হনুমান উড়ে চলছেন । সমুদ্রের নীল জলরাশির ওপর দিয়ে । নীচে কেবল বিশাল তরঙ্গ। অগাধ জলরাশির নীচে তল অবধি দেখা যায় না। মেঘের রাজ্য ভেদ করে পবন নন্দন মারুতি প্রবল বেগে উড়ছেন। তাঁর “জয় শ্রী রাম” ধ্বনিতে চতুর্দিক ধ্বনিত হচ্ছিল্ল। হনুমানের বিক্রম দেখে দেবতারাও খুশী হলেন । সেই জলে সিংহিকা নামক এক রাক্ষসী থাকতো। ভয়ানক চেহারার সেই রাক্ষসীর মস্তকটা একটি বিশাল পর্বতের চূড়ার ন্যায় ছিলো। সেই মস্তকে মুখটি ছিলো অন্ধকার মৃত্যুগুহার ন্যায় । মায়াবিদ্যার পারঙ্গদা রাক্ষসীর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো। আকাশ দিয়ে যখন কোন প্রানী যেতো তখন সে তার ছায়া আকর্ষণ করে টেনে এনে গ্রাস করতো। কেউ তার থেকে রেহাই পেতো না। রাক্ষসী সমুদ্র তল থেকেই হনুমানকে দেখতে পেলো। মনে মনে ভাবল- “আজ অনেক হৃষ্টপুষ্ট বানর পেয়েছি। একে ভক্ষণ করে আমার উদর তৃপ্ত করবো।” প্রচণ্ড খুশী হয়ে সিংহিকারাক্ষসী হনুমানের ছায়া ধরে আকর্ষণ করতে লাগলো। হনুমান আকাশে উড়ছিলো। হঠাত মনে হল অগাধ জলরাশি যেনো তাকে টেনে নীচে নামাতে চাইছে । শত চেষ্টা করেও এই আকর্ষণ উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। একি আকর্ষণ! সমুদ্রে এমন আকর্ষণ হয় নাকি! হনুমানকে টেনে নামালো রাক্ষসী । হনুমান দেখলো তাঁর সামনে সমুদ্র থেকে এক রাক্ষসী মস্তক বের করেছে। ভয়ানক গহ্বর স্বরূপ নয়ন থেকে মনে হয় জ্বালামুখী নির্গত হচ্ছে। জ্বালামুখী যেরূপ পর্বতের গহ্বর থেকে নিস্কাশিত হয়- সেই রূপ অগ্নিযুক্ত চোখ তার। নাসিকা সুউচ্চ পর্বতের ন্যায়। দন্তসাড়ি তরোয়ালের ফলার ন্যায় । মুখ গুহার ন্যায় । রাক্ষসী ক্রমাগত আকর্ষণ করে হনুমানকে গিলবার চেষ্টা করছে । ঝড়ের মতো বায়ু যেনো হনুমানকে রাক্ষসীর গুহার ন্যায় মুখে টেনে আনতে চাইছে । হনুমান রাক্ষসীকে অনেক সাবধান করলো। রাক্ষসী না মেনে হনুমানকে গ্রাস করলো ।
রাক্ষসীর শ্বাসনালী তে জমাট অন্ধকার দেখতে পেলো হনুমান । যেনো অন্ধকার পর্বত গুহা। হনুমান রামনাম করে হাতের নখ দিয়ে রাক্ষসীর বুক ছিন্নভিন্ন করে বের হল। প্রচণ্ড গর্জন করে রাক্ষসী সমুদ্রে পড়তে যেনো বিশাল প্লাবন কয়েক যোজন ছড়িয়ে পড়লো। বিশাল স্রোতের আকারে রাক্ষসীর বুক থেকে রক্ত মাংস বের হল। সমুদ্রের জল বিশাল এলাকা জুড়ে রক্তবর্ণে পরিণত হল। হাঙর, মকড়েরা পেট ভরে রাক্ষসীর মাংস ভক্ষণ করতে লাগলো । হনুমান আবার উড়ে চলল। রাক্ষসীর অন্ত হয়েছে দেখে অন্তরীক্ষে দেবতারা হনুমানের স্তব স্তুতি ও প্রশংসা করতে লাগলো । সিংহিকারাক্ষসীর প্রান নিয়ে হনুমান এগিয়ে চলল। একসময় দেখতে পেলো লঙ্কার চূড়া । সূর্যের আলোক পড়ে এমন জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে যেনো সেদিকে তাকানো যায় না। এত দূর থেকেই সোনার লঙ্কার দ্যুতি দেখা যাচ্ছে । রাবণের রাজমহলের চূড়া থেকে যেনো আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল্ল। সোনা দিয়ে তৈরী এই লঙ্কাপুরী । আরোও এগিয়ে যেতেই লঙ্কার অনান্য প্রাসাদ গুলি দেখা যেতে লাগলো। সেখানে থেকে সোনা- হীরা- মুক্তার আলোর প্রতিফলন দেখে মনে হচ্ছিল্ল আকাশের নক্ষত্র সকল ঐ নগরীতেই অবস্থান করছে । আরোও কাছাকাছি যেতে লঙ্কার রাজ্যের দুর্গ দেখা গেলো । দুর্গের বাইরে বিশাল জলের পরিখা তে হাঙর, কুম্ভীর ইত্যাদি প্রানী বিচরণ করছে । লঙ্কার স্তম্ভ দেখতে পেলো। রাবণের বিজয় নিশান- রাক্ষস জাতির মহিষ চিহ্নিত পতাকা পতপত করে উড়ছে । লঙ্কার সন্নিকটে ধীরে ধীরে আসতে লাগলো হনুমান। যতদূর চোখ যাচ্ছে কেবল স্বর্ণের দ্যুতি ভিন্ন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বোধ হয় স্বর্গেও এত শোভা নেই । আর দেখতে পেলো বিকট চেহারার রাক্ষস রাক্ষসীরা অস্ত্র উচিয়ে পাহারা দিচ্ছে। এই নগরীতে মানুষ থাকে না- মানুষ খেকো রাক্ষসেরা থাকে । সুরক্ষিত একটি জায়গা দেখে হনুমান নীচে অবতরণ করলো । নামবার সাথে সাথে একজন দেবী ধেয়ে এলো। তিনি নরকঙ্কালের মালা শোভিতা, কৃষ্ণা বর্ণা, লোল জিহ্বা, করালিনী চেহারা, আলুথালু কেশ, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, খড়গ- পাশ- খর্পর- শূল ধারিনী । হনুমান প্রনাম করে বলল- “হে দেবী! আপনি কে?” তারপর হনুমান বুঝলো ইনি কে ।
হনুমান দেবীর স্তব করে বললেন-
দেখিয়া চিন্তিত অতি বীর হনুমান ।
জোড়হাতে বলেন দেবীর বিদ্যমান ।।
শাস্ত্রে শুনিয়াছি আমি চামুণ্ডার কথা ।
শিবের প্রেয়সী তুমি, কেন আছ হেথা ।।
তোমারে দেখিয়া আমি বড় পাই ডর ।
কি কারনে আছ মাতা লঙ্কার ভিতর ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
চামুণ্ডা দেবী বলছেন-“ বতস্য তুমি কে? আমি শিবের শক্তি চামুণ্ডা। তাঁর আদেশে লঙ্কা প্রহরা দিচ্ছি। ভগবান শিব বলেছেন- যবে ভগবান বিষ্ণু ‘রাম’ অবতার নিয়ে বনে আসবেন, তখন তাঁর পত্নীকে রাবণ হরণ করবে। রামচন্দ্রের দূত হয়ে হনুমান লঙ্কায় যখন আসবে তখন আমি কৈলাসে ফিরে যেতে পারবো। ভগবান শিব এও বলেছেন যবে হনুমান লঙ্কায় আসবে- বুঝবে লঙ্কার পতনের খুব বিলম্ব আর নেই। ” হনুমান বলল- “মাতঃ! আমি প্রভু শ্রীরামের সেবক তথা দূত হনুমান। এবার মা আপনি কৈলাসে ফিরে যান। বুঝেছি মা আপনি এতদিন এই পাপ রাজ্যে অনিচ্ছা সর্তেও অবস্থান করছিলেন। কিন্তু মাতঃ আপনি বা ভগবান শিব কেন সেই পাপী রাবণকে এত কৃপা করেন?” চামুণ্ডা দেবী বললেন- “পুত্র হনুমান! তপস্যা করলে ফল প্রদান অবশ্যই করতে হয়। সে যেই হোক। সেই কারণে প্রজাপতি ব্রহ্মা অসুরদের এত ভয়ানক বর প্রদান করেন। হনুমান! অতি দুরাচারী ব্যাক্তিও যদি সকল শাস্ত্র অধ্যয়ন করে তবে সে পণ্ডিত হয়, কিন্তু তাঁর জন্য দেবী সরস্বতীকে দোষ প্রদান করা যায় না। এই সৃষ্টি সেই নিয়মে পরিচালিত হয়। তবে ভক্ত যদি পাপে লিপ্ত হয় তবে ভগবান তাঁকে শেষ সময়ে কোন সহায়তা করেন না । রাবনের পাপের ঘরা পূর্ণ হয়েছে, এবার সেই ঘরা ভঙ্গ হবে। আমি বা ভগবান শিব কেউ আর তাকে সহায়তা করবো না। বতস্য হনুমান তোমায় আশীর্বাদ করি, তুমি তোমার কাজে সফল হও, লঙ্কার বিনাশ হোক – আমি এই কামনাই করি।” এই বলে চামুণ্ডা দেবী অদৃশ্য হয়ে কৈলাসে চলে গেলেন।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন