প্রকৃতিকে দেবীরূপে ভজনা- এই বিশ্বাস, সাধনা, দর্শন ও আরাধনার সমস্ত প্রক্রিয়াকে আমরা একত্রে বলতে পারি- ‘তন্ত্র’। যে তান্ত্রিক বিশ্বাসের উন্মেষ হয়েছিল নিষাদদের ধর্মীয় চেতনায়, নিষাদদের মাতৃতান্ত্রিক ধর্মীয় ভাবনায়। কাজেই তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলায়। এই দেবী বাঙালিসমাজে ‘শক্তি’ দেবী নামে পরিচিতা। যারা শক্তি দেবীর উপাসনা করেন তারাই ‘শাক্ত’ বলে পরিচিত। ধর্মতত্ত্বের ভাষায় -- শাক্ত-তান্ত্রিক। শক্তিদেবী অবশ্য বাঙালিসমাজে আরও নানা নামে পরিচিতা। তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিওরি নয়, প্র্যাকটিস্।
তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
নিষাদদের কৌম (গোত্রীয়) সমাজটির গড়ন ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজবিকাশের অনিবার্য নিয়মে প্রথমে নিষাদসমাজ ছিল শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী। তারা বাংলার প্রাচীন অরণ্যে ফলমূল কুড়োত। পরে হাতিয়ারের উন্নতি হল; তারা বনভুমি কেটে জমি চাষ করতে থাকে। এভাবে ওদের কৃষি জীবনে উত্তরণ ঘটে । তবে অনুন্নত হাতিয়ারের (টুলস) কারণে কৃষিজীবন ছিল ভারি অনিশ্চিত। ওদিকে গোত্রের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। কাজেই প্রকৃতির কৃপার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কী!
সেই আদিম নিষাদসমাজটি মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলেই প্রকৃতিকে তারা ‘চৈতন্যময়ী’ ভেবেছিল। তারা নারীকে জগতের আদি কারণ বলেও ভাবল কাজেই অদৃশ্য প্রকৃতিক শক্তিটি ওদের আদিম মনে একজন দেবী হিসেবে প্রকাশ পেলেন, দেবতা হিসেবে নন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পূর্বে শিব ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধানতম অনার্য দেবতা। একইভাবে, প্রাচীন বাংলাতেও আর্যরা আসার পূর্বে শিব ছিলেন প্রধানতম অনার্য দেবতা। যে কারণে প্রকৃতিকে দেবী কল্পনা করলেও শিবের গুরুত্ব এতটুকু কখনওই হ্রাস পায়নি।
তন্ত্রের প্রধান একটি সিদ্ধান্তই হল এই যে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা।
কিন্তু, শক্তি কি?
বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার। যে শক্তিকে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আধুনিক সভ্যতা এই মূলতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সূত্র আবিস্কার করে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক এই প্রশ্নও তো আজকাল উঠছে । এই দৃষ্টিভঙ্গি হটকারী কিনা, পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে এই দর্শন সক্রিয় কিনা- এসব প্রশ্নও নিয়েও তো আমরা আজ উদ্বিগ্ন।
তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।
চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী কালী- বাসুলী – তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে “শিবত্ব” লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।
(c) Prithwish Ghosh
তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
নিষাদদের কৌম (গোত্রীয়) সমাজটির গড়ন ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজবিকাশের অনিবার্য নিয়মে প্রথমে নিষাদসমাজ ছিল শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী। তারা বাংলার প্রাচীন অরণ্যে ফলমূল কুড়োত। পরে হাতিয়ারের উন্নতি হল; তারা বনভুমি কেটে জমি চাষ করতে থাকে। এভাবে ওদের কৃষি জীবনে উত্তরণ ঘটে । তবে অনুন্নত হাতিয়ারের (টুলস) কারণে কৃষিজীবন ছিল ভারি অনিশ্চিত। ওদিকে গোত্রের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। কাজেই প্রকৃতির কৃপার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কী!
সেই আদিম নিষাদসমাজটি মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলেই প্রকৃতিকে তারা ‘চৈতন্যময়ী’ ভেবেছিল। তারা নারীকে জগতের আদি কারণ বলেও ভাবল কাজেই অদৃশ্য প্রকৃতিক শক্তিটি ওদের আদিম মনে একজন দেবী হিসেবে প্রকাশ পেলেন, দেবতা হিসেবে নন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পূর্বে শিব ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধানতম অনার্য দেবতা। একইভাবে, প্রাচীন বাংলাতেও আর্যরা আসার পূর্বে শিব ছিলেন প্রধানতম অনার্য দেবতা। যে কারণে প্রকৃতিকে দেবী কল্পনা করলেও শিবের গুরুত্ব এতটুকু কখনওই হ্রাস পায়নি।
তন্ত্রের প্রধান একটি সিদ্ধান্তই হল এই যে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা।
কিন্তু, শক্তি কি?
বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার। যে শক্তিকে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আধুনিক সভ্যতা এই মূলতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সূত্র আবিস্কার করে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক এই প্রশ্নও তো আজকাল উঠছে । এই দৃষ্টিভঙ্গি হটকারী কিনা, পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে এই দর্শন সক্রিয় কিনা- এসব প্রশ্নও নিয়েও তো আমরা আজ উদ্বিগ্ন।
তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।
চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী কালী- বাসুলী – তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে “শিবত্ব” লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।
(c) Prithwish Ghosh
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন