কৌশল্যারে দেখা দেন প্রভু নারায়ণ ।।
স্বপ্নে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শার্ঙ্গধারী ।
চতুর্ভুজ রূপে দেখা দিলেন শ্রীহরি ।।
পুত্রভাবে হরিকে করিল রাণী কোলে ।
কহিলেন কৌশল্যারে ডাকিয়া মা ব’লে ।।
কৌশল্যা দেবী স্বপ্নে চতুর্ভুজ ভগবানের নীলনবঘন শ্রীমূর্তি দর্শন পেলেন। দেখলেন সেই অনাদির আদি গোবিন্দ পুত্র রূপে তাঁর ক্রোড়ে । কিন্তু ভগবান তাঁহার অবিছিন্না যোগমায়া শক্তি অবলম্বনে বৈষ্ণবী মায়া দ্বারা কৌশল্যার সেই স্বপ্ন স্মৃতি মুছে দিলেন । কারন তাহলে ভগবান রাম বাৎসল্য সেবা পাবেন না । আমরা যেরূপ শ্রীকৃষ্ণের শিশু রূপ গোপাল পূজা করি তেমনি উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান ঐদিকে শিশু রামের পূজো হয়। যাঁহাকে বলে “রামলালা”। সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী মহারাজ লিখেছেন-
বিপ্র ধেনু সুর সন্ত হিত লীনহ মনুজ অবতার ।
নিজ ইচ্ছা নির্মিত তনু মায়া গুন গো পার ।।
এর অর্থ- “শ্রীভগবানের নরদেহ ধারন বিপ্র, ধেনু, দেবগণ ও সাধু সন্ত কল্যাণে নিহিত ছিল । অজ্ঞান রূপে মায়ার মলিনতা , ত্রিগুণ ও ইন্দ্রিয় তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর দিব্য তনু নিজ ইচ্ছায় নির্মিত , তা কোন কর্ম বন্ধনের বশীভূত হয়ে ত্রিগুণাত্মক পঞ্চভূত দেহ নয় ।”
এখানে “সাধু” শব্দের অর্থ যিনি জটা লম্বা শ্রশ্রু রেখে বনে থাকেন খালি তারাই নয়, সাধু বলতে যিনি অন্তর থেকে পবিত্র সর্বদা অন্যের মঙ্গল কামনা করে সেই মতো কর্ম করেন । “সন্ন্যাসী” শব্দের অর্থ- “সৎ ন্যাস” অর্থাৎ যিনি সৎ অর্থাৎ মঙ্গল কর্ম করেন তিনিই সন্ন্যাসী । আর শ্রীভগবান এঁনাদের কল্যাণ করেন । যাই হোক চৈত্র মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে কর্কট লগ্নে পুনর্বসু নক্ষত্র ( মতান্তরে অশ্লেষা ) দ্বিপ্রহরে কৌশল্যা দেবীর গর্ভ থেকে আবির্ভূত হলেন শ্রীভগবান রামচন্দ্র । এই দিনটি “রামনবমী” নামে পালিত হয় । যথা কৃত্তিবাস ওঝা লেখেছেন-
মধুচৈত্রমাস, শুক্লা শ্রীরাম নবমী ।
শুভক্ষণে ভূমিষ্ঠ হ’লেন জগৎস্বামী ।।
শ্রীরামের আবির্ভাব হতে দাসীরা গিয়ে রাজা দশরথকে সংবাদ দিলেন। রাজা দাসীদিগকে মণি মুক্তা অলংকার বিতরণ করলেন । পুত্রের মুখ দেখে অতিশয় খুশী হলেন । এই দেখে মন্থরা গিয়ে গর্ভ যন্ত্রনায় কাতর কৈকয়ীকে বললেন- “তোমার কপাল পুড়লো, এবার কৌশল্যা আগে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে সেই রাজা হবে, আর তুমি ভিখারী।” কৈকয়ী জন্ম দিলেন এক পুত্রের। দশরথ রাজা শুনে আনন্দে দান ধ্যান করে কৈকয়ী পুত্রকে দর্শন করলেন । একদিন পর সুমিত্রা দুটি যমজ পুত্রের জন্ম দিলেন। রাজা দশরথের আনন্দের সীমা নেই । সুমিত্রা সহ যমজ পুত্র দেখে খুশীতে ভরে উঠলেন । শ্রীরামের জন্মেতে ধরিত্রী দেবী খুশী হলেন । মুনি ঋষি রা আনন্দিত হলেন – যথা কৃত্তিবাস পণ্ডিত গেয়েছেন-
রামের জনম শুনি, নাচেন সকল মুনি ,
