১৫ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ১৭ )

ভগবান রাম শোকাচ্ছন্ন হলে- এখান থেকে “শিবগীতা” অধ্যায় শুরু হয়। মূল রামায়ণে শিবগীতা না থাকলেও, পদ্মপুরাণে শিবগীতার উল্লেখ আছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধপ্রাঙ্গনে- আত্মীয় স্বজন- জ্ঞাতি, ভ্রাতা দেখে যেমন অর্জুন গাণ্ডিব ত্যাগ করে শোক ও মায়াতে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন সেইরূপ সীতা বিহনে রামচন্দ্র সীতার শোকে আছন্ন হন। অর্জুনকে ঠিক এইসময় যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ “শ্রীমদ্ভগবগীতা” শোনালেন, যার ফলে অর্জুনের মন থেকে সকল মায়া মোহ দূর হল- রামচন্দ্র এইসময় অগস্ত্যের পরামর্শে শিবের উপাসনা করেন। ভগবান শিব এসে এই সময় রামচন্দ্রকে মায়া থেকে উদ্ধার করেন দিব্য বাণী সমূহ প্রকাশ করে। এইটি “শিবগীতা” নামে পরিচিত। আপনারা চাইলে আলাদা শিবগীতা পড়ে দেখতে পারেন। শিবগীতার সাথে শ্রীমদ্ভগবতগীতার প্রচুর সাদৃশ্য আছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধভূমিতে যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন যে- “সব ধর্ম পরিত্যাগ করে তুমি আমার শরণ নাও- আমি তোমাকে আশ্রয় দেবো, মুক্তি দেবো।” শিবগীতাতেও অনুরূপ ভগবান শিব তেমনি বলেছেন। রামচন্দ্রের সাথে অগস্ত্য মুনির সাক্ষাৎ হল। অগস্ত্য মুনি সীতার বিরহে কাতর রামচন্দ্রকে বোঝালেন দেহ পঞ্চভূতের দ্বারা নির্মিত। পূর্ণ সনাতন আত্মাই সর্ব দেহে বিরাজিত। কে কাহার পতি! কে কাহার স্বামী! শাম্ভবী মায়ার দ্বারা জগত বশীভূত, সেই মায়াই মহেশ্বর । মানুষ সেই মায়ায় পতিত হয়ে রিপুদের দাসত্ব, আমি সুখী- আমি দুঃখী এইরূপ আচরণ করে। অগস্ত্য মুনির কাছে শ্রীরাম বিরজা মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ‘পাশুপত’ ব্রতের অনুষ্ঠান করলেন । এই সময় তিনি এক মহাতেজ দেখতে পেলেন। তিনি নানা অস্ত্র নিক্ষেপ করেও সেই তেজকে স্তব্ধ করতে পারলেন না। দাশরথি রামের হস্ত থেকে অস্ত্রাদি পতিত হল। লক্ষণ মূর্ছা গেলেন । সে দেখে ভগবান রাম পুনঃ পুনঃ মহাদেবের স্তব করলেন । সেই তেজ থেকে মহাদেব প্রকট হলেন, তাঁর আশেপাশে অনেক দেবতা ছিলো। মহাদেবের বামে দেবী পার্বতী ছিলেন। মহাদেব ও সকলে রামচন্দ্রকে নানা আয়ুধ প্রদান করলেন ।

মহাদেব জানালেন দেবতাদের তেজ বানর রূপে জন্ম নিয়েছে, তুমি তাহাদিগের সহায়তায় রাবন বধ করে সীতা উদ্ধার করবে। মহাদেব জানালেন, তিনিই জন্ম দান করেন, তিনিই পালন করেন আবার তিনিই ধ্বংস করেন । তিনি ভিন্ন কিছুই নাই। তিনি নিত্য, অনিত্য, ব্রহ্ম, প্রজাপতি, দশদিক, তিনি সাবিত্রী, গায়ত্রী, স্ত্রী, পুরুষ, নপুংসক , সত্য, সর্বজ্ঞ, শান্ত, অগ্নি, গো, গৌরী, গহ্বর, আকাশ ও জগতের বিভু, তেজ, জেষ্ঠ্য, চারবেদ, সকল শাস্ত্র, শ্লোক ও মন্ত্র। মহেশ্বর জানালেন- তিনিই জ্যোতি, যাবতীয় পবিত্র বস্তু, সকলের অতীত, বুদ্ধি, অহঙ্ঙ্কার , ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ, স্কন্দ, গণেশ ইন্দ্রাদি সকল দেবতারূপে প্রকাশিত । তিনিই সর্বত্র । মহাদেবই সেই পরমাত্মা, মহাদেবই সেই “ওঁ” কার পরমব্রহ্ম । এত বলি মহাদেব তখন বিশ্বরূপ ধারন করলেন । রামচন্দ্র সেখলেন সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, সমুদ্র , চন্দ্র সূর্য, গ্রহ সকল কিছুই মহাদেবের মধ্যেই বিরাজিত । রামচন্দ্র তখন ভগবান মহাদেবের বিশ্বরূপ দেখে নানা স্তব স্তুতি করলেন । মহাদেব জানালেন- “হে রাম! আমি তোমার গুরু। আমি ভিন্ন তোমার পরম গুরু ইহজগতে আর কেহ নাই।” এই বলে মহাদেব দিব্য জ্ঞান দিতে লাগলেন । সন্তানের জন্ম, নারীর গর্ভধারণ , গর্ভধারণের উপযুক্ত সময় , গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা, শিশুর জন্ম, যৌবন, বিবাহ, বার্ধক্য, মৃত্যু সব বললেন। তবুও মানব মহাদেবকে ভুলে বারংবার পাপে নিমগ্ন হয়ে জন্ম মৃত্যুর জ্বালে পতিত হয় । যে যেই রূপ কর্ম করে সে সেইরূপ লোক প্রাপ্তি হয়। কর্মের ফল সমাপন হলে কর্মফল অনুযায়ী পুনঃ ধরিত্রীতে জন্ম নেয়। স্বর্গ আদি ব্রহ্মলোক অবধি অস্থায়ী, কিন্তু শিবকে প্রাপ্তি করলে তাহাদিগের আর জন্ম হয় না । মহাদেব জানালেন তিনি শুদ্ধ, সনাতন- মায়ার সহিত যুক্ত হয়ে বিশ্বের কারন হন । এই বলে মহাদেব , রামচন্দ্রকে মানবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আহারাদি সম্বন্ধে বললেন । যে ব্যাক্তি সকাম মনে পবিত্র ধার্মিক কর্ম করে সে পিতৃলোকে যায়, যে পাপ করে সে সেইরূপ সূক্ষ্মদেহ লাভ করে নরকে গমন করে। যে ব্যাক্তি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেনা , যে পাপ কর্ম করে সে নরকে গমন করে অন্তে পশু জন্ম লাভ করে ।

