• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

২২ মার্চ ২০১৬

মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান, চাদঁ সওদাগর ভনে শুনে পূণ্যবান’। বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে এই কথাটা শোনেনি এমন মানুষ কদাচিৎ পাওয়া যাবে না। সেটা বুঝেই হোক না আর না বুঝেই হোক। যদিও আজ আমাদের আলোচনার বিষয় মহাভারতের বানী কিংবা চাঁদ সওদাগরের কাহিনী নয়। উপরন্তু, মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন প্রতিষ্ঠা করেন সাইবেরিয়া স্রামাজ্র্য ।
See details : http://www.indiadivine.org/krishnas-son-pradyumnas-city-in-por-bajin-siberia/



গান্ধার: মহাভারতের শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম শহর গান্ধার। মহাভারতের বর্ননার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, এই শহরটি সিন্ধু প্রদেশের সিন্ধু নদীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী ছিলেন গান্ধার শহরের রাজা সুবলের কন্যা গান্ধারী। আর গান্ধারীর ভাই শকুনী ছিলেন দুর্যোধনের মামা, যিনি পান্ডবদের শঠতার মাধ্যমে পরাজিত করেছিলেন। অথবা বলা ভালো, তার কারণেই মহাভারতের যুদ্ধের সূচনা।



তক্ষশীলা: মহাভারতের সময়কার অপর এক বিখ্যাত শহর তক্ষশীলা। গান্ধার দেশের রাজধানী ছিল এই শহর। বর্তমানে পাকিস্তানের রওয়ালপিন্ডিতেই ছিল ওই শহরের অবস্থান। মহাভারতের যুদ্ধের পর পান্ডবরা যখন হিমালয়ের দিকে যাত্রা শুরু করে তখন রাজা হিসেবে পরীক্ষিতের অভিষেক হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি সাপের কামড়ে মারা যান। আর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পরীক্ষিতের সন্তান জনমেজয় তক্ষশীলার দিকে নাগরাজকে পাঠান এবং সেই নাগরাজের আক্রমনে অনেক সাপ মারা যায়।



মাদরা দেশ: হিমালয়ের উত্তরের দেশকে বলা হতো মাদরা দেশ। আতরাই ব্রাহ্মনদের মতে, হিমালয়ের এই অংশকে তৎকালীন সময়ে বলা হতো উত্তরকুরু। সেসময় মাদরা দেশের রাজা ছিলেন শল্য। তারা বোন মাদরির বিয়ে হয় পান্ডুর সঙ্গে। সহদেব এবং নকুল ছিলেন মাদরির সন্তান। বর্তমানে নেপাল এবং ভারতের একাংশই হলো সাবেক মাদরা দেশ।




উজ্জয়নী: বর্তমান ভারতের উত্তরপ্রদেশের সাবেক নাম ছিল উজ্জয়নী। উত্তরপ্রদেশের নৈনিতাল জেলার কাশিপুরের নিকটেই ছিল প্রাচীন উজ্জয়নী শহর। এই শহরেই গুরু দ্রোনাচার্য তার শিষ্য পান্ডবদের ধর্নুবিদ্যায় পারদর্শী করেছিলেন। কুন্তীর সন্তান ভীম এই শহরে শিবের মুর্তি স্থাপন করেছিলেন বলে এই শহরকে ভীমশঙ্কর নামেও ডাকা হতো।



শিবি দেশ: ভারতের উত্তরের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ পাঞ্জাবই হলো মহাভারতের শিবি দেশ। এই শহরের রাজা ঊষীণারের নাতি দেবিকার সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের বিয়ে হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় পান্ডবদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ঊষীণারের সন্তান শৈব।


  বানগঙ্গা: ভারতের প্রাচীন নগর হরিয়ানাই হলো মহাভারতের বানগঙ্গা। কুরুক্ষেত্র থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহর। এখনও ভারতের তীর্থস্থান সম্বলিত স্থানগুলোর মধ্যে হরিয়ানা অন্যতম। প্রাচীন ভারতের রীতি-কৃষ্টি ইত্যাদির ছিটেফোটা এখনও হরিয়ানায় পাওয়া যায়। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন।




হস্তিনাপুর: উত্তরপ্রদেশের একটি বিখ্যাত স্থানের নাম মেরুত। আর এই মেরুতই ছিল মহাভারত আমলের হস্তিনাপুর। কৌরব এবং পান্ডব উভয়েরই রাজধানী ছিল হস্তিনাপুর। এই শহরকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনা জন্ম হয়েছিল তৎকালীন সময়ে। যুদ্ধের দামামা থেকে শুরু করে যুদ্ধ পরবর্তী অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে শহরটি।





ইন্দ্রপ্রস্থ: পান্ডবদের হাতে প্রতিষ্ঠিত শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ শহরের নাম ইন্দ্রপ্রস্থ। খান্ডব বন ধ্বংস করে এই শহরটি তৈরি করা হয়েছিল। পান্ডবদের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এই শহর থেকে পরিচালিত হতো। এমনকি এখনও নয়াদিল্লির একটি স্থানের নাম আছে ইন্দ্রপ্রস্থ। আর সাবেক ইন্দ্রপ্রস্থ হলো বর্তমানের দিল্লি।










Share:

মহাভারতের সময় হতে ইন্দ্রপ্রস্থের ৪,১৭৫+ বছরের রাজাদের তালিকা

(নিজে সংগ্রহ করুন অন্যকে সংগ্রহে রাখতে অনুপ্রানিত করুন। আমাদের গৌরবের ও ঐতিহ্যের বিষয় গুলি আমাদের নতুন প্রজন্মের জানা উচিৎ)

নিম্নোক্ত সমস্ত তথ্যের জন্য শ্রী দয়ানন্দ সরস্বতীর নিকট আমার কৃতজ্ঞ সেই সাথে এই সব তথ্য দয়ানন্দ সরস্বতী যাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁদের প্রতি ভক্তি ভরা প্রনাম জ্ঞাপন করছি।

ইন্দ্র প্রস্ত তথা আর্যাবর্তের রাজাদের ধারাবাহিক পরিচিতি ও রাজত্ব কালের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় জ্ঞানী দয়ানন্দ সরস্বতী। তিনি এই তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন - রাজপুতনার অন্তর্গত উদয়পুর মেদার রাজ্যের রাজধানী, চিতোরগড়ের শ্রিনাথদ্বার হতে প্রকাশিত এবং বিদ্যার্থী সম্মিলিত "হরিশ্চন্দ্র চন্দ্রিকা" এবং "মোহঞ্চন্দ্রিকা" নামক পাক্ষিক পত্রিকা হইতে। উক্ত পত্রিকাদ্বয়ের সম্পাদক মহাশয় ১৭৮২ বিক্রমাব্দে লিখিত একখানি গ্রন্থ তাহার কোন বন্ধুর নিকত হতে প্রাপ্ত হয়ে তাথেকে সংগ্রহ করে প্রচলিত ১৯৩৯ সালে মুদ্রন করেন।

ইন্দ্রপ্রস্থের শেষ রাজা ছিলেন শ্রী যশপাল। রাজা শ্রী যুধিষ্ঠির থেকে যশপাল পর্যন্ত আনুমানিক ১২৪ জন রাজা, মোট ৪,১৭৫ বছর ৯ মাস ১৪ দিন রাজত্ব করেছিলেন।

শ্রীমান যুধিষ্ঠির প্রভৃতি আনুমানিক ৩০ পুরুষ ১,৭৭০ বছর ১১ মাস ১০ দিন রাজত্ব করেছিলেন। নিম্নে তার বিবরণ তুলে ধরা হলোঃ

১। রাজা যুধিষ্ঠির – ৩৬ বছর ৯ মাস ১৪ দিন
২। রাজা পরীক্ষিত = ৬০–৮–২৫ (৬০ বছর-৮ মাস – ২৫ দিন)
৩। রাজা জনমেজয় = ৮৪–৭-২৩
৪। রাজা অশ্বমেধ = ৮২-৮-৩২
৫। দ্বিতীয় রাম = ৮৮-২-৮
৬। ছত্রমল = ৮১-১১-২৭
৭। চিত্ররথ = ৭৫-৩-১৮
৮। দুষ্টশৈল্য = ৭৫-১০-২৪
৯। রাজাউগ্র সেন = ৭৮-৭-২১
১০। শূরসেন = ৭৮-০৭-২১
১১। ভুবনপতি = ৬৯-৫-৫
১২। রণজিৎ = ৬৫-১০-০৪
১৩। ঋক্ষক = ৬৪-৭-৪
১৪। সুখদেব = ৬২-০-২৪
১৫। নরহরিদেব = ৫১-১০-০২
১৬। সুচিরথ = ৪২-১১-০২
১৭। শূরসেন (২য়) = ৫৮-১০-০৮
১৮। পর্বতসেন = ৫৫-০৮-১০
১৯। মেধাবী = ৫২-১০-১০
২০। সোনচীর = ৫০-০৮-২১
২১। ভীমদেব = ৪৭-০৯-২০
২২। নৃহরিদেব = ৪৫-১১-২৩
২৩। পূর্ণমল = ৪৪-০৮-০৭
২৪। করদবী = ৮৮-১০-০৮
২৫। অলংমিক = ৫০-১১-০৮
২৬। উদয়পাল = ৩৮-০৯-০
২৭। দুবনমল = ৪০-১০-২৬
২৮। দমাত = ৩২-০-০
২৯। ভীমপাল = ৫৮-০৫-০৮
৩০। ক্ষেমক = ৪৮-১১-২১

মুলত পাণ্ডু বংশের রাজত্ব এখানেই শেষ হয়ে যায়। রাজা ক্ষেমকের প্রধান মন্ত্রী বিশ্রবা ক্ষেমক রাজাকে নিহত করে সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁর ১৪ পুরুষ ৫০০ বছর ৩ মাস ১৭ দিন রাজত্ব করেন। তাঁদের তালিকাঃ

১। বিশ্রবা = ১৭-০৩-২৯
২। পুরসেনী = ৪২-০৮-২১
৩। বীরসেনী = ৫২-১০-০৭
৪। ফবঙ্গশায়ী = ৪৭-০৮-২৩
৫। হরিজিৎ = ৩৫-০৯-১৭
৬। পরমসেনী = ৪৪-০২-২৩
৭। সুখপাতাল = ৩০-০২-২১
৮। কদ্রুত = ৪২-০৯-২৪
৯। সজ্জ = ৩২-০২-১৪
১০। ফমরচূড় = ২৭-০৩-১৬
১১। অমীপাল = ২২-১১-২৫
১২। দশরথ = ২৫-০৪-১২
১৩। বীরসাল = ৩১-০৮-১১
১৪। বীরসালসেন = ৪১-০০-১৪

রাজা বীরসাল সেনের প্রধান মন্ত্রী বীরমহা প্রধান তাঁহাকে হত্যা করিয়া রাজ্যাধিকার করেন। তাঁহার বংশ ১৬ পুরুষ ৪৪৫ বৎসর ৫ মাস ৩ দিন রাজত্ব করেন। তাঁদের তালিকা

১। রাজা বীরমহা = ৩৫-১০-০৮
২। অজিত সিংহ = ২৭-০৭-১৯
৩। সর্বদত্ত = ২৮-০৩-১০
৪। ভুবনপতি = ১৫-০৪-১০
৫। বীরসেন (প্রথম) = ২১-০২-১৩
৬। মহীপাল = ৪০-০৮-০৭
৭। শত্রুশাল = ২৬-০৪-০৩
৮। সঙ্গরাজ = ১৭-০২-১০
৯। তেজপাল = ২৮-১১-১০
১০। মানিক চাঁদ = ৩৭-০৭-২১
১১। কামসেনী = ৪২-০৫-১০
১২। শত্রুমর্দন = ০৮-১১-১৩
১৩। জীবনলোক = ২৮-০৯-১৭
১৪। হরিরাও = ২৬-১০-২৯
১৫। বীরসেন (২য়) = ৩৫-০২-২০
১৬। আদিত্যকেতু = ২৩-১১-১৩
প্রয়োগের রাজা ‘ধন্ধব’ মগধদেশের রাজা আদিত্যকেতুকে হত্যা করে রাজ্যাধিকার করেন। তাঁহার বংশ ৯ পুরুষ, ৩৭৪ বছর ১১ মাস ২৬ দিন রাজত্ব করেন। তাঁদের তালিকা
১। রাজা ধন্ধর = ৪২-০৭-২৪
২। মহর্ষি = ৪১-০২-২৯
৩। সনরচ্চী = ৫০-১০-১৯
৪। মহাযুদ্ধ = ২০-০৩-০৮
৫। দূরনাথ = ২৮-০৫-২৫
৬। জীবনরাজ = ৪৫-০২-০৫
৭। রুদ্রসেন = ৪৭-০৪-২৮
৮। অরীলক = ৫২-১০-০৮
৯। রাজপাল = ৩৬-০০-০০

সামন্ত মহান পাল রাজা রাজপালকে হত্যা করে রাজ্যাধিকার করেন। তিনি এক পুরুষে ১৪ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর কোন বৃদ্ধি নাই।

রাজা বিক্রমাদিত্য অবন্তিকা (উজ্জায়নী) হইতে আক্রমণ চালাইয়া রাজা মহানপালকে হত্যা করে রাজ্যাধীকার করেন। তাঁহার বংশ ১ পুরুষ ৩৯ বছর রাজত্ব করেন। তাঁহার কোন বৃদ্ধি নাই।

শালিবাহনের মন্ত্রী সমুদ্রপাল, যোগীপৈঠনের রাজা বিক্রমাদিত্যকে হত্যা করে রাজ্যাধিকার করেন। তাঁহার বংশ ১৬ পুরুষ, ৩৭২ বছর, ৪ মাস ২৭ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা-

১। সমুদ্রপাল = ৫৪-০২-২০
২। চন্দ্রপাল = ৩৬-০৫-০৪
৩। সাহায়পাল = ১১-০৪-১১
৪। দেবপাল = ২৭-০১-১৭
৫। নরসিংহপাল = ১৮-০০-২০
৬। সামপাল = ২৭-০১-১৭
৭। রঘুপাল = ২২-০৩-২৫
৮। গোবিন্দপাল = ২৭-০১-১৭
৯। অমৃতপাল = ৩৬-১০-১৩
১০। বলীপাল = ১৩-০৮-০৪
১১। মহীপাল = ১৩-০৮-০৪

রাজা মহাবাহু রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া তপস্যার্থে বনে গমন করেন। ইহা শুনিয়া বঙ্গ দেশের রাজা আধীসেন ইন্দ্রপ্রস্থে আসিয়া নিজে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। তাঁর বংশ ১২ পুরুষ, ১৫১ বৎসর ১১ মাস ২ দিন রাজত্ব করেন। তাঁদের তালিকা –

১। রাজা আধীসেন = ১৮-০৫-২১
২। বিলাবলসেন = ১২-০৪-০২
৩। কেশবসেন = ১৫-০৭-১২
৪। মাধবসেন = ১২-০৪-০২
৫। ময়ূরসেন = ২০-১১-২৭
৬। ভীমসেন = ০৫-১০-০৯
৭। কল্যানসেন = ০৪-০৮-২১
৮। হরিসেন = ১২-০০-২৫
৯। ক্ষেমসেন = ০৮-১১-১৫
১০। নারায়ণসেন = ০২-০২-২৯
১১। লক্ষ্মীসেন = ২৬-১০-০০
১২। দামোদর সেন = ১১-০৫-১৯

রাজা দামোদরসেন তাঁর পাত্রমিত্রদিগকে অনেক কষ্ট দিতেন। এই নিমিত্ত তাঁর জনৈক পাত্রমিত্র দীপ্তসিংহ সৈন্য সংগ্রহ করিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তাঁকে যুদ্ধে নিহত করে স্বয়ং রাজত্ব করা আরম্ভ করেন। তাঁহার বংশ ৬ পুরুষ, ১০৭ বৎসর ৬ মাস ২ দিন রাজত্ব করেন। তাঁদের তালিকা –

১। দীপসিংহ = ১৭-০১-১৬
২। রাজসিংহ = ১৪-০৫-০০
৩। রণসিংহ = ০৯-০৮-১১
৪। নরসিংহ = ১৩-০২-২৯
৬। জীবনসিংহ = ০৮-০০-০১

কোন কারণ বশতঃ রাজা জীবনসিংহ তাঁহার সমস্ত সৈন্য উত্তরদিকে প্রেরণ করেন। বৈরাটের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান সেই সংবাদ পেয়ে জীবনসিংহকে আক্রমণ করেন এবং তাঁহাকে যুদ্ধে নিহত করিয়া ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করা আরম্ভ করেন। তাঁর বংশ ৫ পুরুষ, ৮৬ বৎসর ০ মাস ২০ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা –

১। পৃথ্বী রাজ = ১২-০২০১৯
২। অভয়পাল = ১৪-০৫-১৭
৩। দুর্জ্জব পাল = ১১-০৪-১৪
৪। উদয়পাল = ১১-০৭-০৩
৫। যশপাল = ৩৬-০৪-২৭

সুলতান শাহাবুদ্দিন ঘোরী গজনীর দুর্গা হতে রাজা যশপালকে আক্রমণ করেন এবং ১২৪৯ সালে তাঁকে প্রয়োগের দুর্গে বন্ধী করেন। অতঃপর সুলতান শাহাবুদ্দিন ইদ্রপ্রস্থে (দিল্লীতে) রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। তাঁর বংশ ৫৩, ৭৪৫ বৎসর, ১ মাস ও ১৭ দিন রাজত্ব করেন। এ সম্পর্কে বহু তথ্য লিখিত আছে তাই আর উল্লেখ করছিনা।

ঈশ্বর সকল শুভ শক্তির ও ধর্মের ধারকদের মঙ্গল করুন।

Written by:  Ashok Chakraborty
Share:

হোলি : ধর্মের জয়ের আনন্দোৎসব




হোলি : ধর্মের জয়ের আনন্দোৎসব

হিন্দুধর্ম তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও উৎসবের আনন্দে মানবতার বাণীকেই ধারণ করে আছে যুগ যুগ ধরে। বারো মাসে তেরো পার্বণের ন্যায় হিন্দুধর্মে লেগে আছে ঋতুভিত্তিক উৎসব। এই সকল উৎসব ধর্মের গণ্ডী অতিক্রম করে সর্বমানবীয়, উদার দার্শনিক তত্ত্বে ঋদ্ধ। প্রাচীন ঋষিরা তাই হিন্দু ধর্মকে ক্ষুদ্র গণ্ডীতে আবদ্ধ করেননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর ইতিহাস হিন্দু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোত জড়িত। হোলিও তেমনি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির উত্থানের ইতিহাস।





































দৈত্যরাজ হিরণ্যকিশপুর কাহিনী আমরা সকলে জানি। ভক্ত প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্ম নিয়েও পরম ধার্মিক ছিলেন। ভগবান











শ্রীহরির ভক্ত ছিলেন প্রহ্লাদ। ঈশ্বরবিদ্বেষী হিরণ্যকশিপু তার পুত্রকে শ্রীহরিকে ভক্তি করতে নিষেধ করেন। তার নিষেধ অমান্য করেন ভক্তরাজ প্রহ্লাদ। ফলে ক্রুদ্ধ রাজা হিরণ্যকশিপু তার পুত্রকে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু যতভাবেই প্রহ্লাদকে হত্যা করার চেষ্টা করেন মহারাজ, ততবারই ভগবান শ্রীহরি তাঁকে রক্ষা করেন। তাঁকে যখন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও হত্যা করা যাচ্ছিল না তখন হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, হোলিকা এই বর পেয়েছিল যে, আগুনে তার কোন ক্ষতি হবে না। হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করেন। কিন্তু অন্যায় কাজে শক্তি প্রয়োগ করায় হোলিকার প্রাপ্ত বর ফলপ্রসূ হয়নি। হোলিকা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই দহনকে হোলিকা দহন বলা হয়। এদিকে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ অক্ষত থাকেন। ভগবান এভাবেই ভক্তকে বারবার রক্ষা করেন। ভক্তের জয় আর আসুরিক অপশক্তির পরাজয় হয়। ভক্তের জয়ের এই আনন্দ অপরাপর ভক্তদের মাঝে উৎসবে পরিণত হয়। হোলিকা দহনের এই উৎসবই কালের আবর্তে এখন হোলি উৎসব নামে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

অন্যদিক বসন্তের পূর্ণিমার এই দিনে ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেন। কোথাও কোথাও অরিষ্টাসুর নামক অসুর বধের কথাও আছে। অন্যায়কারী, অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করার পর তার রক্ত ছিটিয়ে সকলে আনন্দ করেছিলেন। এই অন্যায় শক্তিকে ধ্বংসের আনন্দ মহানন্দে পরিণত হয়।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হোলির রীতি ও বিশ্বাস বিভিন্ন। বাংলা অঞ্চলে বৈষ্ণব প্রাধান্য রীতি প্রচলিত। রঙ উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে। শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয়। পরের দিন রঙ খেলা।

বাংলাতেও দোলের আগের দিন এইরকম হয় যদিও তার ব্যাপকতা কম, একে আমরা বলি ‘চাঁচর’। এই চাঁচরেরও অন্যরকম ব্যাখ্যা আছে। দোল আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসব। পাতাঝরার সময়, বৈশাখের প্রতীক্ষা। এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা, তার ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। পুরনো জঞ্জাল, রুক্ষতা, শুষ্কতা সরিয়ে নতুনের আহ্বান হচ্ছে এই হোলি। বাংলায় দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’ উদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়।



অঞ্চলভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু উদযাপনের রীতি এক। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন।

দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংসা’য় রঙ উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। এমনকি আল বেরুনীর বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোন কোন অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হত।

মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলোর অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণের রঙ উৎসব। এই রাধা-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে হোলির যে অতি বৈষ্ণবীয় আচার তা অবশ্যই প্রশ্নযুক্ত। কেননা এটি শ্রীকৃষ্ণের জীবন ইতিহাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শ্রীকৃষ্ণ ১২ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করার পর আর কখনোই সেখানে তাঁর যাওয়া হয়নি। অন্যদিকে বহু গবেষক রাধার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন থেকে দোল কথার উদ্ভব। এই উৎসবের নাম ‘ঝুলন যাত্রা’ বা ‘দোল যাত্রা’ও বলে।



সে যাই হোক রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্বকে দাঁড় করিয়ে বিপরীত লিঙ্গের মাঝে অবাধ হোলি খেলা অবশ্যই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থনযোগ্য নয়। আবার বিষাক্ত রঙের ব্যবহারও উচিত নয়। তাই হোলি নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের অসামাজিকতা পরিহার করা জরুরী।

হোলি সম্পর্কে বড় একটি তথ্য অনেকে এড়িয়ে যায়। ধর্ম ও সমাজ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আর একটি উৎসব বা দিন আরও পবিত্র হয়ে ওঠে যদি উক্ত দিনে পৃথিবী কোন মহান পুরুষের জন্ম দেয়। বাঙালি তথা হিন্দু সমাজের অন্যতম মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি হচ্ছে এই পূর্ণিমা তিথি তথা হোলি তিথি। এই মহান পুরুষের জন্ম হোলি উৎসবের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর তাই এর অপর নাম ‘গৌর পূর্ণিমা’।


পৃথিবী পাপে ভারাক্রান্ত হলে ঈশ্বর সেই ভার লাঘব করেন অবতাররূপে। বর্তমান পৃথিবী এমন অন্যায় ভারে ভারাক্রান্ত তাই মানুষের মধ্যে প্রয়োজন শুভবোধ, প্রতিবাদী শক্তি, সংগ্রাম ও সত্যের প্রতি সমর্পণ। ধর্মীয় গণ্ডী ছাড়িয়ে হোলি উৎসবের এই মহান আদর্শ আমাদের পাপ-পঙ্কিল ধরণীকে পরশ পাথরে সত্য করে তুলুক। অন্যায়কে পরাজিত করার আনন্দে সকলের মন রাঙিয়ে উঠুক। মহানপুরুষের আবির্ভাবে সকলের মন আনন্দে নেচে উঠুক, তবে তা অবশ্যই অসামজিকতায় নয়।

রবীন্দ্রনাথের সুরে হোলির রঙ আমাদের মর্মে লাগুক-

ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল, লাগলো যে দোল।

স্থলে জলে বনতলে লাগলো যে দোল।

দ্বার খোল, দ্বার খোল।।


লেখক: সঞ্জয় সরকার, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

এইবেলাডটকম/এমআর
Share:

২০ মার্চ ২০১৬

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র -২০১৫ (প্রথম পর্ব)



বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র -২০১৫ (প্রথম পর্ব)



প্রিয়বালা বিশ্বাস।।
২০১৫ সালের বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কমপক্ষে ২৬২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এ সবের অধিকাংশ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার সংখ্যা কমপক্ষে ১৫৬২টি। এ সময়ে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় ২৪জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২৩৯জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৪ জন সংখ্যালঘু নারী যাদের মধ্যে ৯টি ক্ষেত্রে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ রয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৫ জন। তাদের মধ্যে ১০জন গণধর্ষণের শিকার, ২জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৪জন, তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসিড সন্ত্রাসের শিকার ১জন। জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ২০৯টি। এর মধ্যে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে ৬০টি পরিবার। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে ১৮০ টি।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ।



১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত কেস ডকুমেন্টের ভিত্তিতে গত বছর সারাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র এটি। এসব ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতিকারীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবকে ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে বেশকিছু ঘটনার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশে দুষ্কৃতিকারীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায় জানুয়ারি মাসে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা অন্যান্য মাস থেকে বেশি ঘটেছে। ৮৩টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে এ মাসে। এ মাসে আক্রমণের ফলে জখম বা আহত হওয়ার ঘটনাও ছিল সবচেয়ে বেশি। জানুয়ারি মাসে আর সবচেয়ে বেশি যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয় তাহলো ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা, এরূপ ঘটনা ঘটেছে ৫৪টি। এ মাসে যশোরের স্থানীয় একজন ক্ষমতাসীন নেতার অত্যাচারে ৩১টি সংখ্যালঘু পরিবারের দেশত্যাগ এবং অন্য ৫০টি পরিবারও দেশত্যাগের পথে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানুয়ারি মাসে এত বেশি পরিমাণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পিছনের কারণগুলো তাহলে কী?

বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতনে নির্বাচন ইস্যু একটি অন্যতম বিষয়। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ বর্তমান মহাজোট সরকারের বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি। এই নির্বাচনের ফলাফলকে বিরোধিতা করে প্রথম থেকেই বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিল। ৫ জানুয়ারি থেকে তারা লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচি চলাকালে সারাদেশে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। এসময় পেট্রোল বোমার ব্যবহার ছিল অন্যতম একটি আতঙ্কিত বিষয়। তার ঠিক একবছর আগের যদি আমরা তাকাই তবে যে বিষয়টি এখনও আমাদের সামনে দগড়গে ক্ষত হয়ে আছে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই নির্বাচনে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাপাতলার মালোপাড়া সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতনের নারকীয় তাণ্ডব।

একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পরবর্তী সময় যশোরের অভয়নগর ছাড়াও দিনাজপুর সদরের কর্ণাই, সীতাকুণ্ড, বগুড়া, মাগুরা, সাতক্ষীরা ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই তাণ্ডব চালিয়েছিল নির্বাচনের বিরোধীরা। উক্ত নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে গৃহীত সরকার বিরোধী আন্দোলনেও অনুরূপভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এদেশের সংখ্যালঘুরা। এ মাসে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে যার পরিমাণ ৮৩টি।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের আর যে অন্যতম একটি কারণ তা হলো সম্পত্তি দখল ও উচ্ছেদের তৎপরতা। যার শিকার হন সংখ্যালঘু নারী। ধর্ষণের ঘটনার নেপথ্য কারণ হিসেবেও কাজ করে থাকে ভূমি দখলের অভিসন্ধি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন, উচ্ছেদ, সেই লক্ষ্যে সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ পরিলক্ষিত হয় না, রাজনৈতিক পরিচয় ও আদর্শ থেকে বের হয়ে এসে তখন লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল, উৎখাত এবং দেশত্যাগের সর্বাত্মক ব্যবস্থা সম্পন্ন করা। এরূপ উদাহরণ অনেক রয়েছে। যার একটি অন্যতম উদাহরণ গত ১৩ মার্চ, ২০১৫ সংঘটিত বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের চন্দনতলা গ্রামের ঘটনা।

সেখানে স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা একযোগে ১৪টি হিন্দু পরিবারের বসতবাড়িসহ ৪০ একর জমি দখলের তৎপরতায় নেমেছিল। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে নারীদের উপর যৌন হয়রানি চলছিল এমন অভিযোগ রয়েছে। স্কুল পড়ুয়া হিন্দু মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথে উত্যক্তের ঘটনা ছিল নিত্যদিনের। এমনকি এসব স্কুল পড়ুয়া মেয়ে ও গৃহবধূদের নিয়মিত সন্ত্রাসীদের আস্তানায় গিয়ে দেখা করতে হতো এমন অভিযোগও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লোকলজ্জায় এসব ঘটনা তারা কাউকে না জানিয়ে দীর্ঘদিন সহ্য করেছে। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উক্ত এলাকার অনেকগুলো পরিবার পৈত্রিক ভিটা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহের পরিণাম ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী।

এসব ঘটনা নিগ্রহের শিকার ঐ নারীকেই শুধু আতঙ্কগ্রস্ত করে না, তার পিতা-মাতা, আত্মীয় পরিজন, নিজ সমাজÑ সকলের আত্মমর্যাদা ও সম্মানের উপর প্রবলতর গ্লানি ও কালিমা লেপন করেÑ এমনটাই উপলব্ধ, অন্তত আমাদের বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায়। ফলশ্রুতিতে ভুক্তভোগী পরিবারটি একসময় দেশত্যাগে বাধ্য হয়। ভূমিগ্রাসীরা তাই নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ২০১৫ সালে সংখ্যালঘু নারীকে অপহরণ, ধর্ষণ, এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ২৫টি (১০টি গণ-ধর্ষণ ও ২টি ধর্ষণের পর হত্যা), অপহরণ ২৪টি, অপহরণের পর ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ৯টি। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৪জন, তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১জন।

ধর্ষণ

১. গত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের বৃত্তিডাঙ্গা গ্রামে দরিদ্র এক সংখ্যালঘু পরিবারের মা ও মেয়েকে গণধর্ষণের শিকার হন।

২. ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ সাভারের ব্যাংক কলোনী এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন একজন সংখ্যালঘু নারী।

৩. ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাশখালীতে ২য় শ্রেণীতে পড়ুয়া এক আদিবাসী শিশু বাড়ির পাশের দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হয়।

৪. ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আদিবাসী সাওঁতাল তরুণীকে অপহরণ করে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে দুই বখাটে যুবক।

৫. ৩ মে ২০১৫ রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে এক আদিবাসী নারী গণধর্ষণের শিকার হন। এ সময় তার সঙ্গী অন্য এক নারীও লাঞ্ছিত হন।

৬. ১৫ মে ২০১৫ হবিগঞ্জের মাধবপুরের পল্লী রামেশ্বরের শিল্পীরানী দাস (১৮) কে ধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

৭. ২১ মে ২০১৫ বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গণধর্ষণের শিকার হন একজন গারো নারী। রাতে এই ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য উক্ত নারী ও তার স্বজনদের তিন থানায় ঘুরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। তুরাগ থানা কাছে হয় বলে মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়। এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে। শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে। এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয়।

৮. ২৭ মে ২০১৫ সিলেট জেলার বালাগঞ্জে লিপন চন্দ্র দেবের স্ত্রী সঞ্জু রানী দেব ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় পরবর্তীতে হামলার শিকার হয় লিপন চন্দ্র দেব ও তার স্ত্রী সঞ্জু রানী দেব।

৯. ৩ জুন ২০১৫ যশোরের চৌগাছা পৌর এলাকায় এক দলিত গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হন। এ সময় ধর্ষক মোবাইল ফোনে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করে এবং পরে তা সিডি ও ইন্টারনেটে প্রচার করে। এর প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করে উক্ত গৃহবধূ।

১০. ৫ জুন ২০১৫ রাত আনুমানিক ৯টায় সিলেটের বালাগঞ্জের অপর্ণা দাস ঘরের বাইরে টয়লেটে গেলে সেখান থেকে পূর্ব থেকে ওত পেতে থাকা মোঃ হিরণ মিয়া ও মোঃ শফিক আলী তাকে অপহরণ করে শফিক আলীর বাড়িতে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

১১. ৯ জুলাই ২০১৫ উখিয়া উপজেলার কুতুপালং-এ অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন ইতি বড়ুয়া।

১২. ১১ জুলাই ২০১৫ নওগাঁ জেলার ধামইরহাটের গীতা রানী রবিদাসকে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে দেলোয়ার হোসাইন (৪০)।

১৩. ২৯ জুলাই ২০১৫ খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারায় গণধর্ষণের শিকার হয় আদিবাসী তরুণী অঞ্জনা ত্রিপুরা (১৭)।

১৪. ৪ আগস্ট ও ৮ আগস্ট ২০১৫ খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে ২টি শিশু (শ্রাবন্তী বাছাড় (৮) ও (হিরা রায় (৯)) মোঃ সোহরাব গাজী নামে একই ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়।

১৫. ৪ আগস্ট ২০১৫ রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণির আদিবাসী ছাত্রী মিনিতা মারানকে নির্জন কক্ষে একা পেয়ে ধর্ষণ করে মোঃ আল আমীন (২২)।

১৬. ১৮ আগস্ট ২০১৫ বান্দারবানের আদিবাসী তরুণী সুবরন ত্রিপুরা (১৬) চিকিৎসার জন্য লামা হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানে তিনি হাসপাতালের কর্মচারীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন।

১৭. ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত আনুমানিক ১১.৪৫টায় হবিগঞ্জের বানিয়াচং-এ জনৈক সামসুল আলম ঘরের বেড়া ভেঙে জোরপূর্বক ঘরে প্রবেশ করে রুমি রানী দাস নামে ১১ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করে।

১৮. ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ শনিবার রাতে বগুড়ার শিবগঞ্জের ডাবুইর গ্রামে মোফাজ্জল হোসেন জিন্নাহ (৪৫) নামে যুবলীগ কর্মী বুলি রানী নামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক কিশোরীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে।

১৯. ১ নভেম্বর ২০১৫ নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ভাতগ্রাম নিবাসী এক আদিবাসী গৃহবধূ বাজারে ঝাড়– বিক্রি করতে পাশের দক্ষিণখা গ্রামে গেলে উক্ত গ্রামের সাদেকুল ইসলাম জোর করে তাকে বড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।

২০. ১১ নভেম্বর ২০১৫ বুধবার রাত ৯টার দিকে নীলফামারী সদরের সোনারায় ইউনিয়নের বাবুবাজার এলাকায় এক সংখ্যালঘু তরুণী গণধর্ষণের শিকার হন। উক্ত তরুণীর বাড়ি জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে।

২১. ২২ নভেম্বর ২০১৫ নাটোর বাগাতিপাড়ার লোকমানপুর নর্থবেঙ্গল চিনিকলের সুপারভাইজার ভবানী দাস ঘোষালের স্ত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

২২. ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলা মহালছড়ি উপজেলায় মাইসছড়ি ইউনিয়নে পাচ একর (রাবার বাগান) এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় মাইসছড়ি ইউনিয়নের লম্বাছড়া বাসিন্দা বীণা দেবী ত্রিপুরা (১৬)।

২৩. ডিসেম্বর ২০১৫-এ কাপ্তাই সুইডেন পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (বিএসপিআই) সড়কে হাঁটতে বের হলে নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক আদিবাসী কিশোরীকে একটি অটো রিকশায় চারজন লোক তুলে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে বিএসপিআই সড়কের কাছে ফেলে পালিয়ে যায়।

২৪. এছাড়া ১২ অক্টোবর ২০১৫ গাজীপুর শহরের পূবাইল সাপমারা এলাকার সান্ত¡না রবিদাস নামে ৯ বছরের দলিত শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।



অপহরণ

১. ২১ জানুয়ারি ২০১৫ অপহৃত হয় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বাউরবাগ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী জোৎস্না বিশ্বাস।

২. ৪ মার্চ ২০১৫ নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার রায়মাধম গ্রামের শিল্পী রানী দাসকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একই গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দোস্ত মোহাম্মদ খান অপহরণ করে।

৩. ১৪ মার্চ ২০১৫, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার লেমুয়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী কনা রানী ব্যাপারীকে অপহরণ করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বিবাহের কাগজপত্র তৈরিসহ যৌন-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

৪. ১৭ এপ্রিল ২০১৫ মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার তারাপাশা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী শ্যামলী রাণী দে (১৫) অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর তার জাল জন্ম-নিবন্ধন সনদপত্র তৈরি করে পূর্বের নাম গোপন করে নতুন নাম দিয়ে গত ১৯ এপ্রিল নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।

৫. গত ২৭ মে ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় কিশোরগঞ্জের বিন্নাটি মজিদ মোল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী পিংকি রানী সূত্রধর।

৬. ৫ জুন ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় সিলেটের বালাগঞ্জের দেঘরিয়া গ্রামের অপর্না দাস। পরে তাকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য অপহরণকারী ও তাদের পরিবার তৎপরতা চালায়।

৭. ১৪ জুন ২০১৫ গোয়াইনঘাট ডিগ্রি কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী সোমা রানী দাসকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।

৮. ২৫ জুন ২০১৫, গাজীপুর জেলার বাগের বাজার হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অন্তরা রানী দেবনাথকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে অপহরণকারী ও তার পরিবার অন্তরা রানীকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং অপহরণকারীর সাথে বিবাহের জন্য তৎপরতা চালায়।

৯. ১৩ জুলাই ২০১৫ খুলনার ডুমুরিয়ার সাহাপুর মধ্যমগ্রাম ডিগ্রি কলেজে ছাত্রী প্রিয়া সাহাকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা

১০. ৯ জুলাই ২০১৫ কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার কুতুপালং নিবাসী ইতি বড়ুয়া অপহরণের শিকার হন।

১১. ৩০ জুলাই ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় নারায়ণগঞ্জের আদমজী কলেজের ছাত্রী বৃষ্টি বিশ্বাস।

১২. ৩ আগস্ট ২০১৫ নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সুস্মিতা সিংহ অপহরণের শিকার হয়। এই ঘটনায় অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ রয়েছে।

১৩. ২০ জুলাই ২০১৫ ভাষানটেক দেওয়ানপাড়া এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় রূপা সরকার। পরে অপহরণকারী ও তার পিতামাতা রূপাকে জোরপূর্বক এফিডেভিটের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। এরপর রূপা সরকারের পরিবার প্রশাসনের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয় এবং রূপা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ধর্মান্তরের ঘটনা প্রত্যাখ্যান করে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই গত ২৪ আগস্ট ২০১৫ পুনরায় উক্ত অপহরণকারী আবারও তাকে অপহরণ করে।

১৪. ২৮ আগস্ট ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় চট্টগ্রাম হালিশহর গরিবে নেওয়াজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী রিংকি রানী দেবনাথ।

১৫. ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় সিলেট নাসিরাবাদ বিলপাড় নিবাসী দশমী রানী দেবনাথ (১৪)।

১৬. ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ চট্টগ্রাম হাটহাজারী সদর নিবাসী রাত্রি দাসকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।

১৭. ৮ অক্টোবর ২০১৫ কিশোরগঞ্জে পাকুন্দিয়া হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুপ্রিয়া রানী রায় অপহরণের শিকার হয়। ১০ অক্টোবর ২০১৫ তাকে জোরপূর্বক কোর্ট এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে দুর্বৃত্তরা।

১৮. ২০ অক্টোবর ২০১৫ গাইবান্ধা থেকে অপহৃত হয় ধাপের হাট প্রিয়বালা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বপ্না রানী। গত ১৩ নভেম্বর ২০১৫ কুমিল্লা থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

১৯. ৩১ অক্টোবর ২০১৫ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ইছাকুড়ি বাকাই নিরাঞ্জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অষ্টমী রানী বালা।

২০. ৯ নভেম্বর ২০১৫ সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার জয়শ্রী গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী মন্টি রানী সরকারকে (১৬) অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে ধর্মান্তরিত করে বিবাহে বাধ্য করার অভিযোগ করে অপহৃতার পরিবার।

২১. ১৬ নভেম্বর ২০১৫ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পরিকোরা গ্রামের অরি চক্রবর্তীকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। অপহরণের পর অপহরণকারীরা প্রচার করতে থাকে যে মেয়েটি সেচ্ছায় নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়েছে এবং বিয়ে করেছে। অপহৃতার গরিব পিতা আনোয়ারা থানায় মামলা করতে গেলে থানার ওসি মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানালে মেয়েটির পিতা চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।

২২. ২৬ নভেম্বর ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় টাঙ্গাইল ধনবাড়ি কলেজের ছাত্রী উপমা সাহা।

২৩. ২৯ নভেম্বর ২০১৫ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর সরিফুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রী হিরামনি অপহরণের শিকার হয়। পরে তাকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও বিবাহের তৎপরতা চালায় অপরণকারী ও তার সহযোগীরা।

২৪. ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ অপহরণের শিকার হয় নোয়াখালী সৈকত ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী সুমি রানী মজুমদার। গত ৯ জানুয়ারি ২০১৬ সুমির পরিবার নোয়াখালী প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুমিকে উদ্ধার ও অপহরণকারীদের শাস্তি দাবি করে।

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা একটি অবধারিত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় প্রতিবছর বাংলাদেশে পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৫ সালে রাজধানীতে ২২৫টি সহ সারা দেশে মোট ২৮ হাজার ৯৬২টি পূজা মণ্ডপে শারদীয়া দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের তুলনায় এর সংখ্যা বেড়েছে ২৬২টি। ২০১৪ সালে সারাদেশে ২৮ হাজার ৭০০টি, ২০১৩ সালে ২৮ হাজার ২০০টি, ২০১২ সালে ২৭ হাজার ৮শ’টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে প্রতিবছর পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বাড়লেও ভক্ত বা পূজারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কমে যাচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী। আপাতদৃষ্টিতে তাই প্রতিবছর পূজামণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার কোনো কারণ নেই।

আমাদের সংবিধান দেশের সকল নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বীকৃতি দিলেও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে পারে নি। ফলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উপর উপর্যুপরি এই হামলার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক যে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ঘোষণা কিংবা তা কার্যকরের সময়েও হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। বিগত ৪৪ বছর ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে নি, বরং তা প্রায় প্রতি বছরই থেকেছে উদ্বেগজনক। প্রতিবছর সার্বজনীন শারদীয়া দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরেরও মহোৎসব শুরু হয়। যা পুরো শারদীয়া দুর্গা উৎসবের যেন এক চিরায়ত কলঙ্কময় অধ্যায়। স্বাধীনতার পর এতোগুলো বছর অতিক্রান্ত হলেও এই কলঙ্ক থেকে এখনো মুক্ত হতে পারে নি অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণের বাংলাদেশ। প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে উল্লেখযোগ্য হারে ঘটে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। ২০১৫ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এসময় দুর্গাপূজা, লক্ষ্মী পূজা কালী পূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেকারণে প্রতিমা ভাঙচুর সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাও এসময় বেশি ঘটে থাকে। ২০১৫ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ৩৬টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

পূজার মৌসুম ছাড়াও প্রায় সারা বছরই প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু ডিসেম্বরে কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুরের তথ্য উল্লেখ করতে চাই যে মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো পূজার মহোৎসব ছিল না। ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২১টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।



১. ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পৌরসভার শহরগাছী এলাকায় চন্দনা পাহাড়ী (৩২) নামের এক আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কাজিরবন কালী মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।

২. ৫ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার পর্যটন কেন্দ্র দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তজিউর মন্দির প্রাঙ্গণে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলে দুর্বৃত্তের ছোড়া হাতবোমা বিস্ফোরণে আহত হন ৯জন।

৩. ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবরশাহ থানাধীন নিউ শহীদ লেন এলাকায় শ্রীশ্রীশ্যামাকালী বাড়ির মন্দিরে দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায়। এ সময় মন্দিরের আসবাবপত্র ও অন্য জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়। এতে ৬ জন আহত হয়।

৪. ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার ডাবোর ইউনিয়নের জয়নন্দ ডহচি গ্রামে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) মন্দিরে গুলি ও বোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। রাত সোয়া ৮টার দিকে মন্দিরে কীর্তন ও ধর্মসভা চলার সময় ওই হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধসহ চারজন আহত হয়।

৫. ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়রা গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রকাশ্যে শিব মন্দিরে হামলা ও ৩টি প্রতিমা ভাঙচুর করে স্থানীয় প্রভাবশালী কলিমুদ্দিন গং। হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানোর কারণে অনেকেই তাদের জমি ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছেন।

৬. ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার জহরেরকান্দি গ্রামের উত্তর পাড়া সার্বজনীন মনসা মন্দিরে মনসা মূর্তি ও একই গ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনের রাধা গোবিন্দ মন্দিরের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

৭. ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার রাতে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা বাজারের শত বছরের পুরোনো সার্বজনীন কালীমন্দিরের ৭টি প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।

৮. ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ রোববার সকালে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় বাউসী বাঙ্গালীপাড়া পদ্মা পূজা মন্দিরের পদ্মা প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।

৯. ২১ ডিসেম্বর ২০১৫ সোমবার রাতে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের মহেষপুর গোপপাড়া গ্রামে সার্বজনীন কালীমন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে শীতলা মূর্তি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।

১০. ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রামের রৌমারীতে উপজেলার নমদাসপাড়া গ্রামে মন্দিরের কালী, লক্ষ্মী ও শিবের মূর্তি ভাঙচুর করে।

১১.২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ শনিবার রাতে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মির্জাবাড়ি বাজারের কাছে দড়িহাসিল এলাকার মাখন লাল গোপ ও সুবল চন্দ্র গোপের বাড়ির দুটি পারিবারিক কালী মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার ঘটনা বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য একটি উদ্বেগজনক বার্তা। এদেশের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের পেছনের অন্যতম একটি কারণ এটি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশ ত্যাগ করে থাকেন। তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে ব্যবসা, বাড়িঘর, সম্পত্তি লুটপাট, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও মামলার হুমকিসহ হত্যার হুমকির ঘটনা ঘটে থাকে, তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। যে কারণে নিরাপত্তাহীন অসহায় পরিবারগুলো বাপ-দাদাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্মভিটা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, রাষ্ট্র এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে কখনও দেখছে না। বরং কখনও কখনও রাষ্ট্রের মন্ত্রী, সাংসদ, জনপ্রতিনিধি বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় এই হামলার খবর প্রকাশিত হলেও কোনোটির আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি বরং হয়রানির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দল যখনই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে তাদের যেন এই জায়গাটিতে একটি দৃশ্যমান মিল পরিলক্ষিত হয়। একদিকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে এই সব হামলা ও নির্যাতনের বিচার হচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বিচারহীনতা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। সরকারদলীয় কেউ এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে সেক্ষেত্রে বিচারের প্রত্যাশা আরও ক্ষীণ। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।

২৮ অক্টোবর ২০১৫ বুধবার রাতে চাঁদা না দেওয়ার ‘অপরাধে’ ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারা জেলেপাড়ায় হামলা চালায় আওয়ামী লীগ দলীয় ক্যাডাররা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ ও পেটের সন্তান। তার পেটে উপর্যুপরি লাথির চোটে ঘটনাস্থলেই মৃত বাচ্চা প্রসব করেন তিনি। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে যায় শিশুটির। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও মারধরে গুরুতর আহত গৃহবধূ তুলসী রানী দাসকে আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরও ২০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- আলোরানী দাস, জহরলাল দাস, শোভারানী দাস, বিকাশ, শুকদেব দাস ও পরিমল দাস। প্রায় ২২-২৫ জনের হামলাকারী দলটি জেলেপাড়ার ঘরবাড়িগুলোতে আচমকা ভাংচুর ও লুটপাট শুরু করে। প্রতিবন্ধী স্বপন দাসের দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায় তারা।

এ সময় তাদের ঠেকাতে পাড়ার লোকজন এগিয়ে এলে ক্যাডাররা নিরীহ সংখ্যালঘুদের মারধর শুরু করে। হামলাকারীদের হাত থেকে আহত রবীন্দ্রদাসকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন তার ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তুলসী রানী দাস। এ সময় হামলাকারীরা তুলসীর তলপেট ও কোমরে উপর্যুপরি লাথি মারে। লাঠি দিয়েও তাকে মারধর করে। মুহূর্তেই রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি। পরদিন সকালে আহত তুলসীকে ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে প্রায় অর্ধশত পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে নৌকায় ছোট ফেনী নদীতে আশ্রয় নেন। পরে রাত সাড়ে ৯টায় পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে জেলে পরিবারগুলো নদী থেকে বাড়ি ফিরে আসে। আর আহতরা রাতে পুলিশের সহযোগিতায় ফেনী সদর হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন। এই ঘটনার কোনো বিচার এখনও হয় নি।

সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নিপীড়নের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসীরা। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। চাঁদা না পেয়ে ৯ ডিসেম্বর ২০১৫, বুধবার মধ্যরাতে ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়ার পালপাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এতে আহত হয় ৮ জন। ধলিয়া ইউনিয়নের বালুয়া চৌমুহনীর পালপাড়া গ্রামের গোপাল পালের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছিল এসকল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। ৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ৭-৮ জন সহযোগী নিয়ে গোপাল পালের বাড়িতে হামলা করে এবং দেশীয় বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকি দেয়।

বাড়ির লোকেরা বাধা দিলে উক্ত ছাত্রলীগ নেতার পিতা স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি তার সহযোগীদের নিয়ে দেশীয় বন্দুক, কিরিচ ও রামদা নিয়ে তাদের ওপর আরেক দফা হামলা করে। বিমল পাল ও গোপালসহ ৮জন আহত হয়। ৯ ডিসেম্বর বুধবার বিকেলে ফেনী মডেল থানায় মামলা করা হলে সন্ত্রাসীরা বুধবার মধ্যরাতে আবারও সশস্ত্র অবস্থায় হাজির হয়ে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দেয়। এ সময় তারা বাড়ির আঙিনায় ৪টি খড়ের গাদায় আগুন দেয়। এরপর আতঙ্কে পালাপাড়ার কয়েকটি বাড়ির লোকজন পালিয়ে যায়।

চলবে... (দ্বিতীয় পর্ব)

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ



এইবেলা/প্র.চ/এমআর
Share:

১৬ মার্চ ২০১৬

এক অজানা কাহিনী বৌদ্ধ মন্দিরের ২ কিলোমিটার দেওয়াল জুড়ে রয়েছে মহাভারতের কাহিনী

মন্দিরের ২ কিমি দেওয়াল জুড়ে রামায়ণ! বৌদ্ধমন্দিরের দেওয়ালে আঁকা রামায়ণের দৃশ্য। থাইল্যান্ডের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত এমারেল্ড বৌদ্ধমন্দিরে গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।

মন্দিরের প্রায় ২ কিলোমিটার দেওয়ালজুড়ে আঁকা রয়েছে হিন্দু দেবদেবীর বীরত্বের কাহিনি। ব্যাঙ্ককের প্রাণকেন্দ্রে রয়্যাল প্যালেসের কাছেই অবস্থিত এমারেল্ড বৌদ্ধ মন্দির।

সেদেশের ভাষায় যা ওয়াট ফ্রা ক্রিউ নামে পরিচিত। বিরাট মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে ১০০টিরও বেশি বহুতল। আর মন্দিরে যে বিশাল বৌদ্ধমূর্তিটি রয়েছে, তাকেই দেশের রক্ষাকবচ হিসেবে বিশ্বাস করেন সে দেশের মানুষ।
 




কমপ্লেক্সটি একটা বিশাল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ২ কিলোমিটারের সেই দেওয়ালেই আঁকা রয়েছে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনার দৃশ্য। শুধু ছবিই নয়, প্রত্যেক ছবির নীচে রয়েছে সেই ছবির বর্ণনা।

রামায়ণের থাই ভার্সান রামাকিয়েণের নায়ক ফ্রা রামা ( দেবতা রাম) - র বীরকাহিনি লেখা রয়েছে ১৭৮টি প্যানেলে। মন্দিরটি বহু প্রাচীন হলেও , এই আঁকাগুলিকে তরতাজা রাখতে কয়েক বছর অন্তর অন্তর তাতে পড়ে তুলির ছোঁয়া। শেষবার এই ছবিতে শিল্পীর হাত পড়েছে ২০০৪ সালে।




রামাকিয়েণে গঠনগত দিকে বাল্মীকির গল্পই মোটের উপর অপরিবর্তিত। তবে কিছু চরিত্র ও ঘটনায় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

 থাইল্যান্ডের শাসক ও অধিকাংশ নাগরিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও , অষ্টদশ শতাব্দীর রামাকিয়েণই সেখানে জাতীয় মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত।

Share:

১৩ মার্চ ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিপর্ব- পর্ব ১৮ )

রাক্ষসদের এমন অত্যাচারে গোটা ভারতই আক্রান্ত হচ্ছিল্ল। রাক্ষসদের হাতে নিপীড়িত হতে হতে মুনি, ঋষি আদি মানব সকল ভগবান বিষ্ণুকে ডাকতে লাগলেন । এমনকি দেবতারা মিলে বৈকুণ্ঠে গমন করে ভগবান শ্রী বিষ্ণুকে সকল বৃন্তান্ত জানালেন । তারা বললেন- “রাক্ষস বাহিনীর মাত্রাছাড়া তাণ্ডবে ধর্ম কর্ম বিনষ্ট হতে বসেছে। অনার্য রাক্ষস সংস্কৃতিতে লুপ্ত হতে বসেছে বৈদিক শাস্ত্র জ্ঞান। মুনি ঋষিরা যজ্ঞাদি করে দেবতাদের হব্য প্রদান করতে অসমর্থ হচ্ছেন । ধর্ম নষ্ট হয়ে অধর্মের প্রভাব সর্বত্র দেখা দিচ্ছে । যে জগদীশ আপনি কৃপা বশত পুনঃ আবির্ভূত হন । পূর্বে আপনি মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম অবতার গ্রহণ করে আসুরিক শক্তির নাশ করেছেন, পুনঃ আপনি দানবিক শক্তির সংহার করুন । ” এইভাবে দেবতারা সকলে কাকুতি মিনতি জানালেন। ভগবান মহেশ্বর বললেন- “হে নারায়ণ। আমার অবতার হনুমান মর্তে আবির্ভূত হয়েছে। এবার আপনি মর্তে অবতার গ্রহণ করুন। আপনি সৃষ্টি পালন করেন। এই কারনে আপনি অবতার গ্রহণ করেন, আগামীতেও করবেন। হে লক্ষ্মীনাথ ত্রিবিক্রম, আপনি রাক্ষস বিনাশের জন্য আবির্ভূত হন। রাবণ আপনার হাতেই বধ্য। ” বসুমতী দেবী বললেন- “হে জনার্দন । আমি সর্বংসহা বসুমতী। কিন্তু রাবণের পাপের বোঝা আমি গ্রহণে অসমর্থ । সে স্বয়ং দেবী লক্ষ্মীর অবতার বেদবতীকে অসম্মান করেছে। এই মহাপাপীর বিনাশ না হলে ধরিত্রী ধ্বংস হবে।”

সকলের প্রার্থনা শুনে ভগবান বিষ্ণু অভয় দিয়ে তাঁর অবতারের কথা ঘোষোনা করে দিলেন । বললেন- “আপনারা চিন্তিত হবেন না । আমি ইক্ষাকু বংশে অযোধ্যার সম্রাট দশরথের নন্দন রূপে কৌশল্যা দেবীর গর্ভে আবির্ভূত হব। ধর্ম রক্ষা করে দুষ্ট রাক্ষস দিগকে বধ করবো। ধর্ম সংস্থাপন করে অধর্মের বিনাশ করবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন । ভগবান বিষ্ণু বললেন- “এই অবতারে দেবী লক্ষ্মীও অবতার গ্রহণ করে রাবণের বিনাশের হেতু হবেন ।” দেবী লক্ষ্মী বলিলেন- “বসুমতী ধরিত্রীর কন্যা রূপে আবির্ভূত হয়ে আমি মিথিলা রাজ জনক ও তাঁর পত্নী সুনয়নার গৃহে প্রতিপালিত হবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন । ব্রহ্মা তখন মহর্ষি বিশ্বশ্রবা কে স্বপ্নে জানালেন- “বিশ্বশ্রবা তুমি তোমার পুত্র দশাননকে সংযত হতে বল। ভগবান হরি মর্তে আবির্ভূত হচ্ছেন তাঁর বিনাশ করবার জন্য। সে এরূপ অধর্ম আশ্রয় করে থাকলে সে ধ্বংস হবেই, তাঁর কূলেও কেউ রক্ষা পাবে না।” বিশ্বশ্রবা রাবণকে অনেক বোঝালো, রাবণ সংযত হলই না। উলটে আস্ফালন করে বলল- “যদি বিষ্ণু আমাকে বধ করতে আবির্ভূত হয়, তবে আমি বিষ্ণু বধ করবো। কিন্তু বিষ্ণুর ভয়ে আমি ভীত হবো না। ”

এখানে সবাই প্রশ্ন করতে পারেন যে ভগবান বিষ্ণু ইচ্ছা করলেই গরুড়ে আসীন হয়েই লঙ্কা আক্রমণ করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। এতটাও দরকার হত না , তিনি বৈকুণ্ঠ থেকেই সুদর্শন চালনা করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মর্তে আবির্ভূত কেন হবেন ? এটা ছেড়েও বলা যায়, দেবী লক্ষ্মীর অংশ বেদবতী নিজে যজ্ঞে ঝাঁপ না দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন । কিংবা রুদ্রাবতার হনুমান রাবণকে বধ করতে পারতেন, কিংবা দেবী পার্বতীকে লঙ্কায় নিয়ে যাবার কালে দেবী শাপ দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন বা রাবণ যেদিন কৈলাস আক্রমণ করেছিলো সেদিনই ভগবান শিব তার বধ করতে পারতেন । কিন্তু এঁনারা এমন করলেন না। ভগবান শ্রীহরি কেন মর্তে অবতার নিতে চলেছেন ? এর কারন রূপে কেউ কেউ জয়- বিজয়ের প্রতি সনকাদি মুনিদের অভিসম্পাত , নন্দীর দেওয়া নর বানরের হাতে ধ্বংসের শাপ বা ব্রহ্মার প্রদত্ত নর বানরের হাতে বিনাশের বর প্রদান, বেদবতীর প্রদত্ত অভিশাপ বা রম্ভার অভিশাপকে মুখ্য হেতু মনে করতে পারতেন। যে ভগবান তাই মানব অবতার নিয়েছেন । হ্যা এইগুলো ঠিক । কিন্তু ভগবানের অবতারের দুটি উদ্দেশ্য – অসাধু বিনাশ ও জীবশিক্ষা প্রদান সাথে ভক্ত সঙ্গ । আমরা জানি ভগবান লাভ আমাদের কাছে মূল উদ্দেশ্য । হ্যা ঠিক, যে হরি ভক্ত সে হরিকে, যে শিব ভক্ত সে শিবকে যে দুর্গা ভক্ত সে দুর্গাদেবীর কৃপা প্রাপ্তির জন্যই অচলা ভক্তির পথে চলেন । কিন্তু আমরা কি জানি যে আমরা ভগবান প্রাপ্তির জন্য যতটা ব্যাকুল, ভগবান নিজে শুদ্ধভক্তের সঙ্গ প্রাপ্তির জন্য তাঁর অধিক ব্যাকুল। তিনি শুদ্ধ ভক্ত খুঁজে বেড়ান। তাই ভক্তের জীবনে এত কষ্ট, এই কষ্ট ঈশ্বরের পরীক্ষা। তিনি পরীক্ষা করেন ভক্ত কতটা আঘাত সহ্য করে আমাকে ডাকে, তবেই না সে শুদ্ধভক্ত। ভগবান তখন সেই ভক্তের দাসানুদাস হন। ভগবান বলেন- “যে করে আমার আশ, করি তার সর্বনাশ। যদি না ছাড়ে পাশ, হই তার দাসের অনুদাস।” ভগবান রামের জীবনে আমরা এমন ভক্তের পরিচয় পাবো। তাই তো বলা হয় ভগবানের চেয়ে ভক্ত বড়। ভগবান এমন ভক্তকেই খোঁজেন, এটি তাঁর অবতারের আর একটি উদ্দেশ্য ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড – ১৭ )

অগস্ত্য মুনির নাম সকলেই শুনেছেন । এই মুনির তপঃ শক্তি ছিলো আশ্চর্য রকম। ব্রহ্মার আরাধনা করে অগস্ত্য মুনি অনেক অলৌকিক দিব্যশক্তি পেয়েছিলেন । একবার উনি সমুদ্রের জল এক গণ্ডূষে পান করেছিলেন বলে পুরাণ শাস্ত্রে লেখা । তিনিই নিজ স্ত্রীরূপে যজ্ঞ থেকে লোপামুদ্রা দেবীকে উৎপন্ন করেন । ব্রহ্মার কৃপা পেয়েও নির্লোভী এই মুনি শাস্ত্র নিয়ম মেনে অরণ্যে কুটিরে থাকতেন । এদের সাথে আজকালকার গুরুদেবের অনেক তফাৎ। আজকালকার যুগে বাজার চলতি করে খাওয়া এক ধরণের গুরুর আবির্ভাব হয়েছে । সামান্য ১০-২০ টা শিষ্য হলেই ধরা কে সরা জ্ঞান করে শিষ্যের টাকায় শ্বেতপাথরের দালান কোঠা নির্মাণ করে মহাভোগে জীবন কাটান । যাই হোক । যক্ষ সুকেতুর কন্যা তাড়কার বিবাহ হয়েছিলো যক্ষ শুণ্ডের সাথে । একদিন গর্ভস্থ অবস্থায় তাড়কা অগ্যস্ত মুনির আশ্রমে আসেন । তাড়কা বলেন- “মহর্ষি আমার জন্য অপূর্ব সুন্দর রাজমহল নির্মাণ করে দিন। শুনেছি আপনি দেবতাদের বরে অনেক চমৎকার ঘটাতে সমর্থ । সেই রাজমহল হবে দ্বিতীয় অমরাবতী । স্বর্গের দেবতারা এই মহল দেখে হিংসায় জ্বলে মরবে।” অগস্ত্য মুনি মানা করে দিলেন। জানালে ঐ সব দাবী তিনি মানবেন না। এসমস্ত কর্মে তিনি যোগশক্তির ব্যবহার করবেন না ।

তাড়কা অনেক আকুতি মিনতি করল । অগস্ত্য মুনি কিছুতেই সম্মত হলেন না । তাড়কা রেগে তখন মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করলেন । আশ্রম তছনছ করে মুনিকে শাসাতে লাগলেন । প্রথমে মুনি চুপ থাকলেও শেষে ক্রোধে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “দুর্মতি নারী। তুই আমার আশ্রম উন্মত্ত রাক্ষসের ন্যায় ধ্বংস করেছিস । তুই তোর গর্ভস্থ সন্তান সহ রাক্ষস হবি। ভগবান হরির হস্তে নিধন হলেই তোদের মুক্তি ঘটবে । ” মুনির শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলল । তাড়কা রাক্ষসী হয়ে তপবনে বেড়াতে লাগলো। রাক্ষসী হবার পর তাড়কার প্রথম আঘাত গিয়ে পড়লো অগস্ত্য মুনির আশ্রমে। মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করে মুনির শিষ্যদের চিবিয়ে ভক্ষণ করল । কৃত্তিবাসী রামায়নে বারংবার লেখা – রাবনের রাক্ষস বাহিনী ও রাক্ষসেরা নর মাংস আহার করতো। মনে হয় আমরা যে “ঠাকুমার ঝুলি” তে রাক্ষসের গল্প পড়েছি সেখানে নর মাংস ভক্ষণের কথা এই রামায়ন থেকেই এসেছে । তাড়কার তাণ্ডবে অগস্ত্য মুনির আশ্রম শ্মশানে পরিণত হোলো। মুনি যজ্ঞ করতে আরম্ভ করলেই রাক্ষসেরা ধেয়ে এসে যজ্ঞে রক্ত, অস্থি, মাংস, চর্বি নিক্ষেপ করতো । এইভাবে যজ্ঞ অপবিত্র করতো । মুনি অগস্ত্য শেষে তাঁর আশ্রম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন । এরপর তাড়কার নেতৃত্বে তার পুত্র মারীচ, সুবাহু নামক এক রাক্ষস ও অনান্য রাক্ষসরা ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক দুটি জনপদে হানা দিতে থাকে । রাক্ষসেরা সেখানে মানুষদের হত্যা করে রক্ত মাংস আহার করতে থাকে । রাক্ষসদের উৎপাত ভয়ানক আকার নেয় । মতঙ্গ মুনির আশ্রমেও তাণ্ডব চলে। মহর্ষি তখন আক্ষেপ করেন যে তিনি কেন বালিকে শাপ দিলেন । এই অবস্থায় বালি এখানে এসে রাক্ষস বধ করতে পারবে না ।

রাবণ এই সংবাদ শুনে খুবুই আহ্লাদিত হয়। অপরদিকে পঞ্চবটিতে রাবণের ভ্রাতা খর ও দূষনের নেতৃত্বে রাক্ষসদের তাণ্ডব আরম্ভ হয় । বালির ভয়ে তারা কিস্কিন্ধ্যাতে না গেলেও আশেপাশে তাণ্ডব শুরু করে। সুদূঢ হিমালয়েও রাক্ষস দের অত্যাচার আরম্ভ হয় কালনেমির মাধ্যমে । ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক রাজ্য ক্রমশঃ রাক্ষসদের আহার হতে লাগলে সেখানকার বেঁচে থাকা লোকেরা কিছু অযোধ্যায়, কিছু কিস্কিন্ধ্যায় আশ্রয় নেয়। পরিত্যক্ত নগরী ধীরে ধীরে জঙ্গল হয় । বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রম রেহাই পায় নি । এমনকি একবার নারদ মুনিকেউ আহার করতে গিয়েছিলো তাড়কার বাহিনী রাক্ষসেরা । নারদ মুনি পালিয়ে মহর্ষি দুর্বাসার আশ্রমে যান। দুর্বাসা মুনি অভিশাপ দিয়ে রাক্ষসদের ভস্ম করেন । বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রমে রাক্ষসদের তাণ্ডব হতে থাকে । গৌতম মুনির পরিত্যক্ত আশ্রমে কাউকে না পেয়ে রাক্ষসেরা বিশ্বামিত্রের আশ্রমে হানা দেয় । বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রোজ তাণ্ডব হোতো। বিশ্বামিত্রের যজ্ঞাদি পণ্ড হত । দেবতাদের সাহায্য চাইলে দেবতারা রাবণের ভয়ে রাক্ষস বধ করতে রাজী ছিলো না । বিশ্বামিত্রের আশ্রমে নারদ মুনি একদা পদার্পণ করলে বিশ্বামিত্র মুনি এর প্রতিকারের কথা জানতে চান । নারদ মুনি বলেন- “এই রাক্ষস দের ধ্বংসকর্তারা বানর রূপে জন্ম নিয়েছে। আর এই রাক্ষসদের ধ্বংস কেবল ভগবান শ্রীহরিই করতে পারবেন । আপনারা সকলে মিলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন।” অপরদিকে রক্তমালা নামক এক রাক্ষসীর হাতে আক্রান্ত হয়ে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর সাহায্য চাইলো । রক্তমালার ঔদ্ধত্য , তাড়কাকেউ ছাড়িয়ে গেছিলো। ভগবান বিষ্ণু একদা ছদ্দবেশে রক্তমালার হাতে আক্রান্ত তপবনে আসলেন ছদ্দবেশে। মুনির ছদ্দবেশে হরিকে দেখে রাক্ষসী রক্তমালা তাকে ভক্ষণ করতে আসলো। ভগবান নারায়ণ তখন সুদর্শন চক্রে রক্তমালার বধ করলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড ১৬ )

রাবণের সাথে একবার কিস্কিন্ধ্যার সম্রাট বালির যুদ্ধ হয়েছিলো। বালিকে ইন্দ্রদেবতা বর দিয়েছিল যে- যুদ্ধে শত্রু যখন বালির চোখে তাকাবে তখন শত্রুর অর্ধেক শক্তি বালির দেহে আসবে। আর অনায়েসে সেই শত্রু পরাজিত হবে । রাবণ একদা বালির রাজ্য আক্রমণ করে । কারন সেই সময় পরাক্রমী বালির নাম সুদূর লঙ্কাতে পৌছেছিলো। রাবণের বালির আস্ফালন সহ্য হচ্ছিল্ল না । একদিন রাবণ বালির রাজ্য আক্রমণ করলো। বানরদের সাথে রাক্ষসদের যুদ্ধ বাঁধলো। বালির হাতে অল্প সময়ে রাক্ষস কূল বিপর্যস্ত হল । রাবণের সাথে বালির যুদ্ধ হল। রাবণ পরাজিত হল, সেই সময় সূর্যাস্ত প্রায়। বালি সন্ধ্যাবন্দনা আদি কর্ম করবেন। বালি লেজে পেঁচিয়ে রাবণকে সাতবার জলে ডুবালো আর সাতবার তুলল । রাবণ প্রায় অর্ধমৃত দশা । রাবণের শোচনীয় অবস্থা দেখে দেবতারা প্রসন্ন হয়ে বালিকে আশীর্বাদ করতে লাগলো । এই অবস্থায় রাবণ, বালির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলল- “আমাকে প্রাণদান করুন কিস্কিন্ধ্যা নরেশ । আমি আপনার রাজ্য আর কদাপি আক্রমণ করবো না। আপনার সাথে আমি মিত্রতা করতে ইচ্ছুক।” বালি রাবণের মিত্রতা স্বীকার করে রাবণকে ছেড়ে দিলো। সেই থেকে রাবণের মনে ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে লাগলো যে কিভাবে বালির সর্বনাশ করা যায় ।

রাবণ তার মন্ত্রীদের সাথে শলাপরামর্শ করলো । রাক্ষসেরা বুদ্ধি দিল- এমন বুদ্ধি করতে যাতে বালি আর সুগ্রীবের ভাতৃত্ব বন্ধন নষ্ট হয়। এভাবে বালি শক্তিহীন হলে তাকে ধ্বংস করা সহজ হবে । রাবণের প্রেরিত কিছু বলশালী রাক্ষস বালির রাজ্যে এসে উপদ্রব শুরু করলো। মুনি ঋষিদের ধার্মিক কাজে বাধা দিলে তারা গিয়ে বালিকে নালিশ জানালো । বালি সেই সব বলশালী রাক্ষসদের বধ করে মুনি ঋষিদের অভয় দিয়ে বললেন- “আপনারা শান্তিতে ধার্মিক ক্রিয়াকলাপ করতে পারবেন। যদি কোন রাক্ষস বাধা উৎপত্তি করে তবে তাকে বধ করব।” অপরদিকে রাব তখন দুন্দুভি আর মায়াবি নামক দুই রাক্ষসকে বালির পেছনে লেলিয়ে দেয় । দুই রাক্ষস এসে কিস্কিন্ধ্যায় মহাউপদ্রব সৃষ্টি করে। বালি গদা নিয়ে আসে । প্রথমে মায়াবি নামক রাক্ষস বালির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় । যুদ্ধে হেরে মায়াবি পলায়ন করে । দুন্দুভি রাক্ষস প্রবল যুদ্ধ শুরু করে। পর্বত চূড়া সম উচ্চ উচ্চ প্রস্তর বিশাল বৃক্ষ তুলে বালির পানে নিক্ষেপ করতে থাকলে বালি সেগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলে নিজ গদা দ্বারা । অবশেষে দুন্দুভি শিং উচিয়ে তেঁরে আসে । বালির সাথে যুদ্ধ বাঁধে । বালি দুন্দুভিকে তুলে একটি পর্বতে আছাড় মারে। সেই আছাড়ে দুন্দুভির মস্তক চূর্ণ হয়। এরপর বালি দুন্দুভির মৃতদেহ ঋষমূক পর্বতে ছুড়ে ফেলেন । সেই পর্বতে মহর্ষি মতঙ্গ মুনির আশ্রম ছিলো । মহর্ষি যখন যজ্ঞ করছিলেন তখন তার আশ্রমে দুন্দুভির মৃতদেহ এসে পড়ে। মতঙ্গ মুনি অভিশাপ প্রদান করেন- “বালি তুমি আমার আশ্রম অপবিত্র করেছ । তোমাকে শাপ দিচ্ছি ভবিষ্যতে যদি তুমি ঋষমূক পর্বতের সীমানাতেও যদি চরণ রাখো, সেই মুহূর্তে তুমি ভস্মীভূত হবে।”

বালি এই অভিশাপের কথা জানতো। জীবনে সে আর ঋষমূক পর্বতে আসবার সাহস করেনি । রাবন একবার যমালয় আক্রমণ করেছিলো । দুজনের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ চলছিলো । একদিকে রাবণ অপরদিকে যমরাজ । যমরাজ ও রাবণ উভয়েই ছিলো বীর । এই যুদ্ধের কথা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে পৌছালো । ব্রহ্মার বরে রাবণ যমের হাতে বধ্য ছিলো না। কিন্তু সাক্ষাৎ মৃত্যুর দেবতা যমের সাথে লড়াই । এই ক্ষেত্রে কিছু একটা হতে পারে । যমালয় আক্রমণের বুদ্ধি নারদ মুনি, রাবণকে দিয়েছিলেন। নারদ মুনি বলেছিলেন- “রাবণ তোমার রাক্ষসেরা মরে নরকে গিয়ে যমালয়ে শাস্তি ভোগ করছে। তাদের শাস্তি দিয়েছেন স্বয়ং যম ।” শুনে রাবণ যমালয় আক্রমণ করে ফেলেন । ব্রহ্মা তখন ভগবান শিবের শরণ নিলেন । ভগবান শিব মধ্যস্থতা করে বন্ধ করলেন এই যুদ্ধ ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ১৫ )

হনুমান শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন সূর্য দেবতার কাছে । সূর্য দেবতা তাঁহাকে বৈদিক শাস্ত্রাদি জ্ঞান থেকে আরম্ভ করে যুদ্ধবিদ্যা সকল কিছুই প্রদান করলেন । সূর্য দেবতার দ্বিতীয়া পত্নী ছায়াদেবীর সন্তান ছিলেন শণি । সেসময়ের কথা- শণিদেবের খুব ক্রোধী মেজাজ ছিলো । কোনো কারণে একদিন শণিদেবের সাথে হনুমানের বিবাদ হয়। অবশেষে দুজনের মধ্যে যুদ্ধের সূত্রপাত হয় । যুদ্ধে শণিদেব দারুন ভাবে পরাজিত হয় । তখন সূর্য দেবতা এসে দুজনের মধ্যে মিটমাট করেন । উভয়ে বন্ধুত্ব স্বীকার করেন । শণিদেবতা তখন হনুমান কে বর প্রদান করেন। বলেন- “হে অঞ্জনালাল মারুতি! আমি কথা দিচ্ছি যারা তোমাকে ভজনা করবে তাহাদিগের ওপর আমি কদাপি কুদৃষ্টি দেবো না। তাহাদের সকল গ্রহ দোষ খণ্ডন হবে। নবগ্রহ তাহাদের ওপর সুপ্রসন্ন থাকবে। কলিকালে যাহারা তোমার বন্দনা করবে তাহাদিগের সকল গ্রহদোষ ও শণির দশা খণ্ডন হবে। তাহাদের নবগ্রহ আশীর্বাদ করবেন।” এই কারনে জ্যোতিষীরা “হনুমান চালিশা” পড়বার বিধান দেন। যাই হোক বিদ্যা শিক্ষা সমাপনের পর বালক হনুমান আবার মায়ের কোলে ফিরলেন । কিন্তু তাঁহার দুষ্টুমি কমল না। যেমন নারকেল দিয়ে ঢিলানো বা পক্ক ফলমূল চৌর্য বা ধ্যানরত মুনি ঋষি দের তুলে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া, বিশাল বৃক্ষ তুলে উৎপাটন ইত্যাদি। কয়েকবার খেলাচ্ছল্লে কিছু রাক্ষস কেই বাল্যকালে যমালয়ে পাঠালেন । একবার মহর্ষি রুশি তপস্যায় বসেছিলেন একটি বটবৃক্ষ তলে। হনুমান খেলাচ্ছল্লে ভূমি শুদ্ধ তাকে তুলে অন্যত্র রাখলেন। মহর্ষি রুশি অভিশাপ দিলেন- “তুমি তোমার অলৌকিক সকল দৈবশক্তি বিস্মৃত হও।”

এই দেখে অনান্যরা বলল- “মহর্ষি এ আপনি কি করলেন ? হনুমান রূপে দেবাদিদেব অবতার গ্রহণ করেছেন রাক্ষস কূলের সংহারের জন্য। আপনি অভিশাপ দিয়ে তাঁর শক্তি ভুলিয়ে দিলেন?” মহর্ষি রুশি বললেন- “যথা সময়ে কেউ যখন হনুমানের শক্তির কথা স্মরণ করাবে, তখন হনুমানের সমস্ত শক্তির কথা স্মরণ আসবে।” হনুমান তখন থেকে শান্ত হলেন । একদিনের কথা, ইন্দ্র দেবতা যখন স্বর্গে ছিলেন তখন অনান্য অপ্সরারা পুঞ্জস্থলার কথা বলছিল। পূর্বে বলা হয়েছে যে দুর্বাসা মুনির শাপে অপ্সরা পুঞ্জস্থলা, হনুমানের মাতা অঞ্জনা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন । অপ্সরা গন বলল- “হে মহেন্দ্র! অপ্সরা পুঞ্জস্থলা মর্তে জন্ম নিয়েছেন। তিনি দুর্বাসা মুনির শাপকে বাস্তবায়িত করে রুদ্রাবতার হনুমানের জন্ম দিয়েছেন। এখন তাকে স্বর্গে ফিরিয়ে আনা হোক।” ইন্দ্রদেবতা ভাবলেন তাই তো। পুঞ্জস্থলা স্বর্গের অপ্সরা । মর্তলোকে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন তাকে স্বর্গে ফিরিয়ে আনা হোক । সেই মতো ইন্দ্র কেশরী মহলে এসে নিজ শক্তি দ্বারা অপ্সরা পুঞ্জস্থলার স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন । অঞ্জনা অনেক মিনতি করলেন যে হনুমান এখন ছোটো। এই অবস্থায় দেহ ত্যাগ করলে হনুমানকে দেখবে কে? সে মা ছাড়া হয়তো আর বাঁচবেই না । ইন্দ্রদেবতা কোনো বাধা নিষেধ শুনতে চাইলেন না। উলটে শাসিয়ে গেলেন। বললেন- “তুমি আমার নির্দেশ না মানলে আমি বৃষ্টি বন্যা সৃষ্টি করে কেশরী রাজ্য ধ্বংস করবো। তুমি তো জানো দেবতাদের শক্তির কাছে মর্ত বাসী কত অসহায়। অতএব আমার নির্দেশ পালন করে স্বর্গে ফিরে চলো।”

অঞ্জনা দেবী আর কি করেন। মৃত্যুর জন্য তৈরী হতে লাগলেন । সর্বদা উদাস ভাব দেখে কেশরী, হনুমান অনেক জিজ্ঞাসা করলো, অঞ্জনা দেবী কিছুই বলেন না । শেষে অঞ্জনা দেবীকে জটিল রোগে ধরল । প্রানবায়ু নির্গত হোলো। এই ঘটনায় যেমন কেশরী শোক পেলেন, তেমনি হনুমান মাতৃবিয়োগে রোদন করতে লাগলেন । হনুমানের সেই রোদন পৃথিবী ছাড়িয়ে স্বর্গ এমন কি ব্রহ্মলোক, কৈলাস, বৈকুণ্ঠ অবধি কাঁপিয়ে দিয়েছিলো । ব্রহ্মা, বিষ্ণু মিলে ইন্দ্র দেবতাকে ভৎসনা করলেন । কি কারনে এমন করেছে জানতে চাইলেন। সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ভগবান শিব। তিনি ত্রিশূল দিয়ে ইন্দ্রকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণু মিলে ভগবান নীলকণ্ঠকে শান্ত করলেন । ব্রহ্মা বললেন- “দুর্মতি ইন্দ্র, তুমি হনুমানের মাতা কেশরীর প্রান কেড়ে অন্যায় করেছো। হনুমানের মাতার আয়ু এখনও অনেক বাকী। তাঁহার আয়ুস্কাল পূর্ণ হয় নি।” ব্রহ্মা তখন হনুমানের মাতা অঞ্জনার প্রান ফিরিয়ে দিলেন। জীবিত হয়ে অঞ্জনা দেবী পুত্র হনুমান কে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য আদর করতে লাগলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ১৪)

একদিনের কথা । জটায়ুর ভাই সম্প্রতি আকাশে উড়তে উড়তে একেবারে সৌরলোকে উপস্থিত হয়েছেন । পক্ষী হয়ে সূর্যের নিকটে যেতেই সূর্য দেবতা এমন তাপ বিকিরণ করলেন যে সম্প্রতি পক্ষীর ডানা পুড়ে গেলো । ডানা হারিয়ে সেই পক্ষী সূর্য দেবতার কাছে অনুনয় বিনয় করতে সূর্য দেবতা বললেন- “ তোমার এই উদ্ধত আচরণের জন্যই এই শিক্ষা প্রদান করলাম। তুমি দক্ষিণে সমুদ্র তটে অবস্থান করো। যথাসময়ে তুমি তোমার পাখা ফিরে পাবে। তোমাকে দিয়ে একটি মহৎ কাজ হবে। সেই অবধি প্রতীক্ষা করে রাম নাম জপ করো।” হনুমান শিশু অবস্থায় পালক পিতা পবন দেবতার কাছে আকাশ মার্গে বিচরণের শক্তি পেয়েছিলো । একদিনের কথা । প্রভাতে পূর্ব গগনে উজ্জ্বল লাল দিনমণিকে দেখে হনুমান মহারাজ ভাবলেন সেটি নিশ্চয় মিষ্ট ফল। আকাশে ঝুলে আছে । অতএব ঐ ফল খেয়েই দেখতে হবে । ভাবা মাত্রই লম্ফ দিয়ে ছুটে গেলেন । একেবারে ভূলোক ছাড়িয়ে সোজা ঐ সূর্য লোকে । সেসময় খণ্ডিত রাহুর মস্তক সূর্য কে গ্রাস করবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল্ল । সূর্য দেবতা জানতেন সৃষ্টির নিয়ম অনুসারে গ্রহণ হবে। হনুমানকে দেখে রাহু ও সূর্য উভয়ে চমকে গেলো। হনুমান মহারাজ ঐ বাল্যকালেই রাহুর খণ্ডিত মস্তক তুলে বহুদূরে নিক্ষেপ করে সূর্যকে গিলতে অগ্রসর হল ।

রাহু গিয়ে স্বর্গে ইন্দ্রের কাছে বলল- “হে দেবেন্দ্র! সৃষ্টির নিয়মে আমি চন্দ্র সূর্যকে গ্রাস করি। তবে আজ কোথা থেকে সেই উদ্ধত বালক এসে আমার কর্মে হস্তক্ষেপ করছে?”এইদিকে হনুমান সূর্য কে গ্রাস করলো। সমগ্র জগত প্রথমে ভাবল গ্রহণ উপস্থিত । কিন্তু বহু সময় পরেও সূর্য গগনে দেখা দিলো না দেখে সকলে ভয়ভীত হোল । রুদ্রাবতার হনুমান সূর্য গ্রাস করেছেন । ইন্দ্র দেবতা বজ্র ধারন করে ঐরাবত স্কন্ধে আসলেন । বললেন- “কপি বালক। সূর্য দেবকে উন্মুক্ত করে ফিরে যাও। অন্যত্থায় তোমাকে দণ্ড প্রদান করবো ।” হনুমান তো কিছুতেই সূর্য দেবতাকে ছাড়বেন না । ইন্দ্রদেবতা তখন বজ্র অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। বজ্র গিয়ে হনুমানের বুকে আঘাত হানলো । হনুমানের মুখ থেকে সূর্য বেরিয়ে এলো। রক্তাক্ত অবস্থায় হনুমান আছড়ে পড়লো আরবল্লী পর্বতের উপর । পবন দেবতা এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইন্দ্রদেবতার কাছে গিয়ে বললেন- “হে মহেন্দ্র। আপনি কেন একজন বালকের ওপর বজ্র অস্ত্র প্রয়োগ করলেন ?” ইন্দ্রদেবতা অনেক বোঝালেন যে সূর্য দেবতাকে উন্মুক্ত করতেই এটা করতে হয়েছিলো। পবন দেবতা বললেন- “দেবরাজ । হনুমান আমার পালক পুত্র। এর প্রতিশোধ আমি নেবোই। আজ বিশ্ব সংসার দেখবে পবন দেবতার শক্তি কত। একজন পুত্রহারা পিতার শোকে এই জগত ধ্বংস হবে আজ।” পবন দেবতা সমগ্র জগত থেকে উৎক্ষেপন বায়ু, অবক্ষেপন বায়ু, আকুঞ্চন বায়ু, গমন বায়ু, প্রসারণ বায়ু, প্রান বায়ু, অপান বায়ু, ব্যান বায়ু, সমান বায়ু, উদান বায়ু , নাগ বায়ু, কূর্ম বায়ু, কৃকর বায়ু, দেবদত্ত বায়ু, ধনঞ্জয় বায়ু হরণ করলেন । সমস্ত বায়ু বিশ্ব থেকে নিজের মধ্যে সংহরিত করলেন পবন দেবতা ।

বিশ্ব সংসারে মহাপ্রলয় নেমে আসলে জীব প্রানী কূল বিনষ্ট হতে থাকলো । ইন্দ্রদেবতা, প্রজাপতি ব্রহ্মা অনেক বোঝালেন। পবন দেবতা বললেন- “হনুমানের প্রান দান করা হলেই এই প্রলয় স্তব্ধ হবে। অন্যত্থায় বিশ্ব নষ্ট করবো।” ব্রহ্মা ইন্দ্রকে বললেন- “হে দেবেন্দ্র। হনুমানের আবির্ভাব দেবশত্রু রাক্ষস দের বিনাশের জন্য। আর দেবতা হয়ে তুমি দেবতাদের মিত্রকে বধ করে দেব শত্রুদের কল্যাণ করলে। তুমি নিজের ক্ষতি নিজেই আহ্বান করেছো।” ব্রহ্মা প্রান দান করতে রাজী হলে পবন দেবতা শান্ত হয়ে সব বায়ু ফিরিয়ে দিলেন । দেবতারা আরবল্লী পর্বতে গেলেন। দেখলেন হনুমান মরে নি। তবে ভয়ানক আহত হয়ে মূর্ছা গেছেন। বজ্রের আঘাত খেয়েও জীবিত। ব্রহ্মা হনুমানের নব নাম দিলেন ‘বজ্রংবলী’ । ব্রহ্মা বর দিলেন – হনুমান তুমি চারযুগে অমর হবে। কোনো অস্ত্রই তোমাকে রোধ করতে পারবে না । ইন্দ্র বর দিলেন- বজ্রের ন্যায় বল পাবে। পবন দিলেন- বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী হবে তুমি। বহু দূরের বাক্য তুমি জানতে পারবে। অগ্নি বর দিলেন- আগুনে তোমার ক্ষতি হবে না । বরুণ বর দিলেন- ‘জলের তলে তুমি অবাধে বিচরণ ও শ্বাস নিতে পারবে। যম হনুমানকে গদা দিয়ে বললেন- “এই গদা দিয়ে দুষ্ট দমন করো। তোমার বৃদ্ধির সাথে সাথে এই গদাও বৃদ্ধি পাবে।” সূর্য দেবতা হনুমানের লোমকূপে সমগ্র কিরণ দিলেন । ব্রহ্মা বললেন- “যাবতীয় বিদ্যার জ্ঞাতা হবে তুমি।” বিশ্বকর্মা বর দিলেন- “অযুত শক্তিমান হও।” নারদ বললেন- মহান হরি ভক্ত রূপে খ্যাত হবে। বাসুকী নাগ বললেন- “নাগেরা তোমার বশে থাকবে। তোমার নামে নাগ ভয় দূর হবে।” এভাবে বাকী দেবতারা নানান বর দিলেন । হনুমান এরপর সূর্য লোকে শিক্ষা প্রাপ্তির জন্য গেলেন ।

বাল সময় রবি ভক্ষি লিয়ো তব ।
তীনহুঁ লোক ভয়ো অঁধিয়ারো ।
তাহি সোঁ ত্রাস ভয়ো জগ কো
য়হ সঙ্কট কাহু সোঁ জাত না টারো ।।
দেবন আনি করী বিনতী তব
ছাঁড়ি দিয়ো রবি কষ্ট নিবারো ।
কো নহিঁ জানত হৈ জগমেঁ কপি
সংকটমোচন নাম তিহারো ।।
( সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী )

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড পর্ব – ১৩ )

আজ আমরা বিশ্বকর্মার বানর রূপের কথা বলবো । বিশ্বকর্মাকে নিয়ে পুরানে অনেক আখ্যান লিখিত আছে । তাঁর মধ্যে থেকে একটি আখ্যান শোনা যাক। ঋষি শাপে একদা দেবশিল্পীকে বানর হতে হয়েছিল । ঘটনা টা ঠিক এই রূপ। বিশ্বকর্মা বিয়ে করেছিলেন স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচীকে ।ঘৃতাচীদেবী একজন অপ্সরা- তাই তিনি নৃত্যকলা কে নিয়ে থাকতে চান- কিন্তু স্বামী বিশ্বকর্মা ঘোর নারাজ। তিনি বলেন বিবাহের পর ওসব চলবে না। একদা স্বর্গে নৃত্য প্রতিযোগিতা হয়েছিল। স্বামীর অমতে ঘৃতাচী দেবী লুকিয়ে নাচতে গিয়ে বিশ্বকর্মার হাতে লাঞ্ছিতা হলেন। বিশ্বকর্মার এক কন্যা হয়- তার নাম চিত্রঙ্গদা। অপূর্ব সুন্দরী চিত্রাঙ্গদার নৃত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল- কিন্তু পিতার বদ মেজাজের জন্য- চিত্রাঙ্গদা চুপি চুপি মায়ের কাছে নৃত্য কলা শিখতো, প্রকাশ্যে শেখার সাহস পেতো না । একসময় সূর্য বংশীয় নৃপতি রাজা সুরথের সাথে চিত্রাঙ্গদার ভালোবাসা হয় । তারা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতেন। কিন্তু দেবতাদের দিব্যদৃষ্টি থাকে। সুতরাং পিতা বিশ্বকর্মার থেকে বেশীদিন লুকিয়ে থাকলো না। মর্তের পিতারা যা করেন- মেয়ের প্রেমিক স্ট্যাটাসে, পয়সায় ছোটো হলে , মেয়ে ভালোবাসায় অন্ধ হলে , মেয়েকে বন্দী করে রাখেন, বিশ্বকর্মা তাই করলেন। এই অবস্থায় মর্তের মেয়েরা যা করে পালিয়ে যায়- চিত্রাঙ্গদাও তাই করলেন।

বিশ্বকর্মা ক্রোধে অন্ধ হয়ে প্রথমে স্ত্রীর সাথে খানিক ঝগড়া করে স্বর্গের দেবতাদের কাছে সাহায্য চাইতে গেলেন। দেবতারা বিশ্বকর্মার বদমেজাজের জন্য সাহায্য করতে চাইলেন না। মর্তের পিতারা যা করে এই সময়, মেয়ের প্রেমিক কে শাস্তি দেবার জন্য নেতা, উচ্চ পদস্থ পুলীশের কাছে যায়- বিশ্বকর্মা সেই মতো প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন- “মেয়েদের স্বয়ম্বর সভার মাধ্যমে পতি নির্বাচনের অধিকার আমি দিয়েছি, তোমার মেয়ে নিজ পছন্দের পাত্র নির্বাচন করেছে। সে ঠিক কাজ করেছে। ” বিশ্বকর্মা এরপর বৈকুন্ঠে লক্ষ্মী জনার্দনের কাছে গেলেন। মা লক্ষ্মী বললেন- “আমি নিজেই সমুদ্র মন্থনের পর প্রকট হয়ে ভগবান হরির কন্ঠে মাল্য দিয়েছিলাম। আমি কন্যার পতি নির্বাচনের অধিকারকে সমর্থন করি। আমি তোমার কন্যার পক্ষেই আছি।” বিফল হয়ে বিশ্বকর্মা কৈলাশে গেলে গৌরী দেবী জানালেন- “তোমার কন্যা নিজ পাত্র নিজে নির্বাচন করে স্ত্রী ধর্ম পালন করেছে। অতএব আমরা তোমাকে কোনোরূপ সাহায্য করতে পারবো না।” সাহায্য না পেয়ে বিশ্বকর্মা ক্রোধে নিজ মেয়েকে অভিশাপ দিলেন- “বিয়ের পর তুই বিধবা হবি।” চিত্রাঙ্গদা ভাবল তাঁর জন্য রাজার মৃত্যু হবে- তাই এই বিবাহ করা উচিৎ না। এই ভেবে চিত্রাঙ্গদা নদীর জলে ঝাঁপ দিলো। রাজা সুরথ পাগল হয়ে বনে চলে গেলো। মহর্ষি ঋতধ্বজ এর শিষ্যরা চিত্রাঙ্গদাকে নদী থেকে তুলে আশ্রমে নিয়ে গেলো। সুস্থ করলো। মহর্ষি ঋতধ্বজ সব শুনে বিশ্বকর্মা কে অভিশাপ দিলেন- “তুই পিতা না। তুই পশু। তাই তুই পশু যোনিতে বানর হয়ে থাক। যতদিন তুই তোর মেয়েকে রাজা সুরথের সাথে বিবাহ না দিবি, শাপ ফিরিয়ে না নিবি , ততদিন তুই বানর হয়ে থাকবি।”

বিশ্বকর্মা এর পর মর্তে বানর হয়ে জন্মান। ঘৃতাচী দেবীও বানরী হয়ে জন্মান। দুজনের বিবাহ হয়। নল নামে তাঁদের এক পুত্র হয়। বিশ্বকর্মা অবশেষে শাপ তুলে নিয়ে চিত্রাঙ্গদার সাথে সুরথের বিবাহ দেন। এই কাজে মধ্যস্থতা করেন বালক হনুমান আর জাম্বুবান । তখন ঋষি শাপ ও কেটে যায় । নল হলেন ইঞ্জিনিয়ার । যিনি রামসেতু তৈরী করেছিলেন । এই বিদ্যা তিনি তাঁর পিতার কাছে পেয়েছিলেন। নল ছোটোবেলায় খুব চঞ্চল ছিলেন। মুনি ঋষিদের পূজার জিনিস লোটা, আসন, যজ্ঞকাষ্ঠ , জপের মালা, দণ্ড সব নিয়ে নদীতে ফেলে দিতেন । এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন কোনো এক মুনি তাঁকে অভিশাপ প্রদান করেন যে – “যা জলে ফেলবে সে সকল ডুবে যাবে না। সব জলের বুকে ভেসে থাকবে।” শাপে বর হয়েছিলো । পরবর্তী কালে ভারত থেকে লঙ্কা যাবার সেতু নির্মাণ করেছিলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ১২ )

.এই পর্বে আমরা ভক্ত হনুমান জীর আবির্ভাব দেখবো । হনুমানজি রুদ্রাবতার । কেশরী বানরের সন্তান রূপে হনুমানের আবির্ভাব হয়েছিলেন । রাবণের রাক্ষস কূলের আতঙ্ক এত বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে মুনি ঋষি দেবতারা মিলে ভগবান শিবের শরণাপন্ন হলেন । ভগবান শিব অভয় দিয়ে বললেন “আমার অংশ কেশরী পুত্র রূপে জন্ম নেবে। সেই অবতারে একদিকে যেমন ভগবান নারায়নের সহায়ক হবো, তাঁর নাম মাহাত্ম্য প্রচার করবো, অপরদিকে রাক্ষস নিধন করে সৎ জনকে রক্ষা করবো।” অতঃ মহাদেব পবন কে বললেন- “হে মরুত । তুমি আমার সেই অবতারের পালক পিতা হবে। তুমি তাহাকে যাবতীয় বিদ্যা দেবে।” এরপর মহেশ্বর সূর্য দেবতাকে বললেন- “হে তপন । তুমি যেরূপ আলোক বিকিরণ করে অন্ধকার দূর করো, সেই রূপ আমার সেই অবতারের গুরু হয়ে আমাকে সকল বিদ্যা দিয়ে জ্ঞানালোকে নিয়ে আসবে। ” মহাদেবের ইচ্ছায় দেবর্ষি নারদ মুনি গিয়ে অঞ্জনা দেবীকে শিব উপাসনা করবার পরামর্শ দিলেন ।
অঞ্জনা দেবী বনে গিয়ে ভগবান শিবের তপস্যা করলেন। ভগবান মহাদেব প্রকট হয়ে বললেন- “হে দেবী! তুমি আমার অংশের মাতা হবে। এই অবতারে আমি তোমার বাৎসল্য গ্রহণ করবো।” এরপর অঞ্জনা দেবী এক বলশালী পুত্রের জন্ম দিলেন । হনুমান যখন আবির্ভূত হলেন তখন সকলে খুশী হয়ে পুস্প বর্ষণ করতে লাগলো। গাছ গুলি ফুলে ঢেকে গেলো, পক্ষীরা মধুর সুরে ডাকতে লাগলো। প্রকৃতি যেনো তাঁর নিজস্ব ছন্দ ফিরে পেলো। কেবল লঙ্কায় নানা অশুভ চিহ্ন দেখা দিলো। হনুমান এর আবির্ভাব হয়েছিলো চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে (পূর্বভাদ্র নক্ষত্র মীন রাশি, কর্কট লগ্ন ) । বাল্য হনুমান ভগবান শিবের বাল্যরূপ । কেশরী বানরের রাজ্যে উৎসব আনন্দ অনুষ্ঠান হোলো। তিনি ব্রাহ্মণ ভোজোন, দান ধ্যান, মহাভোজের আয়োজন করলেন । সকলে এসে রাজার দান গ্রহণ করে ধন্য ধন্য করতে লাগলো । দেবতারা ছদ্দবেশে আসলেন । ভগবান শিবের বাল্যরূপ দর্শন সহজে মেলে না। চরণ স্পর্শ করে দেবতারা আশীর্বাদ গ্রহণ করতে লাগলেন । শুধু দেবতারাই নয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সরস্বতী দেবী, লক্ষ্মী দেবী এমনকি মাতা গৌরী অবধি ছদ্দবেশে এসে দর্শন করলেন ভগবান শঙ্করের শিশু রূপ । মাতা অঞ্জনা দেবীর লালন পালন আদর যত্ন পেয়ে হনুমান জী বড় হতে লাগলেন । কেশরী কূলের ইষ্ট দেবতা ছিলেন পবন দেব । পবন দেব মাঝে মাঝে হনুমানকে দর্শন করতে আসতেন ।
হনুমান মহারাজ ছোটো থেকেই চঞ্চল ছিলেন । লাড্ডু, মোদোক, মিষ্ট, পক্ক ফলমূলের প্রতি তাঁর ছিলো বেশী আকর্ষণ । অপূর্ব সুন্দর মিষ্ট দর্শন শিশু হনুমান কে দেখে মোহিত হয়ে যেতেন সকলে। ক্রোড়ে নিয়ে আদর করতেন । শত দুষ্টামি শর্তেও সকলের নয়নের মণি ছিলেন। হনুমানের দেখাদেখি অন্য সকল দেবতাদের তেজ রূপে বানর কূলে জন্ম নিলেন। নল নীল, গবাক্ষ , বালি, সুগ্রীব, মৈনাক আদি বানর বীরেরা । ব্রহ্মার মানস পুত্র রূপে জাম্বুবান ভল্লুক কূলে জন্ম নিলেন । অপর দিকে রাবণের স্ত্রী মন্দাদোরী এক বীর পুত্রের জন্ম দিলেন। সে জন্মে মেঘের ন্যায় রোদোন করতে থাকলে রাবণ তার নাম দিলো মেঘনাদ । নল বিশ্বকর্মার পুত্র । কিন্তু এর পেছনে একটি প্রেমের কাহানী, অভিশাপের কাহানী এক অপ্সরার কাহানী জড়িয়ে আছে। পরবর্তী পর্বে তা বলা যাবে ।
( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা- ( আদিকাণ্ড – ১১)

রামায়নে একাধিক অভিশাপের ঘটনা দেখা যায় । এবার ইন্দ্রলোকের কথা শোনা যাক । মহর্ষি দুর্বাসা একদিন ইন্দ্রলোকে পদার্পণ করেছেন । সেখানে একটি বিশেষ যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিলো । দেবরাজ মহেন্দ্র, অপ্সরা পুঞ্জস্থলাকে যজ্ঞের আয়োজন ও মহর্ষি দুর্বাসার সেবা করতে আদেশ দিয়েছিলেন । বয়সে ষোড়শী নবীনা অপরূপা সুন্দরী পুঞ্জস্থলা ছিলেন চঞ্চল মতির । একেবারে চঞ্চলা মন, অল্প বয়সী ছোটো মেয়েদের মতোন লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে চলা এমন । মহর্ষি দুর্বাসার কাজে গাফিলতিও ঘটালেন । কিন্তু দুর্বাসা ক্ষমা করলেন । শাস্ত্রে মহর্ষি দুর্বাসাকে অত্যাধিক ক্রোধী বলা হয়েছে। সামান্য কারণে তিনি ভয়ানক শাপ প্রদান করেন । এনারই অভিশাপে মাতা লক্ষ্মী দেবী পাতালে প্রবেশ করেছিলেন। যাই হোক একদিন যজ্ঞ চলাকালীন অপ্সরা পুঞ্জস্থলা দুর্বাসা মুনির পূজার উপকরণ ডিঙিয়ে চলে গেলেন। হিন্দু ধর্ম মতে খাবার, শায়িত ব্যাক্তি, গুরুদেব ব্রাহ্মণ গুরুজন বা তাদের ছায়া বা পাদুকা, পূজার উপকরণ ডিঙানো ঘোর অপরাধ । দুর্বাসা রেগে শাপ দিলেন- “বানরের মতো লাফিয়ে কোনো কিছু না দেখেই তুমি বিচরণ করো। এমন চঞ্চল মন নিয়ে স্বর্গে তোমার স্থান নেই। যাও পৃথিবীতে গিয়ে বানর কূলে জন্ম নাও।” এমন অভিশাপ শুনে অপ্সরা পুঞ্জস্থলা অনেক ক্ষমা প্রার্থনা করলেন । দুর্বাসা মুনি খুশী হয়ে বর দিলেন – “তুমি বানরী হয়ে জন্মাবে। তবে তোমার গর্ভে স্বয়ং ভগবান মহেশ্বর অবতার নেবেন। সেই অবতারে তিনি হরিভক্তি প্রচার করবেন। আবার রাক্ষস দলন করবেন। জগতে তুমি তাঁর মাতা রূপে পূজানীয়া হবে।”

অপ্সরা পুঞ্জস্থলা বানরী হয়ে জন্ম নিলো। তাঁর বিয়ে হোলো কেশরী নামক এক বানরের সাথে। ঝাড়খণ্ডে এমন একটি জায়গা আছে যেখানে কেশরী বানরের রাজ্য ছিলো বলে বলা হয় । কেশরী বীর ছিলো। সেও রাক্ষস বধ করেছিলো। পরবর্তী কালে ভগবান শিবের অবতার হনুমান এর জন্ম হয় এই দম্পতির ঘরে । মহর্ষি গৌতমের সুন্দর স্ত্রী ছিলেন অহল্যা দেবী। অহল্যা দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র একদিন অহল্যা দেবীকে শয্যাসঙ্গিনী হবার প্রস্তাব দিলেন । অহল্যা দেবী ঘৃনা ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন । কিন্তু ইন্দ্র দেবতার কু মানসিকতা দূর হোলো না । একদিন ফন্দী এটে রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ইন্দ্র দেবতা বণ মোরোগের ডাক ডাকলেন । মুনি ভাবলেন ব্রাহ্ম মুহূর্ত উপস্থিত । হিন্দু ধর্ম মতে ব্রাহ্ম কালে শয্যা ত্যাগ করা নিয়ম । মুনি স্নানে গেলেন কুমণ্ডলু নিয়ে । অপরদিকে ঘরে অহল্যা একা। ইন্দ্রদেবতা মুনি গৌতমের ছদ্দবেশ নিয়ে গৃহে প্রবেশ করে অহল্যাকে ভোগ করলেন। অহল্যা দেবী বুঝতে পারেন নি । তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অহল্যা দেবী ইন্দ্রের জালে পা দিলেন । মুনি ঘাটে গিয়ে দেখলেন তার সাথে ছলনা হয়েছে। দ্রুত ফিরে এসে আশ্রমে তাঁরই মতোন একজনকে দেখে অবাক হলেন । অহল্যাও অবাক আর ভয় ভীত হয়েছিলো। ইন্দ্র স্বরূপ ধরতেই , গৌতম মুনি শাপ দিলেন- “হে অধার্মিক ইন্দ্র। তুমি দেবতাদের রাজা হবার যোগ্য নও । দেবতা হয়েও তুমি এমন ঘৃন্য কাজ করেছো। তোমাকে শাপ দিচ্ছি, তোমার শরীরে সহস্র যোনি উৎপন্ন হোক।” ইন্দ্রের দেহে সহস্র যোনি উৎপন্ন হোলো। লজ্জায় ইন্দ্র কাউকে আর মুখ দেখাতে পারলো না ।

গৌতম মুনি এবার একটি অন্যায় কাজ করলেন। নীরিহ নির্দোষী, চক্রান্তের শিকার অহল্যাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “তুমি প্রস্তরে পরিণত হও। যবে ভগবান নারায়ণ মানব অবতার নিয়ে এখানে এসে তোমার ওপর চরণ রাখবেন –সেদিনই তুমি মুক্তি পাবে।” সেই থেকে অহল্যা সেই পরিত্যক্ত আশ্রমে পাষাণ হয়ে থাকতে লাগলেন । ইন্দ্র দেবতা পড়ে আরাধনা করে বর পেয়েছিলেন। তাঁর দেহের সহস্র যোনি সহস্র চোখে পরিণত হোলো । এখানে একটি তত্ত্ব কথা আছে । ‘ব্যাঞ্জর’ বা অনাবাদী জমিকে ‘অহল’ অর্থাৎ হাল দেওয়া হয়নি বলা হয়। ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা। এমন অনাবাদী জমিতে ভরপুর বৃষ্টিকে কেউ ইন্দ্র দ্বারা অহল্যা ধর্ষণ বলেছেন । ইন্দ্র দেবতার সহস্র চোখ। যখন বৃষ্টি হয় তখন আমরা কল্পনা করে বলি আকাশের শত চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ইন্দ্র হলেন বৃষ্টির দেবতা। তাই এখানে ইন্দ্রের সহস্র চোখের বর্ণনা করা হয়েছে । যে আখ্যান মানে মানুক, আর যে তত্ত্ব কথা মানে মানুক ক্ষতি নেই। ক্ষতি তখন হয় যখন একজনের মতবাদ অন্যের ওপর জোর করে চাপানোর চেষ্টা হয় । সুতরাং যে যেটা মানে মানুক ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড পর্ব- ১০ )

রাবণকে এই অস্ত্র প্রদানের ঘটনায় দেবতারা চিন্তিত ছিলো। মাতা পার্বতীও রুষ্ট ছিলেন । তিনি বলেছিলেন – “ হে প্রভু। আপনি দুরাচারী নারী নীপিড়ক রাবণকে কেন আশীর্বাদ দিলেন ? আপনি কি বিস্মৃত হয়েছেন যে দেবী কমলার অংশে জন্ম বেদবতী এই রাবণের জন্যই অগ্নিতে প্রবেশ করেছিলেন।” দেবাদিদেব জানালেন – “ হে দেবী। আমি কিছুই অজ্ঞাত নহি। সময় না আসলে কোনো নির্ধারিত কাজ হয় না। রাবন শ্রী বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্রের হস্তেই বধ হবে। কিন্তু তপস্যার ফল প্রদান করা কর্তব্য। কি সে অসুর, মানব, দানব, দেবতাই হোন। রাবণের তপস্যার ফল সে লাভ করেছে। সময় আসলে সে সকল যাবতীয় পাপ কর্মের ফলও ভোগ করবে।” রাবণের মাতা কেকসী ভাবল – ভগবান শঙ্কর যদি এত অল্পেই তুষ্ট হয়ে যান, তাহলে ভগবানকে লঙ্কায় এনে রাখলে আরোও উত্তম। রাবণ অজেয় হবে। অতএব শিবের আরাধনা করে তাঁকে তুষ্ট করতে হবে। কেকসী মহর্ষি বিশ্বশ্রবার কাছে বিশ্বশ্রবা পূজিত জাগ্রত শিবলিঙ্গ প্রার্থনা করলো। বিশ্বশ্রবা এর কারণ জানতে চাইলে কেকসী সব বলল। এই রকম অকল্যাণ জনক বাসনা শুনে বিশ্বশ্রবা রাজী হোলো না। বিশ্বশ্রবা বলল- “তোমার চিন্তাভাবনা ও উদ্দেশ্য ত্রিলোকের অমঙ্গল ডেকে আনবে। তুমি যদি মহৎ উদ্দেশ্যে সেই লিঙ্গ প্রার্থনা করতে তবে অবশ্যই দিতাম ।” কেকসী সেই শিবলিঙ্গ জোর করে তুলে নিয়ে গেলো। বিশ্বশ্রবা অনেক বোঝালো যে শিবলিঙ্গ স্ব স্থান থেকে সড়ানো মহাপাপ। কিন্তু কেকসী শুনলো না ।

সেই শিবলিঙ্গ পূজাকালে ইন্দ্রদেবতা সেই লিঙ্গ হরণ করলো। কেকসী ফিরে গিয়ে রাবণ কে সব জানালো। রাবণ পুনঃ শিব তপস্যায় মগ্ন হোলো। এত কঠিন তপস্যা যে রাবণ নিজ উদর ছিন্ন করে নাড়ি বের করে সেতারের মতো বাজিয়ে শিবের স্তব করতে লাগলো। দশ মাথা ছিন্ন করে যজ্ঞে দিতে লাগলো। ভগবান শিব তুষ্ট হয়ে বর দিতে প্রকট হলেন। রাবন বললেন- “হে আশুতোষ। আপনি সর্বদাই আমার ওপর প্রসন্ন। কৃপা করে আপনি আমাকে দেবী পার্বতী প্রদান করুন। আমি ভদ্রকালী রূপে দেবীর স্থাপনা করে লঙ্কায় বসন্ত ঋতুতে দুর্গা পূজা করবো। আর আপনিও আমার সাথে চলুন। লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে আপনাকে পূজা দেবো।” মহাদেব শিব এখন কি করেন। নিজ স্ত্রীকে কিভাবে দান করবেন। আর ভক্তের মনস্কামনা পূর্ণ করতেই হবে। ভগবান শিব বললেন- “তাই হোক।আমার আত্মলিঙ্গ ও দেবী গৌরীকে গ্রহণ করো।” রাবণকে আত্মলিঙ্গ ও দেবী পার্বতী প্রদান করলেন। শিব বললেন- “হে রাবণ। মনে রেখো আমার এই আত্মলিঙ্গ যেখানে ভূমি স্পর্শ করবে সেখানেই স্থাপিত হবে। অতএব লঙ্কা তে নিয়ে গিয়েই আমার আত্মলিঙ্গ ভূমিতে রাখবে।” রাবণ পুস্পক বিমানে দেবী পার্বতী ও মহাদেবের আত্মলিঙ্গ নিয়ে আসতে লাগলেন । মাতার বিহনে কৈলাসে গণেশ, কার্ত্তিক, নন্দী, ভৃঙ্গি গণেরা রোদন করতে লাগলেন। সেই সময় ভগবান বিষ্ণু অভয় দিলেন। তিনি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বেশে রাবণের সামনে গেলেন। দেবী পার্বতী রাবণের অজ্ঞাতে বৃদ্ধা কুৎসিত রূপ ধরলেন । বৃদ্ধ রূপী নারায়ণ বললেন- “হে রাবণ। মহাদেব তোমার সাথে ছলনা করছেন। তিনি নিজ স্ত্রীকে তোমাকে দেন নি। দেখো।” রাবণ বৃদ্ধা কুৎসিত রূপী দেবীকে দেখে বললেন- “তুমি প্রস্থান করো। তোমাকে চাই না।” রাবণের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেবী পার্বতী স্বরূপ ধরে কৈলাসে গেলেন। অপরদিকে রাবণের উদরে ভগবান বিষ্ণু গঙ্গা ও যমুনা , সপ্ত পবিত্র নদী প্রবেশ করলেন ।

উদ্দেশ্য ছিলো রাবণের হাত থেকে আত্মলিঙ্গ উদ্ধার । এই ব্যাপারে দেবতারা বিঘ্ন বিনাশক, মঙ্গল মূর্তি গণেশের শরণাপন্ন হলেন । প্রচণ্ড মূত্রবেগ উপস্থিত হওয়াতে রাবণ পুস্পক বিমান থেকে নামলেন। এত মূত্র বেগ অথচ শিবলিঙ্গ নিয়ে শৌচাদি কর্ম করা নিষেধ । সেই সময় বিঘ্ন বিনাশক গজানন এক রাখালের বেশে আবির্ভূত হলেন। রাবণ সেই রাখালের হাতে শিবলিঙ্গ দিয়ে বললেন- “বালক এই শিবলিঙ্গ ধারন করো। ভুলেও একে মাটিতে রাখবে না। প্রাকৃতিক ক্রিয়া সুসম্পন্ন করে আমি এসে তোমাকে পুরস্কার প্রদান করবো।” রাখাল বেশী গণেশ বলল- “এত ওজন আমার সহ্যের বাইরে। আমি তিনবার তোমাকে আহ্বান করবো। এর মধ্যে না আসলে আমি আর ধরে রাখতে পারবো না।” রাবন মূত্র ত্যাগ করতে বসলো। রাখাল রূপী গণেশ তিনবার ডেকে শিবলিঙ্গ মাটিতে রেখে দিলো। সেখানেই স্থাপিত হোলো ভগবান শিবের আত্মলিঙ্গ । রাবণ ফিরে এসে রাখালকে দেখতে পেলো না। ঐ শিবলিঙ্গ অনেক ওঠানোর চেষ্টা করেও বিফল হোলো। রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গেলো । ঐ স্থান “বৈদ্যানাথ ধাম” নামে খ্যাত। ভারতের ঝাড়খণ্ডে এই ধাম অবস্থিত । রাবনের মূত্রে সেখানে যে পুষ্করিণী সৃষ্টি হয়েছিলো তা এখনও আছে । এখানে দেবী সতীর হৃদয় পতিত হয়েছিলো। এখানে দেবী দুর্গা রূপে অবস্থান করছেন। দেবীর ভৈরব হলেন এই বৈদ্যনাথ । শ্রাবন মাসে এখানে প্রচুর ভীর ও মেলা হয়। ভারতে আসলে অবশ্যই এই ধাম দর্শন করবেন। এরপর দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু সহিত এই স্থানে এসে ভগবান শিবের পূজা করলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড পর্ব -৯ )

রাবণ নন্দীদেবের অভিশাপ পেয়েও দমে নি। কৈলাসের দিকে অগ্রসর হবার সময় নন্দীকে মহাদেব আদেশ দিলেন রাবণের গতি রোধ না করতে । নন্দী বললেন, “রাবন তুমি জানো না কৈলাস মহাদেবের স্থান । তুমি ভগবান শিবের ধামে আক্রমণ করেছো। এবার দেখো তোমার কি গতি হয়।” রাবণ বলল- “আজ আমি শিব সমেত কৈলাস পর্বতকে তুলে নিক্ষেপ করে কুবেরকে বধ করবো।” এই বলে দশগ্রীব দশানন সমগ্র বাহু দিয়ে কৈলাস পর্বতকে তুলে ধরল । কৈলাসে প্রচণ্ড আলোড়ণ সৃষ্টি হোলো । কৈলাসের বরফের স্তূপ ভেঙ্গে প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হতে লাগলো । ভয়ে ভীত হয়ে দেবী পার্বতী , মহাদেবকে জড়িয়ে ধরলেন । ভগবান মহেশ্বর অভয় দিয়ে বললেন- “হে দেবী। ভীত হয়ো না। আমি এখুনি রাবণের উদ্ধত আচরণকে ধ্বংস করবো ।” রাবণ কৈলাস পর্বতকে তুলে ছিলো। ভগবান শিব বাম চরণের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে মাটিতে চাপ দিলেন। সাথে সাথে কৈলাস পর্বত নেমে এসে রাবণের ওপর পতিত হোলো। রাবণের অর্ধ শরীর পর্বতের নীচে চলে গেলো । এইভাবে কিছুকাল গত হল। ব্রহ্মা দেব তখন সূর্য দেবতাকে দিয়ে রাবন কে সংবাদ প্রেরন করলেন । সূর্য দেবতা বললেন – “রাবণ । প্রজাপতি ব্রহ্মা এই সংবাদ দিয়েছেন । তুমি সাক্ষাৎ পরমপুরুষ শিবকে ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলে। তিনি অনাদি, শাশ্বত, নিরাকার ব্রহ্মের সাকার রূপ। তুমি সেই স্বয়ম্ভু নীলকণ্ঠকে অপমান করেছো, তাই তোমার এই দশা। তুমি সেই পরব্রহ্মের স্তব করো। প্রজাপতি হংসবাহন ব্রহ্মা এই সংবাদ তোমাকে পাঠিয়েছেন ।”

রাবণ তখন শিব স্তব আরম্ভ করলেন । এই গুলি “শিবতাণ্ডবস্তব” নামে খ্যাত। যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে- যিনি জটারূপ অরণ্য থেকে নির্গত গঙ্গাদেবীর প্রবাহে পবিত্র করা সর্পের বিশাল মালা কণ্ঠে ধারন করে ডমরুতে ডম, ডম, ডম- এই শব্দ তুলে প্রচণ্ড নৃত্য করেছেন, সেই শিব যেন আমার কল্যাণ সাধন করেন । ১ যাঁর মস্তক জটারূপ কড়াইতে বেগে ভ্রমণকারী গঙ্গার চঞ্চল তরঙ্গ- লতাসমূহে সুশোভিত হচ্ছে, যাঁর ললাটাগ্নি ধক্ ধক্ করে জ্বলছে , মস্তকে অর্ধচন্দ্র বিরাজিত, সেই ভগবান শিবে যেন আমার নিরন্তর অনুরাগ থাকে । ২ গিরিরাজকিশোরী পার্বতীর বিলাসকালোপযোগী উচ্চ- নীচ মস্তকভূষণ দ্বারা দশদিক প্রকাশিত হতে দেখে যাঁর মন আনন্দিত, যাঁর নিত্য কৃপাদৃষ্টির ফলে কঠিন বাধাবিপত্তি দূর হয়ে যায়, সেই দিগম্বররূপ তত্ত্বে যেন আমার মন আনন্দ লাভ করে । ৩ যাঁর জটাজুটের মধ্যে সর্পের ফনায় অবস্থিত মণির প্রকাশিত পিঙ্গল ছটা দিশারূপিণী অঙ্গনাদের মুখে কুঙ্কুমের রং ছড়ায়, মত্ত হাতীর বিকশিত চর্মকে উত্তরীয় ( চাদর ) – রূপে ধারন করায় যিনি স্নিগ্ধবর্ণ লাভ করেছেন, সেই ভূতনাথে আমার চিত্ত অদ্ভুদ তৃপ্তি বোধ করুক । ৪ যাঁর চরণপাদুকা ইন্দ্রাদি সকল দেবতার ( প্রনামের সময় ) মস্তকের ফুলের পরাগে ধূসরিত হয় ; নাগরাজ ( শেষ ) এর মালায় বাঁধা জটাসম্পন্ন সেই ভগবান চন্দ্রশেখর আমার জন্য চিরস্থায়ী সম্পত্তির ব্যবস্থাপক হয়ে থাকুন। ৫ যিনি তাঁর ললাটরূপ বেদীতে প্রজ্বলিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের তেজে কামদেবকে ভস্মীভূত করেছিলেন, যাঁকে ইন্দ্র নমস্কার করেন, চন্দ্রের কলা দ্বারা সুশোভিত মুকুট সম্পন্ন সেই শ্রীমহাদেবের উন্নত বিশাল ললাটের জটিল মস্তক আমার সম্পত্তির কারণ হোক । ৬ যিনি তাঁর ভীষণ কপালের ধক্ ধক্ রূপ জ্বলন্ত অগ্নিতে কামদেবকে আহুতিদান করেছিলেন, গিরিরাজকণ্যার স্তন্যাগ্রে পত্রভঙ্গ রচনা করার একমাত্র শিল্পী সেই ভগবান ত্রিলোচনের ওপর আমার রতি ( অনুরাগ ) থাকে। ৭

যাঁর কন্ঠে নবীন মেঘমালা বেষ্টিত অমাবস্যার অর্ধরাত্রের ন্যায় দরূহ্ অন্ধকারসম শ্যামলতা বিরাজ করে, যিনি গজচর্মপরিহিত, সেই জগদভার বহনকারী , চন্দ্রের অর্ধাকৃতিতে মনোহর ভগবান গঙ্গাধর যেন আমার সম্পত্তির বিস্তার করেন । ৮ যাঁর কন্ঠদেশ প্রস্ফুটিত নীলকমল সমূহের শ্যামশোভার অনুকরণকারী হরিণীর ছবির ন্যায় চিহ্নে সুশোভিত এবং যিনি কামদেব, ত্রিপুর, ভব ( সংসার ), দক্ষ- যজ্ঞ, হাতি( গজাসুর) , অন্ধকাসুর এবং যমরাজের উচ্ছেদকারী, আমি তাঁর ভজনা করি ।। ৯যিনি নিরাভিমান পার্বতীর কলারূপ কদম্বমঞ্জরীর মকরন্দস্রোতের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মাধুরী পানকারী মধুপ এবং কামদেব, ত্রিপুর, ভব, দক্ষ- যজ্ঞ, হাতি, অন্ধকাসুর ও যমরাজের বিনাশকারী, আমি তাঁর ভজনা করি ।। ১০যাঁর মস্তকের ওপর অত্যন্ত বেগে ঘূর্ণমান ভুজঙ্গের নিঃশ্বাসে ভয়ঙ্কর অগ্নি ক্রমাগত প্রজ্বলিত হচ্ছে, ধিমি ধিমি শব্দে মৃদঙ্গের গম্ভীর মঙ্গলধ্বনির সঙ্গে যিনি প্রচণ্ড নৃত্য করছেন, সেই ভগবান শঙ্করের জয় হোক । ১১ পাথর এবং সুন্দর কোমল বিছানায় সর্প ও মুক্তমালায়, বহু মূল্য রত্ন এবং মৃত্তিকায় , মিত্র ও শত্রুপক্ষে , তৃণ ও কমলনয়না তরুণীতে , সাধারণ প্রজা ও পৃথিবীর মহারাজার প্রতি যিনি সমভাব রাখেন, সেই সদাশিবকে আমি কবে ভজনা করব ! ১২ সুন্দর ললাটসম্পন্ন ভগবান চন্দ্রশেখরকে চিত্ত সমর্পণ করে নিজ কুচিন্তা পরিত্যাগ করে, গঙ্গার তীরে কোন কাননের অভ্যন্তরে থেকে মস্তকের ওপর হাত জোড় করে বিহ্বলনয়নে ‘শিব’ মন্ত্র উচ্চারণ করে আমি কবে সুখলাভ করব ? ১৩ যে ব্যাক্তি এভাবে উক্ত অতি উত্তম স্ত্রোত্র নিত্য পাঠ , স্মরণ এবং বর্ণনা করে, সে সদা শুদ্ধ থাকে এবং অতি শীঘ্র সুরগুরু শ্রীশঙ্করের প্রতি প্রকৃত ভক্তিভাব প্রাপ্ত হয় । সে কখনও বিপথে যায় না ; কারণ শ্রীশিবের সুচিন্তা প্রাণিবর্গের মোহ নাশ করে । ১৪ সায়ংকালে পূজা সমাপ্ত হলে দশানন রাবণ দ্বারা গীত এই শম্ভুপূজন সম্পর্কীয় স্ত্রোত্র যিনি পাঠ করেন, ভগবান শঙ্কর সেই ব্যক্তিকে রথ, হাতি, ঘোড়া সমন্বিত চিরস্থায়ী অনুকূল সম্পত্তি প্রদান করেন । ১৫ ( ১৫ টি শ্লোকে এই স্তব রাবন করেছিলেন )।
রাবণের স্তবে মুগ্ধ হয়ে দেবাদিদেব শিব আবির্ভাব হলেন । রাবণকে সেই দশা থেকে মুক্ত করলেন। রাবণ বললেন- “আজ থেকে রাবণের ইষ্ট রূপে দেবাদিদেবের এক নাম হবে রাবণেশ্বর । আমি, আপনি ছাড়া কারো চরণে নত হবো না ।” ভোলানাথ স্বল্পেতেই তুষ্ট হন। একটি বিল্বপত্র ও এক ঘটি গঙ্গা জলেই তুষ্ট তিনি । দেবাদিদেব রাবণকে “চন্দ্রহাস” নামক এক খড়গ দিয়ে বললেন- “হে রাবন তোমার যশ কীর্তি বৃদ্ধি হোক। এই চন্দ্রহাস খড়গ গ্রহণ করো। ত্রিলোকে এমন অস্ত্র নেই যে এই খড়গ কে বিফল করতে পারে। তবে আমার কোনো ভক্তের ওপর এই অস্ত্র নিক্ষেপ করলে এই অস্ত্র বিফল হয়ে আমার কাছে চলে আসবে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড পর্ব -৮ )

রাবনের ত্রিভুবন বিজয়ের ইচ্ছা বেড়েই চলল। মহারাজ কার্ত্তবীর্য্যার্জুন সহস্র বাহু শক্তি হবার বর প্রাপ্তি করেছিলেন । তাঁর দেহে একশো মত্ত হস্তীর বল ছিলো। রাবণ তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় । শেষে মহর্ষি পুলস্ত্য পুনঃ এসে রাবণকে উদ্ধার করেন। মহর্ষি পুলস্ত্য বলেন- “হে রাবণ! তুমি আমার বংশজ। বারংবার কেন তুমি পূর্বপুরুষদের কলঙ্ক দিচ্ছ ? তোমার কৃত কর্মের জন্য আমি লজ্জা বোধ করছি। তুমি সৎ ধার্মিক হও। তুমি শাস্ত্রবিদ। আয়ুর্বেদের বহু ঔষধি তোমার করায়ত্ত । তুমি ধার্মিক হয়ে মানব কল্যাণ করো।” রাবণ কিন্তু মহর্ষির কথা শোনে নি । অপরদিকে কার্ত্তবীর্য্যার্জুন মহর্ষি জমদাগ্নির আশ্রম তছনছ করে জমদাগ্নিকে হত্যা করে , সর্ব অভীষ্ট প্রদায়ক কামধেনু গাভী হরণ করে। এরপর ভগবান পরশুরাম কার্ত্তবীর্য্যার্জুনকে বধ করে । রাবণের হাতে বহু কন্যা লাঞ্ছিত হয়েছিলো। কোনো এক কন্যা অভিশাপ দিয়েছিলো- “ দুরাচারী দশানন। আমার মতোই অপহৃতা নারীর জন্যই তুমি সবংশে নিহত হবে। তোমার কূলে কেউ বাঁচবে না।” রাবণ এসব অভিশাপকে মোটেও গুরুত্ব দিতো না ।

মাতা লক্ষ্মী দেবী ভগবান বিষ্ণুকে পতি রূপে প্রাপ্তির জন্য ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন । তাঁর নাম ছিলো বেদবতী । ভগবান বিষ্ণুকে প্রাপ্তি করবার জন্য তিনি অখন্ড ব্রহ্মচর্য পালন করে কঠোর উপাসনায় ব্রতী হয়েছিলেন । বেদবতী যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান করছিলেন। ঠিক সেসময় রাবণ সেখানে উপস্থিত হল । বেদবতীর রূপে মোহিত হয়ে রাবণ বলল- “হে সুমুখী। তুমি কেন বৃথা তপস্যায় ক্লেশ ভোগ করছ ? তুমি আমাকে বিবাহ করো। আমি তোমাকে লঙ্কায় নিয়ে যাবো। তুমি লঙ্কায় ভোগ বিলাসে জীবন কাটাবে।” বেদবতী ঘৃনা ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে জানালো- “দুষ্ট। ভগবান বিষ্ণু ব্যাতীত কেউ আমার পতি হতে পারেন না। আমি তাঁহাকেই পতি রূপে প্রাপ্তির জন্য এই যজ্ঞের আয়োজন করছি।” রাবণ ক্রোধিত হয়ে বেদবতীর কেশ আকর্ষণ করে বলল- “তুমি আমার সহিত না গমন করলে বল পূর্বক তোমাকে হরণ করে বিবাহ করবো।” বেদবতী অনেক বুঝালো রাবণ শুনলো না । অতঃ বেদবতী রাবণকে অভিশাপ দিয়ে বলল- “ হে রাবণ। আমি এই শরীর ত্যাগ করবো। তোমাকে অভিশাপ প্রদান করছি পরজন্মে তোমার কাল রূপে আবি আবার আবির্ভূত হব। আমি তোমার ধ্বংসের কারণ হব। আমার জন্যই রাক্ষস কূল ধ্বংস হবে। সেই ধ্বংসের আগুন তোমাকেউ গ্রাস করবে।” বেদবতী এই বলে অগ্নি দেবতাকে আহ্বান করে নিজেকে ভস্মীভুত করলেন । এই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলো ত্রিলোক ।

রাবণ শুনেছিলো তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইকে ভগবান শিব কৈলাসে আশ্রয় দিয়েছেন। কুবেরকে ধ্বংস করার প্রস্তাব রাবণের মাতা কেকসী রাবণকে দিয়েছিলো । পুস্পক রথে চড়ে রাবণ কৈলাসে আক্রমণ করলো । কৈলাসের বিশাল গিরিশৃঙ্গের সামনে নন্দী মহারাজ ছিলেন পাহারায় । রাবণের সাথে নন্দী মহারাজের যুদ্ধ হোলো। কিন্তু ব্রহ্মার বর প্রাপ্ত রাবণকে পরাজিত করতে পারলো না । নন্দীদেব রাবণের হাতে অর্ধমৃত হল । নন্দী মহারাজের বিশাল শিং, লম্ব কর্ণ দেখে রাবণ উপহাস করে বলতে লাগলো – “ওরে তুই নর না বানর ? তোর শরীর নরের আবার বানরের মতো লম্ফঝম্ফ করছ? তুমি আদতে কি?” রাবনের উপহাস শুনে নন্দী মহারাজ কুপিত হোলো। নন্দী মহারাজ রাবণকে অভিসম্পাত করে বলল- “তুমি আমাকে নর বানর বলে উপহাস করলে। তোমাকে শাপ দিচ্ছি হে দশগ্রীব, তুমি ঐ নর বানরের হাতেই বিনাশ প্রাপ্ত করবে।” রাবণ মোটেও ভীত না হয়ে বলল- “ওহে মূর্খ। নর জাতি আমার অনুচর রাক্ষসদের আহার্য, আর বানরকে পায়ে পিষে মারবার ক্ষমতা রাক্ষসদের আছে। তোমার অভিশাপ কোনোকালেই ফলবে না।” নন্দী মহারাজ শিবভক্ত। তিনি পূর্বে দক্ষ প্রজাপতিকে ছাগ মুণ্ড হবার বর দিয়েছিলেন । নন্দী মহারাজের অভিশাপ ফলেছিল ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।