দণ্ড কমণ্ডলু করি হাতে ।
স্বর্গে নাচে দেবগণ , মর্তে নাচে মর্তজন
হরিষে নাচিছে দশরথে ।।
অযোধ্যায় শঙ্খ, উলুধ্বনি, মৃদঙ্গ, করতাল আদি মঙ্গলজনক বাদ্য বাজতে থাকলো । স্বর্গের দেবতারা পুস্প বর্ষণ করতে লাগলেন । ছদ্দবেশে অযোধ্যা পুরীতে এলেন । চার পুত্রকে একই দোলনায় রাখা হল । রানীরা একে অপরের পুত্রকে আদর করিতে লাগলেন । কে কার মা বোঝাই গেলো না । সরল হৃদয় কৈকয়ী রামচন্দ্রকে আদর বাৎসল্য প্রদান করতে লাগলেন । ভগবানের বাল্যরূপ দর্শন করা অতি সৌভাগ্যের । বিশেষত ভগবান যখন পূর্ণব্রহ্ম অবতার গ্রহণ করেন । এর পূর্বে বামন, কপিল, পরশুরাম অবতারে এই দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য হয় নি । মুনি ঋষি গণ আশীর্বাদ করে অন্তরে অন্তরে কৌশল্যার পুত্রকে প্রনাম করলেন । শিশু ভগবান রাম রূপে নারায়ণ অবস্থান করছেন । সেই শিশু রামের কি অপূর্ব শোভা – কৃত্তিবাস ওঝা লিখেছেন-
অন্ধকার ঘুচে যে জ্বালিলেক বাতি ।
কোটি সূর্য জিনিয়া তাঁহার দেহ- জ্যোতি ।।
শ্যামল শরীর প্রভু চাঁচর কুন্তল ।
সুধাংশু জিনিয়া মুখ করে ঝলমল ।।
আজানুলম্বিত দীর্ঘ ভুজ সুললিত ।
নীলোৎপল জিনি চক্ষু আকর্ণ পূর্ণিত ।।
কে বর্ণিতে হয় শক্ত রক্ত ওষ্ঠাধর ।
নবনীত জিনিয়া কোমল কলেবর ।।
সিন্দূরে মণ্ডিত রাঙা চরণ সুন্দর ।
কমল জিনিয়া প্রভু- নাভি মনোহর ।।
সংসারের রূপ যত একত্র মিলন ।
কিসে বা তুলনা দিব নাহিক তেমন ।।
অপূর্ব সুন্দর সদ্যোজাত ভগবানকে দখে মোহিত হয়ে গেলেন সকলে। লঙ্কায় নানা অশুভ চিহ্ন দেখা দিলো । রক্তবৃষ্টি, শেয়াল সারমেয় ক্রন্দন, গৃধ দলের আকাশে বিচরণ , বিনা মেঘে বজ্রপাত , গর্দভের ক্রন্দন ইত্যাদি ইত্যাদি । রাক্ষসেরা ভয়ে ভীত হল ।
চৈত্র মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে অবশ্যই রাম নবমী তিথি পালন করুন । জন্মাষ্টমীর মতোন নিয়ম । তবে শ্রীরামের জন্ম দ্বিপ্রহরে । তাই পূজা দ্বিপ্রহরে ১ টার মধ্যে সমাপন করবেন । উপোবাসী থেকে পূজাদি করে প্রসাদ সেবা নিয়ে ভগবানের নাম কীর্তন করে পালন করবেন এই তিথি । পূজাতে আপনার সাধ্য মতো ফলমূল ও একটি লাড্ডু হলেও দিবেন। কেউ কেউ মাটির সড়ায় ছাতু, মধু, দৈ, ঘৃত , শর্করা একত্রে দেন । ভগবানের পূজার আড়ম্বর নেই। যার যেমন সামর্থ্য। ভগবান রাম শবরীর দেওয়া উচ্ছিষ্ট জাম ফল খেয়েই তুষ্ট হয়েছিলেন । গর্বে উন্মত্ত হয়ে রাশি রাশি ভোগ দিলে ভগবানের কাছে তা বিষ, আবার ভক্তিভাবে এক পাত্র জল দিলেই তিনি তা আনন্দে সেবা করেন । সুদামার তিন মুঠ চিড়াতেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন , আবার বিদূরের স্ত্রী , ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে ভক্তিভাবে এতই উন্মত্ত হয়েছিলেন যে কলা খেতে দিয়ে ভাবে মোহিত হয়ে নিজেই কলা ছুলে কলার পরিবর্তে কলার খোসা নিবেদন করেছিলেন । আর ভগবান হাসতে হাসতে সেই কলার খোসা সেবা নিয়েছিলেন ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন