• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৫ আগস্ট ২০১৭

যুগাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও দ্বারকা নগরী

ম্লেচ্ছ-বিধর্মী ও স্বধর্মীয় কিছু অতি-পণ্ডিত মানুষ সনাতন হিন্দু ধর্মের দেবদেবী নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। সেইসব মানুষেরা ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কে যথেষ্ট খারাপ ভাবে সমালোচনা করে। তাদের উদ্দেশ্যে এই পোস্ট।

যুগাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও দ্বারকা নগরী

=================================

দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত যুগাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পাশবিক শক্তি যখন সত্য সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দরকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার জন্য যুগাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবত গীতার বর্ণনায় শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে বিশৃঙ্খল ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীতে মানবপ্রেমের অমিত বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই সে বাণীর মূল বিষয়। তাই তিনি ভক্তদের কাছে প্রেমাবতার।

দ্বাপর যুগের অস্তিত্ব এবং বর্তমান

==========================


দ্বাপর যুগের অস্তিত্ব এবং বিভিন্ন নিদর্শন বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকার রাজা ছিলেন। বর্তমান ভারতের গুজরাট প্রদেশে জামনগর জেলার গোমতি নদীর তীরে দ্বারকা নগরী অবস্থিত এবং এখানে প্রায় ৮০০ বছর আগে নির্মিত ৫৭ মিটার উঁচু কৃষ্ণ মন্দির আছে। এটাই সমস্ত সন্যাসীদের কাছে দ্বারকা বলে স্বীকৃত। অন্যদিকে মহাভারতে বলা হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃৃক প্রতিষ্ঠিত দ্বারকা সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিল। এই মহাকাব্যের পরিশিষ্ট অংশ হরিবংশে বলা হয়েছে-এই সমৃদ্ধ নগরী ভারতের পশ্চিম উপকূলে যেখানে গোমতী এসে সাগরে মিলেছে সেখানে অবস্থিত।

গোয়ায় অবস্থিত ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অব ওসেনোগ্রাফি এর মেরিন আরকিওলজি সেন্টারের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর ড. এস আর রাও বলেছেন- জলনিমগ্ন দ্বারকা নগরী খুঁজে পাওয়া গেছে। এই প্রবন্ধে তিনি সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ আবিষ্কারের সময় খুঁজে পাওয়া জলের নিচে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরসহ একটা নগরী আবিষ্কারের এক অত্যাশ্চর্য বর্ণনা দেন। রূপকথার গল্প থেকে তিনি তুলে আনেন দ্বারকা কে মানুষের চোখের সামনে। এই স্থানেই পাওয়া গেছে ২১০ টি জাহাজের ভগ্নাবশেষ যা প্রমাণ করে এখানে এক সময় অবস্থিত ছিল এক বিশাল সমুদ্র বন্দর যা আবার মানুষের চোখের সামনে ঊঠে আসছে। ভারতীয় সমুদ্র উপকূলে অনেক প্রাচীন বন্দর ডুবে গেছে তার মাঝে দ্বারকা অন্যতম। যদিও পুরানো দ্বারকার উপরই নতুন দ্বারকা অবস্থিত তবুও এর প্রকৃত পরিচয় ১৯৭৯-৮০ সালের আগে পাওয়া যায়নি।

এ সময় দ্বারকাধীশ মন্দিরের সামনের মাটি খুড়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪ শতকের তিনটি মন্দিরের ধবংসাবশেষ পাওয়া যায় এবং ডুবন্ত নগরীটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা হয়। এর মাঝে খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতকে নির্মিত বিষ্ণু মন্দির সবচেয়ে পুরোনো। এখানে বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও দেবাদিদেবের মূর্তি আছে। প্রথমদিকে মাটির স্থরে একটা লাল মাটির বস্তু পাওয়া গেছে। এটি প্রভাসক্ষেত্রের এবং বয়স ১৫শ খ্রিষ্টপূর্বের (কার্বন ১৪ প্রণালীতে বয়স পাওয়া গেছে)। প্রভাস হচ্ছে আরেকটি মহাভারতীয় তীর্থ যেটি সৌরাষ্ট্রের দক্ষিণে অবস্থিত। আরকিওলজিষ্ট হিসে বোরালা বলেছেন, মহাভারতের যুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ শতকে হবার প্রমাণও পাওয়া গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ শতকে সমুদ্রের তীরে বসতি ছিল বলে প্রমাণ পাওয়ার পর ডুবন্ত দ্বারকার খোঁজার সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল।

বিজ্ঞানীরা কচ্ছ উপকূলে মাটি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন ১০০০০ বছর আগে এই কচ্ছ উপসাগরীয় অঞ্চল ৬০ মিটার নিচু ছিল। হরিবংশে (বিষ্ণু পর্ব- ৫৭-১০৩) একে সমুদ্রের ভেতরে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমান দ্বারকার ৩২ কিমি দুরে খুঁজতে শুরু করেন। এই দ্বারকাতেই পাওয়া গেছে হরপ্পা যুগের পুতির মালা, হাড়ি-পাতিল এবং পলা আকৃতির বিরাট দালানের খন্ডাংশ। এগুলো অনেক প্রাচীন বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। এছাড়া শামুক, ঝিনুক এর তৈরি দেয়াল, সিন্ধু সভ্যতার শঙ্খের সীলমোহরসহ আরো অনেক আরটিফেক্ট এ ভর্তি এই স্থান।

পানির ৬.৪১ মিটার নিচে একটি দুর্গ পাওয়া গেছে, যেটা চুনাপাথরের অর্ধ বৃত্তাকার ব্লক দিয়ে তৈরী। এটি সমুদ্র নারায়ণ মন্দির থেকে ৬০০ মিটার সমুদ্র গভীরে অবস্থিত। এখানে তিন ছিদ্র বিশিষ্ট ত্রিফলা নোঙর উদ্ধার করা হয়েছে- যা ক্ষয় রোধক দেয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হত সাথে সাথে শত্রুর আক্রমণ থেকেও বাঁচাত।

ডুবে যাওয়ার কারণ

===================

বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে- ১০০০০ বছর আগে সমুদ্র পৃষ্ঠ বর্তমান থেকে ৬০ মিটার নিচু ছিল। অতএব ৩৫০০ বছর আগে সমুদ্র ৯ মিটার নিচু ছিল। দ্বারকা ডুবে যাওয়ার কারণ সমুদ্র পৃষ্টের ঊচ্চতা বৃদ্ধি। এভাবে সমুদ্র উপকূল ধ্বংস হতে খুব একটা দেখা যায়না- শুধু মাত্র কার এস সিটি বাহরাইনের এক বন্দর এই সময় এই ডুবে যায়। দুই স্থানের বয়সকাল প্রায় একই বলে নির্ধারন করেছেন বিজ্ঞানীরা। দ্বারকায় যে তৈজসপত্র পাওয়া গেছে তা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন যে এস্থানে অনেক পুরোনো এক সভ্যতা ছিল যা মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীর সাথে মিলে যায়।

মহাভারতে আছে- শ্রীকৃষ্ণের বয়স যখন ১২৫ তখন যদু বংশ ধ্বংস হয় সামান্য এক কারণে। এটা দেখে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম বনবাসী হবার সংকল্প করেন এবং অর্জুনকে সংবাদ পাঠান। বনে শ্রীকৃষ্ণ বসে থাকা অবস্থায় জরা নামে এক ব্যাধ হরিণ মনে করে কৃষ্ণ কে বান মারেন। শ্রীকৃষ্ণ সেখানেই দেহত্যাগ করেন। অর্জুন এই সংবাদ পেয়ে দ্বারকায় এসে শ্রীকৃষ্ণের দেহ সৎকার করেন। এর পর পরই দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়। যে নগরী শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে শাসন করেছিলেন সে নগরী শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর পরই সমুদ্রের মাঝে বিলীন হয়।

Courtesy by: Prithish Gosh
Share:

গুরু নানক

কিছু মহামানবের জ্ঞানতাত্ত্বিক অবদানের কারণেই আজকের এই সমৃদ্ধ মানবজীবন। এই মহামানবেরা আজন্মকাল তাদের চিন্তা ও চেতনা দিয়ে আমাদের জীবন ও জগৎ পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করে গেছেন। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান সব শাখাই সমৃদ্ধ হয়েছে এই মহামানবদের হাতে। যাদের মমতার স্পর্শে মানুষে মানুষে রচিত হয়েছে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন। তাদেরই একজন হচ্ছেন শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক।

ভারতে তখন সুলতানী আমল। পশ্চিম পাঞ্জাবের তালওয়ান্দি (বর্তমান নাম নানকানা সাহেব) গ্রামে থাকতেন মেহেতা কল্যাণ বাই নামে এক সামন্য চাষী। সামান্য কিছু জমিজমা ছিল তার। গাঁয়ের লোক তাকে ডাকত মেহেতা কালু বলে। তার স্থীর নাম ছিল ত্রিপতা। এই ত্রিপতার গর্ভেই ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেছিলন গুরু নানক। ছেলেবেলা থেকেই তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল পিতামাতার। একমাত্র সন্তান। তবু তার সবকিছুই যেন কেমন অদ্ভুত। আত্মভোলার মতো ঘুরে বেড়ান, সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখলেই তাদের কাছে ছুটে যান। নির্জনে বসে থাকেন।

বাবা-মা ভেবেছিল লেখাপড়া করলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। ৬ বছর বয়সে তাই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো গ্রামের পাঠশালায়। সেখানে মাতৃভাষা ছাড়াও শিখেছিলেন ফার্সি ভাষা। তিনবছর পর সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তাকে পাঠানো হলো ব্রিজনাথ শর্মা নামে এক পন্ডিতের কাছে। কিন্ত নানকের পাঠ্যবিষয় বাদ দিয়ে ঈশ্বর, ধর্ম আধ্যাত্নিক বিষয়েই ছিল গভীর আগ্রহ। গতানুগতিক পড়াশুনাতে তার কোনো আগ্রহ নেই দেখে বাবা ঠিক করলেন নানককে বাড়ির গরু –ছাগল চরাবার ভার দেবেন।

একদিন নানক ঘুমিয়ে পড়লে তার গরুর পাল ঘুরতে ঘুরতে একজনের ক্ষেতে ঢুকে পড়ল। ক্ষেতের মালিক নালিশ জানালো জমিদারের কাছে। ডাক পড়লো নানকের। নানক জমিদারের কাছে গিয়ে বললেন, আমার গরু কোনো জমির ফসল নষ্ট করেনি। নানকের কথা শুনে জমিদারের লোকজন মাঠে গিয়ে দেখে জমির ফসল যেমন ছিল তেমনই আছে। ক্ষেতের মালিকতো বিস্ময়ে হতবাক।

নানককে এবার ভর্তি করা হলো ফার্সি ভাষার এক মৌলবীর স্কুলে। কিন্তু পড়ায় কোন মন নেই তার। বই-শ্লেট তুলে রেখে নানক মৌলবীকে জিজ্ঞাসা করে ঈশ্বরের কথা, ধর্মের কথা, এই জগৎ সৃষ্টির কথা। অধিকাংশ প্রশ্নেরই কোনো জবাব দিতে পারেন না মৌলবী। ছেলেকে বিষয়মুখী করতে না পেরে মহাভাবনায় পড়ে গেলেন বাবা। নানকের বোনের স্বামী জয়রাম ছিলেন সুলতান দৌলত খাঁ লোদীর দেওয়ান। অবশেষে তার সুপারিশে সুলতানের গুদাম ঘরের দেখাশুনার চাকরি পেলেন নানক। যখন কোনো দুঃখী মানুষ আসত তিনি গুদাম থেকে খাবার দান করতেন। নিজে যা মাইনে পেতেন তার অর্ধেকই গরিব-দুঃখী মানুষের পেছনে খরচ করতেন। কিন্তু নানকের এই সেবার কাজকে ভালোভাবে দেখত না কিছু মানুষ। তারা সুলতানের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাল, নানক গুদামের মাল বিলেয়ে দিচ্ছে। সুলতান কয়েকজন কর্মচারীর উপর তদন্তের ভার দিলেন। সবকিছু পরীক্ষা করে দেখা গেল গুদামের সব মাল হিসেব মতোই আছে।

এদিকে নানক কাজকর্মে মন দিয়েছে জেনে তার বাবা নানকের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। মেয়ের নাম সুলখানি। এই সুলখানির গর্ভে নানকের দুটি সন্তান জন্ম হয়-শ্রীচাঁদ ও লক্ষ্ণীদাস। একদিন খুব সকালে নানক নদীতে গেলেন গোসল করতে। গোসল শেষ করতেই তার অন্তরে এক অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠল। নিজের অজান্তেই ছুটে গেলেন কিছুদূর একটি পাহাড়ের দিকে। সেখানে পাহাড়ের গুহায় বসে ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেলেন। ভুলে গেলেন ঘর-বাড়ি, সংসার ও স্ত্রী-পুত্র। তিনদিন তিনরাত্রি কেটে গেল। অবশেষে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করলেন নিজ অন্তরে।

প্রায় কুড়ি বছর ধরে নানক দেশে দেশে তার ধর্মপ্রচার করেছিলেন। পাঁয়ে হেটে, বনজঙ্গল, নদী-নালা, কত মরুভূমির রুক্ষ প্রান্তর, পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তাকে চলতে হতো। যেখানেই তিনি যেতেন, ফুলের সৌরভের মতো মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হতো। তিনি তাদের বলতেন, ঈশ্বর এক অদ্বিতীয়। তিনি সকলকে বলতেন, সত্য পথে চল, সৎ জীবন যাপন কর, ঈশ্বরের নামকর। তিনি বলতেন, ঈশ্বর মানুষের ধর্ম দেখেন না। তার জাতি দেখেন না, ধনী –দরিদ্র দেখেন না, তার চোখে সকলেই সমান। তিনি শুধু বিচার করেন মানুষের কর্ম। যে মানুষ যেমন কাজ করবে সে তেমনি ফল ভোগ করবে। ধর্মের নামে কুসংস্কার, গোঁড়ামী, বাহ্যিক আচার-আচরণকে তিনি কঠোর ভাষায় নিন্দা করতেন।

একবার নানক স্থির করলেন, মুসলমানদের দুই পবিত্র তীর্থস্থান মক্কা আর মদিনায় যাবেন। নানকের সঙ্গী হন পীর সৈয়দ আহমেদ হাসান ও পীর জালালউদ্দীন। এরা মুসলামান হলেও নানকের আধ্যাত্বিক শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নানকের পরনে মুসলমান দরবেশের পোষাক। মক্কা-মদিনা হয়ে নানক যান প্যালেষ্টাইন। বহু দিন নিজের স্বদেশভূমি ত্যাগ করে এসেছেন এবার ফেরার পথ ধরলেন নানক। পথ চলতে চলতে নানক নির্জন প্রান্তরে এসে পৌঁছলেন। দীর্ঘ পথশ্রমে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এক শিষ্যকে বললেন, দেখতো কাছাকাছি কোথাও জল আছে কিনা। শিষ্য গিয়ে দেখে কাছের গ্রামে একটা পুকুর রয়েছে। কিন্তু পুকুরে এক ফোটা জল নেই। শিষ্য ফিরে এসে সব কথা বলতেই নানক বললেন, গুরুর নাম করে সেখানে আবার যাও জল পাবে। এবার পুকুরে যেতেই শিষ্য বিস্ময়ে হতবাক, সমস্ত পুকুর জল আর জল, কি অপূর্ব সে জলর স্বাদ। ঠিক যেন অমৃত। লোকে তার নাম দিল অমৃত সায়র। আর তার থেকেই অমৃতসর কথাটির উৎপত্তি। ১৮০২ সালে মহারাজ রঞ্জিত সিং ওই পুকুর সংস্কার করে স্বর্ণমন্দির স্থাপন করেন। এই স্বর্ণমন্দির শিখদের এক পবিত্র তীর্থ।

১৫৩৯ সালের কথা- নানক বুঝতে পেরেছিলেন তার জীবনের কাল শেষ হয়ে এসেছে। তিনি সে কথা বলতেই দলে দলে তার শিষ্যরা এসে উপস্থিত হলো। এদের মধ্যে যেমন ছিল হিন্দু তেমনি ছিল মুসলমান। নানক বুঝতে পেরেছিলেন তার দেহ সৎকার করা নিয়া হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিবাদ দেখা দেবে। তাই দুই দলের শিষ্যদের ডেকে বললেন, তোমরা ফুল নিয়ে এসে আমার দুপাশে রাখ। যাদের ফুল সতেজ থাকবে তারাই আমার দেহের সৎকারের অধিকারী হবে। এবার তোমরা প্রার্থনা শুরু কর।

সমস্ত রাত ধরে চলল প্রার্থনা, ভজন, নামগান। ভোরবেলায় দরজা খুলতেই সকলে দেখল নানকের দেহ নেই। সেখানে রয়েছে রাশিরাশি তাজাফুল। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এইভাবে মৃত্যুর মধ্যেও মানুষের মিলন ঘটিয়ে গেলেন গুরু নানক।

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

মনসা নামের উৎপত্তি

‘মনস’ শব্দের স্ত্রী লিঙ্গে ‘আপ’ প্রত্যয় করে মনসা শব্দের ব্যুৎপত্তি। সুতরাং এই দিক থেকে মনসা মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবী ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ পুরান বলেন – সর্প ভয় থেকে মনুষ্যদের উদ্ধারের জন্য পরম পিতা ব্রহ্মা কশ্যপ মুনিকে বিশেষ মন্ত্র বিশেষ বা বিদ্যা আবিস্কারের কথা বলেন। হয়তো এখানে বিষের ঔষধ আবিস্কারের কথা সেই সাথেও বলা হয়। কশ্যপ মুনি এই বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করছিলেন। তখন তাঁর মন থেকে এক দেবীর সৃষ্টি হয়। তিনটি কারনে দেবীর নাম হয় মনসা।

'সা চ কন্যা ভগবতী কশ্যপস্য চ মানসী ।
তেনৈব মনসা দেবী মনসা বা চ দীব্যতি ।।
মনসা ধ্যায়তে যা চ পরমাত্মানমীশ্বর ম্ ।
তেন যা মনসা দেবী তেন যোগেন দীব্যতি ।।
আত্মারামা চ সা দেবী বৈষ্ণবী সিদ্ধযোগিনী ।' ---- ( দেবীভাগবত পুরাণ )

প্রথমতঃ মনসা কশ্যপ মুনির মানস কন্যা, কেননা চিন্তা ভাবনার সময় মুনির মন থেকে উৎপন্না। দ্বিতীয় মানুষের মন তদীয় ক্রীড়া ক্ষেত্র, তৃতীয়তঃ নিজেও মনে মনে পরমাত্মার ধ্যান করেন বলে দেবীর নাম মনসা। মন মানুষের শত্রু আবার মন মানুষের মিত্র হতে পারে। “মন এব মনুষ্যানাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ।” মন যদি শুদ্ধ, একাগ্র চিত্ত, নিজ বশীভূত, ভগবৎপরায়ণ হয় - ত সেই মন মোক্ষের কারন। তাই এই মনকে ‘মিত্র’ বলা যাবে। কিন্তু মন যদি অশুদ্ধ, চঞ্চল, ইন্দ্রিয় পরায়ণ, ভগবৎ বিমুখ হয়- ত সেই মন নরক গমনের হেতু। এই মন হল শত্রু মন। কশ্যপ মুনি মানব কল্যাণের জন্য ঔষধ আবিস্কারের কথা ভেবেছিলেন - তাই তাঁর মন থেকে দেবীর সৃষ্টি হল। তাই শাস্ত্রের এই শিক্ষা যে, আমাদের সর্বদা কল্যাণকর, হিতকর, ভগবানের কথা-

ইত্যাদি মনে ভাবনা চিন্তা করতে হবে।

মনসা আদিবাসী দেবতা। পূর্বে শুধু নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসা পূজা প্রচলন লাভ করে। মনসার সাথে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের আত্মীয়তা কীভাবে গড়ে উঠলো সেই কথাটা একটু বলি। বর্তমানে মনসা আর আদিবাসী দেবতা নন, বরং তিনি একজন হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁকে নাগ বা সর্পজাতির পিতা কশ্যপ ও মাতা কদ্রুর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ্ মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকেই প্রজনন ও বিবাহ রীতির দেবী হিসেবেও মনসা স্বীকৃতি লাভ করেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন; সেই থেকে তিনি বিষহরি নামে পরিচিতা হন। তাঁর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মনসার পূজকেরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও অবতীর্ণ হন। 

শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনি এরই ফলশ্রুতি। এর পরেই হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করেন। শ্রী আশুতোষ ভট্রাচার্য তার মনসামঙ্গল নামক সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘’এখন দেখিতে হয় পশ্চিম-ভারতের ‘মনসা’ নামটি কখন হইতে জাঙ্গুলী দেবীর পরিবর্তে ব্যবহৃত হইতে আরম্ভ হয়। পূর্বেই বলিয়াছি জাঙ্গুলির সঙ্গে বৌদ্ধ সমাজের সম্পর্ক ছিল, তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবী ছিলেন। পাল রাজত্বের অবসানে সেন রাজত্বের যখন প্রতিষ্ঠা হইল, তখন এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ ও তাহার স্থানে হিন্দুধর্মের পুনরাভ্যুত্থান হইয়াছিল, সেই সময়ে যে সকল বৌদ্ধ দেবদেবীকে নুতন নাম দিয়া হিন্দুসমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হইয়াছিল, এই সর্পদেবী তাহাদের অন্যতম। বৌদ্ধ সংস্রবের জন্য তাঁহার জাঙ্গুলী নাম পরিত্যাক্ত হয় এবং তাহার পরিবর্তে মনসা নামকরণ হয়। বাংলার পূর্বোক্ত অর্বাচীন পুরাণগুলি ইহার কিছুকাল মধ্যেই রচিত হয় এবং তাহার মধ্য দিয়া মনসাকে শিবের কন্যারুপে দাবী করিয়া হিন্দু-সমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হয়।’’

-

মনসা দেবী বা সর্প দেবী হিসাবে পুজা বোধ হয় বৌদ্ধ ধর্ম থেকে এসেছে বৌদ্ধ গ্রন্থেই সর্প দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় । ‘বিনয়বস্তু’ ও ‘সাধনমালা’ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে সর্পের দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে সর্পের দেবীর বর্ণনা আছে। ‘সাধনমালা’ গ্রন্থে সর্প দেবীকে ‘জাঙ্গুলি’ বা ‘জাঙ্গুলিতারা’ বলে উল্লেখ করা আছে। প্রাচীন যুগে সাপের ওঝাকে বলা হতো জাঙ্গুলিক (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস --- ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় জাতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ‘মঞ্চাম্মা’ বা ‘মনোমাঞ্চী’। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর মতে মঞ্চামা নাম থেকেই ‘মনসা’ নামের উৎপত্তি। আবার ডাঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য বৌদ্ধ সর্প দেবী জাঙ্গুলিকেই ‘মনসা’ বলে মানেন।

 তাঁর মতে -- “অত্যন্ত প্রাচীনকাল হইতেই এই পূর্ব ভারতীয় বৌদ্ধ সমাজে জাঙ্গুলীদেবীর পূজা প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনার সূত্র গ্রন্থ 'সাধনমালা'-তে এই জাঙ্গুলী দেবীর পূজার প্রকরণ ও তাহার মন্ত্রের সম্বন্ধে বিস্তৃত উল্লেখ আছে। তাহা হইতে সহজেই অনুমতি হইতে পারে যে, এই জাঙ্গুলীদেবী বর্তমানে সমাজে পূজিতা সর্প দেবী।” গবেষকদের মতে মনসা অনার্য দেবতা, পরে আর্য দের পুরানে স্থান পেয়েছেন। গবেষকরা বলেন বঙ্গদেশ ছিল জঙ্গলে ভরা। সাপের উপদ্রব ছিল বেশী। বাংলা ছিল কৃষি প্রধান। এই বিষাক্ত সাপেদের সাথেই তাঁদের বসবাস ও দ্বন্দ্ব। একটি বিষাক্ত প্রানী, যার ছোবোলেই মৃত্যু। তাই 'মনসা পূজা' বঙ্গদেশে বিশেষ প্রসার পায়। ত্রিপুরা, ওড়িশা, আসাম, দুই বঙ্গ, বিহারে এই পূজোর প্রচলন বেশী। হিমালয়ের পাদদেশে জঙ্গলে ছিল সাপেদের অবাধ বিচরণ ভূমি। মানুষের বসতি বাড়লো, সাপেদের সাথে সংঘাত বাড়লো। প্রথমে নিম্ন জাতির মধ্যে এই পূজোর প্রসার থাকলে কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য দেবী হয়ে ওঠেন মা মনসা।

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

শক্তিরঙ্গ বঙ্গভূমে অন্যতম প্রধান শাক্তপীঠ তারাপীঠ।

বীরভূমের প্রধানতম তীর্থ তারাপীঠ আজ আন্তর্জাতিক কৌতূহলের কেন্দ্রভূমি। শক্তিরঙ্গ বঙ্গভূমে অন্যতম প্রধান শাক্তপীঠ তারাপীঠ। ঠিক কবে এই পীঠস্থান আবিস্কৃত হয়, তা যেমন সঠিক জানা যায় না তেমনই সুস্পষ্ট নয় তারাদেবী সংক্রান্ত খুঁটিনাটি। অতিপ্রাচীন দেবী-শিলা মা উগ্রতারা, বশিষ্ঠদেবের পরম্পরা, সর্বোপরি দিব্যপুরুষ বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় বা বামাক্ষ্যাপাকে ঘিরে চলিত রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। রহস্যের পরে রহস্য আবৃত রেখেছে এই শক্তিপীঠকে।

দেখা যাক রহস্যাবৃত তারাপীঠের কয়েকটি জরুরি তথ্যকে।

১. তারাপীঠ ৫১ পীঠের অন্তর্বর্তী নয়। ‘মহাপীঠপুরাণ’-এ উল্লিখিত পীঠস্থান-তলিকায় তারাপীঠের উল্লেখ নেই। জনচিত্তে অবশ্য একথা অনেকদিন ধরেই প্রচলিত রয়েছে যে, সতীর তৃতীয় নয়ন এখানে পড়েছিল। কিন্তু পুরাণাদি গ্রন্থে এর কোনও সমর্থন পাওয়া যায় না।

২. কিন্তু এই ‘তৃতীয় নয়ন’-এর কাহিনিকে প্রতীকী ধরে বিচার করলে একথা বোঝাই যায়, তারাপীঠ এক মহাশক্তির কেন্দ্র। পরবর্তী কালে গণবিশ্বাস এবং পুরাণ একত্র হয়ে তারাপীঠ-মহিমাকে অন্য মাত্রা প্রদান করেছে।

৩. তারাপীঠ আসলে একটি ‘সিদ্ধপীঠ’। সুদূর অতীত থেকে এখানে বহু সাধক এসেছেন তপস্যা করার জন্য। এবং তাঁদের সিদ্ধিলাভেই ধন্য হয়েছে এই পীঠ। সুতরাং এই পীঠের মহিমা অন্য শক্তিপীঠগুলির চাইতে একাবেরেই আলাদা।

৪. দেবী তারা-র উল্লেখ মূলত রয়েছে বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্মে। আবার দশমহাবিদ্যা স্তোত্রেও তিনি উপস্থিত। ‘তারারহস্য’ ও অন্যান্য তন্ত্রগ্রন্থ পাঠে বোঝা যায়, তারা কাল্ট অতি প্রাচীন। বজ্রযান গড়ে উঠেছিল মহাযানবাদ এবং লোকধর্মের মিশ্রণে। সেখানে দেবী তারার অবস্থিতি বেশ গুরত্বপূর্ণ স্থানে। দশমহাবিদ্যা স্তোত্র অবশ্য অনেক পরের রচনা। সেখানে তারার উল্লেখ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

৫. তারাপীঠ মন্দিরের স্থাপত্য খুই সাধারণ। কিন্তু এই মন্দির-স্থাপত্যে বাংলার নিজস্ব স্থাপত্য ভাবনার ছাপ রয়েছে। চালা ডিজাইনের মন্দির বাংলার ঐতিহ্যকেই ব্যক্ত করে।

৬. মায়ের শিলারূপ ঢাকা থাকে একটি আচ্ছাদনে। সেই আচ্ছাদনকেই মাতৃরূপের প্রতীক ধরা হয়। এই মূর্তিই তারামূর্তি হিসেবে ঘরে ঘরে পূজিতা।

৭. তারাপীঠ মহাঋষি বশিষ্ঠের সাধনপিঠ হিসেব প্রসিদ্ধ। ঐতিহাসিকভাবে এই বশিষ্ঠ ঠিক কে, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। তিনি কি মাহাকাব্য-পুরাণে উল্লিখিত বশিষ্ঠ? সম্ভবত বশিষ্ঠ একটি সাধক-পরম্পরা। এই পরম্পরারই কোনও মহাত্মা এখানে সিদ্ধিলাভ করেন। তারাপূজার অন্তর্গত গুরুপংতি পূজায় বশিষ্ঠানন্দনাথের পূজা করতে হয়, আমার ধারণা ইনি কোনও নাথযোগী-তারাসাধক ও ইনিই সেই বশিষ্ঠ, শ্রী রামচন্নের গুরু বশিষ্ঠ না।

৮. তারপীঠের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় তথা বামাক্ষ্যাপা। তন্ত্রধর্মে তাঁর স্থান প্রশ্নাতীত উচ্চতায় স্থিত। তাঁকে ঘিরে যেমন আবর্তিত হয়েছে বাংলার তন্ত্রচর্চার একটি বড় অধ্যায়, তামনই তিনি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছেন অসংখ্য কিংবদন্তির।

৯. তারাপীঠ মহাশ্মশান আজও বহু তান্ত্রিকের বিচরণক্ষেত্র। তন্ত্রে উল্লিখিত শ্মাশানক্রিয়া সমাধা করতে সারা দেশ থেকে শাক্ত সাধকরা এখানে আসেন।

১০. তারাপীঠ দ্বারকা নদের তীরে অবস্থিত। দ্বারকা উত্তরবাহিনী জলধারা। উত্তরবাহিনী জলস্রোত কুলকুণ্ডলিনীর ঊর্ধ্বগতির প্রতীক। এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিপুল।

১১. বাবা বামদেব ও মা তারার দর্শন অনেক মানুষ এখনও পেয়ে থাকেন।

১২. 'আধুনিকতার স্পর্শে তারাপীঠ সম্পূর্ণ বদলে গেছে ও তার মহিমা-মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে' - বলে যারা উদ্বিগ্ন হ'ন, তারা মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন।

১৩. তারাপীঠের অদুরেই 'মলুটী'-তে মা তারার আর একটি সাধনক্ষেত্র বাম বাবার লীলাক্ষেত্রও বটে।

১৪. তারামায়ের ভৈরব মল্লারপুরের মল্লেশ্বর শিব বলে অনেকে বলে থান। কারণ হিসাবে তারা বলেন - কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন মায়ের মুর্তি মন্দির থেকে বার করে তাই মল্লারপুরের মল্লেশ্বর শিব মন্দিরের দিকে মুখ করিয়ে বসানো হয়।

১৫. তারাপীঠ এক অদ্ভুত 'শক্তিকেন্দ্র' তাই মন্দিরের সংলগ্ন ও আশেপাশের গ্রামের পরিবারগুলিতে আদ্যশ্রাদ্ধের দিনেই মৎস্যমুখ হয় বা মাছ-ভাত খাওয়া হয়।

Written by: Prithwish Ghosh
Share:

"যজ্ঞো বৈ শ্রেষ্ঠতম কর্মম্”--- যজ্ঞই শ্রেষ্ঠ কর্ম

★(এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলে আপনার একাধিক বন্ধুকে দয়া করে শেয়ার করুন)★

ব্রহ্মবিদরা বলে থাকেন দুটি বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে, 'পরা' এবং 'অপরা'। অপরা হল ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। আর পরা বিদ্যা হল তাই যার দ্বারা ব্রহ্মকে অধিকার করা যায়। ব্রহ্মবিদরা বলে থাকেন দুটি বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে, পরা এবং অপরা। অপরা হল ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। আর পরা বিদ্যা হল তাই যার দ্বারা ব্রহ্মকে অধিকার করা যায়।

বৈদিক সাহিত্যকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগে আছে ব্রহ্মবিদ্যা অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে যে অবিনাশী সত্তা প্রচ্ছন্নভাবে ক্রিয়াশীল তার সন্বন্ধে জ্ঞান সঞ্চয় করা। এই জ্ঞান লিপিবদ্ধ হয়েছিল বেদেরই অঙ্গীভূত এবং আশ্রিত এক শ্রেণীর রচনায়। তাদের আমরা উপনিষদ বলি। উপনিষদ অর্থে বুঝি বেদের প্রান্তে যা অবস্থিত। বেদান্ত অর্থেও তাই বুঝি। পরবর্তীকালের শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত বেদান্তদর্শন এই উপনিষদ বা বেদান্তের রচনাকেই অবলম্বন করে রচিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় ভাগে পড়ে আর সব কিছু। তাদের মধ্যে প্রথম আছে বেদের চারটি সংহিতা – ঋক্, সাম, যজু এবং অথর্ব। তারপর যেগুলি আছে সেগুলি সংখ্যায় ছ’টি এবং তাদের সাধারণ নাম বেদাঙ্গ। তারা হল শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। তাদের কেন বেদাঙ্গ বলা হয় তা বুঝতে গেলে কিছু প্রাথমিক কথা বলার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

সনাতন বৈদিক ধর্মের প্রধান উৎস হল বিশ্বের মূল শক্তিকে শ্রদ্ধা, ভক্তি বা অর্ঘ্য নিবেদনের আকুতি। এই আকুতির প্রেরণা নানা রকম হতে পারে। বেদ অতি প্রাচীনকালে রচিত হয়েছে। সে যুগে মানুষ ভক্তের স্তরে উঠতে শেখেনি। সে যুগে দেবতার উপাসনার প্রেরণা ছিল ব্যবহারিক প্রয়োজন। বেদের যুগে উপাসনা রীতির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। ঠিক বলতে কি তা অনন্য-সাধারণ। এ ধরনের রীতি অন্য কোনও দেশে দেখা যায়নি। অবশ্য পারসিক সম্প্রদায় অগ্নির উপাসনা করত। তবে বৈদিক যজ্ঞরীতি ভিন্ন ধরনের।

প্রকৃতির বুকে সেকালের ঋষিগণ শক্তির বা সৌন্দর্যের উৎস আবিষ্কার করেছেন যেখানে, তার ওপরেই দেবত্ব আরোপ করে তার জন্য স্তোত্র রচনা করেছেন। এই স্তোত্রের নাম হল 'সূক্ত'। এইভাবে 'অগ্নি' দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি শুধু দেবতা নন 'পুরোহিত'-ও বটেন; ফলস্বরূপ অগ্নিতেই অন্য দেবতার উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হত। সূক্ত নিয়ে গঠিত বেদের এই মূল অংশকে বলা হয় সংহিতা। এখন শ্রদ্ধা নিবেদন বা প্রার্থনা জ্ঞাপন শুধু স্তোত্র পাঠেই হয় না। তার সঙ্গে কিছু আনুষঙ্গিক ক্রিয়া থাকে। বৈদিক যুগে সেই আনুষ্ঠানিক অংশ প্রধানতঃ রূপ নিত যজ্ঞানুষ্ঠানের। এই যজ্ঞের উপকরণ খুব সরল ছিল। একটি বেদী নির্মিত হত। তার উপর কাঠ দিয়ে আগুন জালানো হত। সেই সঙ্গে বৈদিক মন্ত্র পাঠ হত বা সুর সংযোগে গাওয়া হত। তার সঙ্গে ঘৃতের আহুতি দেওয়া হত। সোম নামে এক লতা সেকালে জন্মাত। তার রসও আহুতি হিসাবে দেবতাদের উদ্দেশ্য নিক্ষিপ্ত হত।

এখন বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ আছে। কোনোটিকে বলা হয় অগ্নিষ্টোম, কোনওটিকে জ্যোতিষ্টোম, কোনটিকে বিশ্বজিৎ। আবার কতদিন ধরে একটি যজ্ঞ স্থায়ী হত তার ভিত্তিতে বিভিন্ন নামকরণ হত। যেমন যে যজ্ঞ বারো দিনের বেশী স্থায়ী হত তাকে বলা হত 'সত্র'। এইসব বিষয় বিধি-নিষেধ নির্দেশ করবার জন্য ‘ব্রাহ্মণ’ শাস্ত্রের উৎপত্তি হয়। এই ব্রাহ্মণগুলিতে বিভিন্ন যজ্ঞ কি করে নিষ্পাদিত করতে হয় তার সবিস্তার বিবরণ আছে। যেমন ঋগ্বেদের অন্তর্ভূক্ত ঐতরেয় ব্রাহ্মণে রাজসূয় যজ্ঞের বিবরণ আছে। ব্রাহ্মণগুলি সংস্কৃত ভাষায় রচিত।

জৈমিণি বলেছেন মন্ত্রাতিরিক্ত বেদভাগের নামই ব্রাহ্মণ। (মীমাংসা সূত্র, ২।১।৩৩)। আরণ্যক ও উপনিষদ ব্রাহ্মণের অঙ্গ হলেও তাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য আছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ এই সমগ্র বৈদিক সাহিত্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি কর্মকান্ড ও অপরটি জ্ঞানকান্ড।কর্মকান্ডে যজ্ঞ সম্পর্কিত বিষয়গুলি আছে। সুতরাং তার অন্তর্ভূক্ত হবে বেদের সংহিতা বা মন্ত্র অংশ এবং ব্রাহ্মণ অংশ; কারণ তাতে যজ্ঞের বিধি-নিষেধের আলোচনা আছে। জ্ঞানকান্ড হিসাবে উপনিষদেরই ভূমিকা প্রধান। যজ্ঞানুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন ভূমিকা থাকত।

যজ্ঞের সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে ‘দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্য ত্যাগ যজ্ঞ।’ অর্থাৎ যজ্ঞ করতে যে সমস্ত সামগ্রীর প্রয়োজন হতো, যেমন সমিধ বা কাঠ, আহুতির জন্য ঘৃত, সোমরস প্রভৃতি সরবরাহ করতে হত। যিনি দ্রব্য ত্যাগ করেন তিনি হলেন যজমান। অর্থাৎ তাঁরই কল্যাণ কামনায় যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো সুতরাং তাঁকেই এই দ্রব্যগুলি সরবরাহ করতে হত।

আর যাঁরা যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন তাঁদের বলা হতো ঋত্বিক। এই ঋত্বিকদের মধ্যে আবার ভূমিকা বিভিন্ন ছিল। তার ভিত্তিতে তাঁদের মধ্যে শ্রেণী বিভাগ আছে। যেমন যিনি সূক্ত পাঠ করতেন তাঁর নাম হল হোতা। যিনি এই সূক্ত গান করে পাঠ করতেন তাঁর নাম হল উদ্গাতা। আর যিনি অগ্নিতে আহুতি দিতেন তাঁর নাম হল অধ্বর্যু। সুতরাং বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে অনেকের ভূমিকা ছিল। আগুন জ্বেলে একটি ভাবগম্ভীর সমাবেশে তা অনেকের সাহচর্যে অনুষ্ঠিত হতো।

সাধারণত যজ্ঞ বলতে আমরা বুঝি একটি কুণ্ডে আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পাঠ করে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য আহুতি দেয়া। বৈদিক ধর্মে এমনি নিত্য আচরিত একটি যজ্ঞ হচ্ছে হবন বা অগ্নিহোত্র। অনেক বস্তুবাদীই প্রশ্ন করতে পারেন অগ্নিহোত্র কি অর্থহীন আড়ম্বর নয়? মোটেও নয়, বরং এর মাঝে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের অন্যতম বিস্ময়।

আমাদের এ জগতে শক্তির মধ্যে তাপ শক্তি ও শব্দ শক্তি অন্যতম। যজ্ঞে এই দুই শক্তিরই সম্মেলনে আমরা অর্জন করতে পারি শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উপকারিতা। যজ্ঞে বিভিন্ন পদার্থের দহন ঐ বস্তুর অন্তর্নিহিত সঞ্চিত শক্তির উন্মোচন ও পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়ার একটি উৎকৃষ্ট প্রক্রিয়া। অন্যদিকে যজ্ঞে উচ্চারিত মন্ত্রের কম্পাঙ্ক শক্তি বহন করে এক আধ্যাত্মিক প্রেরণা।

যজ্ঞে সমিধ হিসেবে যেসব দ্রব্য ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে থাকে নানা সুগন্ধি পদার্থ, ওষধি বৃক্ষের কাঠ, পুষ্টিকর খাদ্য ইত্যাদি। আপনাদের মনে হতে পারে এসব দ্রব্য পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড, বিষাক্ত কার্বন মনো অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড প্রভৃতি উৎপন্ন হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি বৈদিক কল্প ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বিধি মোতাবেক সঠিক অনুপাতে জ্বালানী, দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করেন এবং যজ্ঞকুণ্ড যদি শাস্ত্রীয় রীতি অনুসারে তৈরী করেন তবে কোনো বিষাক্ত গ্যাসই উৎপন্ন হবে না।

যে কার্বন ডাই অক্সাইড যজ্ঞকুণ্ডে উৎপন্ন হবে তা যজ্ঞকুণ্ডের প্রবল উত্তাপে বাষ্পের সঙ্গে ক্রিয়া করে ফরমালডিহাইড উৎপন্ন করবে যা যজ্ঞকুণ্ডের চারপাশের পরিবেশ সুগন্ধে পূর্ণ করে তুলবে। আর এই গ্যাস কেবল সুগন্ধিই নয়, বায়ুতে থাকা বিভিন্ন কীটাণু দমনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ যজ্ঞের মাধ্যমে আপনি পাবেন দুর্গন্ধ মুক্ত স্বাস্থ্যকর এক পরিবেশ।

আর যে অল্প পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে যাবে সেটি সালোকসংশ্লেষণ ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যাবে। যা একই সাথে বৃক্ষরাজির খাদ্য ও পরিবেশে মুক্ত অক্সিজেনের যোগান দেবে। তাই যজ্ঞ কেবল যজ্ঞকারীর নয়, বরং সমগ্র পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।

অনেকে বলতে পারেন যজ্ঞে ব্যবহৃত কাঠের জন্য তো প্রচুর বৃক্ষ নিধন করতে হবে। আপনাদের জন্য বলছি বৈদিক ঋষিগণ কেবল মৃত বৃক্ষের কর্তনেরই নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই সাথে মনু আদি মহর্ষিরা ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। তাই যজ্ঞের জন্য কোনো জীবিত বৃক্ষ কর্তনের প্রয়োজন নেই, বরং মৃত বা মৃতপ্রায় বৃক্ষের কাঠই যজ্ঞে সমিধারূপে ব্যবহৃত হবে।

বর্তমান পরিবেশ দূষণ ও রোগ মহামারীর যুগে যজ্ঞের আয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ড. হাফকিন বলেছেন, “ঘি এবং চিনি মিশ্রণ করে যজ্ঞে পোড়ালে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় তা বিভিন্ন রোগজীবাণু ধ্বংস করে।” প্রফেসর টিলওয়ার্ড বলেন, “চিনি মিশ্রিত হবিষ্যের পরিবেশ শোধনের শক্তি রয়েছে। এটি যক্ষ্মা, মিলস, বসন্ত প্রভৃতি জীবাণুনাশক।”

গায়ত্রী পরিবার আয়োজিত গোরখপুরে অশ্বমেধ যজ্ঞ চলাকালীন সময়ে “উত্তর প্রদেশ দূষণ রক্ষা বোর্ড” এর ডিরেক্টর ড. মনোজ গর্গ একদল বিজ্ঞানী নিয়ে বেশকিছু পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষার ফল “অখণ্ড জ্যোতি” সাময়ীকির সেপ্টেম্বর ’৯৭ সংখ্যাতে প্রকাশ পায়।

যা যজ্ঞের ব্যাপক উপযোগিতা ফুটিয়ে তুলে। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যজ্ঞ সম্পাদনের পূর্বে সে স্থানে বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩.৩৬ ও ১.১৬ ইউনিট এবং যজ্ঞ সম্পাদনের শেষে বিষাক্ত গ্যাস দুটির পরিমাণ কমে দাড়ায় যথাক্রমে ০.৮০ ও ১.০২ ইউনিট।

বিজ্ঞানীর দল যজ্ঞকুণ্ডের কিছু দূরে অবস্থিত জলাশয়ের জল পরীক্ষা করেও অভূতপূর্ব ফল লাভ করেন। তাঁরা দেখতে পান সংগৃহীত নমুনায় যজ্ঞের পূর্বে ব্যাকটেরিয়া ছিল ৪৫০০ এবং যজ্ঞের শেষে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমে দাড়ায় ১২৫০।

যজ্ঞাবশিষ্ট যে ছাই বা বিভূতি ছিল তাতে মিনারেল পদার্থের পরিমাণ পরীক্ষা করে উত্তরপ্রদেশ কৃষির ডেপুটি ডিরেক্টর একে উত্তর মৃত্তিকা উর্বরকারক বলে মত দেন। ১৯৯৩-১৯৯৫ পর্যন্ত ২৭ টি যজ্ঞ ভিত্তিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যার প্রত্যেকটিই বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে যজ্ঞের উপযোগিতা ব্যাপকহারে সমর্থন করে।

আপনারা অনেকেই ভূপাল ট্র্যাজেডির কথা শুনেছেন, যেখানে বিষাক্ত এমআইসি গ্যাস নির্গমনের ফলে শতশত মানুষ মারা যায় এবং সহস্র মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এই গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছিল মাইলের পর মাইল।

৪মে ১৯৮৫ এর দৈনিক “দ্যা হিন্দি” এর একটি প্রতিবেদন সকলকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “দূষণ প্রতিরোধে বৈদিক উপায়।” যেখানে বলা হয় ওই গ্যাস প্ল্যান্টের খুব নিকটবর্তী সোহান লাল খুশওয়া এর পরিবারের কোনো সদস্যই ওই ঘটনার ফলে মৃত্যু তো দূরে থাক অসুস্থই হয় নি। কারণ কি? অগ্নিহোত্র। হ্যাঁ একমাত্র এই পরিবারটিই সেখানে নিয়মিত বৈদিক অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করত। যার ফল স্বরূপ এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পায় পরিবারটি। আর এই ঘটনা পরিবেশ দূষণ রোধে অগ্নিহোত্র যজ্ঞের কার্যকারিতা পুনরায় প্রতিপাদন করল। তাই তো বৈদিক ধর্ম ঘোষণা দিয়েছে “যজ্ঞো বৈ শ্রেষ্ঠতম কর্মম্”।

--------------------------------------------------------------------

বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় ---

'তারাপীঠ-কামাক্ষা সিদ্ধ TV-বাবা' মহাশয়দের ... তারাপীঠে বা নিজস্ব গৃহমন্দিরের হোমযজ্ঞ সম্পর্কে আমার কোনও জ্ঞান নেই।

এই আলোচনার সাথে কবচ্-মাদুলীর হোম-যজ্ঞ সম্পূর্ণ আলাদা।

-----------------------------------------------------------------------------

Courtesy by: Prithish Gosh

Share:

আপনি কি নিজে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহীদের একজন?

১) আপনি কি হিন্দু?
২) আপনি নিজেকে ধর্মবিশ্বাসী বলে মনে করেন?
৩) আপনি কি নিজে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহীদের একজন?

উপরের তিনটি প্রশ্নের উত্তরে আপনি যদি 'হ্যাঁ' বলেন, তবে অবশ্যই এই পোস্টটি পড়ুন।
হিন্দু ধর্ম বুঝতে হলে প্রথমেই এর ঈশ্বরবাদ বুঝতে হবে, ঈশ্বর কয়জন, প্রথমেই এই প্রশ্নের উত্তর জেনে হিন্দু ধর্মে প্রবেশ করতে হবে। কারণ কেউ যদি না জানে যে ঈশ্বর কয়জন ও কি তবে ভক্তি অর্চনা করবে কাকে?

পরমাত্মা বা পরমব্রহ্ম হচ্ছেন সেই ঈশ্বর যিনি সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত আছেন এবং থাকবেন এবং তিনিই প্রকৃত আরাধ্য। ঈশ্বর, পরমাত্মা বা পরমব্রহ্ম হচ্ছেন নিরাকার, কিন্তু তিনি চাইলেই যে কোন সাকার রুপ ধারণ করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণকে সেই পরমব্রহ্মের এক সাকার রূপ ধরা হয় এবং পরমেশ্বর মানা হয়। এখন কেউ যদি বলেন শ্রীকৃষ্ণ না শিবই আমার কাছে পরমেশ্বর তাতেও ভুল নেই কারণ তিনি যাঁকেই ডাকুন না কেন, সেই পরেমশ্বর কেই ভজনা করছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কৃষ্ণ বড় নাকি শিব বড়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সৃষ্টিখন্ডে ঈশ্বর শিবকে বলছেন " যে তোমার ও আমার মাঝে বিভেদ করবে তার মত পাপী আর পৃথিবীতে নেই"।

মূল কথা হচ্ছে ঈশ্বর একজন তিনি নিরাকার বা সাকার, আমরা যাকেই ভক্তি বা পূজা করিনা কেন তা সেই ঈশ্বরকেই করা হয়। আমারা বিভিন্ন রুপের মূর্ত্তিকে পুজা করি তা কিন্তু ঈশ্বর থেকে আলাদা মনে করে না, মূর্ত্তির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকেই পূজা করা হয়। ঈশ্বরের বিভিন্ন রুপ কল্পনা করে আমরা পূজা করেলেও ঈশ্বর কিন্তু সেই একজনই। অনেকে প্রশ্ন করেন ভাত সোজা করে না খেয়ে এত ঘুরিয়ে খাও কেন? গীতায় ঈশ্বর বলেছেন -- "যে আমাকে যেভাবে ডাকবে আমি তাকে সেভাবেই ফলদান করব"। হিন্দু ধর্ম যে কতটা উদার তার প্রমাণ এখানেই পাওয়া যায়। আমি যেভাবে, যেরুপে তাকে ডাকব তিনি সেভাবেই আসবেন তা সে ৩৩ কোটির যে কোন একটা হোক না কেন।

আমাদের দেহে যে আত্মা আছে, তা সকল ধর্মেই বিশ্বাস করে। ঈশ্বর হচ্ছেন সকল আত্মার উৎস অর্থাৎ পরমাত্মা। আর প্রতিটি জীবের শরীরে যে আত্মা আছে তা হচ্ছে জীবাত্মা। সকল ধর্ম কর্মের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে লীন হওয়া অর্থাৎ পৃথিবী থেকে মুক্ত হওয়া। পুরষ্কার অথবা শাস্তির শেষ আছে, মানে ভাল কাজের জন্য স্বর্গভোগ আর খারাপ কাজের জন্য নরকভোগ আছে। কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করতে হয়, দুই টাকায় ভালো করে ১০ টাকার মিষ্টি খাবেন তা হবে না। পাকা হিসাবে যতটুকু ভাল ততটুকুই মিষ্টি। কিন্তু প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু স্বর্গ নয় সেই পরমাত্মার সাথে বিলীন হয়ে যাওয়া, এর আর কোন শেষ নাই।

আত্মার কোন ধ্বংশ বা শেষ নাই। এটা এক দেহ হতে অন্য দেহে গমন করে মাত্র। দেহের পরিবর্তন হয়, শিশু হতে কিশোর আবার কিশোর হতে যুবক, কিন্তু আত্মার পরিবর্তন নাই। গীতা অনুযায়ী মানুষ যেমন পুরাতন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে তেমনি আত্মা ও পুরাতন জীর্ন শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীরে গমন করে। একটু আধুনিক ভাবে বলা যায়, দেহ হচ্ছে প্রোগ্রাম করা কোন যন্ত্র আর আত্মা হচ্ছে এর ব্যাটারী যখন এই দুই একত্রিত হবে তখনই যন্ত্র সচল হবে এখানে ব্যাটারী দিয়ে কথা তা যে যন্ত্র বা শরীরে সেট করা হোক না কেন, এর চালনা শক্তি থাকলেই চলে।

Written by: Prithish Gosh
Share:

সাকার নিরাকার উপাসনা ---- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সম্প্রতি কিছুকাল হইতে সাকার নিরাকার উপাসনা লইয়া তীব্রভাবে সমালোচনা চলিতেছে। যাঁহারা ইহাতে যোগ দিয়াছেন তাঁহারা এম্‌নি ভাব ধারণ করিয়াছেন যেন সাকার উপাসনার পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাঁহারা প্রলয়জলমগ্ন হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধার করিতেছেন। নিরাকার উপাসনা যেন হিন্দুধর্মের বিরোধী। ...... বুলবুলের লড়াইয়ে যেমন পাখিতে পাখিতেই খোঁচাখুঁচি চলে অথচ উভয়পক্ষীয় লোকের গায়ে একটিও আঁচড় পড়ে না, আমি বোধ করি অনেক সময়ে সেইরূপ কথাতে কথাতে তুমুল দ্বন্দ্ব বাধিয়া যায় অথচ উভয়পক্ষীয় মত অক্ষত দেহে বিরাজ করিতে থাকে। সাকার ও নিরাকার উপাসনার অর্থই বোধ করি এখনো স্থির হয় নাই। কেবল দুটো কথায় মিলিয়া বাঁও-কষাকষি করিতেছে। 

 অসীমতা কল্পনার বিষয় নহে, সীমাই কল্পনার বিষয়। অসীমতা আমাদের সহজ জ্ঞান সহজ সত্য। সীমাকেই কষ্ট করিয়া পরিশ্রম করিয়া কল্পনা করিতে হয়। ..... সমুদ্রের মাঝখানে গেলে আমরা বলি সমুদ্রের কূলকিনারা নাই। আকাশের কোথাও সীমা কল্পনা করিতে পারি না, এইজন্য সহজেই আমরা আকাশকে বলি অসীম, আকাশকে সসীম কল্পনা করিতে গেলেই আমাদের মন অতিশয় ক্লিষ্ট হইয়া পড়ে, অক্ষম হইয়া পড়ে। কালকে আমরা সহজেই বলি অনন্ত, নক্ষত্রমণ্ডলীকে আমরা সহজেই বলি অগণ্য-- এইরূপে সীমার সহিত যুদ্ধ বন্ধ করিয়া অসীমের মধ্যেই শান্তি লাভ করি। অসীম আমাদের মাতৃক্রোড়ের মতো বিশ্রামস্থল, ......... সীমাতেই আমাদের শ্রান্তি, অসীমেই আমাদের শান্তি, ভূমৈব সুখং, ইহা লইয়া আবার তর্ক করিব কী! ...... পৌত্তলিকতার এক মহদ্দোষ আছে। 

চিহ্নকে যথার্থ বলিয়া মনে করিয়া লইলে অনেক সময়ে বিস্তর ঝঞ্ঝাট বাঁচিয়া যায় এইজন্য মনুষ্য স্বভাবতই সেইদিকে উন্মুখ হইয়া পড়ে। পুণ্য অত্যন্ত শস্তা হইয়া উঠে। পুণ্য হাতে হাতে ফেরে। পুণ্যের মোড়ক পকেটে করিয়া রাখা যায়, পুণ্যের পঙ্ক গায়ে মাখা যায়, পুণ্যের বীজ গাঁথিয়া গলায় পরা যায়। হরির নামের মাহাত্ম্যই এত করিয়া শুনা যায় যে, কেবল তাঁহার নাম উচ্চারণ করিয়াই ভবযন্ত্রণা হইতে অব্যাহতি পাওয়া যায় তৎসঙ্গে তাঁহার স্বরূপ মনে আনা আবশ্যকই বোধ হয় না। ......... আসল কথা, আমাদের সীমা ও অসীমতা দুইই চাই। আমরা পা রাখিয়াছি সীমার উপরে, মাথা তুলিয়াছি অসীমে। 


........ ঈশ্বরের আশ্রয়ে আছি বলিতে গিয়া ভক্তের মন মনুষ্যস্বভাববশত সহজেই বলিতে পারে "আমি ঈশ্বরের চরণচ্ছায়ায় আছি' তাহাতে আমার মতে পৌত্তলিকতা হয় না। কিন্তু যদি কেহ সেই চরণের অঙ্গুলি পর্যন্ত গণনা করিয়া দেয়, অঙ্গুলির নখ পর্যন্ত নির্দেশ করিয়া দেয়, তবে তাহাকে পৌত্তলিকতা বলিতে হয়। কারণ, শুদ্ধমাত্র ভাব- নির্দেশের পক্ষে এরূপ বর্ণনার কোনো আবশ্যক নাই-- কেবল আবশ্যক নাই যে তাহা নয়, ইহাতে করিয়া ভাব হইতে মন প্রতিহত হইয়া বস্তুর মধ্যে রুদ্ধ হয়। "চরণচ্ছায়ায় আছি' বলিতে গেলেই অমনি যে রক্তমাংসের একজোড়া চরণ মনে পড়িবে তাহা নহে। চরণের তলে পড়িয়া থাকিবার ভাবটুকু মনে আসে মাত্র। একটা দৃষ্টান্ত দিই।.... কে না জানেন চন্দ্রানন বলিলে থালার মতো একটা মুখ মনে পড়ে না, অথবা করপদ্ম বলিলে কুঞ্চিত দলবিশিষ্ট গোলাকার পদার্থ মনে আসে না-- কিন্তু তাই বলিয়া চাঁদের মতো মুখ ও পদ্মের মতো করতল চিত্রপটে যদি আঁকিয়া দেওয়া যায় তবে তাহাই যথার্থ মনে করা ব্যতীত আমাদের আর অন্য কোনো উপায় থাকে না।

 ....... আর-একটি কথা। কতকগুলি বিষয় আছে যাহা বিশুদ্ধ জ্ঞানের গম্য, যাহা পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করা যায় ও করাই উচিত। যেমন, ঈশ্বর ত্রিকালজ্ঞ। ঈশ্বরের কপালে তিনটে চক্ষু দিলেই যে ইহা আমরা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার বুঝিতে পারি তাহা নহে। বরঞ্চ তিনটে চক্ষুকে আবার বিশেষ রূপে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া বলিতে হয় ঈশ্বর ত্রিকালজ্ঞ। বিশুদ্ধ জ্ঞানের ভাষা অলংকারশূন্য। অলংকারে তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া দেয়, বিকৃত করিয়া দেয়, মিথ্যা করিয়া দেয়। জ্ঞানগম্য বিষয়কে রূপকের দ্বারা বুঝাইতে গেলেই পৌত্তলিকতা আসিয়া পড়ে। ...... বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতিনিধি রূপককে লইয়াও এইরূপ গোলযোগ ঘটিয়া থাকে। আমরা প্রথম দৃষ্টিতে তাহাকেই জ্ঞানের স্থলে অভিষিক্ত করিয়া লই ও জ্ঞানের পরিবর্তে তাহারই গলে বরমাল্য প্রদান করি-- অবশেষে ভ্রম ভাঙিলেও সহজে হৃদয় ফিরাইয়া লইতে পারি না। ইহার পরিণাম শুভ হয় না। কারণ, জ্ঞানোদয় হইলে অজ্ঞানের প্রতি আমাদের আর শ্রদ্ধা থাকে না, অথচ অভ্যাস অনুসারে শ্রদ্ধাসূচক অনুষ্ঠানও ছাড়িতে পারি না। 

