• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী ।  পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।


এই শহরের সূচনা সেই গান্ধার যুগে এবং এখানেই রয়েছে প্রাচীন গান্ধারি শহর তক্ষশীলার পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। প্রাচীন তক্ষশীলা শহর ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং বর্তমান সময়েও উক্ত ধর্মদুটির ঐতিহ্যে এ স্থানটির একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৮০ সালে বেশকিছু এলাকাসহ তক্ষশীলাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষনা করা হয়। গার্ডিয়ান পত্রিকা ২০০৬ সালে এটিকে পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যটন স্থান হিসেবে নির্বাচিত করে।
তক্ষশীলার বৌদ্ধবিহার
তক্ষশিলায় প্রাপ্ত মূর্তি
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত খ্রিষ্টপূর্ব- ২০০-১০০ অব্দের তক্ষশীলার মুদ্রা

 হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে— দশরথের পৌত্র এবং ভরত গান্ধার দেশ জয় করে নিজের পুত্র তক্ষের নামানুসারে তক্ষশীলা ও পুষ্কলের নামানুসারে পুষ্কলাবতী নগর স্থাপন করেন । মহাভারতের মতে এই স্থান গান্ধারের অন্তর্গত। রাজা জনমেজয় এই নগরীতে সর্পযজ্ঞ করেছিলেন। এই নগরীর ভগ্নাবশেষ এখনও বর্তমান।



কিংবদন্তীতে রয়েছে, তক্ষ একটি রাজ্য শাসন করতেন যার নাম ছিল তক্ষ খন্ড এবং তিনিই তক্ষশীলা নগরের প্রতিষ্ঠা করেন। দামোদর ধর্মানন্দ কসামবি প্রবর্তিত অন্য একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, তক্ষশীল নামটি তক্ষক শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত যা ছুতার বা সূত্রধর শব্দের সংস্কৃতরূপ এবং এই শব্দটি প্রাচীন ভারতের নাগা জনগোষ্ঠীর অপর একটি নাম। এই জাতির নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছিল তক্ষখণ্ড। কালক্রমে তক্ষখণ্ড নামটি তক্ষশীলা নামে পরিবর্তিত হয়।


খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৪৬৫ অব্দের ভিতরে পারশ্যে রাজারা এই অঞ্চলে অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ঐতিহাসিক প্লিনির মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৫৩০ অব্দের ভিতরে পারশ্য সম্রাট কাইরাস ভারতে কয়েকবার আক্রমণ করেন এবং কপিশা নগরী দখল করতে সমর্থ হন। আরিয়ান নামক অপর একজন ঐতিহাসিকের মতে- কাইরাস কাবুল ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল দখল করে নেন এবং এই অঞ্চল থেকে কর আদায় করতেন। কাইরাসের তৃতীয় উত্তরসূরী সম্রাট প্রথম দারায়ুস খ্রিষ্টপূর্ব ৫২২ অব্দ থেকে ৪৮৬ অব্দের ভিতরে গান্ধার, সিন্ধু-উপত্যাকা এবং পাঞ্জাব দখল করেন। এরপর জারেক্সিস খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের উপরে আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। এই সময় এই অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার সাথে তক্ষশিলাও পারসিকদের অধিকারে ছিল।খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৫ অব্দের দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তক্ষশীলা পরিদর্শন করেন এবং এই স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দেআলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। এই সময় তক্ষশিলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তক্ষশিলায় অভ্যর্থনা করেন। এরপর অভিসার জাতির নেতাও আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। এরপর আলেকজান্ডার তক্ষশিলা থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ঝিলম নদী পার হয়ে পুরুর রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের আগে ঝিলম ও বিপাশা নদীর মধ্যাভাগের অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন। এরপর চন্দ্রগুপ্তের গুরু এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের (চাণক্য) পৃষ্ঠপোষকতায় তক্ষশিলায় রাজত্বের পত্তন করেন চন্দ্রগুপ্ত। কালক্রমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিশাল রাজত্বের অধিকারী হন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র বিন্দুসারে কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর, তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিন্দুসারে নির্দেশে তাঁর যুবরাজ অশোক তক্ষশীলার বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে অশোক রাজত্ব লাভ করেন। তখন মৌর্য রাজাদের রাজধানী ছিল পাটালীপুত্র। কিন্তু তক্ষশিলা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। অশোক পাটালিপুত্র থেকে তক্ষশিলার ভিতরে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেন।

খ্রিষ্টাপূর্ব ১৮৫ অব্দের দিকে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেন তাঁর সেনাপতি পুষ্যমিত্র। এই সময় মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথের আত্মীয় যজ্ঞসেন বিদর্ভের স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা দেন। পুষ্যমিত্রের সাথে যজ্ঞসেনের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হলে, যজ্ঞসেন পরাজিত হন। পরে যজ্ঞসেনের দুই আত্মীয়ের ভিতর বিদর্ভরাজ্যকে ভাগ করে দেওয়া হয়। পুষ্যামিত্রের রাজত্বকালে গ্রিকরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলে, গ্রিকরা পরাজিত হয়। পুষ্যামিত্র বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী ছিলেন। ফলে তাঁর সময় তক্ষশীলা গুরুত্ব হারাতে থাকে। অনেকে মনে করেন এই সময় তক্ষশীলারা বৌদ্ধ-স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে পুষ্যামিত্র পরলোক গমন করার পর, তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র বিদিশার ক্ষমতা দখল করেন এবং বিদর্ভরাজকে পরাজিত করেন। অগ্নিমিত্রের পর পর এদের উত্তরপুরুষরা রাজত্বের সমৃদ্ধিকে বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। এই বংশের শেষ সম্রাট সুমিত, মুলাদেব নামক এক আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপর এই অঞ্চলে শুঙ্গবংশের রাজত্ব শুরু হয়। এই রাজবংশের রাজত্বকালে গ্রিকরা তক্ষশীল দখল করে নেয়। এরপর শকদের কাছে গ্রিকরা ক্ষমতা হারায় এবং তক্ষশিলা শকদের অধীনে চলে যায়। এপর শকদের উৎখাত করে ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে কুষাণ রাজবংশ। কুষাণদের রাজ্য বিস্তারের সময় তক্ষশীলা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তী সময় কুষাণ রাজবংশের শাসনমলেই তক্ষশিলা আবার তার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে থাকে। কালক্রমে তক্ষশীলা বৌদ্ধদের বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্রে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। বৌদ্ধ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, হিন্দু রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তশালী হয়ে উঠে। বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী রাজাদের দ্বারা তক্ষশীলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্র হীন কাঠামোতে পরিণত হয়। এবং তক্ষশীলা জন-পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হয়। ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে তক্ষশীলায় সর্বশেষ আক্রমণটি আসে হুনদের পক্ষ থেকে। এরপর পুরো তক্ষশীলা ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়:

ব্যবেলিয়ন, গ্রীস, সিরিয়া, পারস্য, আরব, চীন সহ পৃথীবির বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্যা লোভী ছাত্ররা এখানে এসে ভীড় করত প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থা,  এবড়ো থেবড়ো অমসৃন পথের দুঃসহ যন্ত্রনা ও যাত্রা পথে মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে উচ্চ শিক্ষার হিরন্ময় সাফল্য লাভের আসায়।
তক্ষশীলায় যাওয়া আসার তিনটি প্রধান পথ খোলা ছিল সেসময়-
উত্তরা পথঃ ভারত বর্ষের তৎলালীন মগধের রাজধানী পাটালিপুত্র হয়ে গান্ধারা রাজ্যে প্রবেশ করেছিল।
উত্তর-পশ্চিমা পথঃ বেকট্রিয়া, কেপিসা হয়ে পুষ্কালাভাটি। অর্থাৎ এই পথটি বর্তমানে গ্রীক, ইরান, চীন উজবেকস্থান, আফগানিস্থান হয়ে পেশোয়ারে প্রবেশ করেছিল।
সিন্ধু পথঃ কাশ্মির, শ্রীনগর, পাকিস্তানের খাইবার পাক্তুনখোয়া, হরিপুর উপত্যকা, চীন হয়ে মধ্য এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত।
এই সব যাত্রা পথের বিপদ, ক্লান্তি ও দুঃস্বপ্নকে জয় করে তক্ষশীলায় দেশী বিদেশী ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০,৫০০ ছাত্রদের লেখা-পড়া, থাকা-খাওয়া বাবদ প্রচুর পয়সা গুনতে হত তক্ষশীলায়। বয়স কম পক্ষে ১৬ বা তার চেয়ে বেশী বয়সের শিক্ষার্থীদের এখানে ভর্তির সুযোগ দেয়া হত। তবে শর্ত ছিল তাদের অবশ্যই নিজ নিজ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার অধ্যায়টি শেষ করে এসে তক্ষশীলায় পড়ার উপযুক্ততা প্রমান দিতে হবে। নগদ পয়সা ছাড়াও সোনা দানা জমা দিয়েও পড়ার ব্যবস্থা ছিল। পড়াশুনার খরচ বাবদ ধনী ছাত্রদের কাছ থেকে অগ্রিম ১০০০ মুদ্রা বা কম বেশী অর্থ জমা নেওয়া হত। মেধাবী অথচ হত দরিদ্রদের বিশেষ ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। নিয়ম এত কঠোর ছিল রাজার ছেলে হয়েও যোগ্যতা প্রমানে ব্যর্থ হলে তক্ষশীলায় পড়ার কোন প্রকার সুযোগ দেয়া হত না। ছাত্রদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের পছন্দসই বিষয় পড়ার সুযোগ থাকত। ভেদাস, ভাষা, ব্যাকরন, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, ধনু বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধ বিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান, গনিত, অর্থনীতি, গান, নাচ, হস্তশিল্প, ইত্যাদি বিষয় সহ এখানে কোর্সের সংখ্যা ছিল ৬০ ঊর্ধ। কোর্স চলাকালীন সময় শিক্ষক যদি মনে করেন তাঁর কোন ছাত্র ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ার উপযুক্ত নয় বা কোন কারনে উপযুক্ততা হারিয়েছে সেক্ষেত্রে শিক্ষক চাইলে তাকে  বিদায় করার ক্ষমতা রাখতেন। প্রায় প্রত্যেকটা পাঠ্য বিষয়ের মেয়াদ ছিল ৮ বছর ব্যাপি। দিনের সাথে সাথে রাতের বেলায়ও শিক্ষক ছাত্রের বিদ্যা দান ও গ্রহনের অপূর্ব কোলাহলে চঞ্চল থাকত এই শিক্ষানিকেতন।
আধুনিক কালের এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা যুগের সূচনার আগে মানুষের জীবন রক্ষায় একমাত্র ভরসা ছিল গাছ-পালা, কান্ড, ফল-মূলের নির্যাস দিয়ে তৈরী ঔষধ। চিকিৎসা শাস্ত্রে যা ভেষজ বা আয়ুর্বেদ নামে পরিচিত। বর্তমানে অবশ্য তা হারবাল চিকিৎসা নামে সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। তক্ষশীলা ছিল ভেষজ ও শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যার প্রাণ কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন রোগের কারন ও প্রতিকার নিয়ে চলত দিন রাত গবেষনা। রোগ যন্ত্রনা নিয়ন্ত্রন ও মানুষেয় দীর্ঘ আয়ু লাভের প্রচেষ্টায় বছরে বছরে উৎপাদন করা হত প্রচুর চিকিৎসক। তাদের অনেকে নিজ সৃষ্টি কর্মের যোগ্যতা, প্রতিভা ও নিরলস প্রচেষ্টায় স্থান দখল করে উজ্জ্বল হয়ে আছেন প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা ইতিহাসের পাতা জুড়ে।
সাফল্যের সাথে কোর্স শেষে কোন প্রকার সনদ প্রদানের ব্যবস্থা সে আমলে গড়ে না উঠলেও শিক্ষা শেষে ছাত্ররা নিজ নিজ দেশে ফিরে আসলে মর্যাদা পেত বরেণ্য পন্ডিত ব্যক্তি রূপে। কোন ছাত্র তার শিক্ষা খরচ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাকে গুরু গৃহের কৃষিকাজ, পানি আনা, আগুনের জন্য শুকনো কাঠ জোগাড় করা সহ বিভিন্ন গৃহস্থালি কাজ করে তা শোধ করার রেওয়াজ ছিল তক্ষশীলায়।
সেই সময় সম্ভবত নারীদের উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন অবকাঠামো তৎলালীন সমাজে গড়ে উঠেনি। তক্ষশীলায় নারী শিক্ষার কোন প্রমান এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য পণ্ডিতবর্গ:


০১. চাণক্য (অর্থনীতিবিদ):

তক্ষশীলা ও চাণক্য যেন ছাপানো মুদ্রার এপিট ওপিট। তক্ষশীলা নিয়ে কোন কথা উঠলেই যেমন চাণক্যর নাম আসে অবধারিত ভাবে তেমনি চাণক্যর জীবনী তক্ষশীলাকে বাদ দিয়ে আলোচনা করলে তা হবে অসম্পূর্ন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, প্রখর মেধা, বাস্তববাদী ও অসাধারন পান্ডিত্যের অধিকারী এই মহা পুরুষ টির শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্ম জীবনের প্রথম অধ্যায়টি কাটে তক্ষশীলায়।তিনি তক্ষশীলার রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে আচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন।

ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম নেয়া মহাপুরুষটির পিতা মাতার দেয়া নাম ছিল “বিষ্ণুপদ”। “কূটিলা গোত্র” থেকে এসেছেন বলে গোত্র নামকে অক্ষয় করতে “কৌটিল্য” ছদ্ম নামে লেখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “অর্থশাস্ত্র”। নামে “অর্থশাস্ত্র” হলেও মূলত তা ছিল রাজ্য শাসন ও কূটনৈতিক কলা কৌশল বিষয়ক সুপরামর্শ।“অর্থশাস্ত্র”র মোট ভাগ ১৫ টি। গ্রন্থে মোট শ্লোক সংখ্যা ৬০০০ রাষ্ট্র বিজ্ঞান, শত্রু দমন, রাজস্ব, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, প্রভৃতি রাষ্ট্র ও জন কল্যান মূলক বিষয় নিয়ে এই ১৫টি ভাগ গঠিত। খ্রীষ্ট পূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে “চানকা” গ্রামে জন্ম নেওয়ায় বিষ্ণুপদ “চানক্য” নামে ব্যাপক পরিচিতি পান। আবার কোন কোন ইতিহাসবিদদের ধারনা পিতার নাম “চানক” অনুসারে তাঁর নাম হয় “চাণক্য”।

মগধ রাজা “ধনানন্দ”র রাজসভা থেকে বিতাড়িত হয়ে “চাণক্য” ও দাসী “মুরা”র গর্ভে জন্ম নেওয়া “ধনানন্দ”র সৎভাই রাজ্য থেকে বিতারিত “চন্দ্রগুপ্ত” দুজনে মিলে অপমানের প্রতিষোধ নিতে গড়ে তোলেন এক বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী। যা নন্দ বংশের রাজা “ধনানন্দ”কে শেষ পর্যন্ত পরাজিত করে গোড়াপত্তন করেন ইতিহাসখ্যাত “মৌর্যবংশ”।

০২. পাণিনি (ব্যাকরণবিদ, অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণের রচয়িতা):

গান্ধারা রাজ্যের “শালাতুর” বর্তমান লাহোরে জন্ম নেয়া পাণিনি তক্ষশীলা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আরেক মহান সৃষ্টি। তাঁর জন্ম সন নিয়ে প্রচুর মতানৈক্য আছে ইতিহাসবিদদের মাঝে। তিনি “অষ্টাধ্যায়ী” নামক সংষ্কৃত ব্যাকরণ রচয়িতা হিসাবে বেশ সুপরিচিত। এই গ্রন্থে তিনি সংষ্কৃত রূপমূলতত্ত্বের ৩৯৫৯টি নতুন নিয়ম যোগ করেন। “অষ্টাধ্যায়ী” প্রাচীন সংষ্কৃত ভাষায় রচিত ব্যাকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে শব্দের উৎপত্তি, ধ্বনি তত্ত্ব, বর্ণমালা, উচ্চারণ, সন্ধির নিয়ম কানুন বিজ্ঞান সন্মত করে উপস্থাপন করে গেছেন অত্যন্ত সাবলীল ভাবে।
পণি বা পাণিন হল একটি গোত্রের নাম। গোত্রের নামানুসারে তাঁর নাম হয় “পাণিনি” তাঁর পিতার নাম ছিল শলঙ্ক।তাই পণিনির আরেক নাম “শালাঙ্কি”। তাঁর মা ছিলেন দক্ষ জাতির কণ্যা। তাই অনেকে আবার তাঁকে “দাক্ষিপুত্র” নামেও অভিহত করেন।
০৩. চরক (চিকিৎসক, চরক সংহিতা নামক আয়ুর্বেদ-গ্রন্থের রচয়িতা): 

২০০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করা চরক চিকিৎসা শাস্ত্রে তক্ষশীলার আরেক বিস্ময়কর অবদান। যোগ সাধনা চর্চার জন্য অনেকে আবার তাকে চরক মুনি বা ঋষি হিসাবে ডেকে থাকেন। তাঁর অনেক অনুসারী ছিল। ছিলেন কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্র “চরক সংহিতা” রচনা করে।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসাকে এই বই এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক ছোঁয়া। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয় এই “চরক সংহিতা”এই গ্রন্থে তিনি ৫০০ ঔষধের বর্ননা লিপি বদ্ধ করেছেন।
চরক-সংহিতায় মতে “তাকেই বলে ভেষজ যাতে হয় আরোগ্য”।
চরক ও সুশ্রম্নত সংহিতায় উল্লেখ আছে কাঁচা আমলকির রসের সাথে ২/১ কোয়া রসুন বাটা খেলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়। অতএব আর দেরি নয়, কোন রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনাও একেবারে শুন্যের কোঠায়। দীর্ঘ যৌবন প্রত্যাশীরা যৌবন ধরে রাখতে শেষ চেষ্টা চালিয়ে দেখতে পারেন একবার।
০৪. জীবক (শৈল্য চিকিৎসক, গৌতমবুদ্ধের চিকিৎসক):

তক্ষশীলার শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যায় জীবক ছিলেন আরেক অনন্য সৃষ্টি। ইতিহাসবিদদের মতে তার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ থেকে ৪৮৬ অব্দের কোন এক সময়ে। তিনি প্রায় ৭ বছর তক্ষশীলায় চিকিৎশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। তিনি ছিলেন মগধ রাজ্যের অধিপতি রাজা বিম্বিসার ও বুদ্ধের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। জীবক ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক এবং প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের আরেক নক্ষত্র আত্রেয়-এর সেরা শিষ্য। তিনি শরীর ও শল্য উভয় বিদ্যায় সমানে দক্ষতা অর্জন করেন। রোগীর নাড়ী পড়ার অপূর্ব ক্ষমতা রাখতেন তিনি। ছিলেন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ। জটিল অপারেশনেও তাঁর ক্ষমতা ছিল বলে শোনা যায়। রোগ নির্ণয় এবং তার প্রতিষেধক নিয়ে জীবক লিখিছিলেন অসংখ্য গ্রন্থ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাশ্যপ-সংহিতা।
ছাত্রবস্থায় চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর প্রজ্ঞা নিয়ে একটি গল্প চালু আছে তা হলো- তক্ষশীলার জনৈক শিক্ষক তার ছাত্রদের একটি বাগানে নিয়ে বলেন সেখান থেকে গুন হীন উদ্ভিদ খুঁজে বের করতে। শুরু হল খোজা খুজির প্রতিযোগীতা কিন্তু জীবক বাদে অন্য শিষ্যরা তাদের মতে নির্গুণ উদ্ভিদ হাত বোঝাই করে এনে তুলে দেন গুরুর হাতে। কিন্তু জীবক অনেক খোজা খুজি করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলেন ভগ্ন হৃদয়ে শুন্য হাতে। ফিরে এসে তাঁর শিক্ষককে জানালেন তিনি এমন কোনো উদ্ভিদ খুঁজে পাননি যার ভেতরে কোন না কোন গুণ নেই। শিক্ষক যারপরনাই খুশি হয়ে বলল্লেন একমাত্র জীবকের শিক্ষাই সম্পূর্ণ হয়েছে।
এছাড়াও রাজা প্রসেনজিত, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, মোহালির মত আরো অসংখ্য ইতিহাসিক ব্যক্তিত্ব রাত-দিন নীরব নিভৃতে সুনিপুন ভাবে তৈরী করে গেছে এই মহান প্রতিষ্ঠানটি।
চাণক্য, আত্রেয়, বিষ্ণু শর্মা, নাগার্জুনের মত ইতিহাস খ্যাত প্রথিযশা জ্ঞান তাপস পন্ডিত ব্যক্তিদের শিক্ষক রূপে পেয়ে তক্ষশীলার সুখ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল অনতিক্রম্য উচ্চতায়, দ্রুত নজর কেড়েছিল বিশ্ব দরবারে। তক্ষশীলার খ্যাতির পরশ গ্রিক সেনাপতি আলেকজেন্ডারকে এতটাই তন্ময় করেছিল তিনি তক্ষশীলা দখল করার পর সাথে করে কিছু শিক্ষক তার সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রাচীন শিল্প সভ্যতায় উন্নত গ্রীক সভ্যতাকে আরো গতিশীল করার মানসে।
ছাত্রদের সুশিক্ষা, পন্ডিত শিক্ষকদের সৎ,মানবিক, সুস্থ চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ শুধু বাক সর্বস্ব ছিল না, তার প্রয়োগিক চর্চা করতেন তাদের ব্যবহারিক জীবনে। আমারা তার ঐতিহাসিক প্রমান পাই আলেকজেন্ডারের আগ্রাসী আক্রমনে যখন গৃহ, সহায়-সম্বল, ভিটা-মাটি অর্থ-বিত্ত সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচতে তক্ষশীলার কোলে আশ্রয় নেয়। এই অনাকাঙ্খিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কি করা উচিত তা নিয়ে তক্ষশীলার রাজা এক পরামর্শ সভার আয়োজন করে। সে সভায় তক্ষশীলার শিক্ষক মন্ডলি এই সব উদ্বাস্তু লোকদের তক্ষশীলায় ভূমি দানে তাঁদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সভ্যতাকে প্রগতির পক্ষে পরিচালিত করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে উৎপত্তি বিলয়ের জাগতিক ব্যতয়হীন নিয়ম রক্ষার্থে বোধহয় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গেছে সাম্রাজ্যবাদী পারস্য, গ্রীক, রোমান, শক, কুষান, আক্রমণ। এই সব আক্রমনে সৃষ্ট অস্থির রাজনৈতিক ঘোর অন্ধকার পরিমন্ডলে আগুয়ান অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনতার দুশ্চিন্তায় ক্রমে ক্রমে হ্রাস পেতে শুরু করে শিক্ষক ও ছাত্র সংখ্যা। ৪৫০ খ্রীষ্টাব্দে সর্ব শেষ আক্রমণটি আসে হুন দের পক্ষ থেকে। এভাবে বার বার সাম্রাজ্যবাদীর হিংস্র থাবার কবলে পড়ে ধীরে ধীরে মৃত্যু গ্রাস করে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ব বিদ্যালয়টিকে। স্তব্দ হয় তার পথ চলা। শোকের মাতমে যেন অব্যবহৃত ইট সুড়কির দালান কোঠা গুলোতে ধুলোর আস্তর ঢেলে স্মৃতি সমাধি তৈরী করে প্রকৃতি নিজের হাতেই।

সূত্র:
ভারতের ইতিহাস। অতুলচন্দ্র রায়/প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
 এবং মুক্তমনা বল্গ হতে ।

ছবিঃ নিরঞ্জন হাওলাদার ও উইকিপিডিয়া হতে


Share:

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী

 (জন্মঃ  ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪ টঙ্কর, অধুনা গুজরাট ও মৃত্যুঃ ৩০ অক্টোবর ১৮৮৩ (৫৯ বছর) আজমির, রাজস্থান জাতীয়তাঃ ব্রিটিশ ভারতীয় )

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী একজন গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক এবং আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । পশ্চিম ভারতের কাথিয়াওয়াড়ের মোরভি শহরে এক ধনাঢ্য নিষ্ঠাবান সামবেদী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর গার্হস্থ্যাশ্রমের নাম মূলশংকর । বাল্যশিক্ষা পিতার কাছেই লাভ করেন । ইংরাজি শিক্ষার সুযোগ না হওয়ায় প্রথম থেকেই তিনি সংস্কৃতশাস্ত্র উত্তমরূপে আয়ত্ত্ব করেন এবং ধীরে ধীরে সমগ্র যজুবেদ ও আংশিকভাবে অপর তিন বেদ, ব্যাকরণ, তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র, কাব্য, অলংকার, স্মৃতি প্রভৃতিতে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন ।

''আর্য সমাজ''   হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের জন্য স্বামী দয়ানন্দ কর্তৃক ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি হিন্দু সংগঠন। তিনি একজন বেদ প্রচারক সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি ব্রহ্মচর্যের আদর্শের উপর জোর দিয়েছিলেন।

বৈদিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাঃ
-----------------------

১৮৬৯ থেকে ১৮৭৩ এর মধ্যে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ভারতে তাঁর প্রথম সংস্কার প্রচেষ্টা চালান। এই প্রচেষ্টা ছিল মূলত “বৈদিক বিদ্যালয়” বা “গুরুকূল” স্থাপনের লক্ষ্যে যা শিক্ষার্থীদের বৈদিক জ্ঞান, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে গুরুত্ব প্রদান করে। প্রথম বিদ্যালয়টি ১৮৬৯ সালে ফররুখাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয় মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থীদের নিয়ে। প্রারম্ভিক সাফল্যের দরুণ মির্জাপুর(১৮৭০), কাসগঞ্জ (১৮৭০), চালিসার (আলীগড়) (১৮৭০) এবং বারাণসী (১৮৭৩)-তে দ্রুত বেশ কিছু বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বৈদিক বিদ্যালয় সমূহ মূলত স্বামী দয়ানন্দের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের প্রায়োগিক প্রয়াসকেই তুলে ধরে। সেগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। একদিকে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ঐতিহ্যগত মূর্তিপূজা করতে পারত না, বরং তাদের প্রতিদিন দুবার সন্ধ্যা বন্দনা ও অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করতে হত। তারা ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ। অন্যদিকে তাদের সমস্ত খাবার, বাসা, পোশাক এবং বই বিনামূল্যে দেয়া হত এবং অ-ব্রাহ্মণরাও সংস্কৃত পাঠ করতে পারত। তাদেরকে প্রধানত বেদ শিক্ষা দেয়া হত। বৈদিক বিদ্যালয়সমূহ দ্রুতই বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়।

আর্যসমাজের মূলনীতি:
---------------------

আর্য সমাজ মূলত স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রবর্তিত দশটি নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিয়মগুলো হচ্ছে:

    ০১/ সব সত্যবিদ্যা এবং যা পদার্থবিদ্যা দ্বারা জানা যায় সেসবের আদিমূল পরমেশ্বর।

    ০২/ ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অনুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, অজর, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র ও সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র তাঁরই উপসনা করা উচিত।

    ০৩/ বেদ সব সত্যবিদ্যার পুস্তক, বেদের পঠন-পাঠন, শ্রবণ ও শ্রাবণ সবল আর্যের পরম ধর্ম।

   ০৪/  সত্য গ্রহণে ও অসত্য পরিত্যাগে সদা উদ্যত থাকবে।

  ০৫/   সব কাজ ধর্মানুসারে অর্থাৎ সত্য ও অসত্য বিচারপূর্বক করা উচিত।

   ০৬/  সংসারের উপকার করা এই সমাজের মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থাৎ শারীরিক, আত্মিক ও সামাজিক উন্নতি করা।

    ০৭/ সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্বক ধর্মানুসারে যথাযোগ্য ব্যবহার করা উচিত।

    ০৮/ অবিদ্যার নাশ ও বিদ্যার বৃদ্ধি করা উচিত।

    ০৯/ প্রত্যেককে নিজের উন্নতিতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়, কিন্তু সবার উন্নতিতে নিজের উন্নতি ভাবা উচিত।

   ১০/  সব মানুষকে সামাজিক সর্বহিতকারী নিয়ম পালনে পরতন্ত্র এবং প্রত্যেক হিতকারী নিয়মে সবাইকে স্বতন্ত্র থাকা উচিত।


দর্শনঃ

 চার বেদ সংহিতার উপর গড়ে ওঠা ত্রৈতবাদী বৈদিক দর্শন এবং এটি ষড় দর্শনের পাশাপাশি নিরুক্ত ও নিঘণ্টুতেও পাওয়া যায় যা পাণিনিয় ব্যাকরণ সমর্থিত

সাহিত্য কর্মঃ সত্যার্থ প্রকাশ (১৮৭৫)

উদ্ধৃতিঃ

"ওঁ বিশ্বানি দেব সবিতর্দুরিতানি পরা সুব। য়দ্ভদ্রং তন্ন আ সুব।।"
Share:

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০১ ( গান্ধার )

আজ থেকে নিয়মিত পরিচয় করিয়ে দিব আপনাদের প্রাচীন সেই সব শহর ও জায়গাগুলো এবং সেগুলোর বর্তমান ভৌগলিক অবস্থান যেগুলোর কথা উল্লেখ ছিল ‘মহাভারতে’’এবং ৫০০০ খ্রিস্টপূর্ব  হতে ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব  সময়কার ।

গান্ধার ( বর্তমনে সিন্ধু প্রদেশ, রাওয়ালপিন্ডি, উত্তর পাকিস্থান ও আফগানিস্তানের কান্দাহার ):

প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের ভগ্নাবশেষ
এটি একটি সুপ্রাচীন পৌরনিক শহর মহাভারতের সময়কার । এটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সিন্ধু নদীর পশ্চিমে এবং আফগানিস্তানের কান্দাহার অবস্থিত । ধৃতরাষ্টের স্ত্রী গান্ধারী ছিল গান্ধার রাজ্যের রাজা সুবলের কন্যা । গান্ধারীর ভাই শকুনি ছিল দূর্যোধনের মামা । দুর্যোধনকে তিনি নানান কুবুদ্ধি দিতেন। কালকূট বিষ প্রয়োগ করে ভীমকে হত্যা, জতুগৃহে কুন্তি সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা,ইত্যাদি ষড়যন্ত্রে শকুনির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সে ছলের আশ্রয় নিয়ে পান্ডবদের পাশা খেলায় হারিয়ে সবকিছু কেড়ে নিয়ে বনবাসে পাঠিয়েছিল । তার এই জালিয়াতির কারনেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সুত্রপাত ঘটে । যুদ্ধ শুরু হবার আগে শকুনির পুত্র উলুক দুর্যোধনের দূত হিসেবে দুর্যোধনের শিখিয়ে দেওয়া অভদ্র অশ্লীল কথাগুলো পাণ্ডব পক্ষকে গিয়ে শোনালেন। সহদেব সেই শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে শপথ করলেন যে, শকুনির সামনে প্রথমে উলুককে হত্যা করে,তারপর তিনি শকুনিকে বধ করবেন। যুদ্ধের শেষ দিনে সহদেবের হাতেই শকুনি-পুত্র উলুক ও শকুনির মৃত্যু হয়।


মহাভারতের সময়ের ভারতবর্ষ

আফগানিস্তানে এখনও পর্যন্ত মহাভারত সময়কালীন অনেক প্রাচীন হিন্দু মন্দির অবস্থিত । পূর্বে আফগানিস্তান শাসন করত হিন্দু শাহী রাজারা । তারা দশম শতাব্দী পর্যন্ত এই সনাতন ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছিলেন । কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামের অভ্যুথানের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে ঐ দেশের প্রধান ধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম স্বীকৃতি লাভ করে । দেশটিতে এখনও পর্যন্ত অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাস করে । যাদের অনেকেই বংশগত পরম্পরায় এখনও পর্যন্ত টিকে রয়েছে। সনাতনী সম্প্রদায়ের অধিকাংশই বাস করে আফগানিস্তানের কাবুল এবং কান্দাহারে । হিন্দু শাহী রাজাদের আমলে ‘কাবুল’ ছিল তখন প্রধান রাজধানী । 





বৈদিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে তখন শাহী রাজাদের আমলে প্রচলিত স্বর্নের দিনারে দেবাদিদেব শিবের মনোগ্রাম স্থাপিত ছিল ।

শাহী রাজা কিংগালের আমলে ৫ম শতাব্দিতে স্থাপিত শ্রী গণেশের মূর্তিও অবস্থিত যেটি আফগানিস্তানের গার্ডেজে দেখতে পাওয়া যেত । তবে এখন মূর্তিটি কাবুলের দার্গ পীর রঞ্জন নাথ নামক স্থানে স্থাপিত রয়েছে । যদিও মূর্তির বিভিন্ন অংশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে । এই স্থানটিতেও অনেক হিন্দু মন্দির রয়েছে । কান্দাহারের শিখাপুর বাজার, কাবুলি বাজার, যাম্পীর সাহীব এবং দেবী দেওয়ার, চাসমা সাহীব, সুলতানপুর, জালালাবাদ, ঘজনী, হেলমান্ত(লম্বারগ) এবং কুন্তজ নামক আঞ্চলেও অনেক প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায় । 


পাকিস্থান ও আফগানিস্তানের এসব প্রাচীন নিদর্শনসমূহ ও শকুনি মামার রাজ্যের প্রাচীন সংস্কৃতিসমূহ থেকে আমাদের এটি উপলব্ধি করতে বাধ্য করে যে, সনাতন ধর্মের সংস্কৃতি বহু প্রাচীন এবং মহাভারতের কাহিনীসমূহ কাল্পনিক নয় বরঞ্চ চির শাশ্বত ও বাস্তব । যার প্রমাণ পাকিস্থান ও আফগানিস্তানের এ নিদর্শনসমূহ ।











ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ নিরঞ্জন হাওলাদার
Share:

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শ্রাদ্ধ মানে শ্রদ্ধা

মহাভারতের কথা, মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খেতে দেওয়া হল শুধুই সোনা আর ধনরত্ন।
----- কর্ণ জিজ্ঞাসা করলেন ইন্দ্রকে (মতান্তরে যমকে) -- 'ব্যাপার টা কি?'
----- ইন্দ্র বললেন, ‘তুমি, বাপু, সারাজীবন সোনাদানাই বিলিয়েছো, পিতৃপুরুষকে জল দাওনি; তাই তোমার জন্যে এই ব্যবস্থা।’
-------- কর্ণ বললেন, ‘আমার কী দোষ? আমার পিতৃপুরুষের কথা তো আমি জানতে পারলাম এই সেদিন। যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে মা কুন্তী আমাকে এসে বললেন, আমি নাকি তাঁর ছেলে। তারপর যুদ্ধে ভাইয়ের হাতেই মরতে হল। পিতৃতর্পণের সময় পেলুম কই?’
--------- ইন্দ্র বুঝলেন, কর্ণের দোষ নেই। তাই তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দিলেন। ইন্দ্রের কথা মতো এক পক্ষকাল ধরে কর্ণ মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্নজল দিলেন। তাঁর পাপস্খালন হল। এবং যে পক্ষকাল কর্ণ মর্ত্যে এসে পিতৃপুরুষকে জল দিলেন সেই পক্ষটি পরিচিত হল পিতৃপক্ষ নামে।
সূর্য কন্যা রাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষের সূচনা হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই সময় আমাদের স্বর্গত পিতৃপুরুষগণ স্বর্গলোক ছেড়ে নেমে আসেন মর্ত্যলোকে। থাকেন যতদিন না সূর্য প্রবেশ করেন বৃশ্চিক রাশিতে, ততদিন। এই সময় প্রথম পক্ষেই হিন্দুদের পিতৃতর্পণ করতে হয়।
------
তর্পণ
------
------ ‘জলের দ্বারা কৃত পিতৃপুরুষ ও দেবতাদের তৃপ্তিবিধায়ক অনুষ্ঠান’। এর অপর নাম পিতৃযজ্ঞ। এই অনুষ্ঠানে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব প্রমুখ দেবতা, সনক-সনন্দ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সপ্তর্ষি, চতুর্দশ যম ও দ্বাদশ পূর্বপুরুষ (পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধপ্রমাতামহ, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহী ও বৃদ্ধপ্রমাতামহী) এবং ত্রিভুবনের উদ্দেশ্যে জল দেওয়া হয়। পিতৃপক্ষের সময় 'তিলতর্পণ' অনুষ্ঠিত হয়; অর্থাৎ তিল-মেশানো জলে তর্পণ হয়।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে; এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তর্পণ, শাস্ত্রমতে, নিত্যকর্তব্য। তবে আজকের বাজারে রোজ বাপ-ঠাকুরদাদের স্মরণ করা সম্ভব হয় না বলে, লোকে পিতৃপক্ষে এবং, বিশেষ করে, 'সর্বপিতৃ' অমাবস্যায় (যে দিনটিকে আমরা ‘মহালয়া’ বলে থাকি) তিলতর্পণ করেই পিতৃকৃত্য সেরে থাকি।
পিতৃতর্পণের সঙ্গে দুর্গাপূজার সরাসরি যোগ নেই। দুর্গাপূজার কল্পারম্ভ মহালয়ায় হয় না। মহালয়ার ঠিক আগের নবমীতে হয় কৃষ্ণানবম্যাদি কল্পারম্ভ এবং মহালয়ার পরদিন হয় প্রতিপদ্যাদি কল্পারম্ভ। মহালয়ার দিনটি নির্ধারিত শুধু পিতৃতর্পণের জন্যই। পিতৃকৃত্যের ক্ষেত্রে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিন তিথিনিয়মের বাইরে সকল পূর্বপুরুষের শ্রাদ্ধ করা যায়। যাঁদের সাংবাৎসরিক শ্রাদ্ধ সামর্থ্যে কুলায় না, তাঁরা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালন করেন। আবার প্রতিপদের দিন দৌহিত্র মাতামহের তর্পণ করে। পিণ্ডদান, গীতাপাঠ, চণ্ডীপাঠ, দানধ্যান–সবই হয় এদিন।
বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাঁরা অপারগ, তাঁরা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালন করে পিতৃদায় থেকে মুক্ত হতে পারেন। মৃত ব্যক্তির পুত্র (বহুপুত্রক হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র) বা পিতৃকুলের কোনো পুরুষ আত্মীয়ই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী এবং শ্রাদ্ধ কেবলমাত্র পূর্ববর্তী তিন পুরুষেরই হয়ে থাকে। মাতার কুলে পুরুষ সদস্য না থাকলে সর্বপিতৃ অমাবস্যায় দৌহিত্র মাতামহের শ্রাদ্ধ করতে পারেন। কোনো কোনো বর্ণে কেবলমাত্র পূর্ববর্তী এক পুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়।
.
অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপক্ষের শেষ হয়, আর পরের দিন প্রতিপদ তিথিতে শুরু হয় দেবীপক্ষের।

written by: Prithwish Ghosh
Share:

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বেদ পরিচয় পর্বঃ ১

সমস্ত শাস্ত্রের মূল কথা হইতেছে – পরম পবিত্র বেদ । বেদ চারিভাগে বিভক্ত- ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ , সামবেদ ও অথর্ববেদ। সৃষ্টির প্রথমে আদিপুরুষ ভগবান ব্রহ্মা যোগাসনে সমীসন হইয়া স্থিরচিত্তে পরমাত্ম-চিন্তায় নিমগ্ন আছেন; এমন সময় কল্যানময় পরমেশ্বরের কৃপায় তাহার হৃদয় কন্দরে একটি অস্ফুট নাদ-ধ্বনি প্রকাশ পাইল। পরে তাহা হইতে সর্ববেদের বীজরূপী ব্রহ্মনাম ‘প্রনব’ এবং স্বর- ব্যঞ্জনময় বর্ণরাশি একে একে অভিব্যক্ত হইল । তখন ভগবান ব্রহ্মা সেই বর্ণরাশির সহায়ে যে শব্দসমহ উচ্চারণ করিলেন, তাহাইজগতে বেদবিদ্যা বলিয়া বিখ্যাত হইল ।

অতঃপর ভগবান ব্রহ্মা সেই অপূর্ব বেদবিদ্যার বিস্তার করিবার ইচ্ছায় মরীচি, অত্রী, অঙ্গিরা প্রভৃতি ঋষিগনকে তাহা শিক্ষা দিতে লাগিলেন । ক্রমে বৈদিকজ্ঞান জগতে প্রসার লাভ করিল। এইরূপে গুরু-শিষ্যানুক্রমে যুগ যুগান্তর চলিতে লাগিল । ক্রমে দ্বাপর যুগ আসিয়া পড়িল । মানুষের স্মৃতিশক্তি হ্রাস হইয়া পড়িল । তখন-

পরাশরাৎ সত্যবত্যামংশাংশ-কলয়া বিভুঃ ।
অবতীর্ণো মহাভাগো বেদং চক্রে চতুবির্ধম্ ।।
ঋগথর্ব-যজুঃ-সাম্নাং রাশীনুদ্ধৃত্য বর্গশঃ।
চতস্রঃ সংহিতাশ্চচক্রে মন্ত্রৈ-মনির্গণা ইব ।।

অনুবাদঃ ভগবান নারায়ন, পরাশরের ওরসে মাতা সত্যবতীর গর্ভে পুত্ররূপে আবির্ভুত হইলেন । তাহার নাম হইল-‘কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন’ । তিনি বেদশিক্ষার সুবিধার্থে এক এক শ্রেনীর মন্ত্রসমুহ একত্র সংগ্রহ করিয়া ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথর্ব নামে এক বেদকে চারটি ভাগে ভাগ করিলেন, এইভাবে বেদকে বিভাগ করিভার জন্য তখন হইতে তাহার অপর নাম হইল- ‘বেদব্যাস’।

মহর্ষি ব্যাসদেব বেদকে চারভাগে বিভক্ত করিয়া তাহার বহুল প্রচারোদ্দেশ্যে স্বীয় শিষ্য পৈলকে ঋগ্বেদ, বৈশম্পায়নকে যজুর্বেদ , জৈমনিকে সামবেদ এবং সুমন্তকে অথর্ববেদ শিক্ষা দিলেন । পরে তাহারাও আবার স্বীয় স্বীয় শিষ্যমণ্ডলীকে যথাযথরূপে চতুর্বেদ শিক্ষা দিতে লাগিলেন । এইরূপে এক বেদ বহু শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হইয়া পড়িল ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তি

তথসুত্রঃ স্বামী অরুণানন্দ রচিত ''বেদসার- সংগ্রহ'' হতে । 
Share:

অসুরের দেশে রাম নাম

রামায়নে কথিত আছে রাবনের ভাই বিভীষন ছিল রাম ভক্ত আর রাবনের দেশ ছিল লঙ্কায় । তিনি অসুরের ভাই হয়েও অসুরের দেশে রাম নাম করতেন আর তার বাড়ির ভিতরে ও আশেপাশে রাম নাম লিখে রাখতেন । রাবন তার শত্রুর নাম লিখাতে ক্ষেপে গিয়েছিল বিভীষনের উপর, তখন বিভীষন বললেন
রাবন দাদা আমি তোমার নাম প্রচার করছি । তখন রাবন বললেন কিভাবে? বিভীষন বললেন রাম মানে “রা-তে রাবন আর ম-তে মন্ধোদরি” । তখন রাবন বুঝতে পেরে বিভীষনকে তার গলার মালা খুলে পুরুষ্কার হিসেবে দেন ।

কিন্তু শেষে ফলাফল দেখা যায় রাম এসে ঐ অসুর রাজ্যে অসুরদের বিনাশ করে বিভীষনকে লঙ্কার রাজা বানিয়ে দেন । এতে কিন্তু বিভীষনের কম কষ্ট হয় নায় বললে ভুল হবে । রাম ভক্ত হওয়ার কারনে উনি অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন এমনকি তাকে পরিবার থেকে ত্যাগ করে দিয়েছিল এবং আরো অনেক ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু বিভীষন রামকে ছাড়েনি রামের উপর বিশ্বাস ছিলই বিধায় শেষে সত্যের জয় হয়েছিল ।

আবার এদিকে দেখি হিরন্যকশিপু একজন মারাত্মক অসুর হওয়ার পরও তিনি তার ছেলের মুখ থেকে তার শত্রু বিষ্ণুর নামটি ছাড়াতে পারি নি । এতে তার পুত্র প্রহ্লাদকে মেরে ফেলার জন্য কত পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু একটিও বাস্তবতা হয়নি । প্রহ্লাদ কিন্তু ভগবান বিষ্ণুকে ছাড়েনি শেষে ফলাফল দেখলাম বিষ্ণু নৃসিংহ অবতারে হিরণ্যকশিপুকে মেরে ফেললেন আর একসময় তার বাবার রাজ্যের রাজা হলেন । এতে কিন্তু প্রহ্লাদের কম কষ্ট হয় নাই বললে ভুল হবে তিনিও অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন এমনকি তাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিল কিন্তু বিষ্ণুর প্রতি অগাদ বিশ্বাস ছিল বলে শেষে সত্যের জয় হয়েছিল ।

উপরের দুটি ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারি কেউ যখন ভক্তিযোগ পালন করে তখন তিনি আর সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ট থাকে না কারন ভগবানের চোখে সবাই সমান তার কাছে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ট বলতে কিছু নাই, যারাই ভক্তি করবে তাদের জিত অবশ্যই হবে তাদের কোন বিনাশ নাই যা ভগবদগীতায়ও বলা হয়েছে । কিন্তু আমাদের শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে আর ভগবানের ভক্তি করতে হবে যা যেকোন কঠিন পরিস্থিতিতে আসুক না কেন, আমাদের ভক্তি ত্যাগ করা উচিত নয় । তা যদি করতে পারি তাহলে জিত আমাদের হবেই । কারন জগৎটা এমনই ভক্তদের কষ্ট দেওয়ার জন্য অসুরেরা সবসময় তৎপর সেটা অন্য যুগে ছিল তা নয় এটা আমরা এই কলিযুগেও দেখি । উপরের ঘটনায় বিভীষন আর প্রহ্লাদ ছিলেন কিন্তু সংখ্যালঘু, তাই বলে কি ওদের ভক্তি কি কেউ কেড়ে নিতে পারেছে, না কেউ কেড়ে নিতে পারে নি, জয় কিন্তু সেই সংখ্যালঘুদের হয়েছে । তাই সংখ্যালঘু বলে নিজেকে দুর্বল ভাববেন না ভগবানের ভক্তি করুন মনে সাহস আনুন আর একতা থাকার চেষ্টা করুন দেখবেন ভগবান আপনার পাশেই আছে আর জিত আপনারেই হবে ।

Written by: songkirton madob das
Share:

সিদ্ধিদাতা শিব গৌরী পুত্র গণেশ মহারাজ

সিদ্ধিদাতা শিব গৌরী পুত্র গণেশ মহারাজ ছিলেন বুদ্ধিতে সুনিপুণ । পুরাণ গুলিতে এমন বহু ঘটনা আছে । এক সময়ের কথা , মাতা উমা ঠিক করলেন দুই পুত্রের বিবাহ দেবেন । সেইমতো শর্ত হোলো যে আগে সাতবার পৃথিবী পরিক্রমা করে আসতে পারবে তার বিবাহ অগ্রে দেওয়া হবে । এই শুনে কুমার স্কন্দ, তাঁর বাহন ময়ূরে চেপে পৃথিবী পরিক্রমা করতে বের হলেন। গণেশ মহারাজ চিন্তায় পড়লেন। তাঁর
বাহন মূষিক। মূষিকে চেপে সাতবার পৃথিবী পরিক্রমা করতে কয়েক যুগ চলে যাবে। মঙ্গলমূর্তি গণেশ জী তখন শিব পার্বতীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে বললেন- “পিতা মাতা। আমার পৃথিবী পরিক্রমা হয়ে গেছে ।” হরগৌরী আশ্চর্য হয়ে বললেন- “সেকি? তুমি তো পরিক্রমা করতে গেলেই না, কিভাবে পরিক্রমা হোলো?” বক্রতুণ্ড গজানন বললেন- “পিতামাতাই সন্তানের কাছে ভগবান, পিতামাতাই সন্তানের কাছে জগত। তাই আপনাদের পরিক্রমা করে আমার জগত পরিক্রমা হয়ে গেছে।” হরগৌরী বুঝলেন সিদ্ধিদাতার বুদ্ধি তীব্র। রিদ্ধি ও সিদ্ধি নামক দুই কন্যার সাথে গণেশের বিবাহ দিলেন। গণেশের দুই পুত্র ও এক কন্যা। পুত্রদের নাম শুভ ও লাভ, কন্যার নাম সন্তোষী । পুরানে এমন ঘটনা বেদব্যাস লিখেছেন যাতে আমরা পিতামাতার সেবা করি ।

গণেশের আর এক বুদ্ধি । মূষকরাজ নামক এক অসুর ছিলেন । তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বর্গচ্যুত দেবতারা কৈলাসে এসে ভগবান শিবের কাছে সকল বৃতান্ত বললেন। ভগবান শিবের নির্দেশে গণেশ অসুরপুরী আক্রমণ করে অসুর নিধন শুরু করলেন । মূষকরাজ যুদ্ধে আসলে গণেশ জী চাতুরী দ্বারা তাকে মূষিকে পরিণত করে বিশাল দেহ নিয়ে মূষিকে বসলে , মূষকরাজের দফারফা শেষ হতে লাগলো। মূষকরাজ ক্ষমা চাইলে গণপতি বর দিয়ে বললেন- “আজ থেকে তুমি আমার বাহন, তুমিও আমার সাথে পূজা পাবে। তোমার স্কন্ধে আমি পুষ্পসম ওজন পরিগ্রহ করে অধিষ্ঠান করবো। তখন তোমার কষ্ট হবে না।” ভিন্ন মতে স্বর্গের কোনো এক গন্ধর্ব কোনো মুনি শাপে মূষিকে রূপান্তরিত হয়ে সেই মুনির আশ্রমে তাণ্ডব আরম্ভ শুরু করে। তখন মুনির প্রার্থনায় গণেশ মহারাজ প্রকট হয়ে সেই মূষিক কে বাহন বানান । একদিনের ঘটনা। গজানন মূষিকে অধিষ্ঠান করে যাচ্ছিল্লেন। পথে মূষিকের শত্রু এক নাগ কে দেখে মূষিক ভীত হলে গণেশ জী মূষিক থেকে পড়ে যান। সেসময় চন্দ্রদেব গণেশ জীর স্থূল দেহ ও হস্তীমুখ নিয়ে ব্যাঙ্গ করলে গণেশ জী চন্দ্রদেবকে অভিশাপ করেন । পরে চন্দ্রদেব গণেশ জীর আরাধনা করে শাপ থেকে মুক্তি পান । ভাদ্রমাসের নষ্টচন্দ্র দিন চন্দ্র দর্শন করলে নাকি সেই অভিশাপ লাগে বলে পুরাণে লেখা। বলা হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেইদিন চন্দ্র দর্শন করেছিলেন, এরপর মণি অপহরণের ঘটনা ঘটে। যাই হোক ব্যাস মুনি পুরানে আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছেন যে কারোর দেহ দেখে তাকে ব্যাঙ্গ উপহাস করতে নেই।

একদা কুবের নিজ দর্প প্রদর্শনের জন্য গর্বে বুক ফুলিয়ে কৈলাসে শিব কে নিমন্ত্রণ করতে আসেন । ভগবান শিব অন্তর্যামী । তিনি কুবের কে শিক্ষা দেবার জন্য গণেশ কে পাঠালেন । গণেশ এসে কুবের মহলে গ্রেগ্রাসে এত খাবার খেতে লাগলেন, যে কুবের ভবন খাদ্যশূন্য হোলো। কুবের এসে মহাদেবের কাছে ক্ষমা চাইলে মহাদেব গণেশ কে ফিরিয়ে আনলেন। এই জন্য কদাপি গর্ব করা উচিৎ নয় । একবার কৈলাসে সমস্ত দেবতা ও ত্রিদেব ত্রিদেবী উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন না শুধু গণেশ । সেসময় সিন্দুর নামক এক অসুর এসে সমগ্র কৈলাস কে হাতে তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে চাইলেন। ভগবান শিব ভাবলেন কপাল নয়ন অগ্নি দিয়ে সেই অসুরকে ভস্ম করবেন । কিন্তু ভাবলেন অসুরের হাতে সমগ্র কৈলাস। এই মুহূর্তে অসুরকে ভস্ম করা উচিৎ না । উপায় না দেখে গণেশ কে স্মরণ করলেন। গণেশ এসে তাঁর দন্ত দিয়ে সিন্দুর অসুরকে টুকরো করে দিলেন । মহাভারত এর লেখক ছিলেন গণেশ । ব্যাসদেব শ্লোক বলতেন , গণেশ মহারাজ তাঁর দন্ত ভেঙ্গে কলম বানিয়েছিলেন সেটা নিয়ে লেখতেন । গণেশ জীর যে হস্তীমুণ্ড সেটা ঐরাবত হস্তীর মুণ্ড। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে ঐরাবতের ওরকম হয়েছিলো। তবে মুণ্ড কাটার পর ঐরাবত মরে নি। দুর্বাসার আশীর্বাদে ঐরাবতের একটি মুণ্ড গজিয়েছিলো । গণেশ জী মঙ্গল মূর্তি। নতুন ব্যবসা, নতুন কিছু কেনা বা গৃহ নির্মাণের আগে বা যেকোনো পূজায় অগ্রে গণেশের পূজা করা উচিৎ । যাত্রা কালে গণেশ নাম উচ্চারন করলে যাত্রা নিস্কণ্টক হয় । গণেশ পূজায় চতুর্বিধ ফল লাভ, গ্রহ দোষ খণ্ডন ও সুখ, সমৃদ্ধি, আয়ু, যশ, মান, অর্থ, সম্পদ প্রাপ্তি হয় । এজন্য ভারতের সিনেমা নির্মাতা তথা মুম্বাই তে গণেশ পূজার এত ঢল। কালক্রমে গোটা দেশে বিস্তৃতি হয়। আগামী কাল গণেশ চতুর্থী, গণেশের আবির্ভাব তিথি ।

আসুন গণেশ জীকে প্রনাম জানিয়ে বলি-

ওঁ দেবেন্দ্র- মৌলি- মন্দার মকরন্দ কণারুণাঃ ।
বিঘ্নং হরন্তু হেরম্বচরণাম্বুজরেণবঃ ।।
Share:

পবিত্র বেদ অমৃত

যজুর্বেদ ৪০.৮, ঈশোপনিষদ-৮

সপর্ষগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্রাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভুঃ স্বয়ম্ভুর্ষাথানথ্যতোর্থান্ব্যশ্চতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।

ঈশ্বর সবর্ব্যাপক, জ্যোতির্ময়, শরীর রহিত, নিখুত, স্নায়ু আদি বন্ধন রহিত, পবিত্র। তিনি সর্বজ্ঞ, সকলের অন্তরজ্ঞাতা, সকল প্রকার পাপ হতে মুক্ত এবং তিনি স্বয়ং বিদ্যমান বা সয়ম্ভু। তিনি যথার্থরূপে বেদের মাধ্যমে তাঁর স্মরণীয় গুণের সমস্ত কিছু প্রকাশ করেছেন, তিনি জন্ম ও মৃত্যুর বন্ধন হতে মুক্ত।

এই মন্ত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এতে একই সঙ্গে ঈশ্বর ও বেদ সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। যারা ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে জানতে চান তাদের জন্য এই একটি মন্ত্রই যথেষ্ট। এই মন্ত্রে ঈশ্বরের পূর্ণ রূপ আক্ষরিক অর্থেই প্রতিফলিত হয়েছে। এমনকি এই মন্ত্রে এটিও স্পষ্ট হয়েছে যে ঈশ্বরের সম্পূর্ণ জ্ঞান এই পবিত্র বেদেই অবতীর্ণ হয়েছে। যার ফলে পরবর্তীতে আব্রাহামিক মতবাদ এর ন্যায় যুগে যুগে কিতাব নাজিল করতে হয় না। কারণ বেদ স্বয়ং সম্পূর্ণ। আর কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী আছে, যারা প্রচার করে ‘‘বেদ পড়ো না। বেদ অতি পবিত্র তা কলিযুগের জন্য নয়।’’ তারা এই কথা বলে কারণ আমরা যদি বেদ পাঠ করি এবং বেদ আচার্যের ব্যাখ্যা অনুধাবন করি তবে আমরা নিজেরাই ঈশ্বরকে জানতে পারব। আমাদের ধর্মকে যথার্থরূপে অনুধাবন করতে পারব। যা এই মন্ত্রে বলা হয়েছে। তবেই ঐসকল ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভন্ডুল হবে। অবশ্যই বেদ পবিত্র, আর সেই পবিত্রতা আমরা ইচ্ছে করলে নিজেরাই অর্জন করতে পারি। আসুন আমরা সকলে বেদকে জানি, সত্য ধর্মকে জানি এবং ঈশ্বরকে জানি। 
Share:

হিন্দুধর্মের অত্যন্ত প্রচলিত একটা মিসকনসেপসন হল ৩৩কোটি দেবতা

হিন্দুধর্মের অত্যন্ত প্রচলিত একটা মিসকনসেপসন হল ৩৩কোটি দেবতা। প্রকৃত ব্যপারটা দেখে নেয়া যাক।

দুইটা পয়েন্ট দেখে আলোচনা করব।একটা হল "কোটি" শব্দটির অর্থ নিয়ে।আরেকটা হল "দেবতা" শব্দটা নিয়ে।প্রথমেই কোটি শব্দটি নিয়ে বলি।কোটি অর্থ প্রচলিত বাংলায় Crore হলেও সংস্কৃত ভাষায় তার অর্থ"ধরন" বা "প্রকার"।আর বেদ এ দেবতা বলতে কোন শব্দ নেই।মুল সংস্কৃত শব্দটি হল দেব যার অর্থ শক্তি।অর্থাত্‍ ঈশ্বরের ৩৩ধরনের শক্তি।এ বিষয়ে প্রথমেই যজুর্বেদ এর একটি মন্ত্র দেখে নেয়া যাক-

ত্রয়স্ত্রিং শতাস্তুবত ভুতান্য শাম্যন্ প্রজাপতিঃ।
পরমেষ্ঠ্যধিপতিরাসীত্‍।।

যজুর্বেদ ১৪.৩১

অর্থাত্‍ যাঁহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিতহয়,প্রজার পালক, সর্বব্যপক,অন্তরীক্ষে ব্যপ্ত,,তাঁহার মহাভূতের তেত্রিশ প্রকার গুনের স্তুতি কর।

এখন তেত্রিশ ধরনের শক্তির ব্যখ্যা দেখা যাক।শতপথ ব্রাহ্মন ১৪.৫ এ যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি শাকল্যকে বলছেন-দেব ৩৩টি যা পরমেশ্বরের মহিমার প্রকাশক।৮ বসু,১১রুদ্র,১২ আদিত্য,ইন্দ্র,প্রজাপতি।
শতপথ ব্রাহ্মন,
মনুসংহিতা ও বৃহদারন্যক উপনিষদ এ এর বিস্তারিত বর্ননা দেয়া আছে।

বৃহদারন্যক উপনিষদ ৩.৯.২-১১
"বিদগ্ধ শাকল্য যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞেস করলেন,হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব(শক্তি) কয়টি? যাজ্ঞবল্ক্য বললেন ৩৩টি।তখন শাকল্য আবার বললেন,হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি?তখন তিনি আবার বললেন ৬টি।শাকল্য আবার বললেন,হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি?তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন ৩টি।আবার শাকল্য জিজ্ঞেস করায় তিনি উত্তর দিলেন দুইটি।তখন শাকল্য আবার জিজ্ঞেস করলেন,হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি?তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন দেড়টি।শাকল্য আবার জিজ্ঞেসকরলেন হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি?তখন তিনি বললেন একটি!তখন শাকল্য জিজ্ঞেস করলেন এই ৩৩টি দেব কি?যাজ্ঞবল্ক্য বললেন ৮বসুযা হল অগ্নি,পৃথিবী,
বায়ু,অন্তরীক্ষ,
আদিত্য,দ্যৌ,
চন্দ্র,নক্ষত্র, ১১ রুদ্র যা হল প্রান(নিশ্বাস), অপান(প্রশ্বাস), ব্যন,সমান,উদাম, নাগ, কুর্ম্ম,কৃকল,দেবদত্ত, ধনন্জয় এবং জীবাত্মা,১২ আদিত্য হল ১২মাস,ইন্দ্র,প্রজাপতি অর্থাত্‍ মোট ৩৩টি।ইন্দ্র হল বিদ্যুত্‍ আর প্রজাপতি হল যজ্ঞ(যে কোনশুভ কর্ম)।তখন শাকল্য আবার জিজ্ঞেস করলেন তাহলে ৬টা দেব কি কি?
তখন তিনি উত্তর দেন অগ্নি,পৃথিবী,
বায়ু,অন্তরীক্ষ, আদিত্য,দ্যুঃ।তখন তিনি বললেন তাহলে ৩টি দেব কি?তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন তিনলোক(ভ্যু,দ্যু,অন্তরীক্ষ)।তারপর শাকল্য আবার বললেন সেই দুইটি দেব কি কি?খাদ্য এবং প্রান-উত্তর দিলেন যাজ্ঞবল্ক্য।তখন আবার শাকল্য জিজ্ঞেস করলেন সেই দেড়টি কি?তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন যিনি প্রবাহিত হন।তখন শাকল্য বললেন সেই এক এবং অদ্বিতীয় যিনি প্রবাহিত হন তাঁকে আপনি কিভাবে দেড় বললেন?তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন যখন তা প্রবাহিত হয় তখন ই সবকিছু উত্‍পন্ন হতে শুরু করে।তাহলে কে সেই এক?
প্রান!!!হ্যঁ প্রান(পরমাত্মা) সেই এক এবং অদ্বিতীয় দেব যাকে সবাই তত্‍ বলে জানে"
অসাধারন এই শৈল্পিক ও গভীর দার্শনিক কথোপকথন ব্যখ্যা করছে সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরব্রহ্ম থেকে সবকিছু উত্‍পন্ন হতে শুরু করে।একে একে অগ্নি,বায়ু,আদিত্য,ভু,দ্যু এবং অন্তরীক্ষলোক,
বিদ্যুত্‍শক্তি সবকিছুই তার থেকে তৈরী হয় যাদেরকে ৩৩টি ভাগে ভাগ করা হয় এবং এদেরকে বলা হয় দেব অর্থাত্‍ শক্তি।আর দিনশেষে শক্তি একটাই যা থেকে সকল কিছু আপাতশক্তিপ্রাপ্ত হয়।আর এই শক্তিই এক এবং অদ্বিতীয় পরমাত্মা।
আশা করি এর মাধ্যমে দেবতা এবং ৩৩কোটি দেবতা সম্বন্ধে আপনাদের ভুলধারনা দুর হবে।

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।