লঙ্কাতে অশোকবনে সুমিষ্ট ফলমূলে ভরা প্রচুর বৃক্ষ ছিলো। আর ছিলো নানা দিব্য সুগন্ধি পুস্পের গাছ। রাবণ আয়ুর্বেদ জানতো। সেই অশোকবনে অনেক আয়ুর্বেদিক ভেষজ উদ্ভিদ ছিলো । সুন্দর রম্য এই উদ্যান দেখে দেবতাদেরও ঈর্ষা হতো। বোধ হয় রাবণ দ্বিতীয় নন্দনকানন বানিয়েছিলো। বিকট চেহারার রাক্ষসীরা সর্বদা সীতাকে কটু কথা, গালাগালি, রাম- লক্ষণের নিন্দা ও রাবণকে বিবাহ করবার কথা জানাতো । সীতাদেবী সেসকল শুনে কেবল রোদন করতেন, আর মনে মনে রামচন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করতেন, তিনি যেনো শীঘ্র এসে তাহাকে নিয়ে যান । রাক্ষসীদের মধ্যে ত্রিজটা নামক এক বয়স্ক রাক্ষসী চেড়ি ছিলো। সে জাতে রাক্ষসী হলেও, অনান্য রাক্ষসী অপেক্ষা উদার ছিলো । সীতাকে সে কন্যার মতো আগলে রাখতো। সীতাও যেনো এই অরণ্যে ত্রিজটার মধ্যে নিজ মাতা সুনয়নাকে দেখতে পেয়ে, তাঁরই সাথে সকল কথা ভাগ করে নিতো। রাবণকে তার ধার্মিক ভ্রাতা বিভীষণ অনেক বোঝালো যে – “দাদা আপনি কেন এরূপ অশুভ ও নিন্দনীয় কর্ম করলেন? আপনার নামে ত্রিলোকে অপযশ ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্বলা নারীজাতির ওপর এইরূপ অত্যাচার করে আপনি কেবল কুখ্যাতি সংগ্রহ করেছেন। আপনি শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ, আয়ুর্বেদের বহু ঔষধি জানেন। আপনি পরম শিবভক্ত। বসন্ত ঋতুতে আপনি সকল শাস্ত্রীয় বিধানে দুর্গাপূজা করে থাকেন । তবে কেন এইসকল পাপ কর্মে নিযুক্ত হলেন ? আপনি যে শুভ উদ্যোগ নিয়েছিলেন যে ধরিত্রী থেকে স্বর্গে যাত্রার সিঁড়ি তৈরী করবার- যাতে সমগ্র মানব মৃত্যুর পর অনায়েসে স্বর্গযাত্রা করতে পারে, সেই কাজ সম্পূর্ণ না করে কেন এইহেন পাপ কর্ম করে বসলেন ?” রাবণ বিভীষণের কথা বিন্দুমাত্র না শুনে আস্ফালন করতে লাগলো। তাঁর প্রবল ইচ্ছা সীতাকে বিবাহ করবার । বিভীষণের কোন কথা না শুনে বলল- “সীতার ন্যায় অমূল্য মণি কেবল রাবণের কণ্ঠেই শোভা পায়, ভিক্ষুক রামের নয়।” শূর্পনাখা গিয়ে দিবারাত্র সীতাকে গালমন্দ করে বলতো – “তোর স্বামীর আদেশে তোর দেবর আমাকে এইরূপ কুরূপা করেছে। এখন তোর এরূপ অবস্থা দেখে আমি অতি আনন্দ পাচ্ছি। তোর নিকটে সুবর্ণ সুযোগ আছে। ভ্রাতা দশানন কে বিবাহ করে সুখ ভোগ কর।”
সীতাদেবী ঘৃনায় সেই বিবাহের প্রস্তাব পদাঘাত করলেন । বললেন- “রঘুবীর আমার আত্মা। তিনি এই সীতা নামক পুস্পের শোভা। রঘুবীর এই সীতার সমস্ত অঙ্গ জুড়ে আছে। এই মন্দিরে কেবল দেবতা রঘুবীর। অপর কেহ নন।” দশানন এসে সীতাদেবীকে বললেন- “হে সীতা ! এত বিষণ্ণ কেন? আমাকে বিবাহ করো। ত্রিলোকে সকল ঐশ্বর্য ভোগ করো। এই মণি, মুক্তা, অলঙ্কার, হীরা সব তোমার। আমার ন্যায় বীরপুরুষকে বরণ করে নিজের সৌভাগ্যের পথ উন্মোচন করো।” সীতামাতা হাস্য করে বললেন- “দুষ্ট রাবণ! নিজেকে বীর বলিস? হরধনু তুলবার সময় তোর সেই বীরত্ব কোথায় ছিলো ? তোর বিফলতা দেখে সকলে হাস্য করেছে । নিজেই নিজেকে বীর বলিস, তাহলে আমার স্বামী, দেবরের অনুপস্থিতিতে এক সাধুর বেশে কেন আমাকে হরণ করলি ? যদি এতই সাহসী বীর হতিস, তাহলে আমার স্বামীকে যুদ্ধে পরাজিত করে আমাকে নিয়ে আসতিস । শৃগালের মুখে যেমন বীরত্ব মানায় না, গর্দভের মুখে যেমন পাণ্ডিত্য মানায় না, তেমনি এক তস্করের মুখে বীরত্বের কথা মানায় না।” রাবণ ক্রোধে বলল- “আমাকে অপমান ! এখুনি তোমাকে বলপূর্বক বিবাহ করবো।” সীতাদেবী তখন ভূমি থেকে একটি দূর্বা তুলে বললেন- “হে রাবণ! তুমি আমার সতীত্ব তেজ জানো না! এই দূর্বা আমার সতীত্ব রক্ষা করবে। সমুদ্র মন্থনের সময় কূর্মরূপী ভগবান নারায়নের অঙ্গ থেকে এই দূর্বা প্রকট হয়েছিলো।” রাবণ সীতার দিকে হাত বাড়াতে গেলে সীতাদেবীর চারপাশে ভীষণ অগ্নিবলয় সৃষ্টি হল। প্রলয় স্বরূপ সেই অগ্নি বলয় যেনো রাবণকে ভস্ম করে দেবে, এই লঙ্কা যেনো ভস্ম হয়ে বাতাসে মিশে যাবে । এত তেজ এই অগ্নির। প্রচণ্ড শিখা যেনো দাবানল হয়ে অশোকবাটিকা শ্মশান করে দেবে। রাবন কোন মতেই সীতাকে স্পর্শ করতে পারলো না। এমনই সেই অগ্নির তেজ। সম্মুখে দাঁড়ালে মনে হয় শরীর যেনো আগুনে ঝলসে যাবে। সীতা বলল- “রাবণ! তুমি সতী নারীর তেজ সম্পর্কে অবগত নও । মাতা অনুসুয়া সতীত্ব বলে স্বয়ং ত্রিদেবকে শিশু বানিয়ে রেখেছিলেন। দেবী নর্মদার সতীত্ব তেজে সূর্যদেব আচ্ছন্ন হয়েছিলো। দেবী সাবিত্রীর সতীত্ব তেজে স্বয়ং যমরাজ পরাজিত হয়েছিলেন- তো তুমি তো সামান্য ভীরু রাক্ষস মাত্র। চাইলে আমার সতীত্ব তেজে তোমাকে এই লঙ্কাকে এখুনি ভস্ম করতে পারি। কিন্তু আমি চাই তোমার নিধন আমার স্বামী রঘুবীরের হস্তে হোক। এতে তাঁর সম্মান বৃদ্ধি পাবে। স্ত্রীর কাছে তাঁর স্বামী সবথেকে বড় অলঙ্কার। আমার স্বামীর সম্মান, খ্যাতি বৃদ্ধি হলে আমি খুশী হবো।”
মন্দাদোরী ভীত হয়ে স্বামীকে বলল- “আপনি প্রত্যক্ষ করেছেন মহাসতী সীতার সতীত্ব তেজ। সেই সতীর তেজে লঙ্কায় নানা অঘটন ঘটতে পারে। একবার ভালোভাবে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করুন, দেখুন চারিধারে কেমন সব অশুভ চিহ্ন । স্বপ্নে আমি মহাকালীকে লঙ্কার বুকে তাণ্ডব করতে দেখেছি। এমন না হোক সীতার কারণে আপনার ক্ষতি হোক। সীতাকে সসম্মানে , তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিন।” মন্দাদোরীর কথায় রাবণ অতীব ক্রোধিত হয়ে বলল- “ত্রিলোকবিজয়ী দশানন রাবণ ঐ ভিখারী বনবাসীর ভয়ে কদাপি ভীত হয় না। আমি ঐ সীতাকে বিবাহ করবোই । দেখি কতদিন সে কষ্টে থাকতে পারে। আমার ভয়ে দেবতারা থরথর করে কাঁপে। আমার রাজ্যের রাক্ষসেরা নরমাংস আহার করে। নবগ্রহ এমনকি শণি পর্যন্ত আমার নিকট বন্দী। আমি ঐ তুচ্ছ নরের ভয়ে সীতাকে ফিরিয়ে দেবো?” এই বলে রাবণ অট্টহাস্য করতে লাগলো। রাম লক্ষণ অপরদিকে বনে দক্ষিণ দিকের ঋষমূক পর্বতের দিকে এগিয়ে গেলো। সামনে পম্পা সরোবর। অতীব মনোরম পরিবেশ সেখানে রচিত হয়েছে । সরোবরের মধ্যে পদ্ম, শালুক ফুটে আছে। পদ্মের মধুর আকর্ষণে অলিকুল সেই দিকেই ধাবমান হয়েছে। চতুর্দিকে কেবল মধুর পক্ষীর কলরব। পুকুরের জলে মাছেরা খেলা করছে। বক, সারস, মাছরাঙা , ডাহুক ইত্যাদী পক্ষীরা মাছ ভক্ষণ করছে । রাজহাঁসেরা পুকুরের জলে সাঁতার দিচ্ছে। চতুর্দিকে বনের শীতল ছায়া আর ঋষমূক পর্বত দেখে বয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া এই পরিবেশকে মধুর করে তুলেছে। ঠাণ্ডা হাওয়াতে বুক ভরে শ্বাস নিলে নানান বনজ পুস্পের মিষ্টি সুবাস পাওয়া যায় । সেখানে রাম লক্ষণ স্নানাদি সেড়ে, সূর্য বন্দনা করলেন। তারপর রওনা হলেন মতঙ্গ মুনির আশ্রমের দিকে। সেখানে শবরী নামক এক সাঁওতাল বৃদ্ধা থাকতো। তিনি ছিলেন ভগবান রামের পরম ভক্ত ।
আজ মাতা সীতাদেবীর আবির্ভাব তিথি। এই দিনটিকে সীতানবমী বলা হয়।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন