১৫ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( অরণ্যকাণ্ড পর্ব- ১৫ )


এইদিকে দশানন রাবণ পুস্পক বিমানে সুন্দরী সীতাকে নিয়ে যাচ্ছিল্লেন। সীতাদেবী অনেক অনুনয়- বিনয় করলেও রাবণের মন নরম হল না। সীতাদেবী বনের দেবদেবী, স্বর্গের দেবদেবী , পশু পক্ষীদের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু রাবণের ভয়ে তারা আর কি করে। বহুবার সীতা রাম- লক্ষণ কে ডাকলেন। কিন্তু তিনি জানেন রামচন্দ্র, লক্ষণ এইস্থান থেকে অনেক দূরে। এই কাকুকি মিনতি তাঁদের নিকট পৌছাবে না। কিন্তু দশরথের বন্ধু জটায়ু পক্ষী সীতার আর্তনাদ শুনলেন । বৃদ্ধ পক্ষী ঠিকঠাক আকাশে উড়তে না পারলেও সাহসে ভড় করে পাখসাট মেরে আকাশে গেলেন। জানকী দেবী তাঁকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে বললেন- “তাত! এই পাপী আমাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি আপনার মিত্র স্বর্গীয় দশরথ রাজার পুত্রবধূ। সম্পর্কে আপনি আমার শ্বশুর। কৃপা করে এই অভাগা নারীকে রক্ষা করুন।” জটায়ু তখন রাবনের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো । রাবণ সেই বৃদ্ধ পক্ষীর ওপর বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলো। কিন্তু গড়ুর পুত্র জটায়ু তাঁর বিশাল পঙ্খ দ্বারা রাবণের নিক্ষেপিত শর গুলো বিতস্তিত করে এদিক ওদিক ফেলে দিলো। জটায়ু উড়ে এসে রাবণের মস্তক, স্কন্ধে ধারালো নখ ও চঞ্চু দ্বারা আঘাত করতে লাগলো। রাবণের রক্ত বৃষ্টির ন্যায় ধরিত্রীর বুকে পতিত হতে লাগলো। দশ মস্তক ক্ষতবিক্ষত হল। এইদেখে সীতাদেবী আনন্দিত হলেন। রাবণ তখন দশটি শর নিক্ষেপ করলে জটায়ু পাখা দিয়ে শরগুলিকে নিস্ক্রিয় করে দিলো। জটায়ু যখন বিশাল ডানা মেলে রাবণের রথের ওপর বিচরণ করছিলো, তখন সূর্য ঢাকা পড়ে ছায়া সৃষ্টি হল। জটায়ু রাবণের ধনুক খন্ডখণ্ড করে দিলো। রাবণ আরোও একটি ধনুক নিতেই জটায়ু সেটিও খণ্ডখণ্ড করে সীতাদেবীকে ক্রোড়ে নিয়ে ভূমিতে নেমে আসলো। রাবণ পিছু পিছু রথ নিয়ে ভূমিতে নামলো ।

জটায়ু রাবণের রথ খণ্ড খণ্ড করে দিলেও, রাবণ মায়াবলে রথ জোড়া লাগিয়ে পুনঃ জটায়ুর সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো তরবারি হাতে নিয়ে । রাবণ তরবারি নিয়ে জটায়ুকে দারুনভাবে আহত করলো। রাবণের তরবারির আঘাতে জটায়ুর এক পাশের পঙ্খ কেটে আলাদা হয়ে গেলো। বৃদ্ধ জটায়ু আর কি করেন । অপর পাঙ্খা ছিলো, সে লম্ফ দিয়ে ঐ এক ডানাতে স্বল্প ভড় দিয়ে রাবণের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো। রাবণ অপর পঙ্খ টাও কেটে দিলো, এরপর তরবারি দিয়ে জটায়ুকে বারংবার আঘাত হানলো । ভীষণ আহত হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে লাগলেন । আফশোষ করে বলতে লাগলেন- “পুত্রী সীতা! তোমায় আমি বাঁচাতে পারলাম না। কিন্তু রামচন্দ্রকে এই সংবাদ আমি অবশ্যই দেবো যে লঙ্কারাজ রাবণ তোমাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে।” রাবণ আবার জানকী দেবীকে রথে তুলে আকাশে উঠে লঙ্কার উদ্দেশ্যে চললেন। সীতাদেবী ভাবলেন একবার লম্ফ দিয়ে আত্মহত্যা করে নিস্কৃতি পাই। পড়ে ভাবলেন আত্মহত্যা মহাপাপ। রাবণের আস্ফালন দেখে সীতাদেবী কুপিতা হয়ে পুনঃ অভিশাপ দিলেন – “নীচ! পাপী! তোর ন্যায় নির্দয় ব্যাক্তি ত্রিভুবনে নেই। আমি শাপ দিচ্ছি খুব শীঘ্র তুইও জটায়ুর ন্যায় ভূমিতে আহত হয়ে মৃত্যুকে বরন করবি, আজ তুই যেরূপ আনন্দ করছিস নীরিহ জটায়ুকে মেরে- সেইদিন ত্রিলোকে সবাই তোর শোচনীয় অবস্থা দেখে আনন্দে হর্ষ ধ্বনি করবে। আর তোকে সেই সর্বনাশের আগুনে নিক্ষেপ করবেন স্বয়ং আমার স্বামী রামচন্দ্র। তুই আমাকে নয় – লঙ্কার বিনাশকে রথে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিস।” রাবণ এসব শুনলোই না। আনন্দে সে বলল- “হে সীতা! তুমি যত ইচ্ছা অভিশাপ দাও, আমার কিছুই হবে না। পর্বতে যেমন একটি ক্ষুদ্র প্রস্তর নিক্ষেপ করলে, পর্বতের কিছুই হয় না তেমনি তোমার শাপে আমার কিছুই হবে না।” এরপর পুস্পক বিমান এর সামনে এসে দাঁড়ালো সুপার্শ্ব পক্ষী । বিশাল সেই পক্ষীর আকৃতি দেখে রাবণ ভয় পেলো না। সে পক্ষী জানালো সীতাকে মুক্ত করতে। কিন্তু দশানন রাবণ নারাজ। বলল- “ওহে সুপার্শ্ব! এই সীতার স্বামী রামের আদেশে, রামের ভ্রাতা লক্ষণ আমার ভগিনী শূর্পনাখাকে বিকৃতা করেছে। তাই সীতাকে আমি লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে প্রতিশোধ নেবো। ওহে পক্ষী আরোও শোন, জটায়ু এই কাজে বাধা দিতে এসে আমার হাতে মারা পরেছে। তোর সহিত আমার কোন শত্রুতা নেই। তাই তুই এসবে জড়াস না। অন্যত্থায় তোর পরিণতিও জটায়ুর ন্যায় হবে।”

সুপার্শ্ব পক্ষী চলে গেলো। কিছু সময় পড়ে সীতাদেবী দেখলেন একটি পর্বতের ওপর কিছু কপি আছে। এই স্থানে বানর দেখে অবাক । সেটা ছিলো ঋষমূক পর্বত। মাতা সীতা ভাবলেন এই বানরেরা যদি প্রভু রামকে সংবাদ দিতে পারে । এই ভেবে সীতাদেবী শরীর থেকে অলঙ্কার খুলে নীচে ফেলে দিলেন। মস্তকের টিকলি, চূড়া, কানের কুণ্ডল, হস্তের বালা, বন্ধনী, নুপূর, নাকছাবি সব ফেলে দিলেন। আকাশ থেকে অলঙ্কার পড়তে দেখে বানরেরা অবাক। কেউ যেনো কোন নারীকে রথে নিয়ে যাচ্ছে। সেই রমণী কাতর স্বরে সাহায্য চাইছে। বানরেরা সমস্ত অলঙ্কার গুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিয়ে সুগ্রীবকে দেখাতে গেলেন । কিছু সময় পর সীতাদেবীকে নিয়ে রাবণ ভারতবর্ষের শেষ প্রান্তে এলেন- যেখান থেকে সমুদ্র শুরু। সমুদ্র তটে সম্পাতি পাখী বসে দেখছিলেন রাবণ একজন নারীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে লঙ্কার দিকে। কিন্তু সম্পাতির এক ডানা বহু আগে সূর্যের তেজে ভস্ম হয়েছে। সেই থেকে মুক্তির জন্য সে রাম নাম জপ করছে। সম্পাতি এই জানে না যে রাবণ ইতিপূর্বে তার ভ্রাতা জটায়ুকে হত্যা করে এসেছে। সম্পাতি আর কোন প্রকার সাহায্য করতে পারলো না। সমুদ্রের বড় বড় ঢেঊ, তিমি- হাঙর- মকর দেখে সীতাদেবী ভয় পেলেন । কাতর কন্ঠে সমুদ্র রাজ রত্নাকরের কাছে সাহায্য চাইলেন । কিন্তু রাবণের ভয়ে রত্নাকর কি আর সাহায্য করে। রাবণ বলল- “হে সুন্দরী! রাবণের হাত হতে তোমার নিস্তার নেই। অতএব সকল খেয়াল ভুলে আমাকে বিবাহ করো। মনে করো তোমার নবজন্ম হয়েছে। এখন আমার প্রধানা রাণী হয়ে ত্রিলোকের সকল সুখ ঐশ্বর্য ভোগ করো।” সীতাদেবী ঘৃনা ভরে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে রাবণের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় ও সাবধান করলেন। রাবণ শুনলো না। পুস্পক রথ নিয়ে সীতা সমেত লঙ্কায় নামলেন । বিকট চেহারার লঙ্কার রাক্ষস রাক্ষসী দেখে সীতাদেবীর ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হল।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।