• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২০ জুন ২০১৬

আজ জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা উৎসব

জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রা সূর্যের অয়নপথ পরিক্রমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রার সঙ্গে বর্ষাগমনের সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। আর বর্ষারম্ভেরই উৎসব জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। সূর্য-সপ্তাশ্ব বাহিত রথে আকাশলোক পরিক্রমণ করেন। জগন্নাথদেবও রথে আরোহণ করে গুণ্ডিচা যাত্রা করেন। অয়নপথে সূর্যের দিকে যাত্রা ও উত্তরে প্রত্যাগমন জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিবৃত্ত। বলরাম ও সুভদ্রা জগন্নাথদেবের সঙ্গী। স্কন্দ পুরাণমতে, জগন্নাথদেবের সঙ্গী বলরাম বিষ্ণুর অনন্ত শয্যার অংশীদার।শ্রী জগন্নাথদেবের প্রাকট্য সম্বন্ধে কিংবদন্তি ও শাস্ত্রীয় উক্তি, উভয় বিবরণ পাওয়া যায়।



উৎকল ভাষায় রচিত 'দেউল-তোলা' নামক উড়িষ্যায় বহুল প্রচারিত একটি কবিতা গ্রন্থ থেকে শ্রী জগন্নাথদেবের প্রাকট্যের ইতিহাস প্রচারিত হয়েছে। শ্রী ব্রহ্মার প্রথম পরার্ধে চতুর্বূ্যহ-ভগবান নীলমাধবমূর্তিরূপে শঙ্খক্ষেত্র-নীলচলে পতিত-নীচকে কৃপাবিতরণার্থ অবতীর্ণ হন। দ্বিতীয় পরার্ধে মনু-সন্ধি গত হলে সত্যযুগ আরম্ভ হয়। সেই সময় শ্রী ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজ মালবদেশের অবন্তীনগরীতে রাজত্ব করতেন। তিনি শ্রী ভগবানের সাক্ষাৎকার লাভ করার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। ভগবৎপ্রেরিত কোনো এক বৈষ্ণব তখন শ্রী ইন্দ্রদ্যুম্নের রাজসভায় উপস্থিত হয়ে কথা প্রসঙ্গে শ্রী নীলমাধবের কথা বলেন। রাজা এ সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন ব্রাহ্মণকে শ্রী নীলমাধবের অনুসন্ধানে পাঠান। সবাই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলেও বিদ্যাপতি অনেক কষ্টে অনেক ঘটনার পর নীলমাধবের সন্ধান দেন; কিন্তু রাজা শেষ পর্যন্ত নীলমাধবের দেখা পান না।


রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ শ্রী নীলমাধবের দেখা না পেয়ে অনশন করে প্রাণত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তখন জগন্নাথদেব তাকে স্বপ্নে বললেন, তুমি চিন্তা করো না, সমুদ্রের বাঙ্কিমুহান নামক জায়গায় দারুব্রহ্মরূপে ভাসতে ভাসতে আমি উপস্থিত হবো। রাজা এ-স্বপ্ন দেখার পরে সৈন্যসামন্তসহ ওই জায়গায় উপস্থিত হয়ে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মাকৃত শ্রী দারুব্রহ্মকে দেখতে পান এবং মন্দির স্থাপন করেন।রাজা দারুব্রহ্মকে মূর্তিতে প্রকট করার জন্য বহু দক্ষ শিল্পীকে আহ্বান করলেন; কিন্তু তারা কেউ দারুব্রহ্ম স্পর্শ করতে পারলেন না। তাদের অস্ত্রশস্ত্র সবই ভেঙে গেল।


অবশেষে স্বয়ং ভগবান 'অনন্ত মহারাণা' নামে আত্মপরিচয় দিয়ে একজন বৃদ্ধশিল্পীর ছদ্মবেশে রাজার দরবারে হাজির হয়ে ২১ দিনের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বিগ্রহকে প্রকটিত করবেন, এমনটি কথা দিলেন। ওই বৃদ্ধের উপদেশানুসারে রাজা অন্য কারিগরদের তিনটি রথ তৈরি করতে বললেন। বৃদ্ধ কারিগর দারুব্রহ্মকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে কাজ শুরু করলেন; কিন্তু দু'সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর কারিগরের অস্ত্রশস্ত্রের কোনো শব্দ না পেয়ে রাজা অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। শেষে মন্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও রাজ্ঞীর পরামর্শানুসারে জোর করে মন্দিরের দরজা খুলে ফেললেন। সেখানে তিনি বৃদ্ধ কারিগরকে দেখতে পেলেন না। কেবল দেখলেন, দারুব্রহ্ম তিনটি শ্রীমূর্তিরূপে প্রকটিত রয়েছে। আর সামনে এগিয়ে দেখলেন, মূর্তির হাতের আঙুল ও পায়ের আঙুল প্রকাশিত হয়নি। বিচক্ষণ মন্ত্রী জানালেন, ওই কারিগর আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং জগন্নাথ।


রাজা অপরাধ করেছেন_ এই মনে করে কুশশয্যায় প্রাণত্যাগ করবেন বলে ঠিক করলেন। রাতে জগন্নাথদেব তাকে স্বপ্নে বললেন, আমি এইরূপ দারুব্রহ্ম আকারেই শ্রীপুরুষোত্তম নামে শ্রী নীলাচলে নিত্য অধিষ্ঠিত আছি।ধর্মাতিহাস থেকে জানা যায়, কাঠ দিয়ে তৈরি বিষ্ণুদেবের মূর্তির মতো জগন্নাথদেবের মূর্তিকেও পূজা করা হতো আদিকাল থেকে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রা কত পুরনো তা না জানা গেলেও পুরীর জগন্নাথদেবের মূর্তিকেই জগন্নাথদেবের পূজার আদি বলে মনে করা হয়।


নীলাচলে বিষ্ণুর জীবন্ত মূর্তি, নীলমাধবের অন্তর্ধান ও পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুস্ন কর্তৃক বিশ্বকর্মাকে দিয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত বিবরণ স্কন্দ পুরাণের উৎকলখণ্ডে বর্ণিত আছে। জগন্নাথদেবের ত্রিমূর্তি বলরাম সুভদ্রা ও কৃষ্ণ বা জগন্নাথ। স্কন্দ পুরাণে জগন্নাথদেব নীল মেঘের মতো বর্ণ, কাঠ দিয়ে তৈরি, শঙ্খচক্রধারী বলভদ্র ও সুভদ্রা একসঙ্গে অবস্থিত।উৎকলখণ্ডের বর্ণনা অনুযায়ী, জগন্নাথদেব শঙ্খচক্রধারী, সুতরাং দ্বিভুজ; কিন্তু প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে বিশ্বকর্মা জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করার সময় কারও প্রবেশ ছিল নিষেধ, এমনকি আদেশদাতা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নেরও না।


বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরি করছেন তো করছেনই। এক দিন দুই দিন করে বেশ ক'দিন কেটে যাওয়ার পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অধৈর্য হয়ে বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। রাজা সেখানে দেখতে পান মূর্তির অঙ্গ অসম্পন্ন রয়েছে এবং সেখানে বিশ্বকর্মা নেই। সেই থেকেই জগন্নাথদেবের মূর্তি অসম্পন্ন।সারদা তিলকতন্ত্রে পুরুষোত্তমের ধ্যানে বিষ্ণুকে জগন্নাথদেব এবং পুরুষোত্তম বলা হয়েছে। তাই জগন্নাথদেবকে পুরুষোত্তমও বলা হয়ে থাকে।হিন্দু সমাজের প্রতিটি পূজা-অর্চনার পেছনে পুণ্যলাভের একটা ব্যাপার থাকে। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়। খুব সকালে উঠে জগন্নাথদেবের সঙ্গে স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার পুণ্যার্থী মনে করে থাকেন, তাদের পূর্বের যত পাপ-পঙ্কিলতা থাকে স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণ করলেই তা বিনাশ হয়ে যায় এবং অশেষ পুণ্য অর্জিত হয়। যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ বিশ্বাস অবিচল ছিল, আছে, থাকবে।


লিখেছেনঃ তারাপদ আচার্য্য
Share:

১৬ জুন ২০১৬

হিন্দু ধর্মে উল্লিখিত 'বিষ্ণুর দশাবতার' ও ডারউইনের প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্ব

হিন্দু ধর্মে বিষ্ণুর দশাবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ জনপ্রিয় ধর্মীয় বিষয়। অতি সহজ কথায়, হিন্দু ধর্মে জগৎ সংসারের পালন-কর্তা ভগবান শ্রী বিষ্ণু, যুগে যুগে (সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি) বিবিধ অশুভ শক্তি ও বিপদ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে দশবার বিভিন্ন অবতার রূপে জন্মগ্রহন করেছেন (বা করবেন)। এই দশ অবতারই, বিষ্ণুর দশাবতার নামে পরিচিত।
বিষ্ণুর দশাবতার ---- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, কলকি।
(আঞ্চলিক তারতম্যে, এই তালিকায় কখনও কখনও কৃষ্ণের পরিবর্তে বলরাম ; গৌতম বুদ্ধের পরিবর্তে জগন্নাথ বা বলরাম কে তালিকাভুক্ত করা হয়।)
অনেক আধুনিক বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা হিন্দু ধর্মে উল্লিখিত, বিষ্ণুর দশাবতার এর ডারউইনের প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের তুলনা করেছেন ---
মৎস্য -- মাছ, প্রথম পর্যায়ের মেরুদন্ডী প্রাণী, জলে উদ্ভূত, জলজ প্রাণী।
কূর্ম -- কচ্ছপ, জলে ও স্থলে বসবাসকারী উভচর প্রাণী।
বরাহ -- বন্য স্থলজ প্রাণী।
নরসিংহ -- অর্ধ মানব ও অর্ধ পশু রূপী প্রাণী।
বামন -- খর্ব, প্রাক-পরিনত মানব।
পরশুরাম -- জঙ্গলে বসবাসকারী ও আদিম অস্ত্র ব্যবহারকারী প্রাচীন মানব।
রাম -- সমাজবদ্ধ মানব।
কৃষ্ণ -- উন্নত রাজনীতিজ্ঞ মানব।
গৌতম বুদ্ধ -- সন্ন্যাসী, ধর্মজ্ঞ, দিব্যজ্ঞানযুক্ত মানব।
কলকি -- অতিআধুনিক প্রচন্ড ধ্বংস ক্ষমতা যুক্ত মানব।

Courtesy by : Prithwish Ghosh
Share:

কুলকুণ্ডলিনী


আমাদের শরীরের মধ্যে অসংখ্য নাড়ী আছে, তার মধ্যে ১৪টি প্রধান। এগুলো হলো- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, সরস্বতী, বারূণী, পূষা, হস্তিজিহ্বা, যশস্বিনী, বিশ্বোদরী, কুহূ, শঙ্খিনী, পরদ্বিণী, অম্লম্বুষা ও গান্ধারী। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান নাড়ীগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে কুহূনাড়ী জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে। এই কুন্দস্থানেই কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করছেন। কুলকুণ্ডলিনী হচ্ছে সমস্ত শক্তির আধার। প্রাচীনকালের সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী-ঋষিরা মানবদেহ ও মনের কুণ্ডলিত শক্তি-উৎস সম্পর্কে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে মত অনুসরণ করেই যুগে যুগে সাধকপুরুষরা যোগসাধনায় ব্যাপৃত থেকে এই শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভের অন্বিষ্ট খুঁজেছেন।
বলা হয়ে থাকে, আমাদের শরীরের মধ্যে মৃণালতন্তুর ন্যায় সূক্ষ্ম জগন্মোহিনী আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি নিজের মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারের মুখ আবৃত করে জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মধ্যবর্তী কুন্দস্থানে সর্বদা নিদ্রিত রয়েছেন। এ স্থানকে বলে মূলাধারচক্র। এটা সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া (Ida Nadi), মধ্যে সুষুম্না (Sushumna Nadi) ও ডানদিকে পিঙ্গলা (Pingala Nadi) নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষট্চক্র বলা হয়।
বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে -----
গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।
ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষট্চক্রান্তু ক্রমাদিতি।।
অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষট্চক্র বিরাজ করেন।
এই ষট্চক্র হচ্ছে ---
১) ললাটে অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে আজ্ঞাচক্র (Agnya Chakra),
২) আজ্ঞাচক্রের নিচে কণ্ঠমূলে বিশুদ্ধিচক্র (Vishuddhi Chakra),
৩) বিশুদ্ধিচক্রের নিচে হৃদিস্থানে অনাহত চক্র (Anahata Chakra),
৪) অনাহত চক্রের নিচে নাভিমূলে নাভিচক্র বা মণিপুর চক্র (Nabhi Chakra/Manipura Chakra),
৫) মণিপুর চক্রের নিচে লিঙ্গমূলে সুষুম্নার মধ্যে স্বাধিষ্ঠান চক্র (Swadhisthana Chakra),
৬) স্বাধিষ্ঠান চক্রের নিচে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে সুষুম্নানাড়ীর মুখদেশে মূলাধারচক্র (Mooladhara Chakra)।
এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান।সুষুম্নার এই সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথই মুক্তির পথ। মুক্তির এই পথ দিয়েই কুণ্ডলিনীকে উর্ধ্বদিকে চালিত করতে হয়। কুণ্ডলিনীর অবস্থান সম্বন্ধে সিদ্ধ-যোগীদের বক্তব্য হচ্ছে- ‘মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে যে মূলাধার চক্র আছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই স্থানটি হচ্ছে প্রজননশক্তি বীজের আধার। একটি ত্রিকোণ মণ্ডলে একটি ছোট সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে- যোগীরা এঁকে এই প্রতীকে প্রকাশ করেছেন। এই নিদ্রিত সর্পই কুণ্ডলিনী; এঁর ঘুম ভাঙানোই হচ্ছে রাজযোগের একটিমাত্র লক্ষ্য।’
কুণ্ডলিনীকে জাগরিত করার উপায় হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন- ‘ প্রাণায়ামের পূর্বে ঐ ত্রিকোণ মণ্ডলকে ধ্যানে দেখবার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ করে এঁর ছবি মনে মনে স্পষ্টরূপে কল্পনা কর। ভাবো এর চার পাশে আগুনের শিখা, তার মাঝখানে কুণ্ডলীকৃত সর্প ঘুমিয়ে রয়েছে। ধ্যানে যখন কুণ্ডলিনীশক্তি স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে তখন কল্পনায় তাকে মেরুদণ্ডের মূলাধারে স্থাপন কর; এবং তাকে অনুভব করার চেষ্টা কর। প্রাণায়ামসহ বিভিন্ন মুদ্রা ও বন্ধন অভ্যাস কালে কুম্ভকে শ্বাস রুদ্ধ রাখার সময় সুপ্ত কুণ্ডলিনীকে জাগাবার জন্যে ঐ রুদ্ধ বায়ু সবলে তার মস্তকে নিক্ষেপ করবে। যার কল্পনা শক্তি যত বেশি সে তত শীঘ্র ফল পায়, আর তার কুণ্ডলিনীও তত শীঘ্র জাগেন। যতদিন তিনি না জাগেন ততদিন কল্পনা কর- তিনি জাগছেন। আর ইড়া ও পিঙ্গলার গতি অনুভব করার চেষ্টা কর, জোর করে তাদের সুষুম্না পথে চালাতে চেষ্টা করো- এতে কাজ খুব তাড়াতাড়ি হবে। মনের সংযমের দ্বারাই কল্পনা করা সম্ভব।’
মহাসর্প অনন্ত যেমন রত্ন-নিধিসমাকীর্ণা পৃথিবীর একমাত্র আধার, তেমনি কুণ্ডলিনী শক্তি হঠ্তন্ত্রের আধার। ঐ কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হলে শরীরে ষট্চক্রস্থিত অখিল পদ্ম ও গ্রন্থি ভেদ হয়ে যাওয়ায় প্রাণবায়ু সুষুম্নাচ্ছিদ্র দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। প্রাণায়াম অভ্যাসে যা বিশেষ প্রয়োজন।
প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব-কার্য থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়, তাকে উর্ধ্বদিকে মানব শরীরের মহাবিদ্যুৎ আধার মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে পারলে সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌনশক্তি ‘ওজঃ’ বা আধ্যাত্মিক শক্তিলাভে সাহায্য করে। এই ‘ওজস’ হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব- একমাত্র মনুষ্যশরীরেই এই শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব। যাঁর ভেতর সমস্ত পাশব যৌনশক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে, তিনি মহাপুরুষ বা দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হন।
যোগীরা মনে মনে কল্পনা করেন যে এই কুণ্ডলিনী সর্প সুষুম্না পথে স্তরে স্তরে চক্রের পর চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রধারে (Sahastrara Chakra) উপনীত হয়। মনুষ্য শরীরের শ্রেষ্ঠ শক্তি যৌন-শক্তি যে পর্যন্ত না ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়, সে পর্যন্ত নারী বা পুরুষ কেউই ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে পারে না।
কোন শক্তিই সৃষ্টি করা যায় না, তবে তাকে শুধু ঈপ্সিত পথে চালিত করা যেতে পারে। এটাই রাজযোগের উদ্দেশ্য। কিন্তু এটা সাধারণ গৃহীদের কাজ নয়। একমাত্র যোগীরাই যোগ প্রভাবে এই সমস্ত নাড়ী সম্বন্ধে সবিশেষ জানতে পারেন এবং তা অনুভবও করেন। রাজযোগ অভ্যাস করতে হলে প্রথমে হঠযোগ আয়ত্তে আনতে হয়। হঠযোগই রাজযোগের সোপান।

Courtesy by : Prithwish Ghosh
Share:

বিষ্ণুর মোহিনী অবতার

অনেক যুগ আগের কথা সারা সৃষ্টিতে 'ওঁ নমঃ শিবায়' এই সুমধুর ধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে। দেবর্ষিনারদ ব্যাকুল হয়ে পরমপিতা ব্রক্ষার কাছে গেলেন। ব্রক্ষা বললেন ভষ্মাসুর নামক এক দানব শিবের এই আরধনা করছে। এই মধুর 'ওঁ নমঃ শিবায়' ধ্বনি তার মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে। নারদ বলল কি সুমধুর মন্ত্র তন মন পবিত্র করে দেয় এই ধ্বনি। ব্রহ্মা বললেন এই ধ্বনি বেশিক্ষন উচ্চারিত হলে সৃষ্টির বিনাশ হয়ে যাবে। দেবেশ্বর শিবশংকরকে দ্রুত কিছু করতে হবে। নারদ কিছুই বুঝল না ব্রক্ষার কথার অর্থ। তিনি প্রশ্ন করতে যাবেন ঠিক সেই সময় ব্রক্ষা চোখ বন্ধ করে ধ্যান মগ্ন হয়ে গেলেন। নারদ বিষন্ন মনে ব্রক্ষলোক থেকে পৃথিবী লোকের দিকে রওনা দিলেন। এদিকে ভষ্মাসুরের তপস্যার সাথে সাথে তার তপস্যার তেজ ও শক্তি বেড়ে চলছিল। সমগ্র পৃথিবীতে হাহাকার শুরু হয়ে গেল। তখন শিবশংকর কৈলাস থেকে অদৃশ্য হয়ে ভষ্মাসুরের কাছে এলেন এবং তাকে বর চাইতে বললেন। ভষ্মাসুর বর চাইলেন যার মাথায় ভষ্মাসুর হাত রাখবেন সেই ভষ্ম হয়ে যাবে। শিব তথাস্তু বললেন। বর পেয়ে অসুরের মাথায় কুবুদ্ধি এল। ভষ্মাসুর শিবকে বলল বর দিলেন যে এটা সত্য না মিথ্যা তার প্রমান কি। শিব বলল প্রয়োগ করে দেখ। তখন ভষ্মাসুর বলল সামনে তো আপনি ছাড়া আর কেউ নেই তবে আপনার উপরেই প্রয়োগ করে দেখি। শিব এই কথা শুনে দৌড় দিলেন। কারন শিবের মাথায় হাত দিলে শিব যদি ভষ্ম হয় তবে সংহার কাজ থেমে যাবে। আর যদি ভষ্ম না হয় তবে বর মিথ্যা হয়ে যাবে। শিব পৃথিবী আকাশ সব স্থানেই দৌড়ে বেড়ালেন কিন্তু ভষ্মাসুর পিছনে পিছনে আসছে। শিব চাইলেই ভষ্মাসুরকে বধ করতে পারে কিন্তু নিজের ভক্তকে নিজে মারা অশোভনীয়। তাই তিনি বধ ও করতে পারছেন না কি করবে ভেবে না পেয়ে দীনবন্ধু করুনাসিন্ধু শ্রী নারায়নকে আহ্বান করলেন। আহ্বানের সাথে সাথে শ্রী হরি প্রকট হলেন। শ্রী নারায়ন শিবকে গাছের আড়ালে যেতে বলে নিজে মোহিনী অবতার ধারন করলন। এরপর ভষ্মাসুর শিবের খোজ করতে করতে সেখানে এলেন এবং নৃত্যরত মোহিনীকে দেখলেন। মোহিনী রুপ ধারী নারায়নের নৃত্য দেখে সমগ্র সৃষ্টিতে নৃত্যপূর্ন ভাব বিরাজ করছিল। ভষ্মাসুরও মোহিনীর সাথে নৃত্য শুরু করে দিল। এরপর ভষ্মাসুর নৃত্যর মাঝে এমন মোহিত হয়ে গেল যে কখন নৃত্যর তালে মোহিনীর দেখাদেখি মাথায় হাত রাখল নিজেই বুঝতে পারল না। মাথায় হাত রাখার সাথে সাথে ভষ্মাসুর ছাই হয়ে গেল। এরপর মোহিনী থেকে নারায়ন রুপে ফিরে আসলেন। তখন শিব নারায়নের স্তব করে নারায়নকে খুশি করলেন এবং দেবেশ্বর শিবশংকর কৈলাসে এবং জগদীশ্বর বিষ্ণু বৈকুন্ঠে প্রস্থান করলেন।
এই ঘটনা বলার একটাই উদ্দেশ্য অনেকে জানেন যে সাগরমন্থনের সময় বিষ্ণু মোহিনী অবতার নেয়। এবার জানলেন যে ঐ সাগর মন্থন ছাড়াও বিষ্ণু মোহিনী অবতার নেয়। এছাড়াও আরও কিছু ঘটনা আছে বিষ্ণুর মোহিনী অবতার নেওয়ার --যার সবই জগতের এবং দেবতাদের কল্যানে।
এখন সবাই বলুন জয় শিবশংকর...... জয় জয় নারায়ন

courtesy by : Prithwish Ghosh


Share:

হনুমান জী, শ্রীরামচন্দ্রের একনিষ্ঠ সেবক

হনুমান জী, শ্রীরামচন্দ্রের একনিষ্ঠ সেবক। মা সীতার অপহরণের পর হনুমান জীর উদ্যোগে ভগবান রামচন্দ্রের সাথে বানর রাজ বালীর ভাই সুগ্রীবের বন্ধুত্ব হয়। বালী আবার নিজ ভ্রাতা সুগ্রীবের বৌ রুমাকে অপহরণ করে বন্দী করে রেখেছিল- রামচন্দ্র বালীকে বধ করে সুগ্রীবকে বানর জাতির রাজা বানান। হনুমান জী প্রথম অপহৃতা মা সীতার সংবাদ আনেন। ভগবান রামচন্দ্রের লঙ্কা আক্রমণ কালে হনুমান জী নিজে প্রচুর রাক্ষস সৈন্য, বড় বড় রাক্ষস বীরদের বধ করেন, এবং যুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্রে আহত লক্ষণ এর প্রান বাঁচাতে তিনি গন্ধমাদন পর্বত টাই তুলে আনেন। এভাবে হনুমান জী ভগবান রামচন্দ্রের সেবা করেন। হনুমান জীর প্রবল ভক্তির একটি কথা পুরানে পাওয়া যায়। ভগবান রামচন্দ্র তখন রাক্ষস বাহিনী আর লঙ্কেশ রাবণকে বধ করে ভাই লক্ষণ ও সীতাদেবীকে নিয়ে ১৪ বছর বনবাস শেষে অযোধ্যাতে ফিরেছেন। একদা মা সীতা দেবী হনুমান জীকে একটি মুক্তার মালা উপহার দিলেন। ভক্ত হনুমান জী মালাটি নিয়ে দেখে, নেড়ে চেড়ে ছিড়ে মুক্তো গুলো দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ফেলে দিলেন। সকলে অবাক হল। ভাবল বনের পশু মুক্তার মালার মর্ম কি জানে? সকলে হনুমান জীকে কারন জিজ্ঞাসা করলে হনুমান জী বললেন- “যাহাতে রাম নাম নেই- তাহাতে কি প্রয়োজন?” সকলে বলল- “তাই যদি হয়- তবে তোমার অন্তরে কি রাম নাম আছে? থাকলে দেখাও দিকি।” এই শুনে হনুমান জী নিজের নখ দিয়ে নিজের বুক বিদীর্ণ করলেন- সকলে দেখলো সেখানে ভগবান রামচন্দ্র মা সীতা বিরাজমান। হনুমান জীর এই শিক্ষা আমাদের পথ দেখায়। যাঁহাতে ভগবানের নাম নেই, যেখানে ভগবানের নাম কীর্তন হয় না - সেই স্থান পরিত্যাগ করা উচিৎ।
হনুমান জী দ্বাপর যুগেও ছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেছেন। হনুমান জীর অনুরোধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-ভগবান রামচন্দ্রের রূপ ধারন করে হনুমান জীকে একবার দর্শন দিয়েছিলেন। এবং বলা হয় হনুমান জী পরম বৈষ্ণব, ভগবান হরির প্রিয় ভক্ত। একটি মন্ত্রে বলা হয় –
যত্র যত্র রঘুনাথকীর্তনং তত্র তত্র কৃতমস্তকাঞ্জলিম্।
বাষ্পবারিপরিপূর্ণলোচনং মারুতিং নমত রাক্ষসান্তকম্।।
অর্থাৎ -- যেখানে যেখানে রঘুনাথের গুণগান করা হয়, সেখানে সেখানেই যিনি মস্তকে অঞ্জলি স্থাপনপূর্বক সাশ্রুনয়নে অবস্থান করেন, সেই রাক্ষস বিনাশী মারুতিকে (হনুমান) সকলে নমস্কার করুন।
হনুমান জীর প্রনাম মন্ত্রে বলা হয় --
মনোজবং মারুততুল্যবেগং
জিতেন্দ্রিয়ং বুদ্ধিমতাং বরিষ্ঠম্।
বাতাত্মজং বানরযূথমুখ্যং
শ্রীরামদূতং শিরসা নমামি।।
অর্থাৎ -- যিনি মন ও বায়ূর ন্যায় দ্রুতগামী, বুদ্ধিমান, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং বানর বাহিনীর অধিনায়ক, সেই শ্রীরামের দূত, জিতেন্দ্রিয় পবন নন্দনকে অবনত মস্তকে নমস্কার করি।

courtesy by : Prithwish Ghosh
Share:

ব্রহ্ম বৈবর্তপুরাণে দেবীর লক্ষ্মী পরিচয়

ব্রহ্ম বৈবর্তপুরাণে দেবী লক্ষ্মী নিজ পরিচয় দিয়ে বলেছেন --- “যে সকল গৃহে গুরু, ঈশ্বর, পিতামাতা, আত্মীয়, অতিথি, পিতৃলোক রুষ্ট হন, সে সকল গৃহে আমি কদাপি প্রবেশ করি না। আমি সে সকল গৃহে যেতে ঘৃনা বোধ করি, যে সকল ব্যাক্তি স্বভাবতঃ মিথ্যাবাদী, সর্বদা কেবল ‘নাই’, ‘নাই’ করে, যারা দুর্বলচেতা এবং দুঃশীল। যারা সত্য হীন, মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে, বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন, যে সকল ব্যাক্তি সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ভয়গ্রস্ত, শত্রু গ্রস্ত, ঋণ গ্রস্ত, অতি কৃপণ, দীক্ষা হীন, শোকার্ত, মন্দঘ্নী, স্ত্রী বশীভূত, কুলটার পতি, দুর্বাক, কলহ পরায়ণ, যারা ভগবানের পূজো ও তাঁর নাম গুন কীর্তনে বিমুখ, যারা শয়নের পূর্বে পাদপ্রক্ষালন করে না, নগ্ন হয়ে শয়ন করে, বেশী ঘুমায়, প্রভাতে সন্ধ্যায় দিবসে নিদ্রা যায়, যাদের দন্ত অপরিচ্ছন্ন, বসন মলিন, মস্তক রুক্ষ, হাস্য বিকৃত, তাদের গৃহে আমি কদাপি গমন করি না।
আমি সে সকল গৃহে বসতি করি, যে সকল গৃহ শ্বেত পারাবত অধুষ্যিত, যেখানে গৃহিণী উজ্জ্বল সুশ্রী, যেখানে কলহ নাই, ধান্য সকল সুবর্ণ সদৃশ, তণ্ডুল রজতোপম এবং অন্ন তুষহীন। যে গৃহস্থ পরিজনের মধ্যে ধন ভোগ্য বস্তুর সমান বিভাগ পূর্বক বিতরণ করেন, যিনি মিষ্টভাষী, বৃদ্ধপোসেবী, প্রিয়দর্শন, স্বল্পভাষী, অ-দীর্ঘসূত্রী, ধার্মিক, জিতেন্দ্রিয়, বিদ্যাবিনয়ী, অ-গর্বিত, জনানুরাগী, পরপীড়ন বিমুখ, যিনি ধীরে স্নান করেন, চয়িত পুস্প আঘ্রাণ করেন না, সংযত এমন ব্যাক্তি আমার কৃপা পেয়ে থাকেন। শুধু অর্থ নয়, উন্নত চরিত্রও মানুষের অমূল্য সম্পদ।'

Courtesy by: Prithwish Ghosh
Share:

গুরু

গুরু (বি) -- উপদেষ্টা, উপদেশক, শিক্ষক, দীক্ষক, দেশিক, দিশারী, শাস্ত্রীয় জীবনের উপদেষ্টা, সাধনপন্থা নির্দেশক, সম্মানে বা বয়সে জ্যেষ্ঠ, মাননীয় ব্যক্তি,(বিণ) -- ভারী, গুণসম্পন্ন, দুর্বহ, দায়িত্বপূর্ণ, কঠিন, মহান, দুরূহ, শ্রদ্ধেয়, মাননীয়, অতিশয়, অধিক, জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, knowledge, master, teacher ---.যে মহান মনীষী মানুষকে নৈতিক শিক্ষাদীক্ষা প্রদান করেন তাকে গুরু বলা হয় আবার চিত্তপটের সাথে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যাদিকে জ্ঞান বা রূপকার্থে গুরু বলা হয়।
-
আপনদেশের মধুরবাণী
গুরু আমায় শোনাও না
দেশবাসী কয় উল্টাকথা
সোজা করে শোনায় না
... গুরু উপায় কী আমার
কেমনে হব তিরবেণী পার.......
....ত্রিতাপ জ্বালায় পরাণ পুড়ে
গুরু উপায় বল না
....প্রেমজ্বালায় অঙ্গ জ্বলে
মদনজ্বালা সহে না......
...গুরু বলো উপায় কী আমার
কেমনে হব তিরবেণী পার......
.....শেষের সে'দিন তুমি বিনে
........আর তো কেউ রবে না .......
-
গুরু চার প্রকার ---
-
যথা --
১. মানুষগুরু -- মানুষ আকারধারী যে মহান মনীষী সাধারণ মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা প্রদান করেন তাকে মানুষগুরু বলে। যেমন বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবার গুরুপদ প্রাপ্ত ব্যক্তির জ্ঞানকেও গুরু বলে।
-
২.জগৎগুরু -- সারাবিশ্বে বিরাজিত বাতাসকে জগৎগুরু বলে। আবার নাসিকার শ্বাসকেও জগৎগুরু বলে। যেমন -- 'রণে, বনে, পাহাড়ে ও জঙ্গলে যেখানে আমাকে স্মরণ করবে সেখানেই আমাকে পাবে।' তাই - মানুষগুরু জগতের সর্বত্রই বিরাজ করতে পারে না কিন্তু জগৎগুরু জগতের সর্বত্রই বিরাজ করতে পারেন।
-
৩. কামগুরু ----- শাস্ত্রীয় মতে কামের প্রতীতি মদনকে কামগুরু বলে। মূলতঃ পুরুষ জীবের শিশ্নকে কামগগুরু বলে। “প্রেম প্রকৃতি স্বরূপসতী, কামগুরু হয় নিজপতি, ও মন অনুরাগী না হলে, ভজন সাধন হয় না”। কাম ব্যতীত যেমন জীবের প্রজন্ম টিকিয়ে রাখা যায় না তেমন কোন প্রজাতির জীব সাংসারিক, সামাজিক, দলবদ্ধ বা সঙ্ঘবদ্ধ হতেও পারে না। জীবের প্রজাতি টিকিয়ে রাখার জন্য কামশাস্ত্রে কামের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমন কামযজ্ঞ পরিচালনার জন্য শিশ্নের গুরুত্ব আরো অপরিসীম। কামযজ্ঞ পরিচালনা করার গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য করেই শিশ্নকে কামদেবতা বা কামপ্রতীতি বা কামগুরু বলা হয়।
-
৪. পরমগুরু ------ জীবের লালনপালনকর্তা পরমেশ্বরকেই পরমগুরু বলে। “পরমগুরু বড়ই রঙ্গিলা আমার মনভোলা, কত নামে ধরাধামে করে আকারে লীলাখেলা” বা “ত্রিবেণীর ত্রিধারে, মীনরূপে গুরু বিরাজ করে, কেমন করে ধরবি তারে, বলরে অবুঝ মন”। পরমেশ্বর হলেন তরলমানুষ --- যিনি এখনো মূর্ত আকার ধারণ করেননি। মাতৃজঠরে ভ্রূণ লালনপালনের দায়িত্ব পালনকারী সুমিষ্ট, সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের জল, মস্তিস্কে অবস্থিত 'চন্দ্রসুধা'।
-
গুরু যার থাকে সদয়
শমন বলে কিসের ভয়
গুরু চেনা সহজ নয়রে ....গুরু চেনা সহজ নয়
জগৎগুরু চিনতে গেলে ...মানুষ গুরু ভজতে হয় .......... জয় গুরু

courtesy by : Prithwish Ghosh
Share:

যারা ফোটা তিলক কেটে নিরামিষ ভোজন করে 'রাধা-কৃষ্ণ' নাম গানে জীবন কাটান তারাও বৈষ্ণব বলে আখ্যায়িত হোন। তা কি ঠিক?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্পূর্ণ জীবনকে মোটামুটি ৬ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে ---
ক. বাল্যকাল,
খ. মথুরা বাসকাল (শিক্ষার্থী শ্রীকৃষ্ণ),
গ. দ্বারকায় বাস শ্রীকৃষ্ণ ( রাজা শ্রীকৃষ্ণ),
ঘ. মহাভারতে ধর্ম রাজ্যর স্থাপনে শ্রীকৃষ্ণ (রাজনীতিবিদ শ্রীকৃষ্ণ),
ঙ. লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ ( প্রাণের শ্রীকৃষ্ণ),
চ. শ্রী কৃষ্ণে শেষ জীবন,
-
শ্রী কৃষ্ণের ১২৫ বছর জীবনকাল দীর্ঘ সময়। স্বধর্ম নিষ্ঠ, তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ, ভূগোলবিদ, ভক্ত-রক্ষাকারী , দুর্জনের শমন, লৌকিক জ্ঞান সম্পন্ন কৃষ্ণকে পাওয়া যায় মহাভারতে।
যারা লীলাময় শ্রীকৃষ্ণেকে পেতে চান তারা পুরাণাদি পাঠে তাকে খুঁজে পাবেন।
মধুর শ্রীকৃষ্ণকে পেতে হলে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, যদিও এটি পুরাণরই অন্তর্গত।
শ্রী কৃষ্ণের শেষ জীবনটি বিধৃত হয়েছে হরি-বংশে। শ্রী কৃষ্ণকে শ্রী বিষ্ণুও বলা হয়। বিষ্ণু শব্দের অর্থ সর্বব্যাপী বা ব্যাপীত্ব। বিষ্ণু, তিনি সর্বত্রই আছেন এ অর্থে একমাত্র ঈশ্বরই সর্বব্যাপী। বিষ্ণু অপত্য অর্থে ” বৈষ্ণব” শব্দটির নিষ্পন্ন হয়। তাই ঈশ্বরের সন্তান হিসাবে সকলই বৈষ্ণব। পৃথিবীতে যত প্রাণী, স্থাবর জঙ্গমাদিয যা আছে সবই বিষ্ণুর অংশ হিসাবে বৈষ্ণব আখ্যা পেতে পারে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণ ভজনকারীগণ নিজেদেরকে বৈষ্ণব আখ্যা দিয়ে থাকেন। এছাড়াও যারা ফোটা তিলক কেটে নিরামিষ ভোজন করে 'রাধা-কৃষ্ণ' নাম গানে জীবন কাটান তারাও বৈষ্ণব বলে আখ্যায়িত হোন। তা কি ঠিক?

Courtesy : Prithwish Ghosh
Share:

