• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাধা রানী অস্বীকারীদের যৌক্তিক উত্তর

আজ রাধারানীর সখী শ্রীললিতা দেবীর আবির্ভাব তিথি। কাল রাধাষ্টমী। বৃন্দাবনেশ্বরী , গোলকপুরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী শ্রীরাধারানীর বৃষভানু কন্যা রূপে আবির্ভাব তিথি। আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেকেই রাধার অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন । এটা সত্য যে “রাধা” দেবীর অস্তিত্ব মহাভারত বা শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন মহাভারত কিন্তু পূর্ণ শ্রীকৃষ্ণজীবনী নয় । এখানে পঞ্চপাণ্ডব ও কুরুপাণ্ডব যুদ্ধ ও শ্রীমদ্ভগবতগীতাই মুখ্য। ঘটনাচক্রে এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আংশিক লীলার পরিচয় পাই । এখানে তিঁনি শান্ত অর্থাৎ পরব্রহ্ম রূপে আত্মপ্রকাশিত। আবার শ্রীমদ্ভাগবতে গুপ্তা দেবী রূপে রাধারানীর উল্লেখ আছে।

রাসলীলার আরম্ভে প্রধানা সখীকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মণ্ডল থেকে- সেটা আছে। গুপ্তা দেবীরূপে রাধারানী সকল ভক্তকে কৃপা করেন। রাধারানী কৃপা না করলে সেই ভক্ত কোটি জন্মেও কৃষ্ণ কৃপা পায় না। রাধারানী কি কাল্পনিক ? মোটেও তা না। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য অনেক লেখক শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র রচণা করেছেন, তাতে রাধারানী প্রসঙ্গ আনেন নি। কারণ বিপ্লববাদে “প্রেম” নয় সুদর্শন ধারী শ্রীকৃষ্ণের রূপ প্রয়োজন।

এখন পরিস্থিতি অনুসারে ভগবানের রূপ ধারণ। অসুর দমন কালে ভগবান কিন্তু অতি ক্রুদ্ধ নৃসিংহ রূপ ধরেছিলেন আবার সেই এক ভগবান রাসমণ্ডলে সখীদের বাসনা পূর্ণ করার জন্য শ্যামসুন্দর বংশীধারী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এমনকি চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি ধারণ করলেও সখীরা সেই রূপে নয় বরং সেই বংশীধারী বনমালা শোভিত কৃষ্ণ স্বরূপকেই কামনা করেছিলেন । আর শ্রীমদ্ভাগবতগীতা বলার সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অদ্বৈতস্বরূপ এ এসে বিরাট ব্রহ্মের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন। সুতরাং গীতায় যে মাধুর্য রসের সাধিকা রাধা ও সখীদের নাম থাকবেই না ইহা বোঝাই যায়।
শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী মহাশয় ব্যক্ত করেছেন-
আত্মেন্দ্রিয়প্রীতি বাঞ্ছা- তারে বলি ‘কাম’।
কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্রীতি- ইচ্ছা ধরে ‘প্রেম’ নাম ।।

“প্রেম” কাহাকে বলে ? একটি ছেলে একটি মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেলো বা পর ধর্মের একজনকে বিয়ে করলো ভালোবাসা করে – সেটি কি ? না তা নয় । ভগবান এর প্রীতির জন্য যে ইচ্ছা তাহাই প্রেম । আর বাকী সব ইচ্ছা “কাম” নামেই পরিচিত। অর্থাৎ ইষ্টদেবের সেবা, আকুতি , মিনতি হল প্রেম । প্রেমের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ রূপে বলে বোঝানো যায় না। কৃষ্ণ ভজনের পথে নিজেই উপলব্ধি করা যায় । এবার আসা যাকা শ্রীরাধারানী প্রসঙ্গে। তত্ত্ব কথানুসারে জীবাত্মা মাত্রই “রাধা” বা প্রকৃতি । পুরুষোত্তম একমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ । জীবাত্মা আর পরমাত্মার যে মিলন হয় তাই “মহারাস”।

 এই মিলন অন্তরে দিব্য স্বরূপে হয়। জড়জাগতিক ভাবে এই মিলনের ব্যাখা বা উপলব্ধি কোনোটাই হবে না । অষ্টসখী ( ললিতা, বিশাখা, সুচিত্রা, চম্পকলতা , সুদেবী, রঙ্গদেবী, তুঙ্গরেখা ও ইন্দুরেখা ) হলেন রাধারানীর ‘পরমশ্রেষ্ঠসখী’। এঁনাদের পথ অবলম্বন করে মঞ্জরী ভাব নিয়ে যুগলের সেবাই সাধনা। গুরু পরম্পরা অনুসারে এই সাধনা গুপ্ত । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবান বিষ্ণু এক । বৈকুণ্ঠধাম হল ভগবান বিষ্ণুর নিবাস। যাঁরা নৃসিংহ, ভগবান শ্রীরাম, বরাহ, বামন, বুদ্ধ আদি অবতারের সাধনা করেন তারা এই বৈকুণ্ঠধাম প্রাপ্ত হন। এমনকি ভগবানের হস্তে নিহত অসুরেরাও এই লোকে আসেন। কিন্তু গোলোকধাম এই বৈকুণ্ঠধামের ওপর। যারা কুঞ্জসেবাদি করেন, তারাই এই ধামে আসেন। মাধুর্য ভাবেই এই ধামে আসা যায় ।

 বস্তুত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাতীত অপর কারোর মাধুর্য সেবা নাই। আর সখীরা চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি নয়, শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপই কামনা করেছিলেন । এই মাধুর্য সেবাই শ্রেষ্ঠ। যথা শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন রায় রামানন্দের সাথে মহাপ্রভুর আলাপ প্রসঙ্গে-
মহাপ্রভু, ভক্ত রায় রামানন্দ সনে এই গোপিনী প্রেমকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছিলেন-

পূর্ব পূর্ব রসের গুণ পরে পরে হয় ।
দুই তিন গণনে পঞ্চ পর্যন্ত বাঢ়য় ।।
গুণাধিক্যে স্বাদাধিক্যে বাঢ়ে প্রতি রসে ।
শান্তদাস্যসখ্যবাৎসল্যেরগুণমধুরেতে বৈসে ।।
আকাশাদির গুণ যেন পর পর ভূতে ।
দুই তিন ক্রমে বাঢ়ে পঞ্চ পৃথিবীতে ।।
পরিপূর্ণ কৃষ্ণপ্রাপ্তি এই প্রেমা হৈতে ।
এই প্রেমের বশ কৃষ্ণ কহে ভাগবতে ।।
( শ্রীচৈতন্যচরিতামমৃত – মধ্যলীলা )

রাধারাণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। স্বামী স্ত্রী যখন একত্র হন তখনই সন্তানের জন্ম হয়। আদিমকাল থেকে এই ভাবেই চলছে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড , কোটি কোটি নক্ষত্র যিঁনি সৃষ্টি করেছেন সেই ব্রহ্ম কে পুরুষ আবার প্রকৃতিও ধরা হয়। যিনি পুরুষ তিনিই প্রকৃতি। রামকৃষ্ণ দেব একজায়গায় বলেছেন- “বেদে যিনি ব্রহ্ম তন্ত্রে তিনিই শক্তি”। সেই পুরুষ প্রকৃতি( শক্তি) রূপ অর্ধনারীশ্বর । শিব আর কালী। কৃষ্ণ আর শ্রীরাধিকা । এই পুরুষ যখন নিস্ক্রিয় হন, প্রকৃতি বা শক্তি হন সক্রিয় । কালীমূর্তি দেখলে দেখবেন, মায়ের চরণে শান্ত অর্ধ নিদ্রিত ঢুলুঢুলু চোখে মহাদেব উপরে দেবীর চোখে তাকিয়ে আছেন, পুরুষ এখানে নিদ্রিত, তিঁনি দেবীর দিকে তাকিয়ে। আবার মা কালী নয়ন নীচে মেলে মহাদেবের নয়নে দৃষ্টি রেখেছেন, তিঁনি সক্রিয় – সৃষ্টি- স্থিতি- লয় করছেন ।

বস্তুত আদ্যাশক্তির রূপ হলেন রাধারানী। শক্তি যখন পুরুষের বামে অবস্থান করেন, তখন সেই রূপ হয় পরিপূর্ণ। দেখবেন কৃষ্ণ বামে মাথা হেলিয়ে সেই ভাবে আদ্যাশক্তি রাধারানীর দিকে তাকিয়ে আছেন, আর রাধারানী বরামুদ্রায় আছেন, অর্থাৎ আশীর্বাদ দিচ্ছেন। শ্রীকৃষ্ণের কোনো এমন ছবি দেখেছেন যেখানে রাধাকে বামে নিয়ে একহাতে বাঁশী ধরেছেন অপর হাতে আশীর্বাদ দিচ্ছেন? এমন দেখা আয় না। ব্রহ্ম এখন শক্তির দিকে চেয়ে আছেন, আর শক্তিরূপিনী রাধারানী আশীর্বাদ করে “কৃষ্ণপ্রেম” প্রদান করছেন । শ্রীরূপ গোস্বামী “উজ্জ্বলনীলমণি” গ্রন্থে লেখেছেন-
হ্লাদিনী যা মহাশক্তিঃ সর্বশক্তিবরীয়সী ।

হ্লাদিনী যে মহাশক্তি যিনি শক্তিগণ দ্বারা পূজিতা । আর সেই রাধারাণী “কৃষ্ণপ্রেম” প্রদান করেন । আপনি যদি সব সময় শ্রীকৃষ্ণের কাছে “প্রেম” চান উনি দেবেন না। গৌড়ীয়া মতে এই প্রেম প্রদান করেন রাধারানী । আর তার জন্য দরকার যুগলের সেবা, আকুতি মিনতি, সদগুরু দ্বারা মঞ্জরী সেবা গ্রহণ। আর চাই শাস্ত্র শ্রবণ, সাধুসঙ্গ , অসৎ আলাপ বর্জন । বস্তুত রাধারানী কাল্পনিক নয়। শ্রীমদ্ভাগবতের গুপ্তা দেবী তিনি । “রাধা” নামে আঁখি ধারা ঝড়লে সেই প্রেমের পথে গোবিন্দ প্রাপ্তি হয় । রাধারানী কাল্পনিক দেবী নন- তিনি বীজমন্ত্রস্বরূপা গুপ্তা দেবী।

সবার সামনে সেই তত্ত্ব প্রকাশ করা যায় না, করেও বোঝানো যায় না। ভজন হয় গোপোনে – মনে মনে। ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে ভজন হয় না, শাস্ত্রীয় তর্ক করেও ভজন হয় না। যারা ভজনহীন , সাধনহীন তাঁহাদিগের কাছে “রাধারানী” হামেশাই কাল্পনিক থাকবেন। আর একদিন তারাও একসময় কাল্পনিক হয়ে যাবেন। কারণ লক্ষ কোটি পশু জন্ম তারপর মানব জন্ম পেয়ে ঈশ্বর সাধনার সুযোগ মেলে- এটাকে হাতছাড়া করা উচিৎ না ।
Share:

হিন্দু ধর্মের কিছু নিয়মের পেছেন কিছু যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকে।

গর্ভবতী নারীদের ভূতের গল্প শুনতে নেই কেন ?

উঃ- গর্ভবতী নারীকে খুব সাবধানে থাকতে হয়। সামান্য ভুলের জন্য সন্তান এমনকি মায়ের জীবন সংশয়ও হতে পারে। ভূতের গল্প শুনে আমরা ভয় পাই । এমন কি একলা থাকলে সেই সব গল্প মনে জেগে উঠলে আমরা শঙ্কিত হই। স্বপ্ন দেখে চমকে উঠি। কারণ আমরা যা ভাবি, সেই গুলিই স্বপ্নে আসে। এখন প্রাচীন কালে বিদ্যুৎ আবিস্কার হয় নি। প্রদীপ, লণ্ঠন , হ্যাজাক ছিলো ভরসা। এই অবস্থায় ভূতের গল্প শুনে এবং একলা থাকা কালীন এসব ভেবে গর্ভবতী নারী ভয় পেলে বা স্বপ্নে চমকে উঠলে গর্ভের সন্তান ও মা দুজনের জীবন সংশয় হতে পারে। বিশেষ করে ভয় পেয়ে জ্বর হলে সেটা খারাপ। সেজন্য এই নিয়ম গর্ভবতী নারীদের ভূতের বা হিংসামূলক, খুন খারাপির গল্প শুনতে নেই।

গর্ভবতী নারীদের ঈশ্বরের কথা শোনা উচিৎ কেন ?

ঊঃ- হিন্দু পুরাণ বলে প্রহ্লাদ তাঁর মাতা কয়াদুর গর্ভে থাকাকালীন নারদ মুনির আশ্রমে হরিনাম শুনতে পেয়ে হরি ভক্ত হন। মহাভারতে বলে শুভদ্রার গর্ভে থাকাকালীন অভিমণ্যু পিতা অর্জুনের মুখের যুদ্ধবিদ্যা শুনে যুদ্ধ শিখেছিলেন। পৌরাণিক এই সকল আখ্যানের মাধ্যমে যে সত্যি পুরাণকার রা শেখাতে চেয়েছিলেন, তা হল- গর্ভকালীন অবস্থায় নারী যদি ঈশ্বরের কথা, শাস্ত্র পাঠ ইত্যাদি শোনেন- তবে তার মন প্রান উৎফুল্ল থাকবে। এটা গর্ভবতী নারীর পক্ষে উত্তম। সুস্থ, আনন্দিত থাকলে মনে ভয় টয় আসবে না। সন্তান ভালো থাকবে। তবে এই সময় পূজা পাঠ- উপোস নিষিদ্ধ, কারণ এতে শরীরের পরিশ্রম হয়। আর গর্ভবতী নারীদের বিশ্রাম নেওয়া খুব প্রয়োজন। সেজন্য গর্ভবতী নারীরা ভজন কীর্তন শুনবেন। ধার্মিক পুস্তক ও মহাপুরুষদের জীবনি পড়বেন ।

গর্ভবতী নারীদের খোলা আকাশের তলায় খেতে নেই কেন ?

ঊঃ - গর্ভবতী নারীদের খোলা আকাশের তলায় খেতে নেই। বলে খোলা আকাশের তলায় খেলে বেতাল, পিশাচ দের দৃষ্টি পড়ে গর্ভবতী নারীদের ওপর। এর কারণ আছে। গর্ভস্থ সন্তান খুব সেনসিটিভ। সামান্য ভুলে মা ও সন্তান উভয়েই মারা যেতে পারে। খোলা আকাশের তলায় খেলে উড়ন্ত পাখীর মল বা ধূলাবালি, জীবানু খাবারে পড়তেই পারে। অজান্তে তা খেলে কি হবে বোঝাই যায়। তাই গর্ভবতী নারীদের সাবধানে চলা উচিৎ।

গর্ভবতী নারীদের সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হওয়া বারণ কেন ?

ঊঃ- গর্ভবতী নারীদের সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হতে দেয় না। বলে ভূত প্রেতের দৃষ্টি পড়বে গর্ভের সন্তানের ওপর। এর কারণ আছে। আসলে প্রাচীন কালে বিদ্যুৎ আবিস্কার হয় নি। তখন সন্ধ্যায় বের হলে হোঁচট খেয়ে পড়লে গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু ত হতেই পারে সাথে মায়েরও। এছাড়া সূর্যাস্তের পর কিছু জীবানু সক্রিয় হয়। সূর্যের আলো বহু প্রকার জীবানু নাশ করে। সেইজন্য সন্ধ্যার পর জীবানু শরীরে আসতে পারে। এছাড়া শীতল বাতাসে ঠাণ্ডাজনিত রোগের শিকার হতে পারে গর্ভবতী নারী। যার কুপ্রভাব সন্তানের উপরেও পড়ে। এছাড়া বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিছা এই রাতের অন্ধকারেই বের হয় । প্রাচীন কালে ত ইলেকট্রিক আবিস্কার হয় নি। সেই জন্য এই নিয়ম ।

সন্ধ্যাকালে প্রদীপ দেওয়া হয় কেন তুলসী তলায় ?

ঊঃ- সন্ধ্যাকালে গৃহের রমণীরা তুলসী তলায় প্রদীপ দিয়ে শাঁখ বাজান। এটি হিন্দু ঐতিহ্য । যদিও এখন সন্ধ্যাবেলায় অধিকাংশ বাড়ীতে টিভির আওয়াজ শোনা যায়। প্রথমত এটি হল গৃহ আঙিনা আলোকিত করার জন্য। দ্বিতীয় সন্ধ্যার পর কিছু ফসলের ক্ষতিকারী পোকা বের হয়। যারা আগুন দেখে লম্ফ দিয়ে পুড়ে মরে। যেমন পঙ্গপাল, শ্যামাপোকা, মাজরা পোকা ইত্যাদি। ফসলের ক্ষতি কম হয়। আর প্রাচীন কালে ছিলো মাইলকে মাইল বন জঙ্গল মাঠ, তারপর একটি গ্রাম। তখন ত ইলেকট্রিক, মোবাইল গুগলি ম্যাপ এগুলো কিছুই ছিলো না। সন্ধ্যার অন্ধকারে পথিক গ্রামের দিক ভ্রষ্ট হয়ে সোজা পড়তো বিপদের মুখে কারণ সে সময় বাঘ, ডাকাত, ঠক দের উৎপাত ছিলো । এজন্য প্রদীপের আলো দেখে পথিক গ্রামের দিশা দেখতে পেতো।

কার্ত্তিক মাসে আকাশপ্রদীপ দেওয়া হয় কেন ?

ঊঃ- কার্ত্তিক মাসে আকাশ প্রদীপ দেওয়া হয়। একটা উচু বাঁশ বা উচু জায়গার মাথায় একটি প্রদীপ দেওয়া হয়। একে আকাশ প্রদীপ বলে। এর একটি কারণ কার্ত্তিক মাসে খুব পোকার উৎপাত। পোকা গুলো আগুনে এসে পুড়ে মরে। আর একটি কারণ কার্তিক মাসে কুয়াশা পড়ে অল্পস্বল্প। মাইলকে মাইল মাঠের পর একটি গ্রাম থাকতো আগের দিনে। কুয়াশাতে দিক ভ্রষ্ট হতেই পারে । পথিক যাতে দিকভ্রষ্ট না হয় তার জন্য উঁচু জায়গাতে প্রদীপ দেওয়া হত ।
ভালো লাগলে বলবেন। আবার কিছু যুক্তি কারণ নিয়ে লেখবো।
Share:

"! 'ওঁ' বা 'প্রণব' তত্ত্ব !"