...... জ্ঞানগম্য বিষয়কে রূপকে ব্যক্ত করা অনাবশ্যক ও হানিজনক বটে কিন্তু আমাদের ভাবগম্য বিষয়কে আমরা সহজ ভাষায় ব্যক্ত করিতে পারি না, অনেক সময়ে রূপকে ব্যক্ত করিতে হয়। ঈশ্বরের আশ্রয়ে আছি বলিলে আমার মনের ভাব ব্যক্ত হয় না, ইহাতে একটি ঘটনা ব্যক্ত হয় মাত্র; স্থাবর জঙ্গম ঈশ্বরের আশ্রয়ে আছে আমিও তাঁহার আশ্রয়ে আছি এই কথা বলা হয় মাত্র। কিন্তু ঈশ্বরের চরণের তলে পড়িয়া আছি বলিলে তবেই আমার হৃদয়ের ভাব প্রকাশ হয়-- ইহা কেবল আমার সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জনসূচক পড়িয়া থাকার ভাব। অতএব ইহাতে কেবল আমারই মনের ভাব প্রকাশ পাইল, ঈশ্বরের চরণ প্রকাশ পাইল না। অতএব ভক্ত যেখানে বলেন, হে ঈশ্বর আমাকে চরণে স্থান দাও, সেখানে তিনি নিজের ইচ্ছাকেই রূপকের দ্বারা ব্যক্ত করেন, ঈশ্বরকে রূপকের দ্বারা ব্যক্ত করেন না।......... নিরাকার উপাসনাবিরোধীদের একটা কথা আছে যে, নিরাকার ঈশ্বর নির্গুণ অতএব তাঁহার উপাসনা সম্ভবে না। 

আমি দর্শনশাস্ত্রের কিছুই জানি না, সহজ বুদ্ধিতে যাহা মনে হইল তাহাই বলিতেছি। ঈশ্বর সগুণ কি নির্গুণ কী করিয়া জানিব! তাঁহার অনন্ত স্বরূপ তিনিই জানেন। কিন্তু আমি যখন সগুণ তখন আমার ঈশ্বর সগুণ। আমার সম্বন্ধে তিনি সগুণ ভাবে বিরাজিত। জগতে যাহা-কিছু দেখিতেছি তাহা যে তাহাই, তাহা কী করিয়া জানিব! তাহার নিরপেক্ষ স্বরূপ জানিবার কোনো সম্ভাবনা নাই। ................... ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের হৃদয়ের যাহা উচ্চতম আদর্শ, তাহাই আমাদের পূজার ঈশ্বর, তাহাই আমাদের নেতা ঈশ্বর, তাহাই আমাদের সংসারের ধ্রুবতারা। তাঁহার যাহা নিগূঢ় স্বরূপ তাহার তথ্য কে পাইবে! কিন্তু তাই বলিয়া যে আমাদের দেবতা আমাদের মিথ্যা কল্পনা, আমাদের মনগড়া আদর্শ, তাহা নহে। ...... প্রতি পদক্ষেপে, উন্নতির প্রত্যেক নূতন সোপানে পুরাতন দেবতাকে ভাঙিয়া নূতন দেবতা গড়িতে হইতেছে না। অতএব আইস, অসীমকে পাইবার জন্য আমরা আত্মার সীমা ক্রমে ক্রমে দূর করিয়া দিই, অসীমকে সীমাবদ্ধ না করি। যদি অসীমকেই সীমাবদ্ধ করি তবে আত্মাকে সীমামুক্ত করিব কী করিয়া।

 ঈশ্বরকে অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত দয়া, অনন্ত প্রেম জানিয়া আইস আমরা আমাদের জ্ঞান প্রেম দয়াকে বিস্তার করি, তবেই উত্তরোত্তর তাঁহার কাছে যাইতে পারিব। তাঁহাকে যদি ক্ষুদ্র করিয়া দেখি তবে আমরাও ক্ষুদ্র থাকিব, তাঁহাকে যদি মহৎ হইতে মহান বলিয়া জানি তবে আমরা ক্ষুদ্র হইয়াও ক্রমাগত মহত্ত্বের পথে ধাবমান হইব। নতুবা পৃথিবীর অসুখ অশান্তি, চিত্তের বিক্ষিপ্ততা বাড়িবে বৈ কমিবে না। সুখ সুখ করিয়া আমরা আকাশ-পাতাল আলোড়ন করিয়া বেড়াই, আইস আমরা মনের মধ্যে পুরাতন ঋষিদের এই কথা গাঁথিয়া রাখি "ভূমৈব সুখং' ভূমাই সুখস্বরূপ, কোনো সীমা কোনো ক্ষুদ্রত্বে সুখ নাই-- তা হইলে অনর্থক পর্যটনের দুঃখ হইতে পরিত্রাণ পাইব।

ভারতী, শ্রাবণ, ১২৯২

Written by: Prithwish Ghosh
Share:

'সত্য' হলো 'ভগবান'

পরমাত্মা যে মানুষের মধ্যেই থাকেন এটা কিন্তু অনেক সুপ্রাচীন বিশ্বাস। অন্তত ধর্ম গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা যেসব কিংবদন্তী পাই তা থেকে বিষয়টা বোঝা যায়। ধর্ম তো আর আকাশ থেকে গল্প তৈরী করে আনেনি! প্রচলিত বিশ্বাসগুলোকে আর দর্শনকে সংকলিত কার হয়েছে ধর্মগ্রন্থে। স্থান ও কালের গন্ডিতে মোড়ানো এ জগতের দৃশ্যমান কোন দেহেই পরমাত্মা তার সব গুনাবলী নিয়ে আর্বিভূত হন না, আর সে কারনেই দেহ-খাঁচায় বন্দি আত্মা দেখতে পায় না তার আসল রূপ। কিন্তু সব দেহের তুলনায় মানবদেহেই আত্মা আর্বিভূত হন তার সবচেয়ে বেশী গুনাবলী বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এই কারণে মানুষের চিন্তা জগতের কোন সীমা পরিসীমা নেই। অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে মানুষের পক্ষে সব দেখা সম্ভব। নিজেকে চেনা সম্ভব। কিন্তু মানুষ চিনতে পারে না নিজেকে। রিপুর তাড়নায় মানুষ হয়ে পড়ে দেহ কেন্দ্রিক। তখন মানব আত্মার ভাবনা গুলো হয়ে পড়ে নিতান্তই দেহ কেন্দ্রিক। আত্মার প্রধান কাজই হয়ে পড়ে দেহজাত তাড়নাতে সাড়া প্রদান করা।

ঈশ্বর নিজেকে স্থান ও কালের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ করে মানবরুপে আর্বিভূত হয়েছেন কেননা পরমাত্মা দেখতে চান ভালবাসা দিয়ে দেহজাত সব তাড়নাকে পরাজিতা করা সম্ভব কিনা। ভালবাসা দিয়ে সাধন সিদ্ধ হয় যার, সেই আত্মা লীন হয় পরমে। আর ব্যর্থ আত্মা ফিরে আসে বার বার মানব দেহে যতবার না মানব-সাধন সিদ্ধ হয়। যে সত্য জানে সে নিজেকে খুঁজে পায়। মানবসাধন সেদিনই হবে সিদ্ধ যেদিন ভালবাসার আলোয় দেহ আর মন হবে একই স্বত্ত্বা।

ভাল আর মন্দ হলো জগতের আর সব দ্বান্দিক বিষয়ের মতই প্রতিনিয়ত চলমান। মূর্ত আর বিমূর্ত সব কিছুই কিন্তু জগতে দ্বান্দিক জোড়ায় বিদ্যমান। দ্বন্দের মাধ্যমে কি তিনি কোন মীমাংসায় পৌঁছতে চান? ভাল আর মন্দের দ্বান্দ্বিকতা জগতের নিয়ম। মায়াময় জগৎ ঈশ্বরেরই তৈরী ভ্রান্তি। এ মোহনীয় ভ্রান্তিকে সত্যের বিপরীতে তিনি দাঁড় করিয়ে সত্যের মহানুভবতাকে উদযাপন করেন। সত্য আর মিথ্যা যদি পাশাপশি না থাকে তাহলে সত্যের সৌন্দর্য আর গুরুত্ব তাৎপর্য্যহীন হয়ে পড়ে। তাই এ জগতে সত্যের পাশাপাশি থাকে মিথ্যা, সুন্দরের পাশাপাশি কদর্য, শুভর পাশেই থাকে অশুভ, ভালোর সাথে মন্দ।

মানবজনম তারই সার্থক হয় যে খুঁজে নিতে পারে সত্যকে। 'সত্য' হলো 'ভগবান', জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ভালবাসা আর মানবিকতা।

Written by: Prithwish Ghosh
Share:

শ্রী গণেশ চতুর্থী বা বিনায়ক চতুর্থী

গণেশ চতুর্থী হ'ল হিন্দু দেবতা শ্রী গণেশের বাৎসরিক পূজা-উৎসব। শিব ও পার্বতী পুত্র গজানন গণেশ হিন্দুদের বুদ্ধি, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের সর্বোচ্চ দেবতা। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন গণেশ চতুর্থীর দিন গণেশ তাঁর ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে মর্ত্যে অবতীর্ণ হন। সংস্কৃত, কন্নড়, তামিল ও তেলুগু ভাষায় এই উৎসব বিনায়ক চতুর্থী বা বিনায়ক চবিথি নামেও পরিচিত। কোঙ্কণি ভাষায় এই উৎসবের নাম চবথ। ভারতের বাইরেও নেপালে গণেশ পূজা হয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দুরাও গণেশ পুজো নিয়ে মত্ত থাকেন।

সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্মোৎসব রূপে পালিত হয় এই উৎসব। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী তিথিতে গণেশের পূজা সাধারণত এই দিনটি ২০ অগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মাঝে কোনো এক দিন পড়ে। দশদিনব্যাপী গণেশোৎসবের সমাপ্তি হয় অনন্ত চতুর্দশীর দিন। ভাদ্রপদ শুক্লপক্ষ চতুর্থী মধ্যাহ্নব্যাপিনী পূর্বাবিদ্ধ – এই পূজার প্রশস্ত সময়। চতুর্থী দুই দিনে পড়লে পূর্বদিনে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি দ্বিতীয় দিন মধ্যাহ্নের সম্পূর্ণ সময়ে চতুর্থী বিদ্যমান হলেও পূর্বদিন মধ্যাহ্নে এক ঘটিকার (২৪ মিনিট) জন্যও যদি চতুর্থী বিদ্যমান থাকে তবে পূর্বদিনেই গণেশ পূজা হয়।

গণেশ চতুর্থী নিয়ে হিন্দু সমাজে এক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, একবার গণেশ চতুর্থীতে প্রতি বাড়িতে মোদক ভক্ষণ করে ভরা পেটে ইঁদুরে চেপে ফিরছিলেন গণেশ। পথে ইঁদুরের সামনে একটি সাপ এসে পড়লে সে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। এতে গণেশ পড়ে যান ও তাঁর পেট ফেটে সব মোদক রাস্তায় পড়ে যায়। গণেশ উঠে সেগুলি কুড়িয়ে পেটের মধ্যে পুরে পেটের ফাটা জায়গাটি ওই সাপ দিয়ে বেঁধে দেন। আকাশ থেকে চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন। তাই গণেশ শাপ দেন যে চতুর্থীর দিন চাঁদ কেউ দেখবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য গণেশ অত্যন্ত মোদকপ্রিয় দেবতা। অন্যমতে, এই দিনে শিব গণেশকে লুকিয়ে কার্তিকেয়কে একটি ফল দিয়েছিলেন। চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন বলে শিব চন্দ্রকে অভিশাপ দেন।

গণেশের জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর প্রথম পূজ্য হওয়া পর্যন্ত এমন বহু ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের অনেকের অজানা।

আগে জেনে নেওয়া যাক গণেশের জন্মের কাহিনী। কথিত আছে, উবটন বা গায়ের ময়লা দিয়ে একটি বালকের মূর্তি তৈরি করেন পার্বতী। এর পর তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনদানের পর ওই বালককে নিজের পুত্র স্বীকার করেন পার্বতী। শুধু তাই নয় পরম শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান হওয়ারও আশীর্বাদ দেন তাঁকে। যে সময় গণেশের জন্ম হয়, তখন শিব কৈলাশে ছিলেন না।

কৈলাশ ফেরার পর গুঁফাদ্বারে একটি বালককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। সেই গুঁফাতেই ছিলেন পার্বতী। মা-এর আদেশ মেনে শিবকে ওই গুঁফায় প্রবেশ করতে দেননি গণেশ। ফলে গণেশের ওপর রেগে যান মহাদেব। এর পরই দেবতাদের সঙ্গে গণেশের যুদ্ধ বাধে। একে একে সমস্ত দেবতাই গণেশের শক্তির সামনে পরাজিত হন। এর পর ত্রিশূল দিয়ে নিজের অজান্তেই পুত্র গণেশের শিরোশ্ছেদ করেন মহাদেব। গণেশের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ পার্বতীকে শান্ত করতে অবশেষে গণেশের প্রাণ ফিরিয়ে দেন শিব। হাতির মাথা ওই বালকের দেহে যুক্ত করা হয়।

জন্মের কিছু সময় পর পিতার সঙ্গে যুদ্ধ এবং তার পর প্রথম পূজ্যের আসন লাভ করেন তিনি। কিন্তু এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাঁর জন্ম সময়ের কারণ।

শাস্ত্র মতে, ভাদ্রপদ শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে গণেশের জন্ম হয়। তাই শাস্ত্রে ভাদ্রপদ শুক্লপক্ষের চতুর্থী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনই সারা দেশে গণেশ চতুর্থী পালিত হয়।

জ্যোতিষশাস্ত্রে চতুর্থীকে রিক্তা তিথি বলা হয়েছে, সে দিন কোনও শুভ কাজ হয় না। কিন্তু সে দিনই গণেশের জন্মদিন হওয়ায় চতুর্থীতে রিক্তা তিথির দোষ গ্রাহ্য করা হয় না। তাই সমস্ত শুভ কাজ করা যায়। গণেশের কোষ্ঠীতে লগ্নে বৃশ্চিক রাশি রয়েছে এবং মঙ্গল বিরাজ করছে।

লগ্নস্থানে শনির পূর্ণদৃষ্টি রয়েছে। আবার সূর্যের ওপর শনির দৃষ্টি থাকার ফলেই বাবার হাতে পুত্রের শিরোশ্ছেদ হয়।

গণেশের কোষ্ঠীতে লগ্ন এবং লগ্নেশে বৃহস্পতির পূর্ণ দৃষ্টি রয়েছে। বৃহস্পতি দ্বিতীয় এবং পঞ্চম গৃহের স্বামী। অন্য দিকে বুধও স্বরাশির। এ কারণে গণেশ বুদ্ধি এবং জ্ঞানের দাতা এবং প্রথম পূজ্য।

গণেশের কোষ্ঠীতে পঞ্চমহাপুরুষ যোগের মধ্যে শশ এবং রুচক নামের যোগ তৈরি হয়। দশমেশ নিজের গৃহে রয়েছেন, তাই গণেশ শিবের গণের অধ্যক্ষ। তিনি গণাধ্যক্ষ নামেও পরিচিত।

গণেশের অপর নাম বিঘ্নহর্তা। কারণ তিনি সমস্ত ধরনের বিঘ্ন-বাধা দূর করেন। লগ্নে অবস্থিত মঙ্গলে শনি এবং বৃহস্পতির দৃষ্টির কারণে তিনি এই ক্ষমতা পান।

লেখকঃ Prithwish Ghosh
Share:

জীবের প্রকারভেদ

পরমেশ্বর ভগবান সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের একমাত্র কর্তা। সকল জীবই তাঁর থেকে উৎপত্তি ও লয়প্রাপ্ত হয়। উৎপত্তি ভেদে জীব চার প্রকারের হয়ে থাকে। যা হলো,

01) জরায়ুজঃ জরায়ু থেকে উৎপন্ন হয় যারা, তাদের বলে জরায়ুজ প্রাণী। যেমন -মানুষ, গরু,
মহীষ, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি।

02) অন্ডজঃ অন্ডকোষ বা ডিম থেকে উৎপন্ন প্রাণীদের বলে অন্ডজ। যেমন -পক্ষী, সর্প,
টিকটিকি, গিরগিটি ইত্যাদি।

03) উদ্ভিজঃ পৃথিবীর মাটি ভেদ করে উপরে যে গুলি ওঠে, সেগুলো উদ্ভিজ। যেমন -বৃক্ষ, লতা, দুর্বা ইত্যাদি।

04) স্বেদজঃ স্বেদ বা ময়লা হতে উৎপন্ন জীবদের বলে স্বেদজ। যেমন উকুন, কেঁচো ইত্যাদি।

এই চারটি স্থান হতে চুরাশি লক্ষ জীব উৎপন্ন হয়। এগুলি হতে দুই প্রকার জীব জন্মায়, স্থাবর ও জঙ্গম। বৃক্ষ, লতা, দুর্বা ইত্যাদি একই স্থানে থাকায় এগুলিকে বলে 'স্থাবর' জীব। আর মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদি চলাফেরা করে যেসব জীব তাদের বলা হয় 'জঙ্গম' জীব। এই সব জীবের মধ্যে কেউ থাকে জলে, কেউ থাকে আকাশে এবং কেউ থাকে মাটিতে। এই চুরাশি লক্ষ জীব ব্যতীত দেবতা, পিতৃগণ, গন্ধর্ব, ভুত, প্রেত, পিশাচ, ব্রহ্ম-রাক্ষস ইত্যাদি নানা প্রকার জীব আছে। এই সমস্ত জীবেরই বীজ অর্থাৎ মূল কারণ হলেন একমাত্র ভগবান। তাৎপর্য হলো এই যে, অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে অনন্ত জীব আছে, কিন্ত সবেরই বীজ সেই 'এক'। তাই সর্বভুতে একমাত্র ভগবানই বিরাজমান -'বাসুদেবঃ সর্বম্'।

বীজ হতে যেমন চারা হয়, তেমনই এক ভগবান হতে এই সম্পূর্ণ জগত সংসার সৃষ্ট হয়েছে। যেমন গম থেকে গম, পশু থেকে পশু, মানুষ থেকে মানুষই উৎপন্ন হয়, তেমনই ভগবান থেকে ভগবানই হয়। অর্থাৎ, জগত-সংসার রুপে ভগবানই প্রকটিত। স্বর্ণ নির্মিত গহনা যেমন স্বর্ণময়ই হয়, লৌহ নির্মিত দ্রব্যাদি যেমন লৌহময়ই হয়ে থাকে, তেমনই ভগবান হতে সৃষ্ট এই জগতও ভগবৎস্বরুপই হয়। লৌকিক বীজের একটি প্রকার থেকে একই প্রকারের চাষ হয়। যেমন গম বীজ হতে গমই উৎপন্ন হয়, এমন নয় যে গম বীজ থেকেই গম, বাজরা, মুগ ইত্যাদি সর্বপ্রথম শস্যই উৎপন্ন হবে। বীজই পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। কিন্ত ভগবৎস্বরুপ বীজের বিশেষত্ব হল এই যে, সেই এক ভগবৎবীজ হতে নানা প্রকার জগৎ-সংসার সৃষ্টি হয় এবং এতো কিছু সৃষ্টি হলেও তাতে কোনো প্রকার বিকৃতি আসে না। তা একই ভাবে বিরাজ করে, কারণ এই বীজ হলো 'অব্যয়' এবং 'সনাতন'। এখানেই সচ্চিদানন্দ ভগবানের বিভুতি প্রকাশ। পরমকরুনাময় সচ্চিদানন্দ ভগবান শ্রীহরি সবার মঙ্গল আর কল্যাণ করুণ।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে!!"
!!জয় শ্রীগোবিন্দ!! জয় রাধে!!

Courtesy : দেবেন্দ্র
Share:

লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার বাণী

বাবা লোকনাথ একজন সিদ্ধ পুরুষ। তিনি মানবের কল্যাণে অসংখ্য অমৃত বাণী দিয়ে গেছেন যা অনুসরণ করলে মানব জাতি শান্তি ও স্বস্তি পাবে, মুক্তির পথ তার খুলে যাবে ............ আসুন হৃদয়ে ধারণ করি বাবার অমৃত বাণী ।

** সত্যের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। সত্যই স্বর্গমনের একমাত্র সোপানস্বরূপ, সন্দেহ নেই।

** যে ব্যক্তি সকলের সুহৃদ(বন্ধু), আর যিনি কায়মনোবাক্যে সকলের কল্যান সাধন করেন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানী।

** গর্জ করবি, কিন্তু আহাম্মক (নির্বোধ) হবি না। ক্রোধ করিব কিন্তু ক্রোধান্ধ হবি না।

** দেখ-অর্থ উপার্জন করা , তা রক্ষা করা, আর তা ব্যয় করবার সময় বিষয় দুঃখ ভোগ করতে হয়। অর্থ সকল অবস্থাতেই মানুষকে কষ্ট দেয়। তাই অর্থ ব্যয় হলে বা চুরি হলে তার জন্যে চিন্তা করে কোন লাভই হয় না।

** যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞ, ধার্মিক, সত্যাচারী, উদারচিত্ত, ভক্তিপরায়ন, জিতেন্দ্রিয়, মর্যাদা রক্ষা করতে জানে, আর কখনো আপন সন্তানকে পরিত্যাগ করে না, এমন ব্যক্তির সঙ্গেই বন্ধুত্ব করবি।

** ওরে, সে জগতের কথা মুখে বলা যায় না, বলতে গেলেই কম পড়ে যায়। বোবা যেমন মিষ্টির স্বাদ বলতে পারে না, সেই রকম আর কি!

** আমিও তোদের মতো খাই-দাই, মল-মূত্র ত্যাগ করি। আমাকেও তোদের মতই একজন ভেবে নিস। আমাকে তোরা শরীর ভেবে ভেবেই সব মাটি করলি। আমি যে কে, তা আর কাকে বোঝাবো, সবাই তা ছোট ছোট চাওয়া নিয়েই ভুলে রয়েছে আমার প্রকৃত আমি কে।

** সমাধির উচ্চতম শিখরে গিয়ে যখন পরমতত্ত্বে পৌঁছালাম, তখন দেখি আমাতে আর অখিল ব্রহ্মান্ডের অস্তিত্বে কোন ভেদ নেই। সব মিলেমিশে একাকার।

** রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়বি, আমাকে স্মরণ করবি, আমিই রক্ষা করবো।

* অন্ধ সমাজ চোখ থাকতেও অন্ধের মতো চলছে।

* এই বিরাট সৃষ্টির মধ্যে এমন কিছু নেই যাকে উপেক্ষা করা চলে বা ছোট ভাবা যায়। প্রতিটি সৃ্ষ্টি বস্তু বা প্রাণী নিজ নিজ স্থলে স্বমহিমায় মহিমান্বিত হয়ে আছে জানবি।

* যা মনে আসে তাই করবি, কিন্তু বিচার করবি।

* যে কর্ম মনে তাপের সৃষ্টি করে তাই পাপ। যে কর্মের মধ্য দিয়ে আত্মসচেতন বা শান্তির ভাব মনকে ভরিয়ে তোলে তাই পুণ্য এবং স্বর্গতুল্য।

* ধার্মিক হতে চাইলে প্রতিদিন রাতে শোবার সময় সারাদিন কাজের হিসাব নিকাশ করবি, অর্থাৎ ভাল কাজ কি করেছিস এবং মন্দ কাজ কি করেছিস, সেটা ভেবে মন্দ কাজ যাতে আর না করতে হয় তার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হবি।

* দেখ-যেখানে ত্যাগ নেই, আছে মোহ ও আসক্তি সেখানেই যত দুঃখ, দৈন্য ও অশান্তি।

* যারা ধর্ম নেই মনে করে সাধুগণকে উপহাস করে, আর ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে, তারা নি:সন্দেহে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।

* সচেতন হতে হবে। অচেতনাই জীবনের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরন্তর অভ্যাস এবং চেষ্টার ফলে তাকে সচেতনায় রূপান্তরিত করতে হবে।

* কাম, ক্রোধ সব রিপুই অবচেতন মনের স্তরে স্তরে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। সুযোগ পেলেই তারা প্রকাশ হয়, কারণ মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়। অচেতন মন রিপুদের অবাধ ক্রীড়াক্ষেত্র।

* মন যা বলে শোন, কিন্তু আত্মবিচার ছেড়ো না। কারণ মনের মতন প্রতারক আর কেউ নেই। মহাপুরুষদের বাক্য, শাস্ত্র বাক্যে শ্রদ্ধাবান না হলে প্রকৃত আত্মবিচার সম্ভব নয়।

* আত্ম-বিশ্লেষণের ধারাটিকে সদাজাগ্রত রাখতে না পারলে, কামগন্ধহীন শুদ্ধ মনের জগতে প্রবেশ করা যায় না। কাম কলুষিত বিক্ষিপ্ত চিত্তে ধ্যান বা সমাধিও সম্ভব নয়।

* ক্রোধ ভাল, কিন্তু ক্রোধান্ধ হওয়া ভাল নয়।

* গুরু প্রদত্ত মন্ত্রের শুদ্ধাশুদ্ধ বিচার করা শিষ্যের কর্ম নয়। গুরু যা বলেছেন বিনা দ্বিধায় তা জপ করে যাওয়াই শিষ্যের কর্তব্য।

* বিদ্যা, তপস্যা, ইন্দ্রিয়সংযম ‍ও লোক পরিত্যাগ ছাড়া কেউই শান্তিলাভ করতে পারে না।

* অহং চলে গেলে নিজের মনই নিজের গুরু হয়, সৎ ও অসৎ বিচার আসে। জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির মণিকাঞ্চন যোগ হলে শ্রদ্ধা হবে তোদের আশ্রয়, শ্রদ্ধা হবে তোদের বান্ধব এবং শ্রদ্ধাই হবে তোদের পাথেয়।

* ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, যে সন্তান মায়ের আদেশ পালন করে, ভগবান তার মঙ্গল করেন।

* দীন দরিদ্র অসহায় মানুষের হাতে যখন যা দিবি তা আমিই পাব; আমি গ্রহণ করবো।
 * দরিদ্রতায় ভরা সমাজের দুঃখ দূর করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করবি।

* তোরা যদি দীর্ঘায়ু হতে চাস্ তাহলে তোদের সদাচারী, শ্রদ্ধাশীল, ঈর্ষাহীন, সত্যবাদী, ক্রোধবিহীন ও সরল স্বভাব হতে হবে।

__ সংগ্রোহিত।
Share:

জানতে হলে পড়তে হবে

প্রতিটি মুহূর্ত চলাফেরা অথবা কাজ করার সময় ভগবানের নাম মনে মনে স্মরন করুন বা জপ করুন এবং মনে প্রানে বিশ্বাস করুন ভগবান আমাকে রক্ষা করবেন সমস্ত বিপদ আপদ হতে । তাহলে নিজেই দেখতে পাবেন কিভাবে কত বিপদ হতে আপনারা রক্ষা পাচ্ছেন তবে অবশ্যই সৎ থাকতে হবে । ভগবান আমাদের হাজারো বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন এবং সতর্ক করে দেন আর এসব পরীক্ষা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় একান্ত ভাবে ভগবান কে স্মরন করেই ।
.
আর চেষ্টা করুন প্রতিদিন একটি করে হলেও শ্রীমদভগবত গীতার শ্লোক পরতে এবং তা মনোযোগ দিয়ে তার অন্ত নিহিত অর্থ বুঝতে । শ্রীমদভগবত গীতা কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুখস্ত বা রিডিং পড়ে পূন্য অর্জন করার জন্য দেয়নি । এর মাধ্যমে দিয়েছে মানব কল্যানের পথ, দিয়েছে আত্মত্বত্ত লাভের পন্থা, দিয়েছে চির মুক্তির পন্হা, দিয়েছে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর, জীবনে চলার সঠিক রাস্তা । তাহলে কেন শুধু পুন্য অর্জনের জন্য মুখস্ত করছেন বা না বুঝে শুধু পড়ে যাচ্ছেন ? এবং আপনার সন্তানদের কেউ গীতা পাঠের অভ্যাস করান ।
আর আপনি নিজে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন মন্দিরে গিয়ে পাঠ শুনুন মন্দিরে গিয়ে এখানে সখানে বসে আড্ডা না মেরে এবং যাদের ছেলে মেয়ে আছে তাদেরকেও নিয়মিত মন্দিরে নিয়ে যান । ধর্মীয় গ্রন্থ পড়তে উৎসাহ দিন এবং তাদের সনাতনের এই বিশাল জ্ঞানভান্ডার কে জানান এবং নিজে জানুন । তবেই বৃদ্ধ বয়সে আপনার সন্তান আপনাকে ছেড়ে যাবে না অবহেলা করবে না । আপনার সন্তানদের সংস্কার দিন ও নিজেও সংস্কার জানুন । তবেই আপনার সন্তান তা লালন করবে ও ধারন করবে । তবেই সে ধর্মান্তরিত হবে না । মনে রাখবেন সন্তান আপনার কাছে যা শিখবে তাই লালান করবে । তাই নিজে মানুষ আপনার সন্তান এমনিতেই মানুষ হবে ।
.
নিজের ধর্মকে জানার চেষ্টা করুন তবেই আপনাকে বিধর্মীদের প্রশ্ন শুনে বিবরত হতে হবে না । তখন তাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর গুছিয়ে সুন্দর করে বোঝাতে পারবেন তখন তারাও বুঝবে ও অন্যকে বিরক্ত করবে না এবং নিজেও গর্ববোধ করবেন নিজেকে সনাতনী হিন্দু ভেবে । নিজে জানুন অন্যকে জানান ।
.
আর একটা কথা মনে রাখবেন সনাতন ধর্মে জাত প্রথা আছে এবং থাকবে তবে কখনই তা জম্মের ভিত্তিতে নয় তা হলো কর্মের ভিত্তিতে আর সেখানে কোন উচু জাত নিচু জাতের স্থান নেই । যার ব্রহ্ম জ্ঞান আছে বিদ্বান ও সৎ চরিত্রের অধিকারী তাকেই বলা হয় ব্রাহ্মন, এটা জম্মগত কোন অধিকার নয় । যিনি দেশ শাষন ও দেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত তিনি ক্ষত্রিয়, যেমনঃ সেনাবাহিনী, সরকার যা যে কেউ হতে পারে । যিনি ব্যবসা করেন তিনি বৈশ্য অর্থাৎ, টাটা আম্বানির মত ব্যবসায়ীরা । আর শুদ্র হলো যারা সেবা কাজে নিয়োজিত, যেমনঃ ডাক্তার, নার্স, আইনজীবী । সকলকেই কর্মের মাধ্যমেই ভাগ করা হয়েছে তবে কেন উচু জাত নিচু জাত এর কুসংস্কার নিয়ে বসে আছেন ? তাই বলি আগে জানুন তরে ব্যবহার করুন ।
লজ্জায় নয়, গর্ব করে বলুন আমি হিন্দু আমি সনাতন ।
লিখেছেনঃ অমিত
Like our page: সনাতন সন্দেশ - Sanatan Swandesh
Share this post
Share:

লক্ষ্যে একনিষ্ঠতা

বর্তমানের যান্ত্রিক সভ্যতায় জীবন যাত্রার গতি যেমন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, তেমনি আমাদের চিন্তাচেতনায়ও অস্থিরতায় চকিত থাকে সর্বক্ষণ। আমরা ধর্ম পালন তো দুরের কথা, ধর্মতত্ত্ব শোনার বা পড়ারও সময় পাইনা। অথচ শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সর্বচিন্তা কর্মে ধর্মাধর্ম পালনের সুন্দর উপদেশ দিয়েছেন।

আমরা দেখি, সন্ন্যাস জীবনে মানুষ গৃহত্যাগী হয়ে বনেজঙ্গলে অথবা আশ্রমে জীবনাতিপাত করেন। সে তো শুধু নিজের আত্মার উন্নতিকল্পে। ঈশ্বর আমাদের এই সংসারের জীবদের কল্যাণের নিমিত্তে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি গীতায় বলেছেন যে সকল কর্ম করেও কর্মে বা কর্মফলে যে আশা করেনা, সেই প্রকৃত সন্ন্যাসী। অর্থাৎ সকল কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করে লোক হিতার্থে কর্ম করাই আমাদের লক্ষ্যও উদ্দেশ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।

মাদকের নেশা যেমন মানুষকে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে টেনে নেয়, তেমনি ফলাকাঙ্ক্ষা কর্মেও মানুষের সর্বনাশ আর বন্ধন, তথা জীবন মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ করে। সংসারে আমাদের প্রধান লক্ষ্য সুখে শান্তিতে আপনজনদের সাথে জীবন যাপন করা। কিন্ত একবারও কি চিন্তা করে দেখেছি, সৎ পথে আর সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য আমাদের কর্তব্য কর্ম কেমন বা কিরুপ হলে আমরা ধর্মীয় চেতনা অক্ষুন্ন রেখে, সবদিক বজায় রাখতে পারি?

ফেসবুকে আজকাল দেখি প্রচুর ধর্মীয় পেজ গ্রুপ ইত্যাদিতে ভরপুর। যা দেখে সত্যিই ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে, যখন কারো কারো লেখার চমৎকারিত্বে। যদি এসব লেখা মৌলিক হয়, তবে লেখককে সাধুবাদ না দিলে সেটা হবে অকৃতঞ্জতা। কারণ এদের শাস্ত্রঞ্জান সত্যিই লোকশিক্ষায় সহায়ক। আমরা যদি ধর্মকর্ম নাও করি, এই যে ধর্মীয় কাজে সময় ব্যয়, এটা তো মিথ্যা নয়। যতক্ষণ একটা পোস্ট করতে, লাইক বা কমেন্ট করতে সময় লাগে, ততক্ষণ তো ভগবান সান্নিধ্যে থাকা হলো।
এখানে কারো কাছে কিছুরই প্রত্যাশা নেই, আছে শুধু জিঞ্জাসা যা ভগবদ্ কর্ম তথা ভগবদ্ঞ্জান সংগ্রহের আকাঙ্খা। গীতার মতে এটা অবশ্যই নিষ্কাম কর্ম। আমরা সবাই যদি এমন কাজে ব্যপ্ত থাকি

তবে আর বেশি দিন নেই, যেদিন ভগবানের অপার কৃপায় ঘরে ঘরে "হরিনাম" কীর্ত্তিত হবে।

তাই সকল বন্ধুদের নিকট আমার সবিনয় নিবেদন, আমরা যেন অহং, কর্তৃত্বাভিমান ইত্যাকার আসুরিক ভাব গুলি দুরে রেখে, সবাই সবার জন্য মঙ্গল আর শান্তির জন্য কাজ করি। আর আমাদের উত্তরসুরিদের ধর্মীয় আদর্শ ও ভাবধারায় মানুষ করার চেষ্টা করি।

আমাদের চেষ্টায় যদি কোনো সংশয় বা কর্মে যদি কোনো আকাঙ্খা না থাকে, তবে নিশ্চয়ই আমরা সফল হবোই হবো। কারণ স্বয়ং ভগবান আমাদের সাথে আছেন। আর আমাদের মহা অস্ত্র, সর্ববিপদ সংহারী মহামন্ত্র তো আছেই।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে!!"
!!জয় শ্রীকৃষ্ণ!! জয় রাধে!!
!!জয় সকল ভক্তবৃন্দের!!

courtesy : দেবেন্দ্র
Share:

কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্

পরমকরুনাময় সচ্চিদানন্দঘন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল জীবের বীজ। যা তিনি শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় বার বার বলেছেন যে তিনি সকল দেবতার দেবতা। সকল ঈশ্বরের ঈশ্বর। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকে বড় কোনো ঈশ্বর নেই। এই চরম সত্যটা অনেকে মানতে চাননা। তাঁদের ধারণা বা বিশ্বাস এমনকি মনে করেন যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একজন একজন যোগী ছিলেন, ঈশ্বর নন।

যোগের আটটি অঙ্গ। যা হলো, যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি। সর্ব প্রথমে যম কে ধরা হয়। যম পাঁচ প্রকার, অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ। সুতরাং যিনি যোগী, তিনি অবশ্যই 'যম' পালন করবেন। অর্থাৎ সত্য কথা তাঁকে বলতেই হবে। যদি তিনি অসত্য বা মিথ্যা কথা বলেন, তবে তিনি যোগী হতে পারেন না। কেননা তিনি যোগের প্রথম অঙ্গ 'যম'ই পালন করেননি। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কয়েক স্থানে নিজেকে ঈশ্বর বলে জানিয়েছেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, তিনি যদি যোগী হয় থাকেন, তাহলে অবশ্যই সত্য কথা বলেছেন। আর তিনি যদি সত্য কথা বলে থাকেন, তাহলে তিনি যে সচ্চিদানন্দঘদ পরম ঈশ্বর একথা মানতেই হবে। কাজেই যাদের অঞ্জানতার ও অবিদ্যার ফলে এমন অহেতুক কথা প্রচার ও বিশ্বাস করেন, তাঁরা যত শিঘ্র নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন, ততই মঙ্গল। আর সবথেকে বড় প্রমাণ তো "কৃষ্ণ নাম"

জপ কীর্ত্তন। এই নাম জপ কীর্ত্তনে যে মানসিক তৃপ্তি ও শান্তি, তা' আর কোথায়?

তাই সকল বন্ধুদের আহবান করি এই মধুর নাম জপ কীর্ত্তন করার জন্য। নিশ্চয়ই ভগবান সবার মনের সংশয় কাটিয়ে পরম শান্তি প্রদান করবেন।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে!!"

!!জয় শ্রীকৃষ্ণ!! জয় রাধে!!

কার্টেসীঃ দেবান্দ্র
Share:

শ্রীভগবানর্পনেই পূর্ণতা

সচ্চিদানন্দঘন, পরমেশ্বর ভগবান সকল উৎস্য ও সৃষ্টির কারণ। তিনি অনাদি ও অনন্ত, ষড়ৈশ্বর্যময়, চৌষট্টি কলায় পূর্ণতম। সকল জীবজড় তাঁর অস্তিত্বে এবং তিনি সকল জীবজড়ের অস্তিত্বে একীভূত। তাইতো তিনি সর্ববিভু, সর্বঞ্জ ও সকলের অন্তঃরাজ্যের অধিপতি। তাঁর পদে অর্পিত সকল কর্ম, চিন্তা, ধ্যান, ধারণা ইত্যাদি পূর্ণ থেকে পূর্ণময় হয়ে ওঠে।

আমরা অনেকে তানসেনের নাম শুনেছি। তিনি ছিলেন একজন গায়ক। তাঁর সঠিক গায়কী কুশলী আর সুরসৌষ্ঠবে প্রকৃতি সাড়া দিতেও অবহেলা করতো না। তানসেন ছিলেন দিল্লীর বাদশাহ আকবরের সভাগায়ক। তাঁর সঙ্গীত মুর্ছনায় আকবরের সভা বাঙ্ময় হয়ে উঠতো। আকবর বাদশাহ তানসেনের সঙ্গীতে এমন বিমোহিত হয়ে থাকতেন যে, তানসেনকে তুষ্টি করার ভাষা হারিয়ে ফেলতেন। একদিন তানসেন আকবরকে বললেন যে তিনি আর কি গান করেন, সঠিক গান করেন তাঁর সঙ্গীত গুরু হরিদাস ঠাকুর। আকবর বাদশাহ ছিলেন সত্যিকারের সঙ্গীত পিয়াসী মানুষ। তাই তিনি দাবী করলেন যে যেমন করেই হোক, হরিদাস ঠাকুরের গান তাঁকে শুনতেই হবে, তানসেন যেনো ব্যবস্থা করেন। তানসেন তাঁর গুরু হরিদাস ঠাকুরের নিকট যেয়ে বাদশাহর ইচ্ছার কথা জানালেন। হরিদাস ঠাকুর মহাকুন্ঠায় পড়লেন। তিনি যে সন্ন্যাসী মানুষ, রাজদর্শন যে মহা অপরাধ। তাই কিছুতেই তিনি রাজী হলেন না বাদশাহকে গান শোনাতে। 
তানসেন আকবরকে খুলে বললেন সব। কিন্ত বাদশাহ যে ছাড়বার পাত্র নয়, তিনি তানসেনকে বললেন যে ঠাকুরের গান তাঁকে শুনতেই হবে, তা যেমন করেই হোক। তানসেন জানতেন তাঁর গুরু কোন সময়ে গান করেন। তিনি আকবরকে বললেন যে রাতের অন্ধকারে গোপনে গুরুদেবের কুটিরে গেলে, ভাগ্য যদি প্রসন্ন হয় তবে শোনা যেতে পারে। যথারীতি বাদশাহ আকবর আর তানসেন ছদ্মবেশে রাতের অন্ধকারে হরিদাস ঠাকুরের কুটিরের পার্শ্বে লুকিয়ে রইলেন। সময় যেনো আর কাটে না। অবশেষে রাত দ্বিতীয় প্রহরের শেষে, তৃতীয় প্রহরের শুরুতে হরিদাস ঠাকুর গান শুরু করলেন। তিনি জানতেও পারলেন না, তাঁর এক পরম ভক্ত কতো কষ্ট ভোগ করে তাঁর গান শুনছেন। হরিদাস ঠাকুরের গান শুনে, আকবর এমন বিমোহিত হলেন যে, তাঁর মুখে কোনো ভাষা আসলো না। গান শেষে যেভাবে গোপনে দুজন এসেছিলেন, সেভাবে গোপনেই দরবারে চলে গেলেন।

এরপর তানসেনের গান আর খুব একটা ভাল লাগতো না আকবরের। একদিন তিনি বলেই ফেললেন তানসেনকে। "আপনার গুরু এমন ভাল গান করেন, কিন্ত আপনার গান তার ধারেকাছেও যায়না কেনো?"

উত্তরে তানসেন বললেন, "দেখুন নবাব, আমার গানের শ্রোতা দিল্লীশ্বর আর তাঁর সভাসদেরা, কিন্ত আমার গুরুদেবের গানের শ্রোতা স্বয়ং জগদীশ্বর আর তাঁর ভক্তরা। তাই শ্রোতার তারতম্যের ফলেই গানের এমন পার্থক্য।"

আসলেই তো তাই। ভগবদ্ভক্তরা যেমন ভগবদ্ভক্ত কথা শুনতে, জানতে আগ্রহের অন্ত রাখেনা, তেমনি ভগবানও ভক্তদের প্রাণের কথা শুনতে সদা উদগ্রীব হয়ে থাকেন। তিনি শুধু ভক্তদের তাঁর উপর আন্তরিকতার আর ভক্তির ভাবই দেখতে চান। তাই বন্ধুরা আমরা যেনো ভগবানের উদ্দেশ্যে যা কিছু করি, তা আড়ম্বরে না করে ভক্তিভাবে করি। আর নিরন্তর জপকীর্ত্তন করি।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে!!"

!!জয় শ্রীহরি!! জয় রাধে!!

Written by: দেবেন্দ্র
Share:

সকল জীবই স্ব-আত্মীয়

এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পূর্বে সচ্চিদানন্দ ভগবান ছিলেন "একমেবাদ্বিতীয়াম্"। সৃষ্টির মূলে যেমন তিনিই সব আবার স্থিতি ও ধ্বংসের কারণও তিনি একাই। তাঁর লীলামধুর্য্য তথা হ্লাদিনী শক্তির আস্বাদনের নিমিত্তে তিনি বহু হলেন। মাধুর্য্যাবগাহনে তাঁর বিভুতি প্রকাশে আমরা প্রত্যক্ষ করি অবাক বিশ্ময়ে। সকল জীবের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ জীবাত্মা রুপে। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, তার সবথেকে প্রিয় ব্যাক্তি কে, নিশ্চয়ই উত্তর আসবে সে নিজেই। কারণ মানুষ নিজেকে যতোটা ভালবাসে, ততোটা আর কাউকে নয়। এর পরই আসে মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান তথা পরিবার। এর পর সেই ভালবাসার ক্ষেত্র ক্রমে পরিবর্ধিত হয়ে, পরিবার থেকে, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ, গ্রাম, এলাকা, দেশ ছাড়িয়ে যায়। জাতীয় পর্যায় ছেড়ে ক্রমে এই ভালবাসা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছায় যখন মতে ও পথে মিল হয়। এমনকি পরিচয় বা সম্পর্ক জনিত কারণেও ভালবাসা প্রকাশিত হয়। এটা আমাদের সম্পর্কোন্নয়ন বা চেনা জানা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্ত এই চেনা জানা বা সম্পর্কের বাইরে আর একটা কারণ আমরা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো।

এই যে ফেসবুকে কতজনের কত শত হাজার বন্ধু, হয়তো অনেকের সাথে অনেকের দেখাও হয়নি বা কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না। অথচ মনে হয় কেউ কেউ কতো আপন, যেন জন্ম জন্মান্তর ধরে পরিচিত। কেউ কি এর কারণ খোঁজার প্রয়াস করেছে? আমার মনে হয়, না। এটাই আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি, যা ভগবান গীতায় বলেছেন। আত্মায় আত্মায় মিলন হলেই তো আত্মীয় হয়। এই যে আমার দেহের যে জীবাত্মা, সে তো পরমাত্মারই অংশ। ওই যে কুকুর, সাপ, কীট, পতঙ্গ সহ লক্ষ কোটি জীব, সবার দেহের ভেতরের জীবাত্মা ও তো সেই এক পরমাত্মার অংশ। তাহলে কি বিশ্বের সকল জীবই আমার আত্মার সাথে সম্পর্কিত হলো না? এযে পরমেশ্বরের অকৃত্রিম বিভুতি, একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মানুষে মানুষে, অন্য প্রাণীতে যতোই হানাহানি হোক না কেন, সবাই যে সবার পরমাত্মীয়, একথা অস্বীকার করার কোনো কারণও নেই।

তাইতো শ্রীগীতায় ভগবান "সর্বভূতে সমদর্শন" নামে একটা কঠিন অথচ প্রাণ্জল ও সার্ব্বজনীন শব্দ বসিয়ে সবাইকে সবার সাথে বেঁধে রেখেছেন। ঈশ্বর সর্বদা সর্বভুতে বিরাজমান। সকল জীব, বস্তু তার বাইরে নয়। তিনি যেমন অনন্ত অসীম, তেমনি সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতম। যেদিন আমরা পরস্পর পরস্পরকে সত্যিকার ভাবে আত্মীয় বা আপন ভেবে ভালবাসতে পারবো, সেদিন হবে আমাদের প্রকৃত ভক্তিতত্ত্বের প্রকাশ। আর তা যতদিন না হচ্ছে, যতোই আমরা ভগবদ্ ভক্ত বলে পরিচয় দেই বা আত্মশ্লাঘায় কালাতিপাত করি না কেন, আমাদের ভক্তি, "মদ্-ভক্ত" পর্যায়ে উঠতেই পারবে না। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমরা 'গীতামৃত' রুপ ভগবদ্ বানী, যা সর্বোপনিষদ রুপী গাভীর দুগ্ধ, অমিয় তৃপ্তির সাথে আস্বাদন করতে পারছি। আমাদের প্রতি ভগবানের এটা বিশেষ কৃপা। আর এই অমৃতের উপভোগ তখনই সার্থক হবে, যখন তা' আমরা ব্যবহারিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বক্ষণ প্রয়োগ ও অনুসরণ করতে সক্ষম হবো। তদুপরি শ্রীমন্ মহাপ্রভুর বাণী, "সর্ব ঘরে হরি নাম সঙ্কীর্তন" ধ্বনীত হবে অহর্নিশি। সকল মত পথ ভুলে মানুষ একে অপরকে কাছে টেনে নেবে আত্মীয়তার বন্ধনে। অন্য জীবদেরও দিবে যথার্থ মর্য্যাদা, তবেই না সার্থক মানব জন্ম আর প্রকৃত ভক্ত থেকে মদ্-ভক্ত হয়ে ওঠা। আর তখনই এই জীবাত্মা পরমাত্মায় বিলীন হতে আর হবে না বিলম্ব। অন্তরে এই আশা আছে অনেক দিন ধরেই। আরো অনেকের নিশ্চয়ই এমন ভাবনায় ভাবিত হয় প্রাণ। পরমকৃপাময় সচ্চিনানন্দ ভগবান সকল জীবের কল্যাণ আর মঙ্গল করুণ। শ্রীহরির চরণকমলে এ অধমের এই প্রার্থনা।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে!!"

!!জয় শ্রীকৃষ্ণ!! জয় রাধে!!
!!জয় হোক সকল জীবের!!

কার্টেসীঃ দেবেন্দ্র
Share:

বর্ণ, সঙ্করবর্ণ ও বিবাহ


ভগবান শ্রীগীতায় বলেছেন, "আমি গুণ ও কর্মানুসারে চারি বর্ণের সৃষ্টি করেছি।" এই চারবর্ণ হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। ব্রাহ্মণের স্বভাবজ কর্ম হলো, শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষান্তি, আর্জ্জব, ঞ্জান, বিঞ্জান ও আস্তিক্যবুদ্ধি। যা সত্ত্বেও গুণময়। সত্বগুণের গৌনাধিকারে ও রজোগুণের মুখ্যাধিকারে সৃষ্ট জীব ক্ষত্রিয়। এদের কর্ম শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দাক্ষ্য, অপলায়ন, দান ও ঈশ্বর ভাব। তমোগুণের গৌনাধিকার ও রজোগুণের মুখ্যাধিকারে সৃষ্ট জীব বৈশ্য। এদের কর্ম কৃষি, গোরক্ষা ও বানিজ্য। পরিশেষে তমোগুণের মুখ্যাধিকারে সৃষ্ট জীব হয় শূদ্র। এদের কাজ সেবা করা। তাই বলে শূদ্র ব্রাহ্মণাদির ক্রীতদাস নয়। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের সম্পর্কের মতোই।

ঋগ্বেদ-সংহিতায় একটি বিশিষ্ট মন্ত্রে বলা হয়েছে যে পরম পুরুষের মুখ হতে ব্রাহ্মণ, বাহু হতে ক্ষত্রিয়, ঊরু হতে বৈশ্য এবং চরণ হতে শুদ্রের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই চতুরাঙ্গের ব্যবহার ও কর্ম অনুসারেই চতুর্বর্ণের কর্ম নির্দিষ্ট। শুধু ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত হলেই যে সে ব্রাহ্মণ হবেন, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যদি তার মধ্যে ব্রাহ্মণের গুণ-কর্ম না থাকে, তবে সে শুদ্রের হিসেবেই গন্য। পক্ষান্তরে শুদ্রের বংশোদ্ভূত হলেও যদি তার মধ্যে ব্রাহ্মণের গুণাবলী দৃষ্ট হয়, তবে সে ই ব্রাহ্মণ। এই প্রসঙ্গে মহাত্মা মনু বলেছেন, "যাঁহারা দ্বিজ বলিয়া পরিচয় দেন, তাঁহারা যদি বেদ অধ্যায়ন না করিয়া অসৎপথে চলেন, তবে বাস্তবিকই তাঁহারা শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন।"


মহর্ষি অত্রি স্বকীয় সংহিতায় ব্রাহ্মণকে দশ শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যা হলো, দেবব্রাহ্মণ, মুনিব্রাহ্মণ, দ্বিজব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ব্রাহ্মন, বৈশ্যব্রাহ্মণ, শূদ্রব্রাহ্মণ, নিষাদব্রাহ্মণ, ম্লেচ্ছব্রাহ্মণ, চন্ডালব্রাহ্মণ ও পশুব্রাহ্মণ। মহর্ষি এদের স্বভাব বলেছেন এমন-

*যে ব্রাহ্মণ যথাবিধি স্নান, সন্ধ্যা, উপাসনা গায়ত্রীজপ, হোম, অতিথি সৎকার, দেবতা পূজনাদি কর্ম নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন, তিনি দেবব্রাহ্মণ।

*যিনি উপরোক্ত গুণসম্পন্ন হয়ে বিশেষতঃ শাকপত্র ও ফলমূলাদি দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করতঃ বানপ্রস্হ অবলম্বন করেন, তিনি মুনিব্রাহ্মণ।

*যিনি দেবব্রাহ্মণের লক্ষণযুক্ত হয়ে সর্বপ্রকার বিষয়াসঙ্গ ত্যাগ করতঃ তত্ত্বানুসন্ধিৎসু ভাবে বেদান্তপাঠ ও সাংখ্যযোগ বিচার করেন, তিনি দ্বিজব্রাহ্মণ।

*যিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে ধনুক ধরে বিপক্ষকে আঘাত করেন, তিনি ক্ষত্রিয়ব্রাহ্মণ।

* যিনি বৈশ্যোচিত কৃষি, গোপালন ও বানিজ্য করেন, তিনি বৈশ্যব্রাহ্মণ।

* যিনি লাক্ষা, লবন মিশ্রিত দ্রব্য, দুগ্ধ, ঘৃত, মদ, মৎস্য, মাংস বিক্রয় করেন, তিনি শূদ্রব্রাহ্মণ।

*যে ব্রাহ্মণ পরস্যাপহারক, উৎকোচ গ্রহণে তৎপর, ঈর্ষা অসুয়াযুক্ত, পরের অপকারী, মৎস্য-মাংসে লোলুপ, তিনি নিষাদব্রাহ্মণ।

* যে ব্রাহ্মণ বৈদিক ক্রিয়াহীন সর্ব্বধর্ম্ম বিবর্জিত, নিষ্ঠুর, সে চন্ডালব্রাহ্মণ।

* যে ব্রাহ্মণের ব্রহ্মত্ব কিছুই নাই, কেবল যঞ্জোপবিতটি সম্বল -এই দেখিয়ে 'আমি ব্রাহ্মণ' গর্ব্বিত করে বেড়ায়, পাপহেতু সে পশুব্রাহ্মণ পদবাচ্য।

বিবাহ সংক্রান্ত সম্বন্ধে আচার্য্যদের অসবর্ণে বিবাহ স্বীকৃতি দৃষ্ট হয়। অসবর্ণ বিবাহ দ্বিবিধ, অনুলম ও বিলোম। অনুলোম শাস্ত্র সম্মত বিলোম বয়াবহ। পিতা অপেক্ষা মাতা নিম্নবর্ণা এমতাবস্থায় বিবাহ
বিধিসম্মত, এতদ্বিপরিত নিষিদ্ধ। পিতা মাতা উভয়েই স্ববর্ণের হলে, তাদের জাত সন্তানকে 'সজাতিক' বলা হয়েছে।
অনুলোম বিধিতে ব্রাহ্মণ পিতা, ক্ষত্রিয় মাতার সন্তান 'মূর্ধাবসিত', ব্রাহ্মণ পিতা বৈশ্য মাতার সন্তান 'অন্বিষ্ঠ', ক্ষত্রিয় পিতা ও ও বৈশ্য মাতার সন্তান 'মাহিষ্য'। এই তিন সন্তানকে 'অনন্তরজ' সন্তান বলা হয়েছে। তবে এই তিন সজাতিক ও তিন অনন্তরজ মোট ছয় পুত্র সন্তানই দ্বিজধর্মী বলে গণ্য। তারা উপনয়নাদি সংস্কার গ্রহণ করতে পারবে।

উপনয়ন বিবাহ সংস্কারাদির যথেচ্ছতা দ্বারা নিম্নবর্ণ বা উচ্চবর্ণ বিবেচিত হবে না। গুণ ও কর্মের দ্বারাই এটা পরিস্ফুটিক হবে। উচ্চবর্ণে আরোহনেচ্ছু ব্যাক্তির গুণ কর্মাদির উন্নতি সাধনই প্রধান লক্ষ্য হওয়া
উচিত। রজস্তমোময়ী চিত্তবৃত্তিকে সত্ত্বগুণময় করতে পারলেই তার উচ্চাধিকার স্বতঃই স্বীকৃত। অহিংসা, অস্তেয়, শৌচ, সংযম, সত্য এই পঞ্চবিধ ধর্মকে মানবধর্ম বলা হয়েছে। এটা চতুর্বর্ণেরই পালনীয় বলে মনু ব্যবস্থা দিয়েছেন।

তাই আমরা সকল ভাই, বোন, বন্ধু, সন্তানসহ শুভানুধ্যায়ীদের নিকট বিনীত নিবেদন রাখি, যেখানে 'কৃষ্ণ নামে' সকল পাপ, অধর্ম, বর্ণের নিম্নতা বিদুরিত হয়, সেখানে আমরা সবাই মিলে সমস্বরে এক হয়ে যাই 'কৃষ্ণ কথামৃত' অমিয় সুধা আস্বাদন করে। নিশ্চয়ই শ্রীহরির কৃপায় সবার জীবন সুন্দরময়, মঙ্গলময় আর কল্যাণময় হয়ে উঠবে।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে!!"
!!জয় শ্রীকৃষ্ণ!! জয় রাধে!!
!!জয় হোক সর্বপ্রাণীর!!

কার্টেসীঃ দেবেন্দ্র

Share:

২৪ আগস্ট ২০১৭

আর্য বহিরাগত নাহলে কারা এই আর্য

আর্য কোনো জনজাতি ছিল না। আর্য মানে কোনো জাতি নয়, 'ব্যবহারে যে মহান' তাকে আর্য বলা হতো। সাধারণত ক্ষত্রিয় রাজাদের আর্যপুত্র বলে সম্বোধন করা হতো। অনেকে আর্য মানে একটি উচ্চ পদকে বুঝিয়েছেন। ভারতের আদি নাম আর্যাবর্ত। ম্যাক্স মুলার আর্য বলতে ভাষা ভিত্তিক শ্রেণী বুঝিয়েছেন, জনজাতি হিসাবে নয়।

আর্য বলতে জীবন যাপনের শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতিকে বোঝানো হয়েছে, বেশির ভাগ আধুনিক পণ্ডিত এই মতবাদ মেনে নিয়েছেন। তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র আর্যদের বর্ণবিভাগ। 'অন্ত্যযশ' বলে একটি উপজাতিকে আর্য বলা হচ্ছে না কারণ তারা আর্যদের এই জীবন যাপন পদ্ধতি মেনে চলতো না। অথর্ব বেদে অনার্যদের 'ব্রাত্য' বলা হয়েছে। অর্থাৎ যাদের কোনো পুজোর রীতিনীতি ছিল না।

সমগ্র ঋক বেদে 'আর্য' শব্দটি কখনোই একটি জনজাতিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়নি। যদি আর্যরা বিদেশী, আলাদা একটি জনজাতি হতো, তবে তারা নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক আবদ্ধ রাখতো নিজেদের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে। কিন্তু আর্য অনার্যদের মধ্যে বিবাহ খুব সাধারণ ছিল।

বর্ণবিভাগ প্রথায় চারটি বর্ণ ছিল। বর্ণ এখানে জীবিকা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু 'বর্ণ' মানে রঙ, তাই ইউরোপীয় পণ্ডিতরা রঙ অর্থে ব্যবহার করলো। দুটি বর্ণ বা রঙের কথা বলা হলো, সাদা ও কালো। প্রথম তিনটি বর্ণ সাদা ও শেষ বর্ণ কালো হয়ে গেলো। আর ভারতীয়দের আসল রঙ বাদামী অনুল্লিখিত থেকে গেলো। সব কিছু আরোপিত, কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। ঋক বেদে 'অনাস' বলে এক জাতির উল্লেখ আছে। 'অনাস' এর মানে 'নাক নেই' বলে ধরে নেওয়া হয় কারণ আর্যরা 'উন্নত নাসা' ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত 'অনাস' মানে যারা ঠিক ভাবে কথা বলতে পারতো না।
আর্যরা যদি সাদা হতো তবে তাদের উপাস্য বিষ্ণু, কৃষ্ণ কখনো কালো হতেন না। মহাভারতের নায়ক অর্জুন কালো, দ্রৌপদীর আর এক নাম কৃষ্ণা মানে কালো। এই মহাকাব্যের রচয়িতা বেদব্যাস কুরূপ ছিলেন। প্রচলিত আর্য মতবাদ সঠিক হলে তিনি অতি অবশ্যই কোনো সাদা সাহেব হতেন।

খ্রীঃ পূঃ 1500 সালে ইউরোপ থেকে কোনো জনজাতি ভারতে প্রবেশ করেনি। ওই সময় বড় কোনো অভিপ্রয়াণের কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। প্রায় এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগরে স্থানান্তরিত হবার প্রমাণ আছে। সেখান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে তারা। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আনুমানিক 60000 বছর আগে হয় এবং তার পরে আর কোনো জনজাতির অনুপ্রবেশ ভারতে ঘটেনি। আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে এক পৃথক ভারতীয় জনজাতির উন্মেষ ঘটে। নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যাতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে 60000 বছর ধরে ভারতে অন্য কোনো বড় মাপের বহিরাগত জনজাতি আসেনি। নৃতত্ত্ববিদ ডঃ বি এস গুহ প্রাগৈতিহাসিক মানব কঙ্কাল ও আজকের কঙ্কাল গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে ভারতীয় জাতিতে মোট ছয় রকম জাতির মিশ্রন ঘটেছে।

1. Negrito 2. Proto - Australoid 3. Mongoloid 4. Mediterranean 5. Western Brachycephate 6. Nordic

পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে খুব বড় সংখ্যায় মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে ইউরোপে চলে যায়। আর তাই ভাষাগত সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ইউরোপের সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতার অবদান বলা যেতে পারে।
*********************************************

বৈদিক সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী পর্যায়
------------------------------------------------------------------------
আর্যরা যদি বাইরে থেকে না আসে তাহলে এরা কারা? আর কোথা থেকেই বা এলো? আর্যরা কোথাও থেকে আসেনি। বিগত প্রায় 60000 বছর ধরে তারা ভারতীয় উপমহাদেশেই বসবাস করছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তারা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতা তৈরি করেছিল, সেটা হলো সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা।
হরপ্পা সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ বিগত কয়েক বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন কার্যের ফলে পাওয়া গেছে। প্রতিটা শহরের ডিজাইন, প্ল্যানিং, লে আউট সব এক। এক রকম নিকাশী ব্যবস্থা, খাদ্যশস্য ভাণ্ডার, স্নানাগার, বড় বড় প্রাসাদ, সব শহরেই পাওয়া গেছে। খ্রীঃ পূঃ 2600 সালে মেসোপটেমিয়ার সাথে হরপ্পার বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হরপ্পার সীলমোহর, গয়নার যে রকম নমুনা পাওয়া গেছে, একে তাই কোনো বিচ্ছিন্ন সভ্যতা না বলে এক সুশাসিত সাম্রাজ্য বলা উচিত হবে। সাম্রাজ্য অর্থাৎ কোনো কেন্দ্রীয় সংগঠিত শক্তিশালী শাসক ছাড়া এত নিয়ম মেনে সব কিছু করা সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে এমন এক সাম্রাজ্য এক যাযাবর গোষ্ঠীর হঠাৎ আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেলো, সেটা অসম্ভব।

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংস প্রধানতঃ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হয়েছিল। মহেঞ্জোদারো শহরেই 3 বার ভীষণ বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও মহেঞ্জোদারো অনেক উঁচুতে অবস্থিত ছিল। কিন্তু নীচু জায়গা সব সম্পূর্ণ রূপে জলের তলায় জলে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, আর সেই সব জায়গার খোঁজ এখন পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই পালিয়ে যাওয়া ছাড়া নাগরিকদের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। গুজরাটের লোথাল একটা বড় বন্দর শহর ছিল। জল দিয়ে ঘিরে যেখানে নোঙ্গর ফেলা হতো, আজো একি রকম আছে। বড়সড় কোনো আক্রমণ হলে সব ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো। এখনো পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতার কোনো জায়গায় আক্রমণের কোনো চিহ্ন নেই। কাজেই বন্যা ছাড়া ধ্বংসের অন্য কারণ ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না।

সরস্বতী নদী খুব বিশাল ছিল যা শুকিয়ে যায়। সিন্ধু নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এদের প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। এই সব জায়গার মাটি লবণাক্ত হয়ে যায়। রাজস্থান মরুভূমিতে পরিণত হয়। সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাবার পর মানুষ পূর্বে সরে আসে গঙ্গা যমুনা অববাহিকায়। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় এই সময় পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে আসার। খ্রীঃ পূঃ 1900 এর পরে মেসোপটেমিয়ার সাথে আর কোনো বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় যে শাসন ছিল তা দুর্বল হয়ে যায়। অর্থনীতিও ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ বেকার হয়ে যায়। পরবর্তী কালের হরপ্পা শহরে আগের মত নগর পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়নি। বড় বড় বাড়ির বদলে ছোট ছোট বাড়ি পাওয়া যায়। শিল্পের অবনতি, নিকাশী ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রশাসন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। বড় শহর বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেলো। ছোট শহরে মানুষের ভিড় বেড়ে গেলো। কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব হলো কারণ জমি সব অনুর্বর হয়ে যায় বন্যার জন্য। কাজেই মানুষ উর্বর জমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।
1995 থেকে 98 সালে মেহেরগড়, নৌশারো এবং পিরাকে ব্যাপক খননকার্য চলে। এই জায়গাগুলো প্রমাণ করে যে উন্নত শহুরে হরপ্পা সভ্যতা থেকে কিভাবে গ্রাম্য সভ্যতায় পরিণত হলো। খ্রীঃ পূঃ 1900 থেকে খ্রীঃ পূঃ 1300 সাল এই জন্য পরবর্তী হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়।
নাগরিক মানুষ অবস্থার বিপাকে পড়ে গ্রামীণ হয়ে গেলেও সংস্কৃতি কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় না। রীতিনীতি হারিয়ে যায় না। ধীরে ধীরে শুধু বিবর্তন হয়েছে মাত্র সময়ের সাথে সাথে। হরপ্পা সভ্যতার ওজন ও পরিমাপের পদ্ধতি গুপ্ত যুগেও পাওয়া যায়। বর্তমানে আমরা যে জগ, গরু বা পশু টানা গাড়ির অংশ, চিরুনি ব্যবহার করি, সেগুলো হরপ্পা সভ্যতার সময়েও ব্যবহৃত হতো।
1790 সালে জন প্লেফেয়ার একটি হিসাব কষে বলেন যে হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু খ্রীঃ পূঃ 4300 তে। বৈজ্ঞানিক ভাবে এই তথ্যের বিরোধিতা কেউ করেনি। কিন্তু বেন্টলে যে অযৌক্তিক অবাস্তব কারণ দেখান, সেটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামি। যেহেতু খ্রীঃ পূঃ 4000 এর আগের সময় বাইবেলের সময়পঞ্জী বহির্ভূত, তাই ব্যাখ্যা হলো না।
আসলে ঋক বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে কোনো বহিরাগত আক্রমণকারী আসেনি। বরঞ্চ বলা যায় যে দেশীয় সভ্যতার মৌলিক পুনর্গঠন হয়েছিল মাত্র।
ইউরোপীয় পণ্ডিতরা যে ঋক বেদের রচনাকাল খ্রীঃ পূঃ 1500 ধরেছিলেন, সেটাও কিন্তু গোড়াতেই ভুল হয়েছে। কারণ বেদ 'শ্রুতি'। অর্থাৎ বহু বছর ধরে প্রচলিত এই বেদ যা মানুষ শুনে মনে রেখে এসেছে। সেক্ষেত্রে কথ্য ভাষার পরিবর্তন হলেও শ্রুতি কিন্তু অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনা বেশী। অনেকে হরপ্পা সভ্যতার সাথে যজুর্বেদের মিল খুঁজে পেয়েছেন। আর ঋক বেদ হয়তো তার আগের সভ্যতায় তৈরি হয়েছিল, যখন সরস্বতী নদী প্রধান নদী ছিল।
আর ঠিক এখানেই শুরু হলো সব সমস্যার সূত্রপাত। কারণ ঋক বেদ ও অন্যান্য বৈদিক সাহিত্য পড়লে বোঝা যায় যে ভারতীয় সভ্যতা কতটা প্রাচীন। ভারতীয় সভ্যতা আসলে পৃথিবীর অন্যতম প সভ্যতা। ইউরোপীয় সভ্যতা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ভারতীয় সভ্যতার কাছে নিতান্তই শিশু হয়ে গেলো। কাজেই শুরু হলো কাটাছেঁড়া। অবৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলো বৈদিক সভ্যতা ইউরোপীয় সভ্যতার অবদান। ভারতীয় ভাষা ইউরোপীয় ভাষা থেকে সৃষ্ট। ভারতীয় বিজ্ঞান, দর্শন গ্রীসের বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আমরা, ভারতীয়রা এই তত্ত্ব আজো বিশ্বাস করি। আজো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস পড়ানো হয়, তাদের অনুবাদ করা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হয়।
ভারতবর্ষ আজো তাদের ইতিহাসে ইউরোপের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করেনি। দয়ানন্দ সরস্বতী, ঋষি অরবিন্দ বা বাল গঙ্গাধর তিলকের মত হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া সেই সময় এর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। আজো আসমুদ্রহিমাচল মনে করে যে আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী এবং তারা ইউরোপীয় বংশধর। এখনো খ্রীস্টান মিশনারীদের করা বেদের অনুবাদের উপর নির্ভর করে আমরা কথা বলি যেমন ম্যাক্স মুলার, গ্রিফিথ, মনিয়ের উইলিয়ামস, এইচ এইচ উইলসন ইত্যাদি। আজ যদি আমরা বাইবেলের অনুবাদ করে তার ইতিহাস নিজেদের মত করে বোঝাতে যাই, খ্রীস্টানরা মেনে নেবে কি?? আসলে উপমহাদেশের হিন্দুরা হিন্দু ব্যতীত সবাইকে বিশ্বাস করে এসেছে। আর নিজেদের নিম্ন মানের ভেবে ঘৃণা করে এসেছে। পরিণতি ভোগ তো করতেই হবে যতক্ষণ না স্বীয় চেষ্টায় মহিমান্বিত হয়ে সদর্পে নিজের আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।

সোর্সসমূহ :
1. T. Kivisild et. al, Current Biology, Vol 9, No 22, pp 133-134
2. Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, by Jonathan Mark Kenoyer, Oxford University Press, Karachi/American Institute of Pakistan Studies, 1998.
3. Myth of the Aryan Invasion of India by David Frawley
4. Koenaard Elst
5. Indian Gods and Kings, the story of a living past by Emma Hawkridge, Houghton Miffin Company 1935
6. Concise History of the World, An Illustrated Time Line by National Geographic
7. Racial Elements in the Population by DrB S Guha.

https://www.istishon.com/?q=node%2F23877

Share:

০৪ আগস্ট ২০১৭

বলিপ্রথা কি সত্যই হিন্দু তথা সনাতন ধর্মে নিষিদ্ধ?

মনসাপূজা, দুর্গাপূজা এবং কালীপূজা আসলেই দেখি কিছু মানুষ একটিভ হয়ে লেখালেখি এবং প্রচারণা শুরু করে দেয় শাস্ত্রীয় বলিপ্রথার বিরুদ্ধে। তাদের কিছু বালখিল্য যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চায় সনাতন ধর্মে পশুবলি অধর্মাচরণ এবং অশাস্ত্রীয় । তবে একথা সত্য যে বলি প্রথা অমানবিক এবং অনেকটা দৃষ্টিকটুও বটে।কিন্তু বলিপ্রথা কি সত্যই ধর্মে নিষিদ্ধ?

আমাদের পূজা পদ্ধতি প্রধানত দুইটি ধারায় বিকশিত বৈদিক এবং তান্ত্রিক শাস্ত্রাচার পদ্ধতি । এই দুটি পদ্ধতিতেই পশুবলির বিধান দেয়া আছে।
সারা পৃথিবীর হিন্দু সম্প্রদায় প্রধানত তিনটি প্রধান মতে বিভক্ত শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব। এ তিনটি মতের মধ্যে বৈষ্ণব মতটিকে বাদ দিলে অন্যদুটি মতে পূজা উপাসনার অত্যাবশ্যকীয়ভাবেই পশুবলির বিধান দেয়া আছে। শাক্ত মতের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দ্বাদশ অধ্যায় (১০,১১, ২০) সহ একাধিক স্থানেই দেবীপুজায় পশুবলির কথা বলা আছে। একইভাবে শৈবদের গ্রন্থাবলীতেও পশুবলির বিধান আবশ্যকীয়ভাবে দেয়া আছে।

শুধুমাত্র বৈষ্ণব পুরাণ এবং শাস্ত্রাবলিতে পশুবলির আবশ্যকতা খুব একটা পাওয়া যায় না। এর অন্যতম কারণ বৈষ্ণব শাস্ত্রাদিতে ও উপাসনায় অহিংসা তত্ত্বের প্রভাব এবং শ্রীরামানুজাচার্য, শ্রীমধ্বাচার্য, শ্রীনিম্বার্ক এই প্রধান চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধান আচার্যবৃন্দ সকলেই দক্ষিণ ভারতের। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, দক্ষিণ ভারতে ঐতিহাসিকভাবেই নিরামিষাশী প্রভাব প্রবল। সেখানে বহু মুসলিম এবং খ্রিস্টানরাও নিরামিষাশী।এই নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসেরই সরাসরি প্রভাব পরেছে বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলোর উপরে।

বেদের পরে বৈষ্ণবদের প্রধান গ্রন্থ হলো শ্রীমদ্ভাগবত এবং বিষ্ণু পুরাণ। তবে বৈষ্ণবদের জীবনে শ্রীমদ্ভাগবতের প্রভাব তীব্র এবং অসীম। ফেসবুকে যেহেতু বেশী কথা লেখার সুযোগ নেই তাই পশুবলি এবং মাংসাহার সম্পর্কিত ভাগবতের দুটি স্কন্ধের কয়েকটি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ তুলে দিচ্ছি। আপনারা নিজেরা পড়ে নিজেরাই বুঝে যাবেন যে পশুবলি এবং মাংসাহার সম্পর্কে ভাগবতের মতাদর্শ কি।
( এখানে অনুবাদে রণব্রত সেন সম্পাদিত এবং ত্রিপুরাশংকর সেনশাস্ত্রী ভূমিকা সম্বলিত হরফ প্রকাশিত শ্রীমদ্ভাগবত ব্যবহৃত হয়েছে)
"অজগর যাকে গ্রাস করেছে সে যেমন অন্যকে রক্ষা করতে পারে না, তেমনি কাল, কর্ম ও ত্রিগুণের অধীন পাঞ্চভৌতিক এই দেহের পক্ষে অন্য কাউকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভগবানই সকলের উপযুক্ত জীবিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হাতযুক্ত মানুষ হাত নেই এমন প্রাণীদের খায়, পা যুক্ত পশুরা পা নেই এমন খাদ্য অর্থাৎ ঘাস-লতাপাতা খায়। এভাবে বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের হত্যা করে। জীবই জীবের জীবিকা - এই নিয়ম। এ জগৎ ভগবানই। তিনিই সর্বজীবের আত্মা, অথচ অদ্বিতীয়, ঐভাবে স্বপ্রকাশ। তিনিই অন্তরস্থ, তিনিই বহিঃস্থ। এক ঈশ্বরকে মায়া প্রভাবে দেব,মানুষ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থিত দেখ।"
( শ্রীমদ্ভাগবত: প্রথম স্কন্ধ, ১৩ অধ্যায়, ৪৫-৪৭)
"শাস্ত্রে দেবোদ্দেশে পশুবধের বিধান থাকলেও বৃথা হিংসার বিধান নেই।....... কিন্তু ভোগাসক্ত মানুষ এই বিশুদ্ধ ধর্ম জানে না। শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ, গর্বিত ও পণ্ডিতম্মন্য সেই পাপাচারী নিঃশঙ্কচিত্তে পশুবধ করে, কিন্তু পরলোকে সেই নিহত পশুরাই তাদের মাংস খেয়ে থাকে। এইভাবে যারা পশুহিংসা দ্বারা পরদেহের প্রতি হিংসা করে, তারা সেই সর্বান্তর্যামী শ্রীহরিকেই দ্বেষ করে।"
(শ্রীমদ্ভাগবত : একাদশ স্কন্ধ, ৫ম অধ্যায়, ১৩-১৪)
শ্রীমদ্ভাগবতের দুটি কোটেশনে আপনাদের দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করবো-
১.হাতযুক্ত মানুষ হাত নেই এমন প্রাণীদের খায়, পা যুক্ত পশুরা পা নেই এমন খাদ্য অর্থাৎ ঘাস-লতাপাতা খায়। এভাবে বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের হত্যা করে। জীবই জীবের জীবিকা - এই নিয়ম। এ জগৎ ভগবানই।
২. শাস্ত্রে দেবোদ্দেশে পশুবধের বিধান থাকলেও বৃথা হিংসার বিধান নেই।....... কিন্তু ভোগাসক্ত মানুষ এই বিশুদ্ধ ধর্ম জানে না।
আশাকরি এখানেই আপনারা আপনাদের উত্তর পেয়ে গেছেন যে শ্রীমদ্ভাগবতে পশুবলি এবং মাংসাহার নিষিদ্ধ কি নিষিদ্ধ না?
একারণেই মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে -
দেবোদ্দেশং বিনা ভদ্রে হিংসা সর্বত্র বর্জয়েৎ।(১১.১৪৩)
দেবোদ্দেশে বলিদান উৎসর্গ ব্যতীত সর্বত্রই হিংসা বর্জন করতে হবে।
এবং এ বিষয়ে আরো বলা হয়েছে-
কৃতায়াং বৈধহিংসায়াং নরঃ পাপৈর্ন লিপ্যতে। (১১.১৪৩)
দেবোদ্দেশে বলিদানে যে হিংসা শাস্রে তাকে বৈধহিংসা বলা হয়েছে। হিংসা পাপ, কিন্তু বৈধহিংসায় পাপ স্পর্শ করে না।
আমি বিশ্বাস করি আর না করি, শাস্ত্রে আছে বলিকৃত পশু সকল বন্ধন মুক্ত হয়ে মুক্তিলাভ করে। আমাদের ষড়রিপুর নাশের প্রতীক হিসেবেই পশুবলি দেয়া হয়। যেমন পাঠা হলো অনিষ্টকর কামের প্রতীক, মহিষ হলো ক্রোধের প্রতীক। তবে পশুবলি হয়তো প্রতিকী, কিন্তু সত্যিকারের পশুবলি দেবতার উদ্দেশ্যে আমরা তখনই দিতে পারবো যখন সত্যিসত্যি আমরা আমাদের দেহ থেকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ,মদ ও মাৎসর্য রূপ শরীরস্থ এই ষড়রিপুকেই বিনাশ করে পশুত্ব থেকে
প্রথমে মনুষ্যত্ব এবং অন্তে দেবত্বে পৌছতে পারবো।

শ্রীভগবানের কাছে এই হোক আমাদের প্রার্থনা -
#ধিয়ো_যো_নঃ_প্রচোদয়াৎ।।

শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

( আমি জানি আমার লেখাটায় কিছু মানুষ দুঃখ পেয়েছেন, অথবা আমার উপরে বিরক্ত হয়েছেন; কিন্তু ঠিক কিছুই করার নেই আমার। গত কয়েকদিনের পশুবলির বিরুদ্ধে প্রচারণায়, অসংখ্য মানুষ আমার কাছে এ বিষয়ে আমার মতামত চায় ম্যসেঞ্জারে অথবা মোবাইলে ফোন করে। তখন আমি তাদের বলি, আমি বিষয়ে ধারাবাহিক দুইতিনটা পোস্ট দিয়ে দেবো। তাই বাধ্য হয়ে ঢেঁকিগেলার মতো এই পোস্টটি দেয়া। কেউ দুঃখ বা কষ্ট পেয়ে থাকলে, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত!)
Share:

হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে? জানতে হলে পড়তে হবে।

প্রায়ই আপনার মুসলমান বন্ধুদের কাছে আপনাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় - হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে? কবরও তো দিতে পারতো বা অন্যকিছু করতে পারতো। পুড়িয়ে ফেলা কি অমানবিক নয়?
আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হই। প্রথমে যে ইনফরমেশনটি আপনার জানা প্রয়োজন তা হলো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ হিন্দু-বৌদ্ধ রীতি অনুসরণ করে অর্থাত মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার করে। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপান থেকে শুরু করে চীন, করিয়া, ভারত ও অনান্য জাতি এই রীতি অনুসরণ করে। তাহলে আপনি প্রথমত: পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন : ১. পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপানিরা কি তাহলে অমানবিক ? পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ কি অমানবিক ? যদি এই অর্ধেক মানুষ অমানবিক হয় তবে এদের মধ্যে কেন আমরা সবচেয়ে কম হানাহানি দেখতে পাই ?
আসুন এবার প্রকৃত উত্তরের দিকে যাই।

১. হিন্দুধর্মে কবর দেয়া বা সমাধি দেয়া নিষিদ্ধ নয়। স্মৃতিশাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই এটা অনুমোদিত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে এখনও এটা প্রচলিত আছে। যেমন- নাথ বা যোগী সম্প্রদায় এবং সন্ন্যাসীদেরকে সমাধি দেয়া হয়। অনেক জায়গায় দেখা যায় কারও অপমৃত্যু হলে তার শব সমাধি দেয়া হয়, পোড়ানো হয় না।

২. আমরা কথ্য ভাষায় 'লাশ পোড়ানো' বলি, কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় এটা 'অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া'। এটা আবার কী? অন্ত+ইষ্টি=অন্ত্যেষ্টি। ইষ্টি মানে যজ্ঞ। অন্ত্যেষ্টি হলো জীবনের শেষ যজ্ঞ।
আমরা জানি, আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ ছিল যজ্ঞপ্রধান। জীবনের শুরু 'গর্ভাধান' থেকে জীবনের শেষ 'দেহত্যাগ' সবই হতো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। জীবৎকালে প্রতিদিনই পঞ্চমহাযজ্ঞ করতে হতো (এখনও করার বিধান)। এছাড়া অগ্নিহোত্র যজ্ঞের মতো বিবিধ যজ্ঞে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে 'হবি' (বর্তমানে পূজায় অর্ঘ্য নিবেদনের মতো) উৎসর্গ করা হতো। এ হলো ঈশ্বরের দেয়া জীবন ও দেহ দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির উপাদানসমূহ ভোগ করার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতাপূর্বক তাঁর উপাসনা করা। তাই অন্ত্যেষ্টি তথা জীবনের শেষ যজ্ঞে ঈশ্বরপ্রদত্ত এই দেহখানি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই 'হবি' বা অর্ঘ্যরূপে উৎসর্গ করা হয়। এটা সত্যিই চমৎকার একটা ব্যাপার!

