• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

১২ এপ্রিল ২০১৬

আজ আপনাদের সামনে বলব নব দুর্গার কথা

দেবী দুর্গার নয়টি রূপ। সে গুলো হল --শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কূষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী,সিদ্ধিদাত্রী।
-
প্রথমং শৈলী পুত্রীতি, দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী।
তৃতীয়ং চন্দ্রঘণ্টেতি, কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম্
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা।
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি অষ্টামম্
নবমং সিদ্ধিদাত্রীতি নবদুর্গাং প্রকীর্তিতার।
উক্তান্যেতানি নামানি ব্রহ্মনৈব মহাত্মনা।
-
---- এভাবে মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রী চণ্ডীর দেবীকবচে ব্রক্ষাবর্ণিত দেবী দুর্গার নয়টি রূপের বর্ণনা করা হয়েছে। এরাই হলো নবদুর্গা। দেবীপক্ষের প্রথম দিনটি থেকে শুরু করে নবমী পর্যন্ত এই নয়টি রূপে পূজিত হন তিনি। নয়টি রূপ হলো ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী। আর নবদুর্গার এই নয়টি রূপের বর্ণনা করছি।
সতী দেহ ত্যাগের পর, পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যা হয়ে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন দেবী পার্বতী। তাই তার নামকরণ করা হয় শৈলপুত্রী। তিনি পার্বতী বা হৈমবতী নামেও পরিচিত। নবদুর্গার প্রথম রূপ হলো এই শৈলপুত্রী। এই রূপে দেবীর হাতে থাকে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল আর মাথায় থাকে অর্ধচন্দ্র।
নবশক্তির দ্বিতীয় রূপ হলো ব্রহ্মচারিণী। শিবের সঙ্গে বিয়ের আগে এই রূপে দেবী যোগিনী অথবা তপস্বিনী। মহর্ষি নারীদের প্রভাবে দেবী তপস্যা করেন কয়েক হাজার বছর। এই রূপে তিনি 'অর্পণা' নামেও পরিচিত। দেবীর হাতে থাকে কমণ্ডলু এবং রুদ্রাহ্ম তার অঙ্গভূষণ।
দেবীর তৃতীয় রূপ হলো 'চন্দ্রঘণ্টা'। 'ঘণ্টা' অর্থাৎ দেবীর মুখ। সে অর্থে 'চন্দ্রঘণ্টা' মানে দেবীর মুখ চাঁদের মতোই সুন্দর ও সি্নগ্ধ আলোয় উজ্জ্বল। তার দর্শনেই সকলের মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই রূপে দেবী যুদ্ধোদ্যত। ভক্তদের রক্ষা করতে তিনি অস্ত্রধারণ করেছেন। এই রূপে দেবী 'দশভুজা', আটটি হাত আটটি অস্ত্রে সজ্জিত, বাকি দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা।
দেবীর চতুর্থ রূপ হলো 'কুষ্মাণ্ডা', কুষ্মাণ্ডা শব্দটি কু, উষ্ণ, অণ্ড এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। কু মানে স্বল্প, উষ্ণ মানে গরম এবং অণ্ড বলতে এই বিশ্ব জগৎকে বোঝানো হয়েছে। দেবী নিজ হাসি এবং হাতের পাত্রের রক্ত দিয়ে সৃষ্টি করেন আলোকিত ব্রহ্মাণ্ড। এই রূপে দেবীর গাত্রবর্ণ সূর্য কিরণের মতো উজ্জ্বল। আটটি হাতে দেবী কমণ্ডলু, ধনুক, বাণ, পদ্ম, অমৃতকলস, চক্র, গদা এবং জপমালা ধারণ করেন। স্কন্দমাতা দেবীর পঞ্চম রূপ। পুত্র কার্তিকের অর্থাৎ স্কন্দকে কোলে নিয়ে পদ্মের ওপর উপবিষ্ট দেবী পার্বতী। এ কারণে দেবী স্কন্দমাতা নামে পরিচিত। দেবীর গাত্রবর্ণ স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল। আর পদ্মের ওপর উপবিষ্ট বলে তাকে পদ্মাসনাও বলা হয়। কাত্যায়নী হলো দেবীর ষষ্ঠ রূপ। দেবীর এই রূপের জন্ম নিয়ে দুটি ব্যাখ্যা প্রচলিত। প্রথমটি অনুযায়ী মহর্ষি কাত্যায়নের উপাসনায় খুশি হয়ে তার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন দেবী। তাই তার নাম কাত্যায়নী, দ্বিতীয়টি বলে, মহিষাসুরের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও অন্য দেবতারা মিলে তাদের তেজ দিয়ে তৈরি করেন দেবীকে। মহর্ষি কাত্যায়ন প্রথম তার আরাধনার সুযোগ পান। তাই দেবীর নাম কাত্যায়নী। দেবী কাত্যায়নী দশমীর দিন দানব মহিষাসুরকে বধ করেন। সপ্তম রূপে দেবী ভয়ঙ্করী। এই রূপের নাম কালরাত্রি। দেবীর গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, গলায় উজ্জ্বল হার, অনেকটা যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো! মাথার চুল খোলা, অবিন্যস্ত। দুষ্টের দমন করার জন্যই দেবীর মর্ত্যলোকে আগমন। দেবীর অষ্টম রূপ হলো 'মহাগৌরী'। শিবকে স্বামীরূপে কামনা করে কঠোর তপস্যা করেছিলেন দেবী পার্বতী। তাতে তার গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব দেবীকে দেখা দেন এবং তপস্যাজনিত ক্লান্তি এবং কালিমা দূর করতে তাকে গঙ্গাজলে স্নান করান। এতেই দেবী গৌরবর্ণা হয়ে ওঠেন। তখন তার নাম হয় মহাগৌরী। দেবীর বস্ত্রও শ্বেত, তার হাতে থাকে ডমরু। দেবীর নবম রূপ সিদ্ধিদাত্রী। এই রূপে সি্নগ্ধা, গন্ধর্ব, যহ্ম, অসুর এবং দেবতাদের দ্বারা পূজিত হন দেবী। কথিত আছে, মহাদেব দেবীর এই রূপের তপস্যা করেই অর্ধ নারীশ্বর হয়েছিলেন।
নবদুর্গা যে রূপেই মর্ত্যলোকে আসুন না কেন তা তার ভক্তদের কাছে কামনীয় ও মঙ্গলময়। দেবী তার রূপ ও গুণে তার ভক্তদের রক্ষা করেছেন সকল অশুভ শক্তির কাছ থেকে।
Written by: Prithwish Ghosh
Share:

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব –৫ )


রামচন্দ্র একবাক্যে বনবাসে যেতে প্রস্তুত। কোন অভিযোগ নেই। কোন আক্ষেপ নেই। তিনি তৈরী। এখন শুধু মহারাজ দশরথের আদেশ নিয়ে যেতে হবে। একেতে রঘুবংশীয় মহারাজ দশরথের প্রতিজ্ঞা, অপরদিকে মাতা কৈকয়ীর ইচ্ছা । রামচন্দ্রের সহধর্মিণী মাতা জানকী দেবী এই সকল সংবাদ শ্রবন করলেন। তিনিও স্বামীর ন্যায় মনে কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, আক্ষেপ, দুঃখ রাখেন নি । তিনি রামচন্দ্রকে বলিলেন- “হে নাথ! আমিও আপনার সাথে বনে গমন করতে ইচ্ছুক।” রামচন্দ্র বললেন- “ইহা অসম্ভব! বন গমনের কথা কেবল আমার। মাতা কৈকয়ী আমাকে বনে যেতে বলেছেন। আমি একাই যাবো। তুমি সেখানে গিয়ে কি করবে?” সীতাদেবী অনেক বোঝালেন। বললেন- “প্রভু! পতির চরণেই পত্নীর সকল তীর্থ, পতির সেবা পত্নীর পরম ধর্ম, পতির অনুগমন করাই আদর্শ সতী নারীর কর্তব্য। আপনি যেখানে যাবেন আমিও সেইখানেই থাকবো।” ভগবান রাম বহু বোঝালেন সীতাকে। কেবল বোঝানোই নয়, জঙ্গলের বিভীষিকার কথাও তুলে ধরলেন । রামচন্দ্র বললেন- “হে বৈদেহী ! তুমি রাজার কণ্যা। জনক রাজ্যে তুমি অতীব সুখ সমৃদ্ধিতে লালিতা পালিতা হয়েছো। অরণ্যে কি কারনে যাবে? আর সেখানে গিয়ে থাকবে কিভাবে ? অরণ্যের নিদারুন কষ্ট তুমি সইতে পারবে না। অরণ্য বাস কালে কোন প্রকার রাজকীয় সুখ, সেখানে প্রাপ্ত হবে না। তোমার কোমল, পুস্প সম চরণ কি প্রকারে পথের কণ্টকের আঘাত সহ্য করবে? শুধু কি এই ? সেখানে বহু হিংস্র জন্তু বিচরণ করে, উপরন্তু তাড়কা, মারীচ, সুবাহুর তুলনায় বহুগুণে শক্তিশালী রাক্ষসেরা সেখানে থাকে? তোমাকে এমন বিপদ সঙ্কুল স্থানে কিভাবে নিয়ে যাই? তুমি বরং অযোধ্যায় থাকো। চতুর্দশ বৎসর সমাপন হলে আমি ফিরে আসবো।”

সীতাদেবী সেসকল শুনে বলল- “প্রভু! আপনি স্বয়ং রাক্ষস বধ করে ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের তপোবন রক্ষা করেছেন । আপনি যেখানে , সেখানে রাক্ষসেরা কিভাবে জীবিত থাকবে ? আপনি আমার সুরক্ষা। হে নাথ! পতি যেস্থানে থাকুক, পতিব্রতা রমণীর কাছে সেই স্থানই স্বর্গ । পতি বিনা দেবপুরীও নরক তুল্য বোধ হয় । জন্ম থেকে আমাকে পতির অনুগামিনী হতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমি সে সকল কিভাবে বিস্মৃত হব? আপনি আমার স্বর্গ, আপনার চরণেই আমি অমৃত সুখ অনুভব করি। আপনি কুটীরে কিংবা রাজমহলে যেখানেই থাকুন, আপনার সঙ্গই আমার কাছে সর্ব বৃহৎ সুখ। অতএব এক আদর্শ পতিব্রতা রমণীর ন্যায় আমি আপনার অনুগামিনী হয়ে চতুর্দশ বৎসর বনবাসে কাটাবো। আপনার সান্নিধ্য পেয়ে সেই অরণ্যবাস আমার কাছে দেবপুরীবাস হয়ে উঠবে। বিবাহ কালে আমি আপনি অগ্নি সাক্ষী করে এই শপথ রেখেছিলাম। আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী, যেখানে আপনি সেখানেই ছায়ার ন্যায় আমি বিচরণ করবো।” শ্রীরামচন্দ্র আর কি করেন ? অনেক বুঝিয়ে সীতাদেবীকে নিরস্ত্র করতে পারলেন না। তখন ভগবান রাম , সীতাদেবীকে সঙ্গে নেবার মনস্থির করলেন । অপরদিকে লক্ষণ সব শুনে তাঁর অগ্রজের সাথে দেখা করতে আসলেন । তিনি প্রথমে ভরত আর বিমাতা কৈকয়ীকে অনেক বকাঝকা করতে লাগলেন। শ্রীরাম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “ভ্রাতা , মাতা ও ভ্রাতার নামে কুবাক্য প্রয়োগ করো না। এ আমাদের মায়ের আদেশ। আমি একে পালন করবো। আমি ও সীতা দুজনেই বনে যাচ্ছি। সীতাকে আমি অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু সে আমার বাক্য রাখেনি। সে আমার সাথেই অরণ্যে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছে ।” লক্ষণ তখন বলল- “অগ্রজ! যখন আপনি ও বৌঠান দুজনেই বনে যাচ্ছেন, তবে সাথে আমাকেও নিয়ে চলুন। আমিও আপনাদের সাথে অরণ্যে গিয়ে চতুর্দশ বৎসর বনবাসীর ন্যায় থাকবো।”

রামচন্দ্র বললেন- “এ হয় না ভ্রাতা। বন গমনের শর্ত শুধু আমার। বল পূর্বক সীতা আমার বাক্য অগ্রাহ্য করে তাকে অরণ্যে নিয়ে যেতে আমাকে স্বীকৃত করেছে। এর উপর তোমাকে আমি কিমতে নিয়ে যাবো? তোমার ঘরে স্ত্রী আছেন। তোমাকে কোনরূপ বন গমনের শর্ত দেওয়া হয়নি। মাতা সুমিত্রা এসকল শুনলে কষ্ট পাবেন । তুমি রাজমহলেই থেকে আমাদের প্রতীক্ষা করো। ” লক্ষণ তখন ভগবান রামের চরণে বসে বললেন- “অগ্রজ! জন্ম থেকে মাতা আমাকে জেষ্ঠ্য ভ্রাতার সেবা করতে বলেছিলেন । আমি তাই করি। জেষ্ঠ্য ভ্রাতার সেবা করা কনিষ্ঠ ভ্রাতার কর্তব্য। অগ্রজ ভরত এসকল বিস্মৃত হয়ে তোমাকে অরণ্যের দুঃখে ঠেলে দিয়ে সে মাতুলালয়ে বসে সুখাদি ভোগ করছে । কিন্তু আমি নীতিবাক্য ভুলিনি। যদি যেতে হয়, তবে আমিও আপনার সাথে যাবো। আপনার সেবা করা, অরণ্যে আপনাদের সুরক্ষার দায়িত্ব সব আমার। আমি জানি আপনি মহাবীর । কিন্তু এই লক্ষণ থাকতে আপনাকে কেন কষ্ট করে ধনুর্বাণ তুলতে হবে? সেসকল দায়িত্ব আমার। অতএব আমিও আপনার, বৌঠানের সেবার জন্য চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে গমন করতে চলেছি। আপনি আদেশ দিন।” রামচন্দ্র অনেক বোঝালেন লক্ষণ কে । কিন্তু লক্ষণ কিছুই শুনলো না। তখন রামচন্দ্র অনুমতি দিলেন । মাতা সুমিত্রা পুত্র লক্ষণকে স্নেহ ভরে আদর করে বললেন- “পুত্র! তুমি উচিৎ কর্ম করেছো। তোমার জন্য গর্ব হচ্ছে। দেখো অরণ্যে যেনো আমার জেষ্ঠ্য পুত্র রামের কোনরূপ যেনো অসুবিধা না হয়। তাঁর সেবায় কোন ত্রুটি রেখো না। অযোধ্যার কূল বধূ সীতাকে সর্বদা রক্ষা করো। যেনো কোন দুঃখের ছায়া উহাদের জীবনে না আসে।” সীতার ও লক্ষণ রামচন্দ্রের সাথে বণে যাবে, এই কথায় গোটা অযোধ্যার শোক আরোও বৃদ্ধি পেলো। রামচন্দ্র, সীতাদেবী, লক্ষণ সকলে রাজবেশ ত্যাগ করে বনবাসীদের ন্যায় মস্তকে জটা বাঁধলেন, পরনে সন্ন্যাসীর ন্যায় গেরুয়া বস্ত্র, কর্ণে , বুকে, বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা, মৃগ চর্ম দ্বারা সজ্জিত হলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব –৪ )


সকলে শুনে কৈকয়ীকে কটু বাক্য বলতে লাগলো। কৈকয়ী নিজ জেদে অস্থির। মহারাজ দশরথ অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলেন। খাওয়া, দাওয়া বন্ধ করে দিলেন । কেবল কৌশল্যা আর সুমিত্রা জোর করে দুবেলা সামান্য কিছু রাজাকে আহার করাতেন । কৈকয়ী কি করবে ভেবে পাচ্ছিল্ল না। একবার গিয়ে মন্থরা কে বলে- “মন্থরা। বল আমি সঠিক না ভুল করলাম?” মন্থরা বলল- “কৈকয়ী তুমি সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছো। তুমি সফল হও, ভরত রাজা হোক, রাম বনে যাক- এই কামনাই করি। রাজার দুঃখে গলে যেয়ো না। ওসব শক্ত মনে দমন করো। তুমি যদি নরম হও আজকে, তাহলে কাল তোমাকে দুঃখ ভোগ করতে হবে। শান্তি, সুখ প্রাপ্তির জন্য এসব কষ্ট সহ্য করতেই হয়। একবার ভরত রাজা হোক, রাম বনে যাক- দেখবে তখন তুমি সুখে আছো। রাজাও সুস্থ হয়ে যাবেন।” রাজা কিন্তু ভালো হল না। ক্রমশঃ স্বাস্থ্যের অবনতি হতে লাগলো । রামচন্দ্র সব শুনলেন । দশরথ রাজা আক্ষেপ করে বললেন- “পুত্র রাম! প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের দায়ে আমি নরকে যেতে হলে যাবো, তবুও তোমাকে বনে প্রেরণ করতে পারবো না।” রামচন্দ্র তখন রাজা দশরথকে আশ্বাস দিতে লাগলেন । গিয়ে কৈকয়ীর সাথে কথা বললেন। কৈকয়ী বললেন- “পুত্র রাম! আমি জানি তোমার সাথে অন্যায় করছি। কিন্তু ইহা ভিন্ন আমার কাছে অপর মার্গ ছিলো না । আমি নিরুপায়। প্রত্যেক মাতা যেমন গর্ভস্থ শিশুকে সদা রক্ষা করে, ভূমিষ্ঠ হবার পর আমৃত্যু সন্তানের কুশল, মঙ্গলের চিন্তায় থাকে তেমনি আমি আমার পুত্র ভরতের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। ভরতের কল্যাণ দেখা আমার কর্তব্য। অতএব তুমি ভ্রাতা ভরতকে রাজ্যভার দিয়ে নিশ্চিন্তে চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনে থেকে বনবাসীর ন্যায় জীবন পালন করো। কথা দিচ্ছি বনে তোমার কোন কষ্ট হবে না। তোমার সহধর্মিণী সীতাকে আমি কন্যা রূপে পালন করবো। বনবাস অন্তে তুমি অযোধ্যায় এলে তোমার জন্য উত্তম জীবনযাত্রার ভার আমি নেবো। ”

শুনে রামচন্দ্র বললেন- “মা । জন্মকাল হতে তুমি আমার আর ভ্রাতা ভরতের মধ্যে কোনপ্রকার ভেদ দর্শন করিনি । মাঝে মাঝে আমি বিস্মৃত হয়েছি, আমার গর্ভধারিণী মহারাণী কৈকয়ী, নাকি মহারাণী সুমিত্রা নাকি মহারাণী কৌশল্যা! মাতঃ তোমার স্নেহে আমি লালিত পালিত হয়েছি। তোমার বাৎসল্যে আমি সর্বদা ছায়ায় থেকেছি। মা এই সামান্য কিছুর জন্য আপনি পিতার কাছে এই বর চাইলেন! আপনি আমায় আদেশ করতেন, আমি তখুনি ভ্রাতা ভরতকে রাজ্যভার দিয়ে বনে গমন করতাম । তুমি আমার মাতা। সিংহাসন অপেক্ষা মাতার আদেশ অনেক বড়। আমি আপনার ইচ্ছা যথাযোগ্যভাবে পালন করবো। ” কৈকয়ী রামের এমন ব্যবহারে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেলো। একবার ভাবল এমন রত্ন ছেলের জন্য তিনি এমন নরক যন্ত্রনা তৈরী করছেন ? যে পুত্র তার এক কথায় সব কিছু ছেড়ে দিতে প্রস্তুত- তাকে এমন বনবাস দেওয়া কি উচিৎ ? কিন্তু পর মুহূর্তে তার মনে ঘুরেবেড়াতে লাগলো মন্থরার কুটিল বুদ্ধি। যদি কোনদিন রামচন্দ্রের মন পরিবর্তন হয়। যদি ভরতকে সে বিতারিত করে দেয়। তাই কৈকয়ী পুনঃ জেদে অটল হয়ে থাকলো । সারা রাজ্যে কৈকয়ী সম্বন্ধে ছিছিকার পড়ে গেলো। অনেক দূরে বসে কেকয় রাজ্যে ভরত এসব কিছুই জানলো না । ভরতের নামে সকলে গালি দিতে লাগলো। বলল- এমন দুর্মতি মাতা পুত্রকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করা প্রয়োজন। এদের সংস্পর্শে আকাশ বাতাস দূষিত হবে। উত্তম মানবও যদি এদের সংস্পর্শে আসে তবে সেও অধম হবে । দশরথ রাজার অবস্থা শোচনীয় । চোখ কোটরগত হয়েছে। চিন্তায় মুখে একটা যেনো শোকের ছায়া। কোথায় গেলো সে আনন্দ ? গোটা অযোধ্যা নগরী যেনো অন্ধকারে ডুবল । শোকে যেনো এই নগরী মূর্ছা গিয়েছে। না জ্বলল বাতি, না কোলাহল। ধূ-ধূ মরুভূমির ন্যায় নিস্তব্ধতা ।

রাজবাড়ীতে শোকের পরিবেশ । সর্বদা দশরথ রাজা নিজেকে দোষী ভাবেন । ভাবেন কেন তিনি না বুঝে প্রতিজ্ঞা করলেন। কেন সেদিন কৈকয়ীর সেবা পেয়ে সুস্থ হলেন ? যদি সেদিন অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু তাকে গ্রাস করতো- তবুও এত আক্ষেপ থাকতো না । রাম নয়নের মণি, প্রদীপের আলো, দেহের প্রাণ। এগুলি ছাড়া তিনি মৃতদেহ । কৈকয়ী এক বাঘিনীর মতো তাকে ধীরে ধীরে ভক্ষণ করে খাচ্ছে । শত বোঝানো হল, অনেকে বোঝালো। তবুও কৈকয়ী মত পরিবর্তন করলো না। উলটে সকলকে সে নিজের আর ভরতের শত্রু বলে জাহির করলো । মন্থরা আরোও কুটিল বুদ্ধি দিতে লাগলো কৈকয়ীকে । মহারাজের করুণ অবস্থা দেখেও কৈকয়ীর পরিবর্তন হল না। মহারাজের শরীর অসুস্থ । রামচন্দ্র বুঝতে পেরেও মাতা কৈকয়ীর ইচ্ছা পালন করতে চলছিলেন । যে বংশে হরিশ্চন্দ্রের মতোন মহান রাজা জন্মে শপথ ভাঙ্গেন নি, সেই বংশে জন্মে তিনি কেবল করে পিতার শপথ ভাঙ্গবেন ? আর মাতার ইচ্ছা পূর্ণ করা পুত্রের ধর্ম । বিমাতা হলেও সে মা । বিমাতা অথবা নিজ গর্ভধারিণী, দুজনকেই সমদৃষ্টিতে দেখে তাঁদের সেবা করাই পুত্রের ধর্ম । হোক বিমাতা কঠোর , অত্যাচারী- কিন্তু পুত্রের কর্তব্য গর্ভধারিণী জ্ঞানে তাঁর সেবা, ইচ্ছা পূর্ণ করা । ভগবান রামচন্দ্র সেই শিক্ষাই দিয়েছেন । যাই হোক রামচন্দ্রের বন গমনের কথা সীতাদেবীও শুনেছিলেন । দশরথ রাজা দিবারাত্র “হে রাম” বলে ক্রন্দন করতে লাগলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব – ৩)


রাণী কৌশল্যা, সুমিত্রা , মন্ত্রী সুমন্ত্র ও রাজার পাত্র মিত্র দেখলেন রাজা অসুস্থ । হঠাত এত খুশীর সময়ে রাজা অসুস্থ কেন হলেন বুঝলেন না । অপরদিকে কৈকয়ীর অদ্ভুত রূপ, আচরণ দেখে রাজবাটির সকলেই অবাক আশ্চর্য হলেন। কৈকয়ী কারো সাথে কথা বলে না। কেবল দ্বার এটে মন্থরার সাথে পরামর্শ করে । সম্পূর্ণ অলঙ্কার বিবর্জিতা অলক্ষ্মীর ন্যায় কৈকয়ীকে দেখে এক হিংস্র সর্বগ্রাসীর ন্যায় বোধ হয় । কৌশল্যা, রাণী সুমিত্রা সকলে রাজার কাছে জানতে চান কি হয়েছে ? রাজা দশরথ আর কতক্ষণ চুপচাপ থাকেন। একসময় বলেই দিলেন তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা, কৈকয়ীর ইচ্ছা । কৌশল্যা, সুমিত্রা রাজার মন্ত্রী সেনাপতি এই ভেবে অবাক হন । কুলগুরু বশিষ্ঠ এই শুনে আশ্চর্য হলেন । শুনে সকলেই ভয়গ্রস্ত হয়। রামচন্দ্র তো নয়নের মণি । নয়ন আছে দেখেই পৃথিবী সুন্দর, নয়নহীনের কাছে সব অন্ধকার। রামচন্দ্র অযোধ্যা ত্যাগ করলে এই অন্ধকার জীবন রেখে কি লাভ ? দুর্ভাগা সে যে নয়ন থাকতেও রামচন্দ্রকে দর্শন করে না। অন্ধ যদি রামচন্দ্রের স্পর্শ, বাক্য শ্রবণের সান্নিধ্যে আসে তবে সে ধন্য আর ভাগ্যবাণ- সেই যথার্থ জীবিত । কৈকয়ী কেন সকলের প্রাণ কে কেড়ে নিয়ে ‘জীবিত শবদেহ’ বানাতে চাইছে ? কৈকয়ী কেন সকলকে অন্ধ বানাতে চাইছে ? কৈকয়ী সুস্থ তো, নাকি কৈকয়ীর ছদ্দবেশে রঘুবংশের কোন প্রাচীন শত্রু ? নাকি নিশাচর রাক্ষসী কৈকয়ীর ছদ্দবেশে? নাকি কোন দুষ্ট মায়াবলে কৈকয়ীর মধ্যে থেকে সকল প্রকার শুভ চিন্তা হরণ করেছে? কৌশল্যা, সুমিত্রা বোঝাতে গেলো কৈকয়ীকে । রাণী দ্বয় বলল- “কৈকয়ী। তুমি সর্বদা রামকে নিজ পুত্র বলে আদর স্নেহ করতে ? আজ তোমার সেই আদর যত্ন কোথায় লুপ্ত হল? তবে সেগুলো কি কেবল তোমার অভিনয়?”

কৈকয়ী বলল- “নিজ পুত্রের সুরক্ষা করা মাতার প্রধান কর্তব্য ? আমি কি এমন অন্যায় আবদার করেছি ? ভরতের সুরক্ষা প্রদান করা আমার প্রধান কর্তব্য । কেন রাম রাজা হবে? ভরত কোন অংশে কম ? ভরত কি যোগোত্যাহীন ? কেন কৌশল্যা তুমি রাজমাতা হবে? আমি হবো না কেন? আমি নিজ পুত্রের জীবন সুরক্ষিত করবার কর্ম করেছি। আমি কোনরূপ আন্যায় আবদার করি নি।” রাজা দশরথ অনেক বোঝালো, “এমন অন্যায় আবদার ফিরিয়ে নাও । এমন কদাপি করো না। রাম তোমাকেই মা রূপে নিজ গর্ভধারিণী কৌশল্যা থেকেও অধিক উচ্চাসনে স্থাপন করে, সেই রামের সাথে অন্যায় করতে তোমার বিবেকে বাধে না ?” কৈকয়ী বলল- “মহারাজ ! আমাকে ভুললে চলবে না ভরত আমার গর্ভজাত। রাম যতই আমাকে মাতৃভক্তি করুক, কিন্তু ভরত আমার গর্ভের। আমি রামকে গর্ভে ধারন করি নি। সে আমার সতীনের গর্ভজাত- একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না? তবে সতীনের পুত্রের উপর ভরসা কি? যদি রাজা হবার পর যদি সে আমাকে আর আমার গর্ভের সন্তান ভরতকে বিতারিত করে তবে আমাদের গতি কি হবে? আপনি নিজেও তো অন্যায় করেছেন। আপনি রামকে এতই স্নেহ করেন যে ভরত আপনার পুত্র – এটা বিস্মৃত হয়েছেন। কেন আপনি ভরতের অনুপস্থিতিতে রামের রাজ্যাভিষেক করালেন ? এর অর্থ কি? আপনি জীবিত থাকতেই যদি এমন অন্যায় হয় , তবে আগামীকালে আমার আর আমার গর্ভজাত পুত্র ভরতের জীবন যে অন্ধকারময় হবে- এতে সন্দেহ কি? ভরত আমার গর্ভজাত, রাম নয় ।” রাজা দশরথ বললেন- “কুটিল নাগিনী। তোমার গর্ভ থেকে ভরতের ন্যায় সর্প উৎপন্ন হবে, এতে আর সন্দেহ কি? রামের ন্যায় রত্ন কদাপি তোমার গর্ভ থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। বোধ হয় ভরত মাতুলালয়ে যাবার পূর্বে তোমাকে কুবুদ্ধি দিয়েছে। সেও কি বিস্মৃত হয়েছে যে রামচন্দ্র তার ভ্রাতা ভরতকে কত স্নেহ করে? তোমরা জননী- পুত্র উভয়েই সর্বনাশের হোতা। ভুল করেছি আমি তোমাকে বর দেবার প্রতিজ্ঞা করে। তোমাদের শাস্তি প্রদান করা উচিৎ।”

পুনঃ দশরথ শান্ত হয়ে বললেন- “হে কৈকয়ী! তোমার প্রথম ইচ্ছা আমি পূর্ণ করবো। কিন্তু রামকে বনবাসে প্রেরণ করতে বোলো না। রাম বিনা অযোধ্যা অন্ধকার, এই রাজমহল অন্ধকার, আমি অন্ধকার। সে বরং এখানেই থাক।” কৈকয়ী বলল- “মহারাজ। সেও সম্ভব না। আমি জানি এতে আপনার এবং আপনার বড় রাণীর কষ্ট হবে। ক্লেশ আমিও ভোগ করবো। কারণ রামচন্দ্র আমারও সন্তান । কিন্তু মহারাজ আমি ভরতের রাজ আসন নিষ্কণ্টক করতে চাই। আমি চাই না রাম বিদ্রোহ ঘটিয়ে ভরতকে হত্যা করে পুনঃ সিংহাসন অধিষ্ঠান করুন। অযোধ্যা, মিথিলা, নিষাদ রাজ্যে রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তা অত্যাধিক। এই অবস্থায় গোপোনে ষড়যন্ত্র করে রামচন্দ্র যে কোন মুহূর্তে আমার সন্তানকে হত্যা করতে পারে। মহারাজ! সিংহাসন এমন , যাঁর জন্য মানুষ তো দূর দেবতারাও অপরাধ করেন। আপনি কি বিস্মৃত হয়েছেন স্বয়ং দেবতাদের সম্রাট ইন্দ্র , তাঁর বিমাতা দিতির গর্ভস্থ সন্তান কে হত্যা করেছিলো। সেজন্য এই সব ব্যবস্থা । অতএব আপনি রামচন্দ্রকে সব বলে এখুনি বনে প্রেরণ করুন। আর ভরতকে মাতুলালয় থেকে এনে রাজা করে দিন। আপনার বয়স হয়েছে। এবার আপনি আপনার পুত্র ভরতকে রাজা বানিয়ে বিশ্রাম নিন। ” শুনে কৌশল্যা, সুমিত্রা কৈকয়ীকে অনেক বকা ঝকা করতে লাগলো। অনেক কাকুতি মিনতি করলো। কৈকয়ী নিজ জেদে অটল। কিছুতেই মানলো না । দশরথ কৈকয়ীকে বলল- “তুমি মহাপাপিষ্ঠা। তোমার মনে বিষ। বিষাক্ত নাগিনী যেভাবে বিষ উদ্গীরন করে, সেইভাবেই তুমি বিষবাক্য নির্গত করছ। আমি তোমাকে রানীদিগের মধ্যে সর্বাধিক প্রেম নিবেদন করতাম। আজ জানলাম আমি মহামূর্খ । তোমার ন্যায় কুটিলা রমণীকে বিবাহ করাই আমার সব থেকে বড় ভুল। তুমি দূর হও। তোমার মুখ যে দেখবে তার হৃদয়ের সকল মানবতা ধ্বংস হবে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব – ২)


মন্থরার পরামর্শ মেনে কৈকয়ী তার বুদ্ধি মতো চলল। সমগ্র রাজ্য আনন্দমগ্ন । ভগবান রামের বাল্যসখারা , রামকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন । রাজা দশরথ দেখলেন এই সময় কেবল রাণী কৈকয়ী অনুপস্থিত । তিনি রানী কৈকয়ীর কক্ষে উপস্থিত হলেন রাণীর কাছে । দেখলেন রাণী কৈকয়ীর কক্ষে সমস্ত প্রদীপ নির্বাপিত- ভাগ্যবিধাতা দশরথের ভাগ্যে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত এভাবেই দিচ্ছিল্লেন যা রাজা বুঝতে পারেনি। রাজা বোঝেন নি এই আনন্দ আর ক্ষণস্থায়ী । এক বিশাল দুর্যোগ ধেয়ে আসছে অযোধ্যার দিকে। কক্ষে ঢুকে দশরথ দেখলেন রাণী কৈকয়ী সর্ব অলঙ্কার ত্যাগ করে , একবস্ত্রা হয়ে, নাগিনীর মতোন তাঁর কেশরাশি চতুর্দিকে ছড়িয়ে ভূমিতে অবস্থান করছে । সামান্য একটি প্রদীপের আলোয় রাণীর সেই ভয়ঙ্করী রূপ রক্তপিশাচীর ন্যায় বোধ হচ্ছিল্ল । রাজা দশরথ বললেন- “কৈকয়ী! তোমার এই হেন অবস্থা আমি পূর্বে কদাপি দর্শন করিনি । সমস্ত রাজ্য যখন রামের রাজ্যাভিষেকের কথা শুনে আনন্দিত, তখন তুমি এমন বিষাদগ্রস্তা কেন? এসো এই উৎসবে সামিল হও। তুমি তো রামকে নিজের জেষ্ঠ্যপুত্র বলে দাবী করো। পুত্রের আনন্দের দিনে তোমার এমন অবস্থা কেন? তুমি কি ব্যাধিতে পীড়িতা, তবে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈদ্য এমনকি স্বর্গ থেকে অশ্বিনীকুমার দ্বয়কে বন্দী করে আনতে পারি। তোমাকে কি কেউ কটু কথা বলেছে? কেউ মনে আঘাত দিয়েছে? তাঁর পরিচয় ব্যক্ত করো, এখুনি তার শিরোচ্ছেদ করে তাহার মুণ্ড তোমার চরণে এনে দেবো।” এইভাবে দশরথ রাজা কৈকয়ীকে বোঝালো । কৈকয়ী তখন একটি প্রদীপ হাতে নিয়ে রাজার সম্মুখে এলো। প্রদীপের আলোতে কৈকয়ীর মুখ পদদলিত কালনাগিনীর ন্যায় বোধ হচ্ছিল্ল ।

কৈকয়ী বলল- “মহারাজ! সম্বর অসুর বধের সময় আপনার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো, আমি সেবা করে আপনার প্রান রক্ষা করেছিলাম। সেসময় আপনি আমাকে দুটি বর দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ঐ দুটি বরে আমি যা চাইবো, তাই আমাকে দেবেন! মনে আছে?” দশরথ রাজা বললেন- “হ্যা কৈকয়ী, তোমার সেই ঋণ আমি কদাপি বিস্মৃত হবো না।” কৈকয়ী বলল- “আজ আমি সেই দুটি বর প্রার্থনা করবো। আপনি শপথ গ্রহণ করুন আমি যা চাইবো তাই দেবেন। মনে রাখবেন আপনি রঘুবংশীয় নরপতি। আপনাদের কূলে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে কিন্তু আপনার ও এই কূলের নামে অপযশ হবে।” মহারাজ দশরথ বললেন- “আমি আমার এই সূর্যবংশীয় কূল, সাক্ষাৎ ভগবান সূর্যনারায়ণ ও পূর্বপুরুষদের নামে শপথ করে বলছি তুমি যা চাইবে আমি তাই দেবো।” কৈকয়ী নিষ্ঠুরা ডাইনীর মতো হয়ে বলল- “তবে শুনুন মহারাজ। আমার প্রথম ইচ্ছা যে রাম নয় আমার গর্ভজাত পুত্র ভরত হবে অযোধ্যার রাজা। আপনি রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক বাতিল করুন। দ্বিতীয় ইচ্ছা এখুনি রামকে চৌদ্ধ বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে। বনবাসে গিয়ে রামচন্দ্রকে বনবাসীর ন্যায় জীবন কাটাতে হবে।” শুনে মহারাজ দশরথের যেনো পায়ের তলায় মাটি সড়ে গেলো। বুকে লক্ষ লক্ষ বজ্রপাত হতে থাকলো। চোখে মুখে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার ছেয়ে গেলো । একি কথা বলছে কৈকয়ী ! এমন কথা কৈকয়ীর মুখে ! রাজা অজ্ঞান হয়ে ভূমিতে আহত গজের ন্যায় পতিত হলেন । কৈকয়ী চোখে মুখে জল দিয়ে চেতনা ফেরালেন রাজার। তারপর বললেন- “মহারাজ । আপনি আপনার কূল, ইষ্টদেবতা, পূর্বপুরুষদের নামে শপথ করেছেন। এবার শপথ পালন করুন।” মহারাজ দশরথ বললেন- “কৈকয়ী তোমার কি চেতনা লুপ্ত হয়েছে ? নাকি কোন অশরীরী আত্মা তোমাকে গ্রাস করেছে ? নাকি তুমি মানসিক ভারসাম্য লুপ্ত হয়েছো? নাকি তুমি কৈকয়ীর ছদ্দবেশী কোন দুষ্ট রাক্ষসী? নাকি তুমি আমার সাথে প্রহসন করছ ? এহেন বাক্য তোমার জিহ্বায় কিভাবে ফুটে ওঠে?”

কৈকয়ী বললেন- “মহারাজ । আমি সুস্থ আছি। কিন্তু যদি আপনি আমার এই দুটি ইচ্ছা পূর্ণ না করেন তবে আমি অনাহারে থেকে অসুস্থ হয়ে প্রাণত্যাগ করবো। আপনিও শপথ ভাঙবার জন্য পূর্বপুরুষদের অভিশাপ প্রাপ্তি করবেন ? ভুলে গেলেন আপনার পূর্বপুরুষদের অমর গাঁথা? অতএব আমার ইচ্ছা পূর্ণ করুন।” মহারাজ দশরথ অনেক বোঝালেন । কিন্তু কৈকয়ী নাছোড়বান্দা । তাঁর ঐ দুটি ভিন্ন অপর ইচ্ছাই নেই । রাজা দশরথ নিজেকে বিমর্ষ মনে করছিলেন । যুদ্ধে আহত সৈন্যের ন্যায় টলতে টলতে কোনো রকমে নিজ কক্ষে গেলেন । বসে রোদন করতে লাগলেন । সারা রাজ্যে যখন আনন্দ , রাজার মনে আতঙ্ক, ভয়, দুঃখ । নিজের কপালে নিজেই আঘাত করে বিলাপ করতে লাগলেন কেন তিনি কৈকয়ীকে দুটি বর দিবার অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন ? কেন তিনি বংশ কুলদেবতার নামে শপথ করতে গেলেন? কেন না জেনে উন্মাদের ন্যায় প্রতিজ্ঞা করলেন । রামচন্দ্র কৈকয়ীকে কদাপি বিমাতা জ্ঞান করে না। বরঞ্চ নিজ গর্ভধারিণী থেকেও অধিক সম্মান, শ্রদ্ধা করে। তবে কৈকয়ী আজ সেই রামের সাথেই কেন বা এমন প্রবঞ্চনা করলো । ক্ষুধার্ত শিশুর সামনে কেমন করে মা তাঁর স্তন্যে বিষ লেপন করে যেতে পারে ? কৈকয়ী সে কর্মটাই করেছে। পুত্র রামকে আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে। বোধ হয় ভরত মাতুলালয়ে যাবার আগে মাতা কৈকয়ীকে এসব কুপরামর্শ দান করে গেছে। রাজা দশরথ “হে রাম!” বলে রোদন করতে লাগলেন । বাইরের আনন্দ, বাজনা, নৃত্য, গীতে রাজার এই ক্রন্দন চাপা পড়ে গেলো। অপরদিকে কৈকয়ী জালে বদ্ধ হরিণের অপেক্ষা করতে লাগলো ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব – ১ )

নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্ ।
দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততোজয়মুদীরয়েৎ ।।

ভয়হর মঙ্গল দশরথ রাম ।
জয় জয় মঙ্গল সীতা রাম ।।
মঙ্গলকর জয় মঙ্গল রাম ।
সঙ্গতশুভবিভবোদয় রাম ।।
আনন্দামৃতবর্ষক রাম ।
আশ্রিতবৎসল জয় জয় রাম ।।
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম ।
পতিতপাবন সীতা রাম ।।

রাজা দশরথের চারপুত্রের বিবাহ হয়ে গেছে। চার পুত্রেরা সুখে সস্ত্রীক সংসার ধর্ম পালন করছেন । সমগ্র অযোধ্যায় খুশীর পরিবেশ । চারপাশে শান্তি। রাজা দশরথ নিশ্চিন্ত হলেন। বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে রাজার । জীবনের আর ভরসা কি? পরকালের ডাক আসলেই কেউ আর এক মুহূর্ত বেঁচে থাকে না । রাজা দশরথ মন্ত্রী, সেনাপতি, উপদেষ্টার সাথে পরামর্শ করলেন। সকলেই বলল রামচন্দ্রের রাজ্যভিষেক করতে। তাঁকে অযোধ্যার রাজ আসনে বসাতে । দশরথ রাজা খুশী হলেন । ভাবলেন এটাই তো মনের ইচ্ছা। অপরদিকে মন্থরা এসকল শুনে , কৈকয়ীকে বলল- “রানী কৈকয়ী। তুমি নিজের সর্বনাশ দেখতে পেয়েও অন্ধ হয়ে আছো? রামের জন্য আনন্দ প্রকাশ করছ ? তোমার ন্যায় অবধ ত্রিলোকে নেই।” কৈকয়ী শুনে ক্ষেপে গিয়ে গেলো। বকাঝকা করে মন্থরাকে বলল- “তোর দেহের ন্যায় তোর মন কুৎসিত। জিহ্বা সংযত করো। পুনঃ আমার পুত্র রামের সম্বন্ধে অনুচিত কিছু বললে আমি তোর জিহ্বা চ্ছেদ করবো।” একদিন মহারাজ দশরথ ভরতকে মাতুলালয় কেকয় রাজ্যে পাঠালেন । ঠিক সেই সময় রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের কথা ঘোষণা করলেন রাজা দশরথ । ভরতের অনুপস্থিতিতে এই ঘোষণা হল । সারা রাজ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো। সমগ্র অযোধ্যাবাসীর নয়নের মণি ছিলেন রামচন্দ্র। এই অবস্থায় রামচন্দ্রের রাজা হওয়ার সংবাদে সমগ্র নাগরিকেরা আনন্দ উৎসব করতে লাগলেন। সুদূঢ মিথিলাতে এই সংবাদ পৌছালে সেখানেও আনন্দ উৎসব আরম্ভ হল ।

ভরতের অনুপস্থিতিতে রামচন্দ্রের রাজা হবার সংবাদ শুনে কৈকয়ীর মোটেও ভালো লাগেনি । উপরন্তু মন্থরা আরোও কুবুদ্ধি দিয়ে বলতে লাগলো। বলল- “কৈকয়ী! তোমাকে আমি শিশু অবস্থা থেকে দেখছি। পিতার গৃহে আদর যত্নে পালিতা হয়েছো। অযোধ্যার রাণী রূপে সুখ ভোগ করছ। কিন্তু রামচন্দ্র রাজা হলে এই সব সুখ তোমার কপালে স্থায়ী হবে না। রাজা দশরথকে হাত করে কৌশল্যা এসব বুদ্ধি করেছে। সেজন্যই ভরতকে মাতুলালয়ে প্রেরণ করেছে। রাজার মনে সুবুদ্ধি থাকলে সে এমন ভরতের অনুপস্থিতিতে কেন রাজ্যাভিষেক ঘোষণা করলেন! জাগো রাণী কৈকয়ী। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করো।” রাণী কৈকয়ী সত্যি এবার ভীত হলেন। ভাবতে লাগলেন কি করা যায় । মন্থরার কুটিল বাক্য সমানে কৈকয়ীর মনকে বিষাক্ত করে তুলতে লাগলো । কৈকয়ী ভাবল- “সত্যি তো ! ভরতের অনুপস্থিতিতে রাজ্যাভিষেক কেন?” মন্থরা সমানে কুপরামর্শ দিয়ে বলতে লাগলো- “কৈকয়ী! আপন আপনই হয় আর পর পরই হয় । ভরত তোমার গর্ভজাত, রামচন্দ্র তোমার গর্ভজাত নয়। রাম সর্বদা কৌশল্যার ভালো মন্দই দেখবে। তোমার নয়।” শুনে কৈকয়ী ভাবলেন – “সত্যি যদি এমন হয়, শেষ বয়সে হয়তো রাম তাঁকে রাজবাটি দেখে বিতারিত করবে। তখন ভরতকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো? ” মন্থরা বলল- “একবার রাম রাজা হয়ে সিংহাসনে বসলে কৌশল্যা হবে রাজমাতা। আর কৌশল্যা তখন তোমাকে দাসীতে পরিণত করবে। কেউ নিজের সতীনকে সহ্য করতে পারে না। কৌশল্যা এতকাল মনে ক্ষোভ সহ্য করে তোমার সাথে উত্তম ব্যবহার করেছে। তখন সে তোমাকে ঝি বানিয়ে রাখবে। আমি তোমাকে রাজার কণ্যা হিসাবে , রাজার পত্নী রূপে চিরকাল দেখে এসেছি। ঝিগিরি করতে তোমাকে আমি দেখতে পারবো না। আর ভরতকে বানাবে দাস, বা তাঁকে গোপোনে হত্যা করতেও পারে। ভাবো কৈকয়ী ভাবো। রামচন্দ্র রাজা হলে তোমার অদৃষ্টে শণির দশা আছে।”

কৈকয়ীর ভয়ে বুক হাত পা শুকিয়ে গেলো। বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগলো। কৈকয়ী বলল- “চুপ কর। এসব আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আমি আমার ভরতের জন্য সব কিছু করতে রাজী। বল মন্থরা আমি কি করবো?” মন্থরা বলল- “উপায় আছে। সম্বরাসুর বধের পর রাজা দশরথ ক্ষতবিক্ষত হলে তুমি তার সেবা করে তাকে সুস্থ করেছিলে। সেই সময় রাজা দশরথ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তোমাকে দুটি বর দেবেন। রাজা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। স্মরণ করো। এখন সেই বর দুটি চেয়ে নেবার সময় এসেছে।” কৈকয়ী বলল- “আমার সব স্মরণ আছে। বল মন্থরা আমাকে কি চাইতে হবে?” মন্থরা বলল- “প্রথম বরে তুমি রামের বদলে ভরতকে রাজা করবার দাবী জানাও, আর দ্বিতীয় বরে রামচন্দ্রের চৌদ্দ বছরের বনবাস প্রার্থনা করো।” কৈকয়ী বলল- “প্রথম বর ঠিক আছে, দ্বিতীয় বরে বনবাস কেন?” মন্থরা বলল- “তুমি অত্যন্ত নির্বোধ রাণী। রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তা প্রজাদের মধ্যে বিপুল আছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী নিষাদ রাজ গুহক রামচন্দ্রের মিত্র। মিথিলার মতো শক্তিশালী দেশের রাজা জনক, রামের শ্বশুর। ইচ্ছা করলেই রাম গোপোনে এদের দিয়ে আঁতাত করে ভরতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষোনা করে ভরতকে বধ করতে পারে। তারপর সে নিষ্কণ্টক অবস্থায় রাজা হতে পারবে। তাই রামের চৌদ্দ বছর বনবাস প্রয়োজন। ভরতের প্রান রক্ষার ভাবনাও তোমার।” কৈকয়ী বিষাক্ত নাগিনীর মতো বলে উঠলো- “তাই হবে মন্থরা। আমি আমার ভরতের জন্য সব করতে রাজী। আমি রামের রাজা হওয়া রোধ করবো।”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড – ৩৭ )


এইভাবে বিবাহ সম্পন্ন হল। মিথিলাবাসী খুব আনন্দের সহিত এই বিয়েতে অংশ নিলেন। অবশেষে বিদায়ের সময় এলো। মিথিলাপুরীতে কান্নার রোল উঠলো। সমগ্র মিথিলাবাসীর চোখে জল। যেনো সীতা সকলের দুহিতা। কন্যাবিদায়ের সময় যেমন পিতামাতা রোদন করেন- তেমনি মিথিলার লোকজন রোদন করতে লাগলেন । পুস্প, স্বর্ণ মাল্য দ্বারা চার ভ্রাতার রথ সাজানো হয়েছিলো। বরযাত্রীরা ধ্বজ, ছত্র, বিবিধ বাজনা নিয়ে অযোধ্যা ফিরবার প্রস্তুতি নিলেন। ঠিক সেই সময় এক অঘটন ঘটলো। মহর্ষি পরশুরাম এসে হাজির হলেন । পরশুরামের ক্রোধের কথা সকলে জানতেন। তিনি ২১ বার ধরিত্রী ক্ষত্রিয়শূণ্য করেছিলেন । তিনি আসতেই সমগ্র ক্ষত্রিয়রা ভূমিতে দণ্ডবৎ হয়ে প্রনাম জানাতে লাগলেন। রাজারা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন- কি জানি আবার ইনি ক্ষত্রিয় বধ আরম্ভ করেন কিনা । পরশুরাম ক্রোধে বললেন- “কে ভগবান শিবের ধনুক ভঙ্গ করেছে ? কে সেই বীর? সামনে আসুক সে। নচেৎ আজ একটি ক্ষত্রিয়কে আমি জীবিত রাখবো না। সব নাশ করে দেবো। আমি জমদাগ্নি পুত্র পরশুরাম । আমার নাম শুনে গর্ভস্থ ক্ষত্রিয় সন্তান অবধি থরথর করে কাঁপে।” লক্ষণ রেগে বললেন- “আপনি অত রাগছেন কেন? বাল্যকালে আমরা খেলাচ্ছল্লে কত ধনুক ভেঙ্গে ফেলেছি? এ আর এমন কি?” শুনে পরশুরাম ক্রোধে হুঙ্কার দিয়ে বললেন- “মূর্খ বালক। আমার সহিত রসিকতা? এ যে সে ধনুক নয়। রুদ্রদেবের প্রদত্ত ধনুক। একে ভঙ্গ তো দূর, তোলার শক্তি অবধি নেই। হে ক্ষত্রিয় বালক, স্তব্ধ হও, নাহলে এবার আর একবার আমি ক্ষত্রিয় নিধন করবো। তুমি কি শোনোনি যে আমি একুশবার ক্ষত্রিয় জাতির নাম বিলুপ্ত করেছি!”

লক্ষণ বললেন- “আপনিও রঘু বংশের বীরত্ব গাঁথা শোনেননি । আমরা থাকলে আপনি আর একুশ বার ক্ষত্রিয় শূন্য করতে পারতেন না। সমুচিত উত্তর দিতাম। আপনি গর্বে উন্মত্ত হয়ে আমাদিগকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু কদাপি আমরা ভীত হবো না।” শুনে পরশুরাম মুনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন- বললেন- “উদ্ধত বালক! আর একটি কথা বললেই ভগবান শিবের প্রদত্ত কুঠার দিয়ে তোমার বলি চড়াবো।” লক্ষণ নিজেও দমবার পাত্র নয়। অতএব তখন ভগবান রাম এসে করজোড়ে বললেন- “মহামুনি! আপনার শ্রী চরণে প্রনাম জানাই। আমি সেই, যে শিব ধনুক ভঙ্গ করেছে।” তখন ভগবান পরশুরাম কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন- “হে রামচন্দ্র! ভগবান শিব আমাকে একটি দিব্য ধনুক দিয়েছেন। দেখি তুমি এই ধনুকে জ্যা সংযোগ করো। তবেই বুঝবো।” বলে পরশুরাম তাঁর ধনুক এগিয়ে দিলেন। ভগবান রাম জ্যা পরালেন সেই ধনুকে । পরশুরাম মুনি অবাক হলেন। এরপর একটি তাজ্জব ঘটনা ঘটে গেলো। অকস্মাৎ পরশুরাম দেখেন তাঁর সম্মুখে রামচন্দ্রের স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন চতুর্ভুজ ভগবান নারায়ণ । তিনি মৃদু মৃদু হাসছেন । পরশুরাম মুনি করজোড়ে তখন রামচন্দ্রকে প্রনাম করলেন । স্তব স্তুতি করে বললেন- “হে রাম! আপনি আমার দর্প চূর্ণ করেছেন । ক্ষত্রিয় নিধন করতে করতে আমার মনে গর্ব উৎপন্ন হয়েছিলো। আজ আপনি তা চূর্ণ করলেন । আপনি দিব্য শর দ্বারা আমার সকল শক্তি হরণ করুন। এক যুগে একসময়ে দুটি অবতার একত্রে থাকতে পারে না। আমি প্রস্থান করবো।” তখন ভগবান রাম পরশুরামের ধনুক থেকে দিব্য বাণ নিক্ষেপ করে পরশুরামের সকল শক্তি নষ্ট করলেন। এরপর পরশুরাম সকলকে আশীর্বাদ করে প্রসন্ন চিত্তে মহেন্দ্র পর্বতে তপস্যার জন্য প্রস্থান করলেন ।

এরপর বরযাত্রী অযোধ্যায় এলেন। চারপুত্র চার বধূকে এনেছে , সমগ্র অযোধ্যা সেজে উঠলো। রাস্তাগুলি পরিষ্কার করে রংবাহারী মালা, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হল। গৃহগুলির সামনে কদলী বৃক্ষ, প্রদীপ, পুস্পমালা দিয়ে সাজানো হল । এছারা গৃহের আঙ্গিনায় রঙবেরঙ্গের রঙ দিয়ে রঙ্গোলি বানানো হল। বিবিধ আতসবাজিতে আকাশ ঢেকে গেলো। চতুর্দিকে আলোর রোশনাইতে ভরে গেলো। কৌশল্যা দেবী সীতাকে বরণ করে নিলেন, কৈকয়ী মাণ্ডবীকে বরণ করলেন। সুমিত্রা রানী, ঊর্মিলা আর শ্রুতকীর্তিকে বরণ করে নিলেন। বিবিধ উপঢৌকন দেওয়া হল। উপস্থিত রাজণ্য বর্গ বিবিধ অলঙ্কার, আভূষন উপহার দিলেন । দুন্দুভি, ন্যাকরা, বাঁশী, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, কাঁসর বাজতে লাগলো । সকলেই নববধূ দেখতে রাজমহলের দিকে ধাবমান হল । রাম সীতাকে দেখে মনে মনে তাঁরা বলতে লাগলো- “সাক্ষাৎ লক্ষ্মী নারায়ণ এক আসনে বিরাজিতা হয়ে আছেন।” রাজা দশরথ খুশী হয়ে মহাভোজ এর আয়োজন করলেন । সমস্ত রাজ্যে উৎসব । খালি একজন ছিলো অখুশী, সে ছিলো কৈকয়ীর দাসী মন্থরা । সমানে সে কৈকয়ীকে কুবুদ্ধি দিতে লাগলো। কৈকয়ী এসবকে মোটেও পাত্তা দিতো না । বিবাহ কে কেন্দ্র করে রাজা অনেক দান ধ্যান করলেন। এভাবে চার ভ্রাতার বিবাহ সমাপন হল। রাম সীতা আনন্দে থাকতে লাগলেন ।