'ওঁ' শব্দটি অতি পবিত্র। যার উচ্চারণ অ-উ-ম্। একে ওঙ্কার বা প্রণবও বলা হয়। ওঙ্কার শব্দটি এমন মহাপপবিত্র যে সর্ব্বাবস্থায় ব্যবহার করা উচিৎ নয়। এই জন্য এর আর এক নাম প্রণব। 'প্র' উপসর্গ পূর্ব্বক 'নু' ধাতুর 'অল্' প্রত্যয়ে 'প্রণব' গঠিত। 'নু' ধাতুর অর্থ ডাকা বা স্তব্ধ করা। প্রণব অর্থ প্রকৃষ্ট উপায়ে ডাকা, অতি সুন্দর ভাবে ডাকা, প্রীতির সাথে ডাকা।

মানুষের অনেক নাম থাকে। একটি পোষাকী নাম হয়, আর একটি থাকে ডাকনাম। কেউ যদি কাউকে ডাকনাম ধরে ডাকে, তাহলে তার অধিক প্রীতি হয়। বোঝা যায় সে অতি প্রিয় বা আপন জন। ব্রহ্মের অনেক নাম। কেউ যদি তাঁকে 'ওঁ' বলে ডাকে, তবে তিনি অধিক প্রীত হন। তাকে প্রিয়জন মনে করেন। ভগবানকে তুষ্ট করতে এই নামটি সুন্দর, মনোহর। এজন্য ওঙ্কারকে প্রণব বলে। শ্রেষ্ঠ পুরুষের বাচক শব্দ প্রণব। ঈশ্বর বাচ্য আর প্রণব বাচক। উপনিষদ বলছে, গাছের সব পাতা যেমন যেমন কান্ডের সাথে যুক্ত, ঠিক একই ভাবে সব শব্দই একত্রিত আছে 'ওঁ' উচ্চারণের মধ্যে।'ওঁ'ই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। শুধু মানুই নয়, সমগ্র মহাবিশ্বেরও এই একীভূত হওয়ার প্রচেষ্টা আছে সরলীকরণের মাধ্যমে। আর পরমেশ্বর ঈশ্বর এটাই আশা করেন।

'ওঁ' এর প্রথম অর্থ হলো, অন্য কোনো অর্থ যুক্ত না করে মূলতত্ত্বকে ঘনীভূত রুপ দেওয়া এবং সহজ করা। 'ওঁ' এর দ্বিতীয় মানুষের প্রয়োজনে হ্যাঁ বোধক সাড়া দেওয়া। 'ওঁ' ই হচ্ছে পরিপূর্ণতা। স্তোত্র, প্রার্থনা এবং ধ্যান শুরু হয় গায়ত্রী মন্ত্র দিয়ে। যার শুরু ও শেষ 'ওঁ' দিয়ে। এই দুটি বস্তুই বিভিন্ন ভাবে পরম পুরুষকেই বোঝায়। 'ওঁ' ই শ্বাশত ব্রাহ্মণ, 'ওঁ' ই শেষ অবলম্বন। যার উপর মানুষ নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারে জীবন যাত্রার শেষে। অর্থাৎ ব্রহ্মনে মিলিত হওয়ার সময়ে। 'ওঁ' এর প্রতি উচ্চারণেই গভীর থেকে গভীরতর উপলব্ধি আসে সেই পরম একের। 'ওঁ' উচ্চারিত হয়ে থাকে শাস্ত্রাদি পাঠ, পবিত্র কাজ ইত্যাদির আরম্ভে এবং শেষে। যোগী পুরুষেরা অনবরত 'ওঁ' ধ্বনি উচ্চারণ করে থাকেন।

বারবার 'ওঁ' ধ্বনি উচ্চারণ এবং শ্রবণ মঙ্গলকারক। 'ওঁ' কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রার্থনার বস্তু নয়, এ সকলের, সার্বজনীন। 'ওঁ' কোনো দেবতার প্রার্থনার মন্ত্র নয়। সমগ্র বিশ্বপ্রপঞ্চকের মূল কথা নিহিত আছে এই শব্দে। এই ডাকটি একটি স্বর্গীয় বস্তু। সামগ্রিক পরমার্থিক চিন্তার আত্মসমর্পণ বলা যায় 'ওঁ' কে। 'ওঁ' ধ্বনির বিনাশ নেই। 'ওঁ' ই ব্রাহ্মণ, 'ওঁ' ই শব্দব্রহ্ম। 'ওঁ' শুধু ধ্বনিই নয়, নীরবতাও। এই মহাধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে এক নীরবতার স্তর আছে, যার নাম 'তুরীয়'। প্রকৃত ঞ্জান এবং আত্মোপলব্ধির জন্য এই মাধুর্যমন্ডিত নীরবতাই অভিপ্রেত। প্রকৃত সাধণার শুরু নীরবতায় এবং অনন্ত শাশ্বত নীরবতায়ই মানুষের পরম প্রাপ্তি। 'ওঁ' ই প্রথম শব্দ, মহাবিশ্বের প্রথম প্রতীক, প্রথম বিকাশ, বাস্তব সত্তার ঘনীভূত রুপ। ইহা পৃথিবীর আগে, ইহাই পৃথিবীর শেষ কথা, ইহাই সারকথা। এর নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। কারণ সমগ্র অর্থের এই ই উৎস। 'ওঁ' একের প্রতীক। পরমকরুনাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয় এই ওঙ্কার শব্দ।

তাঁর শ্রীচরণে আমাদের ভক্তিপূর্ণ অর্ঘ্য,
"ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।"
!!হরে কৃষ্ণ হরে কৃৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে!!
!!জয় শ্রীহরি!! জয় রাধে!!

Written by: Ripon Saha
Like our page: সনাতন সন্দেশ - Sanatan Swandesh
Share:

সাত প্রকার স্ত্রী কথা ও বুদ্ধের উপদেশে সুজাতার আমূল পরিবর্তন

সুজাতা ছিলেন ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা। বিশাখার ছোট বোন সুজাতা ছোটকাল হতে অত্যন্ত মুখর দাম্ভিক ছিলেন। বিশাখার সহোদরা হলেও দু'বোনের মধ্যে স্বভাবের কোন মিল নেই। বড় বোন বিশাখা ধীরস্থির, বিদুষী, বিনীতা, শান্তশীলা ও বুদ্ধিমতি আর ছোটবোন সুজাতা ঠিক তার বিপরীত।
ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী কন্যা সুজাতাকে অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর বাড়ীতে বিবাহ কার্য্য সম্পন্ন করেন। সুজাতার পিতার অতুল ঐশ্বর্য্যের নিকট শ্বশুর অনাথপিণ্ডিকের সম্পত্তি কম হলেও উপেক্ষণীয় নয়। তবুও শ্বশুরকুলের বিত্ত সুজাতার মনকে সন্তোষ দিতে পারল না।

অনাথপিণ্ডিক জেতবন বিহার তৈরী করতে চুয়ান্ন কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করেন। তখন তিনি সেই সময় প্রতিদিন পাঁচশত ভিক্ষুসংঘকে পিণ্ডদান করতেন। কত কর্মচারী, দাস-দাসী রয়েছে! তবুও সুজাতার মন খুশী নয়। ধীরে ধীরে তার স্বভাব, আত্মগৌরব ও দাম্ভিকতা উন্মুখ হয়ে উঠল। পিতার সম্পত্তির গর্ব করে শ্বশুরকুলের প্রতি অমান্যতা, কর্কশ বাক্য আর উচ্চবাক্য প্রয়োগ করতে লাগল। সকলের শান্তি নষ্ট হল। শান্তিকামী সুখবিহারী অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর সুখ ভেঙ্গে গেল। তাদের সুখের সংসারে অশান্তির সূচনা হল। অনাথপিণ্ডিক চিন্তিত হলেন। পুত্রবধুর কুৎসা প্রচার রটানো কি অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর শোভা পায়? অগত্যা তিনি নীরবে থাকায় বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন।

একদিন অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠী তথাগত বুদ্ধকে ঘরে আহারের নিমন্ত্রণ করেন। তথাগত যথাসময়ে এসে সুসজ্জিত আসনে উপবেশন করলেন। এমন সময়ে অন্তঃপুরে কলহের উচ্চ শব্দ শুনতে পেয়ে বুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন। এতে শ্রেষ্ঠীর মুখ বিমর্ষ হইল। দুঃখের সাথে বললেন, ভগবান, আমার পুত্রবধু সুজাতাই যত অনর্থের মূল। ধনকুবের ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা কিনা, তাই তার এত অহংকার বেশী! সে শ্বশুর-শ্বাশুরীকে মান্য করে না, স্বামীকে অমান্য করে, অবহেলা করে। এমনকি প্রভু! আপনাকেও সম্মান প্রদর্শনে সে আগ্রহী নয় মনে করি। অন্যজনের কথাই বা কি! তথাগত সুজাতাকে আহ্বান করলেন। সুজাতা এসে বুদ্ধকে বন্দনা করে বসে পড়ল।

 বুদ্ধ বললেন, সুজাতা! আমি এখন তোমাকে পুরুষের সাত প্রকার ভার্য্যা সম্বন্ধে বলব; (১) বধকাসমা ভার্য্যা, (২) চৌরিসমা ভার্য্যা, (৩) আর্য্যাসমা ভার্য্যা, (৪) মাতৃসমা ভার্য্যা, (৫) ভগ্নিসমা ভার্য্যা, (৬) সখীসমা ভার্য্যা ও (৭) দাসীসমা ভার্য্যা - এই সাত প্রকার ভার্য্যার মধ্যে তুমি কোন প্রকারের ভার্য্যা? সুজাতা তখন বিনীতভাবে বললেন, প্রভু! আপনি সংক্ষেপে যা বললেন তা আমি বুঝলাম না। অনুগ্রহ করে আমাকে ভালভাবে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিন আমি যাতে বুঝতে পারি। বুদ্ধ তখন বললেন, শোন সুজাতা ----

(১) যে স্ত্রী প্রদুষ্টাচিত্তা, কলহ স্বভাবা, স্বামীর অমঙ্গলকারিনী, পরপুরুষে আসক্তা, নিজের স্বামীকে অবজ্ঞাকারিনী, স্বামীর ধনসম্পদ অপব্যয়কারিনী, অর্থ না পেলে অনর্থকারিনী, স্বামীকে হত্যা করার ভয় দেখায়, এমনকি হত্যা করতেও উন্মুখ হয়, তেমন স্ত্রীকে বধকাসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(২) যে স্ত্রী স্বামীর শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষি কর্মের দ্বারা উৎপন্ন ধন-সম্পদ উপভোগ করে, তবুও স্বামীর সম্পদ চুরি করার ইচ্ছা করে এবং অল্প হলেও চুরি করে, যেমন- রান্নার সময় ধৌত করার জন্য যে চাউল নেয়া হয়, তা হতেও চুরি করে। আর অন্যকিছুর কথাই বা কি? সেই রকম স্ত্রীকে চৌরিসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(৩) যে স্ত্রী নিষ্কর্মা আলস্যপরায়ণ, অধিক ভোজনকারিনী, আর্য্যের বস্তুর প্রতি অধিকার ও লোভ পরায়ণা, মুখরা, প্রচণ্ডা, দুর্ভাষিনী, বাক্যের উপর বাক্য প্রয়োগ করে, স্বামীকে অবজ্ঞা করে, জনমণ্ডলীকে পরাস্থ করার চেষ্টা করে, স্বামীর উৎসাহ উদ্যম অসহনশীলা। এই রকম স্ত্রীকে আর্য্যাসমা ভার্য্যা বলে।

(৪) স্বামীর সঞ্চিত ধন যে স্ত্রী রক্ষা করে, সর্বদা স্বামীর হিত কামনা করে ও উপকারিনী, মাতা পুত্রকে রক্ষার ন্যায় স্বামীকে রক্ষা করে, এই রকম স্ত্রীকে মাতৃসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(৫) জ্যেষ্ঠ সহোদরের প্রতি কনিষ্ঠ ভগ্নির আদর ও সম্মান প্রদর্শনের ন্যায় যে স্ত্রী স্বামীকে প্রতি আদর সম্মান করে, স্বামীর প্রতি লজ্জাবনতা ও স্বামীর প্রতি অনুবর্ত্তনী হয়। এই রকম স্ত্রীকে ভগ্নিসমা ভার্য্যা বলে।

(৬) দীর্ঘদিন পরে সখার আগমনে সখীর আনন্দিত হবার মত স্বামী দর্শনে যে স্ত্রী আনন্দিত হয় এবং কুল মর্যাদা রক্ষাকারিনী, শীলবতী ও পতিব্রতা হয়। সে স্ত্রীকে সখীসমা ভার্য্যা বলা হয়।

(৭) যে স্ত্রী স্বামী শাসন-অনুশাসন এবং লাঠি হস্তে তর্জন-গর্জন করলেও যে স্ত্রীর চিত্ত দূষিত হয় না বা ক্রোধ হয় না, হিংসা উৎপন্ন হয় না বরং স্বামীর শাসন সহ্য করে এবং ক্রোধহীনা, শান্তশীলা ও স্বামীর আনুগত্য হয়। সে স্ত্রীকে দাসীসমা ভার্য্যা বলা হয়।

এই সাত প্রকার ভার্য্যা বিষয়ে বর্ণনা করার পর বুদ্ধ আরো বললেন “সুজাতা, যে সকল ভার্য্যা বধকা, চোরী ও আর্য্যাসমা হয়, মুখরা, প্রচণ্ডা, দুঃশীলা, লজ্জাহীনা হয় ও পরুষবাক্য প্রয়োগ করে, স্বামীকে অনাদর করে, অখাদ্য খাওয়ায়, স্বামী রোগগ্রস্থ হলে সেবা করে না, সেইসব স্ত্রী মৃত্যুর পর নরকে জন্ম নিয়ে দুঃসহ দুঃখ ভোগ করে। আর যেইসব স্ত্রী মাতৃসমা, ভগ্নিসমা, সখীসমা এবং দাসীসমা তারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গে উৎপন্ন হয়। সুজাতা, এই সপ্ত প্রকারের মধ্যে তুমি কোন প্রকারের ভার্য্যা? সুজাতা তখন বিনীত বাক্যে বললেন, প্রভু! অদ্য হতে আমাকে দাসীসমা ভার্য্যা বলে জানবেন। সুজাতা আবার বলে উঠল, প্রভু! আমি এতদিন অন্ধকারে আবৃত ছিলাম।

এখন আপনার দয়ায় আলোকের সন্ধান পেয়েছি। বাবার ঐশ্বর্য্যের অহঙ্কার আত্মভিমান এখন আমার ধ্বংস হয়েছে। আমার ভ্রান্তি নিরসন হয়েছে। ভগবান! মহান বৌদ্ধকুল পরিবারের কুলবধু হয়ে আমার বিচ্যুতির জন্য আমি এখন খুবই লজ্জিত, অনুতপ্ত। আপনার অমৃতবাণী আমার মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই বলে সুজাতা বুদ্ধের চরণ তলে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। আর শ্বশুর-শ্বাশুরীকে ও স্বামীর পায়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

সেই হতে সুজাতা ভদ্রা, বিনীতা, শান্তশীলা, প্রিয়ভাষিনী হলেন; মধুর মিষ্টি স্বরে সকলের প্রতি প্রাণে প্রীতি ও আনন্দ দান করতেন; ত্রিরত্নের উপাসিকা হয়ে দানে আত্মনিয়োগে রত থাকতেন, শীল সমাধিতে ও প্রজ্ঞায় অনুশীলনে তাঁর কুল মর্যাদার অক্ষুন্ন রাখতেন। অর্থাৎ সুজাতার বিভিন্ন গুণ বিদ্যমানে সবাই আনন্দমুখর হয়ে উঠল। সর্বজ্ঞ বুদ্ধের মহিমাময় প্রভাবেই সুজাতার এমন বর্ণনাতীত আমূল পরিবর্তন হল।

(c) Prithwish Ghosh
Share:

সাধনা

প্রকৃতিকে দেবীরূপে ভজনা- এই বিশ্বাস, সাধনা, দর্শন ও আরাধনার সমস্ত প্রক্রিয়াকে আমরা একত্রে বলতে পারি- ‘তন্ত্র’। যে তান্ত্রিক বিশ্বাসের উন্মেষ হয়েছিল নিষাদদের ধর্মীয় চেতনায়, নিষাদদের মাতৃতান্ত্রিক ধর্মীয় ভাবনায়। কাজেই তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলায়। এই দেবী বাঙালিসমাজে ‘শক্তি’ দেবী নামে পরিচিতা। যারা শক্তি দেবীর উপাসনা করেন তারাই ‘শাক্ত’ বলে পরিচিত। ধর্মতত্ত্বের ভাষায় -- শাক্ত-তান্ত্রিক। শক্তিদেবী অবশ্য বাঙালিসমাজে আরও নানা নামে পরিচিতা। তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিওরি নয়, প্র্যাকটিস্।

তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।

নিষাদদের কৌম (গোত্রীয়) সমাজটির গড়ন ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজবিকাশের অনিবার্য নিয়মে প্রথমে নিষাদসমাজ ছিল শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী। তারা বাংলার প্রাচীন অরণ্যে ফলমূল কুড়োত। পরে হাতিয়ারের উন্নতি হল; তারা বনভুমি কেটে জমি চাষ করতে থাকে। এভাবে ওদের কৃষি জীবনে উত্তরণ ঘটে । তবে অনুন্নত হাতিয়ারের (টুলস) কারণে কৃষিজীবন ছিল ভারি অনিশ্চিত। ওদিকে গোত্রের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। কাজেই প্রকৃতির কৃপার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কী!
সেই আদিম নিষাদসমাজটি মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলেই প্রকৃতিকে তারা ‘চৈতন্যময়ী’ ভেবেছিল। তারা নারীকে জগতের আদি কারণ বলেও ভাবল কাজেই অদৃশ্য প্রকৃতিক শক্তিটি ওদের আদিম মনে একজন দেবী হিসেবে প্রকাশ পেলেন, দেবতা হিসেবে নন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পূর্বে শিব ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধানতম অনার্য দেবতা। একইভাবে, প্রাচীন বাংলাতেও আর্যরা আসার পূর্বে শিব ছিলেন প্রধানতম অনার্য দেবতা। যে কারণে প্রকৃতিকে দেবী কল্পনা করলেও শিবের গুরুত্ব এতটুকু কখনওই হ্রাস পায়নি।

তন্ত্রের প্রধান একটি সিদ্ধান্তই হল এই যে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা।
কিন্তু, শক্তি কি?

বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার। যে শক্তিকে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আধুনিক সভ্যতা এই মূলতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সূত্র আবিস্কার করে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক এই প্রশ্নও তো আজকাল উঠছে । এই দৃষ্টিভঙ্গি হটকারী কিনা, পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে এই দর্শন সক্রিয় কিনা- এসব প্রশ্নও নিয়েও তো আমরা আজ উদ্বিগ্ন।

তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।

চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী কালী- বাসুলী – তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে “শিবত্ব” লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।

(c) Prithwish Ghosh
Share:

"পিতৃপক্ষ এবং মহালয়াতে তর্পন"

তর্পন হল সেই কর্ম যার দ্বারা আমরা আমাদের পূর্বে মৃত দের উদ্যেশে তিল জল দিয়ে থাকি। তর্পন হল দুই প্রকার যথা --- ১> স্থানাঙ্গ ২> নিত্য। প্রতিদিন পুকুরে বা নদীতে স্থানের সময় যে তর্পন করা হয় তা স্থানাঙ্গ তর্পন। এর দ্বারা প্রতিদিনই পূর্বপুরুষ দের উদ্যেশে জল দেয়া হয়। কিন্তু আমরা এখন তা করতে অসমর্থ, তাই আমরা নিত্য তর্পন করি পিতৃপক্ষে। যা আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথির পরদিন থেকে শুরু হয় এবং মহালয়ার দিন আমাবস্যা পর্যন্ত এই কার্য করা যায়। আমাবস্যার দিন পিতৃপক্ষের শেষ এবং মাতৃপক্ষের শুরু হয় বলে এই দিনে বেশীর ভাগ মানুষ তর্পন করে থাকেন।

যদি আপনার বাবা বা মা অথবা দুজনেই মারা গিয়েছেন তাহলে আপনার তর্পন করা বাধ্যতা মূলক কর্তব্য। শুধুমাত্র আপনার মাতা পিতার উদ্যেশে তর্পন করবেন তা কিন্তু নয়, আপনি আপনার বংশের যত অগ্রজ ব্যক্তি আছেন যারা মারা গেছেন পূর্বে তাদের নামেও তর্পন করতে হবে। শুধুমাত্র আপনার বংশের নয়, আপনার মায়ের বংশের মৃতদের উদ্যেশেও তর্পন করতে হবে। আপনার স্ত্রী থাকলে তাহলে তার বংশের মৃতদের উদ্যেশেও তর্পন করতে হবে।

এবার জেনে নেই তর্পন কত প্রকার -- ১) মনুষ্য তর্পন, ২) ঋষি তর্পন, ৩) দিব্য পিতৃতর্পন, ৪) যম তর্পন, ৫) ভীষ্ম তর্পন, ৬) রাম তর্পন, ৭) শূদ্র তর্পন।
আপনার আঘে আপনার বংশে যারা মারা গিয়েছেন তারা এখন কোথায় আছেন? কেউ স্বর্গে, কেউ নরকে আর কেউ যদি খুব ভাল কাজ করে তাহলে বৈকুন্ঠ, কৈলাশে অথবা আবার পূর্নজন্ম নিয়েছেন। তারা যেখানেই থাকুন না কেন তাদের আত্মার এক সময় জল পাবার ইচ্ছা করে। তারা তাদের বংশধর দের কাছে জল প্রার্থনা করে। সেই জন্য আমরা তর্পন করে থাকি। এতে করে তাদের আত্মার শান্তি হয়। শুধু মাত্র আমাদের পূর্বজদের নয়, দেবতা ঋষি আদি মহান ব্যক্তিদের উদ্যেশেও তর্পন করতে হয়।

তর্পন করলে আমাদের মধ্যে শান্তির সঞ্চার হয়। পূর্ব পুরুষদের আশীর্বাদে আমাদের মঙ্গল হয়। শুধু পূর্বপুরুষ দের নয়, দেবতা ঋষি আদি দের আশীর্বাদও আমরা পাব। অপরপক্ষে, যদি আমরা তর্পন না করি তাহলে আমাদের পূর্বজদের আত্মা পীড়িত হয় হয়, তারা বিভিন্ন ভাবে আমাদের বুঝাতে চায় তাদের তৃষ্ণার কথা। অনেকে তাকে ভূতে উপদ্রব মনে করে কারণ তারা জানে না যে তাদের পূর্বজদের জলের প্রয়োজন। তাছাড়া সংসারে নেমে আসে অশান্তি।

****** (হয়ত) এখন অনেকেই জানতে চাইবেন তর্পন কীভাবে করতে হয়। এক কথায় বলছি জলাশয়ে নেমে তিল-জলে মন্ত্র উচ্চারণ করে তর্পন করতে হয়। মন্ত্র-তন্ত্র যা আছে সেই গুলো চাইলে আমি লিখতে পারতাম তবে এতে আপনারা বুঝতে পারবেন না আর তা অনেক বিস্তারিতও। তাই একজন অভিজ্ঞ পুরোহিতের শরণাপন্ন হতেই হবে।

(c) Prithwish Ghosh
Share:

তন্ত্র ও 'পঞ্চ ম'-কারের সাধনা

তন্ত্র সাধনা একটা নেশা, যে কোনও কিছুর চেয়েও মারাত্মক নেশা। সাধারণে ভাবেন তান্ত্রিকেরা নেশা-ভাঙ করে, মাঝে মাঝে বেশ্যা এনে ফুর্তি করে, পঞ্চ ম-কারের সাধনা মানে মদ ও মহিলা ভোগ, তান্ত্রিকেরা সমাজে থাকতে পারে না, বা তাদের আলাদা একটা সমাজই আছে ইত্যাদি। আসলে তা মোটেই নয়, তন্ত্রশাস্ত্রে মানুষ প্রথম অবস্থায় পশু। প্রথম স্তরের যে মানুষ, স্ত্রী শক্তির সঙ্গত ছাড়া তার এক পাও উপরে ওঠার জো নেই, শক্তিকে আশ্রয় করেই তাকে এগোতে হয়। কারণ, পুরুষ শক্তির সঙ্গে প্রকৃতি শক্তির মিলন সম্পূর্ণ না-হলে সৃষ্টি হয় না। আর, পঞ্চ ম-কার এই পশু-স্তরের আচার। এই আচার শুধু তন্ত্রে নেই; ছাল চামড়া ছাড়ালে আমাদের আজকের তথাকথিত সভ্য সমাজেও দেখতে পাবেন। তন্ত্রে যা 'নিয়মানুগ', সমাজে তা ছাড়া গরু, অনিয়ন্ত্রিত, অপরিমিত, অমার্জিত --- তন্ত্রে এটা উপরে ওঠার রাস্তা, লোক-সমাজে তা নামার।

তান্ত্রিকেরা পারেন বাহ্যিক বিশ্বের পাশ কাটাতে, তাঁরা উৎকট সাধনে দিনের পর দিন কাটান। এ ভাবেই শেখেন ব্রহ্মাণ্ডের কোনও কিছুতেই ভয় না পেতে, জিততে শেখেন কামভাব, শেখেন গা ঘিনঘিন করা জিনিসকেও ঘেন্না না করতে। মন থেকে বাহ্যিক টানগুলো কেটে গেলেই তান্ত্রিক পূর্ণ জ্ঞান পান। তখন ওই পঞ্চ ম-কারের মানেই বদলে যায়।

-

সাধকদের কাছে মদ উত্তেজক নয় ----

মদ্য --

‘ব্রহ্মরন্ধ্র হতে যেই সুধা ঝরে অনিবার

পিয়ে মাতে সদানন্দে সেই মদ্যসাধক সার’।

মাংস --

‘মা শব্দে রসনা বুঝ, বাক্য তারই অংশ হয়,

সেই বাক্য রসনার অতি প্রিয় সুনিশ্চয়,

সে বাক্য ভক্ষণ করে বাকসংযত যেই,

নির্বাক সেই মহাসাধু মাংসের সাধক সেই’।

মৎস্য -----

ঈড়া-পিঙ্গলা ও সুষুম্নার ত্রিবেণীতে

যে সাধক সাঁতরে থাকে সুস্থ্য চিতে,

সে সাধক জানিবে ব্রহ্মময়ীর বৎস

সাধনায় সিদ্ধ হয়ে হয়েছে মৎস্য।

আর মৈথুন, তখন—

‘মৈথুন পরম তত্ত্ব সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কারণ,

ব্রহ্ম আর তাঁর শক্তির নাইকো বারণ,

তাহাতে হইলে সিদ্ধি সুদুর্লভ লভে ব্রহ্মজ্ঞান

এই মৈথুনে রত যেই সে মৈথুনের সাধক প্রধান।’

-

পার্থিব ভোগ-বাধা কাটিয়ে পরম শক্তির সঙ্গে এক, একাত্ম হয়ে যাওয়ার রাস্তা খুলে দেয় তন্ত্র। এ কাজে তার সহায় প্রকৃতিরই এক অমোঘ নিয়ম— রোজ এক খাবার খেলে কিছু দিনেই তা বিস্বাদ লাগে, রুচি হয় না। যাঁরা এই রুচি হারিয়ে খাদ্যের সারাৎসারটা বুঝতে পারেন, তাঁরা তন্ত্রাদর্শে প্রথমে বীর সাধক, পরে দেবতা।

তন্ত্র কল্পনায় আমাদের মেরুদণ্ডের আগাগোড়া একটি অতি সূক্ষ্ম পথ আছে। সেই পথই প্রাণের পথ বা নাড়ী। চোখের পলক ফেলতে যতটা সময় লাগে, সেই সময়ে ওই নাড়ী বরাবর প্রাণের যে কত বার ঊর্ধ্ব-অধঃ যাতায়াত হয়, তা ভাবা যায় না। তন্ত্রে এই প্রাণশক্তিকে ‘মা’ আর তাঁর গতিক্রিয়াকে নৃত্য বলা হয়েছে। অর্থাৎ মা নাচ্ছেন, সে নাচের বিরাম নেই। এই প্রাণশক্তির পথ ধরে এগোলে মেরুদণ্ডের একেবারে শেষ প্রান্তের উপরে একটি সূক্ষ্ণ ছিদ্র পথ পাওয়া যায়, যাকে বলে মূলাধার চক্র। লিঙ্গমূলে রয়েছে আর একটি ছিদ্র বা দ্বার। তান্ত্রিক নাম— স্বাধিষ্ঠান চক্র। সেই রকমই হৃৎপিণ্ডের সমসূত্রে মেরু পথে রয়েছে অনাহত চক্র। শরীরের গোপন শক্তির আরও কত উৎস! কণ্ঠের সমানে আছে বিশুদ্ধাক্ষ চক্র। যেখানে মেরুদণ্ড আরম্ভ, চলতি কথায় আমরা বলি দুই ভ্রূর মধ্যে, তাকে বলা হয় আজ্ঞা বা প্রজ্ঞা চক্র। তার উপরে পরমাত্মার রাজ্য— সহস্রার। তান্ত্রিক সাধনে এই ছয় চক্র ভেদ করা সম্ভব হলে জীব আত্মা পরমাত্মায় মিলিত হয়।

স্থুল ভাবের পশুপ্রবৃত্তিসম্পন্ন প্রথম স্তরের মানুষে এই জীবাত্মা প্রাণশক্তিকে অবলম্বন করে সাড়ে তিন পাক দিয়ে সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে, মূলাধার চক্রে অতি সূক্ষ্ণ দেহে থাকে। চৈতন্য বা সম্যক জ্ঞান পেলে জীবাত্মা পূর্ণ বিকশিত হয়। মূলাধার চক্রের গাঁট যাদের খোলে, তারা ঈশ্বরের টানে ছটফট করতে শুরু করে। গিয়ে ঠেকে প্রথমে স্বাধিষ্ঠান, পরে মণিপুর-চক্রে। এই অবধিই যা কিছু বিত্তবাসনার টান। প্রথমের এই তিন চক্র ছাড়ানোই ভীষণ কষ্টের। ব্যাপারটা আরও ভাল বুঝিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বলেছেন ‘‘যখন সংসারে মন থাকে, তখন, লিঙ্গ, গুহ্য ও নাভি মনের বাসস্থান, মনের চতুর্থ ভূমি হৃদয়, তখন প্রথম চৈতন্য হয়েছে। তখন আর নীচের দিকে মন যায় না। মনের পঞ্চম ভূমি কণ্ঠ। মন যার কণ্ঠে উঠেছে, তার ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোনও কথা শুনতে বা বলতে ভাল লাগে না। মনের ষষ্ঠ ভূমি কপাল। সেখানে অহর্নিশি ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন হয়। শিরোদেশে সপ্তম ভূমি। সেখানে মন গেলে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন মেলে।’’ এটাই তন্ত্র-সাধনা। এ বিদ্যা পুরোপুরি গুরুমুখী। গুরু সহায় না হলে প্রতি পদে পা হড়কানোর ভয়।

----- তন্ত্র সাধনা মূল শক্তি দেয়, বাইরের নয়, ভিতরের। শক্তি চালনার ক্ষমতা পেলে নিজেকে সামলানো বড়ই কঠিন। তা ছাড়া, প্রতি পদে থাকে প্রলোভন। অর্থ, ক্ষমতা সব শক্তিই দেন কালী। অনেক সাধক তখন চার হাত-পায় ভোগে লেগে যায়, প্রবৃত্তি তার ঘাড়ে চেপে বসে। ফলও হয় মারাত্মক। যেখানে সেখানে শক্তি প্রয়োগ করে শেষে এক দিন শক্তি বিলকুল উবে গিয়ে জীবনটাই মিছে হয়ে যায়। এমন পচা কাদায় পড়ে যে, আর ওঠার ক্ষমতা থাকে না। প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টাও যেখানে বিফল। এ পথ খেলুড়ে বা হঠকারীদের জন্য নয়। -- লাল-কালো শালু পরে, গলায় রুদ্রাক্ষ মালা দিয়ে, কপালে লাল সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে, 'জয় জয় তারা' আওয়াজ করে তারাপীঠে বসত করে সিদ্ধিলাভ হয় না, মনই হ'ল একমাত্র তীর্থ। মনঃসংযম হ'ল তান্ত্রিকের সর্বপ্রধান অস্ত্র।

(c) Prithwish Ghosh
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।