শ্রীশ্রী করুনাময়ী মাতা ঠাকুরানীর মঠের ইতিহাস


ভারতে মুঘল রাজবংন্সের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উত্তরসুরী রুপে দিল্লীর সিংহাসনে বসলেন হুমায়ুন পুত্র আকবর। তাঁর লখ্য ছিল এক বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন। সম্রাটের এই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। সম্রাট আকবর এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুবরাজ সেলিমকে বাংলাদেশ অভিজানে পাঠান। কিন্তু যশোরের জমিদার প্রতাপাদিত্য (বারভুঁইয়া) মাঁ যশোরেশ্বরীর আশির্ব্বাদী ফুল অবলম্বন করে মুঘল আক্রমণের মোকাবিলা করেন। সেই যুদ্ধে যুবরাজ সেলিম পরাজিত হলেন। এর পর সম্রাট আকবর অম্বররাজ সেনাপতি মানসিংহকে দ্বিতীয় বারের জন্য বাংলাদেশ আক্রমনে পাঠান। কৌশলী সেনাপতি মানসিংহ তাঁর চর মারফৎ প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানলেন যে, প্রতাপাদিত্যের শক্তি ও পরাক্রমের উৎস হলেন শ্রীশ্রী মাতা যশোরেশ্বরী।
তাই মানসিংহ এক ব্রাহ্মণের সহায়তায় মন্দির থেকে যশোরেশ্বরী মাতার বিগ্রহকে সরিয়ে নিজ শিবিরে নিয়ে আসেন। এই সংবাদে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে প্রতাপাদিত্য মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামানন্দগিরি গোস্বামীকে যৎপরনাস্তি তিরস্কিৃত করলেন। শোকে বিহ্বল পরম ধার্মিক ব্রাহ্মণ দুঃখে উন্মাদ হয়ে যশোর ত্যাগ করেন। অম্বররাজ ঠিক সেই মুহুর্তে মোঘল বাহিনী নিয়ে প্রতাপাদিত্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করে বাংলাদেশ দখল করলেন।
বাংলাদেশ অভিযান সফল হয়ার পর অম্বররাজ মাতৃ বিগ্রহকে সন্মানের সাথে অম্বর প্রাসাদে অধিষ্ঠান করালেন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সেই 'যশোরেশ্বরী' মাতৃবিগ্রহ রাজস্থানের অম্বর ফোটে আজও অবস্থান করছেন।
অম্বরফোটে মাতৃবিগ্রহ অধিষ্ঠানের পরেই মহারাজ মানসিংহ দেবীর কাছে স্বপ্নাদেশ পান যে - তিনি যেন, দেবীর প্রধান পুরোহিত পরম ভক্ত ব্রাহ্মণ রামানন্দগিরি গোস্বামীকে দিয়ে দেবীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্ত্তি তৈরী ও প্রতিষ্ঠান করে আসেন। দেবীর আদেশে মানসিংহ বাংলাদেশে এসে রামানন্দগিরির খোঁজ করে যমুণা শাখা সূক্ষাবতী (বর্তমান নাম সুঁটির খাল -- জবরদখল হয়ে এ' নাম হয়েছে) নদীর তীরবর্তী মাতার বর্ত্তমান মন্দিরের নিকট সেই ব্রাহ্মণের দেখা পান এবং যশোরেশ্বরীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্ত্তি তৈরী ও প্রতিষ্ঠান করে আসেন। প্রাচীন সেই পুরোহিতের নাম ও নদীর তীরবর্তী স্থান অনুযায়ী ঐ স্থানের নাম হয় ‘রামডাঙ্গা’। পরবর্ত্তী কালে বাংলা ভাষার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সেটি ‘আমডাঙ্গা’ নামে এবং মন্দিরটি ‘আমডাঙ্গা করুনাময়ী মঠ’ নামে পরিচিত।
এর পর প্রায় দুশো বছর অতিবাহিত করার পর ১৭৫৬ সালে ইংরেজদের উৎখাত করার জন্য সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন তখন নবাবের সেই বাহিনীতে নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও ছিলেন। বর্ত্তমান মন্দিরের নিকট নবাবের শিবির হয়েছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই শিবিরের পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাতৃমূর্ত্তির জীর্ণ দশা দেখতে পান। সেই সময়েই তিনি মাতৃমূর্ত্তির সামনে বসে প্রার্থনা করেন -- যদি মাঁ তার মনোকাম্না পূর্ণ করেন, তা হলে তিনি মাতার মন্দিরের তথা পূজার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থাদি গ্রহন করবেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হবার পর বাংলার সিংহাসনে বসলেন মীরজাফর, তার পর তাকে পরাজিত করে তার জামতা মীরকাশিম সিংহাসনে বসেন। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে নবাব মীরকাশিম কৃষ্ণচন্দ্রকে মুঙ্গেরে বন্দী করে প্রানদন্ডের আদেশ দেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এই বিপদে আমডাঙ্গা করুনাময়ী মঠের মোহান্ত পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে করুনাময়ী মাতৃদেবীর আরাধনা করে দৈব শক্তির প্রভাবে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বিপদ-মুক্ত করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মাতৃদেবীর এই অপার করুণায় খুশী হয়ে আমডাঙ্গা করুনাময়ী মঠ সংস্কারে ব্রতী হন। শোনা যায় তাঁরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মঠের বর্ত্তমান দ্বিতল মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। সেই সময় থেকে এই ‘মঠ’ শুধু বাংলাদেশ নয় সারা ভারতেও পরিচিতি লাভ করে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত করুনাময়ীর জাগ্রত রুপ দর্শন করতে আসা শুরু করেন। মা করুনাময়ীর অপার করুণায় ভক্তগণের মনোবাঞ্ছা পূ্রণ সহ বিবিধ রোগ, জ্বালা নিবারণেরর এক মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয় এই ‘মঠ’।
মঠের প্রথম সেবাইত রামানন্দগিরির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরবর্ত্তী কালের মোহান্তগণ মঠকে ধর্মীয় তথা আধ্যাতিক দিক থেকে এক উজ্জ্বল অবস্থায় আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে গিরি অধ্যায়ের শেষ মোহান্ত রতন গিরি মোহান্ত পদে উত্তরাধিকার নিয়ে কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন। উচ্চ আদালতের সম্মতি অনুযায়ী মহামান্য হাওড়া জেলা জজ করুনাময়ী মঠের পর্যবেক্ষণ কর্তৃপক্ষ তথা প্রশাসক রুপে দায়িত্ব পান। মঠ পরিচালন সংক্রান্ত বিসয়ে পরিচালন কমিটির প্রথম সম্পাদক হন প্রকাশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয়। ইতিপূর্বে করুনাময়ী মঠ তারকেশ্বর মন্ডলীর অর্ন্তভুক্ত হয়েছিল। মোহান্ত পদে গিরি অধ্যায়ের সমাপ্তির পর আশ্রম অধ্যায়ের সূচনা হয়। আমডাঙ্গা মঠের আশ্রম পর্বের প্রথম মোহান্ত হয়ে আসেন দন্ডীস্বামী অচ্যুৎ আশ্রম। পরবর্তী কালে একে একে মোহান্ত পদে অভিষিক্ত হন দন্ডীস্বামী নৃ্সিংহ আশ্রম ও দন্ডীস্বামী বিশ্বেশ্বর আশ্রম, তাঁর আমলে মঠের পূজা ভোগ ও বলিদান সংক্রান্ত বিষয়ে মঠ কমিটির সহিত তাঁর মতবিরোধ চরমে ওঠে। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৯৬২ সনে মঠে এক ধর্মীয় বিচার সভা আহূত হয়। এই ধর্মীয় বিচার সভায় কোন সুষ্ঠ নিষ্পত্তি না হওয়ায় অভিমানে দন্ডীস্বামী বিশ্বেশ্বর আশ্রম মঠ পরিত্যাগ করে কাশীবাসী হন। তৎপরবর্ত্তি কালে এক টানা প্রায় ২০ বৎসর মঠ পরিচালন ব্যাবস্থা কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকে। মঠ পরিচালন সমিতির দ্বিতীয় সম্পাদক নিযুক্ত হন শ্রীযুক্ত সুধাংশু বন্দোপাধ্যায় মহাশয়। তাঁর আমলে মঠের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে এলাকার জনসাধারণ মহামান্য হাওড়া জেলা জজের দৃষ্টি আকর্ষন করলে তিনি তদন্ত করে কমিটি বাতিল করে দেন।
১৯৮৩ সালের মে মাসে মহামান্য হাওড়া জেলা জজ নূতুন পরিচালন সমিতি গঠন করেন এবং এই নবগঠিত পরিচালক সমিতির সম্পাদক রুপে মাননীয় শ্রীযুক্ত শঙ্কর ঘোষ মহাশয়কে মনোনীত করেন। ইতিমধ্যে ১৯৮৪ সালে দীর্ঘ ২২ বছর বাদে মঠে মোহান্ত রুপে তারকেশ্বর মন্ডলীর প্রতিনিধি হয়ে আসেন দন্ডীস্বামী শিবাশ্রম মহারাজ। তাঁর সভাপতিত্বে এবং শ্রীযুক্ত শঙ্কর ঘোষ মহাশয়ের সহৃদতায় মঠে এক স্বর্গীয় অনুভূতি বিরাজ করতে থাকে।
বর্ত্তমান মন্দির সংলগ্ন মাঁয়ের উল্লিখিত ফাঁকা জমিতে মাঁয়ের বাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে ২৫ শে ও ২৬ শে ডিসেম্বর বৃহৎ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মঠের বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘রত্নবেদী’। ভারতের মধ্যে একমাত্র শ্রীক্ষেত্র ছাড়া আর কোন তীর্থক্ষেত্রে এই রত্নবেদী নেই। রত্নবেদীর মহাত্ম হল ১০৮ টি নারায়ণ শীলার উপর প্রতিষ্ঠিত এই আসন। শোনা যায় এই রত্নবেদীর আকর্ষনেই মহাসাধক রামপ্রসাদ ও পরমহংস ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের আগমন ঘটেছিল এই মঠে। মঠের দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য স্থান হল ‘পঞ্চমুন্ডী আসন’। তন্ত্র সাধকেরা এই আসনে বসে তন্ত্র সাধন করেন। উল্লেখ্য, ব্রহ্মপরায়ন উপাধিকারী সেবাইত নারায়ণ গিরি এই আসনে বসেই সাধনার দ্বারা দৈববলে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে রক্ষা করেন।
মঠের তৃতীয় দ্রষ্টব্য স্থান হল ‘মনসা বেদী (বাস্তুতলা)’। নিষ্ঠাভরে এই বেদীতে দুধ কলা সহযোগে পূজা দিলে সর্পদংশন ভয় দূ্র হয়। এছারা ব্রজমোহন মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমময় যুগল মূর্ত্তি মন্দিরের আকর্ষণ বৃদ্ধি করছে। সর্বোপরি শ্রীশ্রী করুনাময়ী মাতা ঠাকুরাণীর কষ্ঠিপাথরের নির্মিত মূর্ত্তিটি মাতার নামকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল করে রেখেছে। মাতার সম্মুখের চন্দন কাঠের সূক্ষ কারুকার্য্য শোভিত দরজাটিও দীর্ঘ ৪৫০ বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষ হয়ে আজও অক্ষত অবস্থায় বর্ত্তমান আছে।
জয় কালী ......জয় কালী
Prithwish Ghosh
Courtesy by : 
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১৭ )

শুরু হল সেঁতু বন্ধনের কাজ। বানরেরা ধরাধরি করে বিশাল তাল, শাল, শিশু গাছ আনলো। বিশাল প্রকাণ্ড গুঁড়ি কেটে এনে ধরাধরি করে আনলো । অতি প্রকাণ্ড তাল বৃক্ষ শয়ে শয়ে বানর ধরে এনে সমুদ্র তটে জমা করতে লাগলো । তাঁর সাথে মন্দার পর্বত থেকে প্রকাণ্ড শিলা বানরেরা বহন করে আসতে লাগলো । সমুদ্র তটে প্রচণ্ড উত্তাপের বদলে সূর্য দেবতা স্বল্প উত্তাপ প্রান করছিলেন, যাতে ভগবানের সেবক দের কোন রূপ কষ্ট না হয় । সকলে নাওয়া খাওয়া ভুলে সমানে কাজ করে যেতে লাগলো । ভল্লুক, মর্কট, বানর যে যতটা পারে বিশালাকার শিলাখণ্ড আর শাল বৃক্ষ এনে দিলো । হনুমান শ্রীরামের মহিমা গায়কের মতোন গাইছিলো। শ্রীরামের মহিমা শুনে পশুদের সকল ক্লান্তি দূরীভূত হয়েছিলো । হনুমান সকল শিলাখণ্ডে ‘রাম’ নাম লেখে যাছিল্লো। ‘রাম’ নামে ভবসমুদ্র পার হওয়া যায়- এতো মাত্র একশো যোজণ । ‘রাম’ নাম জপ করেই রাজা দশরথের ব্রহ্মহত্যা পাপ নিবারিত হয়েছিলো । কোটি পাতকীর পাপ নাশ হয় ‘রাম’ নাম উচ্চারন করলে । তারকব্রহ্ম ‘রাম’ নাম জপ না করে মনুষ্য যদি হেলায় দিন কাটায় তবে তার মনুষ্য জনম বৃথা । কি সন্ন্যাসী , কি ব্রাহ্মণ, কি ক্ষত্রিয় , কি বৈশ্য কি শুদ্র – চণ্ডাল- অন্তজ যদি ‘রাম’ নাম কীর্তন করে তবে সে দেবতুল্য হয় । আর উচ্চকূল ব্যাক্তি যদি ‘রাম’ নাম ত্যাগ করে তবে তাহার ন্যায় অচ্ছুৎ আর কেহ হয় না । দস্যু যদি ‘রাম’ নাম জপ করে ‘মহর্ষি’ হতে পারে তবে ‘রাম’ নামে কি না হয়। নল আর নীল সেই সকল প্রস্তর , বিশাল বৃক্ষ, প্রকাণ্ড গুঁড়ি সমুদ্রে নিক্ষেপ করা মাত্র ভেসে থাকলো। সমুদ্রের ঢেঊ কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি করলো না । মজবুত করে একটির সাথে একটি জোড়া লাগলো । ‘রাম’ নামের এই মহিমা যে নল নীলের ওপর অভিশাপ এখন ‘বরদান’ এ পরিণত হয়েছে । কাহারো মুখে ক্লান্তি নেই । সকলে কাজ করে যাচ্ছে।

এইভাবে দশ যোজন, বিশ যোজন, ত্রিশ যোজন সেঁতু নির্মাণ হল। বড় বড় বৃক্ষের আর বড় বড় প্রস্তরের নির্মিত সেঁতুতে কিছু ফাঁক ফোঁকর থেকেই যাছিল্ল। যেগুলো বানর, মর্কট, ভল্লুক, লেঙুরদের নজরে আসছিলো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাষ্ঠবিড়াল এসে ছোট্ট ছোট্ট প্রস্তর নিয়ে এসে সেই ফাঁকফোকর গুলো ভরাট করে যাত্রাপথ মসৃণ করছিলো । তখন হনুমান বিড়াল দের সড়িয়ে দিলো । হনুমান ভেবেছিলো এই ক্ষুদ্র প্রানী আর কি সহায়তা করবে ? যথা-

কাষ্ঠবিড়াল সব আইল তথাকারে ।
লাফ দিয়া পড়ে গিয়া সাগরের তীরে ।।
অঙ্গেতে মাখিয়া বালি ঝাড়য়ে জাঙ্গালে ।
ফাঁক যত ছিল তাহা মারিল বিড়ালে ।।
যাতায়াত করে সদা বীর হনুমান ।
বিড়ালেরে চারিদিকে ফেলে দিয়া টান ।।
কান্দিয়া কহিল সবে রামের গোচর ।
মারিয়া পাড়য়ে প্রভু পবন- কুমার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

কাষ্ঠবিড়াল সকল গিয়ে প্রভু রামের কাছে বলল- “প্রভু আমরা তুচ্ছ হয়েও কি আপনার সেবা করতে পারবো না। আমরা সেঁতুর ফাঁকফোকর ক্ষুদ্র প্রস্তর দিয়ে বন্ধ করছিলাম । পবনপুত্র এসে আমাদের বিতারিত করল। আমরা দুর্বল, বিশাল প্রস্তর বহনের শক্তি নেই। তাই এইভাবে আপনার সেবা করছিলাম।” কাষ্ঠবিড়ালীদের এইরূপ ভক্তি দেখে ভগবান রাম অতি প্রীত হলেন । এই বিড়ালিদের ভক্তি দেখে তাঁর চোখে জল আসল । তিনি কাষ্ঠবিড়ালি দের করে তুলে আদর করলেন। বললেন-

হনুমানে ডাকিয়া কহেন প্রভু রাম ।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেন কর অপমান ।।
যেমন সামর্থ্য যার বান্ধুক সাগর ।
শুনিয়া লজ্জিত হইল পবন- কুমার ।।
সদয় হৃদয় বড় প্রভু রঘুনাথ ।
কাষ্ঠবিড়ালের পৃষ্ঠে বুলাইল হাত ।।
চলিল সবাই তবে জাঙ্গাল উপর ।
হনুমান বলে শুন সকল বানর ।।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেহ কিছু না বলিবে ।
সাবধান হ’য়ে সবে জাঙ্গালে চলিবে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান লজ্জিত হয়েছিলেন । তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন এই দুর্বল কাষ্ঠবিড়ালিরা কি আর প্রভুর সেবা করবে। এরা তো নিজেরাই সামর্থ্য হীন । পরে ভাবলেন তিনি ত ভ্রম করেছেন। স্বয়ং প্রভুই তো সৃষ্টি রচনার সময় এদের এইটুকুই শক্তি দিয়েছিলেন । সুতরাং এরা এইটুকু দিয়েই প্রভুর সেবা করবে । তাই তিনি কাষ্ঠবিড়ালীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁদেরকেও প্রভুর সেবার অধিকার দিলেন । কাষ্ঠবিড়ালীরা অতি ক্ষুদ্র হয়েও এই মহৎ কাজে যোগদান করল ।

আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছে, যারা দরিদ্র । অনেকে আছে সহায় সম্বলহীন । কিন্তু তাই বলে তাঁদের যে প্রভুর সেবা করার অধিকার নেই- এমন নয় । এই কাষ্ঠবিড়ালীরা তাঁর প্রমান। ভগবান শ্রীরাম এই নগণ্য জীবগুলিকে সেঁতুবন্ধনের কাজে নিয়ে এসেছিলেন । নগণ্য, ক্ষুদ্র, দরিদ্র যে যেই অবস্থায় থাকুক, সেই অবস্থায় ভগবানের সেবা করা কর্তব্য। “শবরী” অধ্যায়ে সেখানে বিশ্লেষণ হয়েছে । ভগবান মনুষ্য জাতি সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কর্তব্য সেই ঈশ্বরের ভজনা করা । আমরা অনেকেই ভাবি আমি দরিদ্র, আমি নিঃসহায় , আমি ক্ষুদ্র- আমি কি ভগবানের সেবা করবো ? ভগবানের সেবা হয় তো কেবল মন্দিরে। যেখানে ছাপান্নো ব্যাঞ্জন, কত পুস্প, কত সুগন্ধি দ্বারা ভগবানের সেবা হয়। এই ধারনা ভুল । বস্তুত ঈশ্বরের ভজনা যেখানে হয় সেটিই মন্দির । ইট দিয়ে একটি কক্ষ বানানো বানিয়ে যে মন্দির আমরা দেখি, সেটিই যে কেবল ও একমাত্র মন্দির - এমন নয়। গাছতলায় বসেও যদি কেউ ভগবানের সেবা, ভজনা করেন- সেই গাছতলাই মন্দির। অপরদিকে পাকা দালানে যদি ভগবানের সেবা ভজনা না হয়, তবে সেটা কেবল ইঁটের স্তূপ মাত্র । আর যে যেই অবস্থায় থাকে তাঁকে সেই অবস্থায়, সেই ভাবে ঈশ্বরের ভজনা করা উচিৎ। আমাদের মনে খুব একটা ভুল ধারনা আছে যে রাশি রাশি ব্যাঞ্জন ও এলাহী ভাবে ভগবানের পূজা করলেই সেই পূজা সফল হয়- এটা খুব বড় ভুল। এই অজুহাতে অনেক দরিদ্র ব্যক্তি ঈশ্বর ভজনা করেন না। বলেন আমার নিজের নাই, আমি কি ঈশ্বরকে দেবো ? আরে এই জগতে যা কিছু সবই তো ঈশ্বরের সৃষ্টি। আর এলাহী ভাবে পূজো করলেই ভগবান সন্তুষ্ট হয় না। শবরীর প্রদত্ত সামান্য জাম ফলেই ভগবান তৃপ্ত হয়েছিলেন। যে দরিদ্র সে সামান্য বাতাসা দিয়েই ভগবানের সেবা করবে- আর যে ধনী সে যদি সামান্য বাতাসা দিয়ে কার্পণ্য করে, সেটা তার পক্ষে অনুচিত হবে। যাঁর যা সামর্থ্য- সেই ভাবেই ঈশ্বরের ভজনা করা উচিৎ । যাই হোক, দেখতে দেখতে সেঁতু নির্মাণ সমাপ্ত হল। লঙ্কার তট পর্যন্ত শত যোজন সেঁতু তৈরী হল। লঙ্কায় বসে রাবণ গুপ্তচরদের মুখে সব শুনে কেবল দর্পে হাস্য করতে লাগলো ।

( ক্রমশঃ )

Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১৬ )


শুক আর শারণ সকল কিছুই দেখেছিলো। সে গিয়ে দশানন রাবণকে সকল সংবাদ প্রদান করল । বলল- “দশানন! শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ সেনা সমেত সমুদ্র পাড়ে উপস্থিত । এবং বানর যোদ্ধা নল আর নীল সমুদ্রে সেঁতু তৈরী করতে কাজে লেগে পড়েছে। সেঁতু তৈরী হলেই তারা এখানে আসবে।” দশানন রাবণ অট্টহাস্য করলো। তার দেখাদেখি সভামাঝে বিভীষণ ব্যতীত সকলেই তাচ্ছিল্ল্য ভরে হাসল । বিভীষণ জানতো এই হাসি কিছুকালের মধ্যেই লঙ্কা দেখে বিদায় নেবে । দশানন রাবণ বলল- “দেবতারা যার পদসেবা করে তাকে মারবে ঐ তুচ্ছ ভিক্ষুক ভাতৃদ্বয়! বনের পশু নিয়ে লঙ্কা জয় করার স্বপ্ন সে দেখছে। আসতে দাও ওদের। আসবে ঠিক, কিন্তু একটাও ফিরে যাবে না। লঙ্কাই হবে ওদের মৃত্যুভূমি।” সকল রাক্ষসেরা রাবণের নামে জয়ধ্বনি করে রাবণকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহ দিতে লাগলো । রাক্ষসেরা জানালো বহুদিন যাবত পশু মাংস আহারের স্বাদ । ঐ বানর, মর্কট, ভল্লুক, লেঙুরদের মাংসে উদর তৃপ্ত হবে। এইভাবে রাক্ষসেরা নানা বিধ কল্পনা বুনে হাস্য করতে লাগলো । বিভীষণ বলল- “ভ্রাতা! আপনি কি এখনো বিজয়ী হবার স্বপ্ন দেখেন ? আপনার কি মনে হয় আপনি শ্রীরামকে বধ করতে সমর্থ হবেন ? এ কদাপি হয় না। ঈশ্বরকে বধ করা যায় না। আপনি কেন এমন মিথ্যা কল্পনা রচনা করে আনন্দ করছেন ? এই রাক্ষস বীরেরা কেউ কিন্তু বাঁচবে না। আপনার লঙ্কা ধ্বংস হয়ে যাবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই রাক্ষসদের পরিবার স্বজন হারানোর ব্যাথায় গভীর শোকে আচ্ছন্ন হবে। ভ্রাতা! যদি আপনি এমন অনর্থ রোধ করতে চান , তবে এখুনি সীতাদেবীকে ফিরিয়ে দিয়ে ভগবান শ্রীরামের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন।” রাবণ এই কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়লো। রাক্ষসেরা শুনে ক্ষেপে সকলে বিভীষণের গর্দান চাইলো। বিভীষণ রাক্ষস কুলের কলঙ্ক। রাক্ষস হয়ে কিনা ঐ তুচ্ছ ভিক্ষুক আর বনের পশুদের ভয় করে। রাবণ বলল- “বিভীষণ! তুমি সীমা লঙ্ঘন করো না। নাহলে তোমাকে লঙ্কা থেকে বিতারিত করতে বাধ্য হবো।”

বিভীষণ বলল- “ভ্রাতা! আমি আপনাকে, আপনার পুত্রদের, আপনার রাজ্য, আপনার প্রজাদের খুবুই স্নেহ করি। আপনি এদের বিনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছেন। শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করার পরিণাম যে কি হবে আপনি তা ভাবতে পারছেন না । তিনি সাক্ষাৎ বিষ্ণু । অসুর নিধন করেন। তাঁর সহিত যুদ্ধে জয়ী কেউ হতে পারে না । সীতাদেবী রাক্ষসদের কালরাত্রি স্বরূপ, আর তেনাতেই আপনার এত প্রীতি কিভাবে আসে ? আপনি লঙ্কার কালকে অশোক বনে রেখেছেন। এক মহা দুর্যোগ আসতে চলেছে। আপনি সত্বর সীতাদেবীকে , শ্রীরামের হাতে তুলে দিন। এতে আপনিও বাঁচবেন, এই লঙ্কাও বাঁচবে , আপনার সেনা সকল বাঁচবে । শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করার অর্থ বিনাশ। ভুলে গেলেন কিশোরকালে এই শ্রীরাম কিভাবে অনায়েসে তাড়কার আশ্রিত তিন কোটি রাক্ষস বধ করেছিলেন। তাড়কা, মারীচ, সুবাহু এই দর্পেই হত হয়েছে। বিরাধের ন্যায় শক্তিশালী রাক্ষস এই শ্রীরামের হাতে নিহত হয়েছে। আরোও ভাবুন খড়, দূষণ এর বলশালী চৌদ্দ রাক্ষস কিভাবে বধ হয়েছে। খড়, দূষণ, ত্রিশিরা এই সমস্ত দেবতাদের অবধ্য রাক্ষসকে অনায়েসে রঘুপতি রামচন্দ্র নিহত করেছেন। আপনি তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। লঙ্কা দহন নিজের চোখেই দেখলেন। ভগবান রামের শরের সামনে আপনার এই রাক্ষসেরা ভেকের ন্যায়। অতএব সীতাদেবীকে ফিরিয়ে আপনিও ভগবান শ্রীরামের শরণ নিন। তিনি ভক্তবৎসল । তাঁর শরণ নিলে আর কোন ভয় থাকবে না । হৃদয়ে এই বৈরীভাবকে ধ্বংস করে রামভক্তি স্থাপন করুন। ভগবান রামের নাম জপ করুন। ঐ নাম জপ করেই দস্যু রত্নাকর , বাল্মিকী মুনি হয়েছেন।” এত শুনে রাবণ কুপিত হল-

তবে সেই দশানন মহাবেগে চলে ।
পদাঘাত কৈলা বিভীষণ বক্ষঃস্থলে ।।
বিভীষণ অচেতন হইয়া তাহায় ।
পড়িল ধরণীতলে ছিন্ন তরুপ্রায় ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইবার রাবণ বললেন- “কুলাঙ্গার! তুই নিজ ভ্রাতার পক্ষ ত্যাগ করে ঐ শ্রীরামের নাম করিস। যা দূর হয়ে যা লঙ্কা থেকে। তোর মুখ আর দেখবো না।” এই বলে রাবণ , বিভীষণের বুকে পদাঘাত করে দূর করে দিলো । বিভীষণ রাবণের পা জড়িয়ে বলল- “দাদা! আমাকে তাড়িয়ে দাও , খেদ নেই। কিন্তু লঙ্কার সর্বনাশ কে আমন্ত্রণ জানিও না। শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করার পরিণাম কেবল সর্বনাশ। হাহাকার উঠবে কেবল লঙ্কা থেকে । সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” রাবণ বলল- “দূর হ! এত যখন রামের প্রতি প্রীতি! তো ঐ রামের ওখানেই থাক। আর দ্যাখ কিভাবে আমি তাদের যমালয়ে প্রেরন করি।”

বিভীষণ তখন নিজ অনুচর নিয়ে সাগর পারে বানরদের মাঝে আসলো । সমুদ্র তটে বিভীষণ ও তাঁর আশ্রিত রাক্ষসদের ঘুরতে দেখে বানরেরা রাবণের গুপ্তচর ভেবে বেঁধে ধরে শ্রীরামের কাছে নিয়ে গেলো । হনুমান দেখে বলল- “আরে তোমরা করো কি? ইনি আমাকে সেদিন মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচিয়েছেন। ইনি প্রভুর ভক্ত। ইনি জাতিতে রাক্ষসরাজ রাবণের ভ্রাতা হলেও, অন্তর থেকে প্রভুর ভক্ত। শীঘ্র এর বন্ধন মোচন করো।” বিভীষণের বন্ধন খোলা হল। তিনি গিয়ে প্রভু শ্রীরামের চরণে লুটিয়ে পড়লেন । অনেক স্তবস্তুতি করলেন। সকল ঘটনা সবিস্তারে বললেন। ভগবান শ্রীরাম বললেন- “রাবণের বিনাশ নিকটে এসেছে। তাই সে তোমার মতোন শুভবুদ্ধিদাতাকে বিতারিত করে কুটিল রাক্ষস দের বুদ্ধি শুনছে।” বিভীষণ বলল- “প্রভু! আমি অনেক বুঝিয়েছি আমার ভ্রাতাকে । তিনি কোন কথাই শোনেন নি। বৌঠান দেবী মন্দোদরী, আমাদের পিতামাতা এমনকি অনেকেই বুঝিয়েছেন , কিন্তু আমার অগ্রজের সকল বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। সে কারোর কথাই শোনে নি। আজ আমাকে পদাঘাত করে বিতারিত করেছেন।”এই বলে বিভীষণ পুনঃ পুনঃ নানা ঘটনা বললেন। রাক্ষসদের সকলের বুদ্ধি ভ্রম হয়েছে। তাদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। রাবণের জেদে সব কটা মরবে । ভগবান রাম বললেন- “বিভীষণ! আজ থেকে তুমি আমার মিত্র হলে। তোমার ন্যায় ধার্মিক , শাস্ত্রজ্ঞ শাসক লঙ্কার রাজা হবার যোগ্য। তোমার ন্যায় ব্যক্তি রাজা হলে রাজ্যে সুখ, সমৃদ্ধি , উন্নতি বৃদ্ধি পায়। আমি শপথ করছি, দশানন রাবণকে বধ করে আমি তোমাকে লঙ্কার রাজা বানাবো। তুমিই হবে আগামী লঙ্কার রাজা।” এই বলে বিভীষনের রাজতিলক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন ভগবান শ্রীরাম। সমুদ্র বারি দ্বারা অভিষেক করলেন । এইদিকে বানরেরা সকল কিছু জমায়েত জিনিষ দিয়ে সেতুর কাজ শুরু করলো।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১৫ )

ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পূজাতে সন্তুষ্ট হলেন ভগবান শিব প্রকট হলেন তিনি সমুদ্র তটে । ভগবান শঙ্করের জ্যোতির্ময় রূপে আলো হয়ে উঠলো সমুদ্র তট । ভগবান পশুপতির গাত্র থেকে যে দিব্য জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল্ল- তা স্বর্গ থেকে সুরবৃন্দ প্রত্যক্ষ করছিলেন । ভগবান শিবকে দেখে বানরেরা “হর হর মহাদেব” বলে দিগবিদিগ পরিপূর্ণ করলেন । পুস্পাদি উৎসর্গ করলেন ভগবান শিবের চরণে। ভগবান শিবের চরণ পুস্প বিল্ব দলে ঢাকা পড়লো । প্রসন্ন চিত্তে ভগবান শিব সকলকে আশীর্বাদ প্রদান করতে লাগলেন । ভগবান রাম বহু স্তব করে বললেন- “হে রুদ্র! আপনি আমার ইষ্ট! আমার পূজা গ্রহণ করুন । আপনি আশীর্বাদ করলেই আমি যুদ্ধে জয়ী হতে পারবো । আপনার আশিষেই রাবণ বধ করা সম্ভব হবে। হে আদিনাথ! হে যোগীশ! কৃপা করে আশীর্বাদ প্রদান করুন।” ভগবান মহেশ্বর বললেন- “হে রাঘব! আপনি সাক্ষাৎ বৈকুণ্ঠাধিপতি জনার্দন । রাবণ বধের নিমিত্তই আপনি এই মর্তলোকে রামাবতার গ্রহণ করেছেন । আপনার হস্তেই রাবণের মৃত্যু লেখা হয়ে গেছে । হে রঘুপতি ! আপনি নিজেই সব শুভ কর্ম ঘটাতে সমর্থ ! তবুও আপনি আমার পূজা করেছেন। আমি আপনাকে কিছু প্রদান করতে চাই। মনোবাঞ্ছা ব্যাক্ত করুন।” ভগবান রাম বললেন- “তবে প্রভু আপনি আমার দ্বারা নির্মিত এই বালুকা শিবলিঙ্গে অবস্থিত হউন । এখানে আপনি ‘রামের ঈশ্বর’ অর্থাৎ রামের আরাধ্য দেবতা ‘রামেশ্বর’ নামে অবস্থান করুন।” এই শুনে ভগবান মহেশ্বর বললেন- “হে রাম! এই স্থানে আপনার দ্বারা পূজিত এই শিবলিঙ্গে আমি অবস্থান করবো । আজ থেকে এই লিঙ্গ দ্বাদশ জ্যোতিরলিঙ্গের অন্যতম ‘রামেশ্বরম্’ নামে খ্যাত হবে ।” এই বলে ভগবান শিব প্রসন্ন বদনে নানা দিব্য কথা বলে অদৃশ্য হলেন । সেই শিবলিঙ্গ এখনো অবস্থিত । হনুমান তখনও এসে পৌছায়নি । এতই দূর ছিলো যাত্রাপথ ।

ভগবান রাম এরপর বললেন-

সিব দ্রোহী মম ভগত কহাবা ।
সো নর সপনেহুঁ মোহি ন পাবা ।।
সঙ্কর বিমুখ ভগতি চহ মোরী ।
সো নারকী মূঢ় মতি থোরী ।।
সঙ্করপ্রিয় মম দ্রোহী সিব দ্রোহী মম দাস ।
তে নর করহিঁ কলপ ভরি ঘোর নরক মহুঁ বাস ।।
(তুলসীদাসী রামায়ণ )

অর্থাৎ- শ্রীরাম বললেন, “আমাকে ভক্তি করেও যদি কেউ শিবদ্রোহ করে তাহলে সে স্বপ্নেও আমাকে লাভ করতে পারে না । শ্রীশংকরবিমুখ ( দ্বেষী ) ব্যক্তি যদি আমার ভক্তিতে সচেষ্ট হয়- তবে সে নরকে যাবে ; সে অতিশয় মূর্খ ও অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন । যে ব্যক্তি ভগবান শ্রীশঙ্কর ও আমার মধ্যে একজনের উপর প্রীতি ধারণ করে অন্যজনকে অশ্রদ্ধা করে সে কল্পকাল পর্যন্ত নরকে বাস করে থাকে।”

কৈলাসে ফিরে হর গৌরী পুনঃ আলাপে মগ্ন হলেন । ভগবান শিব রামেশ্বর তীর্থের কথাই বলছিলেন । এর সাথে মহাদেব জানালেন তিনি আর দশানন কে সহায়তা করবে না। কারন সেই পাপী সর্বদা অসৎ কাজে দেবশক্তিকে ব্যবহার করে থাকে । তাই তাকে আর সহায়তা করবেন না । দেবীকেও জানালেন তুমি ভদ্রকালী রূপে রাবণের ওপর থেকে কৃপা তুলে নাও। অহীরাবণ, মহীরাবণ নামক দুই রাক্ষস পাতালে তোমাকে পাতালভৈরবী রূপে পূজা করে থাকে, তাদেরকেও আর কৃপা করো না। এই রাক্ষসেরা কদাপি শুভ কাজ করে না। এদের অন্তিম সময় উপস্থিত । দেবী বললেন সময় আসলে আমি রাবণ, অহীরাবণ, মহীরাবণ কেও পরিত্যাগ করবো । এরপর দেবী গৌরী বললেন – “দেব! তোমার এই রামেশ্বর তীর্থের মহিমা কি?” ভগবান শিব বললেন- “হে উমা! আমার এই জ্যোতিরলিঙ্গ দ্বাদশ জ্যোতিরলিঙ্গের একটি । এই তীর্থের মহিমা অনেক। বিশেষ ভাবে হর আর হরির লীলা এখানে উদ্ঘাটিত । যে ব্যক্তি পবিত্র বারিধারা দ্বারা রামেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গের পূজা করবে, সে মুক্তি প্রাপ্ত করে জন্মমৃত্যু চক্র থেকে চিরতরে মুক্তি থাকবে । যে ব্যক্তি ছলচাতুরী ত্যাগ করে রামেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে- সে হরি হার হরের কৃপা লাভ করে ধন্য হবে। হে ভবানী! আমি সত্য বলিতেছি, যে ব্যাক্তি ভগবান রামের নির্মিত সেঁতু দর্শন করবে- তাঁহাকে দেখে যম পলায়ন করবে। সেই ব্যাক্তি মুক্তি পাবে।” এইভাবে ভগবান শিব এই লিঙ্গের নানা মাহাত্ম্য বললেন।

অপরদিকে হনুমান এসে পৌছালেন । সত্যই বড় দেরী হয়ে গেছে । শিবলিঙ্গ নিয়ে নামলেন সমুদ্র তটে । দেখলেন সেখানে সবাই পাথর, কাঠের গুড়ি আনতে ব্যস্ত। হনুমানের হস্তে শিবলিঙ্গ দেখে ভগবান রাম এসে জিজ্ঞেস করলেন- “বতস্য হনুমান ! তোমার এত বিলম্ব কেন ? আমি বালুকা দ্বারা শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পূজা সমাপন করেছি । কারন তোমার আসতে বড় বিলম্ব হয়েছিলো, অপরদিকে শুভক্ষণ অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল্ল দেখেই আমি বালুকার শিবলিঙ্গ গড়ে পূজো সেড়েছি।” হনুমান বলল- “তবে প্রভু এখন কি হবে? আমি যে শিবলিঙ্গ এনেছি, ইঁহার কি হবে?” ভগবান রাম বললেন- “বতস্য! তুমি যে শিবলিঙ্গ এনেছো তা আমি পূজা করবো। পুনঃ আমি এই সমুদ্র তটে পূজা করবো । এই শিবলিঙ্গ ‘রামনাথ’ নামে বিখ্যাত হবে।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম রামেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গের থেকে স্বল্প দূরে হনুমানের আনিত শিবলিঙ্গ স্থাপন করে শাস্ত্র নিয়মে পূজা করলেন । পুনঃ লঙ্কা জয় ও সীতা উদ্ধারের প্রার্থনা জানালেন । ভগবান শিব আশীর্বাদ করলেন । এই দুটি শিবমন্দির ভারতবর্ষের তামিলনাড়ুতে অবস্থিত । আপনারা একবার অবশ্যই দর্শন করে আসবেন । ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা যাবার পথে এখনো রামসেতুর ভাসমান শিলা ভঙ্গ অবস্থায় সমুদ্রে দেখা যায় । এই শিলা নিয়ে একবার রথযাত্রা হয়েছিলো । কাঁচের আক্যোরিয়ামে জলে ডোবানো ছিলো এই শিলা । আশ্চর্য এই শিলা ডোবে না। ভারতবর্ষের বেশ কিছু হনুমান মন্দিরে এই শিলার অংশ নিয়ে গিয়ে সেখানে স্থাপিত করে পূজা করা হয় । একে “রামশিলা” বলে। এর থেকে স্পষ্ট প্রমান হয়, বুদ্ধিজীবি ও সেকুলার, বিধর্মীরা যতই “রামলীলাকে” কাল্পনিক বলুক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না। সেই অযোধ্যা এখনো আছে উত্তরপ্রদেশে , শ্রীলঙ্কাতে এখনো রাবণের মহলের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়, অশোক বন, অশোক বনে হনুমানের পদচিহ্ন দেখা যায়। শ্রীলঙ্কা গেলে দেখে আসতে পারেন বা নেটে সার্চ করে ছবি দেখতে পারেন। শ্রীলঙ্কাতে এখনো নিকুম্ভিলা মন্দির আছে । সুতরাং ভগবান রাম সত্য, রাম- রাবণ যুদ্ধ সত্য, রামায়ণ সত্য, হিন্দু ধর্ম সত্য। আর যারা এগুলোকে বদনাম করেন বা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন, মনে রাখবেন তারাই অসত্য।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১৪ )



নল নীল কাজের দায়িত্ব পেলো । কিন্তু ভগবান রাম ভাবলেন অন্য কথা । প্রতি শুভ কাজের আগে ইষ্ট দেবতার পূজা করা জরুরী । শ্রীরামের ইষ্টদেবতা হলেন ভগবান মহেশ্বর । সেই রুদ্রদেবতার কৃপা না নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করা ঠিক হবে না । সেই নীলকণ্ঠ , দেবাদিদেব সর্বদা মঙ্গল ফল প্রদান করেন । তাই সবার অগ্রে শিবের পূজা সেড়ে নিতে হবে । শ্রীরাম তখন সুগ্রীব, জাম্বুবান, হনুমানকে জানালেন যে , “এই শুভ কাজ আরম্ভের পূর্বে ইষ্ট দেবতা ভগবান শিবের পূজা করা একান্ত মঙ্গলের হবে। অতএব শম্ভুর পূজো আগে সেড়ে নেই।” সকলে সম্মত হল। যেহেতু রাবণ পাপীষ্ঠি হলেও শিব উপাসক । আর ইষ্টদেবতা ভক্তের সঙ্গ নিয়ে ফেলেন। যদিও সেই দুর্মতি আর কোন রূপ সহায়তা পাবে না। তবুও ভগবান শিবের আশিস নিলে যুদ্ধে সাফল্য নিশ্চিত । কিন্তু সেই বালুকা তীরে সমুদ্র তটে কোন শিবমন্দির ছিলো না। ভগবান রাম হনুমানকে বললেন- “বতস্য হনুমান ! তুমি কৈলাস থেকে শিবলিঙ্গ আনয়ন করো। সেই শিবলিঙ্গে আমি পূজা করবো। কিন্তু যথা সময়ে এনো। শুভক্ষণ যেনো অতিক্রান্ত না হয়।” যাই হোক এখানে একটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ভগবান রাম একটি না দুটি শিবলিঙ্গ পরপর পূজা করেন তা নিয়ে দ্বিমত আছে। ভারতবর্ষের তামিলনাড়ুতে রামেশ্বর শিবমন্দিরের পাশে “রামনাথ” নামক একটি বহু প্রাচীন শিবমন্দির আছে। বলা হয় রামেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ পূজা করবার পর ভগবান রাম “রামনাথ” লিঙ্গ স্থাপন করে এখানে পূজা করেন। যেহেতু একসাথে দুটি শিবলিঙ্গ পূজা করা অশাস্ত্রীয়। কিন্তু একটি পূজা করে আর একটি পূজা করা যায় । ভগবান রাম সেই শাস্ত্র নিয়ম পালন করেছেন । সুতরাং আমরা সেই তামিল উপকথার প্রসঙ্গ নিয়েই লেখছি। শ্রীরামের কথা শুনে হনুমান এক লম্ফ দিয়ে আকাশে উড়ে গেলো । দেখতে দেখতে তার বিশাল তনু দৃষ্টির বাইরে গিয়ে গভীর আকাশে যেনো মিলিয়ে গেলো । ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর প্রান্তে হিমালয়ে পৌছানো খুব সহজ ব্যাপার নয় । পবনের মতো বেগ ধারন করে পবনতনয় হনুমান উড়ে চলল মেঘের রাজ্য দিয়ে ।

নীচে দেখলো কত পাহার, কত গ্রাম, কত গভীর জঙ্গল, কত নদ নদী , কত রাজ্য, কত পথ ঘাট । রাক্ষসের উৎপাত আর কোথাও নেই । সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে রাক্ষসের আতঙ্ক দূর হয়েছে। মুনি ঋষিরা পবিত্র যজ্ঞ করছে। রাজারা ধর্ম মেনে প্রজা পালন করছে । মানুষ আনন্দে রাস্তাঘাটে বের হয়েছে । বন গুলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে । এই সব দেখতে দেখতে হনুমান চলতে লাগলো । একসময় অনেক পর্বত পার করে হিমালয়ের উপরে উড়তে লাগলো । যেনো তুষার চাদরে সমগ্র পর্বত ছেয়ে গেছে। ঠাণ্ডা ধোয়া বরফ পিণ্ড থেকে উড়ছে । চারপাশে শীতলতা। সেখানে দেখলেন কত শত মুনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরকে ডাকছে। তাহাদের জটা, দাঁড়ি ভূমি স্পর্শ করেছে। বরফে শরীর ছেয়ে গেছে । আরোও দেখলেন গুহার মধ্যে সব সাধুরা কেবল কৌপীন পড়ে ঠাণ্ডাকে জয় করে ঈশ্বর আরাধনা করছেন । একসময় নামলেন কৈলাস পর্বতে । সেখানে শিব আর ভবানী নানা আলোচনা করছেন । রুদ্র আর রুদ্রাবতারের মুখোমুখি দেখা হল। হনুমান করজোড়ে ভব ভবানীর স্তবস্তুতাদি করলেন । বললেন- “হে ভোলেনাথ। লঙ্কা আক্রমণের পূর্বে প্রভু শ্রীরাম আপনার পূজা করতে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। হে আশুতোষ শঙ্কর ! আমার কাছে সময় স্বল্প । এর মধ্যে আপনার জ্যোতিরলিঙ্গ নিয়ে লঙ্কায় পৌছাতে হবে। কৃপা করে প্রদান করুন।” ভগবান মহেশ্বর বললেন- “হনুমান। পাপী রাবণকে আমি আর কোন প্রকার সহায়তা করবো না। তবে সে দেবীর ভক্ত। দেবী ভবানী, ভদ্রকালী রূপে তাকে সহায়তা করেন কিনা! যাই হোক আমি তোমাকে জাগ্রত লিঙ্গ প্রদান করছি। শীঘ্র তুমি নিয়ে যাও।” এত বলি মহাদেব নিজ হৃদয় থেকে একটি জ্যোতির্ময় শিবলিঙ্গ উৎপন্ন করে হনুমানের হস্তে দিলেন । হনুমান পুনঃ হরগৌরীর বন্দনা করে দক্ষিণ প্রান্তে রওনা দিলেন। এদিকে হনুমানের আসতে অনেক দেরী। বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন শ্রীরাম । বানরেরা উচু টিলায় উঠে দেখতে লাগলো হনুমান আসেন নাকি । কিন্তু হনুমান আর আসে না। অপরদিকে শুভ সময় বয়ে যাচ্ছে। তখন শ্রীরাম বললেন- “বোধ হয় হনুমানের আসতে বিলম্ব হবে। আমি বালুকা দ্বারা শিবলিঙ্গ রচনা করে পূজা করবো। তোমরা বিল্ব পত্র , বেল, ধুতুরা, আকন্দ, নীলকণ্ঠ, ভাট পুস্পের , ফলমূলাদির বন্দোবস্ত করো।” নিমিষে বানর সেনারা সব কিছু নিয়ে এলো। ভগবান রাম সমুদ্রের জল দ্বারা বালুকা মেখে একটি শিবলিঙ্গ তৈরী করতে লাগলেন । ধীরে ধীরে একটি শিবলিঙ্গ গঠন করলেন । আশে পাশে থেকে মুনি ঋষিদের এনে এরপর পূজায় বসলেন ।

হরি আর হরের লীলা কে বুঝতে পারে ? কৈলাসে মহাদেব দেখছিলেন। আর বলছিলেন – “দেবী ! নিত্য আমি যাঁকে ধ্যানে অন্বেষণ করি- আজ তিঁনি আমার পূজো করছেন।” অপরদিকে ভগবান রাম পূজায় বসলেন। এখানে সামান্য উপাচারে পূজা। মহা মন্ত্র সকল উচ্চারন করে সমুদ্রের জল দ্বারা শিবলিঙ্গের অভিষেক করলেন । সশস্ত্র অবস্থায় তিনি পূজায় বসেছিলেন । এরপর বেলপাতা , বেল, পুস্পাদি দ্বারা শিবলিঙ্গে পূজা করলেন । দীপ- ধূপ দ্বারা আরতি আদি করে বনজ ফলমূল উৎসর্গ করলেন । মহাদেব সামান্যতেই তুষ্ট। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি শিবপূজার। কোন আড়ম্বর নেই। সামান্য গঙ্গাজল আর বেলপাতা দিয়ে ব্যোম ব্যোম শব্দ তেই প্রসন্ন হন । এইবার ভগবান রাম করজোড়ে প্রার্থনা করে বললেন- “হে আশুতোষ! হে মহাদেব! আপনি আমার প্রণাম স্বীকার করুন। হে নীলকণ্ঠ আপনার অপার করুণা । আপনি দয়ার মূর্তি। আপনি কৃপা করে এই পূজা স্বীকার করুন । হে রুদ্রদেব! আমাকে আশীর্বাদ করুন যেনো এই যুদ্ধে আমি জয়ী হয়ে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করে নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে পারি। হে চন্দ্রমৌলি! হে ভগবন! হে গৌরীপতি ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা জানাই, যেনো আমার এই সহায়কেরা যুদ্ধে অনায়েসে রাক্ষসদের বধ করতে পারে, আমি এও জানি একমাত্র আপনি সহায় থাকলেই এই শুভ কর্ম সম্ভব হবে। হে নটরাজ ! হে ত্রিলোচন , আমাকে কৃপা করে বিজয়ী হবার বর প্রদান করুন। হে মহেশ! আপনি পুরাকালে অসুর সমূহকে নাশ করে যেরূপ দেবতাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন, সেইরূপ এই লঙ্কা জয়ের পথে সমগ্র বাধাকে দূর করে আমার মঙ্গল করুন । দেবাদিদেব, আপনি সকল দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ! আপনার আরাধনা করেই বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু হতে পেরেছেন, সেইরূপ আপনার আরাধনা করেই যেনো আমি রাবণের বিনাশক হতে পারি । হে চন্দ্রচূড় ! আমাকে দয়া পূর্বক আশিস প্রদান করুন।” এইভাবে ভগবান রাম লঙ্কা জয় করবার জন্য প্রার্থনা করতে লাগলো । হনুমান তখনও এসে পৌছায় নি । ভগবান শিব প্রসন্ন হলেন ।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১৩ )


রাবণ কোন মতেই মানলো না সুবুদ্ধি। কেকসী এবং বিশ্বশ্রবা মুনি এসে রাবণকে অনেক বোঝালো । বলল- “পুত্র দশানন ! পুলস্ত্য ঋষির বংশজ হয়ে কেন এইরূপ কুকাজ করছ ? এতে আমি লজ্জিত বোধ করছি । তার উপর সীতা দেবী সাক্ষাৎ দেবী লক্ষ্মী। তোমাকে এর পূর্বে বহুবার সংযত হতে বলেছি । বারবার বলেছি ভগবান শ্রীহরি মর্তে আবির্ভূত হয়েছেন । ইতিপূর্বে তিঁনি তাড়কা, সুবাহু, মারীচ, বিরাধ, খড়, দূষণ , ত্রিশিরা রাক্ষস সংহার করেছেন । তুমি সেই বিষ্ণু অবতার রামচন্দ্রের স্ত্রীকে অপহরণ করে এনেছো। তুমি ভগবান বিষ্ণুর ক্রোধ সম্বন্ধে অবগত নও । সেই ক্রোধে তোমার লঙ্কা উজার হয়ে যাবে। অতএব সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসো।” রাবণ বলল- “তা হয় না। ঐ ভিক্ষুক রাম যদি বিষ্ণু হয়, তবে আমি বিষ্ণু বধ করবো। কিন্তু সীতাকে কদাপি ফেরাবো না। হয় সীতা আমার কণ্ঠের উজ্জ্বল মাল্য হয়ে ভূষিত হবে, নচেৎ তাকে দুমাস বাদে হত্যা করবো। দেখি ঐ রাম কি করতে পারে ? বনের পশু নিয়ে সে যে দল গঠন করেছে, লঙ্কার একজন রাক্ষস সেই গোটা দলকে ভক্ষণ করতে সমর্থ । এবার রাক্ষস বধ করার পরিণাম রাম হারে হারে টের পাবে। তাড়কা, সুবাহু, মারীচ, বিরাধ, খড়, দূষণ , ত্রিশিরা রাক্ষস বধের শাস্তি সে পাবে। আসুক সেই রাম। ওদের এমন শাস্তি দেবো যে ভবিষ্যৎ এ আর কেউ রাক্ষস বধ করবার কথা স্বপ্নেও চিন্তা করবে না।” বিভীষণ বলল- “অগ্রজ! পিতার কথা মেনে নিন। আপনি সীতাকে নয় লঙ্কার বিনাশকে এনে অশোক বনে পালন করছেন । ভগবান শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করা মানে লঙ্কার পরাজয় নিশ্চিত । ভগবান শ্রীরামের শর থেকে এই লঙ্কাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না? কেন আপনি সেই শক্তিমান রামচন্দ্রের সাথে শত্রুতা করছেন ? সীতাকে ফিরিয়ে দিন।” শুনে রাবণ ক্রোধে গর্জে বলল- “চুপ করো! তোমার মুখে কেবল ঐ ভিক্ষুক রামের প্রশংসা । পুনঃ যদি রামের প্রশংসা করে আমাকে বোঝাতে আসো তবে পদাঘাত করে লঙ্কা থেকে বিতারিত করবো।”

রাম, লক্ষণ, জাম্বুবান, হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, নল- নীল আদি সব সেনা বিশাল সমুদ্রের পাড়ে পৌছালো । বিশাল সমুদ্র। আর বিশাল ঢেউ এসে তীরে আছরে পড়ছে। সেই উত্তাল ঢেউয়ের আওয়াজে কান ঝালাপালা হয় । তার তীরে সব বানরেরা বসে দেখছিলো । কিভাবে পাড় হবে এই সমুদ্র । এতে তো নৌকা নিয়ে পারাপার করাও অসম্ভব । সকলে কেবল মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিলো । আর ভগবান রামের দিকে তাকিয়েছিলো । তখন লক্ষ্মণ বললেন- “ভ্রাতা! আপনি আদেশ দিলে এখুনি এই সমুদ্র শুকিয়ে যাত্রাপথ রচিত করি।” ভগবান রাম বললেন- “কদাপি নয়। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। বহু জলজ জীবের প্রানহানি হবে। আমি সমুদ্র দেবের তপস্যা করে ওনাকে সন্তুষ্ট করে যাত্রাপথ চাইবো।” এই বলে ভগবান রামচন্দ্র করজোড়ে সমুদ্র দেব রত্নাকরের স্তবস্তুতি করতে লাগলেন । বললেন- “ হে রত্নাকর ! হে সমুদ্র দেবতা! রঘুনন্দন শ্রীরাম আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছে। হে দেব! আপনি অগাধ, আপনি উত্তাল হয়েও জলজ প্রানীকে মাতৃক্রোড়ে থাকা শিশুর মতো তাদের আশ্রয় দিয়েছেন । হে সিন্ধুদেব! আপনি ঐশ্বর্য দায়িনী দেবী লক্ষ্মীর পিতা, সেই কারণে সর্বলোকে সম্মানীয় । হে সমুদ্র দেব! তোমার জলরাশি পরম পবিত্র, কারণ সমস্ত পুন্যা নদী এসে তোমাতেই বিলীন হয় । হে দেব প্রসন্ন হোন! আপনি অবগত দুষ্ট দশানন আমার পত্নীকে হরণ করে লঙ্কা নিয়ে গেছে। তাঁকে মুক্ত করতে আমাদের লঙ্কায় যেতে হবে। আপনার অগাধ জলরাশি মাঝে পথ দিন। হে সিন্ধুদেব, কৃপা করুন।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম সমুদ্র দেবতার পূজা করে তপস্যায় বসলেন । তিনদিন কেটে গেলো। তবুও সমুদ্র দেবতা দেখা দিলেন না। কোন রকম পথ দিলেন না। বিশাল ঢেউ এসে তীরে আছরে পড়তে থাকলো। তখন দাশরথি রাম ধ্যান ভঙ্গ করে উঠে গর্জে বললেন- “হে সমুদ্র ! তুমি সাহায্য করলে না। তিনদিন ধরে নির্জলা নিরম্বু উপবাস করে তোমার তপস্যা করেছি , তবুও তুমি সহায়তা না করে কেবল গর্জন করে ঢেউ উৎপন্ন করে নিজ দর্প প্রকাশ করেছো। এতদিন এই ত্রিলোক এই রামের কোমল , নমনীয় স্বরূপ দেখেছে, এবার কঠিন রূপ দেখবে।” এই বলে ভগবান রাম ধনুকে অগ্নিবাণ আনলেন ।

শ্রীরামের শর দিয়ে প্রলয়াগ্নি নির্গত হতে লাগলো । যেনো ত্রিলোক পুড়ে ভস্ম হবে। চতুর্দিকে কেবল অগ্নির সপ্ত জিহ্বা দেখা গেলো । শ্রীরাম সেই বাণ নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন । সেই সময় সমুদ্র দেব উদিত হলেন । করজোড়ে বললেন- “ক্ষান্ত হন প্রভু! আমাকে অগ্নিবাণে শুকাবেন না। হে প্রভু আপনি স্বয়ং সৃষ্টি পালন করেন। আমাকে শুকিয়ে আপনি সৃষ্টির নিয়ম উলঙ্ঘন করতে পারেন না। হে দয়াময় রঘুপতি ! আমাকে কৃপা করে ক্ষমা করুন । আমি আপনার শরণ নিচ্ছি।” তখন ভগবান রাম কোমল হয়ে বললেন- “যে আমার শরণাগত হয় তাকে আমি ক্ষমা করি। যদি রাবণ এসেও আমার শরণ নেয়, তবে আমি তাকেও ক্ষমা করবো। হে সমুদ্র! সীতা উদ্ধারের জন্য আমি এই সেনা সমেত সমুদ্র লঙ্ঘন করে শত যোজন পারে লঙ্কায় যাবো। তুমি দুভাগ হয়ে মধ্যে স্থলপথ রচনা করে আমাদের যেতে দাও।” সমুদ্র বলল- “ এ হয় না প্রভু। এতে অনেক নিরীহ প্রানী মারা যাবে। আপনি বরং আমার উপরে সেঁতু নির্মাণ করে লঙ্কায় যান। আমি কথা দিচ্ছি যতদিন না আপনি সীতা উদ্ধার করে ফিরে আসেন, ততদিন এই সেঁতু আমি রক্ষা করবো।” সকলে বলল এই সমুদ্রে কিভাবে সেতুবন্ধন সম্ভব ? সমুদ্রের যে তাণ্ডব এখানে। সমুদ্র দেব বললেন- “প্রভু ‘রাম’ নাম জপ করে ভবসমুদ্র পার হওয়া যায়। এই সমুদ্র তো অতি তুচ্ছ। আপনার নাম নিয়ে সব সম্ভব । আপনি যেখানে, সকল সমস্যার সমাধান সেখানে। আপনার দলে বিশ্বকর্মা পুত্র নল নীল আছেন। তারা ছোট বেলায় ঋষি শাপ পেয়েছিলো যে তারা যা কিছু জলে ফেলবে সব ভেসে থাকবে, কিছুই নিমজ্জিত হবে না। তাহাদিগের দিয়ে বড় পাথর, বৃক্ষ সমুদ্রে ফেলে সেতু নির্মাণ করে লঙ্কায় গমন করুন।” তখন শ্রীরাম বললেন- “বেশ তাই হবে। কিন্তু আমি যে ক্রোধ বশত অগ্নিবাণ প্রকট করেছি এর কি হবে? একে তো ফেরানো যাবে না।” তখন সমুদ্র দেব বললেন “ হে প্রভু! আমার উত্তর প্রান্তে দুরাচারী রাক্ষসেরা থাকে। আপনি সেখানে এই অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করুন। যাতে সেই রাক্ষসেরা ভস্ম হয়ে মরে।” ভগবান রাম তখন সেই দিকেই অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন। সেখানে অবস্থিত রাক্ষসেরা পুড়ে ভস্ম হল।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১২ )

রাবণের লঙ্কা পুড়ে ছাই । চতুর্দিকে স্তূপীকৃত ভস্ম থেকে কেবল ধোয়া উঠছে। সে সবের মাঝে রাবণ কপালে হাত দিয়ে বসেছিলো । ক্রোধে তার শরীর কাঁপছিলো। পুত্র হারানোর শোক আর প্রিয় লঙ্কাকে হারানোর শোক উভয়ে তাকে গ্রাস করেছিলো । রাবণ মেনে নিতে পারছিলোই না যে এক সামান্য মর্কট এসে লঙ্কায় এত তাণ্ডব করে চোখ রাঙিয়ে হুমকি দিয়ে গেলো । আর গর্বিতা সীতা সে সকল দেখে আনন্দ প্রকাশ করলো । রাবণকে এসে বৃদ্ধ মন্ত্রী মাল্যবান জানালো যে- “লঙ্কেশ! এবার লঙ্কার পুনঃ নির্মাণের প্রয়োজন। যে কোন ব্যক্তি এই কাজ পারে না। এই লঙ্কা দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা তৈরী করেছে। পুনরায় তাহাকেই এনে নির্মাণ করা হোক।” রাবণ বলল- “দেবতারা আমার দাস। ঐ মর্কট লঙ্কা দহন করে নবগ্রহকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে। দেবতারা আমার দুর্দশা দেখে অবশ্যই হাস্য করছে। যেখান থেকে হোক, বিশ্বকর্মাকে ধরে আনো। যদি আসতে না চায় তাহলে বেঁধে আনো।” মন্দোদরী সেখানে ছিলো। মহারানী সে ভয়ে ভীত ছিলো । সে বলল- “মহারাজ আমি চাই আপনি সুখে রাজ্য করুন । আপনি সীতাকে ফিরিয়ে দিন। এই রাক্ষসদের সর্বনাশ আপনি ডেকে আনছেন কেন?” এই বলে মন্দোদরী বললেন-

রহসি জোরি কর পতি পগ লাগি ।
বোলী বচন তীতি রস পাগী ।।
কম্ভ করষ হরি সন পরিহরহূ ।
মোর কহা অতি হিত হিয়ঁ ধরহূ ।।
সমুঝত জাসু দূত কই করনী।
স্রবহিঁ গর্ভ রজনীচর ঘরনী ।।
তাসু নারি নিজ সচিব বোলাঈ ।
পঠবহু কন্ত জো চহহু ভলাঈ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

মন্দোদরী বললেন- “ হে প্রিয়তম ! আমি করজোড়ে মিনতি করছি । আপনি শ্রীহরির সাথে শত্রুতা করবেন না । আমি সমগ্র রাক্ষস জাতির জন্য হিতের চিন্তা করেই বলছি । তাঁর দূতের কথা ভেবেই রাক্ষসীদের গর্ভপাত হচ্ছে । হে প্রিয় পতি দেব! যদি সত্যই লঙ্কার মঙ্গল চান তাহলে সীতাকে ফিরিয়ে দিন । সীতার কারণে আপনি নষ্ট হবেন । আপনি সীতাকে না ফেরালে ব্রহ্মা ও হর এসেও আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।”

রাবণ দর্পে মত্ত হয়ে বলল- “স্বভাবে নারীজাতি ভীতা হয়। সে সব কিছুতেই কেবল অমঙ্গল দেখে । শূর্পনাখাও তো নারী। সে তো তোমার মতোন ভীত নয়। তুমি ময় দানবের কণ্যা হয়ে এত ভীত কেন ? আমি চাই ঐ ভিখারী, বনের পশু নিয়ে এখানে আসুক । আমি তাদের জন্য মৃত্যুজাল রচনা করে রেখেছি । পিঁপড়ের মতো পিষে মারবো তাদের । আমার আশ্রিত নরমাংস ভোজী রাক্ষসেরা আনন্দে পশুর মাংস ভক্ষণ করবে। একবার যুদ্ধ হতে দাও- দেখবে কপির দলকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারবো।” মাল্যবান অনেক বোঝালো রাবণকে । কিন্তু রাবণ মানেই না । রাবণ মাল্যবানকে অনেক বকাঝকা করলো। এরপর রাবণ শুক আর শারণ নামক দুই গুপ্তচর কে নিয়োগ করলো। বলল- “তোমরা মায়া বিদ্যায় পারঙ্গদ। সর্বদা রাম লক্ষ্মণ আর কপিদের ওপর দৃষ্টি রেখে আমাকে খবর দেবে।” শুক আর শারণ সেই কাজেই লেগে পড়লো । রাক্ষসেরা বীর দর্পে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। একদিনের কথা কুম্ভকর্ণ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে । স্বয়ং নারদ মুনি এসেছেন । নারদ মুনিকে প্রনাম করে কুম্ভকর্ণ অনেক স্তবস্তুতাদি করলো । নারদ বলল- “কুম্ভকর্ণ! এবার তোমার আর তোমার ভ্রাতা রাবণের মুক্তির সময় এসেছে।” কুম্ভকর্ণ বলল – “কিসের মুক্তি প্রভু?” নারদ মুনি বললেন- “কুম্ভকর্ণ স্মরণ করো তোমাদের পূর্ব জন্মের কথা। তুমি আর তোমার ভ্রাতা সত্যযুগে জয়, বিজয় নামে ছিলে। তোমরা ছিলে ভগবান বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠধামের দ্বারপাল । একদা যখন প্রভু বিষ্ণু তোমাদের দ্বার প্রহরাতে রেখেছিলেন সে সময় সনক , সনাতন, সনন্দন , সনৎকুমার নামক চার বাল্য ঋষি বৈকুণ্ঠে এসেছিলেন । তোমরা তাঁদের বিষ্ণু দর্শনে বাধা দিয়েছিলে। তারা ক্রোধে তোমাদের অভিশাপ প্রদান করেন যে তোমরা তিনযুগে ধরিত্রীতে বিষ্ণু বিদ্বেষী হয়ে জন্মে বিষ্ণুর হস্তে নিধন হবে। তারপরে পুনঃ বৈকুণ্ঠে ফিরে আসবে। মনে করো বতস্য।” কুম্ভকর্ণের ধীরে ধীরে সব কিছু মনে পড়লো । সে আর রাবণ আগে দ্বারপাল ছিলো । কুম্ভকর্ণ বলল- “হ্যা দেবর্ষি ! আমার সব মনে পড়েছে।”

নারদ মুনি বললেন- “তুমি আর রাবণ এর পূর্বে হিরণ্যক্ষ আর হিরণ্যকশিপু নামে কশ্যপ মুনির পুত্র ছিলে। কিন্তু তোমরা ছিলে দানব । ভগবান শ্রীবিষ্ণু বরাহ ও নৃসিংহ অবতার গ্রহণ করে তোমাদের বধ করেন । সেই প্রভুই এবার অযোধ্যার স্বর্গীয় রাজা দশরথের পুত্র রাম রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন । যিনি বরাহদেব , যিনি নৃসিংহ দেব তিঁনিই বর্তমানে রঘুপতি শ্রীরামচন্দ্র। তাঁর স্ত্রী রূপে লক্ষ্মী দেবী, সীতা রূপে আবির্ভূতা হয়েছেন । তোমার ভ্রাতা, ভগবান শ্রীরামের স্ত্রীকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে এসেছেন। এবার রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করবেন। এই যুদ্ধে লঙ্কার পতন অবধারিত । তুমিও প্রভুর হস্তে নিহত হবে, পরে তোমার ভ্রাতাও নিহত হবে। তোমাদের শাপ খণ্ডন হবে। তুমি মুক্তির জন্য প্রস্তুত হও।” কুম্ভকর্ণ এভাবে স্বপ্ন দেখলো । অপরদিকে রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ অযূথ সেনা নিয়ে লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যথা-

দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি উত্তরফাল্গুনী ।
শুভক্ষণ শুভলগ্ন শুভফল গণি ।।
দক্ষিণে সবৎসা ধেনু হরিণ ব্রাহ্মণ ।
দেখিলেন রাম বামে শব শিবাগণ ।।
সূর্য্যবংশী নৃপতির নক্ষত্র রোহিণী ।
রাক্ষসগণের মূলা সর্বলোকে জানি ।।
মূলা ঋক্ষ দেখিলেন রোহিণী বড় রোষে ।
সবংশে মরিবে তেঁই রাবণ- রাক্ষসে ।।
চলিল বানর ঠাট নাহি দিশপাশ ।
কটক যুড়িয়া যায় মেদিনী আকাশ ।।
কিলি কিলি শব্দ করি কপিগণ চলে ।
উত্তরিল গিয়া সবে সাগরের কূলে ।।
রহিবারে পাতা লতা দিয়া করে ঘর ।
অবস্থিতি করিলেন সকল বানর ।।
সেই স্থানে রহিলেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
চরমুখে নিত্য বার্তা পায় সে রাবণ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

( ক্রমশঃ ) 
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১১ )

এইভাবে দধিমুখের পালিত বানরেরা পালিয়ে গিয়ে দধিমুখকে খবর দিলো । দধিমুখ প্রচণ্ড ক্রোধে সেনা সমেত মধুবনে আসতে থাকলো । অপরদিকে বানরেরা মধুবনের ফলমূল আহার করে পরম সুখে বিশ্রাম নিছিল্ল। একে অপরের সাথে নানা প্রকার হাস্য কৌতুক করছিলো । কেউ কেউ আবার একে অপরের মস্তকের আবর্জনা পরিষ্কার করে দিচ্ছিল্ল । এত ফল খাওয়া সর্তেও মনে হয় বাগানের দশভাগের এক ভাগও ফল সমাপন হয় নি। এত ফল ছিলো বাগানে । চতুর্দিকে বিখিপ্ত ফলের খোসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলো বানরেরা। বড় বড় বৃক্ষের ডালে ঝুলে তারা খেলা করছিলো । মধু পান করে উদর ফুলিয়ে কেউ নিশ্চিন্তে শয়ন করছিলো । হনুমান, অঙ্গদ, জাম্বুবান, নল, নীল, গবাক্ষ এরা প্রচুর ফল খেলো । দধিমুখ এসে দেখে বাগান তছনছ করে রেখেছে বানরেরা। আবার শয়ন করছে সুখে । আরোও দেখলো অঙ্গদ, হনুমান সেখানে বসে ফলমূল সেবা করছে । দধিমুখ তখন তাদের বাগান থেকে বের হতে বলল। কিন্তু কেউ বের হল না। হনুমান আর অঙ্গদের অভয় পেয়ে সকলে আরোও নিশ্চিন্তে ফলমূল খেতে লাগলো। দধিমুখের কথা কেউ শুনলোই না । দধিমুখ তখন তার আশ্রিত বানরদের পুনঃ যুদ্ধ করবার আদেশ দিলো । হৈ হৈ করে দধিমুখের আশ্রিত বানরেরা তেরেফুরে আসলো । পুনরায় দুইদল বানরের মধ্যে মারামারি, আঁচর- কামড় ইত্যাদি চলতে লাগলো । একে অপরের উপর লম্ফ দিয়ে পড়ে কিল, মুষ্ট্যাঘাত করতে থাকলো । তখন অঙ্গদ তেড়ে ফুড়ে এসে গদা দিয়ে দধিমুখের আশ্রিত বানরদের পিটিয়ে বিতারিত করলেন । দধিমুখের আশ্রিত বানরেরা পালিয়ে গেলে দধিমুখ যুদ্ধে নামলো । অঙ্গদ আর দধিমুখের মধ্যে সেই যুদ্ধ আরম্ভ হল ।

দুজনের মল্লযুদ্ধে বড় বড় বৃক্ষ গুলি পতিত হল। কত শত ডাল ভেঙ্গে পড়লো। বানরেরা যে যেদিকে পারলো ভয়ে লুকালো । দধিমুখ কিছুতেই অঙ্গদের সাথে পেরে উঠছিলো না। অঙ্গদ তাকে তুলে ভূমিতে বারংবার আছার দিতে লাগলো । দধিমুখ হেরে গিয়ে পলায়ন করলো । পুনঃ তখন বানরেরা এসে গ্রেগ্রাসে ফলমূল ভক্ষণ করতে লাগলো । দধিমুখ তখন রাম, লক্ষণ , সুগ্রীবের কাছে গিয়ে বলল- “সুগ্রীব। তোমার ভাতুস্পুত্রের আর হনুমানের সাহায্যে বানরেরা মধুবন ভঞ্জন করেছে। সেখানে অযূথ ফলমূল তারা ভক্ষণ করেছে। বাধা দিতে গেলে আমাকে আর আমার আশ্রিত বানরদের মেরে তাড়িয়েছে । একি অনাচার সুগ্রীব!” তখন সুগ্রীব বললেন- “মাতুল! আপনি শোক কেন করছেন ? অঙ্গদ আপনার নাতি। তাঁর বীরত্বে আপনি প্রসন্ন হোন। সে আপনার মতো বীরকে পরাজিত করেছে । আপনি তাহাকে আশীর্বাদ করুন । আর সে এখন কিস্কিন্ধ্যার যুবরাজ । সমগ্র বানর জাতির আগামী রাজা। সে আমার ভ্রাতা বালির ন্যায় শক্তিমান হয়ে উঠছে। এতে সমগ্র বানরদের আনন্দ হওয়ার কথা।” দধিমুখ ভেবে দেখলো তাই তো। অঙ্গদ পরাক্রমী আর বীর হয়ে উঠেছে । সে নিজেই অত গুলি শক্তিশালী বানরদের মেরে তাড়িয়েছে । তাহার ন্যায় বীর কে বিতারিত করেছে । এতে আনন্দ হওয়ার কথা । তখন দধিমুখের সমস্ত রাগ কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো । ভগবান রাম বললেন- “সেখানে কি হনুমানকে দেখেছেন?” দধিমুখ হ্যাঁ জানালো। ভগবান রাম খুশী সহকারে বললেন- “হনুমান সফল হয়েছে। সে ঠিক লঙ্কায় গিয়ে সীতার সাথে সাক্ষাৎ করে আমার সংবাদ দিয়েছে। তবেই সে নিশ্চিত হয়ে ফলমূল ভোজন করছে। দেখি সেই রাবণ কি উত্তর দিলো। সেকি জানকীকে ফিরিয়ে দেবে, না আমার সাথে যুদ্ধ করবে।” দধিমুখ ফিরে গিয়ে অঙ্গদের কাছে ক্ষমা চাইলো । হনুমান এরপর এক ছুটে প্রভু শ্রীরামের কাছে এলো ।

প্রভু শ্রীরামকে সষ্টাঙ্গে প্রনাম করে সমুদ্র যাত্রার সকল কিছু বলল। সেই যোগিনী স্বয়মপ্রভার কথা, সম্পাতির কথা , রাক্ষসী হত্যা , নাগমাতার পরীক্ষা, মৈনাকের উদয়, চামুণ্ডার বিদায়, মাতা সীতার সাথে সাক্ষাৎ, দুমাস পর সীতা হত্যার রাবণের অভিলাষ, রাবণের পুত্র ও রাক্ষসদের হত্যা, লঙ্কা দহন করা সব কিছু বলল। এরপর হনুমান ভগবান শ্রীরামকে বললেন- “প্রভু ! আপনার অঙ্গুষ্ঠ পেয়ে মাতা সীতা খুব প্রীতা হয়েছেন। তিনি এই মণি আপনাকে দিতে বলেছেন।” এই বলে হনুমান , মাতা সীতার দেওয়া মণি , ভগবানের হস্তে দিলেন। ভগবান রাম দেখলেন এই মণি স্বয়ং বৈদেহীর। তাঁর মস্তকে শোভা পেতো এই মণি । এই মণির স্পর্শ যেনো সীতার মতো। চোখ বন্ধ করে সেই মণি বুকে চেপে ভগবান রাম “হা সীতা!” বলে বিলাপ করতে লাগলেন । ভগবান রামচন্দ্রের মনে হতে লাগলো তিনি যেনো অন্ধকার গহ্বরে – আর সীতা তাকে ছেড়ে অনেক দূরে। ঐ বিশাল সমুদ্র পাড়ে একাকী । কিভাবে সেখানে পৌছানো যায় । হনুমান সীতাদেবীর দুর্দশা ব্যক্ত করে বলল- “প্রভু। আপনি সেদিন মৃগ ছদ্দবেশে থাকা মায়াবী মারীচের পেছনে ছুটেছিলেন। মারীচ আপনার কণ্ঠ নকল করে চিৎকার করে। সেই চিৎকার শুনে মাতা সীতা লক্ষ্মণকে পাঠান আপনাকে খুঁজতে। সেই সময় রাবণ সাধুর ছদ্দবেশ ধরে তেঁনাকে অপহরণ করে। সেই পাপিষ্ঠী রাবণ মাতাকে বিবাহ করবার জন্য কত যাতনা দিচ্ছে। আপনার বিহনে মা সেখানে জলবিহীন মৎস্যর ন্যায় অবস্থান করছেন। পাপী দশানন দুমাস সময় দিয়েছে মাকে। তারপর ওঁনাকে হত্যা করবে। মাতা সীতা, লক্ষ্মণ ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলেছেন সেদিন কুবাক্য প্রয়োগের জন্য দুঃখিত তিনি।” এই সব শুনে লক্ষ্মণ শোকার্ত শ্রীরামকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন । হনুমান বললেন- “প্রভু! মাতা সীতা আপনাকে এখন নমনীয় থেকে কঠিন মূর্তি ধারন করে রাক্ষস সংহারক রূপে অবতীর্ণ হতে বলেছেন। দুমাসের মধ্যে রাবণকে হত্যা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন।” তখন ভগবান রাম নিজের চোখের জল মুছে কঠিন কণ্ঠে গর্জে বললেন- “পাপী রাবন কি জানিয়েছে? সেকি সীতাকে ফিরিয়ে দেবে?” হনুমান বলল- “না প্রভু! সেই পাপী দশানন , মাতা সীতাকে কোনো অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে না বলেছে। সে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।” তখন ভগবান রাম প্রচণ্ড ক্রোধে ধনুক তুলে বললেন- “তবে তাই হোক। আমি এই মুহূর্তে লঙ্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষোনা করছি।” বানরেরা সমবেত ভাবে “জয় শ্রী রাম” ধ্বনি তুলে দিগ্বিদিক পরিপূর্ণ করলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব –৬)

হনুমান দেখলো সাড়ি সাড়ি কদলী গাছ পক্ক কদলীর ভারে নুয়ে আছে । বিবিধ রকমের কদলীর জাতি। পক্ক কদলীর গন্ধে আমোদিত হয়ে আছে । একেবারে গিয়ে কলা গাছ উপরে ফেলে কলার কাঁদি টেনে এনে পক্ক কদলী ভোজন করতে লাগলো। অপূর্ব স্বাদ। যেনো মিষ্ট মাখন দিয়ে বিধাতা কদলী গুলি রচিত করেছেন । মড় মড় করে একে একে কদলী বৃক্ষ উপরে ফেলে সাবাড় করতে লাগলেন। কদলীর খোসার যেনো পাহার জমল। রাক্ষসী গুলোর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেখলো এক বানর সমানে কলাগাছ উপরে নিয়ে কদলী ভক্ষণ করছে। রাক্ষসী গুলো রে রে করে তেড়ে আসলো। হনুমান গদা দিয়ে পিটিয়ে রাক্ষসীদের অর্ধমৃত করলো। কাউকে লাঙুরে পেঁচিয়ে ছুড়ে মারলো, কাউকে কলাগাছ ছুড়ে মারলো। প্রকাণ্ড কদলী বৃক্ষ চাপা পড়ে মরল রাক্ষসেরা। হৈ হৈ পড়ে গেলো লঙ্কায়। এক মর্কট এসে উৎপাত শুরু করছে। হনুমান একে একে নারকেল বৃক্ষ উপরে নারকেল , কচি ডাব ভক্ষণ করলো। তরমুজের বাগান তছনছ করে সকল তরমুজ সাবার করলো, বারোমাসের আমের গাছে একটা আম্র অবশিষ্ট থাকলো না। যত না খেলো তার অধিক ছড়িয়ে ফেলল, বারোমাসের পনস ফলে এমন গাছে কাঠাল গুলি গ্রেগাসে আহার করতে লাগলো। তাল বৃক্ষে উঠে তাল ফলগুলি খেতে লাগলো। বিকট চেহারার রাক্ষসেরা অস্ত্র হাতে তেড়ে আসলো। হনুমানের দিকে তির, বর্শা ইত্যাদি নিক্ষেপ করলো। হনুমানের কিছুই হল না। দাঁত-মুখ দিয়ে ভেঙচি কেটে রাক্ষসদের দিকে বৃহৎ তাল, নারিকেল ছুড়ে ছুড়ে হতাহত করলো। বিশাল বৃক্ষ গুলো তুলে রাক্ষসদের ওপর ফেলতে লাগলো। গাছের চাপা পড়ে ছটফট করতে করতে সেই বিকট চেহারার বলশালী রাক্ষসেরা অক্কা পেলো । হনুমান লাফ দিয়ে দিয়ে এক গাছ থেকে আর এক গাছে গিয়ে ফলমূল সাবাড় করে রাক্ষসদের ওপর গাছ তুলে তুলে নিক্ষেপ করতে লাগলো। অতি সুজ্জতিত স্তম্ভ গুলি একে একে ধূলিসাৎ হল।

হৈ হৈ করে রাক্ষসেরা ছুটতে লাগলো। এই সময় রাবণের এক পুত্র অক্ষয় কুমার প্রহরা দিচ্ছিল্ল। সে এসে বলল- “এই তুচ্ছ ঘটনার জন্য পিতাকে জানানোর প্রয়োজন নেই। আমি এখুনি গিয়ে সেই কপিকে বধ করবো, অন্যথায় ধরে বেঁধে আনবো।” ইতিমধ্যে জাম্বুবালী রাক্ষস হনুমানের সাথে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধে করতে লাগলো। তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ শর চালনা করলো। ঘাতক দিব্যাস্ত্র সকল নিক্ষেপ করতে থাকলো। হনুমানের ওপর ব্রহ্মার বর আছে যে কোন দিব্যাস্ত্রেই তাঁর কিছুই হবে না। দিব্যাস্ত্রে হনুমানের কিছুই হল না। হনুমান দাঁত, মুখ ভেঙিয়ে ভেঙচি কেটে বড় শাল, তাল বৃক্ষ তুলে জাম্বুবালীর সেনাদের দিকে ছুড়ে মারলো। রাক্ষসেরা চাপা পড়ে হতাহত হল। এরপর হনুমান গাছ থেকে নেমে গদার আঘাতে জাম্বুবালীর স্বর্ণ রথ চূর্ণ চূর্ণ করলো। আর এক গদার আঘাতে জাম্বুবালীর মাথাটাই থেঁতলে দিলো। জাম্বুবালী নিহত হয়েছে দেখে রাবণের পুত্র অক্ষয় কুমার বিড়ালাক্ষ, শার্দূল , ধুম্র আদি শক্তিশালী রাক্ষস যোদ্ধা ও রাক্ষসে সেনা নিয়ে হনুমানকে বন্দী করতে আসলেন । গিয়ে দেখলেন অশোক বাটিকার আর সৌন্দর্য বলে কিছু নেই। ফুল- ফলের গাছ সব তুলে ফেলে দিয়েছে। এদিকে ওদিকে কেবল রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। বহু রাক্ষস প্রান হারিয়েছে। কিছু রাক্ষস যন্ত্রনায় ছটফট করছে । অক্ষয় কুমার বলল- “ওহে মর্কট! তোমার এত দুঃসাহস? রোস ! আজ তোর প্রান নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবো। দেবতারা অবধি লঙ্কায় আসতে সাহস করে না- আর তুই বনের পশু হয়ে এই সাহস দেখালি? আজকেই তোর অন্তিম দিন।” বিড়ালাক্ষ, শার্দূল , ধুম্র আদি রাক্ষসেরা রাক্ষস সেনা পরিবৃত হয়ে হৈহৈ করে হনুমানের দিকে ধাইলো। হনুমান বড় বড় পাথর, শাল- তাল বৃক্ষ তুলে রাক্ষসের পালে নিক্ষেপ করলো। রাক্ষসেরা চাপা মরে মরল। রাক্ষসদের নিক্ষেপিত অস্ত্রে হনুমানের কোন ক্ষতিই হল না। কিছু রাক্ষসকে তুলে অনেক উচুতে ছুড়ে ফেলল, কিছু রাক্ষসকে পদদলিত করে পিষে দিলো। একসাথে শত রাক্ষসকে লাঙুরে পেঁচিয়ে ভূমিতে আছাড় মেরে খুলি চূর্ণ করে দিলো হনুমান ।

বিড়ালাক্ষ রাক্ষসের ওপর বিশাল পর্বতের চূড়া আকৃতি প্রস্তর নিক্ষেপ করলো মারুতি । মারুতির নিক্ষেপিত প্রস্তরে বিড়ালাক্ষের মস্তক পিষে সমস্ত অস্তি, মাংস, শিরা সকল বাহিরে চলে আসলো। বিড়ালাক্ষের নিথর দেহ পতিত হতেই দাঁত কড়মড় করে শার্দূল , ধুম্র রাক্ষসেরা ছুটে এলো । পট্টিশ , লৌহকাটা, বর্শা, তীক্ষ্ণ ছোড়া, তীক্ষ্ণ শর সকল হনুমানের দিকে নিক্ষেপ করতে লাগলো । হনুমান গদা দিয়ে সেই সকল অস্ত্র গুলি ছুড়ে ফেলে দিলো । হনুমান তখন গদা দিয়ে শার্দূল কে পিটিয়ে যমালয়ে পাঠালো। অক্ষয় কুমার অবাক হল এই দেখে যে এই সামান্য মর্কট বড় বড় রাক্ষসদের কিভাবে যমালয়ে প্রেরন করছে । এর শক্তি অনেক । ধুম্র রাক্ষস হনুমানের দিকে ধেয়ে যেতে হনুমান তখন বড় পাথর নিক্ষেপ করে তাঁর দেহটাকে পিষে দিলো । চার বড় বড় যোদ্ধা মারা গেছে দেখে বাকী রাক্ষস সেনারা কেউ আর অগ্রসর হতে সাহস করছিলো না। অক্ষয় কুমার ক্রোধে রথে উঠে হনুমানের দিকে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলো। হনুমান লম্ফ দিয়ে গগনে উঠলো। অগ্নিবাণের কোন প্রভাব হনুমানের ওপর খাটলোই না । এরপর হনুমান একটি প্রস্তর নিক্ষেপ করলো অক্ষয়কুমারের প্রতি ।অক্ষয়কুমার এক শরে প্রস্তর চূর্ণ করলো। হনুমানের দিকে নানা ঘাতক সকল বর্ষণ করতে লাগলো। বাণে বাণে ছেয়ে গেলো। কিন্তু হনুমানের কিছুই হয় না । এরপর হনুমান লম্ফ দিয়ে অক্ষয়কুমারের রথে এলো। হনুমান যত গতিতে লম্ফ দিয়ে অক্ষয়কুমারের রথে এসে পড়লো, রথ খানি সেই বেগ সহ্য করতে না পেরে টুকরো টুকরো হল। এরপর হনুমান “জয় শ্রী রাম” ধ্বনি তুলে অক্ষয় কুমার কে তুলে ভূমিতে আছাড় দিলো। রাবণের পুত্র অক্ষয়কুমারের অস্থি , মস্তক চূর্ণ হয়ে নিহত হল। রাবণের পুত্র মারা গেছে শুনে লঙ্কায় শোরগোল পড়ে গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১০)

লঙ্কায় অগ্নি সংযোগ করে হনুমান প্রবল বেগে পুনঃ ফিরে গেলো । পেছনে যতদূর দেখা গেলো লঙ্কার সমগ্র স্থানে কেবল আগুন আর আগুন। লেলিহান শিখা থেকে সমানে ভস্ম উড়ে চতুর্দিকে আচ্ছন্ন হয়েছে । হনুমান রাম নাম জপ করতে করতে উড়ে আসলো । আবার সেই সমুদ্রের নীল জলরাশি , মেঘের রাজ্যে বকের সারি, সমুদ্রের প্রবল ঢেউ । এই পথেই সে এসেছিলো। পথে ছিলো নানা বিপত্তি । এখন সেসব নেই । নীচে দেখলো অগাধ তরঙ্গ । হনুমান বায়ুর বেগে আসতে থাকলো । একসময়ে এসে পৌছালো সমুদ্রতটে । সেখানে দেখলো জাম্বুবান, নল- নীল, গবাক্ষ। অঙ্গদ ও অনেক কপি অপেক্ষা করে আছে । হনুমানকে আসতে দেখেই সকলে আনন্দে জয়ধ্বনি করলো । হনুমান নেমে এসে প্রসন্ন বদনে জাম্বুবানকে আলিঙ্গন করলো । জাম্বুবান বলল- “পবন নন্দন ! তোমার এই প্রসন্ন ভাব ব্যক্ত করছে যে কার্যসিদ্ধি হয়েছে । বল মাতা সীতার দর্শন লাভ করেছো ত? ওনাকে প্রভুর নিদর্শন প্রদান করেছো ত? অবাক কাণ্ড হনুমান। তোমারো মুখ পোড়া। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম সকল হনুমান প্রজাতির মুখ পুড়ে গেছে। এ কি ভাবে হল? ” হনুমান তখন যাত্রা পথের সকল ঘটনা বলল। নাগদেবী সুরসার পরীক্ষা, মৈনাকের সেবা, সিংহিকা বধ, চামুণ্ডা দেবীর সাথে সাক্ষাৎ , রাবণের স্বর্ণ লঙ্কার দর্শন , অশোকবনে মাতা সীতার প্রতি রাবণের হুমকি, দেবী সীতাকে প্রভু রামের নিদর্শন প্রদান, মাতা সীতার নিদর্শন আনা, অশোক বন নষ্ট করা, রাবণের পুত্র অক্ষয় কুমার ও চার রাক্ষস যোদ্ধা ও বহু রাক্ষস সেনার হতাহত হওয়া, রাবণকে বুঝিয়ে বিফল হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি । হনুমান বলল- “দুর্মতি দশানন রাবণ যুদ্ধ চায়। সে মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেছে। আর বলেছে দুমাসের মধ্যে মাতা সীতা বিবাহে রাজী না হলে , তাকে হত্যা করা হবে।” শুনে বানরেরা বলল- “যদি রাবণ যুদ্ধ চায়, তাহলে আমরা যুদ্ধ করবো। লঙ্কা আক্রমণ করবো।”

হনুমান বলল- “রাবণের পুত্র অক্ষয় ও রাক্ষস সেনাদের বধ করার অপরাধে রাবণের অপর পুত্র মেঘনাদ আমাকে ব্রহ্মাস্ত্রে বন্দী করে দরবারে নিয়ে যায়। সেখানে রাবণ আমাকে হত্যার আদেশ দেয়। কিন্তু রাবণের ভ্রাতা ধর্মপ্রাণ বিভীষণের কথা মেনে পরে রাবণ আমার পুচ্ছ পুড়িয়ে দেবার আদেশ দেয়। রাবণ আমার পুচ্ছে যে অগ্নি দিয়েছিলো, তা দিয়েই আমি সমগ্র লঙ্কা ভস্ম করি। রাবণের স্বর্ণ লঙ্কা এখন ভস্ম। আমি রাবণের অস্ত্রাগার, অশ্বশালা , হস্তীশালা, রথ অনেক অনেক পুড়িয়েছি। এখন রাবণের শক্তি কমেছে । তার চোখের সামনে তার লঙ্কাকে আমি ধূম্রতে ছেয়ে দিয়েছি। তবুও সেই মহাপাপী বিন্দু মাত্র শোচনা করে নি। সে জানিয়েছে মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দেবে না। সেই অগ্নি নির্বাপিত করতে আমি মুখে লাঙুল দিতেই মুখ পুড়ে গেলো। স্বজাতির কাছে মুখ দেখাই কেমন করে এমন ভাবতেই মাতা সীতা অভয় দিলেন যে হনুমান জাতির সকলেরই মুখ পোড়াই থাকবে। তাই এমন হয়েছে । লঙ্কেশ ভেবেছিলো আমাকে লাঙুরহীন করে স্বজাতির কাছে উপহাসের পাত্র বানাবে। কিন্তু সেই দুর্মতি সফল হয় নি। ” সোনার লঙ্কা পুড়ে ভস্ম হয়েছে শুনে বানরেরা আনন্দে জয় ধ্বনি করলো । হনুমানের জয়ধ্বনিতে আকাশবাতাস ভরিয়ে দিলো । সকলে আনন্দে কেউ কেউ সমুদ্র বালুকাতে গড়াগড়ি খেলো। কেউ হনুমানের চতুর্দিকে তালি দিয়ে নৃত্য করতে লাগলো। কেউ একে অপরকে অভিবাদন জানালো। দুন্দুভি, ন্যাকড়া বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলো । বানরদের এই আনন্দ দেখে অতি উচ্ছ্বাসিত হল মারুতি হনুমান । বানরেরা জানালো তারা এখানে বহুদিন ধরে অপেক্ষা করতে করতে ক্ষুধার্ত । এখন তাহাদিগের আহারের প্রয়োজন । অপরদিকে হনুমান চাইছিলেন সত্ত্বর গিয়ে প্রভু রামকে সকল সংবাদ দিতে। কিন্তু বানরকুলের আহারের প্রয়োজন । সত্যই এরা না খেয়ে আছে । সকলের আবদার মেনে নিলো হনুমান ।

কিস্কিন্ধ্যা পৌছাতে বানরগণ চাইলো বালির “মধুবন” ভঞ্জন করতে । এটি বালির প্রিয় বাগান ছিলো। এখানে তাল, চালতা, কদলী, পনস , আম্র, সবেদা, পেয়ারা নানাবিধ বারোমাসের মিষ্ট ফল ধরত । এই বনে বেশ কয়েকটি প্রকাণ্ড মৌচাক ছিলো, যাতে মিষ্ট মধু এত অতিমাত্রায় ছিলো যে মাঝে মাঝে নীচে বিন্দু বিন্দু পতিত হত । এছাড়া বনে নানান মিষ্ট কন্দ ছিলো। এখানে সুগ্রীবের মাতুল দধিমুখ বানর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে থাকতো । হনুমান, অঙ্গদের সাথে বানরেরা মিষ্টি ফলের গাছ দেখতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো। আগুনের ধোয়া সৃষ্টি করে মৌমাছি তাড়িয়ে মনের আনন্দে মিষ্ট মধু সেবন করতে লাগলো । বড় বড় ফলের গাছে বানরেরা উঠে মনের সুখ ফল খেতে লাগলো । কেউ কেউ ডাল ভাঙ্গলো, কেউ গোটা কদলী বৃক্ষ উপরে এনে খেতে লাগলো। এদিক ওদিক অর্ধেক ফল খেয়ে ঢিলাতে আরম্ভ করলো । তাল গাছে উঠে তাল পেড়ে সেবা করতে লাগলো । অঙ্গদ কয়েকশো কলার কাঁদি জড় করে ভক্ষণ করতে লাগলো । গাছের ডালে বানরেরা বসে ফল খাচ্ছিল্ল, আর তাদের পুচ্ছ গুলি কেবল সর্পের ন্যায় নীচে ঝুলছিলো । বানরেরা কেউ কেউ মিষ্টি কন্দ, মিষ্টি বীজ আহার করলো । মধু খেয়ে পেট ফুলিয়ে একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমাতে লাগলো । এক গাছের শাখা হতে ঝুপ ঝুপ করে আর এক গাছে বসে বানরেরা ফল খাছিল্ল । যত না খেলো তার অধিক ছড়ালো । লাঙুর, মর্কট , শিম্পাঞ্জী , ভল্লুক , বানর প্রভৃতিরা মনের সুখে ফলমূলাদি আহার করতে লাগলো । বৃদ্ধ বানর দধিমুখের অনুচরেরা এসব দেখে রে রে করে তেরে আসলো । বনের মাঝে দুদল বানরের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ বাঁধলো । একে অপরকে আঁচর , কামড়, পুচ্ছ দিয়ে প্রহার , মুষ্টাঘ্যাত করতে লাগলো । হনুমান তখন বলল- “তোমরা মনের সুখে ফল খাও। যে তোমাদের বাধা দেবে তাদের হত্যা করবো।” এই বলে হনুমান দধিমুখের অনুচরদের পিটিয়ে তাড়ালো ।

( ক্রমশঃ )

Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ৯ )


রাবণের গোটা লঙ্কা জ্বলছে । চতুর্দিকে যেদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল আগুনের লেলিহান শিখা ভিন্ন অপর কিছুই চোখে পড়ে না । কি সেই পর্বতপ্রমাণ শিখা । যেনো আজ সমগ্র লঙ্কা নগরীকে ভস্ম করে দেবে । চারপাশে রাক্ষসেরা কেবল এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। রাবণের রাজ্য আজ গ্রাস করেছে স্বয়ং বৈশ্বানর । যেনো দেবতাবৃন্দ রাবণের ধ্বংস হেতু যজ্ঞ করে তাতে রাক্ষসদের দেহ ও পবন দেবতার প্রবাহিত বায়ুকে আহুতি দিচ্ছে। হনুমান লম্ফ দিয়ে এদিক ওদিক আগুন দিয়েই বেড়াচ্ছে। আর হনুমানের পিতা হাওয়া প্রবাহিত করে এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে আগুন প্রবাহিত করে হনুমানকে সাহায্য করছে । কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হল না। তাঁর সমস্ত গৃহে আগুন ধরলেও কুম্ভকর্ণের নিঃশ্বাসে অগ্নি নির্বাপিত হল। তাঁর দুই পুত্র কুম্ভ ও নিকুম্ভ পলায়ন করলো। এমনকি রাবণের মাতা কেকসীর গৃহ ভস্ম করলে সেই আদি রাক্ষসী কোন মতে বাহিরে আসলো । রাবণের মন্ত্রী সেনাপতির গৃহ কোন বাগান বাকী রাখলো না। কেবল বিভীষণের গৃহতে অগ্নি সংযোগ করলো না হনুমান । আর অশোক বনে অগ্নি সংযোগ করলো না। হনুমানের জলন্ত লেজ থেকে ধোয়া সমেত অগ্নি থাকলেও হনুমানের বিন্দু মাত্র কষ্ট হচ্ছিল্ল না । কোথায় গেলো স্বর্ণ লঙ্কা! রাবণ স্ত্রী সমেত অশোক বনে আসলো । সে এক মুহূর্তের জন্য সীতার স্থানে তাঁর ইষ্টদেবী ভদ্রকালীর তেজময়ী স্বরূপ প্রত্যক্ষ করলো । তিনি সহস্র জিহ্বা দ্বারা লঙ্কার ভোগ নিচ্ছেন । যেনো সমগ্র লঙ্কাকে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়েছে । দেবী সীতা অট্টহাস্য করলেন । সেই অট্টহাস্য যেনো গগনে গগনে গর্জে উঠলো । সীতাদেবী সেই অগ্নির প্রকাশিতা তেজ শক্তি সম বাক্যে বললেন- “দুর্মতি রাবণ! তুই আমার স্বামী রঘুবীরের সাথে যুদ্ধের বাসনা রাখিস? দেখ তেঁনার সামান্য সেবক এসে তোর লঙ্কা কেমন ভস্ম করে দিলো। আর যদি তিঁনি আসেন ভাব তোর কি দশা হবে ? ওরে রাবণ এবার তোর চিতার আগুন জ্বলবে । তাই বলছি আমার স্বামীর কাছে আমাকে ফিরিয়ে ওঁনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।”

রাবণ ক্রোধে বলল- “মূর্খা নারী ! তোর স্বামী সামান্য এক বানর দিয়ে আমাকে ভয় দেখিয়েছে! দশানন রাবণ এইসবে ভীত নয় । তোর জন্য একশো লঙ্কাকে আমি বলি দিতে পারি। কিন্তু কদাপি তোকে ঐ ভিক্ষুক রামের হাতে ফিরিয়ে দেবো না। সেই ভিখারী যদি ভাবে সামান্য বানর নিয়ে এসে লঙ্কা জয় করবে, তবে সে মস্ত বড় ভ্রম করছে।” মন্দোদরী বলল- “প্রভু! এই সতী নারী সীতা সত্যই বলছে । আপনি এর কথা মেনে নিন। দেখুন আপনার দর্পের পরিণাম । আপনার সন্তান আজ নিহত। লঙ্কার চার বীর যোদ্ধা প্রান হারিয়েছে। না জানি কত রাক্ষসেরা হতাহত হয়েছে। সেই শ্রীরামচন্দ্রের একজন দূত এসে যদি এই অবস্থা করতে পারে তবে গোটা সেনা সমেত রামচন্দ্র আসলে না জানি কি হবে? আমি চারিদিকে কেবল অমঙ্গল দেখতে পাচ্ছি। আপনি সীতার কথা মেনে নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়াসুন।” রাবণ প্রবল কণ্ঠে বলে উঠলো- “কদাপি নয়। এতদিন সীতাকে আমি বিবাহের ইচ্ছায় এখানে রেখেছি। এখন সীতা লঙ্কার গৌরব। সেই গৌরবকে আমি ঐ ভিখারী রামের হাতে কিছুতেই দেবো না। সেই রাম যুদ্ধের অভিলাষ করেছে। আমি এর যোগ্য জবাব দেবো। লঙ্কা দহনের শাস্তি সে পাবে। জীবিত থাকতে যতক্ষণ শ্বাস থাকবে ততক্ষণ আমি সীতাকে ফিরিয়ে দেবো না। এই গর্বিতা সীতার সকল গর্ব চূর্ণ করবো।” এভাবে রাবণ সীতার সকল কথা উড়িয়ে দিলো। লঙ্কার লেলিহান অগ্নি দেখে রাবণের পরিবর্তন হল না । লঙ্কার থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে যে ধোয়া উঠছিলো তা সাগর পাড়ে বসে অঙ্গদ, জাম্বুবান, নল , নীল , গবাক্ষ আদি বানরেরা বসে দেখছিলো। তারা তখনও জানতো না যে হনুমান লঙ্কায় আগুন দিয়েছে । তারা ঐ ধোঁয়া সম্বন্ধে বিস্মৃত ছিলো । অপরদিকে রাবণের একে একে বলশালী অশ্ব, হস্তী পুড়ে ভস্ম হল। বাকী অশ্ব, হস্তী পলায়ন করলো । স্বর্ণ রথ গুলি আগুনে গলে তপ্ত সোনার নদীর ন্যায় লঙ্কার রাজপথ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল্ল। লঙ্কার বিজয় স্তম্ভ হুড়মুড় করে বিকট শব্দে ভেঙ্গে রাক্ষসদের মাথায় পড়লো । হনুমান এরপর নিজের জলন্ত পুচ্ছের অগ্নি নেভানোর জন্য নিজের মুখে নিজের লেজ চেপে ধরতেই লেজের আগুনে মুখ পুড়লো, কিন্তু আগুন নিভল না ।

হনুমান সেই অবস্থায় মাতা সীতার কাছে গিয়ে সব কিছু বলে বলল- “মা! এই আগুনে আমার মুখ পুড়েছে। আমি এখন স্বজাতির কাছে কিভাবে মুখ দেখাবো ?” মাতা সীতা বললেন- “পুত্র! তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তুমি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সেবক । তিঁনি থাকতে ভয় কি। আমি বর প্রদান করছি আজ হতে সকল হনুমানের মুখ পোড়া হবে। যাতে তারা কেউ তোমাকে দেখে ব্যাঙ্গ না করে। তুমি সমুদ্রের জলে লাঙুলের অগ্নি নির্বাপিত করো।” হনুমান এবার ফিরতে অনুমতি চাইলো। মাতা সীতা অনুমতি দিয়ে বলল- “পুত্র! মনে রেখো আমাকে রাবণ দুমাস সময় দিয়েছে। ওঁনাকে বল এই দুমাসের মধ্যেই যেনো তিঁনি রাবণকে বধ করে আমাকে উদ্ধার করেন।” “তাই হবে” বলে হনুমান লম্ফ দিয়ে আকাশে উঠলো । এবার রাবণ কে বলল- “রাবণ । অন্তিম বার বলছি। দেখলি তো ভগবান শ্রীরামের সাথে শত্রুতার ফল কি? আজ ঘর পুড়িয়েছি। কাল শ্মশানে তোর চিতায় আগুন দেবো। তাই যাতে বাঁচতে চাস- সেই উপায় বলি। ভগবান শ্রীরামের কাছে ক্ষমা চেয়ে মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে রাজ্যসুখ ভোগ কর । অন্যত্থায় কি পরিণাম হবে তা দেখতেই তো পাচ্ছিস।” রাবণ বলল- “সীতাকে আমি ফিরাবো না। সে যে পরিস্থিতি হোক। তোর ঐ ভিক্ষুক প্রভু রাম যুদ্ধ চায়- তো যুদ্ধ হবে। যুদ্ধে তোদের বধ করে ঐ রাম আর লক্ষণের বধ করে বিজয় উৎসব করবো। তুই গিয়ে বল সীতাকে রাবণ ফিরিয়ে দেবে না। যুদ্ধ চাইলে সে যেনো এসে আমার সাথে যুদ্ধ করে।” হনুমান বলল- “দশানন! তোর বুদ্ধি নাশ হয়েছে। তোর মৃত্যু ধেয়ে আসছে। ঠিক আছে যুদ্ধক্ষেত্রেই তোর সাথে দেখে হবে।” এই বলে হনুমান উড়ে চলল । প্রথমে সমুদ্রের গভীর জলে লাঙুল ডুবিয়ে অগ্নি নির্বাপিত করলো। তখন একটি মৎস্য হনুমানের লেজের পুচ্ছের জল ভক্ষণ করেছিলো । এরপর হনুমান ফিরে চলল প্রভু শ্রীরামের কাছে ।

( ক্রমশঃ )

Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ৮ )



লঙ্কেশ রাবণ অবাক হল হনুমানের কথা শুনে । দশ চোখ কটমট করে বলল – “ মূর্খ কপি! তোর এত সাহস যে লঙ্কারাজ রাবণকে উপদেশ প্রদান করিস ? এখুনি তোকে সমুচিত দণ্ড প্রদান করবো । তোকে শিরোচ্ছেদ করা হবে। তুই আমার আদেশ ভিন্ন লঙ্কায় প্রবেশ করে আমার বাগান লণ্ডভণ্ড করেছিস । আমার আশ্রিত রাক্ষসদের বধ করেছিস । আমার প্রিয় পুত্র অক্ষয়কুমারকে বধ করেছিস।” এই বলে হনুমান এর দিকে লঙ্কেশ দশানন দশমুখ মেলে চেয়ে সেনাদের আদেশ দিলো শীঘ্র একে হত্যা করো । সেখানে বিভীষণ ছিল। সে এসে বলল- “অগ্রজ! এ আপনি কি করছেন ? হনুমান শ্রীরামের দূত । সে দূত রূপে এসে আত্মরক্ষার নিমিত্ত যুদ্ধে জড়িয়েছে। দূতকে হত্যা করা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ।” লঙ্কারাজ রাবণ তখন ক্রোধে বিভীষণকে নানা আকথা কুকথা বলে বলল- “তুমি ভ্রাতা হয়েও লঙ্কার শত্রুদের পক্ষ নিচ্ছো? এই কপি এসে লঙ্কায় কি উপদ্রব করেছে তাকি তুমি অবগত নও ?” বিভীষণ বলল- “দাদা! এই কপির শাস্তি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু দূত রূপে এই কপি লঙ্কায় আগমন করেছে। এমনিতেই আপনি নারী হরণ করে অখ্যাতি ও অপযশ কুড়িয়েছেন। এর উপর দূত হত্যা করলে ত্রিলোকে আরোও কলঙ্ক হবে।” রাবণ ভাবল তাই তো ! দূত রূপে আগত এই কপিকে হত্যা করা উচিৎ না। কিন্তু এই কপিকে মৃত্যুদণ্ডের থেকেও ভয়ানক কিছু শাস্তি দিতে হবে। হঠাত রাবণ ভাবল এর লাঙুল টাই পুড়িয়ে দেই। লাঙুল পুড়লে আর গজাবে না। সারা জীবন এ তখন স্বজাতির কাছে লজ্জিত হয়ে তিলে তিলে যন্ত্রনা ভোগ ক্রবে। রাবণ বলল- “তাই হোক! এই কপিকে প্রাণে মারবো না। বরং এর লাঙুল পুড়িয়ে দাও। এই দুষ্ট কপি আমার সামনে লাঙুল নির্মিত আসনে বসে দর্প প্রকাশ করেছে। এর লাঙুল আগুনে পোড়াও।” সাথে সাথে রাক্ষসেরা হৈহৈ করে হনুমানকে নিয়ে গেলো। লাঙুলে কাঁপড়, ঘৃত, তৈল মাখাতে লাগলো ।