৩. প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী বিশ্বচরাচর তথা আমাদের দেহও পাঁচটি ভূত বা উপাদান দ্বারা তৈরি। একে 'পঞ্চভূত' বলে। এগুলো হলো- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস), ব্যোম (আকাশ বা শূন্যস্থান)। যারা বলেন 'মাটির দেহ' বা দেহ শুধু মাটি দিয়ে তৈরি, তাই একে মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া উচিৎ, তারা অবশ্যই ভুল বলেন। বাস্তবে দেহ এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। শবদাহ করার মাধ্যমে দেহকে এই ৫টি উপাদানেই মিশিয়ে দেয়া হয় প্রত্যক্ষভাবে। দাহ শেষে অবশিষ্টাংশ জলে বিসর্জন দেয়া হয়। এজন্য শ্মশান সর্বদাই জলাশয়ের পাশে হয়ে থাকে।
অপরদিকে সমাধি বা কবর দিলে দেহ পঞ্চভূতে লীন হয় বটে, তবে পরোক্ষ ও ধাপে ধাপে। কারণ দেহ মাটির সাথে মেশে পঁচন প্রক্রিয়ায়। কোটি কোটি অনুজীব, পোকা-মাকড়ের খাবারে পরিণত হয় দেহ। এভাবে পঁচে গলে মাটিতে মেশানোই বরং দাহ করার চেয়ে বেশি অমানবিক মনে হয়।
একটা মজার তথ্য দিই। অনেক সময় আমরা বলি, লোকটা তো মরে ভূত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সে প্রকৃতিতে (পঞ্চভূতে) লীন হয়েছে -এটাই বুঝতে হবে।

৪. মৃত্যু হয় দেহের; আত্মার নয়। অবিনাশী আত্মা অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। এটা জগদীশ্বর পরমাত্মার অংশ। ('বিদ্রোহী' কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে কি?) জড় প্রকৃতির পঞ্চভূতে গড়া দেহ ফিরে যায় পঞ্চভূতে, আর জীবাত্মা ফিরে যায় পরমাত্মাতে। (মৃত্যুর পরে অবশ্যই আর কখনোই আপনি পুরনো দেহে ফিরে আসবেন না, বা কোন প্রকার শাস্তি/আজাব ভোগ করবেন না। শবদাহ করার পরে/মাটিতে মিশে যাওয়ার পরে নিশ্চয়ই লীন হওয়া দেহকে শাস্তি/আজাব যৌক্তিকভাবে সম্ভব নয়।)

৫. মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শোকের কোন ব্যাপার নয়। তীর্থস্থান বেনারস বা কাশীতে মৃত্যুও একটা উৎসবের ব্যাপার। 
"জাতস্য হি ধ্রুবর্মৃত্যো ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ"-গীতা। 
যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরেছে তার জন্মও নিশ্চিত।
অতএব, দেহান্তরের নিছক সাধারণ ঘটনায় শোক কেন? বরং জরাজীর্ণ রোগশোকে আক্রান্ত দেহ ছেড়ে জীবাত্মার নতুন সুস্থ-সুন্দর দেহে জীবন আরম্ভের প্রাক্কালে মৃতকে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানানোই উচিত।

Courtesy by: Rana Nandi

➤ লাইক এবং শেয়ার করে সকলকে জানার জন্য সুযোগ করে দিন।
➤ পোষ্ট গুলো ভালো লাগলে কৃপা পূর্বক পেজটিকে লাইক দিয়ে রাখুন।
Share:

ব‌লি রাজা ও বামন অবতার


প্রহ্লা‌দের পৌত্র ব‌লি । প্রহ্লা‌দ ছিলেন পরম হ‌রিভক্ত । ব‌লি ছিলেন বিষ্ণু‌দ্বেষী । বিষ্ণু‌নিন্দা করার জন্য প্রহ্লাদ ব‌লি‌কে অ‌ভিশাপ দি‌য়ে‌ছিলেন - " বিষ্ণু‌নিন্দার জন্য রাজ্য হারা‌বে ।তোমার দারুণ অধঃপতন হ‌বে । " ব‌লি ইহাতে ভয় পাইয়া ব‌লি‌লেন - " কি উপায় হ‌বে , পিতামহ ? এমন শাপ কেন দি‌লেন ? "

প্রহ্লাদ বলি‌লেন - " উপায় আবার কি ? শ্রীহ‌রি‌তে ভ‌ক্তি জন্মা‌লেই সব ফি‌রে পা‌বে । "

প্রহ্লাদ হ‌রিভক্ত ছি‌লেন - তাই ব‌লিয়া ই‌ন্দ্রের প্রতি বি‌দ্বেষ তাঁহার কম ছিল না । দেবতা‌দের তি‌নি শত্রু ব‌লিয়াই ম‌নে করি‌তেন । একশত বৎসর ধ‌রিয়া প্রহ্লা‌দ দেবতা‌দের স‌ঙ্গে অ‌বিরত যুদ্ধ চালান । বৃদ্ধ বয়‌সে প্রহ্লাদ পরা‌জিত হইয়া রাজত্ব ত্যাগ ক‌রেন । তি‌নি পৌত্র ব‌লি‌কে রা‌জ্যে অ‌ভি‌ষিক্ত ক‌রিয়া গদ্ধমাদন পর্ব্ব‌তে তপস্যার জন্য চ‌লিয়া যান ।

ব‌লি রাজা হইয়া দেবতাদের স‌ঙ্গে যুদ্ধ চালাইতে থাকেন । ব‌লির অ‌ন্ত‌রে বিষ্ণুভ‌ক্তি তখনও জা‌গে নাই । পিতামহের অ‌ভিশা‌পের ফ‌ল ফ‌লিল । ইন্দ্র বিষ্ণুর সহায়তায় ব‌লি‌কে রাজ্যভ্রষ্ট ক‌রি‌লেন ।ই‌ন্দ্রের ভ‌য়ে ব‌লি নানাস্থা‌নে লুকাইয়া বেড়াই‌তেন । একবার তি‌নি গর্দ্দ‌ভের রূপ ধ‌রিয়া ভ্রমণ ক‌রি‌তে‌ছি‌লেন । ছদ্মরূপ ধ‌রিলেও তাহা দেবতা‌দের দৃ‌ষ্টি এড়ায় না । ইন্দ্র তাঁহা‌কে দে‌খিয়া চি‌নিয়া ব‌লি‌লেন - " হে দৈত্যরাজ , আজ না হয় তু‌মি রাজ্যহারা হ‌য়েছ । তাই ব‌লে এ কি দুর্গ‌তি তোম‌রি ! ছি ছি ! কাপুরু‌ষের মত তু‌মি একটা গর্দ্দ‌ভের মধ্যে আত্মগোপন ক'‌রে আছ ! বড়ই লজ্জার কথা । "

দৈত্যরাজ উত্তর দি‌লেন - " এ‌তে আর লজ্জা বা দুঃখ কি আ‌ছে ? তোমা‌দের হত্তাকর্ত্তা বিধাতা বিষ্ণু মৎস , কূর্ম্ম , বরাহ ইত্যা‌দির রূপ ধ‌রে‌ছি‌লেন প্র‌য়োজন‌সি‌দ্ধির জন্য । তু‌মি নি‌জেও ব্রহ্মহত্যা ক‌রে মানস - স‌রোব‌রে পদ্মপাতার তলায় আশ্রয় নি‌য়ে‌ছি‌লে ।

আজ আমার দু‌র্দ্দিন - তাই আমাকে ধিক্কার দিচ্ছ । ইন্দ্র , আমার এ‌দিন থাকবে না । চাকা উ‌ল্টে যাচ্ছে । ইহ‌লো‌কের ঐশ্বর্য্য , ধনসম্পদ আজ আ‌ছে , কাল নেই । তা নি‌য়ে গর্ব্ব করছ , কর । দু'‌দিন পরে তোমার দশাও এম‌নি হবে । "

দৈত্যগুরু ব‌লি‌কে নানাস্থা‌নে খুঁ‌জি‌তে খুঁ‌জি‌তে সহসা একদিন আ‌বিস্কার করি‌লেন । তি‌নি ব‌লি‌কে বিশ্ব‌জিৎ য‌জ্ঞে অ‌ভি‌ষিক্ত ক‌রিলেন । সেই য‌জ্ঞের অ‌গ্নি‌তে আহু‌তি দিবামাত্র ই‌ন্দ্রের র‌থের মত এক‌টি রথ , ই‌ন্দ্রের অ‌শ্বের মত অশ্ব , সিংহ‌চি‌হ্নিত ধ্বজা , স্বর্ণময় ধনু , দিব্য কবচ ও দুই‌টি অক্ষয় বা‌ণে পূর্ণ তূণ উত্থিত হইল । শুক্রাচার্য্য এক‌টি বিজয়শঙ্খ দান ক‌রি‌লেন ।

নবরূ‌পে স‌জ্জিত হইয়া ব‌লি দৈত্য‌সেনা লইয়া প্রথ‌মে পৃ‌থিবীর রাজ্য অ‌ধিকার ক‌রি‌লেন ও তারপর স্বর্গরাজ্য - জ‌য়ের জন্য যাত্রা ক‌রি‌লেন । দেবগণ ভীত হইয়া বৃহস্প‌তির শরণ লই‌লেন ।

বৃহস্প‌তি ব‌লি‌লেন - " তোমরা যুদ্ধ কর‌তে যেও না । তোমরা এখন দুর্ব্বল । শুক্রাচার্য্য সঞ্জীবনী বিদ্যার দ্বারা দৈত্য‌দের বাঁ‌চিয়ে দে‌বে । তা ছাড়‌া , দুর্ব্বাসার অভিশাপ তোমা‌দের উপর চল‌ছে । তোমরা সব স্বর্গ হ'‌তে স'‌রে পড় । মর্ত্ত‌লো‌কে গিয়ে মানুষ ও জীবজন্তুর ম‌ধ্যে লু‌কি‌য়ে থা‌ক । "
ব‌লি বিনাযু‌দ্ধে স্বর্গরাজ্য অধিকার ক‌রিয়া লই‌লেন ।

শুক্রাচা‌র্য্যের উপ‌দে‌শে ব‌লি একশত বার অশ্ব‌মেধ যজ্ঞ ক‌রিলেন ।

বহস্প‌তি দেবতা‌দের উপ‌দেশ দি‌লেন - " দেখ , সমুদ্রমন্থন ক'‌রে অমৃত উদ্ধার করতে না পার‌লে আর দৈত্য‌দের তাড়া‌নো যা‌বে না । অমৃত পেলে তোমরা অমর হ'‌য়ে যাবে ।

শুক্রাচা‌র্য্যের সঞ্জীবনী বিদ্যা তখন বে‌শি অ‌নিষ্ট কর‌তে পার‌বে না । সমুদ্রমন্থন খুব দুরূহ কাজ । তোমরা একা পারবে না - দৈত্য ও দেবতা দুই দ‌লে মি‌লে মন্থন কর‌তে হবে । ব‌লির কা‌ছে গি‌য়ে প্রস্তাব ক‌রো । ও‌দের সাহা‌য্যে সমুদ্রমন্থন ক'‌রে অমৃত উঠলে ফাঁ‌কি দি‌য়ে তোমরা অমৃতভাণ্ডটা অ‌ধিকার ক'‌রে নি‌তে পার‌বে । বিষ্ণুর স‌ঙ্গে পরামর্শ কর । "

দেবগণ ব‌লির স‌ঙ্গে সাক্ষাৎ ক‌রিয়া সমুদ্রমন্থনের প্রস্তাব ক‌রি‌লেন । ব‌লি সম্মত হই‌লেন । দেবতারা দৈত্য‌দের সঙ্গে যোগ দিয়া সমুদ্রমন্থন ক‌রিয়া অমৃত অধিকার ক‌রিলেন । তাহা‌তে দেবাসু‌রে সংগ্রাম ঘোরতর হইয়া উ‌ঠিল । দেবতারা কিছু‌তেই স্বর্গরাজ্য হই‌তে দৈত্য‌দের তাড়াই‌তে পারি‌লেন না । দেবতামা অ‌দি‌তি বিষ্ণুর শরণাপন্ন হই‌লেন । অ‌দি‌তি ব‌লি‌লেন - " বৎস , তু‌মি ছাড়া ত ' আমার ছে‌লে‌দের আর স্বর্গরাজ্য ফি‌রে পাওয়ার উপায় দেখ‌ছি না । তু‌মি একটা উপায় কর । "

বিষ্ণু বলি‌লেন - " মা , প্র‌তিকার করবার জন্য তোমার গ‌র্ভেই আ‌মি একবার জন্ম নেব । তু‌মি নি‌শ্চিন্ত হ‌য়ে যাও । এবার আ‌মি বামন হয়ে জন্মাব । "

শ‌্রী‌বিষ্ণু অ‌দি‌তির গ‌র্ভে বামনরূপে জন্ম লই‌লেন ।

ক‌য়েক বৎসর প‌রের কথা । নর্ম্মদাতী‌রে ভূগুকচ্ছ নামক স্থা‌নে ব‌লি এক‌টি বিরাট যজ্ঞ ক‌রিলেন । সে য‌জ্ঞে ব‌লি যে যাহা চা‌হি‌তে‌ছিল , তাহাই দান করি‌তে‌ছিলেন । বাম‌ন‌দেব সেই যজ্ঞস্থ‌লে অ‌তি‌থি হইলেন । ব‌লি বামন‌দেবকে সমাদর ক‌রিয়া পাদ্য - অর্ঘ্য দিয়া অভ্যর্থনা ক‌রিয়া জিজ্ঞাসা ক‌রিলেন - " হে ব্রাহ্মণ , আপনার প্রার্থনা কি ? যা চান তা- ই পাবেন । "
বামন বলি‌লেন - " আমার প্রার্থনা সামান্য । আ‌মি ধনরত্ন চাই না , আ‌মি চাই সামান্য ত্রিপাদ ভূ‌মি । "
শুক্রাচার্য্য দে‌খিয়া বু‌ঝি‌লেন - এই বামন নিশ্চয় ছদ্ম‌বে‌শী বিষ্ণু । ইহার উ‌দ্দে‌শ্যে ভাল নয় । ব‌লি‌কে তি‌নি ব‌লি‌লেন - " মহারাজ , সাবধান ! এই বামন যা চাই‌বে , তা - ই‌ দি‌তে সম্মত হ‌বেন না । এই বামন এ‌সে‌ছে আপনা‌কে ছলনা কর‌তে । "
ব‌লি ব‌লি‌লেন - " আ‌মি যখন অঙ্গীকার ক‌রে‌ছি , তখন ই‌নি যা চান , তা - ই দেবই । "

দান ক‌রিবার আগে আচমন ক‌রি‌তে হয় । আচম‌নের জল যাহাতে ব‌লি না পান , সেজন্য শুক্রাচার্য্য ভূঙ্গারের মধ্যে প্র‌বেশ ক‌রিয়া জল‌রোধ ক‌রি‌লেন ।ভূ্ঙ্গার ভরা , অথচ জল প‌ড়ে না ! তখন বামন এক‌টি কুশ লইয়া ভূঙ্গা‌রের ন‌লের ম‌ধ্যে খোঁচা দিলেন - তাহা‌তে শুক্রাচা‌র্য্যের এক‌টি চোখ কানা হইয়া গেল ।
যাহাই হোক , ব‌লি আচমন ক‌রিয়া দা‌নে উদ্যত হই‌লেন । বামন‌দেব তখন বিশ্বরূপ ধারণ ক‌রি‌লেন । এক পা‌য়ে তি‌নি পৃ‌থিবী , অন্য পায়ে তি‌নি স্বর্গ আক্রমণ ক‌রি‌লেন । তাঁহার না‌ভি‌দেশ হই‌তে তৃতীয় এক‌টি চরণ নিঃসৃত হইল ।

বামন‌দেব ব‌লি‌লেন - " এই পদ‌টি কোথায় ফেলব , দৈত্যরাজ ? "

প্রহ্লা‌দের পৌত্র ব‌লি , র‌ক্তের ম‌ধ্যে হ‌রিভ‌ক্তি ছিল - সেই ভ‌ক্তির চরম নি‌দর্শন দেখাইবার সময় আ‌সিয়া‌ছে । ব‌লি তৃতীয় প‌দের জন্য নি‌জের মাথা পা‌তিয়া দি‌লেন ।

‌ত্রি‌বিক্রম বামন‌দেব ব‌লির মাথার উপর তৃতীয় পদ রা‌খি‌লেন । ব‌লি চির‌দি‌নের জন্য ব‌ন্দী হই‌লেন ।

স্বর্গম‌র্ত্ত্যে আর ব‌লির ঠাঁই হইল না । ব‌লি পাতাল আশ্রয় ক‌রি‌লেন । তি‌নি পাতালের রাজা হইয়াই থা‌কি‌লেন । দেবতারা বাম‌নের ছলনায় স্বর্গরাজ্য ফি‌রি‌য়া পাই‌লেন । হ‌রিও চির‌দি‌নের জন্য ব‌লির কা‌ছে বন্দী হ‌ইয়া র‌হিলেন ।

স্বর্গম‌র্ত্ত্যে আর ব‌লির ঠাঁই হইল না । ব‌লি পাতাল আশ্রয় ক‌রি‌লেন । তি‌নি পাতালের রাজা হইয়াই থা‌কি‌লেন । দেবতারা বাম‌নের ছলনায় স্বর্গরাজ্য ফি‌রি‌য়া পাই‌লেন । হ‌রিও চির‌দি‌নের জন্য ব‌লির কা‌ছে বন্দী হ‌ইয়া র‌হিলেন ।

ব‌লি দৈত্যহ‌লেও অব‌শে‌ষে বিষ্ণুর নিকট পরা‌জিত হই‌লেন । তাই তি‌নিও ভ‌ক্তে প‌রিণত ।

হ‌রিবল

Courtesy: Joy Shree Radha Madhav
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।