এরপর মহাদেব বললেন- যে ব্যাক্তি আমাকে আরাধনা করে, আমার নাম উচ্চারন করে, আমার শরণ নেয় সে শূদ্র হলেও মুক্তি লাভ করে, সে আমাকেই প্রাপ্ত করে । সেইজন্য আমার ভক্ত আমাকেই লাভ করে। আমি বেদ সৃষ্টি করেছি। যে ব্যাক্তি আমাকে ছেড়ে অন্য দেবতার উপাসনা করে সে আমারই উপাসনা করে। আমি সকল দেবতারূপে বিরাজিত । এই বলে ভগবান শিব, রামকে ব্রহ্ম , আত্মা সম্বন্ধে জ্ঞান দান করলেন । ভগবান শিব বললেন- আমার শরণাগত হও, আমি তোমাকে মুক্তিদান করবো। এইজগত মায়াতে আছন্ন হলেও আমার ভক্ত কদাপি মায়াতে আছন্ন হয় না । যিনি মোহাদি রিপু বর্জিত, যিনি সর্বভূতে আমাকে, আমাকে সর্বভূতে দর্শন করেন তিনিই “মুক্ত”। তত্ত্ব জ্ঞান উদয় হলেই অজ্ঞান নাশ হয় । এই বলে ভগবান শিব পঞ্চভূতের কথা, উপাসনার কথা ভগবান রামকে বর্ণনা করলেন । যে ব্যাক্তি “ওঁ” কার উচ্চারন করে শিবপূজো করে সে মুক্তি লাভ করে। যে ব্যাক্তি শাল কাঠের ভস্ম অভিমন্ত্রিত করে গাত্রে লেপন করে সে শূদ্র হলেও মুক্তি লাভ করে। অর্থাৎ ভগবান শিব বোঝালেন- জাতিতে নয়, ভক্তিতে মুক্তি। চার বর্ণের যে কেউ, যে একাগ্র চিত্তে ভগবান শিবের শরণ নেয় সেইই মুক্তিলাভ করে। যে ব্যাক্তি কুশ, পুস্প, বিল্বপত্র দিয়ে “ওঁ” ধ্বনি উচ্চারন করে শিবের পূজো করে সেই শিবের প্রিয় । অষ্টমী, চতুর্দশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, কৃষ্ণ পক্ষের নিশি , একাদশীতে শিবের পূজা করলে ভগবান শিব তৃপ্ত হন- ইহাই ভগবান রুদ্র বললেন রামচন্দ্রকে। পঞ্চগব্য, পঞ্চামৃত, কুশোদক, দ্বারা, গো দুগ্ধ, ঘৃত, মধু, আখের রস, নারিকেলের জল, জাহ্নবীর সলিল দ্বারা ভগবান শিবের অভিষেক করলে তিনি প্রসন্ন হন। ভগবান শিব বললেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, নারী সকলেই শিব পূজোয় অধিকারী । কিন্তু শিবভক্ত ব্যাতীত অপর কেহ শিব উপাসনার যোগ্য না। যে ব্যাক্তি অন্তিমে আমার নাম জপ করতে করতে দেহ ত্যাগ করে সে অক্ষয় শিবলোকে গমন পূর্বক আমাকেই লাভ করে। এই রকম বহু আধ্যাত্মিক কথা বললেন ভগবান শিব। তাই শুনে ভগবান রামের সকল মায়া মোহ দূর হল। আপনারা বিষদে জানতে “শিবগীতা” পড়ুন। এটি “পদ্মপুরাণের” অন্তর্গত ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।