১৬ জুন ২০১৬

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব – ৫)

রাতের অন্ধকার চতুর্দিকে । জোনাকী পোকার সাড়ি অশোক বনে ফুলে ফলে সজ্জিত ডালাপালায় খেলা করে মিটিমিটি জ্বলছে। যেনো তারকামালার সাড়ি বসেছে । রাক্ষসীরা সকলে অতি উচ্চ বীভৎস শব্দে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে নাসিকা গর্জন করে ঘুমাচ্ছে । কেবল সীতা মাতা একাকী বসে ক্রন্দন করে ভগবান রামচন্দ্রকে স্মরণ করে বলছেন- “হে প্রভু! মম নাথ! তুমি কবে এই অভাগিনী জানকীকে কৃপা করবে। কবে এই পাপ নগর থেকে আমি মুক্তি পাবো। হে নাথ! দয়া করে এসে আমাকে নিয়ে যান।” হনুমান দেখলো এই সুবর্ণ সুযোগ । এই সময়ে কেউ কোথাও নেই। নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। এই ভেবে হনুমান বৃক্ষ থেকে লম্ফ দিয়ে নীচে নামলো। স্বাভাবিক রূপে এসে বলল- “মাতঃ! আমার প্রনাম গ্রহণ করুন। আমি আপনার পুত্র তথা প্রভু শ্রীরামের দূত হনুমান।” সীতা এই সমুদ্র পাড়ে দ্বীপে হনুমানকে দেখে অবাক হল। আশ্চর্য হয়ে ভাবল এই স্থানে কি ভাবে উনি দূত পাঠাবেন । এ নিশ্চয়ই রাবণ হবে। মর্কট বেশে ছলনা করতে এসেছে। যে সন্ন্যাসী বেশ ধরে ছলনা করতে পারে সে সব পারে। সেই নির্দয় , ধর্ষক , নারীলোলুপ জঘন্য দশানন রাবণ সকল প্রকার পাপেই সিদ্ধহস্ত। সীতাদেবী ক্রোধে বললেন- “মূঢ়মতি রাবণ! তুমি পুনঃ কপির রূপ ধরে আমাকে ছলনা করতে এসেছো ? রাবণ তোমার মায়া এবার ধরতে পেরেছি। আর তুমি ছলনা করতে পারবে না। পাপীষ্ঠি! তোর লজ্জা, বিবেক বোধ কি সমুদ্র দেব তার স্রোতে ধুয়ে নিয়ে চলে গেছে। জগতের সব থেকে নিকৃষ্ট প্রানী তুই। চলে যা এখান থেকে।” হনুমান বলল- “মাতঃ! আপনার সন্দেহ স্বাভাবিক। এই রাক্ষসেরা মায়া দ্বারা যেকোন রূপ ধরতে পারঙ্গদ। কিন্তু মা বিশ্বাস করুন, আমি পাপী রাবন নই । আমি বৃক্ষের ওপরে থেকে সব দেখেছি যে রাবণ আপনাকে কিভাবে যন্ত্রনা প্রদান করেই যাচ্ছে। মাতঃ ! আমি সত্যি বলছি আমি ভগবান শ্রীরামের দূত। মা আপনিই তো প্রভু শ্রীরামকে সঙ্কেত দেবার জন্য ঋষমূক পর্বতে আপনার অলঙ্কারাদি নিক্ষেপ করেছিলেন। আমরা সেই গুলো পেয়ে প্রভুকে দেখিয়েছি। প্রভু আমাকে তাঁর অঙ্গুলির অঙ্গুষ্ঠ প্রদান করে দূত রূপে এখানে প্রেরন করছেন।”

এই বলে হনুমান প্রভুর অঙ্গুরীয় মাতা সীতাকে প্রদান করলো। মাতা সীতা অঙ্গুরীয় দেখে নিলো। অঙ্গুরীয়তে “রাম” নাম লেখা। এই অঙ্গুরীয় তাঁর চেনা । ভগবান শ্রীরামের পদ্মাভ হস্তের আঙ্গুলে শোভা পেতো এই অঙ্গুরীয় । এই অঙ্গুরীয় স্বয়ং ভগবান শ্রীরামের। তবে ঠিক স্বামী, এই কপিকে প্রেরন করেছে । সীতা বলল- “বতস্য! তুমি সত্যই বলেছো । এই অঙ্গুরীয় আমার স্বামীর। আমাকে ক্ষমা করো পুত্র। রাবণের এই পাপ রাজ্যে কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। সেই মায়াবী মায়া দ্বারা সব করতে পারে। সেই পাপীর মৃত্যু হলে ত্রিলোকে শান্তি নেমে আসবে। কেন যে আমি সেদিন স্বামীকে মৃগ ধরে আনতে বলেছিলাম, কেনই বা দেবর লক্ষ্মণকে আকথা- কুকথা বলে বনে প্রেরন করেছিলাম, কেনই যে লক্ষণের রচিত গণ্ডী অতিক্রম করে সেই পাপীষ্ঠিকে ভিক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। সব আমার জেদের ফল। এই পাপী রাবণের মনে দয়া মায়া বিন্দুমাত্র নেই। সে সব পারে। এই রাক্ষসেরা সব রকম পাপকর্মে সিদ্ধহস্ত। তবে রাবণ প্রভু শ্রীরামের বীররূপ দেখেনি। যেদিন দেখবে সেইদিন তার অহঙ্কার মাটিতে মিশবে। তুমি বল হনুমান আমার স্বামী আমার দেবর সকলে কেমন আছে?” হনুমান তখন শ্রীরামের শোকার্ত অবস্থা বর্ণনা করে বললেন- “মাতঃ! রাবণের ধ্বংসের আয়োজন তিনি করেছেন । বানর রাজ বালিকে বধ করে , তাঁর ভ্রাতা সুগ্রীবকে বানর জাতির রাজা বানিয়েছেন। সুগ্রীব সকল বানর সেনা সমেত প্রভুর সাথে আছেন । প্রভু আপনার বিহনে খুবুই শোকগ্রস্ত । আমরা বানরেরা আপনার খোঁজে গোটা ধরিত্রী ভ্রমণ করেছি। জটায়ুর ভ্রাতা সম্পাতি আমাদের আপনার খোঁজ দিয়েছেন।” এই বলে হনুমান সকল ঘটনা সকল বলল। মাতা সীতা ভগবান শ্রীরামের শোকার্ত কথা শুনে রোদন করলেন। আহা প্রভু তাঁকে এত ভালোবাসেন । তারপর বললেন- “হনুমান! তুমি ওঁনাকে বলবে শোক ত্যাগ করে কঠোর হতে। এই রাক্ষসদের বিনাশের সময় এসেছে। তাঁর হস্তেই এদের মৃত্যু লিখিত আছে। তুমি তো দেখলে রাবণ আমাকে মাত্র দুমাসের সময় দিয়েছে। যা করার ওঁনাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। এই রাবণ এত নিষ্ঠুর সে আমাকে ফিরিয়ে কদাপি দেবে না। এর নাশ হওয়াই মঙ্গল।”

হনুমান বলল- “মাতঃ! আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা বানর সেনা তৈরী হচ্ছি। যুদ্ধের সময় রাবণ টের পাবে আমরা কত শক্তিশালী। এই সকল রাক্ষসদের আয়ুস্কাল পূর্ণ হয়েছে। তাই এদের অত্যাধিক আস্ফালন হয়েছে। প্রদীপ নির্বাপণের আগে তা একটু বেশীভাবে জ্বলে ওঠে। এদের জীবন শেষ সীমায় এসেছে। মাতাঃ আপনি চাইলে আমার স্কন্ধে আরোহণ করুন। এখুনি আপনাকে আমি সমুদ্র পারে প্রভুর কাছে নিয়ে যাবো।” সীতা গুর গম্ভীর হয়ে বলল- “এ হয় না পুত্রঃ। আমি অযোধ্যার কুলবধূ তথা বীর যোদ্ধা শ্রীরামের পত্নী। আমি জনক রাজার দুহিতা। আমি ক্ষত্রিয়া নারী। এভাবে আমি পলায়ন করতে পারি না। এতে আমার স্বামী, শ্বশুর কুল, পিতৃকূলের নামে অপযশ ও অখ্যাতি রটবে। হয় রাবণ নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাকে আমার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইবে- নচেৎ আমার স্বামী যেনো রাবণকে বধ করে আমাকে নিয়ে যান। আমি রাবণের ন্যায় ছলাকলার আশ্রয় নেবো না। তাহলে বীর আর প্রবঞ্চকের মধ্যে কি তফাৎ থাকে?” এইভাবে হনুমান আর মাতা সীতার কথাবার্তা হল। মা সীতা মস্তকের সুশোভিত একটি মণি হনুমানকে দিয়ে বললেন- “পুত্র! তুমি এটি আমার স্বামীর হস্তে দেবে। আবার দুরাবস্থার কথা সকল বলবে। লক্ষ্মণের কাছে আমার ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলবে। আমার স্বামীকে বলবে দুমাস কেবল সময় আছে। এরপর রাবণ আমাকে হত্যা করবে। এরই মধ্যে তিনি যেনো লঙ্কা বিজয় সম্পন্ন করেন। আমি প্রতীক্ষায় আছি। আজ থেকে আমার দিন গোনা শুরু।” হনুমান তখন সম্মত হল। হনুমান চারপাশে অনেক মিষ্ট ফলের গাছ দেখতে পেয়ে বলল- “মাতঃ! লঙ্কায় আসবার পর আমার উদরে বিন্দুমাত্র ভোজন পৌছায়নি। আপনি আদেশ দিলে আমি এই সকল ফলমূল গ্রাস করবো।” মাতা সীতা বললেন – “অবশ্যই পুত্র! পেট ভরে ফল খেয়ে ঝিলের মিষ্ট জল পান করো। আর ফিরে যাবার আগে একবার আমার সাথে সাক্ষাৎ করে যেয়ো।” হনুমান ভাবলো ফল খাবার ছলে রাবণকে একবার দেখানো যাক যে রামভক্তের শক্তি কত!

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।