( আদিকাণ্ড সমাপ্ত )
Share:

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড – ৩৬ )

বিশ্বামিত্র মুনি একাকী অযোধ্যায় গেলেন । শয্যাগত রাজা দশরথ একাকী বিশ্বামিত্রকে আসতে দেখে মহা আতঙ্কগ্রস্ত হল। ভাবল রাম লক্ষণের প্রাণ চলে গেছে। রাণীরা ভয় পেলো। বিশ্বামিত্র মুনি খুশীর সংবাদ প্রদান করলেন । বললেন- “রাজন! আপনি ভরত, শত্রুঘ্ন ও আপনার আত্মীয় স্বজন নিয়ে সত্বর মিথিলায় চলুন। রাম, লক্ষণ সেখানেই আছেন।” শুনে যেনো উৎসবের রোল পড়ে গেলো সমগ্র অযোধ্যায় । রাণীরা খুশীতে দাস দাসীদের অলঙ্কারাদি অর্থ উপহার দিলেন । দুন্দুভি, শিঙা, ন্যাকড়া, করতাল , ঢোল বাজতে লাগলো । অযোধ্যা নগরীতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেলো । রাজা দশরথ অবিলম্বে আত্মীয় স্বজন, কুটুম্ব, বান্ধব, পাত্র, মিত্র নিয়ে চললেন মিথিলার উদ্দেশ্যে । হাজার হস্তী, লক্ষ ঘোড়াসোয়ার , লক্ষ রথ, লক্ষ সেনা নিলেন বরযাত্রী রূপে । ভরত, শত্রুঘ্নকে বর বেশে সাজানো হল। সোনার উঞ্জীস, হীরক মালা, স্বর্ণ খচিত ধুতি, হীরক- মণি- মুক্তা খচিত পাদুকা পড়ে ভরত, শত্রুঘ্ন রথে উঠলেন। তিন রাণী ধান দূর্বা দিয়ে বরযাত্রী প্রেরণ করলেন। উলুধ্বনি, শঙ্খের ধ্বনিতে ও বিবিধ বাজনায় আকাশ- বাতাস ভরে উঠলো। অযোধ্যার লক্ষ কোটি মানব সাথে বরযাত্রী রূপে মিথিলায় রওনা দিলো । আতস বাজি, হাউই, ফুলঝুরি আদি শব্দবাজি দিয়ে যেনো চতুর্দিকে আলোকময় হয়ে উঠলো । নর্তক নর্তকী আগে আগে নৃত্য করতে করতে চলল। বরযাত্রীরা আনন্দে উল্লাসে চলতে লাগলেন । মিথিলায় পৌছাতে দুই ভ্রাতাকে বরন করে নিলেন সুনয়না দেবী ও জনকের ভ্রাতা কুশধ্বজ এর পত্নী ।

মার্গশীর্ষ তে শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে মৃগশিরা নক্ষত্রে এই বিবাহ স্থির হয়েছিলো । এই উৎসব “বিবাহ উৎসব” নামে নেপালে এখনও পালিত হয় । বিবাহের দিন উপস্থিত হল। চার ভ্রাতা অতি উত্তম বস্ত্রে সুসজ্জিত হলেন । মিথিলা রাজবাড়ীতে বিবিধ বাজনা বাজতে লাগলো । ঢোল, ন্যাকরা, মৃদঙ্গ, দুন্দুভি, শিঙা, শঙ্খ বাঁজতে লাগলো । স্বর্ণ দ্বারা পরিহিত উঞ্জিস, হীরা- মণি যুক্ত মাল্য , স্বর্ণ দ্বারা খচিত ধুতি পড়ে চার ভ্রাতাকে দেবদূত মনে হতে লাগলো। বর দেখতে মিথিলাবাসীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়লো। সকলে এমন ঠেলাঠেলি করতে লাগলো- যেনো স্বর্গ থেকে ঈশ্বর অমৃত ভাণ্ড নিয়ে বিতরণ করতে উপস্থিত হয়েছেন । চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখেও মনের আশা মেটে না। যত দেখা যায় তত দেখার ইচ্ছার তিনগুন বৃদ্ধি পায় । চার কন্যা উত্তম রেশমি বস্ত্রে সুসজ্জিতা হলেন। নক্ষত্র মণ্ডলের দ্যুতির ন্যায় অলঙ্কারাদি দ্বারা চার বোন সজ্জিতা হলেন । মহর্ষি শতানন্দ ঠিক করলেন গোধূলী লগ্নে রাম সীতার বিবাহ দেবেন, অন্য লগ্নে বাকী তিন ভ্রাতার বিবাহ হবে । কিন্তু দেবতারা দেখলেন গোধূলী লগ্নে বিবাহ হলে রাম সীতার বিচ্ছেদ অসম্ভব । একদিকে যেমন নারদ মুনির শাপ ফলবে না তেমনি রাবণ বধ হবে না। অতএব ঐ লগ্ন নষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন । ইন্দ্রাদি দেবগণ তখন চন্দ্রদেবকে সুন্দরী নর্তকীর বেশে সভায় পাঠালেন । নিশানাথ শশীদেব এক অপূর্ব সুন্দরী নর্তকী সেজেছিলেন । যাঁর ঘুঙুরে মিষ্টি সুরে ত্যাগী পুরুষেরও ব্রহ্মচর্য খণ্ডন হয়। অপূর্ব চাউনি কটাক্ষে কামবাণে জর্জরিত করতে পারে। নরম গোলাপী ঠোট এর মধ্যে বিদ্যুত তরঙ্গ প্রবাহিত। সেই তরঙ্গ বোধ হয় সে মদন দেবের থেকে হরণ করে এনেছে। কালো অমাবস্যার রজনীর ন্যায় কেশ, ফনাধারী নাগিনীর ন্যায় তার কোমল পৃষ্ঠে খেলা করে । সেই নর্তকী এসে সভামাঝে নৃত্য আরম্ভ হল। নৃত্য দেখতে দেখতে সকলেই তন্ময় হয়ে গেলো। গোধূলী লগ্ন পার হয়ে গেলো। হঠাত সেই নর্তকী সভামাঝে অদৃশ্য হলেন । তখন সকলে সচেতন হলেন ।

অন্য লগ্নে চার ভ্রাতার বিবাহ একত্রে ঠিক হল । যথা সেই ক্ষণ আবির্ভূত হল। রামচন্দ্রের সাথে সীতার, ভরতের সাথে মাণ্ডবীর, লক্ষণের সাথে ঊর্মিলার, শত্রুঘ্নের সাথে শ্রুতকীর্তির বিবাহ সম্পন্ন করতে লাগলেন পুরোহিত শতানন্দ। রাজা দশরথ, রাজা জনক দুই মিত্রতে পরস্পরে শুভেচ্ছা কুশল বিনিময় করতে লাগলেন । ভগবানের বিবাহ তে স্বর্গ থেকে দেবতারা সস্ত্রীক মানবের ছদ্দবেশে নেমে এলেন । প্রজাপতি ব্রহ্মা- সরস্বতী দেবী, শিব- গৌরী, নারদ মুনি সকলে ছদ্দবেশে আসলেন । রাজা জনক অভ্যর্থনা জানালেন । মুনি ঋষিরা উপস্থিত হয়েছিলো। পবিত্র মন্ত্র উচ্চারন করে চারভ্রাতার বিবাহ হল। সকল উপস্থিত লোকেরা- সূপ, সুবাসিত অন্ন, পলান্ন, দৈবরা, ঘৃতান্ন, ক্ষীরমঞ্জরী, রসমঞ্জরী, দুগ্ধকদম, শিরা, পুরি, কচুরি, পিষ্টক, জিলাপী, লড্ডু, মোদক, বরফি, অষ্টাকি , মতিচুর, হালুয়া, ক্ষীর, নবনী, উত্তম দহি , ক্ষীরমণ্ড , বোঁদক, গজা- খাঁজা, সারিশি ( ক্ষীর মণ্ড উত্তম রূপে পাক করে চিনি গুর মিশ্রিত করে এক ধরণের মিষ্ট), কদমরস ( এক ধরণের মিষ্ট ), পায়সান্ন , প্যাঁডা, দৈরসা (নারকেল, বাদাম, কাজু, কিসমিস মিশ্রিত ময়াদার মণ্ড এলাচ মিশ্রিত মিষ্ট দুধে ঘন করে জ্বাল করা ) , অম্বল, কর্পূর- মশলাদি সজ্জিত তাম্বুল ( তামিল রামায়ন ) এমন ও আরোও অনেক ব্যাঞ্জন পেট পুড়ে ভোজন করে আবার অনেকে ভোজোনান্তে বাধা ছাঁদা করে নিয়ে গেলো । সকলে খেয়ে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। নানারকম গান, বাজনা, নৃত্য ইত্যাদি মিথিলা রাজ্যে অনুষ্ঠিত হতে লাগলো। রাজা প্রচুর দান ধ্যান করলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ৩৫ )

জনক রাজার সভায় রাজারা উপস্থিত । তুলসীদাসী রামায়ণে লিখিত আছে এই সভায় ১০ সহস্র রাজা এসেছিলো। বাণাসুরও এসেছিলো । রাজা জনক সভামাঝে সকল রাজণ্য বর্গকে সম্মান জানিয়ে স্বাগত জানালেন । রেশমি স্বর্ণ খচিত বস্ত্রে ও বিবিধ অলঙ্কারে সুসজ্জিতা হয়ে জনক দুহিতা সীতাদেবী সভায় উপস্থিত হয়ে পর্দার আড়ালে বরমাল্য নিয়ে কেবল লজ্জিত দৃষ্টিতে শ্রীরামকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন । দেবীর অলঙ্কার গুলি থেকে এমন দ্যুতি নির্গত হচ্ছিল্ল, মনে হচ্ছিল্ল আকাশের নক্ষত্র মণ্ডল দিয়ে জানকী দেবীর অলঙ্কার গুলি নির্মিত হয়েছে । অলঙ্কারের দ্যুতিতে সীতাদেবীর মধুময় মুখমণ্ডল অতীব সুন্দর দেখাচ্ছিল্ল । মনে হচ্ছিল্ল পরমপিতা ব্রহ্মা ত্রিলোকের সকল সৌন্দর্য একত্রিত করে সীতাদেবীকে গঠন করেছেন । সীতাদেবীর মা সুনয়না দেবী রামকে দেখা মাত্রই মনে বাৎসল্য ভাবের উদয় হল। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন- “এই কিশোর যেন অবশ্যই আজ ধনুক তুলে তা ভঙ্গ করতে পারে। এই পাত্রই সীতার জন্য উপযুক্ত।” এই ভেবে সুনয়না দেবী মনে মনে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন । উপস্থিত মিথিলার নাগরিকেরা নিজ নিজ ইষ্টের কাছে প্রার্থনা জানালো- ঐ সুদর্শন অযোধ্যার রাজকুমার রামের সাথেই যেন সীতার বিবাহ হয় । সভামাঝে বিশাল হরধনু এনে স্থাপিত করলেন রাজা জনক । কুলগুরু মহর্ষি শতানন্দ ও উপস্থিত সাধু সন্ন্যাসী , ব্রাহ্মণ দিগের প্রনাম করে রাজা জনক প্রতিযোগিতার সূত্রপাত করলেন ।
কত রাজা এলো- কিন্তু ধনুক ভঙ্গ করা তো দূর, একচুল নড়াতে অবধি পারলো না । সকল রাজা, রাজকুমার আস্ফালন করে এলেন, আবার লজ্জিত হয়ে চলে গেলেন । কেউ একচুল নড়াতে পারলো না সেই দিব্য ধনুক । হঠাত সভামাঝে বাণাসুর এলো। ভয়ে সীতাদেবী মনে মনে মাতা উমার কাছে জানালেন- যেনো এই অসুর ব্যর্থ হয় । প্রবল পরাক্রম অসুর ব্যর্থ হয়ে লজ্জিত হয়ে চলে গেলো । এরপর আরোও রাজা, রাজকুমার এলেন – কিন্তু সকলেই অসফল হয়ে লজ্জিত হয়ে হেট বদনে চলে গেলেন । হঠাত সভামাঝে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হল । যেনো বিশাল ঝড় সভাতে প্রবেশ করেছে এমন অবস্থা। ভয়ানক অট্টহাস্য করে দশানন রাবণ সভায় উপস্থিত হল। রাজা জনক বললেন- “হে দশানন আপনাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি, আপনি কেন এসেছেন?” রাবণ দশমুখ দিয়ে অট্টহাস্য করে বলল- “এর ফল তুমি ভোগ করবে রাজা জনক। আজ আমি এই ধনুক ভঙ্গ করে তোমার কণ্যাকে বিবাহ করে লঙ্কায় নিয়ে যাবো। আমি এই হস্তে কৈলাস পর্বত উত্তোলন করেছি- ঐ ধনুক তো কোন ছাড়!” রাবণ যখন ধনুক তুলতে অগ্রসর হল , তখন ভয়ে সীতা দেবীর মুখ শুকিয়ে গেলো। তিনি মনে মনে মাতা উমাকে স্মরণ করে বললেন- “মাতঃ ! এই পাপী যেনো কোনমতে সমর্থ না হয়। নচেৎ এই মুহূর্তে আমি এই দেহ ত্যাগ করবো। হে শঙ্করী, ভবানী! তুমিই ভরসা । আমাকে এইহেন বিপদ থেকে রক্ষা কর।” জনক রাজা , রানী সুনয়না, উপস্থিত মুনি ঋষি ও লোকেরা প্রার্থনা করতে লাগলেন ভগবানের কাছে। এই পাপীর হস্তে সীতাদেবীকে তুলে দেওয়া মানে অগ্নিতে কন্যা সমর্পণ করা। সকলে ইষ্টদেবতার কাছে রাবণের অসফলতা কামনা করতে লাগলো। রাবণ বহু চেষ্টা করে সেই ধনুক তুলতে পারলো না। পরাজিত হয়ে রাবনের ঘাম নির্গত হল । সকলে হাসতে লাগলো। রাবণ বলল- “এর শোধ আমি নেবোই। একদিন সীতাকে আমি আমার রাজ্যে নিয়ে যাবোই।” বলে রাবন গর্জন করতে করতে মিথিলা থেকে চলে গেল।
কোনো রাজা, রাজকুমার সফল হল না দেখে জনক রাজা আক্ষেপ করে বলল- “এই ধরণী তে কি বীরের অভাব হয়েছে ? এমন কি কোন বীর নেই যে এই ধনুক ভঙ্গ করে আমার কন্যাকে বিবাহ করে? তবে আমার কণ্যা কুমারী থাক।” শুনে লক্ষণ রেগে গিয়ে বলল- “ক্ষমা করবেন মহারাজ! আপনি এখনও রঘুকুলের বীরত্ব দেখেন নি, তাই এমন বলছেন। রঘুকুলের বীরত্ব দেখলে এমন কদাপি উচ্চারন করতেন না।” তখন বিশ্বামিত্র মুনির আদেশে রামচন্দ্র উঠলেন । তিনি সভামাঝে উপস্থিত বিশ্বামিত্র গুরু , মুনি, ঋষি , ব্রাহ্মণ, জনক- সুনয়না দেবী ও উপস্থিত সকলকে প্রনাম জানিয়ে হর ধনুর সম্মুখে গেলেন। সেই পবিত্র শিব প্রদত্ত ধনুককে পূজা, প্রণাম, প্রদক্ষিণ করে এক হস্তে ধনুক তুলে নিলেন । সকলে দেখে তাজ্জব হল। রাজা জনক, সুণয়না, মিথিলা বাসী ও সীতাদেবীর মুখে হাসি ফুটলো । তারপর রামচন্দ্র ধনুকে জ্যা পড়ালেন। তারপর জ্যা আকর্ষণ করতেই ধনুক দ্বিখণ্ডিত হল। ধনুক যখন দ্বিখণ্ডিত হল তখন ভয়ানক বজ্রপাত হল । সকলের মুখে হাসি ফুটলো। বিশ্বামিত্র, মুনি , ঋষিরা উঠে দাঁড়িয়ে ‘সাধু’, ‘সাধু’ বলে প্রশংসা করতে লাগলেন । রামচন্দ্র সকলকে প্রনাম জানালেন। আনন্দিতা হয়ে সীতাদেবী মনে মনে গিরিজা দেবীকে প্রনাম ধন্যবাদ জানিয়ে বরমাল্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সেই বরমাল্য রামচন্দ্রের কন্ঠে পড়িয়ে চরণে প্রনাম করলেন । রাজা জনক বললেন- “পুত্র রাম! তুমিই আমার কন্যা সীতার স্বামী হবে। আমি তোমার সাথেই সীতার বিবাহ দেবো।” ভগবান রাম বললেন- “রাজণ! আমার একটি অনুরোধ আছে। আমরা চার ভ্রাতা একত্রে তিন মায়ের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছি। মাঝে মাঝে আমরা বিস্মৃত হই যে আমাদের আসল গর্ভধারিণী জননী কে? তিন মাতাই আমাদিগকে সমান আদর বাৎসল্য দিয়ে লালন পালন করেছেন। আমরা চার ভাই একত্রে বিদ্যা শিক্ষা নিয়েছি। আপনি আরোও তিনটি কন্যার ব্যবস্থা করুন। আমরা চার ভ্রাতা একই দিনে বিবাহ করবো।” মহর্ষি শতানন্দ বললেন – “তাই হবে। রামচন্দ্রের সাথে সীতার আর জনকের অপর কন্যা ঊর্মিলার সাথে লক্ষণের বিবাহ হবে। আর জনকের ভ্রাতা কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবীর সাথে ভরতের আর শ্রুতকীর্তির সাথে শত্রুঘ্নের বিবাহ হবে।” রাজা জনক ও কুশধ্বজ উভয়ে খুশী হলেন। বিশ্বামিত্র মুনিকে রাজা অনুরোধ জানালেন অযোধ্যায় গিয়ে রাজা দশরথ, ভরত, শত্রুঘ্নকে ও আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে আসুন।
( ক্রমশঃ )
Share:

আসুন জেনে নিই মা দূর্গার পূজা সম্পর্কিত অতীতের সকল ঘটনা

দুর্গা মহা দেবী পরমা প্রকৃতি। তিনি ছিলেন শিবের স্ত্রী। মা দুর্গার আরেক নাম শিবদূতী। মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ হতে তাড়িয়ে দিয়ে স্বর্গরাজ্য দখল করলে দেবতারা বিপন্ন হয়ে ব্রক্ষ্মার কাছে গিয়ে তাদের দুর্দশার কথা বলেন এবং তাদের এ মহা বিপদ থেকে যেভাবেই হোক রক্ষার পথ দেখাতে বলেন। ব্রক্ষ্মার বলেই মহিষাধুর পুরুষদের অবাধ্য হয়েছিল। তিনি তখন বলেন এই অসুরকে বধ করতে হলে প্রত্যেক দেবতার নিজ নিজ স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে নিজ নিজ তেজের কাছে প্রার্থনা করতে হবে যেনো এই মিলিত এক নারীমূর্তি আবির্ভুত হন। এই শুনে ব্রক্ষা, শিব ও অনান্য দেবতাদের তেজ থেকেই এক নারীমূর্তি আবির্ভুত হন। সকল দেবতা তাদের অস্ত্রসমূহ সে দেবীকে দান করলে সেই দেবী মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন। প্রথমবার অষ্টদশভুজা উগ্রচন্ডা রুপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার মা দূর্গারুপে। মহিষাসুর মা দূর্গার আরাধনা করলে দেবী মহিষাসুরের কাছে আসলে তিনি বলেন ‘আপনার হাতে মৃত্যুর জন্য কোনো দুঃখ নেই , কিন্তু আপনার সাথে আমিও যাতে সকলের পুজিত হই, তারই ব্যবস্থা করুন’। মা দুর্গা তখন বলেন উগ্রচন্ডা, ভদ্রকালী ও দুর্গা এই তিন মূর্তিতে তুমি সব সময় আমার পদলগ্ন হয়ে দেবতা, মানুষ ও রাক্ষসদের পূজ্য হবে। সুরথ রাজার সময় হতেই এই দুর্গা পূজা চলে আসছে। সুরথ যুগে সত্য রাজাই প্রথম দূর্গা মূর্তি প্রস্তুত করে পূজা অচর্না শুরু করেন। মুলত বসন্তকালে এ পূজা করা হত তাই এ পূজা বাসন্তী পূজা হিসেবেও পরিচিত।

পরবর্তীকালে রামচন্দ লঙ্কেশ্বরের রাবনের বিনাশের জন্য শরৎকালে ব্রক্ষার মাধ্যমে দেবীকে জাগ্রত করে তার পূজা করেছিলেন। শরৎকালে দেব দেবীরা ঘুমন্ত থাকে বলেই তাকে মা দূর্গাকে জাগাতে হয়েছিলো। তা থেকেই এ শরৎকালীন দুর্গা পূজার অভূদ্যয়।

বিভিন্ন সময় শ্রী শ্রী চণ্ডী তার সর্বশক্তি দিয়ে বিভিন্ন নামে মানবকল্যাণ সাধন করেছেন। মহিষুর নিধন করেছেন দুর্গা হয়ে, মধু কৈটভ বধ করেছেন বিষণ রূপে, শুম্ভ-নিশুম্ভ সংহার করেছেন চামুণ্ডা তথা কালীরূপ ধারণ করে। শ্রী শ্রী দুর্গতিনাশিনী, অসুর বিনাশিনীসহ হাজারও উপাধি। স্বর্গের রাজা ইন্দ্রাকে পরাজিত করে অসুররা স্বর্গলাভ করায় দুর্গার আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কারণ দেব-দেবী, দেবতারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল অসুরদের হাতে। এই নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পায় দেবী দুর্গার অসীম কৃপায়। ব্রহ্মরূপা সনাতনী ত্রৈকোল্য জননী দুর্গা এলেন- গিরিরাজ ও মা মেনকার ঘর আলোকিত করে হিমালয়ে অধিশ্বর হয়ে উমা নাম ধারণ করে। তিনি পার্বতী নামেও খ্যাত ছিলেন। আবার কেউ কেউ তাকে গৌরীও বলতেন। ৮ বছর বয়সে উমা শিবের কঠোর তপস্যা করে পতিরূপে গ্রহণ করেন। গৌরীদান কথাটি তখন থেকেই চালু রয়েছে।

এর আগের কথা হলো_ সতীসাধ্বী কন্যা স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহ ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। মনের দুঃখে সতীপতি শিব সতীর মরদেহ কাঁধে নিয়ে এক বছর ত্রিভুবন ভ্রমণ করেন। এ সময় সতীর দেবীর দেহ গলিত ছিন্নভিন্ন হয়ে পচে খসে পড়তে থাকলেও কাঁধ থেকে না নামিয়ে বরং তার গলিত দেহাংশ শিব তার সারা দেহে মেখে নেন। আর তখন থেকেই অকাল বোধন হিসেবে দুর্গাপূজা, যদিও বসন্তকালে বাসন্তী পূজা হিসেবেই এর প্রচলন ছিল।

সম্রাট আকবর বাংলা-বিহারের নাজা কংসনারায়ণকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। বয়সের কারণে দেওয়ানী ছেড়ে রাজশাহীর তাহেরপুরে এসে কংসনারায়ণ ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাহেরপুরে এসে তার জমিদারির ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মহাযজ্ঞের জন্য আহ্বান করেন। ওই সময় নাটোরের বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্যরা বংশানুক্রমে তাহেরপুর রাজাদের পুরোহিত ছিলেন। এদের মধ্যে রমেশ শাস্ত্রী নামে একজন বাংলা- বিহারের বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। তিনি শাস্ত্রমতে বললেন, বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেদ ও গোমেধ- এই চারটি মহাযজ্ঞ রয়েছে। বিশ্বজিৎ ও রাজসুয় নামক মহাযজ্ঞ শুধু সম্রাটরা করতে পারবেন। অশ্বমেধ ও গোমেধ যজ্ঞ দুটিও নিষিদ্ধ। একমাত্র দুর্গোৎসব ছাড়া অন্য কোনো মহাযজ্ঞ করা সঠিক নয়। রাজা রামচন্দ্রের বিধানে ভক্তিসহ দুর্গোৎসব করলে সর্বযজ্ঞের ফল লাভ করা সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন রমেশ শাস্ত্রী। উপস্থিত অন্য পণ্ডিতরাও ওই মতামতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। আর রাজা কংসনারায়ণ সে মতেই পূজার বিশাল আয়োজন করেন। ওই সময় সাড়ে ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজকীয় পরিবেশে দুর্গোৎসব শুরু করেন। আর এই বিশাল পূজার পূরোহিত ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। আর এখান থেকেই শুরু হয় মহা ধুমধামে দুর্গোৎসব। তৎকালীন সময়ে এই মহাযজ্ঞে আনন্দ, ধুমধাম ও উৎসাহে সবাই মোহিত হয়েছিলেন। পরের বছর থেকে এ অঞ্চলের অনেক সামন্ত রাজা ও ধনী ব্যক্তি বিখ্যাত পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পদ্ধতি অনুসারে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু করেন। মার্কন্ডেয় পুরাণে যদিও দুর্গোৎসবের কিছু বৃত্তান্ত রয়েছে, কিন্তু সমগ্র যজ্ঞটির বিধান প্রাচীন কোনো গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে নেই। এ কারণে পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর প্রণীত আচারই ব্যাপক জনপ্রিয় হিসেবে সনাতন হিন্দু সমাজ সানন্দে দুর্গোৎসব পালন শুরু করে।

সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে আছে সারাবিশ্বে। বাংলাদেশ এবং কলকাতার নামকরা প্রাচীন পূজার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। দুই বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে পূজার শুরু ও প্রাচীন ইতিহাস কলকাতাকে ঘিরেই। বাংলার দুর্গাপূজার সূচনা করেন কলকাতার রাজশাহী তাহেরপুরের জমিদার কৃষ্ণনারায়ণ। তখন সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল। মতান্তরে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাতেই দুর্গাপূজা শুরু। কলকাতার নামকরা পুরনো পূজাগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে শোভাবাজার রাজবাড়ি, হাটখোলার দত্ত, পাথুরিয়াঘাটা, লাহাবাড়ির পূজা, ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পূজা, মালিক বাড়ির পূজা ইত্যাদি।

প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পুজো :

 কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে সবচেয়ে পুরনো পূজা বলতে পাওয়া যায় বাগবাজারের প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পূজা। কষ্ঠিপাথরের খোদাই করা সেই মূর্তির সঙ্গে ছেলেমেয়ে নন, ছিলেন জয়া আর বিজয়া নামে দুই সঙ্গিনী। সে প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা।

বেহালার সাবর্ণ রায় চৌধুরীর পূজা:

কলকাতার প্রথাগত দুর্গা পূজার পথিকৃৎ কিন্তু প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো বেহালা সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের এই পূজা। ১৬১০ সালে এই পূজার সূত্রপাত করেন বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ রায় মজুমদার। এই পূজা আজো চলছে শুরুর সময়কার আচার পদ্ধতি অনুসারেই। পূজার বোধন হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, অর্থাৎ মহানবমীর ১৫ দিন আগের তিথিতে। দেবী মূর্তির রূপ ও রংয়ের কোনো পরিবর্তন নেই। মণ্ডপে মূর্তিও তৈরি হয় সেই পুরনো আমলের কাঠামোর ওপর। আটচালা মণ্ডপেই হয় কুমারী পূজা।
শোভাবাজারের রাজবাড়ির পূজা : ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভের পলাশী জয়ের পরে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের আপ্যায়নের জন্যই রাজা নবকৃষ্ণদেব এই পূজার আয়োজন করেন। রথের দিনে কাঠামো পূজা করে মূর্তি বানানো শুরু হয়। বোধন হয় নবমীর ১৫ দিন আগে। পূজায় বসত বাছাই করা বাইজিদের নাচের আসর। সন্ধিপূজায় কামান ছোঁড়া হতো। গোরাদের ব্যান্ড বাজিয়ে মহাসমারোহে জোড়া নৌকায় ভাসান হতো দশমীতে। তারপর উড়িয়ে দেওয়া হতো কৈলাশের উদ্দেশ্যে নীলকণ্ঠ পাখি।

হাটখোলার দত্তবাড়ির পূজা :

পূজায় শোভাবাজার বাড়ির সঙ্গে বরাবরের টক্কর দিত হাটখোলার দত্তরা। নিমতলা স্ট্রিটে জগৎরাম দত্ত এই পূজার প্রচলন করেন। পরে পূজার দায়িত্ব নেন ঈশ্বর দেব প্রসাদ। সিংহের মুখ হতো ঘোড়ার মতো। চালচিত্রের উপরে রাধাকৃষ্ণ আর নিচে নিশুম্ভ যুদ্ধের বর্ণনা আঁকা। মাথায় থাকত দুটি টিয়া। রিপু বলির নামে ফল, সবজি বলি হতো। বাইজি থেকে সপুত্র মহিলা সব কিছুতেই ছিল টেক্কা দেওয়ার লড়াই। লড়াই চলত ভাসানের মিছিল বা ঘাটের লড়াই নিয়ে। ভাসানে উড়ত দুইটি নীলকণ্ঠ।

লাহাবাড়ির পূজা :

ঈশ্বর প্রাণকৃষ্ণ লাহা প্রায় ২০০ বছর আগে এই পূজা শুরু করেন। কথিত আছে স্বপ্নে পারিবারিক দেবী জয়া জয়া মায়ের নির্দেশেই পূজা আরম্ভ হয়। এই পূজা লাহা বাড়ির পূজা নামে বিখ্যাত। এদের দুর্গা শিবনেত্র। শিবের কোলে তার অধীষ্ঠান। রিপু বলি এদেরও হয়। পূজা শুরু হয় সপ্তমীতে নাটমন্দিরে জয়া জয়া মা-এর অধীষ্ঠানের পরে। দশমীতে যখন মা বেরিয়ে যান তারপর থেকে মূল ফটক বন্ধ থাকে। বিসর্জনের পরে একজন বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ৩ বার মা কে ডাকেন, মা ভিতরে থেকে গেছেন কী না জানতে। নিশ্চিত হলে তবে দরজা খোলে।

ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা :

 ১৭৮০ সালে থেকেই রামদুলাল দে সরকার তার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে যে পূজার প্রচলন করেন তাই পরে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা নামে খ্যাত। এদের ঠাকুরদালান গঙ্গামাটির তৈরি, এদেরও রথের দিনে কাঠামো পূজা হয়। এখানে অসুরসহ মা-দুর্গা এবং তার সন্তানদের সাজানো হয় মঠচুবড়ি আর্টে। সিংহ ঘোটকাকৃতি। লক্ষ্মী- সরস্বতী পূজিত হন জয়া-বিজয়া রূপে। আর থাকেন শিব, রাম, হনুমান। প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠি পর্যন্ত ঘট পূজা করা হয়। সপ্তমীতে কলা বোউ স্নান করিয়ে মূর্তিপূজা শুরু। শুরুর দুই বছর পরে এক অষ্টমীতে বলির জন্য আনা ছাগশিশু রামদুলালের পায়ের ফাঁকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয়। এই ঘটনার পরে প্রাণি বলি বন্ধ হয়ে যায়। আখ ও চালকুমড়ো বলি হয়।

পাথুরিয়াঘাটার পূজা :

পাথুরিয়াঘাটায় প্রায় ১৬৫ বছরের পুরনো দুর্গা পূজার সূত্রপাত রামলোচন ঘোষের হাতে। ৩ চালার ঠাকুর আর ঘোড়া মুখের সিংহ এই পূজায়। ষষ্ঠী ও নবমীতে কুমারী পূজা ছাড়া সধবা পূজাও হয়। এদের শিল্পী ও ঢাকিরাও আসত পরিবারের মধ্যে থেকেই। ৭০-৮০ বছর হলো এখানে বলি বন্ধ।

হাওড়া পণ্ডিত মহাশয়ের বাড়ির পূজা:

হাওড়া পণ্ডিত সমাজের সভাপতি মুরারী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে পূজা শুরু হয় ৩৫০ বছর আগে। মা এখানে কন্যারূপে পূজিত হন। বাড়ির মেয়েরা পূজার বৈদ্যের জন্য মুড়কি, নাড়ু তৈরি করেন। সারা বছর বাড়িতে যা রান্না হয় সপ্তমী থেকে নবমী সেই সমস্ত পদ রান্না করে মায়ের ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর দিন সন্ধি পূজার পর একটি থালায় সমান করে সিঁদুর দিয়ে চৌকির ওপর মূল বেদীর তলায় একটি কাঠির সাহায্যে রাখা হয়। দশমীর দিন ওই থালায় মায়ের হাত, পা কিংবা পদ্মের চিহ্ন পাওয়া যায়।

Share:

০১ এপ্রিল ২০১৬

মৃত্যুর পরে যেভাবে পরিবর্তিত হয় আত্মা ---- শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা অনুসারে

কর্মের আক্ষরিক অর্থ হল কার্য, ক্রিয়া অথবা করণ এবং বলা যেতে পারে এটি হল "কারণ এবং করণের (কার্যের) নৈতিক ধর্ম"। উপনিষদ্ মতে একজন মানুষ (অর্থাত্‍ জীবত্মা) সংস্কার (লব্ধ জ্ঞান) অর্জন করে তার শারিরীক ও মানসিক কর্মের মধ্যে দিয়ে। মানুষের মৃত্যুর পর সমস্ত সংস্কারগুলি যথাযথ ভাবে তার লিঙ্গ-শরীরে (যে শরীর রক্ত-মাংসের শরীর থেকে সুক্ষ অথচ আত্মার থেকে স্থূল) বিদ্যমান থাকে এবং পরজন্মে তার সুনির্দিষ্ট কক্ষপথ তৈরী করে। সুতরাং, একটি সর্বজনীন, নিরপেক্ষ, এবং অব্যর্থ কর্মের ধারণা মানুষের পুনর্জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য, এবং পরিবার সম্পর্কিত ধারণার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও ভাগ্য প্রভৃতি ধারণাগুলিকে কর্ম একত্রে সংযুক্ত করেছে।
কার্য, কারণ, জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের বৃত্তাকার পরম্পরাই হল সংসার। দেহধারণ এবং কর্মফল ধারণা সম্পর্কে হিন্দুধর্মে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ চিন্তার প্রকাশ দেখা যায়। শ্রীমদ্ভগ্বতগীতায় বলা হয়েছে --
-
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী। -- (শ্রীমদ্ভগ্বতগীতা, দ্বিতীয় অধ্যায়, ২২)
-
[ব্যখ্যা: মানুষ যেমন জীর্ণ-শীর্ণ পুরোনো বস্ত্রগুলি ত্যাগ করে অন্য নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ জীবাত্মা পুরোনো শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর গ্রহণ করে। (শ্রীমদ্ভগ্বতগীতা, দ্বিতীয় অধ্যায়, ২২)]
-
যেখানে সংসার ক্ষণিকের আনন্দ দেয়, যা মানুষকে আরেকটি বিনাশশীল শরীর পরিগ্রহ করতে উত্সাহী করে। সেখানে মোক্ষ এই সংসারের গণ্ডী থেকে মুক্ত হয়ে চির আনন্দ ও শান্তির বিশ্বাস প্রদান করে। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস যে অনেকগুলি জন্মান্তরের পর অবশেষে জীবাত্মা মহাজাগতিক আত্মায় (ব্রহ্ম/পরমাত্মা) মিলিত হতে ব্যাকুল হয়।
জীবনের চরম লক্ষ্যকে (চরম লক্ষ্য বলতে এখানে মোক্ষ অথবা নির্বাণ অথবা সমাধি) বিভিন্ন ভাবে বোঝানো হয়েছে: যেমন ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতার বোধ; যেমন ঈশ্বরের সঙ্গে অবিছ্যেদ্য সম্পর্কের বোধ; যেমন সমস্ত বস্তুর সম্পর্কে অদ্বৈত বোধ; যেমন আত্ম বিষয়ক বিশুদ্ধ নিস্বার্থতা ও জ্ঞান; যেমন নিখুঁত মানসিক শান্তিলাভ; এবং যেমন পার্থিব বাসনার থেকে অনাসক্তি বোধ। এই ধরনের উপলব্ধি মানুষকে সংসার এবং পুনর্জন্মের বন্ধন থেকে মুক্ত করে। আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস থাকার ফলে, মৃত্যুকে পরমাত্মার তুলনায় নেহাত্‍ই তুচ্ছ মনে হয়। অতঃপর, একজন ব্যক্তি যার কোন ইচ্ছা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাকি নেই এবং জীবনের কোন দায়িত্বই বাকি নেই অথবা একটিও রিপু দ্বারা আক্রান্ত নয়, সে প্রায়োপবেশন (যার আক্ষরিক অর্থ হল মৃত্যু কামনায় উপবাসের মাধ্যমে দেহত্যাগ) দ্বারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে।


Written by:  Prithwish Ghosh
Share:

মৃত্যুর পরে যেভাবে পরিবর্তিত হয় সাধের মানবদেহ

মৃত্যুর পরে শরীরে ধীরে ধীরে পচন ধরতে শুরু করে -- এ কথা সবারই জানা। কিন্তু মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকে পচন ধরা পর্যন্ত কী কী শারীরিক পরিবর্তন হয় বা কোন কোন পথ ধরে শরীরে পচন ধরতে শুরু করে, আসুন তা জেনে নিই -----
চিকিৎসা শাস্ত্র মতে, মৃত ঘোষণার অর্থ এই নয় যে শরীরের প্রতিটি কোষের মৃত্যু হয়েছে। হৃদযন্ত্র পাম্প করা বন্ধ করলে, কোষ গুলো অক্সিজেন পায় না। অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ হলে পেশিীগুলো শিথিল হতে শুরু করে। পাশাপাশি অন্ত্র এবং মূত্রস্থলী খালি হতে শুরু হয়।শরীরের মৃত্যু ঘটলেও, অন্ত্র, ত্বক বা অন্য কোনও অংশে বসবাসকারী কোটি কোটি ব্যাক্টেরিয়া তখনও জীবিত থাকে। মৃত্যুর পর শরীরের অভ্যন্তরে যা ঘটে, সে সবের পিছনেই এই কোটি কোটি ব্যাক্টেরিয়ার অবদান থাকে। 
মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম শরীরের তাপমাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট কমতে থাকে। এক্ষেত্রে শরীরের নিম্নাংশে রক্ত এবং তরল পদার্থ জমা হয়। ব্যক্তির ত্বকের আসল রঙের ভিত্তিতে তা ধীরে ধীরে গাঢ় বেগুনি-নীল রঙে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। এরপর অত্যধিক ক্যালসিয়াম ক্ষরণের ফলে পেশী গুলো শক্ত হয়ে যায়। ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই অবস্থা থাকে।
এরপর শরীরে পচন ধরতে শুরু করে। রক্ত চলাচল বন্ধ হলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের গঠন শুরু হয়, অম্লের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর ফলে কোষগুলোতে ভাঙন ধরে। দুই-তিন দিনে শরীর পচতে শুরু করে। পরিপাকনালীতে থাকা ব্যাক্টেরিয়া এবং আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তলপেট সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং তাতে গ্যাস তৈরি হয় আর তার চাপে শরীরের মলমূত্র নিষ্কাশিত হয়। 'পিউট্রেসিন' এবং 'ক্যাডাভেরিনের' মতো জৈবিক যৌগ শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়লে, দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করে। এই গন্ধই মৃতদেহের অন্যতম বৈশিষ্ট।
'নেক্রোসিস' পদ্ধতিতে এরপর শরীরের রং কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। মৃতদেহের দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমায় উচ্ছিষ্ট-ভোগী পোকা-মাকড়। মৃত শরীরকে খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়াও, এই সমস্ত পরজীবী কীট সেখানে ডিমও পাড়ে। ডিম ফুটে বেরোনো শূককীট মাত্র এক সপ্তাহে শরীরের ৬০ শতাংশ নিকেশ করতে পারে। এভাবেই কেটে যায় প্রথম সাতদিন। এর পর ধীরে ধীরে প্রাণহীন মানবদেহ ক্রমে মাংস-চামড়ার খোলস ত্যাগ করে পরিণত হয় হাড় সর্বস্ব কঙ্কালে। 
-
এই হ'ল আমাদের সাধের মানবদেহের স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু আত্মা !!!! 
......... পরের পোস্টে জানাব, সঙ্গে থাকুন।

Written by: Prithwish Ghosh

Share:

যে দেহেই অবস্থান করুক না কেন, ভগবান সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকেন

কঠোপনিষদ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আছে -----
'সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।'

অনুবাদ -- “দুটি পাখী একই গাছে বসে, কিন্তু যে পাখীটি ফল আহারে রত, সে তাঁর কর্মের ফলস্বরূপ সর্বদাই শোক, আশঙ্কা এবং উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখীটির দিকে ফিরে তাকায়, তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়, কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।”


পদ্মপূরাণ থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ব্রহ্মাণ্ডে মোট ৮৪ লক্ষ ধরণের জীব-শরীর বা প্রজাতি রয়েছে এদের মধ্যে --
৯ লক্ষ প্রজাতি হচ্ছে জলচর জীব,
২০ লক্ষ উদ্ভিদ প্রজাতি,
কীট-পতঙ্গ হচ্ছে ১১ লক্ষ প্রজাতির,
পাখী-প্রজাতি হচ্ছে ১০ লক্ষ,
পশু ৩০ লক্ষ প্রজাতির
এবং মানুষ ৪ লক্ষ প্রজাতির।
জীবসত্তা নানা প্রজাতির বিভিন্ন রকম জীব-শরীরে অবিরাম দেহান্তরিত হয়ে চলে, কিন্তু পরমাত্মা একান্ত সখার মতোই সর্বদাই তার সঙ্গে থাকেন; সেই জীবসত্তা মানবদেহে বা একটি কীট দেহে --- যে দেহেই অবস্থান করুক না কেন, ভগবান সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্জুনের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারি ---- অর্জুন হচ্ছেন ফল-আহারে রত পাখী, আর পর্যবেক্ষণরত পাখীটি হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু, তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্যজন হচ্ছেন ভৃত্য। পরমাত্মার সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই জীবাত্মা-রূপ পাখী এক গাছ থেকে অন্য গাছে, অর্থাৎ এক দেহ থেকে আরেক দেহে ঘুরে বেড়ায়। এই জড়দেহ-রূপ বৃক্ষে জীবাত্মা তার কর্মের ফল-স্বরূপ নানা রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, কিন্তু যে মুহূর্তে সে পরমাত্মার নিত্য দাসত্ব বরণ করে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে -- সেই মুহূর্তে সে জড়বন্ধন থেকে মুক্ত হয় এবং তার সবরকম দুঃখ-কষ্টের নিবৃত্তি ঘটে।

Written by:  Prithwish Ghosh
Share:

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড- ২৮)

এভাবে অযোধ্যায় শ্রীরাম বয়োঃবৃদ্ধি পাচ্ছিলেন । তিনি নিত্য বাগানে খেলা করতেন । সখা দের সাথে ভ্রাতার সাথে মিলে কুল ধর্ম মেনে বনে গিয়ে মৃগয়া করতেন । সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী লিখেছেন-

বন্ধু সখা সঁগ লেহিঁ বোলাঈ ।
বন মৃগয়া নিত খেলহিঁ জাঈ ।।
পাবন মৃগ মারহিঁ জিয়ঁ জানী ।
দিন প্রতি নৃপহি দেখাবহিঁ আনী ।।

অর্থাৎ- ভ্রাতা সখা পরিবৃত হয়ে শ্রীরামচন্দ্র নিত্য মৃগয়ায় যেতেন ( ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে ) । পূত মৃগ শিকার করতেন এবং তা এনে দশরথকে দেখাতেন । 

প্রাচীন কালে ক্ষত্রিয় গণ বনে গিয়ে মৃগয়া করতেন । এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে । এক আহার্য হিসাবে মৃগ মাংস সেই যুগে প্রসিদ্ধ ছিল এবং ক্ষত্রিয় গণ তা খেতেন । দ্বিতীয়ত মৃগ চর্ম পবিত্র আসন । এছাড়া শিকাড় করাকে বীরত্ব মানা হত । অবশ্য রামচন্দ্রের হাতে নিহত মৃগ অবশ্যই মুক্তি পেয়েছিলেন । অপরদিকে রাজা জনকের গৃহে সীতা দেবী বৃদ্ধি পেতে লাগলেন । রাজা জনকের রাজ্যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটলো । উপযুক্ত পরিমাণে বর্ষণ হল । মাঠগুলি সিক্ত হলে প্রজারা চাষাবাদ করে ধনধান্যে ফুলে উঠলেন । এসবই হয়েছে মাতা লক্ষ্মীর কৃপায়। তিনি নিজেই সীতা রূপে জনক রাজা ও সুনয়নার কোল আলো করে বড় হতে লাগলেন । সীতা দেবী ভগবতী উমামাতার ভক্ত ছিলেন । অপরদিকে রামচন্দ্র ছিলেন শিবভক্ত । রামচন্দ্রের মনোহর রূপ দেখে অযোধ্যার আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই মোহিত হয়ে রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে আদর করতেন । এমনই ছিলো রামচন্দ্রের রূপ । পাঁচ বছর বয়স হতে রামচন্দ্রকে ভ্রাতাদের সহিত গুরু বশিষ্ঠের আশ্রমে বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠানো হল । বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে রামচন্দ্র ও তাঁহার ভ্রাতারা চতুর্বেদ , উপনিষদ, কাব্য, অলংকার, ব্যাকারন, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন বিদ্যা আদি সব শাস্ত্র শিখলেন । 

এরপর অস্ত্র বিদ্যা শুরু হল । প্রথমে মল্ল বিদ্যা শিখলেন। তারপর গদা, তরবারি, বর্শা, লাঠি, ছোড়া ইত্যাদি অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করলেন । এরপর মহর্ষি বশিষ্ঠ ধনুর্বিদ্যা দিলেন চার রাজকুমারকে । চার ভ্রাতাকে অনেক দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান দিলেন। এই অস্ত্র গুলি জগত ধ্বংস করবার শক্তি রাখে । রামচন্দ্রের তীব্র বেগে বাণ নিক্ষেপ, অব্যর্থ নিশানা দেখে দেবতাবৃন্দ আনন্দ প্রাপ্তি করেন । কারন এবার রাবণ অনায়েসে মরবে । একদিন মারীচ রাক্ষস মায়া দ্বারা হরিণ সেজে খোঁজ করতে আসেন । হরিণ রূপী মারীচ বনে ঘুরছিলো। সেসময় রাম লক্ষণ ধনুক হাতে বনে ঘুরছিলেন । মৃগ দেখে রামচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করেন । কৃত্তিবাস পণ্ডিত লেখেছেন- 

মৃগ দেখি রামের কৌতুক হৈল মন ।
ধনুকে অব্যর্থ বাণ যুড়িল তখন ।।
ছুটিল রামের বাণ তারা যেন খসে ।
মহাভীত মারীচ পলায় মহাত্রাসে ।।
শ্রীরামের বাণশব্দে ছাড়িল সে বন ।
জনকের দেশে গেল মিথিলা ভুবন ।। 

রামচন্দ্রের বাণে ভীত হয়ে মারীচ রাক্ষস অযোধ্যার সীমা ছেড়ে সোজা মিথিলায় পলায়ন করলো । 

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড- ৩৪ )

মহর্ষি জনক রাজার সুন্দর বাগানে বিশ্রাম করছেন । মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি এসেছেন শুনে একটু পর রাজা জনক সেখানে আসলেন । মুনি বিশ্বামিত্র ও অনান্য উপস্থিত ব্রাহ্মণকে প্রনাম করলেন । এরপর শ্রীরাম ও লক্ষণ , রাজা জনককে প্রনাম করলেন । রামচন্দ্রকে দেখে জনক রাজা মোহিত হলেন । মনে মনে ভাবলেন , এমন সুন্দর পাত্র আগে দেখলে স্বয়ম্বরের আয়োজন করতামই না। এই পাত্রের সাথেই সীতার বিবাহ দিতাম । নিশ্চয়ই সীতা মানা করতো না। লক্ষণ কে দেখে তিনি ভাবলেন এর সাথেই কন্যা ঊর্মিলার বিবাহ দিতাম । আহা কি অপূর্ব রাজপুত্র । জনক রাজা দুই রাজপুত্রের পরিচয় জানতে চাইলেন। তিনি বহুদিন অযোধ্যায় আসেননি তাই রাম লক্ষণকে চিনতেন না । বিশ্বামিত্র মুনি দুই বালকের রাক্ষস নিধনের খবর দিয়ে বললেন- “রাজন! এরা আপনার প্রতিবেশী রাজ্য তথা আপনার মিত্র দশরথের পুত্র রাম লক্ষণ। আপনার স্বয়ম্বর সভায় অংশ নিতে আমি শ্রীরামকে এখানে আনিয়াছি।” শুনে জনক রাজা খুব প্রীত হলেন । রাম, লক্ষণকে অনেক আদর যত্ন করলেন । খানিকবাদে রাজা জনকের সাথে মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজবাটির অন্দরে চলে গেলেন । রাম লক্ষণ ভাবলেন তারা মিথিলা ঘুরে দেখবেন । তারা ঘুরতে বের হলেন । অপূর্ব শোভা চারপাশে বিস্তৃত । একদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা , চারপাশে পুস্প শোভিত বৃক্ষ, শীতল বারিধারা বহন করে বয়ে যাচ্ছে একাধিক নদী, পদ্ম- শালুক প্রস্ফুটিট দীঘিতে হংস হংসী কেলি করছে । মাছরাঙা, বক, সারস ইত্যাদি শ্বেত ধবল পক্ষী সেই দীঘির শোভা বর্ধিত করেছে। চারপাশে পাখীর মধুর কুজনে পরিবেশ মিষ্টি হয়েছে ।

যেখানে লক্ষ্মী দেবী বিরাজ করেন সেখানে এমন মধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয় । রাম লক্ষণ কে দেখতে মুনি ঋষিরা যেমন আসলেন, তেমনি মিথিলার লোকজন আসলেন । মুনি ঋষি, ব্রাহ্মণেরা তাড়কা, মারীচ, সুবাহুর ও রাক্ষসদের নিধনের বার্তা শুনে অতীব প্রীত হয়ে রাম লক্ষণের ভূয়ষী প্রশংসা করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে লাগলেন। দিব্যাত্মা মুনি ঋষিরা অন্তরে অন্তরে রামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রনাম নিবেদন করলেন । মিথিলার লোক জন, যুবতী নারী সকলেই রামচন্দ্রকে দেখে পরম প্রীতি , সন্তোষ লাভ করলেন । তারা রামচন্দ্রকে চরণে , মস্তকে স্পর্শ করে নিজেদের ধন্য মনে করছিলেন । সোনাদানা, অর্থ দান করা আরম্ভ করলে যেমন লোকে গৃহ, বাটি, কাজ কর্ম রেখে ধাবমান হয়, তেমনি রাম লক্ষণ কে দেখতে মিথিলার লোকজন ধাবমান হলেন । যেখানে যেখানে রাম লক্ষণ গেলেন সেখানেই ভীর উপচে পড়লো । রাতে তারা জনক পুরীতে বিশ্রাম করলেন । রাজা জনক উৎকৃষ্ট ভোজন করালেন- পলান্ন, পিষ্টক, পায়সান্ন, পুরি, ক্ষীর, লাড্ডু, মোদক, মাখন ইত্যাদি সুস্বাদু ব্যাঞ্জন ভোজন করালেন । অন্তে স্বর্ণ খড়িকা, তাম্বুল, কর্পূর, সুপারী প্রদান করলেন । পর দিন স্বয়ম্বর সভা । মিথিলায় দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ উমাদেবী শক্তিপীঠ আছে । স্বয়ম্বর সভার দিন সীতাদেবী প্রাতেঃ উঠে স্নানাদি করতে গেলেন সখী সহিত। স্নানাদি করে সীতাদেবী পুস্প চয়ন করতে লাগলেন । এক সখী গিয়ে রাম লক্ষণ কে দেখে সীতাদেবীর কাছে এসে বললেন- “হে সখী জানকী! পুস্পদ্যাণে বিশ্বামিত্র মুনির সাথে আগত দুই রাজকুমারকে দেখলাম। কি তাহাদিগের অপূর্ব রূপ। কি তুলনা দিব? সকল মিথিলার নাগরিকেরা তাঁহাদিগের প্রশংসা করছেন । তাহাদের একজন শ্যাম অপরজন গৌর বর্ণ । এই নয়ন দিয়ে যেরূপ দেখলাম সেরূপ বর্ণনা করার শক্তি নেই।” সকলে বলিলেন- “তাহলে একবার সেই রাজকুমার দ্বয়কে দেখে আসি। দেখি আমাদের সখী জানকীর উপযুক্ত কিনা?” 

সখী গণ মিলে সীতাকে নিয়ে সেই স্থানে গেলেন । প্রথম দর্শন হল সীতাদেবী ও রামচন্দ্রের । দুজন দুজনার দিকে চেয়ে রইলেন । এই অবস্থায় উভয়ের প্রেম জন্মালো। মিষ্টি পাখীর কলরব আর সুগন্ধি ফুলের গন্ধে সমগ্র বাগান শীতল পবনে মৃদু মৃদু আলোরিত হচ্ছে- এমন সময়ে উভয়ে উভয়ের যেনো মন সমর্পণ করলেন । আর সীতাদেবীর ভগিনী ঊর্মিলা চেয়ে রইলেন লক্ষণের প্রতি । নয়নে নয়ন, মনে মন যেন একত্র হল । কিছুক্ষণ এইভাবে অবস্থান করার পর সখীদের ডাকে সীতাদেবীর চেতনা ফিরে এলো। এতক্ষণ রামচন্দ্র সীতাময় আর সীতাদেবী রামময় হয়ে গেছিলেন । সখীদের সাথে সীতাদেবী, ঊর্মিলা তখন উমাদেবীর মন্দিরে গেলেন । সীতাদেবীর মনে তখন রামচন্দ্রের মুখচ্ছবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যেমন শিল্পী তার অপূর্ব কলা দ্বারা মনের ভাবনাকে চিত্রিত করেন । কথা, বার্তা সবই বলছেন , কিন্তু মনে পড়ে আছে ঐ রামচন্দ্রের পাণে। পূজা করবার সময় মন্ত্র পাঠ করতে করতে বারংবার উমাদেবীর কাছে প্রার্থনা করলেন- “হে মাতঃ! তুমি যেমন কঠোর উপাসনা দ্বারা শঙ্করকে পতিরূপে প্রাপ্তি করেছিলেন, তেমনি আমি যেনো তাঁকেই পতি রূপে পাই। তিনি ভিন্ন এই মনে আর কেহ নাই, আর থাকবেও না। হে মাতা গিরিজা। তুমি কৃপা কর।” কৈলাস থেকে হরগৌরী সব দেখে আনন্দে আশীর্বাদ করতে লাগলেন । 

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড – ৩৩ )


রাক্ষস বধ করবার পর মুনি ঋষি গণ প্রসন্ন চিত্তে রাম লক্ষণের জয়ধ্বনি দিলেন । বিশ্বামিত্র মুনি তখন রাম লক্ষণকে নিয়ে মিথিলায় যেতে উদ্যোগ নিলেন । মিথিলার রাজা জনক , তাঁর পুত্রী সীতাদেবীর জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছিলেন । “স্বয়ম্বর” একটি মহাকাব্যের বিবাহ প্রথা, এখানে কোন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কন্যার জন্য পাত্র , অথবা পাত্রী স্বেচ্ছায় নিজ পছন্দের পাত্র নির্বাচন করতেন । বলা হয় প্রজাপতি ব্রহ্মা নারী স্বাধীনতা ও তাহাদিগের পছন্দের মর্যাদা দিতে এই “স্বয়ম্বর” নামক বিবাহবিধি প্রচলন করেছিলেন । জনকের কন্যা সীতাদেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে অনেক রাজা মিথিলা আক্রমণ করে বসতো, সে সবের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজা জনক শিব উপাসনা করে “হর ধনুক” প্রাপ্তি করে আক্রমণকারীদের পরাস্ত করেছিলেন । সেই ধনুক তুলবার শক্তি জনক ভিন্ন অপর কারোর ছিলো না। একদিন মহর্ষি পরশুরাম ও রাজা জনক গল্প করছিলেন। সেই সময় খেলাচ্ছলে বালিকা সীতা দেবী সেই ধনুক এক হাতে তুলে নিলেন। এই দেখে পরশুরাম ও জনক রাজা আশ্চর্য হলেন। পরশুরাম বললেন- “জনক! তুমি তোমার দুহিতার স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা করো। শর্ত রাখবে যে পাত্র এই ধনুক তুলে গুণ পড়িয়ে ভঙ্গ করতে পারবে, তাঁরই সাথে সীতার বিবাহ দেবে।” জনক রাজা সেই মতো সীতাদেবীর স্বয়ম্বর ঘোষোনা করে দিলেন । অপরদিকে রাম লক্ষণ মুনি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে কিছুকাল থেকে ব্রাহ্মণ দিগের কাছে শাস্ত্র কথা শ্রবন করলেন । এরপর বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণকে নিয়ে মিথিলায় চললেন। 

পথে গৌতম মুনির পরিত্যক্ত আশ্রম পড়ে । আগাছা, জঙ্গলে সেই আশ্রম ছেয়ে গেছে। যজ্ঞবেদী, তুলসী মঞ্চ, পূজা ঘর, কুটির গুলো আগাছা জঙ্গল আর বিষাক্ত সাপের আস্তানা হয়েছে । জৌলুষ হারিয়ে সেই আশ্রম এখন জরাজীর্ণ । বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণ কে অহল্যার ঘটনা, ইন্দ্রের ছলাকলা, গৌতম মুনির অভিশাপের কাহানী ব্যক্ত করলেন । সেই আশ্রমে বাতাসে ভেসে আসে এক নারীকণ্ঠের ‘রাম’, ‘রাম’ বোল । কোন এক যুগ থেকে চলে আসা সেই ‘রাম’ নাম এখানে গুঞ্জরিত হচ্ছে কোন অদৃশ্য উৎস থেকে । অহল্যা দেবীর পাষাণ মূর্তির কাছে রাম লক্ষণ কে নিয়ে বললেন- “রঘুবীর! এই হচ্ছেন মাতা অহল্যা দেবীর শাপিত পাষাণ মূর্তি। তুমি তোমার শ্রী চরণ দিয়ে এই মূর্তি স্পর্শ করো, তবেই অহল্যা দেবীর মুক্তি ঘটবে।” রামচন্দ্র মানা করলেন। বললেন- “ক্ষমা করবেন গুরুদেব। ইনি ব্রাহ্মণী, ইনি আমার মাতৃতুল্যা । আমি এঁনার ওপর চরণ রেখে মহাপাপ গ্রহণ করতে ইচ্ছা করি না।” মুনি বিশ্বামিত্র বললেন- “রাম। এছাড়া আর উপায় নেই। মহর্ষি গৌতম অভিশাপ দেবার সময় ঘোষোনা করেছিলেন তোমার চরণের পবিত্র স্পর্শেই মুক্তি ঘটবে। সেইজন্য তোমাকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি। তুমি এঁর মুক্তি না দিলে, চিরকাল অহল্যা দেবী পাষাণ হয়ে কষ্ট ভোগ করবেন । তুমি এঁনার মুক্তির ব্যবস্থা কর।” ভগবান রাম তখন পাদুকা খুলে ডান চরণ মূর্তির ওপর রাখলেন । সাথে সাথে মূর্তি জীবিত হয়ে উঠলো। অহল্যা দেবী চোখ খুলে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু সামনে ভগবান রামচন্দ্রকে দেখে প্রনাম করলেন ।

ভক্তিভাবে অহল্যার নয়ন দিয়ে অশ্রু নির্গত হচ্ছিল্ল। তিনি করজোড়ে বললেন- “হে দীনানাথ। হে ভক্তবৎসল ভগবান রাম ! আপনার জয় হোক । আমি অতি ক্ষুদ্রা সামান্যা নারী। আজ আপনার চরণ স্পর্শে আমার মুক্তি ঘটলো । হে ভবভয়নাশন, আমি আপনার শরণাগত হলাম । মুনির অভিশাপে পরম কল্যাণ নিহিত ছিলো। যাঁহাকে দর্শন করার জন্য যোগীরা কঠোর তপ সাধনা যোগ অবলম্বন করেন সেই শ্রীহরি আমার সম্মুখে । আমি অল্পবুদ্ধি । হে রঘুনাথ আমাকে কৃপা করে এই বর দিন যেনো সততঃ আপনার শ্রীপাদপদ্মে ভক্তি থাকে।” এভাবে স্তব করে গৌতমের পত্নী অহল্যা দেবী বারংবার ভগবান রামচন্দ্রের চরণে প্রনাম জানাতে লাগলেন । এরপর তিনি পতি গৌতম মুনির কাছে চলে গেলেন । এইবার বিশ্বামিত্র মুনির সাথে রাম লক্ষণ গঙ্গার ধারে পৌছালেন । বিশ্বামিত্র মুনি গঙ্গা অবতরণের কথা শোনালেন । রাম লক্ষণ এখানে মুনি ঋষিদের সাথে গঙ্গায় স্নান সেড়ে দানাদি পুন্য কর্ম করলেন। এরপর বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণ কে নিয়ে নৌকা দিয়ে গঙ্গা পার করে মিথিলায় আসলেন । মিথিলা নগরী সুন্দর ছিলো। সমস্ত নগরী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শ্রীযুক্ত ছিলো। গৃহগুলি সুন্দর করে সাজানো, বিবিধ কারুকার্যময় আল্পনা দ্বারা সুজ্জিত ছিলো। বৃক্ষ গুলি ফল ফুল সুন্দর বৃহঙ্গ দ্বারা সজ্জিত হয়েছিলো। উত্তম বস্তু এখানে কেনাবেচা হচ্ছিল্ল, ব্যবসায়ীরা ধনী ছিলো । ধর্মাত্মা , জ্ঞানী গণ, পণ্ডিত দের দেখতে পেলেন । রাজা জনকের বৃহৎ রাজবাটী অতি সুন্দর আর রম্য ছিলো। তাতে কোষ্ঠ গুলি হীরা মাণিকে সজ্জিত ছিলো। বিশাল সিংহদ্বারে অবস্থিত রাজ কর্মচারীরা সুবাসিত বারি, চন্দন, কুঙ্কুম, সুবাসিত পুস্প, পান সুপারী দিয়ে রাম লক্ষণ ও মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে স্বাগত জানালেন । রাজা জনকের উদ্যান বাটি খুবুই সুন্দর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বিশ্বামিত্র মোহিত হলেন। সেখানেই রাম লক্ষণ কে নিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন । 

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড – ৩১ )

বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণ কে সাথে নিয়ে গেলেন বনে । তাড়কা সম্বন্ধে বলে মুনি বললেন- “রাম! তাড়কার দেহে ব্রহ্মার বরে সহস্র হস্তীর শক্তি আছে।” রামচন্দ্র জানালেন- “ হে ব্রহ্মর্ষি ! তাঁড়কা নারী। নারীর ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ কি প্রকারে করি ?” মহর্ষি বললেন- “নারী হোক বা পুরুষ, পাপ কর্মের ফল সকলকেই ভুগতে হয়। তাড়কা তার কৃতকর্মের ফল পাবেই।” মুনি রামচন্দ্র ও লক্ষণ কে নিয়ে তাড়কার বনে প্রবেশ করলো । হাড় হিম জঙ্গল সকল সৌন্দর্য হারিয়ে ভয়ঙ্কর চেহারা প্রাপ্তি করেছিল । বিকট দর্শন চামচিকা, এদিক ওদিক কেবল উড়ে বেড়াছিল্ল । চারপাশে অস্থি, কঙ্কালের খুলি গড়াগড়ি খাচ্ছে । এই জঙ্গলে তাড়কা যাকে পেতো তাকেই ভক্ষণ করত । মুনি বিশ্বামিত্র জানালেন “তোমরা সাবধানে চল। এই বনেই তাড়কা থাকে। সেই রাক্ষসী মহাবল ধরে।এছারা মায়াবিদ্যা জানে।” মানুষের গন্ধ পেয়ে তাড়কার নিদ্রাভঙ্গ হল। উদরের ক্ষুধা তীব্র হল। মনের আনন্দে সে আসতে লাগল। বড় বড় তাল, নারকেল, খেঁজুর , বাঁশবন দুলিয়ে এমন ভাবে আসতে লাগলো, যে দূর থেকেই দেখা গেল। মনে হচ্ছিল্ল যেনো এক বিশাল আলোরন জঙ্গল গুলোকে দোলা দিয়ে আসছে । অট্টহাস্য শোনা গেল তাড়কার । সামনে এসে সে রাম, লক্ষণ, মুনিকে দেখতে পেল। কচি বালক দেখে তাড়কার জিহ্বা দিয়ে জল ঝড়ে মাটিতে পড়ে পুকুর সৃষ্টি হল । বিশাল লম্বা চেহারা, স্থূল শরীর, মুখের দন্ত গুলি গজ হস্তীর নয়, হাতের নখ তীক্ষ্ণ তরবারির ন্যয় ছিলো রাক্ষসীর । চোখ দুটিতে আগুনের ভাটা জ্বলছিল । পা দুটি দেখে মনে হচ্ছিলো বিশাল আকৃতির স্থূল স্তম্ভের ন্যায়, স্তন্য মণ্ডল পর্বতের চূড়ার ন্যায়। রাক্ষসী কঙ্কাল, অস্থির মালা ধারন করেছিলো । 

রাক্ষসী অট্টহাস্য করে বলল- “প্রত্যহ কেবল মুনি ঋষিদের কৃশকায় শরীর ভক্ষণ করি। আজ বিধাতা আমার জন্য দুটি কোমল বালক প্রেরন করেছে। এদের খেয়ে মুখের স্বাদ পরিবর্তন করবো ।” শুনে রামচন্দ্র হাসতে লাগলেন । ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র বললেন- “রাম। সন্ধ্যা প্রায় সমাগত । তুমি শীঘ্র এর বধ কর। রাত্রে নিশাচর রাক্ষস রাক্ষসী দের শক্তি বৃদ্ধি পায়।” রামচন্দ্র তখন তাড়কাকে লক্ষ করে বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তাড়কা মায়াবিদ্যা দ্বারা অদৃশ্য হয়ে শিলাবৃষ্টি সৃষ্টি করলো। রামচন্দ্র পবন বাণ নিক্ষেপ করে মেঘ সড়িয়ে দিলেন । তাড়কা তখন সামনে এসে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে লাগলো। তাড়কার নিঃশ্বাসে বনে প্রলয় ঝড় বইছিল । কখনো আগুনের হুল্কা নিক্ষেপ হচ্ছিল্ল। রামচন্দ্র বাণ দ্বারা তা প্রতিরোধ করলেন । এইভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল। তাড়কা বড় বড় শাল, শিশু গাছ রাম লক্ষণের দিকে ছুড়তে লাগলো । রামচন্দ্র বাণ দ্বারা সেই সব গাছ খন্ড খণ্ড করতে লাগলেন । তাড়কা তখন পর্বতের চূড়ার ন্যায় বৃহৎ প্রস্তর খণ্ড বর্ষণ করতে থাকলো। ভগবান রাম তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করে সেই প্রস্তর গুলি ধ্বংস করলেন । এরপর ভগবান রাম ধনুকে বজ্রবাণ আনয়ন করলেন। মন্ত্র পড়ে সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন । কানে তালা লাগানো বাজের শব্দ ও ঝলসে যাওয়া বজ্রপাত সৃষ্টি করে সেই বাণ তাড়কার বুকে বিদ্ধ হল । 

সেই বাণ তাড়কার প্রান হরণ করল । তাড়কা মহা আর্তনাদ করে ভূপতিত হল । রক্তধারা নদীর ন্যায় প্রবাহিত হল। তাড়কা যখন ভূপতিত হল – তখন বসুমতী প্রবল কেঁপে উঠলো । গাছপালা গুলো ভেঙ্গে চুড়ে তাড়কার পৃষ্ঠদেশের তলায় চূর্ণ হল । বিশালাকৃতি বট, অশ্বত্থ , আম্র, কৃষ্ণচূড়া ইত্যাদি মহীরুহ গুলো চূর্ণ হল। বিকট রাক্ষসীর দেহ বিশাল পর্বতের ন্যায় জঙ্গলে পড়লো । দূর থেকে তাঁকে দেখলে এক পর্বত রূপে ভ্রম হবে । দেবতারা প্রীত হলেন । তাড়কার সদ্গতি হল। তাঁর শাপমুক্তি হল । বিশ্বামিত্র মুনি আশীর্বাদ করতে লাগলেন। অতঃ তিনি সন্ধ্যা হতে রাম লক্ষণ কে নিয়ে আশ্রমে গেলেন । আশ্রমের শিষ্যরা রাম লক্ষণ কে আদর যত্ন আপ্যায়ন করল। বনের মিষ্ট ফল, কন্দ, মধু রাম লক্ষণ কে খেতে দিলেন । বিশ্বামিত্র মুনি বললেন- “বতস্য রাম। কাল আমি তোমাকে বলি ও অতিবলি বিদ্যা দান করবো। তোমাকে আরোও কিছু দিব্যাস্ত্র প্রদান করবো।” রামচন্দ্র বললেন- “মহর্ষি । আপনাকে আমি গুরু রূপে প্রাপ্তি করে ধন্য হব। আপনি তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মণ্যত্ব প্রাপ্তি করে ক্ষত্রিয় থেকে ব্রহ্মর্ষি হয়েছেন । জগতের কাছে আদর্শ তৈরী করেছেন।” তাড়কার আতঙ্ক মিটলেও তাড়কার তিন কোটি ( কৃত্তিবাসী রামায়নে লেখা তাড়কার সাথে ৩ কোটি রাক্ষস থাকতো ) রাক্ষস মারীচ , সুবাহু জীবিত ছিলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড – ৩০ )

বিদ্যা শিক্ষা সমাপন করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এলেন । রানীরা সাদর সমারোহে চার রাজকুমারকে বরণ করে নিলেন । শ্রীরামচন্দ্রের ধনুর্বিদ্যা দেখে সকলের তাক লেগে গেল । চোখের নিমিষে রামচন্দ্রের ধনুক থেকে বাণ ছুটে নিশানায় বিদ্ধ করে । রাজা দশরথ নিশ্চিন্ত হলেন । ভাবলেন অযোধ্যার যোগ্য উত্তরসূরি এসে গেছে । এবার আর চিন্তার কারণ নেই । ওদিকে তপোবনের কথা । তপবনে বিশ্বামিত্রর আশ্রমে রাক্ষসেরা রোজ হামলা চালাতো । তাড়কার ভয়ে অরন্য একেবারে জীবশূন্য হয়েছিলো। গাছগুলিও যেনো জড়বৎ হয়ে গিয়েছিলো। গাছে ফুল, ফল আসতো না। অরন্যের শোভা নষ্ট হয়ে জায়গায় জায়গায় কেবল অস্থি, খুলি ইত্যাদি দেখা যেতো। ভুলবশত এই বনে কেউ প্রবেশ করলে সে আর জীবিত ফিরতো না। সোজা রাক্ষসদের আহারের তালিকায় স্থান পেতো। সেই হাড় হিম অরণ্য ছিলো প্রাকৃতিক শোভা বর্জিত । কেবল রাক্ষসদের অট্টহাস্য শোনা যেতো । শিষ্যেরা বললেন- “হে গুরুদেব ! এই রাক্ষসের অত্যাচার কোনোকালেই কি স্তব্ধ হবে না ? আমরা কি চিরকাল যাগ যজ্ঞ করে দেবতাবৃন্দকে আহুতি প্রদানে ব্যর্থ হব? দেবর্ষি নারদ বলেছিলেন এই রাক্ষসদের বিনাশ করতে ভগবান হরি আসবেন!” বিশ্বামিত্র বললেন- “বোধ হয় এই রাক্ষসদের অন্তিম কাল উপস্থিত । ভগবান , দশরথ রাজার গৃহে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁহার শিক্ষা সমাপ্তি হয়েছে। আমি তাহাদিগকে আনিতে অযোধ্যায় যাবো।”

মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি অযোধ্যায় আসলেন । রাজা দশরথ এই সংবাদে ভীত হয়েছিলেন । তিনি জানতেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র পূর্বে তাঁর পূর্বপুরুষ হরিশ্চন্দ্র রাজার কাছে দানে সমগ্র রাজ্য নিয়েছিলেন। আবার কি তিনি এমন করবেন ? রাজা মুনিকে স্বাগত জানালেন । করজোড়ে রানী সহিত মুনিকে আপ্যায়ন করলেন । আসনে বসিয়ে মুনির পদযুগল সুগন্ধি বারি দ্বারা ধৌত করতো, স্বর্ণ উত্তরীয় দ্বারা মুনির পদযুগল মুছিয়ে দিলেন। অতঃ চামর, পাখা ব্যাঞ্জনাদি করে চন্দন অগুরু কর্পূর পুস্প দ্বারা, বিবিধ নৈবদ্য দ্বারা মুনির পূজা করে বলিলেন- “হে মহর্ষি আদেশ করুন, আমি আপনার কিরূপে সেবা করিতে পারি?” বিশ্বামিত্র রাক্ষসদের অত্যাচার কাহানী বলে বললেন- “হে রাজা দশরথ ! রাক্ষস বাহিনীর বধ প্রয়োজন । অন্যথায় তারা তপোবন ধ্বংস করে দেবে। আপনি রাম লক্ষণ কে প্রদান করুন। তাহারা রাক্ষস বধ করবেন।” শুনে দশরথ রাজা , রাণীদের প্রান শুকিয়ে গেল। দশরথ রাজার বুকে মহাভয় উপস্থিত হল। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন । মহর্ষির চরণ ধরে বললেন- “ মহর্ষি ! আপনি অন্য কিছু প্রার্থনা করুন। কিন্তু রাম লক্ষণকে কিভাবে দেবো ? তাহারা সদ্য কৈশোরে এসেছে । তাহারা কিভাবে সেই ভয়ানক মায়াবী রাক্ষসদের বধ করবে? আপনি চাইলে সমগ্র অযোধ্যা নগরী আপনার চরণে সমর্পণ করব, সমগ্র অযোধ্যার সেনা আপনার সহিত প্রেরন করবো, তাহারা গিয়ে সেই রাক্ষসের বধ করবে। আমি নিজে তাহাদিগকে বধ করবো- আপনি আদেশ করুন। কিন্তু প্রভু, রাম লক্ষণ এখনো বালক, তারা ঐ রাক্ষসদের বধ করা তো দূর, তাহাদের দেখেই হয়তো প্রাণত্যাগ করবে।” বিশ্বামিত্র বললেন- “রাজন। সেই রাক্ষস গণ আপনি বা অন্য কেউ কিংবা আমার হাতে বধ্য নয়। এমন হলে আমি নিজেই তাদের বধ করতাম। পূর্বে আমি ক্ষত্রিয় গাঁধিপুত্র ছিলাম। বহু অস্ত্রের জ্ঞাতা আমি। আপনার বা মিথিলা নরেশ জনকের সাহায্য চাইতে পারতাম। কিন্তু ওরা কেবল রাম- লক্ষণের হাতে বধ্য হবে।” 

রাজা তো নারাজ । কিন্তু শেষে রাম লক্ষণ এগিয়ে এলেন । পিতাকে সান্তনা দিলেন । বললেন- “পিতা। আপনার আশীর্বাদে আমরা সেই রাক্ষস বধ করতে পারবো। গুরুদেব বশিষ্ঠ মুনি আমাদের যে যুদ্ধবিদ্যা , অস্ত্রদান করেছেন- এখন সেইগুলির প্রয়োগের সময় এসেছে। তবেই তো জানবো যে আমাদের বিদ্যা শিক্ষা সফল হয়েছে । আপনি অমত করবেন না। সেই রাক্ষস কূল বিনষ্ট করে আমি আপনার নাম উজ্জ্বল করবো। প্রজা পালন ও দুষ্টের বিনাশ করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। আপনি অনুমতি প্রদান করুন।” রাজা ভয়ে দিশেহারা । মনে মনে অন্ধ মুনির প্রদত্ত শাপ মনে পড়লো। হয়তো রাম লক্ষণ আর বেঁচে ফিরবে না। রাক্ষসেরা তাদের বধ করে খাবে। আর সেই শোকে তাঁর মৃত্যু ঘটবে । অনেক মানা আপত্তি করতে লাগলেন রাজা দশরথ । মুনি বিশ্বামিত্র ক্রোধে বললেন- “দশরথ । তুমি আমার শক্তি সম্বন্ধে অবগত আছো । পূর্বে তোমার পূর্বপুরুষ রাজা হরিশ্চন্দ্রকে যেরূপ সর্বস্বান্ত করেছিলাম, সেইরূপ শাপ দিয়ে তোমার নগরী ভস্ম করবো। অবশ্য রাক্ষসেরা বধ না হলে তারা এরপর তোমার রাজ্যে হানা দিয়ে তোমার রাজ্য ছারখার করবে। যদি তুমি এমন না চাও তাহলে রাম লক্ষণ কে প্রদান কর ।” রাজা দশরথ আর কি করেন ? দিয়ে দিলেন শ্রীরাম ও লক্ষণ কে। রাজা শোকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লেন । বিশ্বামিত্র মুনি তখন রাম লক্ষণ কে নিয়ে চললেন । 

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড – ২৯ )


বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে এভাবে বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করছিলেন শ্রীরাম । মুনি নানা অস্ত্র বিদ্যার জ্ঞান দিলেন শ্রীরামচন্দ্রকে । দেবতারা অতীব প্রীত হলেন রামচন্দ্রের বিদ্যাশিক্ষা দেখে । গুরুগৃহে থাকাকালীন শিক্ষা লাভের পাশাপাশি আশ্রমের কাজ কর্ম করতে হত । সেখানে রাজকুমার আর সাধারণ শিক্ষার্থীকে এক ভাবেই রাখা হত । রাজার তনয় বলে বিশেষ কোন ছাড় বা সুবিধা দেওয়া হত না । এই আশ্রম গুলিকে “গুরুকুল” বলে । এখানে গার্হস্থ আশ্রম, সংসার ধর্ম পালনের শিক্ষা দেওয়া হত । বর্তমানে স্কুল কলেজগুলিতে এর কানাকড়িও দেওয়া হয় না । তাই সমাজ অমানুষে ছেয়ে গেছে । তেমনি মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে থাকাকালীন রাম , ভরত, লক্ষণ, শত্রুঘ্ন চার ভ্রাতাই অনান্য শিক্ষার্থীর মত আশ্রমের নিয়মাবলী পালন করতেন । ব্রাহ্ম মুহূর্তে উত্থান, যোগাসন প্রানায়াম, পূজা, বনে গিয়ে কাষ্ঠ পুস্প ফলমূলাদি সংগ্রহ, নদী থেকে জল ভরে আনা, গো পালন, গোসেবার জন্য তৃন সংগ্রহ , আশ্রম পরিষ্কার ইত্যাদি এমন কর্ম করতে হত । 

একদিন রাম লক্ষণ বনে গেছেন । অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা সমগ্র বনে ছেয়ে গিয়েছিল । হরিণ শিশুর ইতিউতি ভ্রমণ, বিবিধ পক্ষীর মধুর কলরব , সুগন্ধি পুস্পের ঘ্রান, তরুলতা গুলি সূর্যের আলো মেখে সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা বর্ধন করেছিল । রাম লক্ষণ এই মধুর দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে গেলেন । দানার লোভে পক্ষী গুলি শ্রীরামচন্দ্রের আশেপাশে এসে বিচরণ করতে লাগলেন । নবদূর্বাদল কান্তিময় রামচন্দ্রের মধুর মনোহর রূপ দেখে ময়ূর গুলি কেকা রবে ডাকতে লাগলো , বৃক্ষ গুলি যেনো পুস্পের ডালি দিয়ে ভগবানের চলার পথ কোমল করে দিয়েছিলো । রাম ও লক্ষণ এইগুলি দেখে অতীব প্রীত হলেন । কিন্তু উভয়ের ক্ষুধা তৃষ্ণা পেলো । দেবলোকে ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মা সহিত ভগবানের বাল্যলীলা দেখে আনন্দ প্রাপ্তি করতে লাগলেন । উভয়ে যখন ক্লান্ত তখন রামচন্দ্র একটি আমলকী বৃক্ষ দেখতে পেলেন । ভগবান সেই বৃক্ষে আরোহণ করে আমলকী ফল পেরে এনে ভ্রাতা লক্ষণকে দিয়ে কিছু নিজে সেবা নিলেন । সম্মুখে তাঁরা এক দীঘি দেখতে পেলেন । টলটলে দীঘির জলে পদ্ম ফুটে আছে । ব্রহ্মার আদেশে ইন্দ্রদেবতা পদ্মের মৃণালে ‘সুধা’ সৃষ্টি করলেন । রাম লক্ষণ সেই জলে নেমে পদ্ম পুস্প আরোহণ করে মৃণালের সেই সুধা গ্রহণ করলেন । অতঃ দীঘির শীতল মিষ্টি জল পান করে বনে ফিরলেন । বৃক্ষের ছায়ায় কোমোল পাতার ওপর শয্যা রচনা করে উভয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন । পক্ষী গুলি মধুর কলরব করে যেনো তাহাদিগকে ঘুমপাড়ানি সঙ্গীত শ্রবন করাতে লাগলেন । ভ্রমরেরা গুনগুন করে সেই সঙ্গীতে সুরতাল দিল । 

এই অতীব সুন্দর লীলা দেখে স্বর্গের সুরেরা মর্তলোকে নেমে আসলেন । ইন্দ্রদেবতা দেখলেন গাছপালার মধ্যে মধ্যে সূর্য কিরণ এসে প্রভুর চোখে মুখে পড়ছে এবং তিনি তাতে বিরক্ত হচ্ছিল্লেন ঘুমের মধ্যে । এই দেখে ইন্দ্রদেবতা মেঘ দিয়ে আকাশে আচ্ছাদন করলেন। সমস্ত জায়গাতে সূর্যের কিরণ পৌছালেও প্রভুর উপরে কেবল মেঘের আচ্ছাদন থাকলো । অগ্নি দেবতা তাপ হরণ করে সেই স্থানকে শীতল মনোরম করলেন , পবন দেবতা মৃদু মৃদু বায়ু উৎপন্ন করে প্রভুকে বাতাস দিতে লাগলেন । বিবিধ কোমল, সুগন্ধি পুস্প কত জন্মের পুণ্যফলে তাঁরা এখানে পুস্প হয়ে ফুটেছিলো, তাঁরা শ্রীপ্রভুর অঙ্গে পতিত হতে লাগলো । বরুণ দেব সেই পুস্প গুলিতে শিশির বিন্দু সৃষ্টি করলেন যাতে গরমে প্রভুর নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটে । শিশিরসিক্ত পুস্প গুলি শ্রীরামের অঙ্গে পতিত হয়ে প্রভুকে গরমে শীতলতা প্রদান করছিল । এইভাবে দেবতাকূল ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে সেবা করে নিজেদের ধন্য করলেন । অতঃ সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হতে উভয়ে আশ্রমে ফিরে গেলেন । গিয়ে দেখলেন তাঁহাদের বিদ্যা সমাপনে রাজবাড়ী থেকে দশরথ , রাজা কৈকয়ী এসেছেন। রাণী কৈকয়ী তাহাদের না দেখে অতীব চিন্তায় ছিলেন । পুত্র রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য প্রদান করতে লাগলেন । 

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ণ কথা ( আদিকাণ্ড – ২৭ )


এবার একটু বালির কথা শোনা যাক । বালি আর সুগ্রীব এর ভাতৃপ্রেম সকলেই বিদিত ছিলেন । বালির স্ত্রীর নাম তারা, সুগ্রীবের স্ত্রীর নাম রুমা । বালি ইন্দ্র দেবতার বর পুত্র ছিলেন, সুগ্রীব সূর্য দেবতার বর পুত্র ছিলেন। দুন্দুভি রাক্ষস বধ বধ করার সময় তাঁর সহযোগী রাক্ষস মায়াবী পলায়ন করেছিলো । পুনঃ একদিন মায়াবী রাক্ষস কিস্কিন্ধ্যায় এসে মহা উপদ্রব সৃষ্টি করলো। বানর দের বধ করতে লাগলো । খবর পেয়ে বালি গদা হস্তে ভীষণ মূর্তি ধরে ছুটলো। পেছন পেছন সুগ্রীব ও কিছু বানর ছুটলো । মায়াবী রাক্ষস মায়াবিদ্যায় পটু ছিলো । কিন্তু বালির সাথে যুদ্ধে পেরে উঠছিলো না। বালির গদায় আহত হয়ে মায়াবী রক্তবমন করতে লাগল । মায়াবী যুদ্ধে হেরে আরবল্লী পর্বতের একটি গুহায় ঢুকল । বালি গদা হাতে সেই গুহায় ঢুকতে গেলে সুগ্রীব বাধা দিয়ে বলল- “অগ্রজ, পলায়মান শত্রুর ওপর আঘাত যুদ্ধ নিয়মের বিরোধী। আপনি ফিরে চলুন।” বালি সে কথায় কান না দিয়ে গুহার ভেতরে একা প্রবেশ করল । দুজনে এমন যুদ্ধ হল গুহার ভেতরে যে মনে হল গোটা পর্বত টাই ভেঙে পড়বে । দুজনের যুদ্ধে পর্বতে কম্পন সৃষ্টি হয়ে ধস নামল । গুহার মধ্যে থেকে রক্ত নদীর ধারা বের হল। মায়াবী গুহার ভেতরে বালির গলার নকল করে আর্তনাদ করতে লাগল। সুগ্রীব ভাবল বালি বুঝি সেই রাক্ষসের হাতে মারা পরেছে। এবার যদি সেই রাক্ষস বের হয়ে আসে তবে গোটা কিস্কিন্ধ্যা ধ্বংস করবে। এই ভেবে সুগ্রীব একটা বড় পাথর চাপা দিয়ে গুহার মুখ বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে এলো । 

রাজ্যে ফিরে সব বলতেই বালির পত্নী তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে শাখা পলা সিঁদুর বিসর্জন দিয়ে বিধবার বেশ ধরল । বালির দেহ আনাও সম্ভব না। দেহ আনতে হলে পাথর সড়িয়ে আনতে হবে, আর তাহলে সেই রাক্ষস পুনঃ এসে উৎপাত আরম্ভ করবে । বালির কুশপুতুল পুড়িয়ে অঙ্গদ সকল প্রকার ভাবে পিতৃ শ্রাদ্ধ পালন করল । ফাঁকা রাজ আসনে কে বসবে ? অঙ্গদ এখনও শিশু । সুগ্রীব রাজা হয়ে অঙ্গদকে যুবরাজ ঘোষিত করে রাজ্য চালাতে লাগল । বছর ভরে যুদ্ধ করার পর বালি সেই গুহার ভেতরে মায়াবীকে বধ করলো । বালির শরীরে এত বল ছিলো যে সে হাত দিয়ে পাথর সড়িয়ে গুহা থেকে বের হল। রাজ্যে ফিরে সুগ্রীবকে রাজার আসনে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল- “তুই ভাই নামে কলঙ্ক । আমি সেখানে যুদ্ধ করছিলাম, আর তুই রাজ্য পাবার লোভে আমাকে পাথর চাপা দিয়ে গুহা মুখ বন্ধ করে এসে রাজা হয়েছিস। কি ভেবেছিলি যে আমি ঐ বদ্ধ গুহায় মারা যাবো?” জীবিত দাদাকে দেখে সুগ্রীব এসে ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করে বলল- “অগ্রজ । আপনাকে জীবিত দেখে আমি আনন্দিত হয়েছি। আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি ঐ রাক্ষসের হস্তে মারা গেছেন। যাতে ঐ রাক্ষস বের হতে না পারে সেই জন্য গুহা মুখ রুদ্ধ করেছিলাম।” বালি ত ঐ সকল কথা বিশ্বাস করলো না। উলটে বলল- “সুগ্রীব । যদি এতই তোর রাজা হবার ইচ্ছা তো আমাকে বলতিস তোকে এই রাজ্য দান করতাম । আমি স্বয়ং দশানন কে সাতবার জলে ডুবানোর ক্ষমতা রাখি । আর ঐ সামান্য রাক্ষস আমাকে বধ করবে? বেরিয়ে যা আমার রাজ্য হতে ।” বালি সুগ্রীবকে তাড়িয়ে দিল। সুগ্রীব গিয়ে ঋষমূক পর্বতে আশ্রয় নিলো । বালি সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো । রুমা রাজী হল না, বালি তখন রুমাকে কারাবন্দী করল । 

একদিনের কথা । ভগবান শিব একজন মাদারী ( বাদর খেলা যে দেখায় তাকে মাদারী বলে ) সেজে আর হনুমান কে এক বাঁদর সাজিয়ে অযোধ্যা তে গেলো । রামের ইষ্ট শিব আবার শিবের ইষ্ট রাম । অযোধ্যা নগরীতে নেমে ডুগডুগি বাজিয়ে শিব বাদর খেলা দেখাতে লাগলো । রাজবাটিটে বাঁদর নাচানো দেখাতে গেলেন স্বয়ং পশুপতি । চার ভ্রাতা সেই খেলা দেখে আনন্দিত হলেন । শিশু রাম , দশরথকে অনুরোধ জানালেন তাঁকে ঐ বাঁদর টি দিতে । দশরথ রাজা মাদারীকে বললেন- “কত মূল্যে তুমি বাঁদর টি দেবে ?” মাদারী রূপধারী হর জানালেন- “মহারাজ। এর কোনো মূল্য লাগবে না। খালি একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যেনো সারা জীবন আপনার পুত্র এই বাঁদর টিকে তাঁর সেবক রূপে রাখেন।” রামচন্দ্র বচন দিলেন। মাদারী রূপী শিব সেইখানে বাঁদর টি দিয়ে চলে গেলেন । চার ভ্রাতা যখন খেলা খেলতো তখন বাণর রূপী হনুমান তাঁদের সাথে খেলা করতেন । ভগবান রাম খুবুই স্নেহ করতেন হনুমানকে । আর হনুমান মহারাজ সর্বদা রামচন্দ্রের আগেপিছে ঘুরতেন। প্রভুর খেলা সামগ্রী যেমন কন্দু, ঘুড়ির লাটাই, তির ইত্যাদি এনে এনে দিতেন । গাছে উঠে সুগন্ধি পুস্প বা মিষ্ট ফল পেরে পেরে দিতেন । সুগ্রীবের অবস্থার কথা রামচন্দ্র যোগবলে জেনেছিলেন। তিনি হনুমানকে সুগ্রীবের কাছে ঋষমূক পর্বতে গিয়ে অবস্থান করতে বলেছিলেন। আর বলেছিলেন- যথা সময়ে আবার দেখা হবে । 

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।