১৬ জুন ২০১৬

রামায়ন কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব – ৪)


সন্ধ্যা হতেই রাবণ রানী গণ শোভিত হয়ে উদ্যানে আসলেন। এক আড়ম্বর শোভাযাত্রা ছিলো। শত শত রাক্ষসেরা ধ্বজ, নিশান নিয়ে দামামা, ভেরী, তুড়ি, শিঙা বাজিয়ে আসতে লাগলেন । সীতাদেবী বুঝলেন যে রাবণ আসছে। তিনি হস্তে দূর্বা ধারন করলেন । দেবকন্যা, গন্ধর্ব কন্যা, অপ্সরা গণ শোভাযাত্রার আগে আগে পবিত্র ঘট থেকে সুগন্ধি বারি দিয়ে আম্রপল্লব দ্বারা পথে জল সিঞ্চন করছিলো। অতি সুন্দর দেবকন্যারা রাবণের দুপাশে সাড়ি সাড়ি অবস্থিত হয়ে চামর, পাখা ব্যাঞ্জন করছিলো । রাবণের জয়ধ্বনিতে লঙ্কার রাজপথ ভরে গেলো। হনুমান ভাবল এবার দেখা যাক রাবণের স্বরূপ । রাবণ ও তার শত রানী সোনা, হীরা, মাণিক্য দ্বারা সুগঠিত অলঙ্কারে সুসজ্জিত ছিলেন। সেই অলঙ্কার থেকে এমন দ্যুতি নির্গত হচ্ছিল্ল যেনো মনে হচ্ছিল্ল বিঁধুদেব, নক্ষত্রমালার মাঝে অবস্থিত ছিলেন । রাবণ এসে অশোকবাটিকায় সীতার সামনে দাড়ালেন। রাবণ অট্টহাস্য করে বলল- “হে সুমুখী! চন্দ্রমুখী সীতা! একবার তোমার মুখমণ্ডল দেখতে চাই। কেন তুমি আমার সম্মুখে অধোমুখে থাকো? কেনই বা আমাকে বিবাহ করছ না? তুমি কেন তোমার সৌভাগ্যকে পদদলিত করছ? এসো। আমার সহিত আমার রাজবাটিতে চলো। আমাকে বিবাহ করে এই সুখ ঐশ্বর্য ভোগ করো। দেখো আমার আশ্রিতা এই দেবকন্যা, গন্ধর্ব কন্যারা সব তোমার দাসী হয়ে থাকবে। ত্রিলোকের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কারে তোমার সুন্দর বদন আচ্ছাদিত থাকবে। তোমাকে দেখে ইন্দ্রপত্নী শচীদেবীও লজ্জা পাবেন। হে সুন্দরী ! এসো আমার সহিত। ভুলে যাও তোমার ভিক্ষুক স্বামী রামকে। সে তোমাকে দুঃখ ব্যতীত কিছুই দেয় নি। আমি তোমাকে সকল প্রকার সুখ প্রদান করবো। আমার এই শত রানী তোমার দাসী হবে।” এই বলে রাবণ সীতাদেবীকে নানা প্রলোভন দেখাতে লাগলো।

সীতাদেবী ঘৃনা ভরে বলল- “ওরে দুর্মতি! জোনাকীর আলোকে কদাপি পুস্প ফোটে না । সেটা তোর সম্বন্ধেও প্রযজ্য । এই সীতা নামক পুস্প কেবল শ্রীরামের আলোকেই প্রস্ফুটিত হয় । ওরে পাপী। তোর কথা কর্ণে প্রবেশ করাই আমার সবথেকে বড় দুর্ভাগ্য । নির্লজ্জের মতোন আমাকে হরণ করে এনে, স্ত্রীদের মাঝে অবস্থান করে নিজেকে বীরপুঙ্গব বলিস? তোর বীরত্বে ধিক! লজ্জাহীন, কাপুরুষের এমন আড়ম্বর শোভা পায় না । তুই আমার স্বামী রঘুপতিকে ভয় পাস। কদাচিৎ তোর ভ্রাতা খড় আর দূষনের অন্তিম পরিণতি শুনে তুই ওঁনাকে ভয় পেয়েছিস- তাই যুদ্ধ না করে সাধুর বেশে আমাকে হরণ করলি! শ্রীরামের শর থেকে তোরও মুক্তি নেই । সবংশে নিপাত হবি।” এই শুনে রাবণ ক্রোধে উগ্র হল। দশ মস্তকের কুড়ি নয়ন বড় বড় হয়ে দাঁত কটমট করতে লাগলো। সবার সামনে এত অপমান! তরবারি নিয়ে রাবণ , সীতাকে কাটতে গেলো । মন্দোদরী বলল- “আর কত নীচে নামবেন প্রভু! এমনিতেই নারী অপহরণ করে আপনার কলঙ্ক হয়েছে। এর ওপর নারী হত্যা করলে আপনার আরোও অপযশ হবে । নারী হত্যা নিন্দনীয় কাজ ।” এইভাবে মন্দোদরী রাবণকে নিরস্ত্র করলো । তখন রাবণ বলল-

মাস দিবস মহুঁ কহা ন মানা।
তৌ মৈঁ মারবি কাঢ়ি কৃপানা ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

সীতার কথা শুনে রাবণ ক্রোধে বলল- “ওহে সীতা! তোমার বড় জেদ। এই জেদ আমি ভাঙ্গবো। এক মাস তোমাকে সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি আমার প্রস্তাবে সায় না দাও, তবে আমার রাক্ষসী সেনারা তোমাকে কেটে ভক্ষণ করবে।” এরপর দশানন রাবণ রাক্ষসী চেড়িদের আদেশ দিলো সীতাকে নানাভাবে ভয় দেখাতে । দেখুক রাক্ষসদের বিক্রাল রূপ । শুনে সীতাদেবী বললেন- “দুর্মতি রাবণ! তুই আমাকে একমাস সময় কি দিবি? যম তোকে আর মাত্র একমাস আয়ু দিয়েছে। যত পারিস সুখ ভোগ করে নে। কারন এরপর রঘুবীরের শর তোকে যমালয়ে পৌছে দেবে।” কৃত্তিবাসী রামায়নে আবার অন্যরকম লেখা। যথা-

এত যদি সীতাদেবী বলিলেন রোষে ।
মনে সাত পাঁচ ভাবে রাবণ বিশেষে ।।
আসিবার কালে আমি বলেছি বচন ।
এক বর্ষ জানকীরে করিব পালন ।
বৎসরের তরে তোকে দিয়াছি আশ্বাস ।
বৎসরের মধ্যে তোর যায় দশ মাস ।।
সহিবেক আর দুই মাস দশস্কন্ধ ।
দুই মাস গেলে তোর যে থাকে নির্বন্ধ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

কৃত্তিবাসী রামায়নে এখানে দুমাসের কথা বলা হয়েছে । যাই হোক রাবণের আদেশে চেড়ীরা ভয় দেখাতে লাগলো । বিকট চেহারার রাক্ষসীরা সব দেখতে ক্রুর ছিলো। কুৎসিত ভয়ানক মুখ, হাতের নখ তীক্ষ্ণ, তীক্ষ্ণ দন্ত । তাহাদের অট্টহাস্য শুনলে থরথর করে কাঁপতে হয় । অগ্নির ভাটার মতো তাদের চোখ । হস্তী, অশ্ব, শ্বাপদ, শৃগালের মতো কাহারো কাহারো মুখ । রাতের অন্ধকারে সেই নিশাচরী রাক্ষসীরা বীভৎস রূপ ধরে সীতাকে ভয় দেখাতে লাগলো। সীতাদেবী ভয় না পেয়ে দুঃখিত হয়ে বিলাপ করে বলতে লাগলো- “হা ঈশ্বর! আমার মরণ হয় না কেন ? কেন এই অশোক বৃক্ষের শাখা আমার মস্তকে পড়িতেছে না। হে অশোক! তুমি আমার শোক নিবৃত্তি করো। চন্দ্রের জ্যোৎস্না আকাশে অগ্নিসম – হে চন্দ্র আমার উপর অগ্নি বর্ষণ করো। এই জীবন আর রাখিতে চাই না।” এই বলে সীতাদেবী বিলাপ করে রোদন করতে লাগলেন । ত্রিজটা রাক্ষসী এসে অনান্য রাক্ষসীদের এক সত্য ঘটনা বলল। ত্রিজটা বলল- “তোমরা একে এত কষ্ট দিও না! তোমরা জানো না এই সতী নারীর স্বামী কতটা শক্তিমান । আমি এক স্বপ্নে দেখেছি। সেই স্বপ্ন শুনলে তোমরাও ভয় পাবে। দেখলাম একজন বানর এসে লঙ্কা নগরী আগুনে ভস্ম করেছে। তারপর দেখলাম এই সীতার স্বামী রামচন্দ্র এসে সব রাক্ষসদের বিনাশ করেছে। এমনকি লঙ্কারাজ রাবন কে গর্দভের পীঠে চেপে ছিন্নস্কন্ধ হয়ে দক্ষিণ দিকে যেতে দেখলাম। আর দেখলাম এর স্বামী রাম এখানে এসে একে নিয়ে যাচ্ছে। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। তোমরা একে কদাপি কষ্ট দিও না। তখন কিন্তু রামচন্দ্র তোমাদের দণ্ডিত করবেন।” এই শুনে রাক্ষসীরা সীতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। ত্রিজটা এইভাবে সীতাকে বুঝিয়ে চলে গেলো। হনুমান গাছ থেকে সব শুনছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল্ল গদা দিয়ে রাবণের মুখ চূর্ণ করতে। কিন্তু রামচন্দ্রের আদেশে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছিলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।