১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড পর্ব –৭)


চতুর্দিকে কেবল লেঙুর, কাঠবিড়ালী, বানর আর মর্কটেরা, ভল্লুকেরা, শিম্পাঞ্জী চারপাশে । “হুপ, হুপ” শব্দ ভিন্ন অপর কিছু শোনা যায় না। বিশাল বিশাল সব হনুমানেরা সুগ্রীবের সাথে পরামর্শ করছিলো । সুগ্রীব তাদের সব বোঝালেন । কে কোথায় যাবে। সুগ্রীব মহারাজ চার দলে ভাগ করলেন । যারা পূর্বদিকে যাবে, তাদের বললেন- “তোমরা ভাগীরথি, সরয়ূ , কোশিকী , গোমতী, সরস্বতী নদীর ধারে জঙ্গল পর্বত, বন, গ্রাম, নগর সব জায়গাতে দেখবে, মলয় প্রদেশ, কশ্যপ প্রদেশ, মগধ, ব্রহ্মপুত্র, মন্দর পর্বত , কিরাতদেশ, কর্ণাট , শাক দ্বীপ, ক্ষীরোদ সাগর, শ্বেত গিরি, কালোদর পর্বত, লোহিত সাগর, পূর্ব সাগর, উদয়গিরি সর্বত্র দেখবে।” সুগ্রীবের কথা শুনে কয়েকশো বানর সেই দিকে চলে গেলো। যারা পশ্চিমদিকে যাবে তাদের সুগ্রীব বললেন- “তোমরা সকল স্থান অনুসন্ধান করবে। গুহামুখ, বাটি, সকল উপবন, সকল রাজার রাজমহল এমনকি গাছের কোটর অবধি বাদ দেবে না। বর্বর দেশ, হিমালয়, গঙ্গোত্রী, মানস সরোবর, ত্রিশৃঙ্গ, মন্দর পর্বত, কৌশিকী নদী , মহেশ সাগর, মহীধর ক্রৌঞ্চ পর্বত, দ্রোণ গিরি, অনন্ত সাগর, হেমগিরি সকল স্থান দেখবে। দেখো কোন স্থান যেনো বাদ না যায়। যদি পথে রাক্ষস দেখো, তাহলে তাকে সীতাদেবীর খোঁজ জিজ্ঞাসা করবে। যদি সে না বলে তবে তাকে যমালয়ে প্রেরন করবে।” উত্তরদিকে অনেক বানর “জয় শ্রীরাম” বলে ধাবিত হল। যারা পশ্চিমদিকে যাবে তাদের সুগ্রীব মহারাজ আদেশ দিলো – “তোমরা সিন্ধুদেশ, কাবেরী নদী, ক্রিমীজীব দেশ, হিঙ্গুলিয়া গিরি, চন্দ্রবাণ পর্বত, বরাহ পর্বত, সুমেরু পর্বত অনুসন্ধান করবে। দেখো সাধুদিগকে যেনো উৎপাত করো না। এতে শ্রীরাম রুষ্ট হবেন।” হৈহৈ করতে করতে পশ্চিমদিকে বানরেরা গেলো। যারা দক্ষিণ দিকে যাবে তাদের সুগ্রীব বললেন- “কৃষ্ণাবেণী , নর্মদা, গোদাবরী, অশ্বমুখ , কাবেরী, বিন্ধ্য, কলিঙ্গ, মহেন্দ্র পর্বত, মৈনাক পর্বত, ঋষভ পর্বত, যমের দক্ষিণ দিক এমনকি দক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্র তীরে যাবে। যেভাবেই হোক দেবী সীতার সংবাদ আনবে। আমরা যেনো বিস্মৃত না হই যে আমরা প্রভু শ্রীরামের দয়াতে বালির থেকে মুক্ত হয়েছি।” দক্ষিণ দিকে যারা যাবে তাদের সাথে সুগ্রীব, হনুমান, নল, নীল, জাম্বুবান ও আরোও বানর ছিলো।

তখন ভগবান রাম নিজের অঙ্গুলি থেকে অঙ্গুষ্ঠ খুলে হনুমানকে দিয়ে বললেন- “হনুমান আমার পূর্ণ বিশ্বাস তুমি আমার সীতার খোঁজ এনে দিতে পারবে। সীতার সাথে সাক্ষাৎ হলে তাঁহাকে আমার অঙ্গুরীয় দেবে। আমার অবস্থা সকল বলবে। তাঁর অবস্থা জ্ঞাত হয়ে আমাকে এসে জানাবে। আর রাবণ কে বোঝাবে যেনো সে সীতাকে ফিরিয়ে দেয়। অন্যত্থায় আমি লঙ্কা আক্রমণ করে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করবো।” এরপর শ্রীরাম বললেন- “মিত্র সুগ্রীব রাজ্য শূন্য করে তোমার যাওয়া উচিৎ নয়। যেহেতু তুমি এখন রাজা। তোমার প্রতিনিধি হয়ে অঙ্গদ যাক। সে বড় বীর। পিতার নাম উজ্জ্বল করবে।” অঙ্গদ চলে গেলো সুগ্রীবের সাথে । চারিদিকে বানর, ভল্লুক, কাঠবিড়ালী, মর্কট, লাঙুর, শিম্পাজী তন্ন তন্ন করে মাতা সীতার খোঁজ করতে লাগলো। পাহার, নদী, গুহা, সুরঙ্গ, ঝর্না, গ্রাম, মন্দির, নদ , নদী, ঝিল, হ্রদ, নগর, সকল বাটি, কোটর, জঙ্গল, কানন , প্রদেশ , আশ্রম, খাল, বিল কিছুই বাকী রাখলো না। যেখানে যেখানে সুগ্রীব যেতে বলেছিল সকল স্থান খুঁজেও পেলো না । তিনদিকে বানরের দল খুঁজলো। পথে যে কটা রাক্ষসকে দেখতে পেলো- শাল গাছ, গদা, পাথর দিয়ে পিষে তাদের যমালয়ে প্রেরন করলো। যে সকল রাক্ষস বেঁচে পালিয়ে দুষ্কর্ম করছিলো- তারা কেউ আর আর জীবিত থাকলো না । কিন্তু তবুও আসল কাজ সম্পূর্ণ হল না । সীতামাতার কোথাও সন্ধান পাওয়া গেলো না । তিনদিক থেকে বানরের দল শূন্য হস্তে ফিরে আসলো। ভগবান রাম অতি বিলাপ করে বলতে লাগলেন- “নাজানি সেই পাপী রাবণ কোথায় আমার জানকীকে লুকিয়ে রেখেছে! তবে কি সীতা উদ্ধার আর হবে না?” লক্ষ্মণ ও সুগ্রীব সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “হনুমান সব কাজেই সফল হয়। আপনি প্রতীক্ষা করুন। হনুমান ঠিকই সংবাদ আনবে।” অপরদিকে হনুমান, অঙ্গদ, সুগ্রীব, জাম্বুবান, নল, নীল সকলে তন্নতন্ন করে নানাদিকে খুঁজতে লাগলো। সুগ্রীবের কথা মতো সেই সকল স্থান খুঁজলো। কোথাও পেলো না। তারা আক্ষেপ করে বলতে লাগলো- সীতামাতার সন্ধান না পেলে এইখানেই মরবে। এই মুখ আর দেখাবে না।

একস্থানে তারা একটি গুহা দেখতে পেয়ে প্রবেশ করলেন । দেখলেন সেখানে এক সুন্দরী কন্যা ভগবান রামের নাম জপ করছে। অপূর্ব সুন্দরী সেই কন্যা যোগিনী বেশে কেবল রাম নাম জপ করে যাচ্ছে। রূপে তিনি ইন্দ্রপত্নী শচীর থেকেও সুন্দরী । সকলে ভাবল- এই বুঝি সীতামাতা । তবে এখন সন্ধান পাওয়া গেছে । এবার এখান থেকে সীতামাতাকে নিয়ে যাবে। হনুমান নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল- “মা! আপনিই কি সীতাদেবী?” সেই কন্যা বলল- “না বতস্য। আমি তপস্বীনী সম্ভবা । তোমরা কারা? ” হনুমান নিজেদের পরিচয় দিয়ে রামচন্দ্রের বনে আগমন, সীতা হরণ, সীতার সন্ধানে এখানে আসা সকল কিছু বলল। তপস্বিনী সম্ভবা বলল- “হে কপি গণ। দেবী সীতার নাম আমিও শুনেছি। আমি জানি না তিনি কোথায়। তবে যেখানে গেলে আপনারা তাঁর সন্ধান পেতে পারেন। আমি সেখানেই আপনাদের যোগবলে পৌছে দেবো। এখন আপনারা ক্লান্ত। শীতল জল ও ফলমূলাদি আহার করুন।” আর খাওয়া দাওয়া! তবুও যোগিণীর অনুরোধে তারা শীতল জল ও মিষ্ট ফলমূল আহার করলেন। সেই যোগিণী যোগবলে তাহাদের বললেন- “আপনারা গুহা থেকে বের হতেই সেই স্থানে পৌছে যাবেন।” সকলে গুহা থেকে বের হতেই দেখলো সামনে সমুদ্র। বিশাল গর্জন। বিশাল ঢেউ এসে বালুকাতে আছরে পড়ছে। সেই ঢেউ, গর্জন শুনলে তরাশ হয় । চারপাশে কেবল বালুকারাশি, সামনে নীল অগাধ সমুদ্র। কোথায় সীতা? নেই তিনি। সেইখানে বানরেরা বসে বিলাপ করছিলো। সেই স্থানেই সম্পাতি পাখী এক পাখনা হারিয়ে “রাম” নাম জপ করছিলো। সে ছিলো গড়ুড়ের পুত্র, জটায়ুর ভ্রাতা। এতগুলো বানর দেখে সম্পাতির জিহ্বা দেখে লালা ঝড়তে লাগলো। মনে মনে ভাবল- “আহা বহুদিন পর এমন বানর ভক্ষণের সুযোগ এসেছে। এবার সব বানর গুলোকে ভক্ষণ করবো।” সম্পাতি সেই বানরদের কথা শুনছিলেন ।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।