হনুমানের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি! লাঙুল বড় করতে লাগলো । এত বড় করলো যে রাক্ষসেরা যতই কাপড় পেঁচায়, তত কম পড়ে । হাজারে হাজারে রাক্ষস এসে হনুমানের লাঙুলে কাপর পেঁচাতে থাকলো । হনুমানের হাত পা বন্দী, তবুও সে লাঙুল দিয়ে নানা দুষ্টুমি করতে থাকলো। রাক্ষসদের কখনো বেঁধে আছার দিলো, কখনো বা তেলের ভাণ্ড উলটে দিলো। কখনো কাউকে লেজের আঘাতে ফেলে দিলো। হনুমান চুপ করে এই সকল কর্ম করতে থাকলো । লঙ্কার রাক্ষস রাক্ষসীরা হনুমানকে নিয়ে নানা ব্যাঙ্গ করতে থাকলো । এরপর যতটুকু লেজে কাঁপর পেঁচিয়ে ঘৃত, তৈল মর্দন করা হয়েছিলো ততটুকুতেই আগুন দেওয়া হল। সীতাদেবী এই শুনে অগ্নিদেবের কাছে প্রার্থনা করলেন – “হে অগ্নি! যদি আমি মনে প্রাণে সতী হয়ে থাকি, তবে ঐ আগুনে যেনো হনুমানের কোনরূপ ক্ষতি না হয়।” আগুন লাগিয়ে রাক্ষস রাক্ষসীরা অতি বিকট হয়ে হাস্য করতে থাকলো । হনুমান প্রবল জোরে রামনাম নিয়ে এক ঝটকায় বন্দী দশা খুলে ব্রহ্মাস্ত্রের সকল ক্ষমতা বিনষ্ট করলো । তারপর এক লম্ফ দিয়ে রাবণ রাজার প্রাসাদে গেলো। সেখানে নানা আসবাবপত্র , পর্দা , শয্যাতে লেজের আগুন থেকে আগুন ধরিয়ে দিলো। দাউদাউ করে রাবণ রাজার প্রাসাদে আগুন ধরল । এরপর হনুমান রাবণ রাজার নানা কক্ষ তে এক ভাবে গিয়ে চতুর্দিকে আগুন ছড়িয়ে দিলো। অগ্নিদেবতা আর পবন দেবতা উভয়ে মিলে হনুমানকে সাহায্য করলো। যত রাক্ষস প্রহরায় ছিলো বিকট অগ্নিশিখার বলি হল । বাকী রাক্ষসেরা, রাবণের শত রানী, দাস দাসী, সেপাই যে যেদিকে পারলো দৌড়ে পলায়ন করলো । হনুমান রাবণের প্রাসাদে প্রতি কক্ষে আগুন দিলো। মেঘনাদ , মেঘনাদের স্ত্রী সকল পলায়ন করলো। এক কক্ষে হনুমান দেখলো সেখানে নবগ্রহ বন্দী হয়ে আছে। তারা হনুমানের কাছে মুক্তির আবেদন করলো। হনুমান তাহাদিগের মুক্তি দিলেন । নবগ্রহ বর দিলো , বলল- “হনুমান! আমরা কদাপি তোমার ভক্তের অনিষ্ট করবো না। তোমার ভক্তেরা, তোমার পূজারীরা সর্বদা গ্রহপীড়া থেকে মুক্ত থাকবেন। আমরা সদয় হয়ে তাহাদিগের মঙ্গল করবো।” হনুমান নবগ্রহের মুক্তি দিয়ে লঙ্কার অনান্য বাটিটে বহ্নি ছড়িয়েদিলেন । রাবণের অস্ত্রাগার, অশ্ব শালা, হস্তীশালায় অগ্নি দিয়ে অস্ত্র, অশ্ব , হস্তী গুলোকে ভস্ম করলেন। এরপর অগণিত জমায়েত স্বর্ণ রথ কে আগুন ধরিয়ে দিলেন । বিবিধ বাগিচায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দিলেন। লঙ্কার বিজয় স্তম্ভে এমন আঘাত করলেন যে চিড় ধরল ।

এইভাবে হনুমান লঙ্কার প্রতি ঘরে আগুন ছড়িয়ে দিতে লাগলো। রাক্ষসেরা হনুমানকে ধরতে পারলো না। লম্ফ দিয়ে হনুমান পালিয়ে গেলো । সকলে ঘড়া ঘড়া জল দিতে থাকলো। কিন্তু কতটুকু আর নেভে? এক দিকে আগুন নিভলে নয়দিকে জ্বলে উঠে । কে কার প্রাণ বাঁচাবে- তাই চিন্তা। কত রাক্ষস, রাক্ষসী পরিবার সমেত জীবন্ত দগ্ধ হল।

এক ঘরে অগ্নি দিতে আর ঘর জ্বলে ।
কে করে নির্মাণ তার কেবা কারে বলে ।।
অগ্নিতে পুড়িয়া পড়ে বড় ঘরের চাল ।
অর্ধেক স্ত্রী পুরুষের গায়ের গেল ছাল ।।
উলঙ্গ উন্মত্ত কেহ পলায় উভরড়ে ।
লেজে জড়াইয়া ফেলে অগ্নির উপরে।।
ছোট বড় পুড়িয়া মরিল এককালে ।
রাক্ষস মরিল কত স্ত্রী লইয়া কোলে ।।
কেহ বা পুড়িয়া মরে ভার্যা পুত্র ছাড়ি ।
কাহারো মাকুন্দ মুখ দগ্ধ গোঁপদাড়ি ।।
লঙ্কা মধ্যে সরোবর ছিল সারি সারি ।
তাহাতে নামিল যত রাক্ষসের নারী ।।
সুন্দর নারীর মুখ নীরে শোভা করে ।
ফুটিল কমল যেনো সেই সরোবরে ।।
দূরে থাকি দেখে হনুমান মহাবল ।
লেজের অগ্নিতে তার পোড়ায় কুন্তল ।।
সর্বাঙ্গ জলের মধ্যে জাগে মাত্র মুখ ।
অগ্নিতে পোড়ায় মুখ দেখিতে কৌতুক ।।
ত্রাসে ডুব দিল যদি জলের ভিতরে ।
জল পিয়া ফাঁপর হইয়া সবে মরে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইভাবে সমস্ত লঙ্কা নগরীতে আগুন দিলো হনুমান । বড় বড় বৃক্ষ গুলি প্রকাণ্ড অগ্নি শিখা ধারন করে জ্বলতে থাকলো। স্বর্ণ লঙ্কাকে দেখে অগ্নিলঙ্কা মনে হচ্ছিল্ল। চারিদিকে কেবল রাক্ষসদের হাহাকার । যে যেদিকে পারছে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কে কার ঘরের আগ্নুন নির্বাপণ করবে? লঙ্কারাজ রাবণ বাগিচার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখলেন তার সুন্দর রাজসভা, শয়ন কক্ষ, অস্ত্রাগাড়, রম্য বারান্দা সকল কিছুই অগ্নি বিশাল জিহ্বা দিয়ে গ্রহণ করছেন । চারপাশে কেবল ভস্ম উড়ছে । আর কুণ্ডলী পাকিয়ে বিশাল সর্পের ন্যায় সেই ধোঁয়া আকাশে উঠছে । রাক্ষসেরা পলায়মান অবস্থায় কেউ কেউ পদদলিত হয়ে মরছিল । কেউ আবার ঝিলে ভীরে পদদলিত হয়ে দম আটকে মরল । হনুমান সমানে সেই লেজের অগ্নি দিয়ে একের পর এক ঘরে আগুন দিচ্ছিল্ল। আকাশ থেকে এই দ্বীপকে দেখলে মনে হয় অগ্নির দ্বীপ ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব –৭)


অক্ষয় কুমার মারা গেছে। লঙ্কার প্রাসাদে এই খবর পৌছাতেই কান্নার রোল উঠলো। রাবণ তাঁর পুত্রের নিথর দেহ দেখে শোকে আছন্ন হল। পড়ে ক্রোধে বলে উঠলো- “যেভাবেই হোক ঐ বানরকে বন্দী করে আমার কাছে নিয়ে আসো। ওকে আমি মৃত্যুদণ্ড দেবো।” অক্ষয় কুমারের মৃত্যু দিয়ে লঙ্কার পতন আরম্ভ হয়েছিলো । মেঘনাদ অস্ত্রাদি নিলেন । দিব্যাস্ত্র সকল তূনে রাখলেন। এরপর বিশাল রাক্ষস সেনা নিয়ে স্বর্ণ রথে উঠে বসলেন । তারপর চললেন অশোক বাটিকার দিকে । দূর থেকে রাক্ষসদের হৈহৈ করে আসতে দেখে হনুমান বিন্দুমাত্র চিন্তিত না হয়ে মনের সুখে ফল খেতে লাগলেন। ঝিলের জল পান করলেন । মেঘনাদ অশোক বাগিচায় ঢুকে দেখলেন ছিন্নভিন্ন অবস্থা। ফুল- ফল ছড়িয়ে ছিটিয়ে নরককুণ্ড করে রেখেছে সেই বানর । সুন্দর সুন্দর পুস্পশোভিত বৃক্ষ গুলো উপরে ফেলেছে। সারা বাগানের সমস্ত সৌন্দর্যকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। রাক্ষস দের মৃতদেহের স্তূপ জমেছে। বলশালী সব রাক্ষস বীরদের অনায়েসে বধ করেছে সেই বানর । কিছু কিছু রাক্ষসের মুণ্ড এমনি ভাবে পিষে গেছে যে চেনাই যাচ্ছে না । মেঘনাদ ক্রোধে গর্জন করে বললেন- “ওরে দুর্মতি ! তোর এই সকল কর্মের ফল ভোগ করবি।” এই বলে মেঘনাদ নানা ঘাতক অস্ত্র প্রয়োগ করলো। নানা ধরণের ঘাতক অস্ত্র বিশাল শব্দ ও বিশাল আলো উৎপন্ন করে মেঘনাদের ধনুক থেকে ছুটে গেলো। কিন্তু দেবতাদের আশীর্বাদে সে সকল বাণ হনুমানের শরীরে পুষ্পসম ঠেকল। অস্ত্রগুলি চূর্ণ হয়ে মাটিতে পড়লো । মেঘনাদ অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলো। ভয়ানক অগ্নিশিখা উৎপন্ন হয়ে হনুমানের কাছে যেতেই নিভে গেলো। মেঘনাদ পবন বাণ নিক্ষেপ করলো। অশোক বাগিচায় যেনো ঝড় উঠলো। কিন্তু পবনপুত্র হনুমানের কাছে যেতেই সেই বাণ মিলিয়ে গেলো। সূচীমুখ, শিলামুখ, গন্ধর্ববান , যক্ষবান , ইন্দ্রাগ্নি, ময়ূরাক্ষী , পর্বত বাণ নিক্ষেপ করলো। কিন্তু কোন অস্ত্রেই কিছু হল না । এরপর মেঘনাদ ভাবলেন কি করা যায়। এই কপি নিশ্চয়ই বড় মায়াবী কেউ হবে। নচেৎ ছদ্দবেশী কোন দেবতা। কোন অস্ত্রেই এর কিছু হচ্ছে না। হনুমান তখন মেঘনাদের সাথে আগত রাক্ষস সেনাদের সংহার করা আরম্ভ করলো। বড় বড় বৃক্ষ উৎপাটন করে রাক্ষসদের পালে নিক্ষেপ করলো। বড় বড় প্রস্তর, ডাব, তাল ইত্যাদি রাক্ষসদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো । রাক্ষসেরা সব অন্ত হতে লাগলো। তখন হনুমান একটি বৃহৎ তাল বৃক্ষ তুলে মেঘনাদের স্বর্ণ রথে নিক্ষেপ করলো। প্রকাণ্ড তালবৃক্ষ কে ছুটে আসতে দেখে মেঘনাদ রথ থেকে লম্ফ দিয়ে নামলো। সেই তালবৃক্ষের তলে মেঘনাদের স্বর্ণ রথ পিষে গেলো।

এখন মেঘনাদ নিরুপায় হয়ে বলল- “ওহে কপি! তুমি বৃহৎ কোন মায়াবী বা ছদ্দবেশী দেবতা যেই হও না কেন- আমি তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্রে বন্ধন করবো। ব্রহ্মাস্ত্র থেকে মুক্তি কেউ পায় না। দেখি তোমার কত মায়া।” এই বলে মেঘনাদ ধনুকে ব্রহ্মাস্ত্র আনয়ন করলো। মন্ত্র পড়ে হনুমানের দিকে নিক্ষেপ করলো। ব্রহ্মাস্ত্রের মুখ দিয়ে প্রলয় সমান অগ্নি নিক্ষেপ হল। চারপাশে প্রলয় ঝড়, বজ্রপাত হতে লাগলো। সমুদ্রের জলে বিশাল ঢেউ উৎপন্ন হল। ব্রহ্মাস্ত্রের তেজে চতুর্দিকে চোখ ধাঁধানো আলো সৃষ্টি হল। হনুমান দেখলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে ব্রহ্মাস্ত্রে তাঁর কোন ক্ষতিই হবে না। কিন্তু তিনি ব্রহ্মাস্ত্রে বদ্ধ না হলে ব্রহ্মার অপমান হবে। প্রজাপতি ব্রহ্মার সম্মান রাখার জন্য তিনি ব্রহ্মাস্ত্র কে স্বীকার করে নিলেন ও রজ্জুবদ্ধ হলেন । মেঘনাদ বিজয়ীর ন্যায় অট্টহাস্য করে বললেন- “চলো! আবার আমার পিতা দশানন তোমাকে উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করবেন।” হনুমান বদ্ধ হয়েছে এই শুনে রাক্ষস রাক্ষসীরা আনন্দে নৃত্যগীত করতে করতে হনুমানকে দেখতে আসলো । ভয়ার্ত হয়ে সীতাদেবী অবিরত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন যেনো হনুমান মুক্ত হয়ে যায়। লঙ্কার রাক্ষসেরা হনুমানকে দেখে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলেন ।মেঘনাদের নামে জয়জয়কার পড়ে গেলো। রাবণ এলেন লঙ্কার রাজসভাতে তে। সেখানে হনুমানকে বন্দী করে আনা হয়েছে । রাবণের সুন্দর রাজসভা এত অনুপম সুন্দর যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সোনা মাণিক্যের দিব্য ঝলকে আলো হয়ে আছে চতুর্দিক । রাক্ষসেরা সমানে হট্টগোল করে হনুমানের জন্য মৃত্যুদণ্ড চাইছিলো। রাবনের সামনে বন্দী হনুমান দণ্ডায়মান । হনুমান বলল- “লঙ্কারাজ! আমি একজন দূত! আপনার রাজ্যে কি দূতকে এই ভাবে দাঁড় করিয়ে বন্দী করে অভ্যর্থনা জানানো হয়? আপনি যদি আমাকে আসন প্রদান না করেন, তবে আমি নিজের জন্যই নিজে একটি আসন রচনা করছি।” এই বলে হনুমান তাঁর লাঙুল বৃহৎ করে পেঁচিয়ে কুণ্ডলী বদ্ধ করে তাঁর ওপর বসলেন । একেবারে রাবণের মুখোমুখি। হনুমানের বিক্রম দেখে রাক্ষসেরা সব হা করে থাকলো । দশানন ভাবল এই কপি কে? একি ছদ্দবেশী দেবতা? নাকি শিবের কোন সেবক। বহু আগে নন্দী শাপ দিয়েছিলো যে নর বানরের হাতে লঙ্কার ধ্বংস হবে- এই কি সে? রাবণ বলল- “তুই কে? কোথার থেকে কেন লঙ্কায় এসেছিস? তোর এত সাহস হল কিভাবে যে আমার বাগান তছনছ করিস, আমার পুত্র ও আমার সেনাদের হত্যা করেছিস?” হনুমান বলল- “ওরে দুর্মতি! যাঁর ইচ্ছাতে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় হয়, যিঁনি এই ব্রহ্মাণ্ড রচনা করেছেন, যাঁর ইচ্ছায় শেষনাগ মস্তকে এই বসুমতীকে ধারন করেন – আমি তাঁরই দাস । যিঁনি দেবতাদের রক্ষা করবার জন্য অবতার গ্রহণ করেন, তোমার মতোন মূর্খকে শাস্তি দিয়ে থাকেন আর কঠোর হরধনুক ভঙ্গ করে থাকেন, খড়- দূষণ- ত্রিশিরা-মারীচ যিনি বধ করেছেন- আমি তাঁরই দাস।” এই শুনে লঙ্কারাজ রাবণ সহ সকলে হাসতে থাকলেন। কিন্তু পড়ে পুত্রের মৃত্যুর কথা মনে হওয়াতে রাবণ হাস্য থামিয়ে ক্রোধী হয়ে বললেন- “ও তাহলে সেই ভিক্ষুক রাম তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? শুনি সেই বনবাসী ভিখারী আমাকে কি বলেছে?” হনুমান বলল- “মূর্খ ! তিনি রাজারও রাজা। তুমি বালির হস্তে পরাজিত হয়েছিলে, সেই বালি নিহত হয়েছেন তাঁরই হাতে। হে লঙ্কেশ আমি বন্দী অবস্থায় আমার প্রভুর সেবা করে যেতে চাই। আমি সীতামাতার কাছে প্রভুর সংবাদ দিয়েছি। আমি ক্ষুধার্ত হয়ে ফল খাচ্ছিল্লাম। সেই অবস্থায় তোমার পুত্র ও তোমার সেনাদের বধ করি। দেখো আমি ভগবান শ্রীরামের তুচ্ছ সেবক হয়েই তোমার এমন সর্বনাশ করে দিলাম। এবার ভাবো তিঁনি যদি অস্ত্র ধরেন, তাহলে তোমার কি দশা হবে?”

হনুমান আরোও বলল- “হে লঙ্কেশ! আমি করজোড়ে বিনীত ভাবে বলছি, প্রভু শ্রীরামের সাথে শত্রুতা করো না। মাতা সীতাকে ওঁনার কাছে পৌছে দিয়ে ওঁনার কাছে ক্ষমা চাও। তুমি মহান পুলস্ত্য ঋষির বংশজ । এভাবে এই পবিত্র কুলে কালিমা লেপন করো না । মন থেকে সকল পাপ, অহঙ্কারকে বিসর্জন দিয়ে ভবভয়হারী শ্রীরামকে মনে অধিষ্ঠিত করো। এই জগতে ‘রাম’ নামই সত্য। বাকী সব অসার। তুমি সেই জগতের সার ‘রাম’ নাম অবিরত জপ করে প্রভু শ্রীরামের শরণ লও । আমি শপথ করে বলছি, রামবিমুখদের এই জগতে কেহ রক্ষা করতে পারে না। ব্রহ্মা ও শিব এসেও তোমাকে বাঁচাতে পারবেন না। অতএব মাতা সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” শুনে সকলে অট্টহাস্য করলো। বলশালী রাক্ষসেরা ভাবল তারা এত শক্তিমান হয়ে ঐ তুচ্ছ নরের নাম জপ করবে। আরে নর তো আহার্য। তাকে আবার পূজা? রাবণ দশমুখ দিয়ে অট্টহাস্য করে বলল- “এবার দেখছি আমার এক পরম জ্ঞানী বানর গুরু জুটেছে, যে আমাকে ধর্ম কথা শেখাচ্ছে। ওরে দুষ্ট ! তুই আমাকে কি জ্ঞান দিচ্ছিস? তোর শিয়রে যে কাল উপস্থিত। কিছুক্ষণ পর তুই পৃথিবী থেকে সোজা যমের দক্ষিণ দুয়ারে যাবি।” হনুমান অনেক বুঝিয়ে রাবণকে রাজী করাতে পারলো না। হনুমান বলল- “ঠিক উল্টোটাই হবে দশানন। রামভক্তদের তুই কালের ভয় দেখাচ্ছিস? যাঁর মুখে রাম নাম জপ হয় তাঁকে যম স্পর্শ অবধি করতে পারে না। আমি নয়, বরং তুই যমের দক্ষিণ দুয়ারে যাবি। আর সেই দিনটি ক্রমশঃ সন্নিকটে আসছে। মৃত্যুর পূর্বে ব্যাক্তির বাড়বাড়ন্ত প্রবল হয় বলে শুনেছিলাম। আজ চাক্ষুষ উদাহরণ দেখলাম । বিনাশের আগে মানুষের বিপরীত বুদ্ধি হয়।” হনুমানের কথা শুনে রাবণ ক্রোধে দাঁত কটমট করতে লাগলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।