১৩ মার্চ ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড – ১৭ )

অগস্ত্য মুনির নাম সকলেই শুনেছেন । এই মুনির তপঃ শক্তি ছিলো আশ্চর্য রকম। ব্রহ্মার আরাধনা করে অগস্ত্য মুনি অনেক অলৌকিক দিব্যশক্তি পেয়েছিলেন । একবার উনি সমুদ্রের জল এক গণ্ডূষে পান করেছিলেন বলে পুরাণ শাস্ত্রে লেখা । তিনিই নিজ স্ত্রীরূপে যজ্ঞ থেকে লোপামুদ্রা দেবীকে উৎপন্ন করেন । ব্রহ্মার কৃপা পেয়েও নির্লোভী এই মুনি শাস্ত্র নিয়ম মেনে অরণ্যে কুটিরে থাকতেন । এদের সাথে আজকালকার গুরুদেবের অনেক তফাৎ। আজকালকার যুগে বাজার চলতি করে খাওয়া এক ধরণের গুরুর আবির্ভাব হয়েছে । সামান্য ১০-২০ টা শিষ্য হলেই ধরা কে সরা জ্ঞান করে শিষ্যের টাকায় শ্বেতপাথরের দালান কোঠা নির্মাণ করে মহাভোগে জীবন কাটান । যাই হোক । যক্ষ সুকেতুর কন্যা তাড়কার বিবাহ হয়েছিলো যক্ষ শুণ্ডের সাথে । একদিন গর্ভস্থ অবস্থায় তাড়কা অগ্যস্ত মুনির আশ্রমে আসেন । তাড়কা বলেন- “মহর্ষি আমার জন্য অপূর্ব সুন্দর রাজমহল নির্মাণ করে দিন। শুনেছি আপনি দেবতাদের বরে অনেক চমৎকার ঘটাতে সমর্থ । সেই রাজমহল হবে দ্বিতীয় অমরাবতী । স্বর্গের দেবতারা এই মহল দেখে হিংসায় জ্বলে মরবে।” অগস্ত্য মুনি মানা করে দিলেন। জানালে ঐ সব দাবী তিনি মানবেন না। এসমস্ত কর্মে তিনি যোগশক্তির ব্যবহার করবেন না ।

তাড়কা অনেক আকুতি মিনতি করল । অগস্ত্য মুনি কিছুতেই সম্মত হলেন না । তাড়কা রেগে তখন মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করলেন । আশ্রম তছনছ করে মুনিকে শাসাতে লাগলেন । প্রথমে মুনি চুপ থাকলেও শেষে ক্রোধে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “দুর্মতি নারী। তুই আমার আশ্রম উন্মত্ত রাক্ষসের ন্যায় ধ্বংস করেছিস । তুই তোর গর্ভস্থ সন্তান সহ রাক্ষস হবি। ভগবান হরির হস্তে নিধন হলেই তোদের মুক্তি ঘটবে । ” মুনির শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলল । তাড়কা রাক্ষসী হয়ে তপবনে বেড়াতে লাগলো। রাক্ষসী হবার পর তাড়কার প্রথম আঘাত গিয়ে পড়লো অগস্ত্য মুনির আশ্রমে। মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করে মুনির শিষ্যদের চিবিয়ে ভক্ষণ করল । কৃত্তিবাসী রামায়নে বারংবার লেখা – রাবনের রাক্ষস বাহিনী ও রাক্ষসেরা নর মাংস আহার করতো। মনে হয় আমরা যে “ঠাকুমার ঝুলি” তে রাক্ষসের গল্প পড়েছি সেখানে নর মাংস ভক্ষণের কথা এই রামায়ন থেকেই এসেছে । তাড়কার তাণ্ডবে অগস্ত্য মুনির আশ্রম শ্মশানে পরিণত হোলো। মুনি যজ্ঞ করতে আরম্ভ করলেই রাক্ষসেরা ধেয়ে এসে যজ্ঞে রক্ত, অস্থি, মাংস, চর্বি নিক্ষেপ করতো । এইভাবে যজ্ঞ অপবিত্র করতো । মুনি অগস্ত্য শেষে তাঁর আশ্রম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন । এরপর তাড়কার নেতৃত্বে তার পুত্র মারীচ, সুবাহু নামক এক রাক্ষস ও অনান্য রাক্ষসরা ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক দুটি জনপদে হানা দিতে থাকে । রাক্ষসেরা সেখানে মানুষদের হত্যা করে রক্ত মাংস আহার করতে থাকে । রাক্ষসদের উৎপাত ভয়ানক আকার নেয় । মতঙ্গ মুনির আশ্রমেও তাণ্ডব চলে। মহর্ষি তখন আক্ষেপ করেন যে তিনি কেন বালিকে শাপ দিলেন । এই অবস্থায় বালি এখানে এসে রাক্ষস বধ করতে পারবে না ।

রাবণ এই সংবাদ শুনে খুবুই আহ্লাদিত হয়। অপরদিকে পঞ্চবটিতে রাবণের ভ্রাতা খর ও দূষনের নেতৃত্বে রাক্ষসদের তাণ্ডব আরম্ভ হয় । বালির ভয়ে তারা কিস্কিন্ধ্যাতে না গেলেও আশেপাশে তাণ্ডব শুরু করে। সুদূঢ হিমালয়েও রাক্ষস দের অত্যাচার আরম্ভ হয় কালনেমির মাধ্যমে । ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক রাজ্য ক্রমশঃ রাক্ষসদের আহার হতে লাগলে সেখানকার বেঁচে থাকা লোকেরা কিছু অযোধ্যায়, কিছু কিস্কিন্ধ্যায় আশ্রয় নেয়। পরিত্যক্ত নগরী ধীরে ধীরে জঙ্গল হয় । বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রম রেহাই পায় নি । এমনকি একবার নারদ মুনিকেউ আহার করতে গিয়েছিলো তাড়কার বাহিনী রাক্ষসেরা । নারদ মুনি পালিয়ে মহর্ষি দুর্বাসার আশ্রমে যান। দুর্বাসা মুনি অভিশাপ দিয়ে রাক্ষসদের ভস্ম করেন । বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রমে রাক্ষসদের তাণ্ডব হতে থাকে । গৌতম মুনির পরিত্যক্ত আশ্রমে কাউকে না পেয়ে রাক্ষসেরা বিশ্বামিত্রের আশ্রমে হানা দেয় । বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রোজ তাণ্ডব হোতো। বিশ্বামিত্রের যজ্ঞাদি পণ্ড হত । দেবতাদের সাহায্য চাইলে দেবতারা রাবণের ভয়ে রাক্ষস বধ করতে রাজী ছিলো না । বিশ্বামিত্রের আশ্রমে নারদ মুনি একদা পদার্পণ করলে বিশ্বামিত্র মুনি এর প্রতিকারের কথা জানতে চান । নারদ মুনি বলেন- “এই রাক্ষস দের ধ্বংসকর্তারা বানর রূপে জন্ম নিয়েছে। আর এই রাক্ষসদের ধ্বংস কেবল ভগবান শ্রীহরিই করতে পারবেন । আপনারা সকলে মিলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন।” অপরদিকে রক্তমালা নামক এক রাক্ষসীর হাতে আক্রান্ত হয়ে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর সাহায্য চাইলো । রক্তমালার ঔদ্ধত্য , তাড়কাকেউ ছাড়িয়ে গেছিলো। ভগবান বিষ্ণু একদা ছদ্দবেশে রক্তমালার হাতে আক্রান্ত তপবনে আসলেন ছদ্দবেশে। মুনির ছদ্দবেশে হরিকে দেখে রাক্ষসী রক্তমালা তাকে ভক্ষণ করতে আসলো। ভগবান নারায়ণ তখন সুদর্শন চক্রে রক্তমালার বধ করলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।