১৩ মার্চ ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিপর্ব- পর্ব ১৮ )

রাক্ষসদের এমন অত্যাচারে গোটা ভারতই আক্রান্ত হচ্ছিল্ল। রাক্ষসদের হাতে নিপীড়িত হতে হতে মুনি, ঋষি আদি মানব সকল ভগবান বিষ্ণুকে ডাকতে লাগলেন । এমনকি দেবতারা মিলে বৈকুণ্ঠে গমন করে ভগবান শ্রী বিষ্ণুকে সকল বৃন্তান্ত জানালেন । তারা বললেন- “রাক্ষস বাহিনীর মাত্রাছাড়া তাণ্ডবে ধর্ম কর্ম বিনষ্ট হতে বসেছে। অনার্য রাক্ষস সংস্কৃতিতে লুপ্ত হতে বসেছে বৈদিক শাস্ত্র জ্ঞান। মুনি ঋষিরা যজ্ঞাদি করে দেবতাদের হব্য প্রদান করতে অসমর্থ হচ্ছেন । ধর্ম নষ্ট হয়ে অধর্মের প্রভাব সর্বত্র দেখা দিচ্ছে । যে জগদীশ আপনি কৃপা বশত পুনঃ আবির্ভূত হন । পূর্বে আপনি মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম অবতার গ্রহণ করে আসুরিক শক্তির নাশ করেছেন, পুনঃ আপনি দানবিক শক্তির সংহার করুন । ” এইভাবে দেবতারা সকলে কাকুতি মিনতি জানালেন। ভগবান মহেশ্বর বললেন- “হে নারায়ণ। আমার অবতার হনুমান মর্তে আবির্ভূত হয়েছে। এবার আপনি মর্তে অবতার গ্রহণ করুন। আপনি সৃষ্টি পালন করেন। এই কারনে আপনি অবতার গ্রহণ করেন, আগামীতেও করবেন। হে লক্ষ্মীনাথ ত্রিবিক্রম, আপনি রাক্ষস বিনাশের জন্য আবির্ভূত হন। রাবণ আপনার হাতেই বধ্য। ” বসুমতী দেবী বললেন- “হে জনার্দন । আমি সর্বংসহা বসুমতী। কিন্তু রাবণের পাপের বোঝা আমি গ্রহণে অসমর্থ । সে স্বয়ং দেবী লক্ষ্মীর অবতার বেদবতীকে অসম্মান করেছে। এই মহাপাপীর বিনাশ না হলে ধরিত্রী ধ্বংস হবে।”

সকলের প্রার্থনা শুনে ভগবান বিষ্ণু অভয় দিয়ে তাঁর অবতারের কথা ঘোষোনা করে দিলেন । বললেন- “আপনারা চিন্তিত হবেন না । আমি ইক্ষাকু বংশে অযোধ্যার সম্রাট দশরথের নন্দন রূপে কৌশল্যা দেবীর গর্ভে আবির্ভূত হব। ধর্ম রক্ষা করে দুষ্ট রাক্ষস দিগকে বধ করবো। ধর্ম সংস্থাপন করে অধর্মের বিনাশ করবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন । ভগবান বিষ্ণু বললেন- “এই অবতারে দেবী লক্ষ্মীও অবতার গ্রহণ করে রাবণের বিনাশের হেতু হবেন ।” দেবী লক্ষ্মী বলিলেন- “বসুমতী ধরিত্রীর কন্যা রূপে আবির্ভূত হয়ে আমি মিথিলা রাজ জনক ও তাঁর পত্নী সুনয়নার গৃহে প্রতিপালিত হবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন । ব্রহ্মা তখন মহর্ষি বিশ্বশ্রবা কে স্বপ্নে জানালেন- “বিশ্বশ্রবা তুমি তোমার পুত্র দশাননকে সংযত হতে বল। ভগবান হরি মর্তে আবির্ভূত হচ্ছেন তাঁর বিনাশ করবার জন্য। সে এরূপ অধর্ম আশ্রয় করে থাকলে সে ধ্বংস হবেই, তাঁর কূলেও কেউ রক্ষা পাবে না।” বিশ্বশ্রবা রাবণকে অনেক বোঝালো, রাবণ সংযত হলই না। উলটে আস্ফালন করে বলল- “যদি বিষ্ণু আমাকে বধ করতে আবির্ভূত হয়, তবে আমি বিষ্ণু বধ করবো। কিন্তু বিষ্ণুর ভয়ে আমি ভীত হবো না। ”

এখানে সবাই প্রশ্ন করতে পারেন যে ভগবান বিষ্ণু ইচ্ছা করলেই গরুড়ে আসীন হয়েই লঙ্কা আক্রমণ করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। এতটাও দরকার হত না , তিনি বৈকুণ্ঠ থেকেই সুদর্শন চালনা করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মর্তে আবির্ভূত কেন হবেন ? এটা ছেড়েও বলা যায়, দেবী লক্ষ্মীর অংশ বেদবতী নিজে যজ্ঞে ঝাঁপ না দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন । কিংবা রুদ্রাবতার হনুমান রাবণকে বধ করতে পারতেন, কিংবা দেবী পার্বতীকে লঙ্কায় নিয়ে যাবার কালে দেবী শাপ দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন বা রাবণ যেদিন কৈলাস আক্রমণ করেছিলো সেদিনই ভগবান শিব তার বধ করতে পারতেন । কিন্তু এঁনারা এমন করলেন না। ভগবান শ্রীহরি কেন মর্তে অবতার নিতে চলেছেন ? এর কারন রূপে কেউ কেউ জয়- বিজয়ের প্রতি সনকাদি মুনিদের অভিসম্পাত , নন্দীর দেওয়া নর বানরের হাতে ধ্বংসের শাপ বা ব্রহ্মার প্রদত্ত নর বানরের হাতে বিনাশের বর প্রদান, বেদবতীর প্রদত্ত অভিশাপ বা রম্ভার অভিশাপকে মুখ্য হেতু মনে করতে পারতেন। যে ভগবান তাই মানব অবতার নিয়েছেন । হ্যা এইগুলো ঠিক । কিন্তু ভগবানের অবতারের দুটি উদ্দেশ্য – অসাধু বিনাশ ও জীবশিক্ষা প্রদান সাথে ভক্ত সঙ্গ । আমরা জানি ভগবান লাভ আমাদের কাছে মূল উদ্দেশ্য । হ্যা ঠিক, যে হরি ভক্ত সে হরিকে, যে শিব ভক্ত সে শিবকে যে দুর্গা ভক্ত সে দুর্গাদেবীর কৃপা প্রাপ্তির জন্যই অচলা ভক্তির পথে চলেন । কিন্তু আমরা কি জানি যে আমরা ভগবান প্রাপ্তির জন্য যতটা ব্যাকুল, ভগবান নিজে শুদ্ধভক্তের সঙ্গ প্রাপ্তির জন্য তাঁর অধিক ব্যাকুল। তিনি শুদ্ধ ভক্ত খুঁজে বেড়ান। তাই ভক্তের জীবনে এত কষ্ট, এই কষ্ট ঈশ্বরের পরীক্ষা। তিনি পরীক্ষা করেন ভক্ত কতটা আঘাত সহ্য করে আমাকে ডাকে, তবেই না সে শুদ্ধভক্ত। ভগবান তখন সেই ভক্তের দাসানুদাস হন। ভগবান বলেন- “যে করে আমার আশ, করি তার সর্বনাশ। যদি না ছাড়ে পাশ, হই তার দাসের অনুদাস।” ভগবান রামের জীবনে আমরা এমন ভক্তের পরিচয় পাবো। তাই তো বলা হয় ভগবানের চেয়ে ভক্ত বড়। ভগবান এমন ভক্তকেই খোঁজেন, এটি তাঁর অবতারের আর একটি উদ্দেশ্য ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।