিন্তু এই ধরনের মূর্খতা প্রচারকেরা বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশের অনুসরণ করছে না। তারা নিজেদের মনগড়া পন্থা তৈরি করে জনসাধারণকে বিপথগামী করছে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
আয়ুঃ-সত্ত্ব-বল-আরোগ্য-সুখ-প্রীতি-বিবর্ধনাঃ।
রস্যাঃ স্থিরাঃ হৃদ্যাঃ আহারাঃ সাত্ত্বিক-প্রিয়াঃ।।।৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- যে সমস্ত আহার আয়ু, সত্ত্ব, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বর্ধনকারী এবং রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, স্থায়ী ও মরোরম, সেগুলি সাত্ত্বিক লোকদের প্রিয়।
কটু-অম্ল-লবন-অত্যুষ্ণ-তীক্ষ্ণ-রুক্ষ-বিদাহিনঃ।
আহারাঃ রাজসস্য-ইষ্টা দুঃখ-শোক-আময়প্রদাঃ।।৯।।
অনুবাদঃ যে সমস্ত আহার অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ণ, অতি শুষ্ক, অতি প্রদাহকর এবং দৃঃখ, শোক ও রোগপ্রদ, সেগুলি রাজসিক ব্যক্তিদের প্রিয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যাতযামম্ গতরসম্ পূতি পর্যুষিতম্ চ যৎ।
উচ্ছিষ্টম্ চ-অমেধ্যম্ ভোজনম্ তামস-প্রিয়ম্।।১০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- আহারের এক প্রহরের অধিক পূর্বে রানা করা খাদ্য, যা নীরস, দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী এবং অপরের উচ্ছিষ্ট দ্রব্য ও অমেধ্য দ্রব্য, সেই সমস্ত তামসিক লোকদের প্রিয়।
তাৎপর্যঃ খাদ্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে আয়ু বর্ধন করা, মনকে পবিত্র করা এবং শরীরের শক্তি দান করা। সেটিই হচ্ছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য। পুরাকালে মুনি-ঋষিরা বলদায়ক, আয়ুবর্ধক সমস্ত
খাদ্যদ্রব্য নির্বাচন করে গেছেন, যেমন দুর্গন্ধজাত খাদ্য, শর্করা, অন্ন, গম, ফল ও শাক-সবজি। যারা সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন, তাদের কাছে এই ধরনের খাদ্য অত্যন্ত প্রিয়। অন্যকিছু খাদ্যদ্রব্য,যেমন ভুট্রার খই ও গুড় খুব একটা সুস্বাদু নয়, কিন্তু দুধ বা অন্য কোন খাদ্যের সঙ্গে মিশ্রিত হওয়ার ফলে সেগুলি খুব সুস্বাদু হয়ে ওঠে। তখন সেগুলি সাত্ত্বিক আহারে পরিনতি হয়। এই সমস্ত খাদ্যগুলি স্বাভাবিকভাবেই পবিত্র। এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য মদ্য, মাংস আদি অস্পৃশ্য বস্তু থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র। অষ্টম শ্লোকে যে স্নিগ্ধ বা স্নেহজাতীয় খাদ্যের বর্ণনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে হত্যা করা পশুর চর্বির কোন সর্ম্পক নেই। সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে খাদ্য দুধ, তাতে যথেষ্ট পরিমাণে স্নেহ পর্দাথ আছে। দুধ, মাখন, ছানা এবং এই জাতীয় পর্দাথের যে পরিমাণ স্নেহ পর্দাথ পাওয়া যায়, তাতে আর নিরীহ পশু হত্যা করার কোন প্রয়োজন থাকে না। শুদু মাত্র পাশবিক মনোবৃত্তির ফলে এই সমস্ত পশু হত্যা হয়ে চলছে। সভ্য উপায়ে স্নেহ পর্দাথ পাওয়ার পন্থা হচ্ছে দুধ। নরপশুরাই কেবল পশু হত্যা করে থাকে। ছোলা, মটর, গম আদিতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন বা অন্নসার পাওয়া যায়।
রাজসিক খাদ্য হচ্ছে সেই সমস্ত খাদ্য, যা তিক্ত, অত্যন্ত লবণাক্ত বা অতি উষ্ণ অথবা অতিরিক্ত শুকনো লঙ্কা মিশ্রিত, যার ফলে উদরে কফ উৎপন্ন হয়ে শ্লেষ্মা প্রদান করে এবং অবশেষে রোগ দেখা দেয়। আর তামসিক আহার হচ্ছে সেগুলি, যা টাটকা নয়। যে খাদ্য আহার করার কম করে তিন ঘন্টা আগে রান্না করা হয়েছে ( ভগবৎ প্রসাদ ব্যতীত) তা তামসিক আহার বলে গণ্য করা হয়। যেহেতু তা পচতে শুরু করেছে, তাই এই সমস্ত খাদ্য দুর্গন্ধযুক্ত। সেগুলি তমোগুণ সম্পন্ন মানুষকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন মানুষেরা তা সহ্য করতে পারে না।
উচ্ছিষ্ট খাদ্য তখনই গ্রহন করা উচিত তা যদি ভগবান নিবেদিত হয় বা মহাত্মার, বিশেষ করে গুরুজনের উচ্ছিষ্ট হয়। তা না হলে উচ্ছিষ্ট খাদ্য তামসিক বলে গন্য হয়।
শ্রেষ্ঠ খাদ্য হচ্ছে সেই সমস্ত খাদ্য, যা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নিবেদন করা হয়। ভগবদ্ গীতায় ভগবান বলেছেন যে , শাক-সবজি, ময়দা, দুগ্ধ আদি প্রস্তুত আহার্য যখন ভগবানকে ভক্তি সহকারে নিবেদন করা হয় তিনি তা গ্রহন করেন। পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ম্।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অফলাকাঙ্ক্ষিভিঃ-যজ্ঞঃ বিদিদিষ্টঃ য
ইজ্যতে।
যষ্টব্যম্-ত্রব-ইতি মনঃ সমাধায় সঃ সাত্ত্বিক।। ১১।।
অনুবাদঃ ফলের আকাঙ্ক্ষা রহিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক শাস্ত্রের বিধি অনুসারে অনুষ্ঠান করা কর্তব্য এভাবেই মনকে একাগ্র করে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তা সাত্ত্বিক যজ্ঞ।
তাৎপর্যঃ সাধারণত মানুষ কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে যে, কোনও রকম ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা উচিত। কর্তব্যবোধে আমাদের যজ্ঞ করা উচিত। মন্দির ও গির্জাগুলিতে যেভাবে সমস্ত আচার অনুষ্ঠান করা হয়, তা সাধারণত অনুষ্ঠিত হয় জড়- জাগতিক লাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তা সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন নয়। কর্তব্যবোধে মানুষের মন্দিরে বা গির্জায় যাওয়া উচিত এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা, পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করা ও নৈবেদ্য নিবেদন করা উচিত। সকলেই মনে করে যে, কেবল ভগবানের আরতি করার জন্য মন্দিরে গিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু অর্থ লাভের জন্য ভগবানের উপাসনার কথা শাস্ত্রে অনুমোদিত হয়নি। ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করার জন্যই সেখানে যাওয়া উচিত। তার ফলে মানুষ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সভ্য মানুষের কর্তব্য হচ্ছে শাস্ত্রের নির্দেশ পালন করা এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অভিসন্ধায় তু ফলম্ দম্ভ-অর্থম্-অপি চ-এব যৎ।
ইজ্যতে ভরতশ্রেষ্ঠ তম্ যজ্ঞম্ বিদ্ধি রাজসম্।। ১২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- হে ভারতশ্রেষ্ঠ ! কিন্তু ফল কামনা করে দম্ভ প্রকাশের জন্য যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাকে রাজসিক যজ্ঞ বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ কখনও কখনও স্বর্গলোক প্রাপ্তির জন্য অথবা কোন জাগতিক লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে যজ্ঞ ও বৈদিক আচার অনুষ্ঠান করা হয়। এই ধরনের যজ্ঞ বা আচার অনুষ্ঠান রাজসিক বলে গণ্য করা হয়।
বিধিহীনম্-অসৃষ্টান্নম্ মন্ত্রহীনম্-অদক্ষিণম্।
শ্রদ্ধাবিরহিতম্ যজ্ঞম্ তামসম্ পরিচক্ষতে।।১৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শাস্ত্রবিধি বর্জিত, প্রসাদান্ন বিতরণহীন, মন্ত্রহীন, দক্ষিণাবিহীন ও শ্রদ্ধারহিত যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলা হয়।
তাৎপর্যঃ তমোগুণে শ্রদ্ধা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে অশ্রদ্ধা। কখনও কখনও মানুষ টাকা-পয়সা লাভের আশায় কোন কোন দেব-দেবীর পূজা করে থাকে এবং তারপর শাস্ত্র-নির্দেশের সম্পূর্ণ অবহেলা করে নানা রকম আমোদ-প্রমোদে সমস্ত অর্থ ব্যয় করে। এই ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ লোকদেখানো ধর্ম অনুষ্ঠানকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করা হয়। এই সমস্তই হচ্ছে তামসিক। তার ফলে আসুরিক মনোভাবের উদয় হয় এবং মানব-সমাজের তাতে কোন মঙ্গল সাধিত হয় না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দেব-দ্বিজ-গুরু-প্রাজ্ঞ-পূজনম্ শৌচম্-আর্জবম্।
ব্রক্ষচর্যম্-অহিংসা চ শারীরম্ তপঃ উচ্যতে।।১৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ব্রাহ্মণ, গুরু ও প্রাজ্ঞগণের পূজা এবং শৌচ, সরলতা, ব্রক্ষচর্য ও অহিংসা --এগুলিকে কায়িক তপস্যা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান এখানে বিভিন্ন ধরনের তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যাখ্যা করছেন। প্রথমে তিনি কায়িক তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনেরর কথা বলেছেন। পরমেশ্বর ভগবানকে, দেব-দেবীকে, সিদ্ধ পুরুষকে, সদ্ ব্রাহ্মণকে, সদ্ গুরুকে এবং পিতা-মাতা আদি গুরুজনদেরকে অথবা যাঁরা বৈদিক জ্ঞান সম্বন্ধে অবগত, তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধা করা উচিত অথবা তাদের শ্রদ্ধা করার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এদের সকলকে যথাযথ সম্মানী দেওয়া উচিত। বাইরে ও অন্তরে নিজেকে পরিস্কার রাখার অনুশীলন করা উচিত এবং আচার ব্যবহারে সহজ সরল হতে শেখা উচিত। শাস্ত্রে যা অনুমোদন করা হয়নি, কখনই করা উচিত নয়। কখনই অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীসঙ্গ করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর কোন মতেই নয়। একে বলা হয় ব্রক্ষচর্য। এগুলি হচ্ছে দেহের তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অনুদ্বেগকরম্ বাক্যম্ সত্যম্ প্রিয়-হিতম্ চ যৎ।
স্বাধ্যায়-অভ্যসনম্ চ-ত্রব বাঙ্ময়ম্ তপ উচ্যতে।।১৫ ।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- অনুদ্বেগকর, সত্য, প্রিয় অথচ হিতকর বাক্য এবং বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করাকে বাচিক তপশ্চর্যা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ এমনভাবে কোন কথা বলা উচিত নয়, যার ফলে মন উত্তেজিত হতে পারে। তবে শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের
শিক্ষা করবার জন্য সত্য' কথা বলতে পারেন, কিন্তু তা যদি অন্যদের, যারা তার শিষ্য নয়, তাদের উত্তেজিত করে তোলে, তা হলে সেখানে তাঁর কথা বলা উচিত নয়। এটিই হচ্ছে বাচোবেগ দমন করার তপশ্চর্যা। এ ছাড়া অর্থহীন প্রজল্প করা উচিত নয়। ভক্তমণ্ডলীতে যখন কথা বলা হয়, তখন তা যেন শাস্ত্র-প্রমাণের উল্লেখ করা উচিত। সেই সঙ্গে, ঐ ধরনের আলোচনা অন্যের কাছে শ্রুতিমধুর হওয়া উচিত। তবেই এই ধরনের আলোচনার মাধ্যমে পরম মঙ্গল লাভ হতে পারে এবং মানব-সমাজের উন্নতি সাধিত হতে পারে। বৈদিক সাহিত্যের অনন্ত ভাণ্ডার রয়েছে এবং সেগুলি পাঠ করা উচিত। একেই বলা হয় বাচোবেগের তপশ্চর্যা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
মনঃপ্রসাদঃ সৌম্যত্বম্ মৌনম্-আত্মবিনিগ্রহঃ।
ভাবসংশুদ্ধিঃ-ইতিত্রতৎ তপঃ মানসম্ -উচ্যতে।।১৬।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- চিত্তের প্রসন্নতা, সরলতা, মৌন, আত্মনিগ্রহ ও ব্যবহারে নিষ্কপটতা-- এগুলিকে মানসিক তপস্যা বলে।
তাৎপর্যঃ মানসিক তপশ্চর্যা হচ্ছে সব রকমের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের ইচ্ছা থেকে মনকে মুক্ত করা। মনকে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে সে সর্বক্ষণ মানুষের কি করে মঙ্গল হবে, সেই চিন্তায় মগ্ন থাকা। মনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হচ্ছে চিন্তায় গাম্ভীর্য। কৃষ্ণভক্তি থেকে কখনই বিচ্যুত হওয়া উচিত নয় এবং সর্বদাই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ পরিত্যাগ করা উচিত। স্বভাকে নির্মল করে গড়ে তোলার উপায় হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া। মনের সন্তোষ তখনই লাভ করা যায়, যখন মনকে সমস্ত ইন্দ্রিয় উপভোগের চিন্তা থেকে দুরে সরিয়ে রাখা যায়। আমরা যতই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের চিন্তা করি, মন ততই অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। বর্তমান যুগে আমরা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য নানা রকম পন্থায় মনকে অনর্থক নিযুক্ত করছি এবং তাই মানসিক শান্তির কোন সম্ভাবনা নেই।
মানসিক শান্তি লাভের শ্রেষ্ঠা উপায় হচ্ছে মহাভারত ও পূরাণ আদি বৈদিক শাস্ত্রে মনকে নিবদ্ধ করা, যা নানা রকম মনোমুগ্ধকর আনন্দদায়ক কাহিনীতে পরিপূর্ণ। এই জ্ঞানের সহয়তা লাভ করে মানুষ পবিত্র হতে পারে। মন যেন সব রকমের কপটতা থেকে মুক্ত থাকে এবং আমাদের উচিত সকলের মঙ্গল কামনা করা। মৌনতা মানে হচ্ছে সর্বক্ষমতা আত্মজ্ঞান লাভের চিন্তাম্ মগ্ন থাকা। এই অর্থে কৃষ্ণভাবনামৃত ভক্ত হচ্ছেন যথার্থ মৌন।
আত্মনিগ্রহের অর্থ হচ্ছে মনকে সব রকমের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা থেকে মুক্ত রাখা। আমাদের অকপট ব্যবহার করা উচিত, তার ফলে আমাদের অস্তিত্ব শুদ্ধ হয়। এই সমস্ত গুণাবলী হচ্ছে মানসিক তপশ্চর্যা।
শ্রীভগবান্ উবাচ
শ্রদ্ধয়া পরয়া তপ্তম্ তপ-তৎ ত্রিবিধম্ নরৈঃ।
আফলাকাঙ্ক্ষিভিঃ-যুক্তৈঃ সাত্ত্বিকম্ পরিচক্ষতে।। ১৭।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ফলাকাঙ্ক্ষা রহিত মানুষের দ্বারা পরম
শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত ত্রিবিধ তপস্যাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে।
সৎকার-পূজার্থম্ তপঃ দম্ভেন চ-ত্রব যৎ।
ক্রিয়তে তৎ-ইহ প্রোক্তম্ রাজসম্ চলম্-অধ্রুবম্।। ১৮।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- শ্রদ্ধা, সম্মান ও পূজা লাভের আশায় দম্ভ সহকারে যে তপস্যা করা হয়, তাকেই এই জগতে অনিত্য ও অনিশ্চিত রাজসিক তপস্যা বলা হয়।
তাৎপর্যঃ অনেক সময় তপশ্চর্যার আচরণ করা হয় মানুষকে আকৃষ্ট করবার জন্য এবং অন্যের কাছ থেকে
সম্মান, শ্রদ্ধা ও পূজা লাভের জন্য। রাজসিক মানুষেরা তাদের অধস্তনদের কাছ থেকে পূজা আদায়ের বন্দোবস্ত করে, তাদের দিয়ে পা ধোয়ায় এবং সম্পদ দান করতে বাধ্য করায়। তপশ্চর্যার আচরণের দ্বারা এই ধরনের কৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলির ব্যবস্থা রাজসিক এবং তার ফল ক্ষণস্থায়ী। তা কিছু দিনের জন্য কেবল থাকে , কিন্তু স্থায়ী হয় না।
।
শ্রীভগবান্ 'উবাচ
মূঢ়-গ্রাহেণ-আত্মনঃ যৎ পীড়য়া ক্রিয়তে তপঃ।
পরস্য-উৎসাদনার্থম্ বা তৎ-তামসম্-উদাহৃতম্।। ১৯।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- মূঢ়োচিত আগ্রহের দ্বারা নিজেকে পীড়া দিয়ে অথবা অপরের বিনাশের জন্য যে তপস্যা করা হয়, তাকে তামসিক তপস্যা বলে।
তাৎপর্যঃ নির্বোধ তপশ্চর্যার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন হিরণ্যকশিপু, যে অমরত্ব লাভ করে দেবতাদের হত্যা করাবার জন্য তপস্যা করছিল। সে ব্রক্ষার কাছে এই সব প্রার্থনা করে, কিন্তু পরিণামে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের হাতে সে নিহত হয়। অসম্ভব কোন কিছু লাভের আশায় যে
তপস্যা করা হয়, তা অবশ্যই তামসিক।
শ্রীভগবান্ উবাচ
দাতব্যম্-ইতি যৎ-দানম্ দীয়তে-অনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তৎ-দানম্ সাত্ত্বিকম্ স্মৃতম্। ২০।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- দান করা কর্তব্য বলে মনে করে প্রত্যুপকারের আশা না করে উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে এবং উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলে।
তাৎপর্যঃ পারমার্থিক কর্মে নিযুক্ত যে মানুষ, তাকেই দান করার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। নির্বিচারে দান করার কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। পারমার্থিক উন্নতিই জীবনের পরম উদ্দেশ্য। তাই তীর্থস্থানে, চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময়, মাসের শেষ অথবা সদ্ ব্রক্ষাণ বা বৈষ্ণবকে অথবা মন্দিরে দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে দান করা উচিত। কখনও কখনও অনুকম্পার বশবর্তী হয়ে গরিবদের দান করা হয়, কিন্তু সেই গরিব লোকটি যদি দানের যোগ্য না হয়, তা হলে সেই দানের ফলে কোন পারমার্থিক উন্নতি সাধিত হয় না। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, নির্বিচারে দান করার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি।
শ্রীভগবান্ উবাচ
যৎ-তু প্রত্যুপকারার্থম্ ফলম্-উদ্দিশ্য বা পূনঃ।
দীয়তে চ পরিক্লিষ্টম্ তৎ-দানম্ রাজসম্ স্মৃতম্।। ২১।।
অদেশকালে যৎ-দানম্-অপাত্রেভ্যঃ-চ দীয়তে।
অসৎকৃতম্-অবজ্ঞাতম্ তৎ-তামসম্-উতাহৃতম্।।২২।।
অনুবাদঃশ্রীভগবান্ বললেন- যে দান প্রত্যুপকারের আশা করে অথবা ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং অনুতাপ সহকারে করা হয়, সেই দানকে রাজসিক দান বলে।
অশুচি স্থানে, অশুভ সময়ে, অযোগ্য পাত্রে, অনাদরে এবং অবজ্ঞা সহকারে যে দান করা হয়, তাকে তামসিক দান বলা হয়।
তাৎপর্যঃ কখনও কখনও স্বর্গলোকে উন্নীত হওয়ার জন্য দান করা হয়, কখনও আবার গভীর বিরক্তির সঙ্গে দান করা হয় এবং কখনও দান করার পরে অনুশোচনা হয় যে," কেন আমি এভাবে এতগুলি টাকা নষ্ট করলাম"। কখনও আবার গুরুজনের অনুরোধে
বাধ্য হয়ে দান করতে হয়। এই ধরনের দানগুলিকে রাজসিক বলে গণ্য করা হয়।
অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে যারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগে লিপ্ত প্রতিষ্ঠানের উপহার সামগ্রী দান করে থাকে। এই ধরনের দান কে বৈদিক শাস্ত্রে অনুমোদন করা হয়নি। কেবল মাত্র সাত্ত্বিকভাবে দানের নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
নেশা করা বা জুয়াখেলার জন্য দান করতে এখানে উৎসাহিত করা হয়নি। এই ধরনের সমস্ত দান তামসিক। এই ধরনের দানের ফলে কোন লাভ হয় না।
উপরন্তু পাপকর্মে লিপ্ত সমস্ত মানুষগুলি প্রশয় পায়। তেমনই, কেউ যদি আবার অশ্রদ্ধার সঙ্গে এবং অবহেলা করে যোগ্য পাত্রেও দান করে, তা হলে সে দানকে তামসিক বলে গণ্য করা হয়।
শ্রীভগবান্ উবাচ
ওঁ তৎ-সৎ-ইতি নির্দেশঃ ব্রক্ষণঃ-ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ।
ব্রাক্ষণঃ-তেন বেদাঃ-চ যজ্ঞাঃ-চ বিহিতাঃ পুরা।।২৩।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- ওঁ তৎ সৎ -- এই তিনপ্রকার ব্রক্ষ-নির্দেশক নাম শাস্ত্রে কথিত আছে। পুরাকালে সেই নাম দ্বারা ব্রাক্ষণগণ, বেদসমূহ ও যজ্ঞসমূহ বিহিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তপস্যা,যজ্ঞ,দান ও আহার তিনভাগে বিভক্ত---সাত্ত্বিক,রাজসিক ও তামসিক। কিন্তু উত্তমই হোক, মধ্যমই হোক বা কনিষ্ঠই হোক,সে সবই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কুলষিত। যখন সেগুলি পারমার্থিক উন্নতি সাধনের উপায়-স্বরূপ হয়ে ওঠে। শাস্ত্রের নিদের্শসমূহ সেই উদ্দেশ্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। ওঁ তৎ সৎ ---এই তিনটি শব্দ নির্দিষ্টভাবে পরমতত্ত্ব পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে সূচিত করে। বৈদিক মন্ত্রে সর্বদাই ওঁ শব্দটির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। যে শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে আচরণ করে না, সে কখনই পরম-তত্ত্বকে প্রাপ্ত হতে পারবে না। তার পক্ষে কোন সাময়িক ফল লাভ হতে পারে, কিন্তু তার জীবনের পরম অর্থ সাধিত হয় না। সুতরাং সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, যজ্ঞ, তপস্যা অবশ্যই সাত্ত্বিকভাবে অনুষ্ঠান করতে হবে। রাজসিক বা তামসিকভাবে সেগুলি অনুষ্ঠিত হলে তা অবশ্যই নিকৃষ্ট। ওঁ তৎ সৎ ---এই তিনটি শব্দ পরমেশ্বর ভগবানের পবিত্র নামের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়, যেমন ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ। যখনই কোন বৈদিক মন্ত্র বা পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য নামের উচ্চারণ করা হয়,তার সঙ্গে ওঁ শব্দটি যুক্ত হয়। সেই কথা বৈদিক শাস্তে বলা হয়েছে। এই তিনটি শব্দ বৈদিক মন্ত্র থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ওঁ ইত্যেতদ্ ব্রক্ষণো নেদিষ্ঠং নাম (ঋক্ বেদ) প্রথম লক্ষকে সূচিত করে। তারপর তত্ত্বমসি ( ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬-৮-৭) দ্বিতীয় লক্ষ্য সূচনা করে এবং সদেব সৌম্য ( ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬-২-১) তৃতীয় লক্ষ্যকে সূচিত করে। একত্রে তারা ওঁ তৎ সৎ। পুরাকালে প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রক্ষা যখন যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন,তখন তিনি এই তিনটি শব্দের দ্বারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নির্দেশ করেছিলেন। অতত্রব গুরু-পরস্পরাতেও এই তত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং, এই মন্ত্রটির বিপুল তাৎপর্য রয়েছে। তাই ভগবদ্ গীতায় অনুমোদিত হয়েছে যে,যে কোন কর্মই করা হোক না কেন , তা যেন ওঁ তৎ সৎ অথবা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের জন্য কর হয়। কেউ যখন এই তিনটি শব্দ সহকারে তপস্যা,দান, যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন,তখন বুঝতে হবে তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করছেন। কৃষ্ণভাবনা হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান সমন্বিত অপ্রাকৃত কর্ম যা অনুশীলন করার ফলে আমরা আমাদের নিত্য আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারি। এই রকম অপ্রাকৃত করে কোন রকম শক্তি ক্ষয় হয় না।
শ্রীভগবান্ উবাচ
তস্মাৎ ওঁ ইতি-উদাহৃত্য যজ্ঞ-দান-তপঃ-ক্রিয়াঃ।
প্রবর্তন্তে বিধানোক্তাঃ সততম্ ব্রক্ষবাদিনাম্।।২৪।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- সেই হেতু ব্রক্ষবাদীদের যজ্ঞ, দান,তপস্যা ও ক্রিয়াসমূহ সর্বদাই ওঁ এই শব্দ উচ্চারণ করে শাস্ত্রের বিধান অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
তাৎপর্যঃ ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ ( ঋক বেদ ১-২২-২০)। শ্রীবিষ্ণুর শ্রীচরণ-কমল হচ্ছে পরা ভক্তির পরম আশ্রয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত কর্ম হচ্ছে সমস্ত কর্মের সার্থকতা।
তৎ ইতি-অনভিসন্ধায় ফলম্ যজ্ঞ-তপঃ-ক্রিয়াঃ।
দান-ক্রিয়া-চ বিবিধাঃ ক্রিয়ন্তে মোক্ষকাঙ্ক্ষিভিঃ।।২৫।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বললেন- মুক্তিকামীরা ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে 'তৎ' এই শব্দ উচ্চারণ- পূর্বক নানা প্রকার যজ্ঞ, তপস্যা, দান আদি কর্মের অনুষ্ঠান করেন।
তাৎপর্যঃ চিন্ময় স্তরে উন্নীত হতে হলে জড়-জাগতিক লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কর্ম করা উচিত নয়। চিন্ময় জগৎ ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়ার পরম উদ্দেশ্য নিয়ে সমস্ত কর্ম করা উচিত।
শ্রীভগবান্ উবাচ
সদ্ভাবে সাধুভাবে চ সৎ-ইতি-ত্রতৎ প্রযুজ্যতে।
প্রশস্তে কর্মণি তথা সচ্ছব্দঃ পার্থ যুজ্যতে।।২৬ ।।
যজ্ঞে তপসি দানে চ স্থিতিঃ সৎ-ইতি চ-উচ্যতে।
কর্ম চ-এব তৎ-অর্থীয়ম সৎ-ইতি-ত্রব-অভিধীয়তে।।২৭।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! সৎভাবে ও সাধুভাবে ' সৎ 'এই শব্দটি প্রযুক্ত হয়।
তেমনই শুভ কর্মসমূহে ' সৎ' শব্দ ব্যবহৃত হয়। যজ্ঞে তপস্যায় ও দানে ' সৎ ' শব্দ উচ্চারিত হয়। যেহেতু ঐ সকল কর্ম ব্রক্ষোদ্দেশক হলেই ' সৎ ' শব্দে অভিহিত হয়।
তাৎপর্যঃ প্রশস্তে কর্মণি কথাগুলির অর্থ এই যে, বৈদিক শাস্ত্রে নানা রকম পবিত্রকারক কাজকর্ম করার নির্দেশ দেওয়া আছে, যা শৈশবে পিতা-মাতার তত্ত্ববধানে খেকে শুরু করে জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত পালন করা উচিত। জীবনের পরম সিদ্ধি লাভ করার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত পবিত্রকারক কর্তব্যগুলি অনুষ্ঠান করা হয়। এই সমস্ত কাজকর্মে ওঁ তৎ সৎ মন্ত্র উচ্চারণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সদ্ভাবে ও সাধুভাবে শব্দগুলি দিব্য অবস্থাদি নির্দেশ করে। কৃষ্ণভাবনাময় কাজকর্মকে বলা হয় সত্ত্ব এবং যিনি কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম সম্বন্ধে সর্ম্পূণ সচেতন, তাকে বলা হয় ' সাধু'। শ্রীমদ্ভগবতে (৩-২৫-২৫) বলা হয়েছে যে, সাধুসঙ্গ করার ফলে অপ্রাকৃত বিষয়বস্তু সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে অবগত হওয়া যায়। এই সর্ম্পকে শ্রীমদ্ভগবতে যে কথাগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, তা হচ্ছে সতাং প্রসঙ্গাৎ। সাধুসঙ্গ ব্যতীত
দিব্যজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। যখন দীক্ষা বা উপবীত দান করা হয়, তখন ওঁ তৎ সৎ শব্দগুলি উচ্চারণ করা হয়। তেমনই, সব রকম যজ্ঞানুষ্ঠানের বিষয় হচ্ছে পরম-তত্ত্ব অর্থাৎ ওঁ তৎ সৎ। তদর্থীয়ম্ শব্দটি আরও বোঝাচ্ছে পরম-তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে এমন যে কোন কিছুর প্রতি সেবা নিবেদন, যেমন রান্না করা ও মন্দিরে সহয়তা করা অথবা ভগবানের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে অন্য যে কোন রকম কাজকর্ম।
সমস্ত কর্মকে পবিত্র করে তোলার উদ্দেশ্যে ওঁ তৎ সৎ শব্দগুলি বহুভাবে
ব্যবহৃত হয় এবং সব কিছুকে সম্যক্ভাবে পরিপূর্ণ করে তোলে।
শ্রীভগবান্ উবাচ
অশ্রদ্ধয়াঃ হুতম্ দত্তম্ তপঃ-তপ্তম্ কৃতম্ চ যৎ।
অসৎ-ইতি-উচ্যতে পার্থ ন চ তৎ প্রেত্য নো ইহ।।২৮।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! অশ্রদ্ধা সহকারে হোম, দান বা তপস্যা যা কিছু অনুষ্ঠিত হয়, তাকে বলা হয় ' অসৎ '। সেই সমস্ত ক্রিয়া ইহলোকে ও পরলোকে ফলদায়ক হয় না।
তাৎপর্যঃপারমার্থিক উদ্দেশ্য রহিত যা কিছুই করা হয়, তা যজ্ঞ হোক, দান হোক বা তপস্যাই হোক, তা সবই নিরর্থক। তাই এই শ্লোকটিতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, সেই সমস্ত কর্ম জঘন্য। সব কিছুই কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে পরব্রহ্মেরর জন্য করা উচিত। এই বিশ্বাস না থাকলে এবং যথার্থ পথপ্রদর্শক না থাকলে কখনই কোন ফল লাভ হবে না। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রে পরম-তত্ত্বের প্রতি বিশ্বাস-পরায়ণ হওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সমস্ত
বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশাদি অনুসরণের চরম লক্ষ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। এই নীতি অনুসরণ না করলে কেউই সাফল্য লাভ করতে পারে না। তাই সদ্ গুরুর তত্ত্ববধানে থেকে প্রথম থেকেই কৃষ্ণভাবনায় ভক্তিযোগের অনুশীলন করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। সব কিছু সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার এটিই হচ্ছে পন্থা।
বদ্ধ অবস্থায় মানুষ দেব-দেবী, ভূত-প্রেত অথবা কুবের যক্ষদের পূজা করার প্রতি আসক্ত থাকে। রজ ও তমোগুণ থেকে সত্ত্বগুণ শ্রেয়। কিন্তু যিনি প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করেছেন, তিনি এই জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের অতীত। যদি ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধন করার পন্থা রয়েছে, তবুও যদি কেউ শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ লাভ করার ফলে সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করতে পারেন,সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা এবং এই অধ্যায়ের সেটিই অনুমোদিত হয়েছে। এভাবেই জীবন স্বার্থক করতে হলে, সর্ব প্রথমে সদ্ গুরুর পাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং তাঁর পরিচালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। তখন পরম-তত্ত্বের প্রতি বিশ্বাসের উদয় হবে। কালক্রমে সেই বিশ্বাস যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, তখন তাকে বলা হয়
ভগবৎ-প্রেম। এই প্রেমই হচ্ছে জীবসমূহের পরম লক্ষ্য। তাই সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করা উচিত। সেটিই হচ্ছে সপ্তদশ অধ্যায়ের বক্তব্য।
ইতি---' শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ ' নামক শ্রীমদ্ভগবদগীতার সপ্তাদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ অন্তে শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা-
ওঁ যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্ ভবেৎ ।
পূর্ণং ভবতু ত্বৎ সর্বং ত্বৎ প্রসাদাৎ জনার্দ্দন ।।
মন্ত্র হীনং ক্রিয়া হীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন ।
যৎ পূজিতং ময়া দেব পরিপূর্ণং তদস্তুমে ।।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন